হাসন রাজা : আধ্যাত্মিক চেতনার বাউল কবি
আধ্যাত্মিক চেতনার বাউল কবি
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
বাউলা কে বানাইলো রে
হাসন রাজারে বাউলা, কে বানাইলো রে
বানাইলো বানাইলো বাউলা, তার নাম হয় যে মাওলা
দেখিয়া তার রুপের ঝলক, হাসন রাজা হইলো আউলা
দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী
জন্ম: ২৯ ডিসেম্বর ১৮৫৪ মৃত্যু: ৬ ডিসেম্বর ১৯২২
সাধক বাউল হিসেবে ফকির লালন সাঁই এর পরেই যাঁর নামটি সবচেয়ে বেশি আলোকিত ও আলোচিত, তিনি হচ্ছেন আধ্যাত্মিক চেতনার মরমি কবি ও বাউল শিল্পী দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। যদিও জানা যায় তাঁর প্রকৃত নাম অহিদুর রেজা, তবে তিনি মানুষের কাছে ‘হাসন রাজা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। বাংলার মরমি ও লোক সংগীত বিশ্ব দরবারে সমাদৃত হওয়ার পেছনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন হাসন রাজা। তিনি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী নিষ্ঠুর জমিদার। উচ্চ বিলাসী জীবন যাপন, আমোদ-প্রমোদ এবং প্রজাদের উপর নির্মম অত্যাচার করাই ছিল যাঁর কাজ। সেই তিনিই আবার বিশাল জমিদারি ত্যাগ করে গ্রহণ করেন অতি সাধারণ জীবন। আভিজাত্যের চাকচিক্যতা ভুলে সাদাসিধে বৈরাগ্য জীবনে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ¯্রষ্টার সন্ধানে নির্জন সাধনায় আত্মনিয়োগ করে জগত সংসার নিয়ে উদাসীন হয়ে যান। একের পর এক আধ্যাত্মিক গান রচনা করতে থাকেন, যার সংখ্যাটা প্রায় সহ¯্রাধিক। তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, যা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করে ছিল। বিশেষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন সহ আরও অনেকেই উনার জীবন দর্শনের প্রভাবিত হয়ে ছিলেন। এমনকি ইংল্যান্ডের রাজ দরবারেও এই মরমী সাধকদের বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্পটা পৌঁছে যায়। ১৯৩৩ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাদেশের মরমি কবিদের মধ্যে চারজনকে দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই চারজন হলেন- লালন শাহ, শেখ ভানু শাহ, শেখ মদন শাহ ও হাসন রাজা। যদিও বাস্তবে তিনি আধ্যাত্মিক আরাধনা কিংবা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রদর্শন করার কথা শোনা যায়নি। তবে লোকমুখে প্রচলিত ছিল, হাসন রাজা অল্প বিস্তর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারি ছিলেন। অনেকেই তাঁকে আল্লাহর অলি হিসেবেও দাবি করেন। তবে তিনি সূফি মরমী সাধক, বাউল কবি, দার্শনিক কবি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও সমাদৃত। হাসন রাজার রচনাবলির সাহিত্য মূল্যায়নে দেখা যায়, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি লোকসাহিত্যের একজন অন্যতম বাউল কবি ছিলেন। তাঁর গানগুলোকে আধ্যাত্মিক গান, মারফতি গান, মুরশিদি গান, মরমি গান, দেহতত্ত্ব গান, পল্লি গান, লোকসংগীত প্রভৃতিতে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী সুনামগঞ্জ জেলার লক্ষণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাম দেওয়ান আলী রাজা এবং মাতার নাম মোছাম্মৎ হুরমৎজান বিবি। পৈত্রিক বাড়ি রামপাশা, বিশ্বনাথ সিলেটে এবং মায়ের বাড়ি খালিয়াজুড়ি, নেত্রকোনা বৃহত্তর ময়মনসিংহে। হাসন রাজার পিতা দেওয়ান আলী রাজা ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। তাঁর পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে আসেন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, হাসন রাজার অনেক কবিতা ও গানে পূর্বপুরুষের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মিলবন্ধন পাওয়া যায়। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন নি, তবে তিনি ছিলেন সশিক্ষিত। হাসন রাজার দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন রাজা জমিদারীতে অভিষিক্ত হন। হাসন রাজা কিশোর বয়স থেকেই পিতার জমিদারির ভোগ বিলাসে মত্ত ছিলেন। যখন অল্প বয়সে বিশাল জমিদারি পেয়ে গেলেন, তিনি যেন তখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তখন ব্যাপকভাবে তাঁর চারিত্রিক স্থলন ঘটে এবং ভালো মন্দের বিচার না করে নিজের মর্জি মাফিক চলতে থাকেন। কথিত আছে, হাসন রাজার বিলাসবহুল নৌ-তরী ও কয়েকটি রঙমহল ছিল। যেখানে তিনি মদ্যপান, বাঈজি নাচ সহ বিভিন্ন ধরনের আমোদ প্রমোদ করতেন। এছাড়াও ওই রঙমহল গুলোতে জোরপূর্বক অসংখ্য রমণীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হন। তাঁর জমিদারি এলাকায় কোন রমণী নিরাপদ ছিল না। যাকে ভালো লেগেছে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যেতেন তার রঙমহলে। অবশ্য তাঁর চরিত্রের এই বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর উত্তরসূরিরা দ্বিমত পোষণ করেন। যদিও হাসন রাজার বেশ কিছু গানেই কথিত কথাগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়। যেমন তিনি একটি গানে বলেছেন, ‘সর্ব লোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’ এছাড়াও তিনি প্রজাদের উপর নির্মমভাবে জোর জুলুম করতেন। হাসন রাজা তখন অত্যাচারি জমিদার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন এবং গান বাজনা নিয়ে মজে থাকতেন। তাঁর নিজে গানের দলও ছিল, যাদের নিয়ে তিনি নিজেই গান বেঁধে গান গাইতেন। হাসন রাজার যৌবনকালের উল্লেখযোগ্য কিছু গান হচ্ছে- ‘সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘নেশা লাগিল রে' প্রভূতি। কথায় কথায় ছন্দ কেটে কথা বলাও তাঁর অভ্যাসে ছিল। এভাবেই তাঁর মাঝে কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
ভোগ বিলাসী অত্যাচারী জমিদার হাসন রাজার একসময় আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে এক আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম নিতে থাকে। যা তাঁর স্বপ্ন ও জীবন দর্শনে আমূল প্রভাব ফেলে। বেপরোয়া জমিদার থেকে তাঁর চরিত্রে এক শান্ত ভাব চলে আসে। বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি সাদামাটা জীবন বেছে নেন। জমকালো পোশাক ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরতে শুরু করেন। তার বহিঃজগৎ ও অন্তর্জগতে আসে বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তার এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের বৈরাগ্য তৈরি হয়। একপর্যায়ে তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নামরে, না করলাম তার কাম।’ বৈরাগ্যভাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাসন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। অত্যাচারী নিষ্ঠুর শাসক থেকে হয়ে গেলেন সাধক। একসময় তিনি গেয়ে উঠেছিলেন- ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন।’ এর মধ্যেই আছে আত্মোপলব্ধির এক মরমি পর্যায়। আর এর ভিতরেই আমরা খুঁজে পাই দার্শনিক হাসন রাজাকে। হাসন রাজা সিলেটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সম্রাট অশোকের যেমন বোধোদয় হয়েছিল, ছেলেবেলার সেই ভূমিকম্প হাসন রাজার চিন্তারও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হাসন রাজা প্রেমিক ছিলেন। একসময় তার প্রেমের গভীরতা মহাকাল স্পর্শ করে। হাসন রাজার গানগুলো শুনলেই আমরা দেখতে পাই আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। হাসন রাজার কাছে মনে হয়েছে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, জগৎ নশ্বর। এক সময় ¯্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। তাই ¯্ষ্টার সাধনা বিনা মুক্তি উপায় নেই। এই উপলব্ধি থেকে গেয়ে উঠেন, ‘আমি যাইমু ও যাইমু আল্লাহর সঙ্গে, হাছন রাজা আল্লাহ বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।’ কবি নজরুল গানে গানে যাকে বলেছেন, ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর।’ এই মনোহরের কাছেই হাসন পেয়েছিলেন তার সব প্রশ্নের জবাব। অন্তরের নূরের ঝলক মনের চোখ দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এরপর থেকেই তিনি মরমি কবি।
১৯০৭ সালে হাসন রাজা রচিত ২০৬টি গান নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিন পুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’ সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, হাসন রাজার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ ‘শৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয় ছিল- স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। হাসন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। সৈয়দ মুর্তজা আলীর ‘মরমি কবি হাসন রাজা’ রচনায় এক জায়গায় হাসন রাজার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘হাসন রাজা সুনামগঞ্জের একজন মুকুটহীন রাজা ছিলেন।’ হাসন রাজা সম্পর্কে বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, ‘রাজা সুলভ সত্তায় একটি অতি কোমল দয়ালু মনের পরিচয় পাওয়া যায়।’ সুনামগঞ্জের আরেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক গবেষক আবদুল হাই রচনা করেছেন ‘হাসন পছন্দ’ নামে একটি গ্রন্থ। হাসন রাজার দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে ‘ওহফরধহ চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ ঈড়হমৎবংং’ এ বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।’ এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ’ঞযব জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ’ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন। এছাড়াও ২০০২ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এবং চিত্র নায়ক হেলাল খানের প্রযোজনায় হাসন রাজার জীবনের ভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। চলচ্চিত্রটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আরও ছয়টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে এবং দুটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে।
বাউল সাধক হাসন রাজা ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর (২২ অগ্রহায়ন ১৩২৯ বাংলা) মাত্র ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে মায়ের কবরের পাশে তিনি সমাহিত হন। যে কবরখানা মৃত্যুর পূর্বেই তিনি নিজে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাসন রাজা ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এছাড়াও, সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পান্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগাপ্লুত করে।
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা
দরবার
দরবার
যাহিদ সুবহান
সোহরাব মুনশীর মত এ গ্রামের সব দরবারে আরেকজন মানুষকে থাকতে হয়। তিনি মসজিদের ঈমাম হুজুর। জুমআর নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ান তিনি। সব সময় তসবিটা হাতেই থাকে তাঁর। বাড়তি কথা কম বলেন। সব দরবারের ফয়সালা তাকেই দিতে হয়। সোহরাব মুনশী শুধু রায় ঘোষনা করেন। তিনি অবশ্য এ গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন। এ গ্রামের যত মিলাদ-দোয়া-খায়ের সবই তাঁকে করতে হয়। মসজিদের সম্মানীতে তার সংসার চলে। এ ছাড়া গাঁয়ের মানুষদের জ্বিনের আছড় হলে কিংবা শিশু বাচ্চারা ভয় পেলে এমনকি বিছানায় প্র¯্রাব করলেও তাকে তাবিজ-কবচ দিতে হয়; পড়া পানি, তেল পড়া দিতে হয়। অবশ্য তাবিজ-কবচ কিংবা পানির ব্যবস্থা ভুক্তভ’গী যারা আসে তারাই নিয়ে আসে। হুজুরের কাজ শুধু দোয়া পড়ে তিনটি ফুঁ দেওয়া। সামান্য হাদিয়া সেখানেও মেলে তাঁর।
চিরায়ত ভঙ্গিমায় দরবারের প্রধানের নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে বসেন সোহরাব মুনশী। যথারীতি হাঁক ডেকে রহমুদ্দিকে বললেন,
কী রে রহমুদ্দী, কী হয়ছে ক দেহি?
রহমুদ্দী আজকের দরবারের বাদী। হাত মোচর পাড়তে পাড়তে সে সোহরাব মুনশীর সামনে এসে বলে,
আর কবেন না, কাহা! এই নষ্টা মহিলা (জুলেখাকে নির্দেশ করে) চেলাকাঠ দিয়ে মাইরে আমার সালামের মাতা ফাটা ফ্যালাইছে। আপনে ইর একটা বিচার কইরি দেন কাহা।
রহমুদ্দীর কথা শুনে আর কারো কোন কথা না শুনেই ক্ষেপে যায় সোহরাব মুনশী। যেন বাঘের তর্জন-গর্জন শুরু হয়ে যায়। দরবারে উপস্থিত সকলে দেখতে পায় সোহরাব মুনশীর আসল চেহারা। সবাই ভীত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলে,
এ ছেড়িডা কী কইরলো রে! আইজ যে কপালে কী আছে। মুনশী আইজ ক্ষেপিছে।
এত বড় সাহস এই মহিলার! একটা মহিলা মানুষ হয়ে তাও আবার বিধবা, একজন পর পুরুষের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সোহরাব মুনশী ক্ষেপে গিয়ে রক্তচক্ষু করে জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করে,
ক্যারে জুলেখা, সালামের মাতা ফাটাইছস ক্যা?
সোহরাব মুনশীর কথায় কোন কর্ণপাত করে না জুলেখা। একবার মাথা তুলে তাকায় সোহরাব মুনশীর দিকে। আবার আগের মতই সে মাথা নিচু করে মাটির দিকে একপানে চেয়ে থাকে। জুলেখার রক্তলাল চোখে যেন আগুন ঝরছে। নাগিনীর মত ফুসে আছে সে। জুলেখার মুখে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে দ্বিগুণ ক্ষেপে যায় সোহরাব মুনশী। জুলেখার এমন বেয়াদবী মেনে নিতে পারে না সে। সোহরাব মুনশীর চেয়ে বেশী ক্ষেপে যায় দরবারে উপস্থিত থাকা জামাল। সোহরাব মুনশীর চোখে চোখ তুলে কথা বলে এমন সাহস নেই এ গাঁয়ের কারো। অথচ জুলেখা কোন কথাই বলছে না। এত বড় সাহস ওর! সোহরাব মুনশীর সাথে বেয়াদবী! এতক্ষণ চুপ ছিল। যদি সোহরাব মুনশী ক্ষেপে যায়; বেয়াদবী হয়, তাই কিছু বলে নি। এবার আর থেমে থাকা যায় না। সে গিয়ে ক্ষপ করে জুলেখার চুলের মুঠি ধরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে আর বলতে থাকে, কতা কইস নি ক্যা মাগী, কতা ক!
জুলেখার মুখে তখনও কোন কথা বের হয় না। ব্যথায় ককিয়ে উঠে সে অষ্পষ্ট আওয়াজ করতে থাকে, উহ্!
জুলেখা গাঁয়ের শেষ মাথায় বনের ধারে একটা খুপরি ঘরে থাকে। ২৫ বছর বয়স। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। ছয় বছর বয়সের ছেলেটাকে নিয়ে সে থাকে। এই ছেলেটাই তার বেঁচে থাকার সম্বল। এ বাড়ী ও বাড়ী দাসীবাদী করে তার কোনমতে চলে যায়। গ্রামের গৃহস্থের কাঁচা ঘর, কাঁচা উঠোন লেপার দরকার হলে ডাক পরে জুলেখার। জুলেখা বাড়ির পাশের পুকুর কিংবা খাল থেকে কাদামাটি এনে তাতে কাঁচা গোবর- ধানের তুষ মিশিয়ে খুব যতœ করে সেগুলো লেপে দেয়। জুলেখার নিখুত কাজে সবাই খুশি। গাঁয়ের নায়েব আলীর মা, সাদ্দামের মাও লেপার কাজ করে কিন্তু জুলেখার মত এত ভাল কাজ কেউ করতে পারে না। শুধু কি ঘর লেপা; গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, বাড়ির চারপাশ ঝাড়– দেওয়া, কাপড়কাঁচা, এমনকি রান্নার কাজও করতে হয় জুলেখার। বিনা আপত্তিতে জুলেখা এসব করে দেয় বলেই সবার বিশেষ পছন্দের মানুষ সে। সবাই ওর প্রশংসা করে বলে,
জুলেখার কামের মেলা ঢক!’ সবাই কাজ শেষ হলে খুশি হয়ে ভাত-তরকারি, কয়েকটা টাকা এবং এককেজি চাল দেয়। ঈদ উৎসবে কমদামী প্রিন্টের শাড়ীও জোটে জুলেখার কপালে।
জুলেখার ছেলেটা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। জুলেখার চিন্তাও বাড়ছে দিন দিন। ছেলে বড় হচ্ছে। ওর ভবিষ্যত কী? ছেলেটাও মাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। স্কুল থেকে ফিরে মাকে বাড়িতে না দেখলে ও বিগড়ে যায়। বইগুলো বারান্দার মাঁচায় ছুড়ে ফেলে এক দৌড়ে ছুটে যায় হয় মোল্লাদের বাড়ি নয়তো মুনশীর বাড়ি। ও ঠিকই জানে ওর মাকে কোথায় পাওয়া যাবে। মাকে পাওয়ার সাথে সাথে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। জুলেখার হাতে-গায়ে তখন হয়তো লেগে আছে কাদা কিংবা গোবর। তরিঘরি করে হাত ধুয়ে ছেলেটাকে পরম যতেœ জড়িয়ে ধরে সে। কপালে একটা চুমু খায়। হালকা ঘামে ভেজা ছেলের কচি মুখটা আঁচল দিয়ে মুছে দেয়। ছেলের মুখটা দেখার সাথে সাথে একটা প্রশান্তি এসে জুলেখাকে ছুয়ে যায়। মুহূর্তেই তার সকল ক্লান্তি যেন হাওয়ায় ভেসে যায়।
সারাদিন কাদামাটি, গোবর, ময়লা-আবর্জনার মধ্যে থাকলেও এগুলো জুলেখার সুন্দর রুপলাবণ্যকে একটুও ম্লান করতে পারে নি। অভুক্ত-অপুষ্টিতে অবিরাম দিনপাত করলেও দৈহিক গড়নে একটু ঘাটতি নেই। অবিরাম অযতেœ দেহের চামড়ার ভাজে ভাজে ময়লার স্তর পরলেও তার রুপলাবণ্য প্রকাশে এগুলো ব্যর্থ। চুলগুলোতে নিয়মিত তৈল-সাবান হয়তো পড়ে না তাতে কী, সেগুলো দীঘল কালো! অনেকেই আফসোস করে বলেই ফেলে,
হায় রে অভাগী, আল্লাহ ওকে সব দিয়েও সব কেড়ে নিয়েছেন!
আর এত হারখাটুনি পরিশ্রমের পরেও দাঁতের ফাঁক গলে এক ফোটা হাসি যেন লেগেই আছে। তবে জুলেখা এসব নিয়ে ভাবে না। ছেলেটাকে মানুষ করাই তার একমাত্র লক্ষ। সব কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরে জুলেখা। পাশের জঙ্গল থেকে জোগাড় করা লাকড়ি চুলার পাশে নিয়ে রান্না করতে যায়। কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে মায়ের পাশে খেজুর পাতার বোনা পাটি পেরে বসে পরে জুলেখার ছেলে। জোরে জোরে পড়তে থাকে, ‘অ তে অজগরটি আসছে তেড়ে!’
সব হারিয়ে নিঃস্ব জুলেখা। বাবা গত হয়েছেন অনেক শিশুবেলায়। বাবার মুখটাও মনে পড়ে না তার। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা মা অনেক কষ্টে বড় করে তুলছিলেন জুলেখাকে। একদিন মাকেও হারাতে হয়েছিলো অবেলায়। বিধবা মায়ের ঘরে ঢুকেছিল এক অচেনা পুরুষ। মা প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু এই অন্ধ সমাজ সেদিন জুলেখার নিরপরাধ মায়ের পক্ষ না নিয়ে বরং বিপক্ষে গিয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেদিন ওর মাকে চরিত্রহীনা অপবাদ দিয়েছিলো। সেদিন এই সোহরাব মুনশীর উঠোনেই বসেছিল দরবার। সোহরাব মুনশীই ছিলেন দরবার প্রধান; দিয়েছিলেন রায়। বেদম প্রহার জুলেখার মাকে সামান্যতম আঘাত করেনি। চরম আঘাত করেছিল চরিত্রহীনা অপবাদ। সেদিন আজকের মতোই গোধূলি নেমছিল পৃথিবীতে। সাদা বকেরা আজকের মতই নীড়ে ফেরার প্রতিক্ষায় ছিল। জুলেখা বাড়িতে ফিরে আবিষ্কার করেছিল তার মা ঘরের একটা ডাবে নিজের শাড়ীতেই ঝুলে আছে। নিরব; নিথর! সেদিন থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটার প্রতি জুলেখার প্রবল ঘৃণা। এই সমাজের কাছে জুলেখারা বরাবরই দূর্বল-অসহায়। তাই এই সমাজের সোহরাব মুনশীদের মুখে অবিরাম থু থু ছিটিয়ে প্রতিবাদ করা ছাড়া জুলেখা আর কী ই বা করতে পারে!
ঘটনাটা গতকাল সন্ধ্যার। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রহমুদ্দির ছেলে সালাম এসময় হাজির হয় জুলেখার বাড়িতে। বেশ কয়েকদিন ধরেই সে জুলেখার পিছু নিচ্ছে। সময় অসময়ে সে জুলেখাকে বিরক্ত করে চলছে। মাঝে মাঝেই নতুন শাড়ী, নগদ টাকা নিয়ে হাজির হয় জুলেখার বাড়িতে। জুলেখা এসব পছন্দ করে না। সে সালামকে এসব করতে নিষেধ করে। সালাম বিবাহিত মানুষ; তার বাড়িতে সুন্দরী বউ আছে। মানুষ এসব শুনলে বরং জুলেখারই কলঙ্ক হবে। গতকালও এসেছিল হাতে করে ছেলের জন্য একটি স্কুলব্যাগ হাতে করে। জুলেখা বাড়িতে এমনিতেই একা থাকে; বিধবা মানুষ। সে সালামকে অনুরোধ করে বলে,
সালাম ভাই, আপনে চইলে যান, এই বাড়িত এইভাবে আইসপেন না!’
সালাম জুলেখার কোন কথাই শোনে না। সে খপ করে জুলেখার হাত ধরে ফেলে।
তুমি রাগ করো ক্যা জুলেখা? আমি কি তুমার পর মানুষ? তুমি রাজী থাকলি আর কি ডা কী জানবি কউ!
জুলেখা এক ঝটকায় সালামের হাত থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বারান্দায় সাজিয়ে রাখা একটা চেলাকাঠ নিয়ে সে এলাপাথারি সালামকে পেটাতে থাকে।
পরদিনই দরবার বসায় সকলে। সোহরাব মুনশীর উঠোনে দরবার বসে; দরবার প্রধানও সেই সোহরাব মুনশী। দরবারে মাটির দিকে মুখ করে জুলেখা তার অতীত নিয়ে ভাবতে লাগে। সে এক অন্যগজতে চলে যায়। বাবা-মা কিংবা স্বামীটা বেঁচে থাকলেও কি এমন নরক যন্ত্রনা পোহাতে হতো তাকে। অন্ধ এ সমাজ কি জুলেখার মত অসহায় মেয়েকে কঠিন দরবারের মুখোমুখি করতে পারতো? হঠাৎ সম্ভিৎ ফিরে পায় জুলেখা। সে টের পায় কেউ একজন তার চুলের মুঠি ধরে ঝাকাচ্ছে আর বলছে,
কতা কইস নি ক্যা মাগী, কতা ক!
জুলেকার মুখে তখনও কোন কথা বের হয় না। ব্যথায় ককিয়ে উঠে সে অষ্পষ্ট আওয়াজ করতে থাকে, উহ্!
পাবনা।
ফাঁদ
ফাঁদ
মনিরা মিতা
রাখালপুর গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তের কোলঘেষে মাসুমদের ছোট্ট কোণঠাসা বাড়ী। মাসুমের মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে পরিবারের জন্য সামান্য আয় করতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়।
কত ভিটায় নতুন ঘর ওঠে, কত জনের ভাগ্য ফেরে, শুধু পরিবর্তন হয় না কাল প্রবাহে খড়-কুটার মত ভেসে বেড়ানো মজিদ যোদ্ধার জীবন। কালেভদ্রে এক আধটুকু হাসি ফোঁটে তার মুখে, ঘর সংসারের চিন্তায় তার মাথা সর্বদাই ঝুঁকে থাকে। তবে ইদানিং সে স্বপ্ন দেখে তার ছেলে মাসুম অদৃষ্টের দু:খ খন্ডাবে, ছেলে এবার এইচএসসি পাস করেছে।
হ্যাঁ, অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত এসেছে মাসুম, পড়াশোনা আর চালানোর সাধ্য তার দরিদ্র পিতার নেই, তা তার অজানা নয়। মাসুম আর তা আশাও করে না। শুধু স্বপ্ন দেখে ছোট ভাইকে মানুষ করবে, বোন দুটোকে ভাল ঘরে বিয়ে দেবে, বাবা - মায়ের বৃদ্ধ বয়সের লাঠি হবে।
বেশ কিছুদিন ঢাকা এসেছে মাসুম একটা চাকরীর খোঁজে। কিন্তু চাকরী সেটা যে সোনার নয় হীরার হরিণ। জ¦লন্ত আগুন হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যতোটা না কষ্ট তার চেয়েও অধিক কষ্ট একটা চাকরী হাতের মুঠোয় বন্দি করা তাও আবার এইচএসসি পাশ করে।
দ্বিধা - জড়তা নিয়ে মাসুম যখন কুঁকড়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ এক বন্ধুর মামার সাথে পরিচয় হয়, যে কিনা বিদেশে লোক পাঠায় কম খরচে। খবরটা জানার পর থেকে চিন্তার ঘন কুঁয়াসায় ডুব দেয় মাসুম। মাথায় ঘুরপাক খায় অসংখ্য চিন্তা। এই জরাজীর্ণ জীবন থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠে সে।
অনেক আশা নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে মাসুম। ছেলের মুখে স্বপ্ন পূরনের কথা শুনে মজিদ মিয়ার বুকও উথাল-পাথাল করে। কিন্তু পরক্ষণে একটা ক্ষোভ দীর্ঘশ্বাস আকারে নেমে যায় মজিদ মিয়ার বুক চিরে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে কতজন মাসে মাসে সরকারি ভাতা হাতিয়ে নিচ্ছে অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সে সবকিছু থেকে বঞ্চিত। টাকার অভাবে নিজের ওষুধের টাকাই সে জোগাড় করতে পারে না আর ছেলের বিদেশ যাওয়ার এতো টাকা সে কোথা থেকে জোগাড় করবে? অবশেষে স্বপ্ন-বাস্তবের দোলায় দুলতে দুলতে মজিদ মিয়া সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেকে সত্যিই বিদেশ পাঠাবে। যদিও এ জন্য খোয়াতে হবে তার শেষ সম্বল, এক টুকরো জমি। বাবার মুখে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন সত্যি হবে জেনে ঢাকা আসে মাসুম। অতি দ্রুত ঠিক করে ফেলে দুবাই যাওয়ার সব ব্যবস্থা। বন্ধুর মামা, তাই মাত্র দুই লক্ষ টাকায় সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। পাসপোর্টসহ নানা ফরমালিটি শেষ করে গ্রামে ফিরে আসে মাসুম।
ওদিকে মজিদ মিয়া চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু খুইয়ে জোগাড় করল ছেলে স্বপ্ন পূরনের ভিসা। সুতরাং নির্ধারিত সময়ে বাবা-মা ভাই-বোনকে শুভ বিদায় জানিয়ে সুখের ঠিকানায় পাড়ি দিল মাসুম।
তারপর...।
ছয়মাসে পার হল। আজ অসহায়ের মত বিমান থেকে ছেঁড়া কাপড় পরে নামল মাসুম। চোখে দুটো তার অথৈ সমুদ্র, সেখানে টলমল করছে বঞ্চিত-নিপিড়ীত হওয়ার জল।
দুবাই পৌঁছেই পুলিশের হাতে বন্দি হয় মাসুম। কারণ সে গলাকাটা পাসপোর্ট আর নকল ভিসা নিয়ে দুবাই এসেছে। হঠাৎ এক ঢেউয়ের তীব্র ঝাপটায় ডিঙ্গি উল্টে যাওয়ার মতই উল্টে যায় মাসুমের জীবন। ছয় মাসের জেল হয় তার। কারাগারের অন্ধকারে মাসুমের বারবার ভেসে ওঠে বাবা মায়ের করুন সুখ, অথচ সে নিরুপায়।
বাংলাদেশে পৌঁছে শ্রান্ত-ক্লান্ত মাসুম কি করবে ভেবে পায় না। বাড়ীর সবাই যে পথ চেয়ে আছে তার। বাবা শেষ সম্বল হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একটু সুখের খোঁজে কি করে সব হারিয়ে বাবার সামনে যাবে মাসুম? কৃষ্ণপক্ষের গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে মাসুমের জীবন। মাকড়শার জালে মাছি যেমনি আটকা পরে তেমনি মাসুমও বন্দি, তবে মাকড়শার নয় লোভের ফাঁদে। আর সে লোভের বলি হয়েছে মাসুমের সর্বহারা পরিবার।
শিরোমনি,খুলনা
পদাবলি
তুমি
রেবেকা ইসলাম
তোমাকে ভাবলেই নদী চলে আসে
পাহাড়ের সমান ঢেউ হয়ে
খুব কাছে,একপাতা দূরে,
এক অতুল জলজ ঘ্রাণে
সন্নাসব্রতী হয়ে যায় মন,
নেশাতুর হয় এক পশলা রোদের দেয়াল,
দিগি¦দিক দোলে তৃষ্ণার্ত লম্বা বেণীযুগল
মেথিপাতার ঘ্রাণমাখা ঠোঁট সাহসী হয়ে ওঠে
অপরিমেয় তিরতির কম্পনে,
হয়ত এটাই পরম চাওয়া,পরম পাওয়া,
রক্তে ভেজানো আঙুরলতার মতো সন্ধ্যা নামে
যখন তুমি ঘুমাও দুহাত বুকে,
মুঠোভর্তি দলিত রোদ তুমুল মিছিল করে
যখন তুমি অজানায় হারাও,
আর আমি ইতিহাসের মমি হয়ে যাই।
স্মৃতি
মাহবুব এ রহমান
ওই শুনো না; আমায় তুমি আগের মত মিস করো?
আমায় ভেবে কল্পনাতে এখনো ফিসফিস করো!
আগের মতো আমার লাগি কুল কফি আর বানাও কি,
নীল কাগজে আমার ছবি দেয়াল জুড়ে টানাও কি?
পড়লে মনে আমার কথা আগের মতো গানও গাও?
কল্পনাতে ভাসলে পরে জর্দা-চুনের পানও খাও,
এখন কারো ধমক খেলে মনটা উচাটন করে
কিংবা কারো মিষ্টি টোনে আগের মত মন ভরে?
ভাল থেকো আগের মত নিয়ে ঘরের সব্বারে
তোমায় কিন্তু আজও খোঁজে ফিরে অদম জব্বারে!
পরিভ্রমণ
শোয়াইব শাহরিয়ার
অবহেলায় নুয়ে পড়েছে লতাটা
প্রাণ আসে, প্রাণ যায়
অপসংস্কৃতির বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে!
সুতীব্র যন্ত্রণায়, কুয়াশায় স্নান
পরিযায়ী পাখি আসে
উড়ে উড়ে
হৃদয়ের গহীন বালুচরে;
পরিভ্রমণ শেষে
ফিরে যায় সাইবেরিয়ার স্তনে!
সাহারার উষ্ণতা—
ছুঁয়ে যায় বাউণ্ডুলে জীবন
অবহেলায় ফুটে না ফুল শাখায়
সংসারে জঙ ধরে
প্রাণ আসে, যায় না একেবারে!
আধমরা এই জীবন
‘কুয়াশায় যদি ডুবি একেবারে
মিনতি তবে
ক্ষমা করো সব যন্ত্রণা।'
অবহেলায় হারালো সোনালি শৈশব
সবুজ ঘাসের দেশ
খেলা শেষে সন্ধ্যায় আলো হাতে
একা ফিরতে ফিরতে
গরীসৃপের ছোঁবলে হারাবে না;
যদিও জীবনের জালে
পেঁচালো স্বপ্নের দিন
অবহেলায় প্রাণ আসে, প্রাণ যায়...
প্রেমজাল
ফাহমিদা ইয়াসমিন
তোমার কথা ভাবি আমি খুব
তোমায় ভেবে অতল জলে দেই অজান্তে ঢুব
তুমি মনের গহীন কোণে বলছো প্রেমের কথা
সেই কথাতেই নীরব আমি নীরব মুগ্ধ শ্রোতা।
তুমি আমার হৃদমাজারে অচীন একটা বৃক্ষ
একজীবনে তোমায় পেয়ে নির্বাসনে দুঃখ
তাই তো আমি প্রেমের ঘাটে আজকে বাঁধা পাখি
দিবানিশি স্বপ্ন দেখি স্বপ্ন গড়ি স্বপ্নে জাগে আঁখি।
একদিন আমরা পাখি হবো পাখির মতো উড়বো
প্রেমের সুখ করতে বিলি নদী হয়েও ঘুরবো
সেদিন থেকে মিথ্যে প্রেমের হবে খুব বিলুপ্তি
সবার মনে প্রেম খবরে আসবে একটা তৃপ্তি।
শাল
ইস্রাফিল আকন্দ রুদ্র
নিভৃতে কেঁদে সময়ের রথ অগ্রসর
শাদা দেয়ালে ঝুলানো লাল সোয়েটার-
ঘড়ির কাঁটার ন্যায় পর্যায়বৃত্ত গতিতে ঘুরছে প্রেম!
কষ্টের রাইফেল বাম কাঁধে ঝুলছে
খবর নেই মানবীর অথচ প্রেমে ছইছই-এয
আমার ভেতরের এক মাইল রাস্তা। উঃ না
চাঁদ বোকার মতো হাঁসে এই ভেবে তাতে জমানো আমাদের সুখ ও শোক ।
ঘাসভর্তি মাঠের ন্যায় মোলায়েম শাল জড়িয়ে ধরে আমার শরীর!
পদাবলি : ০১
প্রভাতদূত
আহমাদ সোলায়মান
অজান্তে তা গ্রহণ করেছে অবাধ্য মন,
সূর্যের ক্লান্তিঘুম থেকে যে যৌবনখেলার শুরু
মধ্যপ্রহর অন্ধকারের অশ্রুস্নানে তার শেষ খুঁজে;
দুঃস্বপ্নের সাগরে ডুবে অর্ধনিশি শেষ সময়ের পরিত্রাণ
আর সেখানে রংধনুর মত ইচ্ছে নিয়ে আছে প্রভাতদূত।
অবহেলা
পার্থ কর্মাকার
এভাবেই বোধহয় অবহেলা কুড়াতে কুড়াতে
একদিন মৃত অন্ধকারে নিখোঁজ হবো!
নিখোঁজ হৃদয়ের প্রতি সমালোচনা
নিঃশব্দ আহামদ
একটা হৃদয় থাকে, কখনো সে ভিজে আমি অনুভব করি ¯্রােতের মতো তাজা রক্তে, ক্ষরণে এবং দাগে-কখনো উষ্ণ হয়, কাম-তাপ রসায়নে। আর সে হৃদয়খানি জুড়ে থাকে সম্মোহন; ঠিক বলি যাকে প্রেম।
কখনোবা ভাঙে, বিচূর্ণ কিনা ঠিক কাঁচ চূর্ণরুপ
অথবা ধপাস শব্দে পতিত যে পাত্রটিরও অবশিষ্টাংশ কাজে লাগানো ভার, এমনো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া হৃদয় এক আমার, ধড়ফড় রোজ মরে যায়।
না পাখা নেই, তবু উড়াউড়ি বিরান-
হারায় উদ্দেশ, নিরূদ্দেশ কোনো হৃদয়
ঠিক আরও কোনো হৃদয়ের ছোঁয়া পেতে হলে মরিয়া
উড়তে থাকে ব্যথায়, যখন কোনো মানুষ থাকে অধরায়।
মানুষের একটা হৃদয় থাকে শুনি, বন্ধু এবং প্রেমিকারও
সময় ফুরোয়, আরও আরও আগামি দখলে ব্যস্ততায়
নাহ বন্ধু নেই, না কোনো প্রেমিকা-শুধু একা
শুধু সময়টুকু নাড়ায় হৃদয় অতঃপর, অথচ সবখানে দ্যাখে গেলাম কেবল অভিনয়।
হৃদে হৃদে লাগুক জোড়া, হায়! ভাঙন না এতোটা আর
মৃত্যুসম শোক বাজে হৃদে, কে শুনিবে কান পেতে বুকে আমার।
চিরযৌবনা
মিশির হাবিব
তোমার তখন বিয়ে হয়ে গেছে,
লাল শাড়ি, লাল চুড়ি আর মেহেদীর লাল রঙে
তোমাকে একটা আস্তো লাল গোলাপের মতো দেখাচ্ছে,
অথচ আমার মনে হচ্ছে, আমি শুধু তোমার রাতজাগা চোখ দেখছি,
তোমার ক্লান্ত ঢলে পড়া মাথা আমার কাঁধে বিশ্রামের ভালোবাসায় নুয়ে পড়তে চাইছে।
তুমি তখন একটা ছেলে সন্তানের ‘মা মা’ শুনছো,
সবাই বলছে, তোমার শরীর ভেঙে গেছে
মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো কমে এসেছে তোমার চেহারায় চাঁদের ঝিলিক;
অথচ আমার মনে হচ্ছে, আমি শুধু তোমার পদ্মফুলের মতো ঠোটের তিরতির কাঁপন দেখছি,
তোমার চুলের মেঘে কালো হয়ে ঢেকে আসছে আমার নীলিম আকাশ।
তোমার বয়স তখন ষাটেরও অনেক বেশী,
মখমলের মতো নম্র গাল ভেঙে ঢুকে গেছে চোয়ালের ভেতর;
একদিনকার আবলুসের মতো চুল দেখলেই লোকে বলছে পাটের আঁশের কথা;
হাসতে গেলে মনে হয় কান্নায় ভেঙে পড়ছো তুমি,
অথচ আমার মনে হয়,
তুমি সূর্যের মতই চির ঝাঁজালো,
ইচ্ছে হয় তোমার হাসিতে গায়ে মৃত্যুর রঙ মেখে খুন হই নিযুত কোটিবার;
মনে হয় আরো একটিবার তোমার প্রেমে পড়ি।
তুমি আমার আস্ত একটা কবিতা
ইয়াকুব শাহরিয়ার
তোমার আধখোলা পিঠে লেখা হয়
আমার কামনার সাতকাহন।
মেঘের মতো ঢেউ খেলানো চুল
নীল শাড়ি, চুড়ি আর মেহেদি রাঙা ধলা হাত;
লিখে চলে প্রেমের ইতিহাস।
সমস্ত দেহ যখন খেলে বেড়ায় কবিতা হয়ে-
স্বভাবতই আমি কবি বনে যাই।
কবি হওয়াই আমার স্বভাব
তোমায় পাওয়ায় আমি কবি। স্বঘোষিত কবি এক।
ফর্সা হাতে নীল চুড়ি, দেহভর্তি নীল শাড়ি
আর রূপায় তৈরি ঘুঙুরি নূপুর।
সবটাই যেনো আস্ত কবিতা একটা।
আমি, হ্যাঁ- আমিই সেই কবিতার কবি।
পদাবলি : ০২
সর্ষে ফুলের সৌরভে
সোহেল রানা
সকালের স্নিগ্ধতা শরীরে মেখে
পাখির কলতানে হৃদয়ে ভালোবাসার হাওয়া লাগিয়ে,
আমি চলছি প্রকৃতির পথে-প্রকৃতির সাথে।
সর্ষে ফুলের সৌরভে, মৌমাছির গুঞ্জরণে
হলুদে হলুদে চারিপাশ ভরে গেছে,
কৃষান-কৃষানির হাসিতে- সূর্যের সোনা আলোয় তা ঝিকিমিকি করছে;
আর আমি যেন হারিয়ে গেছি শাখাতে-প্রশাখাতে;
কখনো আবার পাখির মতো ডানা মেলে উড়ছি তো উড়ছিই-
ওই দূর আকাশে নীলিমার সাথে সাথে;
কখনো আবার এ মাটির কোলে সবুজ শ্যামলে-
সোনা ফলা ফসলে সোনালি প্রভাতে-
খোলা বাতাসে; ভালোবাসার হাওয়ায় শরীর ভিজিয়ে
প্রাণ খুলে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস নিয়ে নিয়ে-
আমি চলছি প্রকৃতির পথে প্রকৃতির সাথে।
অবশেষে সকাল পেরিয়ে, দুপুর গড়িয়ে,
অপরাহ্নের হিমেল মাদকতায় কৃষান-কৃষানি ঘরে ফেরে
হলুদ বর্ণ শরীরে মেখে; মৌমাছি মধু নিয়ে মৌচাকে
আমিও ফিরি ঘরে; প্রকৃতির স্নিগ্ধতা শরীরে মেখে।
ফিরতেই বিষন্নতায় মন ধরলো আঁকড়ে !
প্রকৃতির নিস্তব্ধতা নেমে আসে সন্ধ্যাতে-
সকালের স্নিগ্ধতা, দুপুরের সোনা আলো, বিকেলের
হিমেল মাদকতা, হৃদয়ে জাগে বারে বারে !
আসা যাওয়ার পথে হৃদয় নদীর মাঝে
এ কি খেলা খেলে-
কখনো প্রেমে কখনো বিরহে !
রাতের নিস্তব্ধতার পরে যেমন দিনের আলো জ্বলে
সুখ পাই তবে প্রকৃতি তোমায় দেখে।
বনসাই জীবন
আহমেদ ইউসুফ
ছায়াতরু আশ্রিত জীবনের মাহাত্ম্য
বিটপীর ছায়াতল পর্যন্ত বিস্তৃত
এ বলয় অতিক্রম করার ক্ষমতা
ক্রমশ হারিয়ে, গত হয়ে যায় সময়।
ঝড়-ঝাপটার দাপট থেকে বেঁচে বেঁচে
হৃদয়ে হৃদয় সন্নিবেশিত
ভরসার প্রদ্যোত প্রদীপের আবডালে
থেকে যায় প্রমাদ ভয়।
তরুতলে বেড়ে উঠা বামন বনসাই যেন
প্রাচীন প্রাকারে অর্গালিত ঘরে বেষ্টিত
নিদ্রাতুর নিনাদে অস্তিত্বের হাহাকারে
একদিন জেগে উঠবে নিশ্চয়।
সেদিন শাখা-প্রশাাখা বিস্তৃত হতে হতে
ফুলের সৌরভে মাতিয়ে সমীরণ
মৌমাছিদের নিরুপম আনাগোনায়
ফলিত ফলফলাদি নিয়ে
স্বীয় অস্তিত্বের স্বীকৃতি পেয়ে
ভুবনময় তুলবে এক বিস্ময়কর বিজয়।
আকাশের আর্শিতে
শাহীন রায়হান
আকাশের আর্শিতে ঝিকিমিকি তারা
ধুয়ে যায় বৃষ্টিতে জেগে থাকে যারা
ফুল ফোটে গাছে গাছে নীল পরী নাচে
চাঁদ হাসে মিটিমিটি তারাদের কাছে।
এলোমেলো হাওয়া বয় জোনাকি জ্বলে
ঘুম ভাঙা পাখিরা নানা কথা বলে
সাদা মেঘ উড়ে উড়ে করে বাজিমাত
বুকে জমা কথাগুলো বলে যায় চাদঁ।
মেঘমালতি ফুল
মিসির হাছনাইন
১.
পাশের বাড়ির চোরা করিম্মার বউ শরীফা খাতুন এককালে আমার প্রেমিকা ছিল। খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকতো বুকের উপর। লাজ লজ্জা ছিলো না তাঁর, বলতো- এই দেহ নাকি তাঁর। রাতদিন শুধু বলতো- ‘তোমারে ছাড়া আমি বাঁচুম না, তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার কলিজা’। আমার লজ্জা ছিল, সে ভালোবাসতো লজ্জাবতী ফুল, আর আমি ভালোবাসতাম দূর আকাশের মেঘ। তাই তো আদর করে নাম দিয়েছিলাম মেঘমালতি।
সেদিন আকাশে দশ পাহাড়ের সমান কালো মেঘ জমেছিল দক্ষিণের কহুয়া বিলে, চারদিকে এমন এক অদ্ভুত অন্ধকার নেমেছিল, মনে হয়েছে- ইস্রাফিল দিয়েছেন সিঙায় ফু। আমার মেঘমালতি দৌড়ে এসে ঢুকে পড়লো বুকের ভিতর। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকলো, হঠাৎ একটা বিকট শব্দ! অনুভব করলাম- কে যেন বুকের কলিজাটা টান দিয়া ছিঁড়া নিয়া গেল...
তারপর....!!! পরের ঘরে বড় হচ্ছে মেঘমালতি ফুল...
বুঝে নিতে পারো জলের ভাষা
তারিক ফিজার
চাইলেই এ বৃষ্টিতে তোমাকে ফোন করে
বলে দিতে পারি- হৃদয়ের কথা।
কিন্তু- কেন বলব?
তুমি তো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে
বুঝে নিতে পারো- জলের ভাষা।
কাম নয়- শুধু পাশাপাশি বসে
দু’চারটা কথা বলা,
জলময়ূরের মতো-
আমাদের হৃদয়ের খুনসুটি।
চাইলেই এই বৃষ্টিতে তোমার হাতে নিজেকে- সপে দিতে পারি।
কিন্তু কেন দিবো?
তুমি তো ‘টু লেট’ দেখে বাইরে থেকে ভেতরের অনুনয় বুঝে নিতে পারো।
পদাবলি : ০৩
আবার লাগাও যুদ্ধ
হামীম রায়হান
যুদ্ধে যাওয়ার যে গান রচেছিলো কবি,
সে সুরে লেগেছে ঘুণ,
যৌবনের উত্তাল সমুদ্রে আজ চরিত্রের
নৌকায় লাগে আগুন।
পোকায় খেয়েছে সততার ফল,
নরম মাংসের লোভে জিহ্বায় জল।
মানব গড়ার পথ ছেড়ে যৌবন আজ
অন্ধকারের পথ ধরে হাঁটে,
আবার লাগাও যুদ্ধ, যৌবন যেন
লাগে জীবন গড়া হাটে!
আবার লাগাও যুদ্ধ জীবনের তরে,
ফিরে আসুক শুদ্ধতা, যৌবনের ঘরে।
হেমন্তে হারাবার প্রত্যাশা
রাশেদ বিন শফিক
বিহানের হিম শীত গায়ে মেখে,
শিশিরে স্নান করা শ্যামলের বুকে;
হাতে রেখে হাত চলবো নগ্ন পায়ে।
পাখিদের ডাকাডাকি সুর আর
আমন ধানের ঘ্রাণে বিভোর হয়ে,
সঞ্চিত কথা সব বলে হবে চলা;
যেখানে ঊর্মি উঠে সোনা রোদ নিয়ে।
মনে করে একটি ফুল খোঁপাতে দিও,
নীল চাদরটাও গায়ে জড়িয়ে নিও,
আমার দেওয়া সে নুপুরটিও-
পায়ে দিতে ভুল না করে;
এসো প্রিয় হারিয়ে যাই হেমন্তি রূপে।
বাক্সপর্ব
সোমনাথ বেনিয়া
গুছিয়ে রাখছো, মুখ থুবড়ে পড়ছে বিষয় ভর্তি
নিজের রং ভুলে প্রভৃতির রং ধরছে জঠরে
অগোছালো কিংবা নির্ভেজাল সাজানো প্রতিরূপ
মোহময় হাসি পছন্দের অথবা বিরূপ মন্তব্য
মনে রাখবে নেই বলে ঋজু উচ্চতায় অবিচল
গোপন কুটিরে কাঞ্চন হারানোর ভয় সাবধানী
গৃহিণী জানে ভরসার সংজ্ঞা আঁচলের চাবি
শরীরের বিভিন্ন স্তরে জমিয়ে রাখা আপ্যায়ণ
খুলে দিলে মোহিত গন্ধ অনেক বছর আবদারে
প্রয়োজন ফুরালে স্ক্রাপ ভ্যালু সংস্কারে আসে
নতুন জায়গা ঝাঁটার মুখে পরিচ্ছন্ন ইতিহাস
প্রস্থান
রাহাত রাব্বানী
তুমি চলে গেলে-
কবিতারা শিখে নিলো আত্মহত্যার সূক্ষ্ম নিয়ম
খসে গেলো আমাদের প্রিয় নক্ষত্ররাজি
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভুলে গেলো শরত বন্দনা।
তুমি চলে গেলে-
বেহুঁশ প্রেমিক ভুলে গেলো দ্রুততা।
যানজট মুক্ত হলো আবেগের শহর।
তুমি চলে গেলে-
বেড়ে গেলো সূর্যের পরমায়ু।
তুমি চলে গেলে; তোমার চলে যাওয়ার পর-
এ পৃথিবীর সব ‘চলে যাওয়া’ থেমে গেলো।
দূরত্ব জানে কতোটা নিকটে এসেছিলাম।
ভবে নাহি সৎ-বাবা
শাহাব উদ্দিন ভূঁইয়া জয়
শ্রেষ্ঠ সুখ নিতে গিয়ে স্পর্শ করেছো
কোমলময়ী নারী,
যে সুখ নিতে ছাড়িয়াছো
গঞ্জ-শহর কিংবা বাড়ি।
একফোঁটা নাপাকীয় জলে
ভবে এনেছো শিশু নবজাতক,
সুখ কিনতে গিয়ে জন্ম দিলে
তবে এখন কেনো পলাতক।
স্বর্গসুখ নিতে খুঁজেছ ঝিকিমিকি আলো
খুঁজেছ গভীর অন্ধকার,
নবজাতকের চিৎকার শুনেনি কেহ
নবজাতক শিশুটি কাহার।
বড্ড মানুষ আজব সমাজে
অনেকের আছেএ স্বভাব,
নবজাতকের ভার নিবে কে?
এমন সৎ-বাবা খুবি অভাব।
পদাবলি : ০৪
মানুষ বিষয়ক প্রস্তাবনা
জারিফ এ আলম
সুরের সাথে মিলিয়ে যেতে যেতে পাশ ফিরে ঘুমোয় ঔরশের সন্তান। আর তুমি জননী হবার ইচ্ছে নিয়ে ভীষণরকম আঁকড়ে থাকো। এ রকম প্রেমকাতর ইচ্ছে নিয়ে ঢেউ তুলে নেচে যায় পরিযায়ী সময়। কিসের অভিযোগে রাত ডেকে নেয় গোপন অভিসারে। চর্যার চঞ্চল হরিণীর মতো দাপিয়ে বেড়াও নিরাপদ বুকের আকাশজুড়ে। কখনো দুর্বৃত্তের মতো হরণ করে নিয়ে যাও মধ্যরাতের ভাবনাসকল। অর্ফিউস সুর তোলে বেদনার। অভিযোগ নেই বলে, হৃদয়ের পাশটাতে দখল নিয়েছো খুব সহজে। সকল অর্চনা শেষে মানুষ যখন তোমাতেই আসে ফিরে, তোমাকে পাবার প্রস্তাব ওঠে মানুষের ভিড়ে।
অদৃশ্য বার্তা
হাসান মাসুদ
যখন তোমার গুলিবিদ্ধ ঠোঁটে
রক্তের প্রবাহ বিছিয়ে দেয়
সবুজ রঙের গালিচা,
তখন তোমার সেই দেবীত্বটুকু
পাঠিয়ে দিও- উৎসুক কামনায়।
যখন তোমার মনের ভিতর
বেদনার ভায়োলেটে আড়ষ্ট সুর
বাজায় উচ্ছ্বল কাকাতুয়া,
তখন টেলিফোন বার্তায় পাঠিয়ে
দিও- দৃঢ় কামার্ত কন্ঠস্বর।
যখন প্রতিনিয়ত একটা অদৃশ্য
ছায়া তোমাকে আবিষ্ট করে রাখে
হলুদ রঙের বসন্তের মতো,
তখন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস পাঠিয়ে
দিও- বাতাসের ব্যাঞ্জনায়।
কেউ একজন
খায়রুল আলম রাজু
আমার মৃত্যু হোক, আমি না চাইলেও
কেউ একজন চায় আমার মৃত্যু হোক-
আমার আয়ু ফুরাবার আগেই।
আমি দুঃখের সাগরে নামতে না চাইলেও
কেউ একজন চায় আমি দুঃখী হই-
আমার চারপাশ, ঘিরে থাকুক তার অভিশাপ!
আমি কাঁদতে না চাইলেও
কেউ একজন চায় আমি আজীবন কাঁদি,
তার চাওয়া-পাওয়া আর প্রার্থনা জুড়ে;
শুধু এই আমির ধ্বংস...
আমার আষ্টেপৃষ্টে মৃত্যুর মিছিল,
আমার চারপাশ জুড়ে দুঃখের ঢেউ,
আমার চোখের পাতায় টলোমলো জল,
আমার জীবন জুড়ে কতোই না আঁধার...
পৃথিবী এভাবে ঘুমাক
নূরনবী সোহাগ
বাসরপালঙ্কে ক্ষুধার্ত আঙ্গুল
খাঁজে খাঁজে ছুটে বেড়ায়
ধাওয়া খাওয়া হরিণের মতো
ঘামের প্রলাপে
মোহ বাড়ে
অবোধ, সাঁজে শ্রেষ্ঠ উন্মাদ
শীতরাতে ঢুকে যায় শরীর
গ্রীষ্মের উত্তাপ ভুলে
আলো নিভে যায়
রঙিন স্বর্গ জ্বেলে
দূরত্ব নিয়ে যায় নিজস্বতা
অংশ অংশ তুলে দেয় স্বইচ্ছায়
যা কিছু একান্ত
শরীরের ফ্রেমে শরীর পুঁতেছে রাত
আলোকে ডেকো না
পৃথিবী এভাবে ঘুমাক
না বলা কষ্টগুলো
সাহিদা সাম্য লীনা
তোমার মনের পাসওয়ার্ড টা দাও,
এতো লজ্জা কিসের?
তোমার কথা অনেকে বলে,
তুমি ঘাড় তেড়া, রাগি
আমার একটুকুও বিশ্বাস হয় না।
আমার সাথে কেমন সুন্দর করে
কথা বলো, কতো উপদেশ
আমার নিজের প্রতি যতœশীল হতে বলো
আরো কতো কি!
ব্যস্ততা কমাতে, কাজ কমাতে।
তুমি আমায় নিয়ে এতো ভাবো!
আমার লেখার প্রশংসা!
মনের যে আরো কিছু কথা তোমার
তা তো বলনা, এতো দ্বিধা কেন?
জান, আমি অপেক্ষায় সেসব শোনার!
তোমার পাসওয়ার্ড পেলে
আমি নিজেই খুঁজে নিতাম তোমার না বলা কষ্টগুলো।
পদাবলি : ০৫
পোড়া হৃদয়ে প্রেম জাগাতে নেই
রায়হান কিবরিয়া রাজু
ভুলে যেতে পারিনি আমিও।
ব্যথার জোয়ার চলছে দিনরাত,
বুক জুড়ে প্রেমিক আত্মার আত্মচিৎকার
যদিও কথা, হাসি, আড্ডার সেই লাল-নীল দিনগুলি
রংহীন বিবর্ণ ডায়েরিতে বন্ধি করিনি কখনও
কখনও মনে হয় নি তোমাকে বিরহ বাসরে বসাবো
অশ্রুর ঝরে পড়া নিঃশ্বব্দে পুরোনো আমিকে
খোঁজার বিন্দু মাত্র প্রয়াস ছিল না আমার।
অথচ আজ তুমিহীন নিঃসঙ্গতা বারবার নিয়ে যায় কল্পরাজ্যে
ধোয়াসায় ভরে যায় পৃথিবী
ভীষণ অন্যরকম হয়ে যাই আমি, ভীষণ অন্যরকম।
জানি তুমিও ভীষণ অন্যরকম হয়ে যাও
চোখ ফেটে তোমারও বেরিয়ে আসে জল
সেই মানুষটার ভীড়ে আমাকেও খুঁজতে চেষ্টা করো নির্বিকায়
শরীরের তাপে আমার নামেই বজ্র নেমে আসে তোমার হৃদয়ে
অথচ সেই তুমি জানো পোড়া হৃদয়ে প্রেম জাগাতে নেই।
মাদকতার মিছিল
রুহুল আমিন রাকিব
অবশেষে তুমি এলে, শরৎ রাতের জোছনা স্নানে;
তোমার আগমনে শিউলি বকুলের কী যে লজ্জা!
বুক এপিটাফকে যেন ষ্ট্রিম রোলার চাপিয়ে দিল।
আমার নিশ্বাস যেন গরম বীণ; তোমার ছোঁয়া পেয়ে!
মুহুর্তে নিজেকে আবিস্কার করলাম, তোমার খাঁজ-কাটা দেহর ভাজে।
আমার মৃত্যু প্রায় দেহ অবয়ব জুড়ে,
ঢেউ খেলতে শুরু করল একশ চার ডিগ্রির অধিক জ্বর।
আজ কত বছর পরে, নেতিয়ে পড়া শরীর জুড়ে খেলা করল মাদকতার মিছিল!
কিছু সময়ের জন্য আমি যেন স্বর্গিও সুখে আবদ্ধ ছিলাম।
অতঃপর নেশা কেটে গেলে, তোমাকে আবিস্কার করলাম অচল পয়সার মতো।
হে মানবী তুমি ভুলে যেওনা, পুরুষ মানেই খাঁজ-কাটা দেহর বিভোর।
নিওরের টিপ
দ্বীপ সরকার
আকাশ পেখম মেললে- পৃথিবীও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে
ছায়াঘেরা কুয়াশার চোখ ফোটে, দূর্বাঘাসের কি যে উল্লাস!
কাশবনে মেঘসমূহের দরদ ভরা হাসি-
কুকুরে কুকুরে ইশারার ঝর- অদ্ভূদ সঙ্গমের দিন ওদের
অতঃপর প্রযতেœর জোসনাসমূহ
কুয়াশার খাম থেকে বেরিয়ে আসে
খিল খিল করে হাসে জানলার কার্টেইনের কাছে
এ কারণেই শরতকে বলি- আসো ফিরে ফিরে
বহকাল ঘুরে ঘুরে ফের আসো
পৃথিবী সমর্পিত হলে- পলাতক শীতও আসে দেশে ফিরে
কুহুক জড়ানো গোধূলীরা ডুবে যাচ্ছে যাক একখন্ড ‘নিওরের টিপ’ নিয়ে
পরের সকালে খোঁপায় বেঁধে মুদ্রিত হয় নতুন করে
প্রাণোচ্ছল
কাজী মারুফ
হৃদয়ের সবটুকু আবেগ আপ্লুত অনুভূতি দিয়ে,
নিপুণ কারুকাজের সংমিশ্রণে
পঙ্তিগুলো গেঁথেছি মনের পাতায়।
শ্বাস-প্রশ্বাস যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে
ক্ষত-বিক্ষত করেছে হৃদয়।
বিষাদের নোনাজলে ভিজে যায় আঁখিদুটি,
মন পিঞ্জিরার পোষাপাখিটা করছে ছোটাছুটি
উড়ে যেতে চায় দূর অজানায়।
তবুও থেমে নেই ক্লান্ত পথিক
ধীরেধীরে চলছে সম্মুখ পানে-
বুকের গহীনের লালিত জমানো কথামালা,
অনায়াসে ভেসে বেড়ায় স্মৃতির আঙিনায়।
শূণ্যতা করে হাহাকার!
অতীতের দুঃস্বপ্নগুলো অস্থির করে তোলে
চলার পথ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আকস্মিক বন্ধ হয়ে যায় লেখনীর পাতা
হাতটা শক্তিহীন হয়ে ঢলে পড়ে যায়।
স্তব্ধ হয় কলমের শক্তি
হারিয়ে যায় মহামূল্যবান সময়!
বিরামহীন চলছে ক্ষণিকের জয়োল্লাস!
পুনরায় আবার চেষ্টা,
এ চেষ্টা যেন তেজস্বী, প্রাণপণ লড়াইয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
এই সংগ্রামে নেই কোন সংশয়, দুঃশ্চিন্তা, পরাজয়ের ভয়,
নেই অস্থিরতা, অপুষ্পক হা-হুতাস,
ইচ্ছেশক্তি, আদর্শ আর সততায় কভু হয়না কেহ পরাজয়।
দুর্গম কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে বহুদূর,
এর পরই তো রয়েছে কাঙ্খিত মঞ্জিল,
যেখানে থাকবে না কোলাহল, আক্রোশ, স্বার্থের কুপোকাত,
প্রাণবন্ত সজীব নিঃশ্বাসে শীতল হবে প্রাণ
শান্তিময় হবে তামাম ধরণী।
স্বাধীনতার উদীয়মান সূর্যটা প্রোজ্জ্বল হয়ে বিলাবে আলো অজ¯্র ধারায়।
তুমি আসলেই ছদ্মনাম
শেখ আশরাফুল ইসলাম
তুমি এমন হয়েছো যে, আমার কথা শুনতে নারাজ
কেন হয়েছে এমন, বলতে আমি পারছি না ওগো সুরাজ!
তোমার নাম টা যেন একটু ভিন্ন তাই না?
তবুও কেন সরাসরি বলো না, তোমাকে আমি চাই না!
আমার ভালবাসার কথা গুলোকে,
ব্লাকহোলের মত পাঠিয়ে দাও তোমার অন্তর গহিনে!
সেই কথা গুলো আর্তনাদেই ডুবে মরে ব্লাকহোলে গহিনে।
তোমাকে মিথ্যাবাদী ও বলা যায় না,
যা বলো সত্য, না বললে নয়।
এটি আসলে কি করে হয়!
তুমি নিজেকে আড়াল করতে জানো বটে,
তুমি চিন্তায় ও থাকো, তোমার কখন কি রটে।
তুমি সূর্য থেকে ত্যাজ নাও ঠিকি,
আমি তা বারে বারে দেখি।
তুমি এক আসলেই ছদ্মনাম,
তুমি আসলে কে আমি যদি যানতাম!
ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : পর্ব ০৪
অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ
[গত সংখ্যার পর]
৭.
ক্লাশ শেষ। সবাই বই-খাতা গুটিয়ে ব্যাগে ভরছে। তখন তূর্য বলল, তুমি একটু বসো।
তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নিশ্চয় কোনো ভুল-চুক হয়ে গেছে। নির্ঘাত এবার বকা খেতে হবে। তূর্য স্যার মিষ্টি মিষ্টি ভাষায় কি যে কঠিন বকা দেয়! যাকে বলে মিশ্রির ছুরি। সেদিন ফয়সালকে মিশ্রির ছুরি বিঁধিয়ে দিলো না? শুধু আমার ব্যাগ টান দিয়ে বলেছিল, তোমার সেলফোনটা একটু দাও তো। আর অমনি শুরু করে দিলেন, এ্যাই ছেলে, তুমি ক্লাশের মধ্যে ওর ব্যাগ টানাটানি করছো কেন? বেশি বড় হয়ে গেছো না? এটা ইউনিভার্সিটি না। মনে রাখবে স্কুলে পড়ো। তুমি আর কখনো ওর আশেপাশের বেঞ্চিতে বসবে না। পাকামো আমি একদম পছন্দ করি না।
কিন্তু আজ ভুলটা কি হলো সে তা বুঝতে পারছে না। আজ তো তূর্য স্যার ক্লাশে কোনো পড়া ধরেন নাই। শুধু এ্যাকটিভ টু প্যাসিভ ভয়েস এর রুল লিখে দিয়েছেন। তাহলে ?
সে ফ্যাকাশে মুখে বসে রইল। সবাই একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্লাশ থেকে। সবাই বেরিয়ে গেলে সে ক্লাশে একা। না, ঠিক একা নয়। সে আর তূর্য। তূর্য একটু এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে ঠিক তার মুখোমুখি বসল। সে কোনো কথা বলছিল না কিছুক্ষণ। তাকিয়ে ছিল নিচের দিকে। পাখার বাতাসে তার লম্বা চুলগুলো উড়ছিল। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিন্দু বিন্দু ঘাম নাকের ডগায়। সে ঘাম দেখে তূর্য স্যারের আবৃত্তি করা একটা কবিতার লাইন মনে পড়ল-নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে টুকু দি বলেছিল/দেখিস, তোর বউ তোকে খুব ভালোবাসবে।
ছেলেদের নাক ঘামলে নাকি বউরা খুব ভালোবাসে। তূর্য স্যারকেও নিশ্চয় তার বউ অনেক ভালোবাসবে। সে গোপনে তূর্যের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন তার কাছে তূর্যকে আগের যে কোনো দিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিল।
বেশ একটু সময় পেরিয়ে যাবার পর তূর্য মাথা তুলে বলল, আচ্ছা, তোমার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে ?
তার মুখ এবার একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল-রক্তশূন্য প্রায়। তূর্য একদিন ক্লাশে বলেছিল, চোখের দিকে তাকিয়ে সে ছাত্র-ছাত্রীদের মনের ভাষা বুঝতে পারে। তা না বুঝলে সে পড়াবে কেমন করে?
নিলয়ের সাথে যে তার ঘনিষ্টতা, অনেকটা প্রেম-প্রেমের ব্যাপার তা বোধহয় সে বুঝে ফেলেছে। অবশ্য নিলয়কে তো সে এখন অতোটা ভাবে না, যতটা ভাবে তূর্যকে। তাহলে কী বুঝলো সে? পরীক্ষার আগে প্রেম-টেম অবশ্যই লেখাপড়ার ক্ষতি সৃষ্টি করে। সে তবু কথাটা গোপন রেখে বলল, জি না স্যার, আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।
তাই বলো। শোন, রাখ-ঢাক না করেই বলছি-প্রথম দেখায়ই তোমাকে আমার ভাল লেগে যায়। প্রতিটি মুহূর্তে আমার সে ভাল লাগা বাড়তেই থাকে। বলবো না, বলবো না করেও শেষ পর্যন্ত কথাটা তোমাকে না বলে পারলাম না। আমি যদি তোমার কাছে ভালোবাসার জন্য হাত প্রসারিত করি, তুমি কি আমার হাত ফিরিয়ে দেবে?
এবার তার ফ্যাকাশে মুখ রক্ত রঙিন হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে কাঁপন। সারা অস্তিত্বময় ছড়িয়ে পড়ল অসম্ভব এক ভাল লাগার অনুভূতি। যেন হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এরকম একটা অনুভূতির জন্য সে অপেক্ষা করছিল। সে সহসা মুখে কিছু বলতে পারছিল না।
তূর্য বলল, তোমার যদি আপত্তি থাকে......আমি জোর করছি না......তুমি ভেবে দেখো.....।
না না, সমস্যার কিছু নেই স্যার।
কাউকে ভাল লাগা নিশ্চয় অন্যায় কিছু নয় ?
অন্যায় হবে কেন ?
ভাল লাগা, ভালবাসা আছে বলেই তো পৃথিবীটা এত সুন্দর।
ঠিক তাই।
কখন যে কার, কাকে ভাল লেগে যাবে তা কেউ জানে না।
ঠিক তাই।
এতদিন ধরে পড়াচ্ছি, কত মেয়েকেই তো পড়ালাম, অথচ তোমাকে দেখেই......।
ঠিক আছে স্যার।
তাহলে তুমি আমাকে একসেপ্ট করছো?
কেন করবো না স্যার? আপনাকে একসেপ্ট না করার কোনো কারণ আছে বলুন? কিন্তু আমি কি আপনার যোগ্য? আপনি এত কিছু......।
এরকম কোনো কথা বলো না প্লিজ। পৃথিবীর সবাই সবার যোগ্য যদি হৃদয়ে নিখাদ ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসাই ভালোবাসার যোগ্য। অন্য কিছু দিয়ে ভালোবাসার যোগ্যতা মাপা ভুল।
আপনি অনেক সুন্দর কথা বলেন স্যার। ঠিক আছে, আসি স্যার।
বাসায় ফিরে তার মনে হতে লাগলো, কে যেন তার দুই হাতে অদৃশ্য দুটি পাখা লাগিয়ে দিয়েছে। সে এরুম থেকে ওরুমে উড়ে উড়ে চলছে যেন। অতি দুঃখে মানুষ খেতে পারে না। অতি সুখেও কি তাই হয়? কোচিং থেকে ফেরার পর তার কিছুই খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তূর্যের ভালোবাসা পাবার পর তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা যেন সব মিটে গেছে। জগতের সব চাওয়া-পাওয়াও যেন পূরণ হয়ে গেছে। সে যেন দিশেহারা। কি করবে, না করবে তা কিছুই বুঝতে পারছে না। একবার টিভি খুলে, আবার বন্ধ করে। সিডি প্লেয়ারে একটা গান চালু করে, গানটা এক লাইন বাজতে না বাজতেই বন্ধ করে দেয়। একটা বই চোখের সামনে খুলে ধরে, পর মুহূর্তেই বইটা ছুড়ে ফেলে দেয় খাটের উপর। রান্না ঘরে গিয়ে অকারণে কুলসুমকে ধাক্কা দিল। কুলসুমের হাত থেকে চামচ কেড়ে ভাজিতে নাড়া দিল। চুলার আগুন বাড়া-কমা করল কয়েক বার। কুলসুম বলল, কী করেন ? আগুন বাড়ান ক্যান ? পুইড়া যাইব তো!
পুড়–ক। পোড়া ভাজি খাব। পোড়া ভাজি খেয়েছিস কখনো ? দারুন টেস্ট! মিষ্টি আলু পোড়ার মতো লাগে।
তারপর সে গরম কড়াইতে হাত ছুইয়ে আগুনের ছ্যাঁকা খেয়ে কানের লতিতে হাত ছোঁয়াল। কুলসুম বলল, ছ্যাঁকা খাইছেন ?
কিসের ছ্যাঁকা ? আমাকে ছ্যাঁকা দেবে কে? আমার পেছনে ঘোরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছেলেরা। আমিই যাকে খুশি ছ্যাঁকা দিব।
আফা, আপনের কি হইছে কন দেহি? নিলয় ভাই আসবো?
ধ্যাত তোর নিলয় ভাই! ও একটা গেঁয়ো ভূত-খ্যাত। চলবা, করবা, ধরবা করে কথা বলে।
কুলসুম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার মুখে। একদিন সে নিলয়কে গেঁয়ো বলাতে রামঝারি খেয়েছিল।
তার উৎফুল্লতা বাবা-মা’র চোখও এড়ায় না। সন্ধ্যায় মা বলেন, পরীক্ষার তো আর বেশি দেরি নাই। তোমাকে খুব উৎফুল্ল লাগছে। যারা সারা বছর ঠিকমতো লেখাপড়া করে না, পরীক্ষা যত কাছে আসে তাদের উদ্বিগ্নতা তত বেড়ে যায়, তারা ভয়ে তত কুঁকড়ে যায়। আর যারা ঠিকমতো লেখাপড়া করে, পরীক্ষা যত কাছে আসে তাদের আনন্দ তত বেড়ে যায়। তোমাকে দেখেই সেটা বুঝতে পারছি। আমারও পরীক্ষার আগে এমনটিই হয়েছিল। আমার মতোই আমার মেয়েটা সারা বছর মন দিয়ে লেখাপড়া করেছে।
জি মা।
তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা। তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।
জি মা।
তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান।
জি মা।
আমরা জানি, তুমি আমাদের স্বপ্নকে পায়ে দলতে পারো না।
জি মা।
কী জি মা, জি মা করছো! এখানে কি জি মা বলা যায়?
রাতে বাবাও বললেন একই রকম কথা। সে বাবার কথার পৃষ্ঠেও কয়েক বার ‘জি বাবা’ বললো। আসলে সে বাস্তবিক কারও কথাই মন দিয়ে শোনেনি। তার মনের ভেতর হাজারটা প্রজাপতি হাজার রঙের পাখা মেলে দিয়েছে। হাজারটা পাখি হাজার সুরে গান গাইছে। কারো কথা কি শোনার মত অবস্থা মনের আছে?
রাত এগারোটা। ধরা যায় সে কিছুই খায়নি। তার কন্ঠ কেমন শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর পর সে এক ঢোক পানি খাচ্ছে। কুলসুম ভাত-তরকারি তার ঘরে রেখে গেছে। সেগুলো ঢাকা পড়ে আছে। খাবারে সে মন বসাতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কখন রাত শেষ হয়ে ভোর আসবে। ভোর শেষ হয়ে সকাল। নয়টা বাজলেই সে কোচিং-এ ছুটে যাবে। দশটায় তূর্য স্যারের ক্লাশ।
বেজে উঠল ফোন। অপরিচিত নাম্বার। সে ভুরু কুঁচকে তাকালো ফোনের দিকে। অপরিচিত কারও সাথে তার এখন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার সমস্ত অস্তিত্ব এখন শুধুই কথা বলছে তূর্যের সাথে। তবু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া-ধরি না। দেখি কে। অপ্রয়োজনীয় হলে কেটে দেব।
ফোন রিসিভ করতেই কর্ণ কুহুরকে অবশ করে দেবার মত সুন্দর একটা কন্ঠ, কেমন আছো তুমি ?
যেন এফএম রেডিওর লাভ গুরুর কন্ঠ! সে প্রথমটায় কিছু বলতে পারছিল না। কন্ঠটা আবার বলল, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না?
ঠিক.....মানে.....।
প্রতিদিন যার কথা শোন.....আশ্চার্য!
আপনি কি.......... ?
আচ্ছা, একটা কবিতা শোনাই, তারপর দেখ চেনা যায় কি না-ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে .........।
স্যার আপনি! আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায় ?
তোমার নাম্বার পাওয়া বুঝি খুব কঠিন? কোচিং-এ আর কাউকেই কি তুমি তোমার নাম্বার দাওনি?
তাই বলেন।
কী করছিলে? লেখাপড়া করছিলে?
হ্যাঁ, প্যারাগ্রাফ পড়ছিলাম-দ্যা মুন লিট নাইট।
ভেরি ইম্পর্টেন্ট ফর দিস ইয়ার। ডিসটার্ব করলাম তাহলে?
না না, কি যে বলেন স্যার! মুন লিট নাইট আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। এখন একটু রেস্ট নেবো ভাবছিলাম, আর তখন আপনি.....। স্যার, আপনি ফোন করেছেন, কি যে ভাল লাগছে! সত্যি আমি কল্পনাও করিনি যে......!
আজ সারাদিন শুধু তোমারই কথা মনে পড়ছিল। ফোন করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে করেই ফেললাম।
খুব ভাল করেছেন স্যার। আমি সন্ধ্যায়ই পড়তে বসি। এগারোটার মধ্যে আমার লোখাপড়া শেষ হয়ে যায়। এগারোটার পর আপনি প্রতি রাতেই ফোন করবেন। আপনি ফোন করলে আমি অনেক খুশি হব।
তুমি বলছো ?
জি স্যার, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি-আপনি আমাকে প্রতি রাতেই ফোন করবেন।
এর মধ্যে নিলয়ের ফোন ঢুকে গেল। তূর্যের ফোন গেল কেটে। বিরক্তিতে ভরে গেল তার মন। সে নিলয়ের ফোন কেটে দিয়ে আবার তূর্যকে ফোন করল। কিছুক্ষণ পর আবার নিলয়ের কল ঢুকে যায়। আবার কেটে যায় কল। আবার। আবার। আবার।
এভাবে কেটে কেটে তূর্যের সাথে রাত একটা পর্যন্ত কথা বলল সে। তার ভাল লাগার অনুভূতি অনুভবের সীমানা ছাড়িয়ে গেল। তূর্য স্যার আজই ভালোবাসার কথা বললেন, আর আজই ফোন নাম্বার যোগার করে কল করে ফেললেন! এমনটি যে সে ভাবতে পারেনি।
যখন সে এসব ভাবছিল ঠিক তখন আবার নিলয়ের কল এল। বিরক্তিতে ছেঁয়ে গেল তার মন। তবুও সে কল রিসিভ করল। নিলয় বলল, কী ব্যাপার ? এগারোটা থেকে ফন করছি আর ফোন রিসিভ করলে একটা দশে।
আপনি ফোন করছেন কেন ?
আশ্চর্য! প্রতিদিন কেন ফোন করি ? একদিন ফোন না করলে কেঁদেকেটে অস্থির হও-কাল ফোন করলেন না কেন? কাল ফোন করলেন না কেন? আর এখন কি বলছো তুমি?
আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না।
তুমি কি কিছু পান করেছো? টাল অবস্থায় আছো নাকি? আমাকে মনে হয় তুমি চিনতে পারছো না। আমি নিলয়। তোমার ভলোবাসা। লাভ। তোমাদের শহুরে আধুনিক ভাষায় যাকে বলে-বয়ফ্রেন্ড।
অতো পরিচয় দিতে হবে না। সত্যি বলতে কি, এখন আর আপনি আমার লাভার বা বয়ফ্রেন্ড কোনোটাই নন। এখন আপনি শুধুই আমার খালাতো ভাই।
যা বাব্বাহ! গত রাতেও না আই লাভ ইউ-আই লাভ ইউ করে মুখ দিয়ে ফেনা বের করে ফেললে।
গত রাত পাস্ট হয়ে গেছে। এখন যা বলছি তাই ঠিক। আজ থেকে আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না।
তুমি কি তাহলে নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ড পেয়েছো? কোচিং সেন্টারের অতি মেধাবী কোনো টিচার?
যদি মনে করেন তবে তাই।
তাই বলো! কোচিং সেন্টারে যাবা আর অতি মেধাবী টিচারের প্রেমে পড়বা না, তা কি করে হয়? আমাদের এই মফস্বল টাউনেই তো দেখি.......।
তিনি আপনাদের মফস্বল টাউনের টিচারদের মত না।
বুঝলাম, তিনি সুন্দর গান গাইতে পারেন-আমি যামিনী, তুমি শশী হে। আর সুনীলের সেই কবিতাটা নিশ্চয় সুন্দর আবৃত্তি করেন-ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেধেছি লাল কাপড়/বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি একশ’ আটটা নীল পদ্ম/তবু কথা রাখেনি বরুনা/সে এখন যে কোনো নারী/ তার বুকে এখন শুধুই মাংসের গন্ধ। আহারে! বরুনাদের জন্য ওরা সবাই এই কবিতাটা খুব ভাল করে শিখে রাখে। আচ্ছা, প্রথম যেদিন তার কন্ঠে এই কাবিতাটা শুনেছিলা সেদিন তোমার মনে কষ্ট বাজেনি? রাগ হয়নি বরুনার ওপর যে, কেন সে কথা রাখল না? এখন তো বুঝছো, বরুনারা সব এক। তুমিও বরুনা। বরুনার মতোই তুমিও এখন যে কোনো নারী। তোমার বুকেও এখন শুধুই মাংসের গন্ধ।
যাই বলেন, আপনি তার কাছে ত্যাজপাতা।
বরুনারা তো এমনই। তার জন্য যে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিলো, দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বাধল লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনলো ১০৮টা নীলপদ্ম। এক সময় বরুনা তাকে মনে করল ত্যাজপাতা। ত্যাজপাতা না কাঁঠাল পাতা তা আগেই বোঝা উচিত ছিল তোমার। আমি কিন্তু প্রথমেই বলেছিলাম-তোমার যদি ভাল না লাগে তো ডাইরেক্ট বলে দিবা, চলে যাব। আমি এক হাতে তালি বাজাতে চাই না। মানা করে দেবার পর ফ্যাচর ফ্যাচর করার ছেলে নিলয় না। কি বলি নাই? তখন তো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছো-কি যে বলেন নিলয় ভাই! আপনি কেন যোগ্য হবেন না? কেন আপনাকে ভাল লাগবে না? কি বলো নাই? তখন ত্যাজপাতার কথা মনে হয় নাই? মনে হয় নাই সামনে কাঁঠাল পাতাও আসতে পারে? ছাগলের কাছে তো ত্যাজপাতার চাইতে কাঁঠাল পাতাই বেশি প্রিয়।
আপনি আমাকে ছাগল বলছেন ?
তোমাকে ছাগল বলা ঠিক হবে না, বলতে হবে ছাগী-মহিলা ছাগল-বকরি।
যা খুশি বলেন, আমি এখন আর আপনাকে ভালোবাসি না। প্লিজ, আপনি আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করবেন না।
তুমি কি আমাকে মুরগির বিষ্ঠা মনে করেছো যে, কোঁদাল দিয়ে তুলে ছুড়ে ফেলে দিলাম? অতো সোজা না। আমি সেই বাপের ছেলে যে বাপ রিস্ক না নিয়ে কোনো কাজ করে না। আমি রিস্ক নিয়েই তোমাকে ভালোবেসেছি।
মানুষের ভাল লাগা, মন্দ লাগা পরিবর্তন হয়। সব সময় যে একজনকেই ভাল লাগবে তা হতে পারে না।
তুমি দেখছি দার্শনিক হয়ে গেছো। দার্শনিক ফরহাদ মজহার। নাম শুনেছো এই দার্শনিকের? সব সময় লুঙ্গি পরে থাকেন। একবার তিনি ঘোর নাস্তিক ছিলেন। তখন আল্লাকে তার ভাল লাগতো না-বিশ্বাস হতো না। আর এখন এমন ভাল লাগে, যাকে বলে জামাতি ভাল লাগা। জামাতি ভাল লাগা বোঝ?
আপনি নিজেকে আল্লার সাথে তুলনা করছেন?
তুমি দেখছি কাঁঠাল পাতা খাওয়ার শেষ ধাপে চলে গেছ। আমি নিজেকে কোনো তুলনা করি নাই। আমি তোমাকে ফরহাদ মজহারের সাথে তুলনা করছি। দর্শন কপচায়লা তো তাই।
আপনি আমার পথ থেকে সরে যাবেন, এটাই শেষ কথা। আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।
আমি তোমাকে তো বিরক্ত করবোই, তোমার বাপ-মা, তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠিরে বিরক্ত করবো। কোনো বকরি আমাকে ত্যাজপাতা ভেবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইবে তা আমি সহ্য করবো না। আমিও আবৃত্তি করতে পারি-
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেও নাকো তুমি,
বলোনাকো কথা অই ভন্ডের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রুপোলি আগুনভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে-আরো দূরে
ভন্ডের সাথে তুমি যেও নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে।
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজঃ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাসঃ
বাতাসের ওপাড়ে বাতাস
আকাশের ওপাড়ে আকাশ।
কার লেখা কবিতাটা?
তোমার নতুন ভাল লাগা পুরুষকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
কবি কি এখানে ভন্ড বলেছেন?
হ্যাঁ।
আমি বিশ্বাস করি না।
তোমার বিশ্বাস-অবিশ্বাস মাথায় নিয়ে কি জীবন বাবু কবিতা লিখেছেন ?
জীবন বাবু কে? এই নামে কোনো কবির কথা শুনিনি।
তুমি জীবনে কি যে শুনছো তা তো বুঝতেই পারছি। জীবন বাবু আমার আত্মীয়।
আত্মীয়!
হ্যাঁ, আত্মার আত্মীয়। আমার আত্মার কথাগুলো তিনি লিখে গেছেন।
ধ্যাৎ!
তারপর থেকে তার ২৪ ঘন্টার রুটিনটা এরকম-সন্ধ্যা থেকেই মনটা উড়– উড়–। মনের মধ্যে কেমন অস্থির অস্থির ভাব। সামনে বই খোলা। চোখ বইয়ে। কিন্তু মনের আয়নায় তূর্যের ছবি। বইয়ে কোনো পাঠ নেই। পাঠ হয় সে ছবিতে। ফোন কখন আসবে ? এলে কি কী বলবে। আগের দিন যা বলা হয়নি তা বলতে হবে। যা ভুল বলেছিল তা শুধরাতে হবে। এরকমই রিহার্সেল চলে।
পরীক্ষার চিন্তায়, লেখাপড়ার ধ্যানে মেয়ে যে ধ্যানমগ্ন। ডাকলে সাড়া দেয় না। জোরে ডাকলে চমকে ওঠে। খাবারে আগ্রহ নেই। দুঃশ্চিন্তার কথা মা জানান বাবাকে।
দু’জন মিলে মেয়েকে বোঝান-মাগো, তুমি তো শুরু থেকেই মনোযোগি ছাত্রী। কখনো অকারণে সময় নষ্ট করো নাই। তাহলে এত চিন্তার কি আছে? এখন এতটা পড়ার কোনো দরকার নাই। সব দুঃচিন্তা ঝেড়ে ফেলো। স্বাভাবিক পড়াটা পড়ে যাও। অহেতুক রাত জাগার দরকার নাই। ঠিকমতো খাও, ঘুমাও, স্বাস্থ্য ঠিক রাখো। শরীর ভাল থাকলে মনও ভাল থাকবে। রিমেম্বার-হেলথ ইজ ওয়েলথ। বডি ইজ রিলেটড উইখ মাইন্ড। সাউন্ড বডি মিনস সাউন্ড মাইন্ড।
রাত এগারোটার সময়ই সে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আর তখনই তূর্যের ফোন আসে। রাত ১/২টা পর্যন্ত চলে প্রেমালাপ। তারপর ৩/৪টা পর্যন্ত নিলয়ের সাথে ঝগড়া। রাতের রুটিন মূলত এটাই।
সকালে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে নয়টা কি সারে নয়টা। তারপর সাজগোজ করে কোচিং-এর দিকে ছুট। আগে সাজগোজের ব্যাপারটা তেমন ছিল না। তূর্যের সাথে সম্পর্ক হবার পর সাজগোজের ব্যাপারটা বেড়ে গেছে। সে কেমন সাজ পছন্দ করে, কোন পোশাকটা তার ভাল লাগে এ ব্যাপারটা মাথায় রেখেই ঘর থেকে বের হতে হয়।
আগে ক্লাশে পড়াশোনায় কম-বেশি মন দেবার একটা ব্যাপার ছিল। এখন সেটার বালাই নেই। কেচিং-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিচার এখন তার বয়ফ্রেন্ড। সে আর কাউকে পরোয়া করে না। প্রায়ই পেছনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে নীল ছবি দেখে। ব্যাপারটা অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে। নিলয় বলেছিল-তুমি তো কুয়ার ব্যাঙ। আজকাল সেভেন/এইটের পোলাপানের মোবাইলেও এসব থাকে। কোচিং-এ আসার পর সে কথাটার সত্যতা পেয়েছে। অনেকের সেলফোনেই এসব আছে। কোচিং-এ এসে সে ইন্টারনেটের প্যাকেজ নেয়া আর ডাউনলোড করাও শিখে গেছে। তবে ডাউনলোড সে কম করে। ক্লাশ চলাকালীন সে অন্যের সেলফোন থেকে নিজের মোবাইলে এসব শেয়ার করে নেয়। যার কাছ থেকে শেয়ার করবে সে তার পাশে বসে। দু’জনের পায়ের ফাঁকে নামানো থাকে দু’টো ফোন। তার ফোন মেমোরিতে আসতে থাকে নীল ছবিগুলো। শুধু কিছুক্ষণ পর পর একজন সেন্ড বাটন আর আরেকজন রিসিভ বাটনে চাপ দেয়।
বারোটার পর সে আর কোনো ক্লাশ করে না। বারোটার পর সে ঘুরতে বের হয় তূর্যের সাথে। হ্যাঁ, প্রায় প্রতি দিনই। চারটা/সারে চারটা পর্যন্ত তারা এক সাথে থাকে। খায়। গল্প করে। হাসে। ঢাকা শহরে ঘোরার মত কোনো স্থান তার বাদ নেই। কোথায় বলদা গার্ডেন, কোথায় বোটানিক্যাল গার্ডেন, কোথায় লালবাগ কেল্লা, কোথায় আহসান মঞ্জিল, কোথায় তামান্না স্পট, টিএসসি, কলাভবন, চারুকলা, পাবলিক লাইব্রেরী সব তার নখদর্পনে। আর চাইনিজ, ফাস্টফুডের ব্যাপারটাও এরকমই। কোন রেস্টুরেন্টের কোন খাবারটার দাম কত, কোন রেস্টুরেন্টের কোন খাবারটা অধিক সুস্বাদু তাও তার মুখস্থ। বেড়ানো আর চাইনিজ, ফাস্টফুড খাওয়াটা তার নেশার মধ্যে চলে এসেছে।
আর নেশার মধ্যে এসেছে তূর্যের স্পর্শ। বেড়ানো, আর খাবার ছাড়া যেমন একদিন ভাল লাগে না, তেমন একটা দিন ভাল লাগে না তূর্যের স্পর্শ ছাড়া। ওর স্পর্শের মধ্যে একটা মাদকতা আছে। নিলয়ের স্পর্শ ছিল অনেকটা বল প্রয়োগের মতো। পেশি বহুল শরীরে ঝাপটে ধরা, পিশে ফেলার মতো অবস্থা। আর তূর্যের স্পর্শ মানে আলতো ছোঁয়া। খুব আলতোভাবে হাত নেমে আসে শরীরে। প্রথমে মুখে, তারপর গলার কাছে, তারপর......। শিরশির করে সারা শরীরে অনুভূতিটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অনেক সময় শরীরের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে। ঠোঁট ফুলে যায়। শরীর জেগে উঠে ভীষণভাবে।
আর ওর চুমুর ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন রকম। আলতোভাবে ওর ঠোঁট নেমে আসে ঠোঁটের উপর। তারপর আস্তে আস্তে একেবারে মিশে যায় চারটি ঠোঁট। দীর্ঘ সময়েও ভাল লাগা শেষ হয় না। অথচ নিলয়ের ব্যাপারটা এমন ছিল না। সে এমন ভাবে ঠোঁট জোড়া নিজের মুখের মধ্যে পুড়ে ফেলতো যেন কামড়ে ছিড়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ পর ব্যাথার অনুভব হতো।
তূর্য তাকে গল্প শোনায় ঢাকা শহরের আশে-পাশের দর্শনীয় জায়গাগুলোর। আমাদের প্রাচীন রাজধানীর কথা বলে। সেখানে বিরাট দিঘী আছে। সানবাঁধা ঘাট আছে। নৌকা করে পানিতে ভাসার সুযোগ আছে। শিল্পাচার্যের নিজ হাতে তৈরী লোকশিল্প যাদুঘর আছে। ফুলের বাগান, বৃক্ষের ছায়া, পাখির গান আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলে। সেখানে সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশ। শান্ত-নিরিবিলি। সাথে আছে লেক, বন-বনানী। শীতে লেক ভরে যায় অতিথী পাখিতে।
তারপর বলে গাজীপুরে একটা রিসোর্টের কথা। পানির ওপর ভাসমান রিসোর্ট। কাঠের পুল। পুরো লেক হেঁটে বেড়ানো যায়। বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে জলের ঢেউ দেখা। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে যাবে নিজের ছায়া। ইচ্ছে করলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যায়। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। সেখানে চাইলেই এক দিনের জন্য একটা রুম ভাড়া করা যায়।
শুনে শুনে তার মন আকুলি-বিকুলি করে। একটু দূরে যদি যাওয়া যেত! কিন্তু তা কি করে সম্ভব ? মা তো পাঁচটায় অফিস থেকে ফেরেন। পাঁচটার আগে বাসায় ফিরতেই হবে। কিন্তু ঢাকা শহরের একই জায়গায় বার বার যেতে ভাল লাগে না।
ভাবতে ভাবতে একদিন সে মরিয়া হয়ে তূর্যকে বলে, আচ্ছা, সকাল নয়/দশটার দিকে রওয়ানা হলে পাঁচটার আগে গাজীপুর থেকে ফিরে আসা যাবে না ?
ঠিক পাঁচটার আগে ফেরা বোধহয় সম্ভব হবে না। তবে সন্ধ্যার আগে ফেরা যাবে।
আচ্ছা, কিছু একটা বলে যদি মাকে ম্যানেজ করতে পারি?
সেটা তোমার ব্যাপার। কী বলবে?
বলবো-কোচিং-এ পরীক্ষা ছিল।
তুমি যদি ম্যানেজ করতে পারো তো আমার যেতে আপত্তি নেই।
সামান্য চিন্তা-ভাবনা করেই সে মাকে ম্যানেজ করার পথ বের করে ফেললো। যথাদিনের আগের দিন মাকে বলল, কাল কোচিং-এ আমার দুইটা এক্সাম আছে।
কখন ?
একটা নয়টা থেকে বারোটা, আরেকটা তিনটা থেকে ছয়টা।
মাঝে এতখানি গ্যাপ?
তখন ক্লাশ হবে।
কোন কোন সাবজেক্টের এক্সাম?
ইংলিশ সেকেন্ড পেপার আর জেনারেল ম্যাথ।
টাফ পেপারস। কোচিং-এ বেশ চাপ দিচ্ছে মনে হয়। লাঞ্চ কোথায় করবে?
কেচিং-এর পাশে ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। টিচারদের টাকা দিলে পিয়ন দিয়ে খাবার আনিয়ে দেন।
তাহলে তো ভালই। তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাখো।
কাল সকালে নেব।
সকালে মনে থাকবে না। তুমি ইদানিং যে মনভুলো হয়ে গেছো-এখনই নিয়ে রাখো।
সবচেয়ে বড় সুবিধা কোচিং-এ ভর্তি হবার পর থেকে কুলসুম তার সাথে থাকে না। এখন সে আর ছোট্টটি নয়। সাথে কাউকে রাখার কোনো দরকার নেই-এমনটি সে বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়।
[চলবে...]
ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৪
ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন
[গত সংখ্যার পর]
সকালে নীলা এলো। আমাকে বিমর্ষ দেখে কারণ জানতে চাইল। গতরাতের ঘটনাটা ওকে বিস্তারিত খুলে বললাম। বলতে বলতে আমরা চা-নাস্তাও খেলাম। আজ মিজান মিয়া এসেছে সকাল সাড়ে ন’টার দিকে। আমাকে ঘুমুতে দেখে জাগিয়ে দেয়। দোতলায় গিয়ে দুটো তালা দরোজায় ঝুলতে দেখি। মিজান মিয়াকে নিয়ে উপরতলার পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কারোর অস্তিত্ব সেখানে নেই।
নীলা সবকথা শুনে বলল, তুমি একটা হাত দেখেছ। অথচ কোনো মানুষ দেখোনি। সে হাত টেবিলের উপর থেকে ডায়েরিটা তুলে নিলো, তারপর উধাও! কিভাবে পসিবল? যদি তোমার কথা বিশ্বাস করে ধরে নিই, তুমি যা দেখেছ, ঠিকই দেখেছ। কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য কিভাবে?
নীলা, এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা আসছে না। যা ঘটেছে তাই তোমাকে বললাম।
নীলা কিছুটা সময় চুপচাপ ভাবল।
সোম, ধরে নিচ্ছি যা ঘটেছে সবই সত্যি। কিন্তু কেন এমনটি ঘটল? কী এমন কারণ লুকিয়ে রয়েছে এর পেছনে?
নীলার প্রশ্নের জবাবে বললাম, আমি মিজান মিয়াকে কিছুটা সন্দেহ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, মূল্যবান কিছু খোঁজার জন্য হয়তো সে এ কাজ করতে পারে। কিন্তু ওর দ্বারা এসব সম্ভব বলে মনে হয় না। যে ঘরে এসেছিল সে মিজান মিয়া নয়, কিংবা ভুতুড়ে ঘটনা নয়।
এই পুরনো ঘরে অন্য কেউ কী উদ্দেশ্যে হানা দিতে পারে?
জানি না নীলা। তবে হতে পারে মূল্যবান কিছু খোঁজতে এসেছে।
মূল্যবান কী জিনিস আছে সে ঘরে?
ঘরে আসবাব পত্র বলতে কতগুলো আলমারি। পুরনো একটা খাট, শোকেস, চেয়ার-টেবিল। আলমারিতে পুরনো বই, খাতা আর ডায়েরি। মূল্যবান কী আছে জানি না।
আচ্ছা, যে ডায়েরিটা গতরাতে ফিরে এল, সেটি তুমি ভালভাবে দেখেছ?
আলমারির তাকে সাজানো দেখেছি, হাতে নিয়ে খুলে দেখিনি।
নীলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ব্যাপারটা ভারি ইন্টারেস্টিং। মনে হয়, কেউ পড়ার উদ্দেশ্যে ডায়েরি চুরি করে নিয়ে যায়। আবার চুপি চুপি ফেরত দেয়। তোমার দাদাজানের ডায়েরিগুলো তুমি পড়ে দেখেছ?
না। এলাম তো মাত্র কদিন হলো, তবে ইচ্ছে আছে পড়ব।
দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই নীলা একগ্লাস পানি পান করল। আমি আগ্রহ ভরে তাকে বললাম, তুমি ডায়েরিগুলো দেখবে?
নীলা হাসল, ওর প্রসারিত ঠোঁটে একরাশ সজীবতা, ঘাসের ডগার শিশিরের মতো একবিন্দু পানি জমে আছে।
নীলাকে নিয়ে দাদাজানের ঘরে গেলাম। আলমারিগুলো সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ১৯৩১ সালের ডায়েরিটা খুলে প্রথম পৃষ্ঠা পড়তে লাগল। আমাকে শুনিয়ে নীলা পড়ছে,
“মেঘাদ্রি, আজ তুমি অমর্ত্যলোকের অধিবাসী। ধূলির ধরাতে আমি তোমাকে ভুলে দিব্যি বেঁচে আছি। অথচ কতবার বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।.... মিথ্যে বলেছিলাম। সে মিথ্যেকে কেন্দ্র করে আমি এখন ক্রমশ আবর্তিত হচ্ছি। জানি না, এ বৃত্তের পরিধি পেরুতে পারব কিনা। কখনো কখনো ইচ্ছে করে, মহাব্যাস অতিক্রম করে পরিধির ওপাড়ে চলে যাই। সেখানে কি তুমি?”
নীলা থেমে বলল, তোমার দাদাজান কবিতা লিখত? মেঘাদ্রি নামে কাউকে ভালবাসত?
দাদাজান কবিতা লিখত না, তিনি গণিতবিদ ছিলেন। সেটা তো তুমি জানো। কাউকে ভালবাসত কিনা সেটা আমি জানব কী করে?
হুম।
নীলা একটা নিশ্বাস ফেলে ডায়েরির পাতা উল্টে অন্য একটি পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করল।
“মনে পড়ে প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিত স¤প্রদায়ের কথা? যাঁরা পৃথিবীর বুকে গণিতের অভিষেক ঘটিয়েছিল।
সাবধান! অকৃতজ্ঞ মানব সমাজ ওদের ভুলে যেও না। তোমাদের মস্তিষ্ক বরাবরই বিস্মৃতির দুষ্টচক্রে ঘূর্ণায়মান। ভুলে যাওয়া, এ গ্রহের সর্বাধিক উন্নত প্রাণী মানুষের নিজস্ব স্বভাব। তোমরা ইচ্ছে করলেও এ স্বভাবকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। তবু বলছি ভুলে যেও না।”
নীলা অন্য একটি ডায়েরি হাতে নিলো। সেটা ১৯৫৫ সালের।
“এই পৃথিবীর প্রতিটি ঘটনা বা রাশি এক একটা রহস্য সমীকরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটি রাশির পরিবর্তন সাপেক্ষে অন্য একটি রাশি কেন কিরূপ পরিবর্তিত হয়, তা নির্ণয় করার একটা তীব্র প্রেষণা আমাকে প্রতিনিয়ত টোকা দেয়। সেগুলোর গাণিতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব হলে, মহাবিশ্বের মহাগোপন তত্ত্ব উদঘাটন সম্ভব হতো। আমার কল্পিত কিছু সমীকরণ নিচে উল্লেখ করলাম।”
নীলা গাণিতিক সমীকরণগুলো পড়েনি বা বুঝেনি। অন্য একটা পৃষ্ঠা পড়তে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। এবার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ওকে পড়ে শোনাব। তাই নিজেই একটি ডায়েরি তুলে নিলাম। সেটা ছিল ১৯৪৭ সালের ডায়েরি।
মাঝখান থেকে একটা পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরু করলাম।
সেখানে কয়েকটা গাণিতিক রাশির শেষাংশে ছোট করে বাংলায় লেখা “একটি ভুল তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভেঙে গেল মহাকালের একটি বৃহৎ রাশিমালা। বিভক্তির যুক্তিতে জন্ম নেয়া নবীন রাশিমালাদ্বয়ের সম্মিলিত সমীকরণ একটি ভুল সমান বা অসমান চিহ্নের দ্বারা আবদ্ধ। সমান চিহ্নের এ অযাচিত ব্যবহার উভয়পাশের রাশিমালার জন্য অসম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সূত্রপাত ঘটাবে। যা বরাবরই বিদ্বেষ দ্বারা আবৃত ও বিষাদগ্রস্ত ইতিহাসে মোড়া থাকবে।”
লেখাটা পড়ে আমি কিছুই বুঝলাম না। অপর একটি পৃষ্ঠা খুলে নীলার দিকে তাকিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম সে পাতায় একটি মাত্র বৃত্ত, সে বৃত্তের ভেতর অনেকগুলো পিঁপড়া আঁকা। কিছুই লেখা নেই। হতাশ হয়ে অন্যপৃষ্ঠায় গেলাম। সেখানে কতগুলো বিন্দুর সমাহার। সে বিন্দু গুলোর উপর হালকা কাঠপেন্সিলের ছোঁয়া। ভালভাবে খেয়াল করলে মনে হয় ছবির মতো কিছু। যেখানে কেউ তীর-ধনুক হাতে শিকারির ন্যায় প্রস্তুত।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে নীলা বলল, কী হলো থমকে গেলে কেন?
না, কিছুই না।
নীলা সর্বশেষ নিচের তাকের বামপাশের ডায়েরিটা তুলে নিলো। অর্থাৎ ২০০০ সালের ডায়েরি। বলল, এবার আমি পড়ছি, তুমি শুনো। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে সে পড়া শুরু করল।
“এ শতাব্দীকে আমি ছুঁতে পারব, তা কখনো কল্পনাও করিনি। অথচ দিব্যি বেঁচে আছি। কেউ আমাকে বাধাগ্রস্থ করতে চায়। থামিয়ে দিতে চায়, আমার গাণিতিক তপস্যা। প্রায়ই আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে সে অতিশক্তিমান শত্রুটি। আমি সম্পূর্ণ সন্দেহ মুক্ত সে এই পৃথিবীর কেউ না। সে ভিন্ন মাত্রার মহাজগত থেকে আসে।”
কতগুলো তারকা চিহ্নের পর তিনি লিখেছেন,
“আজ আমার এ বন্য বাড়িটি সোমকে উইল করে দিলাম। ফারদিনকে আমি পালিতপুত্র হিসেবে পরিচিত করে তুলেছি বটে, কিন্তু দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। ফারদিনের একমাত্র পুত্র সোমকে কোনোদিন স্বচক্ষে দেখিনি। জানি না, ছেলেটি কেমন মেধার অধিকারী হয়েছে।”
অনেকগুলো লাইন ডট চিহ্ন দিয়ে ভরা, নিচের অংশে সামান্য লেখা।
“ক’দিন পরেই আমি নব্বই বছর বয়সে পা দেবো, আমার গাণিতিক সমীকরণগুলো দায়িত্ববান কারোর হাতে সমর্পণ করে যেতে পারলাম না। “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা” আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিস্ময়। অথচ বহুবছর আগে অসম্পূর্ণভাবে ফর্মূলাটি সাজিয়েছি আমি নিজেই। এখনো শেষ পর্যায়ে যেতে পারিনি। যেভাবেই হোক আয়ু সমীকরণ শেষ প্রান্তে পৌঁছার আগে কাজটি সম্পন্ন করা চাই। কারণ এ ফর্মূলার সাথে সম্পর্কিত কতিপয় সমীকরণ রয়েছে। যাতে জড়িয়ে আছে, বহুমাত্রিক জগতের রহস্য। সমীকরণগুলোর সমাধান আবশ্যক।”
নীলার পড়া শুনে আমি অনেকটা বিস্মিত হলাম। দাদাজান আমার কথা যে তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন তা কেমন স্বপ্নের মতো লাগছিল। একটা ভালোলাগার অনুভূতিও তৈরি হলো। নীলা ডায়েরিটার অন্য একটি পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করল।
“কেউ আমাকে হত্যা করতে চায়। একটি অচেনা তরুণ রোজ রাতে আমাকে বিরক্ত করছে। নানা প্রশ্নের সম্মূখীন করে, আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ওকে আমি অবশ্যই শাস্তি দেবো।”
নীলা আমার দিকে তাকাল।
তোমার দাদাজান কিভাবে মারা যায়?
প্রশ্নটার সঠিক উত্তর আমার কাছে নেই। তুমি হয়তো জানো না দাদাজানের সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। এ বাড়িতেই উনি মারা গিয়েছেন, মিডিয়া বার্ধক্যজনিত কারণ উল্লেখ করে খবর প্রচার করেছে।
না, সোম। তোমার দাদাজানকে খুন করা হয়েছে। সেটা কী উদ্দেশ্যে করেছে তা আন্দাজ করা কঠিন। তবে এতটুকু বুঝা যায়, তাঁর গাণিতিক কাজ থামিয়ে দেবার জন্যই এমনটা হয়ে থাকতে পারে।
কী বলছ নীলা?
ডায়েরির লেখা তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সোম, তোমার উচিত সাবধানে থাকা। তোমার দাদাজানের ডায়েরির লেখাগুলো ভালোভাবে পড়া ও জানা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে আমরা বিস্ময়কর নতুন কোনো তথ্য পেতে পারি। “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা” তিনি হয়তো ব্যাখ্যাসহ সূত্রটির সমাধান কোথাও না কোথাও লিখে রেখেছেন।
আমি নীলার কথায় সায় দিলাম।
হতে পারে।
নীলা আমার কাছে এসে বলল, তুমি চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করব। ডায়েরি ও খাতাপত্রগুলো মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে।
ঠিক আছে নীলা।
নীলা চলে যাবার পর দীর্ঘ সময় ভাবনায় ডুবে রইলাম। আমার মধ্যে দাদাজানকে জানার প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো। আব্বুকে কল দিলাম, দাদাজান সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলাম। আব্বু জানাল, দাদাজান সম্পর্কিত তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাঁর কাছে নেই। তবে কেয়ারটেকার শাজান মিয়াকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কিছু না কিছু জানা যেতে পারে।
আব্বু আমাকে ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করলেও, আমি আপাতত ফিরব না জানিয়ে দিলাম। আব্বু বলল আম্মু আমার প্রতি রেগে আছে। তাছাড়া আম্মুর শরীরের অবস্থা ভাল নয়।
মিজান মিয়াকে ডাকলাম। সে তড়িধড়ি ছুটে এল। শাজান মিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই জানাল, তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায়। দাদাজান এখানে আসার কিছুদিন পর থেকে শাজান মিয়াই দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেছে। দাদাজানের মৃত্যুর একবছর পর, তিনি হঠাৎ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। শরীরে পক্ষাঘাতও দেখা দেয়। শাজান মিয়ার অসুস্থতার কারণে বাড়িটি দেখার দায়িত্ব মিজান মিয়ার উপর বর্তায়। বাড়িটিতে সে রাতে পাহারা দেয়, আর মাস শেষে আব্বুর পাঠানো টাকা ডাকে বেতন হিসেবে পেয়ে যায়। এভাবেই তার দিন কেটে যাচ্ছে।
মিজান মিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রূঢ়ভাবে বললাম, একটা সত্যি কথা বলবে, এ বাড়িতে তুমি ব্যতীত অন্য কেউ আসে?
স্যার, একি বলছেন। আর কে আসবে? মিজান মিয়া কাঁচুমাচু হয়ে বলল।
আমি সহজ হয়ে বললাম, গতরাতে কেউ এ বাড়িতে এসেছিল। উপরতলার ঘরে ঢুকে চেয়ার-টেবিল নাড়াচাড়ার মতো শব্দ করেছে। যা আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি।
মিজান মিয়া ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার এমন ঘটনা তো হরহামেশা ঘটে। প্রথম দিকে আমার ডর লাগত। যখন থেকে পাত্তা দেই না, তখন শব্দ শুনলেও না শোনার মতো থাইকা ঘুমাতাম।
তোমার বাবার সাথে একদিন দেখা করতে যাব।
আচ্ছা, স্যার। আমি আপনাকে নিয়া যাব।
আর শুনো, আমি উপরতলায় দাদাজানের ঘরে থাকব। বিছানা, বালিশ, চাদর সবকিছুর ব্যবস্থা করো। তুমি নিচের ঘরে থাকবে। তোমাকে দিন-রাত এখানে থাকবে হবে, বেতন বাড়িয়ে দেয়া হবে। তবে প্রয়োজন হলে যেকোন মুহূর্তে বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে পারবে।
দুপুরে ঘুমানোর আগে দাদাজানের সেই ডায়েরিটা হাতে নিলাম, ১৯৮৫ সালের। যা চুরি যাওয়ার পর ফিরে এসেছে। আর মিসিং হয়েছে ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটা। একটিবার মনে হলো, এ ডায়েরিটিও পড়া শেষে ফিরে আসবে, তারপর অন্য কোন ডায়েরিটি মিসিং হবে? ১৯৮৫ সালের পর ১৯৮৪ সালের ডায়েরি নিয়েছে, এবার নিশ্চয়ই ১৯৮৩ সালের ডায়েরি নিতে আসবে। দাদাজানের সবগুলো ডায়েরি দেখতে একই রকম, একই সাইজের। কিন্তু বিগত দু’রাতে টেবিলের উপরে দেখা সে ডায়েরিটা ছিল কিছুটা ছোট, ও ভিন্ন ধরনের। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আমি ডায়েরির পাতা খুললাম।
একি প্রথম পৃষ্ঠাটা ছেঁড়া। পরের পৃষ্ঠায় খ-িত লেখাটা পড়তে লাগলাম। সেখানে লেখা, “.......তবে তোমাদের জন্য একটি বিকল্প উপায় রয়েছে। তা হলো অন্তরপণ। নিত্যদিনের প্রতিটি বিষয় মানুষের মস্তিষ্কে নথি আকারে সঞ্চিত থাকে। মনে করো, গাণিতিক অঙ্ক ও প্রতীক চিহ্নের সম্পর্কে আবদ্ধ একেকটি স্নায়ু নথিকে স্মৃতিরাশি বলে। ধরা যাক, একটি নির্দিষ্ট পরিধির বৃত্তে একশোটি রাশি রয়েছে। এ রাশিগুলো আমাদের স্মৃতিময় ঘটনা। আবারো ধরা যাক, বৃত্তের ধারণ ক্ষমতা একহাজার স্মৃতিরাশি। প্রতিদিনই বৃত্তে রাশির সংখ্যা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে পুরো বৃত্ত বোঝাই হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিদিনের তথ্য-উপাত্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হতে থাকবেই, তখন বৃত্তের পুরনো রাশিগুলো সংকুচিত হয়ে বৃত্তের বাইরে ঠাঁই নেবে। সংকুচিত রাশিগুলো মিলে অন্য একটি বৃত্ত সৃষ্টিতে মন দেবে, সে বৃত্তে রাশিগুলো থাকবে সংক্ষিপ্ত ও ঘুমন্ত আকারে। এভাবে একের পর বৃত্ত সৃষ্টি হবে, সে বৃত্তগুলো একটির সাথে আরেকটি পরিধির বাহুবন্ধনে সংযুক্ত থাকবে। তখন ঐ সকল বৃত্ত স্প্রিংয়ের আকার ধারণ করবে। সে স্প্রিংয়ের সর্বনিম্নে অবস্থান করা বৃত্তটি আমাদের প্রথম স্মৃতিম-ল বা শৈশবের স্মৃতিরাশির সমাহার। আর সবচেয়ে উপরের বৃত্তটি নতুন বা চলিত বর্তমান সময়। যেখানে এই মুহূর্তের স্মৃতিটি ক্রমাগত সঞ্চিত হচ্ছে।
অন্তরপণ হচ্ছে ইচ্ছেমতো স্মৃতিরাশি বাছাই ও গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিরাশিকে সতেজ রাখার প্রক্রিয়া। প্রতিটি বৃত্তের রাশিগুলোর মধ্যে কোনোটি সজাগ সাবলীল সেগুলোকে বলে প্রসারিত রাশি। আবার কোনোটি ঘুমন্ত সংক্ষিপ্ত সেগুলোকে বলে সংকুচিত রাশি।
সংকুচিত রাশিকে প্রসারিত করার প্রক্রিয়াই অন্তরপণ।
তুমি তোমার পুরনো স্মৃতি থেকে একটি ঘটনা স্মরণ করে কিছুটা সময় এগোতে থাকো, ঘটনাটি পরিপূর্ণ রূপে তোমার কাছে স্পষ্ট আকার ধারণ করতে থাকবে। অর্থাৎ এ স্মৃতিরাশিটি প্রসারিত হচ্ছে। ঠিকই একই সময় ভিন্ন একটি ঘটনা বা স্মৃতিরাশি সংকুচিত হতে থাকবে। এর কারণ বৃত্তের সুনির্দিষ্ট পরিধি, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক স্মৃতিরাশি ঠাঁই পাবে। এবং রাশিসমূহের অবস্থানও (প্রসারিত, সংকুচিত প্রভৃতি) ধ্রুবক বা চলক।
এখানে দেখা যাচ্ছে, একটি রাশির হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে অন্য একটি রাশির ক্রম হ্রাসমান বা বর্ধমান সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। এখন বৃত্তটিকে যদি আমরা মহাবিশ্ব কল্পনা করি তাহলে কী দাঁড়াবে?
মহাবিশ্বের এক একটি ঘটনা বা রাশির সাথে অন্যান্য ঘটনা বা রাশির আপেক্ষিক সম্পর্ক জড়িত।
রাশি সমূহের এ রহস্যময় সম্পর্ককে সমীকরণ আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটি প্রামাণ্য রাশি বা ধ্রুবক রাশি ধরে নিতে হবে। আগের পৃষ্ঠাতে একটি গাণিতিক সমীকরণ চিত্রসহ রয়েছে। যেখানে ধ,ন,প,ফ....া বৃত্তসমূহের কেন্দ্র পরস্পর পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত। এর ফলে বৃত্তগুলো পরস্পরকে ছুঁয়ে গেছে বা ছেদ করেছে।”
আমি আগের পৃষ্ঠা খুলে দেখলাম, সে পৃষ্ঠাটি ছেঁড়া। বুঝতে বাকি রইল না, অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত সে চিত্র, ব্যাখ্যার প্রথমাংশ ও গাণিতিক সমীকরণ সম্বলিত পৃষ্ঠাটি ছিঁড়ে ফেলেছে। যার ফলে আমার পড়া অংশটুকু খ-িত আকারে প্রকাশ পেয়েছে।
রাত দুটো।
আমি দাদাজানের ঘরে চেয়ারে বসা। ১৯৩৪ সালের ডায়েরিটা পড়ছি। গত ছয়রাত ধরে এ ঘরেই রাত যাপন করে আসছি। নীলা প্রতিদিন ভোরে এখানে আসে। ঘণ্টা তিনেক আমার সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে যায় গেস্ট হাউজে। যতক্ষণ এখানে থাকে ততক্ষণই সে দাদাজানের ডায়েরি পড়তে ব্যস্ত থাকে। নীলাকে ফিরে পেয়ে আমি এক নতুন ভুবনের খোঁজ পেয়েছি। যেখানে আমি পথহীন পথিক, এক অজানা মরুভূমির যাযাবর, হেসে খেলে বসে বা দাঁড়িয়ে কেবল খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর মেঘ গুনছি, আর মেঘ গুনছি। মেঘের সে হিসেব জমা দিচ্ছি নীলার কাছে। কল্পিত সে মেঘগুলো হলো দাদাজানের লেখা গাণিতিক সমীকরণ, ডায়েরি থেকে খুঁজে বের করে নীলাকে দেখাচ্ছি। নীলা সমীকরণগুলো নোট আকারে ওর নতুন একটি ডায়েরিতে তুলে রাখছে। প্রতিদিনই আমরা দু’জন দুটো ডায়েরি নিয়ে বসি,পাতা উল্টিয়ে লেখাগুলোর মাঝে খোঁজে বেড়াই গাণিতিক রাশিমালা ও বিভিন্ন সমীকরণ। এভাবেই কাটছে আমার বনবাস দিনগুলো। এ কদিনে আমি এক অন্যরকম নীলাকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছি। আগে কখনো নীলার মধ্যে গণিত নিয়ে আগ্রহ দেখিনি, কলেজে সে চতুর্থ বিষয় হিসেবে নিয়েছিল কৃষিবিজ্ঞান। এছাড়া বিজ্ঞানের মধ্যে ওর আবশ্যিক বিষয় ছিল কেবল পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। আমরা কৃষিবিজ্ঞান অগ্রাহ্য করে গণিত নিলেও, সে গণিতকে ভয় পেয়ে বরাবরই দূরে থাকত। সেই নীলার মধ্যে গাণিতিক কৌতূহল ও প্রেম দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছি। ভালোলাগছে নীলার ভিন্নভাবে পাল্টে যাওয়া দেখে। তবে একটু অন্যরকম অবাক হচ্ছি, ওর মধ্যে অতীতের কোনো অভ্যাস, ভালোলাগা, মন্দলাগা, বিরক্তি, ঘৃণা কিছুই যেন নেই। সবকিছু ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেছে। সেখানে ডালপালা মেলেছে কেবল গাণিতিক আবহ। সবচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছি এই ভেবে, নীলা একটিবারের জন্য শশীর কথা বলেনি। সে মানসিক বিপর্যয় থেকে সুস্থ হবার পরও শশীর কথা ভুলেনি। অথচ আমার এতটা কাছে এসেও নীলা শশীকে কেন ভুলে আছে? ও কি অতীতের এ করুণ স্মৃতিকে ভুলে থাকতে চায়? ও কি কষ্টকে দূরে ঠেলে রাখার জন্যই শশীকে আমাদের মধ্যে টেনে আনতে চায় না। জানি না, হয়তো তাই।
আজ পর্যন্ত আলমারিতে ডায়েরি সংখ্যা ঊনসত্তরই আছে। ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটা এখনো অপশক্তির হাত থেকে ফেরত আসেনি, অপেক্ষায় আছি। এবার হয়তো ১৯৮৩ সনের ডায়েরিটা গুম হবে। প্রতিদিনই ডায়েরিগুলোর উপর সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছি।
গতকাল মিজান মিয়ার সাথে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম তা সফল হয়নি। শাজান মিয়ার সাথে দাদাজানের বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হলো না। মিজান মিয়া প্রথমেই আমাকে জানিয়েছিল। তার বাবা যখন তখন কাশতে শুরু করে, তাছাড়া বয়স বৃদ্ধির ফলে রগচটাভাবে রেগে যায়। হঠাৎ কারণে-অকারণে বেখেয়ালে গালমন্দ করে।
তাদের বাড়িতে যাবার পর বৃদ্ধ শাজান মিয়া হাত উঁচিয়ে লম্বা করে সালাম দিলো। মিজান মিয়া আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করতেই শাজান মিয়া তার শরীরের হাল-অবস্থা সম্পর্কে বিশাল ইতিহাস বর্ণনা করল। ততক্ষণে মিজান মিয়া চার কাপ চা নিয়ে এলো। এককাপ চা শাজান মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমি এক কাপ নিলাম। মিজান মিয়া আরেক কাপ তুলে নিলো। শাজান মিয়া পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে দেহের বামপাশ অসুস্থ হলেও ডানপাশটা বেশ সচল। আমরা সবাই চা পান করছি।
ট্রেতে আরো এক কাপ চা রয়ে গেল। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল মিজান মিয়া চার কাপ চা তৈরি করল কেন? তার মধ্যে কি সংখ্যা জ্ঞান বলে কিছু নেই? এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনতে না পারা মিজান মিয়া জীবন সংসার কিভাবে চালাবে?
এসব ভেবে মিজান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, মিজান, তুমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনতে পারো?
হুম, কেন পারব না স্যার?
আমরা তিনজন মানুষ, তুমি চারকাপ চা কেন তৈরি করলে? এক কাপ চা শুধু শুধু অপচয়।
স্যার, আপনার জন্য এক কাপ এক্সট্রা তৈরি করছি। বাসায় সবসময়ই তো দুই কাপ করে চা খান, তাই আরকি।
না, মিজান এ অপচয় মোটেও ঠিক নয়। এমনটি আর কক্ষনো করবে না।
মিজান মিয়াকে এ উপদেশটা দিতে গিয়েই হলো মূল বিপদ। শাজান মিয়া উচ্চস্বরে বলা শুরু করল, হারামজাদারে ইশকুলে দিছিলাম, পড়ালেহা করে নাই, হিসাব-পত্র কিচ্ছু শিখে নাই। মূর্খ, পুরাপুরি মূর্খ আমার পোলা। অসভ্য, বেয়াদবের হাড্ডি, বাপের সামনে বিড়ি খায়, আরো কি কি যেন খায়।
শাজান মিয়াকে চেষ্টা করেও থামাতে পারিনি। শেষে কাশির আক্রমণে আপনাতেই থেমে গেল। তবে কথা বলা থামলেও কাশি থামেনি।
লোকটা পুরনো কাশিতে আক্রান্ত। চেষ্টা করেও মুখ ফুটে কথা বলার সুযোগটুকু পাচ্ছে না, অনবরত কেশে যাচ্ছে। কথা বলার উপায় নেই দেখে ফিরে এলাম। চলে আসার আগে মিজান মিয়ার হাতে দু’হাজার টাকা দিয়েছিলাম। তার বাবাকে চিকিৎসা করানোর জন্য। আজ সকালে সে তার বাবাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। মিজান মিয়া ফিরে এসে জানাল, হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি নিতে রাজি হয়েছে। জানিয়েছে, সুস্থ হয়ে ওঠতে বেশ সময় লাগবে। আমি শাজান মিয়ার সুস্থতার অপেক্ষায় আছি। দাদাজানকে নিয়ে মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি মারছে। জিজ্ঞাসা করার মতো একজনই আছে, সে শাজান মিয়া। আজ রাতের জন্য মিজান মিয়াকে ছুটি দিলাম। বললাম, আগামীকাল সকালে এসো।
রাত এখন আড়াইটা। অনিদ্রা আমাকে ভালোভাবেই আঁকড়ে ধরেছে। ডায়েরিটা পড়তে পড়তে চা খেতে ইচ্ছে হলো। মিজান মিয়া নেই তাই নিজেই ওঠে গেলাম। নিচতলায় লাকড়ির চুলা জ্বেলে চা বানাতে আমাকে বেগ পেতে হলো না। চায়ের মগ হাতে নিয়ে উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। একফালি চাঁদ আকাশে। উঠোনের নরম ঘাসগুলোকে শরতের শীতল আবরণ ঢেকে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নীলার কথা মনে হলো। নীলার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয়, অথচ ওর ফোন নম্বরটা নেয়া হয়নি। নিজের খামখেয়ালির প্রতি রাগ হচ্ছে। ইশ, এ সময়টাতে নীলার সাথে ফোনে কথা বলা যেত। কাল অবশ্যই নীলার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিতে হবে। আমার ভেতর টান টান উত্তেজনার ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে। ইচ্ছে করছে নীলার গেস্ট হাউজের দিকে যেতে। সেখানে গেলে নিশ্চয়ই ওর সাথে অনেক গল্প করা যাবে, সময়টা সহজে কাটবে।
চোখের চশমাটা খুলে, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে লাগলাম। এখানে আসার পর একদিনও দাড়ি কামানো হয়নি। আশপাশে কোথায় সেলুন আছে তাও খোঁজ নেওয়া হয়নি। ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি সেই বাচ্চা সাপটি ধীরে ধীরে ড্রেইনের দিকে এগোচ্ছে। কি সুন্দর নিরীহ ভঙ্গি, অথচ মানুষ এ প্রাণীটার প্রতি আক্রমণাত্বক আচরণ করে। সেই আচরণের রিপ্লে দিতে গিয়ে ওরাও হিং¯্র হয়ে ওঠেছে। মানুষের মতো সর্পশ্রেণীও মানবজাতিকে অবিশ্বাসের তালিকায় রেখেছে। তাই তো এই শত্রুতা অধ্যায়ের উদ্ভব।
আরেক মগ চা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নীলা বলেছিল বনবিভাগের গেস্টহাউজ সামনের মোড় থেকে ঠিক উত্তর দিকে, অনেকটা গভীর বনে। জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর! আমি হেঁটে চলেছি একপা দুপা করে, সাথে হাঁটছে চাঁদ। চায়ের মগে প্রতিটি চুমুক আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানার দিকে। শালবনে রাতের সৌন্দর্য নিস্তব্ধতা কেন্দ্রিক! গজারি গাছের পাতার উপর হালকা আভা, বাতাসের গতি সে আভাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে এদিক-সেদিক। পাতাগুলোকে আলোর ঝালর মনে হয়, দুলছে তো দুলছেই। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে চোখে পড়ল দূরে কোথাও আলো জ্বলছে। পাশে বিশাল বটগাছ ছাতার মতো ডাল-পাতা ছড়িয়ে স্থির দাঁড়িয়ে। প্রাসাদের মতো দেখতে এই ভবনটিই কি বনবিভাগের গেস্ট হাউজ? সামনে এগোতেই দেখলাম, নীলা পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হলাম না, সহজভাবে এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। কেন অবাক হইনি, সে প্রশ্নটা নিজেকে করে কোনো উত্তর পাইনি। যেন এমনটিই হবার কথা ছিল।
নীলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মিনিট খানেক পরে সে সামনে এগিয়ে এসে আমার বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরল। আমিও ওকে কাছে টেনে নিলাম। কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। রাতের বুনো বাতাস ওর চুলে ঢেউ তুলছে, আমি শত চেষ্টা করেও সে ঢেউ রোধ করতে পারছি না।
নীলা আমার হাত ধরে গেস্ট হাউজের ভেতরে নিয়ে গেল। বাইরে থেকে দেখতে কেবল প্রাসাদ মনে হলেও ভেতরটা রাজপ্রাসাদের সমতুল্য। নীলা আমাকে ওর কক্ষে নিয়ে বসাল। চমৎকার একটি কক্ষ! সুন্দর সব আসবাবপত্র ও পেন্টিংয়ে ভরপুর। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বোধশক্তি ফিরে পেলাম। প্রশ্ন করলাম, তুমি কী করে জানলে, আমি আসব?
মনে হচ্ছিল তুমি আসবে। ওর মুখে লাজুক হাসি।
আমিও হাসলাম। বললাম, তোমার ফোন নম্বর দাও। যেন যখন তখন কথা বলতে পারি।
নীলা ফোন নম্বর বলার পরপরই মুঠোফোনে সেভ করে নিলাম। রুমের এসি অন করে নীলা নিচে নেমে গেল। পাঁচ মিনিট পর সে এক গ্লাস শরবত, ও এক পিরিচ মিষ্টি নিয়ে এল।
শরবত ও মিষ্টি দুটোই খেলাম।
নীলা বলে ওঠল, সোম তোমার চোখ দুটো এত সুন্দর কেন?
চমকে ওঠলাম। নীলা আগে কখনো চোখের প্রশংসা করেনি, আজ ওর কী হয়েছে?
কিছু না বুঝেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কেন সুন্দর তুমিই বলো।
মায়া, তোমার চোখে মায়া লেগে আছে তাই। নীলা দরোজাটা বন্ধ করে দিলো। ধীরে ধীরে আমার কাছে এলো। আমাকে ওর বিছানায় টেনে নিলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীলাকে অনুসরণ করছি। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চির পরিচিত ভাষা, অথচ বুঝেও না বুঝার ভান করছি। জীবন বহু বক্ররেখার সমাহার, আমি আমাকে দেখে তাই শিখেছি।
নীলা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি ধ্রুবকের মতো স্থির ওর সম্মূখে। নীলা বাঁধ ভাঙা নদীর মতো আমার বুকে আছড়ে পড়ল, আর আমি পাহাড়ের মতো নিশ্চুপ!
অজানা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে একসময় আমরা দু’জনই বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁটের স্পর্শ লাগল। আমি আঁতকে ওঠলাম, একি! তোমার ঠোঁট এত ঠা-া কেন? প্রশ্নটা আমার কণ্ঠেই আটকে রইল। ওকে স্পর্শ করতেই বুঝলাম বরফের মতো শীতল ওর দেহ। হিম রমণীর সাথে আলিঙ্গন আমাকে মেরু দেশের তুষার পুরুষে রূপান্তর করতে পারল না। ওকে জড়িয়ে ধরতেই থমকে গেলাম। ক্রমেই আমার শরীরের তাপমাত্রা কমতে লাগল। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজেকে মুক্ত করে বিছানা ত্যাগ করলাম। নীলা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একসময় সেও ওঠে দাঁড়াল। ওর চোখে মিনতি, দু’ফোটা অশ্রুও! এ জলকণা অগ্রাহ্যের অপমান কষ্ট নাকি কেবলই প্রেমক্ষুধা আমি জানি না।
নীলাকে একেবারে স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে বললাম, চলো নীলা, বাইরে হাঁটতে যাব। নীলা অনিচ্ছা প্রকাশ করল না, মাথা নেড়ে সায় দিলো।
দু’জনই বাইরে বেরিয়ে এলাম। শালবনের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। ঝোপের পাশের জোনাকিদের ভিড়। দূরে কোথাও শেয়ালের হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। দু’একটা নিশি পাখির কণ্ঠস্বর থেকে বেরুচ্ছে বিরহের কথামালা। নীলা একেবারে চুপ হয়ে আছে। আমাদের কিছুটা সামনে জলাশয় ও বাইদ জমি, যেখানে কৃষকরা ধান চাষ করেছে। আরো উত্তরে পাড় বাঁধানো লেক। লেকের মাঝখানে বৃক্ষ ফোয়ারা থেকে অনবরত পানি ঝরছে। আমরা লেকের পাড় ধরে হেঁটে পূর্বদিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এদিকটাতে খানিকটা আনারস বাগান, বাকিটা বন। হুট করে একদল বানর চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। আমাদের আগমনে ওরা যে অসন্তুষ্ট তা ওদের চেঁচামেচিতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নীলা আমার হাত চেপে ধরল, সোম সামনে যেও না।
কেন?
পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলাম। একটা সজারু আমার পায়ের পাশে স্থির দাঁড়িয়ে, ওর সুঁচালো কাঁটাগুলো ঊর্ধ্বমুখী ক্ষিপ্ত আকার ধারণ করে আছে। আরেকটু হলে প্রাণীটার উপর পা দিতে যাচ্ছিলাম। সজারুটা ধীরে ধীরে এগিয়ে একটা গর্তে ঢুকে গেল। নীলা সাবধান না করলে আমার পা কি যে হতো জানি না।
রাতের ভ্রমণ ফজরের আজান অবধি চলল। আমি ফিরে যেতে চাইনি, তবু নীলা বলল, এবার ফিরে যাও সোম।
বাড়িতে ফিরে বিছানায় ঠাঁই নিলাম। বালিশের উপর মাথা রেখে এপাশ ওপাশ করা সত্ত্বেও ঘুম এল না। হুট করে মনে হলো, নীলা ফিরে এসেছে এ সুসংবাদটা কাউকে জানানো হয়নি। একবার উৎসবকে জানানো উচিত। ওকেই প্রথম কল দিলাম। উৎসব কল ধরল না। ভাবতে ভাবতে রিমনের নম্বরে ডায়াল করলাম। কল রিসিভ করল।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, হ্যালো।
শোন, রিমন, একটা সুসংবাদ আছে।
কথা না বাড়িয়ে,বলে ফেল।
আরে শোন, নীলার কথা বলছি...
আরে ভাই, বলতে তো মানা করিনি
তুই কি বিরক্ত হচ্ছিস?
এই শোন, পরে কল দিস, আমি এখন ঘুমে।
রিমন লাইন কেটে দিল।
মলয়কে কল দিলাম। ওর মোবাইল বন্ধ, মুহূর্তে একটি মেসেজ এল, সিম অপারেটরের মিসকল এ্যালার্ট থেকে।
তনিমা ও সুজাতকে লাইনে পাবার জন্য চেষ্টা করলাম। সুজাত কল ধরল,
দোস্ত, কেমন আছিস?
ভাল আছি। নীলার কথা মনে আছে?
কেন মনে থাকবে না? সে তোর সাবেক বউ, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলি।
হুম, তোর দেখছি সবই মনে আছে।
থাকবে না, কেন? আমার স্মৃতি কি এতই কাঁচা নাকি?
কাঁচা-পাকা যাই হোক। শোন, আমার বউ আবার ফিরে এসেছে, বুঝলি।
কবে? ওর তো আমেরিকান স্বামীর সাথে বিয়ে হয়েছিল।
হ্যাঁ, হয়েছিল, সেটা তো অতীতকাল। এখন সে আমার, ও আমার কাছে আছে।
কি বলছিস এসব?
কেন তুই খুশি হসনি?
না, মানে....সোম শোন
রেখে দিচ্ছি এখন, আর কিছু শোনার মুড নেই।
কলটা কেটে দিলাম। সুজাতের প্রতি রাগ হচ্ছে। ও আমাদের নতুন প্রেমকে মূল্যায়ন করতে পারল না। আর পারবেই কি করে, ওরা সবাই তো রীতিমত সংসারি। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ আর অভাব অর্থনীতির মেশিনে পৃষ্ট হয়ে বহুমুখী টেনশনে বুঁদ হয়ে থাকে। রাগ হলে আমি গান শুনি, যাতে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারি।
গান শুনতে শুনতে ঘুমে ঢলে পড়লাম।
[চলবে...]
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)