ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ৯৮

 ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ৯৮
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ৯৮
  বৃহস্পতিবার ।। ১৫ নভেম্বর ।। ২০১৮





















হেমন্তে লেখা পদাবলি-১

হেমন্তে লেখা পদাবলি-১



হেম এখন গ্রহপথে লিখিয়েছে নাম
উদয় শংকর দুর্জয়

বনপত্রালীর হলুদ ছায়া হেমকালের স্তুপাকৃত শিশিরকে ভুলতে বসেছে, বেখায়ালি অনাদরে। ও ঠোঁটের হ্রদে পিং স্ট্রবেরি জানিয়ে দিত পেট্রোলিয়াম জেলির অপ্রতুলতা। আবেদনের সবক’টি গ্রহচ্যুত তারকা বিবর্ণতা মেখে আরেকটি আকাশ টানিয়ে দিত মাথার উপর।

এখন আবিরহীন হেমাংগিনী ভোর চৌকাঠের অদূরে, যেখানে শিশিরকণা পুড়ে যাচ্ছে, যেখানে জোনাকি-পাহাড় পাহারা দিত, সেখানে পাথর বাকল ঝরে পড়ে আছে।

সংগিহীন লোকসমুদ্র মনে রাখে না, কি রেখে গিয়েছিল বিগত ঢেউ। কোন ঊষা ভেঙে কোন জলাশয়ে দাঁড়িয়ে গ্যাছে স্কাইস্ক্রাপার, তার খবর শুধু যে মেঘপারাবত জানে।

কাল এখন অকালের নামে লিখিয়েছে অদৃষ্ট, এক গৃহ মন্দিরের নৈবেদ্য রেখে খাবলে নিয়েছে বেলান্তের ধুলোভস্ম। একটি হেমকালের জন্য একটি আলোকবর্ষ, অপেক্ষার গ্রীলে ঠেকিয়ে রাখুক আঙ্গুল।


নোনাজল
নুশরাত রুমু

হেমন্তের আকাশ নিয়ে নামলো অমাবস্যার রাত,
এলোমেলো হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে কান্না হতে চায় সহযাত্রী।
ঝিঁ-ঝির ডাকে মিলিয়ে যায় বেসুরো গলার গান।
শিমুল তুলোর মত উড়ে যায় অন্তরীণ স্বপ্নগুলো।
জীবনের না পাওয়াগুলো পাল তুলে এগিয়ে আসে
মনের সমুদ্রপথে..
ঝুল বারান্দার শক্ত মুঠিতে সুপ্ত বাসনারা গুমরে কাঁদে।
জোনাকির ক্ষীণ আলোয় হাহাকার মুচড়ে ওঠে।
হারিয়ে গেছে হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া এক মুঠো খুশি।
চুপিচুপি মন বারান্দায় যে এসেছিল শীতের রোদ্দুর হয়ে,
যেখানে দাঁড়িয়ে ক্লান্তির সীমানা পার হওয়া যেত,
সে কখন নোনাজলের ঢেউয়ে মিশে গেলো- টের পাইনি !

ভুল ফাগুন
ফখরুল হাসান

বিরহের পারমাণবিক বোমায়,
হিরোশিমার মতো বিধ্বস্ত,
জীবন মানচিত্রের
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু
দুরারোগ্যে ব্যাধিতে আক্রান্ত
জীবন দেয়ালের প্রতিটি ইট।
ভুল ফাগুনে কৃষ্ণচূঁড়ার রঙ হয়
একাত্তরের বুলেটের অদ্ভুত শব্দ...

হেমন্ত আজ নিঃস্ব
আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

হিম কুয়াশার পালকি চড়ে হেমন্ত ফের এলো
কিন্তু একি হেমন্ত কই? সব যে এলোমেলো।
কার্তিক যে  যাওয়ার পথে ব্যস্ততা কই চাষির
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে স্বপ্ন রেখা হাসির।
কোথায় আমন ধানের ঘ্রাণে প্রাণকাড়া সেই দৃশ্য
রূপ হারিয়ে সুমঙ্গলা হেমন্ত আজ নিঃস্ব।
হেমন্ত আজ বইয়ের পাতায়, সমাজ খাতায় মেকি
তাই তো এখন নবান্ন গান গায় না পাড়ায় ঢেঁকি।
ঢেঁকি এখন জাদুঘরে রোদন করে রোজ
প্রযুক্তির এই জোয়ার নদে কে রাখে তার খোঁজ?




হৈমন্তিক মাঠ
অচিন্ত্য রায়

আমার বুকেতে যে ক্ষত এঁকেছো
তাঁর নাম দিও হেমন্তের মাঠ
শানিত কাস্তের বাঁকে সূর্য ডুবে ,
উঠুক চাঁদ

কাটা ধানের একঘর মৃত্যুর মতো
যন্ত্রণাময়, শিশির আমার হোক
কেঁচমাটি মাখা কুর্চি শামুকের বাঁশিতে
বাজুক শৈশব

অতঃপর ধানের জাঙ্গি-পালুই-মড়াই
সমস্বরে বলুক আমরা কৃষকদের
তিরকি চড়ুই, বিষণœ শামুকখোল,
খিদের উপন্যাস তৈরী করতে থাক

লিকের ধুলো মগ্নতায়, একচামচ ঘাম ও রক্তে




ভাঁটফুল
নাসির ফরহাদ

ভাঁটফুল কেমন আছো ?
কথা হয় না বহুবছর!
আমায় কি ভুলে গেলে!
ভুলিনি তোমায়,
তোমার রাঙা যৌবনে আমায়
উদাস করে।
শীতল করে প্রাণ-
আমি তোমার কাছেই ছিলাম
একযুগ আগে!
ছেলে বেলায় খেলতে গিয়ে তোমায়
কতোবার স্পর্শ  করেছি! বাঁধা দাওনি।
ভাঁটফুল এখন তোমায়
সময় দিতে পারিনা।
তবু আমায় ঘৃণা করো না!
ঐ যে তোমার মাঝে কালো কুচকুচে
দ্বীপ্তমান বীজ হয়ে রয়েছি।
বন্দী আছি-
তোমার সাবলীল যুগলে;
বুঝে নিও তুমি বুঝে নিও।



হৈমন্তিক
কৌশিক চক্রবর্ত্তী

নাছোড় ভাস্কর্য যত
ফিরিয়েছো শহরের বুকে
কে বলে পাঁজরহীন
কে বলে আহত নিশী তার

সময়ের আবডালে
কখনো সুবাস আসে
কখনো দরজা ঠেলে
হিসাব মেলেনি সত্ত্বার

এখন জমিয়ে রাখো
নিয়মে ঝলসানো চিঠি
ঝরে গেলে বিষাদ স্মারক

গাছেতে জেগেছে কোষ
হেমন্ত নির্ঘোষ
যেকোনো উচ্ছ্বাস থেকে
জন্মায় বার্তাবাহক-

মাটিরা স্বাধীন নয়
হৈমন্তিক রীতি
স্বাধীনতা অক্ষরের কোল

সেসব প্রকাশকালে
হেমন্ত দর্পন
নাছোড় প্রতিফলনে
ঢেকে নাও বিপন্ন আঁচল।

হেমন্তে
ইয়াসির আরাফাত

একদিন সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে
আবার ফিরে যাব গ্রামে
আম কাঁঠাল অশ্বথের বনে বনে
ধানের মাতাল গন্ধে খুঁজে নেব নষ্টালজিক বিকেল;
বাবার হাত ধরে  হেঁটে যাওয়া সোনাধান জমি
                                   কাদামাটি ঘ্রাণ,
চোখের কোণে উড়ে যাওয়া বক
কি করে হারায় দিগন্তে লালে

আবার একদিন হেমন্তে
ফিরে যাব গ্রামে কাঁচা ধানে খুঁজে নেব
মায়ের গায়ের ঘ্রাণ-বাবার হাসিতে
আমার শৈশব সত্তার উপাদান।

হেমন্তের প্রত্যাবর্তন
মিশকাত উজ্জ্বল 

এই হেমন্তে নববিবাহিত দম্পতিদের মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
গ্রহণ করেনি ফসলী জমিগুলো।
মৃত্তিকার সফল প্রজননে ব্যাপক গর্ভবতী হয়ে উঠবে ধানগাছ-
ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী কৃষকগণ প্রস্তুত থাকবে দড়ি কাস্তে সমেত।

ধান কাটা সারা হলে মঙ্গাক্রান্তরা মেতে উঠবে ঈদোত্তর মহোৎসবে
সেমাই পোলাও, নতুন জামা খোয়াবোপম;
অন্ন নিংড়ানো জল এবং লজ্জাচ্ছদটুকু জোটেনি যাদের গত ঈদে
তাদের মুখে উঠবে নবান্ন-ব্যঞ্জন, পরিধেয়।
গ্রাম্যবধূ ও বালিকারা- যারা শহরে গিয়েছিল কাজের খোঁজে-
স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করবে পাক-সাফ হয়ে।

সুন্নতি আলখাল্লা পরিহিতরা দুধের মাছির মতো ছড়িয়ে পড়বে;
আবার যথারীতি গ্রাম-গঞ্জে; ওয়াজ-নসিহতে।




শব্দ কুড়ানো
হাফেজ আহমেদ রাশেদ

আজ দিগন্তে গোধূলি শেষে
সবুজ সমারোহে হারিয়ে ছিলাম,
শব্দ কুড়ানোর শখে।
মনে হল সব
হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাসরোদ্ধ আবেশে,
এক পেয়ালা শব্দ কুড়ে ফিরলাম অবশেষে।

প্রকম্পিত কাঁচা হাত শব্দ প্রয়োগে,
শব্দের গাঁথুনিতে ছন্দপতন,
তবুও যদি এলোমেলো নির্মাণে,
শব্দের ঝংকারে রূপ নেয় কাব্যরত-
পরিতৃপ্ত হবে মনন।
যে কবিতা বলবে সজীবতার কথা,
জীবন্ত মাঠ ও মাটির লুকায়িত বেদনা,
স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফুটাবে শ্যামলের হাসি।
যে কবিতা কৃষকের গ্লানি,
আনন্দ বেদনার প্রতিচ্ছবি,
গৌরবান্বিত বাংলা মায়ের
সবুজ আঁচলে ঝলমলে প্রতিমা,
দূরদূরান্তের রংতুলি এঁকে দেয়
এক এক শব্দের প্রয়োগে।
তবে আমি সার্থক,
সার্থক আমার দিগন্তে সমারোহে শব্দ কুড়ানো।



হেমন্তে লেখা পদাবলি-২

হেমন্তে লেখা পদাবলি-২



ফসিল নগর
দীপঙ্কর পাড়ুই

একটা ডাকঘর কত ঠিকানার কেন্দ্রবিন্দু হয়। আমাদের পিকলুদা বলে ‘ত্রিবেনীতে সব লেজেন্ডরা থাকে জানিস’। কথাটা ভেবে দেখেছি শুধুই যে হাস্যকর তা নয়। তর্ক পঞ্চাননের ত্রিবেনী এখনও জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। সপ্তম সভ্যতার ফসিল রয়ে গেছে আমাদের চেতনার কোনো কুঠুরীর ভিতর। চন্ডীমঙ্গলের ছায়া মুক্তবেনীর পথ ধরে গিয়ে কালীদহে দেখে ভোর। বানিজ্য নগরীর সুবর্ণবনিক একুশ শতকে কেউ কেউ হয়ে ওঠে কালকেতু আর ফুল্লরা।

একটা ডাকঘর কত ঠিকানার কেন্দ্রবিন্দু হয়। চিঠি আসে চিঠি যায়। মনের হরফ গুলো ভেসে ভেসে যায় আগ্রহী কোন বন্ধুর কাছে। মনের গূঢ়তম নির্যাস থাকে হয়তো আমাদের মুক্তবেনীর জলে। প্রতিদিন জলসিঞ্চনে আসে মুগ্ধতা।

একটা ফসিল নগর বেঁচে থাকে মনের ভেতর, মনের ভেতর...


একদিন তুমিও ছিলে 
নূরনবী সোহাগ

অভিশপ্ত অন্ধকার।
বিষাক্ত ছোবল ছুঁয়ে যায় ঘাসফুলের ঘুম
একটা সরব উঠোনে ভর করে মৃত্যুর নিরবতা
বুনোকাক হতে পারলে-পূর্বাভাস পেতাম
কতটা নিকটে পৌঁছে গেছে বিভীষিকা
নিষিদ্ধ নগরীর একমাত্র বাসিন্দা ভাবতেই
মনে হয় যেকোনো পথ’ই আমার
নিঃসঙ্গ ঝরা পালকের মতো স্থির
দাঁড়িয়ে দেখি— সিলিংভর্তি শৈশবকুঞ্জ
অথচ আমিও একদিন অবিরাম দাপিয়েছি
কোলাহলে।  ঘুমিয়েছি কত কত বুকে
অনুরূপ হয়তো শৈশবও আমায় দেখে ভাবে
একদিন তুমিও ছিলে আমার দলে 


তোমার লেখা হেমন্তের চিঠি
ইভান অনিরুদ্ধ

কতবছর পর তোমার পেন্সিলে লেখা চিঠি পেলাম!
আজকাল কী কেউ তার প্রিয়জনকে চিঠি লেখে?
কেউ লেখে না, তুমি লিখেছো আমার কাছে ।
তাই বলে ভাবছি না যে, তুমি আমাকে এখনো তোমার প্রিয়জন ভাবো !

তুমি লিখেছো- নভেম্বরে খুব স্নোফল হয়, প্রকৃতি শুয়ে থাকে শাদা
বরফের কফিনে, চারপাশে তাকালে মনে হয় মৃত নগরী ।
এই দৃশ্য তোমার অসহ্য লাগে। নেত্রকোণা শহর- গ্রামের
হেমন্তের কথা তখন খুব মনে পড়ে, তোমার হৃদয় আর্দ্র হয়
ভেতরে ভেতরে কার জন্য জানি হাহাকার হয়, বালিশ ভিজে যায় ।

লিখেছো- আমি যেন হেমন্তের সন্ধ্যারাতের কথা ফিরতি চিঠিতে লিখি,
পারলে সোনারঙ পাকা ধানের একটা ছড়া খামের ভেতর দিয়ে দেই যেন ।

জানতে চেয়েছো- উঠানের পুব কোণায় এলাচিগন্ধী লেবু গাছের তলায়
জোনাক পোকার সম্মিলন ঘটে কী না এই হেমন্তের রাতে ।
একবার তিনটে জোনাকী ধরে আমি তোমার
বুকের ভেতর ছেড়ে দিয়েছিলাম,
তোমার ফর্সা বুক দেখে হয়ত আনন্দে এরা অনবরত
জ্বলছিল আর নিভছিলো ।
তোমার এখন খুব ইচ্ছে আরেকবার যেন আমি সেইরকম করি !

তোমার এসব কষ্টের অনুবাদ পড়ে আমার খুব হাসি পাচ্ছে,
করুণা হচ্ছে অবেলায় এসে তোমার এরকম
স্মৃতি তর্পন দেখে ।

আমি এখন কী লিখবো বলো?
হিম বাতাসের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে কার্তিকের বিষন্ন চাঁদ,
মনে হয় এরকম বেঁচে না থেকে মরে গেলেই ভালো হত!
তবে মরে যাবার আগে খামে ভরে তোমার ঠিকানায় পাঠাবো-
একফালি কার্তিকের চাঁদ, তিনটে জোনাকী , এক থোকা লেবুফুল
অগ্রাণের সোনারঙ ধানের একটা ছড়া
আর তোমার ফর্সা বুকে এই হেমন্তের রাতে আমার যাদুময় স্পর্শ !



হেমন্তের দিন
স্বপন পাল

পাতলা সরের মতো এখানে বাতাসে ভাসে
সান্ধ্য উনানের ধোঁয়া, উঁকি মারা তারারা
স্পষ্ট ঠিক হয়নি তখনও । ঘরে ফেরা
সব ঘাম ধুয়ে মুছে এবার বিশ্রাম নেবে
ক্লান্ত, শক্ত, সুসার শরীর,
যেখানে ধানের গন্ধ এখনো জড়িয়ে আছে
ঘাড়ে, পিঠে, এলোমেলো চুলে ।
এখনই জাগবে প্যাঁচা, চাঁদ দেখা গেলে
আদুরে বাতাসে মাঠময় দুলে দুলে
ধানের যৌবন জ্যোৎস্না গিলে অপরূপ হবে ।
এ তল্লাট ছেড়ে গেছ যারা, অনিশ্চিত
এ জীবন ছেড়ে, একবার দেখে যাও
এই এত বৈভবের রাজ্যপাট ছেড়ে
কাকে বেছে নিয়েছ জীবনে ।
বৎসরের এই ক’টা হেমন্তের দিন
এর জন্য বাকী সব ফেলে আসা যায় ।
এর জন্য সব জ্ঞান, যন্ত্রণা, চাতুরী
নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ফেরা যায়
হেমন্তের জ্যোৎস্নাধোয়া ধানগন্ধী মাঠে ।


হেমন্তের নৈবেদ্য
স্নিগ্ধ নীলিমা

এসেছে হেমন্ত, সবুজে হলুদে দোলানো অবারিত মাঠ,
সবুজ ঘাসের ডগায় মুক্তার মত জমানো শিশিরজল ।
হিম কুয়াশার চাদর বিছিয়ে আসে উত্তরা বাতাস,
নীলাভ আকাশ কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধ সৌম্য দুপুর।

বিলে আর ঝিলে  সাদাশাপলারা  রূপের পশরা সাজায়,
গন্ধরাজ , মল্লিকা আর পদ্ম কাননে ফোঁটে।
ঝরাপাতার  টুপটাপ গান আবেশে জড়িয়ে রাখে,
অতিথিপাখিরা  উড়ে চলে আসে এ দেশকে ভালবেসে।

সোনালি ধানের শীষে কিষাণ  দুচোখের স্বপ্ন আঁকে,
বধুয়াকে এবার কিনে দিবে তার  সাধের নীলশাড়িটি।
বহুদিন পরে মেয়েটিকে সে নায়ইর আনবে বাপের ঘরে,
ভাপা পুলি আর ফিরনি  পায়েস  খাওয়াবে কুটুম ডেকে।

বাড়ির নিকানো উঠোন ভরে গেছে নতুন ফসলে ফসলে,
আঙিনাতে তাই ধান শালিকেরা নাচছে মনের সুখে।
ঘরেঘরে আজ ছোট বড় সব মেতেছে নবান্ন উৎসবে,
চিরায়ত  বাংলার চেনারূপটি  খুঁজে পাই এই হেমন্তে।

হেমন্তিকা
কৃপাণ মৈত্র


শিউলি এখনো ফোটে, কাশ বিবর্ণ
হয়নি এখনো, শিশিরে ধানের ঘ্রাণ,
ফড়িং- আনাগোনা অবিরাম, পিচ্ছল ধানের
শিসে সূর্যের লাজুক রোদ,পরিযায়ী পখিদের
পৃথিবী মন্থন, গরুগুলো হয়েছে উতলা, রাখাল
বালকের চোখে স্বপ্ন বিস্তৃর্ণ মাঠ, মরাই বেঁধেছে
বুক সুখ পেতে শষ্য আলিঙ্গনের,
খামার অপেক্ষায় বুকে তার চরবে ফসল, নবান্নের
আয়োজন, মরা মুখে ফুটবে হাসি,
উপবাসি মরমীর মুখে ফুটবে হাসি, হেমন্তের ডাকে জাগে
মাঠ, ঘাট, উঠনে গোময়ের লেপ, সাঁঝ নামে,
জেগে উঠে তুলসীতলা প্রদীপ শিখায়...


ঘুঘু চরা পেইন্ট হাউস
তাপস গুপ্ত

ভাঙ্গা ভিটেতে চরছে ঘুঘু
দানা হীন ধুলোয় ঘুরে
কি যেন খুঁটছে শালিক,
সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বলে করপোরেশন
সাবধান ঝোলে বিপদজনক
হলুদে লাল রঙে,
শুধু নেই চরিত্রগণ
বৃক্ষের শিকড় জুড়ে অতীত
সব চরিত্র কাল্পনিক।
কুলুঙ্গিতে সেই কবে ছিল
নুন হলুদে মাখানো মাছ,
সেই আঁশটে গন্ধ এখন শহর জুড়ে,
দিন গুলি প্রাণ পেত যৌথ কচুটেপনায়
যুদ্ধের ইতিহাস কত সুরে ভাসত অশ্লিল খেউড়ে
উৎসাহী চোখে কৌতুক ঝিলিক প্রতিবেশী জানালায়,
সাদা লাল শাঁখা পলা
কত রূপসী সন্ধ্যে জমায়েত হতো তুলসিতলায়।
সে সব রূপময় রূপকথা
ইঁটের পাঁজরে অস্থিসার বিগত যৌবনা
গতর ঝরানো চুন সুরকির হাসি
হাঁ করা দেয়াল জুড়ে।
কত সূর্য মাখা ছিল এ দেয়াল
প্রভাতী কলহে পায়রার ওড়া ছিল
নিয়মিত চালগমে,
সে অতীতকে ভ্যাংচায় রাতের বাদুড় পেঁচা
চামচিকে দোহারে ডানা ঝাপটায়,
জ্যোৎস্নায় চাঁদ শুধু চাটাই পাতে
কত অভিশাপ আর কেচ্ছায়
রসালো গল্প জমায় রাতে;
গল্প এবার মাপা হবে মিটারে স্কোয়ার ফিটে
বোধনে ভিত পুজো ক্ষমতার খুঁটি গাড়া হয়
ঘুঘুদের যৌথ ভিটের মাটি খুঁড়ে।
পিট পিটে হাঙর চোখ শুধু অপেক্ষায়,
পেইন্ট হাউসে ধরা দেবে চাঁদ
ঝিকিমিকি রূপকথা বুদবুদ স্কচ ও সোডায়।
বুড়ি নটে গাছ ব্যালকনি জুড়ে
যৌবন ধরে নিজেকে বাঁচায়
টবে থাকা মানি প্ল্যান্টের
সবুজ পাতায়।




নদী পাড়ের হেমন্ত উপাখ্যান
সাইয়্যিদ মঞ্জু
 
প্রকৃতির কাছে খুঁজি হৈমন্তিক কবিতার অনুষঙ্গ
মুখভার কৃষাণী তর্জনী ইশারায় দেখায় নদী
অশ্রু চোখে বয়ান, ফসলি জমি নদী হওয়ার গল্প
কান পেতে শুনে সোনালি ধানের শুন্য গোলাও।

হিম কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে নদী পাড়ে হেমন্ত
ভোরের শুভ্রতায় শিশির নূপুর।

ফসলের প্রান্তরে অকৃত্রিম-অনাবিল হাসি
কৃষাণ-কৃষাণীর ব্যস্তময় ধানরাঙা মুখ
নবান্নের পিঠাপুলির সুগন্ধি ঘ্রাণ
কোথাও কিছু নেই-
আত্মস্থের সম্ভারে ডেকে গেছে
বিলীন সুর খরস্রোতা পদ্মা।

শিউলি ফুল
আলী আহম্মেদ

শিউলি ফুল কুড়ানো সেই দিনগুলো, আজ ধুম্র কূয়াশায় আচ্ছন্ন
মনে পড়ে, এক হাতে কায়দা আঁকড়ে
আরেক হাতে শিউলি তলে ফুল কুড়াতাম উৎফুল্ল চিত্তে
ভোরের শিশিরে ভেজা শিউলি, সে কি তার অনন্য রূপ!
শুভ্রতার পাড়ে যেন এক চিলতে কমলা, ভোরের চোখে কাজল টেনে যায়
ফুলগুলো ছোঁয়ার পর দারুণ এক অনুভূতির সৃষ্টি হতো!

চার চালা টিনের ঘরটা আর নেই, এখন সেখানে প্রাসাদ
চারা বকুলের গায়ে বাদামী বাকল
এখন আর আযানের ধ্বনি শুনে মক্তবে ছুটি না
দল বেঁধে দেখা হয়না মাটির বুকে জড়িয়ে থাকা;
শিউলি ফুলের অপার সৌন্দর্য।

মক্তবের সাথিরা আর নেই, কিংবা আমি নেই
ব্যস্ততা ঘুরিয়ে দিয়েছে পথ, গন্তব্য
দায়ীত্ব বুঝে নিতে গিয়ে অনেক বড় হয়ে গেছি,
মাস শেষে গুনে নিতে হয় মজুরী: বাঁচবো বলে
তাই পিছনে ফিরে যাওয়ার আর সুযোগ নেই।

মাটির গায়ে বিছিয়ে থাকা শিউলি ফুলগুলো নেই
কে জানে! হয়তো প্রত্যক্ষ দেখার আর সুযোগও নেই
তাই তাদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি সংগোপনে
বিরহী চিৎকারে তাদের অদৃশ্য বোবা কান্না শুনি কান পেতে
শিউলিগুলো হয়তো জানবেনা কোনদিন,
আমার ফিরে যাওয়ার সে যে কি আকুতি!





যে সব প্রস্থান গল্পে ব্যাকুল দেয়াল
নিঃশব্দ আহামদ

কেবল দাঁড়িয়ে থাকে দেয়াল, নিস্তরঙ্গ চোখে তাকায় দিনপঞ্জি, কেমন খসে যাচ্ছে কোলাহল থেকে একেকটি দিন, আড়ষ্টতার মতো জড়িয়ে থাকে চাকার চেয়ার
দুলতে থাকে ক্রমশঃ যেনো, নিরূত্তাপ দেহ।

এই যে সন্ধ্যা, সম্মোহন বেষ্টন করে রাখে এড়ানো চা-টেবিল, কেবল নির্জন ঘরে প্রেম হয়ে গেছে আমাদের সংলাপ, সব নৈমিত্তিকতা বিরতি হয়ে ফিরে গেছে এই ক্ষণ আয়োজনে- চোখ থেকে শুভ্রতা নিয়ে দীর্ঘায়ূ বুনে আমাদের যোজিত দুরত্ব।

তবু না, কারা যেনো বেশ ধারণ করে এলো, আক্ষেপত্রয়
যদি ভাসায় সে কেবল শব্দ সৃজন না, নয়তো খেয়ালি মিথ আমি আমার ভেতর ছড়িয়ে রেখেছি জলাভূম,
মুগ্ধতার বীজ- বর্ধিষ্ণু চারার মতো পরিচর্যা করে গেছে সমস্ত রোদ।

না, এভাবে বলো না -
যদি কখনো স্বাভাবিকতায় দলিত রেখে যাও কোনো
আহাজারি হয়ে যাওয়া কান্না, তবু ঊল্লাস নাভেতরে তুলে রেখো, এতোটুকু দায়
সারা সময় আমি যে আস্তিনের ঘ্রাণের মতো মিশে আছি হয়ে তোমার, সমস্তকাল।


দুঃখী বাবা

দুঃখী বাবা



দুঃখী বাবা
আহমদ মেহেদী

১. হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। রোগীদের পাশে তাদের কত আপনজন! আমার মা নেই। বাবাই আমার একমাত্র আপনজন। মা গত বছর মে মাসে মারা গেছেন। আজ বাবা ও আসতে পারেনি। তিনি ঢাকা গেছেন আমার ছোট ভাইয়ের বিদেশের ব্যপারে মেডিকেল করাতে। ফিরতে রাত হবে বলে গেছে। কী জানি কখন আসে বাবা। হাসপাতালের ভিতরে কেমন জানি অস্বস্তিকর গন্ধে মাথা ধরে যাবার মত অবস্থা। চিৎকার, চেচামেচি আর হট্টগোল হাসপাতালের পরিবেশকে আরো ভারী করে তুলছে। সকালে বাবাকে বলাতে আমার জন্য একটি পত্রিকা এনে রেখে গিয়েছিলেন। আপাতত পত্রিকা পড়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। আজ দুপুরের খাবার আসবে ফাতেমা আপার বাসা থেকে। ফাতেমা আপা আমার বন্ধু সুজনের বড় বোন। তাদের বাসা হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে। তার ননদের আজ বিয়ে হবার কথা ছিল। কী জানি বিয়ে বাড়ীতে এত ব্যস্ততার মাঝে আমার খাবারের কথা কি মনে নাই সুজনের? সুজন বলেছিল কাজের ছেলেটিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।

২. বাবার ফিরতে রাত হল। তার চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। বাবা বলেন কীরে দুপুরে খাবার পাঠিয়েছিল? হ্যাঁ বাবা। তা বলেই বাবা হাসপাতালের ওয়াশ রুমে গেলেন। বাবাকে মিথ্যা বললাম। তাঁকে দেখে সত্যি মনের ভিতর কেমন জানি করে উঠে। মা মারা যাবার পর বাবা আর বিয়ে করেনি। তাঁর ধারনা যাকে নিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করেছি তার মৃত্যুর পর বিবাহ সে করে কীভাবে? আমি বাবাকে একবার বলেই ফেলেছিলাম বিয়েটা করেই ফেল। আমার দু’ভাই দূরে দূরে থাকি। জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে অজানাতে ছুটতে হয়। প্রুতিনিয়ত জীবনকে বাঁচাতে মানুষের নান পথ কখনো বা গন্তব্য ছোঁয়ার স্বপ্নকে লালন করে পথ হারাই- পথ খুঁজে পাই। কিন্তু মা হারালাম- মা আর পেলাম না। একজন বড় বোন থাকলেও চলত। কিন্তু সেটা ও নেই। বাবা দিনের পর দিন কেমন জানি রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার অসুস্থ্যতার কারণে তাকে আরও বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে। এদিকে ছোট ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার টাকার জন্য বাবা নানান মানুষের কাছে ছুটাছুটি করছেন- হাত পাতছেন। হাত পাতা মানুষকে দেখলে সবাই কেমন করে জানি তাকায়! দেখলে সত্যিই খুব অবাক লাগে। অতি আপনজনরা সেই অসয়হায়ত্বের নমুনা দেখে বড় বেশি তৃপ্তি হাসি হসে। অথচ রক্তের টান নিয়ে কত টানা- হ্যাচড়া।

বাবাকে বলেছিলাম খোকন চাচার সাথে দেখা করার জন্য। আমাকে একটা চাকুরি বলেছিল। সেই এস.এস.সি পাশের পর াকাক বলেছিল-তোকে ঢাকা নিয়ে যাব। ভাল একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিব। কই এইচ.এস.পির পর ও তো কাকার কথার মর্মটা বুঝতে পারলাম না। হয়তো ভুলে গেছেন তার ভাতিজাকে দেওয়া কথাটা। ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা জন্ম ভুলে যাই; মৃত্যু ভুলে যাই। ভুলে যাওয়াটা এখনকার সমাজের নিত্য ব্যাপার।

৩. দুপুরে একটু ঘুমিয়ে ছিলাম। সুজন এসে আমার ঘুম ভাঙ্গালো। সুজন বলল-চা খাবি? আমি নিচের দোকান থেকে রং-চা নিয়ে আসি। আমি বলালম- চা খাব না। সুজন বলল- জয়নাল রাগ করিসনা। ঐদিন কাজের ছেলেটি বিয়ে বাড়ি থেকে আপার মোবাইলটা চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম সে তোকে খাবার দিয়ে গেছে। পরে আপা লজ্জায় আমাকে কথাটি বলতে পারেনি। আমি বলালম- সুজন, তুইতো আমার সেই হাই স্কুল থেকে বন্ধু। এ সামান্য ব্যপারে মন খারাপ করিসনা। তুইতো খাবারের ব্যবস্থা করেছিলি! ওই যে দেখ পাশের বেডে শুয়ে আছে তাঁর থেকেই দুপুরে খেয়েছি। আমার কেউ আসেনি দেখে মেয়েটির মা তাদের থেকে আমাকে হাফ দিয়েছেন। ও তোরেতো আরেকটি কথা বলাই হয়নি-তামান্না এসেছিল দেখতে আমায়। সুজন চুপ করে বসেছিল। যদি পারিস আনারসটা কেটে দে। তামান্না এনেছে। আনারস আমার খুব পছন্দের কিন্তু আজ খেতে মন চাচ্ছে না। খেতে তো হবেই তা না হলে সে রাগ করবে। আর শুন পাশের বেডের মেয়ে ও মাকে দুই পিছ দে।

সুজন বলল-মামুনের বিদেশ গমণের টাকা জোগার হয়েছে? আমি বলালম- হ্যাঁ, কিছুটা বাকি আছে। বাবা আর নোয়াখালি গেছে। সেখানে আশিষ নামের তার ব্যবসা- জীবনের এক বন্ধুর বাড়ি। তার কাছ থেকে হয়তো কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে।

৪. হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেলাম গতকাল মামুন বিদেশ চলে গেছে। শুনেছি ঠিক মত কাজ পায়টি। এদিকে বাবা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাদের দু ভাইয়ের দিকে চেয়ে প্রতিক্ষার দিন কাটান হাসপাতালের যাবতীয় খরচ তামান্না দিয়েছিল বলেই বাবা তার সম্পর্কে জেনে ফেলেন। আর আমাকে বললেন- এমন বন্ধু পাওয়া এই সংসারে বিরল। এতো বিপদে সে এগিয়ে এসেছে। তাকে একদিন আসতে বলবি আমাদের বাড়িতে। তাই বলেই বাবা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

এর মধ্যে একটা এনজিও’র চাকুরি পেয়ে গেলাম। বিষন্ন বাবার মুখে একটু খানি হাসি ফুটাতে চেষ্টা করছি। আর বাবা বলে- আমাকে কিছুই দিতে হবে না; তোর নিজের চলা তুই চল। দেয়ালে পিঠ ঠেকানো থেকে কিছুটা মুক্তির স্বপ্নে আামর দিন কেটে যায়। বরবরই সংসার-উদাসিন ছেলেছি যখন আজ সংসারের হাল টুকু ধরতে চেষ্ট করেন তখন আমার বাবা মুগ্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকনে। মা মারা যাবার পর থেকে ছোট চাচি আমাদের দু’বেলা রান্না-বান্না করেন। এমন করেতো আর চলতে পারেনা। অন্তত রান্নাবান্নার জন্য হলেও তো একজন লোক দরকার। এবার মনে হয় সত্যিই সংসারি হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। বাবা তার সংসার জীবনে যে লাঞ্ছনা (আত্মীয় দ্বারা) দুঃখ পেয়েছিলেন তা উপলব্ধি করার জন্য একটি ছোট্ট সংসার পাতা মনে হয় খুব খারাপ হবে না।

হাসপাতালের জানালা দিয়ে দেখলাম আকাশে মেঘ জমেছে। আর আমি ভাবছি কেমন জানি হয় আমার আগামী দিন গুলো। বাবার দিকে তাকালেই দু’চোখ ভিজে উঠে।

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৪

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৪



(গত সংখ্যার পর)
 ০৪.
আরও দু’তিন দিন বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিলো। বেবী আপা ডাকেননি। নিঃসঙ্গ বাসায় কোনো একাকিত্ব উর্মিলাকে স্পর্শ করেনি। বরং সম্পূর্ণ নতুন এক জগতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাহসী, স্বস্তির বোধ হয়। উর্মিলার মনে হয়, না এখন আর পেছানোর সুযোগ নেই। সহস্র প্রতিকূলতায় জীবনকে বয়ে বেড়াতে হয়। উর্মিলা উচ্চস্বরে বলে, আমি প্রস্তুত।’ কী প্রস্তুত, কেন প্রস্তুত! প্রতিপক্ষকে? উর্মিলা কিছুই জানে না। শুধু মন এবং চিন্তার জগতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব তেড়ে আসে। যা তাকে খুচরো ভাবনা থেকে মুক্ত রাখে। প্রতি সন্ধ্যাবেলা নিত্যনতুন সংবাদ নিয়ে ফেরে রুবী। তার অনেকগুলো মুখরোচক।
‘জানো, কোনার ডেক্সে যে মেয়েটি বসে ওর নাম মিতালী সিকদার। চাঁদপুরের মেয়ে। বিএ পাস। নায়িকাদের মতো সাজতে পছন্দ করে। ওর বোধহয়  বয়ফ্রেন্ড আছে।’
‘কাল টোকন ভাই, কামরাঙ্গীরচর যাচ্ছে তিন দিনের জন্য। সার্ভে আছে। এ তিন দিন টোকন ভাই অফিসে আসবে না।’
‘আমার কিন্তু দীপু ভাইকে দারুণ লাগে। নিরহঙ্কার। হেসে হেসে কথা বলে। কথা বলার সময় চোখের মণি অবাক মনে হয়।’
‘তোমার জাকির সাহেবের সঙ্গে কাজ পড়ে কি না কে জানে?’ রুবীর কথা বলার ঢঙ্গে খুব অবাক হয়। রুবী এভাবে কথা বলে কেন? ক্যামন ইঁচড়েপাকা। উর্মিলা লজ্জা পায়। কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
বেশ সময় পর রুবী জিজ্ঞেস করে, ‘আমার কথা তোমার ভালো লাগেনি আমি জানি।’
‘রুবী আমি এসব কিছুই ভাবি না।’ উর্মিলা ধীর কণ্ঠে বলে।
‘আমি তাও বুঝি।’
‘আসলে আমি কী চাই তাও জানি না। কেন শুভপুরের সহজ জীবন ছেড়ে নগরে এসেছি। রুবী আমি কি ভুল করেছি?’
‘না।’
উর্মিলার আরও একটি নিস্তরঙ্গ রাত কেটে যায়। আটটার ভেতরে তড়িঘড়ি করে রুবী অফিসে চলে যাওয়ার পর পরিপাটি হয়ে রাস্তার গলির মোড়ের স্টুডিওতে গিয়ে পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলে। কলেজে ভর্তির সময় লাগবে। হেঁটে হেঁটে এটা-সেটা কেনাকাটা করে। প্রচ- গরমে একরকম ঘেমে রুমে ফেরে। আর তখনি মনে পড়ে জাকির সাহেব রুবীর বুকে হাত দিয়েছিল। এই ধরনের নীরব কষ্ট ওকে পীড়া দিতে থাকে। রুবী প্রতিবাদ করেনি? বেবী আপাকে জানাইনি কেন? রুবীকে খুব অসহায় মনে হয়। রুবীর মধ্যে গ্রাম্য-সরলতা আছে। ওর মধ্যে কি রুবীর মতো সারল্যে আছে...। নিজের কাছে প্রশ্ন করে উর্মিলা। শুভপুরে ছিল। ঘাসফড়িংয়ের পেছনে উৎফুল্ল কিশোরীর মধ্যে ছিল। ঝুম বৃষ্টিতে পিসিমার কাছে রূপকথার গল্প শোনার সময় ছিল। স্কুলে যাবার পথে ছিল। শুভপুরের ব্রিজ নাকি বংশাই-র জলে ডুব-সাঁতরে যে জীবন তার অবাধ চলাফেরায় যে আকাশ দেখেছিল তার পরতে পরতে নীলের সমারোহ। মুগ্ধতায় ভরা সময়ের বৈতরণী অতিক্রম করে উর্মিলা এখন নগরে এসেছে। সমুদ্রগামী নাবিকের মতো বাতিঘর খুঁজছে। এই রেখায় ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি। গাঙচিলের মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সুদূর শুভপুর থেকে নগরে উঠে এসেছে।
এরও দুু’দিন পর বেবী আপা ডেকে পাঠাল উর্মিলাকে। নিউমার্কেট থেকে কেনা থ্রি-পিস সালোয়ার কামিজের সঙ্গে কিশোর বেনুনি ফুলিয়ে রুবীর সঙ্গে অফিসে যায় উর্মিলা। বুকটা দুরুদুরু করে। হিমশীতল রুমের ভেতরেও ঘামের স্বেদবিন্দু স্পষ্ট হয়। রুবীর টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে থাকে। পিয়ন দু’কাপ লেবু চা দিয়ে যায়। চায়ে চুম্বুক দিতেই দরজা ঠেলে দীপু ভাই ঢোকে। সুঠাম শরীর। টি-শার্টের সঙ্গে জিনস প্যান্ট, রিবকের কেড্স, উজ্জ¦ল হলুদাভ শরীরের রঙ। সব মিলিয়ে সিনেমার নায়কদের মতো। রুবীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আজ তোমাকে কিন্তু ক্ষমা করব না। নোটের কপি চাই।’
দীপু ভাই রুবীর টেবিলের সামনে দাঁড়ায়।
রুবী গদ গদ কণ্ঠে বলে, ‘কালই রেডি হয়ে গেছে। এখন শুধু ফাইনাল চোখ বোলাব।’
‘গুড। তাইলে একটু পর আমার টেবিলে পাঠিয়ে দিও।’
‘দীপু ভাই, ও উর্মিলা। আমাদের সঙ্গে কাজ করবে।’ দীপু ভাই উর্মিলার দিকে তাকায়। দু’হাত তুলে নমস্কার জানায়।
‘আপা বলেছিল। আপনার প্রতি আপার পক্ষপাত আছে। বোঝা যায়।’
‘না না। আপনারা যা ভাবছেন তা না। গ্রাম থেকে এসেছি। হয়তো নিজেই খাপ খাওয়াতে পারব না। তখন হয়তো এ পক্ষপাত থাকবে না।’ উর্মিলা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে।
দীপু ভাই হাসতে থাকে।
‘রুবী,  মেম কিন্তু বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। এটাও একটা যোগ্যতা।’
উর্মিলা আশান্বিত হয়। বিস্ময় নিয়ে দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘ঠিক আছে। ওয়েল কাম। রুবী নোটের কপি দিয়ে আমাকে রক্ষা করো।’ অসম্ভব সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে দীপু ভাই পাশের রুমে চলে যায়।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে রুবী বলে, ‘উর্মিলা, দীপু ভাই ভালো না।’ উর্মিলা চোখের পাপড়ি নাচিয়ে সম্মতি জানায়।
রুবী তড়িঘরি করে দীপু ভাইয়ের নোটের ফাইল বের করে চোখ বোলাতে থাকে। উর্মিলা পাশে বসে সারা অফিসের দিকে চোখ, কান উৎকীর্ণ রাখে। প্রতিটি জিনিস থেকে পিয়নদের চলাফেরা লক্ষ করে।

তারও আধা ঘণ্টা পর বেবী আপা এলো। পরনে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। আধাপাকা চুল। পুরো লেন্সের চশমায় যেন আলাদা ব্যক্তিত্ব ফুটে  উঠেছে।
উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাহ! তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি ক’দিন আগে শুভপুর থেকে এসেছ!’
‘আপা, আমি তো শুভপুর থেকে এসেছি।’ উর্মিলা অকপটে বলে।
‘তা ঠিক, তা ঠিক। আমিও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে এসেছি।’
উর্মিলা কথা বলে না। বেবী আপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘অস্থির হওয়ার কিছু নেই উর্মিলা। আমি জাকিরকে বলে দিয়েছি। রুবী এবং অন্যরা তোমার প্রতি দৃষ্টি রাখবে। কাজ তো আর কেউ জন্ম থেকে শিখে আসে না। আস্তে আস্তে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে হয়। তুমি পারবে।’
‘আপনি আশীর্বাদ করবেন।’
‘আমি জাকিরকে বলে দিয়েছি। কেরানীগঞ্জের সার্ভে মিশনে তোমাকে রাখার জন্য। এসব কাজ রুটস লেবেল থেকে শিখতে হয়। অনেকটা মমতা নিয়ে শিখতে হয়। তোমাকে মনে রাখতে হবে, তুমি মানুষ নিয়ে কাজ করছ। দুঃখী মানুষ। যাদের হাসি কান্না-সুখ-দুঃখ-চাওয়া-পাওয়ার ভাষা তোমাকে পথ দেখাবে।’
উর্মিলার চোখে জল এল। বেবী আপার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে আর অসহায় মনে হলো না।
শুধু বলল, ‘আপা, আমি কি পারব?’
‘শোন উর্মিলা, এ পৃথিবীর সৃষ্টিশীল কাজ সব মানুষ করে। আবার ধ্বংসযজ্ঞের নায়কও এরা। আর তুমি তো সৃষ্টির পক্ষে।’ উর্মিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বেবী আপা চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে উর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘নারী হিসেবে নিজেকে রক্ষা করার যোগ্যতা জরুরি।’
বেবী আপার রুম থেকে বেরিয়ে রুবীর পাশে বসা পর্যন্ত ইতিউতি অসংখ্য ভাবনার নাগরদোলায় দুলতে দুলতে উর্মিলার মনে হলো, উর্মিলা তুই এখন নগরে থাকিস। নগর আর গ্রাম এক না। যে গ্রামে জন্ম, তার মানুষ, প্রকৃতি, বৃক্ষলতা তোকে রক্ষা করেছে। নগর তোকে গ্রাস করার জন্য ফাঁদ পেতে বসে থাকে। কারণ ছাড়াই অন্ধকার তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। লুণ্ঠন করতে পারে তোর সম্ভ্রম এবং জীবন। তারপরও এই নগর থেকে তোকে শুরু করতে হবে। বার্তা পৌঁছাতে হবে প্রতি গ্রামে, মানুষের কাছে। চিৎকার করে বলতে হবে। এ পৃথিবীতে প্রতিটি পিপীলিকারও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দারা তোমরা শোনো, আমি মাতামেরী, মা আমেনা, জননী যশোদা। অগনিত সন্তান জন্ম দিতে দিতে সর্বংসহা মানবিক প্রজাতি। গ্রহণ করো। জন্ম, জননী, জন্মভূমির দায়ভিক্ষা নিয়ে হাজির। তার কি কাঙালপনা মানায়!
ইত্যাকার অসম, অপরিমত ভাবনাগুলোয় আচ্ছন্ন উর্মিলা। না এতকিছু ভাবার বয়স ওর হয়নি। অতোটা শিক্ষাও অর্জিত হয়নি। তারপরও কেন এ ভাবনাগুলো ক্রমাগত মস্তিষ্কের কোষে কোষে তোলপাড় করে ওঠে। একবার মনে হয় ও কি ভেবেছে, কীভাবে প্রকৃতি, পরিবেশ, ধীরে ধীরে তাকে তৈরি করবে, উর্মিলা কি অপেক্ষা করবে?
রুবীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়।
‘কি রে এত বিষণœ কেন? দীপু ভাইকে নোটের কপি দিয়েছি। তোকে দেখে খুব অবাক হয়েছে।’
উর্মিলা কথা বলে না।
খুব হাস্যকর ভাবে বলে, ‘ও মেয়ে পিপলস রিলেশন রাখবে কীভাবে? ওর তো সিনেমার নায়িকা হওয়া উচিত। খুব সরল না।’
‘দীপু ভাইকে বলে দিস, আমি নায়িকা হওয়ার জন্য আসিনি।’ উর্মিলার গম্ভীর কণ্ঠ।


নবান্ন

নবান্ন


                                                    

নবান্ন
প্রনবেশ চক্রবর্ত্তী

হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসে বিচ্ছেদের করুণ হাহাকার। সোনালী ধানের শিষে যে বাতাসের এতো মাখামাখি ছিল, দোলা দিয়ে যেত সারাক্ষণ, ভরিয়ে তুলতো পাকাধানের শিষে কিঙ্কিণীর কলরোল, তার কণ্ঠে আজ বিষাদের সুর। মাটির কন্যার সেই কঙ্কণের শব্দ, সেই নূপুরের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দিয়ে হরিয়ালি হরিৎক্ষেত্রকে চির বিষণœতায় ভরে দেয় রাবণরূপী চাষীর দল। ধরণীর বুক থেকে যেন টেনে হিঁচড়ে হরণ করে নিয়ে যায় তারা মাটির কন্যা সীতাকে! তাই চারিদিকের গভীর নিঃস্তব্ধতা ও বিষণœতায় আজ ধূসর সেদিনের সেই হরিৎবর্ণ। মায়ের বুক থেকে চিরবিচ্ছেদের বিহ্বলতায় তার আলুথালু কেশ ছড়িয়ে পড়ে চাষীর পিঠে, যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার অঙ্গের ভূষণ।

এক একটা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহামূল্যবান কণকভূষণ কুড়িয়ে চলে কচি কচি হাতগুলো একটুখানি ক্ষুধা নিবৃত্তির আশায়।

এদিকে, গ্রামে গৃহস্থের প্রকা- অট্টালিকায় খুশির জোয়ার। গৃহলক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটেছে যে। শুদ্ধ বসনে, শুদ্ধাচারে লক্ষ্মী বরণের পালা। শুদ্ধ আচারে অঘ্রাণের প্রথম কাটা ধানের চালে নবান্নের উপাচার। নানাবিধ ফলমূল, মিষ্টান্নের সমাহারে তারই আয়োজন। অতিথি অভ্যাগতদের আনাগোনা। বাতাসে নবান্নের সুঘ্রাণ।

রাজারামের ব্যস্ততার অন্ত নেই। মনিবের ঘরে নবান্ন উৎসব। সময়মতো সব আয়োজন সেরে ফেলতে হবে। নইলে কচি ছেলেটার মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার মতো সংস্থানও যে হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তাই উদয়াস্ত কাজ করে চলে সে। বস্তাভর্তি নতুন ধানের আতব চাল মাথায় নিয়ে নিজের বাড়ির পাশ দিয়ে সরু পথ ধরে মনিবের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে তার ক্লান্ত পা দুটি।

উদয়াস্ত বাবার পথ চেয়ে বসে থাকে অভুক্ত ছেলেটি। কখন বাবা ফিরবে, বাবা ফিরলে তবেই তো দুটো খেতে পাবে সে। তার খিদে যেন আর বাঁধ মানে না। হঠাৎ ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় বাবাকে। নাকে এসে লাগে সদ্য ছাঁটাই করা আতব চালের গন্ধ। ক্ষুধার্ত চোখ দু’টি জ্বলজ্বল করে ওঠে ওর। বাবা তবু বাড়ি ফেরে না। ক্ষুধার্ত ছেলেটা উঠানে পড়ে থাকা গুটিকয়েক কুাড়িয়ে আনা ধানের শিষের দিকে চেয়ে থাকে। বাবার পিছন পিছন হাওয়াই মিলিয়ে যাওয়া নতুন আতবের গন্ধ আবার অনুভব করে সে। ছুটে গিয়ে অপুষ্ট হাতদুটি দিয়ে এক এক করে ধান থেকে চালগুলোকে আলাদা করার বিফল চেষ্টা করতে থাকে।
দাওয়ায় বসে ছেলের খাওয়ার জন্য মাঠ থেকে তুলে আনা কলমীর শাক বাছতে বাছতে মায়ের চোখ দু’টো জলে ভরে আসে।
‘ওটা কি করছিস, বাবা?
‘মা, আমাদের নবান্ন হবে না?
নীরবে চোখের জল মোছে মা। মা হয়ে ছেলের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে না পারার দহনে দগ্ধ হতে থাকে মা।

সারাদিন মহাব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে রাজারামের দিন। মহাসমারোহ ও আতিশয্যের নবান্নে অবসন্ন এবং অবসাদ চিত্তে সে কেবল কাজই করে চলে। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুসরত মেলা ভার। উদ্ধৃত্ত খাবার এবং উচ্ছিষ্টের ছড়াছড়ি। আবর্জনার পাত্র ভরে উঠে মুহুর্মুহু অপচয়ে। রাজারাম তা বাড়ির বাইরে ফেলে আসে বারবার। যে লক্ষ্মী আবাহনে এহেন আয়োজন, সেই লক্ষ্মীরই কিনা এমন অনাদর, ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে! বিস্ময়ে অভিভূত রাজারাম ভাবতে থাকে,
‘মাগো তুমি এদেরই ঘরে সদা বিরাজ করো, আর যে কিনা সমাদরে কুড়িয়ে আনা দু’চারটে ধানের শিষে তোমায় খোঁজে দিনান্ত, তাকে তুমি দেখাও দাও না! সেই একরত্তি ছেলেটা সারাদিন মাঠে মাঠে ধানের শিষ কুড়িয়েছে মেঠো ইঁদুর আর ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা পাখিদের মাঝে। জঠরে খিদের জ্বালা, অপুষ্টিতে ক্ষীণকায় ছেলেটার বুকের পাঁজর ঠিকরে হৃৎপি-টা বুঝি বেরিয়ে যাবে যেকোনো সময়। নির্লিপ্ত চোখে অনন্ত খোঁজা তার, যদি তাদের উঠানেও লক্ষ্মীদেবীর পায়ের অস্পষ্ট ছাপটুকু পড়ে। ‘কান্নায় বুক ভারি হয়ে অসে তার। ফেরার সময় বেড়ার ফাঁকে ক্ষুধার্ত ছেলেটার বুভুক্ষু মুখ সে যে দেখে নি, তাতো নয়! অভাবের আগুনে তার জগৎটা যেন রাশি রাশি কালো ধোঁয়ায় ভরে ওঠে। দুঃখে, ঘৃনায় ফেটে পড়তে চায় পিতৃহৃদয়।

ডাস্টবিনে ক্ষুধার্ত কুকুগুলোর মধ্যে খাবারের কাড়াকাড়ি, আর্তনাদে সম্বিত ফেরে রাজারামের; অনতি দূরে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট শিশু; ফেলে দেওয়া খাবারের দিকে চেয়ে থাকা দু’টো চোখ ।


জীবন ও জীবিকায় : চলনবিল

জীবন ও জীবিকায় :  চলনবিল


জীবন ও জীবিকায়
চলনবিল

মোহাম্মদ অংকন

বর্ষায় বিল আর গ্রীষ্মে আবাদী জমি, এই নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলন বিল। এই বিলকে কেন্দ্র করে চাষীরা যেমন স্বপ্ন বপন করে, তেমনি জেলেরা স্বপ্নের জাল বুনন করে। বিলকে কেন্দ্র করে শুধু চাষী জেলেরাই স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন দেখে চলন বিলাঞ্চলের প্রতিটি মানুষ এবং দেশবাসী আশায় থাকে চলন বিলে উৎপাদিত ধান ও স্বাদু পানির নানা প্রজাতির মাছের জন্য। পর্যটন আকর্ষক হিসাবেও চলন বিলের নাম সু-বিস্তৃত।

ভরা বর্ষায় চলন বিল হয়ে ওঠে অনন্ত যৌবনা। অঢেল পানির মাঝে মাঝে দেখা মেলে কৃষকের বোনা আমন-আউশ ধান। আর অথৈ পানিতে নৌকা ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। চলন বিলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য- বোয়াল, শোল, পুটি, পাবদা, খলসে, শিং, বেলে, চিংড়ি, আইড়, কই, বাইয়েম সহ বিভিন্ন সুস্বাদু  মাছ। জেলেরা শেষ রাতে জাল ও নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বিলে চলে যায়। সকাল অবধি তারা মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। আবার অনেকে বড়শি, খড়াজাল, ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল, সুঁতিজাল দিয়েও মাছ শিকার করে। এসব মাছ এলাকার স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করার পর তা দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে যায়। সেই সাথে সারা দেশে চলন বিলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে চলন বিলের মাছ বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।



বর্ষার পানি শেষ হতেই চলন বিলের কৃষকরা মাঠে নেমে পড়ে। পাঁকা আমন-আউশধান কেটে ঘরে তোলে। তারপর জমি থেকে ধানের আগাছা পরিষ্কার করে ইরি ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করে। সবাই ইরিধানের বীজতলা তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাস দুয়েক পর চলে আসে ইরি মৌসুম। কৃষকরা চলন বিলের মাঠে ধান লাগাতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ জমির আইল বাঁধে, কেউ কেউ পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে আবার কেউ কেউ জমিতে পানি দেয়, মই দেয়। তখন শীতকাল চলে। কুয়াশা ভেদ করে দল বেঁধে কৃষকরা ধান রোপন করতে হেঁটে হেঁটে জমিতে যায়। তাদের মাথায় ধানের বীজের বোঝা ও হাতে পানতা ভাত। সূর্য উঠার আগেই তারা যেন বিঘাকে বিঘা জমিতে ধান রোপন করে ফেলে। তাদের সারি বেঁধে কাজের দৃশ্য যেন সত্যই অপূর্ব। আরও অপূর্ব লাগে যখন তারা কণ্ঠে আঞ্চলিক গানের সুর তোলে। কাজের আনন্দে গান গেয়ে তারা যেন শরীরকে চাঙ্গা রাখে।

ইরি মৌসুমে চলন বিলের মানুষের অবসর যাপনের সুযোগ নেই। জমিতে ধানের চারা লাগানোর পর প্রতি নিয়ত জমিতে পানি সেচ দিতে হয়। স্যালো- ইঞ্জিনের দ্বারা কৃষক তার ধানের জমিতে পানি দেয়। এখন অনেক স্থানে বৈদ্যুত্যিক মোটর স্থাপনের কারণে কৃষকরা স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলছে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা, সার দেওয়া ও পোকা মাকড় প্রতিরোধ করে কৃষকরা তাদের ধানকে সতেজ করে রাখে। তখন চলন বিল যেন সবুজে ভরে ওঠে। ধানের জমি থেকে তুলনামুলক উচুজমিতে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের বিশস্যের চাষাবাদ করে থাকে। যেমন- গম, ডাল, সরিষা, তিল। অনেকে শীতকালিন সবজি চাষ করে। শীতকালে কাঁচা সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকায় গ্রাম পেরিয়ে সেসব শহরে চলে আসে। চলন বিলের উর্বর মাটিতে ধানের ফলন যেমন ভাল হয়, তেমনি আলু, পটল, পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতার ফলনও আশানুরুপ হয়। কৃষির বৈচিত্র্যতা থাকার কারণে চলন বিলের মানুষ কৃষিজ পণ্যের অভাবে ভোগেনা। চলন বিলের স্বাদু পানির মাছ আর জমির টাটকা সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারির সাথে নতুন চালের ভাত খেলে কৃষকের যেন সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

যখন ইরি ধান ঘরে ওঠে, তখন চলন বিলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় কাটায়। কৃষকেরা ধান কেটে মহিষের গাড়িতে করে ধান এনে উঠানে নামায়। তাই গৃহিনী রাসকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠান গোবর-জলদিয়ে লেপে রোদে শুকিয়ে ঝকঝকে করে তোলে। সোলানী ধানের আঁটিতে উঠান ভরে ওঠে, সেই সাথে কৃষাণ-কৃষাণীর মনটাও সাফল্যে ভরে ওঠে। তারা স্বপ্ন দেখে- ‘বছরটা এবার সুখেই যাবে।’ দিনের প্রথম ভাগ জমিতে ধানকাটা হয় এবং বিকালে তা পা চালানো থ্রেসার দিয়েমাড়াই করা হয়। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কৃষকের শ্রম একটু লাঘবের পথে। শ্রমিকরা ধানমাড়াই করে আরগলা ছেড়ে গান ধরে। মাঝে মাঝে সৃষ্টিকর্তার নামে জয়োধ্বনি দিয়ে আশ^স্ততা প্রকাশ করে। ক্লান্ত শরীরে যখন দুর্দান্ত ঘাম ঝরে, তখন তারা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে। শরীরের ক্লান্তি দূরীকরণে কাঁচা আম মাখানো খায়, বেলের শরবত খায় অথবা টকের আচার খায়। ধান মাড়ানোর পর ধান ও পোয়াল রোদে শুকানো হয়। সবাই মিলে ধান বাতাসে উড়িয়ে গুদামজাত ও বাজারজাত করে। সারা বছরের আহারের জন্য ধানসিদ্ধ করতে চাড়িতে ভিজিয়ে রাখে। শেষ রাতে উঠে তা সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। তারপর চাল বানানোর মধ্য দিয়ে কৃষকদের ধানের আবাদ নেওয়া শেষের দিকে চলে আসে। তাও শেষ হয় না। পোয়াল পালা দেওয়ার দিন ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করে তবেই না ধানের আবাদের দিনগুলো শেষ হয়। অপর দিকে অন্যজেলায় থেকে আসা মহিষের গারোয়ানরা গাড়ি ভর্তি ধান নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করে। তাদের প্রত্যাশা,  ‘আমরা আগামী বছর আবার আসব।’

চলন বিলের মানুষের জীবন- জীবিকা ভারি বৈচিত্র্যময়। যাদের কৃষি জমি আছে, তারা কৃষি কাজ করে। কিন্তু যাদের বসত বাড়ি ছাড়া অন্য জমিজমা নাই তারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কেউ নদীতে নৌকা চালায়, কেউ বাজারে দোকানদারী করে, কেউ পরিবহন শ্রমিকসহ নানাবিধও পেশায় নিয়োজিত। বিভিন্ন পেশার সাথে সম্পৃক্ত থাকার মধ্য দিয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা বজায় রেখে চলেছে। সামাজিকতার স্পর্শে সবাই যেন আন্তরিক। এ অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনে তার উৎকৃষ্ট নমুনা পাওয়া যায়। পরিবার স্বচ্ছল হলে প্রতিবেশি কেউই যেন দাওয়াত থেকে বাদ পরেনা। ধুমধাম করে সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়। এলাকার মধ্যে বিয়ের আয়োজন হলে অনেকে গরুরগাড়ি, অনেকে স্যালো-নৌকা ব্যবহার করে থাকে। গান-বাজনায় বিয়ে বাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। আনন্দ উদযাপনে চলন বিলবাসীর জুড়িনাই। বিভিন্ন মেলা, নৌকা বাইচ, ঘৌড় দৌড়,পুজা-পার্বন ও খেলাধুলার আয়োজন যেন সকলের স্বচ্ছ বিনোদনের মাধ্যম। এসবের মধ্য দিয়ে চলন বিলের মানুষ তাদের অবসর যাপনকে প্রাণবন্ত করে রাখে।

চলন বিলাঞ্চলে উচ্চ ধনী যেমন রয়েছে, তেমনি দারিদ্রতা-ও রয়েছে। ঘর বাড়ির দিকে নজর দিলে তার প্রমাণ মেলে। কেউ কেউ ইটের দালান তুলেছে, কেউ কেউ দামিটিনের ঘর তুলেছে। দরিদ্ররা ছন বনের ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক সময় তারা জীবন জীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়। কিন্তু চলন বিলের মত অনুকূল পরিবেশনা থাকায় তারা আবার নাড়ির টানে ফিরে যায়। তখন তাদের মনে বিশ^াস জাগে, ‘শরীর সুস্থ থাকলে এলাকাতেই ভাতের অভাব হবে না।’ যেহেতু চলন বিলে শ্রমের বৈচিত্র্যতা রয়েছে, সেহেতু দরিদ্রের কষাঘাত থেকে পরিত্রাণপাওয়া দুরুহকিছু নয়। তবে সকলেই ভাগোন্নয়নের চেষ্টা চালায়, অনেক সময় পারিপাশির্^ক নানাকারণে জীবন যুদ্ধে হেরে যেতে হয়। এটাই বাস্তবতা। চলন বিলের মানুষ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন শিক্ষিত হওয়ারও পথে। চলন বিলের অনেক গ্রাম আছে যেখানে শত ভাগ লোক শিক্ষিত হয়েও কৃষিকাজ করে। চাকরির পেছনে না ছুটে পৌত্তিক সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা এখন ভাগ্য গড়ার দিকে। এ অঞ্চলের অনেক কৃষকের সন্তানরা আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় চাকরির পদে রয়েছে। অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি, এমপি-মন্ত্রী রয়েছে। তারা সবাই গর্ব করে বলেন, ‘আমি চলন বিলের মানুষ, আমি একজন কৃষকের সন্তান’।

পরিশেষে বলা যেতে পারে, চলনবিলাঞ্চল যেমন কৃষিজ, মৎসজ উপযোগী এলাকা, তেমনি এলাকটি মানব সভ্যেও জায়গা। মানুষে মানুষে বন্ধন এ এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য ভাল দিক। হানাহানি নয়, সম্প্রতির বন্ধনে সবাই যেন জীবনকে চলন বিলের ¯্রােতের মত করে বাইয়ে চলেছে। নানা প্রতিকুল তাকে বির্সজন দিয়ে সভ্য জাতি হিসাবে বছর বছর ধওে চলন বিল বাসী জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। আমি চলন বিলের মানুষ হয়ে ভীষণ গর্বিত। আমি আমার চলন বিলকে হৃদয় থেকে ভালবাসি।