শাহেন শাহ
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
শাহেন শাহ
নন্দি আরজু রুবি
ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো শাহেন শাহর চোখে
পড়ছে। বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে পাশ ফিরলো। অনেক রাত অবধি ঘুম হয়নি, খিদেয় ছটফট করেছে। কাজ নাই, কাল দুপুর থেকে শুধু পানি খেয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না, পিপাসা পেয়েছে খুব ইস্টিশনের কলটাও নষ্ট,শূন্য বোতল পানি আনতে যেতে হবে দূরে। পেটের ভিতরে ক্ষুধার জ্বালায় চো-চো করছে।
ঠিক সেই সময় আকালীর ডাক, ‘‘গুরু ওঠো বেলা বেড়েছে, আর কত ঘুমাবে।’’
চোখ কোচলে উঠে বসলো শাহেন শাহ তার আধ ছেঁড়া প্যান্টের দড়ির গিঁটটা আর একটু কষে বেঁধে নিলো। পেটে খাবার নাই ঢিলে হয়ে গেছে।
আকালী বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল ‘‘কও তো গুরু, কী খবর আছে?”
জানিনে, ‘‘তুই বল।”
ওই যে মাঠের ওপাশের গ্রামে আজ বিয়ের মেজবানি, যাবে?
শুনেই শাহেন শাহর খিদে বেড়ে উঠলো, দোনোমোনো করে বললো ‘‘হ্যাঁ যাবো, চল যাই দুজনে।”
এটা রাজশাহীর সীমান্তবর্তী ছোট একটা ইস্টিশন ‘‘বীরকুৎসা” ভিড় নাই চারিদিকে খোলা, মাঠের পর মাঠ ধানের আবাদ। কিছুদুর গেলেই দেখা যায় বিশাল পরিত্যক্ত হাজারদুয়ারি বীরকুৎসা রাজবাড়ী। এরপরে আর একটা ইস্টিশন আছে তার পরেই ভারতের সীমান্ত।
প্রতিদিন একটা ট্রেন যাতায়াত করে। এখানে রুটির দোকানে কাজ করে শাহেন শাহ। দোকানের মালিক আকবর আলি গরীব মানুষ দোকানের যৎসামান্য আয় দিয়ে কোন মতে সংসার চলে।শাহেন শাহ নাম তার দেওয়া।
আকালী চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটে।
সকালে ট্রেন যাওয়ার সময় যাত্রীরা রুটি সিঙাড়া চা খায় তাতেই কোনমতে এখানকার দোকান চলে। মাত্র তিনটে দোকান দুটো চা আর এটাতে রুটি সিঙাড়া বিক্রি হয়।
বেশ কিছুদিন ট্রেন বন্ধ তাই দোকানও বন্ধ। খাবারের খুব কষ্ট।
শাহেন শাহ শূন্য দোকানে রাতে ঘুমায়। দুদিন খাবারের কোন জোগাড় নাই। কদিন আকবর আলি খাবার দিয়েছে, এখন আর পারছে না।
তার অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নাই, এখানে ছোট্ট ইস্টিশনে মায়াপড়ে গেছে। নিজের ঘর বাড়ি বাবা-মা কোন ঠিকানা জানা নাই।
সুবোধ শান্ত চেহারা মায়াবী মুখ শাহেন শার, বড় বড় চোখে সারল্য গলায় মাশাল্লাহ দারুণ সুর। আগে ট্রেনে গান গাইতো যাত্রিরা খুশি হয়ে যা দিতো তাতেই চলে যেতো। এই ইস্টিশনে এসে একেবারে থেকে গেছে, ভেসে বেড়াতে আর ইচ্ছে করে না। আকালীও শাহেন শাহর মতো তারও কেউ নেই। ইস্টিশনে অন্ধ এক ভিক্ষুকের সাথে ভিক্ষে করতো। সে মারা যাওয়ার পরে চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে। দুজন প্রায় সমবয়সি সবে কৈশরে পা দিয়েছে।
সাতপাঁচ ভাবার সময় নাই, রংচটা গেঞ্জি তালি দেওয়া প্যান্ট আর খালি পায়ে দুজনে হাঁটা শুরু করলো, আজ খুব গরম, রোদের তেজ চড়চড় করে বেড়ে উঠছে। তাতে আবার দুদিন দুজনের পেটে দানাপানি কিচ্ছু জোটেনি।
চারিদিকে সবুজ চারা ধানে মাঠ ভরে আছে। কোনো গাছ নাই ছায়াহীন খেতের সরু আলপথ ধরে হেঁটে চললো সটকাট। রোদে কাদামাটি থেকে ভাপ উঠছে ভ্যপসা গরম। পেটের খিদে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চললো। মনে আশা গেলে কিছু খাবার জুটবে।
মাঠ পেরিয়ে ঘামে ক্লান্ত শ্রান্ত দুই কিশোর মেজবান বাড়ির প্রায় কাছে এসে পৌঁছালো। দূর থেকেই ভাত আর মাংসের ঘ্রাণ নাকে ঝাপটা দিলো। পেটের ভিতর রাক্ষুসে ক্ষুধাটা নড়েচড়ে জাকিয়ে বসলো। শাহেন শাহ প্যান্টের দড়ি আর একপ্রস্ টাইট করে নিলো। দুজনের চলার গতি শ্লথ হয়ে গেছিলো। খাবারের ঘ্রাণ তাদের শক্তি এনে দিলো। ক্ষুধার্ত দুজনের চোখাচোখী হতেই হাসি উপচে পড়ছে খুশিতে। এই খুশি আনন্দ একমুঠ ভাত খেতে পাওয়ার আশা।
হায়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্দশা মানুষকে কত অসহায় করে দেয় সে শুধু ক্ষুধার্ত কর্মহীন মানুষ জানে।
ক্ষুন্নিবৃত্তির তাড়না মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। ক্ষুদ্র কাজ অন্যায় অনৈতিক কাজ করতে দ্বীধা বোধ করে না।
বড় প্যান্ডেল ভদ্র সুবেশী লোকজন খাওয়া দাওয়া করছে। হতদরিদ্র দুই কিশোর ধীর পায়ে প্যান্ডেলের গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন খেকিয়ে উঠলো এই যা ভাগ কোথা থেকে সব ভিক্ষিরি এসে জুটেছে। যা ওদিকে...
দুজন দূরে এসে গাছের নীচে বসে রইলো। দেখছে মানুষ খাচ্ছে তাদের হাক ডাক ভাত আনো মাংস, ডাল, মাছভাজা, দই..
ক্ষুধা আর পিপাসায় কাতর হয়ে দুজন প্রতীক্ষায় বসে রইলো। তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকালো না।
উচ্ছিষ্ট এঁটোকাঁটা একজন ডালায় করে এনে ঢেলে দিয়ে গেলো পথের কুকুর গুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। শুকনো মুখে শাহেন শাহ বললো চল আকালী ফিরে যাই। এখানে খাবার দেবে না কেউ। এতোটা পথ ফিরে যেতে হবে তৃষ্ণায় কাতর আকালী বললো আর একটু দেখিনা অপেক্ষা করে! বেলা প্রায় গড়িয়ে এলো...
একটা দীর্ঘছায়া পড়লো দুই কিশোরের গায়ে, কেউ এসেছে ওদের পেছনে। খাবারের গন্ধ ছাপিয়ে একটা অন্য মা মা গন্ধ তাদের নাড়িয়ে দিলো। পিছনে তাকিয়ে দেখলো একজন মাঝবয়সি মহিলা, পরনে পুরাতন ছেঁড়া শাড়ি। আঁচলের তলে থালায় ভাত তরকারি। হয়তো এই বাড়িতে কাজ করে। মহিলা ভাতের থালা বের করে দুজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও বাবা আহা মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।”
এই স্নেহের পরশ টুকু পেয়ে অন্য এক তৃষ্ণা জেগে উঠলো মমতা দরদ এই যে অচেনা তবুও মাতৃত্বের স্নেহময় ভালোবাসা দুজনের চোখে জল চলে এলো। শাহেন শাহ বলল, মা তুমি খাবে না।”
তোমরা দুজনে ভাগ করে খাও। আমি খাবো না বাবা।
আকালী আর শাহেন শাহ পেট পুরে খেলো। মাগো গেলাম বিদায় নিয়ে দুই কিশোর ক্ষেতের আল দিয়ে ফিরে চললো। অপরিচিত মা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো...
হঠাৎ দূরে ট্রেনের হুইশেলের শব্দ শোনা গেলো, ট্রেন চলাচল আবার শুরু হয়েছে..
দুই কিশোর খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, বাতাসে তার উল্লাস খেতের আল পথে দৌড়াচ্ছে দুহাত ছড়িয়ে একরাশ সবুজের ভিতর যেন উড়ছে..।
শব্দমালা
শব্দমালা
মমতাজ রোজ কলি
ডাঙা
এক সাদাসিধে নদী তুই...
ঢেউ নাই, গর্জন নাই, ভাঙনের ক্ষিধেও নাই।
একবার মাছ হয়ে পুচ্ছ ভিজে’ই ছিলাম
পাখির মতো ওড়াউড়ি ছেড়ে...
হাত বাড়াইয়ে ছুঁই জমানো আক্ষেপগুলো তোর
পড়ি অনামিকা রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলে অক্টোপাস রিং।
দু’হাতের ঝিনুক মুঠোয় আগলেই তোর
বালুকাময় মুক্তোর উচ্ছ্বাস।
তাঁরার মতো...
ভেসে থাকবো বলে শিখেছি সাঁতার!
অথচ ডাঙা ছুঁতে গেলেই আঁটকে দিস পা
বুকে জমানো শেওলার ঝাঁকে...
দেয়াল
জবরদস্তি!
কেরে নেয় রাজ্যপাট লুন্ঠন করে সম্ভ্রম
ছিনিয়ে নেয় অর্থ; কণ্ঠস্বরও...
তাইতো! ময়না, টিয়া খাঁচায় বুলি হারায়
শেখে অন্যের কথা...
শঠ-কপট-লোভীর নৃশংসতা কেরে নেয় অস্তিত্ব।
কিন্তু! অধরা কোকিল, বউ-কথা-কও মুক্ত ;
ডাকে আপন ভাষায়...
আমরাও দেইনি কথার ঝুড়ি-
তাই তো! বুকের সবুজ ঘরে লাল দরজা আঁকি....
বন্ধন
সবুজাভ হলদে নীল। কতো নামে ডাকি তোকে!
কতো আদরে আদার গেলাই। এক বালিশে গল্প বুনি, এক আহারের কাব্য চষি।
অথচ দিনশেষে ফসলের নামে চিটা তুলি ডোলে!
তুই হয়ে যাস সবুজ শর্ষে ক্ষেত! দূরের কোন আবাদি মাঠে।
আমি নিরন্ন চাষির ফুসফুস বুকে দাঁতে খড় কামড়ে ক্ষয়ে যেতে থাকি
কৃষ্ণকায় জোস্নার মতো কোনো ঘন গাঢ় অন্ধকার স্পর্শে...
আগুনে আগুন জ্বলে
ভীষণ দাবানল...
সে ঘুমে আমারও নিষ্পত্তি ছিল বটে।
শিশিরের হিমানী মেখে কলা পাতার ভোজন কাকজ্যোৎস্না ভালোই জানে...
তবু পুড়ছে বুক- আগুনে আগুন জ্বলে!
ধ্রুপদ রাগে তান্ডব কৈলাশে চষে বেড়ায়
আপন ভূমি নিশ্চিহ্ন শালুকের ডাটা....
ঠিক যাতা নয়; ছাঁকন ছিদ্রই জানে
আটার আকার সকার.....
সম্পর্ক
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
সম্পর্ক
আশ্রাফ বাবু
চুয়াডাঙ্গা ফেরার জন্য সৈয়দপুর স্টেশনে একটু তাড়াতাড়ি চলে আসে জেসমিন। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। রিসার্ভেশন যদিও কনফার্মড, তাও কয়দিন ধরে যেভাবে সারা নীলফামারী তথা দেশে রাজনৈতিক ক্যাচাল নিয়ে উত্তাল, তাতে মনে সংশয় ছিলো আজও ট্রেন চলবে কিনা। একদিনের নীলফামারী সফরে কাজগুলো শেষ করতে গিয়ে সারাদিন খাওয়া হয় নি। ভেবেছিল, তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছে কিছু খেয়ে নেবে। উফফ, আসবার সময় যা অভিজ্ঞতা হলো, এখনো মাথার রগ দপ দপ করছে।
মাহিন্দ্রের পেছনের সিট থেকে ড্রাইভারকে যতটুকু দেখেছি, তাতে রোগাটে চেহারা, মুখে দাড়ি, চুল অবিন্যস্ত, বয়স ৪০-র কাছাকাছি। গাড়িতে ওঠার পরে জেসমিন শুধু বলেছিল, ‘আপনি এই পথ দিয়ে কেন যাচ্ছেন, সামনের রাস্তা ধরলে হতো না’। প্রতিদিন যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এই মধ্য চল্লিশেও নিজেকে নিরাপদ লাগে না। কিন্তু ড্রাইভার লোকটি বেশ বীরত্বের সঙ্গে উত্তর দেয়,
‘জানেন আমি বিশ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। এই শহরের অলি-গলি সব চেনা। এখন তো সব মানুষ গুগল রুট ম্যাপ চেনে। ওসব আমার লাগে না’।
এরপর সারা রাস্তা দেশের পরিস্থিতি, ডি-মানিটাইজেসন, নেতা-নেত্রীদের কার্যকলাপ নিয়ে বকর বকর করে গেল। বলার সময় এক হাত স্টিয়ারিঙ্গে রেখে অন্য হাত হাওয়ায় উঠিয়ে এইস্যা ছুঁড়ছিলো, জেসমিন ভাবলো, লোকটি নিশ্চয়ই কোন ইউনিয়নের নেতা। তারপরেই খটকা লাগলো,
‘জানেন, এরপর শুধু দুই শ্রেনীর মানুষ থাকবে, একশ্রেনীর আয় লাখ টাকা এবং অন্য শ্রেনীর কোটি টাকা। দারিদ্রসীমার নীচে কোন মানুষ থাকবে না। পুরো ক্যাশলেস হয়ে যাবে। রাস্তায়, সোনা পরে থাকলেও কেউ ছুয়ে দেখবে না। ঘরে বেশী টাকা রাকলেই সরকার জেনে যাবে। তাই চুরি, ডাকাতি, ঘুষ সব ভ্যানিস’।
জেসমিন বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তাই নাকি?’। বলেই ভাবলো, এই রকম কথাতো শোনেনি কোথাও। জেসমিনের উত্তর পেয়ে লোকটি আরও উৎসাহিত হয়ে প্রায় সমস্ত শরীরটাকে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরিয়ে বলে ওঠে,
......‘হ্যাঁ, জানেন না চীন আর রাশিয়াতেও একই নিয়ম। ওখানে সবাই সমান’।
......‘আরে আরে সামনে দেখে চালান, গাড়ি আসছে তো’।
রীতিমতো বজ্রকঠিন স্বরে বলে, ‘আপনার ভয় নেই। না দেখেও চালাতে পারি’। এবার লোকটিকে ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। আজ সুস্থমতো স্টেশনে পৌঁছাতে পারবে তো?
.........‘জানেন, এখন দেশের এই অবস্থা কেন? এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের পাপের ফল, বুঝেছেন। যেমন, বাবার পাপের ফল নিজের সন্তানকে পেতে হয়, তেমন। দেখছেন না, এখন মানুষ নিজের কাছের জনদের থেকে বাইরের লোকের কথা বেশী শোনে আর বিশ্বাস করে। সেদিন আমার বউকে, মা বল্লো, শুটকি রান্নাতে বেশি ঝাল দিতে। বউ না শুনে নিজের মার কথামতো কাচামরিচ দিলো। ব্যাস, তেলে পুড়ে এমন রং, কেউ খেয়ে মজা পাইলনা। তাই তো রবীন্দ্রনাথঠাকুর বলেছিলেন, মঙ্গলে উষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। মানে, যেখানে খুশী চলে যা। সবাই জাহান্নমে যা, বুজলেন?’।
দুত্তোরী, এতো রীতিমতো আধ-পাগলা বা মাতাল। সমাজতন্ত্র, শ্বাঁশুড়ি, শুটকি, রবীন্দ্রনাথ, মিলে মিশে চচ্চরি বানিয়ে ইচ্ছে মতো যুক্তি দিয়ে চলেছে। জেসমিনের আতংকে হাত-পা অবশ। কি করবে এখন? বেশী উচ্চবাচ্চ করলে যদি ক্ষেপে গিয়ে নামিয়ে দেয়...অগত্যা চুপ করে বসে থাকলো। গাড়ি এদিক ওদিক এঁকে–বেঁকে হর্ন দিতে দিতে এগিয়ে চললো। জেসমিনের মনে হচ্ছিল পিছনে পুলিশের তাড়া খেয়ে হিন্দী সিনেমার ঢঙ্গে কিডন্যাপাররা ওকে নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে পালাচ্ছে। একেবারে দম বন্ধ অবস্থা!
নীলফামারী থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে সৈয়দপুর স্টেশনে ঢুকিয়ে ড্রাইভার যেই দাঁড় করিয়েছে, জেসমিন লাগেজ নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে একেবারে বাইরে। অন-লাইনে পেমেন্ট করা ছিল, তাই রক্ষা। তারপরে, একটুও সময় নষ্ট না করে একেবারে স্টেশনের ভেতরে। কি স্ট্রেঞ্জ অভিজ্ঞতা! উত্তেজনা টের পাচ্ছে এখনো।
ঘড়িতে দেখলো, ৫.৩০। সময় আছে অনেক। কফি খাবে বলে এদিক-ওদিক ঝকঝকে স্টলগুলিতে উঁকি দিল। থরে থরে সব খাবার। কিন্তু দাম ও মান কোনটাই ঠিক পছন্দসই নয়। তাই পাশ কাটিয়ে কোনের দিকে একটি স্টলে গিয়ে কফি চাইল। সেখানে দুটি ছেলের মধ্যে একজনকে বেশী সপ্রতিভ লাগলো, তার বয়স,২৮-২৯।
কফি খেতে খেতে হঠাৎ দূরের ঝকঝকে স্টলগুলির দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো,
......‘এখানে রাতের খাবার কোথায় ভাল পাব?’ ছেলেটি স্টলের কাঁচঘেরা কাউন্টারের উপর ঝুঁকে প্রায় ফিসফিসে জানালো,
......‘একটাও ভাল না’।
...... ‘তাহলে, কোথায় পাবো?’, বেশ শুকনো মুখে জেসমিন বলে ওঠে।
...... ‘আপনি কি খাবেন? মাছ না মাংস?’
...... ‘নিরামিশ’
...... ‘তাহলে আপা, এই সোজা প্ল্যাটফর্মের বাইরে যান। দেখবেন, (সন্দু) হোটেল। সুন্দর চালের ভাত, রুটি, দুটোই ওখানে পাবেন’।
...... ‘এ বাবা, লাগেজ আছে তো। আচ্ছা ফোন-এ অর্ডার করলে দিয়ে যাবে না?’
...... ‘না আপা। চলে যান না, কাছেই তো। এখানে লাগেজ রেকে যান। আমরা আছি, দেখে রাখবো’।
জেসমিনের সন্দিহান মন জানালো, খবরদার, বিশ্বাস কোরোনা। যত মিষ্টি কথা, তত খারাপ অভিসন্ধি। তাই চালাকি করে বলে,
......‘অতদূরে আর যাবনা। এখান থেকেই নিয়ে নিচ্ছি’। কফির কাপটা পাশের ডাস্টবিনে ফেলে ট্রলি ব্যাগের হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই, ছেলেটি কাউন্টার থেকে বেড়িয়ে এসে,
......‘চলুন, আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। এই কালু দোকানটা কটু দেখিস তো’।
এরপর, জেসমিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, ট্রলিব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করে।
......‘আরে আরে করছো কি? না না আমি নিচ্ছি’, জেসমিন বেশ জোরেই বলে ওঠে। ছেলেটি হেসে বলে,
......‘ ভয় নেই, আসুন না’। কিছুটা হতবম্ব হয়ে জেসমিনের পিছু পিছু চলা শুরু করে।
ফুটবলাররা যে ভাবে ড্রিবলিং করে বল নিয়ে এগোয়, ওরাও সেইভাবে সৈয়দপুর স্টেশন নির্মাণ হকারের গলির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ ছেলেটিকে হারিয়ে ফেলতেই ভয় পেয়ে যায় জেসমিন। ভাবে, অচেনা একটি ছেলের সঙ্গে আসা খুবই হঠকারিতা হয়েছে। লাগেজও তার জিম্মায়। নিশ্চয়ই অন্য মতলব আছে। আজকালকার দিনে নইলে একজন অচেনা মানুষকে কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ সাহায্য করে?
অবশেষে কিছুটা হেঁটে তারা সন্দু হোটেলে পৌঁছায়। ভেতরে ঢুকেই মালিককে দেখিয়ে বলে, ‘আপা কি খাবেন বলুন’।
হোটেলের ভেতরটা ছোট হলেও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জেসমিন খাবার অর্ডার দিতেই, ছেলেটি পাশে এসে বলে,
......‘স্টেশনের ঐ দোকানগুলোর থেকে এখানে সব গরম পাবেন। ভাল রান্না। দামও কম’।
জেসমিনের মনে হলো, কমিশনের লোভেই এইসব করছে। ফেরার সময় ছেলেটি জেসমিনের ট্রলি ব্যাগের সাথে খাবারের ঝোলাটাও বয়ে আনল। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে ব্যাগটিকে লাগেজ ট্রলির উপর চাপিয়ে দেয়। জেসমিন জানতে চাইলো সবাই তো দিচ্ছে না, তুমি কেন দিলে? ছেলেটি স্মিত হেসে বলে,
......‘আমরা কেন নিয়ম মানবো না’।
আশ্চর্য! জেসমিন অবাক হয়। ভাবে, এইসব সাহায্যের বিনিময়ে এবার নিশ্চয় টাকা চাইবে। তাই বলে ওঠে,
...... ‘তুমি যা করলে, আমি কোনদিন ভুলবো না। আপা বলে ডেকেছো, এই নাও, যা ভাল লাগে খেয়ো।’ জেসমিন ১০০ টাকা ব্যাগ থেকে বের করে।
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘আপা ডেকেছি, আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েই যাব। এর জন্য আপনার কাছ থেকে টাকা নেবো? ভাই-এর দায়িত্ব আপাকে দেখাশোনা করা। কত নম্বর কোচ?’
কথাটা চাবুকের মত গায়ে এসে লাগে জেসমিনের। তারমানে, এতক্ষন ধরে ছেলেটিকে নিয়ে যা যা ভেবেছিল তার একটাও তো মিলছে না। টাকাটা হাতে নিয়ে নিজের দোদুল্যমান মন নিয়ে আস্তে করে বলে,
...... ‘এখানকার কোন ট্রেন কয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসে, কোন কোচ কোথায় দাঁড়ায়, আমার সব মুখস্থ। চলুন, নিয়ে যাচ্ছি। আসলে, আমারও এক আপা আছে। আপনাকে দেখে আপার কথাই মনে পড়ছে’।
...... ‘কোথায় থাকে তোমার আপা’।
...... ‘কুড়িগ্রাম। এই তো গত বছর বিয়ে দিলাম, ছেলে সরকারী চাকরী করে। ব্যস আমি নিশ্চিন্ত। বাবা-মা আমাকে বিয়ের জন্য বলচে, আমি রাজী হচ্ছিনা। এই আপার বিয়ে দিলাম জমি বিক্রি করে, একটু নিশ্বাস নিই’।
...... ‘তাই, বা, তুমি তো খুব দায়িত্বশীল ছেলে’।
...... ‘বাবা ঢাকা থেকে আসার পরে, দোকানে কাজ করে খুব কষ্টে ৩ বিঘা জমি কিনেছিল। সেখান থেকেই এক বিঘা দিদির জন্য বেচে দিলাম। এখন বাবা-মাকে দেখা-শোনার জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠাই। বাবা অনেক কষ্ট করেছে এক সময়। তাই বলেছি, আমি দেখবো। তুমি বিশ্রাম নাও’।
...... ‘সত্যি, তোমার মা-বাবা খুব লাকি’।
...... ‘না আপা, আমি চেষ্টা করি সৎ ভাবে বাঁচতে, মানুষকে ভালবেসে জীবন কাটাতে। জানেন, এই স্টেশনে আমি ১০ বছর বয়স থেকে আছি। সবাই আমাকে চেনে আর ভালবাসে। দোকানের মালিক আমার উপরে ভার দিয়ে, নিশ্চিন্তে আছে। মাসে ৮,০০০ দেয়। এখানেই উপরে থাকি। এই স্টেশনই আমার বাড়ী ঘর। মাঝে মাঝে বাবা-মাকে দেখতে কুড়িগ্রাম যাই। এই হাসু ভাই চা দাও দেখি ২ টা’।
কথা বলতে বলতে প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে পৌঁছে দুটো ফাঁকা চেয়ার-এ ওরা বসে। চা দিতেই, জেসমিন টাকা বের করে। ছেলেটি জানায়, ‘এখানে কেউ দাম নেবে না’।
......‘এমা, সেটা তো তোমার জন্য। আমি....’।
......‘হাসু ভাই নেবেই না, এখানে আমরা সবাই খুব মিলেমিশে থাকি। আপনি আমার আপা তো। তাই সবার আপনজন হলেন’। চা-এর লোকটিও হেসে চলে যায়। মোটামুটি কিছুক্ষনের মধ্যে কুলী থেকে হকার, এমনকি টিকিট কালেক্টরের কাছেও জেসমিন হয়ে ওঠে ‘ওর আপা’। এরপরে চেয়ারে পা গুটিয়ে কত গল্প শোনায়। সে এক অচেনা সৈয়দপুর স্টেশনের আনাচে-কানাচের যাপন-কাহিনী।
কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকে। ছেলেটি জেসমিনের সব লাগেজ নিয়ে একদৌড়ে ট্রেনে উঠে সিটের নীচে ঢুকিয়ে হাসি মুখে বলে, ‘ব্যস, আপা বসে পড়–ন’। জেসমিন বসতেই, ‘আমি আসছি একটু’, বলে ট্রেন থেকে নেমে যায়। কোন কিছু বোঝার আগেই একটা বড় জলের বোতল নিয়ে ফিরে আসে।
......‘আরে আরে, আমার কাছে জল আছে তো। আচ্ছা, এটার টাকা...’। কোন উত্তর না দিয়ে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মে নেমে যায়। জেসমিনের মুখোমুখি জানালার রড ধরে দাঁড়ায়। সারা মুখে বিষন্নতার ছাপ, চোখ ছলছল করছে,
......‘আপা, আপনি খুব ভাল। আবার এসো, আমাকে এখানেই সবসময় পাবে’।
জেসমিন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেক না বলা কথা ফুটে উঠছে ছেলেটির চাহনিতে। বিশ্বাস! ভালবাসা! এমন সময় হঠাৎ ট্রেন দুলে ওঠে। চলা শুরু হতেই জেসমিনের মনে এলো, আরে ওর নামটাই তো জানা হয় নি।
......‘তোমার নামটা?’। ট্রেন তখন অনেকটাই গতি নিয়ে ফেলেছে। তাও শুনতে পেলো,
......‘র-হ-ম-ত প্রামা-নিক’।
রহমত! রহমত! এ এক অদ্ভুত অনুভুতি! যা জেসমিনকে স্তব্ধ করে দিল। মনে মনে বললো, ‘ভাল থাকিস ভাই। দেখা হবে। আমি আবার আসবো’।
ট্রেনের গতির সঙ্গে জোরে হাওয়া লাগতে লাগলো গায়ে। জেসমিন অনেকক্ষন একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রহমতের মায়াবী মুখটা বার বার ভেসে উঠছে। হঠাৎ ওর মনে এলো, আচ্ছা, রহমত-রাও তো কুড়িগ্রাম থেকে এসেছিল। এখন রাজনীতি নিয়ে যা চলছে......এতদিন এই দেশে থাকার পরেও যদি ওদের ঘরছাড়া হতে হয়, ডিটেনসন ক্যাম্প! রক্তপাতহীন নিঃশব্দ অঙ্গচ্ছেদের যন্ত্রনার মতো জেসমিনের মন ফাফিয়ে কেঁদে উঠলো..... না, না, এ হতে পারে না, অসম্ভব। আল্লাহ এতো নিষ্ঠুর নয়। তারপর চোখ বন্ধ করে একমনে প্রার্থনা করে যেতে লাগলো, ‘রহমতের যেন কিছু না হয় আল্লাহ, কিছু না হয়, ওকে খুব, খুউব ভাল রেখো’।
পদাবলি
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
সবুজ শাড়ির রূপকথা
অনিন্দিতা মিত্র
তোর সবুজ রঙের শাড়ির আলোকলতায় জসীমউদ্দীন এঁকেছেন নকশি-কাঁথার কাব্যচিত্র। আনমনা রোদ চা বাগানের সর্পিল গ্রন্থি ছুঁয়ে হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যায় তিস্তার জলে, ইলোরার নিপুণ কারুকার্যে নীলাভ রঙ কাজল হয়ে ধরা দেয় তোর চোখে। নক্ষত্রের অনন্ত গর্ভে মুখ গোঁজে সভ্যতা। সম্পর্কহীন সম্পর্কে উষ্ণতা খুঁজে চলে অবুঝ মন। ভালোবাসার অকৃত্রিম আদিম গন্ধে শুদ্ধ হয় পৃথিবী।
ফেরা হবেনা কোন দিন
আতিক এ রহিম
কোন একদিন তোমার শহরে বৃষ্টি নামবে
আমরা দু’জন মুখোমুখি ফুটপাতে বসে টুংটাং চায়ের কাপের
শব্দের সাথে কথা মিশিয়ে সুখ দুঃখগুলো ভাসিয়ে দিব বৃষ্টির সনে।
শরতের অলস বিকেলটা ঝিমিয়ে পড়বে সারা শহর জুড়ে
সঙ্গী বিহীন কাকের কর্কশ শব্দে তোলপাড় করে তুলবে বিজন সড়কটা।
অশত্থ গাছের নিচে বসা পাগলি মেয়েটারও একটা স্বপ্ন ছিল
হয়তো কোন কপটতার ভাণে পড়ে আজ স্বপ্নটা ভাগাড়ে নিমজ্জিত।
তোমার শহরে বৃষ্টি নামুক অথবা রোদে ঝলসে যাক আমার আর ফেরা হবেনা এই শহরে কোন দিন।
মেঘনার মেয়ে
গোলাম রববানী
মেঘনার মেয়ে তুমিতো মুঠোর মতো মুক্তির লিফলেট
তুমিতো বদ্ধঘরের খোলা দরজা জানালার মতো
খোলা আকাশের মতো- মাঝেমধ্যে মেঘলোক-
কখনওবা সূর্যে প্রচন্ড প্রখরতা, আবার কখনওবা ভেজা সন্ধেবেলা-ই বৃক্ষপাতায় লেগে থাকা জল
জলেরও আন্তযোগাযোগ- চাঁদের জোছনার আলো।
যে কবিতা গনগনে আগুনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়
অসমান্তরাল কোনোএক চলমান প্লাটফর্মে
মর্মে মর্মে মূর্তিরূপে হৃদয়দানিতে সুসজ্জিত হয়
একটি পুতুল আরও একটি প্রজাপতি হয়ে
সে আর কেউ না- মেঘনার মেয়ে
মন ও মননজুড়ে আছে সেরিব্রামে
মেঘনার মেয়ে তুমি কবিতার মতো চিন্তার দৃশ্য
সুউচ্চমাত্রার এক মেডিটেশনথ না পাওয়া ধ্যানজ্ঞান
যাকে বলা হয় প্রেম: চাইছি ভালোবাসার ফ্রেম।
খুব ভালো আছি
মুস্তফা হাবীব
রাত কতোটা গভীর হলে
সিঁধেল চোরগুলো শাহানশাহ্ হয়ে যায়
হয়ে যায় ঘুমমগ্ন পৃথিবীতে রাজাধিরাজ!
এখন রাতের সুনসান নীরবতা,
বাজার সিন্ডিকেট নির্বিঘ্নে কেড়ে নেয়
মানুষের ক্ষুদ্র সঞ্চয়, বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও সাহস।
রাত শেষে সূর্যে আলো ফুটলেও
রাত ভেবেই বেনেরা সমুদ্রচুরি করে,
স্বৈরবৃক্ষের ছায়াকে পুঁজি করে লুটপাট করে
কিছু মানুষ গড়ে তোলে অভয় অরণ্য,
অত:পর ডায়াসে দাঁড়ায়
সগৌরবে জানান দেয় ‘খুব ভালো আছি’।
ফিরে এসো
ইউনুছ ইবনে জয়নাল
ফিরে এসো; ফিরে এসো হৃদয় পাড়ে; এ বাংলায়-
ফিরে এসো জীবনের সৈকতে,
পালের লাগাম দাও কেটে
তরী ভিড়াও ঘাটে হৃদ্যতে।
ফিরে এসো সেখানে- যেখানে
হৃদয়ের স্পন্ধন থেমে গেছে,
অনেক আগে; সেখানে-
নতুন বন্দর গড়ার মানসে।
ফিরে এসো- যেখানে বুনো হাঁস নীড় বেঁধেছে;
শ্বাপদেরা সারা রাত জেগে থাকে,
নক্ষত্রেরা আলো ছড়ায় আপন মনে
ফিরে এসো- সেই গাঁয়ের বাঁকে।
অবারিত মাঠে ফসলের ক্ষেতে
ফিরে এসো এ বাংলায়,
আমারে অনুভব করিবে যেথায়
ফিরে এসো সেথায়-
এ রূপসীর দেশে জলে কিম্বা ডাঙ্গায়।
আমরা ও রাজপথ
হিলারী হিটলার আভী
যে রাজপথে সত্যের কলম থাকার কথা
সেই রাজপথে রয়েছে লাঠি বোমা আর কামান!
যে রাজপথে মনন আলো থাকার কথা
সেই রাজপথে রয়েছে তীর্যক মশাল আর শ্লোগান!
যে রাজপথে স্নেহ মমতা আর অমোঘ প্রেম থাকার কথা
সেই রাজপথে রয়েছে রক্তশোষক সুদখোর ঘুষখোর আর দালাল!
যে রাজপথে ফুল পাখি আর ইথার-পা থাকার কথা
সেই রাজপথে রয়েছে সাইরেন রক্তমাখা বুট আর অত্যাধুনিক ব্যারিকেড!
যে রাজপথে স্বর্গীয় হাসি আর হাসি থাকার কথা
সেই রাজপথে রয়েছে নির্মম ফাঁসি আর ফাঁসি!
যে রাজপথে শুধু রাজা আর প্রজা থাকার কথা
সেই রাজপথে রাজাও নেই প্রজাও নেই
রয়েছে শুধু আমার তোমার ও তার অসীম ব্যথা!
অর্থাৎ আমরা রাজা ও প্রজার আদর্শ আসন থেকে হাজার বছর ধরে বিচ্যুতি...!
ভালোবাসার বিচ্যুতি
আশরাফ চঞ্চল
জীবনের সর্বস্ব দিয়ে যাকে ভালোবাসলাম
চরণতলে বিছিয়ে দিলাম নৈবেদ্যের ফুল
সে যখন আমার দিকে তাক করে রাখে
বিষমাখা তীর আর নানা ফন্দি ফিকির
ঘায়েল করার চক্রান্তে থাকে বিভোর
তখন খুবই খারাপ লাগে-
যাকে সুখে রাখতে যেয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলি
যার মুখে খাবার জোটাতে নিজে না খেয়ে থাকি
যার ভালো পোশাক কিনতে দামি মার্কেটে যাই
সে আমার পোশাক দেখে যখন নাক সিটকায়
তখন খুবই খারাপ লাগে-
যার একটু অসুখ হলেই দিশেহারা হয়ে যাই
পাগলের মতো হাসপাতালে দৌড়াই
নিজ শরীরে হাজারো অসুখ রেখে
সুস্থ থাকার ভাণ করি
সে যখন আমার মৃত্যু কামনা করে
তখন খুবই খারাপ লাগে-
যার মুখে হাসি ফুটাতে নিজের হাসি জলাঞ্জলি দিই
যার বিলাসিতার জন্যে নানা ধান্দামিতে লিপ্ত হই
পরিজন ছেড়ে ভেতরে ভেতরে নরক পুষি
সে যখন বলে আমি তাকে কিছুই দিইনি
তখন খুবই খারাপ লাগে-
মন চায় ওকে ঘর ছাড়া করি
কিংবা নিজেই ঘর ছাড়া হই!
চিত্রনাট্য
দীপঙ্কর ইমন
ওখানে নুন ফুরিয়ে যাচ্ছে
এখানে বায়বীয় জল আরও উত্তপ্ত হয়।
মাঝখানে ভাত চাষী
সিন্ধু সভ্যতা থেকে আজ অব্দি
মহাজনের ভুল অঙ্ক মেনে নেয়।
ঈশ্বরের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি আজও শেষ হলো না
যদিও,
ধান গাছ গুলো নাস্তিক হয়ে উঠলো এক এক করে।
নুন আনতে আনতে জল উধাও হয়ে যায়!
এখন ভাতের জন্য আরেকটি সভ্যতা চাই
এক পৃথিবী নুনের গল্প।
যদিও
পৃথিবীটা আজ
নিলাম হয়ে গেছে ঈশ্বর সমেত।
ছায়াছবির চিত্রনাট্যে
কেবল মহাজনেরই চরিত্র লেখা আছে।
তোমাকে ছোঁবো না কোনোদিন
ইসলাম মুহাম্মদ তৌহিদ
বারুদের গন্ধ হব
যুদ্ধের কান্না ছোঁবো
তবু তোমাকে ছোঁবো না কোনোদিন
তোমাতে জমে আছে অপ্রেমের ঋণ।
বজ্রপাতের ঝিলিক হব
বিষধর ফণী ছোঁবো
তবু তোমাকে ছোঁবো না কোনোদিন
তুমি যে অস্পৃশ্য, প্রেমহীন!
পথিকের পথ হব
সারাদিন লাথি ছোঁবো
তবু তোমাকে ছোঁবো না কোনোদিন
তুমিই করেছ আমায় বিষাদে বিলীন।
মহাকাব্যিক দুঃখ হব
অগ্নিকুন্ডের ফুলকি ছোঁবো
তবু তোমাকে ছোঁবো না কোনোদিন
তুমি যে নিষ্ঠুর মায়াহীন!
ভালোবাসাহীন নগরে
রুদ্র সাহাদাৎ
শুক্রবার এলে বাবাকে খুব করে মনে পড়ে, মা’কেও
“রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা”
কাঁদে চোখ মোনাজাতে দু’হাতও
জানালাহীন ঘরে যাব আমিও দু’দিন আগে পরে
শূন্যতায় হাসি রোজ ভালোবাসাহীন নগরে....
প্রতীক্ষা
জহুরুল ইসলাম
যমুনার বালুচরে কাশবন,
কতোদিন আসি আসি করে আজও আসোনি।
ঘর ছাড়া মন অপেক্ষায় থেকে থেকে,
ঘরে ফিরতেই ইচ্ছে হয় না।
তোমার ঠোঁটের মতো পাতার নড়াচড়া দেখি-
আশ্বিনি আকাশের ধুলোট মেঘ।
ক্ষয়ে যাচ্ছে সময়-
এসো এবার বালুচরের কাশবনে।
একবার এসো-
ভালোবাসার কথা বলিনি,
তোমার রক্তে তা নেই।
চাতকের মতো অপেক্ষায় আছি-
যমুনার ধারে- কৃষ্ণের বৃন্দাবনে।
সত্যিকারের প্রণয়
কনক কুমার প্রামানিক
জেনে রেখো ওগো প্রিয়তমা
এ প্রণয় ক্ষণিকের নয়,
বিলাসিতা বা বাজীও নয়
এতো দুটি আত্মার জয়।
কামনা বাসনা মোহ নয়
দ্বৈত হৃদয়ের মিলন,
নিদ্রাময় অলীকও নয়
সুখময় জীবনের ক্ষণ।
আবেগমাখা বচন নয়
আঙ্গুল ছুঁয়ে হাটা নয়,
ভালোবাসা অমর অমলিন
সত্যি প্রেম চিত্ত বিনয়
সাবিনা পারভীন লীনা : সত্য দেখার কথক।
সাবিনা পারভীন লীনা
সত্য দেখার কথক
মাহমুদ নোমান
বইয়ের নাম ‘সম্পর্ক’ শুনে যে কেউ নিজেতে দাঁড়িয়ে ভাবতে বাধ্য; কতো ভাব গতি প্যাঁচ পোঁচ আর মোচড়- তবুও কী ‘সম্পর্ক’ ব্যাপারটি বুঝাতে সক্ষম! সম্পর্ক শব্দটি চোখের সামনে এলে ভাবি চোখের দেখায় শেষ না-হওয়া একটা সাঁকো, হাত ধরাধরি করে পার হচ্ছে...সত্যি কী সাঁকো, সাঁকো তো দৃশ্যমান আর সম্পর্ক কেউ দেখাতে পারে? সম্পর্ক ব্যাপারটিতো বুঝানো যায় না। ‘সম্পর্ক’ আত্মস্থ করার, উপলব্ধি করার, একটা টানের, একটা গায়েবি রেখার...
সাবিনা পারভীন লীনা কবিতা লিখতো জানতাম, ‘দেয়াঙ' পত্রিকাতেও কবিতা ছেপেছি ; কবিতার বই পড়ার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু বই হিসেবে পড়েছি গল্পের! কেন জানি মনে হয় গল্প লিখতে সৎ সাহসের প্রয়োজন। চরিত্রকে কথা বলাতে গিয়ে অনেক কথা নিজের আবার যদি ধরে নিই- একেবারে বানানো গল্প, সেখানেও নিজের মতামত ভাব-বোধের পুরোপুরি দাবি থাকেই; এখানে এসে একজন নারী গল্প লেখিকা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজের মতামতকে দাঁড় করিয়ে গল্প যখন লিখে সেটি বেশ শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠে। আমি এই কথা বিশ্বাস করি- একজন নারীর জীবনটা বলা আর না-বলা অনেক গল্পের স্তুপ; সাবিনা পারভীন লীনার গল্প পড়ে মনে হয়েছে এই স্তুপ তিনি রাখেননি সচেতনে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার অভিযানে ফলিয়েছেন নিজের ভাব বোধের চমৎকার ফুল, তেমন সুবাসিত করার প্রয়াস না থাকলেও সৌন্দর্যে আকর্ষণ করে সত্যি...
সাবিনা পারভীন লীনার গল্প পরিশীলিত বোধের চমৎকার মঞ্চায়নে ভাষার দ্বিধা পাবেন না, চরিত্রের প্রয়োজনে চরিত্র এখানে কথা বলে ভাব-গাম্ভীর্যে;
‘সম্পর্ক’ বইটি গল্পকারের প্রথম গল্পের বই হলেও কথক বা লেখক তো আজকের নয়; অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে অনেক দিনের পুঞ্জীভূত পাথর সরানোর মতো এই বইয়ের ভাষ্য... এই বইয়ে মোট ৮ টি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে, প্রতিটি গল্পের মুহূর্ত একেকরকম পরিস্থিতি তৈরি করে, মিহি সুতোয় গাঁথা গল্পমালা যেন;
সাবিনা পারভীন লীনার গল্পের বয়ন মেদহীন, সোজাসাপ্টা এবং পরিমার্জিত মনে হবে। ডায়ালগ ডেলিভারিতে সরাসরি হানে, তবে এক্ষেত্রে কিছু কথা বলতে হয় - কিছু মেদ সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয় বরঞ্চ যথাযথ গড়ে তোলে; অতিরিক্ত ব্যাপারটি কেবল সৌন্দর্য বিনষ্ট করে অর্থাৎ সাবিনা পারভীন লীনা গল্পকে বিভিন্ন মতে-পথে অতো যাচাই করতে চায় না, যা দেখেছে সেটি বলতে পারদর্শী অথচ দেখক- কথক এরপরে লেখকের একটা ভূমিকা থেকেই যায়; সাবিনা পারভীন লীনার গল্পের বই ‘সম্পর্ক’ পড়ে দীলতাজ রহমানের গল্পের কথা মনে এলো, যেভাবে দীলতাজ রহমান নিজের বক্তব্যকে অর্থপূর্ণ করে চরিত্রকে পুরোপুরি প্রাধান্য দিয়ে সেটি পথ দেখাবে... এরকম সাহসের বড়ই অভাব, এটির দায় সমাজ-রাষ্ট্রকে দেওয়া জরুরি মনে করি না, আমি এটুকু বলি - কোন সমাজ -রাষ্ট্র অর্থাৎ এসবের হর্তাকর্তারা কখনও একজন লেখককে লিখতে বলে? বরঞ্চ লেখককে তাঁর ভাবনায় হস্তক্ষেপ করেনি দেখাতে পারবেন?? যদি নারী হয় তাহলে আরো চাপাচাপি, এসবেও সাবিনা পারভীন লীনার গল্প পাঠককে ভাবায়- মনোযোগ কাড়তে সক্ষম, ভবিষ্যতে আরো ভাবাবে আশা করি...
এই গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটির নাম- ‘একটা ফ্যান্টাসি গল্পের খোঁজে’, এই গল্পটির সারমর্ম হলো- আমরা যে যান্ত্রিক যুগে, মান অভিমান মিইয়ে যাওয়ার সময়ে যেকোনো ঘটনাকে শুনতে/জানতে গিয়ে বর্ণনার মধ্যে ফ্যান্টাসি খুঁজি মানে ভেতরে সমস্যাটাকে আড়াল করার জন্য একটা ফ্যান্টাসির পর্দা বা দেয়াল তৈরি করে দিই অর্থাৎ সত্য ঘটনা ক’জন জানতে পারে?? - এই প্রশ্ন এবং উত্তর এই গল্পে, সরাসরি বললে এখনকার এই দেশের অস্থিরতার খন্ডচিত্রের সফল রূপায়ণ....
০২.
এই গল্পগ্রন্থে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সাম্প্রতিক সময় নানানভাবে তুলে ধরা। এমনকি করোনার অস্থিরতা, দুঃসহ স্মৃতির আবহ এই গল্পগ্রন্থের পরতে পরতে; এই বইয়ের নামগল্প ‘সম্পর্ক’- এখনকার সময়ের শহুরে শিক্ষিত দম্পতির সাংসারিক নানান টানাপোড়েন পাঠকের চোখের সামনে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যেন সুনির্মিত চলচ্চিত্র-
‘তোমার কাছে কি আমাদের ক্লোজড ছবি আছে ফেইসবুকে পোস্ট দেয়ার জন্য? অনেকদিন কোনো পোস্ট দেওয়া হয় না’ এটুকু লিখে মনোয়ার বাথরুমে ঢোকে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে এখনও সানজিদা রেসপন্স করেনি। মনোয়ার সানজিদাকে কল করা ঠিক হবে কিনা ভাবে। ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে। মানুষের সম্পর্কগুলো কেমন অদ্ভুত! একটা সময় ছিল কল করার জন্য সময়- অসময় ছিল না, আর এখন কল করা যাবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধা কাটে না।
- সম্পর্ক; ১৭ পৃ.)
গল্পের নায়ক নায়িকার বিয়েটা কিন্তু প্রেমঘটিত অথচ কয়েক বছর যেতেই সম্পর্ক কেমন পাল্টে যায়! তিক্ততা নিয়েও কেমন সুখের অভিনয় করে চলতে হয়, এটি বোধহয় বেশিরভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত দম্পতির সংসারের বাস্তব চিত্র...
‘সম্পর্ক’ গল্পগ্রন্থটি মানুষের সাথে মানুষের নানাবিধ সম্পর্কে টানাপোড়েন, ভালো কিংবা খারাপ লাগার সূক্ষ্ণ অনুভূতির ব্যাপারগুলো স্মার্ট শব্দে মৃদুস্বরে বলেছেন। ‘চেনা অন্ধকার’ গল্পে যেমন এক বৃদ্ধার জবানবন্দি-
‘হোসনে আরার সময় কাটে এখন জায়নামাজে। কখনও কুরআন শরিফের সামনে, কখনও তসবি হাতে। শরীর আর আগের মতো নেই, এ কয়দিনে আরও কুঁজো হয়ে গেছে। সারাক্ষণ বিছানাতেই থাকে। ভাবে, খাট থেকে নিচে নামলেই ময়লা লেগে যাবে। নিজের ছেলেমেয়ে কাউকে বিছানায় বসতে দেয় না, শুধু সুমনা বসতে পারে। ধুলোবালি না ঢোকার জন্য দরজা জানালা বন্ধ করে রাখে সারাদিন। তার ঘরে আলোর চেয়ে অন্ধকারের দাপট যেন বেশি
- ৩৫পৃ.)
তেমনি ‘দ্বিতীয় জন্ম’ গল্পে প্রেমিক- প্রেমিকার নির্ভেজাল আকুতিভরা টলটলে জলে আবাহনের দলিল-
‘ভাইব্রেশনের গোঙানি বন্ধ করতে বালিশের পাশে হাতড়াতে হাতড়াতে শেষ পর্যন্ত মাথা তুলে বসে মীরা। মিনহাজ পাশে নেই, সানাইও বাজছে না। ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে শোঁ শোঁ করে। পর্দার ফাঁক গলে আসা হালকা আলোয় মেয়ের মুখটা দেখে ভীষণ কান্না আসে। ভালোবাসার সঙ্গে কান্নার একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। ধ্বনি দিলে যেমন প্রতিধ্বনি হয়, ভালোবাসলে কাঁদতে হয়।
- ২৯ পৃ.)
এছাড়া এই বইয়ের প্রতিটি গল্পে সাবিনা পারভীন লীনার সৃষ্ট মুহূর্তগুলো কল্পনাপ্রসূত নয় শুধু, গল্পকারের আশপাশে দৃশ্যাবলী, প্রেমের আবহে সাবলীলভাবে বেশ জটিল সব ভাব-বোধের মীমাংসা দিয়েছেন; তবুও কী যেন বাকী রয়ে গেলো, ঝেড়ে নিজেকে হয়তো লিখবে, এক দাপুটে গল্পকার পাবো অচিরে এই প্রত্যাশা করতেই পারি...