চিনের মরমী কবি : বেই দাও
চিনের মরমী কবি
বেই দাও
অনুবাদ : আকিব শিকদার
বেই দাও একজন নির্জনতাপ্রিয় কবি। চিনের যে ক’জন কবি কবিতায় মরমীবাদ আগলে রেখেছেন, কবি বেই দাও তাদের মাঝে একজন। বেই দাওকে বলা হয় রহস্যবাদী কবি।
বেই দাও শব্দটির অন্য উচ্চারণ “পেই তাও” এবং শব্দটির অর্থ “উত্তরের দ্বীপ”। কবির জন্ম ১৯৪৯ সালের ২ আগস্ট বেইজিং এ হলেও কবির শিকড়টি চিনের উত্তরের একটি দ্বীপে প্রোথিত। বেই দাও এর প্রকৃত নাম ঝাও ঝোনকাই। কবি নির্জনতা পছন্দ করেন বলেই হয়তো ‘বেই দাও’ ছদ্মনামটি বেছে নিয়েছিলেন। মরমী এ কবি চিনের লোকদের হৃদয়ে হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন।
সময়ের গোলাপ
যখন দারোয়ান নিদ্রিত থাকে ফটকে
আর তোমরা দল বেঁধে ঝড়ের সাথে বাড়ি ফিরে আসো
এই যে আলিঙ্গনে চলার বয়স- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন পাখিদের চলাচল আকাশকে সাজায়
আর তোমরা পেছনে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখো
এই যে অন্তর্ধানের মাঝে প্রত্যক্ষ- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন তলোয়ার বেঁকে যায় ডুবো জলে
আর তোমরা ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে তোলো বাঁশিতে সুর
এই যে বাঁধাবিঘেœ সজোর আর্তনাদ- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন কলম আঁকে দিগন্তের রেখা
আর তোমরা প্রাচ্যের ঘণ্টাধ্বনীতে বিস্ময়ে জেগে ওঠো
এই যে ধ্বনির অনুরণনে কম্পন- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
মনের আয়নাতে বিম্বিত যে-কোনও মুহূর্ত
যা পৌঁছে দিতে পারে পুনর্জন্মের দরজায়
খুলে দিতে পারে সাগরের কপাট- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
ফিরে আসা ধ্বণী
আকাশের পাখিগুলো সোনালী আলোতে উড়ে
ফিরে এসে বসে পাহাড়ি গাছের ডালে
রাতের ফানসগুলো নিভে গিয়ে
পরে যায় মাটিতে।
আমাদের ডাক, হে প্রভু, ফিরে যায় তোমার কানে।
আমাদের চিৎকার পাহারে সাগরে নদীতে
কত ধ্বণী প্রতিধ্বণী হয়ে ফিরে আসে পুণরায়।
হে প্রভু, তোমার গোপন সুর ফিরে যায় তোমার কানে।
জানালার ওপাশে বিকেল...
জানালার ওপাশে বিকেল...
সৈয়দ নূরুল আলম
দিনের আলো মরে এসেছে। একটু পরে জানালার ওপাশে বিকেল নামবে। এইমাত্র রুবী রুম থেকে বের হয়ে গেল। ওকে হাসান আজ আপনি থেকে তুমি বলেছে। একত্রে বসে দু’জনে ড্রিং করেছে। শূন্য দূরত্বে এসেছে কিনা হাসান তা মনে করতে পারছে না। প্রথম দিন, বে-হিসেবি হয়ে ও একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিল।
ইদানিং মেয়েরা অফিসে নানা কিছু বিক্রয় করতে নিয়ে আসে। কখনও মোটা মোটা দেশি-বিদেশি বই, কখনও কসমেটিক্স। কখনও বা শাড়ি-থ্রি পিচ। অফিসের মেয়ে কলিগরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এসব কিনে থাকে। ভাসমান বেঁচা-কেনা। সো-রুমের দরকার হয় না। কর্মচারি নেই। ভ্যাট-টেক্স দিতে হয় না। স্বাভাবিক ভাবে এসব জিনিসের দাম কিছুটা কম থাকে। এতে করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের লাভ।
বনানী পনের নম্বর রোডে টাচ এন্ড ফেয়ারের অফিস। এরা বিভিন্ন ধরনের প্রশাধনী সামগ্রী তৈরি করে। বছর পাঁচেকের মধ্যে ভালো একটা মার্কেট পেয়েছে। প্রথমে একতলা-দোতলা মিলে অফিস ছিল। এখন তিনতলাটাও অফিস হিসেবে নিয়েছে। হাসান ভাবছে, আগামী দু’বছরের মধ্যে পাঁচতলা পুরো বাড়িটা-ই অফিস হিসেবে নিতে পারবে।
হাসান এ অফিসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। ডাইরেক্টর এডমিন ও ফাইন্যান্স। ওর ওপরে আছে মল্লিক সাহেব। এ কোম্পানীর চেয়ারম্যান। এ দু’জনই কোম্পানীকে টেনেটুনে, জল হাওয়া দিয়ে বড় করেছে।
গুলশান, হাসানের রুমে এসে বলে, স্যার ইনি রুবী আপা। শাড়ি বিক্রি করেন। এ শাড়িটা ভাবীর জন্য নিতে পারেন। মিতু ভাবী তো সুন্দর। মানাবে ভালো।
হাসান শাড়ি চেনে না। না সুতো, না রঙ। কিনতে কিনতে মানুষ এসব চিনে ফেলে। কিন্তু হাসান বিয়ের আগে শাড়ির মার্কেটে কখনও যায়নি। এমনকি বিয়ের পরেও। যা কেনার মিতু নিজেই কেনে। মার্কেটে যেয়ে হাসান শুধু পাহাড়াদার হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
গুলশান শাড়িটা ভালো বলাতে হাসান আস্থা পায়। বলে, তুমি যখন বলছো, দিয়ে দাও।
রুবী একটা প্যাকেটে শাড়িটা ভরে, হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ধন্যবাদ স্যার।
হাসান বাড়ি ফিরে মিতুকে শাড়িটা দেখালে মিতু খুব খুশি হয় এবং বলে, এককাজ করলে কেমন হয়, আমি তো বাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার সময় মা-ভাবী-মিনু ওদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাই। তুমি এ শাড়িটা অনেক কমে পেয়েছ। এটা বসুন্ধরা মার্কেটে তিন হাজার-সাড়েতিন হাজারের কমে পাবে না।
‘ঠিক আছে, গুলশানকে বলব।’
‘খালি গুলশান-গুলশান করো কেন?’ ওকে কী দরকার। রুবী না কি যেন মেয়েটার নাম বললে, ওকে বাসায় আসতে বলো। দেখে শুনে পছন্দ করি।’
হাসানের প্রথম ইস্যু। প্রথমবার মেয়েরা মায়ের কাছে যায়। তাই মিতুও দিনাজপুর মায়ের কাছে যাবে।
হাসান বলে, ঠিক আছে, মেয়েটাকে আগামী শুক্রবার আসতে বলব।
‘শুক্রবার কেন? তার আগে আসতে বলো। আমি তো শনিবার চলে যাব। আর শোন অনেকগুলো শাড়ি আনতে বলবা। ওর মধ্য থেকে কয়েকটা বেছে নেব।’
‘শুক্রবারই আসতে বলি। শুক্রবার ছাড়া তো আমি বাসায় থাকি না।’
পরের দিন হাসান অফিসে যেয়ে গুলশানকে শাড়ি নেয়ার কথা বললে, গুলশান রুবীকে ফোন করে বলে, শুক্রবার বেশ কিছু শাড়ি নিয়ে তোমাকে স্যারের বাসায় যেতে বলেছেন। ভাবি নিজে পছন্দ করবেন। স্যারের বাসার ঠিকানা আমি তোমাকে টেক্স করে দিচ্ছি।
‘ধন্যবাদ গুলশান আপা। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করছেন। ওদিন স্যারের কাছে না নিয়ে গেলে, স্ট্রং রিকোমেন্ড না করলে, স্যার শাড়ি কিনতেন? রুবী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে।
‘আমি আর কী করলাম! এমনিতে তোমার ব্যবহার ভালো। অল্পতে সবাই গলে যায়। তোমার জন্য শুভকামনা।’
‘ওকে আপা। ভালো থাকবেন।’
কিন্তু শুক্রবার যাওয়ার কথা থাকলেও রুবী ওদিন হাসানের বাসায় যায় না। কোন সংবাদও দেয় না।
মিতু কুমড়োর মতো মুখ করে বলে, কই তোমার মেয়েটা তো এলো না। এখন! আমি বাড়িতে মা- বোনদের বলে রেখেছিÑ তোমাদের জন্য শাড়ি নিয়ে আসছি।
এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান কিছুই বলতে পারে না। মেয়েটি এমন করবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিল।
মিতু ফোসফাস করতে থাকে।
হাসান দুখিদুখি মুখ করে বলে, বুঝতে পারলাম না। মেয়েটার কী হলো। ফোন করব তারও উপায় নেই। ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। ঠিক আছে, আমি যখন সামনে মাসে তোমাকে দেখতে যাব, তখন নিয়ে যাব।
মিতু হ্যাঁ-না কিছু বলে না। এ সময় রাগ-অভিমান করে শরীরের ওপর চাপ নিতে চায় না মিতু। তাই মন খারাপ করে, পরের দিন বাবার বাড়ি চলে যায়।
ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। হাসান কমলাপুর ষ্টেশনে যেয়ে মিতুকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে। হাসান দিনাজপুর পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল।
মিতু বলেছে, আমি একা যেতে পারব। বাবা তো ষ্টেশনে এসে নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া তুমি তো ঘনঘন ছুটি পাবে না। দু’সপ্তাহ পরে আমাকে দেখতে যেতে চেয়েছ না?
তবু হাসানের মন খারাপ হয়। এ সময়ে একা একা যাওয়া! যদিও এখন তিন মাস বাকি।
যত সময় ট্রেন না ছাড়ে, হাসান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন চলা শুরু করলে হাত নেড়ে মিতুকে বিদায় জানায়।
হাসানের অফিস সকাল ন’টায়। মিতুকে সাতটায় ট্রেনে তুলে দিয়ে হাসান আর বাসায় যায় না। সরাসরি অফিসে চলে আসে। হাসান মাঝে মধ্যে বেশ আগে অফিসে চলে আসে। এসে আগেরদিনের জমা ফাইলগুলো ছেড়ে দেয়। গতকালকের দু’টো ফাইল টেবলে পড়ে আছে কিন্তু ফাইল দু’টো দেখতে হাসানের মন চাচ্ছে না। ভেতরটা গজ গজ করছে। কতক্ষণে গুলশান অফিসে আসবে।
এ সময় পিয়ন হারুন এসে বলে, স্যার কফি দেব?
‘না।’
‘না’ শব্দে বোম্বাই মরিচের ঝাঁঝ ছিল, সেটা বুঝতে পেরে হারুন আর কোনো কথা বলে না। ওদিনের দু’টো নিউজ পেপার টেবলে রেখে রুম থেকে বের হতে যায়।
হাসান হারুনকে ডেকে বলে, এই শোন, গুলশান ম্যাডাম এসেছেন?
‘জ্বি স্যার।’
‘ডাকো তাকে।’
হারুন গুলশান ম্যাডামের রুমে যেয়ে বলে, ম্যাডাম, হাসান স্যার মনে হয় খুব রেগে আছেন। আপনাকে ডাকে।
গুলশান ভয়ে ভয়ে হাসান স্যারের রুমে ঢুকে বলে, গুড মর্নিং স্যার।
‘গুড মর্নিং। ওই মেয়েটাকে বলেছিলেন, শুক্রবার বাসায় আসতে?’
‘কেন যায়নি স্যার! আমি তো বলেছিলাম।’
‘বাসার এডড্রেস বলেছিলেন?’
‘জ্বি স্যার। এডড্রেস টেক্স করে দিয়েছিলাম।’
‘ও তো যায়নি। তোমাদের ম্যাডাম তো খুব রাগ করেছে। বাবার বাড়ি খালি হাতে যেতে হলো। ভেবেছিল মা-বোনদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাবে।’
‘স্যার আমি এখনই রুবীকে ফোন দিচ্ছি।’
গুলশান রুম থেকে বের হয়ে রুবীকে ফোন দেয়। ফোনে উত্তর আসেÑ সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকবার ফোন দেয়। প্রতিবারই একইÑ সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গুলশান কাচুমাচু হয়ে, রুমে এসে বলে, স্যার রুবীকে ফোনে পাচ্ছি না। ফোন যাচ্ছে না।
‘লিভ দিস।’
‘স্যার আপনাকে কফি দিতে বলি?’
‘না। যান, কাজ করেন গিয়ে।’
গুলশান মন খারাপ করে রুম থেকে বের হয়ে আসে। হাসান স্যারের কাছ থেকে এধরণের ব্যবহার এই-ই প্রথম পেল।
শুক্রবার হাসানের বাসার ডোরবেল বাজলে, হাসান এসে দরজা খোলে। দরজায় রুবী দাঁড়িয়ে।
‘তুমি!’
হাসান রুবীকে না-চেনার ভান করে বলে।
‘স্যার আমি রুবী। ওই যে অফিসে ভাবির জন্য শাড়ি নিলেন।’
‘তো?’
‘গুলশান আপা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, আরও কয়েকটা শাড়ি নেবেন, তাইÑ’
‘ভেতরে আসুন।’
ভেতরে আসুন কথাটা এমন ঝাঁঝ মিশিয়ে হাসান বলে, তাতে রুবী বুঝে যায়, সামথিং রং।
রুবী ড্রয়িং রুমের এক কোনে যেয়ে ভেজা বেড়ালের মতো বসে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে পায়ের কাছে রাখে। দু’টো ব্যাগই বেশ ভারি। একটা কাধে, একটা হাতে নিয়ে রুবী সবসময় বেরোয়। এতেকরে কেউ বুঝতে পারে না, ও শাড়ি ফেরিকরে বিক্রয় করে।
হাসান নিজের রুমে চলে যায় এবং পাঁচ মিনিট পরে ফিরে আসে।
রুবী লক্ষ করে, দরজা খোলার সময় হাসান স্যারের গায়ে গেঞ্জি ছিল। চুল ছিল এলোমেলো। পড়নে ছিল লুঙ্গি। এখন একটা হাফসার্ট পড়ে, চুল আঁচড়িয়ে, লুঙ্গি পাল্টে, প্যান্ট পড়েছে।
রুবী ভেবেছিল, পোষাকের এ পরিবর্তনের সাথে সাথে, হাসান স্যারের ভেতরের রাগটাও পাল্টাবে। কিন্তু না। হাসান আগের শক্ত স্বরেই বলে, কবে আসবেন গুলশান বলেনি?
‘বলেছিল, শুক্রবার।’
‘তো?’
‘আজ তো শুক্রবার।’
‘শুক্রবার তো মাসে চারটে থাকে। বছরে থাকে অনেকগুলো।’
‘বুঝলাম না, স্যার।’
‘গত শুক্রবার আসার কথা বলেছিলাম।’
‘স্যার গুলশান ম্যাডাম তো নির্দিষ্ট করে বলেননি। শুধু বলেছেন, শুক্রবার দেখা করতে। বিশ্বাস না হয়, আমার ফোনে রেকর্ড করা আছে, শুনবেন স্যার?
‘দরকার হবে না। তবে যখন বলা হয় শুক্রবারের কথা, তখন পরের শুক্রবারকেই বুঝায়।’
‘স্যরি স্যার। আমি বুঝতে পারিনি। আমি আপার ফোন পেয়ে, আমাদের বাড়ি রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম,আরও ভালো ভালো কিছু শাড়ি আনতে।’
‘তুমি ফোনও ধরোনি।’
‘স্যার আমাদের বাড়ি রাজশাহী শহর থেকে অনেক ভেতরে। একটা অজপাড়াগাঁ। ওখানে প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি থাকে না। ফোনে চার্জ ছিল না।’
‘বুঝলাম। কিন্তু যিনি শাড়ি নেবেন, তিনি তো চলে গেছেন।’
‘কোথায় গেছেন স্যার? আসবেন না?’
হাসান একথার আর উত্তর দেয় না। বলে, আজ তুমি ফিরে যাও। তোমার ফোন নম্বর রেখে যাও। প্রয়োজন মতো আমি ডাকব।’
একথা শুনে রুবীর ভেতরটা ছেৎ করে ওঠে। কতো আশা নিয়ে এসেছে, সামনে ওর থার্ড সেমিস্টারের ফি জমা দিতে হবে। কয়েকটা শাড়ি বিক্রয় করতে পারলে, বাকিটা টিউশন ফি মিলে হয়ে যেত।
তবে আশার আলো, হাসান স্যার ওকে ‘তুমি’ বলেছে। নিশ্চয় আগের রাগ আর পুষে রাখেনি।
তাই ভেবে রুবী সাহস নিয়ে বলে, স্যার নতুন কিছু শাড়ি এনেছি, আপনি একটু দেখেন।
‘আমি তো শাড়ির কিছু বুঝি না।’
‘স্যার ম্যাডাম কি, ভাই বাড়ি গিয়েছেন? কবে আসবেন?’
‘হ্যাঁ। ওদের বাড়ি গিয়েছে। প্রথম ইস্যু। আসতে বেশ দেরি হবে।’
দেরি হবে শুনে রুবী দ্বিতীয় বারের মতো ধাক্কা খায়। ও নিজের বুকের মধ্যে ধক ধক ঢেঁকির পাড় শুনতে পায়। ওর সব যোগবিয়োগ এলোমেলো হয়ে যায়।
রুবী শেষ চেষ্টা করে বলে, স্যার এক কাজ করলে হয় না, ম্যাডামকে ভিডিও-তে শাড়ি দেখান।
‘না, সেটার আর দরকার নেই। আমি সামনের মাসে সতের তারিখ ওদের ওখানে যাব। তার আগে একদিন আসো। এর মধ্যে আমি একদিন মিতুর সাথে কথা বলে নেবো।’
‘কিছু মনে করবেন না স্যার। তার আগে মানে, ডেটটা যদি নির্দিষ্ট করে বলতেন। না হলে, আজকের মতো ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।’
‘সতের তারিখের আগে দশ তারিখ, শুক্রবার।’
‘ওকে স্যার। তবে আজ একটু যদি দেখতেন। কষ্ট করে এসেছি, আমার ভালো লাগত। আর ম্যাডামকে কিছু বর্ণনাও দিতে পারতেন।’
কিছু সময় থেমে রুবী আবার বলে, স্যার আমি আরেকটা জিনিস বিক্রি করি।
‘কী?’
‘অভয় দিলে বলতে পারি।’
‘আমি কি পুলিশ, না র্যাব?’
‘না। আপনি পছন্দ করেন, কী করেন না, তাই ভাবছি।
‘আমি তো অভয় দিয়েছি।’
রুবী আর কোনো কথা না বলে, ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে,টি টেবলের ওপর রেখে বলে, অনেকে চায়। তাই মাঝে মধ্যে সাথে রাখি।
‘আমি কখনও খাইনি। অভিজ্ঞতা নেই।’
‘তা হলে রেখে দেই।’
‘তাই করো।’
রুবী কোনো দ্বিরুক্তি না করে, যেখানে বোতলটা ছিল, সেখানে রেখে দেয়।
‘স্যার, আজ উঠি তা হলে।’
‘বোতলটা নিতে পারলাম না বলে, মন খারাপ করেছো?’
‘না স্যার। খুশি হয়েছি। আমারই ভুল হয়েছে। আপনার অনুমতি ছাড়া আনা ঠিক হয়নি।’
‘তোমার তো এটা ব্যবসা। নানা ধরণের পন্য সাথে রাখতেই পারো।’
রুবী হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, স্যার আপনি একদিনের জন্যও খাননি?
‘বললাম তো। আমি ওসবের গন্ধ শুকতে পারি না।’
‘স্যার এটা হোয়াইট লেডিস ওয়াইন। খুব সফট। একবার ঠোঁট ছোঁয়াতে পারেন।’
‘না। ওকে।’
‘উঠি স্যার।’
‘অনেক দূর থেকে এসেছ। এক কাপ কফি খেয়ে যাও।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি কফি খাই না।’
‘তা হলে অন্য কী খাবে?’
‘কিচ্ছু না।’
তুমি বসো, আমি দেখি, এই বলে হাসান ভেতরে যেয়ে কিছু সময় পর দু’টো প্লেট হাতে করে ফিরে আসে। একটায় দু’পিচ কেক। অন্যটায় কয়েকটা চকলেট। প্লেটটা রুবীর সামনে টেবলে রাখতে রাখতে হাসান বলে, কোনো বাসা থেকে খালি মুখে যেতে নেই।
ধন্যবাদ স্যার। না ভাবলাম বাসায় ম্যাডাম নেই। আপনার কষ্ট হবে। রুবী ওড়নার আঁচল খুটতে খুটতে বলে।
কষ্টের অপর নামই তো জীবন। এই যে তুমি কষ্ট করছো না? আচ্ছা, গুলশান বলছিলÑতুমি নিজের আয় দিয়ে পড়াশুনা করছ। একটা ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছ।
রুবী হাসানের একথার কোনো জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে থাকে।
আরে লজ্জা কিসের! কোনো কাজকেই হালকা করে বা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কাজ তো কাজই। তাছাড়া তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়াশুনা করছ, এটাতে ভাববার কী আছে। আরও মুখ উঁচু করে বলবে নিজের পড়ার খরচ নিজে যোগার করছ।
হাসানের একথায় রুবী মুখ তুলে বলে, স্যার আমার বাবা তো কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেন না। প্রতি মাসে আমার মামা কিছু পাঠান আর আমাদের স্কুলের হেড মাষ্টার স্যার কিছু পাঠান। বাকিটা আমার টিউশনি আর এই শাড়িটাড়ি বিক্রি করে যা হয়।
রুবীর একথা শুনে হাসানের মন নরম হয়। হাসান বলে, শোন, কখনও মন খারাপ করবে না। কোন কাজই ছোট না। শোন তয়, আমি আমার স্কুল-কলেজ জীবনে প্রায় ছ’বছর বাসায় বাসায় পেপার বিলি করেছি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, বাসায় বাসায় পেপার পৌঁছে দিয়ে, তারপর ক্লাসে যেতাম। এতে আমার কোনো লজ্জা ছিল না। এখনও নেই। আমার বাবাও তোমার বাবার মতো গরীব ছিলেন। আমার লেখাপড়ার খরচ দিতে পারতেন না।
হাসানের একথা শোনার পর রুবীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে, স্যার ওই বয়সে আপনি জীবনকে বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আজ এতবড় হতে পেরেছেন।
‘ঠিক তাই। তুমিও একদিন বড় হবে।’
একথা বলে হাসান কী যেন ভাবে। কান চুলকায়। তারপর বলে, ঠিক আছে শাড়িগুলো দেখাতে চেয়েছিলে, দেখাও। আর তোমার পছন্দ মতো পাঁচটা শাড়ি রেখে যাও। আমি তোমাকে চেক লিখে দিচ্ছি।
হাসানের একথা শুনে রুবীর চোখ-মুখ সকালের কাঁচা রোদের মতো ঝলমল করে ওঠে। ও খাওয়া রেখে ব্যাগ খুলতে যায়।
হাসান বাঁধা দিয়ে বলে, আরে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আগে কেক খেয়ে নাও। আর চকলেটগুলো পকেটে ঢোকাও। রুমমেটদের দিও।
লজ্জা ও আনন্দ মিশ্রিত একটা আদল ফুটে ওঠে রুবীর সাড়া মুখে। রুবী বুঝতে পারে, স্যারের এ ধরণের একটা অতীত আছে দেখে, বিষয়টাকে এতসহজ, এতআন্তরিক ভাবে নিয়েছেন।
রুবী একটা কেকের অর্ধেকটা খেয়ে বলে, স্যার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তবে আমাকে যদি বানাতে দেন, তবে।
‘তুমি যে বললে কফি খাও না।’
‘একেবারে খাই না বললে, ভুল বলা হবে। মানে, পরিবেশ পরিস্থিতি ফেবারে থাকলে মাঝে মধ্যে খাই। তখন খাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক বেড়ে যায়। দমিয়ে রাখতে পারি না।’
‘তা হলে বলতে চাচ্ছো, পরিবেশ এখন তোমার ফেবারে?’
রুবী একথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলে,স্যার, যতই সময় যাচ্ছে, যতই আপনাকে দেখছি, ততই আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে।
হাসান রুবীর একথার কোনো উত্তর দেয় না। দেয় না মানে, কী বলবে খুঁজে পায় না। কয়েক সেকেন্ড দু’জনই নিরব থাকে। পরে নিরবতা ভেঙে রুবী বলে, স্যার কফি বানানোর অনুমতি দিলেন তো?
‘যাও, কিচেনে সব কিছু আছে। কফি এখন আমি নিজেই বানিয়ে খাই। মিতু যাওয়ার সময়, কাজের মেয়ে হাসিকে ছুটি দিয়ে গেছে। আমি একা থাকবÑতাই।
একথা বলে হাসান একটু মৃদু হাসে।
কথার অর্থ রুবী বুঝতে পেরে, রুবীও চোরা হাসি হাসতে হাসতে রান্না ঘরে যায়। চার মিনিটের মাথায় রুবী এককাপ কফি বানিয়ে এনে হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। হাসান তখন একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে কফির কাপটা নিয়ে বলে, তোমার কফি?
‘স্যার এককাপই বানিয়েছি।’
‘কেন?’
‘স্যার, আপনার সামনে বসে কফি খেতে আমি পারব না, তাই শুধু আপনার জন্য বানিয়েছি।’
‘আমার সাথে বসে কফি খেতে লজ্জা কিসের! তোমাকে তো বললাম। তুমিও ব্যবসা করছো। আমিও ব্যবসা করছি। শুধু তোমারটা একটু ছোট, আমারটা একটু বড়, এই যা পার্থক্য।
হাসান একটু থেমে, কফির কাপে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, ঠিক আছে, কফি না খাও, তোমার ব্যাগে যে লেডিস ওয়াইন আছে, ওটা বের করো। আমরা দু’জনে একটু খাই।
রুবী হাসানের কথা শুনে, হা করে হাসানের দিকে চেয়ে থাকে। চট করে ব্যাগটা খুলতে পারে না। ওর হাত কাঁপতে থাকে।
পদাবলি : ০১
শুধু তোমাকে ভালোবাসি
রৌদ্র রাকিব
বহুবার বলেছি; বহুকাল অপেক্ষা করেছি;
বহুদিন দেখেছি; বহুবার কতকথা শুনেছি;
শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে।
তবুও ভালো আছি; তবুও বেঁচে আছি;
তবুও হাসিখুশি আছি; তবুও সুখে আছি;
শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
তুমি চলে যাও- তুমি ভুলে যাও!!
তুমি কিছু রেখে যাও- তুমি হারিয়ে যাও-
শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
চলে যাবো
মাসুদ পারভেজ
তোমাদের এই ঝঞ্ঝাট জমকালো কৃত্তিম কোলাহলপূর্ণ শহর ছেড়ে চলে যাবো,
চলে যাবো তোমাদের দেয়া কবি নামের এক অভিশাপ নিয়ে
জানো তো, কঠিন দুঃখবোধ না থাকলে নাকি কবি হওয়া যায় না,
আমি আজীবন সে প্রয়াস চালিয়ে যাবো।
যদিও তোমাদের প্রতি অনেক অভিযোগ আছে আমার, অনেক কথা বলবার আছে;
বলবার আছে- তোমাদের শহরে পাখিদের ঠাঁই নেই, বৃক্ষ নেই, সহস্র মানুষের ভেতর একটিও মানুষ নেই।
সুন্দরী অনেক ললনা আছে একটিও প্রেমিকা নেই,
অনেক অনেক প্রেমিকা আছে একটিও প্রেম নেই।
অনেক পুরুষ আছে কিন্ত একজনও বিশ্বস্ত সঙ্গী নয়।
তোমাদের শহরে সবুজ বিছানি নেই আছে চকচকে মার্বেল পাথরের অহংকার।
পুকুরের বা নদীর ঘোলা পানি নেই আছে পিত্তরংয়ে সুইমিংপুল।
তোমাদের দালানগুলো আকাশ দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা এখন চরমে।
বলবার আছে তোমাদের শহরে গণহারে মানুষ মেরে গণতন্ত্রের চর্চা হয়
নারীর যৌনতার আবাদ করে নারীবাদের চর্চা হয়।
বেতনধারী স্বীকৃত বুদ্ধিজীবীদের পানশালা হয় রাজদরবারে।
চলে যাবো এই কাগজে প্লাস্টিকে মোড়ানো শৌপিচের অভিনয় ছেড়ে।
তোমাদের কুকুরগুলো নাকি নবজাত মনিষ্যপুত্রেরও বেশি আদর অভিলাষ নিয়ে লালিত হয়।
তোমাদের অভিজাত শোবার ঘরে, বারান্দায় কুকুরের আশ্রয় থাকতে পারে একজন কবির নয়।
তোমাদের দালানের ছাদে বায়োপ্ল্যাগে মৎসকুলের অভিশাপ নিয়ে আমি এক মুহুর্তও থাকতে চাই না।
আমি সবুজ পাতার ফাঁকে বেরিয়ে আসা একমুঠো রোদ্দুরের জন্য চলে যাবো,
ঝিলে ফোটা রক্তকমলের পাশে মিটিমিটিয়ে হাসা একটুকরো চাঁদের জন্য চলে যাবো।
চলে যাবো ছাগলছানার তিড়িং-বিড়িং নাচের খোঁজে অথবা গরু বাছুরের নিষ্পাপ চাহনির জন্য।
নীল আকাশের তলে দলে দলে পাখির ডানা মেলা সুন্দরের জন্য
চলে যাবো সবুজের আঁচল ছিঁড়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নদীর জন্য।
চলে যাবো সোঁদামাটি, পলিমাটির গন্ধে ভরা মানুষের কাছে,
চলে যাবো একটি স্নিগ্ধ বিকেল এর কাছে
চলে যাবো শিশির ভেজা একটি সকালের কাছে
চলে যাবো একটি সুন্দর নিশ্চুপ নিশ্চল নিষ্পাপ পৃথিবীর কাছে।
প্রেমিক বলতে এখনো তোমাকেই বুঝি
রফিকুল নাজিম
অনেকদিন হয় তোমার নাগাল পাই না
কই পালাইছো?
আমাদের এইদিকে কি আর আসো না?
কেরামতের টং দোকানের চায়ের তৃষ্ণা মিটে গেছে
তোমার রং চায়ের নেশাটা কেটে গেছে?
আজকাল কি তবে দুধ চায়ে ঠোঁট ভিজাও?
জানো?
এখনো সেই শালিকটা বিকেলে আমার বারান্দায় আসে,
রেলিংয়ে বসে। তারপর আমার চোখে মায়া মেখে দেয়
আমি এটা ওটা খেতে দেই,
শালিকটা ঠোঁট বাড়িয়ে খায়।
আহা! উড়াল পাখিটাও আমার পোষ মেনেছে;
কেবল তোমাকে আমার বশে আনতে পারিনা,
কেবল তুমি আসো না,
কেন্ আসো না, নাগর?
অথচ আমি নিয়ম করে বারান্দায় আসি
আড়চোখে ইতিউতি তোমাকে খুঁজি
তবুও কোত্থাও তোমাকে আর পাই না।
আচ্ছা-তুমি কি এখন অন্য মহল্লায় যাও
হাতে ফুল নিয়া কি অন্য গলিতে দাঁড়াও
অন্য কোনো বারান্দার দিকে বিড়ালের মত মুখ দাও?
চুকচুক করো?
কার জানালার পর্দা গলিয়ে অন্দরমহলে চোখ বাড়াও?
অথচ আমার চোখ কেবলই তোমাকে খুঁজে...
আকুলিবিকুলি মনটা তোমাকেই প্রেমিক মানে;
অন্য কোনো সিটি প্রেমিক সে খোঁজে না
প্রেমিক বলতে এখনো সে শুধু তোমাকেই বুঝে।
স্বকীয়তা হারিয়ে
জহির খান
ঝড়ের বেগে চলছে সময়
অসমাপ্ত গল্পের পিছনে
তবুও নিষ্ঠুর গল্পের নায়ক
দেখার চেষ্টাই করলো না তোমাকে!
পদাবলি : ০২
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর
রিয়া সাহা অর্পা
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর কিনেছি তো জন্মতেই,
ধরা যখন খুব ক্লান্ত নিয়ে আমায়,
ঠাঁই সে ঘরেতেই,
অতলে একলা কায়া আমার ,
ভবঘুরে আত্মা খুঁজে চেনাজন না পায় ।
নাই প্রদীপ,
তো অন্ধকার-ই বা কই !
চিৎকার নেই কাঠের বাক্সের বাইরে,
অন্দরে নিস্তব্ধ সংসার।
আধভেজা হয় না মাটি ,
আসে না দ্বারে কেও !
আসে তো অতীত !!
ডাকে আমারে,
ফুসরত নাই একলা সঙ্গের !
দেখো তবে সঙ্গ দেয় আজ কে তোমারে !!
এলোমেলো চুল, ফ্যাকাশে দাগ
মা দেখলে শাসনে টেনে নিতো আঁচলে।
অচেতন মন,
কোথায় গেল শত নিয়ম !
বাবা থাকলে রাগ করতো বেশ করে।
প্রিয় যদি আজ কথা মিটাতে আসেই-বা,
গভীর অতলে দেখেও দেখে না আমারে।
নিসর্গ ঘরখানা আঁকড়ে ধরে বলে,
শান্তির ঘুম দাও, রজনী !
কায়াও যে থেকে যাবে ধরণীর-ই।
অনন্তকাল নয় সকল তা তো তুমি জানতে !
আপন আমার,
নিঃশেষ চিহ্ন অক্ত ,
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর !!!
আমার অজানা অন্বয় !!
ধাওয়া
সুজন আরিফ
অঘোষিত সিস্টেম দাঁড়িয়ে যায়
কার ইশারায়?
পুঁজির মিছিল বের করে
কেউ লুকিয়ে কেউবা বন্দনায়।
শতভাগ জয় নিয়ে ঘরে ফিরে ঈশ্বর
নেই কোনো হাওয়া
আহা! মানুষ সন্ধ্যার মত মরে যায়
খেয়ে রাত্রির ধাওয়া।
উদয়াস্ত
সেলিম খান
সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আমিও যাবো।
শুধু সময়ের অপেক্ষা।
পাখিরা সারাদিন ঘুরে ফিরে একসময় তার আপন নীড়ে ফিরে যায়,
শুধু জেগে থাকে নিশাচররা।
আমিও আমার আপন নীড়ে যাবো,
অবশ্যই যাবো, সময়টা আসতে দেও।
তখন হয়তো তোমার অপেক্ষা করে,
কফির মগটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করা হবে না।
কে জানে ওখানে কফির ব্যবস্থা আছে কিনা?
থাকতে পারে, জানা নেই।
আমি চলে গেলে পৃথিবীর ভার কমবে না হয়তো,
আমার জায়গা দখল করবে অন্য কেউ।
হয়তো পৃথিবীর ভার কমার নয়।
আমি অস্ত যাবো নিশ্চিত, আজ হোক, কাল হোক, কিংবা পরশু।
এসেছে নতুন সূর্য জায়গার অভাবে করছে আনছান,
আমি বরং অস্ত যায় বাঁচুক নতুন প্রাণ।
ব্যবধান ভুলে হৃদয়ের চাওয়া
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ
অনেক ব্যবধান মধ্যিখানে..
তুমি অনেক দূরে নাগালের বাইরে
কুয়াশাবেদে মেঘপুঞ্জ সপ্তআকাশ ওপরে
তবু.. ডাকলেই যেন কাছে পাই
একান্ত নিভৃতে নিরবে কথোপকথনে।
প্রতিরাত তুমি খুব কাছাকাছি আছো..
ব্যবধান ভুলে হৃদয়ের চাওয়ায়। মন
থেকে মনের গভীরে...খুব কাছে।
রঙহীন মরিচীকা
রুদ্র সাহাদাৎ
মানুয়ের ভিড়ে থেকেও আজও মানুষ চিনি না
জীবন জীবন চিল্লাতে চিল্লাতে জীবনের অর্ধেকই কেটে গেলো অজান্তে কেউ জানে না
প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে দেখি রণক্ষেত্র, যে যার মতন গন্তব্যের সন্ধানে ছুটছে
মুখোশের মেলায় হাট বসে রঙিণ আয়োজন
মাঝেমধ্যে সব কিছু অচেনা লাগে ফ্যাকাশে চারিধার রঙহীন মরিচীকা
কেমন করে বেঁেচ থাকছি,কেউ জানে না ।
গল্পের শুরু এখানেই...
গল্পের শুরু এখানেই...
ইয়াকুব শাহরিয়ার
আজকে টিউশনিতে যাবো না। ভালো লাগছে না। ভাবি ফোন দিলেন। ভাবি মানে- স্টুডেন্টের মা। যে ছাত্রকে পড়াই তার মাকে ভাবি ডাকি। তিন বছর ধরে পড়াই। কেজি টু’তে পড়ে। ফোন পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরক্তির ছাপ মুখে নিয়ে উঠে যাই। বাসা থেকে বেড়িয়ে রিকশার অপেক্ষা করছি। অফিস থেকে ফোন এলো। সন্ধ্যায় বসের ফোন পেয়ে পিলেচমকে উঠার মতো অবস্থা। আরেকটা অফিসে চাকরি করি। আমার মূল পেশা চাকরি। টিউশনি না। ভাল লাগে তাই করি। দরকারি কাজে অফিসে যেতে হবে। অফিস আমার বাসা থেকে বেশ দূর না হওয়ায় হেঁটেই চলে গেলাম। একটা হিসাব বসকে বুঝিয়ে দিয়ে টিউশনিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
অফিস থেকে বের হতেই রিকশার ড্রাইভার একজন বলল- মামা কই যাবেন? রিকশা পেয়ে যাই। রিকশাতে চড়ে বসে টিউশনিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বাসায় ঢুকতেই দেখি আবির বসে পড়ছে। আবির আমার ছাত্রের নাম। তিন বছরে একদিনও দেখিনি আমি আসার আগে এভাবে পড়তে বসেছে। কিছুটা অবাক হলাম। আমি ঢুকতেই আবির বলল- গুড ইভেনিং স্যার। রিপ্লাই দিয়ে কিছু বলতে না বলতেই মনোযোগ অন্যরুমে গেলো। চিকন গলায় কে একজন বলছে- এমন টিচার বাবার জন্মেও দেখিনি। নিজের ইচ্ছা মতো আসেন। দায় দায়িত্ব বলতে কিছু নাই। কি দরকার উনাকে রাখার। দেশে আর টিচার নাই, নাকি? বলতে বলতে এদিকেই আসছে। কাছে এসে বলছে- আবির, আজ তোর বাবাকে বলবি টিচারকে...... বলতেই আমার সামনে এসে হাজির। হাতে হরলিক্সের গ্লাস। তবে তাতে হরলিক্স আছে বলে মনে হয় নি। কারণ আবির হরলিক্স খায় না। সে চা খায়।
আমাকে দেখে থমকে গেলো মেয়েটি। কোনো কথা নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হরলিক্সও দিচ্ছে না। আবির বললো- সোনামনি, দিবে? গ্লাসটা দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো। আমার চোখ ছানাভরা! চিপচিপা গড়নের আরো মেয়ে দেখেছি, এতো সুন্দরি দেখিনি। চমৎকার চোখ, মুখ, চুল আর কণ্ঠ। আমিও কিছু বলিনি। শুধু মুচকি হাসছিলাম। এতোক্ষণে বুঝে গেলাম যে, সে ভাবির বোন। মানে আবিরের খালা হয় সম্পর্কে। সোনামনি ডাকে আবির। অনেক প্রশংসা শুনেছি সোনামনির।
কিছুক্ষণ পড়িয়ে নিলাম আবিরকে। তার মা চা নিয়ে আসলেন। সাথে সোনামনি। আবিরের আম্মু হাসছেন। ভদ্র মহিলা খুব ফ্রিয়ার। ভাল। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন- ও হচ্ছে কুসুম। আমার ছোট বোন। এমসি কলেজে গনিতে অনার্স করছে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। তার কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। ও এরকমই। তিনি চলে গেলেন। কুসুম সরি বললো। বললাম- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আমু। কিসে পড়ছেন, সিলেটে কোথায় থাকা হয় এরকম কথায় কথায় অনেক কথা হলো। আবির আমার আর কুসুমের মুখের দিকে বার বার তাকাচ্ছিল আর হাসছিল।