বিজয়ের বেদনা
বিজয়ের বেদনা
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
তখনও পুব আকাশে সূর্য ওঠেনি, সকাল হতে আরও কিছু সময় বাকি। এদিকে প্রচন্ড প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে কিশোরী বঁধূ ছালেহা বেগম। বাড়ির বাহির বারান্দায় বসে অস্থির ভাবে হুক্কা টানছে ফজলু মিয়া। অল্প কিছু সময় পরেই করুণ সুরে ফজরের আযান দিচ্ছে মুয়াজ্জিন হুজুর। ফজলু হুক্কা রেখে পুকুরে গিয়ে ওযু করে মসজিদের দিকে পা বাড়ায়। যদিও সে সূরা কালাম কিছুই পারে না। মুয়াজ্জিন হুজুর তখন সুন্নত নামাজ পড়ে মসজিদের বারান্দায় বসে তসবীহ পড়ছেন। ফজলুকে মসজিদের উঠানে দেখেই মুয়াজ্জিন হুজুর ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যান। দশ বছর আগে তার বাবা মারা যাওয়ার দিন শেষ বারের মতো তাকে তিনি মসজিদে আসতে দেখে ছিলেন। হুজুর ভাবলেন আবার কোন অঘটন ঘটলো নাকি। তাই তিনি ফজলুকে প্রশ্ন করতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। হুজুর তখন ধরেই নিলেন কেউ হয়তো মারা গেছে, তাই তিনি বিড়বিড় করে পড়তে থাকেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন..। তখন ফজলু কান্নারত অবস্থায় বলে উঠে, এখনো কেউ মরে নাই কিন্তু মরণাপন্ন অবস্থা। আমার বউটা প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাইতাছে। দাই বেডি কইছে অবস্থা নাকি খুব খারাপ, প্রচুর রক্ত যাইতাছে। হুজুর তখন ফজলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন এবং ধৈর্য্য ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেন। তারপর জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করে হুজুর ফজলুর সাথে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। যাওয়ার সময় পুরোটা পথ তিনি দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে গেলেন। বাড়ির উঠানে পা রাখতেই তারা নবজাতক বাচ্চার কান্না শুনতে পান। তখন দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠে ‘সুবহান আল্লাহ্’। প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে অস্থির হয়ে উঠে ফজলু। তখন তার মা লতিফা বানু ঘর থেকে বের হয়ে বড় মুখ করে জানায় পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে ছালেহা। তখন রক্তিম সূর্য আভায় রাঙিয়ে আছে পুবের আকাশ। নিজের পুত্রের মুখ দেখতেও যেন ঠিক পুবের সূর্যের মতোই লাল বর্ণের। তাই সন্তানের নাম রাখে সে লাল মিয়া। মুয়াজ্জিন হুজুর ইতিমধ্যেই নবজাতক পুত্র সন্তান জন্মের জানান দিলেন বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে আযান দিয়ে।
ছালেহা সন্তানের মুখ দেখে সব কষ্টের কথা ভুলে যায়। সংসারে বংশের প্রদীপ পুত্র সন্তানের আগমনের খুশিতে কদিন মধ্যেই দুটো খাসি জবেহ দিয়ে আকিকা করে। আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে দাওয়াত করে ফজলু। যারাই তার শিশুপুত্র লাল মিয়ার মুখ দেখেছে, সবাই খুব প্রসংশা করেছে। নামও তার লাল, ছোট মুখখানি দেখতেও লাল। বেশ সুখেই কাটছে ফজলু ও ছালেহার সংসার। তবে এই সুখ বেশি দিন রইলো না। হঠাৎ করেই দেশে একটা গন্ডগোল লেগে যায়। চারদিকে অস্থিরতা বিরাজ করছে কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষ তখনও কিছু বুঝে পেরে ওঠেনি। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর কমবেশি সবাই বুঝতে থাকে, এবার একটা কিছু হতে যাচ্ছে। তবে এসব নিয়ে ফজলুর খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই। সে একজন কৃষক মানুষ, এসব বিষয়ে তার চিন্তা না করলেও চলবে। তবে চিন্তা না করতে চাইলেও কি চিন্তা না করে থাকতে পারে? দেশে তখন যুদ্ধ লেগে গেছে। পাক বাহিনী সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, শহরের পর শহর তছনছ করে নির্বিচারে গুলি করে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছে। শহরের মানুষ সপরিবারে গ্রামে ফিরে আসছে। সবার চোখে মুখে শুধু আতঙ্ক, কেউ স্বস্তিতে নেই। বাঙালিরাও দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতেছে। মুক্তি বাহিনী অল্প দিনের মধ্যেই প্রতিরোধ গড়ে তুলে পাক বাহিনী বিরুদ্ধে। দেশে তখন পুরোদস্তুর যুদ্ধ চলছে। ফজলুর মনে তখন একটাই চিন্তা, এবার কোন রকমে ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলার। তাহলেই সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। তবে ঘরে নতুন ফসল তোলার আগেই তাদের গ্রামের হাই স্কুলে ক্যাম্প বসায় পাক আর্মি। একদিন ওদের বিশাল সুঠাম দেহ, পোষাক ও অস্ত্র দেখে ফজলু রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে থাকে। স্কুলের মাঠে আশেপাশের কিছু যুবকদের ধরে এনে নির্যাতন করেতেছে। তাই মনের আতঙ্কে ফসলের মাঠ ছেড়ে সে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে। তারপর কেটে গেল সপ্তাহ খানেক।
একদিন রাতে ফজলুর ফুফাতো ভাই মতিন এসে তার বাড়িতে উঠে। সে কিছুদিন থাকার পর মতিনের আরও দুই বন্ধু এসেও এক রাত যায়। ওদের চলাফেরা ও কথাবার্তায় ফজলুর মনে কিছু সন্দেহ হতে থাকে। মতিনকে চাপ দিয়ে ধরতেই সে সবকিছু খুলে বলে। মতিনের কথা শুনে ফজলু খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। মুক্তি বাহিনী এসে তার বাড়িতে উঠেছে। এবার তো আর কোন রক্ষা নেই। মতিন আরও জানায়, পাক আর্মির গতিবিধি লক্ষ্য রাখতেই সে এখানে এসেছে। আর কটা দিন থেকেই সে চলে যাবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফুফাতো ভাই হওয়ার কারণে ফজলু না করতে পারলো না। পাক আর্মির চেয়ে রাজাকারদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে গ্রামবাসী। তবে প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। তাদের জোর জুলুম নির্যাতন নীরবে মেনে নিচ্ছে। কদিন পরে মতিন চলে যায় এবং এর দু’দিন পথেই পাক আর্মির উপরে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা হামলা হয়। এতে করে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। মুক্তি বাহিনীর খোঁজে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যেতে থাকে। একদিন রাতে ফজলুর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে গ্রামের তিন রাজাকার তার নাম ধরে ডাকতে থাকে। ফজলু বের হয়ে দেখে শুধু রাজাকার না, সামনে পাক আর্মিও আছে। সে ভয়ে তখন এক দৌড়ে পালিয়ে যায়। এটাই ছিল তার চরম বোকামি। তখন পাক আর্মিও তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে ফজলুকে হত্যা করে। তারপর আবার ফজলুর বাড়ি এসে তল্লাশি করতে থাকে। তখন তার কিশোরী স্ত্রীকে দেখে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। যদিও ছালেহার কোলে তখন পাঁচ মাসের শিশু সন্তান। সে পাক আর্মির পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে। তবুও তাদের মনে বিন্দু পরিমাণ দয়া মায়া হয়নি।
পরদিন ভোর সকালে গ্রামের মানুষ দেখে রাস্তার ঝোপের আড়ালে ফজলুর লাশ পড়ে আছে। কেউ তার লাশ ধরেনি, এমনকি বাড়ি গিয়ে খবরও পৌঁছে দেয়নি। মুয়াজ্জিন হুজুরের কানে খবর পৌঁছাতে তিনি তখন লোকজন নিয়ে ফজলুর লাশ তার বাড়িতে পৌঁছে দেন। তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ফজলুর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। এদিকে পিতা-মাতা হারা নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে ফজলুর মা লতিফা বানু যেন অথৈ সাগরে ভাসছেন। একমাত্র ছেলে হারানোর শোকে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে অঝোরে কাঁদছেন। ওই দিকে ছেলের বউ আছে আর্মির ক্যাম্পে। তার সুখের সংসার এভাবে কেউ এসে তছনছ করে দিবে, এটা তার দুঃস্বপ্নেও কখনো আসেনি। দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে যাচ্ছে আর পাক আর্মিদের অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় এলাকার রাজাকার মুন্সী নিয়ামত উল্লাহ তার দলবল নিয়ে ফজলুর বাড়ি দখল করে নেয়। চোখের পানি আঁচলে মুছতে মুছতে নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে লতিফা বানু স্বামীর ভিটে ছেড়ে ভিখারির মতো বের হয়ে যান। এই দৃশ্য দেখে মুয়াজ্জিন হুজুর বলে উঠেন, তোদের পাপের কলসি পূর্ণ হইছে, এখন পতন অনিবার্য। তিনি ফজলুর মাকে কিছু দিনের জন্য পাশের গ্রামের একজনের বাড়িতে কিছু দিনের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন। মতিনের কানে সব খবর পৌঁছে যায়। সে তখন নিজেকে কোন ভাবেই ক্ষমা করতে পারছে না। সবকিছুর জন্য সে নিজেকে দায়ী করছে। যদি না সে ফজলুর বাড়িতে না যেত, তাহলে আজকে তার এমন করুণ পরিণতি নাও হতে পারতো। সব খোঁজ খবর নিয়ে একদিন সুযোগ করে মতিন মুয়াজ্জিন হুজুরকে দিয়ে তার ফুফু লতিফা বানু ও ভাতিজা লাল মিয়াকে তাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
কিছু দিন পরেই এক রাতে গ্রামের হাই স্কুলের আর্মি ক্যাম্পে মুক্তি বাহিনী গেরিলা হামলা করে তাদের কোনঠাসা করে ফেলে। বেশ কজন মুক্তি বাহিনীর গুলিতে মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল, তারা কোন উপায় না দেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তখন মতিন তন্নতন্ন করে ছালেহাকে খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথায় খোঁজে পায়নি। কোথায় আছে ছালেহা, সেটা কেউ জানে না। উত্তেজিত হয়ে উঠে মতিন এবং সে রাজাকার মুন্সী নিয়ামত উল্লাহ এর বাড়িতে একদিন রাতে হামলা করে। নিয়ামত জানায়, কদিন আগে পাক আর্মি অন্য একটা ক্যাম্পে ছালেহাকে নিয়ে যায়। তবে কোন ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, সেটা সে জানে না। মতিন আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনি, সে নিয়ামতের পায়ে গুলি চালায়। তারপর তার বুক বরাবর তিনটা গুলি করতেই নিয়ামতে মৃত্যু হয়। মতিন আবার ফিরে যায় যুদ্ধের ময়দানে। তখন খুব কঠিন সময়, পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশেই পাক আর্মি অনেকাংশে কোনঠাসা হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে যাকেই পাচ্ছে, তাকেই মারছে। তবে মুক্তি বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধে কাছে অল্প দিনের মধ্যেই তারা পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর পাক আর্মির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় আসে। নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে স্বামীর ভিটে মাটিতে আবার ফিরে আসেন লতিফা বানু। তবে আর ফিরে আসেনি কিশোরী পুত্রবধূ ছালেহা।
মতিনের দেখভল ও সামান্য আর্থিক সহায়তায় নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে আবার শুরু হয় লতিফা বানুর জীবন যুদ্ধ। একদিন লতিফা বানুর জীবন যুদ্ধ থেমে যায়, তখন নাতি লাল মিয়ার বয়স তেইশ বছর বয়স। তখন চাচা মতিন মিয়া তার বিয়ে করিয়ে বাড়িতে নতুন বউ নিয়ে আসে। বর্তমানে লাল মিয়া একজন মধ্যবয়সী পুরুষ, একজন অটোরিকশা চালক। সে প্রাইমারি স্কুলেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে দিলেও নিজের তিন সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে খুবই আন্তরিক। তার বড় মেয়ে রাফিয়া বর্তমানে কলেজে লেখাপড়া করছে। তার একটা সরকারি চাকরির জন্য লাল মিয়া অনেকের ধারে ধারে ঘুরে এখন বড্ড ক্লান্ত। সবাই জানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য তার পিতা ফজলু মিয়াকে হত্যা করা হয় এবং তার মা ছালেহা বেগমকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবুও অনেক চেষ্টা করেও লাল মিয়া পায়নি সরকারি ভাবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সনদপত্র। এমনকি কোন দিন সরকারি ভাবে কোন রকমের সহায়তাও তার ঘরে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জন্মের পাঁচ মাস পরেই একই দিনে তার বাবা-মা দুজনকেই হারায়। এতিম হয়ে শৈশব ও কৈশোর কাটানোর কষ্ট একমাত্র লাল মিয়া নিজেই জানে। শুধু জানে না এই সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই বিজয় দিবসে সবাই যখন বর্ণিল আয়োজনে ব্যস্ত, তখন লাল মিয়া ঘরের কোণে বসে নীরবে কাঁদে। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শেষে মুক্তিযোদ্ধার যখন বিভিন্ন সরকারি উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরে, লাল মিয়া তখন চোখের পানি মুছে অটোরিকশা নিয়ে বের হয় সংসারের গ্লানি টানতে। বিজয়ের আনন্দ কখনো লাল মিয়াকে স্পর্শ করেনা। তার কাছে বিজয় মানে হতাশা, বেদনা ও বুক চাঁপা কান্না।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা
এই পতাকা আমার, আমার আত্মার!
এই পতাকা আমার, আমার আত্মার!
মুহম্মদ মাসুদ
একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! উত্তর পাড়ার...।
শেষরাত্রি। ফজরের আজানের খুব কাছাকাছি। মিনিট কয়েক দূরত্ব। হয়তো তারও একটু কাছাকাছি। সত্যি! এই সময়টায় মৃত্যুর সংবাদ কলিজা অবধি গেঁথে যায়। খুবই আফসোস হয় এই ভেবে কেউ একজন ফজরের নামাজ আদায় করতে পারলো না।
ঘুমের ঘোরে তখন হুঁশ বেহুঁশে অজ্ঞান অবচেতন হয়ে ঘুমিয়ে আছি। নানামুখী স্বপ্নের অংশগ্রহনে সংক্ষিপ্ত পদার্পণ এবং হেলে-দুলে জার্সি পরে মাঠে খেললেও আজানের মিষ্টি শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘মা, উঠেছ কি?
‘হ, উঠছি।’
‘আব্বায়?’
‘হ, তোর বাপ জানেও উঠছে।’
‘কিছু শুনেছ?’
‘হ, হেইজন্য তোর বাপ জানে তাড়াতাড়ি গেলো।
মসজিদের কাছাকাছি যেতেই কান্নার শব্দ কানে এসে ভিড় করলো। পরিচিত কন্ঠস্বর। এ কন্ঠস্বরের রিংটোনে পরিত্যক্ত কলিজার সবটুকুই শুকিয়ে গেলো নিমেষেই। আত্মাটা ছাঁইছুঁই ছাঁইছুঁই করতে লাগলো।
মমিন চাচা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। হাউমাউ করে কান্না! পিতৃশোকের কান্না। এ কান্না জীবন ঝড়ের কান্না। যে কান্নার অশ্রুবর্ষণে কোন ছলচাতুরী নেই। অহংকার নেই। আছে নির্ভেজাল ভালবাসা।
ইমাম সাহেব মমিন চাচাকে অনেক বোঝালেন। বললেন, ‘সবাইকেই যেতে হবে। আমরা আলাদা আলাদা এসেছি আর আলাদা ভাবেই খোদার কাছে চলে যাবো।’
পাখি পোষার শখ ছিলো দাদুর। খুবই শখ ছিলো। বিশেষ করে ময়না টিয়াপাখি। কেননা, পাখিদুটো মিষ্টি করে কথা বলতে পারে। যা শেখানো যায় তাই বলে। বিশেষ করে ময়না পাখি। সে রোজরোজ পাঁচ ওয়াক্ত নিয়ম করে বলে উঠতো আজান দিয়েছে, আজান দিয়েছে।
পাখির খাঁচায় কোন পাখি নেই। সেই আদুরে ময়না টিয়াপাখিও নেই। খাঁচাগুলো খাঁচার জায়গায় এখনো স্বাক্ষরিত দেখে মমিন চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা পাখিগুলো কোথায়?’
মমিন চাচা বলল, ‘আব্বা বলেছিল, তিনি মরে গেলে যেন পাখিগুলো ছেড়ে দেই। যদি রাতে মরে যায় তবে যেন ফজরের নামাজের আগে ছেড়ে দেই।’
‘এরপরে কি পাখিগুলো চোখে পড়েছে?’
‘না। আর চোখে পড়েনি। তবে টিনের চালে খাবার দিয়ে রেখেছি।’
প্রাইমারী স্কুল মাঠে বিজয় দিবসের গান বাজছে। আজ বিজয় দিবস। ১৬ই ডিসেম্বর মনে করতেই কলিজার মধ্যে একটা অচেনা ধকল শরীরটাকে শিহরিত করলো। স্মরণ হলো দাদু যদি বেঁচে থাকতো এতোক্ষণে নিশ্চয়ই স্কুল মাঠে পৌঁছে যেত।
পতাকা পতপত করে উড়ছে। লাল সবুজের বিজয় পতাকা উড়ছে। কিন্তু কদমগাছ তলায় মুঞ্জিল দাদু বসে নেই। এইতো প্রতিদিনই, যখন লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়তো। সেই শব্দটি দাদু কান পেতে শুনতো। দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘এ শব্দে কি পাও?
‘দাদু বলতো মুক্তিযুদ্ধের ডাক শুনতে পাই। মুক্তিযোদ্ধার পায়ের শব্দ পাই। বিজয়ের ধ্বনি শুনতে পাই। গোলাবারুদের আওয়াজ শুনতে পাই।’
কদমগাছটি আজ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কত-শত কাহিনী, কত-শত ঘটনার সূত্রপাতের স্বাক্ষী সে। দাদুর মুখে শুনেছি এই কদমগাছ তলায় নসু মিয়াকেও গুলি করে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। যে ছিলো সত্যিকারের সাহসী যোদ্ধা, বীরপুরুষ।
স্কুল মাঠে সবাই তখন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইছে। মনপ্রাণ উজাড় করে গাইছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’
হঠাৎই একটি ময়নাপাখি এসে পতাকার বাঁশের খুঁটিতে বসে পাখা নাড়তে শুরু করলো। আর হঠাৎ করে জাতীয় সংগীত গাওয়া বন্ধ হয়ে যেতেই ময়নাপাখি গাইতে শুরু করলো, ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস...।’
বিজয়ের পদাবলি : ০১
কালকেউটে
মাহমুদ হোসেন মৌসুম
আপনি না হয় ফুল-ফল, লতা-পাতা নিয়ে কথা বলুন
বিস্তৃত আকাশ আর পাশপাখালি নিয়ে ভাবতে থাকুন
সাগর নদীর গল্পগাথা বলুন
আর বসন্ত উৎসবের রঙ গায়ে মাখুন
ভুলেও ওদিকে তাকাবেন না
ওদিকে টকটকে লাল রঙের ফুল ধরছে
রাজপথে কিংবা ওলিতে গলিতে
সে ফুল দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে
তরতাজা রক্তরাঙ্গা সে ফুলের ঔদ্ধত্য
আপনি বইতে পারবেন না
আপনি আরো বড় কিছু নিয়ে ভাবুন
বড় বড় মানুষের সাথে ঘনিষ্ট থাকুন
সামান্য ক’টা মানুষ নিয়ে ভাবতে নেই
আদতে ওরা আপনার ভুত ভবিষ্যৎ নয় মোটেও
আপনি কল্পনা করুন সামগ্রিক নিয়ে
সময় নষ্ট করার ফুরসত আপনার নেই, আমরা জানি
সাহিত্য নিয়ে আপনাকে ভাবতে হয়
সাংস্কৃতিক বিপ্লবে শ্রম দিতে হয়
ভোর থেকে সন্ধ্যা দৌড়তে হয়
রাতের বেলা গিলতে হয়
জিডিপি মাথায় রাখতে হয়
তাই বলছি এতো ক্ষুদ্র বিষয়ে
আপনি মোটেও নজর দেবেন না
আপনি বরং ছাদ বাগান করুন
ফুলের সমারোহে দাঁত কেলিয়ে ছবি তুলুন
আর স্লোগান দিন-
‘যে ফুল ভালোবাসে সে মানুষ খুন করতে পারে না’
অথবা নতুন কিছু খাবারের রেসিপি দিন
লকলকে জিভ বের করে আস্বাদ নিন বারবিকিউয়ের
ওদিকে মানুষ পুড়ছে, পুড়–ক
আহা, ওদিকে মোটেও তাকাবেন না
ওদিকে না তাকিয়ে আপনি রক্তরাঙা সস দিয়ে-
বারবিকিউয়ের, মানে ঐ
পোড়া মাংসের স্বাদ নিতে থাকুন
আপনি পারবেন আমরা জানি
কারণ আপনি আগেও বহুবার পেরেছেন
মাওলানা সাহেব লংমার্চে যাবো
মাসুদ পারভেজ
‘বৎস এখনো ঘুমিয়ে আছো?’
এমন দরাজ গলায় ভালবাসা পূর্ণ ডাক আগে পাইনি বলেই
আচ্ছন্ন ঘুমের ঘোর থেকে হকচকিয়ে লাফিয়ে বসলাম,
অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে কুপি হাতে আধো আলোয়
খুব চেনা লাগছে পুরানো পাঞ্জাবি লুঙ্গি আর মাথায় টুপি পরা লোকটাকে।
এত দ্রুত স্মরণ করতে না পারার আক্ষেপ ¯্রষ্টার কাছে আমার বেশ পুরনো,
বলে উঠলেন, মিছিল মিটিং প্রতিবাদ বিদ্রোহ করে খুব ক্লান্ত বুঝি?
সাতপাঁচ না খুঁজে বলেই ফেললাম-দেখুন, আমি ওসবের মধ্যে নেই,
কপালে ঢেউয়ে মত চারটা ভাঁজ তুলে বললেন-
শুধু তুমি নও তোমরা কেউই নেই, কপাটবদ্ধ ঘরে যে আচ্ছন্ন ঘুমে তোমরা আছো,
রাত কখনোই ফুরাবে না।
আচ্ছা ফারাক্কা বাঁধের কি খবর? সে লংমার্চে তুমি গিয়েছিলে?
আমি অবাক হলাম, যে লোকটা তর্জনী উঁচিয়ে রাখত সদা শাসক-শোষকের মুখের উপর,
যার ডাকে কৃষক কামার কুমার কুলি মজদুর লাখে লাখে বিক্ষোভে ফেটে পড়তো,
যিনি কথায় কথায় সমস্ত বাতিলের বিরুদ্ধে অনশনে বসে যেতেন অসুস্থ শরীরে,
অর্ধেকটা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠ,
সেই মজলুম জননেতা আমার সামনে!!
হৃদয়ের প্রতিটি দরজায় এক বিস্ময়কর শ্রদ্ধা আন্দোলিত হয়ে যেন
পিতামহকে বলে ফেললাম- মাওলানা সাহেব লংমার্চে যাবো।
তৃষ্ণার্ত এক অপরিণত হাসি লাগিয়ে ধীর পায়ে যেতে যেতে মাওলানা সাহেব বললেন-
‘আযান হচ্ছে, আমার অযুর সময় হল।’
আমি একটুও থামানোর দুঃসাহস করলাম না।
শরীরের প্রতিটি পশমের গোড়া ঘেমে উঠল,
বুকের ভেতর ধুপধুপ ঘন্টি বেজে হৃৎপি-ে বাতাসের এক অস্বাভাবিক লেনদেন।
এবার সত্যিই আমার ঘুম ভেঙে গেল,
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখছি মাওলানা সাহেব নেই, দরজা খোলা।
কানে ধরা দিচ্ছে এক চিরসত্যের আহ্বান
‘হাইয়াআলাস সালা,
হাইয়াআলাল ফালা’
যুগের মুয়াজ্জিন শুধু নামাজের জন্য ডাকেননি, ডেকেছেন কল্যাণের জন্য
সমবেত হবার জন্য, ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য
হয়তো মাওলানা সাহেব সে কল্যাণের পথই বাতলে দিয়েছেন।
সাদা মেঘের ওলান
আলহাজ্ব লায়ন এম এ রশিদ
নৌকা দীর্ঘদিন রোধ পোহাতে পোহাতে,
ভুলে গিয়েছে গন্তব্য,
দীর্ঘদিন নরম ওলানের স্বাদ না পেয়ে,
কেহ ভুলে যায় আদি-অন্ত।
সাদা খ- খ- মেঘের ভেলা যেন,
ফোলে ফোলে দুধে ভরে যাচ্ছে,
তাই দেখে দেখে বাছুরের চোখ যেন,
দুধে সাঁতার কাটছে।
ও কিষানের বৌ, তোমার ওলান কি,
দুধে দুধে ফোলা?
সাদা মেঘের মতো তুমিও কি উড়ছো,
ওলান রেখে খোলা।
তোমার কৃষান কি লাঙল চালায় যেই হাতে,
ওলানও কি ধরে সেই হাতে?
সাদা ওলান মেঘে সাঁতার কেটে কেটে কি জন্মায় ফসল,
তোমার জমিতে?
বাবার হাতটি দীর্ঘদিন লাঙল চালিয়ে,
হাতের রেখা হয়েছিল অনেক ফাঁকা,
বাবার হাতের রেখাগুলোর দাগ যেন,
আমার শৈশবের মুখটি আঁকা।
মুক্ত বিহঙ্গ
সাবেকুন নাহার
মুক্ত হাওয়ার পালকগুলো বেজায় ছন্নছাড়া
সঙ্গী হবো তার সাথে পাই গো যদি ধরা।
নেবে কি হাওয়া আমাকে?
তোমার পথের সহযাত্রী বলে।
অহর্নিশ পাড়ি দেব পৃথিবীর অলিগলি
সুখকে নেব জড়িয়ে দুঃখকে দেব বলি।
থোকা থোকা মেঘ বলে আমার পিঠে চড়ো
সাদা-কালো মেঘ মুলুক দেখবো দু’জন চলো।
তাই না যদি হয়
চুপটি করে আর নয়
রাশি রাশি খুশি আর রঙে ভেজা মন
দুঃখের কাছে আড়ি বলতে করি আন্দোলন।
হাওয়ার পালক ধরতে আজি করছি যত পণ
হয়না যেন বৃথা সবি করি আস্ফালন।
কোন বিপিণে যাই হারিয়ে
কোন সে চাঁদের পাহাড় ডিঙিয়ে
ফেরারি মনের শূন্য হাওয়া লাগলো যখন গায়
ধু¤্রলোচন হলাম যেন শিকল ছাড়া পায়!
মানুষ
আবুল বাশার শেখ
আমি মানুষ হতে চাই মানুষ
শুদ্ধ পরিশুদ্ধ একজন সাদা মনের মানুষ
দুই হাত কিংবা দুই পা নয়
এক উদর কিংবা এক মাথা-
কোনটাই প্রয়োজন নেই,
একটা হৃদপিন্ড হলেই চলবে
যেখানে পবিত্র সব কথামালা
অনায়াসে যাওয়া আসা করবে অনায়াসে।
দু’টো চোখ আর কান জমা থাক
সূচালো নাকের সাথে মুখটাও
আর সব বরফের কাছে ছেড়ে দাও।
তীব্র ঝড়ের গতিবেগ দেখেছি বারবার
আগ্রাসী অগ্নির দহন একাধিক
পানির বহুরূপ নিয়ে ভেবেছি শতবার
কিছুই পাইনি কোন কিছুতেই।
সভ্যতার আড়ালে নগ্নতার রূপ
অট্টহাসি দেয় মৃত বিবেক দেখে
সুরের মাতলামী এখন তুতলামী
কণ্ঠ যাই হউক চেহারা হলেই চলে।
ক্ষমতার আড়ালে এলোমেলো ভাবনা
বেশ্যার মাতাল পারফিউম সব ভুলিয়ে-
ডুবিয়ে দেয় নগ্ন কামনার অতল সাগরে।
সময়ের ব্যবধানে ঐসব মুখেই শুনি
নীতিকথা, আগামীর স্বপ্নকথা।
থু দিই আমি ওদের মুখে
অঙ্গ প্রতঙ্গ ছিন্ন ভিন্ন করি হামেশা
ফিরে যাই আদিকাল ক্ষুদ্র অনুতে।
আমি কি মানুষ হতে পেরেছি! বলতে পারো কেউ,
ছিঃ আমি কাকে জিজ্ঞাসা করছি মুখোশের আড়ালে!
এই বহুরূপীদের ভীরে আমি থাকতে চাইনা
একটা সরল পথের পথিক হতে চাই
আমি মানুষ হতে চাই মানুষ।
বিজয়ের পদাবলি : ০২
কাঙ্ক্ষিত একটি আলোর শহর
রফিকুল ইসলাম
লাবণ্য প্রবাহে কনকময় জোছনা আসেনি আজও
আঁধার রাতের আঙিনা দ্বারে,
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ফিরে গেছে ক্ষীণতনু খ-পা-ুর চাঁদ
আমার আকাশ ছোয়া স্বপ্ন পারে।
দখিনের খোলা দরজায় কত বসন্ত বাতাস এসেছে
কতবার ফিরে গেছে আবার,
যেখানে ফোটে আগুনঝরা রক্তরাঙা শিমুল সম্ভার
পাখিরা বিজয়ের গান গাইবে অনিবার।
ফুলেরা ছুঁতে পারেনি পাষাণ দেবতাদের পদতল
কল্পনার সিঁড়িতে বুনেছে মাকড়সার জাল
চারিপাশ মৃত্যুর মতো কালো, থেমে গেছে কোলাহল।
ধুলোময় জানালায় গড়িয়ে পড়েছে ঝাঁঝালো দুপুর
ঝিঁঝিরা নেচে নেচে আর উড়ে না বাজিয়ে নূপুর,
অতশি চশমার ফ্রেমে কৃষ্ণচূড়ার তামাটে রঙ দেখি
জেনেছি, ভালোবাসারা ঠিকানা রেখে যায় না নাকি?
রেখে গেছে শুধু অনুভূতির অস্পর্শী ছায়ার মায়া
দীর্ঘশ্বাসে ভাঙে আধখানা মন নিষ্ঠুর পাথর নীরবে
ছিঁড়ে পড়ে ঝুলে থাকা আকাশের শুকতারা প্রগাঢ় অন্ধকারে।
স্বপ্নরা হেঁটে বেড়ায় শব্দহীন মধ্যরাতের উঠোনে
আধপোড়া সিগারেট পোড়ে, পোড়ে একাকিত্বের প্রহর
অন্ধকারের প্রচ্ছদ ছিঁড়ে দেখি স্বপ্নময় কাক্সিক্ষত একটি আলোর শহর ।
তর্জন
মাজরুল ইসলাম
শত বিরহের পর
লোকগুলোর সামনে আবার এসেছে নতুন হুমকি
তাইতো ঘরবাড়ি সব সাবাড়।
এখন আবার লোকগুলোর ভাবাবেগ নিয়ে
মিথ্যার বেসাতি করে।
কণ্ঠে বেমরশুমি ফুলের হার শোভা পাচ্ছে
যা মিথ্যার স্তোকবাক্য ছাড়া কিছু নয়।
ব্যাপারটা নিয়ে সারাদিন ধরে ফ্যাসাদ চলছে
এবার আসবে তার দুয়ারে দুঃসময় আর
তর্জনীর তখন উঠবে নাভিশ্বাস...
তুমি কি সেই বিজয়?
সুমন আহমেদ
তুমি কী সেই বিজয়?
যার তরে বাবা আজও অবধি নিরুদ্দেশ...
ফিরবেনা জেনেও অবুঝ মন ফিরে আসার প্রত্যাশায়
সকাল থেকে সন্ধ্যা- মায়ের নিরন্তর প্রতীক্ষা।
আর শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে-কেঁদে বুক ভাসাই।
তুমি কি সেই বিজয়?
সন্তানের সম্মুখে ধর্ষিতা জননী- ভাইয়ের সম্মুখে বোন,
নববধূর অঙ্গে সাদা কাফনের সাজে বিধবার সাজ।
নদীর স্রোত বানের পানির মতো সারি বদ্ধ হয়ে ভেসে
যাওয়া অসংখ্য লাশের ভেলা- আর রক্তে পচা গন্ধ,
রক্তের খুলিতে মেতে উঠা তান্ডব ধ্বংসলীলার এক-সাগর
রক্তের বিসর্জনে পাওয়া লাল-সবুজের পতাকা।
তুমি কি সেই বিজয়?
স্বৈরাচার দেশদ্রোহী বিশ্বাস ঘাতক রাজাকারদের স্বপ্নের
স্বপ্নের নৈরাজ্যের দেশ বানাতে দাওনি,
হায়েনার শিকার ধর্ষিতা উলঙ্গ অবলার গায়ে- সেদিন
তুমিই কী পড়িয়ে ছিলে স্বাধীনতা বারো হাত শাড়ি?
মুক্তির লড়াই
মুক্তির লড়াই
সানজিদা আকতার আইরিন
বিঘা দু এক জমি ছিলো করিম মুন্সির। স্বামি স্ত্রী খাটা খাটনি করে সংসারের শান্তির গতি বাড়াতে কখনো আলসেমি করেনি বলে খেয়ে পড়ে ভালোই কাটছিলো দিন গুলো তাদের । বেশি খাটনির ধকলে করিম মুন্সির স্ত্রী নেতিয়ে পড়ে খানিকটা, ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা জটিলতা। যার খেসারতে রুগ্ন কায়া দেহ খানা ফেলে তার আত্তা পৃথিবীর মায়া ত্যাগকরে খুব সহজে। ছেলে মেয়ে দুটোর যতেœর ভার সৎ মাকে দেয়া হয় অল্প কদিনেই। জমিলার তিল তিল করে জোড়ানো সংসার মাজেদার দখলে যাওয়ায় অধিকারের তুলনায় ক্ষমতার দাপট বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। নির্যাতন আর নিপিড়নের ভারে কচি ছেলেমেয়ে দু’টো কোণ ঠাসা হয়ে থাকলেও কিছুই করার থাকেনা বাবা করিমের। ক্ষমতা যার আইন তার বলেই শিশু দুটির সহ্যের সীমা পার হয়ে যাওয়া অত্যাচারও মুখ বুঝে সয়ে নেয়। কিছুতেই বউকে সামলাতে পারছিলোনা বলে সন্তানদের উপর অত্যাচার হয় জেনেও না জানার ভান করে সবসময়। এ যেনো নিজের ঘরে পরবাস। ছয় বছরের মেয়ে সুমনা কিছুই বোঝেনা বলে নিরিহ বোবা প্রাণির মত মার খেয়ে লুকিয়ে কাঁদে। দিনের পর দিন অত্যাচার সইতে সইতে একদিন বড় ছেলে তমাল তেড়ে ওঠে সৎ মাকে। স্ত্রীকে শান্ত রাখতে নিজের ছেলেকে থামিয়ে উল্টা ধমক দেয় বলে রাগে যন্ত্রনার মাত্রা দ্বিগুন হয়ে বুকের মাঝে জ্বলতে থাকে তমালের। মা বেঁচে নেই বলে বাবাও এমন পর হয়ে গেলো? ছোট বোনটার কথাও ভাবেনা বাবা। চোখ থেকে প্রতিশোধের আগুন ঢিকরে বের হতে চায় তার। ছোটবোনের জন্য সে কিছুই করতে পারেনা, এই যন্ত্রনায় ছট ফট করে দিন কাটে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে নিজের ও বোনের অধিকার রক্ষা করা সহজ হবে তাই একদিন প্রতিশোধের আগুনকে অবলম্বন করে ঘর ছাড়ে তমাল।
ঢাকায় একটি বাড়িতে আশ্রয় পায় তমাল। এ বাড়ির সবার বহু আদর পেয়ে তমাল এ বাড়ির এক জন হতে পেরেছে সহজে। বাড়ির একমাত্র ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়া সবুজের হাত ধরে এ বাড়িত এসেছে বলে তার খুব ভক্ত তমাল। সারাক্ষণ তার কাজ গুলো আগে আগে করে দেয় সে। নিজের জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর তাড়নায় সবুজের আশ্রয়টুকু তমালের প্রয়োজন। ছোট বোনকে স্বাধীন করতে নিজেকে সাবলম্বি হওয়ার জন্য সবুজের মত কাউকে পাশে পাওয়া দরকার । সবুজের বন্ধুরা বাড়িতে এলে চা নাস্তা এগিয়ে দেয়ার ফাঁকে তমাল ওদের কথায় কান পাতে। আজকাল তারা প্রায়ই গম্ভীর মুখে আলাপ করে। তমালকে থাকতে দেয়না ঘরে। আগের মত গল্প, আড্ডা হয়না সেটা তমাল বুঝতে পারে। সারাক্ষণ কি পরিকল্পনা ও পরামর্শ করে খুব জানতে ইচ্ছে করে তমালের। সবুজ ইদানিং রাত করে ঘরে ফিরে বলে সবুজের বাবা মা খুব চিন্তা করে। মাঝে মাঝে খুব বকা ঝকা করে। সবুজ কোন প্রতিবাদ নাকরে সয়ে নেয় নিরবে। নির্বাচন, অধিকার, ভোট, পার্লামেন্ট সবকিছু না বুঝলেও বারো বছরের বালক তমাল অধিকার হারানোর বেদনাটা বোঝে ঠিকই । বয়সের চেয়ে অভিজ্ঞতা খানিকটা বেশি বলে এতো কঠিন কথাও সহজেই অনুধাবন হয় তার। অধিকার শব্দটা অন্তরের গভীরে ধাক্কা দেয় তমালের। সৎ মা তাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে এটা তমাল জানে। কিন্তু দেশ মার অধিকারের বিষয়টি পরিষ্কার নয় ততোটা। কিছু দিন পর সবুজ বন্ধুদের নিয়ে দরজা বন্ধ করে রেডিওতে এক ভাষণ শুনছিলো। কি যে অদ্ভুত কণ্ঠ। দরাজ গলায় সবাইকে অধিকার রক্ষার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর যখন ‘বলেন রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো। এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’ তখনই তমালের শিড় দাড়া শক্ত হয়ে ওঠে। তার কথায় রক্তে বিজলি খেলে। বুকের মাঝে তাজারক্তের প্রবাহ অনেক কিছু করার তাড়া দেয়। শত্রুর সাথে মোকাবিলা করার সাহস যুগিয়ে দিয়ে মৃত্যু ভয়কে জ্বয় করতে শেখায়। এক দিনে অধিকার দেশ মা, ভোট সব কিছু বুঝতে না পারলেও আজ বঙ্গবন্ধুর ডাকে বারো বছরের তমাল শত্রু তাড়ানোর শপথ নেয় । এতোদিনে সবুজের চোখের ক্ষীপ্র চাহনি পরিষ্কার তমালের কাছে। এমন বজ্র কণ্ঠের আগুন ঝড়া বক্তব্য কিশোর তমালের বুকের ক্ষত এর জ্বালা কোটিগুন বাড়িয়ে দেয় বলে মনে মনে নিজের জ্বালার চেয়েও দেশ মায়ের জ্বালা আগে মেটাতে হবে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই এ লড়াই এ তমালকেও সামিল হতে হবে। দরজা ভেদ করে ঘরে ঢুকে সবুজের চোখে চোখ রেখে তমাল ঘোষণা করে বাংলা মায়ের সন্তান হয়ে তার পাশে দাঁড়ানোর। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সেও সাড়াদিতে চায়। তমালের শক্ত চোয়ালের দৃঢতা আর চোখের প্রতিশোধ পরায়ণ চাহনি দেখে সবুজ দলে টেনে নেয় তমালকে। আস্তে আস্তে তাকে কিছু সুক্ষ কৌশল ও কাজ শিখিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে বলে। দেশের পরিবেশ ভালোনা বলে ঢাকা থেকে দলে দলে লোক গ্রামে চলে যাওয়ার হিরিক লেগে যায়। যুবক ছেলেরা শহর থেকে হাওয়া । এখানে আগুন ওখানে আর্মি, পুলিশ ধর পাকড় চোখের সামনে অনেক উত্তেজনা তমালকে আরো দৃঢ হতে সাহায্য করে। সবুজ ভারতে যাবার আগে বাবা মাকে গ্রামে যাবার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে তমালকে পাশের একটা মুদি দোকানে কাজ পাইয়ে দেয়ার ফলে আশ্রয়টুকু থাকে। সারা দিনের কাজ শেষ করে রাতে দোকানেই ঘুমিয়ে থাকে। কেনাবেচার ফাঁকে ফাঁকে তথ্য আদান প্রদান করতে অসুবিধা হয়না তমালের। নিজের অধিকারের লড়াইটা এবার দেশ মায়ের জন্য বরাদ্দ হলো বলে চোখের আগুন বুকের আক্রোশ সব ই এখন পাক সেনাদের খাকি পোশাকের উপর বর্তালো। তবুও তমাল কিছু না জানার ভান করে সারাদিন কেনাবেচায় মন দেয়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি এক বৃদ্ধ ভিক্ষারির আটা কেনার ছলে চিরকুট হাত বদলের কাজটি করে দক্ষ ভাবেই। সেই রাতে তমাল স্বশরীরে যুদ্ধ দলে যোগ দেয়।
সাতাশ জনের দলটির কারো প্রকৃত চেহারা বোঝার উপায় নেই। সবার মুখে লম্বা দাড়ি আর লম্বা চুল। নাওয়া খাওয়ার বালাই নেই। চোখ মুখে যেনো প্রতিশোধের ক্রোধ। সকলের চোখে ভয়ালো শিকারি বাঘের তীক্ষè দৃষ্টি যেনো শিকার খুঁজে ফেরে। সবুজ এই দলের কমান্ডার। গত সাত টি অপারেশনে ওরা ব্রিজ ভেঙ্গেছে এগারোটি আর হানাদারদের ক্যাম্প উড়িয়েছে দুটি, গ্রেনেড় হামলায় সেনা দলের ট্যাংক হামলা করেছে বহু। এতে কত হানাদার লোপাট হলো বলা মুসকিল তবে কাজের অগ্রগতি হয়েছে অনেক। তমাল মুক্তিযোদ্ধাদের সব কাজে সাহায্য করে আর মাঝে মাঝে বন্ধুক চালানো শেখে। গহীন জংগলে তাদের ক্যাম্প। দিনের আলোও এখানে প্রবেশ করেনা। যত্র তত্র সাপ বিচ্ছুর ছড়াছড়ি থাকলেও সে নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। সকলের মনে বঙ্গবন্ধুর একটাই ¯েœাগান, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো। এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ সকাল হবার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা বেড়িয়ে পড়ে ফেরার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। অপারেশন হয় রাতে। তমালকে গত কদিন সাথে নেইনি তারা। আজ ভোর রাতে দলের সদস্যরা তমালকে সাথে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায়। নতুন টার্গেট, নতুন পরিকল্পনা। সবার রক্তে চাপা উত্তেজনা, আর চোখে প্রতিশোধের আগুন তাদের যুদ্ধের অনুপ্রেরণা। মাঝে মাঝে যায়গা বদল করে নতুন নতুন কৌশল এটে শত্রু ঘায়েল করাই তাদের লক্ষ।
মাস খানেকের মধ্যে তমাল হয়ে ওঠে এক দক্ষ যোদ্ধা। গত দুইটি অপারেশনে তমালের চোখের আগুনে বুলেটের গতিকে তীব্র থেকে তীব্র করে। হানাদারদের ঘায়েল করতে এক খানা অ¯্র বরাদ্দ পায় সে। গত অপারেশনে তিন সহযোদ্ধাকে হারিয়ে মর্মাহত হলেও অনুতাপে সময় নষ্ট না করে তমালকে অস্র চালানোর অনুমতি দেয়। প্রথম অপারেশনে তমালের কাজ দেখে পিঠ চাপড়ে সবুজ বলেছিলো সত্যি তুই বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। গর্বে তমালের বুক ভরে যায়, ফলে দিগুন আগ্রহে কাজ করে।
ডিসেম্বর মাস শুরু। দেশের কোথায় কি অবস্থা তা সঠিক ভাবে বলা যায়না তবে রেডিওর কিছু গান সবাইকে উজ্জিবিত করে। কত নিহত সঙ্গীকে হেথা হোথা ফেলে এগিয়ে যেতে হয়েছে তার হিসেব নেই। গত অপারেশনে মেডিকেল ছাত্র উজানের মাথার খুলি উড়ে গেলে বিভৎস লাগছিলো। কিন্তু এসব এখন মন কাঁদায়না, শুধু প্রতিশোধের আগুন জ্বালায় চোখে। কত বিপদ উপেক্ষা করে বনে জঙ্গলে দাপিয়ে বেড়াতে হয় তার শেষ নেই। একটাই নেশা শত্রু ঘায়েল। একটাই আশা স্বাধীনতা।
ডিসেম্বর চৌদ্দ তারিখ প্রায় সাত দিনের পরিকল্পনার আক্রমণ। খুব শক্তিশালী সেনা ঘাঁটি। ঘায়েল করা সহজ নয়। জীবন মরণ লড়াইয়ে যা যা করণীয় সব কিছু করতে হবে। রাত পৌনে বারোটার পর আস্তে আস্তে পজিশন নেয় সবাই। খবর আছে ক্যাম্পে আশি জনের মত সেনা আছে। মুক্তি দলের মাত্র এগারো জন। এর মধ্যে আহত আছে দুইজন। তবুও কারোভয় নেই কোন শংকা নেই। পরিকল্পনা মাফিক পজিশন নিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টা পর আক্রমণ করে মুক্তিদল। নিরিবিলি রাতে তারাও প্রস্তুত হতে কয়েক মুহুর্ত সময় লাগে। এতেই গ্রেনেড় বর্ষনে সৈন্য ঘাঁটি অনেক বেশামাল হয়ে পড়ে। মুহুর মুহু গুলি বর্ষণে যুদ্ধ চলে ঘণ্টা খানেক। তার পর মুক্তিদল পরিকল্পনা মাফিক ক্যাম্পের পিছন দিক থেকে পজিশন নেয়। মুক্তিদলের গুলির আওয়াজ না পেয়ে পাক সেনারা বুঝতেই পারেনি কি হতে যাচ্ছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর গ্রেনেড হাম্লায় উড়ে গেলো সেনা ক্যাম্প। সুনসান নিরবতায় আরো কিছু সময়। আবার চললো মুক্তিদলের গুলি। কিন্তু প্রতিপক্ষের কোন সাড়া না থাকায় পরিকল্পনা মাফিক আগাতে থাকে মুক্তিদল। কাছে যেতেই আহত জনা কয়েক পাকসেনা আবার গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। সাথে সাথে দুই মুক্তিযোদ্ধার শরীর ঢলে পড়ে। সবুজের বাম হাতে গুলিবিদ্ধ হয়। মুক্তিদল আর দেরি না করে আবার গুলি চালাতে থাকে। দুটি তাজা প্রাণের বিনিময়ে দখল হলো ঘাঁটি।
গুলিবিদ্ধ আহত সবুজকে বহু কষ্টে নিয়ে আসা হলো ক্যাম্পে । প্রচন্ড যন্ত্রনায় কাতড়াচ্ছে বলে তমালের ভেতরের ছোট্ট মনটা আজ জেগে উঠে। বাড়ি ছাড়ার পর সবুজই তমালের একমাত্র আশ্রয়। এতোদিন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে মনকে শক্ত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু আজ সব গলে জল । কত মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছে। সবুজ আহত মাত্র। তবুও তমালের মন ভেঙ্গে গেছে। যুদ্ধ করতে করতে গুলি খাওয়া আহত সৈনিকের চিকিৎসা করার জন্য কিছু গোপন চিকিৎসক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। এমন কাউকে ধরে নিয়ে এসে ক্ষত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগানো হলো । মাংস ছুয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। সমস্যা না হলেও ভুগতে হবে অনেক। সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। যুদ্ধ এখন চরম পর্যায়ে। কি করে পরের টার্গেট ঠিক হবে? চোখ শুধু শিকার খোঁজে। হেডকোয়াটারে খবর দেয়া হয়েছে নতুন কমান্ডার ও কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধার শক্তি যোগ হবে এই দলে।
ঢাকার পরিস্থিতি ভালো নয় খবর এসেছে। ঘর থেকে নামিদামি লোকদের ডেকে নিয়ে মেরে ফেলছে বা গুম করে ফেলছে। অনেকেরই হদিস মিলছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে আগুন জ্বলছে। নতুনটার্গেট এসে গেছে। প্রস্তুতি চলছে। এই প্রথম অ¯্র আর ভালোবাসার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে তমাল অসহায় বোধ করতে লাগলো। প্রচন্ড তাপে সবুজের গা ফেটে যাবার পালা। জ্বরের প্রকোপে জ্ঞান হারিয়েছে কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেলো। জ্ঞান ফেরার নাম মোটে নেই। তমাল ঠায় বসে আছে। মাটিতে বিছানো খড়ের বিছানাও আজ রাজার পালংক মনে করে সবাই ক্লান্ত দেহ নেতিয়ে দেয়। সারা রাত তমাল দু চোখের পাতা এক না করে প্রতিক্ষায় থাকে কখন সবুজের জ্ঞান ফিরবে। সুর্য উঠি উঠি করছে। কিছুক্ষন পরই পুব আকাশে নতুন আলোর আভা দেখা দিবে। পাখির কিচির মিচির ডাক কানে আসছে। প্রতিক্ষার রাত সহজে পার হয়না বলে মনে হয়। হঠাৎ সবুজের জ্ঞান ফেরায় আহ্লাদে তমালের চোখ পানি ছল ছল করে। যে চোখে প্রতিশোধের আগুন সেই চোখে আজ পানির ফোটায় সহযোদ্ধার প্রতি আবেগের প্রকাশ হয়। সবুজ তার আশ্রয়। তমালের শক্তির অনুপ্রেরণা। বেলা গড়াতে না গড়াতে রেড়িওতে বিজয়ের সংবাদ শুনে উল্লাস আর, আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায় তারা। আর যুদ্ধ নয় এবার সবাই ঘরে ফিরবে যার যার আপন জনের মাঝে। কত মা কত বোন কত বাবা প্রতিক্ষায় আছে তাদের সন্তানদের। তমালের মনে পড়লো ছোট বোনের মুখটি। তমাল চোয়াল শক্ত করে মনে মনে ভাবলো এবার তার স্বাধীন হবার পালা। ছোটবোনের মুখটি বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তমালের। মুক্তি সেনাদের সেই ঘাঁটিতে উল্লাসের ঝড় বইতে শুরু করলো। এ কয় মাসের হারানো সাথীদের কথা মনে পড়ে মর্মাহত হয় তারা। একচোখে হারানোর বেদনা আর এক চোখে স্বাধীন হবার আনন্দ তাদের আপ্লুত করে তুলেছিলো। কত কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার নতুন সূর্য কিনে আনতে হয়েছে তা শুধু বাংলার ঐ দামাল ছেলেরাই জানে। তাই আজো আমরা গভীর ভাবে সেই বীর মুক্তিসেনাদের জানাই অজ¯্র বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।