আজব ঘুম





আজব ঘুম
এ আই জাজাকী

চিটাগাং রোডে দাঁড়িয়ে আছি। যাব গুলিস্তান। চাকরির সুবাদে প্রতিদিন গুলিস্থানস্থ অফিসের দিকে ছুটতে হয়। এই অফিস টাইমে বাসে ওঠা খুবই দুর্বিষহ। সিট পাওয়া তো কল্পনার অতীত। সকাল আটটায় এখানে দাঁড়াই সিলেট কিংবা চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে আসা গুলিস্তানগামী লোকাল বাসের জন্য। সুযোগ পেলেই ঝুলে পড়ি বানরের মতো। তারপর আস্তে আস্তে পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সামনের মৌচাক, সাইনবোর্ড বা শনির আখড়ায় কোনো সিটওয়ালা যাত্রী নেমে গেলে টপ করে বসি পড়ি। তবে এরূপ খুব কমই হয়। বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়েই যেতে হয়। আজ আবার ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু করছে। গতরাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। আমার চার বছরের ছেলেটা জ্বরে সারারাত কান্নাকাটি করেছে। আতঙ্কে চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সকালে অবশ্য জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। তাই নিশ্চিন্ত মনে অফিসের দিকে ছুটছি। অবশ্য ঘুমের চাপে দাঁড়িয়ে থাকাটাও দায় হয়ে পড়েছে। জানি না আজ কীভাবে অফিস করব।
অল্প সময় দাঁড়িয়ে থাকতেই সামনে এসে একটা বাস দাঁড়াল। ভেতরে সিট ছাড়া দেখছি পুরো বাসই ফাঁকা। দাঁড়ানো যাত্রী একটাও নেই। আমি আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত উঠে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম শেষের সারির কোনায় একটা সিট ফাঁকা আছে এখনও। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? আবার আমার পেছনে গেট দিয়ে হুড়মুড়িয়ে লোক উঠছে। পাঁচ সেকেন্ড দেরি করলে হয়ত সিট হারাতে হবে। দ্রুত সিটে বসে গেলাম। এক মিনিটের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল পুরো বাস। দরজায়ও ঝুলছে কিছু লোক। বাস ছেড়ে দেয়ার পরও কিছু লোক দৌড়াচ্ছে উঠার জন্য। তবে আমি আর সেইদিকে দৃষ্টিপাত করছি না। সুযোগ যেহেতু পেয়েছি একটু কাজে লাগাই। অফিস ব্যাগটা কোলের উপর রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলাম। গুলিস্তান পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক ঘণ্টায় একটা ঘুম হয়ে যাবে। ক্লান্তির অন্তত কিছুটা হলেও দূর হবে।
সুপারভাইজারের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন বাস মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের উপরে। আছি সায়েদাবাদ টার্মিনাল বরাবর। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অগণিত গাড়ি। বিশাল জ্যাম। এখানে জ্যাম হয় দুইটা কারণে। প্রথমত অনেক গাড়ি একসাথে ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে দিয়ে ইউ টার্ন নেয় বলে। দ্বিতীয়ত এক লেনে একটিমাত্র টোল প্লাজা থাকার কারণে। একটি টোল প্লাজার মাধ্যমে একসাথে এত এত গাড়ির টোল আদায় করা বেশ সময়সাপেক্ষ। যতটুকু লম্বা জ্যাম দেখা যাচ্ছে তাতে আধ ঘণ্টার আগে শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাবে। যদিও মনে হচ্ছে অফিসে কিঞ্চিৎ দেরিতে ঢুকতে হবে। যাকগে, এতটুকু পথ হেঁটেও যাওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য। তারচেয়ে বরং এখানে আরামসে আর আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই। পঁচিশ টাকা ভাড়া পরিশোধ করে আবারও চোখ বন্ধ করলাম।
সুপারভাইজারের চিৎকারে ঘুম ভাঙল। সামনের সিটের একজনের সাথে ভাড়া নিয়ে তর্ক করছে সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলাম। এ কী! বাস সবেমাত্র শনির আখড়া পার হয়ে ফ্লাইওভারে উঠছে। বিষয় কী? আমি না একটু আগেই সুপারভাইজারকে ভাড়া দিলাম। নাকি আগেরটা স্বপ্ন ছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য পকেট থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখে নিলাম। এবার তো আমি ডাবল ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলাম। সময় ১১ টা বেজে ২৫ মিনিট। আমার সাথে কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। সুপারভাইজার এসে বলল, মামা ভাড়া দেন। আমি বললাম, বিষয় কী? আমি তো একবার ভাড়া দিয়েছি কিন্তু....। সে বলল, ধুর কী বলেন? এই ট্রিপে ভাড়া তো এখনই কাটতেছি। আমি বললাম, আমিও তাই বলছি ফ্লাইওভারের জ্যামে বসে তোমাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিলাম। তুমি পঁচিশ টাকা ফেরত দিলে। মানিব্যাগ চেক করে দেখলাম তোমার দেওয়া সেই পঁচিশ টাকা যেভাবে রেখেছিলাম ঠিক সেভাবেই আছে। জ্যাম লেগেছে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সুপারভাইজার বলল, তাই বলুন। ঐ জ্যাম পার হয়ে তো আবার মদনপুর গিয়ে ঘুরে এলাম। আপনি কি কোনায় এতক্ষণই ঘুমিয়েছিলেন? আমি বললাম, আমি তো জ্যাম দেখে একটু চোখ বন্ধ করেছিলাম। তা তুমি আমাকে ডাক দিবে না? সে বলল, গেইটে থেকে তো ডাক দিয়েছি। আপনি যে এই কোনায় পড়ে ঘুমিয়ে আছেন সেটা তো দেখিনি। আমি বললাম, গত রাতে ঘুম হয়নি তাই বাসে একটু ঘুমিয়েছিলাম। এই ঘুম যে কাল হয়ে দাঁড়াবে এটা কে জানত? অফিস তো পেলামই না, তার ওপর আবার আক্কেল সেলামি। আচ্ছা, তোমাকে আক্কেল সেলামি কত দিতে হবে? সে বলল, জ্বী কী বললেন? আমি বললাম, তোমাকে আর কত টাকা দিতে হবে? সে বলল, গুলিস্তান পর্যন্ত তো ভাড়া দিয়েছিলেন। তা গুলিস্তান থেকে মদনপুর চল্লিশ টাকা, আবার মদনপুর থেকে গুলিস্তান চল্লিশ টাকা। আচ্ছা, আশি টাকা তো হয়। যেহেতু ঘুমিয়েছিলেন, ভুল হয়েছে। দেন পঞ্চাশ টাকা দেন। আমি একশো টাকার একটা চকচকে নোট তার হতে দিয়ে বললাম, নাও একশো টাকাই রাখ। এখন অফিসে ঢোকার চেয়ে না ঢোকাই ভালো। এখন গেলে লেট হওয়ার জন্য বসের কথা শুনতে হবে আর না গেলেও কাল বসের কথা শুনতে হবে। তাছাড়া এই ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে অফিসে না গিয়ে বরং বাসায় গিয়ে ঘুমাই। আর যেতে যেতেও আরও এক-দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই। তুমি কিন্তু মনে করে চিটাগাং রোড গিয়ে আমাকে ডেকে দিও। তা নাহলে আর ভাড়া দিতে পারব না। সুপারভাইজার বত্রিশ দাঁত বের করা একটা হাসি দিয়ে বলল, ঠিক আছে মামা, আপনি তাইলে ঘুমান।
সুপারভাইজারের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে নিশ্চিন্তে আবার চোখ বন্ধ করলাম।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট