ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা
সকাল রয়
সে রাতে মেঝেতে ক’ফোটা রক্ত দেখে আতঁকে উঠেছিলাম!
তখনও ভাবিনি দেখতে হবে রক্তবন্যা। আমার হাত ধরে তুই আর আমাদের ছোট বোন অলকা ঠিক যেন একসাথে কেঁদে উঠেছিলাম। সে চিৎকারে তুই মুখ চাপা দিয়েছিলি। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা বাবার পাঞ্জাবী ভেজা ছিল রক্তে। দেখি মা ঠিক পুতুলের মতো মেঝেতে পড়ে রয়েছে। ঘরদোর এলোমেলো। যেন কোন ঝড় এসে খেলে গেছে তান্ডবলীলা।
বারান্দা পেরিয়ে কলতলায় এসে দেখি পড়ে আছে বড়’দি’র এক পাটি চটি, গতকাল বাবা যেটা খুঁজে খুঁজে কিনে এনে দিয়েছিল বড় বাজার থেকে। আমি শখের সে চটির পানে তাকিয়ে ভাবছি আর এক পাটি কোথায়? আর কোথায় আমাদের বড়’দি।
কিছুটা বিস্ময়ে আমি যখন গেছি তলিয়ে, তুই বললি চল নিষাদ দৌড়ে পালাই! আর এক মুহুর্তও নয়। আমি বলি বড়’দিকে নিয়ে গেছে যে; তাকে কি ফেলে যাব। তুই কিছু বলিসনি শুধু চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিলি কখনো কখনো এমন হয়। হয়তো সে একদিন ফিরে আসবে, সেদিন বিশ্বাস গেথেঁছিলাম তাবিজ করে গলায়।
সারারাত হাঁটা পথে চলেছি তিনজন। আমাদের চারপাশে কত রকমের মানুষ তখন দৌড়াচ্ছে। কত মানুষের ভীড়! একসাথে এত মানুষকে কখনো মরতে দেখিনি। পিকুদের ময়নার খাচাঁ উল্টে গেছে কেথায় যেন উড়ে গেছে স্বাদের সে পাখি। আমরা তিনটে প্রানী হেটে চলেছি কত চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে।
আমাদের হাটা পথ থেমেছিল গাঁয়ের এক বাজারের কাছে যেখানে ছাইপোড়া নগরী দেখে আতঁকে উঠলাম। আরও কত কি যে চোখ পড়লো তার নেই ইয়াত্বা। তারপর বাসে করে ভোর রাতের শেষে গ্রামের পথে পা রাখলাম।
গ্রাম আর পুরোনো রঙে নেই। আগুনের ছ্যাঁকা ছ্যাঁকা দাগে ভরা কৃষকের ঘরগুলো। দেখি লাউয়ের মাচায় ফুলগুলো কেমন চুপসে গেছে। কারা যেন একদল ছেলে বুড়োকে শুয়েই রেখেছে উঠোনের পাশে। কত রকম বিভৎস সে দৃশ্য। কারো কারো আর্তনাদ মাখা মুখ তখনও আগুন রেখেছে ধরে।
হরিদাস গেটে নেই। আমাদের সে বাংলো ঘর। সব কিছুতেই কেমন যেন শূন্যতা। তবে কি লাগলো পাকিদের আঁচড় এখানেও! আমার হৃৎকম্পন ছড়িয়ে যায় সবখানে। একমুহুর্ত থেমে আবার মিশে গেলাম ভীড়ে। আমরা তিনটে প্রানী উঠে বসে বসে থেমে থাকা ভীড়ে চিরে চ্যাপ্টা হবার জোগাড়।
ভীড়ের মাঝে ঠিক মনে নেই ক্যামন করে হাত ফস্কে দেখি অলকা নেই পাশে। আমি খুব করে খুঁজে নিই চারপাশ। কোথায় অলকা বোন আমার! নোনা ধরা চোখে তখন নামছে ঝড়। অলকা হারিয়ে গেছে। কি যে ব্যথা আহ! তুই আমাকে শক্ত করে ধরে বললি কোথায় হারালি বোনকে?
অলকা, অলকা কোথাও নেই শুধু অপরিচিত মুখ গুলো আমাদের ফেলে-ফেলে যাচ্ছে।
আমাদের কেঁদে ফেলা দুপুরের পর তুই আমায় টেনে হিচরে নিয়ে গেলি নদীর ধারে। আমাদের সেই নদী যেখানে সাতরে দুজন করেছি কত এপার-ওপার। আজ সে নদী আর নদী ইেন, এক ভাসমান কবরখানা। লাশগুলো ভেসে ভেসে কোথায় যেন যাচ্ছে চলে। আমরা দুটো প্রানী পুরোনো বাঁশের সাঁেকা পেরিয়ে গেলাম মিশে শরনার্থীদের দলে। অনেকদিন ঘরবন্ধি ছিলাম। জানিনা কবে যেন কে বলে গিয়েছিল দেশটা স্বাধীন হবেই, আমরা ফের উড়াতে পারবো আমাদের প্রিয় লাল-হলুদ ঘুড়িগুলো। অপরিচিতজনের অবহেলায়-অবহেলায় কিছু খেতে আর ঘুমোতে দিয়েছিলো। তবুও মঙ্গল হোক ওদের। পাকিদের মতো জানে তো মারেনি আর!
শেষে নয়টি মাস পার হলে ডিসেম্বরের এক সকালে কাঙ্খিত বিজয় এলো। পৃথিবীর বুকে এক নতুন মানচিত্রে লেখা হলো বাংলাদেশের নাম। সবার ঘরে ফেরা দেখে তুই আমায় বললি, চল নিষাদ ঘরে ফিরি। আমাদের বাড়ি ফেরা। কত কিছু দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরা। লাল সবুজ একটা পতাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা। চারপাশে হাহাকার নিয়ে বাড়ি ফেরা।
এক সকালে বাড়ি এসে গেট পেরিয়ে দেখি; আমাদের সে ঘর পাড়ার সবচে’ খারাপ লোকটা দখল করে বসে আছে। পাড়ার লোকেরা ওকে রাজাকার বলে আর আমি বলি দু’মুখো সাপ। হয়তো তব্ওু কম বলা হয়ে যায়। মৃতপ্রায় মাতৃভূমি ছাড়া আমাদের তখন কিছুই নেই, শুধু ভাঙাচোরা এই স্মৃতি ছাড়া। আমার বড়’দিকে তো পাকিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে রাতে। আজও পেলাম না। আর অলকা বোন আমার না জানি কোথায় আছিস? কখনো দেখা হবে কি তোর সাথে? নাকি তুই কোন ফটোগ্রাফারের ফটোতে হয়ে গেছিস অসহায় মৃত কোন শিশু। অলকা, বড়দি যেখানেই থাকিস তোরা ভালো থাকিস।