হাওরপারের জীবন ও জীবীকা
ছবি : জি এম ফ্রাজের ।
সুনামগঞ্জ হাওরপারের জীবন ও জীবীকা
ওবায়দুল মুন্সী
কথিত আছে, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় ‘কালীদহ সাগর’ নামে বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তীতে ভূপ্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিম্ন সমতলভূমিতে পরিণত হয়, এই সমতলভূমিই এখন হাওর। হাওর শব্দটিও সাগর শব্দের অপভ্রংশ। সাগর থেকে সায়র, সায়র থেকে হাওর।
সুনামগঞ্জ জেলার মোট হাওর সংখ্যা প্রায় ৯৫টি । অপূর্ব সুন্দর এক জনপদের নাম হাওর! হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশ খুবই নাজুক। যেখানে বছরে প্রায় ছ’মাস থাকে জলের নীচে। তখন হাওরকে দেখা যায় বিশাল সমুদ্রের মতো। গ্রামগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। বাকি ছয় মাস শুকনা মৌসুমে হাওর হয়ে ওঠে সবুজ গালিচা বিছানো মনোরমা আর; সোনালি ফসলের মাঠ।
ভৌগোলিক কারণেই সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলের জীবনযাত্রা ভিন্ন। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা এই অঞ্চলের মানুষদের একটু ভিন্নভাবে পরিচয় বহন করে। মূলত দুই ধরনের পেশার ওপর এই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। সেটা হলো কৃষি এবং মৎস্য শিকার। দুটি পেশার সাথে এই অঞ্চলের নারী-পুরুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বেঁচে থাকার তাগিদে ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই সবার শ্রম দিতে হয়। সামাজিক প্রথার কারণে গৃহস্থলির সার্বিক কাজটা সামলে নিয়ে নারীরাও কৃষিকাজে শ্রম দেয়।
ছবি : জি এম ফ্রাজের ।
হাওরের নারী শ্রমিক একাধারে একজন গৃহিণী এবং কৃষাণীও। মাঠে ধান আর গলায় গান বৈশাখ মাসে হাওর অঞ্চলে এ যেন এক মধুময় দৃশ্য। কালের পরিক্রমায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান হাওর অঞ্চল এক অনিশ্চয়তা আর হতাশার নাম। মাঝে-মাঝে হাওরের প্রকৃতি ভয়াবহ রূপ নেয়। বর্ষাকালীন ঝড় এলে হাওরের পানি ফোঁসে ওঠে। এসময় হাওরে চলাচলকারী নৌকাগুলোকে নিরাপদ স্থানে এসে আশ্রয় নিতে হয়। নৌকাগুলো হিজল অথবা করচ গাছের সাথে বেঁধে রাখতে হয়।
বাতাস দীর্ঘস্থায়ী হলে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। এ সময় বাড়িঘর ভাঙতে থাকে। হাওরের লোকেরা এ দুর্যোগকে বলে ‘আফাল’। এই ‘আফাল’ থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় হাওরবাসীকে। ভাঙন প্রতিরোধে বাঁশ, কচুরিপানা ও বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ দিয়ে বাড়ির চারপাশে নির্মাণ করতে হয় শক্ত বাঁধ।
হাওরাঞ্চলকে বাংলাদেশের খাদ্য গুদামও বলা হয়ে থাকে। সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। শরতে ধবধবে সাদা কাশফুল, হেমন্তের শুকনো মৌসুমে চারদিকে ফসলি মাঠ, গাঁয়ের আকাঁবাঁকা মেঠোপথ, শীতে দুর্বাঘাসে শিশির ফোঁটা মুক্তার মতো হাসে। কবিমন ভাবনায় ডুবে যায় হাওরের অপরূপ এই রূপ দেখে! তখন হাওরপারের কৃষকদের কলরবে সারা মাঠ মুখরিত হয়ে ওঠে। পৌষ-মাঘে শীতের পিঠা খাওয়ার উৎসব শুরু হয় কৃষকের ঘরে ঘরে। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা ও ডালপালা গজায় আর সবুজ সমারোহে ভরে যায় হাওরের প্রকৃতি। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে জানান দেয় বসন্তের আগাম বার্তা। তখন কী যে অপরূপ দৃশ্যপট তা হাওরবাসী মাত্রই জানে। আবার যখন বৈশাখ মাসে পাকা ধানের সোনালি রঙে সারা মাঠ ভরে ওঠে। হাওরপারের কৃষাণ কৃষাণীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটায়। মাঝেমধ্যে চৈত্র মাসে ভারতীয় পাহাড়ি ঢালে, বছরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সব সময় কৃষকদের তাড়া করে। কোনো কোনো সময় ফাল্গুন মাস এলে সুনাগঞ্জের অনেক হাওরে পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয়।
চারদিকে খাল বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এঁটেল এবং দো-আঁশ মাটির এসব এলাকায় মাটি ফেটে ধানক্ষেতে গর্তের সৃষ্টি হয়। খাল এবং বিলে পানি না থাকার কারণে বিপাকে পড়েন বিভিন্ন উপজেলার হাওরবাসী কৃষক।
দেশের বৃহত্তম মৎস্য ভান্ডার সুনামগঞ্জের নলোয়ার হাওর, দেখার হাওর, মইয়ার হাওর, করচার হাওর, শনির হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর সহ প্রায় সবকটি হাওর। অত্র অঞ্চলের ভাষায়- লাছো মাছ ও গইন্না মাছ’ একমাত্র টাঙ্গুয়ার হাওরেই জন্মে। এই দুই প্রজাতির কার্পজাতীয় মাছ এখান থেকেই সারা দেশের হাওরাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।
এ জেলায় প্রচুর বিল-বাদাল, ডুবা-নালা, জলাশয় থাকার ফলে অনেক মাছ উৎপন্ন হয়। যা দেশের অমূল্য সম্পদ। প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিতে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে জেলেরা বেরিয়ে পড়ে মৎস্য শিকারে। কেউবা পালতোলা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে আর কেউ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে। ভয়-ভীতি কিছুই নেই! তাদের শুধু একটা চিন্তা মাছ শিকার।
জীবন ও জীবিকার খুঁজে এভাবেই বিরূপ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে হাওরপারের মানুষের জীবন কাটে।
হাওর গবেষণা, চর্চা, সংরক্ষণ এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সব কিছুই আজ কালের গর্ভে হারাতে বসেছে। হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, হাওরের (আফাল) ঢেউয়ের সাথে হাওরবাসীর মানিয়ে নেওয়া জীবন-জীবীকা, শৈল্পিকতা, হাওরের সংস্কৃতি, গান, বিচিত্র পেশা, হাওরের মৎস্য সম্পদ, হাওরের সোনালি ধান, হাওরের সম্ভাবনা, হাওরাঞ্চলের জলেভাসা দ্বীপ ছোট ছোট গ্রাম, ঢেউয়ের গর্জন, হিজল-করচের বাগ, হাওরে জোছনা উদযাপন প্রভৃতি আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার কৃষ্টি-সভ্যতার অংশ।
জীববৈচিত্র্েযর আধার ও সৌন্দর্যের জলকন্যা টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনের নামে যে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম চলছে তা অচিরেই বন্ধ করতে হবে। হাওরের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলন নামে একটি সক্রিয় সেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরলসভাবে কাজ করছে। শুধু সরকারি আইন করে হাওরের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য হাওর উন্নয়নমূলক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং হাওরপারের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে হাওরের পরিবেশ রক্ষা করতে। যদি হাওরের পরিবেশ রক্ষা করা যায়,তখনই নিরাপদ থাকবে হাওরপারের মানুষ; সুন্দর ও সুখময় হবে তাদের জীবন ও জীবীকা।
লেখক: হাওর বাঁচাও আন্দোলন কর্মী, সুনামগঞ্জ।
পারিবারিক অ্যালবাম
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
পারিবারিক অ্যালবাম
আরিফুর রহমান
‘এমন জোরে হাঁটছে যেন বাড়িতে কেউ মারা গেছে!’ মুখ ফসকে কথাটি বেরিয়ে গেল আমার।
লোকটি আমার আগে আগে হনহন করে হাঁটছেন। আমি কিছুতেই তার সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারছি না। এদিকে আমাদের সামনে কিলোমিটার খানেকের এক পাথার। তাছাড়া একটু দূরের খালের উপরে যে ব্রিজ তার গা ঘেঁষে একটি শ্মশানও আছে। তিনি আর আমি ছাড়া এই সন্ধ্যার মুখে এপথে আর কেউ নেই। তার সাথেই আজ আমাকে এই পাথার পেরিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। অথচ আমি তার নাগালই পাচ্ছি না! ফলে মনে মনে বিরক্তি বাড়ছিল, সাথে ভয়ও, তাই কথাটি বলে ফেলেছি!
আমি ছোটোবেলা থেকেই কিছুটা ভীতু। ওই যেদিন একজন প্রতিবেশীর কাফনে মোড়ানো শরীর দেখে চমকে উঠেছিলাম পরিচিত অবয়বের ব্যতিক্রম বলে এবং রাতে ভীষণ জ্বর হয়েছিল, সেদিন থেকে। আর সেদিনই ভয়টা আমার মনে যোগ হয়েছিল, কারণ রাতভর জ্বরের ঘোরে জানালার পাশের চিরপরিচিত জারুলগাছ জুড়ে দেখতে পেয়েছিলাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাফনের কাপড়! ‘ওই যে তরু মিস্ত্রি, ওই যে তরু মিস্ত্রি!’ সবাই আমার এমন বিড়বিড় শুনে বুঝতে পেরেছিল আমি তরু মিস্ত্রির লাশ দেখে ভয় পেয়েছি। তারপর বহুদিন আমাকে কোনো মরাবাড়িতে যেতে দেওয়া হয়নি!
আমার কথা শুনে লোকটি থমকে দাঁড়ালেন এবং ঘাড় ঘুরিয়ে আগুন চোখে তাকালেন। মুখ দেখতেই তাকে চিনতে পারলাম। আমাদের পাড়ার জিন্নাহ দাদু, যার সাথে নাতিনাতনিদের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ সম্পর্ক সম্ভবত আমারই। আমি তার দিকে এগোতে এগোতে বললাম, দাদু আপনি! হাটে গিয়েছিলেন? আমি ছোটো ফুপুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ফিরতে দেরি হয়ে গেল। যাক, চলুন এগোই।
দাদু কোনো কথা বললেন না! নড়লেনও না এতটুকু! গোধূলির শেষ আলোয় তার চোখমুখ বেশ লাল দেখাচ্ছে। আমি গায়ে না মেখে আবারও বললাম, দাদু চলুন।
সাথে সাথে জিন্নাহ দাদু আমার ডান হাতটি খপ করে ধরলেন এবং সেটা বেশ শক্ত হাতেই! হঠাৎ ভয়ের একটি শীতল ¯্রােত বয়ে গেল আমার শরীর জুড়ে! আর খুব দ্রুত দেহের শক্তি কমতে লাগল। অল্পক্ষণ পরই মনে হলো আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি গভীর ঘুমে। তখুনি দাদু সম্পূর্ণ অচেনা গলায় আমাকে বললেন, চল এগোই।
জিন্নাহ দাদুর বামহাতের ভেতরে আমার ডানহাত তেমনি আটকে আছে। টের পেলাম আমরা ধীরে ধীরে হাঁটছি। আর প্রতিটি পদক্ষেপে শোঁ শোঁ শব্দ করে কিছু যেন আমাদের পাশদিয়ে পেছনে চলে যাচ্ছে! আমি কিছুতেই চোখের পাতা খুলতে পারছি না কিংবা কোনো কথা
বলতে পারছি না! সেই শক্তিই যেন আমার নেই। অথচ ধীরপায়ে হলেও আমি হাঁটছি!
কিছুক্ষণ হাঁটার পর দাদু তার হাতের ভেতর ধরে রাখা আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে বললেন, মুন্না, চোখ খুলে দেখ।
আমি ঘুমকাতুরে শিশুর মতো টেনে টেনে অতি কষ্টে চোখের পাতা খুলতে পারলাম। দেখলাম, খুবই সুন্দর একটি পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। দুপাশে সারি করে দাঁড়ানো গাছের ছায়াশীতল পথটির ওই বাঁকে আমাদের বাড়ি, আশেপাশে আর কোনো বাড়িঘর নেই! বিস্ময়াভিভূত আমি আনন্দ সূচক কিছু একটা বলতে চাইলাম কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেলাম না! দেখলাম, আমাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ঠিক আমার মতো দেখতে একজন আমারই কণ্ঠে কিছু বলছে! ‘হেই মিয়া...’ আমি কেবল এই শব্দ দুটো বুঝতে পারলাম। পরের অংশটুকু ভিসিআরে টেনে টেনে সিনেমা দেখার মতো দ্রুত ঘটতে লাগল!
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না; কয়েকমাস আগে হুবহু এরকম ঘটনা ঘটেছে আমাদের বাড়িতে! সেদিন একজন প্রতিবেশীর উপরে এভাবেই নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলাম আমি। যদিও তার ভুল সে-রকম কিছু ছিল না, ভুল করেছিল তার পোষা গরু। কিন্তু গরুটির ভুলের অছিলায় ওর মালিকের কিছু কথার শোধ তোলার সুযোগ সেদিন আমি আর ছাড়িনি! আজ অবশ্য মনে হচ্ছে, প্রতিবেশীর সাথে অমন ব্যবহার করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।
আমি সবিস্ময়ে জিন্নাহ দাদুর দিকে তাকালাম। দেখলাম, দাদু মুচকি হাসছেন।
আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম। এই পথের আগের বাঁকটির মতো আরেকটি বাঁকে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আর আমি বিস্ফারিত নয়নে আমাদের বাড়িটিকেই পুনরায় দেখতে পেলাম! গতবছর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির্র আগে বাড়ির বাইরের বারান্দায় বাবা-কাকাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংক্রান্ত বৈঠক দেখা যাচ্ছে এবার! এতটা দূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি মিনমিন করে বলছি, ‘সাহিত্যে আমার আগ্রহ বেশি, আমি ভাষা ও সাহিত্যে ভর্তি হতে চাই।'
সাথে সাথে ছোটো কাকার ধমকে ওঠা, জ্যেঠার চোখ পাকানো, মেজো কাকার তিরস্কার, বাবার হায় হায় করে ওঠা সব দৃশ্যমান হলো! এমনকি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা’র ফুঁপিয়ে ওঠাটাও টের পেলাম! যেন আমি নিজেকে গোল্লায় নিয়ে যেতে চেয়েছি, সেভাবেই আমার প্রস্তাব ছুঁড়ে ফেলে বলা হলো, ‘পাস করার পর কিছু একটা করে খেতে পারবে এমন একটি বিষয় বেছে নিতে হবে।’
এখন টের পাচ্ছি, আমার মেরুদ-টা তখন খুব একটা সোজা ছিল না!
এরপর আমাকে বিস্মিত হবার সীমানার বাইরে নিয়ে একটু একটু করে এগোতে এগোতে দেখানো হলো, টুনি আপার অমতে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া, দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে সুস্থতার দিকে এগোনো দাদীজানের রহস্যজনক মৃত্যু, অন্য ধর্মের এক যুবকের সাথে ছোটো ফুপুর পালিয়ে যাওয়া, চিরকুমার বড়ো কাকার গলায় ফাঁস নেওয়া, বাড়িতে ডাকাত দলের হানা, পৃথিবীতে আমার আগমনের সময় মা’র মৃত্যুপুরী ঘুরে আসা-সহ অসংখ্য ঘটনা!
প্রতিটি ঘটনায় একটি কালো ছায়ার উপস্থিতি আমার দৃষ্টি এড়ালো না। কিন্তু ছায়াটি কার তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
আবার গভীর ঘুমে জড়িয়ে যেতে লাগল আমার দুচোখ। আমি খুব ঘুমকাতুরে গলাতেও দাদুকে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, এখন কোথায় চললেন? কিন্তু এখনো নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেলাম না।
আমার ডানহাত এখনো আটকে আছে দাদুর বামহাতের ভেতরে। তিনি যেন তাঁর স্বাভাবিক উচ্চতার তুলনায় কিছুটা উঁচু থেকে টানলেন আমাকে। হাঁটতে শুরু করলাম আর তক্ষুনি টের পেলাম আমি শূন্যে হাঁটছি! নিজেকে পাখির মতো হালকা লাগছে। হাওয়ার গায়ে ভর দিয়ে হেঁটে চলার সময়টা দুচোখ ভরে উপভোগ করতে পারলে নিশ্চয়ই আরও মনোমুগ্ধকর হতো, কিন্তু আপাতত আমার চোখের পাতায় ঘুমপরিদের বসতি।
ওভাবে হেঁটে হেঁটে উপরের দিকে উঠতে উঠতে হাওয়ায় জলের স্পর্শ পাওয়ার পর জিন্নাহ দাদু থামলেন। আর এই এতটা সময় পরে আমার হাতটাও ছেড়ে দিলেন। ধীরে ধীরে আমার দেহের শক্তি ফিরে এলো। আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেলাম এবং চোখ খুললাম। দেখলাম, আমি খুবই অদ্ভুত এবং অচেনা একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশ কুয়াশাজড়ানো, যদিও আমি জানি এখন শীতকাল নয়! সেই কুয়াশার আড়াল থেকে সামনে এলেন আমার বড়ো কাকা ও দাদীজান! তারপর এলেন আমার দাদু এবং আরও কয়েকজন, যাঁরা সবাই আমাদের পারিবারিক অ্যালবামের সদস্য! আমাকে কাছে পেয়ে তাঁরা বেশ আনন্দিত। কিন্তু আমি প্রচ- ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম, তাহলে কি আমি মারা গেছি? নাকি জিন্নাহ দাদু কোনো মন্ত্রবলে আমাকে এখানে এনেছেন?
আমাকে ভয় পেতে দেখে তাঁদের মধ্যে সোরগোল শুরু হয়ে গেল। আমার দাদু আমাকে এভাবে এখানে আনার জন্য জিন্নাহ দাদুকে ধমকে দিলেন। ফলে বিব্রত ভঙ্গিতে জিন্নাহ দাদু হালকা কুয়াশায় আড়ালে চলে গেলেন। আর আলোর শেষে আবছা অন্ধকারে তাঁকে একটি কালো ছায়ার মতো মনে হলো এবং সাথে সাথে কিছুক্ষণ আগে দেখে আসা ঘটনাগুলোর ছায়াটিকে চিনতে পারলাম আমি; জিন্নাহ দাদু!
জিন্নাহ দাদু না আমি, আমি তোমার ছোটো পিসেমশাই, মুন্না!
কারোর ধাক্কাধাক্কি ও ডাকাডাকিতে সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। দেখলাম, আমার মাথাটি ছোটো ফুপার কোলে। আর তিনি ক্রমাগত বলছেন, আমি মুন্না, আমি! তোমার ছোটো পিসেমশাই! তোমার...!
আমি ফুপার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে চারপাশটা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ফুপা, আমি এখানে?
তোমাকে এখানে এই অবস্থায় দেখে আমিও খুব অবাক হয়েছি! তুমি ব্রিজ ছেড়ে খালের জলে....! তুমি আমাদের বাড়িতে তোমাদের পারিবারিক অ্যালবামটা ফেলে এসেছিলে। সেটা দিতেই তোমার ছোটো পিসি তাড়াহুড়ো করে আমাকে পাঠাল যাতে পথেই তোমাকে পেয়ে যাই।
আমরা খাল থেকে ব্রিজের ওপরে উঠে এসেছি। চারপাশ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে। ফুপা ব্রিজের রেলিং থেকে তার বিখ্যাত সাইকেলটি সোজা করে নিলেন। তারপর বললেন, পেছনে বসো। তোমাকে তোমাদের বাড়ির পেছনের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে আসি।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চলুন।..... কাউকে কিছু বলবেন না, প্লিজ ফুপা!
ফুপা হাসলেন।
মোড়ে নামতেই আমার মনে খটকা লাগল, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। লোকজনের মধ্যে কেমন যেন খাপছাড়া ভাব। নাকি আমার মনের ভুল? হতেই পারে, যে ধকল গেল!
বাড়িতে ঢুকব তখুনি মসজিদের মাইকে ঘোষণা শুরু হলো, একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ। গোবিন্দপুর পূর্বপাড়া নিবাসী মোঃ জিন্নাহ ম-ল আজ বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকায় তাহার নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন, ইন্না-লিলল্লাহি....!
আমার পুরো শরীর কেঁপে ওঠল! বুঝলাম, এ-যাত্রায় জ্বর থেকে নিস্তার নেই।
হলোও তাই, সারারাত প্রচন্ড জ্বর আর সীমাহীন ঘোরের ভেতর আটকে রইলাম। কখনও কুয়াশাচ্ছন্ন সেই জায়গাটির দৃশ্যগুলো ফিরে এলো তো কখনও আমিই সেই দৃশ্যের ভেতর ফিরে গেলাম। পরিচিত সেই মুখগুলোই আমার চারপাশে কিন্তু আমাকে নিয়ে তাঁরা আর উৎফুল্ল নন, বেশ চিন্তিত! অনাগত সময়ের নানাবিধ আশঙ্কা তাঁদের উচ্ছ্বাসে ভাটার টান নিয়ে এসেছে আর তাতে পড়েছে দুশ্চিন্তার অসংখ্য ভাঁজ! ফলে আমার মহান পূর্বপুরুষগণের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নতুন প্রজন্মের এই যে আমি, তার জীবনের বালিয়াড়ি জুড়ে হয়ত তাঁরা কেবল দুর্বোধ্য আঁকিবুঁকি দেখতে পাচ্ছিলেন আর আঁতকে উঠছিলেন। কিন্তু ঘোরের ভেতর থেকেও আমি ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ নির্লিপ্ত হয়ে উঠলাম! আর মনে মনে সেই বালিয়াড়ি জুড়ে জীবনের হিসাব কষে নিতে লাগলাম!
ফজরের পরপরই আমার জ্বর নেমে গেল। কিন্তু শরীরে ক্লান্তি জাঁকিয়ে বসেছে বলে শুয়ে রইলাম বেশ বেলা পর্যন্ত। খোলা জানালা দিয়ে লোকজনের যাতায়াত দেখলাম। কেউ কেউ জানালার কাছে একটু থেমে ‘আমি এখন কেমন বোধ করছি’ তা জেনে গেল। তেমনই একজন আগন্তুক, আমার বন্ধু শাহিন, একসময় এসে জানতে চাইল, কেমন আছিস এখন?
বিছানা থেকে শরীরটা অর্ধেক উঠিয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে বললাম, ভালো।
তুই ভর সন্ধ্যাবেলা শ্মশানের কাছে খালের ভেতর নামতে গেছিলি কেন রে? শুনেই আমার হাতপা ঠা-া হয়ে গেছিল! অমন পাথার একা পার হয়ে আসা.....! বাপরে!
আমি চোখ পাকিয়ে শাহিনকে থামতে বললাম। ও প্রসঙ্গ পাল্টে আমাকে জিজ্ঞেস করল, জিন্নাহ বুইড়ার জানাজায় যাবি?
হুম। একটু দাঁড়া, আসছি।
জিন্নাহ দাদুর নামাজে জানাজা সকাল আটটায় অনুষ্ঠিত হবে বলে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দাদুর বাড়ি লোকে লোকারণ্য। তাঁর প্রশংসাসূচক বাক্য, টুকরো টুকরো স্মৃতি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ মিলে চাপা গুঞ্জন চলছে।
নির্দিষ্ট সময়ের আগে আগে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালেন।
মাইকে প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেওয়া হলো।
জানাজার নামাজ শুরুর আগমুহূর্তে আমার কি হলো কে জানে, নিজেকে বেশ জোরে-সোরে বলতে শুনলাম, আমি কিছু বলতে চাই!
দেখলাম, যে যেভাবে সম্ভব আমাকে দেখছেন। অনেকেই বেশ বিরক্ত।
ওসব তোয়াক্কা না করে জিন্নাহ দাদুর খাটিয়ার সামনে গিয়ে মাইকের দখল নিলাম। তারপর দৃঢ় উচ্চারণে বলতে শুরু করলাম সেই কথাগুলো যেগুলো আমাদের বংশের অনেকেই জানেন। কিন্তু অনেক কথা বলা হলেও আজ এখানে সেই কথাগুলোর একটিও উচ্চারিত হয়নি! অথচ আমার মনে হলো, কথাগুলো বলা দরকার।
বললাম, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত লোমহর্ষক দুটো খুন এবং আকন্দদের বাড়িতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় জিন্নাহ দাদুর সংশ্লিষ্টতার কথা!
সাথে সাথে দাদুর চার ছেলে হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেলল। আর জমায়েতের পেছনদিকটায় অস্বাভাবিক নড়াচড়া শুরু হলো একদল লোকের। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমাদের বংশের মানুষের মুখগুলো ফ্যাকাসে এবং নত।
বিশৃঙ্খলার মধ্যেই হঠাৎ দুরাউন্ড গুলি চলল! আর তক্ষুনি দেখলাম, আমি ধীরে ধীরে হেঁটে উঠে যাচ্ছি উপরের দিকে! আমার চারপাশে আমাদের মহান পূর্বপুরুষগণ, যাঁরা সকলেই আমাদের পারিবারিক অ্যালবামের সদস্য! তাঁরা বেশ আনন্দিত। আমি তাঁদের সাথে সানন্দে এগিয়ে চললাম। নিচের নশ্বর দেহটির দিকে একবার ফিরেও তাকালাম না, একবারও না! কিন্তু টের পেলাম, নিজের কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলা আমার মা পারিবারিক অ্যালবামটি বুকে জড়িয়ে হাপুসনয়নে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। ওতে সর্বশেষ যে ছবিটি যোগ হলো সে আমারই!
আমাদের পারিবারিক অ্যালবামে কোনো জীবিত মানুষের ছবি নেই!
পদাবলি
বৃষ্টির শব্দে
রুদ্র সাহাদাৎ
বৃষ্টির শব্দে মাঝরাতে ভাঙে ঘুম নভোম-লজুড়ে কান্নার ধ্বনি
টুপটাপ টুপটাপ টুপটাপ রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম
গতকাল সারারাত আমিও কেঁদেছি আকাশের কান্না শুনে।
চোখের কোণায় আজও নোনাজল টলমল দক্ষিণা হাওয়ায় উড়ে যায় যৌবন
প্রাক্তন কে কেনো যে আচমকায় বারবার মনে পড়ে জানে না ভাঙামন।
বৃষ্টির শব্দে মাঝরাতে ভাঙে ঘুম ঘুমন্ত শহরজুড়ে বোবাকান্না ।
বেলা-অবেলার মহাকাব্য
সৈয়দ ইনজামুল হক
শুকনো পাতার মত মরমর করে বাজে
বুকের কোটর
হিমাদ্রীর চূড়া ছোঁয়া বেদনার বধীর তরঙ্গ
আছড়ে পরে শরীর জুড়ে
তোলে বিষাক্ত ফণা।
ধূলো মাখা বিবর্ণ বিকেল
মেলে ধরে স্মৃতির সাদাকালো দু’চোখ।
বর্তমানের শিকড় ছিড়ে
মন খুঁজে ফিরে হারিয়ে যাওয়া অতীত
জোয়ার-ভাটার বয়ে চলা জীবন
লিখে যায় বেলা-অবেলার মহাকাব্য।
অসুস্থ ব্রিজ
সাজ্জাদুর রহমান
পাথরের মতো ভার মাথায়
দাঁড়িয়ে আছে সময়ের অসুস্থ ব্রিজ
বোবা অক্ষর গুলো দ্যুতিহীন আসমানে
খুঁজেই চলে শুকতারার সৌহার্দ্য প্রতিফলন।
জিরাফ দুঃখ বেয়ে উঠে যায়
শিরার বেদনা আকাশমুখে
চলমান নাচ পুতুলেরা
নির্ভরতা এগিয়ে দিয়ে খেলে কানামাছি, বৌচিঁ।
আশু বিকেলের অন্ধকার
শুয়ে পড়ে ব্রিজের হাতল ঘেঁষে
সেই পিরামিড ব্রিজ সুখশৃঙ্গার ভুলে
পাথুরে লজ্জায় আবৃত করে সজ্জিত কুঠার।
মুখস্থ
রাফাতুল আরাফাত
তোমাকে ছাড়া পা রাস্তার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে, হাঁফসা
টিউশন থেকে ফেরার পথে
আজ দুইটা নতুন পাখির ডাক মুখস্থ করেছি
অনেক পাখির ভীড়ে তাদেরকে আলাদা করা যায়
স্কুলে ভালো ছাত্র ছিলাম
ভালো ছাত্র হবার এ যে যন্ত্রণা হাঁফসা
তোমাকে ভুলতে গিয়ে মগজে মার্বেল গড়িয়ে যায়
আর রাস্তায় পড়ে থাকে অসার পা।
দুঃখ
সজল কুমার টিকাদার
দুঃখ-ও এক পবিত্র মন্দির।
মাথা নীচু করে এখানে
প্রবেশ করতে হয়।
তারপর শুদ্ধ আরাধনা...
আর, নৈবেদ্য বলতে,
না-মিষ্টি না-ফল
শুধু কয়েক ফোঁটা চোখের জল!
নির্জনে তোমার ছবি
ইউনুছ ইবনে জয়নাল
নির্জনে তোমার ছবি দেখি স্বপ্নে-
চারিদিকে বৈশাখী ঝড়,
হাড়ের কঙ্কালে রক্তিম ফিতায় বাঁধা
আত্মার ভিতর।
যতদুর চোখ যায়-
চৈত্রের তপ্ত মরিচিকার নদী অস্থির,
তরঙ্গে তুমি অরণ্যের মতো
মনে জাগে নিঃশ্বাস অস্বস্তির।
রাত আর দিন; দিন আর রাত; যেন-
নক্ষত্রের উৎসবে অপরাজিতার গন্ধে মশগুল,
শান্ত তবু বিব্রত সব প্রতিবিম্ব
নিতান্ত’ই বেদনা সংকুল।
জন্মক্ষণ
নীলোৎপল গুপ্ত
এইমাত্র ধুলোর মধ্যে জন্ম হল আমার
ওপরে মেঘের দৃশ্য, ওপরে পাখির পালক।
এই দ্যাখো আঙুলে জলস্পর্শ নিয়ে আমি ভাসমান
চৌদিকে উল্কার রাজ্য, চৌদিকে নক্ষত্র-আগুন
আমি আগুনের পরিমিতি পেরিয়ে পেরিয়ে
মৃত্যুর ভেতরে ঢুকে পড়ি।
এইখানে দিনরাত্রি থেমে আছে
এইখানে জল-আগুনের সঙ্গম।
মৃত্যুর এইপারে এক্ষুনি জন্ম হল আমার
দশচক্রে বাতাসের ঘূর্ণি, চক্রমূলে শব্দহীনতা।
জ্যোতির্ময় দিন
আশ্রাাফ বাবু
নিঃস্ব হয়ে আমার স্মৃতি এখনো পোড়ায়!
বোধের ছদ্মবেশ বৃত্ত আরো বাড়িয়ে দেয়
কোন একটা লালরঙা ঠোঁট।
আমাকে হতাশ করে নীরবতার প্রতি
রুপালি মুখোশ থেকে নির্দয় রাতকে
সন্ধ্যার আলো মগ্ন সম্মিলিত শব্দ।
শব্দে পাগল বিদীর্ণ হয়েছে জীবন্ত চোখ,
শান্ত মানবতা উদ্ধার হওয়া ছাঁচের বাইরে
বয়স একটি ধূমায়িত আড়াল নিজের।
আমি নীরব দাঁড়িয়ে প্রায় নিভে যাওয়া
সোনালি ভালোবাসার রূপকথার মতো,
নীরবতা ছড়িয়ে দেয় আবছা আয়নায়।
হাতছানি জ্বলজ্বলে এবং জ্যোতির্ময় দিনে
কীভাবে তোমার স্মৃতি এখনো পোড়ায়!
অনেক দূরে একটা গান, আমি সেই গান শুনি
ব্যবধান
ইস্রাফিল আকন্দ রুদ্র
কোনো এক বৃহস্পতিবারের পায়ের তলায় হারিয়ে গেছে আমাদের গল্পসমগ্র;
গল্প নিয়ে এগিয়ে চলতে ধপাস করে পড়ে যাওয়ার আগে দাঁড়িয়ে থাকতো আমাদের স্বপ্ন..
ফিরে দেখা কীটনাশক মিশ্রিত সময় বড়ই ব্যথাহীন
স্মৃতি রোমন্থন- সেইসব দিন; আহা কী রঙিন!
আমার বুক তোমার পাপোশ, সন্তপ্ত পা বুকের উপর মুছে অন্য এক জগতে সজোরে ধাক্কা দিযে ঢুকে যাও...
আমি বেদনায় কুঁকড়ে কুকুর হয়ে বসে থাকি তোমার পায়ের তলায়
তখন আমার বুকের উপর লাথি মেরে এগিয়ে যাও ভিন্ন এক সংসারের চৌকাঠে। এভাবেই যুগপৎভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের ব্যবধানের ন্যায় ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে - আমাদের ব্যবধান!
বসন্ত বিরহ
মুস্তফা হাবীব
সুপ্রভা, ‘তুমি বললে একটি পুকুর কাটো
যে পুকুরের সুপেয় জলে দুজনে বিবসনা হবো,
এমন কোনো অশ্বারোহী নেই আমাকে কেড়ে নেয়’।
তুমি আয়তকার পুকুরের পরিসীমা দিয়েছো
দৈর্ঘ্য প্রস্থ দাওনি, দাওনি পাড়ের বিস্তার
আমাকে স্বপ্নের ধাঁধায় ফেলে
মাধবী সেজে তুমি দু’চোখে মেখেছো পূর্ণিমা।
মেধার ঘাম ঝরিয়ে পুকুর কেটে চলছি,
গাণিতিক জট খুলে যখন পুকুর কাটা শেষ
খই মুড়ি সন্দেশ বাতাসায় যখন উদ্বোধন হবে...
পুকুরের মাঝে যখন উড়াবো রঙিন রুমাল
তুমি বললে, ‘আমার পায়ে অদৃশ্য বেড়ি’।
আজ পুকুরে মাধবী ফুটেছে সনাতন সৌরভে
অন্যজন রোজ সাঁতার কাটে ফুলতোলা ভঙ্গিমায়;
সুপ্রভা, তোমার স্বপ্নের পুকুরে আমি এখনও একা!
অহিউল্লাহর আঁকা শেষ ছবি
অহিউল্লাহর আঁকা শেষ ছবি
আরিফুল হাসান
খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নয় বছরের একটি বালক। তার মনটি আপাত বিক্ষিপ্ত। জন্মের পরে এমন ঘনঘোর আর কখনো দেখেনি। মানুষেরা কি এক আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি ভয়ে ভয়ে যেনো ছুটে যাচ্ছে। যেনো ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে দেশটার উপর দিয়ে। কিন্তু দেশটা বলতে সে কতটুকু চেনে? বালক বয়েসে মায়ের কোল ছেড়ে সবে পড়াশোনা আরম্ভ করেছে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এই পড়াশোনা, এই আসা যাওয়ার মাঝে সে টের পায়, ঢাকায় একটা বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কী ঘটতে যাচ্ছে তা তার অবুঝ জ্ঞানে ধরতে পারে না। তবু পিতার শুকনো মুখ, মায়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে, কোনো ভালোকিছু ঘটতে যাচ্ছে না ঢাকায়।
স্কুল বেশ ক’দিন ধরে বন্ধ। কিন্তু এ বন্ধের মধ্যেও একদল ছেলেমেয়ে গোপনে স্কুলে যায়। অহিউল্লাহরও যেতে মন চায়। কিন্তু বাবা মা দেয় না। বাইরে নাকি গ-গোল, আর এই গ-গোলের সময় স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই; পিতা সাফ সাফ জানিয়েছেন। মা-ও কোলছাড়া করতে চায় না। একটু নজরের আড়াল হলেই ভয়ে মায়ের কলিজায় পানি থাকে না। কিন্তু সভাব যার প্রজাপতির মতো, তাকে কি বেঁধে রাখা যায়? অহিউল্লাহ কথা শোনে না। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ফুল, পাখি, প্রজাপতি, চলন্ত রিক্সা, রিক্সাওয়ালার ঘর্মাক্ত দেহ আঁকে সে। কোনো নতুন একটি গাড়ি আসলে সেটি সে কাগজে পেন্সিলে ধরে রাখার চেষ্টা করে।
এই আঁকাআঁকির অভ্যেসটা তার মগজে গেঁথে গেছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল নিয়ে সারাদিন শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো আর যেখানে চোখ আটকে যাবে সেটিরই দৃশ্যপট এঁকে ফেলা অহিউল্লার কাজ। পিতা দরিদ্র মানুষ; গা-খাঁটা রাজমিত্রি, যেখানে যেদিকে কাজ পায় সেখানেই যেতে হয়। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মো. হাবিবুর রহমান। ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে বড় মানুষ করতে চায়। ছেলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো। আগ্রহীও বটে। তবে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার ছবি আঁকায়। ফলে বাবা-মা-ও ছেলের এ স্বভাব সম্পর্কে জানে এবং রীতিমতো প্রশ্রয়ও দেয়। হাবিবুর রহমান বলেছে, আর কিছু দিন পরে অহিউল্লাহকে রং পেন্সিল কিনে দেবে। রঙিন একটি খোয়াব অহিউল্লাহর মাথার ভেতর খেলে। ঢেউ তুলে তার বালক মনে। মনের অজান্তে সে কতকিছু এঁকে ফেলে! আবার সেগুলোকে মুছেও ফেলে মনে মনে। সকালের সূর্য, পূর্ণিমার চাঁদ, হাসের হলদে ঠোঁট, রংধনুর সাতরং সে আঁকে। আঁকে একটি ভোর, একটি টগবগে দুপুর।
সেদিনও সকাল বেলা মা তাকে বাইরে যেতে দেয় না। পিতা হাবিবুর রহমান নিজেও আজ কাজে যায়নি। সকালে ঘরে নাস্তা বানানোর মতো পর্যাপ্ত আটা না থাকা স্বত্বেও ঘর থেকে বের হয়ে ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের গলির মুখে মুদি দোকান থেকে আটা আনতে যায় না তার বাবা। অজানা এক আতংকে ঘরের মধ্যেই কুঁকড়ে থাকে সবাই। অহিউল্লার এই অবরুদ্ধতায় দমবন্ধ হয়ে আসে। সে শোনে, গলির মোড়ে দোতালা বিল্ডিংটার বারান্দার টবে ফোটা ফুলগুলো তাকে ডাকছে। ফুলে ফুলে উড়ে চলা প্রজাপতিগুলো তাকে ডাকছে। গলির মুখে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো তিনচারটি পথকুকুর তাকে ডাকছে। এসবের ডাক সে অবজ্ঞা করে কীভাবে? কিন্তু কীভাবে সে ঘর থেকে বের হবে। পিতার শাসন, মায়ের সুতীক্ষè দৃষ্টি, এসবকে ফাঁকি দিয়ে সে বেরিয়ে পড়তে সুযোগ পায় না।
বেলা বাড়ে। আস্তে আস্তে দুয়েকজন বের হতে থাকে। রাস্তায় একটা দুটো গাড়ি ভয়ে ভয়ে চাকা ঘুরায়। মিলিটারিরা রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে নাকি। গতকাল নাকি মেডিকেলের সামনে গোলাগুলি হয়েছে। অনেক ছাত্ররা নাকি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অসংখ্য। ভাষার দাবিতে এ মিছিল। বালক অহিউল্লাহ ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। ভাষার আবার দাবি কী? কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় কে এল জুবিলি স্কুলের শিক্ষক কামরুজ্জামান যখন এলাকায় এসে কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রের সাথে কথা বলছিলো, তখন অহিউল্লাহও সেখানে ছিলো। সেখানে ছিলো বলতে একটু দূরে একটা আমগাছের নিচে কয়েকটা পথকুকুরের সাথে খেলা করছিলো সে। পশ্চিমের লাল আকাশ বুকে নিয়ে কামরুজ্জামান স্যার ছাত্রদের বলছেন, মিছিলে গুলি হয়েছে। স্পট ডেথ সাতজন। হয়তো আরও বেশি। পুলিশ অনেকের লাশ গুম করে ফেলেছে। আহত হয়েছে অনেকে। এবারে আন্দোলনে যেতে হবে। অলিগলি সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে বিদ্রোহের আগুন।
অহিউল্লাহ আন্দোলনের আগুন দেখে, দেখে চকচক করে কামরুজ্জামান স্যারের চোখ এই ছায়া ছায়া অন্ধকারেও। সে শোনে, মায়ের ভাষায় কথা বলতে দেবে না ওরা। সে শোনে, তার পাখির ভাষা, তার ফুলের ভাষা সব মুক হয়ে যাবে। সে ভয় পায়। আবার মনে মনে জ্বলেও উঠে। শোনে, মিছিলে যাবে ছেলেরা আগামিকাল সকালে। রাতটা তার কোনোরকম কাটে। কিন্তু এই সকালে রাস্তাভর্তি পুলিশ, পাকিস্তানি সৈনিক, জলপাই রঙের ট্যাঙ্কের ভয়ে বাইরে যাবার ব্যাপারে বাবা মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা তার মনখারাপ করে দেয়। সামান্য নাস্তা করে মুখ ভার করে সে বসে থাকে। ক্রমশ লোকজন বেরুতে থাকলে, এক ফাঁকে সেও বেরিয়ে পড়ে বাবা মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে।
রাস্তাটা এতো সুনসান! কেমন যেনো হাহাকার করে উঠে বুকের ভেতরটা। তার পরিচিত তিনচারটি কুকুর পথের একপাশে আমগাছটার গোড়ায় শুয়ে আছে। তাকে দেখে একটা কুকুর মাথা উঁচু করে একবার হাই তুলে, তারপর আবার মাথা নামিয়ে শুয়ে যায়। অহিউল্লাহ এক পলক থামে। পকেট থেকে কাগজ পেন্সিল বের করে এঁকে ফেলে তিনটা কুকুরের শুয়ে থাকা। তারপর তার চোখ যায় দোতলা বাড়িটির ঝুল বারান্দার দিকে। সারি সারি টবে বাহারি রকমের ফুল ফুটে আছে। একটি বড় রক্তজবা ঝুঁকে আছে বারান্দা থেকে নিচের দিকে। তাতে এসে একটি প্রজাপতি পাখা মেলে বসে। ফুলের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু হয়তো বলছে সে। অহিউল্লার ভালো লাগে বিষয়টি। সে ফুল ও প্রজাপতির ছবি আঁকে।
তারপর সে ১৫২ লুৎফর রহমান লেন ছেড়ে উঠে যায় নবাবপুর রোডে। থমথমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো রাস্তাজুড়ে। লোকজন উৎকণ্ঠা নিয়েও বাইরে বেরিয়ে এসেছে এবং কি যেনো একটা ঘটতে যাচ্ছে এমন একটা নিভৃত চাঞ্চল্য বিরাজ করছে সবখানে। তার বালক মনে এতোকিছুর ব্যাখ্যা মেলে না। তবে কামরুজ্জামান স্যারের কথাটা তার মনে আছে। আজ সকালে মিছিল বের হবে। ভাই হত্যার প্রতিবাদে মিছিল। অহিউল্লাহর একান্ত ইচ্ছে সেও মিছিলে যোগ দেবে। সে এগুতে থাকে। কিন্তু খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। রাস্তা জুড়ে জলপাই রঙের ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। শিশু অহিউল্লাহর চোখে এরকম উর্দি পড়া মানুষ এই প্রথম দেখা। তাদেরকে তার মানুষ বলে মনে হয় না। তার মনে হয়, একদল জন্তু জানোয়ার হিং¯্র নখর আর থাবা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে পেন্সিল ও কাগজ বের করে সে আঁকতে থাকে ওই অদ্ভুতদর্শন প্রাণিদের। এমন সময় পেছনদিক থেকে অতর্কিতে একটি মিছিল উঠে আসে নবাবপুর রোডে। অহিউল্লাহর ছবি আঁকা থেমে যায়। কাগজের টুকরোটি মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে দৌঁড়ে গিয়ে যোগ দেয় মিছিলে। হাত উর্ধ্বে তোলে স্লোগান ধরে। কয়েক কদম সামনে বাড়ে তারা। এমন সময় ঠা ঠা করে উঠে পাকিস্তানি সৈন্যদের রাইফেল। চোখের পলকে অন্য অনেকের সাথে উড়ে যায় অহিউল্লার মাথার খুলি। শুধু তার চোয়ালের ভেতর শক্ত করে আটকে থাকে একটুকরো কাগজ, রক্তের অক্ষরে যাতে একটি ভোর আঁকার স্বপ্ন ছিলো।
কুমিল্লা, বাংলাদেশ
শব্দমালা : মাজেদ বিন্ জসিমউদ্দীন
শব্দমালা
মাজেদ বিন্ জসিমউদ্দীন
প্রেতাত্মাদের ধ্রুপদী নৃত্য
সহসাই এক অদ্ভুত তাড়না প্রতিনিয়ত বিভ্রমের দিকে
ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে...
বন্ধনহীন, মমতাহীন এই নিñিদ্র লৌকিকতার
অন্তপুরে শুধুই দেখছি জৈবিক উল্লাস
করোটির ভেতর জন্ম নেওয়া
অনুষঙ্গ একত্রিত হয়ে স্বপ্নের ভেতর
ভাঙতে থাকে কালের নীরবতা
ভাঙতে থাকে জীবনের উপাখ্যান
ভাঙতে থাকে জীবনের সমস্ত জৌলুস
ভাঙতে থাকে কৃষাণের আলবাঁধা মেঠোপথ
ভাঙতে থাকে জোছনাময় রাতের মহেন্দ্রক্ষণ
ভাঙতে থাকে রৌদ্রজ্জ্বল দিনের সূচিশুদ্ধ চিত্রপট।
মেতে উঠা ইচ্ছা-অনিচ্ছার অদৃশ্য আলোর বিচ্ছুরণে সমাদৃত
প্রেতাত্মাদের ধ্রুপদী নগ্ননৃত্য...
অনাস্বাদিত সমীকরণ
ভুল হিসেবের নামতা পড়ে আর্তকে উঠি বারবার
তারপরও মস্তিষ্কের ভেতরে তাড়া খাওয়া
বেসুরো ভায়োলিন মগজের ভিতর-বাহির, হলি-গলিতে
জমায় বিবর্ণতা, পাপ ও প্রহেলিকা।
এক সময়Ñ
ভুলে যাওয়া অতীত কিংবা স্বপ্নে থাকা স্বপ্নেরা
বধির ভগ্নস্তুপ থেকে উঁকি দেয়...
জীবনের যাদুঘর ভরে উঠে এবড়ো থ্যাবড়ো, ভাঙাচোরা
অনাস্বাদিত সমীকরণে।
মুছে যাকÑ ধুয়ে যাক যতো আত্মপ্রতারিত কামাতুর
রাত্রির উদ্ধত বুক
অগ্নি নরক দীর্ঘস্বাস...
নৈবেদ্যের সারৎসার
যৌবনাবর্তী বেলুনের নিজস্ব যশ, খ্যাতি, প্রতিভা
ফেটে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে যাযাবরী ভগ্নাংশের রাত।
প্রলম্বিত এই দীর্ঘ নৈঃসঙ্গের রাত শেষে
অবাধ্য, অনাবৃত উন্মুক্ত মনে একাকী আঁকছি
শূন্যতার নৈবেদ্য...।
অবরুদ্ধÑ
জীবনটা যেন আটকে আছে চিকন রোগাগ্রস্থ মার্জিনে।
করুণ সুর তুলে সুরের মূর্ছনায় রেওয়াজ করে যায়Ñ
উৎকর্ষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসবাস করা নৃত্যরত ঘুনপোকা।
বিবর্ণ স্বপ্নের বিশাল পৃথিবী জুড়ে নির্মাণ করে
ধ্বংসের সা¤্রাজ্য।
প্রতিদিন একটু একটু করেÑ
জাগতিক সুখ খুজি অসমাপ্ত কবিতার পৃষ্ঠায়...
স্বপ্নের শিথানে বিপন্নতা
স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ-
থমকে গেছে সময়, ঠাস ঠাস করে ভেঙে গেছে বিবেকের দেয়াল।
আগুনের ফুলকিতে ভস্ম হয়ে যাওয়া উদ্যমী উচ্চাশাকে দমিয়ে রেখেছি
করাতকলের সানে কেটে যাওয়া নিশ্চিদ্র ভাবনাগুলোকে জিঁইয়ে রেখেছি
কখনও শীতলতায়, কখনও উষ্ণ পরশে নির্ঘুম রাতের স্বপ্ন এঁকেছি
পাড় ভাঙা খেয়া খাটে স্বপ্নতরীদের নোঙর ফেলতে দেখেছি
ভোরের পোয়াতি সূর্যের ভ্রণগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দেখেছি।
কিছু সুখ, কিছু অনুভূতি, কিছু স্বপ্ন খুঁজে পাবো এই বিশ্বাসেÑ
অথচ, অথচÑ সব কেমন যেন এলোমেলো, অগোছালো
বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম অ নে-ক কাল; অনেক বছর
যেমন বেঁচে থাকে সহ¯্র বছরের পুরোনো চাঁদ
যেমন বেঁচে থাকে জনপথ, আততায়ী বিকেল
যেমন বেঁচে থাকে অদম্য ইচ্ছের কুচকাওয়াজ
যেমন বেঁচে থাকে এক ঝাঁক রোদ্রের ঝিলিক
যেমন বেঁচে থাকে নিভৃতে, নিঃশব্দে ঘুনপোকা
যেমন বেঁচে থাকে জনহীন, নির্জন পথের ছায়া।
তারপরও দেখি চেনা জানা মানুষগুলো কেমন যেন বদলে যায়
বদলে যায় বারান্দায় সাজানো টবের বনসাই
বদলে যায় ধূলি ওড়া অপরাহ্ন
বদলে যায শিস দেয়া গার্হস্থ্য সকাল
বদলে যায় ভরা ভাদ্রের জ্যো¯œারাত
বদলে যায় নুয়ে পড়া হেমন্তের হাওয়া
বদলে যায় জীবনের নান্দনিক প্রচ্ছদ
বদলে যায় কবিতা লেখার পঙ্ত্তি।