পদাবলি

পদাবলি



চাহিদা
শোয়াইব শাহরিয়ার

যেতে বললে যাবো। তার আগে একবার তোমায় ছুঁয়ে দেবো।
তার আগে একবার তোমার শহরে বৃষ্টি নামাবো
শুষ্ক মাঠে জন্মাবে ফল আর ফুল
সৌরভে তুমি পাগল হয়ে উঠবে।

বলো, এই জন্মে আমরা ভালোবাসা ছাড়া আর কি-বা চাইতে পারি ?

জীবন-বসন্ত
হাসান নাজমুল

বসন্তের বৃক্ষশাখা হতে যেমন শুকনো পাতা-
ঝরে পড়ে মৃত্তিকার’পর,
আবার শুন্যতা ভরে দিতে বেড়ে ওঠে-
আরেক জীবন;
আলো দ্যাখে নতুন বিশ্বের;
আমিও শুকনো পাতার মতন ঝরে যেতে চাই-
এ বসন্তে; আর বসন্ত-বৃক্ষের শাখায়
বুনো হাওয়ায় উদ্দাম জীবন নিয়ে-
ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠতে চাই বসন্তদিনে,
জীবন শাখায় শুকনো জীবন-
শুকনো পাতার মতো খসখসে মনে হয়,
তাই শুকনো জীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে-
এ বসন্তদিনে জীবনকে বসন্ত বানিয়ে-
জীবন-বসন্ত শাখার শুন্যতা ভরে দিতে চাই।

হাসি
সাবিকুন শুভা

ঠোঁটের ফাঁকে শুভ্র এনামেল
একটু পর পর দৃশ্যমান ইনসিসর;
তুষারের পর্বত ভেবে হারিয়ে যাবার পালা,
দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়-
মাঠ-ঘাট, শহর-বন্দর, গাছপালা
                 লোকালয়ের কোলাহল।
থাকে কেবল তুষারের পর্বত,
দু’টি গোলাপি ফুলের মৃদু ওঠা-নামা।

প্রিয়তমেষু
হোসনা মুরাদ

আর কতকাল অপেক্ষা করলে
তোমার একদৃষ্টি ভালোবাসা পাবো ?
আর কত বিনিদ্র রাত কাটালে
হঠাৎ দেখা দিবে তুমি স্বপ্নের ভোরে ?
আর কত ঝুম বৃষ্টি হলে
তোমার কলম লিখতে শুরু করবে
একটা প্রেমের কবিতা ?
তোমাকে যে ভাবি সারা দিনমান...
তোমাকে যে আমার বড় প্রয়োজন
হে প্রিয় !!!
মনে আছে সেই হিরণ্ময় বিকেলের কথা ?
তুমি বলেছিলে-
তোমার মতো করে কেউ নাকি
ভালোবাসবে না আমায় এই নশ্বর পৃথিবীতে ।
হুম; সত্যিতো আদ্যোপান্তে তুমি আমার
তোমার মাঝে আমার সূর্য উঠে,
দিন গড়িয়ে রাতঘুম দেই তোমায় ভেবে ।
তোমাতেই খুঁজে পাই আমি আমাকে
বিষন্ন আমি লুকিয়ে থাকি সন্তর্পনে
তুমি যে আমার আনন্দ আশ্রম ।
জানো ?
আমি এখনো তোমায় চিঠি লিখি
প্রতি রাতে একটা করে
সেই পুরোনো কথাই বার বার লিখি
তোমার প্রতি আমার অদৃশ্য ভালোবাসা
তোমার মাঝে আমার মুক্তি
তোমাতেই শক্তি ।
উত্তর পাব না জেনেও
জুড়ে দেই সাথে কিছু না বলা অভিমান, অনুযোগ, আবদারের কথা ।
অথচ ভুল ঠিকানা বলে চিঠিগুলো কড়া নেড়ে
ফেরত আসছে পরেরদিন
ঠিকানা কি আসলে ভুল ছিল,
নাকি তুমি কপাট খুলোনি ?
আর কত?
আর কত চিঠি লিখলে তোমার উপেক্ষার মান ভাঙবে?
আমার বুঝি কষ্ট হয়না প্রেরক হয়ে প্রাপক হতে ?
যদিওবা ঠিকানা ভুল হয় চিঠিগুলো কিন্তু ভুল নয়!
অনন্তকাল চিঠি লিখে যাবো আমি...
যদি তুমি একবার প্রাপক হও
তোমাকে যে আমার বড় প্রয়োজন
হে প্রিয় !!!!



তুমি, কেন এত বেশি কৃত্রিম ?
রেবেকা ইসলাম

তুমি, কেন এত বেশি কৃত্রিম ?
ওই যে সেদিন অপরাহ্ন শেষে
নেমে এসেছিল বেলোয়াারি আকাশ
ঝুল বারান্দার ভাঙাচোরা কোণে,
তারপর শোনা গেল দ্রৌপদি মেঘের
কিছু কালজয়ী চরণ
দীর্ঘক্ষণ,
তুমি তা বোঝনি, আমি বুঝেছি।

কেন তুমি এত বেশি কৃত্রিম?
সেই ধুন্ধুমার রাতে বটবৃক্ষের সাথে
গাঢ় জ্যোৎস্নার মুখোমুখি প্রেম,
ডালে ডালে আলোর তীব্র আন্দোলন
নতমুখি পাতাদের ফিসফিস
বুকের ওঠানামা, কম্পন
দীর্ঘক্ষণ,
তুমি তা শোননি, আমি শুনেছি।


মরীচিকা
সাদ সাইফ

অদ্ভূত আঁধারের শেষ প্রহর,
নিদ্রালু চতুর্দিকের গুমট ভাব নিমিষেই উধাও
আনমনেই ধায্যা বেরিয়ে আসে;
আলোর দীপ্তশিখায় রঙিন মখমল
নিমীলিত তৃতীয় চোখে শ্বেতপরীর দেশে।

শব্দাধিষ্ঠানে আসে নগরপালের হাঁক;
মুহুর্তেই কৃত্রিম ভূবনের অসমাপ্ত প্রস্থান,
স্খলিত লাঠির মুহুর্তবাহুতে দৈব অবস্থান।

নগরপালের হাঁক নীরবে ক্ষীণতায় পর্যবসিত
দ্বিবিধ মধ্যমলোক; ভাঁলকে বাঁশের নমনীয়তায় গাঁথা।

ইস্পাত অথবা তৎসম শক্তের পূঁজারি !
শুচিবাই; ইতস্থত সিদ্ধান্ত,
দুরাচারির বপু সিঁদুর রঙাগার
রঞ্জিত করার কৃত্রিম বাসনা,
নাহ্! করমূক; মানবতার ধ্বজা বক্ষজুড়ে
ফিরে আসি শ্বেতপরীর কল্পঘরে।


দেবদারু
রাহাত রাব্বানী

সকালের বয়স বেড়ে বেড়ে দুপুর হয়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, গোধূলির মৃত্যু লিখে দেয়-
সন্ধাধ্বনি। রাতের কোলে মাথা রেখে সন্ধা ঘুমায়।
দেবদারু বৃক্ষ প্রিয় সহচর করে তোমার বাসার মোড়ে-
বিরামহীন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে আমার মস্তিষ্ক, দুটি চোখ;
একবার তোমাকে দেখবে এই প্রত্যাশা। তুমি তার-
কিছুই জানো না, কিচ্ছু জানলে না। অথচ-
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দেবদারু জানে
আমার মস্তিষ্ক, যুগল চোখ, আমি কতোটা প্রেমিক!



মনোজ টান
অভিজিৎ মান্না

নির্জন পথে অনুকূল হাওয়া বইছে
ওখানে মেঘেরাও হালকা হয়
ব্যস্ত জনপদ শোনে না
রঙের কৌটো গড়ায় মাঝ রাস্তায়
ধাক্কা খেতে খেতে পৌঁছে যাওয়াটাই শ্রেয়
ত্রিমাত্রিক ক্ষোভ শীতল হবেই- তুমিও এসো ।
  

কবিতার বারুদ
পবিত্র মহন্ত জীবন

আমার বুকের ভিতর কষ্টঘোচা গুলো
দাউদাউ করে জ্বলছে! জ্বলতে দাও!
মূর্তির বেশে আমিও চলছি আর বলছি
আমার স্বাধীনতা আমার কাছে
জ্ঞান ও বিশ্বাস ঘনিষ্ঠ  মিশ্রিত পদার্থ
এবং সর্বত্রই স্বাগত আমি শুদ্ধ;
বিশুদ্ধ বায়ুতায় হর্ষে উদ্ভাসিত আজ এখনো
এইভূমে কবি ও কবিতার বারুদ,
আমি কবি আজো কবিতাকে বলি-
শব্দাংশ বারুদের চাষ কবি হয়নি নিরাশ।




ক্ষণিক আভাস
নাফছি জাহান

পূর্ববর্তী নৈসর্গিক রূপের বাহার
নির্জন পথ ধরে, অৎ¯্র পর্দা পাড়ি দিয়ে
গভীর অন্ধকারে মিশে ঝরে যাচ্ছে রুদ্ধ বেদনার কূপে,
অসহায়ত্বের বেদনাময় রেখা টেনে
বিমুগ্ধতার সুর তুলে, ভেসে যাচ্ছে দূর কোনো প্রান্তরে।
বিলীন হওয়া নৈসর্গিক রূপের বাহার-
ক্ষণিকের তরে ফিরে আসার আভাস দিয়ে
মিষ্টি স্বপ্নে বিভোর করিয়েছিল,
বর্তমান আজ মিশে আছে
মলিন সবুজে, তীব্র খরা বহন করে।
তীব্র অত্যাচার উজ্জ্বল সবুজকে
আহ্বান করেছিল অন্ধকার মৃত্যুর পথে,
রৌদ্রেরা ভিড় করত, মিষ্টি আলোর সমাহার সঙ্গী করে।
অতিশয় সৌন্দর্যপূর্ণ কারুকার্যে ঘেরা ছিল,
পৃথিবীর দূর দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হারিয়ে যাওয়া পূর্ববর্তী নিসর্গ।
বাংলার এই সবুজ, সেই মৃত্যুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে
ধূসর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে
এতটুকু পরিমাণ বিলম্ব করেনি,
ক্ষণিকের বেঁচে থাকার আভাস চক্ষুর সম্মুখে তুলে ধরেছিল।
ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া পাখির মত ধ্বংসের আহ্বানে পা বাড়িয়ে
হৃদয়ের শব্দহীন পথে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে।

অবনিতা
সাঈদ চৌধুরী

খুব নির্জনে হেঁটেছেন কখনও
জিজ্ঞেস করছিলাম নতুন পরিচিত হওয়া অবনিতাকে
সে বলল, হেঁটেছি তবে এমন করে নয়
জিজ্ঞেস করলাম কেমন করে
এই যে আপনার সাথে দুজন মিলে একা হাঁটা !
বসন্তের পাতাগুলো মারিয়ে যাওয়ার শব্দও প্রতিধ্বণি হয়
দুজনের মধ্যে দূরুত্ব অনেক
এখনও আপনিতেই সীমাবদ্ধ
দুজনের মনেই প্রশ্ন তবে কেন তুমি বলাবলি হচ্ছে না
আমি ডাকলাম অবনিতা
তিনি বললেন “এবার কিন্তু অন্যরকম লাগলো আপনার ডাকটি”
আমি বললাম কেমন বলেনতো
নির্দ্বিধায় অবনিতা বলল “খুব আপন”
আসলে এমন নির্জনে দুজন থাকলে এমনিতেই দুজন আপন হয়
খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম কেন যেন
বুঝতে পারছিলাম অবনিতাও
হাঁটছি খুব দূরের কোন রাস্তায়
ক্লান্তির সময় নারীদের একটু এলিয়ে যাওয়া
অবনিতার মধ্যেও ¯পষ্ট হয়ে উঠছিল
সে আমার কাঁধে মাথা রাখতে চাইছে
কিছুক্ষন পর যখন খেয়াল করলাম তখন হাতে হাত রেখে হাঁটা
একটি নির্জন পথ কখন ভালোবাসায় ডোবালো বুঝলাম না
আজ রাতেও অবনিতা আমার শোবার ঘরে
তার শাড়ীর আচল মেলেই আমাকে ধরে আছে....


জটোচ্ছেদ
পরান জহির

কোন শব্দ নেই। কোন অর্থ নেই। নেই কোন উপমা। নাম-উপনাম । আমরা বিশুদ্ধ ভালোবাসা, বিশুদ্ধ প্রেমের গোলাপ কিনতে চাই। চাই ফুলের ভিতর শান্তির বসতি গড়তে। সাজাতে চাই ফুলে ফুলে, পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল। আমরা আমাদের রেখে যেতে চাই তোমাদের হৃদয়ে। আমরা আমাদের তৃষ্ণা মিটাতে নিয়ে যেতে চাই তোমাদের হৃদয়। আমাদের স্বপ্নের মাটিতে যে বৃক্ষটি শাখা মেলে, আমরা তাকে আমৃত্যু ভালোবেসে যতœ দেই। গাই বৃক্ষসুলভ স্বাধীনতার অপার মুক্তির গান। কোনো প্রকার কলুষতা যেন ছিন্ন করতে না পারে আমাদের পারস্পারিক হৃদয়ের বন্ধন। তাই-রক্তের ভিতরে হেঁটে গিয়ে আমরা রক্তকে শাসাই...

জানিতো-
হৃদয় যতো বড় হয়, মানুষ ততো বড় নয় !

একটি নিরপেক্ষ সকাল এবং আমাদের জাতীয় সংগীত
শৈলেন চৌনী

০১. হাতুড়ির মতো মুহূর্তদের পরেই আমাদের যখন সকাল হয়
বাবা ‘সা রে গা মা পা’ ছেড়ে জাতীয় সংগীতে মন দেন
০২. বেঁচে থাকার যাবতীয় টুকু জুড়ে এক সাদা খরগোশ ছুটে বেড়ায়,
চারদিকে আমাদের সারাদিন শুধু মৃত্যুর আওতায়,
কেবল অবসাদের নিদ্রায় আমরা জীবিত হয়ে উঠি-
০৩. কোনো কোনো দিন এমন হয় দারুণ হেমলক চাখনা
জমতে থাকে স্থবির বিষাদে,
সুর ও সুরেলা স্বরলিপি সহ পুড়ে বিষাদের আঁচে,
আমাদের সেদিন জানা থাকে আজ শনিবার-
০৪. প্রতিটি কথার মধ্যে ঢুকে যায় বিষাদ
যেভাবে ঝাউপাতার ফাঁক দিয়ে হু হু করে ঢুকে পড়ে শোক-
ঠিক তখনই, আমি ভ্রমন শুরু করি, নদীর মতো-
০৫. নিয়ত রোদরাত্রি, ঝড় বাদলা পেরিয়ে
যখন মাতাল হই রাত্রি বেলায় আর, শীলাবতীর বুকে পা ঝুলাই-
বলতে ইচ্ছে করে- ‘ফাক দি রুলস্ এন্ড রুলার্স’ রাষ্ট্র আমার ছিঁড়ে নেবে ।





দীর্ঘ পদাবলি : ঘুম পালানো রাত

দীর্ঘ পদাবলি : ঘুম পালানো রাত


ঘুম পালানো রাত
নূরে জান্নাত

আমরা কেউ’ই ঘরে নেই,
অথচ সবাই জানে
আমরা ঘরেই আছি।
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকির আলো,
শিশিরের আলিঙ্গনে সারা দেওয়া
ধান ক্ষেত, আলপথ মারিয়ে
গ্রাম্য মেলায় পৌছে গেছি।
আমি টানছি মাটিতে বিছানো
ছোট খাট বইয়ের দোকানের দিকে;
তুমি অন্য!
তোমার মুষ্ঠিতে চেপে ধরা
আমার হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হলাম।
তুমি নানান রকম টিপের দিকে
আঙ্গুল তুললে...
আমি বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালাম।
পর পর লিপিষ্টিক, নেইল পলিশ, অন্যান্য
সাজ সরাঞ্জামের দিকে ইঙ্গিত করলে...
আমি ঝটকা মেরে ছারিয়ে নিলাম
তোমার বিশাল হাতের মধ্য থেকে
লিক লিকে লম্বা আঙ্গুল গুলো
হন্নে হয়ে আমাকে খুঁজছ !
পিপাসায় হাতে তুলে নিয়েছো
চপ বিক্রেতার ড্রামের উপরে রাখা
একাধিক জনের অধর ছোঁয়ানো
স্টিলের তেল চিট চিটে
পানি ভর্তি গ্লাস।

তোমার যুগল অধর পানিকে আলিঙ্গনে
অদম্য আগ্রহী..
ঠিক প্রথম চুম্বন মুহূর্তের মত।
হঠাৎ পেছন থেকে কাধে হাত পরায়
চমকে বিষম খেয়ে বসলে।
আমি তোমার মাথায় হালকা করে
তিনটি চাপর দিয়ে আদী যুগী
দাদী নানীদের মত বললামÑ সাট সাট।
কাজ হলো না, অবস্থা বেগতিক!
তোমাকে দাড় করিয়ে পিঠে
হাত বুলিয়ে আবারো বললামÑ সাট সাট।
শুনেছি এরকম করলে এবং এই শব্দ বললে
কেউ বিষম খেলে সেরে যায়।
তোমার চোখ দুটো লাল; টলমল জল!
চায়ের টংয়ে মাচালে পাশাপাশি বসে,
বিস্কিটের প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে
২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ বাল্বের ঘোলাটে
হলদে আলো এসে পরেছে
আমার ডান চোখের কোনের
তিল টির উপরে।

লুকিয়ে তুমি বার বার আমায় দেখছো..
আমি বুঝেও না বোঝার ভানে রত।
চায়ের দাম চুকিয়ে ফিরে এসে
দেখি তুমি নেই!
আমি জানি ৯টায় পুতুল নাচের
২য় শো শুরু হলে তুমি ঠিকি
পাশে থাকবে।
অপেক্ষা করলাম, পাশে তুমি নেই!!
দুটো বাচ্চাকে টিকেট দিয়ে
সিদ্ধান্ত নিলা পুরো মেলা
একাই ঘুরে দেখবো।
হঠাৎ কোত্থেকে কাধে কাধ মিলিয়ে
চলতে শুরু করলে!!
এক সময় তোমার ডান হাত
আমার মৃত ও নিথর বাম হাত
চেপে ধরে বার বার বলাÑ
‘আমার হাতের উপর পৃষ্ঠে
তোমার আঙুল গুলো একটি বার
হেলিয়ে দাওনা প্লিজ !
বিরক্তিতে মৃত হাত থেকে
সরে গেল জীবিত হাত।
গোল হয়ে বসা কিছু
মানুষের দিকে এগুচ্ছিলাম।
ওদের মুখ থেকে ধোওয়ার কুন্ডুলী
নির্গত হচ্ছিল।
আবারো নির্লজ্যের মত শক্ত করে
আমার হাত ধরলে!
আমি বড় বড় চোখে তোমার দিকে তাঁকাতেই..
তুমিও কড়া চোখে ডানে বামে
মাথা নাড়লে শব্দহীন।
কিছুটা অবাক হলাম তোমার কর্তৃত্বে!!
প্রশ্ন করলে...
বাড়ি যাবে না ? ঘুমোবে না ?
উত্তরে...
আজ আমার ঘুম পালানো রাত।
আমার চোখ বন্ধ তোমার নির্দেশে।
কিছু অনুভব করছিলাম,
চোখ খুলে হাত ভর্তি নানান রঙের
কাচের চুড়ি দেখে..
তোমার চোখে চোখ রেখে
অধর দুটো ডানে বামে প্রসারিত করলাম।
তুমি আমার হাসি দেখে ছোট বাচ্চাদের
কান্না শেষে যেমন দীর্ঘশ্বাসে ফুঁপিয়ে ওঠে,
তেমন ফুপিয়ে উঠলে।
সামনে এগিয়ে দিলে নির্মলেন্দু গুণের
‘প্রেমের কবিতা গুচ্ছ’।
আমার উচ্চারিত..
লজ্জ্বা, শরম একটু কম’ শব্দ গুচ্ছে
তুমি ভ্রু কুচকিয়ে বললেÑ
মানে?
- নির্মলের।
পড়েছো নাকি?
-হু।
সব গুলো কবিতা?
-কয়েকটা কবিতা, তাতেই বুঝেছি
উনার লজ্জ্বার মাত্রা।
তবে মনে ধরেছে উনার উপেক্ষা, প্রশ্নাবলী,
ফুলদানী, ভয়, মানুষ, পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু
কবিতা গুলো।
.আর আমাকে?
-লিখালিখির বিশেষ উপকরণ হিসেবে।
আমাকে ভালোবাসো না ?
-অন্য সব মানুষের মতই।
সবাই আর আমি.....?
- প্রতিটি মানুষই আমার লেখার উপকরণ।
অতশত বুঝিনা..তুমি আমার কবে হবে?
-সবাই আমার, আমি সবার নই, আমি কেবল
আমারই।
‘জানি কল্পনা ভর করায়
ঘুম পালিয়েছে।
আর এমন ঘুম পালানো রাতেও
আমি ঘুমোতে চাই।
তাইতো কুপি নিভিয়ে, ডায়রি বন্ধ করলাম।
আঙ্গুলের খাঁজ থেকে
কলমকে ছুরে দিলাম
হাতের কাছে থেকে অনেক দূরে !






গল্প : বাবু

গল্প : বাবু


বাবু
পারু পারভীন

ক্যাম্পাস থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে বাবু। আজকাল তেমন আগ্রহ করে খায় না। খাবারের পরিমাম ও কমে গেছে। কী হলো ছেলেটার?
ওর ভাত খাওয়া দেখছি আর ভাবছি।এখন বিকেল হয়ে গেছে।দুপুরের ভাত এ অবেলায় খাচ্ছে তাই?
: আর একটু ভাত নে।
: জোর করো না তো মা,
:বমি বমি লাগছে।
: কী হয়েছে রে তোর?
:ভার্সিটিতে ওঠার পর ঠিক মত খাস না।
:রাত জাগিস।
: যাও তো ঘ্যাণ ঘ্যাণ ভাল লাগে না।
: পারলে আমাকে কিছু টাকা দাও।
: কি হবে টাকা দিয়ে?
পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্যবসা করব।
:কিসের ব্যবসা?
:ডালের

আমি ভাবলাম এখন ডালের দাম চড়া তাই হয়তো মসুরের ডাল কিনে পাড়ার দোকানদারকে দেবে কিছু লাভের বিনিময়ে।কাওরান বাজার যখন বাসার কাছে। পাইকারী মালের আড়ত।
আমার ভাইরা এমন মৌসুমী ব্যবস করতো।ওদের হাত খরচ চলে যেতো।

কে জানতো ডাল মানে ফেনসিডিল। সর্বনাশ হবার পর জেনেছি।ওর বন্ধুরা এসবের ব্যবসা করে।ওকে মাঝেমধ্যে খেতে ওদেয়। বিনে পয়সায়। থানার পুলিশদের হাত করতে বাবুকে কাজে লাগায়।ওর চাচার নাম ভাঙ্গায় এ কাজে।

 একদিন রাতে ঘরে ঘরে অস্থির হাঁটছিল।আমি এশার নামজ পড়ছিলাম। কিছু একটা বলবে মনে হলো।
: কি রে কিছু বলবি?
আম্মা এবার সত্যি সত্যি ব্যবসা করব কিন্তু।কিছু টাকা লাগবে।আব্বার কাছে রোজ রোজ হাত পাততে ভাল লাগে না।

আমি এবার গজগজ করে উঠলাম।
: দেখ বাবু আমাকে আর বিক্রি করিস না। কত আর মিথ্যা বলবি শুনি?

আমার কথা শুনে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।ও কলেজে ওঠার পর সিগারেট খেত লুকিয়ে। এখন নিজের রুমে খায়।ধোঁয়ায় সারা ঘর ভরে যায়।
এমন অবাধ্য হয়ছে যে বললেও কাজ হয় না।ওর বাবা আমাকে দোষ দেয়। আমি নাকি ছেলেটার মাথা খেয়ে ফেলেছি।

টাকা পয়সা নিয়ে বাবা ছেলে প্রায় কথা কাটাকাটিতে যায়। বাবুটা দিন দিন মার মুখো হয়ে উঠছে।
ওর বাবার প্রতি অভিমান ক্ষোভে রূপ নিয়েছে।ঠিক মত ক্লাসে যায় না।
মাথায় চেপেছে বোতামের ব্যবসা করবে।
জিজ্ঞেস করলাম,
:কি বোতাম রে বাবু?
:নারিকেলের মালার?

আমার মেয়েটা বাবু একটু আড়াল হলে বললো,
: আম্মা তুমি এত বোকা কেন?
:ও ইয়াবাকে বোতাম বলছে।

আমি মাথায় হাত দিয়ে বসেরইলাম অনেক্ষণ।

আমাকে আসলেই বোকা বানাতে চাইছে। জমানো টাকা এখন আর আমার কাছে থাকে না।আগে চেয়ে নিতো।এখন রান্না ঘরের যেখানে যে কৌটায় রাখি না কেন ও চুরি করে নিয়ে যায়।
ওর বাবার পকেটেও হাত দেয়।বোনটাও শখ করে কিছু জমাতে পারে না।দে দে করে নিয়ে নেয়।কি করে ও এত টাকা দিয়ে?

প্রশ্নের উত্তর মেলে যখন সেমিস্টার ফি জমা না দিয়ে রাঙামাটি চলে যায় তখন।
তিনদিন পর ফিরে আসে জবাফুলের মত চোখ
লাল করে।ফোন করে অবশ্য বলেছিল রকিবের বোনের বিয়েতে যাচ্ছে।তিনদিন পর ফিরবে।

আজকাল অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মেয়েটা প্রায় বলে ওর বন্ধুগুলো সুবিধার না।আমিও দেখি সুবিধার না।ওর বাবা সেই কবে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে ওর সাথে।আমরা টাকা চেয়ে আনি।
:বাবু ক্লাসে যাবে টাকা দাও।
: বাবুর মা তুমি কি জানো বাবু যে ক্লাসে যায় না?
শুধু শুধু টাকা দিয়ে তুমি ওর জীবনটা ধ্বংস করছো।


বাবু আসলেই ক্লাসে যায় না।তিন সেমিস্টার বাদ গেছে।প্রাইভেট ভার্সিটি ওরা টাকা পেলেই হয়।

: সারাদিন বাসায় বসে করোটা কী?
ছেলে কই যায় কী করে এসব খবর নেয়া তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?
: মেয়ের পেছেন পই পই লেগে থাকো
: ছেলেটা কী তোমার সন্তান নয়?
বাবুর বাবার কমন ডায়লগ। কেন সে ও তো এই দায়িত্বটা পালন করতে পারে। নয়টা পাঁচটার ডিউটির দোহাই সেই সাথে যানজট। বাবু ছোট বেলা থেকে একা একা স্কুলে আসা যাওয়া করতো।কোন দিন সমস্যা হয় নি।
আমি মেয়েকে নিয়ে কলেজ বাসা টিউটর এই করতে করতে বাবু ভেসে যায়।
বাবুর বাবার প্রইভেট জব।নট নড়ন চড়ন অবস্থা। বাবু হারিয়ে যায়।
একদিন বাসায় আসলে দুদিন আসে না।
খুঁজতে যাই এ ওর বাসায়। ফোন ধরেনা।বন্ধু গুলাও এমন।
ছেলে বাসায় না আসলে প্রথম প্রথম আমার ওপর চড়াও হতো ওর বাবা।
: ছেলেকে মাথার ওপর তুলছিলে তো খুব।
: এবার বোঝ কত ধানে কত চাল!
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো।এখন কিছু বলে না।চাপা একটা হতাশা বয়ে বেড়ায়।
মেয়েটার ভাল মন্দ নিয়ে ভাবে। আমার মেয়েটা খুব মেধাবী।কলেজে খুব নাম।মেয়েটা একা চলতে পারে না একদম।ওর পেছনে সময় যায়।
এর মধ্যে দু এক বার বাবুর ক্যাম্পাসে গেছিলাম।
উল্টো পথ।যেতে আসতে মেয়ের কোচিং টাইম পার হয়ে যায়।সামনে পরীক্ষা।

এভাবে ছেলেটা হরিয়ে যেতে বসেছে।কাউকে বলি না ঘরের কথা। ছেলে নেশা করে। এটা তো বলে বেড়াবার নয় কিনতু যেদিন বাবুকে ধরে বেঁধে রিহাব দিয়ে আসি সেদিন আমার পুলিশ দেবরটা ফোনে অনেক কথা শুনিয়েছে।

: মান ইজ্জত সব ডুবিয়েছেন আপনারা।

চার মাস পর বাবু ফিরে এসেছে।এখন খুব ভয় পায়।বাইরে যায় না।আমি মেয়েটা নিয়ে বাইরে বের হলে বাহির থেকে তালা দিয়ে যাই।এসে দেখি খাটের এক কোণে উবুজুবু বসে আছে।

ওর বাবাকে দেখলে ভয় পায় আমার পেছনে আড়াল নেয়।
ওর বাবা এখন যথেষ্ট সহানুভুতি দেখায়। ডাক্তার তাই বলেছে।রিহাবে ওরা হাত পা বেঁধে রাখতো।বেদম মারত। একবার ধাক্কা মেরে ওয়ার্ড বয় মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল।
বাবুকে কোন দিন আমরা মারি নি। চার মাসে কী এমন করলো ওরা যে ও প্রায় উম্মাদ হয়ে গেছে।

মেয়েটা সপ্তাহ খানেক বাসায় নেই।সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে চলে গেছে।মেধা তালিকায় ছিল তাই ওর ভর্তি হতে টাকা লাগে নি।অবৈতনিক পড়া শুনা।কিন্তু এ আনন্দ আমাদের বাসাটা জাগায় নি। বাবু শিশুর মত হয়ে গেছে।

অনেক দিন পর বাবুর ঘর থেকে ভেসে আসছে গীটারের টুংটাং।কত বছর পর ও গীটারটা বাজাচ্ছে?খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে।মনে মনে বললাম,
: যে ভাবেই হোক বাবু তোকে ভাল করে তুলবো।

কদিন পর বেবীর জন্মদিন।ও বাসায় এসেছে। ভাইকে অনেক দিন পর গান করতে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা।
: মনে আছে মা বাবুইটা আগে ঠিক এমন গান করতো।
: কী সুন্দর দিন ছিল আমাদের।
: তুমি কিছু চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাবুর ভয় ভীতি কাটতে শুরু করেছে। আমাদের বাসাটা এতদিন পর যেন একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।

বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সাধক কবি হেয়াত মামুদের সাহিত্যকর্ম

বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সাধক কবি হেয়াত মামুদের সাহিত্যকর্ম


বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সাধক কবি হেয়াত মামুদের সাহিত্যকর্ম
জাহিদ হোসেন

কবি কাজী হেয়াত মামুদ রংপুর জেলার অর্ন্তগত পীরগঞ্জ থানাধীন ঝাড়বিশালা গ্রামে ১৬৮০ থেকে ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন দাউদ খাঁ। বাংলায় বার ভুঁইয়াদের বিদ্রোহের সময় উত্তর প্রদেশের গাজীপুর থেকে এদেশে সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীতে সামন্ত নায়ক রূপে আগমন করেন। তাঁর পিতার নাম শাহ কবির, মায়ের নাম খায়রুন্নেছা। কবি কাজী হেয়াত মামুদের পিতা ঘোড়াঘাট সকারের অধীন দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন কবি। রংপুর জেলার অর্ন্তগত পীরগঞ্জ থানাধীন ঝাড়বিশালা গ্রাম সেকালে ‘সুলঙ্গা-বাগদুয়ার’ পরগণার একটি সমৃদ্ধ জনপদ। জন্মভূমির প্রতি কবির ছিল সুগভীর ভালোবাসা। কবির জন্মভূমির বিবরণ ও আত্মপরিচয় দিয়ে ‘জঙ্গনামা’ কাব্যে লিখতে দেখা যায়-
‘শুন ভাই নিবেদন/কহি আমি বিবরণ/যেন মতে রচিনু পয়ার।/এঝার বিশেলা গ্রাম/চতুর্দিকে যার নাম/প্রগণে সুলঙ্গা বাগদুয়ার।/সরকার ঘোড়াঘাট/কি কহিব তার ঠাট/নানান বাজার দেখি যারে।/সে গ্রামে আমার ঘর/আছে লোক বহুতর/ছাত্তাল পন্ডিত বোলি তারে।’
 কবি কাজী হেয়াত মামুদ শৈশবে নিজগৃহে এবং পরবর্তী সময়ে ঘোড়াঘাটে বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করেন। করতোয়া নদী তীরবর্তী ঘোড়াঘাট ছিলো প্রসিদ্ধ নদীবন্দর ও সুরক্ষিত শহর। সে সময় বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিলো ঘোড়াঘাট। বাল্যকাল থেকেই কবি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বিদ্যানুরাগী। তাঁর ভাষাপ্রীতিও প্রশংসনীয়। তিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরবী, ফারসী, উর্দু, ভাষায় অসামান্য ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। ফারসী ভাষা ও সাহিত্যের উপর তাঁর এতদূর দখল ছিলো যে, প্রধানত ফারসী সাহিত্য থেকে তিনি কাব্যকল্পনা গ্রহণ এবং বঙ্গানুবাদ করেছেন। তিনি পাঠ সমাপ্তির পর ঘোড়াঘাটের নায়েব ফৌজদারের অধীনে ‘সুলঙ্গা-বাগদুয়ার’ পরগণার কাজী হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। সে সময় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন বাংলাদেশের শাসনকর্তা।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি হেয়াত মামুদ। ডঃ ওয়াকিল আহমদের মতে, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের কাব্য সাধনার শেষ প্রতিনিধি। কোন কোন গবেষকের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে তার মতো প্রতিভাধর কবি খুব কমই জন্ম নিয়েছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর  শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র গুনাকার (১৭২২-১৭৬০) ও শাহ গরীবুল¬াহ (১৭০০-১৭৭০) এবং পূর্ববর্তী মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আলাওল (আনুঃ ১৬০৭-১৬৮০) ও দৌলতকাজীর (আনুঃ ১৬০০-১৬৩৮) সমসাময়িক ছিলেন তিনি। নৈতিকতার শীর্ষে অবস্থান করে তিনি চেয়েছিলেন সকলকে হিতোপদেশ শোনাতে ও ধর্মের পথে পরিচালিত করতে। মধ্যযুগে যে ক’জন মুসলমান কবি সাজাত্যবোধ এবং স্বীয় ধর্ম ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে আরবি ও ফারসি ভাষায় রচিত ধর্মীয় সাহিত্য অনুসরণে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন কবি কাজী হেয়াত মামুদ তাঁদের মধ্যে উলে¬খযোগ্য। অলংকার প্রাচুর্যে বক্তব্য বিষয়কে অযথা ভারাক্রান্ত না করে সহজ সরল অভিব্যক্তির মাধ্যমে পাঠক সাধারণের সম্মুখে তুলে ধরার প্রয়াসী ছিলেন তিনি। বক্তব্যের সারল্যেই তাঁর কবিকীর্তির শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট। রচনা পরিপাট্যে, রসমাধুর্যে ও সুললিত ছন্দবদ্ধে তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থসমুহ বৈশিষ্টের দাবিদার। সপ্তদশ শতাব্দীর কবি আলাওল ও কবি দৌলতকাজী ছাড়া মধ্যযুগের অন্য কোন মুসলমান কবি রচনা করেন নি কাজী হেয়াত মামুদ অপেক্ষা অধিক সংখ্যক কাব্যগ্রন্থ।


ব্যক্তিগত জীবনে কবি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন বলে তার সবক’টি কাব্যগ্রন্থে প্রাধান্য লাভ করেছে নীতিবোধ ও ধর্মীয় প্রেরণা । পন্ডিতগণের মতে, তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ একজন কামেল ব্যক্তি এবং কাদেরিয়া তরিকাভূক্ত একজন সাধক। তিনি যে সময়ে কাব্য সাধনায় ব্রতী হন সে সময় দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা বিরাট ধ্বস নেমে এসেছিলো। সমাজের এই দুর্দিনে তিনি চেয়েছিলেন মানুষের নীতিবোধ জাগাতে। তাঁর কাব্যসাধনা নিছক কল্পনাবিলাস ছিলো না বরং এক মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি কাব্য সৃষ্টি করে গেছেন। কবি কাজী হেয়াত মামুদ মোট কতটা গ্রন্থ রচনা করেন সে বিষয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকলেও ডঃ মাযহারুল ইসলাম সহ বেশির ভাগ গবেষক তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন চারটি । নিচে কবি কাজী হেয়াত মামুদ রচিত কাব্যগ্রন্থ চারটির নাম ও প্রকাশের সময়কাল উল্লেখ করা হলো-
 (১). জঙ্গনামা বা মহরম পর্ব................রচনাকাল....১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দ/ ১১৩০ বঙ্গাব্দ।
(২). চিত্তউত্থান বা সর্বভেদবাণী............রচনাকাল....১৭৩২ খ্রীষ্টাব্দ/ ১১৩৯ বঙ্গাব্দ।
(৩). হিতজ্ঞানবাণী...........................রচনাকাল....১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দ/ ১১৬০ বঙ্গাব্দ।
(৪). আম্বিয়াবাণী.............................রচনাকাল....১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ/ ১১৬৪ বঙ্গাব্দ।
জঙ্গনামা বা মহরম পর্ব-কাব্যটি কারবালার সর্বজন পরিচিত বিষাদময় ও করুণ কাহিনীকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে। শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয় মানবেতিহাসেও মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক কাহিনী কারবালার বিষাদময় ঘটনা। ১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময় রচিত হয়েছিলো কাব্যগ্রন্থটি। ফারসি ভাষায় বিরচিত মুক্তাল হোসেন বা অনুরূপ কাব্য অনুসরণে রচিত হয়েছে ‘জঙ্গনামা’ কাব্যগ্রন্থ। কাহিনীর কাঠামোটুকু ছাড়া রচনা প্রায় সর্বাংশ কবির নিজস্ব। ‘জঙ্গনামা’-কাব্যগ্রন্থে ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন যথেষ্ট পরিমাণে আছে এর পাশাপাশি কবির চিত্রকল্প নির্মাণ, ভাষা প্রয়োগে কুশলতা, উপমা প্রয়োগে শিল্পবোধ, ছন্দ ব্যবহারে পারদর্শিতা সহজে চোখে পড়ে। যেমনঃ
‘পালঙ্ক উপরে আছে বসিয়া যুবতী
উজ্জ্বল করিচে ঘর শরীরের জুতি,
প্রেম রূপে জুড়িয়াছে কাম পঞ্চসর
বিন্ধিয়া মুসার মন করিল জর্জর।’

এই কাব্যখানি পড়ে ঘোড়াঘাটের নায়েব ফৌজদার অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং কবিকে পঞ্চাশ বিঘা জমি জায়গীর হিসাবে দান করেন।

কবি হেয়াত মামুদ রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থের নাম ‘চিত্তউত্থান বা সর্বভেদবাণী’। ডঃ সুকুমার সেনের মতে, হেয়াত মামুদ ‘হিতোপদেশ’-এ যে অনুবাদ করেছিলেন তা সংস্কৃত থেকে নয়, সংস্কৃত অবলম্বনে লেখা ফারসি কাব্যগ্রন্থ থেকে। নীতিকথামূলক এ কাব্যখানি কবি হেয়াত মামুদের আগে আর কোন কবি ‘হিতোপদেশ’-অবলম্বনে কাব্যগ্রন্থ রচনা করেননি। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, সংস্কৃত হিতোপদেশের ফারসি অনুবাদ হইতে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে যা ‘চিত্তউত্থান বা সর্বভেদবাণী’-নামে পরিচিত। ‘চিত্তউত্থান বা সর্বভেদবাণী’ -কাব্যগ্রন্থটি ১৭৩২ খ্রীষ্টা্েব্দ রচনা করেন। কবির ভাষায়-
‘বিষ্ণু রাম বিরচিত/ছিল পুঁথি নাগরিতে/হিত উপদেশ নাম যার/চারি খন্ডে সেই পুঁথি/বিরচিল দ্বিজপতি/প্রতি খন্ডে নানা জ্ঞান তার।’
কবি হেয়াত মামুদ বহু শ্রম স্বীকার করে রচনা করেছেন ‘চিত্তউত্থান বা সর্বভেদবাণী’ কাব্যগ্রন্থ। কবির নিজের কথায়- সর্বভেদ নামে পুঁথি/শ্রম করি দিবারাতি/বিরচিনু ছাড়িয়া আলিস।/কহি সে সালের কথা/যাতে বিরচিনু পোথা/সন এগার’শ ঊনচলি¬শ। (মুসলিম বাংলা সাহিত্য,পৃষ্ঠা-২৩০)। কবি হেয়াত মামুদ এ কাব্যটি রচনা করেছিলেন মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করে তাদের অজ্ঞনতা দূর করতে। তাই তিনি বলেছেন-
‘যার বিদ্যা নাই সে না জানে ভাল মন্দ
 শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ।’


‘হিতজ্ঞানবাণী’-কবি হেয়াত মামুদ রচিত তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দে এই কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। ‘হিতজ্ঞানবাণী’-কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু ইসলাম ধর্মের বিধি-নিষেধ, ঈমান-আমল, মারেফতি বা আধ্যাত্মিক সাধনা। এই কাব্যে ওজু, গোসল, নামাজ, রোজা, হায়াত, মউত, কেয়ামত ও আখিরাত সম্মন্ধে লিপিবদ্ধ আছে। এই কাব্যটি অনুবাদ না হলেও বিভিন্ন আরবি ও ফারসি গ্রন্থের ভাব অনুসারে রচিত। এই কাব্যগ্রন্থে কয়েকজন নবীর জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কবির নিজের কথায়-
‘ফারছির কথা সব আনিয়া বাঙলাত
পদবন্ধ করি কহে মামুদ হেয়াত।
হিতজ্ঞান বাণী ভাল শুন সর্বজন
মোছলমান হয়া পূজা না কর কখন।
ভূত প্রেত পূজে যেবা মোছলমান হয়া
মহা পাপী হয় সেহি ঈমান হারায়া।’

 এই কাব্যগ্রন্থের শেষাংশে কবির জীবন দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘হিতজ্ঞানবাণী’-ইসলাম ধর্মের মূলতত্ত্ব সমন্ধে একটি উপাদেয় কাব্যগ্রন্থ এবং বাংলাভাষায় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত কাব্য রচনার অগ্রদূত।

‘আম্বিয়াবাণী’-কবি কাজী হেয়াত মামুদ রচিত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে এই কাব্যগ্রন্থটি রচিত হয়। পূর্ববর্তী কবিগণ রচিত অনৈসলামিক নবী কাহিনীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইসলাম সম্মত নবী কাহিনী রচনার মহতী উদ্দেশ্যে কবি হেয়াত মামুদ ‘আম্বিয়াবাণী’ কাব্যগ্রন্থ রচনায় ব্রতী হন। ডঃ সুকুমার সেন বলেন,- ‘‘আম্বিয়াবাণী’-তে ইসলাম শাস্ত্রের পুরান কথা, সৃষ্টি হইতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মদীনা গমন পর্যন্ত বিবরণ আছে। এই কাব্যগ্রন্থই হচ্ছে হেয়াত মামুদের বৃহত্তর রচনা। যতদূর সম্ভব ‘মঙ্গল’ কাব্যের ছাঁচে গড়া। বন্দনা অংশে মাঝে মাঝে বেশ ভালো কথা আছে।’’ গুরু বন্দনায়-
‘একে  একে গুরু বন্দো চরণ আরাধী
পাট গুরু হাট গুরু বাট গুরু আদি।
শিক্ষা গুরু বন্দিব উদ্দিশে দুই পাত্র
রাগরস তালমান শিখাইল তাত্র।’
 ‘মঙ্গল’-কাব্যে দিগবন্দনায় যেমন দিগদেশের দেবদেবীর  উলে¬খ থাকে ‘আম্বিয়াবাণী’-কাব্যে তেমনি  উল্লেখ আছে নানা পীরের। যেমন-
‘পূর্বেতে বন্দিব পীর আব্দুল গফ্ফার
পশ্চিমে বন্দিব পীর আব্দুল সত্তার।
উত্তরে বন্দিব পীর আব্দুল করিম
দক্ষিণে বন্দিব পীর আব্দুর রহিম।’
‘আম্বিয়াবাণী’-বৃহদায়তনের একটি কাব্য। এ ধরনের বৃহদায়তনের কাব্য বাংলা সাহিত্যে খুব কমই রচিত হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু চন্ডীদাস রচিত ‘শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্য। শুধু আকারে বা আয়তনে নয়, কাব্য গুণের জন্যেও বৈশিষ্টপূর্ণ এই ‘আম্বিয়াবাণী’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে মহাকাব্যের ব্যাপকতা ও গভীরতা বিদ্যমান।  এই গ্রন্থ রচনাকালে কবি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়েন। তাই অ¯পূর্ণ অবস্থায় তিনি ইতি টেনেছেন এই গ্রন্থের-
‘একে শেষ কাল তাতে জঞ্জাল অপার
কহিতে না পারি আমি একাধিক আর।’
ডঃ সুকুমার সেন বলেন,- ‘আম্বিয়াবাণীর পরিসমাপ্তি আকস্মিক; তাঁহার জন্য হেয়াত মামুদ নিজের বৃদ্ধ বয়স ও অক্ষমতাকে দায়ী করিয়া বলিয়াছেন,যাহার আরও জানিতে ইচ্ছা হইবে সে যেন মূল বই (কিতাব) পড়ে এবং লিখিতে ইচ্ছা হইলে কিতাব দেখিয়া লিখে।’ এই কাব্যের শেষ ছত্রটি বেশ করুণ ও আবেদনময়-
‘হেয়াত মামুদ ভুণে আম্বিয়ার বাণী
আমি না রহিব পুথি রহিব নিশানী।’
কবি হেয়াত মামুদ ছিলেন একজন শক্তিমান কবি। ফারসি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বিষয়াবলী বাংলা ভাষায় তিনি কাব্য রূপ দান করেছেন। বৃহদায়তনের কাব্য রচনায় শুধু নয়,অল্প কথায় গভীর ভাবদ্যোতক প্রবচনের মতো পদ রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যেমনঃ
‘উচিত বচন মোর মন্দ লাগে তাগে
দুগ্ধ বিষ হৈল যেন পড়ি সর্প মুখে।’
আবার,
‘দুঃখ করি যদি কেহ সম্পদ কামায়
প্রাণ সম করি রাখে না খায় খাওয়ায়।’
আবার,
‘যথা সুপুরুষ তথা সুপুরুষ যায়
জলের উদ্দিশে জল হেট মুখে ধায়।’

তারপর খুব বেশী দিন কবি হেয়াত মামুদ জীবিত ছিলেন না। ১৭৬০ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ের মধ্যে কবি হেয়াত মামুদ ইন্তেকাল করেন।


পদাবলি

পদাবলি


 আমাকে বলা হলো একটি কবিতা লিখতে
জোবায়ের মিলন

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি একটি মাছের অবাধ সাঁতার কাটার কথা লিখেফেললাম

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি একদলা উড়ন্ত মেঘের কথা লিখেফেললাম, যে মেঘের
কোনো দেয়াল নেই, আকাশটাই তার বিশাল বাড়ি

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি ফুটফুটে এক শিশুর কথা লিখেফেললাম, যে শিশু
দুরন্ত চর্কার মতো চঞ্চল ও ঘাসের মতো গাঢ় সবুজ

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি মটরশুটি ও ধনিয়াপাতায় ভরা একটি মাঠের কথা
লিখেফেললাম, যে মাঠে ফড়িং ওড়ে গ্রাম্য কিশোরীর মতো
পেখম দুলিয়ে দুলিয়ে

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি নির্দ্বিধায় একটি বাবুই পাখির আত্মগল্প লিখেফেললাম,
যে পাখির ঠোঁটে শ্রমের সাহস, পাখায় দূরন্ত-লক্ষ্য, চোখে তার
সহস্র শতাব্দির অভিজ্ঞান

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি আচমকাই ‘একুশ’ শব্দটি লিখেফেললাম ইচ্ছে মতো
শব্দের গঠনে গড়নে

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি কাউকে কিছু না বলেই ‘একাত্তর’ শব্দটি লিখেফেললাম
আমার নিজের উচ্চারণ ভঙ্গিতে
আমি ন’মাসের তীব্র যন্ত্রণাক্লিষ্ট একজন মায়ের কথা
লিখেফেললাম গভীর শোকাতুর শ্লোকে

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি চৈত্রের ভোরে উদিত উজ্জ্বল সূর্য্যরে তেজস্বী রৌদ্রের কথা
লিখেফেললাম অবচেতন মনের অন্দর থেকে

আমাকে বলা হলো ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখতে
আমি তেরশত নদী আর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কথা
লিখেফেললাম, যেখানে আমার স্বপ্নের রেণু ও বীজে
অনাহূত হবার কোনো অধিকার নেই পৃথিবীর কোনো খড়কুটোর।






মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ও একটি অনন্য বই

 মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ও একটি অনন্য বই


মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ও একটি অনন্য বই
মাইনউদ্দিন মাইন

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেইসবুকের কল্যাণে আমরা সকলেই মোটামুটি অবগত আছি যে,একুশে ফেব্রুয়ারী,ষোলই ডিসেম্বর, ছাব্বিশে মার্চ আমরা কতটা তাৎপর্যপূর্নভাবে পালন করি।দল মত নির্বিশেষে পালন করার মধ্য দিয়েই বুঝা যায় এই দিনগুলো আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনগুলো কেন পালন করা হয়,কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো এগুলো,কোথা থেকে এলো? এই সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলের জানা থাকা উচিত নিজ দায়িত্বে।তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেইসবুকের কল্যাণেই আমরা দেখেছি, এখনো অনেকেই আমরা জানিনা এই দিনগুলো কি।কিভাবে,কোথা থেকে এলো? শুধু ছোট শিশুই নয়, শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সী সর্বস্তরের কেউ আমাদের নিরাশ করেনি যারা সকলেই অম্লান বদনে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত হাসি বিস্তৃত করে উত্তর দিয়েছে  একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের বিজয় দিবস।যা আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয়।এরকমভাবে দেখা যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের দেশের অনেকেই জানেন না সঠিক ইতিহাস। কি হয়েছিল সেদিন? কিসের জন্য,কাদের বিনিময়ে আমরা আজকে কথা বলছি,খাচ্ছি,ঘুরে বেড়াচ্ছি স্বাধীনভাবে?এইসব ইতিহাস কতজন জানি?হয়ত অনেকে জানি কিছুটা কিন্ত পুরোটা আসলে অনেকেই জানিনা।আবার সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীরা কতটুকু অবদান রেখেছেন সেই তথ্য হয়ত জানি হাতে গোনা কয়েকজন।আমরা জাতি হিসাবে এখনো অনেকটা অনগ্রসর উন্নত বিশ্বের তুলনায়।আর আমাদের নারীরাও এখনো পিছিয়ে আছে অনেক ক্ষেএে।সেই নারীরাই আজ থেকে ৪৭ বছর আগে নিজেদের সন্তান, সংসার কে একপাশে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।সেই অনবদ্য ইতিহাস ও সংগ্রামের কথা অনেকে না জানলেও জানার সুযোগ এসে গেলো যখন তাদের নিয়ে লেখা হলো একটি অসাধারণ বই,"একাত্তর ও নারী "।যা প্রকাশ করেছে বাঙালি।
বইটি লিখেছেন রহিমা আক্তার মৌ।যিনি একাধারে একজন কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় গল্প, কবিতা, ফিচার, কলাম, প্রবন্ধ ও নারী বিষয়ে লেখা লিখে আসছেন। সমাজের নানা অসঙ্গতির ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ আর অবসর সময়কে কাজে লাগাতেই মুলতো তিনি কলম হাতে নেন।২০১৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকার মুক্ত আলোচনা বিভাগে 'একাত্তর ও নারী' শিরোনামে নিয়মিতভাবে লেখাগুলো প্রকাশ হতে থাকে।এই বইটিতে তিনি ষোল জন নারীর কথা বলেছেন যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। বইটিতে শওকত আরা,হালিমা খাতুনদের মত নারীরা যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা দেখে একদিকে যেমন শিউরে উঠেছেন পাশাপাশি তাদের ক্রোধের আগুনে নিজেকে পরিণত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে।
"শেখপাড়া,চব্বিশনগর,ঘোড়ামারা,বোয়ালিয়া,আলকার মোড়সহ আশপাশের গলিতে গলিতে ছিল শওকত আরার কাজ।৭ অক্টোবর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী আর শওকত আরা চারটি ট্যাংক বিষ্ফোরক,কয়েকটি এসএমজি,গ্রেনেড ও গুলির ম্যাগাজিন ভর্তি ট্রাকটি নিয়ে কোর্ট এলাকা থেকে ঘোড়ামারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।রাস্তায় পাকসেনারা তাদের অনুসরণ করতে থাকে।শওকত আরা যে যুদ্ধের সাথে জড়িত,এই খবর পেয়ে যায় পাকহানাদাররা।তাকে ধরার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করে পাকবাহিনী।"
এমন সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনায়িত এই বইয়ের প্রত্যেকজন নারীর অংশে।যেখানে একজন নারী তার স্বামী, সংসার ও সন্তানের কথা না ভেবে, ভেবেছেন এদেশের মানুষের মুক্তির কথা।যেখানে দেখা যায় সমাজের কত অন্যায়,অবিচার, অশালীন কথা সহ বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের।তাদের ব্যক্তিগত জীবন ছাপিয়ে তাদের সামাজিক ও জাতীয় জীবনেও মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্মম বাস্তবতার।যে বাস্তবতা তাদের স্ত্রী হিসাবে করেছে বঞ্চিত,মা হিসাবে রেখেছে সন্তান থেকে আলাদা, স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছে কলুষিত। এই বইয়ের পরতে পরতে এরকম কঠিন ত্যাগ ও দেশপ্রেমের অসংখ্য কথা বলা হয়েছে এবং তার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু অসাধারণ তথ্য যা বইয়ের পাঠকগনকে চমকে দিবে প্রত্যেক অংশের শুরুতে।মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা, মুক্তিযুদ্ধের আসাধারণ চমকপ্রদ ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষার এক চমকপ্রদ উপস্থাপন এই বইটি জুড়ে।যা সকল বয়সী ও সকল শ্রেণীর পাঠকের জন্য সহজেই বোধগম্য।আমরা প্রায়শই ভাবি নারীর জীবনে তার স্বামী,সংসার, সন্তান এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই,কিন্তু সেই আমাদের বদ্ধমূল ধারনাকেও ছাপিয়ে এই বইয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে যে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে নারীর জীবনে। কিন্তু একজন মা যখন ছোট শিশুকে রেখে চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে; যাতে তাদের সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারে।সেই গল্প আমাদের গর্বের,আনন্দের।যার নাম স্বাধীনতা, যার নাম মুক্তি।
প্রাথমিকভাবে বইটি পড়ার সময় মনে হতে পারে প্রত্যেক অংশের প্রথমে একইরকম তথ্য দেয়া কিন্তু একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই বুঝা যাবে কি অসাধারণ নৈপূন্যের সাথে মুক্তিযুদ্ধের অজানা তথ্য দিয়ে পাঠককে বিস্মিত করেছেন।বইটি পড়ার সময় আমি যেই তথ্য ও ঘটনাপ্রবাহে বিস্মিত হয়েছি,যতটুকু উত্তাপ অনুভব করেছি,আপনারা হয়তো সেরকম বিস্মিত,সে রকম উত্তাপ অনুভব নাও করতে পারেন কিংবা আমার চেয়েও বেশি উত্তাপে আন্দোলিত করতে পারে,শীতল স্রোত বইয়ে দিতে পারে আপনার শিরা উপশিরায়।আপনার মধ্যে আলোড়ন তৈরী করতে পারুক অথবা শীতল স্রোতে না ভাসাতে পারুক,নারীদের অসামান্য অবদান ও ত্যাগ আর মুক্তিযুদ্ধের সব অজানা তথ্য আপনার মস্তিষ্কের তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।আপনি যদি ইতিহাস,মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য আর আমাদের মা বোনদের সেই মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের কথা সঠিকভাবে জানতে চান তাহলে এই বইটি অদ্বিতীয়।মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধকালীন তথ্য ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীদের অবদান জানার জন্য ক্ষূধার্ত বাঘ হয়ে থাকেন তাহলে বলব এই বইটি অরণ্যঘেরা অসংখ্য হরিণ শাবকের বিচরনভূমি।

'একাত্তর ও নারী'
লেখক- রহিমা আক্তার মৌ
প্রকাশক - আরিফ নজরুল।
প্রকাশনা - 'বাঙালি'
প্রকাশকাল - ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রচ্ছদ- তাবাচ্ছুম মেহরীন।
শুভেচ্ছা মূল্য- ২০০/( দুইশত টাকা মাত্র)




সাহিত্য সংসারে দীর্ঘ হাহাকার !

 সাহিত্য সংসারে দীর্ঘ হাহাকার !


 সাহিত্য সংসারে দীর্ঘ হাহাকার !
ইমরান মাহফুজ

সময়ে অবসাদগ্রস্থতা নগরীর মানবিক রোগের নাম। যাপিত জীবনে নৈতিকতা-মূল্যবোধ মানব অস্তিত্বের বড় দিক হলেও প্রকটভাবে সংকট তৈরি হয়েছে। যোগ করেছে সৃজনশীলতায়Ñ নগরে মোড়ে মোড়ে জমাট বেঁধে নেড়িকাকের অহেতুক চিৎকার আর চেচামেচিতে অস্তিত্বকর পরিবেশ। প্রকৃত মূল্যবোধের কাঠামো ভেঙে যে বুদ্বুদ তোলার চেষ্টা চলছে, তাতে মনোরাসায়নিক দুর্গন্ধসহ পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা। সৃজনশীল সাহিত্যের নামে কতেক তোষামোদকারী কিংবা সুবিধাবাদী লোকের আখড়ায়...
পাঠাভিজ্ঞতায় দেখা যায় সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সাহিত্য বিচার করবার কাজটিও একটি বড় বিষয় বলে সবসময় মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যÑ ‘জ্ঞানের বিষয় নহে, ভাবের বিষয়’Ñ এ্ই বিশ্বাস তাঁর আজীবন ছিল। সেই সাথে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করিÑ  অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ’। এর ফলে সাহিত্য ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠে। আর এ বিশ্বজনীন করতে হলে উন্নত রুচি, বোধ, চিন্তাশীলতার জায়গা বিস্তৃত প্রয়োজন। সেটা সমকালে প্রচন্ড সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
গতকাল এক কবিবন্ধু দেখায়, ‘ঐ যে উনি যাচ্ছেন, তিনি কবিতা যেমনই লিখেন, তার কবিতা যে কাউকে ছাপতে হয় এবং তার অনুষ্ঠানে দাওয়াত করলে আসতে হয়, অন্যথায় অপমান কপালে’।
আমি কিঞ্চিত বিচলিত হলাম না। এই সমাজে আরো হেন কাজ যে হচ্ছে সেটি জানি বলে। একবার গীতিকবি শহিদুল্লাহ ফরায়েজী বললেন : ইমরান, শিল্পচর্চার পূর্বে মানুষ হতে হয়। সে মানুষ হবেÑ সুন্দর আর উন্নত রুচির, তাহলেই সে শিল্পচর্চা থেকে পাঠক উপকৃত হবে।’
মানুষ হওয়া তো দূরের কথা শিল্পজ্ঞান না নিয়েই ক্ষমতা কিংবা লবিংয়ের ‘গুণে’ দেশ থেকে দেশান্তরে বাংলাসাহিত্যের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করে দূর্বাঘাসের মতো মাড়িয়ে দিয়ে আসছে প্রকৃত সাহিত্যকৃষকের ফসল। আর ভিনদেশীরা ভাবছে ‘বাংলাসাহিত্য বুঝি এমনই’। অথচ যার শিল্পজ্ঞান ভাল, শ্রেণী/ সংগঠন না মনে রেখে কীর্তিকে জানান দিয়ে আসতে পারতো, তিঁনি যেতেই পারছে না।
প্রসঙ্গে বলি, সমাজে এখনো একটা চিত্র আছেÑ যে ছেলেটি পড়াশোনা ভালভাবে করেনা, মা-বাবার কথা শোনে না, লোকাল পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ছে, নারী কেলেঙ্কারিতে পরিবারের মানসম্মান যায় যায়, ঠিক সে সময় সিদ্ধান্ত হয় ছেলেটিকে বিদেশ পাঠানোর। এতে কি ছেলেটি কত অংশে ভাল হয়ে যায়? সেকি আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেতে পারে? অবশ্যই না।
এমনটাই হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। মেধাবী সাহিত্যজন, যে জায়গা থাকলে সাহিত্যের উপকার হতো তাকে যোগ্যস্থানে বসাতে সক্ষম হচ্ছি না। কথাও বলছি না কুলুপ এঁেট আছি। যারা আবার বলছেÑ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে কথা বলতে দেখছি না। কখনো কখনো দলকানার পরিচয়ও দিচ্ছে। আবার কখনো ‘তকমা’ জুড়ে কথা বলে কাউকে একঘরে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত একশ্রেণী। যেন হরিলুটের বাজার। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সাহিত্যÑ যে যার মতো বিলিয়ে যাচ্ছে। বলারও কেউ নেই। দেখার আছে হলভর্তি দর্শক।
সমালোচনা সাহিত্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ কিছুটা ভূমিকা রেখেছেন। এই সময়ে তাঁর অনুপস্থিতেতে হাহাকার দীর্ঘ হচ্ছে। আড্ডাগুলোতে প্রশংসার ঝুড়ি নিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। একজন অন্যজনের পিঠ চুলকানোর মত, কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শৈল্পিক সমালোচনা থাকছে অধরা। বিলের ফেনার মতো সবাই ভেসে আছি নয় কি!
আজ সত্যিÑ ‘মানুষ’ অধরা। ফলে যোগ্যজায়গায় যোগ্য লোক না থাকায় এই ‘প্রজন্ম’ কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল দেখছি। আর যাঁরা ভোর এনেছিল আজ তারা লিপ্টের ডানে কিংবা বামে দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ঘরে কলিংবল দিচ্ছে। অযোগ্যদের ‘কদমমুচি’ করে সূর্যনসকালের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দূর থেকে পাখিরাও হাসছে!
ব্যক্তি পরিচয় কিংবা ‘নারী’ বলে নি¤œমানের লেখা ছাপানো হচ্ছে সাময়িকীতে। আবার কখনো না ছাপলে নিজেই পত্রিকা করে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাঠকরা কবির/ গল্পকারের কবিতা/ গল্প চায় নারী কিংবা ক্ষমতার নয়। কীর্তন হউক সৃষ্টির।
যা হোক এই সময়ের ময়না তদন্ত আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং এতে দুর্গন্ধ ছড়ায়। আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। মানব জীবনে বিশ্বাস হারানো পাপ। সময়ের উদ্দেশ্য হউক আলোকোজ্জ্বল। সাহিত্য হয়ে উঠুক দেশীয় এবং বৈশ্বিক। সৃষ্টিশালার দৃষ্টিববোধ র্কীতি নিয়ে দাঁড়াক আকাশচূড়া ক্যানভাসে। স্বপ্নের মশাল হাতে সমকালের মুখোমুখি আমরা।





জীবনানন্দ দাশ কি ফেসবুক চালাতেন !

জীবনানন্দ দাশ কি ফেসবুক চালাতেন !


জীবনানন্দ দাশ কি ফেসবুক চালাতেন !
ইলিয়াস বাবর

আচ্ছা, জীবনানন্দ দাশ বুদ্ধদেব বসু প্রমুখদের দেখলে নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রয়াস চালাতেন কেন? তিনি নিজেও তো জানতেন, বুদ্ধদেব তার অকৃত্রিম সুহৃদ, মহান সতীর্থ। তবে কি জীবনবাবু বুদ্ধদেবের হৃদয়-দোলন বুঝতেন না? যারা হালকার উপর ঝাপসা খবর রাখেন সাহিত্যের, তারাও এটা মানতে চাইবে না। কেননা, ভালো আপনি বাসেন গোপনেÑ তা সময়ের প্রেক্ষিতে উন্মুক্ত হয়ে যায়-ই! বুদ্ধদেবের জীবনানন্দের প্রতি প্রেম, তাকে প্রকাশ্যে আনবার অকৃত্রিম চেষ্টা আজকের স্বার্থবাদী সময়ের জন্য উজ্জ্বল উদাহরণ। সে যাক, যে মানুষটি ভীষণ রকম লাজুক, অর্ন্তমুখীÑ তিনি আজকের দিনে পৃথিবীতে থাকলে, আমাদের বৃদ্ধপ্রায় (জীবন্মৃতÑ যারা অতীতের রেকর্ড আর কবিতাকৃতিকে সম্বল করেই মুখ দেখান বিভিন্ন পর্দায়) কবিদের মতো ফেসবুক ব্যবহার করতেন? কিংবা বয়সের তারুণ্য হেতু মজে থাকতেন ফেসবুকে? তিনি কি তার ওয়ালে নিজের কবিতা পোস্টাতেন নাকি বন্ধুস্বজনের (হতে পারে বিভিন্ন কাগজের সম্পাদক এবং রাজধানীকেন্দ্রিক কোন দৈনিকে সাহিত্যপাতা দেখেন) প্রকাশিত কবিতাও বাজারি ভাষায় উপস্থাপন করতেন এমন সামাজিক মাধ্যমে? অথবা ট্যাগের বিষয়টা তিনি ঠিকঠাক বুঝতেন? না, প্রশ্নের বানে ক্লান্ত করার শখ আমার মোটেই নেই, তবে? হালের উৎসাহী, বিশেষ করে খ্যাতিলিপ্সু তরুণ কবিদের (ক্ষেত্র বিশেষে বয়স্কজন) ফেসবুকে কবিতা পোস্ট, তাতে লাইক-কমেন্ট আদায় করে নেয়ার কায়দা, ব্যাপারটুকু বেশ দৃষ্টিকটুই মনে হয়। কবিতায় ফেসবুকীয় হক আদায় না করায় বন্ধুতালিকা ছাঁটাই, ইঙ্গিতবাহি পোস্ট প্রদান বা ব্লক করা ইত্যাদিতে আমরা রীতিমতো অভ্যস্থ। কবি জীবনানন্দ দাশ কি এসবে মেতে থাকতেন? তার যা স্বভাব, পারতেন বলে মালুম হয় না। ফেসবুকীয় অত্যাচারের আরো রকমফের আছে। কবিতা কোন মাধ্যমে (হোক কাগজ বা অনলাইনে) প্রকাশিত হলে তা পোস্টানোর পর বন্ধুতালিকায় থাকা কবিদের মেনসন করা হবেÑ অতঃপর বাধ্য হয়েই তারা মহান হযরতের প্রকাশিত কবিতায় নজর দিতে বাধ্য হবেন। মজার বিষয়, কমেন্ট না করে যাওয়ার উপায় নেই, ইনবক্সে এসে অনুনয় করবেই। বুঝেন ঠেলা, এমনতর মধুর অত্যাচারের। বুদ্ধদেব বসু হয়তো জীবন বাবুরে জিজ্ঞেস করবেনÑ বাবু, অমুক কবিতাটার গতর সাধু-চলিত ভাষায় মিশ্রিত কেন? শরমিন্দা মানুষÑ হোক না কবি, তাই মুখ লুকায় জীবনবাবু। কিন্তু ফেসবুকের যুগে জীবনানন্দ কোন দিকে যেতেন? বাহ, দারুন, সেইরামÑ এমন সব মন্তব্যে নিজেকে সামিল করতেন? নাকি স্যাডো ইমু দিয়ে বেদনার কথা জানাতেন? সে যাকÑ কবিতার বারোটা সম্ভবত এভাবেই করছি আমরাÑ ফেসবুকের কবিতাকর্মীরা। কে কয়টা লাইক-কমেন্ট পেল তাতেই যদি কবিতার মানদন্ড নির্ধারণ হয় তবে তার দরকার নেই কবিতা নামের উচ্চমার্গীয় শিল্পমাধ্যমে থাকা। সরাসরি স্টার হবার অনেক পথ খোলা আছেÑ গান-অভিনয়-আরো আরো। সুন্দর একটা ছবিতে বেশি লাইকের মানে নিশ্চয়ই এমন নয় তার স্থান একটি শিল্পসম্মত কবিতার অধিক। হঠাৎ বাহবা পায় কবিরাজ-সরকারেরা, কবিতার শ্রমিকেরা নয়। স্বভাবকবির যুগ ইতিহাসে আছে; গোঁড়ামি আর সম্প্রদায়ের গোলামি যারা করে তাদের গন্তব্যও আস্তাকুঁড়ে সুতারাং কবি হয়ে উঠেন সর্বসাম্প্রতিক প্রতিভূ। তাকে আয়ত্বে রাখতে হয় ভূগোল-ইতিহাস-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-দর্শন ও অপরাপর বিষয়াশয়েও। হাজার বার গদ্যকবিতার কথা বলবো কিন্তু ছন্দজ্ঞান না জেনে যে এঁকে যেতে চায় কবিতার মুখÑ সে মূর্খ্য। প্রযুক্তির ক্রমাগত ধেঁয়ে চলা সময়ে, পেনড্রাইভ জেনারেশনের সময়ে আর যাই হোক মূর্খ্যতা আর গোয়ার্তুমির স্থান নেই। ঝোলা কাঁধে হেঁটে যায় কবিÑ এমন বাক্য বিরল। কেননা এখনকার কবিরা স্মার্ট। কবিরা আধুনিক একইসাথে সচেতন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। যার আত্মসম্মান থাকে না সে মানুষ হয় কীভাবে? যে লেখক নিজের লেখার দায় নিতে পারে না, ভোগেন গোষ্ঠীর তাবেদারিতে তাকে দিয়ে শিরদাড়া ঋজু রাখা সম্ভব? সে তো কেবল গুরুর কথাতেই সমর্থন দেয় অন্ধভাবে, বিশ্রুত হন সমসাময়িক সাহিত্যের ধারা থেকে। আজ এখানে কাল ওখানে লম্ফ দিয়ে কার উপকার হয়েছে কোনদিন? শিল্পের জায়গা অহমের জায়গাÑ কিন্তু কবিকে জেনে রাখতে হয় তার পরে শুরু করা তরুণটি শ্রম-সাধনায় তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, সূচিপত্রে তার নাম থাকতে পারে অগ্রজেরও আগে! তবে অগ্রজের অর্জনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার পক্ষাপাতী কেউ কখনো থাকেনি, এখনো না। কিন্তু তর্জন করা অগ্রজদের বোঝা প্রয়োজন, তাকে বড় করে তুলতে হলে অনুজকে পাঠক বানাতে হবে, আজ্ঞাবহ নয়। যেমনি জীবনবাবুকে আবিষ্কার করতে দিনমান লেগে থাকেন একজন মান্নান সৈয়দ।


শুদ্ধ মানুষ না হলে, চেতনার জায়গায় নিজেকে বিকশিত আর যাচাই করে নিতে না পারলে কবি হওয়া যায় নাÑ অন্তত এ যুগে। কবি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সত্ত্বা। সে কারো পিতা, কারো স্বামী, কারো স্ত্রী, কারো ভাই, কারো মা, কারো প্রিয়তমÑ ফলে নিরন্তর সমস্যা আর সম্ভাবনার ভেতরেও তাকে ঠিকিয়ে রাখতে হয় সামাজিক সম্পর্ক, শৃংখলা। অপরিচ্ছন্ন মন দিয়ে শিল্প হয় না, কবিতা হয় না। ক্ষুধার ভেতর, তৃঞ্চার ভেতর, আনন্দ-বেদনার ভেতর, সমাজ-সংসার, চাকরি-ব্যবসার ভেতর থেকেই তাকে খুঁজে নিতে হয় সঠিক মুহূর্তটি। নিজেকে শত কাজের ভেতরে রেখেও অর্ন্তগত সংগ্রাম চলমান রাখতে হয় শব্দের খোঁজে, উপমার খোঁজে; একটি দারুন কবিতা নির্মাণের পেছনে যে শ্রম, যে সাধনাÑ তা-ই শেষপর্যন্ত একজন কবিকে আলাদা করে আর দশজন পার্থিব মানুষের সাথে, এমনকি স্বকালের কবিতাকর্মীদের সাথে। কবির সাথে এখানেই সাধারনের পার্থক্য; চিন্তার অগ্রগামিতা, ভাবনার শৃংখলা মূলত এ ক্ষেত্রেই। বেফাঁস কথাবার্তা, অসংলগ্ন আচরণ, সময়-কান্ডজ্ঞানহীনতা উন্মাদের উপসর্গ, কবি কেন তার দায় নেবে? তবে সত্য এই, কিছু অশিক্ষিত, কিছু মূর্খ্য এমনতর আচরনে নিজেদের ব্যস্ত রাখে; আফসোস, তারা নিজেদের দাবী করে কবি। হতে পারে কৌশলও! শোনা যায় বলিউডে কোন ফিল্ম মুক্তি দেয়ার আগে স্বেচ্ছায় বির্তকের সূত্রপাত করেন ফিল্মে যুক্ত মানুষেরাই... বাজার ধরার আশায়, আলোচনায় থাকার আশায়। কবিতাকে কি বাজারের আর দশটা পণ্যের সাথে মিলিয়ে ফেলবো? গোড়ামূর্খের মতো আবোল-তাবোল খিস্তিতে মাতিয়ে তুলবো ফেসবুকের দেয়াল! এমন স্বঘোষিত কবিসংঘে কবি জীবনানন্দ দাশ কি ফেসবুক চালাতে পারতেন?

বিশ্লেষণ আর যুক্তিতে কারো সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। এমনটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ করেছেন, নজরুল নিয়ে হয়েছে। জীবদ্দশায় জীবনবাবুকে তেমন তো পাত্তাই দেয়নি অনেকে। এর অর্থ এই নয়Ñ বেয়াদবি করবো! প্রশ্ন আসুক, বিশ্লেষণ আসুক নতুন ভাবে, যোগ হোক নতুনতর ভাবনাÑ এটা না হলে কি প্রবাহমান সাহিত্য-নদীটা গতিবান থাকে? তাই বলে ফেসবুকে নাম ধরে, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত আক্রোশে অগ্রজ কবিকে তুলাধুনা করবার অধিকার কেউ দেয়নি কোন অনুজকে। কথা হোক কবিতার শরীর নিয়ে, কথা হোক নতুন ফর্ম নিয়ে, কথা হোক ভাংচুর নিয়ে। নয়া ধারণা আমদানী না হলে কে গাইবে নতুন গান? নতুনকে প্রেষণা দেয়ার কাজ রবীন্দ্রনাথ করেছেন, যদ্দুর জানি এখনকার অনেক লেখক-সম্পাদক-অগ্রজই আছেন কবিকণ্ঠে কিশোরমাখা আবেগে তারুণ্যের সৌন্দর্য দিতে, পরিণতির অলংকার পরাতে। তা কে বোঝাবে ফেসবুকে সাহিত্যপেইজ খুলে রাখা ভুল বানানের এডমিনকে, বারবার মেনশন করা যশোপ্রার্থীকে? সাপ্তাহিক ক্রেস্ট, সনদ দিয়ে কবি বানানো যায় না বন্ধু। দরকার চর্চা আর পাঠচক্র। আড্ডা আর আলোচনা।



এতকাল পরে এসেও জীবনবাবু তুমুল পঠিত কেন? তার কালের প্রতাপশালী অনেকেই এখন মৃতÑ এ দিকটা আমাদের প্রস্তুতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু আলোচনায় থাকার জন্যে ফেসবুকে জঘন্য পোস্ট দেয়া, অসংলগ্ন মন্তব্য করে যদি কবি হওয়া যায়, কবির স্বীকৃতি আদায় করা যায়, তবে জীবনবাবু নয় বরং মোহিতলাল মজুমদারই থাকতো আমাদের প্রতিদিনের আরাধ্য। যার পা-িত্য অকাজের দোকানদারিতে ব্যস্ত রাখে তাকে পতনের হাত থেকে কে বাঁচাবে তবে? যেকোন প্রযুক্তিই ব্যবহারের দুটো দিক থাকে। তা একান্তই ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করে। তবে সুবিধাভোগী যখন কবি, তখন তার দ্বারা রাজনীতির পোস্টারে মুখ দেখানো, তাও ফেসবুক পোস্টে চাউর করা হয় তবে তার রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কারন, যিনি লিখেন সেখানেও থাকে তার রাজনীতির প্রচ্ছন্ন ছাপ, বিশ^াসের রাশটা সে কিছুতেই চাপা রাখতে পারে না। তাছাড়া জগতের অন্যান্য লাভবান কৌশল জানে না বলেই তো কেউ একজন কবিতায় আসে! নিজেরে নিয়ে মেতে থাকার আর প্রচারের নানা মাধ্যম অবিরল নয় বরং সহজলভ্য, ফলে ফেসবুকে কবিতা নিয়ে রাজনীতি আর  কবিতাকেন্দ্রিক ব্যাপারগুলো হয়তো খুব খেলো হয়ে যায় আর অলক্ষ্যেই উন্মুক্ত করে দেয় নিজেদের ভিখিরী রূপ।

টীকা দিয়ে, আল মাহমুদীয় ঢঙে কাঁচা বানানে লোকজ শব্দের নামে অস্পষ্ট আঞ্চলিক টোনে থাকলেই আলাদা হয় না কেউ। দরকার চিন্তার স্বাতন্ত্র্যবোধ। এজন্য পূর্বাপর কবিতারাজ্যে একটু পর্যটন করে আসা সচেতনদের অবশ্য কর্ম। কিন্তু দেখে দেখে মুখচিনা সম্পাদকদের কিংবা কবিতার বড়ভাইদের নিয়ে নির্লজ্জ্বভাবে দলালী করা, ইনবক্সে খাতির করা, ছবি তুলে পোস্ট দেয়ার অবিরাম কাজের চেয়ে একটা ছোটকাগজ পড়া বা ভিন্নতর ভাষার কোন কবির বা দেশেরই প্রত্যন্ত অঞ্চলের হোক খ্যাত কিংবা অখ্যাতদের কবিতা পড়া অথবা কবিতাভাবনার সাথে নিজের অভিজ্ঞতাটুকু গোপনে শেয়ার করা অনেক বেশি জরুরী বলে মনে হয়। সে কথা বলবে কে? অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রজেরা অনুজদের ব্যবহার করা, স্তাবক বানিয়ে রাখার মতো সময়ে কে তবে এসব বলতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে? অকবিদের নিয়ে কিংবা মুখসুন্দরী বে-গুণী রমনীদের খাতির-জেরে টিভির আলোচক করে তো আমাদেরই জেলা শহরের খ্যাতিমান কবিরা! সুন্দর চেহারাই যদি সাহিত্যের কিংবা আলোচক হবার মানদন্ড হয়ে থাকে তো বুঝুন ঠেলা! সেই তথাকথিত গবেষকদের ছবি আবার আপলোড দিয়ে কিছু লাইক আর কমেন্ট না কামালে কি চলে? একজন কবি কখনোই ফেসবুকের মতো মাধ্যমে বলতে পারেন না, এবার কি আমার বই করা উচিত? সে প্রশ্ন বরং গোপনীয়Ñ তারই একান্ত পাঠক কি জানাশোনা অগ্রজের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করলেই পারেন। সৃজনশীল কাজ প্রথমত নিজের জন্যে, তাই কি করা উচিত, কেন করবো, কোন মাধ্যমে করবো, তা প্রথমত নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখা দরকার। হঠাৎ মতামতের উপর, কিছুটা লাভ ইমোর ভেতরই যদি কবিতা হারিয়ে যায়, তো আঁধারের দিকে পা দেয়া। আশার কথা, এরপরেও দেশে এখনো আছে রুচিশীল আর ব্যক্তিত্ববান কবি। এসবের ভেতর দিয়েই দাঁড়িয়ে যায় একজন প্রকৃত ভাবুক, একজন শব্দপ্রেমিক, একজন কবি। কবিতা যদি সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠে, ফেসবুকে মেনশনের দরকার পড়ে না, প্রয়োজন থাকে না ইনবক্সে গিয়ে মন্তব্য করার দাওয়াত। কবিতার ঐতিহ্যিক ও ব্যাকরণিক স্বার্থ সম্পূর্ণ হলে অবশ্যই লোকে বলবে, পাঠক পড়বে, সমালোচক আলোচনা (আলোচনা মানে শুধু গুণগান করা নয় তা ভুলে যায় অনেক কবিই। নিজের সে সীমাবদ্ধতাকে ফলাও করে দেখাতে যায় ফেসবুকেÑ তাতে সাহিত্যের কী লাভ জানা নেই আমাদের, নিজেকে ইতিবাচক বোঝাতেই হয়তো এ পলিসি। তা করতেই পারে তার স্বাধীনতার কল্যাণে। কিন্তু ইউটার্ন ঘুরে নিজেকে পবিত্র কিংবা শয়তান বানানোর এ খেলা আজকাল বেশ জমছেও ফেসবুকে।) এতসব দেখাদেখি আর ধাপ্পাবাজির ভেতরেই আমাদের বসবাস। সাহিত্যের উত্তরাধিকারে যোগ হওয়া নতুন সদস্যটি হয়তো এ কারণেই পুণরায় পিছিয়ে দেয় সামনে দেয়া পা-জোড়া। অথবা নিজের ভেতরেই ধারণ করতে চায় এসব কায়দা। মন্দ কীÑ ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ আমরা ভাসতে থাকি চলমান ¯্রােতে, সময়ের পুঁজে ভাসতে ভাসতে আমার পেছনে খালি ছুটতে থাকে প্রশ্নটিÑ জীবনানন্দ দাশ কি তবে ফেসবুকে একাউন্ট খুলতেন? তিনিও কি তবে বাহ, বেশ, সুন্দরÑ কমেন্টের জন্য কাউকে কাউকে অহেতুক মেনশনও করতেন?


গল্প : ভেবে ভেবে ব্যথা পাই

গল্প :  ভেবে ভেবে ব্যথা পাই


 ভেবে ভেবে ব্যথা পাই
বাসার তাসাউফ

    আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু আমি কাঁদছি। আমার চোখ থেকে গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বুক ভিজে যাচ্ছে। আমার মুখে কোনো শব্দ নেই। বুকের ভেতরে চাপা পড়ে আছে শব্দেরা। আমি যেন নির্বাক হয়ে গেছি। আমি চোখ মেলে দেখছি অসহায় মানুষের কালো ফ্যাকাসে মুখ। আমি কান পেতে শুনছি এসব মানুষের করুণ কণ্ঠের বিলাপ। আমি মুখে মাস্ক পড়ে আছি। কিন্তু আমার নাকের গহ্বরে প্রবেশ করছে উৎকট গন্ধ, লাশের গন্ধ। এখন বাতাসে লাশের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
     আমি সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। একটি মানুষের জন্য, একটি লাশের জন্য। যে মানুষটির জন্য আমি দাঁড়িয়ে আছি তার নাম সুচিত্রা। সে আমার বোন নয়, কোনো আত্মীয়ও নয়। তবু তার জন্য, তার লাশের জন্য আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। বিশাল এ প্রাসাদের নিচে চাপা পড়ে সে কীরকম ছটফট করছে বেরিয়ে আসার জন্য, বাঁচার জন্য তাও জানি না! অন্যান্য মানুষগুলোর কি একই অবস্থা? আজ এতটা দিন হয়ে গেল জন্তুর মতো বিরাট পাথর খ-ের নিচে ইট-বালি, সিমেন্ট-রডের তৈরী স্লাভের নিচে চাপা পড়ে আছে তারা। না জানি তাদের কেমন কষ্ট হচ্ছে? তাদের কি খুব পানির পিপাসা পাচ্ছে? নিকষ কালো কবরের মতো অন্ধকারে তাদের বুক কি ফেটে যাচ্ছে চিৎকার করে করে? না জানি কার মাথা চেপ্টা হয়ে গেছে। কার পুরো শরীর, হাঁড়-মাংস গুঁড়ো হয়ে গেছে। 
     সুচিত্রা কি বেঁচে আছে? মাত্র কয়েক মাস আগে এ ভবনের একটি গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছে সে। অবশ্য তারও কয়েক বছর আগে সে চলে গিয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে। সে ছিল আমার বাসার কাজের মেয়ে। কাজের মেয়ে কথাটা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সে ছিল আমাদের পরিবারের একজন। খুব বিশ্বস্ত। পরিবারের সবাই কোথাও বেড়াতে গেলে তার কাছেই বাসার সব চাবি রেখে যেতাম। কোনদিন দুই টাকার কোন জিনিসও চুরি করে নি। তবে তার একটাই দোষ ছিলÑআসলে দোষ নয়, মুদ্রাদোষ। তা হলো, টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখা। সিনেমা আরম্ভ হলে কাজে মন থাকত না। কাপড় ইস্ত্রি করতে গেলে পুড়ে ফেলত। ভাত বেশি ফুটিয়ে জাউ বানিয়ে ফেলত, নয়তো তরকারিতে লবণ দিতে ভুলে যেত। কাপড় ধুতে গিয়ে অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রেখে রঙিন কাপড়ের দাগ লাগিয়ে ফেলত আর মাসে অন্তত দুটো চায়ের কাপ নয়তো চিনেমাটির থালা ভাংতো। আমি স্পোর্টস চ্যানেলে খেলা দেখলে কিংবা আমার স্ত্রী ভারতীয় মেগা সিরিয়াল দেখতে চাইলে সে বাংলা সিনেমা দেখতে না পেরে রান্নাঘরে গিয়ে ছোট্ট বাচ্চার মতো কাঁদত। তার চেহারা ছিল চমৎকার। অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো। যেদিন যে নায়িকার ছবি দেখত সেদিন সেই নায়িকার মতো ভঙ্গি করে কথা বলত, পোশাক পরত। একটি সিনেমায় তার প্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেনকে কাঁদতে দেখে সে নিজেও দিনভর কেঁদেছে। এরপর থেকে বাসার সবাই মজা করে তাকে সুচিত্রা সেন বলে ডাকা শুরু করল। সেও নিজের নাম বদলে এ নামটা নিয়ে নিল। এর আগে তার নাম ছিল শরীফা। তবে এ নামে ডাকলে সাড়া দিত না। সুচিত্রা বলে ডাকলে কোথা থেকে যেন  এসে হাজির হত। প্রথম প্রথম সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। তার শরীফা নামটা ভুলে আমরা সুচিত্রা বলেই ডাকতে লাগলাম। 
     একদিন সুচিত্রার এক মামা এলো তাকে নিয়ে যেতে। বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে সে। ফলে আমরা চইলেও আর তাকে ধরে রাখতে পারলাম না। মেয়ে মানুষ। সময়মতো বিয়ে দিতে হবে, করতে হবে সংসার। তার বাবা-মা ছিল না। আমার স্ত্রী কিছু টাকা ও একটা শাড়ি দিয়ে বিদায় দিতে গেলে সে ছোট্ট বাচ্চার মতো হাউমাউ করে কেঁদে বিদা নিল। তার বিয়ে হয়েছিল এর কিছুদিন পরেই। একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান থেকে ফোন করে সুচিত্রা নিজেই তা জানিয়েছিল।
     সুচিত্রা চলে যাবার পর দু’দিন যেতে না যেতেই আমাদের ময়লা কাপড় জমে পাহাড় হয়ে ওঠল। টেলিভিশন আর কম্পিউটারের ওপরে ধূলো জমল কয়েক ইঞ্চি। রান্না ঘরে থালা-বাসন, হাঁড়িপাতিল আধোয়া অবস্থায় পড়ে থাকে। ঘরের ছাদের কোণায় মাকড়সারা মিহিন সুন্দর জাল বুনে। বারান্দায় গ্রীলের ফাঁক দিয়ে কাক-চড়–ই-শালিক এসে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে চলে যায়। লাল ও কালো পিঁপড়েরা দুধের মতো সাদা দেয়ালে লাইন ধরে পিলপিল করে চলে অনায়াসে নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে। আরশোলারা ঘরের কোণায় কোণায় লুকিয়ে না থেকে ব্যাপক ওড়াওড়ি শুরু করে। চলে টিকটিকিদের অবাধ বিচরণ। কুনো ব্যাঙ ঘরের কোণা ছেড়ে মেঝে, শো’কেসের তলা, আলনার তলা দখল করে রাখে। মনে হয়, আমরা যেন প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকি। শুধু মাত্র একজন সূচিত্রা নেই বলে আমাদের সংসারের সবকিছু কেমন অগোছালো, কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।

     এরপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর...
     একদিন সকালে বৃৃষ্টি পড়ছে। পড়ছে তো পড়ছেই। কখনও বেড়ে যাচ্ছে, আবার কমছে। কিন্তু থামছে না। বেশির ভাগ সময়ই টিপটিপ। কিছুক্ষণের মধ্যে যে থামবে সেরকম কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আকাশে ছড়িয়ে আছে কালো কালো মেঘ। বর্ষায় কখনও আকাশ মেঘহীন থাকে না। আলো ঝলমল নীলাকাশের বুকে সারাক্ষণ ভেসে বেড়ায় ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ। ভাসমান এসব মেঘ দেখলে মনে হয় পেজা তুলোর মতো হাল্কা। বাতাসে ভেসে বেড়ায় এদিক ওদিক। এসব মেঘ সূর্যকে ঢেকে রেখেছে। যতক্ষণ না এই মেঘগুলো বৃষ্টি ঝরিয়ে নিঃশেষ হবে ততক্ষণ বৃষ্টি ঝরতে থাকবে হয়তো। বৃৃষ্টি হোক, ঝড় হোক অফিসে যেতে হবে। বৃৃষ্টির জন্য অফিসের কাজকর্ম থেমে থাকবে না। তাই বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে কিছু দূর এগিয়েই প্রত্যেক দিন যা ঘটে সেই ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লাম। জ্যামটা বেশি বড় নয়, বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগতে পারে। এই সুযোগে দশ এগারো বছরের একটা মেয়ে থেমে থাকা গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার কাছে ভিক্ষে চাইল। আমি কিছু খুচরো পয়সা ওর হাতে দিতেই দৌড়ে অন্য গাড়ির দিকে ছুটল। আমার গাড়ির জানালা ফাঁকা হলে একটু দূরে ওভারব্রিজের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসা একজন মহিলাকে দেখতে পেলাম। মহিলাকে আমার আধো চেনা আধো অচেনা মনে হল। সে আমাকে দেখেই মুখ আড়াল করে ফেলল ঘোমটা টেনে। কিন্তু আড়াল হবার আগেই আমার মনে পড়ল- এ যে সুচিত্রা! সেই যে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা...!  


     আশ্চার্য! সুচিত্রা এখন ভিক্ষে করে? তার সামনে বিছানো মাদুরে শুয়ে আছে একটা শিশু। শিশুটি মেয়ে না ছেলে ঠিক বোঝা গেল না। ড্রাইভারকে রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে বলে আমি সুচিত্রার দিকে ছুটলাম। কাছে গিয়ে দেখি তার সামনে মাদুরে শুয়ে আছে হাড্ডিসার এক শিশু। আমাকে দেখে ও মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল খুঁটছে। ময়লা শাড়ি, শুকনো মুখ, রুক্ষ চুল। তার দুই মেয়ে- বর্ষা ও মেঘ। এই নামগুলো কি তার কোন প্রিয় নায়িকার মেয়ের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে? বড় মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে যে আমার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছিল তার নাম বর্ষা, মাদুরে ঘুমোচ্ছে মেঘ। 
     আমি তাদেরকে বাসায় নিয়ে এলাম। আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর সুচিত্রার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ছিল ট্রাকড্রাইভার। দুই বছর আগে রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে সে। স্বামীর গ্রামের বাড়িতে সম্বল বলতে সামন্য ভিটে ও ছোট একটা খড়ের ঘর ছিল। কয়েকদিন আগে বন্যার জলে সেটা তলিয়ে গেছে। অসহায় সুচিত্রা অসহায় দুই মেয়ে নিয়ে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে শহরে এসে ওভারব্রিজের নিচে আশ্রয় নিয়ে ভিক্ষে করছে। বাসায় আসতে আসতে গাড়িতে বসে এ কথাগুলো আমাকে জানালো সুচিত্রা। বাসায় পৌঁছানো মাত্র লোকজন জড়ো হয়ে গেল তাকে দেখতে। আমার স্ত্রী তো প্রথমে চিনতেই পারে নি। যে মেয়েটি এক সময় আমাদের ঘরদোর দোকানের শো রুমের মতো ঝকঝকে, তকতকে করে রাখতো। সে মেয়েটি নিজেই এখন কেমন রোগা, লিকলিকে। কোথায় তার সেই নায়িকার মতো চেহারা, সাজগোজ।
     আমরা সুচিত্রাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছি। আমার স্ত্রীর হুকুমে কাজের মেয়েটা বর্ষা আর মেঘকে খেতে দিয়েছে। খাবার পেয়ে তারা মুঠো ভরে খাচ্ছে। টি.ভিতে তখন উত্তম-সুচিত্রার বাংলা সিনেমা চলছিল, হারানো সুর। সুচিত্রা একবারও সেদিকে তাকাল না। ড্রয়িংরুমে বসে রইল মাথা নীচু করে।
     আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এখন কোথায় থাকিস?’ 
     সুচিত্রা নির্বাক। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। শব্দ নেই।
     আমি বললাম, ‘সুচিত্রা, তুমি কি কোনো কাজ করতে চাও?’
     এবার তার মুখে শব্দ জুটল। বলল, ‘হ, ভাইজান। আমার এক দূর সম্পর্কের খালা কইছে আমারে একটা গার্মেন্টসে কাজ যোগাড় কইরা দিব।’
‘কোথায় সেটা?’
‘সাভার। আগামী কালই আমারে যাইতে হইব। গেলেই জয়েন।’
‘ঠিক আছে চাকরি করো। তবে আর ভিক্ষা করো না।’
তারপর সুচিত্রা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। যাবার সময় আমার স্ত্র¿ী তার হাতে কিছু টাকা দিলে তার সে কি আনন্দ! এর দুই মাস পরে একদিন সুচিত্রা আমাদের বাসায় এসে জানালো, সাভারে গার্মেন্টসের সেই চাকরিটা পেয়েছে সে। আপতত দুই মেয়েকে নিয়ে একটি বস্তিতে উঠেছে। মাস শেষে বেতন পেলে ছোটখাটো একটা বাসা নেবে তারপর তার অফিসের ঠিকানা আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিল। সে-ই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। যে অফিসে সে চাকরি করত তার ঠিকানা লেখা কার্ডটি এখন আমার হাতে।
                                                    নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড
                                                     ৩য় তলা [রানা প্লাজা]
                                                     সাভার, ঢাকা
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদছি এখনো। একটু পর পর ধ্বংসস্তুপ থেকে আহত ব্যক্তি কিংবা মৃতদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসছে উদ্ধারকর্মীরা। শত শত স্বজন স্রোতের বেগে ছুটে যাওয়া কচুরিপানার মতো দৌড়ে ছুটছে সেদিকে। পাগলের মতো খুঁজে ফিরছে তাদের হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে। কেউ খুঁজে পায় জীবিত আহত লাশ, কেউ পায় থেতলানো মৃত লাশ, কেউবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে ধ্বংসস্তুপের সামনে। অপেক্ষায় অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে থাকে উদ্ধারকর্মীদের দিকে। এই বুুঝি উদ্ধার হয়ে এলো প্রিয় মানুষটি। সুচিত্রা ৩য় তলায় কাজ করত। জানি না সে বেঁচে আছে কিনা। যদি সে মরে গিয়ে থাকে তাহলে তার দুই মেয়ে বর্ষা ও মেঘের কী হবে?  মেয়ে দুটো এখন কোথায় আছে? সুচিত্রার সাথে যখন আমার শেষবার দেখা হয় তখন সে বলেছিল মাস শেষে বেতন পেলে ছোটখাটো একটা বাসা নেবে। সে কি মাস শেষে বেতন পেয়ে বাসা নিয়েছিল? আমি তা জানি না। জানলে তার মেয়ে দুটোকে সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারতাম। সাত দিন পার হয়ে গেল। সুচিত্রার জীবিত বা মৃত সন্ধান  পেলাম না।
কেটে গেল আরো কিছুুদিন। এ ক’দিন আমি ধসে পড়া ভবন, সাভারে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ ও বিভিন্ন্ হাসপাতালে খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু কোথাও সুচিত্রার খোঁজ পাই নি। এর মধ্যে একজন উদ্ধারকর্মীর সঙ্গে কথা হল।  সে বলল, ‘আপনি কাকে খুঁজছেন?’
আমি বললাম, ‘আমার এক আত্মীয়।’
‘কী নাম?’
‘নাম সুচিত্রা।’
‘সুচিত্রা নামে একজনকে ভেতরে চাপা পড়ে চিৎকার করতে দেখেছি। এমনভাবে আটকে ছিল, উদ্ধার করতে হলে বিম বা কলাম কাটতে হবে।’
আমি উদ্ধারকর্মীকে জাপটে ধরে কাঁদতে কঁাঁদতে বললাম, ‘ভাই, তাকে উদ্ধার করেন। তার দুটো বাচ্চা আছে। পৃথিবীতে সুচিত্রা ছাড়া তাদের আর কেউ নেই।’ 
উদ্ধারকর্মীটি চুপ করে শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি দেখলাম আবেগ ছুঁয়ে গেছে তাকে। তার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রুবিন্দু। চোখের জল মুছে নিয়ে আমার হাতে একটা পরিচয়পত্র বাড়িয়ে দিল। তাতে সুচিত্রার নাম লেখা। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সুচিত্রার জন্য নয়, তার দুটো মেয়ের জন্য। জানি না এখন তারা কোথায় আছে। আমি লাশের দুর্গন্ধ শরীরে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।




পদাবলি

পদাবলি


যন্ত্রণার কৃতদাস
নূরুন নাহার স্বপ্না

বেসামাল ইচ্ছাগুলো....
অদৃশ্য, শৃঙ্খলে আহত পাখির ন্যায় বন্দী।
দ্বিধা, সংকোচ আর অনিশ্চয়তার ভিড়ে
ক্ষত-বিক্ষত ধূসর জমিন।
অপ্রতিরোধ্য উত্তাল সমুদ্র যেন
অন্তহীন অনুভূতিতে বিলীন,
ধূলোর আস্তরে ঢাকা লাগামহীন কল্পনায়
জেগেছে শৈল্পিক চর।
অস্পষ্ট অস্থিরতা গ্রাস করেছে
ছিঁড়ে যাওয়া বীণার তার।
তাইতো, নশ্বর পৃথিবীতে
অবোধ শিশুর ন্যায়
অব্যক্ত শব্দগুচ্ছ আজ ফেরারী। ।


ছদ্মবেশীর মুক্ত ছায়া
সাজিয়া সুলতানা মিম

সেই দেয়াল জুড়ে শূন্যতা
জীবিত খেয়াল পুড়ে পূর্ণতা,
কচুপাতাতে জল যেন মগ্ন নিজেকে বাচাঁনোর
পাথর চিন্তিত সে সুখে তবু স্তব্ধ কেন!
ছবি কথা বলে বোবা ভাষায়
রোদ লজ্জিত তার মাতাল উত্তাপ নিয়ে
স্বপ্ন অলস হয়ে ভাসছে নিত্য ঘুমে,
চাদঁ আলোর চর্চা করতে করতে ক্লান্ত
ভালোবাসা নগ্নতার শিকার হয়ে দিয়ে চলেছে নালিশ
মন হঠাৎ প্রতিবন্ধী জীবনের অগোছালো বাস্তবতায়।
খাঁচাতে আটকানো পাখির ভারি নিশ্বাস
কাক-কোকিলের অন্ধ বিশ্বাস,
ভাগ্যের রং মাখা নকশা
ঝরে পরা পাতা লিখে যায় মৃত্যু বাক্য নিজ দেহে
কলম আত্মতৃষ্ণা মেটাতে ঘর বেধেঁছে সাহিত্য দিয়ে!
জল দাগ টানে ঘন ঘন নৌকার পেরেকের আঘাতে
কাঠ খেয়ে ক্ষুধা মেটায় ঘুণপোকা,
ভাবুক মানচিত্র শাসন করে জেদি অক্ষরকে
ভৃত মুখোশ কান্না করে যুগল শব্দে।
এ সমস্ত ছদ্মবেশীর মুক্ত ছায়া
মিথ্যে নামক সত্য!


স্বাধীন জল
মাযহারুল ইসলাম অনিক

ইচ্ছে মত আমরা এখন ছুটবো দেখো সবে,
দুঃখগুলো দেয়াল কোণে শুধু পড়ে রবে।
আগের মত এখন তো আর  ধারবো না কারো ধার,
ইচ্ছে মত নিজ পথেতে ছুটবো যে বারবার।
কালো কাপড় ছুঁড়ে ফেলে গাইবো স্বাধীন গান,
প্রেম জোয়ারে ভাসায় দিবো সবাই সবার প্রাণ।
কান্না ভুলে দুঃখ ভুলে গড়বো নিজের পথ,
বড়ো গোঁফা শত্রুগুলো করবো দেখো বধ।
কারো আশে পথের পানে রইবো না আর চেয়ে,
ঘোড়ার বেগে ছুটবো দেখো তুমুল গিরি বেয়ে।
নতুন সূর্য নিজের হাতে এখন হবে উদায়,
বীর বাঙালীর রক্তে হবে নতুন কথা খুদাই।
সে কথার’ই বাঁকে বাঁকে স্বাধীন ঘ্রাণ,
বঙ্গ টানে লুটায় দেবো সবাই সবার প্রাণ।
বুলেট ঘায়ে পুড়বে না আর নতুন কোন পাখি,
কান্না জলে ভিজবে না আর বুবুর দুটি আঁখি।
স্বাধীন জলে এখন সবে দেবো শুধু ডুব,
রাজপথেতে চলে ফিরে পাচ্ছি মজা খুব।

এই মহাকাল
মাহবুবা নাছরিন শিশির

সত্যের বিজয় হবে আজ নয় কাল
হাসিমুখে চেয়ে রবে এই মহাকাল,
পাতাঝরা দিনশেষে ফুটবে মুকুল
দখিনা বাতাসে হবে হৃদয় ব্যাকুল!

ব্যথিত স্বপ্নের স্মৃতি ভুলে যাবে লোকে
বিজয়ের হাসিটাই পড়বে দুচোখে,
কেউ দিবে ফুল এনে কেউ দিবে মালা
কেউ দিবে স্তুতিগান, কেউ দিবে বালা।

পেরিয়ে গিয়েছি কত ঘুমহীন রাত
জেগেছিল দুটি চোখ, আকাশের চাঁদ;
শ্রমে-ঘামে মিশেছিল সেইসব দিন
একে একে অতীতের ঘরে হলো লীন।

কতবার হতাশায় ডুবুডুবু ছিলো
সত্যভাষা প্রতিক্ষণে তবু আশা দিলো,
এগিয়ে নিলো সে হেসে সহজের পথে
তুলে নিলো ডানামেলা বিহঙ্গের রথে।

সরল আদর্শ েেমনে চলেছি-বলেছি
বিপদেআপদে আমি ধৈর্য ধরেছি,
সে আমারে দিবে জানি এর প্রতিদান
বেলাশেষে মুছে যাবে গ্লানি অভিমান।

সত্যের বিজয় হবে,  আজ নয় কাল
আমারে রাখিবে মনে এই মহাকাল।


বঙ্গবন্ধু জন্মদিন, জাতীয় শিশু দিবস ও শিশু অধিকারের হালচাল

বঙ্গবন্ধু জন্মদিন, জাতীয় শিশু দিবস ও শিশু অধিকারের হালচাল


বঙ্গবন্ধু জন্মদিন, জাতীয় শিশু দিবস ও শিশু অধিকারের হালচাল
মীম মিজান

আজ ১৭ই মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮ তম জন্মদিন। এ ছাড়া আজ জাতীয় শিশু দিবস। বাংলাদেশে প্রতি বছর বঙ্গাব্দে চৈত্র ৩ আর খ্রিস্টাব্দে মার্চ ১৭ এটি পালিত হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯২০ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। পিতা-মাতার চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাল্যকালে তার ডাক নাম ছিল খোকা। খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এক রাজনৈতিক সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসাবে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর যখন জন্ম হয় তখন ছিল বৃটিশ রাজত্বের শেষ অধ্যায়। গ্রামের স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়সে তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তত্কালীন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিপ্লবী জীবন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে অর্থাত্ দেশবিভাগের বছর এ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে গঠন করেন ছাত্রলীগ। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। ১৯৩৮ সালে আঠারো বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বেগম ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্ররা হলেন শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। আমরা তাঁর জীবনের বাকী দিন গুলো সম্পর্কে সম্যক অবগত।

বাংলাদেশের স্থপতি বলে তাঁর জন্মদিনটিকেই জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কেননা শিশু বয়সে সমবয়সিদের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা।যুবক ও পরিণত বয়সেও তাঁর ছিল অতুলনীয় শিশুপ্রেম। শিশু দিবস যেহেতু শিশুদেরকে নিয়ে তাই শিশু কারা? কি এদের বৈশিষ্ট্য ও অধিকার? এগুলো জানা প্রাসঙ্গিক। শিশু (ইংরেজি: ঈযরষফ) ভূমিষ্ঠকালীন ব্যক্তির প্রাথমিক রূপ। যে এখনও যৌবনপ্রাপ্ত হয় নাই কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রবেশ করেনি সে শিশু হিসেবে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে চিহ্নিত হয়ে আছে। সচরাচর যে ছেলে বা মেয়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে অবস্থান করছে সে শিশু হিসেবে চিহ্নিত। জীববিজ্ঞানের ভাষায় - মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপ হচ্ছে শিশু। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকার সনদের ১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘ ''এই সনদে ১৮ বছরের নীচের সব মানব সন্তানকে শিশু বলা হবে, যদি না শিশুর জন্য প্রযোজ্য আইনের আওতায় ১৮ বছরের আগেও শিশুকে সাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।''

শিশু অধিকার নিয়ে বাংলা পিডিয়া উল্লেখ করেছে, ''বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির  মৌলাদর্শ বর্ণনায় শিশু অধিকারের প্রাসঙ্গিক বিধান [অনুচ্ছেদ ১৫, ১৭ এবং ২৫ (১)], মৌলিক অধিকারসমূহ [অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ (১) (২) (৩) (৪), ৩১, ৩২ এবং ৩৯ (১) (২)], এবং বিচার বিভাগীয় পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা [অনুচ্ছেদ ২৬ (১) (২)] রয়েছ। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১ অনুচ্ছেদে সব ধরনের বৈষম্য থেকে শিশুর নিরাপত্তা বিধানের সাধারণ নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান ও অভিন্ন নিরাপত্তা লাভের অধিকারী বিধায় পক্ষাপাতহীনভাবে তাদের আইনের সুযোগ লাভের অধিকার রয়েছে' । বাংলাদেশের শিশুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ সম্পর্কিত অন্যান্য আইন কোনো একক সংবিধিভুক্ত নয়।" ১৯৬৯ সালে শিশু বিষয়ে ১০টি অধিকার জাতিসংঘ গ্রহণ করে এবং ১৯৮৯ সালে তা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে সনদ আকারে গ্রহণ করা হয়। তবে স্বাধীনতার পর পরই প্রথম ১৯৭২ সালের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের বিষয়টা সুস্পষ্ট ও সার্বিকভাবে আমরা গ্রহণ করি। সংবিধানে বলা হয়, "..শিশুদের অনুকূলে অগ্রগতির জন্য... বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।"



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার অন্যান্য সময়ের তুলনায় মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের প্রতি অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার অতীতের তুলনায় কমে এসেছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬ মতে, 'শিশু মৃত্যু হার ১ বছরের কম প্রতি হাজারে ৩০জন এবং শিশু মৃত্যু হার ৫ বছরের কম প্রতি হাজারে ৩৮জন। 'দৈনিক যুগান্তর' উল্লেখ করেছ, ''জাতিসংঘের শিশু উন্নয়ন ফান্ড এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিশুমৃত্যু হার রোধে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করেছে।" সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ রকম অবস্থানে আমরা পৌঁছেছি। এ সরকারের আমলে লিঙ্গ সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার কমানো সূচকে এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য। যার স্বীকৃতস্বরূপ সাউথ সাউথ পুরস্কার পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেয়েছেন ইউএনএমডিজি পুরস্কারও। শিশুদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রতিবন্ধীতা নিয়ে জন্মায়। সরকার এই সকল শিশুকে সমাজের বোঝা না করে স্বাবলম্বী করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় তাদেরকে পূণর্বাসন করছে। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়ুবিক জটিলতা সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তার কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ায়। প্রথমে নিজ দেশ বাংলাদেশে এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় তিনি কাজ করেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুতুলকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে।



ইংলিশ কবি ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয বলেছেন, ''ঞযব পযরষফ রং ভধঃযবৎ ড়ভ ঃযব সধহ." অর্থাৎ আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অথচ সেই কোমলমতি শিশুদের হত্যার কী মহড়া চলছে দেশে! দেখে নেই সেই চিত্র: ঢাকার বনশ্রীতে পরকিয়ার জন্য দুই ভাইবোন তাদের মায়ের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঘটনাটি সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে। হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশুকে একসঙ্গে হত্যার পর বালিচাপা দিয়ে রাখার ঘটনাও সারা দেশে আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গত চার বছরে সারা দেশে এক হাজার ৮৫টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২০৯টি শিশু, ২০১৩ সালে ২১৮টি শিশু ও ২০১৪ সালে ৩৬৬টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

সিলেটের ১৩ বছরের সামিউল আলম রাজন, খুলনার রাকিব, ঢামেকের সামনে সুটকেসে গৃহকর্মীর ক্ষত বিক্ষত লাশ, বরগুনার রবিউল, চাঁদপুরের শহরাস্তিতে বাবা মায়ের পিটুনিতে শিশু সুমাইয়া, উইলস লিটিল ফ্লাওয়ারের ছাত্রী রিশা, মাগুরায় মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশু এরকম অসংখ্য শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। পত্রিকার পাতা খুললে ও দূরদর্শনের পর্দায় আমরা দেখে অভ্যস্ত হয়েছি জাতির ভবিষ্যৎকে অংকুরে বিনষ্টের দৃশ্য। উপর্যুক্ত শিশু হত্যার কারণ গুলি যদি আমরা খুঁজি তাহলে দেখিযে, অনৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি উদাসিনতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অনলাইন প্রযুক্তির কু-প্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, মানবপাচার, বিরোধ বা শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ শিশু হত্যাকাণ্ডের কারণ। মানবাধিকার সংস্থাগুলি বলছে, শিশুহত্যার মতো ঘৃণিত অপরাধে  জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় শিশু হত্যার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, "শিশুরা পরিবারের চোখের মণি এবং এদের সহজেই টার্গেট করা যায় বলে অপরাধীরা শিশুদের টার্গেট করছে।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশীক মোহাম্মদ শিমুল রেডিও তেহরানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ''মানুষ হত্যা বা শিশু হত্যা দেশে নতুন নয়। গণমাধ্যমের কারণে এ বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে মাত্র। এটা সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। আর দেশে একের পর এক নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়া আর বিপরীতে যথাযথ বিচার না হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা কমে যাচ্ছে। যার ফলে শিশুরাও এ নির্মমতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।" অভিভাবক ফোরামের জিয়াউল কবীর বলেন, “আমরা অভিভাবকরা বিচলিত। বিচারহীনতা, দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং সেন্টারে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বললেও, মনিটরিং এর কোনও ব্যবস্থা না।" এ ব্যপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে  বলেন, "সমাজে বিচারহীনতা এবং অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ এই নির্মম শিশু নির্যাতন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি শেকড় গেঁড়ে বসায় একটি শিশুকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করতে তারা সাহস পেয়েছে।" সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ''বিচার-প্রক্রিয়ার শ্লথ গতিতে অপরাধীরা অপরাধ করা থেকে নিরুৎসাহিত তো হয়ই না, বরং উৎসাহিত হয়। একজনের বেলায় মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করা হলেও অন্য ১০০ জন লোক তা দেখে ভয় পায়। অপরাধীরা ভেবেই নিচ্ছে—অন্যায় করলে বিচার আর কী? আর বর্তমানে যে ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।'' শিশু হত্যার মত জঘন্য অপরাধের সংস্কৃতি থেকে আমরা যদি মুক্তি পেতে চাই তাহলে পরিবারগুলোর মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরকিয়ায় উৎসাহিত করে এমন টিভি প্রোগ্রাম গুলো বন্ধ করতে হবে। মাদক ও চোরাচালানের প্রতি কঠোর ও অনমনীয় হতে হবে। মামলার জটে দীর্ঘসূত্ররা না করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। জিয়াউল কবীরের ভাষায়, "এখন প্রযুক্তি চলে এসেছে মানুষের হাতে। ফলে উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েরা খারাপ পথে যাচ্ছে। অভিভাবকদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। আন্তরিকভাবে সন্তানদের সখ্য দিতে হবে।" আর যদি আমরা সন্তানদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখি তাহলে ঐশীর মত ঘটনা ঘটবে। শিশু শ্রমের বিষয়ে সজাগ হয়ে শিশুদেরকে ঝুকিপূর্ণ ও অনিরাপদ কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের ব্যপারে আইনি তদারকি বাড়াতে হবে। আজকে স্বাধীনতার স্থপতি মরহুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮ তম জন্ম দিনে প্রভুর কাছে প্রার্থনা, স্রষ্টা যেন তাঁকে সম্মান দান করেন। তাঁর স্বপ্নকে যেন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। জাতীয় শিশু দিবসের চাওয়া হোক সকল নেতিবাচক দিক পরিহার করে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুদেরকে ভালোবাসি। ভালোবাসা পেয়ে তারা ফুলের মত ফুটে বিশ্বকে করুক সুবাসে মোহিত।


গল্প : বিরঙ্গনা

গল্প :  বিরঙ্গনা


 বিরঙ্গনা
মোহাম্মদ অংকন

তন্নির বয়স তখন ১৬ বছরের মত। দেশে একাত্তের যুদ্ধ লেগে যায়। গ্রামে গ্রামে দলে দলে মিলিটারি পাক সেনারা আসতে থাকে। তন্নিদের গ্রামনিভৃত একপল্লী। চারিদিকে ঝোঁপঝাড় জঙ্গলে ঘেরা। অপরিচিতদের রাস্তা-ঘাট মনে রাখা মুশকিল। গ্রামের সবার কাছে খবর পৌঁছে গেল, কলম গ্রামের স্কুলমাঠে মিলিটারী বাহিনী ক্যাম্প তৈরি করেছে। এলাকার সকলের মনে ভয় ভীতির জন্ম নিল। তন্নির বাবা ছিল তাগরা জোওয়ান। যখন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চেরভাষণশুনেছিল, তখনই মনোবল স্থীর করেছিল যুদ্ধ করার।

তন্নির স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনো দিন। গ্রামের পথেঘাটে, বনে বাদারে দৌঁড় ঝাঁপ করেই এত বড় হয়েছে। গ্রামের পথঘাট ওর একদম চেনা। মেয়েটি দেখতে অনেক সুন্দরী। যেন গ্রামবাংলার সব রুপ-রস-রং দিয়েতার দেহখানা তৈরি করেছেন বিধাতা। এত সুন্দরী একটি মেয়ে, তবুও সে মেয়েদের পোষাক পড়েনা। সবসময় ছেলে হয়ে থাকে। যে কেউ দেখেই বলবে, এ তো ছেলে মানুষই। যখন প্যান্ট, শার্ট পড়ে,তখন মনে হয় এ যেন সত্যিই ওর বাবার বড় ছেলে। ওর জন্মেও আগেই ওর একটি ভাই হয়েছিল। বসন্ত রোগের কবলে পড়ে পৃথিবীতে টিকতে পারেনি। সেই ছেলের অভাব পূরণের তাগিদে তন্নিকে ছেলেদের পোষাক পড়িয়েই বড় করেছে তারমা-বাবা। তন্নিও এখন সেসব পোষাক ছাড়তে নাছড়বান্দা।

সেদিন ছিল এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ। পাক সেনাবাহিনী কলমগ্রামে প্রথম হানা দেয়। ধওে নিয়ে যায় অসংখ্য যুবকদের। গুলি কওে হত্যাকরে। তন্নিরবাবা ও আরও কয়েকজন পালিয়ে আতœগোপন করে। বাড়িতে পরে থাকে তন্নি আর ওর মা। ওদেও মাঝে ভীষণ ভয় কাজ করে। ওরা রেডিওতে শুনেছিল, পাকবাহিনীরা সুন্দরী মেয়েদেরও ক্যাম্পে ধওে নিয়ে যাচ্ছে। কারও কাছ থেকে নাচ দেখছে, কারও কাছ থেকে গানশুনছে। অতঃপর ইজ্জ্বত হরণ কওে রাস্তায় ছুড়ে মারছে।

বিকালের দিকে পাকবাহিনীরা তন্নিদের পাড়ায় টহল দিতেআসে। এক সময় তাদের বাড়িতেও আসে। ওর মাআর ও ঘরেই ছিল। এমন সময় তাদের দরজায় পাক সেনারা কড়া নাড়া। শার্ট-প্যান্ট পড়–য়া তন্নি তার বাবা হবে ভেবে দরজা খুলেই যেন থমকে যায়। এই প্রথম সে মিলিটারী দেখল। এক মিলিটারী উর্দু ভাষায় তাকে জিজ্ঞেস করে-
:তোমারবাড়িতে কে কে আছে?
তন্নি বুদ্ধি কওে উল্টর করে যে সে একাই রয়েছে। তারপর ওর হাত ধওে নিয়ে এসে ওদেও উঠোনে দাঁড় করিয়ে এক এক করে প্রশ্ন করতে থাকে।
: খোকা, তোমার নাম কি?
খোকা শব্দটি শুনতেই তন্নির মনে ছেলে ছেলে ভাব চলে আসে। সে চিন্তাকরে, হয়তো মিলিটারীরা আমাকে চিনতে পাওে নাই যে আমি ছেলে নাকি মেয়ে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তন্নি বলে ওঠে-
: আমার নাম মোঃইউসুফআলী।
: তুমি কি গ্রামের পথঘাট ভালো কওে চিনো, খোকা? সত্য না বললে গুলি করব।
: হ্যাঁ, আমি চিনি।
: চল আমাদের সাথে। এই গ্রামের সকলের বাড়ীতে নিয়ে যাও। তোমাকে আমরা মারব না। তুমি বাচ্চা ছেলে। একটু পর চলে এসো কেমন?

এমন পরিস্থিতিতে তন্নি বিপাকেই যেন পরে যায়। নাপারছে ওদেও হাত থেকে রেহাই পেতে, না পারছে মা’কে ডাকতে। কিন্তু ওর প্রবল সাহস ওকে তাড়া কওে ফিরছে। ও জানে, ওর বাবা যুদ্ধেই গেছে। তাই ও যুদ্ধ করতে চায়। যেহেতুএদের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছে, তাই ওর বাবাকে সহ সকল মুক্তিবাহিনীকে এদেও কার্যবিধির খবরাখবর দিতে পারবে। তাই ওদেও কথামাথা পেতে নিয়েগ্রাম ঘুরতে থাকে। ওর সামনে ওই গ্রামের জমসেদ, রকিব, নূরনবীকে হত্যা হতে দেখে সেদিন। তন্নির গাঁ শিউর্ েওঠে। ভয়বাড়তে থাকে। আর ভাবতে থাকে, ‘আমাকে ওরা কখন বাড়ি যেতে দিবে? যদি বুঝতে পারে, আমি ছেলে নই, তাহলে কি আমাকে ওরা ভাল রাখবে?

সন্ধ্যায় তন্নিকে মিলিটারী বাহিনীরা ওদেও ক্যাম্পে নিয়ে রাখে।
: খোকা, তুমিচিন্তা কর না, কালই তোমাকে বাড়ি যেতে দেব। আমরা এখান থেকে কাল চলে যাব।
তন্নি একটু স্বত্বি পায়। তন্নিকে মিলিটারীরা আদও যতœ করতে থাকে। ভাল মন্দ খেতে দেয়। তন্নি বুঝতে পারে, হয়তো ওরা আমাকে মারবেনা। কিন্তু ভয় একটাই, আমি তো মেয়ে। যদি জেনে যায়!

রাত গড়তেনাগড়াতেই মিলিটারীরা সবাই আড্ডা জমায়। তন্নিকে ওরা সঙ্গে নেয়। তন্নির ক্লান্ত শরীরে যেন তা নিতে পারছিলনা। পেট চুপছে আসছিল। ওদেরখাবার খেতে পারেনি খুব একটা। ছেলেদের শার্ট পড়লেই আর চুল ছোট থাকলেই কি নারীত্ব বোঝা যায় না? ১৬ বছরের একজন মেয়ে তার শারীরিক গঠন কেমন হতে পারে? নারীদেও শরীরের স্পর্শই বা কেমন হতে পারে? একজন পুরুষ মাত্রই তা নির্ণয় করতে পারে। তাই আড্ডা স্থলে মোঃ ইফসুফ আলী পরিচয়ের কিশোরকে একজন যুবতী হিসাবে আবিষ্কার  করতে জাদরেল মিলিটারীদের আর সময় করেও ঠালাগেনা।
সে সময় মেয়েদের ইজ্জ্বত হনন করা মিলিটারী জানোয়ারদের এক নেশা হয়ে দাঁড়ায়। তন্নিদের মত যুবতি পেলেতারা সব ভুলে যায়। শকুনের মত দেহটা কে চিড়ে চিড়ে ভক্ষণ করতে থাকে। আড্ডা বেশ ভালই জমে ছিল সে রাতে ঔ ক্যাম্পে। তন্নি ভাব ছিল, সকাল হলেই মুক্তি পাব। কিন্তু তারক্ষুধার্ত শরীরের গড়ন দেখে এক মিলিটারী তার বুকে হাত দিয়ে ফেলে। খামছে ধরে নব বেড়া ওাা নারী ত্বকে। তন্নিরপৃথিবীটা যেন উল্টো হয়ে যায় নর পশুর শক্ত হাতের থাবায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ও মা, জীবন গেল রে’। সবার কানে পৌঁছে যায়, তন্নি একজন নারী। তারপর দশ বারোটা শকুন তন্নির দেহটাকে ব্যবচ্ছেদ করে। খুলে ফেলে তার শখ কওে গায়ে জড়ানো লাল সবুজ শার্ট। শকুনদের লোলুপ দৃষ্টি দেখে সে আর দু’চোখ খুলতে পারেনা। তাকে উলগ্ন কওে নরপশুরা  মেতে ওঠে রঙলিলায়। অবলানারীর ‘বাঁচাও, বাঁচাও’কথাটি তাদের কানে একবারও পৌঁছায় না। কিন্তু আর কত সহ্য করা যায়। পুরুষ তো ওরা একজন নয়। তন্নির নারীত্ব কে বিলিয়ে দিতে হয় অবশেষে অসণিত পাক শকুনীদের ঠোঁটে। নিমিষে অপ্সান হয়ে ঢলে পড়ে শুকনো মাটিতে।

সকালে সূর্য ওঠে। মিলিটারিরা ছুটে যায় অন্য কোনোক্যাম্পে। তারপর তন্নির ঘুম ভাঙ্গে কয়েক শত কাকের চিৎকারে। নিজের দিকে তাকাতে পারেনা। শরীরের নি¤œাংশ জুড়ে চাপা চাপা লাল লাল রক্ত ফিনকিদিয়ে তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। পিঠে আর বুকে খামচির শত দাগ ফুলে উঠে। ধবধবে সাদা শরীরটা যেন কয়লা হয়ে গিয়েছে। বাম পাশে কাত হয়ে শার্টের ছেড়া টুকরো দিয়ে চেপে ধরে রক্ত নিসৃত ক্ষত বিক্ষত অঙ্গ। লজ্জা নিবারণ কওে ছুটে যায় প্রিয় মায়ের কাছে। গতকাল থেকে পথ চেয়ে বসে থাকা আদরের মা তন্নিকে দেখে যেন বাড়ির বারান্দায় আছড়ে পড়ে। তন্নি মুখ ফুটে বলে ওঠে, ‘মা, আমার আর কিছু রইলনা...।’
নয় মাস যায় কিংবাতারও বেশি সময়। শত শত মা বোনদের ইজ্জত হারানোর মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর ঐ সব মা বোনেরা বিরঙ্গনা হয়ে বেঁচে থাকে এই স্বাধীনতাকে দেখার জন্য। এক সময় বিরঙ্গনা তন্নি মা হয়ে যায়। জন্ম নেয় ছেলে সন্তান। কিন্তু পিতা যে কে সেই সন্তানের কোন ভাবে তা যেমন নির্ণয় করা যায় না, তেমনি জীবনের মায়া ত্যাগ কওে আত্মহত্যা করা হয়না। তন্নির বাবা যুদ্ধের ময়দান থেকে এক সময় ফিওে আসে। নাতির ফুটফুটে মুখখানা দেখে সব দুঃখ ভুলে গিয়ে তার নাম রাখে‘বাংলাদেশ’।