পাখি-পরিধি !
পাখি-পরিধি
মো. আরিফুল হাসান
শূণ্যে উঠে যায় নিয়াজ। এক হাত, দুই হাত করে ছাব্বিশ হাত উপরে উঠে সে ঘুড়ির মতো ভাসতে থাকে। লোকেরা তাজ্জব হয়ে তার দিকে তাকায়। তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মাঠের আল থেকে, ইরিধানের সাঁড়ির ফাঁকে উবু হয়ে নিড়ানি দিতে দিতে, মাঠের মাছখানের হিজলগাছটার ডালে উঠে, এমনকি তিন-চার কোঠা ক্ষেত দক্ষিণে কালু মিয়ার পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য, নারী-বৃদ্ধ শিশু ও যুবক-যুবতীরা মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দৃষ্টি উঁচু করে নিয়াজের দিকে চায়। মাঠের কৃষকের হাটের মুঠোয় নিড়ানির ঘাসগুলো থেকে জল-কাদা চুইয়ে পড়ে, এক সময় তাদের মুঠো শিথিল হয়ে পড়ে যায় কাস্তে ও আঁচড়া। লোকেদের তন্দ্রা ভাঙে না। নিয়াজও উপর থেকে নিচে নেমে আসে না।
লোকেরা তখন নিয়াজকে প্রশ্ন করে, -অ নিয়াজ, তুমি এতো উপরে উঠলা ক্যামনে?
-আমার ভেতর একটা পাখি হৃদয় বাস করে, -দূর থেকে উত্তর দেয় নিয়াজ।
লোকেরা বলে, -নিয়াজ, নিচে নেমে এসো।
নিয়াজ বলে, -নামতে পারছি না।
তখন নিয়াজকে নামাতে লোকে বড় বড় বাঁশ একত্র করে টাউয়ারের মতো একটা কিছু তৈরি করে এবং নিয়াজের সমান উচ্চতায় গিয়ে তাকে পেড়ে আনতে চায়। কিন্তু সাধারণ বাঁশের ভর নেবার মতো অংশ ষোলো সতের হাতের বেশি থাকে না। তাই তারা বাঁশের পরে বাঁশ জোড়া দিয়ে মিনার বানাতে চায়। কিন্তু বাঁশের এই জোড়া দেয়া মিনারে কে চড়বে? সবারই জীবনের ভয় আছে। নিয়াজের ভাইকে প্রশ্ন করলে সে সোজাসুজি না বলে দেয়। তবু গ্রামের মুরব্বীরা নিয়াজের জন্য টান অনুভব করে এবং তাকে নামাতে তৎপর হয়।
কেউ বলে, মন্দবাগের বাঁশ আনলে হবে। ওগুলো লম্বায় তিরিশ বত্রিশ হাত পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্ষাকালে জেলেরা মন্দবাগ থেকে বাঁশ এনে খালের পানিতে জাল পাতে। একে বলে খরো জাল। পুরো খালটি তখন মিহি সুতার মরণফাদে পরিণত হয় মাছেদের জন্য। কিন্তু এখন তো বর্ষাকাল নয়। মন্দবাগ থেকে বাঁশ কিনে নিয়ে আসবে কীভাবে? বর্ষায় ভাটার জলে বাঁশের ভেলা বেঁধে ভাসিয়ে দিলেই হলো। বাঁকে বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে বাঁশ একসময় ঘাটে এসে ভিড়বে। কিন্তু এখন এই সাড়ে সাতমাইল দূরে মন্দবাগ বাজার থেকে বাঁশ কিনে আনাটা দুঃসাধ্য। তবু বাঁশ আনতে হবে; নিয়াজকে নামানো প্রয়োজন। কিন্তু এই গাড়ি-ঘোড়াহীন অজপাড়াগাঁ থেকে মন্দবাগ যেতেও তো দুই আড়াই ঘন্টা সময়ের দরকার। এতক্ষণ কি নিয়াজ ঝুলে থাকবে? মুরব্বীরা দরদী কণ্ঠে ডাক দেয়-
-নিয়াজ, অ নিয়াজ!
নিয়াজ উপর থেকে জবাব দেয়- জী, বলেন?
-তোমার এখন কেমন লাগছে?
-অনেক ভালো।
-আমরা তোমাকে নামাতে পারছি না।
-দরকার নেই।
-দরকার নেই মানে?
-আমি পাখি হয়ে ভালো আছি।
লোকেদের বিস্ময় আরো জমে উঠে। তারা তাগড়া তাগড়া যুবকদেরকে মন্দবাগ পাঠায়। তারপর আবার ডাকে-
নিয়াজ!
জি বলেন।
আমরা তোমাকে নামানো ব্যবস্থা করছি।
নিয়াজ কোনো উত্তর দেয় না। পাখির মতো হাত দুটোকে শূণ্যে ভাসিয়ে রাখে। নিচের দিকে মাথা নিচু করে চায়। গ্রাম ভেঙে মানুষেরা জড়ো হয়েছে। সবাই দেখছে তাকে। এ বিষয়টা নিয়াজ একেবারে গুরুত্বহীন চোখে দেখে। তার মনে হয়, সে এমনিভাবে প্রতিদিন পাখি হয়ে ভেসে থাকে আর এমনি করেই প্রতিদিন লোকেরা তাকে দেখতে আসে।
-নিয়াজ, নিয়াজ! -লোকেরা আবার ডাকে।
নিয়াজ জবাব দেয়, -হু।
-তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
-হু, জবাব দেয় নিয়াজ।
-আমরা তোমাকে নামাতে মন্দবাগ থেকে বাঁশ আনতে পাঠিয়েছি।
নিয়াজ আবার কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। লোকেরা তখন আবার বলে।
-আমাদের গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী যুবকদেরকে পাঠিয়েছি। তারা ঝরের মতো যাবে আর উল্কার মতো ছুটে আসবে। নিয়াজ, অ নিয়াজ, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
-হ্যা, শুনতে পাচ্ছি, বলুন।
-এই কিছুক্ষণ, ধরো তোমার যুবক বন্ধুরা আসতে যে দুই তিন ঘন্টা সময় লাগবে ততক্ষণ কি তুমি ঝুলে থাকতে পারবে? তোমার কোনো কষ্ট হবে কি?
-না কোনো কষ্ট হবে না।
-তুমি কি খুব একাকীত্ব অনুভব করছো নিয়াজ?
নিয়াজ আবার চুপ করে থাকে। শূণ্যে ভাসমান বাতাসের সাথে তার দীর্ঘশ্বাস হয়তো মিলিয়ে যায়। অথবা হয়তো তার ঠোঁটের কোনে কোনো গোপন হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে যায়, দূরত্ব ও বাড়ন্ত রোদের তেজে হয়তো তা দেখা যায় না।
Ñনিয়াজ! গ্রামের লোকেরা ডাকে। -তুমি কি আমাদেরকে চিনতে পারছো উপর থেকে? আমি মতলব চাচা।
নিয়াজ আবার চুপ করে থাকে। কালু মিয়ার পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রমনীরা চোখ মুছে কাঁদে। শিশুরা তাদের আঁচলে জড়িয়ে জড়িয়ে বিস্ময়মাখা চোখে দেখতে থাকে ঝুলন্ত নিয়াজকে।
এমন সময় হঠাৎ পুকুরের উত্তর পাড়ের পশ্চিম অংশ থেকে চিৎকার আসে, সাপ সাপ! রমনীরা যে যার মতো দৌঁড়ে জীবন নিয়ে পালায়। দুটো গোখরো বেরিয়ে এসেছে মুর্তার বনের আড়াল থেকে। শিশুরা চিৎকার করতে করতে তাদের মায়েদের পেছনে ছুটে। মাঠ থেকে কয়েকজন কৃষক পাজুন হাতে করে দৌঁড়ে আসে পুকুর পাড়ে। এসে দেখে এই সাপদ্বয় পাজুন দিয়ে মারার মতো নয়। তখন তারা চিৎকার করতে থাকে, চল্, চল্, চল্ চাই। তখন মাঠ থেকে আরো দুয়েকজন, হিজল গাছ থেকে চারপাঁচজন যুবক নেমে নিজেদের বাড়ির দিকে দৌঁড়ায়। লৌহশলাকা নির্মিত তীক্ষè ধারালো অস্ত্র চল্ আনতে হবে। লোকেরা দৌড়াদৌড়িতে অর্ধেক মানুষ কমে যায়। যুবকেরা যারা চল্ আনতে গ্রামের ভেতর গিয়েছিলো তারা এখনো ফিরেনি। পুকুরের পাড়ে সাপ দুটো ফোঁৎ ফোঁৎ ফণা তুলে আতংক সৃষ্টি করছে। মাঠের যে জায়গাটায় নিয়াজ ভেসে আছে তার নীচে এবং বিশ ত্রিশ শতাংশজুড়ে এখনো জনা বিশেক মানুষ দাঁড়ানো। তারা মনে করে যুবকেরা চল্ নিয়ে ফিরে আসলে সাপদুটিকে তাদের দশবারো জনেই হয়তো মেরে ফেলতে পারবে। কিন্তু তাদের নিয়াজকে ফেলে গেলে চলবে না। নিয়াজ ভাসছে আকাশে। মাটি থেকে ছাব্বিশ হাত উপরে পাখির ডানার মতো দুহাত শূণ্যে বিছিয়ে। নিঃসঙ্গ, অসহায় নিয়াজ ভেসে আছে।
লোকেরা কপালে উপর হাত রেখে গ্রামের দিকে চায়। কী করছে যুবকেরা এতক্ষণ? গ্রাম থেকে চল নিয়ে ফিরে আসতে বড়জোর দশ মিনিটের ব্যপার? কিন্তু মিনিটটা যেনো চলে না। তাদের মনে হতে থাকে মহাকাল ধরে তারা নিয়াজকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর মহাকাল আগে যুবকেরা ফিরে গেছে গ্রামে চল আনতে। তাদের আরও মনে হয়, এক মহাকাল ধরে সাঁপ দুটো মূর্তা বন থেকে বের হয়ে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় গ্রামের ভেতর থেকে চিৎকার আসে, Ñআগুন, আগুন। মাঠের মানুষেরা তরিতে সচকিত হয়ে দেখে গ্রামের উপর দিয়ে লেলিহান শিখা কালো ধোয়া ছেড়ে আকাশ ঢেকে দিচ্ছে। তখন তারা নিয়াজকে ফেলে গ্রামের দিকে ছুটে। কতক্ষণ জানা নেই, নিয়াজ ভাসতে থাকে। আর ওদিকে পুড়তে থাকে গ্রামের কারো ঘর। গ্রামের মানুষেরা কলসি দিয়ে জল এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। বালতি মগ বদনা, যে যেটা দিয়ে পারছে জল এনে ছুড়ে মারছে আগুনের দিকে। এতোগুলি সম্মিলিত মানুষের প্রয়াস অতঃপর বিজয়ী হয়। মোট তিনটি খড়ের গাঁদাসহ নোয়াব আলীর রান্নাঘর পুড়ে আগুনে। তবু সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে যে, বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আগুন নেভানো গিয়েছে। অতঃপর তাদের হঠাৎ করে খেয়াল হয় নিয়াজের কথা। তারা তাগড়া যুবকদের ফিরে আসার অপেক্ষা করে। কেউ কেউ বলে, নিয়াজকে এতক্ষণ একা ফেলে আসা কি ঠিক হলো। কেউ কেউ বলে, যারা মন্দবাগ গিয়েছিলো তারাই বা এতক্ষণে ফিরে আসছে না কেনো? ফিরে আসে অবশেষে যুবকেরা। মন্দবাগ থেকে বাঁশ এনে হেইয়ো বলে গ্রামের পথে ফেলে। মুরব্বীরা বলে, আর রেখে লাভ নেই, মাঠের দিকে চলো। সবাই তখন হৈ হৈ করতে করতে মাঠের দিকে ছুটে। কিন্তু, কোথায় নিয়াজ? সে যেখানে ভেসেছিলো সেখানে এখন শুধুই শূণ্যতা। সবাই হায় হায় করে উঠে। তখন দৃষ্টিশক্তিপ্রখর কয়েকজন মানুষ দেখায় যে, দূরে, দূর থেকে দূরে নীল আকাশের কাছে নিয়াজ যেনো পাখি হয়ে ভেসে যাচ্ছে।
পদাবলি : ০১
লজ্জাবদ্ধতা
হাফিজুর রহমান
লজ্জা দিও না আমাকে
নিচু মাথা নুইয়ে পড়বে, অনলে পোড়া মোমের মতো!
লাজুক আমার এই মস্তক, দাঁড়াতে পারে না স্থির হয়ে
দেখতে পারে না উঁচু মস্তকে ভূপৃষ্ঠ, সবুজ পৃথিবীর!
কারণ, আমার লজ্জিত মাথার মেরুদ- নেই।
কষ্ট দিও না আমাকে লজ্জা দিয়ে
কষ্ট রাখার জায়গা নেই আমার, কষ্টের গুদামঘরে!
কষ্ট নিতে আসে না কেউ, দিয়ে যায় সকলে
তবে, কী করে করি সে কারবার?
লজ্জা নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই, আমি ভাসছি -
লজ্জাবদ্ধতায় আটকে গিয়ে, পারি না নির্লজ্জ হতে।
সাম্যবাদ
মুহাম্মদ ইয়াকুব
পুঁজিবাদী জুয়ার টেবিলে
কেউ জীর্ণশীর্ণ, কেউ পাল্লা দেয় ঐরাবতে
ব্যবধান; আকাশ সমান
কী পেটে, কী মাথায়, কী শরাবের পাত্রে
এসো, মানুষের বিবেকে রোপণ করি সম্মানের চারা
সৌন্দর্য ভালোবাসি বলে
বাগানের উঁচু-নিচু এলোমেলো গাছ কেটে
ছেঁটে সমান করি সব মাথা
পুঁজির দেবতা ভেঙে সাজাই সর্বহারা দেহ।
কুয়াশা বেচা হয় রোদের হাটে
জহুরুল ইসলাম
আঁধার কেটে গেলো বৃষ্টির সাথে,
মেঘ কাটেনি।
কু-ুলি পাকিয়ে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
সোনালিরোদের মুখে।
বেড়াভাঙ্গা রোদ বেরিয়ে আসে
চঞ্চল কিশোরীর মতো।
বাঁশ পাতার আড়ালে ঝলমল করে।
চালতার মরা ডালে একটা দোয়েল এসে শিস দেয়।
এখন কুয়াশা বেচা হয় রোদের হাটে।
কুসুমবাগে প্রজাপতি নাচে।
মধ্যরাতের পদ্ম
রোমানুর রোমান
মধ্যরাতের পদ্মপুকুর ঘুম দেবেনা প্রেম দাও!
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নচূড়ায় বুকের ভেতর বেল দাও।
কথা দাও, কষ্ট দাও, হস্ত দাও, স্বপ্ন দাও,
মধ্যরাতের পদ্মপুকুর প্রেম দেবেনা ঘুম দাও।
নিয়ন আলোয় একলা একা মোবাইল দেখা,
শূন্য ঘরে অকপটে নীল বেদনার গান লেখা!
দুঃখ দেখা, জল দেখা, পেটের সমতল দেখা,
মধ্যরাতে পদ্ম দেখা! এক খেয়ালে চিরঞ্জীব।
কখনো আসেনি সে
অলোক আচার্য
কখনো আসেনি সে
শ্রাবণের বৃষ্টিতে-
ভিজে থাকা এক নিঃসঙ্গ শালিক
অপেক্ষায়,
গুণছে প্রহর-
প্রহর শেষের শরতের আকাশ ভেঙে
নেমে আসা হেমন্তের সন্ধ্যায়,
নবান্নের ধান ভানা রাতে
হৃদয় ভাঙার শব্দ
শেষ প্রহরে ভেসে আসে লক্ষী প্যাঁচার ডাক।
পদাবলি : ০২
এই সময়
মাজরুল ইসলাম
নোনা জলের বিশাল ঢেউ, ঢেউয়ের তীব্র ¯্রােত
ঢেউয়ের ফেনা খেতে খেতে
এক এক করে সব তারা ঝরে পড়ছে
ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে।
তোমার দিশাহীন পথচলায় বহুমাত্রিক দ্যোতনা বারে বারে
বাঙ্ময় হয়ে উঠলে
দুর্ভিক্ষের ছায়া দীর্ঘ হয়।
দেশনায়কের নোনা জলের প্রেম,
লোকসাধারণের মন ভুলানো কথায় শুরু হয়ছে
নোংরা দেশপ্রেম।
এমনটা হবে কে আর ভেবেছিলথ-
ওই লোকটা এখন উপোসি
যে নিজের ভোগ বিলাস ত্যাগ করে
অন্যকে পুষ্ট করেছে।
এখন পুষ্টি ভান্ডার শেষ হওয়ায়
অপুষ্টি অতি নিকটে !
চিন্তা করো না
দিশাহীন পথচলা শেষ
এখন তোমার ফেনাবিদ্যা দেখে সময় হাসাহাসি করছে।
ডুবজাল
বনশ্রী বড়ুয়া
পাতা ঝরা বিকেল
সোনামুখি সূর্যের বিদায়
বিষাদ নদী গোমড়া হয়ে
ফিরে যায় পাহাড়ের কোলে।
এক থালা জোনাকি
জীবনের পরতে ছড়ায় মুক্তো
থেমে যেতে যেতে
কাঁচা ভোর মাখে শিউলির গন্ধ।
ফের নদী বয়ে চলে
সোনালী মাছের মায়া সংসার
নুন তেলে পোড়া
স্বাদ নেয় অভিশপ্ত জীবন।
দূরে যেয়ো না
গোলাম রববানী
দূরে যেয়ো না
অতো দূরে যেতে নেই, যেতে নেই
যতো দূরে গেলে নয়ন ক্ষয়ে যাই ও-কি সহা যাই
বলো হৃদয়ের দাগ কী আদৌও মুছে যাই
ততো দূরে যেতে নেই
কভু তো মানাও নেই
কাছে এসো না
পাশে থেকো না
ভুল পথে ভুল বুঝে আরো দূরে যেয়ো নাকো
মনের কাছে মনের প্রশ্ন করে দেখো আরো
ভুল বুঝে যেতে নেই,
ভুলে আসতেও তো মানা নেই
দ্যাখো পথ থেমে নেই,
পথ থেমে নেই, নেই নেই
পথের মাঝে দ্যাখো কতো ভালোবাসা লুকিয়ে
আকাশের দিকে তাকাতে তো মানা নেই, হৃদয়ে
দূরে যেয়ো না কাছে এসো না পাশে থেকো না
অতো দূরে যেতে নেই দিতে নেই হৃদয়ে ব্যথা
মানচিত্র
আহমাদ সোলায়মান
ঘুম ঘুমানো রাতে জ্বলন্ত আমার দিয়ে ফিরে তাঁকায়নি কেউ
তুমি তো নিজেকে চাঁদের থেকেও সুন্দর ভেবেছ!
হৃদয়ে যে চাওয়া ছিল, আজ তা অক-৪৭এর আঘাতে বিক্ষত-
জীবন শুধু অশ্লীল মিথ্যা পেতেই ব্যস্ত
আকাশের হৃদয়ে আর ফোটেনা হাসি।
মধ্যরাতের নামে যে অন্ধকার আছে
তাকে তুমি কাজল সাজিয়ে চোখে লাগাও
আর, আমি তা দেখে হই নেশাগ্রস্থ
অথচ, এ অন্ধকার প্রতিনিয়ত আমাকে খুন করে।
একটি রোগ ছিল, ভেবেছিলাম দু’জনে রোগী হবো
তুমি ছিলে চতুর, তুমি চোখের পাপড়ি ডুবিয়ে সমুদ্রে যাও;
বলো, ওখানে একটা মানচিত্র আঁকা আছে
আমি দেখতে যাই, আগুনে হারাই,
মিথ্যের জলের মত ওখানে কোন মানচিত্র নেই।
যে গল্পটা লেখা হয়নি....
যে গল্পটা লেখা হয়নি....
হাসান মাহাদি
আচ্ছা কোলাহল ছাড়া গল্প হয়? যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই সেখানে গল্প নেই। যেখানে প্রাণ আছে সেখানে কোলাহল আছে। প্রাণের অস্তিত্বের নিরবতাও কোলাহল। নিরব কোলাহল। হয়তো লেখক নেই নয়তো পাঠক নেই। শব্দের পদচারণা আছে সবখানেই, হয়তো নেই শব্দের সাথে নিঃশব্দের আরাধনা। হয়তো কখনো কখনো লেখকের অভাব নেই। অভাব শুধু গল্প আর জীবনের মেলবন্ধনের। হয়তো সেই মেলবন্ধনে সুর থাকে, থাকেনা স্বরাগমের সঠিক ব্যাকরণ।
আমি সন্যাসী নই, আমি কোলাহল খুঁজি। আমি লোকালয় খুঁজি। শত শত মানুষের রেখে যাওয়া ভীড় নিস্তব্ধ নয়। মিছিল শেষে রাজপথগুলো স্লোগানহীন নয়। গুলিস্তানের ‘একশো, একশো’ বলে দর হাকানো হকারের চিৎকার, পুরান ঢাকার অলিগলিতে লোহার দোকানগুলোর টুংটাং বিচ্ছিরি আওয়াজসহ এই শহরের যন্ত্র কিংবা মানবের অসংখ্য শব্দদূষণ রাতের আঁধারেও মিলিয়ে যায় না। দিনের বেলাতে মোটরের ধোঁয়ার কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো সেই শব্দদূষণ থেকে যায় এই শহরের বায়ুমন্ডলে। আমি শূণ্য মাস্কে সেই কার্বন ডাউ অক্সাইডে আক্রান্ত হতে মাঝ রাতে বেরিয়ে পড়ি। নিঃশব্দে শব্দের খোঁজ করতে। এ শহর আমাকে শুনায় সফলতা আর ব্যর্থতার গল্প, স্বপ্ন পূরণের গল্প, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। সে আমাকে শুনায় সংগ্রামের গল্প। ব্যস্ততা আর বাস্তবতায় ঘিরে থাকা জীবনে যে গল্পগুলো শুনার সময় হয় না, সেগুলো এ শহর আমাকে বলে। জীবিকার তাড়নায় কত মানুষের কত রাত বিনিদ্রা আর হাহাকারে মিশে একাকার হয়ে গেছে তার হদিস শুধু লিপিবদ্ধ আছে এই শহরের খামোশ শুনানিতে।
আচ্ছা অন্যের গল্প খুঁজে কি লাভ? আমারো অনেক গল্প এই শহরের বোবা আর্কাইভে জমা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গল্প লিখেই কি লাভ? কিছুদিন পর ব্যর্থ হলে অন্যের সমবেদনাও আমাকে স্পর্শ করবে না। স্বপ্নের পেছনে ছুটছি আমিও। সফলতার সন্ধানে আমিও আছি। এই শহরের ছুটন্ত প্রত্যেকটা জীবনই জানে ব্যর্থতার গল্প কেউ শুনতে চায় না। ব্যর্থতার সবগল্পই দূষিত শহরের ধূলোর আর্কাইভে ঢাকা পরে যায়। শুধু সফলতার গল্পগুলোই কোলাহলের বিলবোর্ডে বিউগল হয়ে বাজতে থাকে।
দিন শেষে গল্প সেগুলোই যেগুলো মানুষ শুনতে চায়। আমি গল্পকার নই। কাউকে শুনানোর মতো নিজের সেই গল্পটা এখনো লিখতে পারিনি।
ভিক্টোরিয়া পার্ক, পুরান ঢাকা।
শব্দমালা : শোয়াইব শাহরিয়ার
শব্দমালা
শোয়াইব শাহরিয়ার
প্রেম
নদীর পাশে জীবন
পাখির কিচিরমিচির
আহবান-
এসো, নত হও।
তারপর-
ভেতরে প্রবেশ
উপচে পড়ে ঢেউ
আহ্লাদে মেতে ওঠে উপাসনালয়।
তথাপি, উষ্ণতা- শীৎকার- আহ, উহ, আহ!
তথাপি, জীবন- পতন্মুখ- ইশ, ইয়াহু...ইশ!
তথাপি-
হৃদয়ের নিভৃত কোণে প্রতিধ্বনিত হয় প্রেম!
সাক্ষী
আমি বৃক্ষ হয়েছি
পাড়ার কেউ জানে না
পাখি, তুমিও জানো না
উড়াল শেষে
ফিরবে বলে
বৃক্ষ হয়েছি;
ব্যাধিগ্রস্থ জেনেও
ফিরবে বলে
মহাকালের সাক্ষী হয়েছি...
দংশন
টিনের বুকে
বৃষ্টি পড়ার শব্দ
হাতুড়ি পেটার মতো
নীরবে সহ্য করে প্রেমের দংশন;
আজকাল,
হাতুড়ি পেটার শব্দে তোমার কথা মনে পড়ে!
সম্পর্ক
সেতু গড়েছি সম্পর্কের সুতোয়
একটু-একটু করে
সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা-রাতে
যখনি পেয়েছি সময়,
গড়েছি কী ভীষণ উৎসাহে!
আজ দেখি সেতু আছে
সুতো আছে
প্রবাহিত নদী আছে
নেই কেবল তুমি আর আমি...