কুর্দিস্তানি কবি শেরকো বিকাস’র যুদ্ধের ভয়াবহতার কবিতা
কুর্দিস্তানি কবি শেরকো বিকাস’র যুদ্ধের ভয়াবহতার কবিতা
ভূমিকা ও বাঙলায়ন: মীম মিজান
শেরকো বিকাস একজন কুর্দিস্তানি নির্বাসিত কবি ও স্বাধীনতাকামী নেতা। তিনি ইরাকের কুর্দিস্তানে ১৯৪০ সালের ২রা মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফায়েক বিকাস ছিলেন কুর্দিস্তানি প্রখ্যাত কবি ও স্বাধীনতাকামী মানস। মাত্র ১৭ বছর বয়সে শেরকো’র কাব্য প্রকাশ হয়েছিল। তিনি কুর্দিস্তান মুক্তি আন্দোলনের রেডিও ‘দ্য ভয়েস অব কুর্দিস্তান’ এ কর্মরত ছিলেন। তাকে কুর্দিস্তান থেকে একাধিকবার নির্বাসিত হতে হয়েছিল ইরাকি সরকারের চাপে। বিশটির অধিক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। ‘দিওয়ানে শেরকো’ নামে তার কাব্য সংকলন দু’খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে। তিনি ১৯৮৭ সালে স্টকহোমের পেন ক্লাবের পক্ষথেকে ‘তুচোলস্কি স্কলারশিপ’ এবং ‘ফ্লোরেন্স সিটি স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত হন। তার কবিতা আরবি, সুইডিশ, ড্যানিশ, ডাচ, ইতালিয়ান, ফরাসি, ইংরেজিসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি সারাবিশ্বের কাছে মুক্তিকামী জনতার প্রতীক, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, জালিমের শোষণের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ হিশেবে পরিচিত। শেরকো সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকাকালীন ৪ আগস্ট ২০১৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শেরকো’র নিম্নোক্ত কবিতাটি ‘ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম’ থেকে চয়িত হয়েছে। কুর্দিশ থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ চাওছাওয়া ও এ. এম. ল্যাভিন্সন-লা ব্রোজ।
রোজার স্বাস্থ্যগত উপকার
রোজার স্বাস্থ্যগত উপকার
আহাদ আদনান
‘আর যদি রোজা রাখ, তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা অনুধাবন কর’। আল্লাহতায়ালা তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে যে ইবাদতটি আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন, সেটা কত যে বিশাল বরকতময় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর পাশাপাশি রোজা আমাদের জন্য যে উপকার নিয়ে আসে, সচেতন মুসলমান মাত্রেরই সেগুলো জেনে রাখা ভাল।
রোজার যাবতীয় উপকারগুলো মোটামোটি ৪ভাগে ভাগ করা যায়। শারীরিক, মানসিক, আবেগিয় এবং আধ্যাত্মিক।
১। শারীরিক উপকার চিন্তা করতে গেলে প্রথমে ভাবতে হয় পাকস্থলীর বিশ্রাম। পাকস্থলী, তথা সমগ্র পুষ্টিতন্ত্র আমাদের লাগামছাড়া পানাহারে ১১ টি মাস ব্যতিব্যস্ত থাকে। টানা ১ টি মাস সারা দিন পানাহারে বিরত থাকতে হয় বলে অঙ্গগুলো পায় বিশ্রাম। স্বাভাবিক অম্লতা বজায়, বিপাক ক্রিয়া সচল রাখতে পুরো বছরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহনের মাস হচ্ছে এই রমাদান।
২। একটি নিয়মের মধ্যে থেকে যেহেতু আমরা পানাহার থেকে বিরত থাকি, এর ফলে দেহের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন পদার্থ এই রোজায় নিষ্ক্রিয় হয়ে বের হয়ে যায়। শরীর হয় পরিশুদ্ধ। তবে শর্ত হচ্ছে, ইফতার এবং সাহরিতেও সংযমের পরিচয় দিতে হবে। খেতে হবে ভাজা পোড়া মুক্ত, বিশুদ্ধ খাবার।
৩। জেনে অবাক হবেন, দেহের শক্তির ৬৫-৭০% খরচা হয়ে যায় খাদ্য পরিপাক ও বিপাক ক্রিয়ায়। এই রোজাতে শক্তিগুলো বেঁচে যায়। এটা পরে কাজ করে দেহের বিভিন্ন কোষ, কলার ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্গঠনে। দেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ নিস্কাসনে।
৪। রোজায় শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে। ক্ষতিকর চর্বি পুড়ে দেহ হয়ে ওঠে ঝরঝরে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর অসুখ, পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাধি থাকে নিয়ন্ত্রণে।
৫। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালার্জি, ব্রণ, অনিদ্রা, দুশ্চিন্তা জনিত অসুখ, হাঁপানি, দীর্ঘ দিনের হাড় ও গিঁটের ব্যথা, বিভিন্ন জটিল চর্মরোগ (সোরিয়াসিস,একজিমা ), মাইগ্রেন এসব রোগ থেকে বেঁচে থাকতে রোজা অশেষ উপকার করে। (ৎবভ. ধষষধনড়ঁঃভধংঃরহম.পড়স)
৬। যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোজাদারদের মানসিক একাগ্রতা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে মস্তিষ্কে এক ধরনের নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর বাড়িয়ে দেয়। যাতে মস্তিষ্কে কোষ বাড়ে, একইসাথে বাড়ে কর্মদক্ষতা।
৭। বেপরোয়া জীবনে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনি দেখা যায় ওজন কমাতে ‘ডায়েটে’র হিড়িক। ভুল ‘ডায়েট’ করে অনেকে স্বাস্থ্য নষ্টও করে ফেলে। একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত, বৈজ্ঞানিকভাবে ওজন কমাতে রোজাই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।
এই উপকার গুলো ছাড়াও রোজাদারের মন থাকে প্রশান্ত, ইবাদতে বাড়ে একাত্মতা। একজন সঠিক ভাবে রোজা রেখে আবেগকে রাখতে পারেন নিয়ন্ত্রিত। হয়ে উঠতে পারেন সত্যিকারের মুসলিম, আদর্শ মানুষ। আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তো আমাদের কল্পনারই বাইরে। স্বয়ং আল্লাহ যখন রোজাদারের প্রতিদান হবেন, আর কি চাওয়ার থাকে।
মুখোশের ফাঁকে...
মুখোশের ফাঁকে
শফিক নহোর
বেলা রানী আমাদের গ্রামের মেয়ে। ও ছিল আমার শৈশবের খেলার সাথী। আমি আর বেলা কামারহাট সরকারি স্কুলে এক সাথেই পড়তাম। বেলা রানী জেলে পাড়ার মেয়ে। এজন্য তাকে কেউ পছন্দ করতো না। উঁচু জাতের ছেলেমেয়ের সাথে ওর খেলাধুলাকে গ্রামের কেউ কেউ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতো।
তখন গ্রামে জগো পাগলি নামে একটা মেয়ে ছিল। আমরা তাঁকে পেছন থেকে ঢিল ছুঁড়ে মারতাম। ঢিল দিয়ে হুট করে খেজুর গাছের আড়ালে লুকিয়ে যেতাম। ঢিল খেয়ে জগো পাগলি পেছনে ফিরে দেখতো কেউ নেই।
জগো পাগলি মনের সুখে গান গাইতো। ধুলোপড়া রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেত নদীর পাড়ে। পায়ের তলায় কোনোকিছু পড়লে রাস্তায় ফেলে রাখতো না। অথচ এই জগো পাগলির উপর অমানবিক অত্যাচার চলতো। সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরতো। বিকেল হলে খেলার মাঠেও ঘুরে বেড়াতো। কখনো কখনো একাএকাই উঁচুস্বরে হেসে উঠতো। কিন্তু খানিকপরেই চোখের দিকে তাকালে দেখতাম, পাগলির দু’চোখের ধারা মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে । মাঝেমধ্যেই নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে টেনে ছিঁড়তো। তখন বিড়বিড় করে কী যেন বলতো। কথাগুলো সহজে বুঝা যেত না। কাজ একটু কম করলে পাতে খাবারও কম উঠতো। ঘানি টানার গরু থাকা সত্বেও তাকে দিয়েই ঘানি টানায়ে নিত আলতাব শেখের স্ত্রী । জগো পাগলী ক্ষণেক্ষণে হেসে উঠতো, কখনো চোখের জল গড়িয়ে পড়তো। জগো পাগলীর আরেকটা কষ্ট ছিল- রাতের আকাশের মতো একাকী চাঁদকে পাহারা দেওয়া। পাখিডাকা ভোরে কুয়ো থেকে পানি তুলে আনতে হত। রান্নাঘর থেকে শুরু করে গোয়ালঘর পর্যন্ত দরকারি পানির যোগান দিতে হতো। ঘরে প্রয়োজনীয় খাবার ছিল না। কোনো কোনোদিন সকালে বা দুপুরে না খেয়ে থাকতে হতো। পাতিলপোড়া ভাত, মাছছাড়া তরকারি ছিল প্রায় প্রতিদিনের রাতের খাবার। অনেকেই বলতো ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে পাগলিটাকে কেউ মেরে ফেললেই ভালো হতো। এতটা কষ্টের কিছুই টের পেতে না!
নিয়মিতই সংসারের ঘানি টানছে জগো পাগলি। মানুষ পরের দুঃখ দেখে শুধু হাহুতাশ করে, কাজের কাজ কিছুই করতে পারে না। মুখে শুধুই ফাঁকাবুলি আর রঙবেরঙের কথা! এরা কুটনি বুড়ির মতোই সবার কাছে প্রিয়। এরা আসলে দুমুখো সাপ।
কুয়োর জলে জগো পাগলি দড়িবাঁধা কলস ফেললে জলের ভেতরে দুটো মুখ চাঁদের মতো হেসে উঠতো। জল ভর্তি কলস উঠানোর সময় কিছু জল ছলাৎ ছলাৎ করে নিচে পড়তো। তখন মনে হতো জাগো পাগলির চোখের জল কুয়োর পানিতে গড়িয়ে পড়ছে। জগো পাগলি একটা সময় ঘানি টানতে পারতো না। অভাবের সংসার। সৎ মা রাতে আধাথালা খাবার দিতো। যে কারণে কিছুদিন পরেই কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছিল। শরীরের হাড়হাড্ডি গোণা যেত। গলার হাড়ও বেড়িয়ে পড়েছিল। তারপরও সৎমা জোর করে ঘানির জোয়াল কাঁধে তুলে দিতো।
দুই চক্কর দেবার পরেই জগো পাগলি কেঁদে কেঁদে বলতো, মা গো, আমি আর পারছি না। আমারে তুমি মেরে ফেল।
হারামজাদি সংসারে খাবি, আর ঘানি টানবি না?
মরলে তো শান্তি পেতাম। মরতে পারিস না পোড়ামুখী।
মা আমারে একটু পানি দাও।
মরে গেলে খাস। এখন পানি খেয়ে কী তোর পরাণ ভরবে? আমার সংসারে তুই হয়েছিস কাল! মরলে তো আরাম আয়েশ করে খেতে পারতাম!
যখন জাগো পাগলি আর ঘানি টানতে না পারতো, তখন শরীরে খেজুরকাঁটার খোঁচা দিয়ে বলতো, হারামজাদী, ঘানি টানবি না, বল টানবি না? মুখে কথা নাই কেন?
তখন সে অশ্রুসাগরে নীরবে সাঁতার কাটতো, আর বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ঘানি টানতো।
মা, আমি ঘানি টানবো।
জাগো এসব ঘটনা ওর বাবাকে বলতো না। কারণ, জাগোর বাবা এতকিছু জানলে ভীষণ রেগে যাবে। তাছাড়া ও চায় না, ওর বাবা যেন কষ্ট পাক। শুধু বলতো, মা, বাবায় জানি না বুঝে, তুমি আমারে এইভাবে মারছো।
একথা শুনে সৎমায়ের চোখ মুহূর্তেই রক্তলাল। নির্মমতায় মায়ের হৃদয় যেন শুকিয়ে মরুভূমি হতে লাগলো।
জগো পাগলি সবকিছু বুঝতে পারতো। কথা বলতে গেলে স্পষ্ট করে বলতে পারতো না, মুখে জড়িয়ে যেত। বাড়ির ভেতরে সৎ মায়ের অত্যাচার, বাইরে মানুষ ঢিল। কেউ কেউ পোদ্দার বাড়ির জঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইতো। ওরা যেন মানুষ নয়, মানুষখেকো বাঘ। অথচ সেই পোদ্দার বাড়ির জঙ্গলে রান্নার জন্য গাছের ঝরেপড়া পাতা কুড়াতে যেতে হত। জগো পাগলির কুড়ানো পাতায় তিনবেলার রান্না হত। তার খাবার ছিল শুধুমাত্র রাতে!
মনের ভেতরে শেয়াল-কুকুরের কোনো ভয় ছিল না। তবে পুরুষ মানুষ দেখলে ভয়ে পিলে চমকে যেত। এইতো মানুষ খাওয়া রাক্ষস।’
জগো পাগলির বাবা ছিল আলাভোলা মানুষ। বউ তাকে শাড়ির আঁচলেই প্যাঁচিয়ে রাখতো। মেয়ে লতার মতো বড় হয়েছে, সে খেয়াল আলতাব শেখের নেই। ভোরবেলা তৈলের ঘটি নিয়ে গাঁওয়ালে বের হত, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো। বাড়ি ফিরে কুয়ো থেকে পানি তুলে গোসল করতো। গোসলের আগে সারা গায়ে সরিষার তৈল মেখে নিতো।
একদিন চাদিতে হালকা তৈল মেখে গায়ে পানি ঢালতে ঢালতেই জগোকে বললো,
তোর মায়েরে ক, আমার জন্যি ভাত বাড়তে। খিদায় মনেহচ্ছে পুরা দুনিয়া চাবায়া খাই।
“বাজান, তোমার তবন আর গামছা নিয়ে আইতাছি” বলেই জগো কেমন জানি গুঙানি দিয়ে উঠলো। মুখ বেয়ে লালা পড়তে লাগলো! হুট করে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো সে।
আলতাব শেখ বউকে ডাক দিয়ে বললো, “শুনছো নাকি ? জগো মাটিতে পইড়া গেছে ওরে ঘরে নেও।”
মাগি বাপরে দেখলে আহ্লাদ দেখায়। শোন, তোমার মেয়ে তিনবেলা বইসা বইসা খাইবো। সংসারের চারআনার কাম তো দূরের কথা ভাতে জ্বাল দিতেও চায় না। অহন ঢঙ দেখায়া মাটিতে পইড়া গেল!
তোমারে বুঝাইতে চায়, আমি সৎ মা। ঠিক মতো খাওন দেই না। মাইনশে দেইখ্যা আমারে আর তোমারে মন্দ বলুক। মাইয়া নাতো, দুধকলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি!
তুমি অর বাপ, তাই বুঝো না। আমি ঠিকই বুঝি।
আলতাব শেখ গোসল করে তবন উঠোনের তারে ছড়িয়ে দিয়ে ঘরের বারান্দায় গিয়ে বললো,
মা মরা মেয়ে। ওরে একটু দেইখ্যা রাইখো, বউ।
আমি তোমার সংসার দেখবো, না ঘানি টাইনে তেল বাইর করবু। তেল যুদি না হয় গাঁওয়ালে গিয়ে কি বেচবা? বেচা না থাকলে কী খাইবা? মেয়ের চেহারা ধুইয়া পানি খাইলে কি সংসার চলবো? তোমার সংসারে আমিই বেশি! আমারে আমার বাপের বাড়ি পাঠায়া দেও।
শোনো, আমার বাবার বাড়ি কোনো কিছুর অভাব নাই।
‘আমারে আর জগো রে খাইতে দাও।’
তোমার মাইয়া খায়াও ভান ধরছে।
তুমি খায়া নেও।
মাগির শরীর ভর্তি তেজ।
রাতের অন্ধকার যতো গভীর হয় জগোর পেটের ক্ষুধা ততোই বাড়তে থাকে। ওর শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে পাতিল থেকে এক থালা ভাত নিয়ে পিঁড়ি পেতে বসেছে। মুখে এক নলা ভাত দিতেই সৎমায়ের চোখ ভাতের থালায় পড়ল।
মুখচেপে বাইরে নিয়ে এলো সৎমা। রাতের অন্ধকারে কুয়ার ভেতর ফেলে দিল! বেঁচে থাকার আকুতিতে মায়ের হাত চেপে ধরলো। কিন্তু সৎমায়ের কাছে ওটা ছিল মিথ্যে বাহানা। ওর চোখে ছিল সমস্ত পৃথিবীর আবেগ। মাটির কলসি ধরে সারারাত বেঁচেছিল জগো।
ভোররাতে আলতাপ শেখ কুয়ো থেকে পানি তুলতে গেলে কলসির সাথে ফ্যাঁকাসে জগোও ওঠে আসে। তখন আলতাব শেখ চিৎকার করে বলে, মায়ের শোক সইতে পারলি না রে মা। শেষ পর্যন্ত কুয়ায় ডুইবা মরলি...
আমি কি তোর ভালা বাসতাম না রে জগো...
চিৎকার শুনে বাড়ির পাশের লোকজন এসে ভিড় করতে লাগলো।
মানুষের মুখে মায়ের মুখোশ থাকলে কাছের মানুষও কিছুই বুঝতে পারে না।
সংসারে নিজেকেই জায়গা করে নিতে হয়। তা নাহলে উদার মানুষগুলো শুধুই আলতাপ শেখের স্ত্রীদের মতো মানুষের অনৈতিক আচরণের শিকার হতে হয়।
এদিকে জেলেপাড়ার মেয়ে বলে বেলা রানী শৈশবে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছিল সমস্ত রকম রঙিন দিন। জীবনে বেড়ে উঠার জন্য কেউ কখনই সুযোগ দেয়নি। আঘাত করেছে, ভুল ধরেছে। সন্ধ্যায় কানছি কোণায় গেলে কেউ লুকিয়ে থাকতো, পায়খানায় ঢিল ছুঁড়ে মারতো। বেলা রানী সহজে সমাজের কারোর কাছে হেরে যায়নি।
অনেকগুলো রাক্ষুসে হাত এগিয়ে আসতো রাতের আঁধারে। বেলা রানীর পরিবার সঙ্গ দিত, সাহস দিত এগিয়ে যাবার। শেষ পর্যন্ত বেলা রানীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল নিকষ-কালো অন্ধকার রাতে। তার গায়ের ঘ্রাণেই আমি বুঝেছিলাম সে-ই বেলা রানী।
অনাদির বসন্তকাল
অনাদির বসন্তকাল
মোস্তাফিজুল হক
বিধবা সালেহা বেগম ছেলের সংসারে সুখেই আছেন। তবু তাঁর প্রায় দেড়যুগ আগের কথা মনে পড়ে যায়। তখন অনাদি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। একদিন মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরেই বলতে লাগলো-
“মা, আর শীত ভালো লাগে না। স্যার বলেছেন, সবচেয়ে মজার ঋতু বসন্ত। এ কারণেই নাকি বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়।”
অনাদি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “মা, বসন্তকাল কবে আসবে?”
মা জবাবে বলতেন, “এই তো আর ক’দিন পরেই বসন্ত আসবে। দেখছিস না, প্রকৃতি নতুন পত্রপল্লবে সেজে উঠছে। শীত তার হিমেল বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়ানো বন্ধ করেছে প্রায়।”
“মা, বসন্তে কি শীত একেবারেই চলে যায়?”- অনাদি জানতে চায়।
ওর মা জবাবে বলে, “শীত চলে গেলেও হিমেল বায়ু প্রবল ধাক্কা দিয়ে মাঝে মাঝে গায়ে কাঁপন তোলে। দুপুরের রোদ বেশ উত্তাপও বিলিয়ে দেয়। ঝলমলে বসন্ত আরো দুই সপ্তাহ পরে শুরু হবে, মা। আর এজন্যই সূর্যের আলো শীত থেকে মুক্তি পেতে ধীরে ধীরে তেজী হয়ে উঠছে।”
“মা, শীতটা যে কবে যাবে, একদম ভাল্লাগে না! বিছানা ছেড়ে উঠতেই মন চায় না। গোসল করতে ইচ্ছে করে না, খেতেও ভালো লাগে না।”
“হ্যাঁ মামণি, ঠিকই বলেছিস। এইতো শীত ফুরোলো বলে অলসতা কাটিয়ে মানুষ কাজের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠছে আর বিছানা ছেড়ে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। অপরূপ মৌসুমী ফুল আর ফলের ঘ্রাণে বসন্ত যে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত!”
“মা, বসন্তে কী কী ফুল ফোটে?”
“বসন্তে শিমুল, পলাশ, রুদ্রপলাশ, ভাঁটফুল, পলকজুঁই, মাদার, মহুয়া, অশোক, আকড়কাঁটা, শাল, ক্যামেলিয়া, স্বর্ণশিমুল, হিমঝুরি, গামারি, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, ঘোড়ানিম, মণিমালা, মহুয়া, বাতাবিসহ কত কি ফুল ফোটে! আম, লিচু, জামের মুকুলে ছেয়ে যায় গাছপালা।”- অনাদির মা মেয়ের প্রশ্নের জবাবে একদমে এতগুলো ফুলের নাম বলে দিলেন।
আজ ক’দিন থেকেই মেয়েটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কথাবার্তা বলছে।
ঋতুরাজ বসন্ত দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রকৃতি এখন ফুলের রাজ্য, ভরা বসন্ত মৌসুম। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু ফুল আর ফুল। অনাদি সময় পেলেই ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে। শিমুল বনে মনের সুখে নেচে বেড়ায়। বাড়ির আঙিনায় চিরসবুজ লম্বাটে পাতার চাঁপাগাছ। চাঁপাতলায় বসে পুতুল খেলে। বর ও কনের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে সামান্য ফাঁকে সূর্যমুখী ফুলের খেতে প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়ায়।
পদাবলি : ০১
কোনো একদিন
সাদ্দাম মোহাম্মদ
কোনো একদিন এভাবেই সংক্রামক হয়ে উঠবে ভালোবাসা,
কোনো একদিন এভাবেই সংক্রামক হয়ে উঠবে উন্নত চরিত্র,
কোনো একদিন এভাবেই সংক্রামক হয়ে উঠবে মানবতাবোধ,
কোনো একদিন এভাবেই সংক্রামক হয়ে উঠবে দেশপ্রেম,
কোনো একদিন থেমে যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাট,
কোনো একদিন নীচু হবে মানুষের মুখোশে ঢেকে থাকা অমানুষগুলো,
কোনো একদিন শুদ্ধতায় ছেয়ে যাবে ধরণী;
কোনো একদিন.. .
ছিলো
শাহীন খান
একদিন এ গ্রাম ছিলো শোন আমাদের
ছায়া মাখা ঘর ছিলো প্রিয় মামাদের।
বুক ভরা আশা ছিল, অনাবিল ভাষা ছিলো
সবুজের ছোঁয়া ছিল, মায়েরই দোয়া ছিলো
সাম্যপ্রীতি ছিলো, সুখেরই গীতি ছিলো
টলমলে জল ছিলো, কতো কোলাহল ছিলো
পড়শির টান ছিলো, মান অভিমান ছিলো
পাখিদের গান ছিলো, মায়া ভরা প্রাণ ছিলো
হাসি ছিলো বাঁশি ছিলো, দীদা ছিলো মাসি ছিলো
ভাইয়ে ভাইয়ে প্রেম ছিলো, বন্ধন ফ্রেম ছিলো
বাড়ি বাড়ি যাওয়া ছিলো, কতো কি যে খাওয়া ছিলো
স্বপ্নের নিঁদ ছিলো, স্বপ্নীল ঈদ ছিলো
যৌথ খানা ছিলো, শোনা ছিলো জানা ছিলো
কথারই দাম ছিলো, গাছে গাছে আমি ছিলো
নদনদী ভরা ছিলো, হাতে হাত ধরা ছিলো
কোরআনের পাঠ ছিলো, গজ্ঞ ও হাট ছিলো
ছিলো কাদা মাঠঘাট পদ্মপুকুর
আঙ্গিনাতে শোয়া ছিলো লক্ষ্মী কুকুর।
বিড়ালও ছিলো ঘরে, খাঁচাতে টিয়ে
মাইকে গান শুনে হতো যে বিয়ে।
ন্যাকড়া পুতুল ছিলো, ছিলো বনভাত
গল্প ও পালা গানে যেতো কেটে রাত।
মৌমৌ জোছনার ছিলো মাখামাখি
তাই দেখে ভরে যেতে সকলের আঁখি।
বাউলের একতারা, আইসক্রীম লাল
জাম রসে একাকার মেখে যেতো গাল
বৃষ্টি বাদল হলে হাঁটা ছিলো দায়
নায়ে চড়ে বঁধূ যেতো দূর তার গাঁয়।
বর্ষা দুপুর হলে ডিঙে নিয়ে খেলা
কলাগাছ দিয়ে কতো বানিয়েছি ভেলা
হা-ডু-ডু দাঁড়িয়াবাঁধা খেলেছি কতো
আজ সব কি করে যে হয়েছে গত!
মন বলে কেঁদে কেঁদে ফিরে এসো সব
ফিরে এসো ফিরে এসো মধু শৈশব।
আত্মহত্যার আগে
এমরান হাসান
দূরেই তো আছি সবকিছু থেকে
আড্ডায় নেই, তর্কে নেই
তোমাদের করুণায় দিব্যি বেঁচে আছি বুকে নিয়ে অলীক পাহাড়।
দূরেই তো আছি
আমার কণ্ঠস্বর চেপে ধরে বেঁচে আছে জলপাইরঙা দেশ
মতবাদ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে পতাকা শোভিত গাড়ি।
আমি নিশ্চুপ...দেখে যাই অর্ধমৃত স্বদেশের ভাঙাচোরা মুখ।
মৃত্যু,
চলো এইবার শুয়ে পড়ি
মুখোমুখি তুমি আমি
আমাদের কবরে পা রেখে জেগে উঠুক উৎসবের পাললিক ভূমি
চুম্বনরত ঠোঁট বিবস হতে হতে
দ্বীপ সরকার
পানের পিক মাখা ঠোঁট- কম্পমান ও শিহরিত ভীষণ
বয়সের ভারে ঘারমোটা হওয়া ষাট বছর বয়সী এক নারী
তেরছা মার্কা পাছার চওড়া
কালের আবর্তে লুপ্ত হওয়া স্তনের বায়বীয় গুণাগুণ
চোখ আছে তার- সব দেখে
মন আছে তার- সব ভাবে
স্পর্শ তুলে নিকটে যেতেই সরে যায় আবেগ ও তাড়না
শিহরণ তুলে উঁচিয়ে ধরে আবেগিক মোটা ঘার
আলিঙ্গনের নিকটে এসে মুখ থুবড়ে প’ড়ে বেগ ও বোধের কোরাস
ফের কামনা আসে-ফের যায়
অনুভূতিতে কমে গেছে জল ও দীপ্তমান খরা- স্রোত নেই
বয়স বাড়ে- কমে যায় সব
চুম্বনরত ঠোঁটও বিবস হতে হতে সেকেলে হয়ে যায়- পুরনো হয়ে যায়
পদাবলি : ০২
আমি যাযাবর
মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর
সামনে ধূসর বালুচর, খাঁখাঁ রোদের উত্তাপ
পারি দিতে হবে আদিগন্ত ধুলোময় জীবন
পাশে আপনজন বলতে কেউ নাই
দুটো হাত শুন্য আমার, পা চলে না সামনে
এগুতে হবে তবুও, বিজয় আনতে হবে
একাকী আমি, তুমি আমরা দুজন
পাশে নাই কেউ তোমার, আমার আমাদের
তুমিও ভুলে গেলে অতীত
বর্তমান আমার জন্য আশির্বাদ নয়, সুখকর নয়
অশান্তির দাবানল দাউদাউ করে জ্বলছে
আগুন জ্বলছে কলিজায়, হৃদয়ের গহীনে
মরুভূমির ক্লান্ত পথিক আমি
অবিশ্রান্ত হাঁটছি, আরও কত হাঁটতে হবে জানিনা
স্বপ্নপূরণের অভিলাষ নিরুদ্দেশের যাত্রী
কখন সকাল হয়, দুপুর কাটে, আবার রাত্রি নামে
জীবনের চাওয়াগুলো এতো নিষ্ঠুর কেন
স্বপ্নপূরণের বাতিঘর এতো দূরে কেন
আলো ছুঁইছুঁই তারাদের দেখি
শশীকে দেখি
চুপচাপ পিনপতন নীরবতার আবাসে বন্দি আমি
আমাকে শুধুই কাঁদতে শেখায়, কাঁদাতে ভালোবাসে
তবুও ভালোবাসি তাকে, দোয়া করি কল্যাণের জন্য
নিরুদ্দেশের যাত্রী আমি, আমি যাযাবর!
স্নায়ুবিক চিন্তার বিকিরণ
আহমেদ ইউসুফ
আকাশের অভিমুখে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে
প্রজাপতির বারো হাজার চোখ
নিউরন বিগলিত স্নায়ুবিক চিন্তার বিকিরণ হচ্ছে
দেশ-বিদেশের প্রতিটি ঘরে দ্বন্দ্ব সমাসে সমাসে
অভাব আর অভিযোগের আবডালে
যেন এ সাজানো সংসার
আসুক মহামারী আসুক ঝড়
তবু না হোক বেদনার কারাগার।
সমযোজী বন্ধন সৃষ্টি হোক
হৃদপিণ্ডের অলিন্দে অলিন্দে
কার্ডিয়াক পেশির ছন্দে ছন্দে অপার আনন্দে।
করোনা নিছক কোন মহামারী নয়
এ যেন বিধির এক অগ্নিপরীক্ষা
যা প্রতি নিয়ত অতিক্রম করে আমরা সম্মুখে যাই
ভয় নয় ভয়, করবো জয়; নিশ্চয়
যদি নেই সময়ের দীক্ষা
তবে এ করোনার বিরুদ্ধে জেগেছে
যে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ; তা দিয়েছে বুক থেকে বুকে ঠাঁই।
যা দেখছি জানালায়
সোলায়মান হোসেন তুষার
চৈত্র দুপুর,
অদূরে বাজে পুলিশের সাইরেন।
দু’একটা খামখেয়ালি তরুণ এই যা ছিল,
থেমে আছে সাঁই-সাঁই ছুঁটে চলা অতিকায় ট্রেন।
থমথমে মহাব্যস্ত রেলস্টেশন!
যা ছিলো দু’একটা ডানপিটে যুবক,
মুখে মুখোশ পরিহিত যারা।
তাছাড়া কয়েকটি অভুক্ত কুকুর,
তারে বসা শীর্ণ কাকের ঝাক,
সবকিছু মুহূর্তে পলাতক!
সাইরেন বাজিয়ে ছুঁটে চলে মুখোশ পরিহিত,
পুলিশের যান।
ছোঁটে চাল-ডাল বোঝাই মিনি ট্রাকভর্তি,
ত্রাণ অনুদান।
ছুঁটছে স্তব্ধ শহরের মহাসড়ক ধরে...
বাহিরে যেতে আজ মানা,
যেতে মানা রাতদিন চুপচুপে ঘামে চুপসে থাকা কাপড় গায়ে,
ছুঁটে চলা রিকশাচালক মামাদের।
যেতে মানা পোষাক কারখানার কর্মীদের,
যেতে মানা পার্কের বেঞ্চে চেপে গল্পে মাতা জুগল জুটির;
যেতে মানা ছাত্র-শ্রমিক, আমলা-মালিক সকলের।
বাহির যেতে মানা আমাদের, যেতে মানা মানুষের!
বাহিরে অপেক্ষায় অচেনা ঘাতক,
যেতে চায় ছড়িয়ে শরীর থেকে শরীরে।
এক অতিক্ষুদ্র ভাইরাস, ‘নভেল করোনা’
চারদিকে ছেঁয়ে আছে লাশের মিছিলে!
ঘরে থাকতেই হবে, এটাই একমাত্র অস্ত্র;
ঢাল-তলোয়ার বলতেও এই যা!
দু’হাজার বিশ; একুশ শতকের অভিশাপ
বিশ্বগ্রাম স্তব্ধ করে আটকে দিয়েছে,
চারদেয়ালে!
দু’হাজার বিশ; একুশ শতকের অভিশাপ
দেখাচ্ছে কতটা ঠনকো আমাদের বন্ধন,
লাশ রাস্তায় ফেলে রাখছে পরিবার।
দেখাচ্ছে কতটা অসহায় মানুষ,
মানুষের কৃতিম পৃথিবী!
শিখেছি, শিখছি আমরাও-
‘জীবনের চেয়ে নয় কিছু দামি!’
তোমাকেই মনে পড়ছে
আরমান জিহাদ
নিস্তব্ধ নিরব আকাশ চারিদিকে
স্ব স্ব আওয়াজে বাতাস বইছে
আমি জানালার পাশে বসে দেখছি
কাঁচের জানালা ভেদ করে যেন
আমার হৃদয়ে আঁচড় লাগছে দক্ষিণা বাতাসের।
চায়ের কাপে চা নিয়ে বসে আছি
পাশে কেউ নেই শুধু স্বপ্নের তুমি ছাড়া।
শরীরে শীত শীত ভাব আসছে আর ভাবছি
যদি তুমি পাশে থাকতে,
শাড়ীর আঁচল দিয়ে শরীর মুড়িয়ে নিতাম।
বইয়ের পাতায় নজর যেন আটকাতে পারছিই না
কেবল বাহিরে চলে যাচ্ছে আর শুধু তোমাকেই খুঁজছে।
তুমি কি ঘুমের ঘোরে আমার এই ভালোবাসা অনুভব করছো?
আমি নিমিষেই হারিয়ে যাচ্ছি তোমার সুরে
তুমি ডাকছো তোমার শিউরে
আমি আবেগে আপ্লূত তুমি আমারই পাশে তবুও বহুদূরে তোমার বাস।
পদাবলি : ০৩
আমরা ভালোবাসলে কি বলবে লোকে
রাকিবুল হাসান রাকিব
আমরা ভালোবাসি তোমাকে আমাকে দুজনে;
তুমি শুধু বলো, ভালোবাসলে কি বলবে লোকে?
লোকের কাজ করবে লোকে, বলব কি? তাকে;
ভালোবাসলে সমাজের লোকে অনেক কিছু বলে।
ভালোবাসা অপরাধ, জানি তবুও যায়, ভালোবেসে।
ভালোবাসার মানুষ হলে যায়, বুঝা যায়, তবে।
ভালোবাসার মানুষ ভালোবাসে, ভালোবাসে বলে।
তারা জানে না, বুঝে না, ভালোবাসলে কি বলবে লোকে।
মানুষের ভালোবাসার মাঝপথে বাঁধা আসে।
সমাজের মানুষ অভিযোগ নিয়ে আসে বারে বারে।
আসলে তারা জানে না, ভালোবাসা হয় কিভাবে;
শুধু শুধু ভালোবাসা অপরাধ বলে, সমাজের লোকে।
যখন ভালোবাসার কথা জেনে যাবে লোকে;
নাম ধরা বারণ, একাপথে চলা বারণ, একসাথে।
তখন লোকলজ্জা বলে, সেই জিনিসটা হারিয়ে যাবে।
সমালোচনা ছড়াবে শুধু লোকে লোকসমাজে।
অবশেষে সবকিছু চারদিক থেকে কালোরাত আসে।
চিঠি লেখা, বন্ধ হবে, পথচলা, বন্ধ হবে, অপরাধে।
নিঝুম রাতে নীরবে দুজন বেড়িয়ে চলে যায়, নগর ছেড়ে।
রাত কেঁটে ভোর আসে, সব সমালোচনা বন্ধ হয়ে যাবে।
বাঁচতে চাই
রেখা দাস
বিশ্বমাঝে আলোর মেলায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
নবীন ত্যাজের হর্ষ ধারায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
জীর্ণতাকে দিয়ে চিরবিদায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
মরতে চাই না গ্রাসের নেশায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
মরতে চাই না ক্ষুধার জ্বালায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
হিংসা বিদ্বেষ পায়ে মারাই
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
হীনতারে দেবো না ঠাঁই
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
ধর্ম দ্বন্দ্বে ঘৃণা জানাই
আমার সবে বাঁচতে চাই!
আমরা সবে মানবতার গান গাই
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
মানবতার চেয়ে মহীয়ান কিছু নাই
অন্তরেতে এই বিশ্বাস আছে সর্বদাই।
সৃষ্টি উল্লাসে প্রেম সাধনায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
দেশকে ভালোবেসে মাতৃ শ্রদ্ধায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
মনুষ্যত্ব ধরে শিরা উপশিরায়
আমরা সবে বাঁচতে চাই!
বিধাতার দরবারে আর্জি একটাই
মানব প্রেমে আমরা সবে বাঁচতে চাই!
মৃত্যুর কোলে
মাজরুল ইসলাম
প্রকৃতির সঙ্গে শত্রুতায়
বক্রগামী হাত
সেই হাত কখনো বোবা কান্না শুনতে পেল না
শুনতে না পাওয়া বোবা কান্না এখন
ভুলের সিঁড়ি বেয়ে ফিরে এল
নিশুতি রাতের কান্না হয়ে
এখন তার কান্নার জল সিঞ্চন করে
আসনপিঁড়ি হয়ে বসে মানবসভ্যতার জীবন খাতার ‘পরে
এরপরও চেতনার উন্মেষ না ঘটালে
কবে হয়তোবা শুনতে হবে স্পর্ধিত হাত ঝুলে আছে
মৃত্যুর কোলে ..
বসন্ত
মিজান ফারাবী
কোকিলের কুহুয়া সুর দক্ষিণা বায়ুতে
ছড়িয়ে যাবে বহুদূর থেকে দূরান্তে
পথ থেকে গ্রামের প্রান্তরে,
প্রকৃতি তার সমস্ত স্বকীয়তা দিয়ে
জানিয়ে দেয় ফাগুন এসেছে ধরায়।
শীতের অবেলায় ঝরা পাতা বিদায় নেয়
প্রকৃতির নির্মল ছায়াতে
বসন্তের সবুজাভ ছড়িয়ে পড়ে মনোমুগ্ধ মায়াতে
আহা! আজি এ-বসন্তে
শাপলা জবা বেলী আরো কতো নাম না জানা
ফুলের মুগ্ধ সৌরভে ছেয়ে যায় বন বনানী।
সেদিন গৌধূলীর বাতাসে ধানের চারায়
ঢেউয়ে ঢেউয়ে নেচে যাবে মন,
বসন্ত বাতাসে ফুল-পাখিদের সাথে
হবে প্রেমের আলাপন,
বালুময় মরুতে পড়ে যাবে কি দারুণ!
সবুজের মায়া আবরণ।
ছায়ামৃত্যু
ছায়ামৃত্যু
শামীম সাগর
আপনি যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন। এক পা এগুবেন। এগুলেই আপনি মারা যাবেন।
ছায়া টা আর দুই পা এগিয়ে আসলো।
লোকটা তার পকেটে থাকা রিভলবার টায় হাত রাখল। দেখুন, আপনি কিন্তু আদেশ অমান্য করছেন। আমাকে কিন্তু বাধ্য করবেন না পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে।
ছায়া টা তার নিজস্ব গতিতে এগুতে লাগলো।
আমি আবারও বলছি, আপনি এগিয়ে আসলে আপনাকে শুট করতে বাধ্য হবো। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
ছায়া টা থামলো না। নিজের মত এগুতেই থাকলো।
লোকটা এবার পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে পয়েন্ট করলো ছায়াটার দিকে। এই রিভলবার দিয়েই গোটা দশেক জীবন উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই রিভলবারটার জন্যেই দেশব্যাপী যিনি একটা ত্রাস। একটা আতঙ্ক।
ছায়াটা এগিয়ে আসতে লাগলো, লোকটা দুই পা পিছিয়ে যেতে লাগলো। তার হাত কাঁপছে। রিভলবারের ট্রিগার টা হঠাৎ জ্যাম হয়ে আটকে গেছে। একটু একটু করে এগুতে এগুতে ছায়াটা তাকে ঘিরে ফেললো। শেষ মুহূর্তে লোকটা শুধু বললো, আর এগুবেন না। গুলি করে দেয়া হবে কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কোনো হুমকি কাজ করলো না। ছায়াটা মৃত্যু হয়ে ততক্ষনে লোকটাকে ঘিরে ফেললো। মৃত্যুর কোনো বাধা নিষেধ মানে না।
বিষফোঁড়া
বিষফোঁড়া
নৃ মাসুদ রানা
সৌমিনী ঘুরে এসেই ভাত চাইতে লাগলো। মা পাতিল থেকে দুমুঠো ভাত প্লেটে দিতেই রেগেমেগে সৌমিনী বলতে লাগলো তরকারি কই। হুদা ভাত আমি খামু না। প্রত্তিবার খালি হুদা ভাত আর ভাত।
লতা কোন কথা না বলে চৌকাঠে বসে দরজার সাথে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কোন কথা বলছে না। চিন্তায় চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছে সে।
মা! ও মা! তরকারি দিয়া যাও। হুদা ভাত ক্যামনে খামু?
না! লতা কিছুই শুনছে না। চিন্তায় মশগুল। দূর আকাশের কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
মা! ও মা! কি অহেছে?
না, কিচ্ছু অয়নি। তুই যা, ভাত খা।
ভাত কি দিয়া খামু?
কি দিয়া খাবি মানে? আমার মাথা দিয়া খা।
সৌমিনী কাঁদো কাঁদো হয়ে ভাতে নুন মিশিয়ে খেতে লাগলো। আর বলতে লাগলো আমার আব্বায় থাকলে আমার লেইগা মাছ কিইন্না আনতো।
লতা কথাটি শুনেই বলতে লাগলো, তুইও তোর বাপের লগে মরতি। আমি বাঁইচা যাইতাম। যত দুঃকু আল্লায় আমারে দিচে।
বাসাবাড়িতে কাজ করে লতা। রিকশাচালক স্বামী গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। ঢাকার বুকে ছোট্ট মেয়ে সৌমিনীকে নিয়েই তার সংসার। কিন্তু এখন বেঁচে থাকাটাই দুষ্কর।
বাংলাদ্যাশে নাকি করোনা ভাইরাস ঢুকেচে। প্রাণঘাতি ভাইরাস। একবার অইলে আর বাঁচন যাইবো না। এজন্যে বাড়ির মালিকেরা কাজে যেতে মানা করেচে। কিন্তু সংসারের যেই একডা অবস্থা বাসা ভাড়া দিতেই হিমসিম খেতে অইবো। তারপর দু’দুটো মুখ, দুটো পেট। কথাগুলো লতার মাথা মগজে ঢুকে কিলবিল কিলবিল করছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
সপ্তাহ খানেক পর।
মা! আমি আর থাকবার পারছি না। খুউপ ক্ষিধে লাগচে। খাওন না পাইলে আমি কিন্তু মইরা যামুনে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে সৌমিনী।
লতা সৌমিনীকে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে চোখের পানি ফেলছে। মেয়ের কথার উত্তর তার জানা নেই। গত দুইতিন দিন আগে ভিড় ঠেলে যেটুকু আটা, চাউল পেয়েছিল সেটা শ্যাষ অইয়া গ্যাছে। এখন কি খাইবো? এদিকে বাড়িওয়ালাও বলে গেছে বাসা বাড়া দিতে। নইলে...।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে সৌমিনী। লতা পাশের রুম থেকে ১০০ টাকা চুরি করে গাঁইটে বেঁধে সৌমিনীকে নিয়ে পালিয়েছে।
ট্রাক ড্রাইভারের পা ধরে কান্নাকাটি করে কোনরকম পিছনে উঠে বসেছে। গ্রামে যাইবো। সৌমিনী জন্ম নেওয়ার পর এই প্রথম গ্রামে যাওয়া। কিন্তু লকডাউন হওয়ায় ড্রাইভার নিজেও নিতে চায়নি। সারা রাস্তায় পুলিশ থাকে। কিন্তু লতার কান্নাকাটিতে তাকে নিতেই হয়েছে।
বাস চলছে। বহু দূরের পথ। পথের দূর। রাত ডিঙিয়ে জোৎস্নার সাথে ভাব জমিয়ে ট্রাক চলছে। আর জাতাঁকলে পিষ্ট হওয়া পিচ ডালা রাস্তা বিদায় দিচ্ছে শহরের।
ভোর সূর্যের দেখা। খুব কাছাকাছি সে আলো। যে আলোয় পৃথিবীর দিন হয়। আর দিনের শুরু হয় ব্যস্ততা, মহামারী, টানাপোড়েন। আরও কতো কি?
আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে যায় লতার। না, তখনও ঘুম ভাঙেনি সৌমিনীর। এখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। বাসের হেলপার চড়া গলায় বারবার নামতে বলছে। তখন সৌমিনীর ঘুম ভেঙেছে। ঘুম থেকে উঠেই বলল, মা! আমার ক্ষিদে লেগেছে। আমাকে কিচু খেতে দাও।
বাসস্ট্যান্ডে কোন দোকান খোলেনি। লতা হেলপারকে বললো, ভাই! আমার মেয়েডার ভীষণ খিদে লাগছে। যদি আমাকে দশডা টাকা ফেরত দিতেন...।
হেলপার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পকেট থেইক্কা দশটা টাকা আর ট্রাকের বক্স খুলে একটা রুটি-কলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, যেখানে যাবেন। তারাতাড়ি যান। পুলিশ কিন্তু আইয়া পড়বো।
সৌমিনীকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটছে । হাঁটতে হাঁটতে খুবই ক্লান্ত সে। শরীরটা টলমল করছে। খাওয়া দাওয়া নেই। পানির পিপাসা লেগেছে খুব।
রাস্তায় কোন গাড়িঘোড়া নেই। মানুষও নেই। শুধু মাঝে মধ্যে দুই একটি ট্রাক যাচ্ছে।
অবশেষে অনেকখানি রাস্তা হেঁটে গ্রামের রাস্তার গড়ান দিয়ে নামতেই পা পিঁচলায়ে ধানক্ষেতে পড়ে যায় লতা। না, হুঁশ নেই। নিশ্বাস মাঝেমধ্যে এসেই চলে যাচ্ছে। সৌমিনী পাশের ডিপকল থেকে চোইলে করে পানি এনে মুখে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে লতার।
ধানক্ষেতের আইলে বসে আছে দুইজন। সৌমিনী জিজ্ঞেস করলো, মা, এগুলো কি?
লতা উত্তর দিলো, এগুলো ধান।
ধান থেকে কি অয়?
ধান থেইক্কা ভাত অয়।
তয় এতো এতো ভাত থাকতো আমাগোর ভাতের অভাব ক্যা?
চৈত্রের দুপুরে
চৈত্রের দুপুরে
জুয়েল আশরাফ
২০২১ সাল।
চৈত্র মাসের ঝাঁঝাল রোদের দুপুর।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে রিকসাটা ধীর গতিতে এগোচ্ছে। রিকসাচালক স্থানীয় হাই স্কুলের গণিত বিভাগের শিক্ষক। যাত্রী একজন আমেরিকান তরুনী। বিস্তীর্ণ মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছে তারা। এই মাঠে অল্প দিন পরেই বৈশাখের মেলা বসবে। গত বছর করোনার মহামারীতে সারা দেশে বিয়েশাদি-বৈশাখের অনুষ্ঠানসহ সব নিষিদ্ধ ছিল। এ বছর জমজমাট মেলা হবে।
পিচঢালা রাস্তা না হলেও কাঁচা রাস্তায় অসুবিধে হচ্ছে না লিলিয়ানার। দু পাশের দৃশ্য দেখে মায়া হচ্ছে। মাটির মায়া, গাছের মায়া, পথের মায়া, ছায়ার মায়া। সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষের মায়া। লিলিয়ানা বিস্ময়ে লক্ষ্য করল তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও গড়াচ্ছে না। গড়াবে, জায়গা মত পৌঁছে যাবার পর শুধু জল নয় রক্তও গড়াবে। রক্ত গড়ানোর কথায় মনে পড়ল, ইবরাহীম বলেছিল- কেয়ামতের দিন আফসোস করা মানুষগুলির চোখ থেকে যখন জল আর বের হবে না এরপর চোখ থেকে বেরোবে রক্ত!
স্টিশনে পৌঁছে সে কেঁদে ফেলল। রিকসাওয়ালা মানুষটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভাড়া দেয়া হয়ে গেছে। তার কান্না দেখতে দাঁড়িয়েছে। অসম্ভব রূপবতী বিদেশী মেয়েরা কীভাবে কাঁদে- এই দৃশ্য দেখে যাবে।
মানুষটি ইংরেজীতে বলল, আপনার ব্যাগ ছেড়ে এসেছেন।
সে ভুলেই গিয়ে ছিল তার সাথে একটা ব্যাগ রয়েছে। রিকসা থেকে নামতে যাবার সময় এত বড় জিনিসটার কথা মনে পড়ল না! লিলিয়ানা স্পষ্ট বাংলায় বলল, আমি বাংলায় কথা বলি। বুঝতেও পারি। আপনি আমার সাথে বলুন বাংলা।
মানুষটি অল্প হাসল। সে জানে, তার বাংলা উচ্চারণের কারণেই মানুষটির হাসি পাচ্ছে। যখন থেকে সে বাংলা শিখে বলতে চেষ্টা করছিল এবং সাত বছরে অনর্গল বাংলা বলছিল, ইবরাহীমও হেসে উঠতো আর বলতো- ‘তোমার বাংলা উচ্চারণ আমার দেশের মানুষের উচ্চারণ থেকে অনেক রোমান্টিক আর শ্রুতিমধুর। শুনলেই কান আরাম পায়।’
মানুষটি বলল, আপনি কোথায় যাবেন?
-ঢাকায়।
-ঢাকার ট্রেন আসবে দুপুর তিনটায়।
সে বুঝল দীর্ঘ সময় আগে এসে পড়েছে।
মানুষটি বলল, আমার নাম জামান। আমি এখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক। আমার সহকর্মীর সঙ্গে বাজি লাগিয়েছি, যাত্রী উঠিয়ে এক ঘন্টায় যার কম আয় হবে শ্রেণীকক্ষের সমস্ত ছেলেমেয়েদের তার খাওয়াতে হবে। আমার সহকর্মী এক ঘন্টায় আয় করেছে সত্তুর টাকা। আমার এক ঘন্টা শেষ হতে পনেরো মিনিট বাকি। আমার আয় হয়েছে পঁচিশ টাকা। বোঝাই যাচ্ছে বাজিতে আমি হেরে গেছি। সহকর্মীর শ্রেণীকক্ষের সবাইকে আমারই খাওয়াতে হবে।
মানুষটির কথা পুরোপুরিভাবে বোঝা গেল না। শুধু বোঝা গেল তিনি স্বুলের একজন শিক্ষক। স্কুলে পড়ানো রেখে রিকসা কেন চালাচ্ছে বোঝা গেল না।
-আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?
-খাদিজা।
ইবরাহীমের দেয়া নামটি বলল লিলিয়ানা। তার আসল নাম কাউকে সে বলে না।
-আপনি আমেরিকান?
-হ্যাঁ। নিউ ইয়র্ক।
-কোথায় গিয়ে ছিলেন?
-ইবরাহীমের বাড়ি। ইবরাহীমের কবর দেখতে এসেছি।
-পাশের গ্রামের ইবরাহীম? গত বছর আমেরিকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এসে অল্প দিনেই মারা গেল যেই ইবরাহীম?
লিলিয়ানা শ্লেষ্মাজড়িত গলায় বলল, হ্যাঁ।
মানুষটাকে বিস্মিত হতে দেখা গেল। বলল, ইবরাহীম মরে গেছে এক বছর হলো। কবর দেখতে সূদুর আমেরিকা থেকে এসেছেন?
-হ্যাঁ।
আপনার সাথে ওর কি সম্পর্ক?
-বন্ধু।
মানুষটির চোখ দেখে লিলিয়ানা বুঝতে পারল, বন্ধু-সম্পর্ক কথাটা বিশ্বাস যোগ্য না। সাত সমুদ্র পারি দিয়ে শুধু বন্ধুর খাতিরে এতদূর কেউ আসবে না। ইবরাহীমদের বাড়িতেও কেউ বিশ্বাস করে নি। একটা গোপন ব্যাপার রয়েছে। সেটা বুঝতে ইবরাহীমের পরিবারসহ আশেপাশের লোকজন দুদিন খুব চেষ্টা করছিল। গ্রামশুদ্ধ লোক তাকে দেখার জন্যে ভিড় করেছে। দুদিন ইবরাহীমদের বাড়িতেই সে ছিল। রোজ ইবরাহীমদের পারিবারিক কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতো। এই গ্রামের সবকিছুই যেন লিলিয়ানার চেনা। দশ বছরে নিজের গ্রামের এত বর্ণনা ইবরাহীমের মুখ থেকে শুনেছে সে! শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে আছে গ্রামের দৃশ্যপট। চলে আসার সময় ইবরাহীমদের বাড়ি থেকে গাড়ি ঠিক করে দেয়া ছিল, এবং স্টিশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবার লোকও ঠিক করা ছিল। সঙ্গে কেউ আসুক সেটা সে চায় নি। একাই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে এবং কিছুদূর এসে গাড়িটাকেও সে ছেড়ে দিল, শুধু একটা রিকসার জন্য।
ইবরাহীমের মুখে এই যানবাহনটির কথা বহু শুনেছিল সে। মাঝে মাঝে নেটে সার্চ দিয়ে ছবিতে দেখাত ইবরাহীম। প্রিয় যানবাহন। প্রিয় মানুষের প্রিয় যানবাহনে চড়ে সে স্টিশনে চলে এসেছে
রিকসাচালক মানুষটি রিকসা থেকে ব্যাগটি নামিয়ে তার সামনে রেখে দিয়ে বলল, ছায়ায় গিয়ে বসুন। এ পাশটায় রোদ অনেক।
-ধন্যবাদ
-এই টাকাটা রাখুন। আপনি আমার দেশের অতিথি। তাছাড়া আমি পেশাদার কোন রিকসাচালক নই। এক ঘন্টার বাজির রিকসাচালক।
অনিচ্ছাস্বত্ত্বে টাকাটা নিল লিলিয়ানা। মানুষটি বলল, আপনার ভ্রমণ আরামদায়ক হোক।
-ধন্যবাদ।
মানুষটি সৌজন্যসহকারে বিদায় নিল। সে বসে থাকল রোদমাখা শরীরে। স্টিশনে কৌতূহলী মানুষগুলি যাওয়া-আসায় তাকে দেখে যাচ্ছে। একসময় হুইসেল বাজিয়ে এলো ট্রেন। ব্যাগ হাতে নিল। ব্যাগের ভেতর ইবরাহীমের ছোটবেলার জিনিসপত্র। দুদিন ইবরাহীমের যাবতীয় জিনিস সংগ্রহ করে এনেছে সে। কিছুই ছেড়ে আসেনি। ছেড়ে আসতে পারেনি। মায়া করে জিনিসগুলি সাথে করে এনেছে, সাথে করেই চলেছে। বুকের পাঁজরে এই মায়া বয়ে বেড়াতে হবে অনেককাল।
দ্বিতীয়বার হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলল।
নবাবগঞ্জ, ঢাকা।
শব্দমালা : সাদিক আল আমিন
শব্দমালা
সাদিক আল আমিন
দয়িতা অথবা অন্য কাউকে
সবুজ আর হলুদের মাঝামাঝি যে দূরত্বে আমরা মুখ ডুবিয়েছি
সেখানে কেবলই নর্দমার গন্ধ আসে
সেখানে, সেই জায়গায়, আমরা ভেবেছিলাম বাঁধবো প্রণয়ের বাঁধ
দয়িতা, তোমার সাথে সেখানে, থাকবো শুধু দুজনে
আধভাঙা চাঁদের নিচে আমাদের একাকী ঘরে
চকচকে টিনের চালে ঝিলিক দিয়ে উঠবে জোছনা আর আমরা
মহাবিশ্ব ভেঙে যাচ্ছে কিনা ভয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরবো
আমরা হবো মহাবিশ্বের সর্বশেষ নর-নারী, প্রথম যেমন আদম-হাওয়া;
সবকিছু ধ্বংসের পর আমরা পরস্পরের ঠোঁটে চুম্বন করে মারা যাবো
যেমন রোমিও মরেছিল জুলিয়েটকে চুম্বন করে-
সেখানেই থাকবো আমরা, পূর্ণিমায় দীঘল নদীর শরীরে দেবো ডুব
যদিও সাঁতার জানিনা; পরম্পরের বিশ্বাসে ভেসে থাকবো শলাকা হয়ে
তারপর ভাববো, কতকিছু অন্যায়ের পরেও আমরা টিকে আছি
হয়তো পাপীদের বিধাতার পছন্দ নয়, তাই তারা পরে মরে
আমরা তাই আরো পাপে জড়াতে থাকি যাতে আরো কিছুটা ক্ষণ পাই
আমরা স্বর্গে যাবোনা জানি, তবুও শেষ সময়টুকু উপভোগ করি
দয়িতা, সেখানে একদিন টিনের চাল ফালি করে নির্জন ঘরে ঢুকে পড়বো জোছনা,
তারপর সেই আলো মাটি ফুড়ে আরো গভীরে চলে যাবে
আমরা তাই ঠিক করি, সেখানেই আমাদের কবর হবে
সেখানে দুজনে আমরা মুহুর্তেই ভালোবাসার পাখি থেকে
গোরখোদক হয়ে যাই, আমরা যতই মাটি খুড়ি, আলো তত ভেতরে যায়
তারপর তুমি মুখ ফিরিয়ে বলো, ‘এসবের আশা করে লাভ নেই’
আমি ভাবি, লাভের কতোকিছুই না আছে জীবনে! লাভ আর লোভেই তো মানুষ
সেই আদম-হাওয়াও ভুল করেছিল লোভ করে, লোভ আমাদের অস্থিমজ্জায়
সুতরাং আমরা লোভ করতে থাকি আর মাটির ভেতরে তলিয়ে যেতে থাকি
তলিয়ে যেতে যেতে একসময় জোছনার আলো ফুরিয়ে যায়,
আমরা আরো লোভ করে মাটি খুড়তে থাকি-
তারপর তুমি বলো, আমাদের মৃত্যু অতি সন্নিকটে
আমরা তখন পরস্পরে চুম্বন করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকি...
তারপর আমরা জন্ম নেই কীট হয়ে, চারদিকে নর্দমার এক ব্রহ্মাণ্ড ছাড়া কিছুই দেখিনা
তখন আমরা আবার সবুজ আর হলুদের মাঝামাঝি যে রঙ, সে রঙে মিশতে চাই
আমরা চাই নদীর ধারে কোনো বালুচরে আমরা সময় কাটাই সারাজীবন
কিন্তু সব রঙ যেন ফিকে হয়ে আসে, কালো রঙ আর উৎকট গন্ধ ছাড়া আর কিছুই দেখিনা
তারপর... তারপর... তারপর...
তুমি দয়িতা, আমাকে তোমার সর্বনাশের মূল মনে করে দূরে সরে যাও
তোমার প্রার্থনা বিধাতা মেনে নেয়, তোমার পাপ আমাকে দিয়ে দেয়
তুমি তখন অন্য এক উদ্যমী স্বপ্নাতুর যুবকের সাথে প্রণয়ে লিপ্ত হও
আর আমি তখনও নর্দমার কীট হয়ে লোভ করতে থাকি,
একদিন কালিমার আস্তরণ ছেদ করে অনাবিল শুভ্রতায় ভেসে বেড়াবো...
অবিরাম, অবিরত
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)