ইপেপার : ধানশালিক: সংখ্যা ১৯২

ইপেপার :  ধানশালিক: সংখ্যা ১৯২

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর। ধানশালিক। সংখ্যা ১৯২,

শুক্রবার, ২০ অক্টোর ২০২৩, ০৪ কার্তিক ১৪৩০, ০৪ রবিউস সানী ১৪৪৫ ।




















প্রজ্ঞা পরবর্তী মানুষ

 প্রজ্ঞা পরবর্তী মানুষ

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


 প্রজ্ঞা পরবর্তী মানুষ

মো. আরিফুল হাসান


আক্কাস ও আলমাস দু‘গাঁয়ের দুই ব্যবসায়ী। বাজারে তাদের দোকান। তাদের দোকান আগুনে পুড়ে গেলো; দোষ পড়লো নাবলু ও তার ভাইয়ের নামে। নাবলুরা মোট চার ভাই, বড় ভাই বৃহস্পতিগঞ্জে কামারপাড়া দোকানের পাশে দোকান দিয়েছে। এ নিয়ে ঝগড়া রোজ। কামারদের লোহার ঠুংঠাং, হাঁপড়ের ভ্যাসভ্যাস ধ্বনি নাবলুর বড় ভাইয়ের কানে বিষ লাগে। একটা কথা পর্যন্ত ঠিক মতো বলা যায় না। শালা যতসব কামারের দল। কামারের দলেরা দোষারুপ করে নাবলুর ভাইকে। বৃহস্পতিগঞ্জের তেলের দোকানের দরকার কী। শালা, যতসব! আগুন-হাঁপড়ের কাছে তেলের দোকান দিছে; কখন কী দুর্ঘটনা হয় কে জানে!


যাইহোক, বাজারের লোকেরা তেলের দোকান আর দা কাস্তের দোকান দুটোকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। নাবলুরও দোকান আছে বাজারে। বাজারের পূর্ব পাশে, যেখানে পেপে গাছের ডালে কেউ একজন ছেড়া জুতা একখান টাঙিয়ে রেখেছে। নাবলু দোকান খুলতে খুলতে খিস্তায়, শালা, কোন শুওর জানি দোকানের সামনে ছিড়া সেন্ডেল ঝুলাই দিয়া গেছে। শুওরের বাচ্চাদের কোনো কাম কাজ নাই। তারপর সে দোকানের সাঁটার খোলে। পেপে গাছ থেকে জুতাটা ফেলে দিতে দিতে আরেকবার অদৃশ্যের প্রতি গালি দ্যায়। 

নিয়াজ মোর্শেদ হন্তদন্দ হয়ে নাবলুর দোকানে আসে। ভাই, অক্ষনই শহরে যাইতে হইবো। দয়া কইরা আমার কাজটা কই দেন। নাবলু মুখ ভাড় করে স্ক্যানার দিয়ে নিয়াজ মোর্শেদের আনা কাগজগুলো স্ক্যান করে এবং ফটোশপে গিয়ে স্ক্যানকপিটিতে সংশোধন বসায়।

এমনি স্ক্যান করে এডিটের পর প্রিন্ট করালে প্রতি স্টাম্পে নাবলু নেয় সত্তুর টাকা। সেটি স্টাম্পের দামের বাইরে। কিন্তু নিয়াজ মোর্শেদ এলে সে একটু বেশিই নিতে পারে। প্রতি স্ট্যাম্প দেরশো টাকা করে হয়ে যায় তখন। নাবলু জানে, শালা নিয়াজের বাচ্চা যতসব জালজালিয়াতির কারবার করে। সুতরাং তার কাছ থেকে বেশি নিলে কোনো গুনাহ নাই। নিয়াজ মোর্শেদ ভাব জমানোর চেষ্টা করে। ও নাবলু ভাই, এট্টু তাড়াতাড়ি করো। নাবলু হাত চালায়। প্রিন্ট হয়ে গেলে নিয়াজ মোর্শেদ এবার আরেকটি আব্দার করে। এইখানে একটা সই কইরা দেন। আমি কেনে সই করমু নিয়াজ ভাই? বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে নাবলু। ভাই বইলা। একজন সাক্ষী খুইজা পাইতাছি না। দয়া কইরে একটা স্বাক্ষর দেন। ভাই, আমি এইসব ঝামেলার মইধ্যে নাই। প্লিজ, মাফ করেন।

নিয়াজ মোর্শেদ ছাড়বার পাত্র নয়। বাইলবুইল দিয়ে, হাতে পায়ে ধরে শেষমেষ নাবলুকে দিয়ে সইটা করিয়ে নেয় সে। বলে, সাত হাজার টেকা মাটি হইবো নাবলু ভাই, আপনে যদি দয়া না করেন, একজন স্বাক্ষীর অভাবে আমি হাইরা যামু। আপনাকে কোটে যাইতে হইবো না। খালি একটা সই দিয়া দেন। নাবলু ভাবলো, গাও গেরামের মানু, দেই না একটা সাইন। এতে করে যদি দুই পইসা রোজগার করতে পারে নিয়াজ, ত করুক না। নিয়াজ আবার আরেকটা জালও বিছিয়েছে। মামলা জিতলে আপ্নের এক হাজার। এই নেন, সত্যি কইলাম। বলে পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে নিয়াজের হাঁতে গুঁজে দেয়। ধরেন, মামলাটা আমরা জিত্তাই রইছি। এই খালি একটা স্বাক্ষীর অভাবে কাজটা হইতেছিলো না। নাবলু সকাল সকাল পাঁচশো টাকার গরম নোট পেয়ে সইটা করে দেয়।


পরদিন থানা থেকে পুলিশ আসে নাবলুর দোকানে। এ প্রসঙ্গে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে। নাবলু উত্তর দিতে পারে না। সন্দেহভাজন মনে করে পুলিশেরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। থানা থেকে নাবলুর বড় ভাইকে ফোন করে। একটা মিথ্যা স্বাক্ষীর দায়ে আপনার ভাইকে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। দয়া করে আসুন।

নাবলুর ভাই তেলের ডিলার। ইতান কি তার ভালো লাগে? সে গোমরা মুখে দোকান থেকে বেরোয়। শাহাদাৎকে ক্যাশের চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলে। ভাংতি উত্তরের সাইডটাতে আছে। দোকান ছাইরা কোথাও কিন্তু যাবি না।


এক বাজারে দোকান হলেও পুলিশ কখন আসলো, কখন নাবলুকে ধরে নিয়ে গেলো অনেকেই টের পেলো না। বড় বাজার। বড় মানে বড়। মস্ত তার পরিসর। সাতটি গলিজুড়ে শুধু সবজিই উঠে। মাছও উঠে তিনটে গলি ভরে। লোকে লোকারণ্য থাকে প্রতি হাটবারে। ওয়াটবারেও বসে সকালের আড়ং। দুপ্রান্তে দু’জন ভাই দোকানদারি করলেও এ প্রান্তের খবর সহজে ও প্রান্তে পৌঁছে না। তাছাড়া পুলিশ এসে বেশি সময়ও নেয় না। দুয়েকমিনিট আলাপের পরই নাবলুকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। 

থানায় গিয়ে নাবলুর বড় ভাই সবিস্তারে সব জানতে পারে। নাবলু কেঁদে কেটে ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করেছে তাকে মুক্ত করতে। নাবলুর বড় ভাই পুলিশকে সত্যটি বোঝানোর চেষ্টা করে। পুলিশ অত সহজে বোঝে না। বলে, নিয়াজ মোর্শেদকে নিয়া আসেন। সেয় সাক্ষী দিলে নাবলুরে ছাইড়া দিমু।


কিন্তু নিয়াজ মোর্শেদকে পাবে কোথায়? ঘটনার দিন মামলা হেরে গিয়ে আদালত থেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। বাড়ি আসলে চেয়ারম্যানের লোকেরা তাকে চ্যাং-দোলা করে পিটাবে। মেরেও ফেলতে পারে হয়তো। সে ভয়েই সে আত্মগোপন করেছে। অথবা সত্যিই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। লাশটা কোথাও গুম করে রেখেছে চেয়ারম্যানের দুর্বৃত্তরা। 

নিয়াজ মোর্শেদ পেশায় একজন মামলাবাজ। শহরের বেশকিছু উকিলের সাথে তার জানাশোনা। গ্রাম থেকে মামলা নিয়ে গেলে সেও দু’চার পয়সা পায়। এই দিয়েই তার জীবন চলে। মানুষও বিপদে আপদে মামলা-মোকদ্দমা করতে তার দ্বারস্থ হয়। কিন্তু অনেকেই জানে, সে আসলে একটা চীট মানুষ। তবু মানুষ আসে। ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগে আসে পক্ষ বিপক্ষ। নিয়াজ মোর্শেদ দু দলের কাছ থেকেই টাকা খায়। খায়া কারো কাজ করে, আবার কারো কাজে ফেল মেরে গা ঢাকা দেয়। গা ঢাকা দিলে তাকে আর তিন-চার মাস পাওয়া যায় না। লোকে বলে, বডারের ওই পাড়ে তার একটা শ্বশুর বাড়ি আছে। সে মূলত এই পলাতক সময়টা পসইখানেই থাকে। যাহোক, এবার সে ফেঁসে গেছে বড়ভাবে। স্বয়ং চেয়ারম্যানের সাথে গ-গোল। 


মামলা নিয়েছিলো প্রতিবেশী গ্রাম আলমপুরের আলমাস মিয়ার পক্ষ থেকে। মামলার বিবাদী স্বয়ং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান একদিন লোকমারফত নিয়াজকে ডেকে নিয়ে বলেছে, আমার সাথে লাগতে যাইস না নিয়াইজ্জা। কাজটা তাইলে ভালা হইব না। নিয়াজ মোর্শেদ, জ্বি চেয়ারম্যান সাব বলে বের হয়ে আসে। বের হয় তো বের হয়।  ওই বের হওযাই মাত্র। বের হয়ে আর চেয়ারম্যানের কথা মনে থাকে না। আলমপুরের আলমাস মিয়ার কাছ থেকে সত্তুর হাজার টাকা নিয়ে উকিলকে দেয়। এর থেকে সে দু’-চার-পাঁচ হাজার টাকা মেরে দেয়। বুঝলেন তো স্যার, গ্রামের মানুষ টাকা দিতে চায় না। বড়ই কঞ্জুস। উকিল তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। 


মামলাটা জায়গাজমি নিয়ে। দু গ্রামের সীমানার কাছাকাছি বাহাত্তর শতাংশ জমি আলমাস মিয়ার নামে। অথচ ভোগ করে চেয়ারম্যানের আপন ভাতিজা আক্কাস। এই নিয়ে অবশ্য দু’গাঁয়ের মধ্যে প্রায়ই কলহ হয়। কিন্তু চেয়ারম্যানের লোক বলে আলমাস মিয়া পেরে উঠে না। শেষে উপায়ন্তর না দেখে নিয়াজ মোর্শেদের দ্বারস্থ হয়। নিয়াজ মোর্শেদ চেয়ারম্যান গঙের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী দাঁড় করাতে পারে না। আলমাসের আপন খালাতো ভাই শুনানির দিনে আদালত থেকে পালায়। সেই রাগববোয়ালের সাথে যুদ্ধে নাবলু বিনা দোষেই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ে।

নাবলুর বড় ভাই চেয়ারম্যানের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে। কাজ হয় না। এজহারে তো নাম লেখাইছে। সত্য না মিথ্যা বুঝুম ক্যামনে? সইডাও কি নকল করন যায়? নাবলুর বড় ভাই কিরা-কসম কেটে আল্লাহর নামে শপথ করে বলে, নাবলুরে ফাসানো হইছে। চেয়ারম্যানের আধা বিশ্বাস হয়, আধা হয় না। নাবলু তো চোট মানুষ না। ইন্টার পাস করে কম্পুটারের দোকান দিছে। এজহার না পইড়া সেয় এতে স্বাক্ষর দিলো ক্যামনে? বড় ভাই আবারও ছোট ভাইয়ের বেখেয়ালির জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে। চেয়ারম্যান বলে, আইচ্ছা যা। দেখি কী করা যায়। কিন্তু চেয়ারম্যানের মতিগতি বোঝা যায় না। লোকে বলে, হেতের দাঁতে বিষ। কখন কারে ছোবল মারে টের পাওন যায় না। 


নাবলুরে ছাড়াই আনতে নাবলুর ভাই দৌঁড়ের উপর থাকে। এদিকে তার ব্যবসাপাতি দোকান পাট সব পড়ে থাকে। পড়ে কি আর থাকে? পড়ে পড়ে ক্ষয় হতে থাকে। দোকানের যে কর্মচারী ছেলেটা, দু-চার সপ্তাহের ভেতরেই সে লালবাত্তি জ্বালিয়ে পালিয়ে যায়। এদিকে নাবলুর দোকান লুট করে চেয়ারম্যানের ছেলেরা। বড় অসহায় বোধ করে নাবলুর বড় ভাই। এতোকিছুর পরেও যদি ছোট ভাইটাকে ছাড়ায়া আনতে পারতো তও মনকে বুঝনদিতো। কিন্তু কী করবে এখন? ছেচল্লিশ দিন পর দোকান খোলে নিজের দোকানের শূণ্যতা, নিজের ভেতরের কূলহীনতা একাকার করে কাঁদে। টেবিলে মাথা ঠুঁকে। কয়েকটা ড্রামের তলানীতে এখনও কিছু তেল অবশিষ্ট আছে। নাবলুর ভাইয়ের ইচ্ছে হয় দোকানে ও নিজের দেহে আগুন ধরিয়ে দেয়।


সেদিন সন্ধ্যার সময় কেমন যেনো নাবলুর ভাইয়ের শরীরটা খারাপ করতে থাকে। কী এক আশংকায় ভেতরটা দুমরে মুচরে উঠে। কিন্তু না, ফলাফল কোনো অশুভ হয় না। রাত দশটার সময় কাপড়ে মুখ ঢেকে নিয়াজ মোর্শেদ আসে। সাথে আসে ছোটভাই নাবলু। দু’ভাই চোখের জলে গলাগলি করে কান্দে। নিয়াজ মোর্শেদ দু’জনকে থামতে বলে বলে, শুনেন, বিপদে আমি ফালাইছি, আবার বিপদ থাইকা উদ্ধারও করছি আমি। আমারে এতটা খারাপ মানুষ ভাইবেন না।


অন্ধকারে পথ চলতে চলতে নিয়াজ মোর্শেদ একপলক থামে। ভাবে, গ্রাম ছেড়ে যাবার আগে একটা কিছু করে গেলে ভালো হয় না? আবার তো সে গ্রামেই ফিরে আসবে। সুতরাং কোনো একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে গেলে মন্দ হয় না। সে সাপের মতো হিসহিস করতে করতে অন্ধকার রাস্তা এগোয়। মাঠ পেরিয়ে বাজারের কাছাকাছি এসে কয়েক মিনিট অবলোকন করে। না, বাজারের কেউ আর জেগে নেই। প্রহরীটাও নিশ্চয়ই রাইতের তিনটার সময় শীতে মরতে, মশার খাবার হতে বাজারে থাকবে না। সেও নিশ্চয়ই বাড়িতে গিয়ে বৌয়ের ওমে সুখ-ঘুম দিচ্ছে। নিয়াজ মোর্শেদ কাশি দেয়। কোনো প্রতি উত্তর আসে না। আবার সে গলা খাঁকাড়ি দেয়। না, কেউ জেগে নেই। সে চুপি চুপি গিয়ে নাবলুর ভাইয়ের দোকানের তালা ভাঙে। সন্তর্পণে ড্রাম কাত করে তেল ছড়ায় মেঝে ও বেড়ায়। তারপর খস করে দেশলাই কাঠি জ্বেলে ছুড়ে ফেলে।


নাবলুর ভাইয়ের দোকানের সামনের সারি, ও একই ভিটের একই রুখের দোকানগুলো কামার দোকান। আবার তার ফিছের বিপরীত দিকের রুখ করা দোকানগুলো কাপড়ের। সেখানে আক্কাস ও আলমাস মিয়ার দোকানও আছে। জায়গাজমি নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও বাজারের দোকানদারিতে তারা প্রতিবেশী। তবে প্রতিবেশী হলেও একজন কিন্তু আরেকজনের চাক্ষুষ চোকের বিষ। তবু ব্যবসা করতে হয়। আলমাস মিয়ার দোকানটা পুরনো; আক্কাস দিয়েছে নতুন দোকান, এই তিনচার বছর হবে। তবে জমে উঠেছে আক্কাস মিয়ার দোকান। পুঁজিও বিনিয়োগ করেছে প্রচুর। ফলে মাজে মধ্যে বেচাবিক্রির ভীড় পরে গেলে আক্কাস মিয়া দোকানেই থেকে যায়।


ঘটনার দিনও আক্কাস মিয়া দোকানেই ছিলো। সকালে তার দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়া লাশটি সনাক্ত করে লোকজন। পুলিশ আসে। আসে চেয়ারম্যানও। আপন ভাতিজার মৃত্যুতে সে ভেঙে ভেঙে কেঁদে উঠে। আলমাস মিয়াও বিষন্ন মুকে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দোকানও পুড়েছে। চেয়ারম্যান ভাবে, আলমাস মিয়াই কি এই কাম করলো মামলাত হাইরা? না, তা হতে পারে না। মাঠের মাঝখানে বাহাত্তর শতক জমির দাম আর কতো? এর অন্তত তিনগুণ পুঁজি আলমাস মিয়ার দোকানেও তো ছিলো। তবে কি ভাতিজাকে পুড়িয়ে মারার জন্যই এই আত্মক্ষতিটা মেনে নিয়েছে আলমাস? না, তা হতে পারে না। নানা দোলনায় দোল খেতে থাকে চেয়ারম্যানের বিক্ষিপ্ত ভাবনা। এমন সময় পুলিশ কর্মকর্তা এসে জানায়, তারা আগুনের সূত্রপাতটা খুঁজে পেয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নাবলুর বড় ভাইয়ের দোকান থেকে। তেলের দোকান। হ। চেয়ারম্যানের এক কথায় বিশ্বাস হয়। বিশ্বাস হয় তার কারন আছে। নাবলুর ভাই তার দোকানের পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত, দেউলিয়া। সেয় হয়তো মনের দুঃখে এমনটা করতে পারে। আবার ভীড়ের মধ্যে নাবলুকেও দেখতে পায় চেয়ারম্যান সাব। এই ব্যাটা আবার ছুটলো ক্যামনে? তখন তার সন্দেহটা বদ্ধমূলে পরিণত হয়। হ্যা, এই দুই ভাই বজ্জাতই করেছে কাজটা। পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগের দায়ে নাবলু ও তার ভাইকে আবারো পুলিশে ধরে নিয়ে যায়।


পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


আমার কবিতা 

জীবন রাজবংশী


আমার কবিতা সহজ সরল 

নিষ্পাপ সাওতালি মেয়ে-

প্যাঁচ বোঝেনা, বোঝেনা আঁকিবুকি। 

গায়তে জানে, নাচতে জানে, 

প্রকৃতির সনে। 


আদিবাসী পোশাকে, 

আস্ত একটা পুষ্প বাগিচা 

মৌমাছি বন বন ঘোরে চারিপাশে

কখনো খোলা চুল, 

কখনো খোপায় পাহাড়ি ফুল। 


আমার কবিতা 

অগ্রহায়ণে আস্ত হাতে ধান কাটে 

ধরছে করুন সুর, 

আমি তখন চলন্ত পথিক অতি দূর। 

সেই সুর আজও বাজে প্রাণে, 

তবে, বুঝিনি তার মানে। 


সে সুর ছিল বড় অচেনা 

তবে মনে হয়েছিল;

 এক মেঘ কান্না ছিল তার গানে, 

সেই সুর আজও বাজে আমার প্রাণে।



শিরোনামহীন-১

বঙ্কিমকুমার বর্মন 


যুবতি রঙের মেঘ আমাকে ডাকে তাঁর স্বপ্নের খুব কাছে

যেখানে ফুলে ফলে ভরে উঠেছে গাছ


ঠিক তুমি যেন এই আকাশ মেনে উঠে দাঁড়িয়েছে ছাদে

কী এমন বিকেল ভরা ছিল আমাদের শার্টের বোতামে


এখন ক্রমশ ঠা-া হয়ে আসছে সমস্ত সম্পর্কের খেলাঘর, মাঠ 


চাকরি নেই, তাই নিয়েই শুধু মুঠো ভর্তি স্বপ্নের সকাল 

এভাবেই আমাদের হাঁ-হুতাশ পেরিয়ে যাচ্ছে কয়েকটা শরৎকাল ।



ঝরা পাতার কাব্য

রফিকুল নাজিম


বোটাখসা ঝরা পাতার ব্যথা আমার বুকে

উত্তরের বাতাসে নোনা দুঃখ লেগে থাকে

শীতনিদ্রা ভাঙলে গো কে মিঠে রোদ মাখে?

মাকড়সার জাল শিশির বিন্দু সূর্য পুষে রাখে।


বকুলতলায় বকুল ফুলের কান্না লেগে থাকে

সবুজপাতা বকুল ফুলের বিচ্ছেদ বুকে ঢাকে,

বানের ¯্রােতে জলের নাচন ভাঙে নদীর কূল

অঝোর ঘোরে বৃষ্টি জলে ভিজে কাগজ ফুল।


পদ্মবিলের পদ্ম কাঁদে-পাতায় ব্যাঙের নাচন

মেঘে মেঘে বিজলী হাসে-বুকে ব্যথার শ্রাবণ,

জল জোছনায় মরি যদি বকুল ফোটার দিনে

বকুলতলায় ঠাঁই দিও গো; গোপন জন্ম ঋণে।



পরশ্রীকাতর 

সোহেল রানা 


তার আকাশ ছিল

শরতের আকাশের মতোই নির্মল

আলোকোজ্জ্বল, সম্ভবনাময় দীপ।

অবশ্য পরমুহূর্তে ঘটে নি এমন আহামরি কিছুই

যা কিনা সৃষ্টি করে মেঘের ঘনঘটা 


যদিও তা কখনও বলে-কয়ে হয় না 

সুতরাং, যা ঘটবার ঘটেছেও তাই-

মনের অজান্তেই মেঘে মেঘে ঢেকে ফেলেছে সকাশ।




কবিতাশ্রম

হাফিজুর রহমান


আমি চাই- তোমরা ভালো থাকো-

ঘুনে খাওয়া কাঠের তাকে হেলান দিয়ে 

আরাম করো শুয়ে - নিশ্চিন্তে;

পাঠকের দুর্ভিক্ষে মলাটে মোড়ানোয়-

পার করো সময়ের ¯্রােতে স্বস্তির ডিঙি। 


আমি চাই, কেউ না বিরক্ত করুক!

দুমড়ে মুচড়ে না-যাক পাতাগুলো 

ভেঁজা আঙুলের মড়মড়ে আঘাতে।

ভালো হোক সন্ধ্যে- আলোকিত ভোর

শান্তি ঝরুক, রাত-দুপুরের জ্যোৎস্নায়।


ভালো থেকো কবিতা, বিশ্ব-প্রযুক্তির গল্পে -

ঘুনে খাওয়া কাঠের তাকে হেলান দিয়ে।



দু’টি কবিতা

রাফাতুল আরাফাত 



প্রতিদ্বন্দ্বী


পুরো পৃথিবীটা একটা কবিতার ভেতর ভরে ফেলেছি

ম্যাচবাক্সে যেমন করে কাঠিগুলো থাকে


নিজের কানের কাছে গুনগুন করি ঘুমপাড়ানি গান

যারা হেরে বসে আছে অসম কোনো খেলায়

যে খেলায় কেউ কোনোদিন জিতে না। 


পরাজিত হতে হতে আমি নিজেকে একমাত্র নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলছি। 



পরিযায়ী পাখি


বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে

তোমার চুলকে পাখির বাসা মনে হয়

আর হাতকে সাইবেরিয়া। 


আমি পরিযায়ী পাখি হয়ে

চলে যাবো দূর উষ্ণ দেশে

আর ফেরার সময় কোনো পাহাড় থেকে 

লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবো।


তার আগে কেঁটে ফেলবো ডানাগুলো

তোমার নরম গন্ধে।


পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
 


বদলেছে মানুষ মানুষের মুখ

মুহিব্বুল্লাহ ফুয়াদ 


ভাঙা সাঁকোটা আর নেই

এখানে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে ইঁট, বালু, সিমেন্ট থেকে জন্ম নেয়া ছোট্ট একটি পুল

ডাকঘর তো সেই কবেই ইন্তেকাল করেছে

পুরোনো কাগজে ভরা ডাকবক্সে ধরেছে ঝঙ

গড়ে উঠেছে জোয়ার আসর

লতাপাতায় ভরে উঠেছে ময়দান 

এখানকার ঘরবাড়িগুলোরও ঘটেছে আমূল-পরিবর্তন 

বদলেছে মানুষ মানুষের মুখ, গাঁয়ের রঙ, পৃথিবীর রূপ

কত চেনা হয়ে গেছে অচেনা!

কতো স্মৃতি নতুনের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে সবুজ


আমিও তো বদলেছি টোল পড়েছে গালে

চেহারাটাও আগের মতো নেই

চিরুনি করা নিকশকালো চুলগুলো দোল খায় না হালকা সমীরণে

যেন উসকো-খুসকো মরুভূমির প্যাঁচানো লতাপাতা


চেয়ে থাকে না কেউ চোখ ধাঁধানো টি-শার্টে দিকে

মুগ্ধ হয় না কেউ....


এমনকি 

মনমাতানো পারফিউমের ঘ্রাণ’ও এখন ফিকে হয়ে গেছে 

হাওয়ায় শুকিয়ে গেছে সব ঘ্রাণ 

পড়ে আছে শুকনো পাতার মতন খালি শিশি


বয়সের ভারে সবই বদলেছে

তবে, 

বদলায় নি শুধু আমার মন 

প্রেম ভালোবাসা।




প্রিয়ার মতো শরতের আকাশ

মুহাম্মদ ইমদাদ হোসেন


শরতের নীলাকাশ আজ নীলাভ নেই ঝুমঝুম বৃষ্টি ঝরছে অঝর ধারায়

এযেনো বর্ষার মুষলধারে অবিরাম বর্ষণ,

আজকাল ঋতুরাও রূপ বদলায় যখন তখন ঠিক যেনো আমার প্রিয়ার মতন।

নদীর দু’কুলে শুভ্র সুকোমল কাশফুল

আজ আর দোল খাচ্ছে না বাতাসে,

সন্ধ্যার আকাশটি রঙধনুর আবীরে সপ্ত রঙে শোভিত হয়নি আজ, 

যেনো অভিমান করেছে ঠিক আমার প্রিয়তমার মতো।

দিনের গগণে সুর্যেকিরণ যায়নি দেখা রাতের আকাশে জ্যোৎস্না 

কিংবা তারার মেলা বসেনি আজ যেনো গোসসা করেছে সবাই ঠিক আমার প্রেয়সীর মতো।

শরতের আবহাওয়া আর আমার শ্রেয়সীর মাঝে কোনো তফাত নেই আজ।




ভাঙারির দোকান

আসহাবে কাহাফ


লালনের আখড়ায় অবিরাম বাজে দেহতত্ত্বের গান

গানের তালে সাজাই কাগজ  পুরাতন লোহা প্লাস্টিক

কিছুটা দূরে যতœ করে রাখি ছোটো-বড়ো কাচের বোতল

তার পাশে তামার তার- থরে থরে সাজানো অন্যান্য জিনিসপত্র

প্রতিদিন ফেরিওয়ালা আসে-যায়, বাড়তে থাকে মালের সারি

কমতে থাকে চলাফেরার জায়গা - এ আমরই ভাঙারির দোকান।




দেহপাঠ

আশরাফ চঞ্চল


তোমাকে পাঠ করি প্রতিনিয়ত

পাঠ করি স্তন

নিতম্ব

নাভি। 

তোমাকে পাঠ করি প্রতিনিয়ত

পাঠ করি গ্রীবা

কপোল

চুল।

তোমাকে পাঠ করি প্রতিনিয়ত

পাঠ করি ঠোঁট

দেহের উপত্যকা

উরুভাজের অনিন্দ্য সুন্দর!




সুহাসিনী  

রজব বকশী 


হাঁটছি একা 

হাওয়ায় বেজে ওঠে রিনিঝিনি সুর 

নরম রোদ্দুরে সুহাসিনী 

তার মায়াবী দুচোখ ভাসমান দূরের নৌকা 


মেঠোপথে ধান শালিকের গান

কত গল্প কথায় জেগে উঠি

ফড়িঙের পিছে ওড়ে মন 

উঁকি দেয় দুরন্ত কৈশোর 

পাখির বাসায়

রঙিন ঘুড়ির ডিগবাজিতে 

ধূলি¯্রােতে লিখি হীরামতি পদাবলি 

আঁকি শস্যক্ষেত

            ছোট নদী

গ্রাম গ্রামান্তর

            রূপকথার রাত 

দেখি ঘাসের ডগায় সমুদ্র নোঙর করে

ডাকে বিপন্ন সবুজ টের পাই 

আজ শূন্যের বাগানে দীর্ঘশ্বাস হয়ে উড়ে লুপ্ত মেঠোগান



অসমাপ্ত যৌবন

স্বপন গায়েন


দীর্ঘশ্বাসের ভিতর লুকিয়ে আছে অলীক স্বপ্ন

অসমাপ্ত যৌবনে এসেও থমকে গেছে জীবনের পথ

কাশফুল নিয়ে ওদের মাথাব্যথা নেই।


দারিদ্র্যের ঘূর্ণাবর্ত জীবন তছনছ

নীল আকাশের নীচে অমাবস্যার কালো ছায়া

ভোরের আলোর মাধুর্য ওরা অনুভব করতে পারে না।


শারদীয়া উৎসব আসবে যাবে তবুও...

ভোরের শিশির ভিজিয়ে দেয় হৃদয়ের হ্রদ

দারিদ্র্যের ভাষা অলিখিত থাক গোপন বন্দরে।


ঘুণপোকা কুরে কুরে খায় হাড় মজ্জা অস্থি

সারাটা জীবন লুকোচুরি খেলতে খেলতে কাটিয়ে দেয় শরীরের মধ্যে

অন্ধকারের কাব্যে পা-ুলিপির ছেঁড়া পাতাগুলো আজও বড়ই বিবর্ণ।


স্বপ্ন নষ্ট করে দিলো...

স্বপ্ন নষ্ট করে দিলো...

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


স্বপ্ন নষ্ট করে দিলো...

সাহেদ বিপ্লব


সাত আট বছরের বালক আবিদ। দুই তিন মাস হলো বাবা মা মারা গেছে এক সড়ক দূর্ঘটনায়। এখন আপন বলে বড় ভাই ছাড়া কেউ নেই পৃথিবীতে।

তাই বড় ভাইয়ের কাছে থাকা। বড় ভাই খুব আদর করে। বলা চলে বড় ভাইয়ের জানের জান আবিদ। ছোট ভাই ছাড়া কিছু বোঝে না কিন্তু এই ভাবে তো চলে না মা বাবা এখন নেই। 

ছোট ভাইকে দেখাশুনা করার জন্য একজন মানুষের দরকার। তাই বড় ভাই একদিন বিয়ে করে ভাবি নিয়ে এলো।

ভাবির হাতে আবিদকে তুলে দিলে বলল, আজ থেকে তুমি বাবা তুমি মা। আমার ছোট ভাইয়ের কেউ নেই তুমি আর আমি ছাড়া।

নতুন বৌ হয়ে আসা মিতালি কিছুই বলল না।

আবিদকে মেনে নিতে পারলো না মিতালি কিন্তু আবিদ ভাবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাই আর তুমি ছাড়া আমার পৃথিবীতে কে আছে ?

মিতালি ভাইকে দেখানোর জন্য মাথায় হাত দিলো কিন্তু মনে মনে অনেক রাগ। একা থাকবো একা খাবো এটা আবার কি উৎপাত। একদিন এই বাড়ি থেকে উৎপাত না তাড়ায় তাহলে আমার নাম মিতালি না।

দুই চার দিন মিতালি কিছু বললো না আবিদকে চোখে চোখে রাখলো, ভাবলো এতো তাড়াতাড়ি কিছু বলা যাবে না। বলতে গেলেই ঝামেলা হতে পারে। তার চেয়ে কিছু দিন দেখে নেই, তারপর দেখবো কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।

বড় ভাই সকাল হলেই মাঠে চলে যায়। বাবা বেশ জমিজমা রেখে গেছেন। এই সব দেখতে হয় তাকে।

আবিদ সকালে স্কুলে চলে যায় ফেরে বিকালে। এসেই ভাবীকে জড়িয়ে ধরে বলে আমাকে খেতে দেও, আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। মা প্রতিদিন স্কুলে টিফিন দিয়ে দিতো। তুমি ব্যস্ত থাকার জন্য দিতে পারো নাই।

তোমার মা যা করেছে আমাকে তাই করতে হবে নাকি ?

আবিদ একটু হাসি দিয়ে বলে কেন করবে না, তুমি তো আমার মায়ের মত।

মায়ের মত কিন্তু মা তো না।

মা হয়ে গেলেই তো হয়।

তোমার মার হতে আমার বয়েই গেছে বলে একটু মুখ বাঁকা করে রাগতে রাগতে চলে গেলো ঘরে ভেতর।

আবিদ অবাক হয়ে ভাবীর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ভাবী ঘরের ভেতর গিয়ে বসলো আর বাহিরে আসলো না।

আবিদ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে এসে বসে রইলো আর ভাবলো মা থাকলে এমন হতো না। স্কুল থেকে ফিরতেই মা পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আসতেই বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিতো এটা  সেটা খেতে দিতো কিন্তু কি হলো এসব এমন তো হবার কথা ছিলো না। মনে করেছিলাম ভাবী এসে মায়ের অভাব পুরণ করে দিবে বলেই একটা দীঘঃশ্বাস ছাড়লো।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ভাবীর রুমে গিয়ে বলে আমার ক্ষুধা লেগেছে, খেতে দাও।

তোমরা দুইটি ভাই আমাকে কি পেয়েছো সব কিছু আমার কাছে চাও। আমি তোমাদের বাড়ির কাজের মানুষ নাকি পানিটাও পর্যন্ত মুখে তুলে দিতে হবে।

আমি কি তাই বলেছি। আমি তো খাবার চেয়েছি।

যাও টেবিলে খাবার রাখা আছে।

আবিদ টেবিলে গিয়ে দেখে একটি রুটি রাখা। এটা খেলে আমার কিছুই হবে না। গিয়ে শুনি আর কোথাও খাবার আছে কি না।

ভাবীর কাছে এসে বলল একটা রুটি, এটা খেলে আমার তো কিছুই হবে না। অন্য কোথাও খাবার রাখা আছে কি ?

আমি খাবার পাবো কোথায় ? যা ছিলো তাই রেখেছি। একজন তো মাঠে কাজ করতে করতে শেষ তুমি তো সাহেব হয়েছো। স্কুলে যাও আর আসো এতো খাই খাই করো কেন বলেই রাগতে রাগতে উঠে গেলো। আবিদ কি বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খাবার রুমের দিকে পা বাড়িয়ে দিলো। কি আর করা ক্ষুধা যখন লেগেছে এখন এটা না খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। রুটি খেয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে বসে রইলো।

খাবার রুমে এসে ভাবী বলল, এই ভাবে বসে থাকলে চলবে ? বাড়িতে কত কাজ আমি একা করতে পারি না। এই নে সাবান কাপড়গুলো ধুয়ে নিয়ে আয়।

আমি তো পারি না।

পারি না বললেই হবে, আমি কি একা একা কাজ করতে করতে মরবো তোদের বাড়িতে আর তুই বসে বসে খাবি।

এমন ভাবে কথা বলছো কেন ভাবী।

কীভাবে বললে তুমি খুশি হবে! আমার আর কোন কাজ নেই তোমাদের দুই ভাইকে খুশি রাখতে আমি মরি তাই তোমরা চাও।

এমন কথা বলছো কেন।

আমি তোর সাথে কথা বলতে চাই না কাপড়গুলো ধুয়ে নিয়ে আয় আমি রান্না করতে গেলাম বলেই রাগতে রাগতে রুম থেকে বের হয়ে অন্য রুমে চলে গেলো মিতালি।

আবিদ বসে বসে কাঁদতে লাগলো আর মনে মনে বলতে লাগলো মা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। আমি এমন জীবন চাই না। তুমি পৃথিবীতে চলে যাওয়ার পর আমার কপালে সুখ চলে গেছে। ভাই বিয়ে করে ভাবীকে নিয়ে এসে আমাকে সুখ দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তা আর হলো না।

মিতালি রুম থেকে বের হয়ে হাসলো আর মনে মনে বললো এমন কষ্ট দেবো তোকে একদিন এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবি।

রাতে ভাই বাড়িতে আসতেই বলে আমি তোমার বাড়িতে থাকতে পারবো না।

কেন কি হয়েছে, এই বাড়ি তোমার কি এমন ক্ষতি করলো।

তুমি তো সকালে বাড়ি থেকে চলে যাও আর ফেরো রাতে কিন্তু এই বাড়িতে কি হয় একবার জানতে চেয়েছো?

কি জানবো, কি হয়েছে?

তোমার ভাই আমার কোন কথা শুনতে চায় না। কিছু বললেই রেগে যায়।

ছোট মানুষ তো এতো কিছু বোঝে নাকি।

খাবার তো ঠিকি বোঝে এতোগুলো ভাত দিলাম একাই খেয়ে ফেললো আমার জন্য একমুঠ রাখলো না।

মিতালির কথা শুনে আবিদের ভাই হাসলো।

তুমি হাসছো আমি সারাদিন না খেয়ে রয়েছি।

না খাওয়ার কি আছে চাউল তো ঘরে আছে, এক কেজিতে না হলে তিন কেজি দেবে। তাহলেই তো হয়ে গেলো।

এই ভাবে খেয়ে খেয়ে পথের ভিখিরি হবো নাকি, আমার ছেলেমেয়েরা এসে কি খাবে।

সে চিন্তা আল্লাহ করবে।

তুমি তোমার চিন্তা নিয়ে থাকো বলেই রাগতে রাগতে চলে গেলো।

এ আবার কেমন বিপদ হলো ছোট একটা ভাই আমার তাকে নিয়ে কত অভিযোগ।

এই দেখ তোমার ভাই কি করেছে বলেই বেশ কিছু কাপড় তার সামনে তুলে ধরলো।

কি হয়েছে।

তুমি দেখছো না কি হয়েছে। তোমার ভাইকে দিয়েছিলাম ধুতে, আমি রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম একটু সাবার দিয়ে রাখ আমি পরে ধুয়ে নিয়ে আসবো কিন্তু দেখ সবগুলো কাপড় ছিড়ে ফেলেছে।

তুমি আবিদকে এটা দিতে গেলে কেন ? ওকি এই সব পারে নাকি।

এ পারে না ও পারে না সব কিছু আমি পারি।

বড় ভাইয়ের একটু রাগ হলো আবিদের প্রতি তাই জোরে জোরে ডাকতে লাগলো।

আবিদ ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ভাইয়া আমাকে ডেকেছেন।

এই কাপড়গুলো দিয়েছিলো ধুতে কিন্তু এই ভাবে ছিড়ে ফেলেছিস কেন ?

আবিদ অবাক হয়ে গেলো তারপর বলল, আমি তো ছিড়িনি।

মুখের উপর কথা। ছিড়ে বলছিস ছিড়িনি।

না ভাইয়া কোথাও আপনার ভুল হচ্ছে।

ভুল আমার হচ্ছে না, তোর বলেই মুখে এতো জোড়ে থাপ্পর দিলো।

আবিদ মাটিতে গিয়ে পড়লো।

মিতালি মনে মনে হাসলো এমনটাই চেয়েছিলাম। একদিন এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সুখে থাকবো, শান্তিতে থাকবো। আমার সুখ ঠেকায় কে।

আর কোনদিন এমন করলে তোর কপালে কি যে হবে। আর কিছু না বলে মিতালিকে নিয়ে ঘরে গেলো।

আবিদ কাঁদতে লাগলো কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলো না। কি আর বলবে। বলার মত কিছু নেই।

অনেকক্ষণ কেঁদে রুমে ফিরে এলো। রাতে এক বারও খবর নিলো ভাই এমন কি ভাবী মিতালি। খাবারের জন্য ডাক এলো না। আবিদ ইচ্ছা করে ডাকও দিলো না খাবারের জন্য। অনেক কাঁদলো এক সময় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরল।

ঘুম ভাঙলো মিতালির ডাকে এই যে সাহেবের বেটা এতো বেলা করে ঘুমালে চলবে। উঠতে হবে না।

ডাক শুনে উঠে দাঁড়ালো।

অনেক হয়েছে এবার আমার সাথে কাজ করতে হবে।

আমার স্কুল আছে।

আমার পুরা কপাল তোমার ভাই মাঠে যাবে তুমি স্কুলে যাবে আমি চাকরের মত কাজ করে তোমাদের খাওয়াবো। আজ অনেকগুলো কাজের মানুষ নিয়েছে, তাদের খাবার দিতে হবে।

আমি কাজ করতে পারবো না। 

কেন পারবি না, তুই পারবি তোমার বাপ পারবে।

বাবার কথা শুনে আবিদ রেগে গিয়ে বলল, আমার বাবার কথা বলবে না।

বললে কি হবে।

ভালো হবে না তোমার।

আমার ভালো হবে না, না তোর ভালো হবে না বলেই একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো মিতালি আবিদের মুখে।

আবিদ ভাবতে পারেনি ভাবী এমন ভাবে মুখে থাপ্পর বসিয়ে দিতে পারে।

আমাকে মারলে ?

মারার কি হলো, এখন থেকে শুরু, তোর ভাই এলে তাকে দিয়ে আবার মার খাওয়াবো।

আবিদ কি বলবে বুঝতে পারছে না। কাঁদতে লাগলো।

মায়া কাঁন্না দেখিয়ে লাভ হবে না। আজ থেকে আমার কথার এদিক সেদিক হলেই কি পরিমান মার হবে, বলেই মিতালি থেমে গেলো।

আবিদ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কি ঘটে যাচ্ছে তার সাথে কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিলোনা।

গেলি না পানি আনতে। দাঁড়িয়ে থাকলে আবার মারবো কিন্তু।

আবিদ মার খাবার ভয়ে পানি আনতে গেলো চোখ মুছতে মুছতে। কিছুক্ষণ পর পানি নিয়ে ফিরে এলো।

এই ভাবে কথা শুনবি। না শুনলে তোর খবর আছে।

আবিদ কিছু বললো না।

দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? এই ভাবে দাঁড়িয়ে আমার চেহারা দেখলে চলবে না। লবণ নিয়ে আয় ঘর থেকে।

আবিদ কিছু না বলে মিতালির কথা মত লবণ আনতে চলে গেলো। আগের মত লবণ নিয়ে ফিরে এলো।

বয় এখানে।

আবিদ বসলো।

পিয়াজগুলো খোসা ছাড়িয়ে দে।

আমি পিয়াজের খোসা ছাড়াতে পারি না, চোখ দিয়ে পানি আসে।

চোখ দিয়ে পানি আসে তাই না বলেই এতো জরে থাপ্পর বসিয়ে দিলো।

আবিদ মাটিতে পড়ে গেলো তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে মারলে কেন ?

আগেই বলেছিলাম আমার কথা না শুনলে কি হয় তোর কপালে। এখন বুঝেছিস।

আবিদ কাঁন্না করতে লাগলো।

মায়া কাঁন্না করে লাভ হবে না। এই বাড়িতে থাকলে হলে কাজ করে থাকতে হবে।

আবিদ কাঁদছে আর পিয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছে। পিয়াজের খোসা ছাড়ানো হয়ে গেলে বলে রসুনগুলো খোসা ছাড়িয়ে দে। তারপর মরিচের  বোটাগুলো ফেলবি, কথাটা মনে থাকে যেনো।

আবিদ কিছু বললো না কাঁদছে আর পিয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছে।    

মিতালি ডাক দিলো আবিদ...।

আবিদ উত্তর দিলো না, কেননা মিতালির উপর তার খুব রাগ।

আমার কথা তোর কানে যায় না বলেই কান ধরে উপরে তুলে ধরে এতো জোড়ে আবার কিল বসিয়ে দিলো পিঠের উপর।

ওরে মারে বলে এক চিৎকার দিলো আবিদ।

আমি বলেছি না আমার কথা না শুনলে কি হয় তোর কপালে। যা পানি নিয়ে আয় কলপাড় থেকে।

আবিদ কাঁদতে কাঁদতে কলপাড় থেকে পানি নিয়ে এলো।

রাতে মন মরা হয়ে শুয়ে আছে মিতালি

আবির বেশ কিছুবার নাম ধরে ডাক দিলো কিন্তু উত্তর পেলো না।

আবার ডাক দিলো কিন্তু তখনো উত্তর পেলো না। তারপর কাছে গিয়ে বলল, কি হলো আমার কথা কি তুমি শুনতে পারছো না এই বলে যখন হাত ধরে টান দিলে তখন দেখলো কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে মিতালি।

কি হলো তোমার?

মিতালি তখনো কিছু বলল না, মিতালি জানে এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথা না বললে পুরুষ মানুষের রাগ বেড়ে যায়। যখন রাগ হতে হতে একশো থেকে দুইশো হলেই বললে কাজ হবে।

কথা বলছো না কেন, এমন কি হলো যে কথা বলা যাবে না। আমি দিন রাত খেটে মরি আর তুমি আমার সাথে রাগ করে থাকবে।

মিতালি আবিরের বুকের উপর পড়ে এমন করে শব্দ করে কেঁদে দিলো।

আবির মিতালির কাঁন্না দেখে মনে করেছিলো মা অথবা বাবা মারা গেছে।

এমন ভাবে কাঁন্না করলে আমি থাকতে পারবো ? সবার মা বাবা চিরদিন বেঁচে থাকে না। সবাইকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে।

এই কথা শুনে মিতালি আরও রেগে যায়।

আমি কি রাগের কথা বলেছি।

তুমি কিছু না শুনে কথা বলতে যাও কেন ? আমার মা বাবা কেউ মারা যায়নি।

আল্লাহ বাঁচালো এই রাতের বেলায় যেতে হলো না।

তোমার সাথে আমার আর কোন কথা নেই বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো মিতালি।

আবির হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল, কি হয়েছে একবার না বললে আমি বুঝবো কীভাবে।

কাঁন্না ভরা কন্ঠে বলে তোমার কষ্ট দেখে আমার ভালো লাগে না। সারাদিন তুমি মাঠে খাটো আর তোমার ভাই লেখাপড়ার নাম করে স্কুল ফাঁকি দিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়।

ঠিক আছে এতে কাঁন্নার কি হলো। আমি কাল স্কুল গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলবো।

মিতালি মনে মনে বলল, আমি যে ভাবে বোঝাতে চাই সেটা বুঝতে পারছে না তাই বলে আমি তোমাকে বুঝাতে পারছি না।

বুঝিয়ে বলো।

তোমার ভাই লেখাপড়ায় তেমন ভালো না। এই ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে তেমন ফল হবে না। তুমি কাল থেকে মাঠে নিয়ে যেতে পারো।

আবির বলল কি বল বুঝতে পারছে না। তারপর বলল, দেখি কি করা যায়।

তুমি সারাদিন মাঠে কাজ করো আবিদ যদি খাবার নিয়ে যায়, তাও তো তোমার উপকার হলো।

তুমি ভালোই বলেছো।

মিতালি হেসে দিলো এতোক্ষণে বুঝেছো বলতে বলতে বুকের উপর গড়িয়ে পড়লো হাসতে হাসতে।

সকালে মাঠে যাওয়ার সময় বড় ভাই আবিদকে মাঠে নিয়ে গেলো। এখন থেকে আবিদের কাজ হলো বাড়ি থেকে খাবার আনা কাজের লোকদের পানি খাওয়ানো। এটা সেটা এগিয়ে দেওয়া।

লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলেও অন্য দিক দিয়ে খুশি ভাবীর হাত থেকে বেঁচে গেলাম।

ভাবীর কথা মত একটা গরু কিনে নিয়ে এলো। এই গরু দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হলো আবিদকে। এখন গরুর ঘাসকাঁটা এই সব নিয়ে থাকতে হয়।

মিতালি এখন মনে মনে খুশি আবিদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিলাম আর কিছুদিন যাক তারপর অন্য ব্যবস্থা করবো।

আবিদের সারাদিন মাঠে থাকতে হয় গরু দেখা, মাঠে খাবার দিয়ে যাওয়া। বাড়িতে ভাবীর বকুনি মাঝে মাঝে পিটের উপর মার। আবিদ ভাবতে লাগলো সে কোন পথে হাঁটবে। একদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো সে আর কোনদিন এই বাড়িতে আসবে না। কোথায় যাবে তার কোন ঠিকানা জানা নেই। আবিদ এখন পথে পথে ঘুরে বেড়ায় কোন ঠিকানায় ঠায় হবে তার সে জানে না।