পদাবলি
মেঘের সফেদ জমিন
আনোয়ার কামাল
ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু ঘাসের ডগায় চুমু দিয়ে যায় মেঘপুঞ্জ ধেয়ে আসে, উড়ে যায় সোনালি ডানার শঙ্খচিল পাখনা মেলে দেয় নীলাকাশ হাতছানি দেয় তুলো তুলো মেঘের সফেদ জমিন ফেরি করে, কাশবনে ছেয়ে থাকে নদীর কিনার চরাঞ্চল আর মেঠোপথ। ডাহুক পাখির বাসা জেগে ওঠে পদ্মার চরে পল্লির প্রলেপ লেপ্টে থাকে কিষাণির পাজরে। আবার গড়ে ওঠে বসতি ঝির ঝিরে উত্তরে হাওয়া গা শির শিরে বার্তা নিয়ে আসে। আমিও বেসামাল হই খুঁজে ফিরি চেনা মুখ ধূসর পাণ্ডুলিপি; বেদনায় বিদীর্ণ মন সহসা উথলে ওঠে প্রেমময় মেঘের ভেলায়- তুমিও শরিক হও, আমরা দু’জন ভেসে বেড়াই নায়ের গলুই ধরে জলের ছোঁয়া নিয়ে ভেজাই উদোম শরীর।
শরতের মাঠ
হাসান ওয়াহিদ
হলুদ ডানাঅলা একটি পাখির মতো
মাঠটা আমার সামনে ভাসছে
নরম আউশ ধানের
ক্ষেতে বসে প্রকৃতি
দু’টো ভালোবাসার কথা লিখে
উড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়।
বনপথে দেখা মিলছে
মন কেমন করা পাখির-
এখনও তীব্র রোদ
নসিমন অন্যত্র থেমেছে।
শরতের মাঠ নিয়ে যাচ্ছে সৃষ্টির দিকে।
দীর্ঘ কবিতা : প্রিয় পাখি সারস
প্রিয় পাখি সারস
সাদিক আল আমিন
এসো তবে পাখি সারস-
কিছু পারিবারিক আলাপচারিতা হয়ে যাক
উদাসীন অশ্বত্থের নিচে জেগে থাকে যেসব
ব্যতিগ্রস্থ ঘাসেদের উম্মাদ কেশরের মতো জীবন
তাদের নিয়ে কিছু মূল্যবান মুহূর্ত ব্যয় করি
তবে হ্যাঁ, ঘরে ফিরে যেনো না শুনি চারুলতার সরব অভিযোগ
তুমি দিয়োনা যেন তাকে কোনো নালিশ, যে লোকটা
ইদানীং ভীষণ অসামাজিক হতে শুরু করেছে !
যে মায়ের প্রসববেদনা প্রথম গর্ভ থেকেই দারুণ নীল
অস্ফুট যন্ত্রণায় যেসব পিতার সামর্থ্য ঝড়ে পড়ে সবুজপত্র ঘাসের বুকে
তারপর জন্ম নেয় তোমার মতো দুরন্ত বিহঙ্গ পাখি
তুমি তাদের মর্মদহন বোঝো ? পিতামাতার ?
অথবা পরাগায়ণ হবে এমন বিকেলে
সকল সিদ্ধান্ত, বস্তুগত আলোচনা শেষে-
স্বল্পদৈর্ঘ্য দূরত্বে কোনো ফুলের সান্নিধ্যে যেতে না যেতেই
যারা ভ্রমরের নেশায় মেতে ওঠে- তাদের কথা
ভেবেছো কি কখনো ? পাখি সারস ?
এই নীল বেদনা বস্তুত আর্তনাদের স্বীকারোক্তি...
এতে নেই কোনো ‘ব্যথার দান’ অন্তিম প্ররোচনা
কেবলমাত্র বহুযুগ ধরে ঘটে আসছে এমন মতান্তরের দায়ে
তুমি হয়ে উঠছো জলজ্যান্ত এক যন্ত্রপাখি-
শুধু খাদ্য যোগানেই সীমিত থেকে- সুখনীড়ে ফিরছো
হে পাখি সারস ! কখনো পর্যবেক্ষণক্ষম দৃষ্টির প্রশ্রয়ে
ভেবে দেখো কিছু লাজুক সন্ধিক্ষণ-
কাঁচা বেলের স্বাদ নিতে যে বালিকাটি আজ বিকেল থেকেই
ছুটে চলেছে গ্রামান্তরে, তরুণ সবুজ ঘাসে ঘাসে-
গন্ধভরা সর্ষে তেলের ঝাঁঝে আর মুখরোচক লবণে
মিশিয়ে খেতে চায় কৎবেল- অথচ কোথাও কোনো
সম্ভাবনার লক্ষণ না দেখে যে ফিরে যেতে থাকে
ধূলিমাখা পায়ে- ফরিদ মিয়ার বাড়ির পাশের
সাঁকোর কোলে ভর দিয়ে- নিলাজ সন্ধ্যেবেলা যে বালিকাটি
ফিরে যায় ঘরে- তার কি কখনো বেলের সাধ মিটবেনা !
বলো পাখি সারস- যে দুরন্ত পাখিটির জন্যে তুমি
এতোকাল হতব্যস্ত হয়ে তৃণ যোগাড় করে গেলে-
সেই সারসী কি পারতোনা হতে এক নিষ্পাপ বালিকা ?
আরো কিছু আক্ষেপ শোনাই তোমাকে...
ডালিমপাড়ার মেয়ে আক্তারা পারভীন-
এক সন্ধ্যেবেলা, যাত্রাগানের দিনে আমাদের গ্রামের স্কুলমাঠে এসে
বারোমিশালি খেতে খেতে খুব সলজ্জ নিয়ন্ত্রণে
তীরের মতো দুটো চোখ আমার দিকে ছুড়ে মেরেছিল
আর উদ্দম তর্জনী তার বেখেয়ালি বারোমিশালির সাথে
শাদা দাঁতের নিচে চাপা পড়ে যায়-
বলো পাখি সারস- তুমি কি কখনো প্রত্যাশা করোনি
কোনো উদাসীন সারসিনীর খেয়ালি মনের বিষ !
আরো কিছু কথা তোমাকে বলা যেতে পারে, তাই
আজকের জন্য সংক্ষিপ্ত রাখছি এ আলোচনা
কথন যখন বিস্তর হয়, তখন পর্যায়ক্রম মানা ভালো
যেমন ‘অধ্যবসায়’ রচনার প্রতিটি পয়েন্টের জন্য বাতেন স্যার আমাদের
আলাদা আলাদা নম্বর দিতেন ।
আরো এক সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো...
দু’টো ভিন্ন সত্তার জন্যে এ মন অবিরত চঞ্চল
বাড়ি ফেরা দরকার- পাখি সারস, খুব সম্ভব তুমিও
আমার মতো করে ভাবতে শিখে গেছো-
চারুলতার কোনো অভিযোগ হয়তো শুনবোনা আর কোনোদিন !
তুমিও নিশ্চয়ই গিয়ে বলবেনা- লোকটা ভীষণরকম
নস্টালজিক হতে হতে তোমাকেই ভুলে গেছে !
গল্প : গুড়ের জিলাপি
গুড়ের জিলাপি
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
তখন বিকেল। জাফর সাহেব বাজারে যাবেন। তাই কার কী লাগবে জানতে চাইলেন। লিস্ট থাকলে বাজার করতে সুবিধে হয়। ‘দাদু, তোমার আব্বুকে বলো আমার পান শেষ হয়ে গেছে। আর তুমি কী খেতে চাও? গুড়ের জিলাপি? ঠিক আছে। আব্বুকে বলে এসো। তবে একদম চুপিচুপি। দেখো, তোমার মা যেন জানতে না পারে। তাহলে বকবেন।’ কোহিনুর বেগম তার নাতি সুপ্তকে এসব কথা শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু অত শত চিন্তা করার সময় নেই সুপ্ত’র। সে পাশের রুমে ঢুকেই নামতা পড়ার মত বাবাকে বলল, ‘দাদির পান শেষ হয়ে গেছে। আমার জন্য জিলাপি এনো।’ মা পাশেই ছিলেন। তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ‘দেখেছো বুড়ির আক্কেল জ্ঞান। এইটুকু বাচ্চার কাছে পানের বায়না পাঠিয়েছে। তোমাকে আগেই বলছি, মানে মানে আপদ বিদায় কর। বসে বসে শুধু ছেলের অন্ন ধ্বংস করছে। ক্যান, ছেলে কী তার এই একটাই? আর গুলার কাছে পাত্তা পায়না, বুঝলে। বাপের বড় ছেলেরা কী সব কী তোমার মত ভাদাইমা হয়?’ এরপর প্রায় আরও আধা ঘণ্টা মা কথার তুড়ি ছুটালেন। ততক্ষণে বাবা বের হয়ে গিয়েছেন। দাদির রুম আর বাবা-মার রুম পাশাপাশি লাগোয়া। দাদির কান এখনও পরিস্কার । সুপ্ত আবার যখন দাদির কাছে ফেরত আসল, তখন দাদি তড়িঘড়ি করে নিজের চোখ মোছায় ব্যস্ত।‘ দ্যাখ না দাদু ভাই! কী সব ছোট ছোট পোকা শুধু চোখের ভেতর চলে যেতে চায়।’ দাদি যে কিছু একটা লুকাচ্ছেন তা বোঝার বয়স তখনও সুপ্তর হয়নি। সুপ্ত’র দাদি কোহিনুর বেগম গ্রামের মানুষ। শহরে তার মন একদম পোষ মানে না। সারাক্ষণ গ্রামে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন আনচান করে। কিন্তু গ্রামে আপন কেউ থাকে না। সব খালি পরে থাকে। দেখারও কেউ নেই। অথচ এক সময় সবাই ছিল। এক কৃষক পরিবারে বিয়ে হয়েছিল দাদির। তার শাশুড়ি ছিল বড্ড দজ্জাল। নুন থেকে চুন খসলেই বাড়ি মাথায় তুলতো। সুপ্তর বাবা তখন পেটে। একবার খুব অসুখ করেছিল তার। ডাক্তার সব দেখে-শুনে শাশুড়িকে খুব বকা দিয়ে ছিলেন। ‘আপনি কী মানুষ , না ডায়নি। এ সময় কেউ পোয়াতি বউকে এভাবে খাটায়। আপনি কী ছেলে বউ আর গর্ভের সন্তানকে মেরে ফেলতে চান?’ কোনো কথা বলতে পারেনি শাশুড়ি। ডাক্তারের পায়ে পরে ছেলের বউ আর গর্ভের সন্তানের জন্য মাথা ঠুকেছে। নামাজে বসে দোয়া করেছে। একটি সুস্থ পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছিল কোহিনুর বেগম। পরিবারের সবাই কী যে খুশি হয়েছিল বলে বোঝানো যাবে না। তারপর শাশুড়ির স্বভাব একদম বদলে গেল। তিনি নিজের মেয়ের চেয়েও আপন করে নিলেন কোহিনুর বেগমকে।
নিজে এসে চাবির গোছা আঁচলে বেঁধে দিয়ে সংসারের সকল দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন তাকে। আর শাশুড়ি মাতলেন তার নাতিকে নিয়ে। এক মুহূর্তে অবসর নেই। আজ এত বছর পর মৃত শাশুড়ির কথা মনে করে চুপিচুপি কাঁদলেন কোহিনুর বেগম। সুপ্ত’র বাবা তখন খুব ছোট। বড্ড জ্বালাতন করত তাকে। প্রচন্ড শীতের রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোহিনুর বেগমও সন্তান কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। এমন সময় ছেলে পানির কল চালিয়ে দিয়েছে। মুহূর্তে সারা শরীর ভিজে একাকার। কোহিনুর বেগম শীতে ঠকঠক করে কাঁপছেন। কিন্তু ছেলেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দেয় নি। বরং ভেজা গা মুছে নিয়ে গরম কাপড় দিয়ে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন বুকের মানিক; সন্তানকে। আর আজ....? তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ছিল একটি সুখের সংসার। খুব কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। মুরগির ডিম, গরু, ছাগল বিক্রি করে সন্তানের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। সন্তানেরা আজ সবাই উচ্চ শিক্ষিত। চাকরিও করছে। অথচ মানুষটি দেখে যেতে পারল না। তাকে একলা করে দিয়ে মানুষটি চলে গেল। নাহ! সে চলে যেয়ে ভালই করেছে। সন্তানদের এমন আচরণ দেখলে মানুষটি নিশ্চয়ই মেনে নিতে পারত না। সুপ্ত’র কণ্ঠস্বরে সংবিৎ ফেরে দাদির। ‘অমন করে কী ভাবছ দাদি।’ ‘নাহ, দাদু ভাই তেমন কিছু না। তোমার টিচার আজ পড়াতে আসবেন না?’ ‘হ্যাঁ, একটু পর আসবেন।’ ‘তাহলে তুমি হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল, কেমন?’ সুপ্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আজ কোহিনুর বেগমের কেন যেন মন খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। পুরনো স্মৃতিগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠছে। স্মৃতিচারণ করা বৃদ্ধ বয়সের একটি রোগ। কেউ শুনুক বা নাই শুনুক এ বয়সে বকবক করা লোকের স্বভাব। মানুষটি তাকে খুব ভালোবাসতো। হাট বাজারে গেলে কোনো দিন খালি হাতে বাড়ি ফিরত না। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে , খালি হাতে কী ফেরা যায়? অন্ততঃ একটা করে চকলেট সবার জন্য বাধা থাকত। সুপ্ত’র দাদা গুড়ের জিলাপি খেতে পছন্দ করতেন। তাই হাট-বাজার থেকে ফিরলেই এক পুটলি জিলাপির প্যাকেট হাতে দিয়ে বলতেন, ‘এই নাও জাফরের মা সবাইকে ভাগ করে দাও।’ আমি ঠিক মত পেয়েছি কী না, খেলাম কী না- তা না জিজ্ঞাসা করে মানুষটি কখনও জিলাপি মুখে তুলতো না। আজ এত বছর পর মানুষটির কথা খুব মনে পড়ছে। কতদিন তার হাতে কেউ জিলাপি প্যাকেট তুলে দেয় না। ‘কেউ বলে না তুমি খেয়েছ জাফরের মা?’ এতদিনে জিলাপির স্বাদই সে ভুলে যেতে বসেছে। কোহিনুর বেগমের প্রত্যাশা ছিল নাতির জন্য জিলাপি আনলে হয়তো তার ভাগেও এক টুকরো পরবে ! কিন্তু কেন যে তা আজ মুখ ফুটে বলতে গেল? খুব লজ্জা লাগছে তার।
শুভ্র শরতে কাপাসিয়া কলেজ ক্যাম্পাস
শুভ্র শরতে কাপাসিয়া কলেজ ক্যাম্পাস
শামীম শিকদার
কয়েকদিন ধরে কোন বৃষ্টি হয় না। তাই পুরো কলেজ ক্যাম্পাসটিতে কেমন যেন একটি ফ্যাকাসে ভাব। কলেজের মাঠের দূর্বা ঘাস গুলোও যেন শুকিয়ে বিবর্ণ সবুজ রঙ্গে পরিণত হয়েছে। উত্তর পাশ দিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসের মূল ফটকে প্রবেশ করতেই মাঠ পেরিয়ে পুকুর পাড়ের পশ্চিম পাশের সাদা সচ্ছ কাশ ফুল গুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে, তা স্পষ্ট চোখে পড়ে। কিন্তু শুভ্র শরতের স্নিগ্ধ এই প্রকৃতিতে কোথায় যেন একটি শূন্যতা জড়িয়ে আছে । আকাশ বেশ মেঘলা, সাদা মেঘের টুকরো গুলো এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে; দেখলে মনে হয় যে কোন সময় অঝরে কান্না শুরু করবে। হঠাৎ করেই টুপটাপ বৃষ্টিতে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে বৃষ্টি প্রেমিদের জন্য আনন্দের একটি জোয়ার বয়ে গেল। মাঠের বিবর্ণ সবুজ দূর্বা ঘাস গুলো পরিপূর্ণ ভাবে তাদের প্রাণ ফিরে পেল। পুরো মাঠে সবুজের ছোঁয়ায় সহজেই দৃষ্টি কাড়ছে চোখের। আমি, কিবরিয়া, ইয়াসিন, শান্ত সহ আমরা প্রায় ৬-৭ জন একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে অবস্থান করছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ভবনের ঘা ঘেসে আকাশি গাছ গুলো ভিজে জবুথবু হয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টিটাও বড় বেশি বায়না নিয়ে আসে। এই আছে, এই নেই; কখন নামবে, কখন থামবে বুঝারও কোন ঝোঁ নেই। গাছের ডাল থেকে পানি ছিটকে গ্রিল বেধ করে শরীরে লাগছে। শীতল পানিতে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে উদাস মনে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু না, আমার আবার বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা জ্বর পিছু ছাড়ে না। ভিজার লোভটিকে হালকা সামলিয়ে সিড়ি দিয়ে তিন তলা থেকে নিচে নমলাম। আমার বৃষ্টিতে ভিজার ভয়কে উপেক্ষা করে অনেকেই ভিজেছে, তবে তা কাক ভেজার মতো। তাদের মতো ক্যাম্পাসের ভিতরের কাশফুল গুলোও ভিজেছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে সব গুলো ফুল এক সাথে জমাট বেধে নিরবতা পালন করছে। মঝে মাঝে বাতাসের ধাক্কায় সে নিরবতা ভেঙ্গে নিজেদের রূপকে জাগিয়ে তুলছে। কাশ ফুল মিশ্রিত সবুজ বাগানের পাশেই কিছু লোক ধান ক্ষেতের পরিচর্চা করছে। আমন ধান, যা হেমন্তকালে ঘরে তোলা হবে। খুব দ্রুত দৌড়ে এক কৃষানী বাড়ি থেকে ছুটে আসছে। কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। ভাবলাম কোন বিপদ হলো না কি! কিন্তু না, মাঠের এক কোণায় গাভী বাধা রয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে থরথর করে কাপছে গাভীটি। তা নিতেই কৃষানী দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে ক্যাম্পাসের পূর্ব পাশে যেতেই চোখে পড়ল কিছু ছোট ছেলে-পেলে পুকুরে হৈইচই করে গোসল করছে। আবার কেউ কেউ পুকুর থেকে লাল শাপলা তুলছে।
শরৎবন্দনা
শরৎবন্দনা
মুহাম্মাদ এমদাদুল্লাহ্
নাগরিক কোলাহল ছেড়ে পৌঁছলাম একটি গ্রামে। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো বন্ধু শুভ্র। আমি ডাকি বইপোকা। বইপোকা বলার কারণ, শুভ্র বইয়ের প্রতি নেশা প্রচুর। যেন নেশা তার পেশায় পরিণত। দেশী- বিদেশী উপন্যাস, থ্রীলার, সায়েন্স ফিকশন তার নাগালে থাকে। তার বই পড়া দেখে আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে পারি না।
কিছুক্ষণের মধ্যে এসে হাজির হয় শুভ্র। এক- অপরের সাথে মোসাফাহ ও বুক মিলালাম। ব্রিজের উপরে নেমেছি গাড়ি থেকে। ব্রিজ থেকে দু’জন পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকি একটু গ্রামের ভেতরে। পিচঢালা পথ, মাঝেমধ্যে খানখন্দে ভরা। আমাদের দু’পাশ মিলিয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালীর ছাউনিতে। আমাদের সামনে দেখা ফসলের মাঠ জল- টুইটম্বুর। বর্ষার একটানা অস্বস্তির পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শরৎ।
ষড়ঋতুর পালাবদলে এখন চলছে শরৎকাল। শরৎ বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে; কাশফুল আর শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। নির্মল নীল আকাশের অপারে সাদা সাদা তুলোমেঘ আনন্দে ভেসে বেড়ানো সুখানন্দ। শরতের সৌন্দর্যতা ও মোহে ক্ষণিকের জন্য আমার দৃষ্টি আটকে রাখে প্রকৃতি। প্রকৃতির সাথে যে শরতের অন্তরাত্মা সম্পর্ক, অন্য কোন ঋতুতে এমন নিবিড় সম্পর্ক বুঝা ও দেখা যায় না।
গ্রাম- বাংলার শরতের সাথে জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই অনেক কিছু। যেন স্বপ্নের মতো মায়াবী আর ছবির মতো ঝকঝকে। শরৎ উদার মনে, সুন্দরের ডানা মেলে সাজিয়ে দেয় প্রকৃতির মাঝে।
সময়টা তখন দুপুরের মধ্যাহ্ন। পিচঢালা পথ ছেড়ে আমরা গ্রামের আরো ভেতরে চলে যাই। যেতে যেতে গ্রাম পেরিয়ে মাঠে এসে পড়ি। জমির আলপথ ধরে হাঁটতে থাকি। কাঁদামাটির কারণে খালি পায়ে হাঁটছিলাম। এখনো জমে আছে শিশির। শিশিরভেজা ঘাস পায়ে অনুভব হয়। শরতের ভোরে শিশির ঝরেছে, এখনো ঘাসে সূর্যকিরণ আলো ছুঁয়নি বুঝায় যাচ্ছে। গাছ-গাছালী, ঝোপঝাড় দিকে তাঁকালে মনে হয়, প্রকৃতিতে যেন সারারাত স্নান করেছে। শুভ্র কথা বলে যাচ্ছে অনবরত। তাদের গ্রামটা হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলো। আমি মুগ্ধমনে শুনে যাচ্ছি। আর দেখছি ঘুরে ঘুরে।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে চোখে ভেসে আসে, সবুজ ধানক্ষেতের তেপান্তর মাঠ। শরতের এই সৌন্দর্যতার বুকে আরো সবুজের আস্তরণ ছড়ায় ধানের গাছগুলো। বাংলা মাসের ভাদ্র - আশ্বিন এই দু’মাস শরতকাল। আশ্বিনের শেষে হাসি ফুটবে কৃষকের। হেমন্তের সময় ধানগুলো সোনারং পেঁকে মৌ মৌ গন্ধ বিলাবে। এখন এসব কচি কচি। শরত সেই হৈমন্তিকের বাণী শোনায় কৃষকের কানে।
সকাল পেরিয়ে গড়িয়ে আসে দুপুর। বকুলের ঘ্রাণে মুগ্ধ করে দেয় শরতের দুপুর। একথোকা পাপড়ি, পাঁশুটে সাদা, মধুগন্ধি বুকল ফুল। আমরা ঝোপঝাড় থেকে বেরুতেই অজস্র বকুল ফুলের সমারোহ। মাটিতে ঝরে আছে। বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত বকুলের আগমণ। শরত ধরা দেয় বকুলের কাছে। বকুলের সৌরভ মেখে নেয়। শরত সুবাসিত হয়। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন-
‘ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল’
‘আঁচল আকাশে হতেছে আকুল’
শরতের দুপুরের নির্মলতার হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের নীলকাশের অপারে। শুভ্রমেঘের সাথে মুগ্ধমনে হাঁটছি। শুভ্রর মনটাও শরতের মতো নির্মল হাসছে। তার হাসিতে যেন মুক্তামালা ঝরে পড়ছে। আমরা হাসছি- খেলছি আবার কখনো বা কোথাও গিয়ে বসছি।
দুপুর যতো যাচ্ছে নীলের গভীরতা ধীরে ধীরে বেড়ে চলছিলো। আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। মেঘগুলো যেন এক-অপরের সাথে কম্পিটিশন দিয়ে চলছে। কখনো উধাও হয়ে যায়, আবার হারিয়ে যায় শূন্যতার আড়ালে। এ নিয়ে ভাবতে থাকি গভীরভাবে দীর্ঘ শরতের আসা-যাওয়ায়। সেই ভাবা থেকে আজও ভাবি।
কিছু দূরে দেখা মিললো কাশবনের কোমল দৃশ্য। কাশ শরতের অনন্য ফুল। কাশবনের স্নিগ্ধ শোভায় প্রকৃতিকে যেন প্রাণবন্ত করে রেখেছে। হালকা বাতাসে কাশবনে শুভ্র ঢেউ ওঠছে। কাশফুলের বাহারি দৃশ্যে রাঙিয়ে আছে অপরূপে। দলবেঁধে এসে বসলো চড়ুই পাখি। এসেছে প্রজাপতি ও মৌমাছিরাও। কাশের বুকে জেগে ওঠেছে শরতের দুপুর। শরতের সাথে প্রকৃতির ভালোবাসা, আমার অন্তরে স্পর্শ করে।
পাশে হালদা নদী। তার ধারে কাশবনটি। শান্ত- নীরব নদীর স্রোত। কোন জলধারা ডেউ নেই। কিন্তু নদীর পাড়ে কাশবনে তোলেছে ছোট ছোট রুপালীর ডেউ। এমন ভাবে যেন, শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে মোহনীয় করে তোলছে মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। আর বাতাসের দোলায়, শরতের আগমনকে যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য আরো সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করে তোলেছে।
অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। গড়িয়ে আসে শরতের বিকেল। বিকেলের গড়ান হাওয়া। খুউব মনোমুগ্ধকর ও মায়াবীভরা মুহূর্ত। মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে তনু-মন। সূর্যটাও ধীর গতিতে হেলে পড়ছে পশ্চিমে। রোদ নিজেকে অনেকটা শীতল করে নিয়েছে। মিষ্টি- মধু রোদ খেয়ে বেশ সজীব হয়ে ওঠেছে প্রকৃতি।
শিউলি ফুলেরা হাসছে ধীরে ধীরে। ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। শিউলি গাছগুলো একটু নরম ধরণের। এদের জাত শত্রু পানি। সারারাত গন্ধ বিলাবে। আর শরতের শিশিরভেজা জমিনে ঝরে পড়বে সূর্য উঠার আগেই। তাই এই নিয়ে কবি বলেনথথ
‘আলোক পরশে মরমে মরিয়া’
‘হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া’
হালদা পাড়ে শিউলির ঘ্রাণে কেটে দেয় পুরো বিকেল। উদাস বিকেল, নদীর টলটলে জল একেবারেই স্থির, নিশ্চুপ। যেন শিউলির কোমল পাপড়ির অপেক্ষায় সে অনন্তকাল ধরে। শরতের সন্ধ্যা এসে দাঁড়ায় লালিমার নিচে। লাল কমলায় রাঙা হয়ে ওঠেছে শরতের মুখ। অনেকটা সময় সবুজ গালিচার উপরে কেটে যায়। এভাবেই শারদীয় দিন-রাত আসে, আসে শুভ্রতার প্রতীক হয়ে।...
অতঃপর। শুভ্র বলে : চলো এবার উঠা যাক্। আমার মন বলে, আরেকটু বসি। শরতে পাশে। বুকুলের তলায়। শিউলি ফুলের সঙ্গী হয়ে।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)