সৈয়দ শামসুল হক : বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজ প্রতিভা
সৈয়দ শামসুল হক [জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫, মৃত্যু: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬]
সৈয়দ শামসুল হক
বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজ প্রতিভা
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?
সৈয়দ শামসুল হক
[জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ মৃত্যু: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬]
অবুঝ দিনের গল্প
অবুঝ দিনের গল্প
যাকারিয়া মুহাম্মদ
বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে আছি। ছোট বাটন ফোন দিয়ে টেক্সটে কথা বলছি। কার সাথে কথা বলছিলাম ঠিক মনে নেই। সূর্য মাথার উপর আগুন ঢালছে তখন। ছোট বোন খেলনার চুলায় ডেগ বসিয়ে কী যেন রান্না করছে। আম্মা ওকে দেখে রাখতে বলে গেলেন। গরমে আমার কপালের ঘাম কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা করে। উঠোনের রেন্ট্রি গাছের ডালে একটা ঘুঘু ডেকে যাচ্ছে একা একা, কী করুণ তার সেই ডাক। আমি টেক্সটের রিপ্লাই দিচ্ছি। আর এদিকওদিক চোখ বোলাচ্ছি আলতো করে ।
পদাবলি : ০১
দীর্ঘশ্বাস
মাসউদ মাহমুদ
বুকারণ্যে তিরতিরে কেঁপে উঠে দুঃখপল্লব
চোখের কোটরে হাহাকার জমে, জেগে উঠে বেদনারা
নোনাজলের দরিয়া উপচে বেরোয় ,
রক্তাক্ত রঙচটা চোখ অপলক চেয়ে রয় কেবল
ঐ শুষ্ক মাংসল কংকাল শরীরে।
পদাবলি : ০২
নাম না জানা পাখি
রুদ্র সুশান্ত
আমাদের বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে একটি রাঙ্গা পাখি,
পাখিটার নাম জিজ্ঞাসিলে বলে- দাঁড়াও; সুরে বলে ডাকি।
আহা কি সুর মিষ্টি মধুর, অবচেতনে সুখ পাই নির্ভেজাল,
এত মধুর সুর, দেহ থেকে প্রাণ কাড়ে আজন্ম কাল।
তবে দাঁড়ায় শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের উপর,
চমৎকার মিষ্টি সুরে শিশির উড়ে গড়ায় দুপুর।
নাম বলে না পাখি।
তবুও আশ্চর্য রকম চমকপ্রদো হয়ে চেয়ে থাকি।
চোখের গোলাপি বিন্দু হতে বিচ্ছুরিত প্রেম আমাকে আরো কাছে ডাকে,
এতো মায়া এতো প্রেম এতো মোহ সব ছেড়ে চলে যাই, তবুও অল্প বাকি থাকে।
রহস্যাবৃতা
রহস্যাবৃতা
সোহেল বীর
নতুন মোবাইল ফোন কেনার পর মিসড্ কল দিতে খুব ভালো লাগত। অন্যরকম অনুভূতি কাজ করত নিজের ভিতর। বিষয়টা দারুণ উপভোগ করতাম আমি। আন্দাজে নম্বর তৈরী করে মিসড্ কল দেওয়াটা ছিল আরও বেশি উপভোগ্য। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ভালো লাগাটা বিষাদে পরিণত হলো। ভাবনার নদীতে জোঁয়ার বইতে শুরু করল। মিসড্ কল দেওয়াটা অন্যের মতো আমার কাছেও কেমন যেন বিরক্তিকর মনে হতে লাগল। সিদ্ধান্ত নিলাম আর কাউকে মিসড্ কল দেবো না। বন্ধ করে দিলাম অন্য নম্বরে মিসড্ কল দেয়া। কিন্তু নিজে মিসড্ কল দেয়া বন্ধ করলেও অন্য নম্বর থেকে ঠিকই মিসড্ কল আসতে শুরু করল। হিতে বিপরীত।
বিশ্বদ্যিালয়ের আবাসিক হলের সামনে গোল চত্বরে একা একা বসে আছি। একটু দূরে কপোত কপোতিরা বসে গল্প করছে। আমার একাকি বসে থাকাটা কারো কারো কাছে হাসির উদ্রেগ হয়েছিল বটে। তাতে কি? আমার সঙ্গী ওই নীল আর পশ্চিমাকাশের গোধূলী। গোধূলী তার পূর্ণ যৌবন নিয়ে হাজির হয়েছে এতক্ষণে। খুব আপন মনে যুবতী গোধূলীকে উপভোগ করছি। এমন সময় একটি অপরিচিত নম্বর থেকে পরপর তিনটি মিসড্ কল আসলো আমার মোবাইলে। কল ব্যাক করব কিনা ভাবলাম। শেষমেশ আমার মোবাইলে কিছু ফ্রি মিনিটের সদ্ব্যবহার করতে ফোন দিলাম। ফোন দিতেই চিকন সুরের কন্ঠ বেঁজে উঠল আমার কানে। কিছুটা ইতস্ততের সাথে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি খুলনা থেকে বলছি কিনা। আমি হ্যা সূচক উত্তর দিতেই তিনি বললেন তিনি আমার বান্ধবীর ছোট বোন। তার বড় বোন নাকি আমার সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে পড়ে। আমি তার বোনের নাম জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে কথা না বলার হুমকি দিয়ে বললেন আমি যেন তার বোন সম্পর্কে কোনোকিছু জানতে না চাই। বুঝতে পারলাম নাম জানতে চাওয়াটা হয়তো আমার অপরাধ হয়ে গেছে। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন রহস্য মনে হতে লাগল। আমি ‘আপনি’ সম্বোধন যেন না করি সেজন্য মেয়েটি আমাকে অনুরোধ করল। আমিও সুবোধ বালকের মতো তার অনুরোধের ঢেঁকি গিললাম। এরপর থেকে মেয়েটি আমাকে নিয়মিত মিসড্ এবং কল দুটোই দিতে লাগল। তবে সে সবসময় তার সুযোগ ও ইচ্ছেমতো কথা বলত।
তার সিমটা বন্ধ থাকে সব সময়। আমি ইচ্ছে করলেও তার সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। যখন আমার সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে হতো তখন সে নাকি কিছু সময়ের জন্য সিমটা তার বাসার মোবাইল ফোনে ভরে আমার সাথে কথা বলত। এভাবে দিন যত যেতে লাগল আমার কাছে তার কল দেয়ার মাত্রাটা বাড়তে লাগল। ভেবে কূল পাই না, মেয়েটি কেন আমার সাথে কথা বলে, কী চায় সে আমার কাছে। সবকিছুই আমার কাছে কেমন যেন রহস্য মনে হতে লাগল। তার সম্পর্কে কোনোকিছু না জানিয়ে মেয়েটি দিনের পর দিন আমার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলতে লাগল। আমিও তার কথার ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিলাম।
মেয়েটির বোনের সম্পর্কে জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠল মন। আমার জানা মতে আমাদের সাথে ছয়জন মেয়ে পড়ে। তাদের কারোরই ছোট বোন নেই। তাই মেয়েটির বোন কে, তা জানার আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রায়ই বলতাম, ‘তোমার বোন আমাদের সাথে, না আমাদের জুনিয়র ব্যাচের কেউ?’ কারণ, আমরাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচ। মেয়েটি নিশ্চিত করে কিছু বলত না। বলত তার বোনের সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো না থাকায় সে সঠিক জানে না আসলে তার বোন কোন বর্ষে পড়ে। কৌতূহলটা বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
মেয়েটির বোনের সম্পর্কে যখনই জানতে চাইতাম তখনই সে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করত। একদিন তো বলেই ফেলল আমি কেন এত তার বোন সম্পর্কে জানতে চাই। সে আমাকে অভিমানের সুরে বলল, ‘আমার সাথে কথা বলতে আপনার ভালো লাগে না? যদি ভালো না লাগে তবে আমি আর কোনোদিন আপনাকে ফোন দিব না!’ আমি সব সময়ই তার কথার যথার্থ মূল্য দেওয়ার চেষ্টা করতাম, কেন তা জানি না। তাই বললাম, ‘না, তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগবে না কেন? খুব ভালো লাগে।’ তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম মাত্র।
মাঝে মাঝে তার সাথে আমার দীর্ঘক্ষণও কথা হতো। কথা বলার বিষয়টা থাকতো এই যেমন মেয়েটিকে আমার কেমন লাগে, আমি কোন ধরনের মেয়েকে পছন্দ করি ইত্যাদি। আমি কোনো মেয়েকে ভালোবাসি কিনা সেটাও জানতে চাইল একদিন। আমি বলেছিলাম, ‘না’। উত্তরটা শুনে মনে হলো সে একটু খুশিই হলো। কেন খুশি হলো তা জানতে পারলাম না। তবে সে আমাকে নিশ্চিত করল যে, এই ধরনের ছেলেদের নাকি তার খুব পছন্দ- যারা প্রেম করে না! কিন্তু আমার ভিতর জন্ম নেয়া রহস্যের জট খুলতে পারলাম না কোনো মতে। মেয়েটির বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সে বললো পাংশাতে। রাজবাড়ি জেলার একটি উপজেলা পাংশা। পাংশায় আমি অনেকবার গেছি। আমার সেজমামা পাংশা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের স্যার। মামার বাসায় মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম। পাংশায় বাড়ি কথাটি শোনার পর তার সম্পর্কে জানতে আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লাম।
বেশ ক’দিন মেয়েটার কোনো খোঁজ পাই না। ভাবলাম একটাবার খোঁজ নিই- অসুখ বিসুখ হলো কিনা। তাকে ফোন দিলাম। কেমন আছে, কোথায় আছে জানতে চাইলাম। সে বলল, ‘ঝিনাইদহে’। ঝিনাইদহে! আমি বেশ অবাক হলাম! ভাবলাম, মেয়েটির সাথে দেখা করার দারুণ সুযোগ! মনটা কেন জানি মেয়েটির সাথে দেখা করার জন্য আস্ফালন করতে লাগল। কারণ একটাই- কৌতূহল। তাছাড়া কেন জানি মেয়েটিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে।
শব্দমালা : আসআদ শাহীন
শব্দমালা
আসআদ শাহীন
অনুবর্র হৃদয় ভূ-খণ্ড
অনুবর্র হৃদয় ভূ-খ-ে চাষাবাদ হয় নি বহুদিন,
ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে চাষীর জরাজীর্ণতার উত্থান-
প্রকট প্রণয়-খরায় ফেটে চৌচির হৃদয়-জমিন,
প্রেমের বারিধারা সিঞ্চনে হয়ত হবে অবসান।
খরা তপ্ত হৃদয়-ভূমিতে ফলাবে কে প্রেমফসল?
সেইজনের প্রতীক্ষায় অনুবর্র হলো হৃদয় ভূ-খ-,
চাষীর চাষাবাদে ঘটছে কেবল-ই বিহ্বল-বিফল;
যবনিকাপাতে স্বস্তির ঢেকুরে তীব্র হতাশার দ্বন্দ।
ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০১
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২০১,
শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ , ০৭ পৌষ ১৪৩০, ০৮ জমাদিউস সানি১৪৪৫
খানাবাড়ির প্যানপ্যানানি
খানাবাড়ির প্যানপ্যানানি
হাফিজুর রহমান
গ্রামের সবচাইতে বড়ো বাড়িটাই খানাবাড়ি। এই বাড়ির মানুষগুলো শিক্ষা-দীক্ষা, বংশ পরিচয়, সম্পদ - প্রভাব, সকল ক্ষেত্রেই আশপাশের আট-দশটা গ্রামের মানুষগুলোর তুলনায় সব দিক থেকে এগিয়ে থাকার কৃতিত্ব ধরে রেখেছে, দীর্ঘদিন থেকে। বিশাল বড় একটি বাড়িতে বসবাস করে এক’শোরও বেশি সদস্যের একটি পরিবার। এক হাঁড়ির রান্না করা খাবার খায় সকালে একসাথে বসে, পাকা ঘরের দীর্ঘ বারান্দায় পাটের তৈরি চট বিছিয়ে। এলাকার বাইরের অজানা কেউ দেখলে খুব সহজেই ভেবে নিবেন, হয়তো গ্রাম্য আয়োজনে কোন বড়সড় বিয়ে অনুষ্ঠানের খাওয়া-দাওয়া চলছে।
উত্তরণ
উত্তরণ
মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম
আজকের সকালটা বেশ মনোরম। সাদা ধূতি পরে খালি গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে পুকুর ঘাটে বসে আছেন হেমাকান্ত রায়। অন্য অন্য দিন মাছ ধরার বড়শি সাথে থাকলেও আজকে বসে আছে একদম খালি হাতেই। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছেন কিছু একটা। হঠাৎই সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল শুনে পিছনে তাকালেন। একগাল হেসে বলে উঠলেন ; আরে ফরিদ না-কি? কি অবস্থা তোমার? চিঠি পত্র আসলো না-কি কিছু? ফরিদ উত্তর দেয়; আজ্ঞে হ্যা। উপর ওয়ালার ইচ্ছায় ভালোই আছি। হেম বাবুর হাসির সাথে তাল মিলিয়ে একটু হেঁসে নিলো পোস্টমাস্টার ফরিদ। গাছের সাথে সাইকেল দাঁড় করিয়ে হেমাকান্ত রায়ের পাশে এসে দাড়ায়। তারপর পুরাতন সেই ব্যাগ হাতড়ে হেম বাবুর হাতে তুলে দিলো একখানা হলুদ খামের চিঠি।
চিঠিটা হাতে নিতেই কেন জানি ফ্যাকসে হয়ে গেলো হেমাকান্ত রায়ের হাস্যজ্বল মুখ। একটু আগেই যা প্রভাতের প্রথম রশ্মির ন্যায় চকচক করছিলো। তিনি চিঠি পড়তে জানেন। এমনকি গুছিয়ে লিখতেও পারেন। তবুও কিছুটা শঙ্কিত হয়ে জিগ্যেস করলেন; রফিক! চিঠিটা কে পাঠিয়েছে? হাসির রেখা স্বস্থানে রেখে উত্তর দেয়; ঐতো শষীভূসন আছে না আমাদের নিমাই বাবুর ছেলে, ভিলেতে থাকে সে। কিছুটা স্থির হওয়ার ভান করলেন কিন্তু পুরোপুরি ব্যার্থই হলেন হেম বাবু। এই পর্যন্ত তিন তিনটি চিঠি এসেছে এই একই নামে। তিনি বহু চেষ্টা করেও এই নামের কারও চেহারা স্মরণে আনতে পারলেন না। তবে এই নামে নিমাই ঘোষের একটা ছেলে আছে তা তিনি জানেন লোকমুখে। কখনো চোখে দেখা হয়েনি। যে নিমাই ঘোষকে খাজনা না আদায় করার দায়ে প্রহার করে মেরে ফেলেছিলেন।
পদাবলি : ০১
কার্তিকের আকাশ
অলোক আচার্য
একা থাকতে শিখে গেছি
বেহুলাও একাই ছিল মৃত স্বামীর পাশে
গাঙুরের জলে।
হেমন্তে মরা কার্তিকের আকাশে যেভাবে
ঝুলে থাকে নিঃসঙ্গ চাঁদ
কোনো রাত জাগা যুবকের বুকে।
পদাবলি : ০২
সফলতা বঞ্চিত জীবন
মাঈনুদ্দিন মাহমুদ
সফলতা বঞ্চিত জীবনে
বোবা কান্নায় ছেয়ে গেছে উদীয়মান বৃক্ষ।
অসার অপরিপক্বতা লাবণ্য হারিয়েছে জীবনের স্বাদ।
ক্ষীণ হয়ে এসেছে, দিগন্ত পেরিয়ে শৃংখ চূড়ায়
আরোহনের মোহনীয় সদিচ্ছা।
এখন পরন্ত বিকেল
ওপাড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করাই বাঞ্চনীয়।
লাভ ক্ষতির হিসাবে, কী আর আসে যায়
অর্ধমৃত হ্রদপিন্ডে আলেয়া তার আলো আর নাই বা ছড়ালো।
পাহাড়ের ডাক
পাহাড়ের ডাক
রাশেদ সাদী
রাত আড়াইটা। প্রধান সড়ক দিয়ে একটা মালবাহি ট্রাক আসে আর চলে যায়। এরপর দীর্ঘ নিরবতা। বসন্তের ফুরফুরে জ্যোৎ¯œায় ফিনফিনে বাতাস বয়ে যায়। দুটো বিড়াল ঝগড়ায় মেতে ওঠে। ফের সব আগের মতো, নীরব।
এমন নীরবতা ঘুমহীন রাত ইস্পাতরে ফলার মতো বুকে বিধে অস্বস্তি দিতে থাকে। বালিশ উলটা-সিধা করে, এপাশ-ওপাশ করেও আরামপদ একটা অবস্থান পাই না। ঘুম আসে না।
অন্ধকার ঘরে রেলিং গলে আলোর কতগুলো স্তম্ভ মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে কতগুলো পাতা কাঁপছে। এই দূর পাড়াতের পাদদেশে অপরিচিত হোটেলে শুয়ে ভাবতে চেষ্টা করি আসলে আমি এখানে কেন?
কিন্তু কেন যেন ভাবনাটা কিছুতেই শরীর পায় না। শুধু ফসকে যায়। ঠিক যেন পাহাড়ের মেঘের মতো। নাকে মুখে এসে ঠেলা মারছে, কিন্তু ধরতে গেলেই কিছু নেই। বরং পা-টাও যেন ফসকে যাচ্ছে। চেতনার পাহাড় থেকে কখন যেন হঠাৎ পা হড়কে যায়; পড়ে যাই ঘুমের নিঃসীম আধারে।
ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০০
তারুণ্যের শিল্প সরোবর।। বর্ষ ৮ম।। সংখ্যা ২০০,
শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১ পৌষ ১৪৩০, ৩০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫
আমি কি বাংলাদেশ!
আমি কি বাংলাদেশ!
রোমেনা আফরোজ
একজন মানুষের অনেক পরিচয় থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবুও বিবাহিত জীবনে সব পরিচয় বাদ দিয়ে মাত্র একটা পরিচয় নিয়ে বেঁচেছিলাম। এখন পর্যন্ত সেই আঁশটে গন্ধ শরীরে লেগে আছে। একটা পরিচয়কে সর্বাধিক মূল্য দিতে যেয়ে মা হতে পারিনি। নারীসত্তা কোথায়, কোন্ বাঁকে যে হারিয়ে গেছে খেয়ালও করিনি। মানুষ হওয়ার পথ তো বহুদূর বাকি। পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সর্বোপরি সংস্কৃতি আমাকে শিক্ষা দেয়নি, কেউ একবারও বলেনি, জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না; শ্বাস নিতে পারলেই জীবন হয়ে ওঠে না। এগুলো যে পরম সাধনার বস্তু, একমাত্র সাধকই পরমের সন্ধান পায়, এই শিক্ষা পেয়েছি সেদিন, যেদিন আমার মর্মমূলে সচেতনতার বৃক্ষ আস্তে ধীরে কুঁড়ি মেলছিল। এই বোধোদয়ের বিলম্বের কারণে একা চলার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অনেকটা সময় লেগেছে। আমার দ্বিধাদ্বন্দ্বের হেতু শুধু আর্থিক নয়, মানসিকও। বর্তমানে রাজনীতিবিদরা যেমন অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে মুক্ত হয়, আমি তেমন পথে না যেয়ে বলছি, আমার যন্ত্রণার অনেকটুকু উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হলেও এর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য আমিই দায়ী। যখন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়, তখন নিজেকেই নিজের মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভুত হতে হয়। আমার চারপাশের অনেক নারীকে দেখেছি, সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা অটলবৃক্ষের মত মজবুত। পারিবারিক অসমর্থন, এমনকি আর্থিক সংকটও তাদের থামাতে পারছে না। শুধু পরিবারের বিরুদ্ধে নয়, তারা সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছে। তাদের জীবন আমাকে মুগ্ধ করতো। আমি তাদের মত হতে চাইতাম। একজন যোদ্ধা হতে চাইতাম, যার কাছে পরিশ্রম এবং শরীরের ঘাম সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস আরম্ভ করার সময়েও জানা ছিল, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতাম। তবে সেসময় জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। সম্ভবত সেটাই কাল হয়েছিল। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় কালবেলা, গর্ভধারিণীর মত বই পড়েছি। জেমস বন্ড ছিল প্রিয় মুভি সিরিজ। বাবার অনুপ্রেরণায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখতাম। তবে কো-এডুকেশনের জন্য চট্টগ্রাম কলেজে ভতির্র বিষয়টি তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্তের বিপরীতে যেয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছি। জামাত-শিবির ট্যাগ মারা কলেজে ছোট চুলে উড়ে বেড়িয়েছি মুক্ত বিহঙ্গের মত। সেই সাতানব্বইয়ে একা একা পথ চলেছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গেছি অসংখ্যবার। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমার মধ্যে পুরুষ শক্তি বিদ্যমান (মাস্কুলিন এনার্জি) ছিল। মা-বাবার মধ্যে একটা ঘাটতি তো ছিলই। তার মধ্যে আমরা পাঁচ বোন হওয়াতে ছোটবেলা থেকে এ নিয়ে নানা জন নানারকম কথা বলেছেন। সবার অবহেলা, অপমানবোধ বয়ে বেড়াতে যেয়ে সম্ভবত জেগে উঠেছিল পুরুষ শক্তি। ডারউইন তাঁর ন্যাচারাল সিলেকশনে এমন বিবর্তনের কথা বলেছেন। মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে কখনো-সখনো অনুভূতির সংযোজন করতে হয়; আবার কখনো বিয়োজন করতে হয়।
নতুন পৃথিবী আমার জন্য বিভিন্ন নিয়ম-কানুন, বাধা-নিষেধ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বই পড়া বারণ। কলেজ বন্ধুদের সাথে মেলামেশা একেবারে বন্ধ। এমনকি একমাত্র মেয়ে বান্ধবী নিয়েও চরম আপত্তি ছিল। এতো নিষেধাজ্ঞার শেকল নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। কিন্তু তাতে মানসিক উৎকর্ষ হয়নি। পরিবারের সমর্থনে দেবতার আচরণ ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করছিল। ড্রাকুলার মত রক্তপিপাসু হয়ে উঠছিল মানুষটা। বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের কারণে পরিবারের যুক্তিবোধের জায়গাটা শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল। দেবতার গলার স্বর রপ্ত করে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন শাসন করছিল আমাকেই। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম পরিবারের রূপান্তর। এসব কারসাজির সাথে তাল মেলাতে না পেরে একসময় ভেঙে পড়ি। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনে বিভিন্ন অসুস্থতা ছায়াসঙ্গীর মত লেপ্টে থাকে। আমার শিক্ষা-দীক্ষা বোধবুদ্ধি সব পরিণত হয় অজ্ঞতায়। দুর্বলতার সুযোগে দেবতার স্বৈরাচারী আচরণ আরও বেড়ে যায়, তিনি হয়ে ওঠেন সর্বগ্রাসী ফ্যাসিস্ট। একের পর এক (কালা কানুন প্রণীত হয়) গ্রেনেড হামলা চলে। একসময় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিতে আকণ্ঠ ডুবে যাই। এক মুহূর্ত চিন্তার করার অবকাশ নেই। সারাক্ষণ অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কা, ভয়-ভীতি। তখন স্বপ্ন দেখিনি। ভাবতাম, এক মুঠো ভাত এবং মাথা গোঁজার ঠাই পেলে ঠিক পালিয়ে যাব। কিন্তু একবারও অনুধাবন করিনি, মুক্তি বিনিময়যোগ্য উপহার সামগ্রী নয়।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি!
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি
হাবিবাতুল উম্মে
যদিও সেই যুদ্ধ দেখিনি চোখে তবে দাদার কাছ থেকে শোনা গল্পও শুনে মনে হয়েছে; আমিও যেন সেই যুদ্ধের যোদ্ধা ছিলাম । আমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা । রংপুর ৬নং সেক্টরে মেজর জলিলের সাথে ছিলেন । আমি বড় ভাগ্যবতী মনে করি নিজেকে এজন্য আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতনী। তার বিরল অভিজ্ঞতা শোনার সময় হয়েছে। সুযোগ হয়েছে । আর এ রকম ভাগ্যবতী ক’জন হয় ।
দাদার কাছ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কথা থেকে আমি বুঝতে পারি যে; আমাদের সোনার বাংলাদেশ স্বাধীন করতে কত ত্যাগ; কত বিসর্জন; কত প্রাণ; কত রক্ত ঝরেছে তার হিসেব করা মুশকিল ।
দিনশেষে আমি; আপনি কিংবা আমরা সবাই যদি হিসেব করি যে, আমাদের এত ত্যাগ; এত বিসর্জন; এত প্রাণ; এত রক্ত কেন দিয়েছিলাম তবে এর উত্তর পাবো কিনা আমার সন্দেহ রয়ে গেছে ।
বর্তমান সময় নিয়ে আমরা কিভাবে দিনযাপন করে চলেছি; সেটা নিয়ে বলতে গেলে কত কথা লেখা সম্ভব আমি জানি । আমাদের সাধারন বাঙালীর মনে ভেতর কত রকমের ইচ্ছে; কত রকমের স্বাদ; কত রকমের আহ্লাদ আছে এই স্বাধীনতা নিয়ে; সেটা বলা অনুমেয় না। আমরা যেহেতু স্বাধীন দেশে বসবাস করি; সেহেতু আমাদের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা কিংবা বেচে থাকার পাথেয়গুলো অন্যরকম হবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু কই ? আমরা তো আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে বাচতে পারি না; আমরা তো আমাদের অধিকার নিয়ে চলতে পারিনা; আমরা আমাদের নির্জীব চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে থাকতে পারিনা । কোথাও যেন বাধা পড়ে যাই আমরা; কোথায় যেন আটকে যায় আমাদের সময় । বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি বারবার; আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা আজ কোথায়; আমাদের বিসর্জন সব ত্যাগ; রক্তের মূল্য কি এই ছিল !
আজ আমার সোনার বাংলাদেশ কেমন অসুস্থ হয়েছে গেছে; বৃদ্ধ হয়ে গেছে । সাধারন মানুষের মনের ভেতর কত রকমের দুঃখ; কত রকমের শোক; কত রকমের আহাজারী; কত রকমের আর্তচিৎকার; কেউ শোনেনা; কেউ দেখেনা; কেউ বোঝেনা । কিন্তু একটা সময় আমরা মানুষ খুব করে চেয়েছি; আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে আমার পাখির মত দারুণ জীবন কাটাবো; হাওয়ার মত ভেসে বেড়াবো, নদীর মত বয়ে যাবো । কিন্তু হায়! হলো না আমাদের পাখির মত বাচা; হলো না হাওয়ার মত ভাসা; হলো না নদীর মত বয়ে যাওয়া । এই অপূর্ণতা নিয়ে আমরা সাধারন মানুষ একদিন মরে যাবো; এই দুঃখ নিয়ে আমরা একদিন কোথাও হারিয়ে যাবো; এই শোক নিয়ে আমরা একদিন বোবা হবো । তখন ওরা আমাদের মরে যাওয়া দেখবে; আমাদের হেরে যাওয়া দেখবে; আমাদের বোবা হওয়া দেখবে । হয়ত ওরা ভাবতে পাবে; আমাদের এমন যাপিত জীবন উপহার দিয়ে ওরা ভীষণ ভালো থাকবে । কিন্তু না; মানুষের দুঃখ; শোক বাতাশে মিলিয়ে যায় না; রুপান্তর হয়ে ফিরে আসে আবার মানুষের কাছে ।
আজ আমরা দাবি করি; আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করি । কিন্তু একটা বিষয় চিন্তা করলে বুঝতে পারি; স্বাধীন দেশে বসবাস করলেও স্বাধীন দেশের যা যা পাওয়া উচিত; তার কিছু আমরা পাইনা । আমরা একটা খাচার ভেতর বন্দি; আমাদের কথা বলার কোনো অধিকার নেই; আমাদের বেচে থাকার কোনো সঠিক পাথেয় নেই! আমাদের বেচে সুস্থ পরিবেশ নেই ।
সবশেষে আমাদের চাওয়া তো এটাই যে; আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করে যেন স্বাধীন দেশের সকল চাওয়া-পাওয়া; অধিকার নিয়ে বেচে থাকতে পারি; সুস্থ সুন্দর জীবন ধারন করতে পারি। আমরা আমাদের সোনার বাংলাদেশকে কখনোই নষ্ট করতে দিবো না। জীবন দিয়ে হলেও ধারন করে রাখবো বুকে। তাই গুনগুন করে মনের ভেতর থেকে বেজে ওঠে- আমার সোনার বাংলা; আমি তোমায় ভালোবাসি; রক্ত দিয়েছি মাগো তাই তোমায় ভালোবাসি !
রক্তরে ক্যানভাসে র্পূণতার শউিলি
রক্তরে ক্যানভাসে র্পূণতার শউিলি
তামীম আল আদনান
ছটিফেোঁটা আলোকছটায় উজ্জ্বল সন্ধ্যারাগ, যনে বধিাতার নপিুণ হাতরে কারুকাজ। উঠোন জুড়ে লপ্টেে আছে গাঢ় নীরবতা। জামগাছ তলায় সন্ধ্যার বঠৈক বসছে।ে দুধ-সাদা দাঁড়ওিয়ালা একজন বৃদ্ধরে দকিে অপলক চয়েে আছে একটা নষ্পিাপ শশিুদল। তাদরে চোখভরা উত্তজেনা। বৃদ্ধ নরিবে বলে যাচ্ছনে একটা ত্যাগরে গল্প। রক্তরে গল্প। হারানোর গল্প। বজিয়রে গল্প। শশিুদল মনোযোগী ছাত্রদরে মতন বৃদ্ধরে কথা শুনছ।ে খানকি থমেে তনিি আবার বলতে শুরু করনে- ‘একদনি সকালে ঘুম থকেে উঠে দখেি আব্বাজান বাড়তিে নাই। উঠোনে জড়সড় হয়ে পড়ে আছে আম্মাজান। আমি দৌড়য়িে আম্মাজানরে কাছে যাই। আম্মাজান আমারে বুকরে সাথে জাপ্টাইয়া ধইরা কয়- বাজান! তোমার আব্বারে মলিটিাররিা নয়িা গছে।ে আমওি আর বশেক্ষিণ এই দুনয়িায় থাকতে পারবো না। যাওয়ার আগে একটা কথা বইলা যাই তোমার।ে কথাটা মনে রাখবা- তোমার আব্বাজানরে মতন অনকে মানুষরইে মলিটিাররিা ধইরা নয়িা গছে।ে তারা আর কখনও ফরিে আসবে না। কন্তিু তুমি এখন থকেে যতদনি দশে স্বাধীন না হবে ততোদনি র্পযন্ত জীবনরে মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে শরকি হবা। আর কারও বাবারে যনে মলিটিাররিা ধরে নতিে না পার।ে আর কোনও ছলেে যনেো তোমার মতন মা হারা না হয়। এটাই এখন তোমার জীবনরে একমাত্র উদ্দশ্যে। তারপর আম্মাজান আমারে আরো একবার বুকরে সাথে জাপ্টাই ধর।’
বৃদ্ধরে দুধ-সাদা দাঁড়ি ধুয়ে পড়ছে চোখরে জল। চোখরে জলে চাঁদরে আলোর প্রতবিম্বি হয়। সদেকিে অপলক চয়েে আছে শশিুদল। সন্ধ্যার উঠোন পড়েয়িে প্রকৃতি এখন রাতরে পোশাকে আবৃত হচ্ছ।ে বালকিার চোখে দওেয়া কাজলরে মতন অন্ধকার রাত্রি নমেে আস।ে সইে রাত্রতিে জ্যোৎস্নার পয়োলা উল্টয়িে দয়ে উজ্জ্বল শশী। চোখমেুখে জ্যোৎস্নার আলো মখেে বৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করনে- ‘তারপর টানা নয় মাস যুদ্ধ হয়। মা-বাবা হারনোর তীব্র শোক আর প্রতশিোধরে অনল বুকে জ্বালয়িে অপক্ষো করছলিাম একটা সোনালী ভোররে। তারপর সত্যি সত্যি সইে দনি আস।ে ১৬ই ডসিম্বেররে কুসুমতি র্সূযরে সাথে ভসেে আসে বজিয়রে স্লোগান। পতাকা হাতে ফরিে এসে দখেি কোথাও কছিু নইে। আব্বা আম্মার কবরে ঘাস জন্মছে।ে আমি তাদরে কবররে পাশে দাড়য়িে চৎিকার করে গয়েে উঠ—ি জয় বাংলা, বাংলারই জয়।’
জামগাছ তলায় গাঢ় হয়ছেে অন্ধকার। বাতাসে ভসেে আসছে একটা সুর- জয় বাংলা, বাংলারই জয়। অন্তরক্ষিরে বুকে হাসছে উজ্জ্বল শশী। হাসছে বৃদ্ধ। নষ্পিাপ শশিুদলরে চোখ বয়েে বয়েে পড়ছে মায়ার শশিরি।
পদাবলি : ০১
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের উচ্ছাস
রওশন রুবী
ওগো মাতৃভূমি তুমিই বল-
যুদ্ধ কি বদলাতে পারে না শত্রুর স্বভাব?
যুদ্ধ কি করতে পারে না শত্রুকে মানবিক?
ক্ষুদিরাম আমাদের ভাই
শিল্পবিপ্লবে আমরাই পেয়েছি জয়,
যুগে যুগে নিজ অধিকারে
আমরাই ফেলেছি সামনে পা,
পেতেছি বুক, আমরা জেনেছি-
দেশের চেয়ে পরিবার বড় নয়,
দেশ বাঁচলে বাঁচবো আমরা,
দেশই আমাদের মা,
তাইতো সেই পঁচিশে মার্চ থেকে
এই আবুল হোসেন আর সব যোদ্ধাগণ থামিনি,
বিসর্জন দেইনি স্বভূম তোমার জন্য টান
এই ভূখ-ে চাঁনতারার পতাকা নেই
চারিদিকে উঠছে জয়ধ্বনি,
এইযে আমার পাশে চোখহীন হাতহীন
খণ্ড- বিখণ্ড যোদ্ধা, এইযে বয়ে যাওয়া রক্তের নদী শোন
ছাপ্পন্ন হাজার বর্গমাইলের উচ্ছাস-
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল...
আজও সেই উচ্ছাস বাঙালির হৃদয়ে অমলিন অবিনশ^র।
জন্ম
বঙ্গ রাখাল
রাত বারটার দিকেÑহাত ঘড়িটা কথা বলে
জীবন ভর্তিÑ জীবন ভাঙ্গনের রহস্য
স্মৃতিতে আত্মহত্যার এক ওষুধের নাম
আগেকার কথারা বেশি দূর যায়
হেঁটে চলে বোন পাশাপাশিÑআবছা অন্ধকার পথ
প্রাচীন জাহাজেও লেখা থাকেÑ জীবনচক্রের প্রবঞ্চণার অভিজ্ঞতা। প্রাত্যহিক জীবনে যারা বিপ্লব চাইÑতাদের এই বিপ্লব নামের অন্তরগাড়িতে চলে অবৈধ সংলাপ...
আম্মার অগ্রন্থিত জীবনে আছেÑবাবা নামের জ্বরের উত্তাপ
যে উত্তাপে পোড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম...ঠিকানা মনে নেই...
বেশ্যালয় ছিল গ্রাম হতে দূরে...জন্মের পর এটুকুই জানি।
মূলমন্ত্র
নীহার মোশারফ
বীজতলা ফুরফুরে মেজাজে আছে
ঘুমভাঙা পাখিরা ডানা মেলে উড়ে গেলে আকাশে
পাশের ঘরের দিলারা মূলমন্ত্র পাঠে
নান্দনিক ছন্দ খোঁজে
শীতার্তরা বস্ত্র চায়, ক্ষুধার্তরা খাদ্য
কার ঘরে রকমারি বাহারি আহার?
পত্রিকা খুললেই পণ্যের দামে বাড়াবাড়ি খুব
পিঁয়াজ আলোচ্য বিষয়
গলা ধাক্কায় মফিজল
অশ্রুতে বেদনার এপিঠ-ওপিঠ
শিশুরা কী এতসব বোঝে?
বাজার থেকে লাল-সবুজের নিশান কিনে
রেখে দেয় যতনে
সর্ষের খেতে পতাকা হাতে দৌড়োয় ওরা
আহা কী আনন্দ তাতে
আমার স্বাধীনতা ওদের সঙ্গে হাঁটে
ফড়িংয়ের পাখায়, পাখির গানে,
সকালের মিষ্টি রোদেÑ বিজয়ের হাসি
কার হাসি লুকোয় তখন অতল আঁধারে?
অলৌকিক ঘ্রাণ
দেলোয়ার হোসাইন
পড়তে পড়তে উঠতে শিখেছি, উঠতে গিয়ে কাঁদতে শিখেছি
কাঁদতে গিয়ে দাঁড়াতে শিখেছি, দাঁড়াতে গিয়ে হাসতে শিখেছি
হাসতে গিয়ে হাঁটতে শিখেছি, হাঁটতে গিয়ে দৌড়াতে শিখেছি
দৌড়াতে গিয়ে আর থামিনি, আজও দৌঁড়ের ওপর আছি...
পিছনে খাঁখাঁ করে ধুলো মাখা উঠোন, কাদা মাখা মাঠ
ভরা যৌবনের নদী, নিম গাছের মগডাল, স্মৃতির বিদ্যাপিঠ
সবুজ মানচিত্র, মোহিনীর মুখ, স্বপ্নের বাইসাইকেল, স্বর্গের শৈশব...
সূর্য এখন মাথার উপর, তপ্ত দুপুর, ঘামের গন্ধ, রাজ্যের তাড়া
বোধের পায়চারি, বুকের ধুকধুকানি, পিছুটান, মায়ার বাঁধন আর
কাক্সিক্ষত একটা আকাশ- যেখানে প্রাণ খুলে নিঃশ^াস নেওয়া যায়...
ক্লান্ত সময়, পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যার ঘনঘটা, রাতের ফরিয়াদ
অলৌকিক ঘ্রাণ আর সাদা কাফনে মোড়ানো কবরের যাত্রী...
তয় কি মানিক আমার পতাকা হইয়্যা গেল
রফিকুল নাজিম
সেই ঘুটঘুইট্টা আন্ধার রাইতে মানিক আমার ফিরা আইছিল্
তার লোহার লাহান হাতে আছিল বন্দুক, কোমড়ে বুলেট,
তার চোখমুখে আছিল গনগনে আগুন!
কয়েক মুহূর্ত আমারে জড়াইয়া ধইরা
চোয়ালডারে শক্ত কইরা কানে কানে কইলো,
‘মাগো, তর লাইগ্যা একটা পতাকা কিনতাম যাইতাছি।
কতাডা কইয়াঐ পাগলডা আত্কা আন্ধারে মিলাইয়া গেল...
একদিন যুদ্ধ শেষ অইলো
পদ্মা মেঘনা যমুনার রক্ত ভাইস্যা গেল দক্ষিণে; সাগরে।
দেশে একটা নয়া পতাকা আইলো
পত্পত্ কইরা আকাশে ওড়লো
শুধু আমার মানিক আর আইলো না।
এহন রোজ রাইতে দরজার পাশে খাড়াইয়া থাহি
মনে কয়- এই বুঝি আমার যাদুধন আইলো
ঠকঠক ঠকঠক কইরা দরজায় বুঝি টোক্কা দিলো
এর লাইগ্যা সারা রাইত আমি দরজায় কান পাইত্তা থাহি।
দেশে লাল সবুজের পতাকা আইলো
ক্ষেতের সোনার ধান গোলায় উঠলো
নদীর রূপালী মাছ ভাতের পাতে হাসতাছে
পোড়া ভিটায় নতুন নতুন ঘর উঠতাছে
গৃহস্থালিতে সুখগুলো ছুঁয়াছুঁয়ি খেলতাছে
সবই অইলো- সবই আইলো,
খালি আমার যাদু মানিক আর আইলো না।
তয় কি মানিক আমার লাল সবুজের পতাকা হইয়া গেল?
অতঃপর অন্ধকার
সাকিব জামাল
‘নো ট্রাস্ট’ এর এই যুগে, আমি বিশ্বাস রেখেছিলাম
তোমার ভালোবাসায়, প্রতিক্রিয়াজ্ঞান ভুলে!
জ্বলেছিল মোমবাতি মনপাগলা ঘরে।
ধুপধুনোর ঘ্রাণ ছিল শ্বাস-প্রশ্বাসে।
অথচ তুমি কামনার ডানা মেলেছো
নিরীহ পাখি শিকারে!
ছক মোতাবেক রাজকাহন শিখেছো বেশ।
রপ্ত করেছো ইনোভেটিভ অর্থনীতির রকমফের।
এলার্জিক ইফেক্টে, এখন
দম বন্ধ আমার। ঘোর অন্ধকার। বিব্রতকর ক্লেশ!
পদাবলি : ০২
নীড়
রজব বকশী
কেউ কাউকে ভুলে না
ভুলে থাকার নাটক মাতালের অভিনয় করে
কষ্ট ভোলার মুখোশ পরিহিত সময়ের ঢেউ
তুমুল আছড়ে পড়ে
ঘাত প্রতিঘাতে
দেখেছি রোপিত গাছ
বীজমন্ত্রের অতীত কখনো ভুলে না
বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস যেন পোষা পাখি
ভারি ডানায় উড়–ক্কু মনে ফিরে আসে
হোক স্বগৃহ পিঞ্জর তবু জানে মমতার নীড়
মৌরি ফুলের দানা
সাব্বির হোসেন নাফিজ
ঘুমিয়ে পড়েছ!
জেগে ওঠো সকাল- জেগে ওঠো
বহুদূরগামী জাহাজ ভিড়েছে নবীনের তীরে
ছায়া আজ না থাক তবুও পুতেছি চারা অশথের ভীড়ে।
বসন্ত এলো বলে,
মনের ডগায় আজ মুক্তির গান
নগরীর দেয়াল ঘেঁসে বয়ে যায় হিমেল কলতান
হঠাৎ বিকেল বেলায় ঘাসের পল্লবে মিশেছে রৌদ্র স্নান।
তুমি কি দেখনি?
সন্ধ্যার আঁচলে নিবেদিত প্রাণ প্রথম জোনাকি
নক্ষত্রের আকাশ পেরিয়ে লাল সবুজের দেশে
ওরা আজ মুক্ত স্বাধীন বিজয় শাণিত আঁখি।
পুকুরের জলে,
হাঁসের পালকে জল টলমল করে
বিজয় ছিনিছে ওই লাল মেঘ জয় বাংলার বলে
মৃত্তিকা কালো মানুষ চাষা সবুজ পত্র ফলায়
ফসলের দেশে আলো শুধু আলো নৌকার মাঝি মাল্লায়।
তরুণ- নবীন- যুবতী- প্রবীণ,
লাখো মুজিব সেনা-
এক হয়েছিল পাঠশালাতে চুকিয়ে সকল দেনায়
উড়ছে নিশান বিজয় মিছিল মৌরি ফুলের দানায়।
ব্যস্তময় দিন
রাতিক হাসান রাজীব
একটা ব্যস্তময় দিন গেলো আজ
ঘন্টাচারেক স্যারের বকবক শোনা,
চায়ের কাপে বিষন্নতার চাপ,
টিউশনে সেই এক নুনতা বিস্কুট,
পাবলিক বাসে চাপাচাপি,
আর মাথাভর্তি তুমি!
সংকট
সজিবুর রহমান
হৃদয়ে ভাঙন ঘটে
অনাবৃষ্টির ফলে দীর্ঘায়িত হয় খরা
অবিরত শোকে বৃদ্ধি পায় লবণাক্ততা
দীর্ঘশ্বাস জমে জমে গ্রীনহাউজে ছেয়ে যায় আকাশ
কেবল উত্তরণের জন্য কোনো
জলবায়ু সম্মেলন হয় না!
আমাদের প্রেমের অমরত্মের গাথা
শেখ ফয়জুর রহমান
তুমিই সে-
যার হাতে আমার জাহেরি ও বাতেনি আত্মা।
আমার তৃষিত প্রাণ কোরবান হোক ইসমাইলের মতো
তোমার অবিনশ্বর প্রেমে ।
হে কৃষ্ণচোখী হরিৎ ললনা,
সেই অবিন্যস্ত রাতগুলো কি মনে পড়ে ?
যখন আমাদের বক্ষ পুড়েছিল!
আজো পুড়েই যাচ্ছে !
কি এক মধুর যন্ত্রনায় অতিবাহিত হয়
দিন আর রাত,
বিদঘুটে সব স্বপ্নেরা চেপে ধরে
আমার আনাড়ি ঘুম।
বসন্ত কবেই হারিয়েছে ঋতুর স্পর্শ!
তোমার চোখ আর ঠোঁট
আমি জান্নাতে খুঁজতে চাই
তোমার পবিত্রতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়তে চাই
আমাদের অকপট প্রেমের বেহেস্ত গড়তে চাই
যেখানে দুটি হৃদয় এক অন্তরাত্মায় বিদ্যমান।
সকল বিপত্তি আর অমূলক অতীত
আমাদের ভালোবাসার উষ্ণ চাদরে ঢেকে
তোমার অন্তঃকরণের ক্যানভাসে আঁকব
আমাদের প্রেমের অমরত্মের গাথা।
ভালবাসতে দিও কিন্তু
নাহিদ্র ইমন
এই আকাশ ছাড়িয়ে আরো ঊর্ধ্বে,
এই বাতাস ছাপিয়ে আরো তীব্রে,
তোমাকে বলতে চাই- ভালবাসি বন্ধু,
বদলা চাই না; ভালবাসতে দিও কিন্তু!!
কি খোঁজো মানুষ?
আহমদ সাইফ
বাঁশ ঝাড়ের গলা বেয়ে নেমে যায় শীতের উম,
কুফরি কালাম লিখে লিখে কি খোঁজো মানুষ?
একচক্ষু হরিণীর মতো লালসার ঝড় তুলে
অমাবস্যার রাতে বৈরাগ্য হয়ে কি খোঁজো?
ফুলের সৌরভ নয়, নয় কোন পবিত্র সুর
শরাবের গেলাসে হেলান দিয়ে কি খোঁজো?
ঘোর লাগা ভোরে কুয়াশার গায়ে হাত রেখে
স্মৃতির দরজায় কি খোঁজো মানুষ?
অসহায় চোখে কামনার সুর তুলে
অভিমানে কি খোঁজো?
ক্লান্তির ভীড়ে ফোটা ফোটা ঘামে
ক্ষুধার্ত পাখির মতো কি খোঁজো?
যুদ্ধের দামামা বাজে, ঝড় উঠে তীরে
ঘোরে বে-ঘোরে কি খোঁজো মানুষ?
তরী ডুবে যায়, ডুবে যায় শেষ চিহ্ন!
বুঝে না-বুঝে কি খোঁজো মানুষ?
পদাবলি : ০৩
তুমি নেই জেনেও
মিজান ফারাবী
তুমি নেই জেনেও আমি ভালো আছি
বেশ ভালোই কাটছে আমার দিনকাল-
তোমাকে ঘিরে আমার ক্লান্তি ও কান্না কোনটাই নেই;
অতীত নেই, নেই ভুলে যাওয়ারও শোক
তবে, একটু মনে রাখি হৃদয়ের কাছাকাছি ছিলো কোন নাম,
এই নাম হৃদয় জুড়ে ছিলো,
থাকাটা আপেক্ষিক, আপেক্ষিক থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো;
যে চলে যায় তারে ফেরানোর কোন ছল ও কৌশল আমার জানা নেই।
আমি জানি, যে মনের মানুষ ফেলে যায়
সে শোকে ও দুখে ভোগে, ভুগতে হয় এমন অসুখে
চলে যাওয়ার যে বেদনা তারে বয়ে বেড়াতে হয় বুকে;
এমন পরিস্থিতিতে মানুষ;
আলো রেখে অন্ধকারে যেতে চায়
কিন্তু প্রেমিক মন বুঝে উঠতে পারে না এই অকালে চলে গেলেও
অন্তরের হাহাকার বন্ধ হয় না!
আমার অবশ্য এসব জানার ইচ্ছেও নেই-
আমি জানি, এসব জেনে দুই পা বাড়িয়ে আবারও
ফেরত আসতে হয় এবং এসেছে শত প্রেমিকযুগল
তার চেয়ে না যাওয়াই ভালো
এই ভাবনা আমাকে টানে না!
আমার হৃদয় আর ভাবায় না সুহাসিনী প্রেমিকারে;
তবুও তুমি নেই জেনে আমি ভালো আছি
বেশ ভালোই কাটছে আমার দিনকাল।
এই হেমন্তে শরতের চাঁদ
শেখ একেএম জাকারিয়া
এই হেমন্তে তুমি শরতের একফালি চাঁদ
অবর্ণনীয় রূপের জৌলুশে আলো ঝরাও
তোমার হাসি নিসর্গের বুকে ঢেউ তুলে
নিখুঁত বিন্যাসে তুমি ওই মনকে রাঙাও
পরিপাটি তোমার আয়ত গহন চোখ ঠোঁট
রেশম ঘনকালো চুল কান নাসিকা ললাট
পৃথিবীর রূপ দেখি তোমার স্বর্নালী মুখে
আমি সিমান্তের ওপারে খুলেছি কপাট
তোমার চোখে পাতায় লেখি এই কবিতা
স্নিগ্ধ দুপুরে তুমি পা রেখেছ ফেসবুক মাঠে
শত রঙের আবির হেসে ওঠে তোমার মুখে
আমি কল্পনায় আঁকি আল্পনা, প্রেমের হাটে!
বাজিকর’ই চ্যাম্পিয়ন হবে
হিলারী হিটলার আভী
শোণিতের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
এ হেঁটে চলাকে রক্ত-বুনন বলা যাবে না
এটাকে আত্মার আত্মঘাতী রক্তক্ষরণ বলাই শ্রেয়
রক্ত-বুনন হয় মনন হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের বিনিময়ে!
নখর থাবা দিয়ে খামচে ধরছে কৌশিকনালীর কু-লীকে
মৃগয়া আত্মাগুলো কোড়া কাগজের মতো পিষ্ট হচ্ছে
অকালে ঝরছে আশাবাদী হৃদয়গুলো!
বাজিকরের হাতেই বান্দি গোলাম সাহেব এমনকি টেক্কা
বেনিয়া ট্রামকার্ডের কথা বাদ দাও
কলব্রীজে মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে বাজিকর-ই চ্যাম্পিয়ন হবে!
রেফারি আজীবন সিংহ হয়ে থাকতে চাবে
কিন্তু জারজ-বীণের নেপথ্যের কলরেটে রেফারি কিছু সময়ের জন্যে
নিজের আত্মার কথা ভেবেই আত্মঘাতী গাধা বনে যাবে!
ভালোবাসা
রামপ্রসাদ সূত্রধর
এই সহজ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে
অধৈর্য কঠিন বেদনা এবং অবাধ আনন্দ
সবাই এই সহজ শব্দের মধ্যে আবদ্ধ আছে
শব্দটি নিয়ে চিন্তা চেতনা এবং অনর্গল ছন্দ।
বিরহ-মিলন সরল-গরল যত গড়মিল
এই শব্দের কাছে কেউ কয়েদি কেউ গাঙচিল।
আবুল কালাম বেলালের ‘বাংলাদেশ’ কবিতা ও একটি দাবী
আবুল কালাম বেলালের ‘বাংলাদেশ’ কবিতা ও একটি দাবী
অনার্য আমিন
ছড়াসাহিত্যকে শিশুসাহিত্যের অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। যিনি ছড়া লেখেন তাকে ছড়াকার বলা হয়ে থাকে। তবে বাংলা সাহিত্যে যারা ছড়া লিখে বিখ্যাত হয়েছেন তাদের সবাইকে কবি বা শিশুসাহিত্যিক বলে সম্বোধন করা হয়। শিশুদের সাহিত্য সম্পর্কে জানার প্রথম সিঁড়ি হলো ছড়া। ছড়াকে কবিতার মধ্যেই গন্য করা হয়। কারণ ছড়াও কবিতা, শুধুমাত্র শিশুদের উপযোগী করে লেখা হয় বলে একে কবিতার ক্যাটাগরি থেকে বাদ দেওয়া উচিত না। তবে ছোটদের কবিতাও বলা যেতে পারে। ছোটদের ছন্দোবদ্ধ কবিতাকে শিশুসাহিত্যিকরা উনিশ শতকের শেষের দিকে আরো মডিফাই করে নতুন কাঠামোয় দাড় করিয়েছেন। বারো থেকে আঠারো-উনিশ বছরের বয়সীদের উপযোগী করে লেখা কবিতাকে নামকরণ করা হয়েছে কিশোর কবিতা। বর্তমানে শিশুসাহিত্যে এ মাধ্যমটি বেশ পরিচিত ও সুদৃঢ়। কেননা বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকরা কিশোর কবিতা নিয়ে দুহাতে লিখে যাচ্ছেন এবং এটাকে আন্দোলনে পরিনত করেছেন। এ কবিতার প্রধান উপজীব্য হচ্ছে স্বদেশপ্রেম, নৈসর্গিক রূপচিত্রন, জীবনমুখী আদর্শ প্রকাশ ও কিশোর মনের কল্লোলিত কল্পনা কালির আচড়ে ফুটিয়ে তোলা। বাংলাদেশে যে সকল শিশুসাহিত্যিকগন কিশোর কবিতার আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন- আবুল কালাম বেলাল। আপদমস্তক সাহিত্যিক এ কিশোর কবির ধ্যানে ও চিন্তায় শুধু শিশু ও শিশুসাহিত্য। শিশু কিশোরদের জন্য তিনি নিবেদিত ছড়া, কিশোরকবিতা ও গল্প লেখায়। তবে কিশোরকবিতায় তার লেখনি ফুল ফুটিয়েছে কাব্যকাননে।
আবুল কালাম বেলাল একজন শব্দ সচেতন কবি। অত্যন্ত সচেতনভাবে তিনি তার প্রতিটি ছড়া, কিশোরকবিতায় শব্দ চয়ন করেছেন যাতে শিশু-কিশোরমন অহেতুক ভারাক্রান্ত না হয়। এতে করে তার লেখাগুলো দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। ফড়িং নিয়ে খেলার বয়সে যুদ্ধে হানা দেয় তার স্বাধীনতায়। নিষ্পাপ নয়নে অবলোকন করে রক্তনদী পেরিয়ে কিভাবে আসে বিজয়োল্লাস। তাইতো তার লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, দেশের গৌরবময় কীর্তিগাথা। তিনি যতগুলো ছড়া-কবিতা লিখেছেন ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটা সবথেকে আলাদা। দেশপ্রেমে ডুব দিয়ে, সময়কে নিজের নিয়ন্ত্রনে এনে, ভাবনার আকাশে বলাকা হয়ে উড়ে উড়ে, শ্বান্তচিত্তে লিখেছেন এ কবিতাটি। আমার পাঠ করা এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা এটি। হয়তো তারও সেরা কবিতা এটি। কবিতায় প্রতিটি লাইনে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে সবর্কালের শ্রেষ্ঠ জননী হিশেবে। কবি শুরুতেই চমৎকার প্রশ্নপর্বের মাধ্যমে কবিতাটি শুরু করেছেন। কবি শিশু-কিশোরদের ছন্দে ছন্দে প্রশ্ন করেছেন এভাবে-
‘কোথায় নিখাদ পটে আঁকা রূপ, ঘাসের সবুজে ঝরে-
আকাশের নীল, শিশিরের হীরে, চন্দ্রিমা অগোচরে?
কোন সরোবরে জলের মুকুরে শাপলা-কমল ফোটে?
অলস দুপুরে নূপুরের সুরে নদীরা কোথায় ছোট?...’
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়তো কিশোরমন ব্যাকুল হয়ে বিশ্বের বড় বড় দেশের নাম তুলে আনতে পারে। কবি ওদের ব্যাকুলতার অনুসন্ধানে সঠিক দেশ পাবে না জেনে লিখেছেন-
‘ভাবছো তোমরা মরু, বালিয়াড়ি আরব দেশের কথা
যেখানে বন্দি সাইমুন-ঝড়ে শ্বাসের স্বাধীনতা।
কিংবা কানাড়া, দূর আমেরিকা, ব্রিটেন দেশের কথা
যেখানে তুহিন প্রাণপাত করে আনে হিম নীরবতা।’
এভাবে যতই দেশের কথা ভাবনায় আসুক না কেন সৌন্দর্যের পালাবদলের শ্রেষ্ঠ দেশ কোথাও খুঁজে পাছে না কেউ। সে দেশ কেবল ময়ুর পেখম সুশীতল দেশ, বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে রূপদান করতে যাদের অবদান ইতিহাস খচিত সেইসব শ্রেষ্ঠ মনীষীদের আবুল কালাম বেলাল চমৎকার নিপুনতার ধাচে অংকিত করেছেন এই কবিতায়। তিনি লিখেছেন-
‘এখানে সূর্য সেন, প্রীতিলতা বিপ্লবী সুর তুলে
আগল ভাঙতে জান করে দান জয়ের মর্মমূলে।
চোখে রঙদার উচ্ছ্বাস মেখে গেয়ে জীবনের গান-
নীলকর ঠেলে বীর তিতুমীর মাঠে বুনে সোনা ধান।’
‘বাংলাদেশ’ কবিতার প্রতিটি লাইন এত চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, পুরো কবিতাটাই তুলে ধরতে লোভ লাগছে। সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থে লোভকে নিয়ন্ত্রনে করেছি। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবনকে তুচ্ছ করে সংগ্রাম করেছেন কবি তাদেরকে তুলে ধরেছেন সন্মানের সাথে-
‘ভাষা ভাষা করে সালাম-রফিক-বরকত ভালোবেসে
বুকের সুপ্ত গোলাপ ফোটায় অমলিন হেসে হেসে।
এখানে আসাদ-মতিয়ুর দেয় মিছিলের লাল ডাক
আলো অভিযানে পেরোয় তপ্ত রক্ত নদীর বাঁক।
এখানে মুজিব নির্মল খোলা আকাশের কথা বলে-
জাগুয়ার চিল তাড়ায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাচ্ছলে।’
সবুজ কিশোরদের প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা কবিতায় কবি শেষে এসে সেই স্বপ্নের দেশের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন-
‘হৃদয় মাতানো জড়োয়া পাতানো পরিমল পরিবেশ
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জননী- আমার বাংলাদেশ।’
কবিতাটি পাঠ শেষে ভালোলাগার স্থান থেকে কিছু চাওয়া মনে জেগে উঠেছে সেটা দবীও বটে। মনের একান্ত চাওয়া বা দাবী যাই বলি না কেন তার আগে বিখ্যাত কিছু ছড়া-কবিতার নাম বলা যাক। যেগুলো ছোট বড় সকালের কাছে প্রিয় ও মুখস্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নন্দলাল’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’, রোকনুজ্জামান খানের ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’, সুকুমার বড়–য়ার ‘এমন যদি হতো’, হুমায়ুন কবিরের ‘মেঘনার ঢল’, কালীপ্রষন্ন ঘোষের ‘পারিবো না’, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের ‘কানা বগীর ছা’ রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’, সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ অতুল প্রসাদ সেনের ‘বাংলা ভাষা’, আল মাহমুদের ‘নোলক’, ‘একুশের কবিতা’, বন্দে আলী মিয়ার ‘আমাদের গ্রাম’ ইত্যাদি। আপদত স্মরনে আসা এই কবিতাগুলো কীভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে গেল? কখনো ভাবা হয়েছে?
এর একটি মাত্র কারণ কবিতাগুলো পাঠ্যবইয়ের। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠের কবিতা এগুলো। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় পঠিত হয়েছে বারবার। তাইতো কবিতাগুলো মুখে মুখে, জনপ্রিয়। বর্তমান সময়ের অসংখ্য সুন্দর সুন্দর কবিতা আছে যেগুলো প্রচারের ধীরতায় পাঠকমহলে সমাধৃত হয়নি এমনকি কিছু কবিতা যথাযথ মূল্যায়িত হয়নি। আবুল কালাম বেলালের ‘বাংলাদেশ’ তেমনি একটি পাঠ্য অন্তর্ভুক্তির দাবিদার কবিতা। প্রয়োজন কতৃপক্ষের দৃষ্টিপাত ও সঠিক মূল্যায়ন। আমার চাওয়া বা দাবীর যায়গাটুকু হলো- বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডসহ সকল সায়ত্বশাসিত ও কিন্ডারগার্টেন এ্যসোসিয়েসনের সকলের দৃষ্ট আকর্ষন যাতে এই চমৎকার সুন্দর দেশপ্রেমের কবিতাটি সকল কচিকাঁচা শিক্ষার্থী পাঠের মাধ্যমে দেশকে সুন্দর ভাবে জানতে ও শিখতে পারে।
ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৯৯
তারুণ্যের শিল্প সরোবর।। বর্ষ ৮ম।। সংখ্যা ১৯৯,
শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫