হলুদ পাতায় সবুজ ঘ্রাণ

হলুদ পাতায় সবুজ ঘ্রাণ





হলুদ পাতায় সবুজ ঘ্রাণ
আরিফুর রহমান

প্রস্তাবনা পর্ব.

    বারান্দায় একজন ভদ্রলোক বসে আছেন।
বই পড়ছিলেন। আমার ধুপ ধাপ বারান্দায় উঠার শব্দে চোখ তুলে চাইলেন। আমি আশ্রয় চাওয়ায় মতো ভঙ্গি করে সালাম দিলাম। ভদ্রলোক সালাম নিয়ে সুন্দর করে হাসলেন।
    ‘এখানে এসো। ইস্ রে প্রায় পুরোটাই ভিজে গেছ। চিত্রা, একটা তোয়ালে দিয়ে যা তো মা।’
তিনি তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘বসো।’ আমি বসলাম তাঁর পাশে। বাইরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কী যন্ত্রণার কথা! এতদিন পর বাড়ি ফিরছি; সোজা বাড়ি গিয়ে মাকে দেখবো তবেই তো শান্তি। তা-না পথের কোন এক চেনা বাড়িতে আটকে রইলাম।
তোয়ালে নিয়ে যে এল সে একজন তরুণী। আমাকে দেখে ঈষৎ লজ্জা পেল। কিন্তু ফিরে গেল না। তোয়ালেটা আমার হাতে দিয়ে বাবার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আলতো করে মাথা মুছে নিলাম।
    ‘চিত্রা কি করছে পলি?’
    ‘ওকে অংক করতে দিয়েছি বাবা।’
    ‘ভালো। তুই নিয়মিত এভাবে মাস্টারি করলে ও দুষ্টামী করার সুযোগ কম পেত।’
    ‘হু।’
আমি চুপচাপ বৃষ্টি দেখছি আর এঁদের কথাবার্তা শুনছি। আমি যে এঁদের অপরিচিত তা মনেই হচ্ছে না যেন অনেকদিন থেকেই আমাকে চেনে। মেয়েটি আন্তরিক ভঙ্গিতেই আস্তে করে আমার কোল থেকে তোয়ালেটা তুলে নিল। সামান্য লজ্জা পেলাম। তোয়ালেটা এগিয়ে দিতে ভুলে গেছি। একটু তাকালাম ওর মুখের দিকে। সে হাসছে। কী সুন্দর হাসি! কী মিষ্টি চেহারা! দীর্ঘ পল্লব, ছায়াময় চোখ। সেই চোখ সবসময় হাসছে।
সে আসছি, বলে ভেতরে চলে গেল। বাইরে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখনো একটানাই ঝরছে ঝর ঝর ঝর। এবার তিনি আমার দিকে মনোযোগ দিলেন। আমার নাম, পরিচয়, ঠিকানা জেনে নিলেন।
    আমি একে একে গুছিয়ে সব বললাম। সব শুনে তাঁর চোখে-মুখে এক ঝলক রোদ্দুর দেখা গেল। তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, ‘তুমি সাজীদ ভাইয়ের ছেলে? দীপক, আমি তোমার ইদরিশ চাচা। সেই ছোট বেলায় তোমাকে দেখেছিলাম। ক্লাস থ্রী-তে পড়তে। এখন কত বড় হয়েছ। তোমার মা ভালো আছেন?’
    ‘জি¦, আমি আনন্দমোহনে পড়ি। অনেক দিন পর বাড়ি ফিরছি। মার শরীর মনে হয় কিছুটা খারাপ। গতকাল ছোট কাকা ফোন করেছিলেন।’
    ‘ও! অনেক দিন যাওয়া হয় না। অ্যাই অ্যাই পলি শোন্, এ তোর দীপক ভাইয়া। চিনলি না? ও-ই যে বিরামপুরের সাজীদ ভাই। তোর সেই চাচার ছেলে। যা, দীপকে ভেতরে নিয়ে যা। যাও বাবা যাও, ভেতরে যাও। তোর মা কোথায় পলি?’
    ‘মা ঘুমুচ্ছে।’
    ‘উহ্, মহিলা ঘুম ছাড়া আর কিছু বুঝল না জীবনে। অষুধ খেয়েছে?’
    ততক্ষণে আমরা ভেতরে চলে এসেছি। সামনে বই-খাতা খোলা, কলম হাতে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকাল। এ নিশ্চয়ই চিত্রা। পলি ওর মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় আমাকে বসতে বলল। আমি সহজ হয়েই বসলাম। চিত্রা উঠে এসে পলির গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
    কী সহজ-সরল-তরল এঁদের সান্নিধ্য! যতোই দেখছি ততোই বিস্মিত হচ্ছি। যতোই শুনছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি। এটা পলির রুম। কী গোছানো, পরিপাটি সুন্দর। সুন্দর এই রুমটি আলো করে আমার সাথে গল্প করছে ওরা দু’বোন পলি আর চিত্রা। কী মিশুক প্রকৃতির এঁরা। কত সহজে আমাকে আপন করে নিয়েছে। অথচ আমি কে? দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্ত মনে হচ্ছে আমি এঁদের অতি আপনজন। চিত্রা মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলে। এবার সে বলল, ‘ভাইয়া আপনার নামটা কিন্তু খুব সুন্দর। দীপক। মানে প্রদীপ। তিমির বিনাশী একটা নাম।’
    ‘হু’, ঠিক বলেছিস।’ চিত্রার সাথে মুচকি হেসে গলা মেলাল পলি।
কী সুন্দর হাসি! ছায়াময়, মায়াময় চোখ দু’টো সব সময় হাসছে। ভয়, পাপ, সংশয় এঁদের থেকে কত দূরে! অন্যরকম একটা ভালো লাগায় ভরে গেল আমার মন। প্রশান্ত মনটার সবকটা দরজা, জানালা খুলে দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের নামও তো সুন্দর পত্রালি, চিত্রালি।’
    আমার নামটা বেশি সুন্দর, চিত্রালি। চিত্রা নামে একটা নদী আছে না?’
চিত্রালি প্রশ্ন করেছে আমাকে। কিন্তু আমাকে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে পত্রালি বলল, ‘হ্যাঁ একটা নদী আছে। আর সেই চিত্রা নদীর বালি আমার বোন চিত্রালি। হি-হি-হি!!!’
    ‘আর চন্দ্র পাতার কালি হল আমার আপু পত্রালি।’
    ‘দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি মজা।’
চিত্রালি হাসতে হাসতে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। ‘দেখুন তো ভাইয়া আমার আপুটা কেমন!’
আমি কেবল দেখছি না শুনছি আর ভাবছিও। কেমন তরো সুখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস এঁদের ঘিরে আছে। দু’বোনের কান্ড কারখানা দেখে হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে যাবার মতো অবস্থা। পত্রালি থেমে গেছে। ওর চোখে মুখে সুখের হাসি লেগেই আছে।
চিত্রালি আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
    ‘চা খাবেন?’
    ‘না, এই তো খেলাম।
    ‘তখন আপনি আর আপু খেয়েছেন। আমি খাইনি। এবার আমি বানিয়ে আনব। আমি ভালো চা বানাতে পারি। আপনাকে খেতেই হবে। অন্য কিছু না শুধু চা। আপুকে দেব না।’
    ‘তাই?’ ওর কথা বলার সুন্দর ভঙ্গি দেখে হেসে বললাম আমি। পত্রালিও হাসছে।
    ‘হু। ওয়েট। জাস্ট ট্যু মিনিটস।’
চিত্রালি প্রজাপতির মতো ডানা মেলে চলে গেল। আমরা চুপচাপ। পলিই মুখ খুলল।
    ‘মনে রাখার মতো কিছুই তো বললেন না আমাকে!’
    ‘তাই? উঁ-উঁ, তাহলে বলি শোন। তোমার পলি নামটা সুন্দর না। কেমন যেন শোনায়।’
    ‘তাহলে কোনটা সুন্দর?’
    ‘পত্রালি সুন্দর।’ মনে মনে বললাম, তুমি তো নিজেই খুব সুন্দর। মুখে বললাম, ‘আর......’
    ‘আর?’
    ‘আমার মনে তোমার সুন্দর একটা নাম কেবলই ঘোরপাক খাচ্ছে। অবশ্য তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।’
    ‘কি সেটা?’
    ‘পত্রালির শেষ অংশটুকু বাদ দিলে কি হয়? পত্র। মানে পাতা।’
পত্রালি কিছু না বলে শরীর সামান্য দুলিয়ে হেসে উঠল। কী সুন্দর হাসি। আমি বললাম, ‘হাসছো যে?’
হাসতে হাসতেই সে উত্তর দিল, ‘চিত্রা কি বলছে শুনুন।’
    ‘পাতা-পু তোর চায়ে চিনি দিলাম কিন্তু?’
আমি ওর হাসির কারণটা বুঝতে পারলাম। আমাকে বিস্মিত করে সে একটা কথা বলল, ‘আপনারা একই জলের মাছ!’
    ‘কার কথা বলছিস্ আপু?’ চিত্রালি রুমে ঢুকেই প্রশ্নটা করল।
    ‘তোর আর দীপক ভাইয়ার কথা।’
    ‘সেটা কেমন?’
    ‘মস্ত একটা ঘোড়ার ডিমের মতন!’
চিত্রালি খিল খিল করে হেসে উঠল। সে চায়ের কাপে চা তুলছিল। হাসির কারণে কাপের অর্ধেকটা চা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। সেই কাপ রেখে অন্য একটা কাপ আমাকে দিল। আরেকটা দিল পত্রালিকে আর অর্ধেকটা সে নিল।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘চিত্রা, তুমি তো সত্যি ভাল চা বানাও।’
    ‘জি¦। আমি ভাল কথা বলতে পারি মোটর সাইকেলের মত ফটফট করে। আর ভাল অভিনয়ও করতে পারি।’
    ‘তাই নাকি?’
    ‘জি¦। মাঝে মাঝে নিজের অভিনয় দেখে মনে হয় আমি স্পর্শিয়া মিম এদের চেয়েও ভাল অভিনয় করতে পারি। আমি দেখতে আরেকটু মিষ্টি হলে টিভিতে চান্স পেতাম।’
    ‘তুমি দেখতে মিষ্টি না?’
    ‘উহু।’
    ‘বুঝলে কি করে?’
    ‘আমি মিষ্টি হলে রাতে নিশ্চয়ই পিঁপড়া ধরতো ঝাঁকে ঝাঁকে।’
এমন কথা শুনে কেউ না হেসে থাকতে পারে না। হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যাবার মতো অবস্থা। হাসি অল্প থামিয়ে বললাম, ‘তুমি গন্ধহীন মিষ্টি তাই পিঁপড়া ধরে না।’
    ‘ওমা, আমার রসে আমাকেই ডুবালেন।’ সবাই একসাথে হাসতে লাগলাম।
   
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগে। আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরুতে চাচ্ছি কিন্তু চিত্রালিটা কিছুতেই ছাড়ছে না। এদিকে বিকেলটা খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত মার অসুখের কথা বলে ছুটি নিলাম আজকের মত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় চিত্রা বলল, ‘আসবেন আবার কবে?’
    ‘যেদিন তোমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে।’
    ‘ওমা, আমি কি এখনো ছোট্ট খুকি আছি, যে পুতুল বিয়ে দেব? আপনি এমনিই আসবেন।’
পত্রালি হাসি মুখে আস্তে করে বলল, ‘আবার আসবেন তো?’
আমি ওর ছায়াময় দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আসবো।’

মধ্য পর্ব.

    গাড়ি থামিয়ে বারান্দায় উঠতেই কানে এল ঘরের মধ্যে ভাঙনের শব্দ। পাতা রেগে মেগে কিছু ভাঙছে নিশ্চয়ই। স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি রাগের কারণটা হতচ্ছাড়া এই আমি। আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। ওকে কথা দিয়েছিলাম হাফ ডে অফিস করেই চলে আসব। কিন্তু ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা। সাড়ে সর্বনাশ! ভাঙনের শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। আজ আর রক্ষা নেই। সুড়–ৎ করে ঘরে ঢুকে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার ডানপাশে ডাইনিং টেবিলের কাছে পাতা অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে। হাতে একটা কাঁচের গ্লাস। ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে দরজা খোলার শব্দে থেমে গেছে সে। ওর অল্প পেছনে পাশের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে চিত্রালি। চোখে-মুখে একরাশ মেঘ।
    ‘এই এতক্ষণে ফেরার সময় হল আপনার! এবার ঠ্যালা সামলান!’
    সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল চিত্রালি। স্পষ্টতই খবরদারি করল আমার উপর। ‘হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও বুড়ো আঙুল দেখায়’ অবস্থা হয়েছে আমার। হাতের গ্লাসটা টাস্ করে টেবিলের উপর রেখে পাতা ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আমার সামনে দিয়ে বেড রুমে চলে গেল। আমি বরাবরের মতো চোখ মুদে সৌরভটুকু উপভোগ করতে পারলাম না।

    ‘আচ্ছা, সেই তখন থেকেই পাশ ফিরে শুয়ে আছো। কোন কথাও বলছ না, আমাকেও বলার সুযোগ দিচ্ছ না। কেন দেরি হয়েছে শুনবে তো, নাকি?
    আমার কথার কোন উত্তর দিল না পাতা। থেমে থেমে ওর শরীর অল্প দুলে উঠছে। অবুঝ হয়ে কাঁদছে ও। আমার দিকে পাশ ফেরানোর জন্য ওর কাঁধে হাত রাখতেই কান্নার বেগ কিছুটা বেড়ে গেল। পাতার মুখটা আমার দিকে করে দেখি দু’গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামছে, আর লাইটের আলোয় তা চিক্চিক্ করছে।
    হাত দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললাম, কেন বুঝতে চাও না? প্রাইভেট ফার্মের চাকরি, ইচ্ছে করলেই তো চলে আসতে পারি না। তাছাড়া অফিস ছুটির পর এক জায়গায় গিয়েছিলাম। অফিসের উল্টো দিকে কাঁচা রাস্তায় বিশ মিনিট মোটর সাইকেল চালিয়ে গেলাম আমাদের পিয়ন আনিসের বাড়িতে। তারপর ওর বাড়িতে গাড়ি রেখে কয়েক মিনিট হেঁটে, নৌকা করে নদী পার হয়ে আবার কিছুক্ষণ হেঁটে তবেই তো নন্দী চরের নিতাই বাবুর বাড়িতে পৌঁছলাম।’
    পাতার কান্না কমে আসছে। আমার এমন জার্নির কথা শুনেই হয়ত। আমি উৎসাহ পেলাম। ‘কাজ সেরে আনিসের বাড়ি ফিরতেই সন্ধ্যা। এদিকে আনিসের স্ত্রী আমাদের জন্য খাবার দাবার রেডি করে বসে আছে। আনিস কিছুতেই আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। বুঝো আমার অবস্থা।’
    ‘তুমি সকালে বললে বলেই তো দুপুরের আয়োজন করেছিলাম, নয় তো রাতের আয়োজনই করতাম।’
    ‘রাত ফুরিয়ে যায়নি। রাতের বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারবে।’
    ‘ঢঙের কথা রাখো। বাবা, ছোট কাকা, কাকী সবাইকে কতক্ষণ বসিয়ে রেখেছিলাম। শেষে দুপুরের খাবার খাওয়ালাম বিকালে। একা বলে কাউকে সালামও করতে পারলাম না, দোয়াও নিতো পারলাম না।’
    ‘আচ্ছা, দোয়া কালকেও নেয়া যাবে। তুমি কি খেয়েছ?... চুপ করে আছ, তার মানে খাওনি কিছুই। না খেয়েই শুয়ে পড়েছ!’
    ‘না না না খেয়েছি, প্রচুর খেয়েছি। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত প্রচুর কষ্ট খেয়েছি। খেতে খেতে আমার চোখ দিয়ে কেমন পানি পড়ল দেখলে না!’
    আমি চট করে উঠে বসলাম। এমনতর অভিমানের কথা শুনে শুয়ে থাকা যায় না। ঘুরে বসে দু’হাতের তালুতে পাতার মুখটা তুলে ধরলাম। ও চোখ বুঁজে ফেলল। আমার দু’হাত ভরা জ্যোৎ¯œাময় একখানা চাঁদ। অপূর্ব, অনিন্দ্য, অতুলনীয়, অসহ্য সুন্দর একখানা মুখ।

    বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম উঠোনটা ফরসা জ্যোৎ¯œায় ঝলমল করছে। সিঁড়ির গোড়া থেকে উঠোনের মাঝামাঝি পর্যন্ত পেয়ারা গাছের ছায়া পড়েছে। পাতার ফাঁক গলে আসা জ্যোৎ¯œার কারুকাজে ছায়াটাকে ছাপা শাড়ির মতো লাগছে। পাতাকে ইশারা করে ছায়াটা দেখালাম। সে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। ওর মুখ না দেখেও বুঝতে পাচ্ছি ও মুগ্ধ হয়েছে।
    ভৌতিক একটা শব্দে পাতা আমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে বারান্দার উত্তর দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম, পিঞ্জিরার পাখিটা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে।
    ‘পিঞ্জিরা? পিঞ্জিরার মধ্যে ওটা কি পাখি?
    পাতা প্রশ্ন করে দ্রুত পায়ে পিঞ্জিরার দিকে এগুতে এগুতে নিজেই বলল, ‘ময়না, ময়না!’
    ময়না পাখিটা পাতার কণ্ঠ নকল করে বলে উঠল, ‘ময়না, ময়না।’
    আমি ধীর পায়ে এগিয়ে পিঞ্জিরার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা মোটর সাইকেলের উপর আলতোভাবে বসলাম।
    ‘তোমার ময়না পোষার শখ। তাই তো আজ অফিস শেষে নন্দী চরে গিয়েছিলাম এই ময়না পাখিটা কিনে আনতে।’
    ‘তুমি একটা মহা দুষ্টু, ইতর, বানর... এত কষ্ট করে পাখিটা এনে আমাকে এতক্ষণে একবারও বলনি।’
    পাতা মহা আনন্দে কথাগুলো বলল। আমার খুব ভাল লাগছে। হতচ্ছাড়া এই আমি শেষ পর্যন্ত সফল। আমার মন পাতার উত্তর দিল, তুমি আমাকে সে সুযোগটা দাওনি চন্দ্র পাতার কালি!
    আমি উঠতে যাচ্ছি অমনই পাতা গর্জে উঠল, ‘নো নো, এখন তুমি আমাকে ছুঁবে না। ছুঁলে আমি আত্মহত্যা করব!’
    বারান্দার লাইটের আলোয় আর বাইরের ফর্সা জ্যোৎ¯œার আভাতেও পাতার কৃত্রিম রাগে মুখের রঙ পরিবর্তন স্পষ্ট বোঝা গেল না। ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ লুফার মত ওর হাত দু’টি ধরে টান দিয়ে আমার পাশে বসালাম।
    ‘অন্য কিছুতে নয় আমার বুকের ভালবাসার সবটুকু গরল পান করে আত্মহত্যা করো।’
    পাতা আমার বুকে মাথা রেখে শরীর দুলিয়ে হালকা শব্দে হাসছে। বাইরের অল্প ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ উত্থাল পাথাল জ্যোৎ¯œা ঢালছে। সিঁড়ির গোড়া থেকে উঠোনের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছাপা শাড়ির মতো ছায়া পড়েছে। বাড়ির পেছন দিকটায় ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে একটানা। আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর এই শারদীয় মোহন রাত আমার খুব খুব ভালো লাগছে।

শেষ পর্ব.

    হেমন্তের দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে, আজ পৌষের প্রথম দিন। কিন্তু আমার বুকে জমছে জলভরা মেঘ শ্রাবণের আকাশের মতো,দলা দলা আবেগ-শুস্ক নয় খুব বেশি আদ্র, মৃত নয় ঘুমন্ত অগ্নিগিরির মতো যার স্বভাব!
    পত্রালি, আমার পাতার অসুখ করেছে। অসহায়ের মতো দেখি অসুখটা ওকে খুব ভোগাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মাঝে মাঝে ককিয়ে উঠে তখন বেদনায় মুখটা নীল হয়ে যায়। প্রতিদিন ডাক্তার আসছেন, ঔষধ দিচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
    আমি সারাদিন ওর কাছে ঘুর ঘুর করি। একলা পেলে হাসি ঠাট্টায় ভুলিয়ে রাখতে চাই সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, বেদনাÑকিছুই পারি না। দিনে ও যতটুকু বা ভালো থাকে রাতগুলো যেন এক একটি কষ্টের হিমালয় হয়ে আসে ওর সামনে। ঘুমোতে পারে না, শুতেও ওর কষ্ট হয়, উঠে বসে, পায়চারি করে সেই হিমালয়ের আড়ালের সূর্যের প্রতীক্ষা করে।
    অথচ এই ক’রাত আগেও পাতার কোন কষ্ট হত না। অবশ্য ওর ঘুম বেশ কিছুদিন থেকেই অনেক কমে গিয়েছিল। খুব সাবধানে এপাশ ওপাশ করত। গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম টের পেতাম না। কখনো মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখতাম পাতা ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তেÑকখনো দেখতাম স্থির চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমাদের ঘরে সারারাত মৃদু লাইট জ¦লে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে পাতা ঘুমুতে পারে না। এমনকি বাসর রাতেও সে আমাকে মৃদু লাইট অফ করতে দেয়নি। সারা বিরামপুর গ্রাম ইলেকট্রিসিটির আলোয় জ¦ল জ¦ল করে শুধু আমাদের এই বাড়ি ছাড়া। বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির সংযোগ নেয়ার ঘোর বিরোধী ছিল পাতা। ওর যুক্তি ‘সৌর বিদ্যুৎ নিরাপদ, হুট হাট করে অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে হয় না।’ সব সত্যি। কিন্তু প্রথম প্রথম আমার মনে কিছুটা খুঁত ছিল। তবে মা পাতার কথা খুব পছন্দ করেছিলেন। তাই তো সৌর বিদ্যুতের শীতল আলোয় উজ্জ্বল এই বাড়ি।
    এই তো ক’রাত আগেও শুয়ে শুয়ে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করতাম। প্রতিটি গল্পে কিছু কথা কখনো ঝড়ের মতো-কখনো মৃদু ছন্দে ঢুকে পড়ত। হয়ত অফিসের কোন একজন কলিগ সম্পর্কে কথা বলছি, একটু শোনার পরই পাতা আমার চোখে অপলক দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকত। বুঝতাম ওর মন অন্য জগতে বসে স্বপ্নের ওল বুনছে। জিজ্ঞেস করতাম,‘কী?’
    ‘আমি কিন্তু ছেলে চাই!... আমার মন প্রাণ ঢেলে ওকে আমি তোমার আদর্শে মানুষ করব।’
    ‘উঁ-হুঁ, না। আমি মেয়ে চাই। সে হবে তোমার মতো সুন্দরী/দেখে তারে হার মানবে নীল আকাশের পরী।’
    ‘তুমি কবিতা লিখলে ভাল করতে। মহাকবি-র স্ত্রী হিসেবে লোকের সালাম, স্যালুট, নমস্কার পেতাম। হি-হি-হি।’
    ‘না লিখলেও একটা কবিতা তো প্রতিদিন পড়ি। তোমার মতো জলজ্যান্ত একটা কবিতা যার শব্দ-ছন্দ-উপমা, আবেগ-উচ্ছ্বাস-বিরহ, হাসি-কান্না-আনন্দ আমাকে ঘিরে থাকে চারপাশে থেকে।
    আমার কথা শুনে পাতা তখন আমার বুকের কাছে মুখ রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকত। আর এখন সব গল্প-কবিতা পরবাসী হয়েছে।
    মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপার আমি কিছুই বুঝি না। ছোট কাকীর বয়স হয়েছে, তবুও পাতার বেশ যতœ করছেন। সানু আপাকে সব জানিয়েছি। আপা আগামীকাল আসছে। ও দুই ছেলে, জামাইসহ শহরে থাকে। ছোট ছেলেটার বয়স তিন, বড়টার বার্ষিক পরীক্ষা কাল শেষ হয়েছে। শহরের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার সময় বাবা-মা পর্যন্ত নিঃশ^াস নিতে ভুলে যায়, অন্য কিছু দূরে থাক।
    পরশু ডেলিভারির তারিখ। পাতাকে জেলা শহরে নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে একজন গাইনোকোলজিস্টকে দেখিয়ে এনেছি। কয়েক ধরনের টেস্ট করা হয়েছে। সানু আপার বাসায় দু’দিন ছিলাম। আপা পাতাকে রেখেই দিতে চেয়েছিল।
    কোন অসুবিধা হলে হাতের কাছে ডাক্তার, হাসপাতাল।
    কিন্তু পাতার প্রবল আপত্তি; ও কিছুতেই থাকবে না। সেখান থেকে ফেরা পরের রাত থেকেই অসুখটার বহিঃপ্রকাশ।

    সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ছোট কাকী মাগরিবের নামাজ আদায় করতে গেছেন। আমি পাতার একটি হাত আমার হাতে ধরে আছি।
    ‘আমার মনে হয় রক্তিমার মুখ কালকেই দেখতে পাবো।’
    ‘কালকে মানে? ডাক্তার পরশুর কথা বলেছেন না!’
    ‘আ-রে আমার শরীরে ওর বসবাস, ডাক্তারের চেয়ে আমি ওর মতিগতি ভাল বুঝি।’
    পাতার কথা আমাকে মানতেই হল এবং প্রমাণ পেলাম রাত দশটার পর পরই পেইন উঠল। প্রসব ব্যথা কিনা বুঝার জন্য নিয়ামতুল্লাহ ডাক্তার ও প্রশিক্ষিত দাই ভোলার মাকে খবর দেয়া হল। তারা এসে ভাল করে দেখল। অভিজ্ঞ ভোলার মা থেকে গেল। নিয়ামতুল্লাহ ডাক্তার আপাততঃ সমস্যা নেই বলে চলে গেলেন, সকালে আসবেন।
    কিন্তু সমস্যা শুরু হল মধ্যরাতে। পাতার শরীরের তাপমাত্রা কমতে শুরু করল। হাত, পা বেশ ঠা-া হয়ে গেছে। এমনিতেই শীত পড়েছে তার উপর অসুস্থ শরীর, তাপমাত্রা কমারই কথা। ভোলার মা হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে, ছোট কাকী স্টোভে কাপড় গরম করে শরীরের বিভিন্ন অংশের উষ্ণতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমি একপাশে বসে পাতার মাথায় সান্ত¡নার পরশ বুলাচ্ছি। পাতার কঁকানো বেড়ে গেল। নিশ্চয়ই ব্যথা বাড়ছে। ওর নিভু নিভু চোখের তারার দিকে তাকালে বুক ধড়ফড় করে উঠে।
    ‘তুমি ঐ রুমে যাও বাবাজী। সময় বেশি নাই।’
    ভোলার মার ব্যস্ত কণ্ঠ শুনে আমি উঠতে যাচ্ছি, পাতা আমার একটা হাত চেপে ধরল। অন্যহাতে ইশারা করে কাছে ডাকল। আমি ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লাম। ও ফিসফিসিয়ে উঠল।
    ‘তোমার পাতা হলুদ হয়ে গেছে, ঝরে পরার অপেক্ষা মাত্র। দীপ, আমাদের রক্তিমা!’ ও ককিয়ে উঠল।
    ‘তোমার কিস্যু হবে না পাতা, আল্লা আল্লা কর।’
    আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। টলতে টলতে ড্রইং রুমে এলাম। ছোট কাকা শুকনো মুখে সোফায় বসে আছেন। বাড়িতে মানুষ এই কয়জনই। মা মারা গেছেন ২৩ শে মার্চ, আমার শাশুড়ী পুরোপুরি বিছানা নিয়েছেন, সানু আপা কাল আসছে, ছোট কাকার ছেলে মেয়েরা সবাই ঢাকায় থাকে। আমার শ^শুর চিত্রাকে নিয়ে আসবেন ফযরের পর, মোবাইলে কথা হয়েছে। চিত্রা আনন্দমোহনে পড়ে, আজই বাড়ি এসেছে।
    পাতা আল্লা, আল্লা, বলে গোঙাচ্ছে। আমার হাত-পা কাঁপছে। পাশের বাড়ির সাবিনা ভাবি, রুবেলের মা, বালি দাদী, কলির মা ঘরে ঢুকল। ছোট কাকা আর আমি বাইরে চলে এলাম। বেশ কুয়াশা পড়েছে। হরিণের বাঁকা শিংয়ের মতো চাঁদটাকে কুয়াশায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লা আল্লা করছি মনে মনে।
    পাতার গোঙানো কমে এসেছে। ভোলার মার গলা শুনলাম।
    ‘ব্যথা বাড়া-কমা ভালা না, সবাই আল্লা আল্লা করেন, দরুদ পড়েন।’
    ছোট কাকা ফিস ফিস করে ইয়াসীন পড়া শুরু করলেন, আমি মনে মনে দরুদ পড়ছি।

    চাঁদের আলো ফিকে হয়ে এসেছে। পূর্বাকাশে বিজয় দিবসের সূর্য প্রথম রক্তিম আভা ছড়াতে শুরু করেছে। আমি বাইরের বারান্দায় ড্রইং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অল্প দূরে ছোট কাকা, বছির কাকা, মণি দাদা বসে গল্প করছেন। আমার সামনে বারান্দার নিচে হাসনাহেনার ঝাড়। ওর একটি ডাল বারান্দার গ্রীল গলে ভেতরে ঢুকেছে। সেই ডালে একটি হলুদ পাতা।
    আমার পাতা রাতে বলেছিল সে হলুদ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই সে গাঢ় সবুজ হয়েছে, কারণ তার বুকে আছে রাঙা সূর্যের মতো আমার মেয়ে রক্তিমা। অল্পক্ষণ আগে যে জন্মেছে। ছোট কাকী বেড রুমের দরজা থেকে হাসতে হাসতে আমাকে ডাকলেন আমার মেয়ে দেখার জন্য। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তখনি আমার পেছনে আমাদের বাড়িতে আসার রাস্তার দিকটায় রিকশার ঝুপ্ ঝাপ্ আর বেলের টুন্ টুন্ টুন্ শুনতে পেলাম। আমি জানি ওদিকটা কুয়াশায় ঢাকা। হলুদ পাতাটি ফেলে দিয়ে পেছনে না ফিরে সামনে পা বাড়ালাম। সামনের দিকটা আমার জন্যে বড় বেশি গর্বের, বড় বেশি সুখের, বড় বেশি আনন্দের! 



ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১০২

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১০২
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১০২
বৃহস্পতিবার ।। ১৩ ডিসেম্বর ।। ২০১৮
















পদাবলি

পদাবলি


কামশীতলরাষ্ট্র
ইমরান মাহফুজ

রোদের অন্ধকার থেকে ছায়া কথা বলে। কেউ শুনে না। চুপচাপ শুয়ে থাকে ক্লান্তবিকেল। আনন্দভ্রমনে পাখিদের যাত্রা। উড়ে যাচ্ছে মেঘ। মানুষরা হারায় সমুদ্রবেলায়। তলদেশে উদ্ভিদের অদ্ভুত সা¤্রাজ্য!
জ্যোতিময় ঘুঘু ছুটির দরখাস্ত রেখে হাসপাতালে গত সাতদিন। আমি সমুদ্র পাড়ে চোখের হলকা পোয়াচ্ছি। কারো কারো ম্লানের দৃশ্যে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। পুকুরের পাড়ে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকতাম। কখনো কখনো ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে রোয়াখেত মাড়িয়ে নিজেই নিজেই পালাতাম। ইচ্ছারা করতো নিঃসঙ্গ রাত্রিযাপন!
এখন আলোতে কিংবা স্বপ্নঘোরে দৃশ্যরা হরহামেশে জ্বালায়। ঘুমন্ত শষের মতো কামশীতলে পড়ে থাকি। যেমন হাজারো বুদবুদ নিয়ে গোয়ালঘরে মুখোশপরারাষ্ট্র।



সূর্যবন্ধনা
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
(স্নেহপ্রিয় আলিফ আল ইমরান স্বরণে)

সংসারের হাড়ে চিতি পড়ে গেলে বেড়ে যায় ঘরের ময়লা; আল বেয়ে বেয়ে হেটে যাওয়া মানুষগুলোও হয়ে ওঠে পিনিকপাখি ! শস্যকণার নিবিড় নিদ্রা শেষ হলে পঙ্গু হয়ে পড়ে শিশিরের সন্তান । আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি মর্গের বিলবোর্ড; কোলাহলে ডুবে ডুবে খাই নিষিদ্ধ চা! কেউ বলেনি; সময় এখন শুয়োরের বাচ্চা !

মানুষগুলো ল্যাংটা চাঁদের দেহ খুলে বসিয়ে রাখে রক্তের প্রদীপ; কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি বলে আমাদেরও হয়না কোনো রকম আক্ষেপ- ঘরে ঝুলিয়ে রাখি পয়সার ছবি; আদর আদর বলে কোথাও বেড়িয়ে পড়ি সংসারের কোলে; মা সেলাই করে চলে গল্পের কাঁথা, সন্ধ্যের খরগোশ ঢুকে পড়লে ঘরে মায়ের হাতে ঢুকে পড়ে সুঁই, চুলোর দুধ পুড়ে উড়ে ধোঁয়া। মা; মানুষগুলোর কথা ভেবে ভেবে রচনা করে মুখর শিলালিপি ।

বাজারের থলে ভরে কেউ কেউ নিয়ে আসে মেঘের মাছ; মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যায় সূর্য ! নিছক কলঙ্ক মেখে দোয়েল কি বলবে ভেবে উড়াল দিল আকাশে, করিডরে নিষ্ঠুর প্রজাপতিরা হেসেই কুটিকুটি। বৈকালিক অভিমানে চুরি যায় মানুষের মন; দৌড়াতে দৌড়াতে মানুষগুলো হারিয়ে ফেলে মন, সূর্য তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষ দেখে; বেরঙের পথগুলো সূর্যের অবাকটুকু গিলে ফেলে কাছে ডাকে, সূর্যও  হয় মানুষ। ঘটা করে একদিন মাছিদের উৎপাতে মানুষের ভীড়ে সূর্যও ঘুমিয়ে পড়ে স্ট্রেশনে !

অতিক্রমন
আমিনুল ইসলাম সেলিম

পথ থেকে উড়ে যাচ্ছে ধুলোর মেকাপ
বেরিয়ে পড়ছে তার ঠনঠনে কঙ্কাল,
লজ্জাহীন কশেরুকাগুলো

অপরাহ্নরোদে-
মেলছে সজারু-কাঁটা বিষাক্ত দুপুর
নৃত্যমাতাল যেনো মিথ্যুক ভয়ের প্রতাপ

অথচ আকাক্সিক্ষত প্রান্তসীমা ছুঁতে
মানুষকে হাঁটতে হবে সুদীর্ঘ জীবন।



কলকাতার  সেলফি ৩৩
সৈকত  ঘোষ

প্রচণ্ড ভাবে বেঁচে থাকার মধ্যেও
আমরা মৃত্যুকে দেখতে পাই
আমাদের জড়িয়ে থাকে আমাদের ছায়া

সুযোগ বুঝে আমরা সবাই
কোনো না কোনো চরিত্রে অভিনয় করছি
সমস্ত অসহায়তা ডিঙিয়ে
অন্ধ হয়ে যায় সম্পর্ক নামক রেলিং

একটা সময় পর আমরা মেনে নিতে শিখি
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে একটা সহনশীল দরজা ।


জীবন
হিমাদ্রী মুখোপাধ্যায়

অতলান্ত ডুবের নিচে, অন্ধকারে
ডুবে আছি-
ডুবে আছে ভাগ্যদেবীর হস্তরেখা...
হাত ধরো হে করুনাময়ী, জল পেরিয়ে
আঙুল ছুঁয়ো-
তোমার হাতেই হাত রাখে এই বাঁচতে শেখা।



খড়ি
হুসাইন আল হাফিজ

তুমি চাইলে নদী হতে পারি
বুক খুঁড়ে প্রত্যহ পান করতে পারো অমীয় সুধা
মনে করো; আমি চাঁদ তুমি জ্যোৎস্না
তুমি আলপিন হলে; আমি বারবার দর্শন দেব
বেলুনরূপে। গালের উপরে উপচে পড়া একগোছা
চুলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমায় দেখো না তুমি
হতে পারি বৃক্ষ; যে গুনে প্রতীক্ষার প্রহর
তোমার বিশ্বাস হয় না?
স্মোকার হয়ে যখন সিগারেটে টান দাও তুমি
আমি আগুনের গোলা হয়ে তোমায় প্রদর্শন করি।
তুমি চাও আমি জ্বলি; অথচ আমি প্রজ্বলিত খড়ি
অবিরাম তোমাতে জ্বলছি আর জ্বলছি!

বছর বিশেক পরে
লাবন্য শাহিদা

ঘুমোচ্ছো?
বললি বা দিক ফিরে
আমি ফিরলাম তোর দিকে চেয়ে

আজ থেকে বছর বিশেক পরে
আমি আর তুই একি ছাঁদের নিচে

একি গন্ধ একি বডি স্প্রে নিয়ে
আমার তোর সময় যাচ্ছে বয়ে
আচ্ছা, বলছি শোন, তখনো কি
এমনি ভাবেই কবিতা শুনতে চেয়ে
দিব্যি রেগে বলবি ভীষন ক্ষেপে
‘তুই একটা বাসন মাজা মেয়ে’
বলব আমি আদর মাখা গলায়
পাচ্ছি কি সময়?
তোর সংসারে যাচ্ছে আমার জীবন
এমনি তুই সটাং করে গিয়ে
আনবি খুজে কাগজ কলম খানি
বলবি রেগে এই নে, তুই ঝাঁসি কি রানী
ওমনি আমি গলগলিয়ে হেসে
বলব এমন দস্যু ছিলি বলে
বশ মেনেছি তোর আকন্ট দেশে
তখনো কি এমন নিয়ম করে
রোজ ঝগড়া আর দস্যিপনা হবে?
এ কথাতেই আবার বা দিক ফিরে,
ঘুমাচ্ছিস তুই কালকে অফিস বলে
সেই বছর বিশেক আগের কথা
যখন অফিস বলে রাখতি ফোন
ঘুমাচ্ছিস এ শুনেই উঠত টোন
ঝগড়া নাকি মেঘের গর্জন
আমার তোর নেশা ছিল মুভির
আজো ঠিক তেমন আছে সবি
শুধু টিনটিন এক হয়েছে
তোর আমার একি ড্রয়ার বেডে
ঠিক আজ এত বছর বাদে
আমি তুই আজো আছি
তেমনি জুড়ে দুয়ে
যাচ্ছে সময় বাড়ছে আয়ু
দীর্ঘ হচ্ছে পথ
এই পৃথিবীর এক বায়ুতে
তুই আর আমি এক রথ
দেখিস,
আজ থেকে বছর বিশেক পরে
আমি আর তুই একি ছাঁদের নিচে।


উঠোনে রাতের ঘাসফুল
খোরশেদ আলম খোকন

উঠোন জুড়ে আলতা রাঙা ঘাসফুলগুলো সকাল সন্ধ্যায় গোধূলির গন্ধে,
প্রত্যহ অন্ধকারে তারার আঙিনায় স্পর্শের শব্দ শোনায়।
তারপর, ক্লান্তির বিশ্রাম এসে হামাগুরি খায় ভোরের ক’ফোটা শান্ত শিশিরে...
নৈশব্দের দো-হাতে কাঁচের চুড়িগুলো গড়াগড়ি করে মরে রাতভর!
কান পাতলে শোনা যায় কালো ঘুটঘুটে  অমাবস্যায় চুড়ির কঙ্কণ,
রাত্রির দ্বিপ্রহরে থেমে থাকা চুম্বন; নূপুরের ঝনঝন আওয়াজ বেজে উঠে পরপর...
প্রভাতীর উঠোন জুরে নুয়েপড়া লজ্জার লাল দাগগুলো-
দুপুরের ঘাসফুলের মত জ্বলজ্বল করছে;
রাত শেষে কুয়াশার ঘুঙুরে প্রভাতী ঢেকে নেয় তার সমস্ত উঠোন।




স্বার্থের ঝুলন্ত ফানুষ

স্বার্থের ঝুলন্ত ফানুষ


স্বার্থের ঝুলন্ত ফানুষ
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অনেক পুরোনো আমলের দালান।
কত দিন আগে! কে জানে?  হয়তো অনেকদিন। দালানের মাটির ফলকে নানান রঙের কারুকাজ আর শিল্পকর্ম বলছে এটার একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এটা নাকি টেরাকোটার দালান।
একসময় হয়তো দালানটার যৌবন ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি দালানটা। হায়রে যৌবন। কলা পাতার মতো ভেসে গেছে নীল সমুদ্রে।
এখনও অন্দর মহলে ঝাড়বাতির আলো আছে। কিন্তু সে আলোর জৌলুস নেই, চোখ ধাঁধানো রূপ নেই। একটা নর্তকীদের নাচের ঘরও আছে। একদিন হয়তো সেখানে নুপুরের ঝংকার ছিল। বাঈজীদের মান, অভিমান, কষ্ট আর কান্না ছিল। এখন কিছুই নেই। আছে কিছু না জানা চার দেওয়ালের ইতিহাস, শব্দহীন দুঃসহ যন্ত্রনা আর ভাঙা নুপুর। অযতেœ পরে আছে জমিদার বাড়ির জলসা ঘর।
কেউ আর বেঁচে নেই। জমিদারিও অনেকদিন আগেই চলে গেছে। কিন্তু এখনও কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন সমীরণ বিবি। জমিদার বংশের বউ।
খুব জাদরেল। স্বামী মরেছে অনেক আগেই। কিন্তু মৃত্যুটাও একটা রহস্য। ঘটনাটা আজও অজানা। হয়তো অজানায় থেকে যাবে। ঠিক এখন থেকে চব্বিশ বছর আগের ঘটনা। ঘরে তখন সাত জন সন্তান। দুটো মেয়ে আর পাঁচটা ছেলে। সবগুলো খুব ছোট ছোট। সবচেয়ে বড়টার তখন ১৫ বছর বয়স। আর সবচেয়ে ছোটটার এক বছর। খুব ভালোভাবে সবাইকে মানুষ করেছেন সমীরণ বিবি।
একে একে সবার বিয়ে দিয়েছেন। এখন শুধু একটা ছেলেই বাকি আছে।
যখন বউ হয়ে ঘরে আসে সমীরণ তখন রূপ যৌবন আকাশের তারার মতো ঝিলিক মারতো। এখন কিছুই নেই। খালি চোখে চশমা বসেছে। লাল রঙের জামদানি শাড়ির বদলে সাদা রঙের শাড়ি গায়ে ধরেছে। চুলগুলো লম্বা থেকে খাটো হয়েছে। কালো কয়লার মতো চুল সাদা দুধের মতো হয়েছে। কপালে কুঁচকে যাওয়া পাতার মতো ভাঁজ পড়েছে। শরীর চামড়ায় জড়তা এসেছে। এখন বাকি জীবনটা সুখে কাটলেই হয়। কে জানে কি হবে। অনিশ্চয়তায় ভুগেন সমীরণ বিবি।
ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেবার পর সব এক এক করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। মায়ের জন্য কিছুই করতে পারেনা তারা। এইতো ফোনে মাসে দুই একবার হাই হ্যালো করা। ভালো মন্দ জানা। এর বেশি কিছু নয়। সমীরণ বিবি ভাবেন কত আদরের তার ছেলে মেয়েরা ছিল। ছোট বয়সে ওরা বলতো, মা তোমাকে ছাড়া আমরা কাউকে ভালোবাসি না। তোমাকে আমরা কখনো ছেড়ে যাবো না। মায়ের আদর তো ফুরোবার না এটা কেমন জানি সময় যত বাড়ে মায়ের আদর বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছায় কেউ হয়তো তা জানে না। এটা তো সংখ্যা দিয়েও গোনা যায় না। কিন্তু বয়স ছেলে মেয়েদের যতই বাড়ে মনের রং তাদের ততোই বেড়ে যায়। মায়ের সাথে ভালোবাসার দেনা পাওনা যতই দিন যায় ততই কমতে থাকে।
হায়রে মা। কিসের নাড়ির বন্ধন। রক্তের ঋণ। সব কল্পনার গল্প। বাস্তবতা খুব কঠিন। রূপবতী বউ পেয়ে সমীরণ বিবির হাত থেকে ছেলেরা বউদের হাতে চলে গেছে। মেয়েদের তো আর করার কিছু নেই। যতই আমরা বলি নারীর ক্ষমতায়ন। কিন্তু সেটা কজনই বা পায়। মেয়ের ঘুড়ির এখনও মতো সুতো আর নাটাইটা পুরুষ নামের স্বামীর হাতেই থাকে। তারপরও সমীরণ বিবির বউদের নিয়ে ফিসফাস মেয়েদের সাথে চলে। এটাতে হয়তো পুরো শান্তি আসেনা কিন্তু মনটা ফুরফুরে থাকে।
সময় তো আর থেমে থাকে না। মানুষ হাঁটলে সময় দৌঁড়ায়। ছোট ছেলেটার বয়স এখন পঁচিশ বছর। টক টকে সাদা রং। চেহারাতেও খান্দানি জৌলুস। আহা একবার দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। সমীরণ বিবি খুব একটা বাইরে বের হন না। তবে পাড়া-প্রতিবেশীরা দল বেঁধে আসে। ছেলে বউ, সুখ-দুঃখ এমন কোনো বিষয় নাই যা নিয়ে আলাপ হয় না।
পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে, ছেলের বয়স তো দুই যুগ পার হলো। ঘরে বউ আনবা না?
সমীরণ বিবি কথাটা শুনে হাসে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রাগতে থাকে। এরপর আত্মীয়-স্বজন সবাই ছেলের বিয়ের বিষয়টা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে।
সমীরণ বিবির মনটা মেঘ হয়। খুব কালো মেঘ।
এতো পাড়াপাড়িতে শেষ পর্যন্ত ছেলের জন্য বউয়ের খোঁজ করতে থাকে। লজ্জায় ছেলের টুকটুকে সাদা গাল লাল হয়ে যায়। একের পর এক সুন্দরী মেয়ে সমীরণ বিবি দেখতে থাকে।
ছেলের মন আন্চান করে। বুকে কাঁপুনি উঠে। সুন্দরী মেয়েদের যাকেই দেখে তাকেই তার পছন্দ হয়। রাতভর বালিশটা নিয়ে বিছানার এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। বউয়ের স্বপ্ন দেখে, বিয়ের স্বপ্ন দেখে।
ছেলে আর পরিবারের অন্যদের মেয়ে পছন্দ হলেও সমীরণ বিবির কিছুতেই পছন্দ হয় না। খুব ধপধপে দুধে আলতায় মেশানো রূপসী মেয়ে দেখলে বলে, এতো রূপ ভালো না। এখানে পোলার বিয়ে দিবো না।
আবার শ্যামলা মেয়ে দেখলে মুখ ভেংচিয়ে বলে, আমার পোলার বিয়ে এমন মেয়ের সাথে দিবো না। আর কালো মেয়ে দেখলে তো কথায়ই নেই।
যখন কোন মেয়ের কোন কিছুতেই খুঁত পাওয়া যায় না তখন নাকটা বোচা, মুখটা বাঁকা, আচার-আচরণ ভালো না, হাতের মধ্যে তিল এরকম হাজারটা অজুহাত করতে থাকে। ছেলেটার ভীষণ রাগ হয়। আহা! এবারও সুন্দরী বউ হাতছাড়া হয়ে গেলো। কিন্তু মায়ের সামনে কিছু বলতে পারে না। মনে মনে ফুসে উঠে।
এভাবে একটার পর একটা মেয়ে দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেলো। ছেলের বয়স এখন ত্রিশ। মনের মধ্যে আর আগের মত রঙ, রূপ, রস কাজ করে না।
ভিতরের আবেগটা এখন ভোতা হয়ে গেছে। তারপরও নিবু নিবু কুপির আলোর মত একটুকরো আশা বেঁচে থাকে। এখন আর বউ না, সংসার করতে পারলেই হয়।
সমীরণ আগের মতই একটার পর একটা মেয়ে দেখতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই তার পছন্দ হয় না। সব দেখে শুনে মনে হয় পানি একবার বরফ হয়েছে, এ বরফ আর কখনও পানি হবে না।
সময় পাগলা ঘোড়ার মত। ছেলের বয়স এখন চল্লিশ বছর। সমীরণ এখনও মেয়ে খুঁজছে। কিন্তু অপছন্দের জায়গায় পছন্দটা এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি। আগে দলে দলে মেয়ের বাবারা এসে সমীরণের বাসায় পড়ে থাকতো। এটা ওটা বলে সমীরণের মন গলানোর চেষ্টা করতো। যদি কোন ভাবে জমিদার বংশে মেয়েটার বিয়ে হয়।
এখন সব অন্যরকম ঘটছে। মাঝে মাঝেই ছেলের সাথে খিটমিট লেগে থাকে।
সমীরণের রক্ত গরম হয়। রাগ করে বলে, তুমি যাকে বলবা তার সাথে তোমার বিয়ে দিবো। ছেলে এবার সংসারের জন্য না শেষ বয়সে একটা সঙ্গী পাবার জন্য বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত সবার কাছে নিজের বিয়ের কথা বলে। মেয়ে খুঁজতে বলে। মেয়েকে পছন্দ হলে ছেলের বয়স চল্লিশ। এখন উল্টা মেয়ে পক্ষ থেকে না করে দেয়। অনেকে গালি দিয়ে বলে বুড়া ব্যাটার লগে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে জীবনটা নষ্ট করতে চাই না।
সমীরণ বিবি ভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে আকাশ পাতাল এক করে দেয়। ছেলেকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে। কিন্তু কোথায় যেনো একটা অন্ধকার মেঘ। পাথরের পাহাড়। বৃষ্টির সাথে শিলা বৃষ্টি। ভিতর আর বাইরের ভিন্ন রূপ।
এখন ছেলের বয়স পঞ্চাশ বছর। এতো দিনেও বিয়ে হয়নি। এখন আর না বউ, না ঘর, না সঙ্গী কিছুই ছেলেটার ভালো লাগে না। সব যেন পান্সে পান্সে লাগে।
সমীরণ বিবির এখন বয়স হয়েছে। মেরুদন্ডটা বেঁকে তাকে কুঁজো বানিয়েছে। শক্ত দাঁতগুলো মাড়ি থেকে আলাদা হয়ে ফকফকা হয়ে গেছে। এখন ছেলেকে দেখলে সমীরণ বিবি কাঁদে আর কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে পাহাড়, নদী, সমুদ্র এক করে দেয়।
কেউ জানে না কার দোষে ছেলেটার বিয়ে হলো না। কিন্তু সমীরণ বিবির ভিতরের মন জানে কার জন্য ছেলেটার বিয়ে হয়নি।
নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় সমীরণ বিবির। নিজের স্বার্থের কথা ভেবে অনেক মেয়েকে পছন্দ হলেও সমীরণ বলেছে, তার পছন্দ হয়নি। বাইরের মনটা পছন্দ করে আনন্দে নেচে উঠেছে। আর ভিতরের মনটা অজানা আশংকায় কালো মেঘ হয়ে জমাট বেধেছে। বার বার বাইরের আর ভিতরের মনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভিতরের মনটাই জিতেছে।
সমীরণ বিবি কপাল চাপড়ায়। অনেকবার সমীরণ বিবি ভিতরের মনটাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পেরে উঠেনি। যখনই বোঝানোর চেষ্টা করেছে তখনই সামনে আয়নার ভিতর থেকে আরেকটা সমীরণ বিবি বের হয়ে এসেছে। মুখটা গম্ভীর করে আয়নার ভিতরের সমীরণ বিবি বলেছে, পোলার বিয়ে দিয়ো না। পোলার যদি বিয়ে দাও তাইলে সে বউয়ের দিকে চলে যাবে। তোমার আর কোন অধিকার ছেলের উপর থাকবে না। পোলা তোমার কথা শুনবে না। বউয়ের কথা শুনবে। ছোট কালে পোলা তোমার কোলেপিঠে মানুষ হয়েছে। তখন তোমার সাথে পোলার সম্পর্ক বাড়ছে। কিন্তু বিয়ে হলে তোমার পোলার সাথে বউয়ের সম্পর্ক হবে। আর তোমার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।
সমীরণ ভাবে, আমি মা। পোলারে আগেও ভালবাসতাম। এখনও ভালবাসি। সবাই বলে মায়েরা নাকি স্বার্থপর হয় না। কিন্তু সমীরণ বিবি ভাবে সে স্বার্থপর হইছে। পোলার ভালটা না ভেবে নিজের ভালটা ভেবেছে। নিজেকে সমীরণের অপারাধী মনে হয়। ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারে না।
দিন যায়, রাত আসে। সময় দূরন্ত নদীর মত এঁকে বেঁকে ছুটে চলে। একদিন সমীরণ বিবির আত্মাটা দেহ থেকে বের হয়ে পাখি হয়ে যায়। ভালবাসার স্বার্থপর পাখিরা ডানা মেলে গন্তব্যহীন অন্যকোন শীতের দেশে চলে যায়।
এখনও ছেলেটা বেঁচে আছে।
অপেক্ষা করছে এই জীবন শেষ করে আরেকটা জীবনের।
দিন যায়, রাত আছে। সময় বদলায়। কিন্তু মনে রঙ আসে না। বসন্ত আসে না।
পাহাড়ের উঁচু ঢালটাতে মাথা নিচু করে ছেলেটা বসে থাকে। একটা মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা বলে কি বাবু আমাকে বিয়ে করবা?
ছেলেটা মাথা উঁচু করে তাকায়। উপরে আকাশ।
কে জানে এটা স্বপ্ন না বাস্তবতা। হয়তো সময় এর উত্তর খুঁজে দিবে। কিংবা জমিদার বাড়ির দালানে যদি কেউ কখনও যায় তবে জানতে পারবে শেষটা কি হয়েছে। হয়তো ভালো নয়তো খারাপ। কিংবা কোনটাই না।

দিনটি ভুলে যাওয়ার নয়

দিনটি ভুলে যাওয়ার নয়


দিনটি ভুলে যাওয়ার নয়
আশিক আহমেদ

আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের ও বেদনাদায়ক একটি দিন। এমন একটি দিন আমার জীবনে আসবে কখনো ভাবিনি।
সেদিনের দিনটি ছিলো একেবারেই ভিন্ন বলা যায় প্রত্যেক দিনের মতো স্বাবাভিক কোন দিন  নয়।  সেদিন হঠাৎ সকালবেলায় চাচাতো ভাই মাসুমের ডাকে ঘুম ভাঙল আমার। কাকার দোকানে থাকার জন্য রাতে তেমনটা  বাড়িতে থাকা হতো নাহ...
তাই সাঝ সকালে দোকানে গিয়েই ডাকতে শুরু করে মাসুম। তবে হটাৎ ঢাকার কারণটা বুঝে উঠতে পারছিলাম নাহ। তবে ঢাকার কারন টা ছিলো একটু  ভিন্ন।
-তর মায়ে তোদের বাড়ির বাথরুমের পাশে অঙ্গান অবস্থায় পড়ে আছে। রুবেল ভাই, একা একা কিছু করতে পারছে নাহ, তুই বাড়ি চল তাড়াতাড়ি।
দোকানের সাটার খুলতে নাহ খুলতেই মাসুমের মুখের কথা।
কথাটা শুনার পর থেকেই ভেতর টা জানি কেমন  শুরু করতে লাগল। কারন আমি আমার জীবনের থেকে বেশী ভালোবাসি মাকে। তাই আর দেরি নয় জ্বলদি বাড়িতে ছুটে গেলাম। আর রুবেল হচ্ছে আমার বড় ভাই।
বাড়িতে এসে  দেখলাম আমার মা কোনো কথা বলতে পারছে না; অঙ্গান হয়ে পড়ে আছে মুখ দিয়ে একটু একটু ফ্যানার মতো বেরোচ্ছে । মার এমন অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই দেরি না করে।
রুবেল ভাই, আর মাসুমকে রেখে দৌড়ে গেলাম ফারমিসি ডাক্তার শফিক ভাইকে ডাকতে সম্পর্কে উনি আমাদের ভাই।
উনি এসে মার এই অবস্থা দেখে বলল হাসপাতালে নিতে হবে। আর এরকম একটা অবস্থায় বাবা ছিলো না বাড়িতে। বাবার খোঁজ আর গাড়ি আনার জন্য দৌড়ে গেলাম সলিং মোড় বাজারে।
কোনোটাই না পেয়ে আবার বাড়িতে ফেরা। এই দিকে মার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।
ওই সময় হঠাৎ বড় ভাই ইজাজ আহমেদ মিলন ভাইয়ের গাড়িটি পেয়ে গেলাম।  বিউটি ভাবি তার দুই ছেলে প্রান্তর আর রাহীকে ইস্কুলে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের ঘরের পেছন দিয়েই যাবার পথ। সেই সময় বিউটি ভাবি মার এরকম অবস্থা দেখে বিউটি ভাবি জ্বলদি মাকে গাড়িতে তুলতে বলল। পরে ওই গাড়ি করেই  নিয়ে যাওয়া হলো; মাওনা চৌরাস্তা আলহেরা হাসপাতালে । মার অবস্থা ভালো নাহ দেখে ঐ খানের ডাক্তার রা বলল ঢাকা নয়ত ময়মনসিং মেডিকেল এ নিয়ে যেতে।
আর ততক্ষণে মার এমন অবস্থার খবর চলে গেছে তার বাপের বাড়ি । খবর শুনার পর তার ভাই, বোনেরা  কিছুক্ষণ পর ভির জমাতে শুরু করে হাসপাতালে।
ঢাকার দিকে জ্যাম থাকায় ময়মনসিং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য রওনা হলাম। যাত্রা পথে আমার সাথে ছিলো; আমাদের সাইদুল কাকা, আমার এক মামা, মামানি ও খালা।

বাকী সব ইতিহাস...
আজও সেইদিনটি ভুলতে পারনি। জানি পারবনা কখনো ভুলতে।
সতিই দিনটি ভোলার নয় আজো মনে আছে, মনে আছে সেদিনের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ  হাসপাতালের ৩য় তলা ভবনের  মেঝোতে শুয়ে থাকা অবস্থার তোমার করুন সেই  বিবৎস্য দৃশ্য। আজো ঘোর অন্ধকারে আমার চোখে জ্বল জ্বল করে ভেঁসে উঠে তোমার গোলাকার মুখ, হাড্ডিশার শরীর।
সেইদিন বুঝি; অভিমান করেছিলে আমার সাথে। অভিমান নয়তো- কী? অভিমান না- করলে হয়তো, একটি কথাও হলে বলতে আমাকে একবারের জন্য।  আমি চাতকের মতো তাকিয়ে ছিলাম তোমার মুখের দিকে। যদি তোমার কন্ঠসর দিয়ে কোন শব্দ বের হয়। যদি একবার তুমি আমার নামটি ধরে ডাকো।
আমি তোমার পাশেই থাকতে চেয়েছিলাম শেষ মুহর্ত পর্যন্ত । কিন্তু ভাগ্যর পরিহাসে থাকতে পারিনি। বড় ভাই, ইজাজ আহমেদ মিলন, মোশারফ হোসাই তযু ও রাজীব ভাইকে, আনতে গিয়ে ছিলাম হাসপাতলের নিচ তলা থেকে।
ফিরে এসে দেখি তোমার হাড্ডিশার শরীরের চারপাশে মানুষের ভিড় জমে গেছে। কারো কন্ঠনালী থেকে আস্তে আস্তে কান্নার শব্দ ভেঁসে আসছে আমার কানে। আমি তখন আর স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না। দৌড়ে ছুটে গেলাম তোমার কাছে। গিয়ে দেখলাম তুমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।
কিন্তু আমি তখনো বুঝে উঠতে পারিনি তুমি যে তখন মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছো।
আমি নিস্তেজ আর নিস্তদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তখন। কিছুক্ষণ পর আমার কান্নার আহাজারি, আর বিকট শব্দে অসার হয়েছিলো পুরো হাসপাতাল। আমার মুখ থেকে শুধু তখন এ কথাটা বের হচ্ছিল
‘আমার মায়ে আমার লগে একটা কথাও কইলনা...
মনে আছে, আমি  শুধু চিৎকার করে এই কথাটাই বলেছিলাম বার বার। মা, তুমি হয়তো শুনোনি কিন্তু হাসপাতালের ভবন আর প্রতিটি দেয়াল কান পেতে শুনেছে  আমার কথা আর আমার  কান্নার বিকট শব্দ।
খুব কী- বেশী অভিমান-ছিলো আমার প্রতি । যে রাগ ঢাক আর অভিমান নিয়েই পারি জমাতে হলো না-ফেরার দেশে।
আজ দু’বছর হয়ে গেলো আমিতো  কাউকে মা বলে ডাকতে পারিছিনা। মা, ডাকটি শুনলে আমার বুকের বাম পাঁজর মৌন বাথ্যায় ভরে উঠে। খুউব খুব বেশী কষ্ট, হয় তখন। তোমার কত শত আদর আর বকুনি ছাড়াই কেটে গেলো কতদিন।
এভাবেই হয়তো কেটে যাবে বাকী দিন। আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে মা,  তুমি কেমন কবি, হেলাল হাফিজের কবিতার  দু’টি লাইন ধার করে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘কষ্ট নেবে কষ্ট, হরেক রকম কষ্ট আছে’।

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৭

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৭
(গত সংখ্যার পর)
০৭.

দীপু ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে এল উর্মিলা। সে সব কিছু ম্যানেজ করে রেখেছিল, শুধু ছবি আর মার্কশিট নিয়ে উর্মিলার উপস্থিতি। ফরম পূরণ করতে ওর হাত কাঁপছিল। বানান যাতে ভুল না হয় তার জন্য প্রতিটি শব্দের বানান দীপু ভাই বলে যাচ্ছে।
উর্মিলা একবার বলল, ‘জানেন আমাকে এ ভাবে কেউ সাহায্য করেনি।’
দীপু ভাই বলে, ‘আরে আমি তো করবই দেবীর সব দায় যে আমার।’
উর্মিলা দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কলেজ থেকে বের হতে রাত নামল।
দীপু ভাই বলল, ‘আমরা কি কোন রেস্তোরাঁয় যেতে পারি?
‘রাতের ভাত কে খাবে?’
‘খাবেন না।’
‘অন্ন নষ্ট করা কি ঠিক?’
‘না। তারপরও অদ্য রজনী আপনি আমার ইষ্টিকুটুম। বেবী আপার জমাকৃত জীব। তাকে কী করে অসম্মান করি।’ দীপু ভাই হাসতে থাকে।
‘আপনি এভাবে বলবেন না। আমি কেঁদে ফেলব।’
‘কাঁদবেন কেন? দুর্গা কি কাঁদে? সে হলো অকল্যাণনাশিনী। আলো। আপনিও আলোর পথে হাঁটবেন। অদ্য দিবস-রজনী বেবী আপা আপনার আদমসুরত ঠিক করে দিয়েছে। আহ! কী আনন্দ ঘরে ঘরে।’ সুর তুলে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে যায়। এ সময় দীপু ভাই উর্মিলার হাত ধরে।
উর্মিলা খুব অবাক হয়। কিন্তু খারাপ লাগে না। এটুকুর জন্য কি ও তৃষ্ণার্ত ছিল? ওর বয়স আঠারো বছর তিন মাস একুশ দিন।
রেঁস্তোরার এক কোণে বসতে বসতে বলল, ‘কী সৌভাগ্য আমার। নগরের সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে নিয়ে রাতে ডিনার খাব।’ দীপু ভাই উচ্চস্বরে হাসে। উর্মিলা লজ্জা পায়।
রে¯েঁÍারার আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে উর্মিলা বলে, ‘এমন করে বললে আপনার সঙ্গে আর কখনো রাস্তায় বের হব না।’
‘আমি মিথ্যে বলছি।’
‘হ্যাঁ, মিথ্যে বলছেন। নগরে সুন্দরীরা থাকে। গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে উপহাস করছেন।’ উর্মিলার কণ্ঠ অভিমানে পূর্ণ।
‘দেবী ভুল বুঝবেন না। আমি সত্যি কথাই বলি। একদিন আপনিও বুঝতে পারবেন।’
‘আমি সত্য-মিথ্যের পার্থক্য বুঝি না।’
‘আমার জন্মান্ধ বোনটির বয়স বাইশ। ও আমার দু’বছরের ছোট। ও রাতদিনের পার্থক্য বুঝতে পারে। একদিন মধ্যরাতে আমাকে চাঁদ দেখাতে উঠোনে নিয়ে আসে। বলে, ‘কী অপূর্ব জোছনা। জোছনার প্লাবনে পৃথিবী ধুয়ে যাচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আসমা, আমি কিছুই বুঝতে পারি না।’
‘না পাবার কথা। বিয়ের যোগ্য জন্মান্ধ বোনের জন্য তোমার মধ্যে হাহাকার আছে। তাই সবকিছু গুলিয়ে যায়।’
মনে মনে ভাবি, ‘তাই হয়তো।’
দীপু ভাইয়ের কণ্ঠ আবেগপূর্ণ।
হঠাৎ উর্মিলার মনে হয়। ওর কী যেন নেই।

বিল মিটিয়ে দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হতে রাত নয়টা বেজে যায়।
রিকশা নেবার আগে দীপু ভাই বলে, ‘এত রাতে কি দেবীকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক! যদি আজ্ঞা হোন, তবে রিকসায় চড়নদার হতে পারি।’
উর্মিলা কিছুই বলে না। রিকশায় উঠে এক পাশে জায়গা রেখে অপেক্ষা করে।
রিকসায় উঠে দীপু ভাই বলে, ‘কী ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছি। দেবী পার্বতী শিব বাবাজীকে নিয়ে কৈলাসে যাত্রা করছেন।’
রিকশা কাওরানবাজার পেরিয়ে যায়। উর্মিলা চলমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোকোজ্জ¦ল বর্ণিল নগরের হরেক রকম দৃশ্য চোখের তারায় খেলা করতে থাকে। ওর মনে হয়, এই আলোটুকু শুভপুর গ্রাম আলোয় ভাসত। শুভপুরের কী বিদ্যুৎ পৌঁছাবে না?
‘দেবী কি রাগ করেছেন? করতে পারেন। তারপরও আপনাকে আপনার ডেরায় পৌঁছে দেব।’
‘ধন্যবাদ। আমি কৃতজ্ঞ।’
‘ধন্যবাদ।’
হঠাৎ উর্মিলা বলে, ‘অফিস আজ এত ব্যস্ত ছিল কেন?’
‘আমি, সুমি, বেবী আপা ম্যানিলাতে যাচ্ছি। তেইশ তারিখ কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য।  আগামীকাল থেকে পেপারস তৈরি করতে হবে।’
রিকশা ফাস্ট গেট পেরিয়ে যায়। ওদের কথাহীন রিকশা এগোয়। ব্যাংক কলোনি পেরিয়ে বাসার গলিতে ঢুকতেই উর্মিলা বলে, ‘সুমি দিদি যাবে কেন?’
‘জানি না। বেবী আপা জানে।’
কোনও কথা না বলে উর্মিলা রিকশা থেকে নেমে যায়। রিকশায় বসে থেকে দীপু ভাই বলে, ‘ধন্যবাদ কি আমি আশা করব?’
উর্মিলা পেছন ফিরে তাকায় না। গেট পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।
রুমে দরজার কাছে পৌঁছে কলিং বেল টিপ দেওয়ার আগে একবার মনে হলো, দীপু ভাইকে কিছু বলা হলো না। না বলা হলো। কলিংবেল টিপতেই রুবী দরজা খুলে দেয়।
একটু অবাক হয়ে বলে, ‘এত রাতে একা এলি।’
‘না একা আসব কেন? দীপু ভাই গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে।’
‘বলিস কী?’
‘আমি সত্যি বলছি।’
রুমের উজ্জ¦ল আলোয় রুবীকে খুব উৎফুল্ল দেখায়।
‘বাথরুম থেকে ফিরে ভাত খেয়ে শুয়ে নে।’
‘ভাত খাব না। দীপু ভাইয়ের সঙ্গে হোটেলে খেয়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হুম।’
‘এমন ভাবে বলছিস যেন দীপু ভাই জনম জনম চেনা।’
‘নগরে এসে পরিচয় হয়েছে।’
‘দীপু ভাই ম্যানিলাতে যাবে। সঙ্গে সুমি।’
‘জানি।’
উর্মিলা বিছানায় গা এলিয়ে দেবার আগে বলল, ‘রুবী। আজ কলেজে ভর্তি হয়ে এলাম। এ সংবাদ বাবাকে জানানো দরকার।’
‘অবশ্যই দরকার। উনি খুশি হবেন।’
রুবী আলোর উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
উর্মিলা বাবাকে লিখে, ‘প্রিয় বাবা, অদ্য কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি খুশি হওনি। ভর্তির পর বোধগম্য হলো, শিক্ষা মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে যায়। তুমি সারা জীবন আলোর ফেরিওয়ালা। আমি ওই পথে হেঁটে যেতে চাই।’

০৮.
পর পর দু’দিন রুবীর সঙ্গে বসে, অনেকগুলো পেপারস দেখতে হলো। উনিশ’ একাত্তরে রংপুরে বিহারী কর্তৃক বাঙালি নিধনের চালচিত্র। বেশিরভাগ পেপার কাটিং। ওই সময়ের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হেড নিউজ। অমানবিক। উর্মিলা অসুস্থতা অনুভব করে। দ্বিধান্বিত আত্মার পাশে প্রতিনিয়ত কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা। উর্মিলার মনে হয়, এ ভূখ-ের জন্য মানুষের এত ত্যাগ। এ সময় একবার সুমি দিদি বলেছিল, ‘উর্মিলা আবেগের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আছে। যা মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়। এ যুদ্ধ চলতেই থাকবে। সুমি দিদি কেন কী কারণে এ কথা বলল তার জবাবে উর্মিলা বলে, ‘মানুষের জন্ম অনেক বেদনার।’
সুমি অবাক হয়। উর্মিলাকে ওর বেশ পছন্দ হয়।
ওইটুকুই। তারপর সুমি দিদির দেখা নেই। ঘন ঘন দীপু ভাই, জাকির সাহেব, বেবী আপার রুমে ঢুকে যায়। পেপারস এর ত্রুটি নিয়ে কলকল করে কথা বলে। অ্যাম্বাসিতে বেবী আপার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে।
দীপু ভাই এ ক’দিন উর্মিলার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়নি। ভাবখানা এমন, উর্মিলা নামক তার একজন অফিস স্টাফ আছে সে জানেই না।
রুবী বলে, ‘দীপু ভাই কি অন্ধ হয়ে গেছে?’
‘কেন? উনি অন্ধ হবে কেন?’, উর্মিলা জবাব দেয়।
‘উর্মিলা ন্যাকামো করো না। দীপু ভাই ক্যামন আমাদের অবজ্ঞা করছে।’ রুবী শ্লেষ মিশিয়ে বলে।
দীপু ভাই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করে। ম্যানিলার কনফারেন্সের পেপারস তাকেই তৈরি করতে হবে।’
‘এত ঠিকুজি তুই জানলি ক্যামনে।’
‘জানতে হয় না বুঝতে হয়।’
‘ও।’ রুবী দীর্ঘলয়ে বলে।
উর্মিলা আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। লাঞ্চের পর দীপু ভাই তার রুমে ডাকে।
হঠাৎ করে উর্মিলার মধ্যে শিশুসুলভ অভিমান চাগিয়ে ওঠে। টেবিলে জমে থাকা ফাইল নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে।
‘বস অলওয়েজ রাইট।’ বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা বলেছিল। পুরোপুরি দশ মিনিট অপেক্ষা করে উর্মিলা। ইতিউতি তাকায়। রুবী ধ্যানমগ্ন হয়ে সংবাদপত্র দেখছে। এটাও চাকরির একটা কাজ। উর্মিলা বুঝতে পারে।
নিজেকে একটু গোজ-গাজ করে নিয়ে দীপু ভাইয়ের রুমে ঢুকে যায়।
দীপ ভাই কলকলিয়ে বলে, ‘আসুন দেবী তাকাহাসি, এজ লাইক জাপানি ডল।’
উর্মিলার অপ্রস্তুত মনে হয়।
কিছু বলার আগেই দীপু ভাই বলে, ‘বলি না সব দায়ভার আমার। তাকিয়ে দেখুন দুটো বইয়ের প্যাকেট আছে। একটি আপনার কলেজের বই। অন্য প্যাকেটে, বেবী আপা দিয়েছেন আপনাকে পড়ার জন্য। মনোযোগী ছাত্রী। নিয়মিত ক্লাস করবেন। লেখাপড়া আপনার প্রথম জরুরি। মাথায় ছাতা  আছে, চিন্তা কম। অফিসের নিয়ম-কানুন রপ্ত করুন। তাতে কৌটিল্যের ছায়া দোষের নয়। সময় আপনাকে বলে দেবে, ‘মানুষ চাঁদে গেলেও পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না।’ দীপু ভাই কী বলে গেল তার অনেকটা বোঝার আগেই বলে, ‘আমি কিন্তু আপনার লোকাল গার্জিয়ান।’
উর্মিলা জানত না কলেজে বেবী আপা ওর লোকাল গার্জিয়ান দিয়েছে দীপু ভাইকে। উর্মিলা চমকে উঠে। অল্প সময় চোখের পাতি স্থির রেখে দীপু ভাইকে দেখে। সুঠাম উদীপ্ত তরুণ। যেকোনো নারীর প্রার্থিত পুরুষ। এসময় ওর শরীর জুড়ে ভয় বাসা বাঁধতে থাকে। নগরে এসে শুভপুর গ্রামের উর্মিমালা স্নায়ুর কোষে কোষে সাঁতরায়। ভাবে, তাইতো! নিয়তি।
দীপু ভাই বলে, ‘দেবী কি বাকরুদ্ধ?’
‘জি না।’
‘কাল বাড়ি যাব। আসমা এবং মা’র সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
‘যাবেন।’
‘আপনি আমাকে করুণা করেন?’
‘করি’
‘কেন?’
‘আপনি আমাকে আপনি বলতে পারেন না।’
‘মানুষকে আপনি বলা ভদ্রতা।’
‘এতো বিদ্যা দিয়ে কী হয়?’
‘আপনি আমাকে মুক্তি দেবেন দেবী।’
‘আপনি আমাকে ডেকেছেন?’
(চলবে)

সৃষ্টিশীল উন্মাদ : সালভাদর দালি

সৃষ্টিশীল উন্মাদ : সালভাদর দালি


সৃষ্টিশীল উন্মাদ 
সালভাদর দালি

লুফাইয়্যা শাম্মী

পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি স্যুরিয়ালিস্টিক এবং এবস্ট্রাক্ট পেইন্টিংয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন চিত্রশিল্পের জগৎ এ। কিউবিজম, ফিউচারিজম ও মেটাফিজিক্যাল পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি তার চিত্রশিল্পে স্বপ্ন, কল্পনা, নির্মোহ বাস্তবতা ও মানুষের মনোজগৎকে এমন ভাবে রূপ দিয়েছেন যার কারনে দালি আজও জগদ্বিখ্যাত। পাশ্চাত্য চিত্রকলায় শিল্প আন্দোলনের ইতিহাস সাজিয়ে তুলেন তিনি নিজের স্যুরিয়ালিস্টিক চিত্রকলার মাধ্যমে।

১৯০৪ সালের ১১ মে স্পেনের ক্যাটালোনিয়ার ফিগুয়েরেস শহরে জন্ম গ্রহন করেন বিস্ময়কর এই চিত্রশিল্পী। ছোট থেকেই অদ্ভুত গড়নার এই মানুষ চিত্রশিল্পের জগতে প্রবেশ করলে সৃষ্টি হয়  অদ্ভুত এক বিপ্লবের। অসচেতনতার কল্পনা কিংবা আবেগকে একটি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার প্রবণতা থেকে দালি পৃথিবীকে দেয় শ্রেষ্ঠ কিছু চিত্রশিল্প, চিত্রকলায় যুক্ত করে নতুন এক অধ্যায়। দালির চিত্রকলা এতো বেশি বিখ্যাত যে শুধু মাত্র তার জন্যই দুইটি মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে। তিনি যে শুধু প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীই ছিলেন তা নয়। তার নিজের প্রতি এতোটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি নিজেকে নিয়ে লিখেন-‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি’। দালীকে বুঝতে হলে জানতে হলে তার চিত্রকর্মের দিকে নজর দিতে হবে।

দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি  (১৯৩১) :


সালভাদর দালির বিখ্যাত কিছু চিত্রকলার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’। বহুল আলোচিত এই ছবির অন্যতম মূল আকর্ষণ ঘড়ি। পটভূমিতে দেখা যায় সমুদ্রের তীর ঘেষে পাহাড় স্থির অনড় দাঁড়িয়ে। একটা টেবিলে গাছের কান্ডে ঝুলন্ত ঘড়ি। কিছু আকৃতি, কিছু ছোট অবজেক্ট। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ে ৪টা পকেট ঘড়ি যা বিচিত্র ভাবে পরে আছে চার জায়গায়। তিনটি ঘড়ি যেন গলে গলে পড়ছে। বাকী একটি ঘড়ি অন্য তিনটি ঘড়ি থেকে ভিন্ন। কমলা রঙের ঘড়ি, এবং তার কেন্দ্রের দিকে মুখ করা অনেক গুলো পিঁপড়ে, যেন কোনো কিছু আকর্ষণে ছুটে চলছে কেন্দ্র অভিমুখে। দালীর সমস্ত কাজ’ই যেন মনের সচেতন এবং অবচেতন ভাবকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। গলে যাওয়া ঘড়ি গলে পড়া সময় হতে পারে, হতে পারে অসতর্ক মনের প্রতিবিম্ব। অবচেতন মনের নিরবিচ্ছিন্ন ভাবনা, যা হারিয়ে যাওয়ার দিকে এগুচ্ছে ক্রমাগত। আর কমলা রঙের ঘড়ি তার সচেতন মনের অবস্থা, যা গলে যাচ্ছেনা কিন্তু পিঁপড়ের দল জেঁকে ধরেছে। যা সচেতন মনের ধ্বংস কিংবা ক্ষতির সম্মুখীন এক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থা ও হতে পারে, হতে পারে নিজেই কিভাবে সময়কে ক্ষতিগ্রস্থ করে চলেছি কিংবা সময় কিভাবে ধীরে নষ্ট হচ্ছে চোখের সম্মুখে। সমুদ্রের জায়গায় সমুদ্র, পাহাড়ের জায়গায় পাহাড় দাঁড়িয়ে শুধু সময় গলে গলে পড়ছে অবচেতন ভাবে। হতে পারে দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি শুধু মাত্রই সচেতন ও অবচেতন মনের একটা অবস্থা বুঝাতে চেয়েছেন সালভাদর দালি।

দ্য ফেইস অভ ওয়ার (১৯৪০) :


দালির অন্য একটি বিখ্যাত চিত্র হচ্ছে  ‘দ্য ফেইস অভ ওয়ার’। নিজ মাতৃভূমি থেকে ক্যালিফোর্নিয়াতে নির্বাসিত দালী যুদ্ধের ভয়াবহতার এক অনন্য চিত্র ফুটিয়ে তুলেন তার দ্য ফেইস অব ওয়ারে। এই ছবিটির সময় স্পেনের গৃহযুদ্ধের শেষ এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কাল। এই ছবির কেন্দ্রে এক ভীত আতঙ্কিত নারী মুখ কিংবা বলা হোক যুদ্ধের মুখ। যার চোখের ভেতর কঙ্কাল, তার ভেতরেও কঙ্কাল, এভাবেই কঙ্কালের পুনঃপুনিক একটা অবস্থা যেন, চলছেই। অর্থাৎ এটার এক অর্থ করলে বলা যেতে পারে নারীর চোখ শুধু মৃত্যু দেখেছে, মৃত লাশ বয়ে বেড়ানো চোখে মানুষের কঙ্কাল ব্যতীত আর কিছু নেই। তেমনি নারীটির মুখেও কঙ্কাল, ঠিক চোখের মতো, পুনঃপুনিক ভাবে চলছেই। অর্থাৎ নারীর মুখ ও শুধু মৃত্যুর কথাই বলছে, অগণিত মৃত্যুতে ভরে আছে চোখ, মুখ। যুদ্ধের এক ভয়াবহ অবস্থা নিজের চোখে দেখে আতঙ্কিত ভীত এক নারীর রূপ। নারী মুখের পিছনে এক ভয়াবহ শূন্যতা, কিছুই নেই, এ হতে পারে যুদ্ধের ধ্বংসের কারনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেটা বুঝানো হয়েছে। নারীমুখের এক পাশে একটি হাতের ছাপে হয়তো দালী তার নিজের অবস্থাটাই বুঝাতে চেয়েছেন। জন্মস্থান স্পেনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের প্রতিফলন দালীর এই চিত্রকর্ম। যাতে তিনি দেখিয়েছেন, মৃত্যু, শূন্যতা, মৃত্যু এবং মৃত্যুর সাক্ষ্য এক মৃত্যুর দলিল।

দ্য গ্রেট মাস্টারবেটর (১৯২৯) :

দালীর অন্যতম আলোচিত এক সৃষ্টি। ধারনা করা হয় এটি দালীর শেলফ পোর্টেট। এই ছবিতে যৌনতা, বিতৃষ্ণা কিংবা তারচেয়েও বেশি কিছু বুঝানো হয়েছে। অনেক গুলো অবজেক্ট দেখানো হয়েছে, যা ধরে ধরে আলোচনা করা সম্ভব নয়, কারন শিল্পীর মনের অবস্থা বুঝে এই ছবি আলোচনা করা অন্তত আমার পক্ষে তো সম্ভব ই নয়। এই ছবিতে তবুও যা বুঝা যায় একটি শান্ত মুখ, বন্ধ চোখ-পরিশ্রান্ত!  ক্লান্ত হতে পারে। নাকের কাছে ঘাসফড়িং। দালী ছোট বেলায় ঘাসফড়িং প্রচ- ভয় পেতেন। হয়তো এই ছবিতে তিনি ঘাসফড়িং দিয়ে তার ভয়টা ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার পেটে কিছু পিঁপড়ে দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমেও ভয়, ধ্বংস, কিংবা আতঙ্কের কিছু বুঝিয়েছেন হয়তো। হাটু ফেঁটে রক্ত বের হওয়া দুটো পা ঠিক কি বুঝানো হয়েছে বলা ঝামেলা, হতে পারে রক্তক্ষরণ,  কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। একটা নারী মুখ যা পুরুষাঙ্গের কাছে থেমে আছে, সঙ্গমের আনন্দ, উত্তেজনা ফ্যান্টাসি বুঝাতে এটা এঁকে থাকতে পারেন। এই ছবিতে  পাথর, গাছের ডাল, মানুষের অবয়ব, সিংহের মুখ এবং আরো কিছু অবজেক্ট রয়েছে যা ছবিকে করে তুলেছে দুর্বোধ্য। এই ছবিতে দালী সঙ্গমের প্রতি ভয়, বিতৃষ্ণা আবার ফ্যান্টাসি সবকিছু একই সাথে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, যার কারনেই এই ছবি হয়ে উঠেছে অধিক আলোচিত।

দ্য বার্নিং জিরাফ (১৯৩৭) :


ধারনা করা হয় এই ছবিটি দালীর নিজের ক্ষোভ আর দুঃখ থেকে সৃষ্টি। এই ছবির সময়কালে স্পেনে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিলো। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ, অস্তিত্ব হীনতা বুঝাতে চেয়েছেন তিনি অনেকাংশে। এই ছবিটিতে গভীর নীল আকাশ দেখানো হয়েছে, যার ফোরগ্রাউন্ডে রয়েছে দুইটি নারী প্রতিকৃতি। ছবির নাম বার্নিং জিরাফ হলেও জিরাফের প্রতিকৃতি আছে ছোট করে পিছনের দিকে যা দুই নারীর তুলনায় ছোট করে দেখানো হয়েছে। নারী প্রতিকৃতিকেই যেন ছবিটাতে ফোকাস করা হয়েছে বেশি। মূল নীল দেহ নারীর শরীরের থোরাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি বড় খোলা ড্রয়ার, আর বাম পা থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্রমান্বয়ে বড় থেকে ছোট হয়ে আসা আরো সাতটি খোলা ড্রয়ার।নারীর হাত এমন ভাবে রেখেছে যেন কিছু থেকে ভয় পাচ্ছে, সরে যেতে চাচ্ছে কিংবা কিছু ঠেকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। পিছনে অন্য নারী প্রতিকৃতির এক হাতে একটা মাংসের টুকরো ঝুলছে। দুই নারীর প্রতিকৃতিই কিছু ক্রাচের মতো অবজেক্ট দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ভূমির সাথে, বলা যায় নারী প্রতিকৃতিকে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে দালী সতকে বুঝাতে নারীর প্রতিকৃতি এঁকেছেন। নারী অন্যের ইচ্চাধীন, নারীকে দমন করা যায়, নারীর ভেতরে গোপন থাকে অনেক কিছু। সমাজের অবস্থাকে নারী আকৃতি দিয়ে দালী বুঝাতে চেয়েছেন অন্যায় আর নৃশংসতা। খোলা ড্রয়ার গুলো দিয়ে ভেতরের গোপন সত্য কিংবা গোপনীয় কিছু বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। আবার প্রতিকৃতিকে ভূমির সাথে আটকে রাখাকে তিনি দমন করাও বুঝাতে পারেন। এই নারী প্রতিকৃতির পিছনে একটা জিরাফের গায়ে আগুন লেগেছে, ধোয়া উড়ছে। জিরাফ তাকিয়ে আছে দূরের পাহারের দিকে। যুদ্ধ এই সমাজ ব্যবস্থার সবকিছু পুড়ে ফেলছে, কিংবা সবকিছুই ধ্বংসের পথে দালীর অবচেতন মনে তা উঁকি দিয়েছে আর সৃষ্টি হয়েছে এই অনন্য চিত্রকলা।


শিল্পকলার ইতিহাসে তিনি যে পরাবাস্তবিক আবহ ফুটিয়ে তুলেছিলেন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তা অত্যন্ত বিস্ময়কর। বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার জগৎ এ দালি এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। স্যুরিয়ালিস্টিক আবহের মাধ্যমে চিত্রশিল্পের জগতে দালী যে বিপ্লব এনেছিলেন তাতে তিনি অমর হয়ে আছেন- শিল্প জগৎ, শিল্পমনে তার বিস্ময়কর সব চিত্রকর্মের মধ্যে।