আয়না-আদল !
আয়না-আদল
আহাদ আদনান
‘বউ-ঝি’রা কুটুম আসলে আলমারি খুলে শাড়ি দেখায়। থাকে থাকে সাজানো শাড়ি। আমার আছে তোয়ালে। সাদা সাদা দামি তোয়ালে। মখমলের মত নরম। কাল রাতেও গুনে রাখছি। ঊনচল্লিশটা তোয়ালে’।
‘তোয়ালে জমানো আপনার শখ বুঝি’?
আহসান মঞ্জিলের দক্ষিণ দিকের গেটের বিখ্যাত পান’টা মুখে দিয়ে, চিবিয়ে লাল করে, আড়চোখে চেয়ে তৃপ্তির হাসি দেন আবদুল বাতেন হাওলাদার। শরীয়তপুরের সড়ক বিভাগের অফিসের কেরানী হাওলাদার বাবু।
‘শখ না, এইটা আমার ধ্যান-জ্ঞান। ল্যাঙটার মাজারে যেমন পাগলেরা তবারক খাবলে নেয়, এই তোয়ালে আমার তবারক, প্রসাদ, মেওয়া যা কন। তাবিজের মতন আমি যতন কইরা রাখি আলমারিতে’।
আড্ডা জমে উঠে ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানে। হাওলাদার মেলে ধরেন তার গল্পের ঝাঁপি।
‘হাইস্কুলে আমার হেডমাস্টার ছিলেন প্রদীপ স্যার। লুকিয়ে বিড়ি খেয়ে ধরা পড়ি। ডাক পড়ল স্যারের কামরায়। বেত খেতে খেতে পিঠের চামড়া উঠে গিয়েছিল। ব্যথার মাঝেও চোখ গিয়েছিল স্যারের চেয়ারে। কাঠের নকশা করা হাতলওয়ালা কেদারা। পিঠ বেয়ে ঝুলছে ধবধবে সাদা একটা তোয়ালে। কয়েকবছর পর পারিবারিক একটা মামলায় গিয়েছিলাম কোর্টে। জজ সাহেব বসে আছেন এক মসনদে। পিছনে ঝুলছে তোয়ালে। বুঝে গেলাম এই তোয়ালে সম্মানের, আভিজাত্যের প্রতীক। জীবনে প্রথম মাসের বেতনের টাকায় মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য জায়নামাজ আর একটা তোয়ালে কিনেছিলাম। অফিসের বড় সাহেবের হাতে তুলে দিতে পিঠ চাপড়ে আদর করেছিলেন বয়স্ক অফিসার। আর চেয়ে নিয়েছিলাম পুরনো তোয়ালেটা। সেই থেকে নেশা শুরু হয়ে গেলো। বদলি আমার হোক কিংবা বড় সাহেবদের, তোয়ালে হতে হবে দেখার মত। এভাবেই পরিচয় নেকবর ভাইয়ের সাথে’।
দোকানের মহাজন নেকবর আলী মৃদু হাসেন। ইসলামপুরের সবচেয়ে সেরা তোয়ালে পাবেন তার দোকানেই। হাওলাদারের অনেক স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, বিকিকিনি আর ছোটখাটো দুর্নীতির সাক্ষী তিনি। অবশ্য পাঁচ হাজার টাকার তোয়ালের দশ হাজার টাকা ম্যামো করার চেয়ে আর কোন বড় চুরির হদিস জানা নেই তার। তবে শিকারি বেড়াল গোঁফে (কিংবা তোয়ালে দিয়ে) চেনা যায়।
‘হাওলাদার বাবু, কোনো বসের সাথে তোয়ালে নিয়ে ঝামেলা হয় নাই? এই যে বেশি বিল ধরছেন, কিংবা তোয়ালে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন। সবাই তো আর এক রকম না’।
মুখে লালা জমে গেছে। পিক করে কিছুটা লাল তরল ফেলে হাওলাদার।
‘বিসিএস কি জিনিস বুঝেন? এইটা হচ্ছে আধুনিক সামন্তবাদ। একেকটা ক্যাডার নিজেরে মনে করে জমিদার। অহংকারে পা পড়ে না মাটিতে। কোন জমিদার তেল খায় না, কন? আমার সাথে ঝামেলা কইরা লাভ আছে? আমি হইলাম ঝানু কেরানী’।
এই ঝানু লোকটাই আবার হেরে যান নিজের ছেলের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করা ছেলেটা ছাড়ে না কথা শুনিয়ে দিতে।
‘তুমি একটা ব্যাকডেটেড লোক। ঔপনিবেশিক আমলের দাসত্বের প্রতীক তুমি সাজিয়ে রেখেছো ঘরে। তুমি জানো, এই তোয়ালের ইতিহাস? ব্রিটিশ বাস্টার্ডগুলো দেখলো বাঙাল খেতগুলো মাথা-ভরতি করে তেল মেখে আসে। সেই তেলে নোংরা হয় চেয়ার। হাতের তেলে নষ্ট হয় জরুরী দাপ্তরিক কাগজ। তারা ব্যবস্থা করলেন গেঁয়োর দল তোমরা চেয়ারে তোয়ালে রাখবে, ময়লা হাত শুকনো রাখবে। সেই তোয়ালে কেন এখনও ব্যবহার করব আমরা’?
‘গর্দভ, এটা আভিজাত্যের প্রতীক। ব্রিটিশ ছিল বলেই সভ্য হতে পেরেছিস। আর তোয়ালে যদি এত খারাপ হয়, ব্রিটিশদের অন্য নিয়মগুলো কেন বাদ যাবে? সমাবর্তনে কেন পাশ্চাত্যের গাউন আর টুপি পরিস? বিচারপতিরা কেন আজও মাথায় পরচুলা লাগিয়ে শপথ করায়? এই তোয়ালে আমার অহংকার, বুঝেছিস’?
‘এত তেল মারো বলেই তেল থেকে তোয়ালে হয়েছে’।
গর্দভটাকে আর বলা হয়না ‘টাওয়েল’ একটা ইংরেজি শব্দ।
আজ বিশেষ একটা দিন। অন্য সময়ের চেয়ে একঘণ্টা আগেই অফিসে হাজির হাওলাদার। নতুন বস যোগদান করবেন। তার চাকরি জীবনের শেষ বস হয়তো। দেড় মাস পরেই তার অবসর। নতুন কেনা তোয়ালেটা সাজিয়ে রেখেছেন বড় সিংহাসনের মত চেয়ারটায়। বসের বয়স খুব কম মনে হচ্ছে। পাঁচ ফুট দশ-এগারো হবেন। শ্যাম্পু করা তেলমুক্ত চুল। রুচির পরিচয় মাথা থেকে পা পর্যন্ত। গলার আওয়াজ মখমলের মত মিহি। শান্তিনিকেতনি উচ্চারণ। হাওলাদারের মত ঝানু লোক কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে নতুন ‘ডিজিটাল প্রজন্মের’ সামনে।
‘চেয়ারে তোয়ালে রেখেছে কে? এটা সরিয়ে ফেলুন। দরজার পর্দাগুলোর রঙতো এমন হওয়া উচিত নয়। ভাবমূর্তি একটি বিশাল ব্যাপার। সমস্যা মনে হচ্ছে। অফিসের খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে’।
এই ব্যক্তিত্বের সামনে হাওলাদারের ভোকাল কর্ড অবশ অবশ লাগে। চাকরি জীবনের শেষ দেড় মাস তার মনে হয় দেড় যুগের মত দীর্ঘ। দেওয়ালের রঙ বদলে যায়, রোমের পর্দা আসে, রাজস্থানের নকশা করা চেয়ার আমদানি হয়। তেহরানের সবচেয়ে সেরা তোয়ালে শোভাবর্ধন করে সেই চেয়ারে। জেলা শহরের সড়ক বিভাগের অফিসটা যেন তাজমহলের সাথে পাল্লা দিতে চায়।
পার হয় আরও ছয়টি মাস। হাওলাদারের তোয়ালের নেশা কিংবা প্রেম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন সেই বড় সাহেব। জমে থাকা তোয়ালে এখন আর নেড়ে চেড়ে দেখা হয় না। রোদ পায়না তারা আর। ন্যাপথলিনগুলো ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যায়। তেলাপোকা আর ছারপোকাদের প্রজননের অভয়ারণ্য হয় তোয়ালের স্তুপ। পুরনো অফিস থেকে ফোন আসছে সপ্তাহদুয়েক ধরে। হাওলাদার পেট এখন ফার্মেসি। উচ্চরক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, অনিদ্রা জাঁকিয়ে ধরে তাকে। ছেলেমেয়েরা দেখে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে বাবা। জিজ্ঞেস করলে একই কথা, ‘আরে কিছু না। আমি ঠিক আছি। ভালো আছি’।
দৈনিক পত্রিকার খবরটাই সব ফাঁস করে দেয়। ‘সড়ক বিভাগে তোয়ালে কেলেঙ্কারি। দেড় লাখ টাকায় কেনা হয়েছে একেকটি তোয়ালে’।
হাওলাদার বাবু প্রমাদ গুনেন। ‘ডিজিটাল’ বস খুব সুন্দর করে অর্থ কেলেঙ্কারি চাপিয়ে দিয়েছেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কেরানীর ঘাড়ে। এলাকায় তার মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে যায়। মামলা চলছে। গ্রেফতার হতে পারেন যেকোনো দিন।
আলমারি থেকে একটা তোয়ালে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান তিনি। চেহারাটা মনে হয় কালো, কুচকুচে কালো। কে যেন এক খাবলা কালি মেখে দিয়েছে আয়না-আদলে। তোয়ালে নিয়ে ঘষতে থাকেন মুখ। কালি উঠে না। এই কালি কলঙ্কের চেয়ে কালো।
মাতুয়াইল, ঢাকা।
পদাবলি
কাঠগোলাপের পঙক্তিমালা
ফজলুর রহমান
আশ্বিনের মেঘ জানতো তুমি আসবে,
রোদে রোদে কী ভীষণ কানাঘোষা;
জলা-জঙ্গলের রুক্ষ ভাব উবে গিয়ে সেখানে পরিপাটি বাতাসের গীতল আসা-যাওয়া।
তুমি আসবে,
কাঠগোলাপ জানতো কী তা; জানতো কী তোমার মেঘকালো খোঁপা?
দর্জিবাড়ির উঠোন, সেখানে নুইয়ে পড়া মাধবীলতার গুচ্ছরা জেলে কন্যা মালতীর মতো অপেক্ষা করে আজকাল।
খেয়াঘাটের নৌকা; নদীপাড়ের বাড়ন্ত কাশবনের সাথে পত্রালাপের মতো কথা কয়।
ডুমুরডোবা হাওড়ের জলের ঢেউ,
তার সাথে ভেসে আসা নকশি রুমাল তোমার মুখোচ্ছবি ভাসিয়ে আনতো।
হেলে পড়া সূর্য যখন লাল শাড়ি পরা রাঙা বউ;
তখন তুমি কী এসেছিলে নরসুন্দার ঘাটে?
কাঠগোলাপ জানতো কী তা; জানতো কী তোমার মেঘকালো খোঁপা?
পিটপিট জ্যোৎস্না আর আলসেমি চাঁদ কী জানতো তোমার কথা?
শাপলার মতো মুখ যা নীলাভো আকাশকে মনে করিয়ে দ্যায় দূর দেশের ঠিকানা;
অমাবস্যার নদী, ঝিনুকের শঙ্খ জানতো তুমি আসবে।
কাঠগোলাপ জানতো কী তা; জানতো কী তোমার মেঘকালো খোঁপা?
পিতলের থালায় দেখা মুখ,
ঘোড়াউত্তরা নদীতে ভাসা আঁচল যে জলছাপ বুনে দিতো মনে,
সে মন জানতো রেলগাড়ি চেপে আসবে কেউ নরহরি কবিরাজের ভিটিতে।
ঝুঁকে পড়া চাঁপা ফুলের মতো তার দেহের গড়ন।
কাঠগোলাপ জানতো কী তা; জানতো কী তোমার মেঘকালো খোঁপা?
মৃন্ময়ী স্নান
বনশ্রী বড়ুয়া
মৃন্ময় লতায় কচিপাতা সাজ,
দেখেছো আঙুল ছুইয়ে?
কতটা রক্তে নিস্তব্ধতা আসে?
ঘেমে উঠে শিশির নিষিক্ত মাটির ফাঁকে,
পোড়া ধূপের গন্ধে বিষাক্ত ছোবলে
কৃষ্ণচূড়ায় ভাসে কায়া;
ফাগুন ছোঁয়া জলরঙে আঁকে ক্যানভাস,
ঘুমন্ত প্রজাপতি গুমরে কাঁদে;
কুমোরে গড়ে দেবীমূর্তি কামাসক্ত হাত!
ভালবাসার উষ্ণতায় দেবা নটরাজ!
কলাপাতায় মোড়ানো আবেগ,
কিছুটা ভুলে বরফ গলে হয়ে উঠে নিশচুপ নদী;
কাগজের পোটলায় আড়াল খুঁজে
মন খারাপের শহর।
হে প্রিয় অভিমানী
রাসেদুল হাসান রাসেল
হে প্রিয় অভিমানী,
সময় পেলে একটিবার এসো-
তোমাকে,
কাটাবন থেকে বেলি ফুলের মালা কিনে দেবো,
আরো দিবো-
শাহবাগ থেকে টকটকে লাল গোলাপ।
এসো কিন্তু।
তবে,
সময় পেলে।
সব সম্পর্ক ভালোবাসা নয়
অরুণ কুমার ঘড়াই
কথা রাখতে পারার মতো অহংকার সবার মধ্যে আসে না
যে পাখি চিনতে চেয়েছে আকাশটাকে হাজার বিশ্বাসে
তার বুকেও ঝড় ওঠে, নক্ষত্র খসে পড়ে, রাত নামে।
ভরসা প্রতি রাতে স্বপ্ন আঁকতে গিয়ে খালি হাতে ফেরে
হারানো ভুলগুলো উঠে আসে জীবনের কাছাকাছি
যে প্রেম যত বেশি চালাক সে ততো বেশি মর্যাদাহীন।
সম্পর্ককে অন্ধ থেকে উদার হতে দাও তবে সে স্বার্থক
শরীর অচল নদীর মতো মোহানা খুঁজে বেড়ায় নিতম্বে
লোভ তার সীমাহীন সে শুধু পেতে চায় স্বর্গে পারিজাত।
চোখ বন্ধ রেখে দেখি তুমি আগের মতো সহজ সরল
যার পাওয়ার চেয়ে হারানোর ভয় বেশি যন্ত্রণাদায়ক
সে কখনো কাউকে ঠকাতে শেখেনি মরীচিকা যেমন।
ভালোবাসার অস্তিত্ব নিয়ে এখনো বৃষ্টিতে ভিজি, হারাই
সব সম্পর্ক ভালোবাসা না হতে পারুক ক্ষতি নেই
যেন কৃষ্ণের মতো কারোর বিশ্বাস নিয়ে না খেলে।
শারদে শরৎ প্রেম
সাব্বির হোসেন
আমাদের শৈশব কেটেছে শরৎ এর রঙে, শিউলি ফুলের ডাঁটায়। ভোরবেলায় শিউলিতলায় উঁকি দিত শুভ্রতা।
ছেলেবেলার সেই শিউলিতলাকে মাড়িয়ে হেঁটে এসেছি নতুনের দেশে। আজও কি শিউলিতলায় বসা যায়?
পাল্টে গেছে সব। পাল্টে গেছে জীবন। শহর, বন্দর দালানের ভীড়ে পাল্টে গেছে মন। বিলাসিতায় মরে গেছে প্রেমিকের চিঠি, প্রেমিকার হাসি আর ভালোবাসা। এখন প্রেমের মত শরৎ বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কারখানার ¤্রমিকের পদতলে মরে যায় শিউলির ঝরে পড়া যৌবন, হারিয়ে যায় পেঁজা তুলোর মতো ফুটফুটে সাদা মেঘ।
কিছু প্রাণ তবুও খুঁজে মরে কাশফুল। আহা শরৎ! তোমার জন্য অপলক পানে চেয়ে বসে থাকা আমার। তুমি শারদ হয়ে ওঠো আমার আত্মায়।
মুছে যাবে অন্ধকার
পেয়ার আহমেদ সুমন
কবিতার ছলে বহুবার আমি
স্বপ্নে বেড়িয়েছি পৃথিবীর বুকে,
মানুষগুলো সব সভ্য- শিষ্ট
নেই কোন হাহাকার -কোলাহল।
কাঁধে কাঁধ রেখে চলছে সবাই
চারদিকে মানবের জয়গান।
জীবনের তাগিদে বহুবার আমি
দিবালোকে হেঁটেছি পৃথিবীর বুকে,
মানুষ গুলো আর মানুষ নেই
পাপের মলাটে আবৃত সমাজ।
বলনে- চলনে নেই কোন মিল
পর সমালোচনায় নিবিষ্ট প্রাণ।
তবুও, আমি ভালোবাসি মানুষ
মানুষের হবে জয়,
মানবতার শিখা জ¦লবে এই ধরায়
মুছে যাবে ঘোর অন্ধকার।
মুখোমুখি !
মুখোমুখি
মৌসুমী চক্রবর্তী ষড়ঙ্গী
মৈনাককে বহুবার এড়িয়ে গেছে মৃদুলা তবুও মৈনাকের এক জেদ- কেন নয় !
মৃদুলা ওকে বুঝিয়েছে জীবনটা ছেলেখেলা নয়। ওর চ্যালেঞ্জটা একটু অন্য রকমের। সেখানে কাউকে সে জড়াতে চায় না। মৃদুলা মৈনাক এক ব্রাঞ্চে প্রায় এক বছর হল একসাথে কাজ করছে। দুজনেই সমবয়সী।
মিল্কশেকে চুমুক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে মৈনাককে আজ সবকিছু খুলে বলতে শুরু করল মৃদুলা-
“আমার যখন চার বছর বয়স তখন মা লক্ষ্য করেন আমি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছি। দিনের অনেকটা সময় বিছানা আঁকড়ে থাকছি। তারপর একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যাই। ডাক্তারের নির্দেশ মত নানা টেস্ট করে জানা যায় আমি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। দীর্ঘ কয়েক মাস আমার স্কুল বন্ধ হলো তবে ছবি আঁকা, পড়াশুনো, গান সব কিছুই মার কাছ থেকে শিখতে থাকলাম।
কয়েক বছর পর আমাদের ঘরে বোন এলো । ডাক্তারের নির্দেশেই আমার বোনের পৃথিবীতে আসা। ডক্টর বলেছিলেন দ্বিতীয় সন্তান সুস্থ হয়ে পৃথিবীতে এলে এনগ্র্যাফ্ট করবেন ।
মৈনাক কৌতূহলে প্রশ্ন করে,
“এনগ্র্যাফ্ট মানে ?”
“ যাকে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট বলে।
মা প্রেগনেন্ট হলে নানা পরীক্ষা করা হয় , জানা যায় গর্ভে সন্তান সম্পূর্ণ সুস্থ। পরিবারের সবার চোখে তখন আশার আলোর ঝিলিক কিন্তু কোন কারণে কোথাও কোন ভুল থেকে যায় । আমার বোনও থ্যালাসেমিয়া অসুখ নিয়ে জন্মায়। মার সব ইচ্ছা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তবুও লড়াইয়ে মা থেমে যেতে শেখে নি কখনও। পাঁচটা স্বাভাবিক সুস্থ মেয়েদের মত মা আমাদের মানুষ করেছেন। সংগ্রাম করতে শিখিয়েছেন। আমরা দুই বোন লেখাপড়ায় জোর দিই, খুব ভালো রেজাল্ট করি, বোন ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায়। ওর এ বছর ফাইনাল ইয়ার আর আমার ব্যাপারে তোমার তো অনেকটাই জানা।
মৈনাক কল্পনা করতে পারে নি আজ তাকে এসব শুনতে হবে কিন্তু মৃদুলাকে যে বলতেই হবে। মৃদুলা আবার শুরু করে,
-তোমার মা বাবার তুমি একটি মাত্র সন্তান। আমি জানি, কিছু নিয়ম মেনে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা বিয়ে করতে পারে কিন্তু আমি তা চাইনা। বলো , আমি কি কিছু ভুল বলছি ?
হাজার চিন্তার সমুদ্রে ক্রমাগত ডুবতে থাকে মৈনাক। ভেঙে খানখান হতে থাকে। ওকে দেখে বড় কষ্ট হয় মৃদুলার।
-কি হলো মৈনাক, এই খেজুর-কফি মিল্কশেক তোমার তো খুব পছন্দের তাই জন্যই তো অর্ডার করেছি , নিচ্ছ না যে !’
ধীরে ধীরে গ্লাসটা মুখের কাছে তুলে নেয় মৈনাক কিন্তু খেতে না পেরে অবশেষে নামিয়ে রেখে দেয়।
ঝুমুর, ঘুম ও হাসি আপা...
ঝুমুর, ঘুম ও হাসি আপা
সাকিব শাকিল
অসংখ্য বাজনা বাজে ঘুমের ভেতর। ঝুম ঝুম ঝুম, বাজনা নাকি বৃষ্টি বুঝতে পারি না। কবরের কান্নাও কি বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে? যেদিন হাসি আপার লাশ আসলো মোহনপুর থেকে সেদিনও এমন বৃষ্টি। আজও কি কোনো পৃথিবীর হাসি আপাকে হত্যা করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কচুরিপানার পুকুরে? আমার ঘুমের বিছানা তাই পুকুর হয়ে যায়। আর ঘুমগুলো ভাসতে থাকে কচুরিপানা হয়ে কিংবা হাসি আপা হয়ে। ঘুমের ভেতর ভাসতে থাকি আমি। কবরের কান্নার মতোন- ঝুম ঝুম বাজনা বাজে। অসংখ্য বাজনা বাজে ঝুম ঝুমের ভেতর...
নুপুর কিংবা ঝুমুরের বাজনার ভেতর আমার এ ঘর হয়ে যায় হাজেরা মঞ্জিল। যার সামনে একটি পুকুর, আর তার ভেতরে ঘুমিয়ে আছে আমার ঘুম, হাসি আপার ঘুম, মৃত মানুষের ঘুম। নৃত্য শুরু হয় হাজেরা মঞ্জিলে। অসংখ্য শব্দের ভেতর ঝুমুরটা ঝুম ঝুম বাজতে থাকে। যেন পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নাই আর কোনো কথা নাই শুধু বাজনা আর বাজনা। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম।
সকলেই নেচে যায় ঝুমুরের তালে তালে। আমাকে ঘিরে ফেলে সকলের নৃত্য। কেন্দ্রীভূত হয়ে যাই এই নৃত্যদলের মাঝে। মাথা টলতে থাকে শব্দে শব্দে। আমার মাথা কি শব্দ হয়ে গেছে নাকি ঝুমুরটা আমার মাথা হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারি না।
প্রচন্ড ভয়ে আমি ঢুকে যাই হাসি আপার কবরে, হাসি আপা হাসতে থাকে শুধু হাসতে থাকে।
আর দূরে চলে যাওয়া চিৎকারের মতো ঝুমুরের শব্দটাও নাই হয়ে যায়।
হাজেরা মঞ্জিলে কিংবা হাসি আপার কবরে আমি একা পড়ে থাকি। চারদিকে নিরন্ন অন্ধকার আর অন্ধকার। যেসব অন্ধকারে চোর পালানো খেলতে খেলতে শিল্পী আপা হারিয়ে ফেলেছিলো তার শৈশব তেমন এক অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছি আমি।
নৃত্য অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে বহুবছর আগে। অনেক নৃত্যের অংশ পড়ে আছে মাটিতে, মঞ্জিলের দেয়ালে দেয়ালে, হাওয়ায় ভাসছে নৃত্য ও শব্দঝুমুর। ঘুমগুলোও ভাসতে থাকে কচুরিপানা হয়ে কিংবা আমাদের হাসি আপা হয়ে।
সিরাজগঞ্জ
শব্দমালা : ইসরাফিল আকন্দ রুদ্র
প্যারাসিটামল
হিমশীতল, সকালের নরম রোদে হাঁটি শতবর্ষী ছাতিমতলায়
সেই আনন্দে কাতর; আছি এবং থাকি বেচে তোমার দায়।
বয়স যখন সাত তখনই করেছো ভালোবাসার সুখে আমার ভেতরটা জখম
জীবনকে তর্জমা করে জেনেছি- ‘তুমি’ই সেই প্রথম!’
তোমার হাতের মলিন স্পর্শ আমার মুখে, হাতে, বুকে বিরাজমান
ইরা তারা হয়ে নয়া দিগন্ত উন্মোচিত করে, সুখে লেগে থাকে আযান।
আমার ফুসফুসের ত্রিকোণাকার ফাঁপা অঙ্গে করি তোমার খোঁজ
ভালোবেসে বিদ্রোহ করে প্রেম বৃদ্ধি করি রোজ।
সুখ ও শোকে দ্রবীভূত, আনন্দ-বেদনা আছে মিশে-
ঝগড়া শেষে বুঝি তুমি আমার প্যারাসিটামল দুঃখ নাও শুষে।
বহু দ্রোহের আগুনে পুড়েও শেষমেশ ঘটে মিলন-
দুঃখের পরমাণু একত্রিত হয়ে করে সুখের অণু উৎপাদন।
প্রলাপ
সাত কোটি বছর হয়ে তোমার সাথে দেখা নেই
তবুও স্পষ্ট ভেসে আছো, মন সায় দেয় তুমি আমার সামনেই
বুকের ভেতর মিছিল করে তোমাকে কাছে না পাবার যত আছে ক্ষত-
সম্পর্কের শেষ সায়াহ্নে আমার আকুতির কাছে তুমি নত; আমি বেহায়ার মত !
শোকার্ত হয়ে কষ্টের সমুদ্রে ডুবে আছি সেই যে কবে গেলে রেখে-
মাঝে মাঝে তামাশার স্বরে ডাকো সুনীল আকাশ থেকে!
থেকে থেকে কেঁদে উঠি জল ভরে নয়নে; লাগে যে মায়া
বৃষ্টিভেজা সকাল ছয়টায় সেই যে দেখেছিলাম তোমার ছায়া।
এরপর আজও দেখা নেই। তবুও মনে হয় তুমি আমার পাশে’ই।
তোমার চিন্তা নেই? যেই তোমাকে একটা দিন না দেখে থাকতে পারতাম না
সেই তোমাকে সময়ের বদলে সাত কোটি বছর দেখি না।
অবহেলা
হিমশীতল, নিজস্ব সংসারে আমি ফিরে যাচ্ছি
প্রেম শোকে আমি কাতর, তোমায় শেষ দেখা দেখছি।
ভালোবাসা যাকে খায় চুষে চুষে খায়-
ভালোবাসা তপ্ত মায়া; বৃষ্টিতে ভিজায় আর রোদ্দুরে শুকায় !
আমি বিহীন ঠিকই সজ্জিত তোমার ঐতিহাসিক শহর
তোমার শোকে আমি পাথর অথচ তুমি মহানন্দে। তুমি স্বৈরাচারী ও স্বার্থপর!
তসবির মতো সারাক্ষণ তোমার-ই নাম জপি
অবহেলায়,বেদনায়, ভালোবাসায় আমি এক নিরেট পাপী
ঘুরে ফিরে তোমাকে পড়ি, তোমাকেই নিয়ে হাঁসি-
তুমিই আমার আখেরি; তুমিহীনা আমার গগণ মরুর শশী।
রাত জাগা পাখির ন্যায় দীর্ঘস্থায়ী নিদ্রাহীন
তোমার অভাবে অন্ধতার রাহু গ্রাসে আমি আজ বিমলিন !