গাঙ পাড়ের প্রেম
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
গাঙ পাড়ের প্রেম
মিসির হাছনাইন
চাঁদপুরের তিন কি সাত নদীর মিলিত ¯্রােত মেঘনা নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বেড়ীবাঁধের পুবে বিশাল বড় খরস্রোতা মেঘনা নদী আর পশ্চিমে গ্রাম উত্তর চাঁচড়া, যেখানে কয়েক সংখ্যক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাস। আর এই বেড়ীবাঁধে ঘর তুলেছে হাজার হাজার ভূমিহীন পরিবার। এরা পুরোপুরি নদীর উপর নির্ভরশীল। নদীর মাছেই তাদের জীবন-জীবিকা।
পুবের মেঘনা মারমার করে ভাঙ্গছে, হয়তো পশ্চিমের তেঁতুলিয়া নদীর সাথে মিশতে চায়। ছোটকালে দাদীর মুখে শুনেছি মেঘনা আর তেঁতুলিয়া ভাইবোন। তাই মিলনের জন্যে দুপাশ থেকে সমান তালে ভাঙ্গছে।
গ্রামের মধ্যবিত্তরা উপজেলা শহরে কিংবা একটু পশ্চিমে গিয়ে ঘর তুলছে, আবার নতুন বেড়ীবাঁধ হয়, ভূমিহীন জেলে পরিবার আবার নতুন ঘর তোলে।
এই অঞ্চলেরই বেড়ীবাঁধে ঘর কাঞ্চন মাঝির। সেই দাদার আমল থেকে বেড়ীতে নিবাস তাদের। তাঁর চার ছেলে, দুই মেয়ে। ইলিয়াস সবার বড়, ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি, মনে আছে স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর ইলিয়াস আর পড়াশোনা করছে কিনা, জানি না, আমরা চলে গেছি উপজেলা শহরে।
তারপর যখন জেলা শহরে অর্নাসে পড়ি, তখন একবার গ্রামের বাড়ি আসা হয়, গাছ বিক্রির জন্যে, নদী তখন আমাদের বাড়ি ভাঙ্গে। সেবার ইলিয়াসের সাথে এই দেশ-গ্রামের নৌকা-নদীর নানান হাবিজাবি কথাবার্তায় খুব একটা ভালো খাতির হয়ে ওঠেছিল আমাদের। বলেছিলাম- সময় করে আবার আসবো। ইলিয়াস বলছিল- মিয়াভাই, বিয়া করলে ফোন দিমু, আপনারে আসতেই হইবো।
তার বহু বছর পর আজ ইলিয়াসের সাথে দেখা। সন্ধ্যার একটু পর বেড়ীবাঁধের উপর বসে নদী দেখছি- ঐ তো ওখানে ছিল আমাদের বসতভিটা, আজ তা নদীর পেটে, ইশ! নদী যদি আর না ভাঙতো, যদি নদীর ভাঙ্গন জাপানিদের মতন রোধ করা যেত, গ্রামের জেলেদের একি হাল অবস্থা, এসব হাবিজাবি চিন্তায় যখন সিগারেট টানছি হঠাৎ ইলিয়াস ডাক দেয়..
- কি অবস্থা শফিক ভাই, কেমন আছেন? দেশ গ্রামের কথা ত ভুলেই গেছেন। কবে আইলেন, কই থাকেন এখন। ঢাকাত নাকি অন্য জায়গায়.. আপনার আব্বা আম্মা কেমন আছেন..?? আর এখন....
আমি কথা না বললে হয়তো আরো শ খানেক প্রশ্ন শুনা লাগত। বললাম-
- ইলু ভাই, ভালো আছি, আব্বা-আম্মাও ভালো আছে। কাছে আইসা বসো। কথা বলি, সব বলবো। আগে বলো, তুমি ভালো আছো ত? শুনলাম- বিয়াশাদি করছো।
- হ, ভাই আছি, গরিবের আর ভালো। আপ্নে যে হে গেলেন আর বলছিলেন আবার আসবেন.. বিয়া করছি, আপনারে খবরও দিতে পারি নাই। খুব ইচ্ছা আছিল আমার বিয়েতে আপনারে দাওয়াত দিমু। পারি নাই!!
- আরে ব্যাপার না ইলু ভাই। ত ভাবী কেমন আছে? পরিবার নিয়া নাকি নতুন ঘর বাঁধছো।
- হ, ভাই। ঐ যে ঐডা আমার ঘর। আছে বেক্তে ভালা আছে। পোলা হইছে, নাম রাখছি লালচাঁন। আল্লাহর রহমতে ভালো রাখছে আল্লাহ।
তারপর নানান কথাবার্তায় আমাদের আড্ডা শুরু হয়, আমরা এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নদীর পাড়ে ইলু ভাইর নৌকায় গিয়ে বসলাম। পৃথিবীর সব মানুষের জীবন নিয়ে হয়তো লেখা যাবে এক একটা দীর্ঘ উপন্যাস, কত অদ্ভূত মানুষের জীবন, কত না জীবন চরিত্র পৃথিবীতে ঘুরছে। আমি এই মানুষটার ক্ষুদ্র জীবনের ঘটে যাওয়া অল্প কিছু দারুণ সত্য কাহিনী, সে বলেছে আমি লিখেছি। হয়তো একটা ছোটখাটো গল্পের মতন হয়ে যাবে। ইলু ভাই আপনি বলেন.. আমি লেখা শুরু করলাম-
ভাই, ওরে আমি প্রথম দেখি- আমগো ঘরের পাশে মামাগো ঘর, ওখানে উঠান বলতে বেড়ীবাঁধের ঢ্যালে নারিকেল গাছ তলায়। দেখার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি, ভাই, তামাম পৃথিবীটা মনে হয় উল্টে গেছে, বুকের ভিত্তে কেমন জানি করতে ছিল। শুধু মনে হইছে মেয়ে মানুষও এতো সুন্দর হয়!! কিছুক্ষণ পর, জেগে দেখি সেও আমার অজ্ঞান হওয়া দেখতে আইছে, আমি চোখ খুলেই তারে দেখলাম। উঠলাম, ভয়ে আমার বুক ধুকপুক করতেছিল, আমি ঘরে গেলাম। একটা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে দেখি, মামাতো বোন আর সে মামাগো পানিফল গাছের নিচে দাঁড়ায় আছে। আমার ভয় লাগতেছিল, যদি মেয়েটারে আমি আর না দেখি- আমি দৌড়ে গেলাম, আমার আসা দেখে সে দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
আমি মামাতো বোনকে ডাকতে লাগলাম- লিপি, লিপি ও লিপি.. বাহিরে আয়.. লিপি আসলো, বললাম- ওরে ডাক দে, নিয়া আয়, বল যে ভাইয়া, কি কথা বলবে। লিপি চলে গেল, আমি দাঁড়ায় আছি, ভয় লাগতেছে যদি না আসে.. কিছুক্ষণ পর লিপি আসলো, বললাম, কিরে ও কই.?? লিপি বলে, ও আসতে চায় না, আমি বললাম, বল যে, জরুরি কথা বলবে, আসতেই হবে, জাস্ট দুই মিনিটের জন্যে, আর বলবি যে না আসলে আমি মারা যামু।
লিপি চলে গেলো, ভাই, কিছুক্ষণ পর সে আসলো.. আমার যে কেমন লাগতেছিল আপ্নারে কেমনে বুঝায়!!
আমি বুঝতেছি আপনার অবস্থা! তারপর.. কি হল-
আমি খপ করে তাঁর হাত ধরলাম। তারপর বললাম, আমার চোখের দিকে তাকান, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে, হাত ধরেই বলতেছি, ‘আপ্নারে ছাড়া আমি বাঁচুম না’, আমি তার হাত আমার মাথায় দিয়া বলতেছি, বলেন- ‘আমারে ছাইড়া কোথাও যাইবেন না। আপ্নারে আমি সারাজীবনের জন্যে পাইতে চাই’। ভাই, সে এক ঝাটকা দিয়া হাত ছাইড়া ইশ! বলে দৌড় দিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকলো। চোখের পলকে হাওয়া। সেদিন তাঁর এই ভাবে চলে যাওয়াতে আমার প্রচুর রাগ হইছে। আমি কি সব ভাবতে ভাবতে আমগো ঘরের দিক গেলাম।
কিছুসময় পর আমি কি জানি ভেবে লিপির খোঁজে বের হইলাম। ডাকতে লাগলাম লিপিরে। ভাই, মনে এতো রাগ লাগতেছিল যে লিপিরে খুঁজে পাই না, দাঁতে দাঁত রাইখা- লিপির বাচ্চা লিপি কই গেলি!! শেষে দেখি, বেড়ীর উপরে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। আমি ডাক দিলাম, লিপি আসলো-
- কে রে এই মেয়েটা?? তোর সাথে এতো ভাব। তাড়াতাড়ি বল তাড়াতাড়ি বল..
- কেন তোরে কমু কেন?? তুই জেনে কি করবি??
- শুন লিপি, তুই ভাইয়ার কাছে এক জোড়া দুল চাইছিলি না, তোরে কালকেই আইন্না দিমু, বল না, কে এই মেয়ে..
- সত্যি দিবি ত..!! এর আগেও বলছিস দিবি কিন্তু দেস নাই।
- আরে দিমু, দিমু, দিমু। বলছি ত দিমু, তুই বল, কে ও, কোনহানে বাড়ি অগো..??
- আল্লাহ কেমন করতেছে, কইতেছি ত.. ওর নাম ঝুমুর। আমার লগে মাদ্রাসায় পড়ে। বাড়ি মাদ্রাসার পিছনে বেড়ীর উপরে, ঐ যে চুকু মাঝি আছে না হেইতের মাইয়্যা। এবার ক, আমার জন্যে দুল আনবি..?
- তুই এবার কোন ক্লাসে জানি পড়স?? আরে কইছি ত আইন্না দিমু।
- ক্লাস নাইনে উঠছি এবার।
- এখন হুন, ওরে কাইলকাও আমগো বাড়ির এদিকে নিয়া আইবি, বলবি যে কি জানি বলবে ভাইয়া। আমি আজকেই ছবিগঞ্জ হাঁটের তন তোর লাই দুল নিয়া আমু।
- ঠিকাছে, আমি যাই, মা সে কোনসুম থেকে ডাকতেছে।
লিপি দৌড় দিয়া ঘরে ঢুকলো.. আমি জোরে ডাক দিয়া বললাম, মনে কইরা নিয়া আসিস, ঝুমুররে..
মনে হয় একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে- আইচ্ছা।।
ভাই, আমি গিয়া গোসল করলাম। বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি দুই এক শুক্রবার ছাড়া জীবনেও নামাজ পড়ি নাই। সেদিন আমি মসজিদে গেলাম, নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে কইলাম, আল্লাহ আমি যেন ওরে (ঝুমুররে) পাই। মাবুদ আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না, শুধু ওরে আমার করে দিও। মসজিদ থেকে বের হয়ে ঘরে গেলাম, ভাত খাইতে পারতেছি না, শুয়ে থাকতে পারতেছি না, শরীরডার মধ্যে খালি কেমন জানি করতেছিল, কেমনে বুঝাই ভাই, খালি মনে হইতেছে আমার কি জানি নাই..!!
আমি সিগারেট টান দিয়া তারে দিলাম। বললো, ভাই এখন খামু না, আপ্নে খান। কি বুঝে আবার কইল- দেন, দেন। দিলাম, একটান দিয়ে সিগারেট আমারে দিয়া কইল, হুনেন তারপর কি হইছে.. সেদিন রাতে আমি আর গাঙে যাই নাই, মা কয়- কিরে তোর কি হইছে, গাঙে যে গেলি না। বললাম, কিছু না, একটু খারাপ লাগতেছে, ঠিক হইয়া যাইবো। মা গায়ে হাত দিয়া দেখলো। তারপর চলে গেলো। আমি সারাটা রাত একটু ঘুমাইতে পারি নাই, শুধু ভাবছি কাল কি ও সত্যি আইবো, যদি না আসে.. ভাই এসব ভাবতে ভাবতে আর ঘুম আসে নাই। খালি চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ওরে দেখি...। সকালে খেয়েধেয়ে মামাগো বাড়ি যাই, ডাকি, লিপি, লিপি ও লিপি। মামানি ঘর থেকে কয়, লিপি মাদ্রাসায় গেছি। আমি বলি, আচ্ছা মামানি, কখন আইবো??
আর কোন সাড়াশব্দ নাই, আমি এর কিছুক্ষণ পর গাঙে গেলাম। ভাই, কি মাছ ধরুম, আমার মন পইড়া রইছে কখন ঘাটে যামু.. লিপি বুঝি মাদ্রাসা থেকে চলে আসলো, এসে যদি না পাইলো!! আমি ঘাটে ভাগী মোল্লারে মাছ বিক্রি করতে দিয়া সোজা বাড়িতে আসলাম। প্রথমে লিপিদের ঘর তারপরই আমাদের ঘর। এসেই লিপি, লিপি ও লিপি। মামানি ডাক দিল, কিরে ইলিয়াস, মাছ পাইছস কয়ডা?? পাইছি চার হালি। লিপি কই মামানি?? লিপি ত মাত্র প্রাইভেটে গেছে।
আমি আমগো ঘরে গেলাম। হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে আব্বার পুরান সাইকেল দিয়া লিপির জন্যে ছবিগঞ্জ থেকে দুল নিয়া আসলাম। দুল নিয়া বেড়ীর উপরে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আছি, কখন আইবো লিপি, কখন প্রাইভেট শেষ হইবো, ভাই, সময়ই কাটতেছে না, কেমন যে লাগতেছিল, মনে হয় পৃথিবীতে ঘড়ির কাটা আটকায় গেছে.. শেষে অনেক পরে আসরের একটু আগে দেখি লিপি একা একা আইতেছে..আমি দৌড় দিয়া লিপিরে জিগ্যেস করলাম, কিরে, ঝুমুর কই? তোরে না কইছি ওরে নিয়া আসতে...
- ভাইয়া, ঝুমুর আইতে চাইছে। অগো বাড়িতে ঢাকা থেকে ওর বড় দুলাভাই আইছে.. তাই স্যারের তন ছুটি লই আগে আগে চলি গেছে।
- এই ল তোর দুল। তোরে ঝুমুর কিছু কইছে..??
- অনেক সুন্দর। হ, কইছে তুই নাকি হেরে ছাড়া বাঁচবি না। তুই কি সত্যি ওরে ভালোবাসিস ভাইয়া..??
- ওরে লিপিরে তোরে বুঝাইতে পারুম না, আমি ঝুমুররে ছাড়া বাঁচুম না। তুই এখন যা.. ঘরে যা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে.. কাইল মাদ্রাসা যাবি না??
- হ যামু ত। এই বলে লিপি ঘরে ঢুকবে, আমি আবার ডাক দিলাম, লিপি শোন, তোর খাতার কাগজে ভাইয়ার ফোন নাম্বার লিখে ঝুমুর রে দিয়া দিস। আর এই ল ওর জন্যেও একজোড়া দুল আনছি..
ভাই, আমি তখন একটা বাটন সেট চালাই। নদীত গিয়া আমার যা ইনকাম হইত তার পুরাটাই আমি খরচ করতাম, মাঝে মইধ্যে আব্বারে কিছু দিতাম আর মার জন্যে পানটান কিনে আনতাম। তখন বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু খাই না। ভাই, রাইত ত শেষ হয় না, কখন লিপি যাইবো, ফোন নাম্বার দিবো, এসব চিন্তায় ঘুম আইয়ে না। তারপর কোনসুম যে আব্বা ডাক দিল, গাঙে যাইতে, গাঙে গেলাম.. গাঙ থেকে আইলাম দুপুরে.. এখন লিপি ত মাদ্রাসায়, আইবো আসরের সময়। ঘরে গিয়া ঘুমায় পরলাম।
ঘুম থেকে উঠছি সন্ধ্যার সময়। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে আমি ফোন দেখি, যে কোন ফোন আইছে কিনা। কই, কোন ফোন ত আসে নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে লিপি নাম্বার দেয় নাই, নাকি দিতে ভুলে গেছে বোধহয়। আমি তাড়াতাড়ি ওঠে মুখ না ধুয়েই মামাগো ঘরে গেলাম, দেখি- লিপি পড়তেছে.. আমি লিপির পাশে বসলাম, বললাম, কিরে নাম্বার দিসত নি? লিপি বলে- দিসি ত। ফোন দেয় নাই?? আমি কইলাম, কই না ত কোন ফোন টোন আসে নাই।
ভাই, ফোনটা বাজলেই এই বুঝি ঝুমুর ফোন দিছে। যখন দেখতাম না, এটা ঝুমুর না, মেজাজটা যা গরম হইত। আর কথাই বলতে ইচ্ছা হইত না। কি যে করি ঝুমুর কেন ফোন দিতেছে না, ভাবছি, ও ত পারে, ঘরের একটা ফোন থেকে একটু ফোন দিতে। আবার ভাবি, হয়তো ভয়ে ফোন দিতেছে না। এই বলে নিজেরে সান্ত¡না দিতেছি.. আর সারা দিন রাইত শুধু চোখের উপর ঝুমুররে দেখি, ভাই ওরে না পাইলে বোধহয় আমি মরা মানুষ এই রকম অবস্থা আমার।
এইরকম করে বিশাল এক অস্থিরতার মধ্যে আমার দিন কাটতেছে, দুইদিন কি তিনদিন লিপির কাছে ওর কথা শুনতেছি, কি কি বললো, ও নাকি শুধু, আমি কেমন আছি এই কথা জিজ্ঞেস করতো। আর আমি লিপিরে সবসময় বলতাম, ওরে আমগো এদিকে আসতে বলিস, আর বলিস আমি কেমন আছি নিজের চোখে দেইখা যাইতে। আমি দুইদিন ঝুমুর গো বাড়ির ঐদিকে গেছিলাম, কিন্তু ঝুমুরের দেখা পাই নাই। তারপর দুইদিনের জন্যে আমরা পুবের গাঙে গেছি মাছ ধরতে, ভাই, দিন গুলো যে কেমনে কাটাইছি আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে। পরে যেদিন আইছি দুপুরে, সাইকেল দিয়া মাদ্রাসায় গেছি, যাইয়া দেখি ছুটি হয়ে গেছে, পরে আসার পথে লিপির কাছ থেকে শুনি, ও নাকি দুইদিন যাবৎ মাদ্রাসায় আসে না। ভাই, হঠাৎ কি যে একটা খারাপ লাগা আমার ভিতরে শুরু হইলো, আমি ভাবলাম কোন অসুখ টসুক হইলো নাকি। আমি লিপিরে বললাম, লিপি তুই যা, ওর বাসায় যা.. হ, এখনই যা, আর এই ধর তিনশ টাকা, কিছু বিস্কুট টিস্কুট কিনে নিয়া যাইস।
সন্ধ্যার সময় ঘর থেকে বের হইছি। দেখি ঝুমুর আর লিপি আমগো বাড়ির দিকে আসতেছে.. আমি দৌড়ে গেলাম, বললাম, লিপি তুই ঘরে যা..
- আসসামুলাইকুম। কেমন আছেন..??
- আমি যে কেমন আছি, কেমনে বুঝাই তোমারে, রাইতে দিনে ঘুম আইয়ে না, নদীতে, ঘরে কোন জায়গায় মন টিকে না। শুধু তোমার কথা মনে আইয়ে.. তুই কেমন আছো, ঝুমুর??
- আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ওমা! কি কন এগুলা।
- হাছা কইতাছি ঝুমুর, তোমারে ছাড়া আমি বাঁচুম না। আমার জান প্রাণ সব তুমি। মনডা চায় সারাক্ষণ তোমারে নিয়া থাকি।
- হাছা নি.? কয়দিন পর ত ভুলি যাবেন!!
- আস্তাগফিরুল্লাহ। কি কও এগুলা, আল্লাহ না শুনুক। লিপি তোমারে ফোন নাম্বার দিছে..??
- হ, দিছে, কিন্তু ভাবীর ফোন থেকে ফোন দিতে পারি নাই ডরে..
- এই লও, এই ফোন আজ থেকে তোমার। আমি নতুন একটা সিম কিনে লিপির কাছে দিমু। আর আমি বাজারে গিয়া নতুন ফোন কিনে নিমু।
- আইচ্ছা, ঠিকাছে, এখন যাই, ম্যালা রাইত হইছে।
- তুমি কি আজকে লিপিগো বাড়িত থাকবা..?
- হ, থাকমু।
- ঠিকাছে যাও। রাতে দেখা করবো...
এই কথা বলার আগেই ঝুমুর নাই, কি সাত পাঁচ ভেবে আর রাতে দেখা করতে যাই নাই। কখন যে ঝুমুর আমগো এদিক থেকে চলে গেছে নিজেও জানি না।
ভাই, সেদিনের মতন খুশি আমি আমার জীবনেও হই নাই। ঘুম থেকে ওঠেই বাজারে গেছি, ষোলশ টাকা দিয়া একটা নতুন ফোন আর একটা গ্রামীণ সিম কিনে আনছি। সারাদিনে মনে হয় হাজার বার ফোন দিছি, সন্ধ্যার একটু পর ফোন রিসিভ করছে, সেই প্রথম পাঁচ মিনিটের মতন কথা হইছে। ভাই, তারপর থেকে এই ফোনের পিছনে যে আমি কত টাকা খরচ করছি তার কোন হিসাব নাই। দোকানদার দুলাল ঐ যে কাটাখালীর ফ্লেক্সিলোড, ওরে বলে রাখছি- যখনই লোড লাগবে সাথে সাথে লোড দিতে, যত টাকাই হয় আমি দিনকে দিন পরিশোধ করে দিবো।
তারপর থেকে আমার ফোনে কথা কওয়া শুরু, একটু পর পর ফোন দেখতাম ইশ! কখন ঝুমুর মিস কল দিবে, কখন তার সময় হবে। ভাই, এই রকম চুরি করে কথা বলতে বলতে একদিন, ঝুমুর ওর ভাবীর কাছে ধরা পড়ে। আমি ওরে বললাম, তুমি তোমার ভাবীরে সব খুলে বলো। ও ভাবীরে সব বলছে, মিছা কথা কমু না ভাই, ওর ভাবী যথেষ্ট হেল্প করছে। তারপর থেকে আমাদের কথা বলা আরো বেড়ে গেছে.. খালি মনডা চাইত কখন ঝুমুররে কাছে পামু, একটু আদর করমু।
কত কথা যে ফোনে বলতাম, ভাই, আল্লাহ জানে এতো কথা কই থেকে নাযিল হইত। আমি ওরে নিয়া ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম, বলতাম, বেড়ীর উপরে আমাগো ঘরের পাশে আমাদের একটা নতুন ঘর হইবো, আর একটা নৌকা করবো, দেইখো- দুজনে কত সুখে থাকবো। ও শুধু বলতো, আল্লাহ, তাই যেন হয়।
ভাই আমি যেমন কইরা কইতাছি, আপ্নের তেমন কইরা লেখতে হইবো না, আপ্নে আপনার মন মতন সাজাই সাজাই সুন্দর করে লেখবেন।
একবার বলতে চাইছিলাম- ভাই, আমি ত লিখতেই জানি না, তারপর গুছিয়ে আবার সুন্দর করে কেমনে লিখবো!! তাও কোথাও কোথাও আঞ্চলিক আর বইয়ের ভাষায় গুরুচন্ডালী হয়ে যাচ্ছে।
তারপরও লিখছি, ইলু ভাই, আপনি বলেন...
২.
পরের কথা আর কইতে ভালো লাগতেছে না ভাই। আরেকটা সিগারেট ধরান। আমি সিগারেট ধরাই, এক টান দিয়া, ইলু ভাইরে দিলাম।
মনে মনে ভাবছি, ইলু ভাই যদি আর না বলে, আমি পাঠক রে কি বুঝ দিমু..!! এই পর্যন্ত শেষ.. পাঠক তো তা মেনে নিবে না। গল্পের শেষ চাইবে..
হঠাৎ ইলু ভাই বলে উঠলো...
ভাই, তারপরে আর কি কমু!! আমি ওর জন্যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম, এই জীবনে বহু কিছু আমি ওরে দিছি, শুধু এই পোড়া কলিজাডা খুলে দিতে পারি নাই, যদি দেওয়া যাইত, তা ও দিয়া দিতাম। ইলু ভাই দেখাইলো, বুকে আর হাতে এসিড দিয়া পুইড়া ‘ঊ+ঔ’ লিখছে। বললাম, ভাই কেমনে সম্ভব!! ভাই হাসে আর কয়, একটুও কষ্ট হয় নাই। বলে, আমি জানতাম, ও আমারে মন থেকে ভালোবাসছে.. আমিও ওরে প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবেসে ফেলছিলাম। তার কারণেই সব পারছি ভাই, আরো যে কত কি করছি, এতোকিছু আপনারে না কই, আপনার লিখতে কষ্ট হইবো।
আমি বললাম, আরে না, ইলু ভাই, আপনি বলেন.. সব লেখা হয়ে যাচ্ছে..তারপর কি হইলো, বলেন না, শুনি...
তারপর আর কি কমু ভাই। আমি দেখলাম ইলু ভাই তারপরের কাহিনী আর বলতে চাইতেছে না, জোর করবো? না। করলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সিগারেটে টান দিয়া নদীর পানিতে ফেললো ফুস করে একটা শব্দ হলো। তারপর বললো ভাই, শুনেন..
- হ্যা, আমি শুনতেছি... আপনি বলেন..
এরপর ঝুমুর অনেক বার লিপিগো বাড়িত আইছে, আমি ওরে নিয়া মাঝ রাইতে নৌকার ভিতর শুইয়া ছিলাম অনেক রাইত শুধু আমি আর ঝুমুর, ভাই নদীর নৌকা আর নোনতা এই গাঙের পানি সাক্ষী .. এই ত, এই যে এখানে এই নৌকায় সারারাত আমরা নদীতে ভাসতাম, যদিও এসব কিছুর পিছনে লিপি যথেষ্ট হেল্প করেছে, ওর কারণেই সম্ভব হইছে।
ভাই, সত্য কইতাছি ঝুমুরের সাথে আমার সব হইছে.. বুঝছেন ত..?
- হ্যা, আমি বুঝছি, আপনি বলেন...
তারপর একদিন হুনি আমার বিয়া ঠিক হইছে। কবে, কই, কার সাথে কিচ্ছু জানি না। আমি মনে হয় আকাশ থেকে পড়লাম, আমার বিয়া আমারই খোঁজই নাই.. অথচ মেয়ে দেখাও নাকি হয়ে গেছে.. ঐদিনই আমি ঝুমুররে সব বলছি, ঠিক করলাম, আমরা পালিয়ে কোথাও চলে যাবো। ঝুমুর বলছিল, তুমি আমারে যেখানে নিয়া যাবা আমি সেখানে যাইতে রাজি এবং সবসময় এক পায়ে রেডি আছি।
আমি ওর কথা শুনে, হাসলাম।
ভাই, ভুলডা আমারই হইছে, আমি ঐদিন ঘরে শুয়ে শুয়ে কথা বলছিলাম, মনে হয় আব্বা হুনছে..
রাতে কথাটথা শেষ করে কখন যে ঘুমাইছি, ঘুম থেকে ওঠে দেখি আমার হাত পা সব চকির সাথে বাঁধা। পাশে ফোনও নাই..(পরে হুনছি ফোন নাকি আব্বা ভাইঙ্গা গুরা গুরা করে পানিতে ফালাইছে।) আব্বা বেড়ীর উপর থেকে চিল্লাইয়া কয়, ওর বান্ধন কেউ খুলবি না। যে খুলবি ওর কল্লা কাডি হালামু। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কাল রাতে ত ঝুমুররে বলছি আজকে বিকেলে লঞ্চ ঘাট থাকতে আমরা ঢাকায় চলে যামু। এখন কেমনে কি!! কিচ্ছু না বুঝেই আমি চোখ বুজে মারে ডাকলাম, সব ঘটনা খুলে বললাম।
-মা কয়, এই সম্পর্ক তোর বাপ জীবনেও মেনে নিবে না, হয় তোরে কাইট্টা নদীত ভাসাই দিবে।
- আমি কইলাম, তাহলে তাই করো, কাইট্টা কও নদীতে ভাসাই দিতে, মা খালি কাঁদতেছিল..
বললাম, ঝুমুর রে না পাইলে এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ। ভাই, এই কথা শেষ হইতে না হইতেই আব্বা বেড়ীর ঢ্যালে বেগুন ক্ষেত নিড়ানি দিতেছিল, ঐ কোদাল দিয়েই আমার মাথায় এক বাড়ি। তারপর মনে হয় আমি মরা গেছি, আমার কোন হুশ নাই..
(পরে জানছি, আমি যখন মায়ের পেটে তখন একবার গাঙে চুকু মাঝি নাকি আমগো জাল কাইট্টা নিয়া গেছে। এই নিয়া অনেক ঝামেলা হইছে, এলাকায় বিচার সালিশ শেষে থানা হাজত পরে নাকি মামলা মোকদ্দমাও হইছে। চুকু মাঝি নাকি কুড়াল নিয়া আব্বারে মারতেও আইছিল। ঘুস দিয়া আব্বারে জেলে পাঠাইছে... আমার জন্মের পরও ঘরে প্রচুর অভাব ছিল, এক বেলা খাইতে পারছি কি পারি নাই, মানষের বাড়িত গিয়া ভাতের ফেন খুঁজে খুঁজে মা আমগো সংসার চালাইছে..)
যেদিন আমার হুশ হইছে, মনে পড়ছে (ঝুমুররে যে বলছি) বিকেলে লঞ্চঘাটে যাইতে আমরা ঢাকা যামু। এর পর দেখি আমগো ঘরে লিপি, ভাই, আমার মামাতো বোন লিপি এখন আমার বিয়া করা বউ। আমি নাকি এই মুখ দিয়া কবুল বলে বিয়া করছি, খাতায় সই করছি। ভাই, বিশ্বাস করেন আমার মাথায় তখন কোন সেন্স ছিল না। আমি অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা ছিলাম। তারপর, আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করতে পারি নাই। আমাদের নাকি বাসারও হইছে। শুধু মায়ের মুখের দিক চাইয়া আমি আর কিচ্ছু করি নাই। ত ভাই, মাঝে মাঝে মনে চায়, এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ। এই যে দেখতেছেন বাঁইচা আছি, বিশ্বাস করেন ভাই, আসলেই আমি বাঁইচা নাই, যেদিন হুশ হইছে (ঝুমুরের কথা মনে পড়ছে) ঐ দিন থেকেই আমি মরা। জীবনেও ভাবি নাই, আমার জীবনডা এই রকম হইব। ভাই, বেশি স্বপ্ন দেখছি ত..
- ইলু ভাই, আসলে কি দিয়া আর কি বলে আমি আপনারে সান্ত¡না দিবো, আমি আসলেই বুঝতেছি না।
- আরে না, ভাই, ঠিক আছি। তো দেশের অবস্থাটা একটু ভালো হইলে আর গাঙে একটু মাছ পড়লে দুইচোখ যেদিকে যায়, সব ছাড়ি সেদিকেই চলি যামু.. মামতো বোন লিপিরে দেখলেই আমার কেমন জানি লাগে, ভাই। আর ভাল লাগে না, পোলাডার দিকে চাইয়া এখনও রইছি..
- আমি বললাম, ঝুমুরের সাথে কথা হয়নি আর??
- ভাই, আপনি নিজেই কন, কোন মুখে আমি ওর সাথে কথা কই! না, আর কথা হয়নি। ত, হুনছি খুবই ভালো জায়গায় ওর বিয়া হইছে। এখন চর জহিরউদ্দিন থাকে। স্বামীর বেশ ভালোই জায়গাজমি আছে, গরু মহিষ আছে, নৌকা আছে, ও আছে, হয়তো সুখেই আছে।
- আমি কি বলবো, বলার মতন কোন কথা খুঁজে পেলাম না। শুধু মনে মনে ভাবলাম- আসলেই সত্য, এই রকমই হয় মানুষের জীবন। মানুষ নিত্য ভালো থাকার অভিনয় করে আর এই ভালো থাকতে থাকতে এইভাবেই হয়তো কেটে যায় মানুষ জীবন
- ভাই, বাদ দেন এসব। এই লন সিগারেট লন। চলেন, আপনারে নিয়া আজকে গাঙে যামু..।
- আমি বললাম চলেন, যাই....।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেম বুঝিনি বলে...
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
প্রেম বুঝিনি বলে...
যাকারিয়া মুহাম্মদ
রোকসানার সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল ঠিক। তবে সেটা আদৌ প্রেমের সম্পর্ক কি-না, ঢের আলাপ আছে। অবশ্য ঝকঝকে একটা প্রেমের গল্প আমাদের হতে পারত। সে সুযোগ ছিল। যেখানে রোদ থাকত, মেঘ থাকত, আলো-আধারের খেলা থাকত।
আমাকে সে-ই প্রথমে প্রেমের প্ররোচনা দিয়েছিল। আমি তখন নতুন কিশোর। প্রেম নিয়ে ভয়-কৌতুলহ দুই-ই কাজ করত একসাথে বুকের ভেতর। সে সুযোগ পেলেই আমার আশপাশ ঘুরঘুর করত, অকারণ। চুপেচুপে আমাকে দেখত। এবং জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত আমার আসা-যাওয়া পথের দিকে। আসলে সে কী চাইত, তখন ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে পারত না অপরিণত বয়স আমার।
একদিন জানালা দিয়ে আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল সে, সে জানালা কাঠের বানানো ছিল, কোনো শিক ছিল না তাতে, তাই মাথা বের করা যেত কী এক কারণে পেছন ফিরে তাকাতেই তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলি। তখন থেকে আমি অন্যরকম কিছু অনুভব করতে থাকি। এক তুমুল ঝড় যেন আমাকে এলোমেলো করে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে প্রেম বুঝতে শুরু করি। নিজের চেহারা, স্বাস্থ্য, জামাকাপড় ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ওঠি।
একদিন তার আশকারা পেয়ে দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে চাচির কাছে ‘ধরা খাই’। এটা আমাদের সম্পর্কের প্রথম বাধা। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, যেন একটা ফুল ফুটবার আগেই ঝরে যেতে থাকে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। যে-কারণে দীর্ঘ দিন দূরে থাকি, তার থেকে।
এর অনেকদিন পর দ্বিতীয়বার একইভাবে ‘ধরা খাই’ আম্মার কাছে। ফলত এপথে আর একটুও এগোনো হয়নি আমার। বরফে ধাক্কা খাওয়া টাইটানিকের মতো আমার জমানো প্রেম, খুচরো স্বপ্ন সবকিছু ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এবার এতবেশি ভয় পাই যে, আমার মনে কোনোদিন আর প্রেমের দখল চলেনি। তখন থেকে প্রেম জড়সড় হয়ে বুকের কোনো এক কোনায় বসে থাকে, এখনো যা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
এরপর আমি পাল্টে যেতে থাকি। যে-প্রেম শুরুর আগে এত প্রতিবন্ধকতা সামনে তার কী হবে, ভেবে শঙ্কিত হই। আর কোনোদিন প্রেমের চিন্তা মাথায় না-আনবার শপথ করি। অবশ্য পরে আরো বছর খানেক সময় রোকসানা ‘চেষ্টা’ করেছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। আমার কিশোর মনের শপথকে একটুও টলাতে পারেনি তার কিশোরী মনের আহ্বান।
এখন যখন রোকসানার বিয়ে হয়ে গেছে। ভাবি, তখন যদি আরেকটু সাহসী হতাম! গল্পটা অন্যরকম হতো হয়তো।
ছাতক, সুনামগঞ্জ
পদাবলি : ০১
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
মায়াবিনী
তামীম আল আদনান
আমাদের দেখা হলো
দুজনের চোখে থমকে গেলো সময়
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিলে একাকার হয়ে গেলো উত্তরের বাতাস।
তুমি চলে গেলে;
অথচ কথা বলার তীব্র পিপাসা নিয়ে আমি অনন্তকাল দাড়িয়ে আছি
এ-ই পথের দূর্বাঘাস, হলুদ পাখি, সোনালুফুল- সবাই এখন আমার ভীষণ পরিচিত।
কেবল অপিরিচিত্তের নোটিশ দিয়ে চলে গেলো একজোড়া মায়াবিনী চোখ।
পরম সুন্দর
নবী হোসেন নবীন
একটি সুন্দর বৃত্ত হতে আরও সুন্দর
আর একটি বৃত্ত আঁকা যায় না।
একটি গোলাপ হতে অধিক কোমল
আর একটি গোলাপ বৃন্তে ফুটে না।
চাঁদের স্নিগ্ধতা ছুঁয়েছে যে
সেই বোঝে জোছনা কতটা নরম।
আকাশের নীলিমা হতে অধিক নীলিম
আর কী আছে পরম?
চোখের জানালায় মনান্তরে দেখেছে যে
মনের আয়না
সেই বোঝে নদীর সুরতে নারী হতে সুন্দর
আর কিছু হয় না।
বৈষম্য
হুসাইন আহমদ
অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোমাকে পড়ছি
তুমি মূলত কী?
তোমার আদি উৎস কোন গহনে?
সহিফা কিংবা ক্বাদিম কিতাবের
পাতা ত নও বে শক
একটা স্থিতিশীল ঘোরের নাম দেই
প্রগলভতা
তারপর ছায়া ছুঁই
পালক ভেজা রাতে ভিষণরকম মায়া ছুঁই
অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোমাকে পড়ছি
মেয়ে চোখ মেলো, দ্যাখো-
পোড়াবসন্তে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় পীতাভ বর্ণের ঢেউ
আমাকে চিনেছে
পারভেজ হুসেন তালুকদার
আমাকে চিনেছে তটিনীর জল কলকলে ছুটা ঢেউ
চিনেছে সাগর চিনেছে পাহাড় তোমাদের কেউ কেউ
জীবন জেনেছে এই হৃদে জুড়ে কতটা স্বাধীন বেগ
আমাকে চিনেছে পাহাড়-চূড়ায় ভেসে থাকা সাদা মেঘ।
আফসোস নেই ক্ষুদে এই মনে তবুও অচেনা আমি
আকাশের কাছে চেনা এই মন নীলেদের মত দামি
আমি অচেনার দলে মিশে থাকি যারা চিনে চিনবার
নিশ্চিত যারা চিনে এই হাসি তারা প্রেমী কবিতার।
যুথীকে মিস করি
সৈয়দ নূরুল আলম
আয় বৃষ্টি আয়, আকাশ ভেঙে যখন-তখন
কুয়া-ডোবা শুকিয়ে আছে,
তৃষ্ণায় ছটফট।
উদাস মন উদাসী, ভিজতে চায় খামখেয়ালি
বন্ধুর খোঁজে বন্ধু আসবে জোসনা ভরা রাতে
বৃষ্টি হলে ধুয়ে মুছে যাবে
তোমার যত অহংকার।
তুমি আর, সেই তুমি নেই।
খুব মিস করি তোমাকে।
শূন্যতা
স্বপন গায়েন
হৃদয় তট শূন্য মরুভূমি
শিউলি ফুল, কাশের দোলা
সব আঁধার কেটে যায় তোমার আগমনে।
শিশির বিন্দুর অলীক স্পর্শে জেগে ওঠে ভোর
আলোর মিছিল শহর থেকে গ্রাম-
সব শূন্যতা কেটে যায় এক লহমায়।
মরা মানুষ বেঁচে ওঠে তোমার পদধ্বনির শব্দে
হৃদয়ের উপকূল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়
কিন্তু সে তো ক্ষণস্থায়ী।
সারা বছরের জমা কান্না কাব্য হয়ে যায়
শূন্যতা থেকে মুক্তি নেই মানুষের
তবুও তুমি আসবে বলে প্রহর গুনি প্রতিদিন।
পদাবলি : ০২
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
রূপালী ইলিশের উপকথা
দীপঙ্কর ইমন
মাঝ পথে কথা থেমে যাবে সব
এমন কি অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠে স্বপ্ন দেখার বৈদিক তিথী।
রূপালী ইলিশ; চোখ বন্ধ করবে কি?
সমুদ্রে ধরেছে ফাঁটল... জল শুঁকাবার অপেক্ষায় আহত ঈশ্বর।
আবার মাছরাঙা খেয়ে নিবে ইলিশের সুস্বাদু দেহ
নিরব মৎস বিভাগ
ঝুলবে মুখস্ত তালা, দায়সাড়া মনিহারি।
আবার সব কথা থেমে যাবে
মাছরাঙার রাজত্বে ইলিশের চোখ বুঁজে যাবে
স্বয়ংক্রিয়।
পূর্ণিমার জোৎস্নারা আবারও ধর্ষিত হবে
বারোমাসি আমাবশ্যায়।
জীবনের আলপনা
এ বি ছিদ্দিক
ঠিক বিষুব রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে
নৈমিত্তিক মুদ্রার পরিপাকতন্ত্র পরখ করি!
কাঁধে গার্হস্থ জোয়াল...
একটু আগপাছ হলেই দর্শনীয় যাদুঘর!
হলদে রঙের শাড়িতে ঝিঙে ফুলের রঙ
উপভোগ করার সময় থাকবে না এতটুকু!
চিরহরিৎ বৃক্ষ যেমন ঠায় দাঁড়িয়ে
তুগলকী ইতিহাস বিদ্যার পাঠ দেয়
ঠিক তেমনি নীল বাতিঘরে রান্না হয় সাত নম্বর ডাল!
প্রশস্ত বুকের জমিনে এঁকে যাই জীবনের আলপনা।
ভালোবাসা রঙিন, ভালোবাসা ধূসর!
তাওহিদ ইসলাম
ভালোবাসা রঙিন। অনবদ্য। প্রাণময়।
বেঁচে থাকার কারণ।
হাজারটা স্বপ্নের পর বিনম্র মিলন। ইচ্ছেদের অপ্রাপ্তির আধাঁর মুক্ত।
কখনো বা ধূসর!
ধূসরিত মলিন। অনাপ্রাপ্তির সুখ।
অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস মৃত্যু অব্দি।
অপূর্ণতার সাক্ষী।
অপেক্ষা, কান্না, আক্ষেপ বেলা ফুরিয়ে যাবার সাথে বয়স বৃদ্ধি।
শারিরীক প্রত্যাবর্তন। পাল্টে যাওয়া সব। পৃথিবীর রঙ। তবুও পুড়তে থাকা।
পিছুটান হয়ে ভুলতে না পারা।
স্মৃতির আদলে ভুলে যাওয়া মানুষটিকে সযতেœ আগলে রাখা।
একটু অদ্ভুত!
এই গল্পখানা ভালোবাসা।
ভালো সবাই বাসে। বাসতে চায়।
মনের ক্যানভাসের এক কোণে আগলে রেখে দিতে চায়।
আজন্মকাল। কেউ পেয়ে ধন্য হয়। পবিত্র বন্ধনে রবের দুয়ারে মাথা নত করে।
আবার কেউ?
ধূসরিত আক্ষেপে যাতনার সাগড়ে ডুবুরি হয়। মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে স্মৃতি চারণ।
কান্নার জলে নির্বিকার চিৎকার!
আহা!
ভালোবাসা দয়াহীন। কি নির্মম!
অতএব। এক জীবনে রব বিনে কাউকে ভালোবাসতে নেই। দুঃখজলে ডুবুরি হতে নেই।
কাফনে মোড়া জীবন
সুশান্ত হালদার
ঈগল থাবায় জীবন
তিন টেক্কায় জুয়াড়ি রেখেছে হাত
ভবঘুরে জীবন মেপেই চলে পথ
অথচ সময়ের হাত ধরে
ঈশ্বরকে ভ্রুকুটি করে চলে এক বদ্ধ উন্মাদ
চৈতন্য বোধে
যাদের কেটে যায় জীবন নির্দ্ধিধায়
পুকুর ভর্তি জলে তাদের কিইবা আসে যায়?
নদী প্রেম আচ্ছন্নতায় জীবন তুচ্ছ মনে হয়
অথচ পাতাঝরা রাত্রির কান্নায়
জেগে উঠে ফিলিস্তিন ইসরায়েল হামলায়
ঋষি বেশ
হাতে বজ্র চিহ্নিত তাসখন্দের আকাশ
মরুঝড়
হুঙ্কারিত বাংলাদেশের অবরুদ্ধ বাতাস
বুকে কুরুক্ষেত্র
সারাদেহে হিংস্র ব্যাধের ক্ষতবিক্ষত শরাঘাত
তবুও কাফন মোড়া জীবন আমার
দ্রোহে নজরুল
প্রেমে হাফিজ
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা উত্তর ‘বাংলাদেশ’!
আমেরিকান কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
আমেরিকান কবি
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
অনুবাদ : আকিব শিকদার
পরিচিতি
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ১৯৪২ সালের ২২ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক সিটিতে জন্ম গ্রহন করেন। বাবা ড্যানিয়েল গ্লিক, আর মা বিয়েট্রিস গ্লিক।
তাঁর কবিতা অন্ত-কথন ধর্মী। মনেহয় যেন তিনি সরাসরি পাঠকের মুখোমুখি বসে পাঠকের সাথে কথা বলছেন। তাঁর কবিতায় আছে আত্ম-জিজ্ঞাসা, মানসিক সংঘাত, মৃত্যু, আকাক্সক্ষা ও প্রকৃতি প্রেম। তিনি দুঃখ ও একাকীত্বকে প্রকাশ করেছেন খোলামেলা-ভাবে। গ্রীক ও রোমান মিথোলজী আছে তাঁর কবিতায়।
লুইস গ্লিক সমসাময়িক কবিদের মধ্যে অন্যতম শুদ্ধ ও সফল গীতিকবি। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ফার্টসবর্ন’ বের হয় ১৯৬৮তে। ১৯৯৩ তে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে তিনি ১২তম সম্মানিত মার্কিন পোয়েট লরেট মনোনীত হন। কবিতার জন্য নোবেল পান ২০২০ সালে। তার কবিতাকে সরল ও সৌন্দর্যময় সুস্পষ্ট কাব্যিক কণ্ঠস্বর বলে আখ্যা দিয়েছে নোবেল কমিটি।
স্মৃতি
একটা অসুখ আমাকে ধরেছিলো
কী কারণে তা কেউ বলতে পারেনি।
যদিও দিনে দিনে জটিলতর হতে থাকলো রোগটা।
কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো স্বাভাবিক চলাফেরার অভিনয়, যে ভাবে
বুঝাবো সবাইকে ভাল আছি, আনন্দময় যাপিত জীবন...
পরবর্তী মুহূর্তগুলো এমন হলো যে, আমি শুধু
তাদের সংশ্রব চাইতাম যারা অবিকল আমারই মত;
খুব খেটে খুটে তাদের খুঁজে বের করতাম,
সহজসাধ্য ছিল না কাজটা।
তারা সবাই ছিলো আড়ালে, অচেনার আঁচল টেনে।
অবশেষে কিছু সহচর পেয়েছিলাম খুঁজে
যাদের সঙ্গে সময়ে-সময়ে আমি হাঁটতাম।
নদীর তীর ঘেসে একেক জনের সাথে, অকপটে আবার
কথোপকথন শুরু হলো, যা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম...
প্রায়ই আমরা থাকতাম নির্বাক। যা কিছু বলি না কেন
সব কথা ফেলে নদীটার কথা বলতে বেশী ভাল লাগতো...
নদীটির দুই কূলে লম্বা জলছোঁয়া তৃণলতা কেঁপে ওঠে
প্রশান্তিময় তরঙ্গের মতো শরতের সমিরনে।
আর মনে হত এই পরিবেশটা আমার আশৈশব চেনা।
যদিও আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে কোন নদী ছিল না,
শুধুমাত্র গৃহ আর আঙ্গিনা।
হয়তো তাই প্রত্যাবর্তণ করছিলাম আমি সেই সময়ে
যে সময় আমার শৈশবের পূর্ববর্তী,
হতে পারে বিস্মৃতির অতলে ঢাকা
এই সেই নদী যার কথা আমার স্মরণে আসে।
তৃষ্ণার্ত পাখি
পাখিটি আসে খুব প্রভাতে।
ডাকে এমন করুণ স্বরে, যেন তার
আপন জনের মৃত্যু হয়েছে।
অথচ কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই
তার সঙ্গী পাখিটি ফিরে আসে হন্তদন্তের মতো।
আমার হৃদয় একটি তৃষ্ণার্ত পাখি, যে প্রতিনিয়ত
ডাকছে প্রিয়ার নাম।
অথচ আমার প্রিয়া কোনোদিন
রাখে না তার পা আমার আঙিনায়।
কালো সোনা
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
কালো সোনা
মোহাম্মদ আবদুর রহমান
প্রিয়া কলেজের সেরা সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে একজন । সে সব সময় নিজের রূপ নিয়ে গর্ববোধ করে । তার রূপের আকর্ষনে প্রভাবিত হয় অনেকে। কেউ কেউ সমর্পন করে তার প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু সে কোন দিন কারো ভালোবাসার ফাঁদে পা দেয়নি । সব সময় বট বৃক্ষের মত মাথা উঁচু করে থাকে ।
প্রিয়ার বাবা তার জন্য অতিসাধারণ পরিবারের একটি ছেলেকে পছন্দ করেন । ছেলেটির শরীরের রঙ কালো হলেও দারুন নম্র স্বভাবের। তাকে পছন্দ করার আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ আছে। ছেলেটি জীবনে পড়াশুনার সময় ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি । তারপর ছেলেটি কলেজের নিয়োগের প্রাথমিক পরীক্ষায় সফল হয়েছে । ইন্টারভিউয়ের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছে । অর্থাৎ এই পরীক্ষায় সফল হলেই সে কলেজের অধ্যাপক হবে ।
প্রিয়া ছেলেটিকে মোটেই পছন্দ করেনা। সে কত স্বপ্ন দেখেছে তার স্বামী হবে যেমন সুদর্শন পুরুষ তেমনি তার ভালো থাকবে আর্থিক অবস্থা। কিন্তু ছেলেটি তার বিপরীত । বাড়ির সকলের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয় প্রিয়া । কারণ তার তো কোন প্রেমিক নেই যে তার সাথে পালাবে । তার ভেতর ভেতর অনুশোচনা হয় যদি সে অহংকার না করে আগে থেকে একটি ছেলে খুঁজতো তাহলে এমন অবস্থা হত না । নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে । তার চোখের সামনে সব কিছু যেন ঘন কালো আবরন ঘিরে ধরেছে। স্মৃতির ছেঁড়া পাতা গুলি এলো মেল ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মনের পর্দায়। আর তার মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে- কি ভাবে মুখ দেখাবে বন্ধু বান্ধবীদের ? তার সব স্বপ্ন তাসের ঘরের মত এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল ।
বিয়ের প্রথম রাতে ছেলেটিকে কাছে দেখার পর তার মনের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠে। আর সেই আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে চাই ছেলেটিকে এবং তার পরিবারকে । ছেলেটি প্রথম দিন কিছু মনে করে নি । ভেবেছে বাড়ি ছেড়ে এসেছে বলে সে এমন করছে। কিন্তু যতই দিন যায় যেন প্রিয়ার মনের ভেতর আগুন আরও অনেক গুণ বেশি হয়ে জ্বলতে থাকে । যেন পরিণত হয় এক ভয়ংকর জন্তুতে।
ছেলেটির ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বের হয় কিছু দিন পর । আর তাতে সে অসফল হয় । তা শুনার পর প্রিয়া আর সে বাড়িতে থাকার ইচ্ছা করেনা । কি দেখে থাকবে সে । কিবা পাওয়ার আছে ছেলেটির কাছ থেকে । তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল । যেন সে কারাগারে বন্দি। সে চাই মুক্তি সেই কারাগার থেকে। তাই তার জন্য ছেলেটির উপর করে অনেক অনেক নির্যাতন । কিন্তু সব নির্যাতন নীরবে মাথা পেতে নেই ছেলেটি। তা ছাড়া কোন উপায় নেই । ছেলেটি তো প্রিয়ার বাহ্যিক কোন চাহিদা পূরণ করতে পারেনা টাকার অভাবে । তবে সব সময় সে তার সাথে ভালো ব্যবহার করে । কোন দিন কোন ছোট কথাও বলেনি । কিন্তু এ সব প্রিয়ার মনের ভেতর প্রভাব ফেলতে পারেনি । অপরাধীকে তো শাস্তি পেতে হবে । একটা আয় নেই বিয়ে করেছে । একে বারেই অপদার্থ । এ সব মনে মনে ভাবে প্রিয়া ।
ছেলেটির পরিবারের লোকজন বুঝতে পারে প্রিয়ার মানসিক অবস্থা কত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে । তাই তাকে তালাক দিতে বলে । কিন্তু সে তার পরিবারকে বলে মানুষের বিয়ে একবার হয় । আমি মনে করি সে একদিন নিশ্চয় বুঝতে পারবে আমাকে । সে দিন থেকে আমরা নতুন ভাবে শুরু করব সংসার । আর যদি সে ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমি একা থাকবো চিরকাল । কোন দিন অন্য কোথাও বিয়ে করবো না । যে সব কথা শুনার পর পরিবারের অপজনেরা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। বলে তোর যা ইচ্ছা কর ।
কয়েক মাস কোন রকম এভাবে অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রিয়া ছেলেটিকে ছেড়ে চলে যায় তার বাপের বাড়ি । ছেলেটি যেন পাগলের মত ঘুরে বেড়াতে থাকে এদিক- ওদিক । সব সময় প্রিয়ার প্রতিচ্ছবি তার চোখের সমানে দেখতে পায় । আর সে যেমন ধরতে যায় তখন এক মুহূর্তে বিলিন হয়ে যায় । এই ভাবে কাটতে থাকে তার দিন। তার নিজেকে এত নগন্য মনে হয় যে তার বাড়ির পাশের রিক্সাওলার থেকেও থেকেই নগন্য । রিক্সাওলাও কিছু চাহিদা পূরণ করতে পারে। সে পারেনা তার স্ত্রীর সামান্য চাহিদা পূরণ করতে। তখন সে ভাবে তার বেঁচে থেকে লাভ কি ? সে আত্মহত্যা করার জন্য মারিয়া হয়ে উঠেছে । যেন তার ভাগ্যের চাকা কাদায় আটকে গেছে যা শত চেষ্টার পরও নড়ানো যায়না। আবার মনে করে আত্মহত্যা করলে তো সব শেষ । পৃথিবীর প্রত্যেকটা উপাদান ধিক্কার দেবে আমাকে । বলবে কাপুরুষ তাই সে আবার জেগে উঠে।
হটাৎ করে ছেলেটির বাড়ি যায় সোনালী। সোনালী তার ছোট কালের খেলার সাথী। সোনালি তার প্রতিবেশী ছিল। তারা এখন বড় শহরে থাকে । ছেলেটির শরীরের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে তার কোন না কোন সমস্যা হয়েছে । সে জানে তার কোন সমস্যা হলে তার একটা মানসিক অস্থিরতা দেখতে পাই। যা সে এখন দেখছে। সে জানতে চাই তার সমস্যা কি ? প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে সব বলতে শুরু করে । চোখের জল গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে। যেন তার দুঃখের বাঁধ ভেঙেছে যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করা সম্ভব নয় । সোনালী সব কথা শুনার পর সে ভরাকান্ত হয়। আর তাকে অনেক বুঝবার পর ছেলেটিকে তাদের শহরে নিয়ে যায় । যা খরচ হবে সোনালী দিবে । চাকুরী পেলে সব টাকা পরিশোধ করে দেবে । আসলে সোনালী তাকে কিছু দিন সময় দিলে সে সফল হবেই। আর সোনালি পরামর্শে সেখান থেকে সে আবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ।
অপর দিকে প্রিয়া তার বাড়ি যাওয়ার পর ভাবতে থাকে ফেলে আসা জীবন নিয়ে । সে কি কোন ভুল করেছে ? নাকি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে । উত্তর যায় হউক। বাড়িতে কেউ তাকে দেখতেই পারেনা । সবাই তাকে দায়ী করছে । ছেলেটি একবার অসফল হয়েছে বলে সে কোন দিন সফল হবে না তা তো আর ঠিক নয়। তাই সে বাড়ি থেকে তার দিদির বাড়ি চলে যায় ।
ছেলেটি কিছু দিন পর আবার ইন্টারভিউ দিতে যায় । আর সে দেখতে পায় তার স্যার ইন্টারভিউ নিতে এসেছে । স্যার আশ্চর্য হয়ে যায় যে তার চাকুরী এখনো হয়নি । আসলে ছেলেটি ছিল ওই স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যার তার চাকরি না পাওয়ার করুন অবস্থা দেখে বলে বাড়ি যা। এবার তোর চাকুরী হবেই । আমি সব ব্যবস্থা করব ।
সময় মত ফলাফল বের হয়। দেখে সে সফল হয়েছে এবং তার চাকুরি হয় পাশের কলেজে। তখন সে যেন বেঁচে থাকার পথ পায়। যেন সফলতার ঘাটে সুখের নৌকা লেগেছ । চোখের সামনে সুখের শহর দেখতে পাচ্ছে । সুখের পায়রা গুলি ডানা মেলে উড়ে আকাশের দিকে । ছুঁয়ে ফেলে যেন চাঁদকে । আর তার চিৎকার করে বলার ইচ্ছা হচ্ছে আমি আর ডাসবিনে পড়ে থাকা নোংরা আবর্জনা নয়। সফলতার উজ্জ্বল ইমারত । যেন তার আটকে থাকা ভাগ্যের চাকা চলতে শুরু করেছে দ্রুত গতিতে । সোনালী যেন তার ভাগ্যের চাকা চলতে সাহায্য করেছে । তাই সে সোনালীর কাছে চির কৃতজ্ঞ ।
প্রিয়া কিছু দিন যাওয়ার পর দিদির বাড়ি থেকে ফিরে আসে । আসলে দিদির বাড়িতে তো আর বেশি দিন থাকা যায়না । মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে । তাই সে স্থির করে যে সে নিয়মিত কলেজ যাবে এবং ডিগ্রি শেষ করবে। সে তার বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করে । সে জানতে পারে কয়েক জন নতুন অধ্যাপক নিয়োগ হয়েছে । তাদের মধ্যে এস.আই স্যার অনেক মেধাবী । সব কিছু যেন মন মত বুঝিয়ে দেয় । যেন বন্ধুর মত সব কিছু বলতে পারে সবাই । তাই কয়েক দিনের মধ্যে সকল ছাত্রছাত্রী তার ফ্যান হয়ে গেছে ।
কয়েক দিন পর প্রিয়া কলেজে যায় । কিন্তু যেতে দেরি হয়ে যায় । দেখে তার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে । তাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আসতে করে বলে - আসতে পারি স্যার ।
তার কন্ঠ স্বর শুনার পর এস.আই স্যারের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরন জাগে । সে তাড়াতাড়ি তার দিকে তাকায় । আর অপ্রস্তুত ভাবে বল -আসো । কারণ মেয়েটি আসলে তার স্ত্রী প্রিয়া । যেন সবার সামনে চিৎকার করে বলে দেখ আজ আমি আজ হয়েছি । এর পর তোমার সকল চাহিদা পূরণ করতে পারব । চলো বাড়ি চল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে তার স্ত্রী যদি মেনে না নেয় । সে তো তাকে স্বামী হিসেবে মানেনি কোনদিন। এমন কি সে তাকে নগন্য ভেবে ছেড়ে চলে গেছে । তাছাড়া সে তো এখন স্যার । সুতরাং তাকে সংযত থাকা উচিত। তাই সে কোন রকম নিজেকে সংযত করে আবার পড়াতে শুরু করে ।
স্যারের দিকে তাকিয়ে প্রিয়াও আশ্চর্য হায়ে যায় । স্যার তো তার স্বামী সফিকুল ইসলাম। আগে বুঝতে পারেনি এস.আই স্যার যে তার স্বামী যখন বান্ধবীদের মুখে শুনেছিল । আসতে আসতে সে ক্লাসের ভেতরে শেষ বেঞ্চে বসে । লজ্জায় যেন তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে । যাকে সে স্বামী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাইনি সে আজ তার সকল বন্ধু বান্ধবের ফেবারিট স্যার। অথচ তার স্বামী কোন দিন একটিও ছোট কথাও বলেনি তাকে । যার পরিচয় বন্ধুদের সামনে কি ভাবে দেবে ভাবছিল সে তো আজ জনপ্রিয় অধ্যাপক ।
প্রিয়ার এক এক বার মনের ভেতর গর্ব হচ্ছে । সে তো তার আমার স্বামী । আমাদের এখনও তালাক হয়নি । প্রয়োজন হলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। কিন্তু আবার আশঙ্কা হচ্ছে সে যদি তাকে আপমান করে । না গ্রহণ করে । নানান প্রশ্ন মনের ভেতর বিচরণ করছে । তবে তার বাবার সিদ্ধান্তটি অকপটে স্বীকার করছে যে আসলেই তার স্বামী কালো সোনা যা সে চিনতে ভুল করে ছিল । ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ছেলেটির দিকে ।
মালদা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।