ফিলিস্তিন ভ্রমণের স্বপ্ন !
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ফিলিস্তিন ভ্রমণের স্বপ্ন
মুঞ্জুরুল হক
মামার সাথে নিজেকে ফিলিস্তিনে আবিষ্কার করে চমকে উঠলাম। বর্তমানে নির্যাতিত-নিপিড়ীত ফিলিস্তিনের অবস্থা সম্পর্কে সবাই অবগত। এতদাসত্ত্বেও মামা কীভাবে কী পদ্ধতি অবলম্বন করে আমাকে সাথে নিয়ে আসলেন এই পবিত্রভূমিতে আমি জানিনা। মসজিদে আল আকসা সম্মুখে পবিত্র ভূমিতে দাড়িয়ে আছি। ভাবতেই হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। অবশ্য পরিস্থিতির নাজুকতার দারুণ অভ্যন্তরে কিছুটা ভীতিও বিরাজ করছে। মামার সাথে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছি। আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম যেন একটা গন্ধ আসছে না মামা? মামা উত্তর দিলেন, ফিলিস্তিনের মাটি থেকে তাজা রক্তের গন্ধ আসছে। উত্তরটা শুনেই আঁতকে উঠলাম । স্মার্টফোনে দেখা দৃশ্যগুলো স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবো কখনো কল্পনাও করিনি। মামার সাথে সামনে অগ্রসর হলাম। চারিপাশে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন, লাশ ও কবরের আধিক্য, হসপিটালের শয্যাশায়ী শিশুদেরকে দেখে একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। আসলে মানুষের জীবনে যে কতো অসহায়ত্ব থাকতে পারে, তা এসব হসপিটালে না গেলে বুঝা যাবে না। কী বীভৎস! কি ভয়ংকর! হসপিটাল থেকে বের হয়ে একটু দুরে আসামাত্র বিকট এক আওয়াজে আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠলো। ভয় পেয়ে মামাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। পেছনের দিকে তাকিয়ে এক্কেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় অসাড় হয়ে গেলো আমার গোটা দেহ। হসপিটালের উপর একটা বোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছে। পুনরায় স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো শয্যাশায়ী শিশুদের রক্তমাখা দৃশ্য। ভাবনার চোরাবালিতে ডুবে উ™£ান্তের মতো হয়ে গেলাম। চিৎকার দিয়ে কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। চোখ খুলে নিজেকে নতুন একটা জায়গায় আবিষ্কার করলাম। উঠে পুনরায় মামার সাথে হাঁটতে লাগলাম পবিত্রভূমির সম্মুখভাগে। একটি শিশু গাছের ছায়ায় বসে অঝোরে কান্না করছে। মামা কিছুক্ষণ কথা বলে জানতে পারলেন, মেয়েটির নাম জান্নাত। তার পিতা-মাতা পিশাচদের নির্যাতনে ইন্তেকাল করেছে। ভেতরটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিলো। আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কত্তো কিছু দেখাবেন মামা? মামা কিছু কথা বললেন। এই হলো আমাদের আবেগের শহর। পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্র শহর ফিলিস্তিন। এখানে পিতা স্বীয় সন্তানকে কবরস্থ করছে। সন্তানের সামনে নির্দোষ পিতাকে বন্দী করা হচ্ছে। নারীরা মানুষরূপী হায়েনাদের হিং¯্র থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রিয়জনদের সামনে। অবৈধভাবে দখলদারত্বের কাজ করছে নিকৃষ্ট মানুষেরা। চোখের সামনে প্রিয়জনদের শরীর ছিন্নভিন্ন হচ্ছে আধুনিক অস্ত্রের আক্রমনে। মামা রক্তচক্ষু নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আর কাঁপছিলেন। হঠাৎ আমার শরীরে তীব্র উষ্ণতা অনুভব করলাম। রক্ত গরম হয়ে গেছে। তাদের জায়গায় নিজেকে রাখলাম। শিশুদের দৃশ্য আর মুসলিম ভাইদের অবস্থা ব্রেইনে স্থাপন করলাম। আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। হাতে পাথর নিয়ে ক্রোধে দৌড়ে গেলাম মানুষরূপী নিকৃষ্ট প্রাণীদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। অল্প কিছুক্ষণ পর আমার বুকে বিশালাকৃতির বুলেট বৃদ্ধ হলো। মৃত্যু শয্যায় শায়িত আমি। মামা কোলের উপর আমার মাথা রেখে শিশুর মতো কান্না করছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো আমার একটুও কষ্ট হচ্ছিলো না। মুখে মুচকি হাসি লেগে ছিলো মৃত্যু অবধি।
ঘুমন্ত ছেলের মাথায় আদরের হাত স্পর্শ করলেন বাবা। কোমল কন্ঠে ডাকতে লাগলেন আবুল বাশার! আবুল বাশার! ওঠো বাবা! তাহাজ্জুদের সময় পেরিয়ে চলে গেলো যে। ঝটপট কাথা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে হাঁপাচ্ছিলাম। একি! নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম! স্বপ্নের ঘোর এখনও পুরোপুরি কাটেনি। স্বপ্নের স্মৃতিচারণে হৃদয় আকাশে মেঘের মতো ভেসে উঠলো নির্যাতনের নির্মম দৃশ্যগুলো। ঝটপট প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে নামাজান্তে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ জানালাম। সর্বযুগেই আল্লাহ তায়ালা মজলুমদের ফরিয়াদ কবুল করেছেন। অচিরেই ফিলিস্তিন বিজয় লাভ করবে ইনসাআল্লাহ!
জগন্নাথপুর, সলঙ্গা, সিরাজগঞ্জ
কতো দূর উত্তর...
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
কতো দূর উত্তর
আরিফুল হাসান
যুদ্ধে আমরা উত্তর দক্ষিণ ভুলে গেছি। মাথার উপরে মৃত্যুর মেঘ, আর নিচে রক্তমাখা বৃষ্টি। হ্যাঁ, আমরা ছুটে চলছি নবজাতকের লাশের উপর পা রেখে। হয়তো পিতার লাশের সাথে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি মায়ের লাশের উপর। আমাদের বোনগুলোর লাশ আমরা কাঁধে বহন করে ছুটছি আর ভাইদের কবর দেবার সময় পাইনি। ছোট্ট শিশুটি কি হাত ফসকে বেরিয়ে গেলো নাকি সহযাত্রীদের মধ্যে কমবয়েসী তরুণেরা পরিণাম চিন্তা না করে এগিয়ে গেলো অকস্মাৎ। আমরা অচিরেই আমাদের সামনে আকাশহামলা, স্থল ও জল হামলা হতে দেখি এবং অগ্রবর্তী দল অথবা হাত ফসকে যাওয়া শিশুটির লাশ দেখি ছিন্নভিন্ন হয়ে হয়ে উড়ে যেতে আকাশে অথবা লাশ দেখি নাÑদেখি সামনেই ভেঙে পড়ছে কোনো পনেরো তলা দালানÑকখনো পর পরÑএকাধিকÑঅনবরত। প্রচ- ধোঁয়া আর বিস্ফোরণে আমাদের কানে-চোখে তালা লেগে যায়। যখন চোখ খুলি দেখি আমাদের পথের চিহ্ন মুছে গেছে; আমরা আবার পথ হারাই।
মুর্ছাগত আমরা প্রায় যখন জেগে উঠি আমরা আবার ছুটি ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় যুদ্ধবিমান আর পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে থাকে থরথর। আমরা বুঝতে পারি, পালাতে চাইলেও পথ নেই। সব পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। তবু জীবনকে ভালোবেসে আমরা উত্তরের দিকে যাত্রা ঠিক করি কিন্তু ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ আমাদেরকে সূর্যের অবস্থান ঠাওরেও পথ চিনতে সায় দেয় না। আমাদের পায়ের নিচের পথ হারাতে থাকে; আমাদের জীবনের পথ হতে থাকে বঞ্চনা।
এভাবে আমাদের সব পথ হারাতে থাকলে আমরা হয়ে পড়ি পথ হারা পথিক এবং আমাদের কাঁধের উপর বোনদের লাশ আরও ভারি হয়ে উঠে। আমাদের পায়ে আর কোনো বল পাই না। আমরা যাত্রা থামাই না, কিন্তু আমরা পথচলার দিশাও যে পাচ্ছি এমনটাও নয়। ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে আমরা আন্দাজে পথ চলতে থাকে। প্রচ- ধুলিউড়া গর্জন আর বিমানের তোরজোর আমাদের দিগভ্রান্ত পথিকের মতো আচ্ছন্ন করে। আমরা অন্ধবধির এবং মুক হয়ে হেঁটে যাই।
এ অন্ধত্ব আমাদের নিজেদের আনয়ন। নিজেদের জান বাঁচাতে আমরা যেহেতু পথে নেমেছি এবং পথই যেহেতু আপনÑআমাদেরকে তো পথই হারাতে হবে। তবু যত সংশয় থাকুক, ভয় থাকুক মৃত্যুর, তবু মৃত্যুকে এগুনোর মিছিল আমাদের দীর্ঘতরো হয়। আমরা দেখতে পাই, ভিবিন্ন জায়গা থেকে লোক ফুরে উঠে আসছে অন্ধকার থেকেÑ সূর্য না চাঁদ, নাকি নক্ষত্রের মতো মানুষ ভেসে আসছে অসহায়। তারাও আমাদের মতো উত্তরে যেতে চায় এবং দিগধাধার খেয়ালে পথ ভুলেÑ স্বজন পরিজন হারিয়ে আপনজনের লাশ কাঁধে করে ছুটে যাচ্ছে।
আমাদের বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আর আমাদেরকে করা হয়েছে মৃত্যুর সমার্থক। কেননা আমরা বন্দি এক মুক্ত কারাগারে আর মারনাস্ত্র আমাদের তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আরেকদিকে আমাদরে নিস্ক্রিয়চোখ আপাতঅর্থে জল ফেলে অক্ষম হুহুংকারে। তখনও আমাদের হুঁশ হয়নি। আমরা পুরোপুরো জেগে উঠিনি আর মৃত্যুর রং স্বপ্ন থেকে আমাদের ফেরানোর কোনো প্রয়োজন দেখে না কেউ। তেমন শক্তিশালী কেউ সরাসরি আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি শুধু মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা ছাড়া আমাদের সঙ্গে আর কিছুই সাথী হয় না। তাই আমরা হয়তো অন্য একটি দূরবর্তী অথবা নিকটবর্তী ভবিষ্যতের দিকে চোখ রেখে জেগে থাকি। হয়তো রাত হয়েছে, হয়তো রাত এখন অনেকÑকিন্তু আমাদের চোখে কোনো নক্ষত্র বা আকাশ প্রতিয়মান হয় না এবং পাই না আমরা সূর্যেরও হদিস।
ভাবতে ভাবতে আবার আমাদের উপর আক্রমণ আসে এবং কোনো ক্ষেপনাস্ত্র আমাদের শক্তিকেন্দ্রে আঘাত হানে এবং কাঁচের বয়ামের মতো গুড়িয়ে যেতে দেখি আমাদের স্বপ্নগুলো। এই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি চাই বলেই আমরা উত্তরে ছুটছি, কিন্তু এ ছোটার যেনো শেষ নেই।
আমরা আরও কিছুদূর পথ চলি। আমাদের নারীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাদের সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে শোকের অন্তরালে এবং আমাদের কিশোরিরা চপলতা ভুলে যেনো হয়ে পড়ে আশি বছরের বৃদ্ধা আর আমাদের বৃদ্ধগুলো যেনো ধুকে ধুকে মরতে মরতে হয়ে যায় কবরের ধূলোবালি।
মেঘের রং মুছে যায়, ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে পড়ে আর ঘাসগুলো ঝলসে যায় বোমার আঘাতে। শাদা ফসফরাস আমাদের মৃত্যুগুলোকে আরও বেশি কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং আমরা মৃত্যুকূপে পড়ে উত্তোরণের আশা পোষন করি। এ লড়াইটা চালিয়ে যেতে আমাদের শিশুদের জন্য শিক্ষা থাকবে যে আগ বাড়িয়ে এমন কিছু বলতে নেই যার মাসুল তাদের কাছে অজানা। এবং সময় ও সুযোগজ্ঞান থাকা স্বত্বেও ভূখ-ের স্বাধীনতার প্রতি আমাদের প্রচ্ছন্ন প্রেম এতদিনে সাগরের ঢেউয়ের মতো জেগে উঠে এবং জন¯্রােত আরও দীর্ঘ হয়। ধীরে ধীরে পৃথিবীর মানচিত্রের আদলে তৈরি হয় ফিলিস্তিনের মুখ।
ধ্বংসস্তুপ পেরিয়ে আমরা আবার কোনো লোকালয়ে পৌঁছে যাই এবং বরাবরই মানুষশূণ্য লোকালয়ে আমাদের তৃষ্ণার নিবারণের কোনো জায়গা থাকে না। বাড়িগুলো ভুতুরে বাড়ির মতো পড়ে আছে আর রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে নিভে আছে বাতি। এ কোন অন্ধকারে আমরা দিনাতিপাত করছিÑআমরা বুঝতে পারি না। তবু আমাদের মৃত্যুগুলো আমাদের সাথে প্রবঞ্চনা করে আমাদের আলেয়ার ভেতরÑশোকের ভেতর কোন সে জুলফিকার চমকাবে তার আশায় আমরা জেগে থাকি। পথ চলি, দীর্ঘ ক্লান্তির।
আমাদের ক্লান্তিগুলো ফুরোয়। আমরা কোনো ভাঙা কার্ণিশে জিরিয়ে নেই অথবা হামলার আশংকায় আত্মগোপন করি। আমাদের নির্দিষ্ট সংখক সহযাত্রী প্রতিদিন খুন হন আর আমাদের নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে দ্বিগুন সংখ্যক মানুষ আবার, আবারও পথে নামে। যার কারণে আমাদের জন¯্রােত আরও দীর্ঘতরো হতে থাকে এবং দীর্ঘতরো ক্ষুধা, দীর্ঘতরো মৃত্যুভয় এবং মুহুর্মূূহু হামলা আমাদের কাবু করে ফেলে। আমাদের সন্তানে হাঁটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে প্রায় এবং আমাদের লোকগুলি, মহিলাগুলো এবং আমাদের বৃদ্ধরা পথশ্রমে, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে মারা যায় কেউ কেউ।
এতো মৃত্যুর পরেও আমাদের পথ চলা শেষ হয় না। আমরা আসলে উত্তরে যেতে চাই না। আমাদেরকে পাঠানো হচ্ছে। চেনা জন্মভূমি থেকে, চেনা অধিকার থেকে আমাদেরকে উৎখাত করা হচ্ছে এবং এগুলো যে কেনো করা হচ্ছে তার কোনো সঠিক জবাবও নেই আমাদের কাছে অথবা হামলাকারী খুনেদের কাছে। আমরা এখন শত্রু-মিত্রের সমার্থক।
পৃথিবীর পরিহাসে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেঠে এবং আমরা দাবার গুটি, জুয়ার গুটি হয়ে পশ্চিমা বিশ্বে খেলে যেতে দেখছি মানুষের আয়ু।
উৎক্ষেপিত নরক আমাদের চারপাশে আর আমরা দিকচিহ্নহীন ছুটছি উত্তরে। ছুটতে ছুটতে হিসেব রাখছি ঘড়ির কাটার অথচ ঘরিটা তখন অচল। প্রহরের হিসেব রাখবোÑ সে উপায়ও নেই। অষ্টপ্রহরব্যপী আমাদের ছুটে চলা জীবনযুদ্ধের এক পলায়নপরতা হলেও আমাদের জন্য মঙ্গল। কারন মানুষ বাঁচলে দেশ বিনির্মাণ হবে। একটি মানুষের মূল্য মানচিত্রের চেয়েও বড়। তবু আমাদের মানুষেরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের সেতু তৈরি করছে। আমরা তাদের মৃতদেহের কাছে থমকে দাঁড়াই এবং মৃতদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা আরও উত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
আমরা আরও বেশি করে উত্তরদিক হারাই। কোন পথে যাচ্ছি, কোনো যাচ্ছি সেসবও একসময় গৌণ হয়ে উঠে। শুধু জানি পেছনে মৃত্যু তাড়া করেছে ফলে হয় আমাদের পালাতে হবে অথবা রুখতে হবে।
ঢাকা
ফিলিস্তিন বিষয়ক পদাবলি : ০১
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
বড়দের ক্লাস থেকে ভেসে আসছে পায়ের নির্মম আওয়াজ
দেলোয়ার হোসাইন
আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের পাতাজুড়ে
কেবলই লেখা আছে মৃত্যু। তবু পড়া না
পারার ভয় নিয়ে আমরা রোজ মক্তবে যাই,
পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে টের পাই কাঁপছে
শরীর। ভিতরে বড় হতে থাকে- নাবালক
অসুখ, পাশ কেটে বাঁচতে গিয়ে দেখতে পাই
আমাদের ডাকছে প্রতারিত লোভ! ক্রমশ
দূরে সরে যায় প্রার্থনার আকাশ। মাঝে
মাঝে ভুল করে ঢুকে পড়ি বড়দের ক্লাসে...!
রুটিনের পাতায় কোনো দাগ পড়ে না, কেবল
দীর্ঘ হতে থাকে পড়া না পারার ভয়, বাড়ছে
শরীরের কাঁপুনি, সাবালক অসুখ, প্রতারিত
লোভ, দূরের আকাশ, বড়দের ক্লাস থেকে
ভেসে আসছে পায়ের নির্মম আওয়াজ...!
হাতের রেখা
আসহাবে কাহাফ
এখনো আহত পাখি দেখি- ডানা ঝাপটায়
রক্তাক্ত পালকের ভাজে বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে
স্বাধীন একটা ভোরের আশায়
আলপথে হেটে হেটে পাড়ি দিবে সোনালি ধানের বিল
হায় চিল, রঙিন ডানার সফেদ শঙ্খচিল!
দেশে দেশে আজো শিকারী পাতছে ফাঁদ
গণকের সম্মুখে অগণিত হাত- হাতের রেখা
পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে পাখির মতন একা।
ফিলিস্তিন বিষয়ক
নাঈমুল হাসান তানযীম
একটি কবিতা লিখতে চাইলাম
ফিলিস্তিনকে নিয়ে
লিখতে পারিনি
কলম হাতে নিতেই হাত কাঁপতে থাকল
জানাল নিজের অক্ষমতার কথা
সাদা কাগজের বুকজুড়ে
ফুটে উঠল ফোঁটা ফোঁটা রক্ত
হাত থেকে কলম পড়ে গেলো
কাগজ বল-
শোনো,
ফিলিস্তিন নিয়ে কবিতা লেখা এতো সহজ নয়
আমি নিজের সবটুকু দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে গেলাম
পারলাম না
হাত কাঁপে
কলম কাঁপে
হৃদয় কাঁপে
আমি আর স্বাভাবিক থাকতে পারলাম না
কবিতা লেখা হলো না
বুঝলাম
ফিলিস্তিনকে কবিতার ভাষায় ব্যক্ত করার
শক্তি আমার এখনও অর্জিত হয়নি
স্বপ্নে দেখা জুতা
যাকারিয়া মুহাম্মদ
ঠিক ক’জোড়া জুতা পা’য়ে দিয়েছি জীবনে?
যে জোড়া জুতা সেই বে-বুঝির দিনে
আমার তুলতুলে পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল-
কী রঙের ছিল সেটা?
শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না আজ।
একবার আম্মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি
শুধু হেসেছেন, কিছু বলেন নি।
মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি,
ছোট্ট একজোড়া জুতা-
রঙ চেনা যায় না; ফ্যাকাসে হয়ে গেছে
পুরোপুরি। রিয়ানদের যে শিমুলগাছ ছিল
তার তলে পড়ে আছে।
ওটা কি আমার?
স্মৃতিগুলো ভীষণ পীড়া দেয় আজকাল-
যে স্মৃতি যত দূরের
সেটা তত বেশি মনে পড়ে-
ক্যাসেটের রিলের এই জীবনে, নির্বিঘেœ
আস্ত কত মানুষকে ভুলে গেলাম, তবুও
একজোড়া জুতা- রঙহীন ফ্যাকাসে-
ভুলতে পারি না।
ফিলিস্তিনের শিশু
শওকত এয়াকুব
আমি ফিলিস্তিনের অবুঝ শিশু
সন্তান হারা মা’র শব্দহীন কান্না,
চোখের সামনেই ভাইয়ের লাশ
বিশ্ব মোড়লেরা দেখতে পান না?
যুবক, তরুণ, সব শোকে মাতম
বৃদ্ধের স্মৃতি হলো ধ্বংসস্তূপ,
বোনের শরীর লালে-লাল রক্তে
মানবতাবাদীরা সব নিশ্চুপ।
কতকাল পেরিয়ে গেল
তাওহিদ ইসলাম
কতকাল পেরিয়ে গেল।
ছেড়ে গেল কতজন। হারিয়ে যাওয়া কত মুখ। প্রিয় কতকিছু। বদলালো পৃথিবী।
আমি নিদ্রাচ্ছন্ন। এতো কিছুর বদলে যাওয়া বুঝতে পারিনি। অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে রইলাম। কতকাল!
সময় গড়ালো। মধ্যে পথে হোচট খেলাম। ভেবেছিলাম ইচ্ছেহীন কাটিয়ে দিবো। এক জীবন। যাযাবর হতে চাইবো না আর। চাইবো না কবি হতেও। অনুভূতিশূন্য মানুষের কবিতা লিখা মানায় না।
সড়ক পথের কেনার ঘেষা সারিবদ্ধ ল্যাম্পোস্ট। রাত্রি জুড়ে আলো দেয়। আধাঁরকে খানিকটা আলোর ঝলকানি পাইয়ে দেওয়া যার কাজ। রাত্রিজুড়ে বিষাদ নামে সেখানে। আলো-আধাঁরের মিলনে বিষাদেরা প্রাণ পায়। জীবিত হয়। ছুটে যায়। যার-তার কাছে।
বেহিসাব অনেক রাত পেরিছে। নিভু নিভু জ্বলতে থাকা ল্যাম্পোস্টের আলোয়। বিষন্নমনা হয়ে প্রকৃতি বিলাস। অনুভূতিটা কেমন যেন! শূন্য শূন্য। আনমনে ভীষণ ভাবনা। কেউ একজন আমার হোক। সমুদয় সুখ-দুঃখে সমান্তরাল ভাগ থাকবে যার।
অনাগত কারো ভাবনায় আকাশ হলাম। ছেড়ে এলাম সব! চোখের সামনে অজানা এক বাসনা। দীর্ঘ সেতু। রোজ কিছুটা পথ পেছন ফেলে এগোচ্ছি ধীর গতীতে। আপনি কিংবা অজানা কারো গন্তব্যে। সঙ্গী হবো বলে।
ফিলিস্তিন বিষয়ক পদাবলি : ০২
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
দু’টি কবিতা
নাসরিন জাহান মাধুরী
উদবাস্তু
হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লাম উদবাস্তু শিবিরে
আমি যে উদবাস্তু এ শহর তা জানে;
ভাঙাচোরা, দেয়ালচাপা কিছু দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিশে যায় আমার দীর্ঘশ্বাস
ঐ আলোহীন, চালচুলোহীন অভুক্ত মুখগুলো
মনে করিয়ে দেয় আমার উপবাসের দীর্ঘকালের কথা
একাল সেকাল করে কত সুদীর্ঘকালের উপবাসে!
গোগ্রাসে এই চোখ গিলে খায় পৃথিবীর তাবৎ ত্রাণ
এখন কোথাও আর ত্রাণ নেই
এই অভুক্ত শিশুটির জন্য বরাদ্দ ত্রাণ টুকুও আমি ভক্ষণ করেছি
এপথ সেপথ ঘুরে আমি সময়ের পথে পায়ের ছাপ রেখে যাই
পিছনে তাকালে দেখি অনেক দূরে চলে এসেছি তবুও
আমার পায়র তালুতে লেগে আছে সেই সব কোমল শিশুদের রক্তের দাগ
পৃথিবীর কোন ইতিহাস মুছবে এ কলঙ্ক!
এ দাগ অমোচনীয়
উপরে সেই হাজার বছরের পুরোনো তারা
আজো জ্বলছে মিটিমিটি
তারো উপরে আরো আরো আরো উপরে আকাশ
তিঁনি সব দেখেন...
ভাবনা
আজকাল আমাকে ভাবাও তুমি
তোমার খেলা বুঝি না কিছুই
কি আনন্দে মেতে আছো কি ভেবে
কত সহজেই থামিয়ে দিলে আমায়
যাই লিখি মুছে যায় শূন্যতার অদৃশ্য ইরেজারে
আমি চাঁদের গল্প, রূপালি রাতের গল্প বলতে চেয়েছিলাম
দেবশিশুটির রক্তাক্ত মুখ, ওর নিষ্পাপ চোখ দুটি আমায় থামিয়ে দিলো।
এ গল্প লিখতে চাই না
আমায় বিজয়ের গল্প লিখতে দাও
পৃথিবীর সব শিশুদের গল্প
সেই শিশুরা মায়ের কোলের অভয়াশ্রমে
নিশ্চিন্তে ঘুমাবে
সেই আস্থার কথা লিখতে দাও
সেই বিশ্বাসের কথা লিখতে দাও
রক্তাক্ত গল্প আর লিখতে চাই না..
ভুলে গিয়ে মনে রাখা
ফজলুর রহমান
আয়োজন করে দুঃখ দিয়েছো বলে তা মনে রাখার জন্য ক্যালেন্ডারের তারিখ মুখস্থ করতে হয় না আমার। আমি তোমাকে না পেয়ে যেভাবে তোমাকে মনে রেখেছি পেলে তোমাকে মুখস্থ করা হতো হয়তো মনে রাখা হতো না। মূলত মানুষ ব্যবহারে ক্ষয় হয় স্মৃতিতে তোলা থাকে ফুলতোলা রুমালের মতো। পরিপাটি, সুগন্ধি চেতনার মতো। তোমার ভাবনা তিরিশ বছর আগে বাদ দিয়ে দেখেছি আমি আসলে তিরিশ বছর ধরে কর্মে যতটা মনোযোগী হয়েছি ‘তোমাকে আর কখনো ভাববো না’Ñ এই চিন্তায় তার চেয়ে ঢের বেশি মনোযোগী ছিলাম। বিগত তিরিশ বছরে আমার ওষুধের কৌটা, মাথা ব্যথার বাম, চশমার বক্স, ছাতা, জলের গ্লাস, কলম, সঞ্চয়িতা, পাঞ্জাবি-পায়জামা বা হাতঘড়ি কোথায় রাখি এসব ভুলে গিয়ে পনোরো অক্টোবর উনিশশো নব্বই এ সাভার বিরুলিয়া গ্রামের গোলাপ বাগানের নির্জন সন্ধ্যা, তার পরের বছর বিজয়া দশমীর দিন লোকাল বাসে চেপে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্গা মাকে দেখতে যাওয়া কিংবা যে বছর অনেক বর্ষা হলো সে বছর মাধবপুর মেলা শেষে দুজনে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে নাগরদোলায় উঠে দোল খাওয়াÑ কীভাবে এসব আমার মস্তিষ্কের নিউরনের পরতে পরতে এতো সজীব! তবে কী তোমাকে ভুলতে চেয়ে অবচেতনে মনে রাখার চর্চা করেছি নিত্য? তুমি আয়োজন করে দুঃখ দিয়েছো কিন্তু আমি তা গোপন করে যাপন করেছি। তুমি বলেছিলে,
‘আামাকে পেলে তুমি সুখী হবে, না পেলে তুমি অমর হবে।’Ñ কোনটা চাও?
আমি অমরত্ব চেয়েছিলাম। তুমি এসে দেখে যাও তোমাকে যে পেয়েছে তার চেয়ে তোমাকে না পেয়ে কতোটা ঢের বেশি পেয়েছি তোমায়।
কয়েদী চিন্তা
নূরে জান্নাত
কাঁচের জানালায় ঝাপসা স্বপ্নগুলো।
দেখ সুনীপন ভঙ্গিতে একা পাখি
কবিতা গেলার মতো
বিশুদ্ধ বিষদতা গিলছে!
আহা..
চাঁদরে মেঘের গন্ধ
শরীর জুড়ে বকুল ফুল!
আঙুল গুলো ফ্যাকাশে প্রেমে
ছুঁয়ে দেখতে চায় মনের চারিপাশ।
ঘুমের ঘোরে নগ্ন স্নানে কাম
ডোবো ডুবাও ভাসো ভাসাও
কাছে খুব কাছে গিয়ে
কয়েদী চিন্তা গুলোকে!
বাম পায়ের বৃদ্ধাঙুলে দাঁতের বসত গড়ো।
অন্ধকার নিরাকার তুমি কে
ছাঁয়া রুপে আকার দাও
ওটা তুমি? চিন্তা? কাম?
নাকি যাকে আমি খুঁজি!
শহরতলির গোলচত্বর
মাসুদ পারভেজ
শহরতলির গোলচত্বরের মাথার উপর গোলাকার রোদ,
এখানে মানুষ ব্যস্ত হয়-ক্লান্ত হয়, কেউ দিক্বিদিক
রিক্সার হুড তুলে চলে যাচ্ছে সময়-
রংধরা সূর্যের আশায়;
এক আকাশ অবসাদ নিয়ে তাকিয়ে দেখছে প্রণয়।
সূর্য কি রং হারিয়েছিল আঁধারের কাছে?
সে আর ফিরে আসেনি কখনো এই শহরতলির গোলচত্বরে।
এই পৃথিবী শিশু বাসযোগ্য নয়
জীবন রাজবংশী
আমি এক অন্য পৃথিবীতে বাস করছি
যার হৃদয় পাথর
যেখানে বিবেক মনুষ্যত্ব নামে
শিশুরা অনেক দূরে সরে গেছে
কোন এক অজানা নদীর তীরে তারা
খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না-
কেননা এই অভিশপ্ত পৃথিবী শিশু বাসযোগ্য নয়।
তোমরা ধর্মের নামে
সাম্রাজ্যের নামে
গোলাগোলির খেলায় মত্ত।
এ ধরা শিশু বাসযোগ্য নয় সত্য।
আমি পৃথিবীর পথ চেয়ে আছি....
যদি আবার আসে কোন দিন।
কী হবে, নিরীহ গানে
জাফর ওবায়েদ
কী হবে, নিরীহ গানে অন্ধ এ-সরণি কাঁপিয়ে!
নারী ও শিশুর রক্ত আজ হোলির নিদান
সহ¯্র জীবন মোড়লের হাতের খেলনা
মানবাধিকার নির্মম ক্রীড়ার সস্তা গুটি!
কী হবে পৌরাণিক স্লোগানে প্রমিলা কন্ঠ ফাটিয়ে!
পৃথিবী চায় সিংহের সৌভিক গর্জন
শহর খোঁজে দ্রোহের আগুন পোড়া বিজয়ের প্রত্যয়
মানুষ চায় নিতিসুখ হন্তারক অত্যাচারীর পতন!
অকৃপণ চাঁদ কৃষ্ণ কাপড়ে ঢেকেছ ম্রিয়মান মুখ
ঘনঘনে সূর্যের আলো লজ্জায় ফিরিয়েছে অবনত চোখ
অন্ধকারেই কি কেটে যাবে মানুষের প্রকৃষ্ট সময়!
কেঁদো না ফিলিস্তিন
আমির হামজা
জলপাই গাছগুলো দিনে দিনে বিলীন হচ্ছে, পাখিবাগান উড়ছে,
বসতি জ্বলছেই,
খাবার পানি ক্রমশ কমে আসছে
আজ কতদিন হলো বাবার মুখটাও দেখিনা! ঘরে খাবার নেই
জোর করে জমি দখল করে আমার দেশ থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছে!
তবুও
কেঁদো না ফিলিস্তিন
তোমার আসবেই সুদিন
নাসরুম মিনাল্লাহী ওয়া ফাতহুন কারিব।
পাখির মতো মেরে মেরে শিশুদের নিশ্চিহ্ন করছে
বাবার কাঁধ বেয়ে ঝরছে সন্তানের শেষ রক্তবিন্দু
মৃত সন্তানের লাশ কোলে
মায়ের হাসিমুখ উজ্জীবিত করে তুলে আমাদের
আমরা কারো আশায় না থেকে নিজেরাই লড়তে শিখে গেছি
আমাদের ভয় নেই
আমাদের আকসা আমরাই ফিরিয়ে আনবো
সিজদায় লুটিয়ে কেঁদে কেঁদে আবার হাসবো।
কেঁদো না ফিলিস্তিন
তোমার আসবেই সুদিন
নাসরুম মিনাল্লাহী ওয়া ফাতহুন কারিব।
রবের মদদ আসবেই
আসমান ফুঁড়ে আসবে আবার আবাবিল
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে
হাসবে ফিলিস্তিন।
কেঁদো না ফিলিস্তিন
তোমার আসবেই সুদিন
নাসরুম মিনাল্লাহী ওয়া ফাতহুন কারিব।
ফিলিস্তিন বিষয়ক পদাবলি : ০৩
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
বেঈমান
সজিবুর রহমান
আমি হতে পারতাম সেই অনাগত শিশু
যার মা প্রসব বেদনা নিয়ে শুয়ে আছে গাজার হাসপাতালে
যে মা জানে না কিছুক্ষণ বাদে ফুলসহ বিনষ্ট হবে গাছ!
হতে পারতাম ধূলিস্যাৎ হওয়া বাড়ির সামনে
বসে থাকা নিরুপায় বাকরুদ্ধ পিতা
যার চোখের অশ্রু শুকিয়ে গেছে কংক্রিটের ধুলায়!
কিংবা পাতা ঝরা জলপাই গাছ
যে ভাবছে প্রতিটি ফলকে বুলেটে রূপান্তর করবে,
কেননা পেট্রোডলারে চেতনারক্ষী অস্ত্র কেনায় ব্যর্থ আরব প্রতিবেশীরা!
হতে পারতাম দখলদার বাহিনীর কোনো সৈন্য
যে যৌবনের সমস্ত শক্তি ব্যয় করছে জুলুমে,
কিন্তু খোদার দয়ায় আমি প্রকাশ্য জালিম হইনি!
বদলে আমি হয়েছি নাফরমান, নিমোকহারাম মুসলমান!
যে রাসূল বলে গেছেন আমি তাঁর ভাই
আমি যার উম্মতের অংশ বলে গর্বে বুক ফুলাই,
যে উম্মাহ একই দেহে লাখো প্রাণ
সে উম্মাহর বিপদে আমার পরিচয়- আমি বেঈমান!
তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে
এ এম তোফায়েল
তবুও স্বপ্ন দেখে মানুষ! গভীর সমুদ্রে দোদুল্যমান বিপন্ন জাহাজে অথবা ভেঙে পড়া অট্টালিকায় আঁটকে পড়া মানুষ যেমন বেঁচে থাকার স্বপ্ন হারিয়েও হারায় না! তেমন করেই স্বপ্ন দেখে কিছু মানুষ! ঢেউয়ে ভেঙে যায় নদীর কুল; জীবন চলে- অতীতে করা নিয়ে কতো ভুল- তা যদি জানতো মানুষ! লেখকের মতো করে বলতে হয় ‘যে জীবন ফড়িংয়ের- দোয়েলের মানুষের সাথে তাঁর হয় নাকো দেখা!’ আঁধার কালো দূর আকাশেও আলো দেখা!
অতিথিশালা
হাফিজুর রহমান
ফিরে গেলেই একবার- প্রমাণ করে দিব
আমিও ছিলাম পৃথিবী নামের এই অতিথিশালায়
শুধুমাত্র একটিবারের জন্য ভ্রমণের;
না-জানা সময়ের, নিয়ে এসেছিলাম ভিসা।
আমি এসেছি বেড়াতে, শিখতে- শেখাতে
আমি এসেছি নেয়ার থেকে বেশি দিতে;
অতিথিদের মাঝে অতিথি হয়ে-
পর্যাপ্ত সম বরাদ্দে- এই জগৎ স্রষ্টার ইচ্ছায়।
এখানের আতিথেয়তায় অতিথিরাও লোভী হয়!
লুটপাট করে কেড়ে নেয় একে অন্যের হক;
ভুলে যায়, অতিথিগণ চিরস্থায়ী নয়!
নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে, ফিরতে হবে একসময়।
যুদ্ধ চাইনা শান্তি চাই
আশরাফ চঞ্চল
দেখো-
ফিলিস্তিন জ্বলছে
ধ্বংসস্তুপের নিচে হাজারো মানুষের লাশ
পশ্চিমা শাসকেরা
মানবতার নামে মানুষেরই রক্ত খাচ্ছে।
দেখো-
বিশ্বের পিশাচেরা
জোটবদ্ধ হয়ে মুসলিম নিধনে মেতেছে
প্রাচ্যের মুসলিম
স্বার্থের মোহে পশ্চিমাদের পাছা চাটছে!
আমরা যুদ্ধ চাইনা শান্তি চাই
রক্তের বদলে সম্প্রীতি চাই।
খিদে
স্বপন গায়েন
উনুন থেকে ধোঁয়া উড়ছে
মোটা চালের গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে
অভুক্ত অভিমান নিষেধ মানে না
ছুট্টে যায় থালা নিয়ে।
শাক সিদ্ধ আর মোটা চালের ভাত
ওদের কাছে ওগুলোই পরমান্ন মনে হয়
প্রতিদিন দু’বেলা জোটে না-
একটু একটু করে মজে যাচ্ছে জীবনের হৃদ।
ভাঙাচোরা সংসার-
অবহেলা অনাদরে মানুষ হয় সন্তান
হাড় জিরজিরে শরীর, তবুও দু’চোখে রামধনু রঙ
তবুও ওদের খিদে পায়...
খিদে যে কারুর কথা শোনে না।
বাক্স বন্দি জীবন
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
বাক্স বন্দি জীবন
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
আব্দুল করিম সাহেব একটি বায়িং অফিসে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরায় বসবাস করেন। স্ত্রী মুনা করিম এবং দুই সন্তান তারেক ও তাহিয়াকে নিয়ে ছোট্ট সুখি সংসার। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের সাথে খুব বেশি সময় কাটাতে না পারলেও তিনি পরিবারের প্রতি খুব যতœশীল। হঠাৎ করেই পৃথিবীর বুকে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে করোনা ভাইরাস। চীনের উহান থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনা ভাইরাসে প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এই মহামারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে আইসোলেশনে রাখা ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই। ব্যাপক গবেষণা করেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। পর্যাপ্ত পিপিই না থাকায় ডাক্তাররাও চিকিৎসা দিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং সর্বোপরি তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। বলতে গেলে লাশের মিছিল চলছে। এদিকে বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস হানা দিয়েছে। বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা যেভাবে দেশে প্রবেশ করেছে এবং বাইরে ঘুরছে-ফিরছে, এতে করে বাংলাদেশেও এই মহামারী দ্রুত বিস্তার লাভ করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। হঠাৎ করেই শোনা যায়, এক স্কুল শিক্ষার্থী নাকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তাই করিম সাহেব ও তার স্ত্রী বেশ চিন্তিত তাদের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। ওদের স্কুল এখনো বন্ধ ঘোষণা করেনি। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করতে দেশের বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে জোরদার পরামর্শ দিচ্ছেন। দুদিন পর দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা এলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন করিম সাহেব ও তার স্ত্রী। তবে বন্ধ নেই করিম সাহেবের অফিস। সন্তানদের নিয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও তিনি এখন নিজেকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। করোনার ভয় নিয়েও রুটিনমাফিক অফিস করতে বাইরে যেতে হচ্ছে। অফিসে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রবাসী ক্লায়েন্টও আসছে। অস্বস্তি নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে হচ্ছে। এ যেন নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধ। তবে এই যুদ্ধ খুব বেশি দিন করতে হয়নি। করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার কর্তৃক জরুরি ছুটি ঘোষণা করা হলে করিম সাহেব দশ দিনের লম্বা ছুটি পেয়ে যান। তবে এই ছুটি অন্যান্য সাধারণ ছুটির মত ছিল না। বলা যেতে পারে, নিজ গৃহে বাক্স বন্দি জীবন যাপনের ছুটি। আর সরকার কর্তৃক চলছে সারাদেশে অঘোষিত লকডাউন।
করিম সাহেব এমন লম্বা ছুটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। পরিবারের সাথে কখনো এভাবে থাকা হয়নি। যখনই ছুটি পেয়েছেন, সেটা পরিবার কিংবা নিজের ব্যক্তিগত কাজে ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটিয়েছেন। এবার লম্বা দশ দিন পরিবারের সাথে নিজ গৃহে সময় কাটাবেন ভাবতেই খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছেন। প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে ফ্রিজে ভরে রেখেছেন। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো রকম টেনশন নেই। বাসায় প্রতিদিন পিকনিক আমেজে খাওয়া দাওয়া করবেন আর রাতে স্ত্রী মুনার সাথে হানিমুন বানাবেন। সেই জন্য করিম সাহেব গোপনে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ফার্মেসী থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পাশাপাশি এক বোতল মধু, এক বক্স কনডম, তিন প্যাকেট সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেট কিনে ছিলেন। কয়েক বছর যাবত আগের মত পেরে উঠছেন না। দীর্ঘ সঙ্গম তো দূরের কথা, অল্পতেই তিনি ক্লান্ত হয়ে যান। তখন স্ত্রী মুনার কাছে লজ্জা পেতে হয়। তাই মুনাকে তৃপ্ত রাখতে সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেটেই করিম সাহেবের একমাত্র ভরসা। এই দশটি দিনে মুনাকে বুঝিয়ে দিবেন করিম সাহেবের যৌবন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তাই তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন। রাতের ডিনার সেরে করিম সাহেব নিজের বিছানায় শুয়ে টিভিতে সংবাদ দেখছিলেন আর মুনা তখন বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে। এই ফাঁকে লুকিয়ে করিম সাহেব দুই চামচ মধুর সাথে দুটি সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। যদিও একটি ট্যাবলেট খাওয়ার নির্দেশ। তারপর বালিশের নিচে এক প্যাকেট কনডম লুকিয়ে রেখে মনে মনে তিনি বলছেন, আজ খেলা হবে। টিভি চ্যানেলের সংবাদ দেখতে দেখতে তিনি বোরিং হয়ে গেছেন কিন্তু মুনার ফিরে আসছে না। এদিকে করিম সাহেবের শরীরে ডাবল ডোজ সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেটের একশন শুরু হয়ে গেছে। তাই তিনি বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে গিয়ে দেখেন বাচ্চাদের নিয়ে মুনা ঘুমিয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে করিম সাহেব রাগান্বিত স্বরে মুনাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাক দিলেন। তখন মুনা জেগে ওঠে বিরক্ত হয়ে ডাকাডাকির কারণ জানতে চাইলে, করিম সাহেব ইশারায় মুনাকে তাদের বেড রুমে আসতে বলেন। মুনা সাফ জানিয়ে দেয়, সে বাচ্চাদের সাথে ঘুমাবে। তখন করিম সাহেব ইনিয় বিনিয়ে অনুরোধ করেও কোন লাভ হলো না। এদিকে বাচ্চাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন মুনা ক্ষেপে ওঠে করিম সাহেবের উপর। তখন নিরুপায় হয়ে নিরস মুখে অনেকটাই লেজ গুটিয়ে নিজের রুমে চলে যান করিম সাহেব। মনের ক্ষোভে ছাই চাপা দিয়ে টিভি দেখে আর বিছানায় ছটফট করে একদম ভোর রাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরদিন বেলা বারোটার দিকে মুনার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে করিম সাহেবের। তিনি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চা-নাস্তা খেয়ে টিভি দেখতে বসেন। অভিমান করে স্ত্রীর সাথে কোনো কথা বলেননি। ভেবেছিলেন, অভিমান ভাঙাতে মুনা হয়তো তার পাশে বসে খুশ মেজাজে কথা বলতে আসবে। কিন্তু তিনি যা ভেবেছিলেন, তার ঠিক উল্টোটাই ঘটলো। ঘন্টাখানেক পর মুনা এসে তুমুল ঝগড়া জুড়ে দিয়েছে বাজার সদাই নিয়ে। ‘এটা নেই, ওটা নেই, কেন আনলে না, কেন ভুলে যাও, সামান্য বাজার সদাই পর্যন্ত ঠিকঠাক করতে পারো না। এখন টানা এই কটা দিন কেমন করে চলবে?’ করিম সাহেব অসহায় হয়ে ভাবছেন, এতো বাজার করার পরেও স্ত্রীর মুখে এতো অভিযোগ! নিরুপায় হয়ে তিনি বললেন, ‘যা যা বাকি আছে, আজ বিকালেই বাজার থেকে নিয়ে আসবো।’ তবুও যেন মুনা খুশি হয়নি। তার মুখে কী যেন এক বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল। করিম সাহেব অনেক চিন্তা ভাবনা করেও সেই রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। তবে চিন্তা করে বেশি সময় নষ্ট করতে পারেননি। আধা ঘন্টা পরেই মুনা এসে চেঁচিয়ে বলছে,
- এভাবে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখে সময় কাটাবে নাকি ঘরের টুকটাক কাজে হাত লাগাবে? আমি তো রান্না ঘরে একা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।
- কেন, তাসলিমা আসেনি? ওকে তো আজ একবারও দেখেনি। কাজে ফাঁকি দিল নাকি?
- আমি আসতে না করেছি। তিন চারটে বাসায় কাজ করে। কখন কার বাসা থেকে করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের বাসায় ঢুকবে, সেই হিসেব কী আছে?
- ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। তাহলে এখন আমার কি করতে হবে শুনি।
- আমি বাচ্চাদের গোসল করিয়ে এসেছি। ওদের নিয়ে এখন লাঞ্চ করবো। তুমি এই ফাঁকে গোসল সেরে নাও আর বাথরুমে ওদের কাপড়গুলো ডেটল পানি দিয়ে ধুয়ে নিবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তবে একটু সময় অপেক্ষা করো। আমি আসলে পর সবাই মিলে একসঙ্গে খাবো।
স্ত্রীর কথা মত করিম সাহেব কাপড় ধুয়ে গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখেন ওদের খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষ। মনে মনে বেশ কষ্ট পেলেন কিন্তু মুখ খুলে কিছু বললেন না। একটু পর গোমড়া মুখে তিনি একাই ডাইনিং টেবিলে বসে লাঞ্চ সেরে নিলেন। তার গোমড়া মুখ দেখেও মুনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এটা ভেবেই তিনি বেশ অবাক হচ্ছেন।
অঘোষিত লকডাউনের মধ্যেই করিম সাহেব বিকালে বাজার সদাই করে বাসায় ফিরে এলেন। তখনই মুনা বলে উঠে, ‘কিচেনে বাজার রেখে সোজা বাথরুমে ঢুকে গোসল করে বের হবে।’ তিনি স্ত্রীর কথা মত তাই করলেন। গোসল থেকে ফিরে এসে বাচ্চাদের কাছে ডাকলেন। ওরা তার ডাকে সাড়া দিয়ে কাছে এলেও একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। তখন তাদের আরো কাছে আসতে বললে করিম সাহেবের ছয় বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে তাহিয়া জানালো, ‘আম্মু তোমার কাছে যেতে নিষেধ করেছে।’ করিম সাহেব তখন রেগেমেগে আগুন হয়ে উচ্চ স্বরে স্ত্রীকে ডাকলেন। মুনা আসতেই তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন,
-কেন আমার সন্তানদের আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো? কেন ওদের আমার কাছে আসতে নিষেধ করেছো?
- একদম বোকার মতো কথা বলবে না। তুমি এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছো। তাই ওদের তোমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছি।
মুনার কথা শুনে করিম সাহেব অবাক বিস্ময়ে আকাশ থেকে যেন মাটিতে পড়লেন।
- খুব অবাক করলে। আমি নিজেই জানি না আর তুমি বলছো আমি নাকি হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি! তাহলে আমাকে বাজারে পাঠালে কেন?
- বুঝতে পারছি তোমার শুনতে খুব খারাপ লাগবে কিন্তু কিছু করার নেই। আগামী চোদ্দটা দিন তোমাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
- কেন, আমি কি বিদেশ ফেরত প্রবাসী নাকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী?
- তুমি বায়িং অফিসে চাকরি করো। সেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষ আসা যাওয়া করে। এমনকি চীনারাও আসে। নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না।
- তুমি কী বলতে চাইছো আমার শরীরে করোনা ভাইরাস আছে?
- আরে বোকা! সেটা কখন বললাম। যদি আমাদের সত্যিই তুমি ভালোবাসো, তাহলে মাত্র চোদ্দটা দিন এই রুমের মধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকো।
- না, আমি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারবো না। তুমি আমার কাছে না আসলেও আমার সন্তানদের আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
- চেষ্টা করে দেখো না। তোমার সন্তানরাও তোমার কাছে যাবে না। আর হ্যাঁ, বেশি জিদ করো না। নয়তো তোমাকে প্রাতিষ্ঠানিক হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হবে।
করিম সাহেব মন খারাপ করে টানা চারদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে একদম বিরক্ত হয়ে গেছেন। তার উপর ঘরের টুকটাক কাজ করতে হচ্ছে। ডেটল পানি দিয়ে ঘরদোর মুছা, কাপড় ধুয়ে দেওয়া। এসব কিছু করে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। রাগে ও মনের কষ্টে কনডমের বক্স ও সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেট গার্বেজ বক্সে ফেলে দেন। পরে চিন্তা করলেন, এগুলো উনার কাজে না লাগলেও কারো না কারো কাজে আসবে। বাসায় বন্দি থেকে আর মোটেও ভালো লাগছে না। তাই একটা ছুতো বের করে বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাটি করতে চাইছেন। তাই ময়লা ফেলার ছুতোয় তিনি বাসা থেকে বের হলেন। ময়লার ব্যাগের সাথে অন্য একটি ব্যাগে কনডমের বক্স ও সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেটের স্ট্রিপ গুলো নিয়ে নিলেন। রাস্তায় পুলিশ ও আর্মি দেখে তিনি বেশ ভয় পেয়ে যান। তাই হাঁটাহাটির চিন্তা বাদ দিয়ে একটা রিক্সা ডাকেন। কোন কিছু না ভেবেই রিক্সাওয়ালে বাজারের দিকে যেতে বলেন। যেতে যেতে তিনি রিক্সাওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দেন।
- তোমার মুখে মাস্ক দেখে খুব ভালো লাগছে। তবে এই কঠিন সময়ে ঘরের বাইরে থাকা কিন্তু মোটেও উচিত নয়। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কিছু জানো?
- স্যার, এইসব নিয়া আমাগো কোন টেনশন নাই। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। যেদিন মরণ লেখা, ওইদিনেই মরণ হইবো। এর একদিন আগেও মরমু না।
- তুমি যদি নিজেকে নিরাপদে না রাখো, তাহলে আল্লাহ্ আর কী করবেন? এই মহামারীর সময়ে ঘরে থাকতে হবে।
- ঘরে থাকলে তো স্যার পেটে ভাত জুটে না। রাস্তায় প্যাডেল ঘুরাইলেই চারটে মানুষের পেটে ভাত জুটে। কয়েক দিন ধইরা খোরাকির টাকাই উঠে না। আপনারা বড়লোক মানুষ, ক্ষুধার জ্বালা বুঝবেন না।
- সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন তো খাদ্য দিয়ে শ্রমজীবীদের সহযোগিতা করছে। তুমি কি কোনো সহযোগিতা পাওনি?
- না স্যার, এখনো পাই নাই। কার শখ হয় মরার জন্যে ঘরের বাইরে যাইতে। পেটের খাবার জুটলে ঘরের মইধ্যেই থাকতাম।
- আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে কিছু টাকা দিবো। তবে শর্ত একটাই, সেটা দিয়ে তুমি বাজার সদাই করে বাসায় চলে যাবে। রিক্সা নিয়ে বের হতে পারবে না।
রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। তারপর সে করিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
- স্যার, আমারে টাকা দেওন লাগবো না। আপনে মুখে কইছেন, এতেই মনটা ভইরা গেছে। তুমি রিক্সা চালাইয়া যা পাই, তাই খামু।
করিম সাহেব পাঁচটি কচকচে এক হাজার টাকার নোট ওই রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
- বেশি কথা না বলে টাকাগুলো ধরো। এক্ষুনি বাজার সদাই করে ফিরে আসো। আমি তোমার রিক্সায় বসে রইলাম।
রিক্সাওয়ালা অশ্রুভেজা চোখ মুছে করিম সাহেবের হাত থেকে টাকা নিয়ে বাজারে ঢুকে। আধা ঘন্টা সময় নিয়ে বাজার সদাই করে হাসি মুখে ফিরে আসে। করিম সাহেব রিকশাওয়ালার হাসি ভরা মুখ দেখে ভীষণ তৃপ্তি পেলেন। নিজের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কষ্ট ভুলে গেলেন। এবার তিনি রিক্সাওয়ালাকে উনার বাসায় পৌঁছে দিতে বলেন। রিক্সা চলছে আর করিম সাহেব বেনসন সিগারেট ফুঁকছেন। আজ এই নিয়ে তিনটি সিগারেট টানলেন। বাসায় গেলেই আর সিগারেট টানা যাবে না। তাই চতুর্থ সিগারেট ধরিয়ে তিনি আবারো রিক্সাওয়ালা গল্প শুরু করলেন।
- যদি কিছু মনে না করো, তাহলে তোমাকে আরো দুটি জিনিস দিবো।
- কি যে বলেন স্যার, আপনের কথায় মনে করার কিছু নাই। আপনি অনেক দিছেন আর লাগবো না।
- না, এবার তোমাকে অন্য কিছু দিবো। যেটা দিয়ে এই কটা দিন ঘরের ভেতর তোমার ভালো সময় কাটবে।
- ঠিক আছে স্যার। তাইলে তো ভালোই হয়। ঘরে বইসা থাকতে আমার ভালো লাগে না। দেন দেহি কি দিবেন।
করিম সাহেব রিক্সাওয়ালাকে ওই ব্যাগটি দিয়ে বললেন,
- এই ব্যাগে এক বক্স উন্নত মানের কনডম ও কিছু ট্যাবলেট আছে। তোমার কাজে লাগবে।
রিক্সাওয়ালা মুচকি হেসে বলল,
- স্যার কনডম কামে লাগবো কিন্তু ট্যাবলেট দরকার নাই। আপনে রাইখা দেন, যদি আপনার কামে লাগে।
রফিক সাহেব নিরস মুখে বললেন,
- এসব আমার দরকার নেই। তোমাকেই দিয়ে দিলাম। তোমার কাজে না লাগলেও ফেলে দিও।
কথা বলতে বলতে এক সময় বাসার গেইটে এসে পৌঁছালেন করিম সাহেব। তিনি রিক্সাওয়ালার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যান। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে পথ আগলে দাঁড়ায় মুনা। সে জানতে চায় করিম সাহেব এই দীর্ঘ সময় ধরে কোথায় ছিলেন? এটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে করিম সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন আবারো রান্তায় বের হয়ে যাবেন। কিন্তু রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ ও আর্মি। অহেতুক কেউ ঘোরাঘুরি করলে মোটা ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় বের হওয়া বোকামি ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। তাই তিনি মুনার কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চান। এবং প্রতিশ্রুতি দেন, বাকি দিনগুলো একদম হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। তারপর মুনা করিম সাহেবকে বাসার ভেতরে ঢুকতে দেন। করিম সাহেব বাকি দিনগুলো হোম কোরেন্টাইনের নিয়ম মেনে বাক্স বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। আর এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, রিক্সাওয়ালা নিশ্চয়ই সময়টা খুব উপভোগ করছে। ওইদিকে রিক্সাওয়ালা ভাবছে, লোকটা নিশ্চয়ই পাগল আর নয়তো ফেরেশতা। আর নয়তো এভাবে কেউ এতগুলো টাকা ও ওইসব জিনিস দিয়ে যায়।
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা