পদাবলি

পদাবলি



 
কাবিনবিহীন প্রেম
আজাদ বঙ্গবাসী

জলের কারুকাজ ভেঙে যে জল উঠে যায়
মগ্নের নিরাকারে,তারে ফিরায় কোন রঙের পিয়াস?

ঐশ্বি বর্ণের ধুলো সমবেত ঘোর
কিংবা শূন্যের স্থায়িগহীনে- যে কঠিন ডুবে যেতে পারে
সেই তো শুদ্ধ প্রেমিক।

অথচ- সর্বভূক বাহুতেই অবুঝ জলের শিল্পকীর্তি
হয়ে যায় সেচ্ছাচারী নদী।
কুহক ধ্বনি মিশ্রিত শিৎকার অন্ধ বাহুর মোহনায়
গান হয়ে ফিরে অনন্ত ডানার আলোকে।

ইঙ্গিতের গালি চাপাবার আগেই; ফুল-ফলের তৃপ্ত সেবার আগেই
অজস্র চাহনি ছিড়ে ফেলছে কাবিনের পাতা।

পিতার রক্ত, মায়ের মা চিৎকার, গোল পৃথিবীর রহস্য
উন্মোচনে আগেই; কুমারী সৌকর্য প্রেমিকের আগুনে
প্লাবিত করছে ভরা মৌসুম।
কালস্রোত, মোছনা ওই ধুলোর কণা। ওই আড়ে বসেই হয়ত-
কোন এক যুবক যুবতী শুনাবে শেষ নদীগান।


ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ১১

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ১১


 রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

নদীর স্্েরাত বাধা পেয়ে যেমন বিকল্প পথ খুঁজে বেড়ায়। ক্লাব বন্ধ হওয়ার পর আমাদের অবস্থাও তদ্রƒপ। আমরাও বিকল্প পথ খুঁজতে গিয়ে কেউ বারে, কেউ জুয়ার আসরে, কেউ আবার পার্কের কোণা-কানা দখল করে গাঁজার শাদা ধোঁয়ায় উড়তে থাকি। একসময় অবস্থা বেগতিক দেখে চৈতন্যোদয় ঘটে। ভাবতে থাকি; এভাবে চলতে পারে না। যেভাবেই হোক নতুন দেবতার খোঁজ করতে হবে। এ-আশায় একদিন গিয়ে ভিড় জমালাম ক্ষণিকালয়ে। দেশ-খ্যাত এক রিমোট কন্ট্রোলারের বাসা। এবিসি গ্রুপের মালিক। শুনেছি তিনি নাকি কন্ট্রোলার থেকে প্রমোশন পেয়ে দেবত্ব পাওয়ার আশায় মহল্লায় কাজ করতে চান। শুনে আমরাও খুশি। আমরাও তাকে সাহায্য করতে চাই। বললাম, আপনি উপরে কথা বলে আমাদের ক্লাবটা খুলে দিন। আপনি আমাদের পাশে থাকুন। সামনের ইলেকশনে আমরা আপনার পাশে আছি। তারপর তিনি খুশি হয়ে উপরে কথা বলে ক্লাব খুলে দিলেন। আমরাও আনন্দে বাকুম বাকুম করতে করতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। তাকে করি প্রধান অতিথি। তিনিও কেতাদুরস্ত হয়ে আসেন। ভাষণ দেন। এবং ক্লাবের উন্নয়নের জন্য একটা চেকও লিখে দেন। তখন আমাদের মনে হয়, ‘সত্যেন সেন স্মারক বক্তৃতা’টা এখন শুরু করা যায়। এবং এ-ব্যাপারে প্ল্যান-পরিকল্পনা করার জন্যে উদীচী’র অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব করিম আজাদ সাহেবের কাছে যাই। গিয়ে দেখি তাঁর মন খারাপ। তাঁর বড়ো মেয়ে আব্বাস আলী ভূঁইয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষিকা ফাহিমা আজাদের চাকরি চলে গেছে। অপরাধ গুরুতর। সে-ও বাবার মতো সাহিত্যের শিক্ষক না হলেও ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে আমাদের শহরে একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তারও রয়েছে বেশ পরিচিতি। নিজে নাটক লেখে, নাটকের নিদের্শনা দেয় এবং অভিনয়ও করে। এজন্যে অধ্যক্ষ সাহেবও কলেজের সহপাঠ্য বিষয়ক নানান কর্মকা-ে তাকে ডাকে। দায়িত্ব দেয়। সে-ও গুরুত্ব দিয়ে পালন করে থাকে। কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যেও একাধিক দায়িত্ব দিয়ে তার সাথে বাড়তি কাজ হিসেবে বলেছিলেন, ‘উৎসবে  একটা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যে আলী আকবর সাহেবকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম; কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হলো না। সময় পেলে তুমি একটু তাকে হেল্প করিও তো।’
আচ্ছা স্যার। এ-নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। এটাও হয়ে যাবে।
তারপর থেকে সে আলী আকবর সাহেবকে সাধ্যমতো সাহায্য করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোটো একটা স্ক্রিপ্ট বাছাই করে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মহড়া চালিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসে। গ-গোলটা বাধে উৎসবের দিন। উৎসবের দিন সকালে অধ্যক্ষ সাহেব নাকি তাকে ডেকে নিয়ে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বসমূহের হাল-হাকিকত সম্পর্কে জানতে চান, তখন সে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কীভাবে সেট করা হয়েছে তার বিবরণ বলতে বলতে পুরো অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার স্ক্রিপ্টটা অধ্যক্ষ সাহেবের হাতে দেয়। তিনি তখন স্ক্রিপ্টটা উল্টে-পাল্টে এক নজর চোখ বুলিয়ে সবকিছু পছন্দসই হওয়ায় খুশি হন। তারপর স্ক্রিপ্টটা তার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘অতিথিদেরকে যেসব মেয়েরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে নেবে, তারা যথেষ্ট সুন্দরী তো? স্মার্ট-সুন্দরী-টল ফিগার না হলে কিন্তু অতিথিরা মনঃক্ষুণœ হতে পারে। আশা করি, তুমি এদিকটাও খেয়াল রেখে কাজ করবে। কারণ বলা তো যায় না, কার ভাগ্যে কোথায় কী লেখা আছে। এমন তো হতে পারে আমাদের কোনো এক মহান অতিথির চোখে কোনো মেয়ে লেগে গেলো, দেখা যাবে, এই এক ক্ষ্যাপেই আমাদের কলেজ বাজিমাত। তুমি তো জানোই আমাদের এক মহান জেনারেল এভাবেই বিয়ে করেছিলেন। স্কুল নাকি কলেজ পরিদর্শন করতে গিয়ে টল ফিগারের এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে ঠাসকি লেগে গিয়েছিলেন। একবার চিন্তা করো তো সে-প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন কেমন হতে পারে? এজন্যই বলি, দেখো এমন একটা চান্স নিতে পারো কিনা।’

গল্প : পিছনের পিছুটান

গল্প :  পিছনের পিছুটান

 পিছনের পিছুটান
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

পিছনের  মনটা ভালো নেই। কদিন ধরেই পিছনের মনে হচ্ছে কি যেন একটা পিছুটান আছে ওর। কি একটা ঘটনা ঝাপসা ঝাপসা। কিছুতেই মনে পড়ছেনা। খুব অস্থির লাগছে। হঠাৎ করে কি হলো সে নিজেও জানেনা। অনেকটা স্বপ্ন দেখার মতো। কিছু স্বপ্ন মনে থাকে আর কিছু স্বপ্ন মনে থাকেনা। ঘুম থেকে উঠে মনে হয় একটা স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু কেন যেন মানুষের মাথায় তা আর থাকেনা। তখন মনটা ঘুমকে হাতড়াতে গিয়েও কিছুই খুঁজে পায়না। পিছন  মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা আব্দারের স্বরে বলে, মাগো ও মাগো বলোনা, আমার কি কোনো পিছুটান আছে। মা হাসেন আর হাসেন আর একটু আদর মাখা ধমক দিয়ে বলেন, আরে, তোর আবার কিসের পিছুটান। বাদ দেতো এসব। পিছুনের বাবা একটু বদরাগী। তারপরও কিছুক্ষন বুক চেপে সাহস নিয়ে বাবার সামনে যায়। বাবা হেলানো চেয়ারে বসে প্রতিদিনের মতো পত্রিকা পড়ছেন। পিছন বাবার সামনে কাচুমাচু করতে থাকে। বলতে গিয়েও বলতে পারেনা। একসময় বাবাই বলেন, কিরে হতচ্ছাড়া, কিছু বলবি। না...হা...না তোতলাতে তোতলাতে পিছন সাহস করে বাবাকে বলেই ফেলে, বাবা আমার কি কোনো পিছুটান আছে। এ কথা শুনে বাবা হেলান থেকে খুব রেগে উঠে দাঁড়ায়। যত্তোসব, বদমাইশি প্রশ্ন। আরে তোর মতো গাধার আবার কিসের পিছুটান। বিকেল বেলা ব্রিজের উপর বন্ধুরা মিলে প্রতিদিন দল বেঁধে আড্ডা দেয়। অনেক বিষয়ে তর্ক বিতর্ক, হাসি, তামাশা সহ পৃথিবীর এমন কোনো জিনিস নেই যা নিয়ে আলোচনা হয়না। পিছনের মনটা আজ আড্ডা দেওয়ার মতো ফুরফুরে মেজাজের ছিলোনা। বন্ধুদের মোবাইলের পীড়াপীড়িতে দো'টানা মন নিয়ে আসতে হয়েছে। বন্ধুরা পিছনকে এমন আগে কখনো দেখেনি। যে ছেলেটা আড্ডা মাতিয়ে রাখতো সেই কেমন জানি চুপসে গেছে। বন্ধুরা পিছনকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, কিরে দোস্ত তুই কারো প্রেমে পড়লি নাকি ? প্রেম তোকে ধরেছে নাকি তুই প্রেমকে ধরেছিস। এখন বল তো কোন রূপসী তোর মনে ধরেছে। পিছন একটু বিব্রত হয়। গালগুলো লজ্জায় মেয়েদের মতো লাল হয়ে যায়। মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, নারে তোরা যে কি বলিস তার মাথামুন্ডু নেই। কথাগুলো পিছন এভাবে বললেও ওর মধ্যে একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব চলে আসে।

নিজস্ব পরিবেশের সৌভাগ্যবান কবি কমরুদ্দিন আহমদ

নিজস্ব পরিবেশের সৌভাগ্যবান কবি কমরুদ্দিন আহমদ



নিজস্ব পরিবেশের সৌভাগ্যবান কবি
কমরুদ্দিন আহমদ

মাহমুদ নোমান

নগরায়নের হিড়িকে প্রকৃতি ধ্বংসের উৎসব আর মানুষ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনসময় আসতেও পারে, মানুষ মানুষকে দেখলে ভয় পাবে। ইতোমধ্যে আতংকিত হওয়া শুরু হয়ে গেছে। ঠিক, তেমনি এখনকার অধিকাংশ আধুনিক কবিতা দেখলে এসব কথা মনে ঝাপটায়। পরাবাস্তবতার বলয়ের আরো বাইরে গিয়ে মানুষের কাছে ফেরে না কবিতার মর্মবাণী। প্রকৃতির কথা, গ্রামের কথা লিখতেই কেমন জানি লজ্জাবোধ আর এসবের কবিতা দেখলেই বিরক্তির চরমদশা। এসব কবিতায় হিংসার গন্ধ প্রকট। এমন দুর্দশায় কেউ কেউ যে প্রকৃতির মাঝে, মানুষের মাঝে আলো ছড়াচ্ছেন কবিতার মর্মকথায়, এটা জেনে খুব আশান্বিত হই। নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে হয়, প্রাণ আর মনভরে....
এমন এক কবির নাম কমরুদ্দিন আহমদ। তিনি প্রকৃতির বাউল কবি, তা তাঁর কবিতার প্রথম লাইন থেকে পাঠকের বুঝতে সময়ক্ষেপণ হবে না। মানুষের মাঝে মানুষের আত্মিক টান অনুভব করবে নিঃসন্দেহে । মনে হতে পারে, পাঠকরা তাঁর খুব কাছের আত্মীয়। হয়তো নানাবিধ কারণে যোগাযোগ নেই।  আবার এমনও মনে আসতে পারে, কবিতার চিত্রকল্পে একেকজন সবুজের বিপ্লবী বা স্বপ্নকথক।
কমরুদ্দিন আহমদের কবিতা পরিশীলিত ভাবের সাথে মোহনিয়া আঞ্চলিক শব্দের চমৎকারিত্বের সফল রূপায়িত এক সাঁকো। ভাবের সাথে খুব খাতির যেন সাঁকোটির এ পাড় আর ঐ পাড়ের শব্দের সাথে। কোনো একটা শব্দকে জোরপূর্বক ব্যবহার করছে এমনতর মনে হবে না, এখানেই কমরুদ্দিন আহমদের কবিতার বাহাদুরি। চেনা জনপদ বা নাড়িপোঁতা মাটিকে নিয়ে লিখতে পারা কম সৌভাগ্যের নয়, তাই কমরুদ্দিন আহমদ সৌভাগ্যবান কবিও।
বিষয়-আশয় বিচারে অথবা বোধের জ্ঞানে কমরুদ্দিন আহমদের কবিতাকে আল মাহমুদের কবিতা পড়ছেন বলে মনে হতেও পারে অথবা বলতে পারেন - আল মাহমুদের কবিতা পড়ছি না তো! কিন্তু, কমরুদ্দিনের আহমদের কবিতাকে আমার কমরুদ্দিন আহমদের কবিতা-ই মনে হল। শব্দ আর আঙ্গিক একেবারে নিজস্ব ধাঁচের, কখনো কখনো যথেষ্ট প্রভাববিস্তারী ভাবের চলনে- বলনে। আল মাহমুদের কবিতার তাত্ত্বিক বিশ্লেষক বলেই হয়তো কিছুটা প্রভাবিত। তবে অতি সম্প্রতি কমরুদ্দিন আহমদের ‘ গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ পড়ে মনে হলো- এটাকে কেউ এককভাবে ছড়া বা কবিতা গ্রন্থ বলে চালিয়ে দিতে পারবে না অথচ দুটোর খাছিলত এখানে বিদ্যমান। তিনি হয়তো চেয়েছেন, প্রকৃতির সারল্যতা ছন্দের তালে বা অন্ত্যমিলের চমৎকার গাঁথুনিতে ফুটিয়ে তুলতে এবং এখানেই কমরুদ্দিন আহমদ সবচেয়ে সফল। নিজস্ব পরিবেশ আর পরিস্থিতির চিত্রকল্পে পাঠক হয়ে ওঠে ভ্রমণপিপাসু-

বউ

 বউ


 বউ
জাহিদ হোসেন

জানিস আমার বউটা না সুন্দর করে হাসে। তোর ভাবীর সে হাসিতে আমি প্রাণ ফিরে পাই। উৎসাহ আর উদ্দিপনায় মনটা ভরে ওঠে। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো পথিক। ওরা তিন বন্ধু প্রাইমারী লেবেল থেকে কলেজ জীবন,এমনকি কর্মজীবন পযর্ন্ত একসাথে পথচলা । একসাথে একই ক্লাসে পড়া,একসাথে টিফিন, খেলাধুলা এমনকি এক রুমাল ব্যবহার পযর্ন্ত। ছোটবেলা থেকেই একে অপরের সুখ-দুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিত।
    পথিকের কথা শুনে পান্থর মন খারাপ হয়ে যায়। তার বউ সুন্দর করে হাসে না। সোহাগ ভরে আদরও করে না। দিনরাত শুধু খ্যাচর  খ্যাচর। সব সময় তার মেজাজটা যেন তিরিক্ষি হয়ে থাকে।  এই তো সেদিন পান্থ বাইরে থেকে এলে বউয়ের সুন্দর হাসি তো  দূরের কথা বরং কড়মড় করে বাজারের লিষ্টিটা হাতে ধরিয়ে বললো- ‘কোথায় ছিলে এতক্ষন ! গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। এই ধরো বাজারের লিষ্টি। লিষ্টি দেখে দেখে সবগুলো ঠিক ঠিক নেবে আর একটা ডাব ক্রিম নিতে ভুলোনা যেন।’ বাসায় কাজের লোক নেই। অনেক কষ্টে পান্থ গতবছর একটি কাজের ছেলে যোগাড় করেছিলো। সে ছেলেটিও এক মাস যেতে না যেতেই বাজার খরচের টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথার খুনসুটি চলতেই থাকে দিনের পর দিন। সংসারে অশান্তি বিরাজ করে।
সেবা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে- ‘এত কাজ আমি একা করতে পারবো না। হয় কাজের লোক আনো নয়তো হোটেল থেকে খাবার এনে খাও।’ এ নিয়ে কয়েক দফা সেবার সাথে ঝগড়াও হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীতে কয়েকদিন কথাও বন্ধ। মাঝে মাঝেই এরকম  ছোট-খাট ব্যাপার নিয়ে বাক-বিদন্ডতা লেগেই থাকতো।
গভীর চিন্তায় পড়ে যায় পান্থ। সিগারেটের পর সিগারেট শেষ করে, কিন্ত কোন উপায় খুঁজে পায় না। এ বিষয়ে পথিক আর পঙ্কোজের সাথে পরামর্শ করতে হবে। কিন্তু ওদেরকে সন্ধ্যার পর ছাড়া পাওয়া যাবে না। এখন সবেমাত্র তিনটা পনেরো। ছোটবেলায় একবার জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিল। জ্যোতিষী বলেছিলো- ‘হাতের রেখায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার একাধিক বউ হবে।’ সেই কিশোর বেলায় জ্যোতিষীর কথা শুনে বন্ধুরা তো হেসেই খুন। পান্থ আরেকবার হাতটা পরীক্ষা করাবে। তার বাম হাতটা উল্টে পাল্টে দেখলো সে। সেই সময় জ্যোতিষী ব্যাটা কী দেখতে কী দেখেছে তার বোধগম্য হয়নি। হয়তো দ্বিতীয় বিয়ের রেখাটি এখনও মুছে যায়নি। আজ পথিক আর পঙ্কোজের সাথে দেখা করে জ্যোতিষীর ব্যাপারটা ফাইনাল করবে। কিন্তু সময় তো যাচ্ছে না । অগ্রহায়ণ মাস হলেও পান্থ বারবার কপালের ঘাম মুছছে। বাম হাতটি পকেট থেকে বের করে আবার দেখে। এই মধ্যমাকে পাশ কেটে তর্জনির দিকে এগুচ্ছে দু’ভাগ হয়ে, এই রেখাটিই হবে হয়তো। পান্থ দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় এ হাত দিয়ে আর কোন কাজ করবে না সে, পাছে যদি দ্বিতীয় বিয়ের রেখাটি মুছে যায়। হাতটি আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। এরকম আরো অনেক অগোছালো ভাবনা ভাবতে ভাবতে পান্থ যখন অফিস থেকে বের হলো তখন সূর্যটা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। লাল সিগন্যাল দেখিয়ে বিদায়ের আয়োজন মাত্র। দ্বিতীয় বিয়ের ভাবনাটা তার মনে আকুলি বিকুলি করে। নতুন একটা বউ হবে, হলে মন্দ হয় না। অফিস থেকে ফিরলে পথিকের বউয়ের মতো সুন্দর করে হাসবে, সেবা-যতœ করবে। গভীরভাবে আদর সোহাগ করবে। পান্থ সে আদরে প্রাণ ফিরে পাবে। প্রবল উৎসাহ আর উদ্দিপনায় তার মনটা বাবুই পাখির মতো নেচে নেচে ওঠে। আহ্! কী শান্তি। মনের আনন্দে গুনগুনিয়ে গানও গাইতে থাকে- ‘আহা কি আনন্দ, আকাশে বাতাসে।’
বন্ধু পথিককে হাত দেখিয়ে ব্যাপারটা নিশ্চিত হলো পান্থ। শুনেছি ফিবছর হাতের রেখা নাকি বদল হয়। পরদিন অফিস শেষ করে পান্থকে নিয়ে পথিক জ্যোতিষীর কাছে গেল। ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী জ্যোতিষী সাহেব ভীষণ ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পান্থর হাতটি মিনিট পাঁচেক পরীক্ষা করে বললেন- ‘হাতের রেখায় ষ্পষ্ট দ্বিতীয় বিয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।’ একথা শুনে ভরা যৌবনা নদীর মতো পান্থ খুশিতে খলখল করে নেচে উঠলো। সে আরেকটা বিয়ে করবে। অফিস থেকে ফিরলে নতুন বউ সুন্দর করে হাসবে। ভাত বেড়ে দিয়ে তালপাখার বাতাস করবে। সেবা-যতেœরও কমতি নেই। ভাবতেই মনটা পুলকিত হয়ে ওঠে। গুনগুন করে মনের আনন্দে গান ধরে- ‘ছাইয়্যা দীলমে আনারে.....মোকো লেকে জানারে.....।’

সেবার চটাং চটাং কথা পান্থ’র গায়ে বিষ মাখানো তীরের মতো হানে। স্বামীর মন মেজাজ ভালো নেই জেনেও কাছে এসে বলে- ‘তোমার কী হয়েছে গো, সারাক্ষণ কী এত ভাবো।’ পান্থ বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে- ‘কানের কাছে গ্যাজর গ্যাজর করিস না তো, ভালো লাগে না।’
ধীরে ধীরে স্বামী-স্ত্রীতে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ক’দিন যেতে না যেতেই সেবার অনুমতি না নিয়েই পান্থ বিয়ে করে ফেলে। নতুন বউ পেয়ে তার আনন্দের সীমা নাই। চারদিকে কুসুম কুসুম নিস্তব্ধতা।  বাসর ঘরেও গুনগুন করে গান গাইতে থাকে- ‘এই রাত তোমার আমার, এই ক্ষণ তোমার আমার, শুধু দু’জনে....।’
সেবা মনের দুঃখে কাঁদে আর বিড়বিড় করে বলে- ‘দেখবো এই ভালোবাসা কতদিন থাকে।’ কিন্তু সে কান্নার করুণ আকুতি তাদের এতটুকু বিচলিত করে না।
পান্থ’র স্বপ্ন আজ সার্থক। পৃথিবীর সব চাওয়া পাওয়া আজ তার হাতের মুঠোয়। অনেকদিন পর আনন্দের একটি রাত কাটাবে। সে নতুন বউ পেয়ে আনন্দে গদগদ। নতুন বউয়ের মিষ্টি হাসি দেখবে। যথারীতি বাসর ঘরে বউয়ের ঘোমটা তুলেই দেখলো নতুন বউয়ের হাসি। সে হাসিতে কদুর বিচির মতো দু’চারটি দাঁত ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।



বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ

বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ


বাংলা সাহিত্যে
চর্যাপদ 

তারেকুর রহমান

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। চর্যাপদের মূল নাম ছিল ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। চর্যা শব্দের অর্থ হলো ‘আচরণ’। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত চর্যাপদ মূলত গানের সংকলন। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধধর্মের তত্বকথা। চর্যাপদ রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মচর্চা। চর্যার প্রধান তত্ব মহাসুখরূপ নির্বান লাভ। এটি রচনা করেন বৌদ্ধসহজিয়াগণ। সহজিয়া সম্প্রদায় ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় সহজান পন্থী। সাধন পদ্ধতির ভিন্নতার কারনে সহজিয়া সম্প্রদায় পৃথক ছিল। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাথে বাউলদেরও ঘনিষ্ঠতার কথা ছিল বলে জানা যায়।
চর্যাপদেদে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীন বাংলা ভাষা। এতে হিন্দি, অপভ্রংশ (মৈথিলী), অসমিয়া ও উড়িয়া ভাষার প্রভাব রয়েছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের ভাষা বঙকামরূপী। দ্ব্যর্থক ও রূপকাতুর ও অস্পষ্টতার জন্য চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষা বা সান্ধ্য ভাষা বলে। সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা হলো, যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি। যে ভাষার অর্থ ও একাধিক। এ ভাষাকে আলো আঁধারির ভাষাও বলা হয়। এর ভাষা দুর্বোধ্য হওয়ার কারন এতে তন্ত্র ও যোগের প্রতাপের জন্য।
১৯০৭ সালে নেপালের রাজগ্রন্থাগার থেকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। নৈহাটি, পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেয়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিনবারের প্রচেষ্টায় চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। চর্যাপদের সাথে তিনি ডাকার্ণব ও দোহাকোষ নামে আর দুটি গ্রন্থ উদ্ধার করেন। তিনি এই সবগুলো বইকে নিয়ে ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
চর্যাপদ নেপালে কেন পাওয়া গেছে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। সত্যজিৎ চৌধুরীর মতে, তুর্কি আক্রমণের সময় পুঁথিপত্র নিয়ে বাংলার প-িত মানুষেরা নেপালে, তিব্বতে চলে গিয়েছিল। আবার তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এক সময় নেপালে বসবাসরত বাঙ্গালীরা বাংলা লিপিতে পুঁথি লিখতেন। তাই নেপালে বাংলা অক্ষরে বাঙ্গালি লিপিকারের লেখা পুঁথির অস্তিত্ব পাওয়া অভাবিত ব্যাপার না। এ দুটি মতের মধ্যে প্রথম মতটাই অধিক গ্রহণযোগ্য।
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ভাষাও অপরাপর লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মত দিয়েছেন। তার মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। অপরদিকে ভাষা বৈশিষ্ট্যের আলোকে ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মত দিয়েছেন। তার  মতে, চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। চর্যাপদে কতজন পদকর্তা রয়েছে তা নিয়েও মতভেদ আছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘ইঁফফযরংঃ গুংঃরপ ঝড়হমং’ গ্রন্থে ২৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। অপরদিকে সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে ২৪ জন পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন। সে হিসেবে চর্যাপদের মোট পদকর্তা ২৩ জন  মতান্তরে ২৪ জন। চর্যাপদের পদ সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে পদ সংখ্যা ৫০, অপরদিকে ড.সুকুমার  সেনের মতে পদসংখ্যা ৫১ টি। তবে সর্বমোট সাড়ে ছেচল্লিশটি উদ্ধার করা গেছে। চর্যাপদের ২৪ নং, ২৫ নং ও ৪৮ নং পদ পাওয়া যায়নি। এবং ২৩ নং পদ খ-িত আকারে পাওয়া গেছে।