কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন
সাদিক আল আমিন
এক.
আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার পারিপার্শ্বিক জগৎ জেগে ওঠে। নিত্যকার মতো অফিস যায়, জ্যামে পড়ে, শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরে। যখন আমি ঘুমিয়ে থাকি, অবচেতনে কর্মরত আমার পারিপার্শ্বিক জগৎকে স্বপ্নে দেখি। ওরা শুধু একজন বা কয়েকজন নয়, হাজার হাজার জন। হাজার হাজারটা স্বপ্নের আদলে গড়ে ওঠে তারা। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম যখন আমি ঘুমোতে শিখি, জন্মের প্রথম দিনে মায়ের কোলে ঘুমিয়েছিলাম যেদিন, তখন থেকে আমার পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তু কিংবা ব্যক্তিসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তবে এ জগৎ আমি ব্যতীত অন্য সাধারণ মানুষজন নয়, অর্থাৎ সাধারণ পরিবেশে বসবাসরত ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তারা নিরস্তিত্ব। কেবল আমার অবচেতন কিংবা অচেতন মনেই তারা বিদ্যমান; যার অনুভব কেবল আমিই টের পাই।
এখন আমার বয়স ৩০ চলছে। বেসরকারি একটা কোম্পানিতে কাজ করি। ৩০ বছর বয়স মানে ১০৯৫০ দিন। গণনানুসারে আমার দশ হাজার নয়শত পঞ্চাশটি পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তু বা পদার্থ কিংবা ব্যক্তি থাকা উচিত। কেননা, নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন ঘুমোনোর ফলে এক এক করে বহিঃজগৎ সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু না, আমার ততোগুলো নেই। আমার সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেকের মতো হবে। অনেক রাত গেছে, আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। এরকম অনেক রাত হয়তো আমাকে জাগিয়ে রেখেছে, নয়তো আমি রাতকে জাগিয়ে রেখেছি; নিজের মতো করে উপভোগ করেছি। ডিটেকটিভ বই পড়ে, রঙ চা আর কফি উইথ ব্রাউনির সাথে ওয়েস্টার্ন মুভি দেখে সময় কাটিয়েছি। কারণ আমি আমার পারিপার্শ্বিক জগৎকে বাড়তে দিতে চাইনা। এর কারণ মূলত দুটো-
১.
আপনার পারিপার্শ্বিক জগৎ যখন আপনার মনোজাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি মাত্রায় বেড়ে উঠবে, তখন আপনি ক্রমশ বুড়ো হতে থাকবেন। মৃত্যুর কাছাকাছি গড়াবে আপনার আয়ু।
২.
ঘুমোনোর মাধ্যমে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতার প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হওয়ার ফলে আপনার পরাবাস্তববাদের প্রতি তিক্ততা এসে যাবে। তখন আপনার কন্সাস মাইন্ড সাবকন্সাস মাইন্ড থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইবে। ফলত আপনার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে। দার্শনিক অর্থেই হোক কিংবা প্রকৃত অর্থেই হোক, স্বপ্নমৃত্যু ঘটা মানুষ বেশিদিন টিকতে পারেনা।
এই কারণ দু’টোর কথা স্মরণে আমি আমার বহিঃজগৎকে আয়ত্বে রেখেছি। কারণ আমি জানি বাহ্যিকজগৎ অন্তঃজগতের চাইতে বেড়ে উঠলেই খসে পড়ে আত্মা। আপনাদের হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারে যে, যেহেতু ঘুমোনোর ফলে অবচেতনে দেখা যে জগৎটা বেড়ে ওঠে তাকে অন্তঃজগৎ বা মনোজগৎ বললাম না কেন? কেন-ই বা বহিঃজগৎ বললাম যেখানে বহিঃজগৎ বলতে আমরা শুধুমাত্র বাস ট্রাকে ভরা যান্ত্রিকীয় জগৎকে বুঝে থাকি! এর উত্তরটাও অনেক সহজ। ধরুন আপনার বাবা-মা কিংবা অতিপ্রিয় েেকউ আজ মারা গেলো। সেই মৃত্যু ঠেকানোর সাধ্য কিন্তু আপনার নেই। এটা কিন্তু বহিঃজগতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। পক্ষান্তরে যদি মনোজগৎকে বাহ্যিক জগতের স্থান দিতেন, তবে যা ঘটতো সবকিছু হতো অবচেতনে। বান্তবে এর কোনো বিরুপ প্রভাব ফেলতো না...।
সুতরাং তত্ত্বানুসারে অন্তঃজাগতিক বাস্তবতার চাইতে বহিঃজাগতিক কল্পনার মাত্রা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মৃত্যুসময় ঘনাতে থাকে।যেমন পুষ্টতার চাইতে রুক্ষতা বেশি হলে ঝড়ে পড়ে পাতা। ঠিক তেমনি একদিন, পক্ষান্তরে বহুদিনের রুক্ষ এক পাতার মতো ঝড়ে পড়েছিলো মেয়েটা। এক কুয়াশাভোরে হঠাৎ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করে সে। আমি তখনো ঘুমিয়ে ছিলাম মেঝেতে। শীতের রাত ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে কাটাতে আমার পছন্দ ছিলো। আট বছর আগের ঘটনা। তখন আমার বয়স বাইশ। আমার ঘুম ভাঙালো একটা বুনো মেষের উৎকণ্ঠা। দরজায় এসে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারছে আর যেন চিৎকার করে বলছে, ‘হে মানব ওঠো, তোমার প্রতিবেশী মানবী কিছুক্ষণ হলো মারা গেছে। তাকে এখন নিয়ে যাওয়া হবে নো ম্যানস ল্যান্ডে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে চাইলে ওঠো।’ আমি যেন মেষটির কথা শুনতে পেলাম! ঘুম ভেঙে গেল। দরোজা খুলে দেখলাম ঠিকই একটা মেষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে নির্বাক চেয়ে। বাইরে বেশ তুষারপাত হচ্ছে। হালকা একটু কুয়াশা। সেই কুয়াশার মধ্যে দেখলাম, ওবাড়ির লোকজন সবাই গ্রেভ ইয়ার্ডে যাবার আয়োজন করছে। কালো কফিনের বাক্সে ভরে রেখেছে মেয়েটাকে। সেই মেয়েটা, কাল রাত্রে যে আমাকে এক বোয়াম কফিবিন দিয়ে গেলো। বলে গেলো, ‘সকালে একমগ হাতে নিয়ে বেরোবেন। ঝিরঝিরে তুষারপাতে দারুণ খেতে লাগবে...।
দুই.
আমি তৈরি হয়ে নিলাম মেয়েটার গ্রেভে যাওয়ার জন্য। শোকাভাব প্রকাশ করার জন্য পরলাম ব্ল্যাক স্যুট। যাবার পথে রাস্তারদোকান থেকে একতোড়া অর্কিড কিনলাম। যেতে যেতে ভাবলাম, ওর বহিঃজগৎ কি অন্তঃজগতের চাইতে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছিলো? অথবা কি তার স্বপ্ন দেখা নির্দিষ্টতার সীমা ছাড়িয়েছিল! যার কারণে নিঃস্বপ্ন হয়ে হঠাৎ মেয়েটাকে দুটো জগৎ ছেড়েই চলেযেতে হয়েছে...!
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হলে তার টম্বের উপর ফুলগুলো রেখে দিলাম। আর বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তার মৃত্যুর কারণ; কি হয়েছিলো তার! নিউমোনিয়া বা এজাতীয় কিছু রোগ কি ছিল! নাকি সব পারস্পরিক জগতের কারবার! ভুক্তভোগী ছিল নাকি সুবিধাভোগী! শিকারি ছিলো নাকি ছিলো শিকার! ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে চলে আসছি, এমন সময় মনে হলো সেই মেয়েটা যেন কথা বলছে পেছন থেকে, ‘কফি কিন্তু প্রতিদিন খাবেন। বিশেষত খাবেন রাতে। জেগে থাকবেন। আমাকে ভুলবেন না’। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সব নিস্তব্ধ, নিশ্চল। মেয়েটা সেদিন কেন মরেছিল সে রহস্য বের করতে আমি দুটো বছর নষ্ট করি। সে দু’বছর আমি একদম ঘুমোইনি। তার মৃত্যুর কোনো কারণও আমি দেখিনা। কারণ মেয়েটা কখনো ঘুমোতো বলে মনে হয়না। তার ঘরের রাতজাগা ল্যাম্পের আলো আমার জানালায় এসে পড়তো। এছাড়াও যেদিন রাতে সে কফি দিতে এলো, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কালসিটে ছায়ায় ঢেকে ছিল চোখ; ব্যাপক ডার্ক সার্কেল। এর অর্থ দাঁড়ায় মেয়েটা অনেকদিন ঘুমোয়নি। অথচ পারিপার্শ্বিক জগৎকে অপ্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও ওর আত্মা খসে পড়লো কেন? পরিবারের সংশ্লিষ্ট লোকদের থেকে অবগত হলাম তার কোনো অসুখও ছিলোনা। আর তাকে মনে রাখারও বা কি আছে! তার সাথে তো আমার কোনো প্রণয় ছিলোনা কোনোদিন!
তারপরের চারবছর আমার ঘুম ছিল খুব সামান্য। চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র এক কি দু’ঘণ্টা ঘুমোতাম। মনে হতো যেন এক অদ্ভুত বাহ্যিক জগতের আশ্রয়ে বেঁচে আছি। পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে সেসব অনুভবের চেষ্টা করতাম। কখনো মনে হতো সবকিছু বস্তুসদৃশ নির্জীব; আবার কখনো মনে হতো যেন অলৌকিক কিছু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি! কিন্তু কোনোভাবেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না যে আমার আবিষ্কৃত দুটো তত্ত্ব মেয়েটির ক্ষেত্রে মিললো না কেন! সুতরাং সিদ্ধান্তক্রমে এটা কি বলা যেতে পারে যে, বহিঃজগত অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে মনঃজগত আবার নতুন করে সৃষ্টি হয়! পূর্বরুপ ডালপালা ছড়িয়ে আবার পারিপার্শ্বিক জগতের চেয়ে বড় হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে! এটাকে যদি তৃতীয় তত্ত্ব ধরি, তবে সবগুলো তত্ত্বের একটিই পরিণতি; সব তত্ত্ব সমান ক্রমধারা মেনে অবশেষে এক অনন্য পরিণতিতে পরিণত হয়; এবং তা হলো মৃত্যু। মৃত্যু উপলব্ধি করার পর থেকে আমি একদিন জেগে থাকি, একদিন ঘুমোই। কেননা এর অন্তিম পরিণতিও হয়তো মৃত্যুই হবে। যদি হয়, তবে এটা আমার আবিষ্কৃত চতুর্থ তত্ত্ব হবে। যদি না হয়, তবে অমরণশীলতার এক সফল তত্ত্ব হিসেবে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সফল হবার কারণ হতে পারে আয়ুবৃদ্ধির সাম্যাবস্থা। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক জগৎ ও অন্তঃজগৎ সর্বদাই ধ্রুব থাকছে।
চতুর্থ তত্ত্ব আবিষ্কারের পর থেকে মেয়েটার দেয়া বোয়ামের কফিবিন দু’চামচ করে গরম পানিতে মিশিয়ে এক দিন অন্তর অন্তর রাতের বেলা খাই। মেয়েটা মারা যাবার আট বছর হলো। আশ্চর্যজনকভাবে তার দেয়া সেই একবোয়াম কফি এখনো ফুরোয়নি।