দুই শালিক
দুই শালিক
সাব্বির হোসেন
১
আমার নাম শের আলী। জগতনন্দী নদীর ঘটেই আমার একমাত্র দোকান। প্রতিদিন কতশত মানুষ আসে যায় নদীর এপার থেকে ওপারে।
আমার দোকান জগতনন্দী নদীর পাড়েই। দোকান লাগোয়া ছোট দুটো বাঁশের টং আছে। লোকজন পারাপারের সময় চা নাস্তা করে। এক কেজি ননী গোপালের রাজভোগ মিষ্টি নিয়ে আমার একমাত্র নাতি ছগির, আজ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাড়ি ফিরেছে। নানাজান যেহেতু ভোরে ঘাটে এসে দোকান খুলে বসে আর রাতবিরাতে বাড়ি ফিরে তাই নাতি আমার টাটকা মিষ্টি নিয়েই বাড়ি হয়ে আমার দোকানে এসে হাজির।
আমার নাতি আবার নানাজানের গল্পের পাগল। তাই বরাবরের মতই আজও গল্প শোনার আবদার করে বসল। সূর্য তখনও মাথার উপরে আসেনি। দোকানের খরিদ্দের নেই বললেই চলে। তাই মিষ্টি খেতে খেতে গল্প ধরলাম। দুই শালিকের গল্প।
দুটো মানুষ। একজনের বয়স পয়তাল্লিশ কিংবা সাতচল্লিশ হবে আর অন্যজনের চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। প্রথমে ছোট জনের কথা বলি। ছোট জনের কোন নাম নেই। মানে নাম, খ্যাতি, সম্মান, সম্পদ এককালে ছিল তবে এখন নেই। সব কিছু হারিয়েছে সে। প্রশ্ন হল, কিভাবে হারালো আর কেন হারালো? যদি বলেন কাজের কোন ছোট বড় নেই তাহলে উদাহরণটা এভাবে দেওয়া যেতে পারে, ছোট জন ছিল মাঝি। নৌকায় এপার ওপার করে আর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। পরিবারের মধ্যে গণ্যযোগ্য হলেও কোনদিন কেউ গণ্যমান্য হিসেবে গণনা করেনি। এমনকি সে নিজেও এভাবে চিন্তা করেনি। কেন চিন্তা করেনি জানেন, কারণ সে মানুষকে খুব বিশ্বাস আর ভালোবাসতো। সমাজের সবার সাথে কাছের মানুষের মত হাসিমুখে চলত। এভাবে সময়গুলো ঠিকঠাক কাটছিলো।
একদিন হঠাৎ মাঝির নৌকা, কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। মাঝি তখনও কিছু বুঝতে পারল না। মাঝির কোন জমানো অর্থ ছিল না যে সে, নতুন একটা নৌকা কিনবে। তাই সে পরিবারের সকলের কাছে টাকা ধার চাইল কিন্তু তাকে সাহায্য করার মত কেউ এগিয়ে এলো না। এরপর সমাজের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী যাদের সে আপন মনে করত তাদের কাছে গিয়েও সে তার সমস্যার কথা জানালো কিন্তু তাতেও তারা কেউই সাহায্য করল না। মাঝি তখন বড় বিপদে পড়ল। মাঝির ঘরে ক্ষুধার্ত দুই সন্তান, স্ত্রী আর মা অপেক্ষা করে। মাঝি ফেরে না। মাঝি তখন চরম এক বাস্তবতার সম্মুখীন। দু’রাত মাঝি ঘরে আসেনি। স্ত্রীর গালমন্দ সভাব। তাই স্ত্রীর গালিগালাজ হরদম চলছেই আর মা তো খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন সন্তানের চিন্তায়। ঘাটে মাঝিকে সবাই ভোলা নামেই চেনে।
২
আসুন বড় জনের ব্যাপারে একটু জেনে নেই। বড় জন ছোট জনের একদম অনুরুপ। বয়স বেশি। মন আকাশের চেয়েও বিশাল। মা ভক্ত। বউ বাচ্চাকেও অনেক ভালোবাসে। শুধু একটা সমস্যা বড় জনের। মিথ্যা, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস কোনটাই তার ভেতরে নেই। শুধু একটা সমস্যা ছাড়া। আর সেটা হল মাদকের প্রতি আসক্ত। বড় জন হল মাদকাসক্ত। মায়ের আদরের সন্তান সে। ভাই বোনের মধ্যে সে মধ্যম। ছেলে হিসেবে সে পরিবারের মধ্যমনি। কিন্তু সবাই এই একটা বিষয় নিয়েই চিন্তিত আর বিরক্ত আর সেটা হল, মাদক সেবন।
একদিন পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, গাঁয়ের সংসারী মেয়ে দেখে তাকে বিয়ে দিলে হয়তো ছেলেটি শুধরে যাবে। কথা মত তাই হল। বিয়ে হল অজপাড়া গাঁয়ে। মেয়েটিকে পেয়ে বড় জন নতুন জীবন গাঁথতে শুরু করেছে। এমনকি সে মাদক সেবন ছেড়ে দেয়। শুরু হয় আলাদা একটা পৃথিবী। মায়ের কথা মত নামাজ আদায় করে। বিয়ের কিছুদিন ঘোরাঘুরি আর শশুড়বাড়ি ঢু দেয়া ছাড়া কোন কাজ তেমন নেই তার। এক্কেবারে আলালের ঘরে দুলাল। বিয়ের কয়েক মাস কাটানোর পর হঠাৎ বড় জন আবিষ্কার করল অন্য এক সময়কাল। আসলে সে কি করছে? বউ শশুড় বাড়ির লোকের ঐ এক কথা “জামাই কি করে?”
তার কি উত্তর সে দেবে? আর বিয়ের পর ভরনপোষণ এর একটা দায়িত্ব থেকে যায়। শুধু শুধু ঘরে থাকলেও তো চলবে না। বাবা মায়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তেমন আশাবাদী উত্তর সে পায় না। এরমানে হল, বউ আর বউয়ের বাড়ির লোকেরা তাকে কিছু বলেছে। যেমন ধরুন কথায় কথায় খোঁটা দেয়া। স্বামী অকর্মা। বেশ কিছুদিন ছটফট করে হঠাৎ একদিন সে বেড়িয়ে গেল এক নদীর পাড়ে। কোন নদীর পাড়ে জানেন?
এ সেই নদী, যেখানে ভোলা নৌকা ভেড়াতো। জগতনন্দী নদী। বড় জনের নাম হল শাহীদ।
৩
মানুষের কাঁধে যখন দায়িত্ব ঝুলিয়ে দেয়া হয় তখন সে হয়ে ওঠে অন্য এক মানুষ। ভোলা খুব অল্প বয়সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সব ঠিকঠাকই কাটছিলো শুধু হঠাৎ এক বৈরী হাওয়া অর্থাৎ নৌকা চুরি যাওয়া। ভোলা সব কিছু হারিয়ে নদীর পাড়ে চায়ের দোকানে মানে আমার টঙ্গের উপর বসে আছে। পকেটে কোন টাকা নেই যে এক কাপ চা খাবে। তবে সে হাল ছাড়েনি। এই যদি পরিচিত কোন কাস্টমার এর সাথে দেখা হয়ে যায় সে হয়তো এক কাপ চা এর অনুরোধ করে বসতে পারে। সেরকমই হল, শাহীদের সাথে দেখা হয়ে গেল ভোলার। এইতো কয়েকদিন আগের কথা, শাহীদ পরিবার পরিজন নিয়ে ভোলার নৌকায় চরে নদী ভ্রমণ করেছে। দু’জনের ঠিকই মনে আছে। তাই আর বুঝতে এবং কুশলাদি বিনিময় করতে দেরি হল না। বিকেল ঠিক চারটে। দু’জনের কথোপকথন -
শাহীদ- ভোলা দা, কেমন আছো? আজ নৌকা বের করোনি? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে সারাদিন তেমন কিছু খাওনি। কিছু হয়েছে নাকি? বলো তো?
ভোলা- আর শাহীদ ভাই। ভগবান যে হালোতে রাখেন ভালই আছি। আশাকরি আপনিও ভাল। নৌকাটা আর নেই ভাই। শকুনের চোখ পরেছে। হঠাৎ দু’দিন আগে কে বা কারা আমার নৌকাটা চুরি করে নিয়ে গেল। ওটাই আমার একমাত্র সম্বল ছিল। হাতের অবস্থা এতোটাই খারাপ যে বাসায় কিছু নিয়ে যেতে পারিনি। পেটেও তেমন কোনো দানাপানি পরেনি। এখানে বসে বসে ভাবছি কি করব।
এই কথা শুনে শাহীদের বুঝতে বাকি রইল না যে ভোলা তেমন কোন ভাল পরিস্থিতিতে নেই। বড় জন, ছোট জনের কথা থামিয়ে দিয়ে দোকানিকে দুটো টোস্ট বিস্কুট আর দু কাপ দুধ চা দিতে বললেন। তারপর আবার ছোট জনকে কথা শুনতে চাইল।
“বিশ্বাস আজ কোথায় বলতে পারেন! কই আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। দিন আনি দিন খাই। আজ দু’দিন হল বাড়ি ফিরি না। কোন মুখ নিয়ে ফিরবো তাও বুঝে উঠতে পারি না। চোখের সামনে সন্তানের অনাহারী মুখ ভেসে ওঠে। গ্রাম থেকে লোক পাঠায় খবর নিয়ে গেছে। আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। নিজে অসুস্থ। ঔষধের দাম বেশি দেখে খাই না। এই তো কয়দিন আগে ঘাটেই অজ্ঞান হয়েছিলাম। চোখ খুলে দেখি হাসপাতালে মেঝেতে শুয়ে আছি। চোখে ঝাপসা আলো। কত মানুষ চলাচল করছে কেউ কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। বাসায় জানাইনি। জানি, বাসায় জানালে চিন্তায় সবাই অসুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থতা দেখিয়ে ডাক্তার বাবুর হাতে পায়ে ধরে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ডাক্তার সাহেবের মুখে শুধু এতুটুকু জেনেছি শরীরের ভেতর রক্ত পচে গেছে।“
এই বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে গেল ভোলা। চায়ের কাপে চা শেষ। শাহীদ তাকিয়ে আছে ভোলার মুখের দিকে। কিছু বলবে মনে হল। হঠাৎ করে ভোলা বলে উঠল, “আমাকে কিছু টাকা দিতে পারেন? এই ধরেন হাজার বিশেক টাকা। নতুন একটা নৌকা কিনে আমি ধিরে ধিরে শোধ করে দেব। অনেক্কেই তো বলেছি। কেউ সায় দিল না।”
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মাগরিবের আজান পরছে। শাহীদ ভোলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কাল দেখা হবে। আমি নামাজ পড়ে চলে যাবো। আর আমি টাকার ব্যবস্থা করছি। আপাতত আমার কাছে পাঁচশত টাকা আছে। এটা রাখো। কিছু খরচ নিয়ে বাসা যাও। আমি আগামীকাল বিকেলে আসবো। তুমি চিন্তা করোনা।”
টাকা পেয়ে ভোলা অনেক খুশি। আশার আলো দেখতে পেয়েছে সে। হাট বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করে বাসায় ফিরল ভোলা। আর এরই মাঝে সব কিছু মন দিয়ে শুনছিলাম, দেখছিলাম আমি, শের আলী।
পরদিন দুপুর ঘনিয়ে বিকেল। ছোট জন ভোলা মাঝি হাজির। অপেক্ষা শাহীদ নামের সেই বড় জনের জন্য। ভোলা আত্মহারা। গুনগুনিয়ে গান গাইছে। মনের কামনা পূর্ণ হবার পালা। ভোলা বলল-
“আলী চাচা, এক কাপ চা দাও। তুমি দেখে নিও যারা আমার ক্ষতি করেছে তাদের ভগবান একটা বিচার করবে। গতকাল বাড়িতে গিয়ে বাচ্চা দুইটারে দেখিয়া চোখের পানি আটকাইতে পারি নাই। জানো আলী চাচা, থাকতে থাকতে হঠাৎ মাথা চক্কর দেয়। ডাক্তার বাবু বলেছিল শরীরে বড় অসুখ! সব ঠিক হয়ে যাবে কি বল চাচা? কিন্তু গতকালের ঐ ভাই আসতে চাইল। এখনও নেই।”
এভাবে অপেক্ষা করতে করতে সময় পেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে। তারপর ভোলা মাঝি চুপচাপ চলে যায়।
পরের দিন বিকেল বেলা বড় জন এসে ছোট জনের কথা জিজ্ঞেস করে। জানালাম, গতকাল এসেছিল। আজ আসেনি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল। এসব শুনে বড় জন আমাকে একখানা প্যাকেট দিয়ে বলে ভোলা মাঝি আসলে যেন তাকে এই প্যাকেটটা দেই। আর বলে, সে দু’ একের মধ্যে দেখা করবে। এই বলে শাহীদ আর দেরি করে না।
কাগজের প্যাকেট টা হাতে নিয়েই আমার আর বোঝার বাকি নেই যে এর মধ্যে ভোলা মাঝিকে ওয়াদা করা সেই বিশ হাজার টাকা আছে। তবে যাই হোক আমাকে আমানত বুঝিয়ে দিতে হবে। একদিন পর ভোলা ঘাটে ফিরলে আমি তার হাতে প্যাকেট টা বুঝিয়ে দিলাম আর বললাম শাহীদ মিয়া তোমাকে এটা দিতে বলেছে। আর বলেছে খুব তাড়াতাড়ি সে তোমার সাথে দেখা করবে।
ভোলার চোখে তখন জল টলমল করছে। এ এক আকস্মিক ঘটনা। মনে হল, ভগবান নিজে এসে ভোলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভোলা হু হু করে কেঁদে উঠলো। ভোলা আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। আমাকে জড়িয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না যে এটা কষ্টের কান্না নাকি উপকারীর উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। ভোলাকে সামলাতে বলে এক কাপ চা বানিয়ে দিলাম। ভোলা মাঝ দরিয়ার মত শান্ত হয়ে কি যেন ভাবলো। চা খাওয়ার পর কাগজের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলল, “আলী চাচা, আমি চলি। নৌকাটা তাড়াতাড়ি প্রস্তুত করতে হবে। আমার প্রাণের শাহীদ ভাই কখন চলে আসবে জানি না। এসে যদি দ্যাখে নৌকা এখনো জগতনন্দীর ঘাটে বাঁধতে পারিনি তাহলে মনে কষ্ট পাবে। হাতে সময় কম। আমি চললাম চাচা। আমি চললাম।”
৪
ইতিমধ্যে সূর্য মাথার উপর ঢলে পরেছে। জোহরের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই মুয়াজ্জিন জোহরের আজান দিবে। আমি আর আমার নাতী ছগির, মুড়ি আর খেজুরের গুড় মাখা টিন নিয়ে বসলাম। বললাম, দ্যাখ তোর নানীজান কতো সুন্দর করিয়া মুড়ি মাইখা দিছে। নে খা।
ছগির মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে বলল, “ও নানা, তারপর কি হইল কও তো”।
“ওরে আমার আদরের পোলা, আগে খাওনটা শ্যাষ কর। আমি নামাজটা আদায় করে আসি।”
ছগির মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে আবার বলল, “তুমি ঝটপট আসো কইলাম। আমি তোমার গল্প শেষ না কইরা যাইতাম না।” আমি নামাজ বাদ কবর জিয়ারত করিয়া আবার দোকানে গিয়া দুই মুঠ মুড়ি নিয়া খাইতে খাইতে গল্প শুরু করলাম।
৫
দেখতে দেখতে পনের দিন পাড় হল। শাহীদ মিয়ার দেখা নেই। ভোলা নতুন নৌকা নিয়ে আবার লোকজন পারাপারের ব্যবসা শুরু করে। বিকেল হলে আবার আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আলী চাচা, শাহীদ ভাইয়ের কোন খবর আছে?” আমি প্রতিবারেই একই জবাব দেই - “না”। তারপর হঠাৎ করে ক’দিন পর বিকেল বেলা শাহীদ মিয়া হাজির। আমি তড়িঘড়ি করে দোকান থেকে নেমে শাহীদ মিয়ারে জিজ্ঞেস করলাম, “এই মিয়া এতোদিন কই ছিলা। তোমার অপেক্ষায় আমাদের ভোলা মাঝি আধখান হয়ে গেছে। প্রতিদিন বিকালে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে শাহীদ ভাই এর কোন খবর আছে কি না? তুমি বসো মিয়া। কিন্তু মিয়া, তোমার শরীরের এই অবস্থা কেন? মনে হয় বহুদিন ধরে ভাত খাও না। কি হইছে? অসুস্থ নাকি?
আমি ভোলারে ডাক দেই।
ভোলা, ভোলারে, তাড়াতাড়ি আয়। শাহীদ মিয়া আইছে। আমি চা বিস্কুট দিতাছি তোমারে। তুমি খাও অপেক্ষা কর। ভোলা আইবোই আইবো।”
এরপর ভোলা মাঝি আর শাহীদ মিয়া একসাথে বসে অনেক সময় কাটায়। অনেক গল্প করে। আমি শুধু ওদের দু’জনের চোখে মুখে এক দীপ্ত কিরণের ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনে তখনও কিছু প্রশ্ন বারবার নাড়া দিচ্ছিল, শাহীদ মিয়া এই টাকা পেলো কোথায়? কেন এতো দিন পর শাহীদ মিয়া ভোলার সাথে দেখা করতে এলো? শাহীদ মিয়া এতো দিন কোথায় ছিল?
৬
একদিন ভোলা মাঝি শাহীদ মিয়াকে সংগে করে নৌকা নিয়ে নদীর মাঝ খানে গিয়ে মাছ ধরার জাল ফেলে বসল। অকুতভয় ভোলা শাহীদ মিয়াকে বলল, “ভাইজান, এতো দিন কোথায় ছিলেন?”
শাহীদ বলল, “আমি মনে হয় বেশি দিন তোমার নৌকায় যাত্রী হতে পারবো না ভোলা। আমি অনেক একা মানুষ। আগুনে পুড়ে পুড়ে এখন স্বপ্নহীন একজন মানুষ। শহরের সমভ্রান্ত পরিবারে আমার জন্ম। আমাদের খানদান চেনে না এমন কেউ নেই। আমার স্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রতি মাসে যে ভাড়া পাই তা খেয়ে দেয়ে আমি এবং আমার পরিবারের দিব্বি চলে যায়। শুধু চলে যায় না, খেয়ে পড়ে আরো বেঁচে যায়। কিন্তু ভোলা জানো, উপরে উপরে আমি যতই সুখি দেখাই না কেন ভেতরে একজন মরা মানুষ। আমার স্ত্রী, আমার সন্তান আমাকে কোন মূল্যায়ন করে না। সম্মান করে না। বাড়ির চাকর-ঝি এর মত আচরণ করে। কেন করে তাও জানি। মেয়েকে কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, তার বাবা কি করে তাহলে সে কি বলবে সে উত্তর তার কাছে নেই। বউকে তার পরিবারের সদস্যরা যদি প্রশ্ন করে যে তার স্বামী কি করে সে প্রশ্নের উত্তরও তার জানা নেই। আমি আমার সয় সম্পত্তি আমার বউকে লিখে দেয়ার পরেও তার ভালোবাসা আমি আজও পাইনি। এসব কিছু সহ্য করতে না পেরে আমি নেশা করতে শুরু করেছি। এমনকি তোমাকে যে অর্থ আমি দিয়েছি সেও আমাকে বউয়ের হাতে পায়ে ধরে এনে দিয়েছি। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না ভোলা। বউয়ের অকথ্য গালিগালাজ শুনে বাসায় থাকতে ইচ্ছে করে না। তার এই অমানবিক অত্যাচারে আমি সাত হাজার টাকা বেতনে পাশের এক পাড়া গ্রামে দোকানের চাকরি নিয়েছি। যেখানে মানুষ আমাকে না চেনে। আমার সম্পত্তির ভাড়ার টাকা সব আমার স্ত্রী একাই নিয়ে নেয়। একটি টাকাও আমাকে দেয় না। সকালে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। ইদানিং আমার বেতনের টাকার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমার মেয়ে আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। এও কি সম্ভব ভোলা।
শাহীদ ভাই, আমার যে বড্ড অসুখ। আমিও হয়তো
বলতে বলতে ভোলা আর শাহীদ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মনে হল পৃথিবী এই দুই জনের কাছে অনেক ঋণী। পৃথিবীর কি কোন শক্তি আছে এ দুজনের বুকের উপর থেকে পাহাড় সমান পাথর সরিয়ে দেবে?
৭
একদিন ভোলা বিকেল বেলা এসে শহীদ আর ভোলার কথাগুলো গল্পের তালে তালে সব আমাকে জানালো। আমি বিষন্নতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসমানের দিকে চেয়ে রইলাম। বেশ কিছুদিন যাবৎ শাহীদের দেখা নেই। আগের মত নদীর পাড়ে আসে না। ভোলারও দিন যায় নিশ্চুপে। ভোলার চিকিৎসা চলছে কিন্তু অর্থ যোগান দিতে না পেরে হোমিওপ্যাথি উপর ভরসা রেখে দিন রাত্রি এক করে কাজ করে যাচ্ছে। তবুও মাঝে মধ্যে লোক মুখে শোনা যায় ভোলা প্রায়শই অজ্ঞান হয়ে যায়।
একদিন হঠাৎ দুপুর বেলা ক’জন লোক চা খেতে খেতে আলাপ করছিল, গড়ের মাঠ নামক স্থানে কে বা কারা অজ্ঞাতনামা একজন মানুষকে খুন করে হাটখোলায় ফেলে রেখেছে। থানার দারোগা আর সাংবাদিকরাও উপস্থিত হয়েছে। পোশাক আসাক আর গড়ন গঠনের কথা শুনে ভেতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। দোকানে আর থাকতে পারলাম না। দ্রুত নেমে হাটখোলার দিকে হাঁটা ধরলাম। ভীর ঠেলে উঁকি দিয়ে দেখলাম, আমারদের বড় জন। সারা শরীর জুড়ে জখম। কাপড় রক্তাক্ত। লাশ পুলিশ ভ্যানে তুলবে এমন একটা পরিস্থিতি। আমি পিছিয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছি না। এ কি আমাদের শাহীদ মিয়া!! আমি ভোলা- ভোলা করতে করতে নদীর পাড়ের দিকে দৌড়ে গেলাম।
“ভোলা কোথায়? ভোলা?” পাড়ে এসে অনেককে জিজ্ঞেস করলাম। রতন নামের আরেক মাঝি আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বলল, আলী চাচা কি হইছে?
“ভোলাকে দেখছ কি রতন?” ভোলারে আমার খুব দরকার।
রতন বলল, “ ক্যান চাচা, আপনে জানেন না, ভোলারে দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে গেছে। গতকাল মাঝ দরিয়ায় ভোলা অজ্ঞান হয়ে যায়। আমরা ধরাধরি কইরা হাসপাতালে নিতেই ডাক্তার বাবু কইল ভোলা আর নাই। চাচা ও চাচা, কথা কওনা কেন!”
না, আমি ঠিক আছি রতন। খুব কাছ থেকে দুইটা শালিক পাখি উইরা যাইতে দেখলাম রতন।
নাতী ছগিরকে নিয়ে আলী চাচা বাড়ি পথে হাঁটা ধরল।
রংপুর
সত্তার মাতব্বরের স্বপ্ন
সত্তার মাতব্বরের স্বপ্ন
মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির
গতকাল তুলি চলে গেছে বিহঙ্গপুরূ জামাইবাড়ি। বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে তুলি। সবকিছু কেমন নিপুণ কৌশলে চুকে গেল একদম! বলতে গেলে বাংলা ফিল্মের মতনই; সিনেমার প্রথমার্ধে বহু ঝাপতাড়া কাটিয়ে কপোত-কপোতীর পিরিতবাসর। প্রেমখেলার ক’দিনের মাথায় প্রেমিকার বাড়িপক্ষ কর্তৃক জোরাজোরি করে বিয়ের পিরিতে বসানো। শেষমেশ লাগা গ্রামের পয়সাঅলা ব্যাংকার ছেলের হাতে গচ্ছিত রাখা। এইটুকু অবশ্য ঠিক ছিল তুলি আর শমসুর বেলায়ও। কিন্তু তুলির বরটা ব্যাংকারের পরিবর্তে হয়েছিল শিল্পবতী নওজোয়ান শিল্পবতী এটুকুই ফারাক। তার আরেক নতিদীর্ঘ আখ্যান। যাজ্ঞে আমাদের জানার বিষয় হলোতুলির বনিবনা হচ্ছিল না তার শিল্পবতী বরের সঙ্গে। যেভাবে ইন্ডিয়া আর জিম্বাবুয়ের ম্যাচটা পানিপানি হয় এমনই অবস্থা! তবুও সে চাচ্ছিল একপ্রকার সাধনা করেই মানিয়ে নিতে। ভাবছিলো দুনিয়া আর ক’দিনেরই। দেখতে দেখতেই চলে যায়! নাহ তা আর হলো কই! তুলির বরের পঁচাগলা লাশটা যেদিন মসজিদের পুরে ভেসে উঠলো তার পরদিনই তুলির বাবা সত্তার সাহেব তুলিকে ফিরিয়ে আনলেন নিজের দৌলতখানায়।
১.
শমসুর দুঃখবোধ জাগে তুলির জন্য। কুয়াশার আস্তরণের ভেতর অদূরে কোথাও গমগম আওয়াজে ডাকতে থাকে ডাহুক পাখি। ভাবনায় ডুবে দরদর ঘামতে থাকে সে। নৈঃশব্দের দীর্ঘতায় আচ্ছন্ন হয়ে ভাবেতুলি যদি আরেকটু কাজুমাজু করতো তার বাপের সাথে। তাইলে আর আজকের এই দূর্দশার ভার কাঁধে পড়তো না তার। বিয়ে করে সুখেই থাকতো শমসুর সাথে। তবুও সে দোষারোপ করতে চায় না তুলিকে। বছরতিনেকের গড়ে উঠা প্রেমকাব্যে সন্দেহের খাঁদ ঢুকাতে দ্বিধাবোধ করে শমসু। দীর্ঘক্ষণ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছেনাদানের মতো আবারও সে হাজির হবে সত্তার মিয়ার কাছে; একখানা শাদীর জন্য। সেই পুরোনো প্রস্তাব। পুরোনো নারীতুলি। শুধু মাঝখানটার গড়মিল, এটা সে ভুলে যাবে ইহকালের জন্য। জীবনের আর ক’দিনেরই!
২.
সত্তার মিয়া এবার ঠেলা বুঝেন। যদিও প্রতিশোধ বা ঠেলাধাক্কার কোনো কল্পনাই নেই দিলদার শমসুর। বিয়েটা তিনি দিবেন। মেয়েকে রাজি করান। রাজি করানোটা জরুর আসে। কারণ তুলি আর চায় না তারপুরোনো ঘা’তে মলম কিম্বা মরিচের গুঁড়ো ছিটাতে । কতজনই তো একা থাকে; ঘরকোণো হয়ে বা ভবঘুরে বেশে কাটিয়ে দেয় আস্ত একটা জীবন। তারও এই প্রতিজ্ঞা আজকাল। তাই সায় দেয়নি সে। বাবার কুঞ্চিত ললাট আর দিলফাঁড়া উৎকন্ঠার কাছে পরাভূত হয়ে এক পর্যায়ে রাজি হয় তুলি। চোখেমুখে নাটকীয় ঔজ্বল্য ছিটিয়ে রাজি হতে হয় তাকে! যেভাবে রাজি হয়েছিল প্রথম শাদীতে; শিল্পবতী বরের সাথে।
৩.
শমসু বেজায় খুশি। তার মুখ ফসকে উগড়ে যাওয়া কথাটি তাহলে বাস্তবতায় রঙিন হচ্ছে। তার মনে পড়েসে সত্তার সাহেবকে বলেছিল “আমি তুলিকেই বিয়ে করুম, ওরে ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো মেয়েরে ইসপর্শ করুম না আমি! হয়তো ওরে পামু নয়তো আজীবন একলাই থাকুম আমি।”
৪.
আরবি হিশাব অনুযায়ী আজ গত হয়েছে বুধবার রাত। একমাত্র মেয়ের জীবনভিটেয় সুখের প্রত্যাবর্তন দেখে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার এরাদা করেছিলেন সত্তার মাতব্বর। তা হয়নি বটে! ফজরের প্রারম্ভেই বিছানা ত্যাগ করেছেন। ওজু, এস্তেঞ্জা সেরে মসজিদের দিকে রওয়ানা হলে দেখলেন তুলির ঘরের দরজা থেকে একটা কপাট খোলা, হাবিয়া দোজখের দরোজার মতন উদাম । বেশ ভাবলেন না; শীতের আয়ত রাতূ তাকেও জাগতে হয় দু-তিন দফা! শীতের মৌন নির্যাতনে প্র¯্রাবের তাড়ায় নয়তো এমনিতেই ঘুম ভাঙে কখনো কখনো; এতোটা ভাবলেন কেবল। ঘরের গেইট বন্ধ করার জন্য রশিদকে হাঁক দিলে তারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না আজ! শরীর থাকলে তিনি এখন রশিদকে একটা গালি দিতেন “হালার পুত মরার ঘুম ঘুমাইছে” বলে। বয়েসের ভারে তা আর হয়নি বলে তিনি গেইটটা উদলা রেখেই মসজিদের পথ ধরলেন। বাড়ির ইটের তৈরি রাস্তা পশ্চাদে রেখে মূল পথে হাঁটতে লাগলেন । শীতল হাওয়া ভেদ করে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছেন তিনি। ভারী শীতের আবহ প্রকাশ পাচ্ছে তার গা-গতরে। তাই কুয়াশা মাপার জন্য দূরের দেশে তাকালে টাওর হলো কুয়াশা নেই তেমন একটা। ফলে গজ বিশেক দূরের বটগাছটাকেও চোখ কুঁচকানো ছাড়াই দেখা যাচ্ছে। আর ওই হতভাগা বটের ডালে আজও ঝুলে আছে আরেকখানা শীতল দেহ। এক মানবমূর্তি। বরফে জমে আছে একদম। এতো দূর থেকেও ঝুলদেহটা চেনা মনে হয় তার কাছে। গেল বছর যখন পুতুলের মা গলায় রশি দিয়ে মরলো তখনও সবার আগে যার চোখে লেগেছিল তিনি হলেনসত্তার মাতব্বর। তিনি আর মসজিদে যান না! রুটিন মাফিক ফজর ছুটে যায় তার। বেহুশ হয়ে ভাবা যায় কি না আমার জানা নেই তবুও ভাবেন সত্তার মাতব্বর তাইলে কি শমসু তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে—“আমি তুলিকেই বিয়ে করুম, ওরে ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো মেয়েরে ইসপর্শ করুম না আমি! হয়তো ওরে পামু নয়তো আজীবন একলাই থাকুম আমি।”
জিন্দাবাজার, সিলেট
পদাবলি : ০১
এ রাগ ক্ষেদ এ লজ্জা রাখার জায়গা নেই
আশরাফ চঞ্চল
দেশটাকে নিয়ে আগে খুব গর্ব হতো
এখন ঘেন্না হয়!
শুধু একটা লোকের কারণে
বিশেষ একটা দল ও গোষ্ঠী
দেশটাকে পচিয়েছে
বিশ্রী গন্ধে ছেয়েছে চারপাশ
এদেশে এখন বাস করা দায়
বিদেশের মাটিতে কেউ যখন জিজ্ঞেসা করে-
তোমার দেশ কই?
আমাকে মাথা নিচু করে বলতে হয়-
বাংলাদেশ!
নির্জনতার আলাপন
অনিন্দিতা মিত্র
তোমার খয়েরি রঙের শাড়ির জমিতে সরোদের সুরে সুরে রৌদ্র ছড়ান আমজাদ আলী, চিলাপাতা জঙ্গলের সবুজ আভা মেখে চাঁদের আলো টুপটাপ ঝরে পড়ে কবিতাখাতার অক্ষরশরীরে। স্মৃতিপথের হাহুতাশটুকু হেরে যায় তোমার রাতভোর ভালোবাসার কাছে। জ্যেৎস্নার সুগন্ধি মেখে সাঁঝের পাখিরা সাজায় কথকতার মেহফিল। বটের ঝুরির নগ্ন ছায়া জুড়ে প্রাণহীন স্বপ্নের বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি, প্রতিদিন আমি একটু একটু হেরে যাই নিজের প্রতিবিম্বের কাছে।
মায়ের ঢাকা বিভ্রম
সীমান্ত হেলাল
শেষবার মায়ের রাজধানীতে গমন অনেক নতুন চিন্তার জন্ম দিয়েছে!
নগরবাতির আলোয়- সন্ধ্যাকে শেষরাত; আর শেষরাতকে সন্ধ্যা বলার প্রয়াস- মায়ের চোখে নন্দনতত্ত্বিয় স্বার্থকতা দিতে পারে!
ইতোপূর্বে মা বহুবার ঢাকায় এসেছিলেন। এবারের গমন ঘটনাবহুল খুব! কিছুটা একরৈখিকও বটে! রাজপথে চলতে চলতে মা স্থানের সৌন্দর্য বর্ননায় মূখর হয়ে ওঠেন! কাকরাইলকে যাত্রাবাড়ি; যাত্রাবাড়িকে বাইতুল মোকাররম চিহ্নিত করার বিভ্রমে আমিও বারবার নিজেকে অচেনা পথিক ভাবা শুরু করি!
গাড়ির চাকায়- ঘুরতে থাকা ঢাকায়; নিজেকে বোকা ভেবে মায়ের কথায় সায় জানাই! পরিচয়ের ব্যঞ্জনায় মায়ের যুক্তিকে তর্কের চেয়ে অধিক মহান ভেবে চুপসে থাকি!
অথচ; ধর্মতত্ত্ব আর নান্দনিকতার লাগামহীন নস্টালজিয়ায় মা- আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন বারবার! ঢাকাকে বিবর্তিত গ্রাম ভেবে পান চিবানোর তৃষ্ণায়-নগরস্থাপত্যের কলা সমৃদ্ধ ফুটপাথে হেঁটে চলেন...!
লালগোলাপের শিশিরে ভরে যাক সবুজের ভূমি
মোস্তফা হায়দার
গলায় কাঁটা বিঁধে কাঁদছে কানিবক
শেয়াল তামাশায় করছে টগবগ।
পেয়ালায় নাচে মন খেতে সারাক্ষণ
তখতের দন্ধে অন্ধচোখে দেখি হিমবাতায়ন।
সবুজের সীমানায় লালের রশ্মি হাসে দিগন্তে
কাতরতায় ভেঙ্গে গেলে হদিস পাবে না শোকের অন্তে।
চাঁদেরও আঁধার আছে দিনের অবগাহন শেষে
সত্যমিথ্যারা বাঁশি বাজায় অন্ধের হাসি হেসে!
জোয়ারের পূর্বে ঘোলা জল জানান দেয় ¯্রােতের
ক্ষান্তির নোনাজলে ভেসে যাবে চিন্তা ও বেতালবোধের।
বেহুলার গায়ে মেখে উড়াল দেয় হিংসার অনল
আঁতুর ঘরের ছেলেরা জানি বসে দেখবে দাবানল!
লালগোলাপের শিশিরে ভরে যাক সবুজের ভূমি
কারবালার ফোরাত চাই না, চাই প্রেমের বাহুবাঁধা তুমি।
শীতের আলকেমি
রাজেশকান্তি দাশ
শীতে গাছের পাতা ঝরে যায়
পাখিরা ঝরে না। এক গাছ থেকে আরেক গাছে থাকে
পাখিরা গাছেই থাকে।
আমি মা’র কম্বল কিনতে বাজারে যাই
শীত সামগ্রীর দোকান, মেগা শপ... কত বড় বড়!
দাম আকাশছোঁয়া। আমার পকেটে পয়সা নাই
বাজারে গাছ একটাও নাই। পাখিও নাই
প্রবীণ করচতলায় বগা তালেব গান গায়। শীতের গান
আমি গানযোগে মনোনিবেশ করি
গানে বিলীনতা ও মলিনতার মূর্ছনা...
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি
বারান্দায় মাকে দেখে মনে হলো তার কম্বল কেনা হয় নাই
চোখ দিয়ে লিটার লিটার জল পড়তে থাকে
পৌষের হাড় কাঁপানো শীত কিন্তু আমার মা’র কম্বল নাই।
পদাবলি : ০২
অনুশোচনায় অমিয়
হাফিজুর রহমান
ভেবেছিলাম ঝগড়াঝাঁটি হবে, হলো না তো!
বর্ষাও লজ্জিত, অঝোর ধারায় শুরু হলো বৃষ্টি।
মনে হলো যেন ক্ষীণ বজ্রপাতের সম্ভাবনা!
গুমোট গগনে নেই কালো মেঘের ঘনঘটা,
মধুচন্দ্রিমার খোঁজে বুঝি ব্যস্ত বেশি পবন!
ভুলে একদম কালবৈশাখীর উচ্ছৃঙ্খলতা।
আমার পৃথিবীটাকে শান্ত দেখে, যেমন-
নিশ্চিন্ত হওয়ার কোন কারণ নেই! তেমনি-
জানি চাঁদ উঠবে না আজ বাদল দিনে,
তবুও পুলকিত প্রাণোচ্ছলতায় জ্যোৎস্না রাত!
হলোই বা মান অভিমানে ঠোকাঠুকি,
তাতে কী? গভীর বড় জ জ্যোৎস্নার প্রেম।
আবার কখনওবা শান্ত শীতলতায় সিক্ত হতে-
পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-নেত্রের একেকটি বৃষ্টিফোটা,
বিধ্বংসী বারুদের থেকেও বেশী সক্রিয়।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট উত্তাপ্ত
লাভার ন্যায় নির্গত, হয়তো দাম্পত্য জীবনে
ঘটে সম্পর্কের শক্ত প্রাচীর নির্মানে।
পোড়ানো হয় হৃদয়, খেলা করে ভালোবাসা
অধর যুগলে, পারস্পারিক অনুশোচনায়।
হঠাৎ করে দূরে সরে গেলে
মিসির হাছনাইন
হঠাৎ করে দূরে সরে গেলে
নিত্য দিনের পরিচিত কাছের
মানুষগুলো মনে রাখে না আর,
কিংবা করে না স্মরণ,
রাখে না যোগাযোগ,
কারণ, তাঁর প্রয়োজনে পাবে না তোমারে।
মানুষ যে শুধু প্রয়োজনে মনে রাখে!
দেখা হলে কথা বলে, এই মনে রাখে।
হঠাৎ করে দূরে সরে গেলে--
মানুষ ভুলে যায়, একদম ভুলে যায়।
মানুষ পারে, ভুলে থাকতে পারে।
নিশ্বাসের দিনে তুমি
জায়্যিদ জিদ্দান
আজকের সন্ধ্যা তো দেখেছো!
সুর্য ও তো দেখেছো- মৃত সূর্য।
তারপর- অনুজ্জ্বল সন্ধ্যারাগ, হিমেল সমীরণ, রাত, রাতের অন্ধকার, রূপোলী চাঁদ
আর ফিনিক ফুটা জোসনার প্লাবন - সবই তো দেখেছো।
আমার পাশে বসা ছিল লেজ কাটা একটি নেড়িকুকুর চোখের চারপাশে যাবতীয় বিষাদ
ছড়িয়ে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে
তাকে তো দেখো নি!
ওমা! তাকেও দেখেছো!
একজোড়া শালিক? ইলেক্ট্রিক তারের উপর বসা ছিল। তাকেও দেখেছো!
তাহলে আমি? আমাকে দেখোনি?
আমার নাকের নল বেয়ে বেরিয়ে আসা উত্তপ্ত নিশ্বাসগুলো?
বুকের বা পাশটায় -
গলগলে রক্ত আর এলোমেলো রগ-শিরা ছাপিয়ে একটুকরো মাংসপি-
সেখানে ভালোবাসার রং দিয়ে লেখা একটি নাম?
সেটা দেখেছো? দেখো নি!
আচ্ছা ভালোবাসার রং কি, জানো?
টুকটুকে লাল নাকি কুচকুচে কালো?
হেঁয়ালি জীবন
সাইফুল্লাহ ইবনে ইব্রাহিম
দিনশেষে পৃথিবীতে কিছু মানুষের
দাম যেন নেই কোনো, আছে ফানুসের
তবে ঠিক মিল পাবে এক দিকে তার
নানা কাজে তাকে সবে করে ব্যবহার
কেউ কেউ পৃথিবীতে অবহেলা পায়
ঘর-দোর যাই বলো যেখানেতে যায়
কেউ তার চায় না তো কভু কিছু ভালো
হুটহাট মনটাকে করে দেয় কালো
তাই বলি পৃথিবীতে একা ভালো থাকি
কারো কাছে সেধে গিয়ে ব্যথা পাব নাকি!
এই বোকা কেনো হব, প্রাণ আছে বুকে
লড়ে যাব জীবনের সাথে ধুঁকে ধুঁকে।
আবার যদি দেখা হয়
সোহানুজ্জামান মেহরান
আমিও সেই তোমার সম হইনি আজো, হবো না আর
হৃদয় কপাট শিথিল করে প্রেমের বাণী কবো না আর।
আজ সীমাহীন রুক্ষ আমি বিচিত্র গান নেই মুখেতে,
হৃদয় কাঁদে নামটি তোমার আনি আমি যেই মুখেতে!
তোমার থেকে আমিই বরং একটু বেশি অভিমানী,
আমি তোমার নই মানানসই আদি অন্ত সবই মানি।
ভুল ছিলনা তোমার কোনো ভুলটা আমার ভালোবাসা,
তোমায় জয়ের স্বপ্ন রচে করেছিলাম কালও আশা।
নিবিড় মনে একলা তুমি ভাবতে থাকো আমায় খুব,
দুটি চোখের কার্নিশে তাই ব্যথার বারিষ নামায় খুব।
ভাবছো মনে কষ্ট ভীষণ মুখ লুকিয়ে কাঁদছো তাই,
বুকের উপর বালিশ চেপে আমার উপর রাগছো তাই।
একলা পথে চলতে গিয়ে বাঁচার নামে মরছি রোজ,
অদূর হতে তোমার হাতটি কল্পনাতে ধরছি রোজ।
তোমার আমার এই দুটি নাম এক কালিতে লেখা হয়,
হাত ধরে ফের হাঁটবো দুজন আবার যদি দেখা হয়।
পদাবলি : ০৩
বিবেকের অপমৃত্যু
আদনান আল মিসবাহ
আলোর বিভায় সম্মোহিত পিপীলিকার মত আমাদের বিবেক
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে আছে
কর্তব্য নির্ণয়ের গোলকধাঁধায় পড়ে
স্মৃতির পাতা থেকে বিস্মৃত-
পূর্বসূরীদের তপ্ত খুনে রচিত গৌরবমাখা ইতিহাস
প্রলয়ংকরী বোমার মুহুর্মুহু আক্রমণ কিংবা
চিকিৎসালয় ধ্বংসের মত বিধ্বংসী হামলা
আমাদের জাগ্রত করে না
শিহরিত করে না আর
কোরআন পুড়িয়ে ফেলার নগ্ন মুহুর্তে
কোরআনের ঐশী বাণীর মর্ম
বিবেকের কানে ঝংকার তুলে না
ইসরাইলী আগ্রাসনে বিধ্বস্ত জনপদের
রক্তের ক্যানভাসে অঙ্কিত আবেদন
আমাদের বিবেকে নাড়া দেয় না
এ যেন অনুভূতিহীন নির্লজ্জ বিবেক
খেলাফত বিলুপ্তির সময়
ভূগর্ভ থেকে যে বিবেকের অকাল প্রয়াণ ঘটেছে
পিংক কালারের সভ্যতা
মাঈনুদ্দিন মাহমুদ
পিংক কালারের সভ্যতা
ঘেরাও করেছে মানবিক মনোজগৎ।
ধর্মীয় বুলি এখন
নানাবিধ অপকৌশলের হাতিয়ার,
স্বার্থান্বেষী মহলের
হিং¯্র থাবায় বিভক্ত, ধর্মীয় নীতিমালা।
প্রেম নিয়ে গেম খেলে
পিংক কালারের সভ্যতা,
উপহাসে অসামাজিক-সংস্কৃতি গড়ে নেয়
বিকৃত মস্তিষ্কবাদীরা।
অতিশয় ঘ্যারাকলে যুতিষ্টীয় আমলোক।
জল তপস্যা
দীপঙ্কর ইমন
ভুল জলে লেগেছে ঢেউ
মাছরাঙার বিদঘুটে হাসি।
দুরে,
সংসার ভেঙে গেল শালিকের।
হিজলের বন জ্বলছে,
কামার্ত সা¤্রাজ্যবাদের বারুদে।
অবশেষে টুনাটুনি
নিজের গোত্র চিনেছে।
তুমিও চিনবে একদিন
তোমার সীমাবদ্ধ স্বপ্ন কে।
জল তপস্যায় বসলে,
মাছরাঙাতেই বিলিন হবে কেবল।
এখনও শিকার ভুলে নি কেউ
“ আদিম বিদ্যা ” !
স্বপ্ন শিকার করে নিয়ে যায় গোত্র প্রধান,
নুন পান্তা খেলার ছলে।
ধানশালিকের জন্য
মোহাম্মদ আবদুর রহমান
আমি যখন নিজেকে দেখছি ব্যর্থতার ভূমি ধ্বসে তলিয়ে যাচ্ছি
তখনই ধানশালিক আমার হাত ধরে নিয়ে আসে এক নতুন সভ্যতায়
স্বপ্ন গুলো উজ্জীবিত হয়ে চলতে থাকে রাজ পথে
খুঁজে পায় কিছু নক্ষেত্র যারা আমাকে আলো দেয়
অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্য হাসে।
আলিঙ্গন
এম. তাওহিদ হোসেন
ফাগুনের হরিদ্রাভ গোধূলি লগ্নে,
ব্যগ্র চিত্তে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে
আলিঙ্গন করতে এসেছি তোমাকে,
তোমার ঐ বাহুডরে স্থান দিও আমাকে।
তোমার ঐ অপার স্নিগ্ধতার আবেশে
প্রভাবিত হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর মাড়িয়ে
এসেছি,
তোমার ঐ বাহুডোরে মাথা রেখে পুলকিত হবো বলে।
তোমার ঐ তেজোদ্দীপ্ত হৃদয়ের বিপ্লবী গান শুনতে এসেছি বিপ্লবী হতে
মিনতি করছি তুমি আলিঙ্গন করে তোমার ঐ
বিপ্লবী বাহুডোরে স্থান দিও আমাকে।
হাওয়াই মিঠাই
হাওয়াই মিঠাই
তামীম আল আদনান
১
অরু। ষোড়শী মেয়ে। ওড়নার কোণায় ঝুলে আছে দুরন্তপনা। স্বপ্নের অসংখ্য অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে অরু ভাবে ‘কিছুদিন বাদে আমার বিয়ে’! ভাবতেই লজ্জায় গলে যায়। অরু কল্পনায় একটা সংসার সাজায়। একটা ছিমছাম বাড়ি। বাড়ির দেয়ালে পরিচ্ছন্নতার ছাপ। পুতুলের মতো একটা মেয়ে ঘরময় হেঁটে বেড়াবে। অপরিচিত শশুর বাড়ির সবাই যদি চলে যায় তখন দিনশেষে স্বামী এসে বলবে মন খারাপ কেন? আমি আছি না তোমার পাশে! অরু তখন বালিকার মতো স্বামীর বুকে মাথা গুজবে। মনে মনে বলবে আমার ভরসার একমাত্র ছাদ।
এই রঙিন স্বপ্ন দেখা মেয়েটার বিয়ে হয়েছে আজ একযুগ হয়েছে। এতোদিনেও মেয়েটার নিজের কোনো সংসার হয়নি। ভরসার ছাদ ভাবা স্বামী কখনো বলেনি আজকে কি তোমার মন খারাপ (?) স্বপ্নের রঙিন শশুর বাড়িকে মনে হয় “পৃথিবীর সব চেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা”।
২
তপু দস্যি ছেলে। যার রঙিন ঘুড়িতে ভর করে নামে সন্ধ্যা-রাত। বড় হতে হতে তপু স্বপ্ন দেখে নিজের ভবিষ্যতের; বন্ধুদের বুক উঁচিয়ে বলে? “আমার ব্যাবসা বাবার ব্যাবসার চেয়েও বড় হবে। দেশের বাহিরেও আমার ব্যাবসার প্রজেক্ট থাকবে...” ঘনঘন রিকশার টুংটাং আওয়াজে বাস্তবে ফিরে আসে তপু। রিকশাওয়ালা ঝাঁঝালো গলায় বলে “ওই মিয়া বাসার থেইক্কা কি কিছু খাইয়া বাইর হননি! এক ঘন্টা ধইরা বেল বাজাইতোছি কানে যায় না?” রিকশাওয়ালার ভাবখানা এমন যে, এই শহরের সর্বশেষ জমিদার উনি।
তপু কপালের ঘাম মুছে স্বপ্নের রঙিন ফানুস উড়ানো শৈশবে আরো একবার ফিরে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে চালশূন্য হাঁড়ি, আবদার পূরণ না করায় গাল ফোলানো ছেলের শুকনো চেহারা, পাওনাদারদের অকথ্য ভাষা। তপু দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে; রঙিন স্বপ্নগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় রঙচটা বাস্তবতার কাছে। যেমন বাতাসে মিইয়ে যায় রঙিন ‘হাওয়াই মিঠাই’।
উৎসর্গ অরু এবং তপু কে। যারা মরে যাবার আগে স্বপ্নের মতন একটা দিন বাঁচতে চায়।
ভূতের প্যাঁচালী
ভূতের প্যাঁচালী
রফিকুল নাজিম
০১.
‘কয়দিন ধইরা আবার জিনিসটা ফিরা আইছে। যারে সামনে পায় তারেই নাকি জ্বালাইতাছে।’- চায়ের কাপে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করতে করতে কথাগুলো বললো কাসেম আলী। তালতলী বাজারের সবজি পট্টির শেষ মাথায় তার দোকান। সকাল থেকেই বাজারের লোকজন তার দোকানে চা নাস্তা করতে আসে। কথাটা শুনে সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বাকি গল্পটুকু শোনার জন্য সবার মন আকুপাকু করছে। পিরিচে ঠোঁট রেখে চায়ে দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে ফজর আলী জিজ্ঞেস করলো, কি রে কাসু, আবার কি অইলো? কেডা আইলো? খুইল্লা ক দেহি।’ একমনে কাসেম চুলায় কাঠের টুকরো দিচ্ছে। চুলার আগুনটাকে উস্কে দিয়ে বললো, ‘কেরে? কিছু মনে হয় হুনো নাই, ফজর ভাই? ‘দোকানে সুনসান নিরবতা নেমে আসলো। সবাই কানটা পেতে রাখলো কাসেমের ঠোঁটের দিকে। কথাটা শোনার কৌতূহলে কারো কারো আঙুলেই বিড়ি পুড়ছে, কারো কারো চায়ের কাপে নেমে আসছে হিমালয়ের শীতলতা!
হারাণ মাঝি অধৈর্য্য হয়ে ধমকের স্বরেই বললো,‘কাসু, এইডা তোর বদঅভ্যাস। গল্প শুরু কইরা জিরাইয়া জিরাইয়া কতা কছ। তাড়াতাড়ি ক তো দেহি; কি অইছে? নাইলে আমি ঘাটে যাই।’ এবার বিরক্তি নিয়ে কাসেম হারাণ মাঝির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ধূর মিয়া, বহো। কইতাছি।’ এবার সবাই আড়মোড়া দিয়ে বসলো। ‘গতকাইল রাইতে রমিজ মিয়ারে ভূতে ধরছিলো। ভোর রাইতে আযানের সময় আমি পিশাব করতে বাইর হইছিলাম। করুণ একটা গোঙানির শব্দ হুইন্না ভয় পাইয়া গেছিলাম। দৌঁড়াইয়া কুনুরহম জানডা লইয়া ঘরে গিয়া পড়ছি। তোমগো বউয়ের চিৎকার হুইন্না বাড়ির বেকতে উইঠ্যা পড়লো। পরে সবার সাথে আমিও কুপিবাতিডা লইয়া সামনে গিয়া দেহি ছাইয়ের পাড়াত রমিজ মিয়া চিৎ হইয়া গোঙাইতাছে। কি যে ভয়ংকর দৃশ্য! সারারাইত মনে হয় ধস্তাধস্তি করছে। রমিজ মিয়ার নাকে মুখে দেখি লোল বিজলা বাইর হইয়া গেছে। শইল্লের মইধ্যে লালচা দাগ। আযান না পড়লে মনে লয় মাইরাই ফালাইতো। আল্লায় বড় বাঁচান বাঁচাইছে রমিজরে’ -একটা গভীর নিঃশ্বাসে ফেলে একটু থামে কাসেম।
রাজমিস্ত্রি আবুল বেঞ্চ থেকে পা নামিয়ে বললো,‘গত পোরকা নাকি পুবপাড়ার কলিমুল্লা চাচারেও রাইতে আটকাইছিলো। এক পাও নাকি গাব গাছটার আগায়, আরেক পাও নাকি মাটিত আছিল। কল্লিমুল্লা চাচারে কইছিলো ঠ্যাংয়ের নিচে দিয়া যাইতো। কলিমুল্লাও চাচায় তো কম জানা লোক না! সূরা কিরাত পইড়া ফুঁ দিছে পরে নাকি ছাড়ছে।’
‘হ, গেলো বছর ছনু পাগলা ট্রাক একসিডিন্টে মরার পরেত্তে এই জায়গাডা দূষিত হইয়া গেছে। কবিরের মুরগির ফারোমের পর থেইক্কা ছনু পাগলার কবর পর্যন্ত কি ঘুটঘুইট্টা আন্ধাইর রে বাবা! গাব গাছের তলাটা আরো ভয়ংকর। দিনের বেলায়ও যাইতে গাও কাঁটা দিয়া উঠে। হুনছি একসিডিন্টে মানুষ মরলে নাকি ভূত হইয়া আহে। ছনু মিয়া তাইলে হাচাঐ ভূত হইয়া গেছে’- হারাণ মাঝিও গল্পে শরিক হয়। এবার ফজর আলী সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় এবং রমিজ মিয়ার সর্বশেষ খবর জানতে চায়। এমন সময় কাসেমের দোকানে আসে মেম্বার সাহেব। চেয়ার টেনে বসতে বসতে তিনি বললেন, রমিজ মিয়ার অবস্তা খুব একটা ভালা না। রমিজরে পানিতে বড়ইপাতা, নিমপাতা দিয়া গরম কইরা গোছল করাইছে। দাওয়ের আগাত নুন লইয়াও খাওইছে। তবুও তার রাইতের ব্যাপারটা যাইতাছে না। খালি কয় পাঁচটা পোলা নাকি তারে মারছে। ছায়ার মতোন নাকি পোলাগুলা আইয়া খুব জোরে জোরে মারছে! কওতো দেহি বেকতে কয় তারে ভূতে ধরছে। হারাণ মাঝি গলাটা একটু উঁচু করে বললো, ‘মেম্বার সাব, গতকাইল রাইতে তো রমিজ মিয়ারে আমি নদী পাড় করছি। মাউরা বাইত মনে হয় খুব বেশি মাল খাইছিল্। হাতেও এক বোতল আছিল্।’
০২.
দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে রমিজ মিয়ার বাড়িতে। তিন বন্ধু; বিটুল, তমাল, শরীফও বড় মসজিদের হুজুরকে সাথে নিয়ে এলাকার বিখ্যাত ঘুষখোর বিচারক রমিজ মিয়াকে দেখতে যায়। মওলানা সাহেব পড়াপানি দিয়েছে। রমিজ মিয়ার বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে তিনি কিসব পড়ে ফুঁ দিয়েছেন। বিটুলরা অনেকক্ষণ ঐ বাড়িতে ছিলো। বিটুল রমিজের সামনেই লুঙ্গির কোচর থেকে একশো টাকার একখানা নোট বের করে হুজুরের হাতে দিলো আর বললো, ‘হুজুর, যোহরের নামাজের পর রমিজ দাদার লাইগ্গা মিলাদ ও দোয়া পড়াইবেন। আমরা জিলাপি আর আগরবাতি লইয়া আমু নে।’
গতকাল সন্ধ্যায়ও রমিজ মিয়া সালিশ বৈঠকে দুই নাম্বারি করেছে। রহিমের কাছ থেকে পনেরো’শ টাকা খেয়ে তার পক্ষে মিথ্যা রায় দিয়েছে। উপরন্তু নিরাপরাধ করম আলীকেই বর্ব অপমান করলো। করম আলী শিশুর মতো বুকে চাপড় দিয়ে বিলাপ করছিলো! আর দু’হাত উপরে তুলে আল্লাহ কাছে নালিশ করেছিলো। অন্যায়ের বিচার চেয়েছিলো সে।
গ্রামের সবার মুখে একই কথা, রমিজকে ভূতে ধরছে। একেকজন একেকভাবে গল্পটা রসিয়ে কষিয়ে বলছে। তবে অনেকে খবরটা শুনে মনে মনে খুশিও হয়েছে। বিটুলরা করম আলীর খুপরি ঘরে ঢুকে বললো, ‘দেখছো চাচা, আল্লার মাইর শেষ রাইতে। তুমি নগদে বিচার পাইলা। তমাল, ট্যাহাগুলা আমার কাছে দে। ধরো, এহানে পনেরো’শ ট্যাহা আছে। রাখো। আবার ইস্কুলের সামনে তুমি ঝালমুড়ি বেচবা। আমগোরে মাঝে মাঝে একটু বেশি খাওয়াইয়ো কিন্তু।’ টাকাটা হাতে নিতেই করম আলীর চোখটা ছলছল করে উঠলো। তবে মুহুর্তেই শামুকের মতো কান্নাটা লুকিয়ে করম আলী মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাজানরা, হুনলাম ভূত নাকি পাঁচটা আছিল্? তয় এহন বাকি দুইটা কই?’ শরীফ বুদ্ধিজীবীর মতো উত্তর দিলো, ‘চাচা, রুমেল আর শাহিন ভূতের কথা হুনলে ডরায়....!-কথাটা শেষ হতেই না হতেই সবার হাসির শব্দে করম আলীর খুপরি ঘরটা কেঁপে উঠলো।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।
শব্দমালা : জ্যোতির্ময় শীল
শব্দমালা
জ্যোতির্ময় শীল
বুলডোজারের দ্বেষ
কানাঘুষো শোনা যায়
গৈরিক আবদার ঘেঁষে
পিতাভ সোহাগে ঘনিয়েছে এক তমসা।
জটিল সেসব হিসেব নিকেশে
বীতশোকে ক্ষুরধার সে শানাচ্ছে খতিয়ান।
অবহেলা কাঁকড় পাতে;
বরাদ্দ ভিটের পলি সরে
তোমার জিহ্বা যায় খাদের কিনারে।
যদি ভাবো—
“আগলে রাখা মাটি
আভাস-অভ্যাসের আম্মিজান
মেয়েবেলা ধুলোবালি,
ইমান লাঙল নাস্তা-রুটি
ইফতার ফরমায়েশি,
এত্ত আতর জরির আবদার মিশে
কাগুজে মাপে আঁটবে কি সে?”
খুলে দেখো দিনক্ষন দরজা সদর,
হয়তো বা টের পাবে ঠায় দাঁড়িয়ে এক বুলডোজার
হুলিয়া নিয়ে সে নব্য রাষ্ট্রের পেশ এক অস্থির নিবেদন!
সেই ধাতব চাকা চুঁইয়ে তরল দ্বেষ;
প্ল্যাকার্ড বধির লোলুপ অভিধানের
তাতে আঁচড় চিহ্ন ক্যাকটাসের;
তামাম বিষের অব্যয় নিয়েও সেজে উত্তম
যেন সাক্ষাৎ মর্যাদা পুরুষোত্তম!
এক সাইকেল মৃদঙ্গ
যখন হা পিত্তেস নিম্নচাপৃ
তখন সেই এক সাইকেল মৃদঙ্গ।
আমার বকুলে, শিমুলে, ঋতুতে
আস্তানা করে থাকা এক আনচান সামিয়ানা;
যখন তোমার বন্ধ দালান
প্যাডেলে স্পর্শ জাগিয়ে চিনে রাখি
যত আছে স্যাঁতস্যাঁতে অলিগলি;
অচির স্তর ছুঁয়ে সহসা ফাটল বেঁধে আসক্তি—
জায়মান মনকেমন বেতার অনুভূতি।
কলিংবেলের শব্দে ছোঁয়াই লালন-সাঁই
দিন-কে-দিন যেন সেতার টানের কুঞ্জছায়ায় ঠাঁই,
আটপৌড়ে হালফিলে বেসামাল।
নিজেকে আগলে সেই সাইকেলে মাইলফলকখানি তোমাকে পেরোই
চৈত্র শেষের দাবদাহে
কয়েক বয়ান রেখে ঋণ
আজকে তবে না ফেরার দিন।
দ্বিচারিতা চোরাবালি
শুকনো ফ্যাকাসে পাতা আনাচে-কানাচে
খুব চেনা ঘোলাটে ভাবে
জেদ যেমন শেওলা-পাঁচিল;
পূর্বাভাসহীন বৃষ্টিবাদল দিনে আবছায়া কাঁচের ফাঁকে
টের পাওয়া নৈঃশব্দের চিড়-ধরা উপকথা
ছুঁতে না পারা এক অজানা বিরুদ্ধতা;
সেই জায়মান অস্থিরতা
খানিক সে তীব্র ¯্রােতের ধারা
বাউল পাগলপারা।
দোটানার আনাগোনায়
সারমেয় শীতলতা।
কোনো এক বিকেলে সব ফুরোলে
বিরহ চিহ্ন বয়ে অবগাহনে
তারপর সাঁকো ধরে অনুবৃত্তি
বিষয় আশয় জুড়ে টুকরোখানি অভিলাসি;
রোদ্দুর ধাঁধানো দিনের মোহনাচরে
তার দ্বিচারিতা চোরাবালি।
হন্যমানে শরীরে?
নিভু নিভু কাঠ আগুনের
নির্বিকার ধূমাইত রেখায় মিশে শূন্যতা লেলিহান।
শবনীড় গঙ্গাজল,
অমোঘ উঠোন জুড়ে খানিক দুপুর জুঁইসাদা।
তারপর?
এরপর বাকী আর কিছু?
শুধু এক অনাবৃত চন্দ্রবিন্দু?
রোগাসোগা একরোখা
উস্কোখুস্কো চঞ্চল দামাল
অশ্লীল অভিধান
স্পর্শগ্রাহ্য মনবিতান
এখন জড়ির সুতোয় বাঁধা ফ্রেমে
খাঁ খাঁ অবয়ব বুকের ভেতরে।