হিমঘর
হিমঘর
আহাদ আদনান
ফ্ল্যাট থেকে বস্তিতে যাওয়ার পথটা পায়ে হেঁটে যেতে লাগে ঘণ্টা খানেক। লকডাউন দেওয়ার পর শিউলি ভেবেছিল চাকরিটা মনে হয় চলে যাবে। সবাই বলছিল, লকডাউন জিনিসটা একধরনের ১৪৪ ধারার মত একটা ব্যাপার। ঘর থেকে বের হলেই ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ। কিংবা গুলি টুলিও চালিয়ে দিতে পারে। বস্তি থেকে বের হওয়া যাবে না। ফ্ল্যাটে যেতে না পারলে সাহেব হয়ত এক দুইদিন সহ্য করবেন। তারপর খুঁজে নিবেন নতুন বুয়া।
বাস্তবে লকডাউন অত কড়াকড়ি হল না। সিদ্ধিরগঞ্জের বিদ্যুৎ বিভাগের এই কলোনি’র মাথায় বাঁশ দিয়ে ঘের দিয়ে, লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়া হল ঠিকই, কিন্তু শতভাগ নিশিছদ্র নয়। ছুটা বুয়ারা তাই কাজ চালিয়ে যেতে পারল। শিউলির কাছে বরং মনে হল এত নিরিবিলি হাঁটার সুযোগ মন্দ কি। রাস্তায় কেও নেই, বিরক্ত করার লোক নেই, উৎপাত করার ছেলেরা নেই। চোখের জল টপটপ করে পড়লেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। একলা নিজের মত করে কান্না করার এমন সুযোগ কবে পায় শিউলিরা?
হাতের চার বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বিকেলে চলে আসার সময় কলোনির মাথায় আসতেই পুলিশ বাধা দিল।
‘কোথায় যাচ্ছেন? বের হওয়া নিষেধ’।
‘আমি ছুটা বুয়া। দশটা থেকে চারটা কাম করি। এখন যাইতে না দিলে রাস্তায় বইসা থাকতে হবে’।
‘তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে কে? করোনা বাড়ছে, শুনোনি? লকডাউন কড়া হয়েছে। সব সিল করে দেওয়া হবে’।
‘আজকের মত যাইতে দেন। কাল থেকে আসুম না’।
‘হাতে কী? টিফিন বাটিতে কী আছে’?
‘খাবার। মাংস ভুনা। খাইবেন’?
‘গেট লস্ট’।
যেতে যেতে শিউলি মনে মনে হাসে। কাল থেকে সে এমনিও আর আসবে না। কড়া করে লকডাউন দিক সরকার। তার কাজ সারা। বস্তির পিছনে কিছু কুকুর সারাদিন আবর্জনা খুঁজে বেড়ায়। শিউলিকে দেখে ওরা ঘেউঘেউ শুরু করে। আনন্দের চিৎকার। অন্নদাত্রীকে চিনে ফেলেছে সারমেয় বাহিনী।
খুব করে আজ গোসল করে শিউলি। গত পনেরো দিন ধরেই করছে সে। ম্যাডামের বডি শাওয়ারটা একদিন চুরি করে এনেছিল। ফেনা ফেনা করে গোসলের মজাই আলাদা। আজকের মত ডলে ডলে গোসল সে প্রথম দিনও করেনি। বুক ভরতি সাহেবের লালা, কামড়ে স্তন ছুলে রক্ত, যোনিতে থকথকে বীর্য, ফুলে যাওয়া ঠোঁট, পিঠ জুড়ে নখের আঁচড়, জামায় রক্তের দাগ, শরীরে রক্তের গন্ধ, এগুলো কি বডি শাওয়ারে দূর হয়? পক্ষকাল ধরে সে এই গন্ধ দূর করতে পারে নি। আজ মনে হয় তার ঈদ। আজকের গোসল ঈদের গোসল।
সাহেব ম্যাডামের ডিভোর্স হয়ে গেছে মাস দুয়েক। তারও ছয়মাস আগে ম্যাডাম ফ্ল্যাট ছেড়ে গেছেন। উনাদের হাতাহাতি, অশ্রাব্য গালাগালি অনেক শুনেছে শিউলি। তার কি আসে যায় তাতে? ম্যাডাম কাজের খুঁত ধরতে বসে থাকেন না, নিজের রুচি মত রান্না করা যায়, স্বাদ নিয়ে কেও আপত্তি করে না, বেতন ঠিকমত পাওয়া যায়, হেঁটে হেঁটে কাজে আসা যায়। ভালোই আছে সে। কিংবা ভালোই ছিল এতদিন। ওর নিজের স্বামী কাজ করে সিলেট। জাফলং পাথরের আড়তে বউ নিয়ে থাকা যায় না। মেয়েটা পড়েছে ছয়ে। ওকে স্কুলে পাঠিয়ে এই সাহেবদের ফ্ল্যাটে কাজটা সে আনন্দের সাথেই করে।
সাহেব কাজ করে বড় একটা ফার্নিচারের কারখানায়। সারাদিনের কাজ। শুক্রবার ছাড়া দেখা হয়না ঠিকঠাক। ম্যাডাম ফ্ল্যাটেই থাকতেন। ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দোটানায় পড়ে শিউলি। তাকে কি আর রাখবে সাহেব? খালি ফ্ল্যাটে কাজ করতে দিবে? সিসি ক্যামেরা নেই। এসব বিল্ডিংয়ে চুরির সম্ভাবনা, সুযোগ বেশি। একজনের অপরাধ আরেকজনের কাঁধে পড়ার আশংকাও অনেক। সাহেব তবু ডুপ্লিকেট চাবি তুলে দেয় ওর হাতে। কাজের স্বাধীনতা বেড়ে যায় অনেক।
কয়েকমাস চলে যায়। ডিভোর্সটা হয়ে গেছে এতদিনে। বস্তির অনেকেই বলেছিল এই ফ্ল্যাটের কাজটা ছেড়ে দিতে। শিউলি গর্বের সাথে বলে দিয়েছিল, ‘আমার সাব মানুষ ভালা। এই কাম ছাড়া যাইবে না’। করোনা আসার পর থেকে সাহেব এক প্যাকেট মাস্ক কিনে দিয়েছিল ওকে। ফ্ল্যাটে ঢোকার সাথে সাথে হাত স্যানিটাইজার দিয়ে ভালো করে পরিস্কার করে ঢুকতে হবে। এসব নিয়মকানুন ভালোই লাগত শিউলির।
যেদিন লকডাউনের ঘোষণা আসল ভয় আর আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশেই। কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। খুব ভোরে চুপি চুপি বস্তি থেকে বের হয় শিউলি। মেয়ের স্কুল বন্ধ। ঘরেই থাকবে সে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ। কলোনির মাথায় বাঁশ দিয়ে আটকানো। ছুটা বুয়া বলে সে ঢুকেও পড়ে ভিতরে। কঠোর না শিথিল লকডাউন এগুলো হিসেব করা শিখেনি তখনো লোকজন।
ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। তার মানে সাহেব ভিতর। পাঁচ-ছয় বার বেল বাজানোর পর খুলে দরজা। সাহেবের চোখ লাল। ঘুম কাটেনি এখনো। ঘরে কেমন যেন গন্ধ। মদের গন্ধ এমন হয়? রান্নাঘরে কলটা খুলতেই পিঠে শক্ত হাতের স্পর্শ টের পায় শিউলি। ভয়ের হিম শীতল স্রোত বয়ে যায় মেরুদন্ড বরাবর। প্রচন্ড চিৎকার সাহেব থামিয়ে দেন সিগারেট আর মদে ভেজা ঠোঁটের পেষণে। পাশবিক শক্তিতে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ওকে আছড়ে ফেলে জানোয়ারটা। ঘড়ির কাটার কয়েকটা ঘূর্ণনে শিউলি নিজেকে আবিস্কার করে বিবস্ত্র একটা লোকের বুকে। একটা সুতো নেই শরীরে, ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন প্রকট হয়ে আছে ঠোঁট, স্তন, পিঠ আর নিতম্বে। উরু বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এক খাবলা বীর্য।
পনেরো মিনিট পর। বিছানার চাদরটা শরীরে প্যাচিয়ে কাঁদছে শিউলি।
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ‘অ্যাম স্যরি। কি করে কি হয়ে গেল। তোকে কমপেনসেট করে দিব আমি। অনেক টাকা দিব। প্লিজ মুখ খুলিস না। মুখ খুললে কি হবে শোন। তোর দোষ খুঁজবে সবাই, সংসারটা ভাঙবে, চাকরি যাবে, পেপারে তোকে নিয়ে কিসসা রটবে আর আমার ছিঁড়বে বাল। কি করবি ভাব’।
কামিজ আর ব্রা’টা ছিঁড়ে গেছে। ওয়ারড্রবে ম্যাডামের পুরনো জামা পাওয়া যায় একটা। শরীরটা ঢাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে কাঁদে শিউলি। দড়ি আছে, কেরোসিন আছে, ধারালো ছুরি আছে, এমনকি ইঁদুর মারার বিষও আছে। এগুলো কোনোটাই টানে না ওকে। সে অন্য ধাতুতে গড়া।
সেইদিন বিকেলের কথা। ভারি এবং ভরা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে হাঁটছে সে। সারাদিনের কান্নায় চোখ ফোলা। শরীর ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে আসছে। অনেক কষ্টে হাঁটছে সে। রাস্তায় এমনিতে লোক অনেক কম। বিকেলে বলে বাজারের ছুতোয় বেরিয়েছে কিছু লোক। আর লকডাউন দেখার উৎসাহী বাঙালি তো থাকেই। সবাই কি তার দিকে তাকিয়ে আছে? চোখ দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে সবাই? টিফিনের বাটিগুলো কেড়ে নিয়ে খাবলে খাবলে খেয়ে ফেলবে আদা, রসুন আর হলুদ দিয়ে কষানো মাংস? অথচ সম্পূর্ণ বিনা বাধায় পুলিশের বাঁশের সীমানা পার হয়ে যায় শিউলি।
ছোট একটা ঘর। ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে। কাঠের খাটিয়াতে চাপাতি দিয়ে মাংস কুচি কুচি করছে একটা লোক। ‘বাজান, তুমি আইলা কবে’? ‘দেখ মা, তোর লেইগা গরুর রান আনছি। আয়, চাপাতিটা ধর। তোরে মাংস কিমা করা শিখাই’। ছোট হাতে চাপাতি নিয়ে কোপ দিতেই এক খাবলা রক্ত ছিটকে যায় লোকটার মুখে। ‘কীরে, তোরে কইছি গরু কোপাইতে, আর তুই দেহি মানুষের কল্লা কোপাইতিছিস। মালটা কে? তোর সাব না’? মুখটার দিকে তাকাতেই কয়েক মিনিটের জন্য শেষ রাতে আসা ঘুমটা ভেঙে যায় শিউলির। পেশায় কসাই পিতাকে মারা যাওয়ার পনেরো বছর পর স্বপ্নে দেখল সে।
পরের দুইটা সপ্তাহে শিউলির ভয়, আতংক কমতে থাকে। লকডাউন ব্যাপারটা খারাপ লাগে না তার। আরেকটা বিষয় তার ভালো লাগে। করোনা জাঁকিয়ে বসার পর লোডশেডিং যেন উধাও হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের এই এলাকাটায় আগে দিনে কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যেত। অনেকবার ফ্রিজে রাখা খাবার নষ্ট হয়েছে ম্যাডামের। এটা নিয়ে শিউলিও ভয়ে ভয়ে ছিল। এখন আর পচনশীল কিছু নষ্ট হচ্ছে না। ফ্ল্যাট খুলে শিউলি ডিপ ফ্রিজটা খুলে রাখে। নিজের জন্য কয়েকটা রুটি আর সবজি বানাতে বানাতে আলগা হয় ফ্রিজের পলিথিনের প্যাকেট। মাংসগুলো ভুনা করে সে ভরে ফেলে ক্যারিয়ার। মাঝে কিছুক্ষণ বসে সে টিভি দেখে। দেশে করোনা বাড়ছে। মৃত্যু সংখ্যাও বাড়ছে। হাসপাতালে অক্সিজেন সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। করোনার ভয় যদিও ছুঁতে পারে না তাকে। এসব খবরে আগ্রহও তার কম। তার ভালো লাগে ‘ক্রাইম পেট্রোল’। ইংরেজি ভয়ের ছবিও তার ভালো লাগে। মেয়ে বলে খুনাখুনি, রক্ত, জিঘাংসা খারাপ লাগতে হবে, কে বলেছে? এটা সে আগেও দেখেছে বিপদেও তার মাথা থাকে শীতল। হিম শীতল। ডিপ ফ্রিজটার মত ঠান্ডা।
কাল থেকে কঠোর লকডাউন। কাজে আর যাবে না সে। যাওয়ার দরকারও নেই। আজ শেষ দিন ফ্ল্যাটটা মনের মত করে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রেখে এসেছে সে। শুকনো গামছা দিয়ে ডলে ডলে জানালার হাতল, দরজার কপাট, চুলার সুইচ, মেঝে, বটি, তৈজসপত্র, কুরবানির সময় লাগে বলে সাহেবের শখ করে কিনে আনা চাপাতি মুছে এসেছে সে। তার হাতে ছিল ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনা গ্লাভস আর পায়ে মোজা। ঘরের কোনো ইঞ্চিতে নেই কোনো ফিঙার প্রিন্ট।
আজ ভেবেছিল খুব আরাম করে একটা ঘুম দিবে। কিন্তু এতো অস্থির লাগছে। হিম শীতল মাথাটা গরম হয়ে যেন টগবগ করছে। সে ভালো করে জানে পুরো কলোনিতে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। সাহেবদের বিল্ডিংটা বানিয়েছে ডেভেলপার কোম্পানি। ফ্ল্যাটটা তার নিজের কেনা সম্পত্তি। ভিতরে কে আছে, কি করছে, খোঁজ নেওয়ার কেও নেই। শিউলি খুব সচেতনভাবে বিদ্যুতের মেইন সুইচ, গ্যাসের চাবি, দরজার তালা বন্ধ করে এসেছে। পুরো কামরায় এক বিন্দু রক্তের চিহ্ন নেই। যে জামাগুলোতে রক্তের দাগ ছিল, অল্প অল্প করে চুলার আগুনে পুড়িয়েছে সে। ছাইগুলো সময় নিয়ে, একটু একটু করে ফ্ল্যাশ করেছে। প্রতিটা মোবাইল বন্ধ করেছে। সেগুলো এখন সিদ্ধিরগঞ্জের নর্দমায় ডুবে আছে। অসামাজিক সাহেবটার বলার মত বন্ধু, প্রতিবেশি, কলিগ নেই। তার দিকের একটা মেহমান আসেনি এই কয় বছরে। শিউলির কোনো ছবি, চিহ্ন নেই এই শহরে। কিসের এত ভয় তার?
রাতের পর রাত যায়। করোনা কমতে থাকে দেশে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে থাকে। তালা লাগানো ফ্ল্যাটটার কথা কেও মনে রাখে না। ডিভোর্সি ম্যাডাম আরেকটা বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে, খবর পেয়েছে সে। কারখানায় দীর্ঘদিনের অনুপস্থিত কর্মচারীর বদলে নতুন কর্মী নিয়ে নেওয়ার কথা। ফেসবুক আইডিতে হয়ত নোটিফিকেশন আর মেসেজের পাহাড় জমছে। হাজার ‘ফ্রেন্ড’ওয়ালা লোকটার আদৌ কোনো বন্ধু ছিল? শিউলি চলে এসেছে সিলেট। দিনগুলো ভালোই কাটার কথা তার। শুধু মাঝরাতে মস্তিষ্ক নামের ডিপ ফ্রিজটার বিদ্যুৎ চলে যায়। গরম হতে থাকে জাইরাসগুলো। সেখানে চলতে থাকে বীভৎস এক চলচ্চিত্র।
সদ্য ধর্ষিতা নগ্ন একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পিছনে বিবস্ত্র এক জানোয়ার তাকিয়ে হাসছে। সিগারেটে টান দিতে দিতে উঠে দাঁড়ায়। নগ্ন অবস্থায় সে যায় বাইরের টয়লেটটার দিকে। সুইচটা জ্বালাতে যাবে এমন সময় পাথরের পুঁতার মোক্ষম এক আঘাতে চৌচির হয়ে যায় খুলির পিছন আর ডান দিক। পুডিঙের মত এক খাবলা মগজ লেপটে যায় টয়লেটের প্লাস্টিকের দরজায়। মেয়েটা তখনো নগ্ন। সুতোর কোনো আবরণে সে রাখতে চায় না কোনো প্রমাণের অস্তিত্ব। লাশটা টেনে নেয় সে টয়লেটে। কৈশোরের পর আবার হাতে তুলে নেয় চাপাতি। অসুরিক শক্তি ভর করে কাজ করে খেটে খাওয়া বাহুতে। গরুর মাংসের চেয়ে অনেক সহজ মানুষের নরম দেহ কোপানো। ঝামেলা করেছিল অন্ত্রের নাড়িভুঁড়ি। বমি আটকে রাখা যায় নি। তিন তিনটা পলিথিনে মুড়ে আস্ত ভুঁড়িটা ফ্রিজে রেখে জমিয়েছিল সে। একদিন সুযোগ বুঝে পাথরে বেঁধে ডুবিয়ে দিয়েছে সে নর্দমায়। অন্তকোষ আর শিশ্নটা সে কুপিয়েছে দেহের সব শক্তি দিয়ে। ঘৃণায়, ক্ষোভে, কষ্টে তার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল।
ছোট ছোট পলিথিনের প্যাকেট করে সে মাংসগুলো রেখেছিল কঠিন হিমে। পচা গন্ধ আর প্রমাণ লোপাটের একটাই পথ ছিল তার সামনে। বীভৎস এক রাস্তা। প্রশ্ন দুইটাই। পুলিশ টিফিন ক্যারিয়ার খুলে চেক করলে বুঝতে পারবে মাংসটা কোন প্রাণীর? কুকুর কি খায় সেদ্ধ ভুনা করা নরমাংস? উত্তর পেয়ে বড় একটা পাথর নেমে যায় বুক থেকে। দুই সপ্তাহ পর ডিপ ফ্রিজ খালি হয়। কুকুরগুলো কেমন তাগড়া হয়ে গেছে এই কয়দিনে। সাফসুতরো ফ্ল্যাটটায় এয়ার ফ্রেশনার ছাড়া অন্য কোনো গন্ধ নেই। নিখুঁত একটা খুনের চলচ্চিত্র সাঙ্গ হয়ে আসে।
শুধু দিনে দিনে মস্তিষ্ক নামের হিমঘরটা বিদ্রোহ করতে থাকে মেয়েটার।
ফ্যাকাল্টি, শিশু বিভাগ, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা
পদাবলি
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
সব একটি একটি দরকার
হিলারী হিটলার আভী
আরও একটি ক্রসেড দরকার
আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ দরকার
আরও একটি দুর্ভিক্ষ দরকার
আরও একটি প্লাবন দরকার
আরও একটি আইয়ামে জাহেলিয়া দরকার,
আরও একটি বিশ্ব-মীরজাফর দরকার
আরও একটি আদমি গতরের নিধনকারী দরকার
আরও একটি জংলী-ড্রাকুলা দরকার
আরও একটি ডাইনোসর দরকার,
আরও একটি পাতাল-ক্ষয়ী ভলকেনো দরকার
আরও একটি উৎস-ক্ষয়ী-সূর্য দরকার,
আরও একটি আলামতধারী দরকার,
কসম- সব একটি একটি দরকার
নয়তো বিশ্ব-মানবতা বুঝবে না কোন দেশের-ই সরকার!
ভালোবাসাগুলো যেন পাথরকুচির পাতা
মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
ভালোবাসাগুলো এখন কেন আবার পাথরকুচি পাতা হয়
নতুন করে তারা জীবনের কথা কয়
স্বপ্নের মাঝে আসে কখনোবা জাগরনেও আসে
তবে কি আবার বৃক্ষ, হবে পাতা ফুল জন্ম দিবে
কি জানি !
তারা কিন্তু পাথরকুচির পাতার মতো আবার জন্ম নিচ্ছে।
একদা যাদের কাছে আমার রোজ যাতায়াত ছিল
তারা পথের বাঁকে বাঁকে কেমন করে হারিয়ে গেল
বুঝতেও পারলাম না, জানতেও পারলাম না
সেটা কি আমার অবহেলায় না তাদের দোষে
কি জানি!
তারা কিন্তু পাথরকুচির পাতা হয়ে আবার জন্ম নিচ্ছে।
বাসন্তীরা স্বপ্নে আসতো, স্বপ্নেরা আসতো বাস্তবে
অনেকদিন তাদের কোনো আসা যাওয়া ছিল না
আমিও তারপর আর মহুয়া তলায় যাইনি
বকুল তলায় থেকে গেছি কারও টানে, কিন্তু কেন
কি জানি !
তারা কিন্তু পাথরকুচির পাতার মতো আবার জন্ম নিচ্ছে।
যারা আমার কবিতায় ছন্দ হয়ে হাজিরা দিত
মৌনতায় লুকিয়ে থাকায় এখন আর কবিতা লিখি না
ঝাউবনে নির্ঝঞ্ঝাট বাতাসে আওয়াজ তোলে
তারা আর কচি সবুজ ঘাসের কার্পেটে বসে না কেন
কি জানি !
তারা কিন্তু পাথরকুচির পাতার মতো আবার জন্ম নিচ্ছে।
ঝুলে আছে নেটওয়ার্ক
রবীন বসু
সম্মুখে অস্তির দিন পড়িমরি ছোটে
বাকলের গন্ধ থেকে গাছের আহ্লাদ
কোথাও ধরেছে বহ্নি আগুনের তাপ
কুঠারে ছেদন হচ্ছে বৃক্ষদের প্রাণ
মানুষের মতিভ্রম দুষ্টচক্র জাগে
মুনাফার লোভে লোভে জিভের স্খলন
লালা ঝরে ধতুচক্রে ফেটে যায় মাটি
হিসেবি সন্ধান জানে কতটুকু জল
মেশালে দুধের গন্ধ থেকে যাবে ঠিক
এই যে বিমর্ষ দিন ক্লান্ত মনে ছোটা
ঘামের ক্ষরণ নিয়ে মানুষের হাঁটা
অন্নের সংস্থান আর গৃহের আশ্রয়
অনিকেত ঝুলে আছে ফোরজি নেটওয়ার্ক
সভ্যতা কোথায় যায় সেটাই দেখার!
ক্ষণস্থায়ী কদমফুলের প্রতি
স্বপন শর্মা
সুশোভিত পুষ্পমঞ্জরিতে-
কদম ডালে ফুটলে কেন?
ফুটলে যদি এই আষাঢ়ে
হতভাগা এই চাষাড়ে
ডাকলে কেন?
ডাকতে তোমায় কে বলেছে?
এই আমাকে বৃষ্টিবাদল বর্ষাকালে।
কদম ডালে পাতার ফাঁকে চুপিসারে
আমায় তুমি এমন করে
মিষ্টিমধুর সুবাস নিয়ে ডাকলে কেন?
টাপুরটুপুর মিষ্টি সুরে
আমায় তুমি রাখলে দূরে, ডাকলে কেন?
বর্ষা উদ্যাপন
রোহিণীকান্ত রায়
কোনো এক বর্ষায় অনাবৃষ্টির অভিশাপ
কুড়ানো পঙ্ক্তিমালা
বৃষ্টি ঝরুক, না ঝরুক
আজ বর্ষা
গ্রীষ্মের তাবৎ প্রখর তা-বতা নিয়ে
যতই আগুন ঝরিয়ে
পুড়–ক সোনাফলা মাটি
এই অভিশপ্ত শ্রাবণ
তবু আজ বর্ষা ...
কিন্তু যারা বোঝে না
এই সব কাব্যের আদিখ্যেতার ভাষা,
জানে না পুঁথি অধ্যয়ন
শুধু ত্বকে
প্রকৃতি চেখে নিয়ে
কাল-টাল করে নিরূপণ
জানিনে এবার কী করে করবে
গোবেচারি’রা বর্ষা উদ্যাপন ...
শিল্পী
অসীম মালিক
এই আলপথ ধরে চলে যাও ।
দেখবে, রিমঝিয়ম বৃষ্টিমুখর দিনে
জল-কাদা-মাটি মেখে
ঈর্ষার সেরা মঞ্চে
আবহসঙ্গীতে তাল মিলিয়ে
হাঁটু গেড়ে ধান রূইছে
আমার শিল্পী বাবা ।
বাবার কণ্ঠে ,
এত মধুর মেঠো সুর
কে এনে দিল জানিনা ।
শুধু জানি ,
বামহাতের কনুই দিয়ে
উপেক্ষিত বীজআঁটি তিন আঙুলে চেপে
ঈর্ষার চোখ আঁকে
মুন্ডেশ্বরীর পলি খুঁজে নেওয়া
আমার মাটি-প্রেমী বাবা ।
একবার মাঠের দিকে তাকাও !
আলপথে বিছানো সবুজ কার্পেট ধরে
একচিলতে আকাশ মাথায়
ওই আদিগন্ত মাঠের দিকে হেঁটে যায়
মাটির ক্যানভাসে গর্বিত বাবা ।
নির্লিপ্ত চুম্বন
আহমেদ ইউসুফ
সুখের মতন শৌখিন ব্যথায় নি®প্রভ জীবনে
যদি কখনও আলোর আলেয়া এসে ওড়ে যায়
বিপন্ন বিস্ময়ে তন্ময়ে দেখব- বিচিত্র জীবন।
কল্পিত আখ্যানে খোয়াবের দৃশ্যে বিনিদ্র রজনী
অস্পষ্ট আলোয় মলিন মুখোশে বিগত বিকেল
গোধূলির মতো এসে উঁকি দেয় পড়ন্ত বেলায়।
হাওয়ার কাফনে ফুলের রেণুকা মেখে নেব গন্ধ
মৃতের মতন সচেতন চোখে দেখব পৃথিবী
লাশের মুখশ্রী কত না সুন্দর শীতল মায়ায়।
অথচ কেউই রাখবে না কিছু বুকে ধরে স্মৃতি
ঝিলাম নদীর স্বপ্নের ভেতর ডুবে যেতে যেতে
কাশ্মীরের মেয়ে সন্তর্পণে দেবে নির্লিপ্ত চুম্বন
মৃত্যুর মতন অতৃপ্ত তৃষ্ণায়- ঢলছি যখন।
বিজলির বেগে সরে যেতে যেতে দেখব ত্রিকাল
অজ্ঞাত কবিরা কখনো বোঝেনি লীলা-লাস্যে-চলা
ধরণী; তরণী- মোহের মওকা- দাবাড়ুর চাল।
চার কুড়ি বয়স
নাসিমা হক মুক্তা
লেপা উঠোনে একজোড়া চোখ
কী যেন আঁকছে!
যে নারী শাড়ি গুঁজে সুখ বাঁধে
খানাখন্দরে
সেখানে লাঙলের পাল গরুবলদ খুঁজে
পুরো গাঁয়ে গতর খেঁটে মিলে না-
দু’খানা উর্বরা বলদ ছাড়া
তবুও চাষা ঘষামাজা করে চারা রুয়ে যায়- খেতে।
যে হাত কষে দু আনা পয়সা জন্মে
সে হাত ফুলের কুঁড়ির মত!
জীবন শরমিন্দা হলেও
মনের সুখের চেয়ে পেটের সুখে অঙ্গশোভা বাড়ে।
মানব ভাগ্যেবাঁক- নদীর মত
চার আঙুলের কপাল ভাঙলেই পরে আহ্লাদ
যেন আর ফোটে না
চার কুড়ি বয়সও মানুষ পায় না।
রিক্ত অমাবস্যা
নুশরাত রুমু
দোয়েলের শিসে সুখের অনুরণন শুনি না কোথাও
শৈতপ্রবাহের মতো মনের আকাশে সূর্য লুকিয়ে,
আস্থাহীন বিবেক ঘুমিয়ে আছে বদ্ধঘরে।
মনোবৈকল্যে বিষাক্ত আজ জীবনের রসব্যঞ্জনা।
রিক্ত অমাবস্যায় তবু চলে আহুত আলেয়ার খোঁজ।
যান্ত্রিক আওয়াজে অতৃপ্তি বাসা বাঁধে মনের কুঞ্জে।
বাঁশের ঝাড়ে বাতাস কুড়িয়ে নেয় দুঃখের ঝরাপাতা,
ফেরিওয়ালার ডাকে সাড়া নেই কারও।
তাই রোমাঞ্চহীন কবিতারা সংঘবদ্ধ হয়,
নিস্তব্ধ দুপুর কেঁদে যায় অন্তিম সুরে...
ত্রিশ বছর পরে
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ত্রিশ বছর পরে
সৈয়দ নুরুল আলম
আগামী কাল কোর্টে মিউচুয়াল ডিভোর্সের জন্য আবেদন করা হবে। ত্রিশ বছর বিবাহিত জীবনের ইতি টানা হবে। এতে করে রমিজ সাহেব বা ফরিদা বেগম কারোই আপত্তি নেই।
ঘটক ফরিদ এসে বলে, বাচ্চু সাহেবের দুটো মেয়ে আছে, যাকে আপনাদের পছন্দ তাকে ছেলের বউ করে আনতে পারবেন। এতে করে ওদের কোনো আপত্তি নেই।
রমিজ সাহেব এ প্রস্তাবে রাজি না। কিন্তু ফরিদা বেগম এ প্রস্তাবটা লুফে নেয়। বলে,ভালোই তো, যাকে পছন্দ হবে তাকে আমাদের এক মাত্র ছেলে রিয়াদের বউ করে আনব।
‘এই হয়? বড় মেয়ে রেখে কেউ কি ছোট মেয়ে মেয়ে দেয়?’
‘না দিলে নাই। আর বড় মেয়ে পছন্দ হলে তো কথা নেই। তাই, দুজনকে দেখতে অসুবিধা কী?’
‘ শোন, এটা হয় না। তুমি ফরিদকে বলো, আমরা বাচ্চু সাহেবের বড় মেয়ে দেখব।’
‘তুমি না জীবনে নিজের ভালো বোঝ নাই। এখন ছেলের ভালোও বুঝতে চাচ্ছো না।’
রমিজ সাহেবের কাছে, বড় মেয়ে রেখে, ছোট মেয়েকে চাওয়া অমানবিক, অসামাজিক। অভদ্রতা।
আর ফরিদা বেগমের কাছে লাভ-লোকসান। পন্য কেনার মতো।
বাচ্চু মাষ্টারের দু’মেয়ে। বড় মেয়ে রিতা। একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে, এখন একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করে। ছোট মেয়ে রিয়া। এন্টারমিডিয়েট কোনো রকম টেনেটুনে পাশ করে, এখন হোম ইকোনমিক্সে পড়ে। দু’জনই বিয়ের উপযুক্ত।
ফরিদ ঘোটক একদিন বাচ্চু মাষ্টারকে মেয়েদের বিয়ের কথা বললে, বাচ্চু মাষ্টার বলেছিলেন, দেখো ভালো কোনো ছেলে থাকলে। মেয়ে তো দুটোই বিবাহ উপযুক্ত।
এ কথার ওপর ভর করে, ফরিদ ঘটক নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে, নিজের থেকে রমিজ সাহেবকে বলেছে, দু’জনের মধ্যে যাকে আপনাদের পছন্দ হয়।
রিয়াদ ইরানে থাকে। ওখানে সরকারী চাকরি করে। এক মাসের ছুটিতে বিয়ে করতে আসবে। আসার পর হাতে কম সময় থাকবে। তাই ফরিদার ইচ্ছে, ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করে রাখবে। যাতে করে রিয়াদ আসার দু’চার দিনের মধ্যে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পারে।
রমিজ সাহেব নিজে একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক। তাই তিনি একজন শিক্ষকের মেয়ে খুঁজছিলেন ছেলের জন্য। ফরিদ, রমিজ সাহেবের মনের মতো একটা প্রস্তাব এনেছে। বাচ্চু মিয়া নবারুন স্কুলের হেড মাষ্টার । খুব নাম করা স্কুল। এ নামের পেছনে বাচ্চু মিয়ার অবদান অনেক। তিনি প্রায় একাই স্কুলটাকে এ পর্যায়ে টেনে এনেছেন। এখন স্কুলের আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ বাচ্চু মিয়াকে চেনে। সবাই তাঁকে বাচ্চু মাষ্টার বলে ডাকে। সব মিলিয়ে রমিজ সাহেবের খুব ইচ্ছে বাচ্চু মাষ্টারের ঘরের একটা মেয়ে নেয়ার।
নির্দিষ্ট দিনে রমিজ সাহেব মেয়ে দেখতে যান। যাওয়ার আগে ফরিদার সাথে কথা হয়, ও বাসায় যেয়ে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে কোনো আলপ হবে না। বাসায় এসে সিন্ধান্ত নেবে পছন্দের বিষয়ে।
ফরিদও বেশ চতুর। মেয়ের পক্ষকে খোলোসা করে বলেনি, কোন মেয়ে দেখতে যাচ্ছে। শুধু বলেছে, রমিজ সাহেব আপনার বাসায় এক কাপ চা খেতে আসবেন। কোনো আয়োজন টায়েজনের দরকার নেই।
এতটুকু বলাতেই বাচ্চু মাষ্টার বুঝতে পেরেছেন, ঘরে বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে থাকলে, কেন স্বামী-স্ত্রী দু’জনে একত্রে বাসায় চা খেতে আসতে চান।
ঘটকের এ কথায় বাচ্চু মাষ্টার মনে মনে খুশি হয়েছেন। আড়ম্বর করে মেয়েকে দেখাতে হবে না। এর আগে বেশ কয়েকবার রিতাকে সেজেগুজে ডলপুতুলের মত করে, ছেলে পক্ষের সামনে যেতে হয়েছে। প্রতিবারই ছেলে পক্ষের কাছ থেকে কখনও সরাসরি, কখনও ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে ‘না’ শব্দ শুনতে হয়েছে। এতেকরে রিতার মন ভেঙে গেছে। এখন আর কেউর সামনে আসতে চায় না।
মেয়ের একটা মাত্র নেগেটিভ দিক, মেয়ে লম্বায় একটু খাটো। টেনেটুনে একইঞ্চি কম পাঁচ ফিট। এছাড়া দেখতে স্বাস্থ্যবতি। শ্যামলা হলেও মিষ্টি চেহারা। পড়া লেখায়, আচার ব্যবহারে, কথাবার্তায়, খুব ভালো।
রিতা ভেবে পায় না, এই খাটো হওয়ার জন্য কি ও নিজে দায়ী?
রিয়ার বেলায় এ সমস্য নেই। মোটামুটি ওকে টলই বলা যায়। এখনই ও রিতার মাথা ছাড়িয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কেউ দেখলে, রিয়াকেই বড় মনে করবে। রিয়া পেয়েছে ওর মার গড়ন। আর রিতা পেয়েছে বাবার গড়ন।
চা খেতে খেতে রমিজ সাহেব রিতাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। বেশ শান্তশিষ্ট মেয়ে। কথা কম বলে। চেহারায় একটা লাবন্য আছে।
ওদিকে ফরিদা বেগম একবার রিতার দিকে , একবার রিয়ার দিকে তাকায়। যেন গাবতলি হাটে গরু বাছছে। কোনটা সংকর। কোনটা দেশি। কোনটার চোখ গোল, বড় বড়, আর কোনটার ছোট।
‘আন্টি আপনি তো কিছুই নিলেন না।’
রিয়ার একথায় ফরিদা বেগম বলেন, নিলাম তো মা। তাছাড়া আমি বেশি খাই না । ডায়েট করি।
‘আন্টি , আপনি এ বয়সে ডায়েট করেন? ডায়েট করবে তো আমার বয়সি মেয়েরা, যাতে মুটিয়ে না যায়। মুটিয়ে গেলেÑ
রিতা , রিয়ার কথা শেষ করতে দেয় না। বলে, তুই চুপ কর। আমি আন্টিকে সামান্য নুডুলস তুলে দিই। অল্প খেলে অসুবিধা হবে না।
রিতা একটা পেলায় নুডুলস তুলে ফরিদার সামনে দেয়। ফরিদা না করে না।
রমিজ সাহেব রিতার দিকে চেয়ে বলেন, মা, আমাকে আরেকটু দাও। খুব মজা হয়েছে। কে রান্না করেছে?
মজা হয়েছে একথা শুনে রিতার চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।
রিতা একটু বেশি করে রমিজ সাহেবের প্লেটে তুলে দিয়ে বলে, আমি রান্না করেছি।
এ সময় রিয়া বলে, আংকেল আমি রান্না ঘরে যাই না। কালো হয়ে যাব, এ ভয়ে।
ফরিদা বলে, কালো হয়ে যাবে কেন মা, তুমি তো অনেক সুন্দর। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে, কাজে একটু হাত লাগাবে। এতে মায়ের একটু সাহায্য হবে।
‘করি তো। চা বানাতে পারি। তাছাড়া কখন সাহায্য করব? আমি তো ক্লাবে লং টেনিস খেলতে যাই।’
‘হ্যাঁ আন্টি, ও ভালো চা বানাতে পারে।’ রিতা কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে।
রমিজ সাহেব বলেন, আজকের চা টা কে বানিয়েছে?
‘বড় আপা বানিয়েছে। আমাকে কিছু করতে দিলে তো।’ রিয়া মুখ গম্ভির করে বলে।
এসময় রিতার মা মরিয়ম বলেন, দুই মেয়ের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকে। আবার দু’জন দু’জনকে ভালোও বাসে।
ফরিদা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলেন, মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী। আল্লাহ আমাকে একটা মেয়ে দিলেন না।
মরিয়ম বলেন, দুঃখ করেন কেন আপা, ছেলে বিয়ে দিলেই তো ঘরে মেয়ে চলে আসবে।
এভাবে কথার পর কথা চলে। রমিজ সাহেব আর ফরিদা বেগম সবার অগোচরে মেয়ে দুটোকে মেপে নিচ্ছিলেন, কে কতটা যোগ্য।
এতসময় বাচ্চু মাষ্টার হু-হা ছাড়া কিছুই বলেননি। তাঁর মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, এবারও কি রিতার জন্য বড় একটা ‘না’ ঝুলে থাকবে?
বাসায় আসার আগেই রমিজ সাহেব বুঝতে পারেন, ফরিদা ছোট মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছে। তা না হলে, আসার সময রিয়ার থুতনি ছুঁইয়ে চুমু খাবে কেন? আর বলবেই বা কেন, লক্ষ্মী মেয়ে, আমাদের বাসায় বেড়াতে এসো?
ওদিকে রিতাকে কিছুই বলেনি। এটাও রমিজ সাহেব লক্ষ করেন।
বাসায় এসে স্বামী-স্ত্রী দুজন মুখোমুখি বসে।
‘তোমার কোন মেয়ে পছন্দ হল?’ ফরিদা বেগম উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
‘আমি তোমায় আগেও বলেছি। এখনও বলছি, ছোট মেয়ের প্রস্তাব আমি দিতে পারব না। তাই ছোট মেয়েকে পছন্দ হওয়ার প্র¤œই ওঠে না।’
‘ সেই পুরনো কথায় রয়ে গেলে? আগে বলো কোনটা কেমন দেখলে।’
‘ ছোট মেয়েকে আমি দেখিনি।’
‘মানে? তুমি কি চোখ বন্ধ করে ছিলে?’
‘ ছেলের বউ করে আনার চোখ দিয়ে দেখিনি।’
‘ দেখনি ঠিক আছে। কার কী গুন সেটা বলো।’
‘রিতা বেশ ভদ্র। নরম স্বভাবের মনে হলো। তোমার ঘরে বউ হয়ে এলে, সংসার ধরে রাখতে পারবে।’
‘আর ছোট মেয়ে?’
‘একটু ছটফট। অগোছালো মনে হলো। তা ছাড়া বহিঃমুখী মনে হলো।’
‘মানে?’
‘দেখলে না, বলল, টেনিস খেলতে ক্লাবে যায়। ঘরের মেয়ে বাইরে খেলতে যেতে পারে?’
‘আমার মতামতটা জানতে চাও না?’
‘চাইব কী। তুমি তো ছোট মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছ।’
‘কী ভাবে বুঝলে?’
‘এতবছর মাষ্টারি করেছি, মানুষের অভিব্যক্তি বুঝি না, ভেবেছ?’
‘ কী অভিব্যক্তি দেখলে আমার মধ্যে?’
‘আসার আগে তুমি যে ভাবে ছোট মেয়েটাকে আদর করে চুমু খেলে, অথচ বড় মেয়েটাকে কিছুই বললে না।’
‘তোমার তো অনেক বুদ্ধি। এতদিন তো জানতাম না।’
‘তুমি তো আমার কিছুই দেখতে পাও না।’
‘ঠিকই ধরেছ। ছোট মেয়েটাকে আমার মনে ধরেছে। খুব মিষ্টি মেয়ে। যেমন লম্বা, তেমন গায়ের রং। চোখ দুটো কতো বড় বড়। আমাদের রিয়াদের সাথে বেশ মানাবে।’
‘আর বড় মেয়েটার কোনো গুণ তোমার চোখে পড়ল না?’
‘ওতো বাট্টু। তাই আমি ভালো করে তাকাইনি।’
‘ভদ্র ভাবে কথা বলো। বাট্টু কী শব্দ?’
‘যেন তোমার নিজের মেয়ে, গায়ে জ্বালা ধরছে।’
‘নিজের মেয়ে আর পরের মেয়ে কী, সব আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে, তুমি কাউকে অপমান করতে পার?’
‘অপমান করলাম কোথায়? অন্ধকে অন্ধ বলা যাবে না?’
‘ভদ্র ভাবে বলতে পারতে। মেয়েটা একটু হাইটে কম। রিয়াদের সাথে মানাবে?’
‘তুমি আমাকে ভদ্রতা শেখাবে?’
‘প্রয়োজন হলে শিখবে।’
‘মাষ্টার মানুষ, সবাইকে ছাত্র ভাব? সারা জীবন নীতির কথা, আদর্শের কথা বলে, নিজে ঠকেছ, আমাকেও ঠকিয়েছ। এখন ছেলের বেলায়Ñ
ফরিদার কথা শেষ হতে পারে না। রমিজ সাহেব ধমকিয়ে ওঠেন, ঠকিয়েছি মানে কী? খেতে পড়তে দেইনি। শাড়ি কাপড় দেয়নি?
‘শাড়ি গওনা আর খাওয়া পড়াই সব? মেয়েদের আর কোনো চাহিদা থাকে না? সারা জীবন ছাত্রছাত্রি নিয়ে মেতে থেকেছ। আমার মন বোঝার চেষ্টা করেছ?’
‘এতদিন, এতব্যথা নিয়ে তুমি আমার কাছে থেকেছ? তা হলে চলে যাও, দেখো কোথায় বেশি সুখ আছে।’
‘আমাকে চলে যেতে বলছ? এত বড় কথা। এই থাকল তোমার সংসার। তোমার মতো তুমি থাক। আমার মতো আমি।’
‘ভয় দেখাচ্ছ? কোথায় যাবে যাও।’
‘ কোথায় যাব মানে? এই ফ্লাট তো আমার। আমার বাবা কিনে দিয়েছে।’
‘শুধু তোমার বাবা দিয়েছে, আমার কোনো অবদান নেই?’
‘যতটুকু তোমার আছে নাও। আমাকে মুক্তি দাও।’ এই বলে ফরিদা বেগম রাগে, ক্ষোপে , দাপাতে দাপাতে নিজের রুমে যেয়ে, দরজা আটকিয়ে দেয়।
রমিজ সাহেব কিছু বলেন না। নিজের রাগ কমাতে, জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে, দশ সেকেন্ড নিশ্বাস ধরে রেখে, আস্তে আস্তে ছাড়তে থাকেন।
দু’দিন পর বাচ্চু মাষ্টার মরিয়ককে ডেকে বলে, রমিজ সাহেব ফোন করেছিলেন, বললেন, আমাদের রিতাকে ওনার পছন্দ হয়েছে।
মরিয়ম এতসময় রান্না ঘরে ছিল। স্বামীর ডাকে রান্না ঘর থেকে এসে, ভিজা হাত শাড়িতে মুছতে মুছতে বলে, একটু আগে ফরিদা আপা আমাকেও ফোন করেছিলেন। উনি যে বললেন, আমাদের ছোট মেয়েকে উনার পছন্দ হয়েছে।
‘ রিয়ার কথা এখানে আসল কী করে?’
‘তাতো জানি না। আমাকে তো তাই বলল।’
‘কী বলো! আমাকে তো বললেন, রিতামাকে পছন্দ হয়েছে। তা হলে দু’জন দু’জনকে পছন্দ করেছে। কিন্তু আমরা তো রিয়ার কথা বলিনি। বড় মেয়ে রেখে , ছোট মেয়ের কথা কেন বলব? না, এটা হতে পারে না।’
‘এটা ফরিদ ঘটকের কার সাজি। ও নাকি বলেছে, যাকে পছন্দ, তাকেই আমরা দেব।’
‘ফরিদ এটা ঠিক করেনি। বড় মেয়েকে রেখে, ছোট মেয়েকে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
বাচ্চু মাষ্টারের মুখের মানচিত্র পালটে যায়।
মরিয়াম বেগম খুশি খুশি মনে বলে, এক কাজ করি, ছেলের মা রিয়াকে পছন্দ করেছে, রিয়াকেই বিয়ে দিয়ে দেই। ও একটু কম পড়াশুনা করেছে, ওকে বিয়ে দিতে আমাদের কষ্ট হবে।
‘তুমি কী বলো। বড় মেয়ে রেখে ছোট মেয়েকে বিয়ে দেব? ওর মনের অবস্থা কী হবে বুঝতে পেরেছ?’
‘রিয়াকে যখন ওরা পছন্দ করেছে, তখন রিয়ার কথাই ভাব।’
‘কখনও না। এ কথা তুমি আর মুখে আনবে না।’
‘বরাবর পুরুষ মানুষের ঘটে বুদ্ধি একটু কম থাকে। তুমি যদি চালাক হতে, তা হলে রিয়ার কথাই আগে ভাবতে।’
‘চালাক হওয়ার দরকার নেই। আগে রিতার বিয়ে হোক, তার পর রিয়ার কথা ভাবা যাবে।’
‘সব সিদ¦ান্ত তুমি একা নেবে?’
‘তুমি বুঝতে পারছ না কেন? রিতার বয়স হয়ে যাচ্ছে। রমিজ সাহেব ওকে পছন্দ করেছে, ওর কথাই আমাদের আগে ভাবা উচিত। রিয়ার কথা আমরা পরেও ভাবতে পাবর। ওর বিয়ে দু’এক বছর পরে হলেও অসুবিধা নেই।’
‘তুমি তো গোয়ারতুমি করবেই। তোমাকে তো আজ থেকে চিনি না।’
‘এখানে গোয়ারতুমির কী দেখলে? তোমার কথায় সায় দিলেই, আমি ভালো, তাই না?’
‘আমার কোন কথা থাকতে পারে না?’
‘আমার মেয়ে, আমি যা বলব, তাই হবে। তুমি নাগ গলাবে না।’
‘তোমার মেয়ে, মানে কী? তোমার মেয়ে, আমার মেয়ে না?’
‘চিৎকার করবে না। ওঘরে মেয়েরা আছে, শুনতে পাবে।’
‘চিৎকার আমি করছি, না তুমি করছ। এখন মেয়ে ফলাচ্ছো। ওদের মানুষ করেছে কে? তুমি তো সব সময় স্কুল নিয়ে ব্যস্থ থেকেছ। অন্যের ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে, সব সময় খরচ করেছ।’
‘ওরা কলা গাছ। জল হাওয়া ছাড়া এমনি এমনি বড় হয়েছে। ডাক্তার হয়েছে।’
‘ শোন, আমার এক কথা। আমি যা বলেছি, তাই হবে। ওই ছেলের সাথে রিয়ার বিয়ে দেব।’
‘তুমি যদি জেদ ধরো, তা হলে আমারও এক কথা। আমি যা বলেছি, তাই হবে।’
দুজন সমানে সমানে জেদ ধরে, রাতে না খেয়ে, মশারি না টানিয়ে, দু’জন দু’দিকে মুখ করে শুযে থাকে।
একই সময়, রমিজ সাহেবের বাসায়ও দু’জন, দু’রুমে। গত দু’দিনে আবহাওয়া আরও তিক্ত হয়েছে। আগামী কাল দু’জন কোর্টে যাবে।
শব্দমালা : আকিব শিকদার
পেনশন প্রিপারেশন
আমার যে সহকর্মীরা ফাঁকা পেলে সরকারী মাল চেটে খেতো, কৌশলে
অসৎ উপার্জনের পথ করে নিতো, তাদের সন্তানেরা
ভেটকি মাছের মতো বোকা ভেবলা। তাদের সংসারে অতৃপ্তির আগুন।
কোনদিন দু’পয়সা ঘুষ নেইনি। কেন নেবো! আমি তো কারও
অপকর্মের সহায়তাকারী হতে চাই না। উনত্রিশ বছর ছিলাম
রোডস এন্ড হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়ার।
আমার গোপন দানে কত পথশ্রমিকের সংসার চলেছে, ওদের সন্তানেরা
মানুষ হয়েছে। প্রতিদানে বিধাতাও আমায় কম দেননি।
বড় মেয়েটা ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফিতে পি.এইচ.ডি করে এখন
কানাডায় সেটেল। ছেলেটা ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে ইতালীতে। তারও আছে
ফুটফুটে দুটা সন্তান।
কাউকে ঠকাইনি আমি, কারও পথে কাঁটা হয়ে দাড়াইনি।
আমার অধিনে কাজ করা শ্রমিকেরা যখন
রাস্তা মাপার তিন পা ওয়ালা ক্যামেরামার্কা যন্ত্রটা টেনে ঘেমে যেতো,
নিজের রুমালে তাদের শরীর মুছেছি। বিনিময়ে পেয়েছি
শ্রদ্ধামাখা ভালোবাসা।
কোনদিন কর্মচারীদের ধমকাইনি, তারা ভুল করলেও না।
ক্ষমতার দাপটে রাগ দেখানো তো
ইতর লোকের কাজ, ক্ষমা করতে জানে মহামানবেরা।
টাকা-পয়সা অনেক জমিয়েছি জীবনে। ঠিক করেছি পেনশনের টাকায়
এক সেট ভালো কোট-পেন্ট বানাবো টপটেন থেকে, এলিফেন্ট রোড ছেঁকে
কিনবো এক্সক্লুসিভ জুতা এক জোড়া।
দামি ব্রিফকেসে কিছু টাকা ভরে, ডাইরিতে পরিচিতজনদের
নাম ঠিকানা লিখে নামবো ভ্রমনে। আমাদের যত আত্মিয় আছে
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়ানো, তাদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে
এক রাত থাকবো। প্যাকেটে ঝুলিয়ে নেবো
কিছু ভালো মিস্টি আর ছোটখাট উপহার।
জীবনটা উপভোগ করতে চাই। আত্মিয়দের সাথে হাসিমাখা সেলফি তুলে
ফেইসবুকে আপলোড দিতে চাই। ইউটিউবে রাখতে চাই
সমবেত আড্ডার কিছু ভিডিও। সুর্যটা ডোবার আগে যেমন
মেঘগুলোকে সোনালী আভায় সাজায়, আমি চাই
জীবনের শেষ দিনগুলো তেমনি রঙ্গীন রঙে রাঙাতে।
ছড়ানো ছিটানো সংসার
বাইরে বৃষ্টি। জানালায় মুখ রেখে
তাকিয়ে ছিলাম।
ট্রেন থামলো স্টেশনে। যাত্রিদের ঘিচঘিচ,
ব্যাগ বস্তার টানাটানি, কুলি আর হকারের চিৎকার।
এরই ফাকে দেখি প্লাটফর্মে
তিনজন ভিক্ষুক; স্বামী-স্ত্রী-সন্তান।
লোকটার একটা পা
হাটু অব্দি কাটা, দাড়িয়েছে স্ক্রেচে ভর করে।
হাতে ভিক্ষার থালা। পাশে তার বউ, সন্তান কুলে
ধরে আছে থালাটিতে।
কুলের শিশুটা হাত উচিয়ে
বাবা মায়ের উপর ছাতা মেলে রেখেছে।
ট্রুংট্রাং শব্দে থালাতে কিছু পয়সা
ছুড়ে মারলাম। অমনি কী আনন্দ শিশুটার।
দম্পত্তির মুখেও তৃপ্তির হাসি। একটা ছাতার নিচে
একটা সংসার, কতো পরিপাটি।
সংসার আছে আমারও, ছড়ানো ছিটানো সংসার।
সকাল আটটায় নাকে মুখে দু’মুঠো খেয়ে
কর্মস্থলে ছুটি। সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বাধি গলার টাই।
মিম, মানে আমার বউ, তার
নয়টা পাচটা অফিস।
ড্রেসিংটেবিলে ব্যাস্ত হাতে চুল আচড়ানোর বেলায়
গলাবাজি করে- ঘরদোর সামলিয়ে
কোনদিন ঠিক টাইমে অফিসে যেতে পারলো না।
রাতে বিছানায় উলটো পাশ ফিরে শুয়। গায়ে হাত বুলিয়ে
অভিমান ভাঙাই যখন, খেকিয়ে ওঠে।
আমাদের একমাত্র মেয়ে, সুহা যার ডাকনাম, একলা ঘরে
টিভি দেখে দেখে চোখে জ্বালা ধরে গেলে
জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখে।
মেঘদের দিকে তাকিয়ে নিজের তুলার পুতুলটার সাথে
কথা কয়, কুলে নিয়ে বসে থাকে।
ট্রেনের হুইসালে সম্বিত ফিরলো। টিকেটের সাথে
নাম্বার মিলিয়ে দুজন যাত্রি বসেছে সামনের সিটটায়।
বৃদ্ধ মা আর পুত্র। ছেলেটার হাতে
এক্সরে প্লেট, প্রেসক্রিপশন, ঔষধপত্রের পুটলি।
বৃদ্ধার ডান হাতে কনুই অব্দি ব্যান্ডেজ,
গলাতে ঝুলানো। সম্ভবত ডাক্তারখানা থেকে ফিরছে।
মনেপরলো আমার মায়ের হার্ডএ্যাটাকের দিনগুলোতে
হাসপাতালেই যেতে পারিনি।
“আম্মার অসুখ, গ্রামে যাবো”- বউয়ের অভিমত
নিতে গেলে জানালো- “তোমার অন্য ভাইয়েরা
কেন আছে! বাবা কী করেন! তোমার না অফিসে
কাজের চাপ?” আরও কতো জ্ঞান দান।
হায় রে স্বজনবিমুখতা! হায় রে শহরবাস!
ট্রেন ছুটছে তিব্র, বাতাসে উড়ছে চুল।
আমি জানি... ওঠোনে পা রাখতেই
মা আমাকে দূর থেকে দেখে শুয়া ছেড়ে
তরিঘরি বসবে।
প্যারালাইজড পা দুটি নিয়েই বিছানা ফেলে
উড়ে আসার ব্যর্থ চেস্টা করবে।
কেমন আছি জিজ্ঞাসার পরপরই বলবে-
“বউমাকে দেখছি না কেন? নাতনিটাকে নিয়ে এলে কি হতো?”
কাধের ভারি ব্যগটা মেঝেতে রেখে
দীর্ঘশ্বাস ছাড়বো যখন, তজবী জপা থামিয়ে বাবা বলবেন-
“আর কতো শহরে থাকবি! তোদের ছাড়া বাড়ি ঘর
কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে রে...”
ব্রেকাপ বৃত্তান্ত
পকেট পয়সাহীন। প্রেমিকার জন্মদিনে
দামী উপহার না দিতে পারলে ব্রেকাপ। চিন্তিত মুখে ছেলেটা
পার্কের দিকে পা বাড়ালো। অবৈধ সঙ্গমরত
কোনো যোগল পেলে গোপনে ছবি তুলে রেইড দেবে।
কানের নাকের গলার অলংকার খুলে নিয়ে বলবে-
“চুপ থাক... ঝামেলা পাকালে ছবি ফাস করে দেবো।”
ঝুপের আড়ালে অর্ধউলঙ্গ জুটির
পেচ মেরে শুয়ে থাকা ভিডিও করে ছেলেটা কাছে গিয়ে দেখে
আরে! আরে! এযে তার কলেজপড়–য়া বোন, কোচিং এর নাম ধরে
প্রেমিকের সাথে যৌবন জ্বালা মেটাতে এসেছে।
থতোমতো খেয়ে বোন বললো-
“কাউকে বলিস না ভাই।”
আহা লজ্জা...! কী দেখলো! মন থেকে বিষয়টা মুছতে না পেরে
ছেলেটা গেলো ফ্রেন্সিডিলের সন্ধানে। নেশা করে মটকা মেরে পরে থাকবে।
দু’বুতল মাল কিনে দাম দেবে যখন, দেখে, হায় এ কী!
মাদক বিক্রেতা লোকটা তার বাবা। সে জানতো তার বাবা
একজন ঔষধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টটেটিভ।
বাবা বললেন- “কী করবো বল? উপরি ইনকাম,
তোদের জন্যই তো করি...।”
ছি ছি! এমন বাবার ছেলে হয়ে মিছেমিছি
নিজেকে ভালো মানুষ সাজিয়ে রেখে কী লাভ!
মনের দুঃখে ছেলেটা গেলো বেশ্যা পাড়ায়। মাগীর বুকে
বুক মিশিয়ে শুয়ে থেকে যদি দুঃখ কমে।
বেশ্যার দালাল তাকে একটা রুমে ঢুকিয়ে
দরজা এটে দিলো। আবছা আলোয়
দেখে ঘরের কোনায় বসে থাকা মহিলাটা তার মা।
মাকে সে জানতো কর্পোরেট অফিসের চা নাস্তা রাধুনী। মা বললেন-
“ভুল বুঝিস না বাপ, আয়ার কাজে কতো আর আয় হয়...”
ছেলেটা ঘৃণায় মুখে দলা হওয়া থুতু
ঢোক গিলে উঠে দাড়ালো। এমন সময়
মুঠোফোন বেজে উঠতেই খিলখিল হেসে প্রেমিকা জানালো-
“জন্মদিনের দাওয়াত খেতে এসে বাবার বন্ধুর ছেলে
এংগেজমেন্ট রিং পরিয়ে গেছে, আগামী সপ্তাহে বিয়ে।”
দুটানায় দিনযাপন
বাবার ক্যান্সার। গলায় ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজে রক্ত।
এগারোটি থেরাপিতে চুল সাফ। চামড়ায় কালো দাগ। বিদেশে নিয়ে
ভালো ডাক্তার দেখালে হতো। টাকা কোথায়...
বউকে ডেকে জানতে চাই- “কী করতে পাড়ি?”
বউ বলে- “যা ভালো মনেহয় করো। ”বাবা যখন যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠে,
চিংড়ি মাছের মতো দলা পাকিয়ে যায়, বড়ো মায়া হয়।
সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িটা বেচে দেবো। কিন্তু, বউ সন্তান নিয়ে
থাকবো কোথায়! এদিকে বাবার মৃত্যু যন্ত্রণা, ওদিকে একমাত্র ছেলেকে
অকুল সাগরে ফেলা।
চিকিৎসার অভাবে বাবা মরলে লোকে বলবে- “কেমন ছেলে!
বিনাচিকিৎসায় বাবাকে মারলো।” বাড়ি ভিটা বেচে দিলে
কুৎসা রটবে- “কেমন বাপ! সন্তানের কথা ভাবলো না!”
অসুস্থ বাপ বাড়ি বিক্রির গুঞ্জন শুনে বলেছিলো- “আমি আর কদিন!
তোরা সুখে থাক বাবা, নাতিটার খেয়াল রাখিস।”
কার খেয়াল রাখবো, নাতিটার? নাকি অসুস্থ বাবার? ভাবতে ভাবতে
কাচের গ্লাসে বেলের শরবতে চামচ নাড়ছিলাম।
হাত পা কাপছে, মুখ ঘামছে। শরবতে তিন ফোটা বিষ
মিশিয়ে দিয়েছি আমি। তিব্র বিষ, মুখে নিলে মৃত্যু।
মনেপড়লো ছোট বেলায় ম্যালেরিয়া জরে
সতেরো দিন ছিলাম হাসপাতালে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে
বাবা তার প্রিয় মোটরসাইকেলটি বেচে দিয়েছিলো।
কই.. একবারও তো বিষমাখা চকলেট খাইয়ে
মেরে ফেলার কথা ভাবেনি। হাতের চামচ থেমে গেলো।
বাবার বানানো বাড়ি ভিটা বেচেই বাবাকে বাচাবো।
পরক্ষনে মনেপরলো ছেলের
পড়াশোনা, বউয়ের আবদার, সংসারের নানা খরচ।
বেলের শরবতে বিষ। না... বাবার হাতে কিছুতেই
বিষের গ্লাস ধরিয়ে দিতে পারবো না।
বাবা কতো ¯েœহে মানুষ করেছে আমাকে। শহরে রেখে
শিক্ষিত করেছে, মোটা অঙ্কের ঘুষে চাকরী জুটিয়েছে, তার হাতে
তুলে দেবো বিষের গ্লাস!
বিষমিশ্রিত শরবত পিরিচে ঢেকে বাবার বিছানার পাশে রেখে
চলে গেলাম দুর। যেন কিছুই জানি না, জানতেও চাই না।
যেন বাড়ি থেকে পালাতে পারলেই বাচি, এমনকি পৃথিবী থেকেও...
আমার ছেলেটা গিয়েছিলো বাবাকে ঔষধ খাওয়াতে।
রুগির পথ্য আপেল কমলা আঙুরের বেশি অংশ
নাতিকে স¯েœহে খেতে দিতো বাবা, আজ দিলো শরবত ভরা গ্লাস।
নাতি এক চুমুক মুখে নিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়লো। তারপর...
বাবা বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, ছেলে মেঝেতে
পড়ে আছে নিস্তেজ। কী করবো! হায়... কোন দিকে যাবো আমি...!
সঙ্গমের প্রস্তুতি কিংবা বারা ভাতে ছাই
আয়নার সামনে তাকে জড়িয়ে ধরে নিতম্বের মাংসে
চাটি মারলাম। ব্যাচেলর মেসের ছেলেগুলো
উত্তেজনায় পরস্পরের দিকে তাকালো।
ওর উরনাটা বুক থেকে তুলে আলনায় ছুড়ে মারতেই
ছেলেগুলো নতুন কেনা দূরবীন নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করলো।
দূরত্বের দরুন ওদের ছ’তলার ছাদ থেকে
আমাদের তিনতলার রুমটা আবছা লাগে।
ঘরে লাইট জ্বলছে আর আমি সঙ্গমের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
দরজা-জানালা বন্ধ। কাচের জানালা; খোলা আর বন্ধ
যদিও একই কথা।
উত্তেজনায় ছেলেগুলোর
জিভে লালা, শরীর কাঁপছে। বিছানাতে বসে
বউ নিজেই নিজের ব্রা খুলছে। পাশের বাসায় দুটি মেয়ে
ফিসফিসিয়ে একে অন্যকে কি যেন বললো।
আমি বউয়ের চিৎ হয়ে শুয়ার উপর
হাটু গেড়ে বসেছি।
মেয়ে দুটি তাদের রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে
উকি মেরে দেখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ওখান থেকে
আমাদের বিছানার অর্ধেক দেখা যায়।
এবার জানালার পর্দাটা টেনে দিলাম। পর্দার উপর
আমার ঘাড়ে তুলে রাখা বউয়ের পায়ের ছায়া।
ছেলেগুলোর একহাত দূরবীনে, অন্যহাতে
পুরুষাঙ্গ ধরা।
মেয়েদের চুলার উপর
কবুতরের মাংস পুড়ে গন্ধ, সেদিকে খেয়াল নেই।
আমরা আদম-হাওয়ার প্রথম প্রণয়ের মতো দুজন দুজনকে
জড়িয়ে ধরলাম, যেন দুটি অজগর লতিয়ে আছে।
রাধাকৃষ্ণের নদীতে নৌকা ডুবিয়ে ডুব সাতারের মতো
আলিঙ্গন করলাম, যেন জলের আড়ালে দুটি ডলফিন জলকেলি করছে।
হঠাৎ দেয়ালের সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিতেই
নামলো অন্ধকার।
তখন ছেলেগুলোর রক্ত-জোয়ারে ভাটা, আর মেয়েগুলোর
বারাভাতে ছাই।