পদাবলি
সন্তানদের চাহিদা ও হ্যালুসিনেশন
আল-আমীন আপেল
সুপ্রভা, নীলরঙা শাড়ি জড়িয়ে আসবে কি!
এক টুনটুনি ডাকা পড়ন্ত বিকেলে?
গহীন অরণ্যে নয়,
বিনয় বাবুদের তালপুকুর পাড়ে।
যেখানে রোমান্টিক শব্দগুলি হাওয়ায় ভাসে,
সেখান থেকে কিছু শব্দ ধার করবো।
তারপর, তোমায় গল্প শোনাবো।
আমার গল্প, আমার সন্তানদের গল্প।
সুপ্রভা, জানো ছেলে-মেয়েগুলি মাঝে মাঝে
আমায় ‘মা’ এর গল্প বলতে বলে।
আমি তোমার কথা বলি।
আজকাল ওরা তোমায় দেখতে চায়।
ওদের সবাই অশিক্ষিত পথশিশু বলে,
আমার গা সয় নি সেটা।
রোজ তাই স্টেশনের চত্বরে
বিকেল হলে ওদের পড়াই।
সুপ্রভা, লোকে বলে ওরা পরিচয়হীন, ওদের পরিচয় নাই।
দুই হাত বাড়িয়ে ডেকেছি ওদের-
মিলেছে সাড়া, বুকের বামপাশে জমিটা
এখন সেটা ওদের দখলে।
স্বার্থপরতার এ যুগে এসব দেখে, লোকে ‘পাগল’ বলে!
তাদের কথায় কষ্ট পাই না।
তবে সন্তানদের মায়ের চাহিদা আমায় ভাবায়।
ওদের নাকি মা চাই!
সুপ্রভা, মেয়েমানুষ নিয়ে আগে তো
কোনো দিন ভাবি নি,
তবে এখন কেন ভাবি?
আলসে দুপুরে তুমি আমায় ছুঁয়ে আছো!
ধ্যাত! এ নিশ্চিত হ্যালুসিনেশন।
সন্তানদের মায়ের চাহিদার প্রতিফলন।
রোদ্দুরে চাঁদ
সা’দ সাইফ
এখন আর হিমালিনীর গায়ে শুভ্র পোশাক নেই।
নেই হিরকদানার সেই সুগন্ধি।
যে সুগন্ধির পরশে শত শত শতদল বুজে রাখত তার পাপড়ি।
রাতের আকাশে নেই তাকিয়ে থাকা জোছনা বিলাস কিংবা জোছনার সুড়সুড়ি।
এ সবুজ প্রান্তর এখন ধুলো মলিন। পদে পদে রেখে যাওয়া পদচিহ্ন এক ঝাপটা
বৃষ্টিতে বেদখল।
রবিজ্জ্বল আলোকছটায় গায়ে মাখেনা তীব্র জ্বলন।
কারণ এ শহর তীব্র নোনায় ভরা।
শহরের প্রতিটি নলকূপ এখন এক একটা স্যালাইনের চৌবাচ্চা।
এখন আর চোখের পানি মাটি স্পর্শ করেনা।
মুখেই শুকিয়ে যায় খেজুরের খিলে থাকা জমাট রসের মত।
কারণ এ শহরে এখন রোদ্দুরে চাঁদ।
তোমাকে পান খাওয়াবো বলে
রুদ্র সাহাদাৎ
তোমাকে পান খাওয়াবো বলে- পানের বরজ বানিয়েছি
মহেশখালীর মৈনাকপর্বতের নিকটে-
ত্রিশ শতক পাহাড় কিনে।
মুরুব্বিদের মুখে পানের বহুত গুনগান শুনেছি
সেই শৈশব থেকে
পান নিয়ে আছে গান, কবিতা, সহস্র গল্প...
তোমাকে পান খাওয়াবো বলে নিজ হাতে পরিচর্যা করি
পানের বাগান অহর্নিশি।
সবুজ মিষ্টিপানের কিলি বানিয়ে প্রতিক্ষায় আছি
তুমি আর আসোনি।
চশমা
ইসমত জাহান লিমা
বিদ্যের দৌড়ে মোরা ছুটছি অহর্নিশ,
গাদিগাদি বইয়ে রাত্রিদিন করেছি এক।
জ্ঞানের ভারে নুইয়েছি উন্নত শির
আমরা অশিক্ষিত, আমরা পরাধীন-
আমরা বধির, আমরা নিথর বঙ্গবীর।
হারিয়ে ফেলেছি মুখের জোড়
হৃদয় ছোঁয় না শোষণ, নিপীড়ন।
কন্ঠে দিয়ে লৌহ কপাট!
প্রতিবাদী স্বর ওঠা কিভাবে সম্ভব?
চোখে লাগিয়ে বিদ্বানের উজ্জ্বলিত চশমা
তাইতো কেউ অন্যায়-অবিচার দেখিনা!!
কলমে লেখি না অন্যায়ের প্রতিবাদ
হাত গুটিয়ে দেখি বিদ্বেষ, নৈরাজ্য, অনাচার।
ধিক মোদের বিদ্বানের চশমায় লক্ষ ধিক!
আমরা মূক, আমরা কাপুরুষ,
আমরা নীচ, আমরা বাকরুদ্ধ বন্যজীব।
এই বুড়ো তোর কাপড় কোথায়
[কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর স্মরণে]
হিমাংশু দাস
অ্যক দৌড়ে-
পালিয়ে গেলি আগুনের ঘরে ।
ঐখানে তোর বসত;
জানি !
বুড়ো,
এই বুড়ো, তুই যাচ্ছিস কোথায় ?
তোর কাপড় কোথায় ?
এতদিন অন্যের কাপড় কোথায় খুঁজেছিস,
এখন তো, তোর কাপড় খুলে রয়ে গেল !
যাক আরেকটা কাপড় তো হলো,
পরতে পারব !
তোর কাপড়ে আমি ঘুমবো
তোর কাপড়ে আমি স্বপ্ন আঁকব
তোর কাপড় গায়ে মেখে আমি গন্ধ ছড়াব
তোর কাপড়ে আমি বৃষ্টি নামাব,
তোর কাপড়ে আমি প্রাণ জুড়াব রে বুড়ো !
এই বুড়ো, আমার লজ্জা আছে
তাই তোর কাপড় রেখে গেলি
আমার জন্য ! বল...
ঘুণপোকা
ঘুণপোকা
সুদীপ ঘোষাল
রতনের স্ত্রী সাত সকালে জানিয়ে দিলো জানালায় ঘুণ ধরেছে। প্রায় চারমাস বর্ষাকালে পশ্চিম ধারের জানালাটা খোলা হয় নি। ঘুণ এমনভাবে ধরেছে, জানলার একটা পাটা খুলে নিচে পড়ে গেছে।
রতন বললো, তোমাকে রোজ একবার করে খুলে যতœ করতে হতো। আমি তো বাইরে কাজে থাকি।
বউ বললো, কি করবো। আমি দেখিনি। নিচের জানালাটা বন্ধই থাকে।
যাই হোক ঘুণ তো কেউ ইচ্ছে করে ধরায় নি। কালে কালে সব কিছু সময়ের ঘুণে খেয়ে নেয়।
রতন ভাবলো, জানালাটা পুরোটা বন্ধ করে দেবে ইঁট গেঁথে। রাজমিস্ত্রি ডেকে আনতে হবে। কিন্তু তার আগে সুরক্ষার জন্যে দুটো পাটা পেরেক ঠুকে লাগানো প্রয়োজন। সব কিছু ঠিকঠাক হলে রতন নিজের কাজ নিয়ে বসলো। ভাবলো দাঁতে ব্যথা করছে। এক কাপ চা খাই। ঠান্ডার সময় ভালো লাগবে।
বেশ জমিয়ে চা পানে মগ্ন ছিলো রতন। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। খারাপ খবর এলো। তার মা অসুখে পড়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। আজ এখনি বড়দা খবর দিলেন, মা মারা গেছেন। বুকটা ধক ধক করে উঠলো জোরে। রতন কাঁদতে কাঁদতে বললো, শুনছো গো, আমি মাতৃহারা হলাম।
রতনের স্ত্রী বললো,এই সময় জোর ধরো। আমারও তো মা মরে গেলেন এই বছরে। বয়স হলে সবার অন্তিম পরিণতি এই মরণ। এখানে মানুষের কোনো হাত -নেই গো। যাও শ্মশানে যাও। আমি ও একবার দেখে আসি চলো।
দাদা আসছে মায়ের মরদেহ নিয়ে। শ্মশানের কাছাকাছি এসে গেছে। চলো আমরাও যাই।
-চলো, তাই চলো।
টোটোতে চেপে রতন ভাবছে, এখনি ঘুণ ধরা নিয়ে তোমাকে বকাবকি করলাম। অথচ মানুষের জীবনেও তো তলায় তলায় ঘুণ ধরে যায়। এই নিয়ম।
শ্মশানের কাছে এসে রতন হু হু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো...
মায়ের মরদেহ দাহ করে গঙ্গায় স্নান করলো সবাই। তারপর খাওয়ার পালা। যে যা পারলো খেলো।
রতন বলে উঠলো, এই একটা নিয়ম আমার ভালো লাগে না। নির্লজ্জ ভুরিভোজ।
বড়দা বললো, পাগলা, চুপ করে যা। এখন ওসব বলতে নেই। দেখবি শ্রাদ্ধের সময় রাগে সব একজোট হয়ে যাবে। নিমন্ত্রণ বর্জন করবে কিছু লোক। তখন খারাপ লাগবে আমাদের।
রতন চুপ করে গেলো। এবার কাছা পড়ে বাড়ি ঢোকা। দশ দিন পালন করতে হবে শোক। বাইরের লোক দেখানো শোক। চটি পরা যাবে না। হবিষ্যি রান্না করে খেতে হবে। মেঝেতে শুতে হবে। বাইরে একা যাওয়া যাবে না। তারপর বামুনের প্রসাদ পেয়ে শোকভঙ্গ। মানুষের মনের শোক অবধি নাগাল সমাজের সেনাপতিরা পায় না। হয়ত সব কিছু পালন করলো আর মনে মনে কষ্ট পেলো, হয়ত গালাগালি দিলো মনে মনে।
রতন ভাবছে এইসব। সে ভাবছে নিয়ম তো একদিনে উঠবে না। একটা মৃত মানুষের শোক পালন করতে গিয়ে জ্যান্ত বড়দা অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার এসে বললো, এনার এখন স্নান করা যাবে না। মাংসের ঝোল খেতে হবে। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু তার কথা মানা হলো না। বড়দা আরও অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভরতি করা হলো।
বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা একদিনে বন্ধ হয় নি। তারজন্য বিদ্যাসাগরের মত লোক, রামমোহনের মত মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। রতন ভাবে, এইসব করার লোক এখন কম। নিজের নিয়েই ব্যস্ত আমরা। কিন্তু ঘুণ ধরছে অন্তরে মানুষের সম্পর্কে। সমাজের কোণে কোণে।
বড়দা বললেন, ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি সুস্থ হয়ে যাবো শ্রাদ্ধের আগেই।
রতন আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বড়দা আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না। আবার দশদিন পরে বড়দারও শ্রাদ্ধ হয়ে গেলো। তার একটি মেয়ে আছে। বিয়ে এখনও হয় নি। রতনের মাথায় বাজ পড়লো। কি হবে এবার। কি করে মেয়েটার বিয়ে হবে।
বড়দার মেয়ে ঝুমা কথা কম বলে। শান্তশিষ্ট। খুব ভালো মেয়ে। এবারে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিয়ের জন্যে যোগাযোগ শুরু করেছে রতন। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে যাবে। এক বছর কাল অশৌচ। তার আগে বিয়ে দেওয়া যাবে না।
যেখানে যায় রতন সব ছেলের বাবা পণ চায় মোটা টাকা। বলে মেয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে তো কি হয়েছে। চাকরি তো করে না। করতে হবে রান্না। এক একটা পরিবার দশজন বারোজন করে আসে আর মিষ্টিমুখ করে চলে যায়। পছন্দ হয়। কিন্তু টাকায় হয় না। রঙ মেখে বসতে হয় ঝুমাকে ওদের সামনে।
একদিন ঝুমা রতনকে বললো, আমি এখন বিয়ে করবো না।
রতন বলে, কি করবি তাহলে?
আমি ছাত্র পড়াবো আর চাকরীর পরীক্ষা দেবো।
বেশ দু’বছর তাই চেষ্টা করবে। তারপর না হয় যোগাযোগ করা যাবে বিয়ের।
ঝুমা পড়ায় পাড়ায় পাড়ায় আর ইন্টারভিউ দেয় রেল, পি এস সি তে।
রতন ভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে বৌদির খেয়ে পড়ে চলে যাবে। দু’চার বিঘে চাষের জমি আছে। বছরে খোরাকির ধানটা পাবে।
রতনের সংসারে ঝামেলা নেই। ওরা স্বামী স্ত্রী। ছেলে পিলে হয় নি। হবে না। ডাক্তার বলে দিয়েছেন। একদম নিশ্চিত হয়ে ওরা হাল ছেড়ে দিয়েছে।
এখন রতনের একটাই চিন্তা কি করে ঝুমার বিয়েটা দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি। রতন ভালো রোজগারও করে না। নগদ টাকা চায় সবাই। তার সঙ্গে সোনাদানা। তারপর খাট, আলমারি, বিছানা। তিরিশটা নমস্কারি, দেড়শো বরযাত্রী। একটা মোটর বাইক। ছেলের আংটি, গলার চেন। সব মিলিয়ে টাকার পরিমাণ যা দাঁড়াবে তার সুদে একটা জীবন খেয়ে পরে চলে যাবে। মাসে মাসে যে টাকা পাবে চলে যাবে খেয়ে কোনোরকমে। রতন ভাবে তাহলে তো সংসার পাবে না। আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে। সাত পাঁচ ভেবে রতনের মেজাজটা বিগড়ে গেলো। এক কাপ চা খেলো। তারপর বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়লো।
ঝুমা অনেক চেষ্টা করে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরির, ভাইভা টেস্টে, গেলো। ওর মা বললেন, দেখ যদি চাকরিটা হয়। তাহলে আমরা দু’জনেই বেঁচে যাই।
ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনজন বসে আছেন। ঝুমার ডাক পরলো। ঝুমা ঢুকে চেয়ারে বসলো। একজন বললেন, আপনার সার্টিফিকেটগুলো সব দেখান। আর একজন বললেন, আপনার নিজের সম্বন্ধে কিছু বলুন। আর একজন বললো, আপনার ব্রাইট রেজাল্ট। কিন্তু শুধু ওতে কাজ হবে না।
ঝুমা বললো, আর কি করতে হবে বলুন।
একজন বললো, আমাদের কোয়ার্টারে একবার আসবেন। আগামীকাল সকাল সাতটার সময়। আমরা তিনজনেই থাকবো। সব তো দেখে নিলাম। আগামীকাল মিটিংয়ের পর আপনার চাকরি পাকা। কাল আসুন। একটু গল্প, একটু বিয়ার ।
ঝুমা ভয়ে পালিয়ে এসেছিলো। মানুষ যে এত অভদ্রতা করতে পারে ও জানতো না।
তারপর ঝুমা আরও অন্য চাকরির খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলো একটা ভালো খোঁজ। লোকটি বললো, আমরা আপনাদের মত বেকারদের জন্য বসে আছি। চাকরি হলে কিছু টাকা দেবেন। ওটা আপনার মর্জি। কাল আসুন দশটার সময়। আপনার চাকরি হবেই এমন কথা বলবো না। তবে চেষ্টা করবো। অনেকের চাকরি করে দিয়েছি। বাইরে বেরিয়ে দুটো ছেলেকে দেখতে পেলো ঝুমা। সে ছেলে দু’জনকে বললো, আপনারা কি এই অফিসে এসেছেন। ছেলে দু’টো বললো। আমাদের চারজন বন্ধুকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে অই লোকটা। আমাদেরও আগামীকাল আসতে বললো। এবার চাকরি আমাদের হবে। ছেলে দু’টোকে দেখে ঝুমার সাহস বাড়লো। এতক্ষণ বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এবার নিশ্চিনত হলো। কিন্তু মুখে কিছু না বলে এগিয়ে গেলো।
লোকটাকে দেখে ভালো লাগলো। হয়ত চাকরিটা হয়ে যাবে। তার মা বললেন, দেখো। কিন্তু সাবধান। সমাজে এখন ঘুণপোকা ধরেছে। তোমাকে সাবধানে থাকতে হবে।
সকাল আটটার মধ্যে সেজেগুজে ঝুমা বেরিয়ে গেলো। লোকটা অফিসে বসে আছে। আরও দুজন চাকরিপ্রার্থী বসে আছে। দেওয়ালে নেতাজীর ছবি। ঝুমার মনে সাহস এলো। দেওয়ালে ও কল্পনায় দেখতে পেলো ভারতবর্ষের মানচিত্র। সুন্দর, সবুজ দেশ।
কত সুন্দর আমাদের দেশ। কত সুসন্তানরা আমাদের দেশে জন্মেছেন। তাদের ত্যাগে আমরা স্বাধীন হয়েছি। ভাবতে ভাবতে ঝুমা স্বপ্নের সাগরে ডুব দিলো। সেখানে কত মণি রতœ। একটা রতœকণা সে খুঁজে পাবেই।
এবার ডাক পরলো কমলেশ সেন...
তারপর বিমল পাল....
ওরা চলে গেলো।
এবার ডাকলো ঝুমা।
ঝুমা একটু বোতলের জল খেয়ে ঢুকলো।
দেখলো একজন মহিলা বসে আছে চেয়ারে। সামনে টেবিল। বাঁদিকে বড় হল ঘর। পর পর খাট পাতা।
এ আবার কেমন অফিস?
মনকে জিজ্ঞেস করলো। আবার ভাবলো, দেখাই যাক।
এবার মহিলাটি কর্কশ কন্ঠে বললো, চাকরি করে কত টাকা পাবি।
চলে আয় আমাদের ডেরায়। পয়সা নিতে পারবি না।
ঝুমা ভাবছে, ও ভুল জায়গায় এসে পরেছে। ওর চারপাশে চারটে ছেলে ঘিরে ধরেছে। আর কিছু করার নেই। চিৎকার করতে পারলো না। গলা শুকিয়ে কাঠ।
মহিলা বলছে, তোর প্রথম খেপেই এখনি দশ হাজার পাবি। কোনো মাসে বিশও হয়ে যাবে। যা ভিতরে যা। বসে আছে সিল খোলার নাঙ। ঝুমার কান, গাল লাল হয়ে গেলো খিস্তি শুনে।এবার মহিলা আয়েশ করে সিগারেট ধরালো।
চারজন জোর করে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো। ভিতরে সুন্দর বিছানায় একটা ভুঁড়িওয়ালা লোক বসে পান খাচ্ছে। আর হাসছে নির্লজ্জের মতো।
ঝুমার মনে ভেসে উঠলো, বাবা, মা, কাকা, কাকিমার মুখ। তাদের সাবধান বাণী মনে পড়লো। মনে হচ্ছে তারা চিৎকার করে বলছে, সাবধান ঝুমা। সমাজের অঙ্গে এখন বেশির ভাগ পোকা ধরেছে। ঘুণপোকা, ঘুণপোকা....
নন্দনপাড়া, খাজুরডিহি, পূর্ব বর্ধমান ।
ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১২
(গত সংখ্যার পর)
বেবী আপা বলতে থাকেন, স্বৈরাচারবিরোধী আজকের এই সমাবেশ। সভাপতি এবং প্রধান অতিথি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আজকে জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে, তা আপনারা জানেন। জাতির মাথার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা, সামরিক জান্তা এরশাদকে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাড়িয়ে জননী-জন্মভূমিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা রাজপথে বেরিয়ে এসেছি, তার পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না। স্বাধীনতাযুদ্ধের সন্তান হিসেবে আমরা কি বসুনিয়াদের রক্তকে ভুলে যাব? যেতে পারি?
চারদিক থেকে চিৎকার ওঠে, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’
ঠিক এ সময় মেডিকেল গেট থেকে টিয়ারশেল ফাটার শব্দ হলো। চারদিকে সেøাগান চলছে। বেবী আপা বক্তৃতা থামানোর পর চারদিক থেকে হায়েনার মতো এরশাদের পেটুয়া আর পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল। টিয়ার শেল, আর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় চর্তুদিক আচ্ছন্ন। সমাবেশ থেকে দৌড়ে পালাচ্ছে জনতা। উর্মিলা লক্ষ করল বেবী আপা পড়ে যাচ্ছে। নাক মুখে গ্যাসের ক্রিয়ায় জ্বালা করছে উর্মিলার। এ সময় মঞ্চের ওপর দুটো টিয়ার শেল এসে পড়ে। বেবী আপা ছিটকে পড়ে যান। দৌড়ে গিয়ে বেবী আপাকে জড়িয়ে ধরে উর্মিলা। শাহরিয়ার কবির শহীদ জননীকে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। লাঠিচার্জে আহতরা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হতভম্ব উর্মিলা বেবী আপাকে নিয়ে উড়নিতে চোখ ঢেকে বসে থাকে। ঠিক এ সময় একটি টিয়ার শেল এসে পরে উর্মিলার দু’হাত দূরে। শুধু অনুভব করে চোখের পাশ দিয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা বইয়ে যাচ্ছে। তারপর আর কিছুই মনে নেই উর্মিলার।
১৩.
যখন জ্ঞান ফিরল তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। স্যালাইন চলছে। বেডের চারপাশে ডাক্তার-নার্স তাকে পরীক্ষা করছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। নিজকে ভয়ানক দুর্বল মনে হচ্ছে। সারা শরীর ব্যথা। পরিচিত কোনও মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
একজন ডাক্তার বলে উঠল, ‘ওকে গুড। ভয় পেয়েছিলাম। মাথার ইনজুরি বেশ ডিপ। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। থ্যাঙ্কস গড। সিস্টার পেশেন্টকে একটা প্যাথেড্রিন দিয়ে দিন। রাতের মতো ঘুমাক।’
ডাক্তার সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রুবী ছুটে এল। উর্মিলাকে অনেকটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘উর্মি আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তোর কিছু হলে আমার কী হতো! বেবী আপা আহত। শহীদ জননীসহ প্রায় বিশজন আহত। তোদের কারণে সারাদেশ তোলপাড়। বাইরে এতক্ষণ সেøাগান হচ্ছিল। শহীদ জননী, বেবী আপাসহ তোদের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
ঝড়ের বেগে কথা বলছে রুবী। সিস্টার এসে বলল, ‘রুগিকে সাউন্ডলেস থাকতে হবে।’
‘আমি তো ওর পাশে থাকব। ও আমার বোন।’
‘থাকবেন। তবে কথা বলা যাবে না। সদ্য জ্ঞান ফিরেছে।’
‘না না আমি কথা বলব না।’
‘পেশেন্টকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে যাবেন।’
রুবী উর্মিলার একটা হাত ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আর ইনজেকশনের ক্রিয়ায় উর্মিলার চোখ নেতিয়ে আসে। হাসপাতাল জুড়ে দাপাদাপি। রাজনৈতিক কর্মী থেকে আরম্ভ করে আম জনতা জানতে চায় আহতদের সর্বশেষ অবস্থা। সাংবাদিক-পুলিশসহ আহতদের আত্মীয়স্বজনে হাসপাতাল সয়লাব। ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের ফটোগ্রাফাররা আহতদের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। কেউ বুঝতেও পারেনি কেন শান্তিপূর্ণ এই জনসভায় ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ।
রাত দশটার দিকে এক প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে দীপু ভাই এল।
উর্মিলা জ্ঞান ফিরেছে জেনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দীপু ভাইয়ের মুখ।
রুবীকে বলে, ‘খাবার খেয়ে নাও। কেবিনে শহীদ জননী আর আর রুবী আপা ঘুমাচ্ছে। তাদের অবস্থা অনেকটা ভালো। তবে বেবী আপার হার্ট অ্যাবনরমাল। তোমাকে তো আজ দেবীর সঙ্গে থাকতে হবে।’ বারান্দায় হেঁটে আসে রুবী আর দীপু ভাই।
রুবী বলে, দীপু ভাই, উর্মির জন্য আমার বুকে এত মমতা জমেছে তা আমি আগে বুঝতে পারিনি।’ রুবী কাঁদতে থাকে।
দীপু ভাই বিষণœ কণ্ঠে বলে, ‘রুবী, জন্মভূমির জন্য দেবী রক্ত দিয়েছে। সেকি সাধারণ! তুমি বিশ্বাস করো, এ জীবনে এত শূন্যতা আমাকে কখনও গ্রাস করেনি।’
দীপু ভাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। রুবীর মনে হয় দীপু ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে।
‘রুবী আজ রাতটা জেগে থেকো। সকালে শিমু, মিতালীরা আসলে ঘুমুতে যেও।’
‘ওকে এ অবস্থায় রেখে আমার ঘুম আসবে আপনি ভাবলেন কী করে।’
‘না না আমি তা বলিনি! রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। কখন আবার কী হয়।’
‘বালাই ষাট।’ রুবী বলে।
রুবীকে বারান্দায় রেখে দীপু ভাই উর্মিলার বেডের কাছে চলে আসে। হাত দিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করে। শরীর ঠা-া। ইনজেকশনের ক্রিয়ায় উর্মিলা ঘুমের অতলে। একটু কাঁপল না। একজন নারী হাসপাতালের বেডে লম্বালম্বি শুয়ে আছে। দীপু ভাইয়ের একবার মনে হলো, উর্মিলার জন্যই এ মানবজন্ম। সত্যি, বেবী আপা সত্যকে ধরতে পারে।
দীপু ভাই বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। রুবীর একবার মনে হলো দীপু ভাইকে বলে, ‘দীপু ভাই আমি কি খুকি? রূপকথার বই দিয়েছেন কেন?’ বলা হয় না। খিলানের আড়ালে এক সময় অদৃশ্য হয়ে যান দীপু ভাই।
রুবী বারান্দার আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনুভব করে ও কাঁদছে। ওর কী যেন নেই।
উর্মিলার যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেছে। রুবী বাসায় চলে গেছে! প্রফেসর রাউন্ডে এসেছে। অন্যান্য আহত রোগীদের দেখে যখন উর্মিলার কাছে এল তখন নয়টা বাজে!
প্রফেসর বলল, পেশেন্ট তো সুস্থ হয়ে গেছে। রাতে অবস্থা খারাপ ছিল। ভয় পেয়েছিলাম। এখন তো দিব্যি পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারের দিকে যেতে পারবে।’
উর্মিলা কথা বলে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘অবশ্য দু’একদিনের মধ্যে ছেড়ে দেব। স্পিøন্টারের ক্ষত, ড্রেসিং থাকতে হবে। ডিস্টার্ব করতে দেয়া যাবে না। পত্রিকাওয়ালাদেরও না।’
চিকিৎসাপত্রে নতুন অর্ডার লিখে প্রফেসর বেরিয়ে যেতেই বারান্দা থেকে দৌড়ে এল মিতালী সিকদার, শিমু দিদি আর নাজনীন আপা। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা উর্মিলা চিৎপাত হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে জটলার শেষ নেই।
‘মিতালী সিকদার বলল, উর্মি, ইউ আর গ্রেট।’
শিমু দিদি বলল, ‘নেশন ডোয়াটার!’
নাজনীন আপা বলে, ‘কিরে, তোর আর সাক্ষাৎকার নিতে হবে না, কতজন তোরটাই নেবে! আমি তোকে হিংসে করছি উর্মি।’
উর্মিলার ঠোঁটের কিনারে একটু ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে।
‘বেবী আপা টেলিভিশনে উর্মির কথা বলছে। কীভাবে উর্মি তাকে শরীর দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও দ্বিধা ছিল না!
মিতালী সিকদার গর্ব ভরে বলে।
‘শহীদ জননী বলেছেন, যেখানে পীড়ন, সেখানেই রক্ত ঢেলে দেব। রক্তে কেনা বাংলাদেশে স্বৈরাচারের স্থান হতে পারে না।’ শিমু দিদি কলকল করে বলে চলেন।
নাজনীন আপা বললেন, ‘উর্মি আমাদের সহযোদ্ধা। লড়াকু। আমরা ওকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব।’
‘পেশেন্টকে এভাবে ডিস্টার্ব করা কি ঠিক?’ সিস্টার অনুযোগ করে।
‘ঠিক না কী করব আপনজনের কষ্ট ভাগ করে নেব।’ মিতালী সিকদার উর্মিলার হাতে হাত রাখে।
উর্মিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘দিদি, আমার কোনো কষ্ট নেই। বাবা কি জানে?’
‘ওসব নিয়ে ভেব না। আগে সুস্থ হয়ে ওঠো।’
‘বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘নিশ্চয়ই দেখবে। সে ব্যবস্থাই করব।’ নাজনীন আপা বললেন।
‘তোমার মদনতো স্তম্বিত। মদন ঠাকুর জাকির বাবাজী।’ উর্মিলা লজ্জা পায়।
এ সময় উর্মিলাকে দেখতে আসেন তেজগাঁও মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল ডলি আপা।
সরাসরি উর্মিলার বেডের কাছে এসে বলেন, ‘ও তুমি আমার ছাত্রী। তোমার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই তোমার এমন বিপর্যয় নেমে এসেছে। বেবী পত্রিকায় তোমার কথা না বললে তো জানতেই পারতাম না। তোমার শরীর এখন ভালো তো?’
উর্মিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘জি ভালো।’
‘তোমার জন্য আমার কলেজের ছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছে। বেবী আহত। শহীদ জননী আহত। ভাবা যায়!’ প্রিন্সিপাল ডলি আপা উষ্মা প্রকাশ করেন।
‘তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি তোমার জন্য বিবৃতি দেব। প্রেস কনফারেন্স করব। আমরা কি আইয়ামে জাহিলাতে বসবাস করছি!’ ডলি আপা উর্মিলার হাত ধরে আদর করে। ওর চোখে জল গড়াতে থাকে।
‘আপনারা পেশেন্টকে রেস্টে থাকতে দিন?’ সিসটার বলে।
ডলি আপা তার লোকজন নিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন।
মিতালী সিকদার, নাজনীন আপা, শিমু দিদি বেবী আপাকে দেখার জন্য কেবিনের দিকে ছুটে যায়।
তারও দশ মিনিট পর দীপু ভাই আসেন। হাতে রাজ্যের সংবাদপত্র। হরলিকসসহ নানান পানীয়।
উর্মিলা তখন তন্দ্রায় চলে গেছে। দীপু ভাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উর্মিলার একটি হাত ধরলে, ওর তন্দ্রা কেটে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই উর্মিলা ভাই দেখে, কী গভীর একাগ্রতা নিয়ে দীপু ভাই চেয়ে আছে। উর্মিলা তন্দ্রা-আক্রান্ত চোখে ধূসরতার ছাপ থাকলেও হাতটি সরিয়ে নেয় না। বরঞ্চ আগ বাড়িয়ে ধরতে চায়। দীপু ভাই বাকরুদ্ধ। উর্মিলার চোখে জলের রেখা।
‘দেবী দুর্গা কাঁদলে মানুষের অকল্যাণ হয়। আমি তো নেশন কন্যার হাত ধরেছি।’
এ সময় উর্মিলার আঁখি পল্লব ভিজে দু’ঁেফাটা জল গড়ায়। দীপু ভাই হাত দিয়ে ওর চোখের জল স্পর্শ করে। দীপু ভাইয়ের মনে হয় মমতা শূন্য এ নারীর জন্য এত আবেগ জন্মেছে যে, তা সামলানোই কঠিন।
পত্রিকাগুলো একেবারে উর্মিলার সামনে মেলে ধরে। প্রতিটি কাগজের হেডলাইন শহীদ জননী, বেবী আপা, শাহরিয়ার কবিরসহ আহতদের ছবি। অধিকাংশ পত্রিকা ছেপেছে বেবী আপাকে জড়িয়ে ধরা উর্মিলার ছবি।
‘দেবী তো দেশজোড়া এক লড়াকু নারীর নাম এখন। যার পূর্বপুরুষ সাপের ওঝা ছিলেন। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছে। এখন স্বৈরাচারের বিষদাঁত খুলে ফেলার জন্য রাজপথে নেমেছে। আমি কি দূরে থাকব?’
‘দূরে থাকবেন কেন? হাত তো ধরেই আছেন।’ উর্মিলার ঠোঁটে হাসির রেখা ফোটে। দীপু ভাই হাত সরিয়ে নেবার জন্য চেষ্টা করে।
উর্মিলা বলে, ‘এ হাত সরিয়ে নেবেন না। সাহায্য করুন।’
দীপু ভাই উর্মিলার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিষলক্ষ্যার ছুরির মতো বিদ্ধ হতে থাকে অচিন এক দৃষ্টিবান। সে ভাষা উর্মিলা বোঝে না, দীপু ভাই বোঝেনি।
[চলবে]
মহাজন
মহাজন
প্রকৌ. আমিনুল ইসলাম
বাবুল সাহেব অনেক পরিশ্রম করে আজ একটি কোম্পানির মালিক হয়েছেন।
তিনি জরুরী কাজে যাবেন তার ফ্যাক্টরিতে। অফিসের জরুরী কাজটি শেষ করে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবেন।
তার ব্যক্তিগত গাড়িটি হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলো। গাড়ির ড্রাইভার বলেছে, গাড়ি দুপুরের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের দাওয়াতে গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।
বাবুল সাহেব অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়াই বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। তিনি হাঁটছেন আর ভাবছেন কিভাবে অফিসে যাওয়া যায়। এই রাস্তাটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রোড। বড় বড় ট্রাক চলে এই রাস্তায়। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তা ঠিক করার কিছুদিনের মধ্যেই আবার খারাপ হয়ে যায়। তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটি চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালেন। দোকানদার বলে উঠলেন,
‘ভাই চা খাবেন?
‘দিন।
‘ভাইজান আপনাকে কখনো এদিকে দেখি নাই । কই যাবেন এই দিকে?’
‘বাবুল কসমেটিকস গেইটে যাবো’
‘সে তো অনেক দূর । রিক্সা, টেক্সি, বাস কোন কিছুই এই রাস্তায় চলেনা। এক কাজ করেন, ড্রাইভারের পাশে বসে যে কোন একটি ট্রাকে করে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার এক পরিচিত ট্রাক ড্রাইভার আসবে । আপনি চাইলে তার সাথে আপনাকে উঠিয়ে দিতে পারি । এখন চা খেতে থাকুন । আমি আপনাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
‘আমাকেতো এখনো চা দেন নাই।’
‘ও দেই নাই? কথা বলতে বলতে ভুলে গেছি । আমি আবার ভুলো মন স্বভাবের মানুষ। আমার নাম মফিজ। কয়েক দিন আগে আমার পরিচিত একজন দোকানের সামনে এসে আমাকে ডাকছিল, মফিজ ভাই, মফিজ ভাই। আমি উত্তর দিলাম, মফিজ ভাই নাই। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার নাম মফিজ। হা হা হা।
‘আপনি আসলে ভুলো মন স্বভাবের না । আপনার আই কিউ একটু কম।
‘আই কিউটা কি ভাই? এইটার নামতো কোন দিন শুনি নাই’
‘আপনি যে আমাকে চা না দিয়ে বকবক করে যাচ্ছেন । এটাকেই আইকিউ কম বলে।
‘দেখছেন ভাই আমি কতটা ভুলো মনের?
‘আপনার ব্রেইনে একটিভ নিউরন কম।
‘এইসব কি বলেন কিছু বুঝিনা। নেন চা খান।
‘আপনার চা লবণাক্ত কেন’
‘খাইতে খারাপ লাগছে ভাই? সবাইতো খায়।’
‘আপনি কি চায়ে লবন দিছেন?’
‘জ্বি ভাই।
‘আমাকে লবণ ছাড়া চা খাওয়াতে পারবে?’
‘না ভাই। লবণ চিনি একসাথে লিকারের সাথে দিয়ে দিছি।
‘লবণ কিন্তু শরীরের জন্য খারাপ, আপনি জানেন কি?
‘আমার মায়ের কিডনিতে সমস্যা ছিল। ডাক্তার বলেছিল লবণ না খেতে। মাকে লবণ খাওয়াই নাই, তাও আমার মা মারা গেছেন। আমার মনে হয় ভাই মানুষ লবণ খাইলেও মরে, না খাইলেও মরে।
‘আপনি চায়ে লবণ দেন কেন?’
‘বেশি লাভের জন্য ভাই’
‘মানে?’
‘লবণ ছাড়া চা বেচলে দিনে যে চিনি লাগে। আর আধা কেজি লবণ যদি চিনির সাথে মিশিয়ে দেই তবে দিনে আড়াই কেজি চিনি কম লাগে। এতে প্রতিদিন প্রায় দেড়শো টাকা বেশি লাভ হয়। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা। আমি গরীব মানুষ ভাই। সাড়ে চার হাজার কি কম টাকা, আপনিই বলেন?
রতন একজন ট্রাক ড্রাইভার। প্রায় সময় মফিজের দোকান থেকে পান-সিগারেট বাকীতে খেয়ে যায়। বয়স বেশি না । তবে দেখতে বয়স্ক মনে হয়। চোখ দুটি লালচে থাকে সব সময়। মফিজের দোকানে এসে প্রথমে একটি সিগারেট ধরাবে, তারপর চা খেতে খেতে সিগারেটা শেষ করবে। চা-সিগারেট খাওয়ার পর একটি পান মুখে দিয়ে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে চলে যাবে।
রতন দৌঁড়ে এসে বলছে, ‘মফিজ ভাই নাও তোমার সব টাকা। আমি নেশাখোর হলেও মানুষ কিন্তু সৎ । কারো টাকা মেরে খাই না । আমাকে বাকি দিতে ভয় করো না।’
মফিজ বলল, ‘তা আমি জানি। রতন টাকা মেরে খাওয়ার লোক না। তুমি কি বাবুল কসমেটিকস গেইটের দিকে যাচ্ছো?’ ‘মহাজন গাড়িতে বসা আছে। ঐ দিকেই যাবে বলেছেন।’
‘তুমি এই লোকটারে একটু বাবুল কসমেটিকস গেইটে নামিয়ে দিও।
‘কে উনি? চেহারা তো ভালই দেখছি।
বাবুল কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারের সাথে উঠলো তার গাড়িতে । গাড়িতে উঠে দেখে ড্রাইভারের পাশে আরেকজন লোক বসে আছেন। পরনে সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি। তিনি পায়ের উপর পা তুলে পা নাচাচ্ছেন আর হাতের মোবাইল টিপছেন। মোবাইল খুব দামি। চোখে চশমাও আছে। চশমার ফ্রেম সোনালী রঙের। বাবুল সাহেব গাড়িতে বসছে দেখে লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাবেন আপনি?
‘আমাকে বলছেন?
‘এইখানে কি আর কেউ আছেন?
‘আমি বাবুল কসমেটিকস গেইট যাবো।
‘সামনের গেইট না পিছনের গেইট?
‘পিছনের গেইট।
‘বসেন নামিয়ে দিবো।
রতন গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মহাজনের দিকে তাকালেন। মহাজন হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা দিলেন গান চালাতে। রতন দুই আঙ্গুল দেখালেন। মহাজন না সূচক মাথা নাড়িয়ে তিন আঙ্গুল দেখালেন। এর মানে হলো মহাজন তিন নম্বর ডিস্কের গান বাজাতে নির্দেশ দিলেন।
গান বেজে উঠলো...
আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো মরার কোকিলে
আমায় পাগল বানাইলো গো মরার কোকিলে
আমায় উদাসী বানাইয়া গেল বসন্তেরই কালে গো
মরার কোকিলে...
গানটি মমতাজের জনপ্রিয় একটি গান।
মহাজন তার মুখে এক খিলি পান ঢুকিয়ে দিয়ে গানের তালে তালে মাথা নাড়াচ্ছেন। পানের ফিক ফেলছেন বাবুল সাহেবের মুখের সামনে মুখ নিয়ে জানালা দিয়ে। বাবুল সাহেবের নাকে তার বাম গাল স্পর্শ করেছে। এভাবে পানের ফিক ফেলা চরম অভদ্রতা। মহাজন কাজটি স্ব-ইচ্ছায় করেছেন। তিনি বাবুল সাহেবকে বুঝাতে চান তিনি এই গাড়ির মালিক। গাড়িতে তার যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা আছে। এদিকে বাবুল সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। তিনি তার ছাত্রজীবনে লোকাল বাসে অনেকদিন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করেছেন । তিনি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে স্বীয় চেষ্টায় আজ বড় হয়েছেন। ট্রাকে যেতে তার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা, বরং মজা পাচ্ছেন।
ট্রাকটি চলতে চলতে হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। ড্রাইভার গাড়ি থামালো। চাকা পাংচার হয়ে গেলো। দশ থেকে পনের মিনিট লাগবে স্পেয়ার চাকা লাগাতে। মহাজন আর বাবুল সাহেব গাড়ি থেকে নেমে গেলেন।
মহাজন বাবুল সাহেবকে বলছে,
‘নেন সিগারেট খান। বেনসন সিগারেট। দামী সিগারেট। নতুন চাকা লাগাতে বেশি সময় লাগবেনা।
‘আমি সিগারেট খাই না।
‘বুঝছি, আপনার মধ্যে কোন দেশপ্রেম নাই।
‘সিগারেটের সাথে দেশপ্রেমের সম্পর্ক কি?
‘আছে। আছে। সম্পর্ক আছে। চাকরি করেনতো বুঝবেন না। আমার মত ট্রাকের মালিক হলে ঠিকই বুঝতেন।
‘আপনি কিন্তু আমাকে বলেন নাই সিগারেটের সাথে দেশপ্রেমের সম্পর্ক কি?
‘সিগারেটের উপর শুল্ক একশো শতাংশের উপরে। একটি বেনসন সিগারেটের দাম এগারো টাকা হলে পাঁচ থেকে ছয় টাকা সরকারের কাছে যায়। সিগারেট খেয়ে নিজের ক্ষতি করছি তাতে কি? দেশের উপকার কিন্তু করে যাচ্ছি। তাই বেশি বেশি সিগারেট খেয়ে দেশপ্রেম বাড়ান।’
মহাজনের কথাা শুনে বাবুল সাহেবের মাথা ঘুরতে লাগলো। ড্রাইভার এসে বলল, চাকা লাগানো শেষ। মহাজন ও বাবুল সাহেব গাড়িতে আবার উঠে বসলো। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। মহাজন বাবুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি যেন কোথায় নামবেন বলেছেন?
‘বাবুল কসমেটিকস গেইট।
‘আমরাও যাবো।
‘আমাকে পিছনের গেইটে নামিয়ে দিবেন।
‘আগে একবার বলেছেন। মনে আছে। নামিয়ে দিবো। আপনি কি করেন?’
‘না মানে, না মানে।
‘মানে মানে করছেন কেন? চাকরি করা কি লজ্জার কিছু? সবাই কি আর আমার মত ট্রাকের মালিক হতে পারে?
পুলিশ তাদের ট্রাক থামালো। বাবুল সাহেবকে গাড়িতে দেখে পুলিশের এএসআই হাত তুলে সালাম দিয়ে বলল, ‘ভালো আছেন স্যার?’
মহাজনের সে কি আনন্দ! পুলিশ তাকে সালাম দিয়েছেন। আবার স্যার বলেও ডেকেছেন। সারাজীবন পুলিশকে স্যার বলতে বলতে শেষ হয়ে গেলাম। আর আজ ট্রাকের মালিক হওয়ায় পুলিশ আমাকে স্যার ডাকছে। মহাজন আজ মনে যে সুখ পেলো তা আর কখনো পাননি।
বাবুল কসমেটিকসের পেছনের গেইটে নেমে গেল বাবুল সাহেব। আর মহাজনের গাড়ি ঢুকলো মেইন গেইট দিয়ে। আজ মহাজন দেখা করবেন বাবুল কসমেটিকস এর মালিকের সাথে। এক মাসের জন্য পন্য পরিবহণে তার গাড়িটি ভাড়া নিবেন বাবুল কসমেটিকসের মালিক।
সিকিউরিটি অফিসার এসে ট্রাক মহাজনকে বলছেন, আপনাকে বড় স্যার ডাকছেন।
‘আমার ভয় লাগছে স্যার। আমি এতো বড় স্যারদের সামনে কখনো যাই নাই।
‘সমস্যা নাই। স্যার মাটির মানুষ। খুব ভালো।
মহাজন বড় স্যারের রুমে ঢুকে বাবুল সাহেবকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
শব্দমিছিল : মারফ আহম্মেদ নয়ন
শব্দমিছিল
মারফ আহম্মেদ নয়ন
কাঠ কয়লার লেখা
বুকের ভেতর কাঠ কয়লায় লিখি তোমার নাম, অক্ষরজ্ঞান নেই বলে চিরকাল, চিনিনি কোন ফুলের শরীর, জানি নি তার ভাষা-ব্যাকরণ, বুঝিনি জল জোছনার ইতিবৃত্ত, আগুনের অক্ষরজুড়ে লেখা থাকে পতঙ্গের দহন দৃশ্য, তার মতো করে তোমাকে ভালবেসে, পুড়িয়েছি এ দুঃখ দেহ, বেদনা অধ্যুষিত অব্জল !
সখ্য ছিলাম
সখ্য ছিলাম হাওয়া বালিকাদের সাথে, জল ও মাছেদের সাথে, তারও অধিক সখ্য ছিলাম; গাছের পতিত পাতাদের সাথে, ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্তে যেমন উড়িয়ে নেয় সব, তার মতো করে হৃদয় নিয়েছ উড়িয়ে (ছিনিয়ে)‘হে অদ্ভুত বাজিকর’ হাত থেকে রুমাল উড়িয়ে দিয়ে দেখিয়েছো, তার ভেতর থেকে কি করে নিঃশব্দে উড়ে যায় একশত প্রজাপতি...
জল জোছনার মেয়ে
ও জল জোছনার মেয়ে, শরীর জুড়ে মেখে রেখেছো আশ্চর্য জোছনার ঘ্রাণ, শাড়ীর আঁচল থেকে মাঠে মাঠে ঝরাচ্ছ রুপালী শস্যবীজ, স্বর্ণ সোহাগ রেণু, উড়িয়ে দিচ্ছ ফুল, তাসের বাহারী খেল, দাবার চালে ভুল ছক, আগুনের কাছে বসে করছি প্রার্থনা, এ মানুষ জন্মের পরের জন্মে তোমার পায়ের কাছে ঘাস হয়ে জন্মাবার আজন্ম সাধ !
শব্দমিছিল : নিগার শামীমা
শব্দমিছিল
নিগার শামীমা
পরিশুদ্ধ নিকোটিন
এক হাত আকাশ নিয়েও আমি নীল সমান
ঠিক যেমন জেগে রয় তুমিময় সব অভিমান,
একরাশ মগ্নতায় গলে পড়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন
আর জানো তো জীবনের দামে কিনেছিলাম
তোমার মতো নেশাময় এক কঠিন নিকোটিন?
তুমি ভাবো আমি ফুরিয়ে গেছি-
পরিত্যক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের সাথে,
পানিতে আমি ভাসতে জানি না, আর
একথা জানো বলে কী আনন্দ তোমার
তলিয়ে গিয়েছি বলে ভেবো না
আমি মদ্যপ মাছের মতো, খামাখা
আমাকে ভাসতে দাওনি একান্ত নিজের মতো!
জল শুকিয়ে যাবার ভয়ে
তুমি আর কোনোদিন জলে আসোনি,
জলেই তো জ্বালা আর কীসে এতো মুক্তি?
তোমার চরাচরে এতো এতো যুক্তি
সেগুলো জ্বালিয়ে দাও এই জলে,
রাত বড় কষ্টের মাছগুলো তাকিয়ে বলে!
বিধিনিষেধ
পুরনো নদী আর তার অভিধান
অচল বাক্যে প্যাঁচায় লতানো মন
চারদিক অবরোধ বুঝি যায় যায় বেলা,
এমন নিষেধ যেন চারচালা ঘরের বেড়া
আমাকে নিয়ে চল্ নৌকা,
আমি ঘরহীন এক লাগোয়া সিথান
যার পাশে রাত-দিন চির সমান সমান,
আলো আসুক তীর ফুটে
জলে শামুকের গান, ভেজা আকাশ
এতো রঙহীন চারধারে অবলা বাতাস;
বেলা যায় এভাবেই বয়ে যায়
যেনো রেলগাড়ি- সুরমা, তিতাস!
আগমনী বসন্তকে বলছি
এই শিশিরেই জমিয়ে রাখছি ব্যথা,
আগমনী বসন্তের না আসা পাতা
কুয়াশার তীব্রতা, জমানো কথকতা
একথা জানে না এ বেলার নৌকা...
কোনো এক কালে শিশিরও ভিজিয়ে-
ছিলো তোমার আমার পায়ের পাতা
আর তারুণ্য মেলেছিলো তার ডানা
সেই কুয়াশার গায়ে ভেসে আমরা
চপল পায়ে হেঁটেছিলাম, একথা
শিশিরের চেয়ে আর ভালো কে জানে?
ডিঙিনৌকার পাশে পানকৌড়ির হা-করে
তাকিয়ে থাকা আর কোনো মিথ নয়,
এপার-ওপার নায়ের পায়ে জড়িয়ে থাকা
আর কোনো ভুলে যাওয়া পথ নয়
সদ্য ফোটে থাকা কলমি ফুলের ঘ্রাণ
তীব্রতা নিয়ে আজও বয়ে যায় আপ্রাণ!
শব্দমিছিল : আহমেদ বাবলু
শব্দমিছিল
আহমেদ বাবলু
একজন একলব্যের বয়ান
বোধের সমস্ত ঢেউ আমার ব্যক্তিগত নদীর।
ঢেউয়ের অভিঘাত আমাকে শিক্ষিত করে অবিরাম,
তুমি যার হদিস পাবে না প্রিয়।
অথচ কখনও খুব গভীর নিভৃতে, কখনও বা উচ্চকিত কলরবে,
সেইসব ঢেউ নির্মান প্রক্রিয়ায় তোমারও ভূমিকা ছিল বেশ।
আমার বোধের নদীতে তুমি ঢিল ছুঁড়েছিলে, ভিজিয়েছিলে পা;
তোমার উত্তপ্ত শরীর ডুব মেরেছিল কোনো কোনো দিন-
তুমি শান্ত হতে চেয়েছিলে,
কখনও কোনো মায়াবি সন্ধ্যায়, একটি হাতের কয়েকটি আঙ্গুলের ঝাঁপটা,
সাক্ষী হয়েছিল- আমার বোধের জল।
সেইসব তরঙ্গ থেকে- আমি ক্রমাগত পাঠ নিতে নিতে
শিখে ফেলি জীবনের বিচিত্র ব্যাকরণ;
তুমি জানলে না! আমি তোমার একলব্য হই।
একটি ছবি আঁকা হবে
মানুষের বিচিত্র ব্যর্থতা নিয়ে যখনই কোনো ছবি আঁকতে গেছি
আঁকা শেষ হলেই কী করে যেন তা একেকটি সেলফ পোট্রেটে রূপান্তরিত হতো।
এবার ভাবছি তোমার হৃদয়হীন সকল সফলতার রঙ এক করে
নতুন কোনো একটি ছবি আঁকা যায় কিনা
এবং সে ছবি আঁকতে গিয়ে আমি এবার কী করে আমাকে এঁকে ফেলি
তা প্রত্যক্ষ করবার জন্যে, নিজের পাশেই বসে থাকবো
ভেবে রেখেছি।
গভীর অসুখের কবিতা
বুকের ভেতর গভীর এক অসুস্থতা বোধ হলে
আমি তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকি হে মাতৃভূমি।
তুমি আমার চোখে চোখ রেখে আমাকে পড়তে পারো নাকি?
তোমার বুকে যে অমৃত পান করবো বলে আমি মুখ রাখি বার বার
তুমি কি আমার সেই তৃষ্ণা অনুভব করো?
মাগো- বড় অসুখ এ বুকে ! সে অসুখ সারা দেহে ছড়িয়ে পড়বার আগে
আমাকে তুমি রক্ষা করো। আমি অমৃতের পুত্র হতে চাই।
শব্দমিছিল : মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম
শব্দমিছিল
মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম
বেসামরিক দিয়াশলাই
ছদ্মবেশী শালিকটি চূর্ণ হচ্ছে
ভেঙে যাচ্ছে বয়ঃসন্ধি পেরুনো সাঁকো
আধ খাওয়া কামরাঙা
সিলিকন রোদ
তাকিয়ে আছে স্নানঘরের নিস্তব্ধতায়
ফুঁসে উঠছে জন্মের দাগ
যদিও কোনওদিন হেঁটে যাই নি
ভ্রমরজাত বিকেলের দিকে
লকলকে তামাক পাতার দিকে
কেউ হয়তো জেনে গেছে
শীতের ওমের ভেতর লঘু অন্ধকার
বড় বেশি অনুর্বর ছিল
অথচ যাবতীয় স্বপ্ন নাইলন বস্তায় ভরে
বসে আছি নিজেরই মুখোমুখি
অধরা ঘ্রাণ
তবে দখলে নিক বেসামরিক দিয়াশলাই
মিহি প্রসাধন
ডাগর অন্তর্বাস আর প্রেতসাধনার বাঁকা লাঠি,
প্রতœনীল সাজঘরে, আয়ুর্বেদিক কিতাবের পাশে
রেখে, যে তুমি জরির অক্ষরে লিখে যাচ্ছো-
ভূগর্ভস্থ প্রেমপত্র;
সে তোমার জবজবে শরীরেই তো দেখেছিলাম,
ফেনার দাগ। সে তোমার খোঁপার গিঁট খুলেই তো
নাভির খোঁড়লে ঢেলে দিয়েছিলাম, শাদা ভ্রম।
বহিঃনোঙরের অপেক্ষমাণ আততায়ী পয়ার
বোঝে না? পরস্পরের তোরঙ্গ, অসংলগ্ন রাত্রির
লিপিতে গোপনে মুদ্রিত করে, যে তুমি জড়িয়ে-
যাচ্ছো বাহারি বোতামে;
অমাবশ্যার নর্তকীরা, ফিনফিনে শুঁয়োপোকার
সঙ্গমে মেতে থাক বা না থাক! বাসকের ছেঁড়াপাতার
বদলে আমিই হবো সে তোমার মিহি প্রসাধন।
বহুদিন থেকে যে তুমি
বহুদিন থেকে যে তুমি অঘ্রাণের নীল!
সে তোমাকেই তো দিতে এসেছি পতনের আকৃতি।
অবসাদের শেষে, যাবতীয় রূপভারাতুর দৃশ্যের ভিড়;
তবে নক্ষত্র ফোটার আগেই অশ্বতর হয়ো।
নুড়ি ঠেলে দেখে যেও যাপনের হাড়গিলে ফাঁদ।
সবুজ হ্রদের ধারে ওঁৎ পেতে থাক দাঁড়ের শব্দ।
সুরতহাল হোক বা না হোক, আমি তো জেনেই গেছি-
বেঁচে থাকার অপরাধে প্রত্যহ আমাকে খুন করা হচ্ছে।
বহুদিন থেকে যে তুমি রোমহর্ষ অন্ধকার!
সে তোমাতেই তো নির্মাণ করতে চেয়েছি কুহকপুরাণ।
পরিত্যক্ত হবার আগেই দেখাতে এসেছি ভিখিরিভ্রমণ।
যদিও গোপন রেখেছি জ্যোৎস্নায় শানানো চাকু।
অস্মীভূত খুলির কাছে আমিই তাহলে কুয়াশারুমাল?
সুদীর্ঘ অস্ত্রোপচার শেষ হয় মূলত বুকের নিকটে এসে।
আয়নার প্রতিবিম্ব কুড়িয়ে কেউ ফিরে যায় করাতকলে?
কেউ কী বনঘুঘুর ছদ্মবেশে ভুলে থাকে মুখোশের মায়া?
একজন আদর্শ শিক্ষক
সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম
একজন আদর্শ শিক্ষক
শাহরিয়ার কাসেম
সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম পেশায় একজন গণিত শিক্ষক ছিলেন। তিনি কর্মজিবন শুরু করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক পন্ডিতরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। এবং তিনি ফান্দাউক পন্ডিত রাম উচ্চ বিদ্যালয়ই শিক্ষাদান জিবন শেষ করেন। তাঁর এই দীর্ঘ পাঠদানের সময় কত ছাত্র- ছাত্রীদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এর একটুও অন্ত নেই। বলতে গেলে এখন বিভিন্ন স্থানে ফান্দাউক পন্ডিতরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম মুখে উঠলেই সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুমের নাম সবার আগে উঠে। এবং প্রত্যেকেই তাঁর গুণ কীর্তনে থাকে পঞ্চমুখ। এরকম সু-পাত্র হতে হয়ত তাঁর কঠিন ত্যাগ, সাধনা করতে হয়েছে অনেক দিন। না হলে এখনো সেই ছাত্র- ছাত্রীরা তাঁর নাম ঝঁপে কেন? সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম শুধু একজন পাঠদান করা শিক্ষকই নন; তিনি সু-মানুষ গড়ার কারিগরও ছিলেন। যার জ্বলন্ত প্রমাণ আশপাশের গ্রামের খ্যাতিমান ছাত্ররা।
সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম তিনি শুধু একজন আদর্শ শিক্ষক নন, বরং তিনি অসংখ্য মানুষের অনুপ্রেরণার উৎসও ছিলেন। দিক হারা কত ছাত্রের দিশা তিনি হয়েছেন তাঁর প্রমাণ অহরহ।
তাঁর অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতেই মনে হয় আমার ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের ইতি ঘটলো। কারণ তিনি শুধু সৃষ্টিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। এবং সৃষ্টি করেছেনও। গড়েছেনও আপন যতেœ, আপন মহিমায়।
তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি। আমি সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে দেখিনি। বলতে গেলে সে জনম আমি পাইনি। তবে জীবনের দিক নির্দেশনায় আমি তাকে পেয়েছিলাম বহুদিন।
তিনি শিক্ষকতার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির শেষেও শিক্ষা দিয়েছেন। তবে সেটা পাঠ্যসূচীর শিক্ষা নয়। সেটা মানুষকে সৎ পথে চলতে, অসৎ পথে নিষেধের শিক্ষা। এমন কি তিনি এ শিক্ষাদানের মধ্য দিয়েই ইহলোক গমন করেন।
তবে আমি যখন সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম সাহেবকে পেয়েছি তখনের কথা বলতে গেলে দু’চোঁখে ভেসে উঠি সেই আমার ছেলেবেলার কথা। আমি যখন তাকে প্রথম দেখেছি, তখন তিনি একজন প্রবীণ, আমার কাছে মনে হয়েছিল গল্প-পুরানে শোনা কোন মহা পুরুষ। ধবধবে সাদা কলার বিহীন পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা, সবুজ পাগড়ী, হাতে লাঠি। আমার তখন থেকেই তাঁর প্রতি মুগ্ধতার শুরু তা আজও বিদ্যামান। সমস্ত চেতনায় এবং সেই তিনি হয়ে উঠতে থাকলেন আমার কাছে ধ্রুব এবং জ্যোতিষ্মান একজন মানুষ। যিনি নির্ভরতার ভুবন তৈরী করে দিলেন আমার মনে।
সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম সাহেব তিনি আমাকে আলাদা করে চিনতেন কি না জানিনা। কিন্তু আমি আমার মনের মন্দিরে শুধু তাকেই বসিয়ে ছিলাম। সে মন্দিরে তিনিই ছিলেন শুধু। তবে দূর থেকে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় আট বছর। এই দীর্ঘ আট বছর আমি শুধু তার দিকে চেয়েই রয়েছি। আর বার বার মুগ্ধ হয়েছি। এত বারই মুগ্ধ হয়েছি চোঁখ বুজলেই সেই মুগ্ধতার পরশ এখনো পাই।
সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম তিনি একজন শিক্ষক হয়েও কতটা আধুনিক হতে পারেন তাঁর উদাহরণ তিনি নিজেই। তিনি তো সময়কে ধারণ করতে পারতেন, বরণ করতে পারতেন অনায়াসে। এবং সময়ের মাঝে হারিয়ে না গিয়ে সময়কে নতুন করে নির্মাণ করতে পারতেন। তাকে দেখলে আমার মনে হয়েছে বারংবার, জ্ঞান এবং মৃত্তিকালগ্নতার অপূর্ব সমন্বয় তাকে মানুষের কাছ থেকে দূরবর্তী করেনি। তাই তো তিনি ছাত্র- ছাত্রীদের কাছে প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন, এবং থাকবেনও। একবার তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারলে তিনি এক মুগ্ধতার জগৎ নির্মাণ করতেন শ্রোতার চেতনায়। আমি দীর্ঘ আট বছর তাঁর শ্রোতা ছিলাম, কম তো নয়। প্রায় আট বছর তাঁর হাতের নাগাল থাকা সে আমার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপারই।
সৈয়দ নাছিরুল হক মাসুম তিনি এক অননুকরণীয় শৈলী নির্মাণ করেছিলেন তাঁর চলায়, তাঁর বলায়, তাঁর লেখায়, তাঁর পাঠদানে। শিক্ষকতাকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। না হলে এমন শিক্ষক মিলানো সত্যিই ভার।
আমি যখন তাঁর ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হতাম তখন আমি ভেবে কূল পেতামনা। কারণ, এত সুন্দর করে একজন মানুষ কী করে কথা বলেন! তিনি যখন সঠিক পথে চলতে, বলতে শেখাতেন তখন খানিক সময়ের জন্য হলেও সুবোধ হতাম।
একজন প্রকৃত দিক নির্দেশক তাই করেন, সোঁজা পথে চলতে শেখান, সত্য কথা বলতে শেখান এবং জানবার বাসনাকে উসকে দেন আর প্রত্যয় জাগিয়ে তোলেন শ্রোতার মনে। তিনি তাই করেছে মৃত্যু অবদি।
একজন মানুষ কত স্বচ্ছ হলে এই কর্দমাযুক্ত পরিবেশে নিজেকে রেখেন আলাদা ভাবে? নিখুঁত তাঁর সব কিছুই। নিখুঁত ছিল প্রত্যহ জীবন। এতটাই নিখুঁত যে, তিনি পান খেলেও পানের পিচ ফেলতেন একটি নির্দিষ্ট বাক্স। মানুষ সাধারণত পান খেলে অন্তত সাদা জামায় পানের আঁচ একটুও হলে ফেলে অথচ তিনি কতই সতর্ক ছিলেন।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)