ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪১

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪১
তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪১
শুক্রবার, ০৬ মার্চ ২০২০




























প্রচ্ছদগল্প : সফর আলীর ঢাকা সফর : এ আই জাজাকী

প্রচ্ছদগল্প : সফর আলীর ঢাকা সফর : এ আই জাজাকী


সফর আলীর ঢাকা সফর
এ আই জাজাকী

প্রায় সারারাত জার্নি শেষে সফর আলী গাবতলী বাস টার্মিনালে নামে সকাল আটটায়। উদ্দেশ্য ঢাকা শহর ঘুরে দেখা। বেশ কিছুদিন হলো সে একটা চাকরি করছে। ছোট থেকে ঢাকার অনেক গাল-গপ্পো সে শুনেছে। সবার কত আকর্ষণ ঢাকার প্রতি। সে দেখেছে দলে দলে কত লোক ঢাকায় এসেছে কাজের সন্ধানে। কাজ করছেও বছরের পর বছর ধরে। আর তারাই গ্রামে গিয়ে ঢাকা সম্বন্ধে কত অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প করে। বলে, কতই না সুন্দর সে শহর। বিশাল দালান-কোঠা, প্রশস্ত আর সুন্দর রাস্তাঘাট। আমেরিকার মতো ফর্সা ফর্সা আর ধনী মানুষজন। ছোট থেকে সেসব গল্প শুনতে শুনতে তারও ইচ্ছে জাগে ঢাকা শহর ঘুরে দেখার। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত থাকার কারণে ছাত্রজীবনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় আসা সম্ভব হয়নি তার। এখন যেহেতু একটা চাকরি করছে তাই টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে কারণেই মনের সাধ মেটানোর উদ্দেশ্যে এ সফর।
ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সারারাত তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। আশেপাশে কোনো দোকানপাটও দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে আন্ডারপাস পর্যন্ত যাওয়ার পর দেখা গেল রাস্তার বিপরীতে কিছু অস্থায়ী দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। আন্ডারপাস দিয়ে পার হয়ে অপরপাশে চলে গেল সে। আপাতত কিছু চা-বিস্কুট খেলেই চলবে। ঘণ্টা দুয়েক পর নাহয় হোটেলে ঢোকে নাস্তা করে নেয়া যাবে। যতটুকু না ক্ষুধা লেগেছে তারচেয়ে বেশি লেগেছে তৃষ্ণা। দোকানে ঢুকেই ট্যাপ (ফিল্টার) থেকে দুই গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিল সে। তারপর এক স্লাইস কেক আর একটা রং চা নিল। কেক আর চা শেষ করে পানি খেল আরও এক গ্লাস। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, ভাই কত হলো? দোকানদার বলল, চব্বিশ টাকা। কথা শুনে যেন সফর আলী সামান্য ভরকে গেল। তার হিসেবে একটা কেক আর একটা চা সর্বোচ্চ বারো টাকা হতে পারে। দোকানদার বলল, কী মামা হিসেব মিলতেছে না? দাঁড়ান আমি মিলিয়ে দিচ্ছি। এক কাপ চা ছয় টাকা, একটা কেক বারো টাকা আর তিন গেলাস পানি ছয় টাকা। সফর আলী মনে মনে বলে, লোকটা বলে কী! আমাদের এলাকায় তো পাঁচ টাকায় এরচেয়ে বড় কেক পাওয়া যায় আর পানি দশ গ্লাস খেলেও কোনো দাম দিতে হয় না। তারপর ভাবল, যাগগে, এ সামান্য ক’টা টাকা নিয়ে এত ভেবে কাজ নেই। চব্বিশ টাকা দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল সে। উদ্দেশ্য মতিঝিল বা গুলিস্তানের বাস ধরে পল্টন যাওয়া। সেখানে আর এক বন্ধু থাকে। তার সাথে দেখা করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে যুহরের নামায আদায় করে একসাথে দুপুরের খাবার খাবে। সারা বিকাল এদিক-ওদিক ঘুরে তারপর রাতে বাড়ির উদ্দেশ্যে আবার বাস ধরবে। প্ল্যান মোতাবেক গন্তব্য এখন পল্টন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ তার সামনে একটা বাস এসে দাঁড়াল। বড় করে লেখা ৮ নম্বর। বাস থামতেই হেলপার ডাকতে লাগল, এই শ্যামলী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী। সফর আলী কাল বিলম্ব না করে ওঠে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুরো বাস ভরে গেল। শুধু সিট না, সিটের চেয়ে বেশি লোক দাঁড়ানো যাত্রী। একেবারে উঠার সিঁড়িতে পর্যন্ত যাত্রী দাঁড়ানো। এতেও যদি হেলপার সন্তুষ্ট হত তাতেও একটা কথা ছিল। তারপরও সে ক্রমাগত ডেকেই চলেছে, এই ফার্মগেট, শাহবাগ, পল্টন....। আর সুপার ভাইজার শুধু বলছে, এই মামারা পিছে চাপেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আর এক ইঞ্চি চাপার মতো জায়গা নেই। অথচ সে ক্রমাগত বলেই যাচ্ছে পিছে চাপেন। এখন একটা উপায় আছে, যাত্রীরা যদি পেছন দিয়ে ভেঙে বেরিয়ে পড়ে।

সফর আলী চিৎকার করে ওঠল, আরে ভাই কী শুরু করলেন? সফর আলীর কথা শুনে আশেপাশের কয়েকজন তার দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছে না, মানুষগুলো কেন এভাবে তাকাচ্ছে। সে ভাবল, হয়ত এ দৃশ্য দেখতে দেখতে তাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই কাউকে এর প্রতিবাদ করতে দেখছে বলে হয়ত এভাবে তাকাচ্ছে। কয়েকটা ছোটখাট জ্যাম পেরিয়ে আসাদগেট থেকে বামে টার্ন নিয়ে বাসটা একটু এগিয়ে যেতেই জানালা দিয়ে দেখা গেল জাতীয় সংসদ ভবন। সে চমকে ওঠল। আরে এটা সংসদ না? আহা রে! টিভিতে কত দেখেছি। দেখি, একটু নেমে ভালো করে দেখি। তারপর খেজুর বাগানের ওখানে বাস থামতেই সে সিট থেকে বেরিয়ে আসে। বাসে এত লোকজন যে ঠিকমতো বের হওয়াও যাচ্ছিল না। সে সিট থেকে উঠতেই দুইজন লোক সিট নিয়ে হৈচৈ জুড়ে দিল। একজন বলছে, আমি বসব। আরেক জন বলছে আমি বসব। দুইজন বেশকিছু কথা কাটাকাটির পর একজন জোর খাটিয়েই যেন বসে পড়ল। কি বিচ্ছিরি একটা অবস্থা! ছোট্ট একটা বাস অথচ সব সিট ভর্তির পরও দুই সারিতে লোক দাঁড়ানো। মাঝখানে এক ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা নেই। সে কীভাবে নামবে বুঝতে পারছে না। তারপরও বলল, দেখি ভাই, একটু সাইড দিন। নামব। কেউ যেন তেমন কর্ণপাত করছে না। অথচ নামার রাস্তায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায়, বাস আস্তে আস্তে এগুতে লাগল। এখন তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে লোকজনকে সামান্য সরিয়ে দিয়ে নামতে লাগল। এদিকে এইটুকু সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন চিৎকার করে ওঠল, এই মিয়া ধাক্কান কেন? সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই এমন চাপের মধ্যে একজনের পায়ে সামান্য পারা লাগাতে তিনি চিৎকার করে ওঠলেন, ওই মিয়া দেখে পা ফেলতে পারেন না? সফর আলী মনে মনে বলল, একটা মানুষ নামবে অথচ তাকে তো সাইড দিচ্ছেই না তার ওপর আবার উল্টো তাকেই কথা শোনাচ্ছে। একটা মানুষ নামবে না নাকি? গেটের কাছে যেতেই দেখল গেট বোঝাই লোকজন। মনে হচ্ছে ভেতরে যত লোক ছিল তার দ্বিগুণ এখানে। এবার সে ভাবছে, এতগুলো লোক সরিয়ে সে কীভাবে বের হবে। এদিকে তার কারণে আরও কয়েকজন বেঁকে, নুয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয়। এর মধ্যেই একজন বলে ওঠল, আরে ভাই নামেন। আপনার জন্য তো সোজাও হতে পারছি না। তারপর সফর আলী বাধ্য হয়েই বলল, ভাই সিঁড়ি থেকে একটু নেমে সাইড দিন। একজন হেল্পার বলল, আরে মামা এখন নামবেন কেমনে? বাস তো ছেড়ে দিচ্ছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? পরে নামেন। সফর আলী কিছু বলল না। শুধু মনে মনে বলল, এতক্ষণ তো ঘুমাচ্ছিলাম। সিগনাল পার হয়ে বাস থামলে কয়েকজন নেমে সফর আলীকে নামতে দেয়। সফর আলী বিশ টাকা ভাড়া দিয়ে ফুটপাতে উঠে। এতক্ষণে সে ঘেমে নেয়ে একাকার। একটু জিরিয়ে রাস্তা পার হয়ে সংসদের দিকে চলে যায়। সে ভাবে ভুল করে হয়ত লোকাল বাসে ওঠে পড়ার কারণে এ অবস্থা। পরের বার ভালো বাস দেখে উঠতে হবে। প্রশস্ত আর পরিচ্ছন্ন ফুটপাত দেখে তার ভালোই লাগে। ঝিরঝিরিয়ে বাতাসও বইছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে সে সংসদের চারপাশ, ক্রিসেন্ট লেক আর চন্দ্রিমা উদ্যানটা ঘুরে দেখল। এবার পেটেও যেন টান পড়েছে। চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বের হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল আশাপাশে কোনো হোটেল/রেস্টুরেন্ট আছে কিনা। সে লোক বলল, না মামা, এটা ভিআইপি এরিয়া। এখানে কোনো হোটেল রেস্টুরেন্ট নেই। তবে চন্দ্রিমা উদ্যান বাস স্ট্যান্ডের অপজিটে গিয়ে খেজুর বাগানের দিকে যেতে থাকলে  চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পেতে পারেন। বিনে পয়সায় লোকটা পরামর্শ খারাপ দেয়নি। লোকটার কথামতো সে সেভাবেই এগিয়ে গেল। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পেয়েও গেল কিন্তু সেগুলোতে সে ঢুকবে না। কেননা, সে শুনেছে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গলা কাটে। চমকে ওঠবেন না, ঠিক গলা কাটে না। তবে তারচেয়ে একেবারে কম কিছুও না। সেখানে এক বেলা খেতেই নাকি ছয়শো থেকে এক হাজার টাকা লেগে যায়। তার এখন জাস্ট দুটো রুটি বা পরাটা আর একটা ডিম পোজ হলেই চলবে। সর্বোচ্চ ত্রিশ টাকার খাবার। হেঁটে খেজুর বাগানের কাছে যেতেই দু-একটা দেশি খাবার হোটেল পাওয়া গেল। সেখান থেকে নাস্তা শেষ করে বের হয়ে খেজুর বাগান স্ট্যান্ডে গেল। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনোক্রমেই বাসে ওঠা সম্ভব হলো না। প্রতিটা বাসের অবস্থা বেগতিক। একেবারে বানরের মতো ঝুলছে মানুষ। কয়েকটা বাসে চেষ্টার পরও যখন উঠতে পারছিল না তখন এক লোক স্বেচ্ছায় এসেই তাকে জিজ্ঞেস করল, মামা কোথায় যাবেন? সে বলল, পল্টন যাব। লোকটি বলল, আপনি এক কাজ করুন, হেঁটে সামনে চলে যান। ফার্মগেটে অনেক লোক নামে। সেখান থেকে উঠতে পারবেন। সফর আলী তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খামারবাড়ি রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেট চলে গেল। একজনের কাছ থেকে জেনে নিল বাসে উঠতে হলে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে ওপর যেতে হবে। ফুটওভার ব্রিজের কাছে গিয়ে সিঁড়িতে উঠার রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছে না। এত দোকানপাট আর হকারের উপদ্রব যে হাঁটার রাস্তাটা পর্যন্ত নেই। ফুটপাত তৈরি হয় মানুষের জন্য আর এখানে দেখে মনে হচ্ছে বাজার তৈরির জন্য। অনেক্ষণে সিঁড়ি পেয়ে ফুট ওভার ব্রিজে উঠতেই সে আরও অবাক হলো। মনে হলো ফুট ওভার ব্রিজে না, সে ভুল করে কোনো মার্কেটে ঢুকে পড়েছে। পুরো ফুট ওভার ব্রিজ জুড়েই শুধু দোকান আর দোকান। এদিকে মানুষের এত চাপ যে, হাঁটাই দায় হয়ে পড়েছে। অথচ তারা পুরো ফুট ওভার ব্রিজই দখল করে বসে আছে। নিচে নেমে আর দাঁড়াতে হলো না। অমুক সিটিং সার্ভিস নামে একটি বাস দাঁড়ানো। যাবে পল্টন হয়ে গুলিস্তান। দেরি না করে উঠে গেল সে। সিট পেল পেছনের দিকে। সিটে বসে ভাবল, নাহ, বোধ হয় এবার তাহলে ভালো বাসেই উঠলাম। যেহেতু সিটিং সার্ভিস লেখা তাহলে খারাপ হবার কথা নয়। ভেতরটা দেখতেও বেশ চাকচিক্যপূর্ণ। মুহূর্তেই সব সিট পূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু এ কী! এরপরও বাসটা ছাড়ছে না কী জন্য? আরেকটা বিষয় সে খেয়াল করেছে। শহরে সবাই শুধু মামা মামা করে সম্বোধন করে। সে সকাল থেকে বেশ কয়েকবার এটি খেয়াল করেছে। সবাই কি সবার বাপের শালা নাকি? এভাবে মামা মামা বলে ডাকার কারণ কী? ভাই বলা কি এরচেয়ে ভালো নয়? যাগগে, কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে এসব ভাবতে ভাবতে দেখে বাসে অলরেডি দাঁড়ানো যাত্রী পাঁচ-ছয়জনের মতো হয়ে গেছে। তারপরও হেলপার ডাকছে, এই শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান। সফর আলী যেন থ হয়ে গেছে। এ কী অবস্থা! বাসের গায়ে লেখা সিটিং সার্ভিস, অথচ...। তারপরও সে এবার কিছু বলল না। অন্য দু-একজন যাত্রী যখন রাগ দেখিয়ে বলল, এই মামা কী শুরু করেছ তোমরা? বাসটা ফিলাপ হয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে তারপরও বসে আছ কেন? যাও না। এবার যেন চালকের একটু টনক নড়ল। আস্তে আস্তে বাস চলতে লাগল। আরও দু-একজন যাত্রী ওঠার পর একজন লোক বাসে ওঠল। হেলপার মাথার ওপর থেকে একটা হার্ড বোর্ড বের করে দিল। লোকটা যাত্রীদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে কী যেন লিখে দিয়ে নেমে গেল। তারপর বাসটার গতি বাড়ল। শুধু গতি বললে ভুল হবে, অনেক গতি। হঠাতই যেন চোখে আঁধার দেখতে লাগল সে। মুহূর্তের মধ্যে ধূলোয় ধূসর হয়ে গেল চারপাশ। লোকজনের হাঁচি আর কাশিতে অবস্থা বেগতিক। কেউ কেউ ড্রাইভারকে বলল, মামা আস্তে চালাও। সফর আলী খেয়াল করল আস্তে চালালেও তেমন কোনো লাভ নেই। আশেপাশের অন্য গাড়িগুলো সমানে ধূলো উড়িয়ে চলেছে। বরং যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই ভালো। কয়েকজন মন্তব্য করল, সারাটা বছর রাস্তাগুলোতে খোঁড়াখুড়ি লেগেই থাকে। এ কারণেই এ অবস্থা। কারওয়ান বাজারের কাছাকাছি যেতেই এক মধ্যবয়স্ক লোক পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে নামতে চাচ্ছে। এদিকে সুপার ভাইজার পাঁচ টাকা ভাড়া নেবে না। সুপার ভাইজার বলে, পাঁচ টাকা ভাড়া নাই। চেক হয়ে গেছে, দশ টাকা দিন। ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার এক কিলোমিটার রাস্তাও হবে না। অথচ পাঁচ টাকা ভাড়া দিচ্ছে বলে এ নিয়ে হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। সফর আলী বুঝতেছে না চেকার আসলে কী গুণেছে। শুধু সিটের যাত্রী নাকি দাঁড়ানো নাকি যাত্রীসহ। তার কাছে তো মনে হলো সে কিছু গুণেইনি। শুধু চোখ ঘুরিয়ে কী যেন লিখে নেমে গেছে। আর মালিকপক্ষ তো বোধ করি সিটের বাইরের হিসাব কখনোই চাইবে না।

যেহেতু এতে সিটিং সার্ভিস লেখা। আর কত যাত্রী তো দাঁড়িয়েই আছে। অথচ পাঁচ টাকা কম দিচ্ছে বলে যা শুরু করল। অবশেষে লোকটা দশ টাকা ভাড়া দিয়েই নামতে বাধ্য হলো। কারওয়ান বাজারের কাছাকাছি পৌঁছতেই হুড়মুড় করে বেশকিছু যাত্রী ওঠে গেল। এবার একেবারে ৮ নম্বর বাসে যেমন অবস্থা হয়েছিল ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে। একজন পুলিশকেও উঠতে দেখা গেল। বাংলামটর সিগন্যালে সামান্য জ্যামে বসে থাকার পর বাস শাহবাগ বাস থামল। বেশকিছু যাত্রী নামল এবং উঠল। সফর আলীর পাশের সিট খালি হওয়ায় একটা ছাত্র এসে বসল সেখানে। যাত্রী ঠেসে ভরার পর আবার ওঠল এক চেকার। চেকার ওঠতেই পুলিশটি তাকে বলল, এই মামা পুলিশ পাস আছে। সফর আলীর সাথে বসা ছাত্রটিও বলল, মামা ছাত্র আছে। চেকার বলল, ছাত্র কাটা নিষেধ। ছাত্রটা সামান্য তর্ক করলেও হাফ ভাড়া নেয়নি তার কাছ থেকে। অথচ পুলিশের কাছ থেকে নেয়নি এক টাকাও। অর্থাৎ পুলিশের ভাড়া ফ্রি। ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা করে। তাদের আয় রোজগার নেই। নিলে তাদের ফ্রি নিতে পারে। অথচ তাদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া পর্যন্ত নিচ্ছে না, নিচ্ছে ফুল। আর পুলিশ চাকরি করে, মাস শেষে মোটামুটি ভালো বেতনও পায়। উপরি ইনকামের কথা নাইবা বললাম। অথচ তাদের নেওয়া হচ্ছে ফ্রি।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সফর আলী খেয়াল করল, বিশাল এক জ্যামে পড়ে গেছে তাদের বাস। সে মাথা উঁচিয়ে দেখল যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু জ্যাম। এটা গাড়িও নড়ছে না। আস্তে আস্তে, এক হাত, দুই হাত করে এগুতে এগুতে প্রায় এক ঘণ্টায় মৎস্য ভবন পার হয়ে বাসটা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পেরেছে। কেউ কেউ অবশ্য বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে। সেখানে আরও আধা ঘণ্টা বসে থাকার পরও যখন জ্যাম ছাড়ছিল না তখন সফর আলী পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই পল্টন আর কতদূর? লোকটা বলল, এই তো সামনের মোড় থেকে বামে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পল্টন। সফর আলী যেন বোকা বনে গেল। মাত্র এইটুকু রাস্তার জন্য সে এত সময় ধরে বাসে বসে আছে? নেমে একটু এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই এত জ্যাম কিসের জন্য বলতে পারেন? লোকটা বলল, কোন ভিআইপি নাকি যাবে সেজন্য। সফর আলী বলল, ও মাই গড! এক ভিআইপির জন্য হাজার হাজার মানুষের এত ভোগান্তি? পল্টন মোড়ে গিয়ে তার বন্ধুকে ফোন দিয়ে তার ঢাকায় আসার খবর জানাল। তার বন্ধু রিসিভ করেই বলল, আহা রে বন্ধু! তুই ঢাকায় আসবি তা আমাকে আগে জানাবি না? আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রাখতাম। আজ অফিসে খুবই কাজের চাপ। সফর আলী বলল, থাক তাহলে। আমি একাই ঘুরে ফিরে চলে যাই। বন্ধু বলল, না, কী বলিস? দেখি দুই-এক ঘণ্টার জন্য ছুটি পাওয়া যায় কিনা। তুই রাস্তার দক্ষিণ পাশের ফুটপাত ধরে দৈনিক বাংলা মোড়ের দিকে আসতে থাক। আমি তোকে একটু পর কল দিচ্ছি।
সফর আলী ফোন রেখে রাস্তা পার হতে যাবে তখন পুলিশ বলল, এখন পার হতে পারবেন না। ভিআইপি যাবে, তারপর যেতে পারবেন। এদিকে আজানও পড়ে গেছে। যুহরের নামাযটা জাতীয় মসজিদে পড়ার ইচ্ছে ছিল। তাই শেষবারের মতো পুলিশকে রিকোয়েস্ট করল, ভাই আমার একটু জরুরি প্রয়োজন, যেতে দিন প্লিজ। আমার সাথে তো আর গাড়ি নেই, হেঁটে যাব। পুলিশ একটু রেগেই যেন বলল, চোখের পলকে পার হোন, দৌড় দিন। সফর আলী তাই করল। রাস্তার দক্ষিণ পাশের ফুটপাতে উঠতেই সে দেখল একটু সামনেই একটা অ্যাম্বুলেন্স সজোরে ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতরে কেনো মুমূর্ষু রোগী আছে। সে একটু কৌতূহল নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটার কাছে গেল। গিয়ে যা দেখল তা সে জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। সে দেখল, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে একটা আট থেকে দশ বছরের ফুটফুটে ছেলে বুকের ব্যথায় ছটফট করছে আর পানি পানি করছে। ছেলের এ অবস্থা দেখে আগেই তার বাবা ডাক্তারের কাছে ফোন দিয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ভুলেও পানি দেওয়া যাবে না আর যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এদিকে ছেলের করুণ কণ্ঠভরা পানির জন্য হাহাকার যেন তার মা সহ্যই করতে পারছে না। দুই-তিনটা বাসের পেছনেই এই অ্যাম্বুলেন্সটা। সফর আলী যতক্ষণ আগে ভিআইপি আসার খবর শুনেছে এর মধ্যে পুলিশ চাইলে অ্যাম্বুলেন্সটা ছেড়ে দিতে পারত। সামনের রাস্তা ফাঁকা কিন্তু পুলিশ তা করেনি। অথচ অ্যাম্বুলেন্সের বেদনাসিক্ত সাইরেন অবশ্যই পুলিশের কানে পৌঁছেছে। তারপরও ছেলে যখন একেবারেই যায় যায় অবস্থা তখন ছেলের বাবা দৌড়ে পুলিশের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাল যে, অ্যাম্বুলেন্সটা যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ বলল, এখন পারা যাবে না। ভিআইপি জিরো পয়েন্টের কাছে চলে এসেছে। ছেলের বাবা আবার দৌড়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে যেতেই দেখল ছেলের দেহ নিথর হয়ে আসছে। হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ করে একদম ক্ষীণ স্বরে বলছে পানি, পানি। ছেলের মা ছেলের এ অবস্থা সইতে না পেরে নিজেই বোতলের ক্যাপ খুলে ছেলের মুখে একটু পানি ঢালল কিন্তু পানিটা গিলার শক্তি যেন ছেলেটার আর ছিল না। পুরো পানিটাই গড়িয়ে পড়ে গেল গাল বেয়ে। সকলের চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল একটা তাজা প্রাণ। মুহূর্তেই তীব্র আর্তনাদে ফেটে পড়ল পল্টন মোড়। একটা অজানা-অচেনা শিশুর জন্য সফর আলীর চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ল কয়েকফোঁটা অশ্রু। ভিআইপি পার হয়ে গেলে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের পেছনের গাড়িগুলো ক্রমাগত হর্ন দিতে থাকল। তারা হয়ত জানেই না অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরের খবর। সফর আলী আবার ফুটপাতে উঠে দাঁড়াল। সে দেখল, অ্যাম্বুলেন্সটা আর হাসপাতালের দিকে না গিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে আবার উল্টো দিকে যেতে শুরু করেছে।
এদিকে সফর আলীর ফোন ক্রমাগত বেজেই চলেছে। কতক্ষণ সময় পার হয়ে গেছে তার খোঁজ নেই। ফোন রিসিভ করতেই তার বন্ধু বলল, কী রে কোথায় তুই? সে বলল, বায়তুল মুকাররমের সামনে। তার বন্ধু বলল, সেই কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি। তুই ধরছিস না বলে আরও ভাবলাম কোনো বিপদ আপদে পড়লি নাকি? সফর আলী বলল, না তেমন কিছু না। তুই আয়। তারপর তার বন্ধু এলে পুরো ঘটনা খুলে বললে সে বলে, ও এই কথা? এরকম কত শত ঘটনা এই আজব শহরে ঘটে। বাদ দে, ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে এসব। তারপরও যেন সফর আলীর মনটা কেমন বিষণœ। সে ভাবছে, এ কেমন শহর? মায়া নেই, দয়া নেই সহানুভূতি নেই। তারপর মসজিদে ঢুকে দুইজন অযু করে যুহরের নামাযটা আদায় করে নিল। যদিও দেরি হয়ে যাওয়ায় জামাত ছাড়াই পড়তে হয়েছে। নামাজ শেষ করে দুইজনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে। সফর আলীর বন্ধু বলে, আজ সময় দিতে পারছি না বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অফিস থেকে এক ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়ে বের হয়েছিলাম। তা তুই এখন কোথায় যাবি? সফর আলী বলল, ইচ্ছে আছে কার্জন হল, দোয়েল চত্বর, শহিদ মিনার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরে দেখার। তার বন্ধু বলল, আচ্ছা আমি রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি, তুই যা। তারপর সন্ধ্যায় আমার বাসায় চলে আসিস। আজ থেকে কাল চলে যাস। সফর আলী বলল, না রে দোস্ত, আজ রাতেই ফিরব। আজ একটা বিশেষ ছুটি ছিল, কাল আবার অফিস ধরতে হবে।
তার বন্ধু রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। সে হাঁটতে হাঁটতে গোলাপ শাহের মাজারের কাছাকাছি চলে গেল। ফুটপাতে একটা কাপড়ের দোকানের কাস্টমার আর দোকানদারের বাকবিত-া শুনে সে একটু দাঁড়াল। দোকানদার বলল, এটা চায়না শার্ট, দাম ষোলোশো টাকা। কাস্টমার বলল, তিনশো টাকায় দিবেন? দোকানদার বলল, ধুর মিয়া, শার্ট কিনতে আসছেন? এই দামে চায়না শার্ট না, স্যান্ডু গেঞ্জি কিনে পরেন গা মিয়া। কাস্টমার চলে যাওয়ার সময় দোকানদার বলল, লাস্ট কত দিবেন বলেন। কাস্টমার বলল, ঐ যা বলেছি তাই। দোকানদার বলল, কিছু বাড়াতে পারলে আইসেন। কাস্টমার বলল, এক টাকাও বাড়াতে পারব না। দিলে দেন, না দিলে যাই। দোকানদার বলল, আসেন ভাই, নিয়া যান। এই প্যাক কর। আর এসব কান্ড দেখে সফর আলী মনের অজান্তেই হেসে ওঠে। কোথায় ষোলোশো টাকা আর কোথায় তিনশো। যাগগে, আর সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে পা বাড়াল সে। মূল সড়কের কাছে যেতেই ঘটল আরেক আচানক ঘটনা। একটা বাস দাঁড়িয়ে ডাকছিল, এই সদরঘাট, সদরঘাট। আরেক মহিলা জানালার পাশে বসে বসে কারও সাথে ফোনে কথা বলছিল। বড় স্মার্টফোনটা যেন জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ দ্রুতবেগে এক লোক এসে চিলের মতো ছো মেরে ফোনটা নিয়ে পালিয়ে গেল। সফর আলী বুঝতে পেরে ছুট লাগাল ছিনতাইকারীর পেছনে। কিন্তু মুহূর্তেই ভিড়ের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ছিনতাইকারী। সফর আলী ফিরে এসে দেখল, মহিলা বাস থেকে নেমে হা-হুতাশ করছে সমানে। কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে মহিলাকেই উল্টো দোষারোপ করছে, আপনি জানালার পাশে বসে ফোনে কথা বলেন, শিক্ষা হলো। ভবিষ্যতে আর এমন করবেন না।



কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সফর আলী সামনে পা বাড়াল। একপাশের রাস্তা পার হয়ে ডিভাইডারে উঠতেই চোখে পড়ল চাকচিক্যপূর্ণ আর আধুনিকতায় আচ্ছাদিত একটা ছোট মাজার। লাল রঙের লেখাটা পড়ে দেখল এটাই সেই ঐতিহাসিক গোলাপ শাহের মাজার। কেউ সেজদা করছে, কেউ জিকির করছে আর কিছু পাগল নানা ভঙ্গিতে বসে আসে। মাজারের আরেকটু কাছে যেতেই দেখল, লাল শালুতে ঢাকা কবরের উপরে টাকার রাজ্য। হাজার হাজার নোট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ভেতরে। সে ভাবল, এ নির্জীব কবর এত টাকা দিয়ে কী করবে? মাজার দেখে তো মনেও হচ্ছে না যে উন্নয়নের কোনো বাকি আছে। রাস্তার মাঝখানে টাইলস মোড়ানো মাজার তো আর স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাবে না। মাজারের কাছেই এক পা-হীন প্রতিবন্ধী ভিক্ষা করছে। তার বাটিতে দেখা গেল দুই-চারটা দুই টাকা আর পাঁচ টাকার নোট। অথচ মৃত মানুষের মাজারে পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকার নোট পর্যন্ত আছে। মাজার পাহারার জন্য আবার রাখা হয়েছে আনসার বাহিনীর সদস্য। সফর আলী মনে মনে বলল, হায় আফসোস! দুর্দশাগ্রস্ত জীবিত মানুষ রেখে মৃতের জন্য কত আয়োজন। ফিনিক্স রোডের উত্তর পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটা দিতেই চোখে পড়ল সারি সারি মোবাইল আর মোবাইল এক্সেসোরিজের দোকান। সে মনে করল হয়ত তারা পুরাতন মোবাইল কিনে ঠিকঠাক করে বিক্রি করে। কিন্তু আরেকটু সামনে এগুতেই ধারণা পাল্টে গেল। এদিকে সব দামি দামি ব্র্যান্ডের নতুন মোবাইল রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। সে চিন্তা করল, দামি দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল এ খোলা ফুটপাতে? এবার তার চোখ পড়ল প্রায় দেড়লাখ টাকা মূল্যের আইফোন টেনের ওপর। সে চমকে ওঠল। আরে! দেড়লাখ টাকা দামের মোবাইল এভাবে পলিথিন বিছিয়ে ফুটপাতে রেখে বিক্রি করছে? সে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, ভাই আইফোন টেনটা একটু দেখি। যদিও তার পকেটে এত টাকা নাই যে একটা আইফোন কিনবে। দোকানদার ফোনটা দিলে সে নেড়েচেড়ে দেখল। নাহ, সব ঠিকই তো আছে। দেখি তো দামটা জিজ্ঞেস করে। দাম জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার বলল, মামা যদি দামাদামি না করেন, একদাম দশ হাজার টাকা। সফর আলী যেন আরও চমকে ওঠল। বলে কী! দেড়লাখ টাকা দামের নতুন মোবাইল দশ হাজার? সে বলল, এত দামি মোবাইল এত সস্তায় কীভাবে দেন? দুই নাম্বার নাকি? দোকানদার বলল, না এগুলো টানা মোবাইল। সে বলল, টানা মোবাইল মানে? দোকানদার বলল, টানা বুঝেন না? আচ্ছা, না বুঝলে নাই। এক নাম্বার মোবাইল। নিলে নিতে পারেন। সে বলল, আচ্ছা রাখেন। সামনের দিকে পা বাড়াতেই দোকানদার বলল, এই মামা কত দিবেন? সফর আলী বিড়বিড়িয়ে বলল, আরও কমানো যাবে? বাপ রে, এগুলো কী? আরেকটু সামনে যেতেই এক দোকানদার আর কাস্টমারের মধ্যে তর্কাতর্কি শুনে সে গতিটা শ্লথ করল। কাস্টমার বলছে, মামা এই মোবাইলটা কালকে আপনার কাছ থেকে নিলাম। আজই নষ্ট হয়ে গেছে, আর খুলছে না। দোকানদার বলল, আরে না এই ফোন আমার না। আমি এ ফোন বিক্রিই করি না। কাস্টমার বলল, কী বলেন? কাল নগদ সাত হাজার টাকা দিয়ে আপনার কাছ থেকেই তো ফোনটা নিলাম। দোকানদার বলল, আরে না। আর যদি নিয়েও থাকেন তারপরও তো ফেরত নিতে পারব না। কারণ আমরা কোনো ফোনের গ্যারান্টি, ওয়ারেন্টি দিই না।
সফর আলী তাদের বাকবিত-া দেখার জন্য আর অপেক্ষা করল না। এদিকে এসব তামাশা দেখতে দেখতে বিকাল হতে চলল। সন্ধ্যার আগে কয়েকটা জায়গা ঘুরে এ আজব শহর ছাড়তে হবে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সামনে দিয়ে ডানে টার্ন নিয়ে হেঁটে কার্জন হলে ঢুকল। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে দোয়েল চত্বর, শহিদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখে হেঁটে জাতীয় ঈদগাহের সামনে আসলো। এখান গাবতলীর বাস পাওয়া যাবে। এসে দেখল, সেই সকালের মতো সুবিশাল এক জ্যাম লেগে আছে। তারপরও একটা গাবতলীর বাস দেখে উঠে পড়ল সে। সিট তো দূরের কথা, কোনোরকম গেট থেকে একটু উপরে উঠে দাঁড়াল সে। প্রায় আধা ঘণ্টায় মৎস্য ভবন পর্যন্ত বাস যেতে পেরেছে। অথচ এইটুকু রাস্তা হেঁটে আসলে বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগত। এই জ্যাম ঠেলে কতক্ষণে গাবতলী পৌঁছাতে পারবে তা আল্লাহই জানে। সামনের গ্লাস দিয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত শুধু জ্যাম আর জ্যাম। সফর আলীর যেন আর ধৈর্যে কুলায় না। সে পাশের একজনকে বলল কমলাপুর কোন দিকে? লোকটি বলে ঐ পূর্ব দিকে। সে বলল, রিকশায় যাওয়া যাবে না? লোকটা বলল, হ্যাঁ যেতে পারবেন। সে আর কোনো কথা না বলে হেলপারের হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে নেমে পড়ল। রাস্তা পার হয়ে পূর্বপাশে গিয়ে শিল্পকলা একাডেমির সামনে থেকে রিকশা নিয়ে সোজা কমলাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। সেগুনবাগিচার আবাসিক এলাকায় ঢুকতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। রিকশাওয়ালা সিটের নিচ থেকে পলিথিন বের করে দিল। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। সে ভিজেই যাচ্ছে। রিকশাওয়ালাকে বলল, ভাই কোনো বাসার সামনে রাখেন, আপাতত দাঁড়াই। একটা বাসার সামনে রিকশাটা রেখে দুইজনেই ঢুকে গেল গেইটের ভেতরে। খাকি পোশাক পরা এক সিকিউরিটি গার্ড বলল, স্যার কয়তলায় যাবেন? সফর আলী বলল, কোনো তলায় না। বৃষ্টির জন্য এখানে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি কমলেই চলে যাব। গার্ড বলল, না না, এখানে দাঁড়াতে পারবেন না। এখনই স্যারদের গাড়ি ঢুকবে। তারা এসে আপনাদের দেখলে আমাকে বকবে। মনে করবে আমি আজেবাজে লোক ঢুকিয়েছি। গার্ডের কথা শুনে তারা আর দাঁড়াতে পারল না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কিছুদূর গিয়ে একটা যাত্রী ছাউনি পেল। মানুষ গিজগিজ করছে সেখানে। তারপরও কোনোরকমে গিয়ে দাঁড়াল। মুষলধারে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। অন্তত মোবাইলটা রক্ষা করতে হলেও এখানে দাঁড়াতে হবে। এতক্ষণ খুব কষ্টে মোবাইলটাকে শুকনো রেখেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানিতে তলিয়ে গেল সামনের রাস্তা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে তাদেও পা ডুবে গেল। একঘণ্টা পর বৃষ্টি কমলে রিকশাওয়ালা বলে, আমি যাব না মামা। সব ডুবে গেছে, পানির মধ্য দিয়ে যাত্রীসহ রিকশা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সফর আলী বলল, এত পানির মধ্যে আমি কীভাবে যাব? একটু নামিয়ে দেন না। রিকশাওয়ালা বলল, যেতে পারি, যদি দুইশো টাকা ভাড়া দেন। সে বলল, সে কী! আপনার সাথে না আমার একশো টাকার চুক্তি হলো? রিকশাওয়ালা বলল, সেটা বৃষ্টির আগে। এমন পানির মধ্যে যাওয়ার চুক্তি হয়নি। সে বলল, তাহলে আর নাহয় বিশ-ত্রিশ টাকা বেশি নিতে পারেন। তাই বলে একশো টাকাই বেশি? রিকশাওয়ালা বলল, গেলে যান, না গেলে পঞ্চাশ টাকা দেন। আমি চলে যাই। আরও কত যাত্রী আছে যাওয়ার জন্য। অবশেষে দুইশো টাকা ভাড়া দিয়েই যেতে হলো তাকে।
কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়েও সুবিশাল এক লাইন ধরে অবশেষে উত্তরবঙ্গের ট্রেনের একটা টিকিট কাটতে সক্ষম হয় সফর আলী। বড় মনিটরে ট্রেনের টাইম শিডিউল ও প্লাটফর্মের নম্বর দেওয়া। সে মনিটরে ট্রেনের নাম দেখতে পেল কিন্তু প্লাটফর্ম নম্বর তখনও দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ ট্রেন এখনও প্লাটফর্মে ঢোকেনি। ট্রেন ছাড়তে আরও প্রায় এক ঘণ্টা দেরি। তাই সে ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছিল। ছোট থেকেই তার মনটা একটু কাব্যিক। মাঝে মাঝে ছন্দ মেলাতে পছন্দ করে। হঠাৎ তার মনে নতুন দুটো লাইন এসে গেল। সে আস্তে আস্তে গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করতে লাগল-
“এই শহরে মানুষ থাকে
কেমনে থাকে, কেমনে থাকে?”

প্রচ্ছদগল্প : দূরুত্ব : আবুল বাশার শেখ

প্রচ্ছদগল্প : দূরুত্ব : আবুল বাশার শেখ


দূরত্ব
আবুল  বাশার শেখ

বিরক্তি একটা ভাব নিয়ে বন্ধু মোমিনকে বার বার মোবাইলে কল দিতে ছিলেন হাফিজ। বেশ কয়েক বার রিং হলেও ওপার থেকে ধরলো না কেউ। দু’একবার নাম্বারটা ব্যস্তও দেখালো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। এতে করে বিরক্তির পরিমাণটা দ্বিগুণ বাড়লো। যোগাযোগ করাটা আর হলো না। উপকার করে বন্ধুর কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেলে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। বিরক্তির রেশে বেশ কয়েক দিন এভাবেই কেটে গেলো। বাড়ির একটা কাজের জন্য টাকাটা খুব প্রয়োজন। নিজের আয় করা টাকা থেকে বন্ধুকে ধার দিয়েছিল। টাকাটা নেয়ার সময় বলেছিল কয়েকদিনের মধ্যেই দিয়ে দেবে। খুব বেশি প্রয়োজন পরেনি তাই এতোদিন সে টাকাটা চায়নি। নিজে থেকেই বেশ কয়েকটি তারিখ দিয়েছিল মোমিন নিজে। কিছুদিন আগে মোবাইলে তারিখ করেছিল তিন মাস পরে টাকাটা অবশ্যই দিয়ে দিবে। তিনমাস পেরিয়ে ছয় মাস হয়ে গেল তারপরও টাকা দেয়ার খবর নেই। এসব কিছু চিন্তা করে বেশ রাগ হলো মোমিনের উপর। বিষয়টি তার কাছে মোটেই ভালো লাগলো না যার কারণে মনের ভেতর বন্ধুর প্রতি বিরূপ একটা ধারণাও কাজ করতে লাগলো। যেহেতু টাকাটা খুব প্রয়োজন তাই লোক মারফত বন্ধুর অফিসের টেলিফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করে ফোন দিলেন। রিসিপশন থেকে একজন সুরেলা কণ্ঠের এক মহিলা ফোন ধরলেন। হাফিজ তার কাছে মোমিনের পারসনাল মোবাইল নাম্বারটা চাইলেন কিন্তু অপরিচিত বলে অনুমতি ছাড়া নাম্বার দেয়া যাবেনা বলে জানিয়ে দিলেন ফোন রিসিপকারী। তিনি মহিলাকে বললেন- তাহলে অনুগ্রহ করে লাইনটা ট্রান্সফার করে মোমিন সাহেবের কাছে দেন। মহিলা লাইনটা ট্রান্সফার করে দিলে ওপার থেকে মোমিন বন্ধু হাফিজের গলা চিনতে পারলেন। যেহেতু অফিসের নাম্বারে ফোন তাই প্রথমেই মোমিন তার বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন, যাতে করে হাফিজ তাকে তেমন কিছু না বলতে পারে।
হাফিজ বললেন- তোর টাকা দিতে সমস্যা হতেই পারে তাই বলে তোর মোবাইল নাম্বারটা বন্ধ রাখতে হবে কেন?
না দোস্ত, বন্ধ না, আমি তোকে টাকাটা দিতে পাচ্ছিনা বলে তোর নাম্বারটা আমার নাম্বারে ব্লক করে রেখেছি। যার কারণে তোর এখানে বন্ধ দেখাচ্ছে, এ জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
‘আচ্ছা মানুষ কি শুধু টাকার জন্যই ফোন দেয়! অন্য কিছুর জন্য কি তোকে প্রয়োজন পরতে পারেনা! তুই টাকা দিতে পাচ্ছিস না সেটা সোজাসোজি বললেই হতো। এতো তারিখ করার কিইবা প্রয়োজন ছিল! যা হোক নাম্বারের ব্লক খোলে দে তারপর তোর সাথে কথা বলি।
‘ঠিক আছে দোস্ত, আমি পরে তোর সাথে কথা বলি এখন অফিসে একটা জরুরী কাজ করছি তো।
‘ঠিক আছে কাজ কর, অফিস শেষ করে আমি তোকে কল দেবো রিসিপ করিস।
‘ঠিক আছে।
দীর্ঘদিন পর বন্ধু মোমিনের সাথে কথার আদান প্রদানে কিছুটা যেন স্বস্তি আসলো। হাফিজ খুব পরিশ্রমী একজন মানুষ। সারা দিনের অফিস শেষ করে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসেন সন্ধ্যায়। শুরু হয় আরেক ব্যস্ততা। এতোসব ব্যস্ততার ভেতরেই ঠিক সাতটায় মোমিনের মোবাইলে কল দিলেন। মোমিন কল রিসিপ করলেন খুব নরম গলায়। এবার হাফিজ বললেন- দোস্ত আমরা একসাথে ছোট থেকে বড় হয়েছি। লেখাপড়া শেষ করে দু’জন ভিন্ন জায়গায় চাকুরি করছি। হয়তো একে অপরের সব খবর জানিনা। সত্যি করে বলতো তোর সমস্যা কি? তুই তো এমন কাজ করার কথা না!
‘ঠিক কথাই বলেছিস আমি এমন ছিলাম না। জীবন বাস্তবতায় আজ আমি যেন এক পরাজিত সৈনিক হয়ে যাচ্ছি কেননা অনেক ক্ষেত্রে কথা দিয়ে কথা রাখতে পাচ্ছিনা। দিন দিন চলার পথ যেন ছোট থেকে আরোও ছোট হয়ে যাচ্ছে।
‘এমন হওয়ার কারণ কি? খোলে বলতো!
‘দেখ দোস্ত আমরা একসাথে দীর্ঘদিন লেখাপড়া করেছি যার কারণে তুই আমার অনেক কিছুই জানিস। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। কারণ আমার পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। এক বাবার উপার্জনে চলছে সব কিছু। আমার পরিবারের সদস্য বলতে বর্তমানে সাত জন। গ্রামের বাড়িতে থাকে বাবা-মা আর এক বোন। শহরে আমি, আমার স্ত্রী আর দুই সন্তান। সবার দায়িত্ব এখন আমার কাধে। বোনটা লেখাপড়া করছে। বাবা-মাও তেমন কিছু করতে পারেনা। গ্রামের বাড়িতে যেটুকু জমি আছে সেটুকুতে চাষ বাস করে আর প্রতি মাসের বেতন থেকে আমার দেয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন মতে সংসার চালিয়ে নেয়।
‘কেন তোর দু’জন বড় ভাই ছিল না! উনারা এখন কি করে?
‘বড় দুই ভাই যে যার মতো সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। ছেলে মেয়েদের নিয়ে তারাও কোন মতে চলছে। তাদেরকে যে কিছু বলবো সে পরিস্থিতি নেই। আমি শিক্ষিত ছোট ছেলে তাই বাবা-মা আর বোনকে ফেলতে পাচ্ছিনা। মায়ার বাঁধনে তাদেরকে সব সময় আগলে রাখতে চেষ্টা করি।
‘তোর সংসারের অবস্থা কি?
‘কি আর অবস্থা! ঢাকা শহরে সাত হাজার টাকার ভাড়া বাসায় কোন মতে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বড় মেয়েটাকে খরচ বেশি বলে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি, সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। তারপরও তার পেছনে প্রতি মাসে খরচ হয় এক হাজার টাকার উপরে। ছোট ছেলে বাচ্চাটাকে বাজার থেকে দুধ কেনে খাওয়াবো তারও সামর্থ নেই। মায়ের বুকের দুধ আর ভাত খাওয়াতে হয় তাকে। সংসারের খাবার খরচ প্রায় ছয় হাজার টাকা। আমি যে বেতন পাই তার থেকে খরচের পর তেমন আর কিছুই থাকেনা। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করলো। তুই বিশ্বাস করবি কিনা তা জানিনা আমি চলার পথে এক কাপ চা পর্যন্ত পান করিনা। বন্ধুরা চা পান করতে বললে মুখে হাসি নিয়ে বলি আমি চা পান করিনা, চা পান করলে আমার গ্যাস হয়। যদিও আমি চা পান করি। একটা কথা আজ তুই আমার চায়ের বিল দিলি কাল তো আমাকে দিতে হবে কিন্তু সেই সামর্থ আমার তো নেই। তাই আমি সব সময় খুব হিসেব করে চলতে চেষ্টা করি। বাজে কোন কাজে আমি একটি টাকাও খরচ করিনা। এতো কিছুর পরও ঠিক মতো চলতে পাচ্ছিনা। অফিসের ভেতরের সহকর্মী ও বাহিরের বন্ধু বান্ধবদের সাথে চলার সময় চেষ্টা করি একটু হাসি মুখে কথা বলে সব কিছু আড়াল করতে কিন্তু আজকে তোর সাথে পারলাম না। বিবেকের দংশনে সব কিছু বলতে বাধ্য হলাম।
‘তা তুই আমার কাছ থেকে এতো টাকা নিয়ে কি করলি?
‘তোর কাছ নেয়া টাকাটা আমি কোন বাজে কাজে খরচ করিনি। ঐ টাকাটা আমার ছোট বোনের কলেজে ভর্তির সময় লেগেছিল। বোনটা লেখাপড়ায় খুব ভালো আর তাইতো ওকে লেখাপড়ায় মানা করতে পারিনা।
‘তোর অন্য ভাইয়েরা কোন হেল্প করতে পারেনা?
‘দোস্ত শিক্ষার আলো না থাকলে যা হয়। বড় দুই ভাই বিভিন্ন কাজ করে কোন রকমে তাদের সংসার চালায়। বাধ্য হয়েই সব কিছু মেনে নিয়েছি। আমার হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সবাই তো ভালো চলছে। সত্যি কথা বলতে কি ওদের ধারণা আমি খুব বড় বেতনের চাকুরি করি। কিন্তু আমি যে কত বড় বেতনের চাকুরি করি সেটা শুধু আমিই জানি।
‘দেখ দোস্ত তুই খুব খারাপ করেছিস। তোর এসব কথাগুলো আগেই বলা উচিত ছিল। কথাগুলো খুব ভাঙ্গা গলায় বলতে বলতে চোখ মুছতে ছিল হাফিজ। আরে দোস্ত আমি কি তোর আপনজন নই। তোর বিপদের দিনে যদি আমি পাশে নাই থাকতে পারলাম তবে কিসের বন্ধু!
‘না মানে দোস্ত শোন, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি বিপদের মাঝে জীবন যাপন করছে। এরা না পারছে নিচু শ্রেণীর কাজ করতে না পারছে উচু শ্রেণীর কাজ করতে। এদের মাস শেষে যে বেতন হাতে আসে তা দিয়েই কোন মতে চলতে হয়। যার কারণে পরিবারের কোন সদস্যদেরই আবদার কিংবা সঠিক প্রয়োজন পূরণ করা হয়ে উঠেনা। অফিসে এ বছর যে ইনক্রিমেন্ট হয়েছে তার এরিয়ার কিছু টাকা দেয়ার কথা ছিল কিন্তু আজ দিচ্ছে কাল দিচ্ছে করে প্রায় তিন মাস হয়ে গেল আজও ঐ টাকাটা পেলামনা। ভেবেছিলাম ঐ টাকাটা পেলেই তোর টাকাটা দিয়ে দেবো কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না। যার কারণে তোর সাথে কথা দিয়ে কথা রাখতে পাচ্ছিনা।
‘থাক দোস্ত আপাতত তুই এ বিষয়ে আর চিন্তা করিসনা। আমি দেখি টাকাটা অন্য কোন দিক থেকে ম্যানেজ করা যায় কিনা। তোর যখন সুবিধা হয় তখনই না দিস আর যদি না পারিস তবেও কোন সমস্যা নেই। তবে হ্যা বন্ধুর কাছে কোন বিষয় এতটা লুকিয়ে রাখতে নেই। এতে করে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।
কথা শেষ হলোনা কিন্তু মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ, লাইনটা কেটে গেলো। হাফিজের মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আত্ম বিবেকে বন্ধু মোমিনের বিষয়টি খুব বেশিই যেন দাগ কাটলো। মানুষের সব বিষয় ভালো ভাবে না জেনে কোন কিছুই ধারণা করা মোটেই উচিত নয়। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থাকলে অবশ্যই তার ভালো মন্দ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখা দরকার। নয়তো বন্ধুত্ব মনুষ্যত্ববোধকে ধিক্কার দিয়ে মানবিকতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। হাফিজ পকেট থেকে টিস্যু বের করে মূছে নিলো সদ্য চোখ থেকে বের হওয়া দু’ফোটা নোনা জল।

ভালুকা প্রেসক্লাব, ভালুকা, ময়মনসিংহ।

পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১


দুঃখ পুষে পুষে
ফজলুর  রহমান

বারান্দার সিলিং এ ঝুলে থাকা বিকেলগুলো;
আজকাল জলময়ূরীর ডানার রোদ নিয়ে ফেরে না।
নেতিয়ে পড়া দুপুর না ফেরা মানুষের ব্যথায় টাটিয়ে ওঠে,
হু হু করে ঘূর্ণি বাতাস একতারার সুর হয়ে;
নোনা মনের চারিপাশে ঘুরে-ফিরে যায়।
সাগর জলে পালক ভেজানো পরিযায়ী পাখির দল যে বিরহ নিয়ে দূর দেশ ছাড়েÑ
কোনো কোনো মানুষ ঠিক অতটা বিরহ নিয়েই;
অজন্ম কচুরিপানা হয়ে ভরা নদীতে ভাসে।
কিছু কিছু দুঃখ ধানের মতোন ফলনশীল,
একটা ছড়ায় থোকায় থোকায় পুরুষ্ট হয়ে তা ঝুলে থাকে।
দুঃখ পুষে পুষে বয়স্ক সন্ধ্যারা আজকাল শীত তাড়িয়ে আনে;
বন্য রাতগুলোকে জ্যোৎস্না আর শালুকের মতোন স্নিগ্ধ করে তোলে।


নিশ্চুপে প্রস্থান
সাঈদ চৌধুরী

নিশ্চুপ পরিতাপে শহর পুড়ে যায়
হতাশার ডাল নুয়ে ছুঁয়ে যায় রোদেলার মন, দেহ, অক্ষত পরিনয়,,,
একদা এ শহরে শুভ্রতা এসেছিলো
ভেন্টিলেটরের গা বেয়ে পূর্ণিমার আলো ঢুকেছিলো কামুক কোন আঁধার কক্ষে
অথচ বিহ্বল অসময়ে বুড়িয়ে যাওয়া দুটো শরীর তখন আলাদা বিছানায়
একজন অঘুমা
সে ভাবছে প্রিয়তমা নুপুর পায়ে,
কাচের চুড়ি পড়ে
আমার বাহুতে ব্যজ্ঞনা দিতে পারতো!
অন্য বিছানায়
রমনী স্বপ্নে ডুবে বিভোর
তার রাজপূত্র তাকে বিদেশ ঘুড়ায়, পিকাসোর দেশে যায়
নীল নদের পূর্ণিমাকে অবগাহন করায়!
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে
আবার শুকোয়
জোনাক আসে, আসে তেলাপোকার অযথা ওড়াওড়ির সময়
চিলগুলো খাবারের তাড়নায় বিলবোর্ডে অঙ্কিত রঙিন ছবিগুলোতে মুখ লাগায়
অথচ কিছু আত্মা  পঁচে বিশ্রী গন্ধে ভরে গেছে লোকালয়!
কেউ দেখেনা
বিধাতা দেখে তবুও চিল শকুন পাঠায় না!
একে একে পোড়ে
বন, বাগান, জলাশয় আর শান্তির নিবাসলয়
বরং এভাবেই চলুক,,,
মাতাল শহরে এলকোহলের আগুনে যখন পুড়বে
তখন বোধ হারাবে পঁচে যাওয়া আত্মাগুলোও!
তখন শহর ছাড়বো
খুঁজে নেবো জেগে থাকা এক অচেনা অপ্সরীকে
পুরো রাত কাটাবো ভোরে এক সঙ্গে শিউলি কুড়োনোর অপেক্ষাতে,,,


অপরিচিতা
মাহদী হাসান
  
আকাশের রং বিহ্বল কোকিলের সিক্ত চোখ যেন
সন্ধ্যে হয়ে এলো ফাগুন জমিনে।
উত্তুঙ্গ হাওয়া মেলেছে ডানা, শোই শাই করে ভাসে হলদে পাতা
ফুলে উঠে বিষণ্ণ সমুদ্র ফানুস;
আরেকটু হলেই পাখা মেলবে সুরভিত সগরপক্ষি।

স্বপ্নে ঢুলুঢুলু চোখে তোমায় দেখি নিঃসঙ্গ হাওয়ার রাতে
তোমায় দেখার চেয়ে অন্ধকার দেখি ঢের
টিম টিম বাতি জ্বলে মস্তিষ্কের ভেতর হাতড়াই-
না, তোমাকে পাইনা-
পাই এক দুরন্ত হরিণ মায়া চোখ নিয়ে চেয়ে আছে।
আমি আরও গহিনে যাই, অরণ্যে যাই, জলোচ্ছ্বাসে যাই। তোমাকে পাইনা।

অতঃপর কোন অলক্ষ্যে কোন পরাবাস্তবতায়
ইকারুস হয়ে বুনোহাঁসের মত মিথ-ফানুসে  
ময়ূর পেখমের বর্ণিল রামধনু আঁচলে
আমায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছ-
অথচ, আমাদের কখনোই কোন পরিচয় ছিল না।


মরা ফাগুনের বিকেলে
মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্

নিজের হাতেই জবাই করেছিলো
এক মিথ্যে ছলনার প্রেম,
অথচ এখনো মনে করিয়ে দেয়
এক মরা ফাগুনের বিকেলে
শেষবার দেখা হবার কালে,
কী অবলীলায় মিথ্যে বলার ঢঙে
কাঁদিয়েছিলো অবুঝ প্রেমের জলে
নিঃশেষ করা এক গভীর দুঃখবিলাসে


বসন্ত তোমার জন্য
মোহাম্মদ আবদুর রহমান

ঊসন্ত তোমার জন্য
অপেক্ষা করেছি অনেক দিন ধরে
কখন যে তুমি আসবে?
আঁচল ভরে আনবে অনেক অনেক ফুল
ফুলদানি সাজিয়ে দিবে সেই ফুল দিয়ে
সুগন্ধে ভরে যাবে হৃদয় ভুবন
কন্ঠে ধারণ করবে অনেক পাখিদের গান
মৃদু হাওয়ায় গান গুলি বেজে উঠবে 
আনন্দে আঁকড়ে ধরব তোমাকে
পাগলের মত বলল -আর যেতে দিবনা তোমাকে।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর
তুমি যখন এসেই পড়েছ
তবে আর দেরি কিসের ?
সাজিয়ে দাও ফুলদানি
শুনাও গান 
আনন্দে ভরে উঠুক হৃদয় কানন।


পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২



বাজে ছেলে অথবা এই শহর
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

একটা বাজে ছেলের নামে
লিখে দেয়া হলো তাবৎ জনপদ;
ছেলেটা অভিমান করে ঘর ছেড়েছে বলে
তাকে নিয়ে কানাকানি শেষ নেই মানুষের;
কেউ জানে না;
এই ছেলেটা রাজ করতে এসেছে এই শহর...


একক বন্ধন 
মিশির হাবিব 

মায়াবী বুকের আবডালে তৃপ্তিময় সাগর আছে
আড়াল হতে দেবে না প্রেমিক বুক
জল নেই
তীর নেই
আছে শুধু ঢেউ
হৃদয় দোলাবে
মন নাচাবে
নাচিয়ে দুলিয়ে নিয়ে যাবে দজলা ফোরাতের পবিত্র তীর
সুবিশাল সাগরে ডুবেই স্বর্গীয় হয়েছেন অনেক পুরুষত্ব
চাপা উত্তাপ নেভাতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হও পুরুষ সমুদয় প্রেম ঢেলে পূর্ণ করো একক নারীত্ব
বিষাক্ত ইনসোমনিয়ায় ভুগবে না চোখ
হৃদয় বিভক্ত করো না পুরুষ কখনো
একই ফুলে হাজারও বাসর সাজানো যেতে পারে
দলিত পাপড়ির বিলাসিতায় দেহ তৃপ্ত হলেও নির্জীব মন
একই ক্যানভাসে কোটি চিত্রকর্ম আকাঁ যায়-একই তুলিতে
হৃদয় কোনো ক্যানভাস-তুলি নয়
মানব হৃদয় প্রেম নিরপেক্ষ হলেও হৃদয় অপেক্ষক
এক সাগরে দুটি তরী ভাসলেই ভ্রষ্ট হয় ঢেউয়ের মাধুর্য হৃদয় বন্টন করো না পুরুষ হৃদয়ে হৃদয়ে
কেননা প্রতিটি হৃদয়জোড় মহাবৈশ্বিক শ্রেষ্ঠ বন্ধন।

বসন্ত
রিপলু চৌধুরী

আজি বসন্ত এসে গেছে
পুবাল হাওয়া বইছে মনে
নতুন কুড়ি জাগছে বনে বনে
নতুন সুবাস ছড়াচ্ছে মনে।

আজি বসন্ত এসে গেছে
গাছে গাছে শিমুল ফুল ফুটছে
কৃষ্ণ চূড়া লাল হয়েছে ফুলে ফুলে
বসন্তের কোকিল বইছে গাছের ডালে
বসন্তের হাওয়ায় আজি মন দুলে।

আজি বসন্ত এসে গেছে
মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে
ফুলেরগন্ধ হাওয়ায় ভাসে
সেই গন্ধে আমার হৃদয়ে মাঝে আসে।

আজি বসন্ত এসে গেছে
তুমি যখন আস বছর ঘুরে
ঊসন্ত ঋতুর দুলা লাগে সবার ঘরে
বসন্তের ছোঁয়া সবার মনে আনন্দ ধরে
শিল্পীগণ বসন্ত ঋতুর গান ধরে।

আজি বসন্ত এসে গেছে
বসন্তকে বরণ করে নানান সাজে
মন সাজে নানান রঙ এর ফুলের সাজে
চারদিকে বসন্তের গান বাজে
ঊসন্ত এসে গেছে নতুন সাজে।


তুমি চলে যাচ্ছো
শাহীন খান

ঝুমু, তুমি চলে যাচ্ছো, মধু মাখা বসন্তকে উপেক্ষা করে, কোকিলের কণ্ঠ বাক রুদ্ধ করে, আমার পাঁজরে একশ একটা লাত্থি বসিয়ে, হৃদয়টা গুঁড়ো গুঁড়ো করে, ময়লা আবর্জনা বাসী তরকারি, ছেঁড়া ঝালর মতো পড়ে আছি মুখ থুবড়ে ডাস্টবিনে।
তুমি চলে যাচ্ছো, এ বুকে পাথর গড়ে, অবহেলার ড্রেনে ফেলে, খুব বেশি তুফান তুলে। সিডের ঝড় তুলে। ঝলমল গাড়ি হাঁকিয়ে, অজনা অচেনা লোকালয়ে আতসবাজি সানাইয়ের রেশ আর আড়শি পড়শী রেখে।
তুমি চলে যাচ্ছো, কোন এক কবিকে অনন্ত শয্যায় শুইয়ে, গানের পান্ডুলিপি মাড়িয়ে, দূরে, দূর দূরান্তে, এক সমুদ্র দুঃখের কষ্টের মহাসাগরে ভাসিয়ে, এক পৃথিবী অভাবে রেখে, গলিত লাভা চারদিকে ছড়িয়ে।
তুমি চলে যাচ্ছো, দোয়েল বাচ্চার মাথা কেটে, ফুলের চারায় ফুটন্ত পানি ঢেলে, উপড়ে ফেলে! পুঁই গাছের মাচা তছনছ করে, স্বর্ণালী বর্ণালী আকাশ আলকাতরায় লেপটে দিয়ে, অমাবস্যা এনে, চিঠি লেখার প্যাড ইঁদুরকে সঁপে, সাজানো ঘর বোশেখী ঝড়ের কাছে গচ্ছিত রেখে, আলুথালু করে।
তুমি চলে যাচ্ছো, কাঁঠাল গাছটার ডাল ভেঙ্গে, শ্যাওলা দিঘির পাশ ঘেঁষে, কলা পাতা ছিঁড়ে, বাঁশঝাড়, কবরস্থান, শশ্মান আর অলিগলি বস্তির নোংরা মাঝ পথ দিয়ে, রাজপথে। ভ্যানিটি ব্যাগে মুঠোফোন আর সাজুগুজু পণ্য ভরে।
তুমি চলে যাচ্ছো, উঁইপোকায় কাটছে লেপ কাঁথা কম্বল, চশমাটায় পড়েছে দাগ, ইমেলের পাসওয়ার্ড গেছি ভুলে, ফেবুকে আইডি হয়েছে নিষ্ক্রিয়। গুগল হয়ে গেছে এলোমেলো।
তুমি চলে যাচ্ছো, ফরমেট করে যাচ্ছো তোমার সমস্ত ডকুমেন্ট, দাবানলে ফেলে যাচ্ছো সব সব সব, না বলা না দেখা অসুখে নিমজ্জিত করে, গার্মেন্টস কর্মী রূপে কিংবা মুখোশধারী হায়েনা সেজে।
তুমি চলে যাচ্ছো, বিরহের গান হৃদয়ের মেমোরিতে আজীবনের জন্য সেইভ করে দিয়ে আর ছলনাময়ী প্রতারকের বদনামে আখ্যায়িত করে।
তুমি চলে যাচ্ছো, তুমি চলে যাচ্ছে, তুমি চলে যাচ্ছো, আমার গোটা হৃদয়টাকে চিতা বানিয়ে, চোখ দু’টোকে শ্রাবণ বানিয়ে, মনটাকে কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে দিয়ে, সব লন্ডভন্ড করে, চলে যাচ্ছো, চলে যাচ্ছো, চলে যাচ্ছো, চলে যাচ্ছো!



পত্রগল্প : প্রিয়তমা : মোস্তফা হায়দার

পত্রগল্প : প্রিয়তমা : মোস্তফা হায়দার

প্রিয়তমা
মোস্তফা হায়দার

প্রিয়তমা,
শীতে ঝড়েপরা পাতাদের সংসারে তোমাকে একরাশ কুয়াশাময় শুভেচ্ছা। ভালোবাসার করিডোরে আজ জ্যাম পড়ে জাঙ হয়ে আছে হৃদয়ের গতিপথ। তাই শুভেচ্ছার আসতে দেরি হয়নি বলে ওটুকুতে তোমাকে শান্ত থাকতে হবে। বাণী আর বাকবিতন্ডায় ভেতরের উত্তজনাটাই বাড়ে। বাড়ে না ভালোবাসাময় বিশ্বাসের। কিন্তু তুমি আমি সে দিন বটগাছের নীচে বসে কত কথাই না বলে বলে প্রতিশ্রুতির আঁটি বেঁধেছিলাম। বাতাসকে বলেছিলাম গতি মেরুকরণে তোমার চুলের কোন ক্ষতি যেনো না হয়! প্রকৃতিকে বলেছিলাম নিবিড়তর হতে হতে চোখের রেটিনার বৃদ্ধিতে যেনো কোন প্রতিবন্ধকতা না বাঁধে!
আসলে আমি তুমি সে দিন ভেবেছিলাম, পৃথিবীকে বসবাসে যোগ্যময় করে গড়ে তুলবো। যাতে করে প্রজন্মরা আমাদের স্মরণ করতে করতে হারিয়ে না ফেলে আপনার আসল পরিচয়।
মনে আছে প্রিয়তমা! যে দিন প্রথম তোমার সাথে সাক্ষাৎ হয়, সে দিন তুমি বলেছিলে হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসকে ফেরত পাওয়ায় তুমি আলিঙ্গন করবে দুচোখের ইশারার সাথে। অথচ তোমার সব হলো। হলো না আমার বিশ্বাসের মূল্য ফেরত! বিধ্বংসি বাবার হাত থেকে তোমাকে সেফ করতে পারলে তুমি বলেছিলে আমাকে স্বাধীনতা দিবে। শুনিয়েছো  আমাকে আসতে বলে লুকিয়ে থাকা অতীতের নতুন গল্প। আমি সেই গল্পের ভেতর মজে আছি।
প্রিয়তমা, আমার বাগান জ্বলতে জ্বলতে পৃথিবীর কানন দাহ্য হতে চলেছে। কোন এক সকালের ভয়ে আজো আমি দাহ্য হতে রাজি, তবে ছাই হতে চাই না! লাল সবুজের পতাকা গায় মাখাকে তুমি আমি চেতনার চাদর মনে করিনি। তোমার জন্মের চেয়ে আমার বিশ্বাসের পরিধি অনেক বড়। আমার সামিয়ানায় জড়ানো স্বপ্নে গেঁথে রেখেছি বেঁচে থাকার আস্থার কার্ণিশ। ভুল ভেবে ভুল করে চেতনার দ্যৌতনায় নাম জপতে জপতে আসলকে ভুলতে বসেছি। এই দায় শুধু তোমার আমার নয়! কতবার বলেছি কাগজের সাদা পিঠ চেপে, যেভাবেই আপনি আসেন না কেনো আমার পিতার প্রতি অসম্মান যেন না হয়, আমার পিতার কবরস্থান আর লাল সবুজের জায়নামাজ অতীতকালের স্বাক্ষ্য ছিল। অথচ অতিবেশী চর্বন আর অতিবেশী অপব্যবহারের ফলে ঈশ্বরের পর্যায় নিতে নিতে তোমরাই মাকড়সার সন্তানের মতো খেতে চলেছো!
যাপিতজীবন আর ধারণ করা বিশ্বাসের চেয়ে মুখের বুলি কখনোই টিকে না, টিকবে না অনাস্থার জোয়ারের মুখে। মনে থাকা দরকার যে, পিতার রেখে যাওয়া কাজের চেয়ে মিথ্যা স্বপ্নের চাষ না করাটাই হোক আমার প্রজন্মের বিশ্বাসে। কারণ পিতার আত্মজীবনীতে আছে ভবিতব্য স্বপ্নচাষের সব সীমানা। নবমশ্রেণীতে থাকাকালীন হোস্টেলের ছাদ ফুটোর ঠিক করে দেয়া দাবীই প্রমাণ করে বাবা তুমি আমাদের।
প্রিয়তমা, বাবাতো দুজনের। বিশ্বাস আপামর জনতার। কাজ সম্পাদন শুধু দুজনে করতে যাওয়া মানে আমাদের পিতার প্রতি অসম্মান নয় কী? এসো আমাদের ভালোবাসাময় সব স্বপ্নটুকু বীজের মতো রোপন করতে করতে লাল সবুজের পতাকায় গেঁথে যাবো প্রিয় মৃত্তিকার সোঁধাগন্ধ। যে গন্ধ শোঁকে শোঁকে আমরা ছড়িয়ে দেবো আমাদের আগামীর স্বপ্ন, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যময় পাতাদের সংসার।
এসো বন্ধু আমরা আমাদের কথা বলতে বলতে বিশ্বজোড়া পাঠশালায় ছড়িয়ে দেবো বেঁচে থাকার আস্থা আর সব ইচ্ছে মানবের ভালোবাসা।
প্রিয়তমা তোমার শাড়ীতে ভাঁজ পরা শুরু হয়েছে। শাড়িতে টান পড়া চেতনা ভাগ করতে করতে আজ শাড়ী ভাগাভাগিতে আমাকে এবং বাবাকে কলুষিতের পুস্কনিতে ডুবিয়ে ছাড়তে শুরু করলে! তুমি-আমি বোধের ডানায় চড়া প্রজাপতিই ছিলাম। কিসে যেন সেই বোধ খেয়েই চলেছে! কিছুটা সময় বাকি থাকতে থাকতে যদি আপামর বোধের সঞ্চোদয় করানো যায়, তাহলে সে দিনের বটতলার সংগ্রামের কথা আবার জাগ্রত করবে সবার সবাইকে। পিতার রেখে যাওয়া স্লোগান জীবিত সুরে গান ধরবে -“এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

প্রীততায়
তোমার প্রিয়তা...

পত্রগল্প : প্রিয়তমা মিষ্টি : আহমদ মেহেদী

পত্রগল্প : প্রিয়তমা মিষ্টি : আহমদ মেহেদী


প্রিয়তমা মিষ্টি...
আহমদ মেহেদী

প্রিয়তমা মিষ্টি,
শুরুতেই বসন্তের হলুদ ছোয়া ভালবাসা নিও। তোমার মিষ্টি ডাকনামটা শুধু আমিই জানতাম।এই নামে চিঠি লিখলে তুমি খুব খুশি হতে একদিন। তুমি কেমন আছ ? তোমার শরীর ও মন কেমন আছে তা আজ জানতে খুব ইচ্ছে করছে তের বছর পর তোমাকে চিঠি লিখছি ।শুনেছি তোমার দুজন ফুটফুটে মেয়ে আছে তারা কেমন আছে? তাদেরকে আমার আদর দিও কেমন। তুমিই একদিন চেয়েছিলে যেন ভালভাবে লেখাপড়া করে দেশ ও জনগনের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করি । বাবার দোকান পুড়ে যাবার কারনে এস.এস.সি পর ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। সংসারের হাল ধরতে একটি এনজিওতে কাজে যোগ দেই। এরপর কোনরকম ডিগ্রি পাশ করি। এইতো চলে যাচ্ছে আর কি । তুমি ত জানো বাবার সময়কার ব্যাবসায়ীরা আজ অনেকেই এই বাজারের বড়লোক। বাবার আদর্শ আর সুদহীন জীবন-যাপন বাবাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। বাবার সে আদর্শ নিজের মধ্যে লালন করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বেতন যা পাই তা দিয়েই কোনরকম চলছি। বর্তমান পৃথিবীতে সৎভাবে বেঁচে থাকাটা একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেছে। চারদিকে ক্ষমতা আর টাকার কম্বিনেশনে সমাজ ও দেশ দুলছে। বাবা যেটুকু  করে গেছেন তার ছিটেফোটাও আমি করতে পারব কিনা জানিনা। আল্লাহ না করুক আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে কারো বড় ধরনের কোন রোগ হলে কারো কাছ থেকে ধার নেওয়া কিংবা বাবার জমি বেচা ছাড়া কোন উপায় নেই।  যাইহোক শুধু নিজের কথাই বলছি । তোমার আম্মার কি অবস্থা এখন ? কলেজ জীবনে শুনেছি তিনি অসুস্থ্য । তার সাথে একদিন দেখা করিয়ে দেবে বলেছিলে একদিন । আর দেখা হলো না। রিফাতের কাছে শুনেছি তুমি নাকি ঢাকাই থাক। তার সাথে নাকি তোমার মাঝেমধ্যে কথা হয় ? যাইহোক জানতে তো পেরেছি অন্তত তোমার কথা ! আচ্ছা তোমার বাগানে কি এখনো শিউলী ফুটে ? তোমার ফ্ল্যাটের ছাদে কি বসন্তের জোসনারা আমার কথা একটিবারও মনে করিয়ে দেয় না? তোমার বিয়ের কথা মীমের কাছে শুনেছিলাম। জানো মীম আমাকে তোমার বিয়েতে মেহেদি পড়া হাতটাকে উচিয়ে দেখিয়ে বলেছিল- ‘মিষ্টির বিয়ে খেয়ে এলাম দাওয়াত পাসনি ?,
এখনো সে দৃশ্য আমার মনে হলে আমি খুব কষ্ট পাই ।প্রায় অন্ধকার এক সমাজে আমার জন্ম হলেও তোমার ,স্কুল-জীবনের সান্নিধ্য নিজেকে আলোময় স্বপ্নে বিভোর  রাখতাম। অবশ্য ব্যাপারটা এতো সহজও ছিলোনা। আমার একজন বড়লোক আত্মীয়ের কারনে জীবনে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয় আমার । তাদের জীবনে অর্থ ছাড়া বাকি সবই মিছা। কিন্তু তখন আমার প্রেমের যৌবন চলছে । তোমাকে কাছে পাওয়ার স্বপ্নে আমি পরীক্ষায় একের পর এক ভাল রেজাল্ট করতে থাকি। বইয়ের ভাঁজে,নোটখাতার ভাঁজে তোমার চিঠি পেয়ে পড়ার টেবিলে নিজেকে নিজের সাথে হাসতে দেখিছিলাম একদিন  ।চারদিকে মাদকের ছোবল,মারামারি –হানাহানি । এই পরিবেশে থেকেই আমি লেখাপড়া করেছি । তোমার ভালবাসা ছিলো বলেই তা থেকে দূরে থাকতে পেরেছি। তুমি পারতে কিন্তু একজন নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনটাকে বদলে দিতে ! তুমি জানো এখনো তোমার দেখানো স্বপ্নের লালন করি । যে সমাজে কোন হানাহানি থাকবে না, মারামারি থাকবে না সে সমাজের মাস্টারপ্ল্যান এখনো আমার হৃদয়ে যত্নে  তুলে রেখেছি। সেটা বাস্তবায়নের জন্যেও অর্থটা খুব দরকার। শিমুল বনে জোসনার হাট বসবে আমি সে হাটের ইজারাদার নিতে চাই কিন্তু চারদিক থেকে বাধা আসে। তুমি ভালবেসে যা দিয়ে গেছ আমাকে এজন্য তোমার কাছে আমি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকব। এই ফাগুনের কোন রাতে একদিন চলে আসতে পারো না তোমার প্রটোকল ভেঙে ? হলুদ রঙের বোরকা পড়ে একদিন চলে আসো আমাকে একটু দেখতে একদিন তোমার মেহেদীকে না দেখলে যে অভিমান করতে সে অভিমানী অধিকার বলে। মরার আগে তোমাকে সাথে নিয়ে শিমুল বনে তোমার হাতটি ধরে কিছুক্ষন শুধু হাটতে চাই। পরপারেও আমি তোমাকেই  শুধু চাইব আল্লাহর কাছে। ভালো থাক সবসময় । এই কামনা। নিজের যতœ নিও কেমন ।
ইতি,
তোমার রাগী রাজা ।

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : শেষ পর্ব

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : শেষ পর্ব


ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]

অশুভ স্বপ্ন
অদ্ভুত! ড. রিয়ন মজুমদার, ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা, জগত ভ্রমণের গাণিতিক সমীকরণ, চতুর্মাত্রিক জগতের প্রাণী অযুত, নীলার আড়ালে ক্রিটিনা, অগ্নিকা- ও মিডিয়ার তা-ব সবকিছু এক মহাঘোরে ঘুরছে।
তখন ভোর চারটা। সৌরক পা-ুলিপিটি পড়া শেষে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। ও ভাবতেই পারছে না, পুরো বিষয়টা এভাবে গাণিতিক রহস্যে মোড়া থাকতে পারে। তবে সোমের স্বপ্নগুলোর কি কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে?
না, স্বপ্ন তো অবচেতন মনের কল্পনা। কিন্তু কোথায় যেন একটু হিসেব থেকে যায়। সে হিসেবটা কষে নিলেই একটি রেজাল্ট পাওয়া যাবে। সে রেজাল্ট দিয়ে কী হবে? নিয়তিকে পাল্টে দেয়া যাবে?

দূরে ফজরের আজান হচ্ছে। নিঃশব্দ ও ঘুমন্ত পৃথিবীকে জাগিয়ে তোলার সংগীত। সে সংগীতে সৌরক ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। সোমের মতো ওর ঘুমেও একটি স্বপ্ন উঁকি দিলো। ঢাকার পথ ধরে সৌরক হাঁটছে। হঠাৎ মৌনর সাথে দেখা। মৌন ও তার গার্লফ্রেন্ড সেঁজুতি সাইকেলে চড়ে কোথাও যাচ্ছে। সাইকেলটা বার বার শাঁ শাঁ শব্দে সৌরককে অতিক্রম করছে। সৌরক বুঝতে পারছে না, সাইকেলটা কোথা থেকে আসছে, আর কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। আর কেনই বা মৌন চুপ করে আছে। ওকে দেখার পর তো কথা বলা উচিত ছিল। আর ঐ মেয়েটা কে? সে তো সেঁজুতি নয়। অন্য কেউ।
সে ভাবল, এবার এলে মৌনকে থামাতে হবে। এই তো সে আসছে।
মৌন কাছাকাছি আসতেই, সৌরক ডাকল, মৌন কোথায় যাচ্ছিস?
মৌনর কোনো সাড়া নেই দেখে, সৌরক পথ আগলে দাঁড়াল।
কিন্তু একি! সাইকেলটা ওর শরীরকে ক্রস করে চলে গেল। না, এটা সাইকেল নয়, ধোঁয়াশা।
সৌরক এগিয়ে চলল সামনের দিকে। চারপাশ নিস্তব্ধ! জনমানব শূন্য শহর, রোডগুলো নদীর মতো একা একা বয়ে চলেছে অজানা কোথাও। ঢাকা শহরের চির পরিচিতি শব্দ দূষণ, কোলাহল হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল?
প্রশ্নটি করার মতো কাউকে সে পেলো না। একসময় ও হাতের ডানপাশে খেয়াল করল। একটি বড় পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে, অদূরে আরো কয়েকটি ছোট পাহাড়! কিছু প্রশ্ন ভাবনা ওকে ধাক্কা দিতে লাগল। সে এসব কী দেখছে? ঢাকা সিটিতে তো কোনো পাহাড় নেই। এ পাহাড়গুলো এলো কোথা থেকে? ঐ তো ধানম-ি লেক। লেকের পাশে এতো চমৎকার পাহাড় আছে তা এতদিন জানাই হলো না। যাক সে অজানার কথা। এখন ওর পাহাড়ে চড়া চাই। যেই ভাবা সেই কাজ! সৌরক বড় পাহাড়টা বেয়ে উপরে ওঠছে। যেভাবেই হোক পাহাড়ের চুঁড়ো সে ছুঁবেই। সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছে সে একটি কদম ফুলের গাছ দেখতে পেলো। পাহাড়ের উপর সুউচ্চ গাছটি অসংখ্য ফুলে ভরা। পাহাড়ের চুঁড়ো থেকে শহরের দিগন্ত কতদূর তা বুঝা যায়। তবে সে দিগন্তের দূরত্ব পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। সৌরক কদম গাছে ওঠে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে নিলো। ধীরে ধীরে সে মগডাল ধরে গাছের সর্বোচ্চ সীমায় ওঠে গেল। দু’চোখ ভরে চারপাশটা দেখল। ভারি চমৎকার! একসময় ইচ্ছে হলো নিচের রোডটা দেখবে। সৌরক রোডের দিকে তাকাল। রোডটা ছোট্ট এক শান্ত নদী। এঁকে বেঁকে ছুটে চলেছে অনেক মোহনার প্রেমে। কালো রোডটাতে বড় বড় গাড়ি এদিক-সেদিক যাচ্ছে। এত গাড়ি কোথা থেকে এল? কিছুক্ষণ আগেও তো রোডটা ফাঁকা ছিল। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল মৌনর দিকে। সে রোড ক্রসের অপেক্ষায় একা দাঁড়িয়ে। যখন মৌন রোড ক্রস করতে পা বাড়াল তখনই ট্রাক তাকে ধাক্কা দিলো। মুহূর্তে ট্রাকটা উধাও। রক্তাক্ত মৌন পথে পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখার পর, সৌরক শুকনো পাতার মতো কদম গাছ থেকে হেলে পড়ল। বাতাসে সে দুলতে দুলতে নিচে নামছে। ভূমিতে নামা হলো না, ওর ঘুম ভেঙে গেল। কটা বাজে? সাড়ে সাতটা।


কৌতূহলের হাতছানি

পরদিন বিকেলে পা-ুলিপিটি মৌনর কাছে পাঠানো হলো। সেও সোম মজুমদারের লেখা পড়ল। জানাল, ভারি ইন্টারেস্টিং লেগেছে ভৌতিক ভৌতিক ছোঁয়া। সাপের বাচ্চাটার জন্য ভারি মায়া হয়েছে।
সৌরক বলল, মৌন, আমি ভাবছি সে বাংলো বাড়িতে যাব। তুইও কিন্তু যাবি আমার সাথে।
হ্যাঁ, যাওয়া যেতে পারে। ভ্রমন দর্শন দুটোই হবে।
আমি দুটো চরিত্রকে খোঁজে বের করতে চাই।
কাকে? অযুত আর ক্রিটিনা?
না। মাহিদ আর মিজান মিয়াকে
ওদেরকে দিয়ে কী হবে?
প্রয়োজন আছে। ঘটনার দিন মিজান কেন অনুপস্থিত? এমন কিছু জিজ্ঞাসা বার বার আমাকে টোকা দিচ্ছে।
পুরো ঘটনা রহস্যে ঢাকা হলেও, কেমন সত্য মনে হয়। আচ্ছা, সত্যিই কি চতুর্মাত্রিক জগতের প্রাণী পৃথিবীতে আসে?
অসত্যি নাও হতে পারে। পৃথিবীবাসীর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ, অনেক বিপদ!
সৌরক, ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলাটি যদি থাকত আমরা অনায়াসে বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণে যেতে পারতাম।
জানি না, হয় তো পারতাম। তবে ফর্মূলাটি এখনো পৃথিবীর বুকে আছে।
কি বলছিস? কার কাছে আছে?
যে ফর্মূলাটি সংরক্ষণ করে রেখেছে।
তাহলে তো জগত ভ্রমণ অসম্ভব হতে পারে না।
না, মৌন। সম্ভব নয়। কারণ ভ্রমণের সমীকরণগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, ক্রিটিনার অগ্নিদাহে। আর রিয়ন সাহেবের ডায়েরিগুলোও পুড়ে ছাই। অযুত হলো শয়তানের দূত!
আচ্ছা। তোর কি মনে হয়, ওদের অস্তিত্ব এখনো ঐ ঘরে আছে।
মনে হয়, আবার হয় না। সোম লিখেছে, অযুত স্থির বিকল হয়ে আছে। ওর মৃত্যু এখন ধ্রুবক।
বিষয়টা আমি এখনো আমলে নিতে পারিনি।
সেটা তোর ব্যাপার মৌন। সব কিছুতেই আমাকে কৌতূহল হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

বুনো বাংলোবাড়ি

মার্চের শেষের দিকে এক সকালে ওরা ট্রেনে চড়ে রওনা দিলো। আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে গেল শালবনে। সোম মজুমদারের মতো ওরা স্টেশন থেকে হেঁটে রিয়ন সাহেবের বাড়িতে গেল। শূন্য খাঁ খাঁ বাড়িটি জ্বলে-পুড়ে ভূতুড়ে রূপ ধারণ করে আছে। ঘাসে ভরা উঠোনের একপাশে দুটো ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার ও একটি টেবিল। নিচতলার ঘরটিতে কেউ নেই, তা দেখলেই বুঝা যায়। সিঁড়ি ভেঙে ওরা দোতলায় ওঠল। বারান্দায় একটি পুরনো কাঠের টেবিল মাঝখানে খানিকটা পোড়া। সৌরক রিয়ন সাহেবের ঘরে প্রবেশ করল। থমথমে পরিবেশ। আলমারিগুলো মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পুরনো ছাইয়ের স্তুপ একপাশে জমা।

ঘরের এক কোনায় সৌরক একটি হাতঘড়ি পেল। ঘড়িটি ধুমড়ে মুচড়ে আছে। এটিই কি সোম মজুমদারের হাত ঘড়?ি সৌরক ও মৌন বেশ কষ্টে আলমারিগুলো দাঁড় করিয়ে রাখল। ভেতরটা খোঁজে করে একটি বালুঘড়ি ব্যতীত তেমন কিছুই পাওয়া গেল না।
মৌন হেসে বলল, ঐ রুপিগুলো খুঁজছিস?
পেলে দোষ কি?
হ্যাঁ, তাই তো। ক্রিটিনার দেখা পেলেও মন্দ হতো না।
খুঁজে দেখ, পেলেও পেতে পারিস।
আর মেঘাদ্রি?
ওকে খোঁজে পাবি না। মেঘাদ্রি তো রিয়ন সাহেবের কাছে।
সৌরক, দেখ দেয়ালে কার ছায়া!
কোথায়?
এই তো এখান থেকে সরে গেল।
তোর ভুল ধারণাও হতে পারে।
না, দোস্ত। এখানে আর এক মুহূর্তও না। আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে।
কেন? কাকে ভয় লাগছে?
ঠিক ঐ ভয় নয়। ফোবিয়া।
অযুতের বিষয়টি তো তুই আমলে নিসনি। তাহলে ভয় কেন?
জানি না। একটু বাইরে যাচ্ছি।
এ কথা বলে মৌন বারান্দার দিকে চলে গেল। সৌরক পুরো ঘর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। হঠাৎ চোখ পড়ল পোড়া কাঠগুলোর দিকে। সেখানে একটি কাঠে লেখা আছে,“ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা”। তখনই সে স্পষ্ট দেখল দেয়ালে একটি মহিলার ছায়া।
অজান্তেই সে বলে ওঠল, নীলা।
একটি শব্দ কানে এল, সোম তুমি?
না, আমি সৌরক।
ফিরে যাও সোম। আমি নীলা নই, আমি ক্রিটিনা।
মুহূর্তে ছায়াটা মিলিয়ে গেল।

সৌরক বিস্মিত! মনে মনে বলল, একি! এটা কী করে সম্ভব? কার সাথে কথা বললাম। ক্রিটিনা? ক্রিটিনা কি কথা বলতে পারে? অযুত ওর তো জিব কেটে ফেলেছিল। জিব না থাকলে কি হবে, হৃদয়েরও তো ভাষা আছে। হয়তো ও সে ভাষাতেই কথা বলছে। সত্যিই কি এখানে ক্রিটিনার অস্তিত্ব আছে?
হঠাৎ সৌরকের বোধ ফিরে এল। ভেবে নিলো, না, পুরোটাই ওর কল্পনা। এ অলীক কল্পনার উৎস আর কিছু নয়, সোম মজুমদারের লেখা। কদিন আগেও সে একটা স্বপ্ন দেখেছে, যার জন্য সোম মজুমদারের লেখাই দায়ী।
সৌরক বাইরে বেরিয়ে এল। দু’জনই পা বাড়াল সামনের দিকে।


নয়নপুর গ্রাম

লোকজনের কাছে প্রশ্ন করতেই ওরা মিজান মিয়ার ঠিকানা পেল। মিজান মিয়াকে বাড়িতেই পাওয়া গেল।
সৌরক তাকে বলল, মিজান ভাই, আমরা সোম মজুমদারের আত্মীয়।
শুনেই মিজান মিয়া ওদেরকে ঘরে নিয়ে বসাল। তার একা সংসার। কুশল বিনিময়ের সময় জানাল অচিরেই সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। সোম মজুমদার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সোম স্যার লোকটা খুব ভালা মানুষ। তবে কিছুটা পাগল কিসিমের। প্রায় সময় একলা একলা কথা কইতো। দুই কাপ চা বানাইতে বলত। এক কাপ খাইতো। আরেক কাপ ঠা-া হইতো। কিছু বললে উল্টা ধমক খাইতে হতো। পরে ভাবলাম পাগল মানুষকে না খেপানোই ভালা। স্যার মাঝে মইধ্যে একলা একলা ঝগড়াও করত। একদিন রাইতে নিচতলার বারান্দায় ঘুমাইয়া ছিল। সকালে গিয়া দেখি এক পদ্ম গোখরা সাপ স্যারের হাত প্যাঁচায়া শুইয়া রইছে।
মিজান মিয়া আরো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিল। সৌরক তাকে থামিয়ে দিলো।
মিজান ভাই, আপনি নয়নপুর গ্রাম চেনেন?
চিনব না কেন? খুব বেশি দূরে না। বনের ভেতর দিয়া সহজ রাস্তায় গেলে বড়জোর আধা ঘন্টা টাইম লাগব।
আমরা সেখানে যাব। ওখানে নিয়ে যাবেন?
কেন নিয়া যাইব না, চলেন।

মিজান মিয়ার সাথে ওরা বনের ভেতর দিয়ে পথ চলতে লাগল। পোড়া গাছগুলো আবার বেঁচে ওঠার চেষ্টা করছে। চারদিকে সবুজ পাতারা আবার উঁকি দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সৌরক দেখল, একটি গাছের পাশে অনেকগুলো সজারুর কাঁটা জমে আছে। কাঁটার পাশেই ছোট্ট কঙ্কালটা।

মিজান মিয়া অগ্নিকা-ের ঘটনাটা বর্ণনা দিয়ে শুনাল। বলল, সেদিন আমার বাবা মারা যায়। যার কারণে ডিউটিতে যাইতে পারিনি। কেডা জানত সেই দিনই এমন ঘটনা ঘটব? বাবার জানাজা শেষে যহন দাফন করতে গেলাম, তহন আগুনের ঘটনা জানতে পারি। তারপর তো ছুটাছোটি। দাফন শেষে, গ্রামবাসী সবাই মিলে সেইখানে গেল, আগুন নেভাইলাম। আমরা ওখানে যখন যাই, তখনই সোম স্যারের এক বন্ধু উনারে গাড়িতে নিয়া ঢাকায় পথে রওনা দিছে।
মিজান মিয়া আরো জানাল, সোম মজুমদারের মৃত্যুর দিন সে এখানে আসেনি। ঘটনার পর সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু ভয় তাকে ঐ ঘরে যাবার সাহস দেয়নি।

নয়নপুর পৌঁছার পর সৌরক লোকজনের সাথে কথা বলল। জিজ্ঞাসা করল মাহিদকে কেউ চিনে কিনা? মাহিদদের বাড়ি কোনটা?
কেউ ওকে সঠিক সন্ধান দিতে পারল না। কারণ গ্রামটি একেবারে ছোট নয়। তাছাড়া ঐ গ্রামে মাহিদ নামে কয়েকটি ছেলে রয়েছে। সবাই পিতার নাম জানতে চাইল। সৌরক বিপাকে পড়ল। অবশেষে বলল, ছেলেটি হয়তো ক্লাস নাইনে পড়ে। কিংবা ক্লাস টেনে ওঠেছে। স্কুলের নাম নয়নপুর মডেল হাই স্কুল। ওদের বাড়িতে ছোট্ট একটি গরুর খামার আছে। তখনই রাহাত নামের একটি ছেলে বলল, আমি মাহিদদের বাড়ি চিনি। আমরা একসাথেই পড়েছি।
মৌন বলল, তাহলে আমাদের নিয়ে চলো।

রাহাত ওদেরকে নিয়ে পাশের পাড়ায় গেল। পুরো পাড়াটা পুড়ে নিঃস্ব হয়ে আছে। চাল বিহীন ঘর-বাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে। রাহাত জনমানব শূন্য একটি বাড়ির দিকে আঙুল তুলে বলল, এটাই মাহিদের বাড়ি।
এখানে তো কেউ নেই।
রাহাত বলল, আগুনে বাড়ি-ঘর পুইড়া গেছে। মাহিদরা গরুগুলা মহাজনের কাছে বেইচ্যা কই যেন চলে গেছে।
মৌন বলল, কবে গিয়েছে জানো?
আগুন লাগার কয়েকদিন পর। যেদিন এদিকে আগুন আসে, সেদিন মাহিদের বুড়ি দাদি ঘরের ভেতর দম বন্ধ হইয়্যা মারা গেছে। তারপর থেইক্যা মাহিদের বাবা প্রতিজ্ঞা করছে এই ভিটাতে আর থাকব না। তারপর তো চইল্যাই গেল।
অর্ধপাকা গোহাল ঘরটা বেশ পরিপাটীভাবে বানিয়েছিল। সেটা এখন পুড়ে নিঃস্ব।
শোনো রাহাত, মাহিদ তোমার কেমন বন্ধু? কাছের না দূরের?
ভাল বন্ধু ছিল। আমরা ছোটবেলা থেকে এক সাথে পড়েছি।
আচ্ছা, ওর কাছে কি কখনো কোনো মার্বেল পাথর দেখেছ?
হ্যাঁ, দেখেছি। আগুন লাগার পরদিনই ওর কাছে একুশটা মার্বেল দেখেছি। ওই মার্বেলগুলার ভেতর এলজেব্রা অংক আছে। মার্বেলগুলা মাহিদ কাউকেই দেয় না।
মৌন বলল, থ্যাংকস রাহাত। আমরা এখন ফিরে যাব, ভাল থেক।
রাহাত মাথা নাড়ল।
ঠিক আছে, আমি যাই। সে অন্যপথ ধরে এগিয়ে গেল।
সৌরক বলল, ছেলেটা খুব সহজ সরল। ওকে কেবল প্রশ্নই করে গেলাম, সে কোনো কিছু জানতে চাইল না।
গ্রামের মানুষগুলো এমনই হয়। বুঝলি!

রাহাত চলে যাবার পর মিজান মিয়াকে সাথে নিয়ে ওরা স্টেশনের রোডে ওঠল। এক সময় মিজান মিয়াও বিদায় নিয়ে চলে গেল। এখন ওরা দু’জন হেঁটে চলল।

কি বুঝলি মৌন?
ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা।
হ্যাঁ, ফর্মূলাটি মাহিদের কাছে আছে। আমার মনে হয় ছেলেটি বুদ্ধিমান। ওর নিশ্চয়ই এই সূত্রের প্রতি আগ্রহ রয়েছে।
ওরা কোথায় আছে জানতে পারলে ভাল হতো। ওর একটা সাক্ষাতকার নেওয়া যেত।
হ্যাঁ, তা হতো। কিন্তু ছেলেটিকে খোঁজে বের করা, আমাদের পক্ষে দুষ্কর। তবু চেষ্টা করতে হবে।
জানিস সৌরক, মৃদু ভাইকে খুব মনে পড়ছে। যা ভেবেছিলাম তা নয়, সবই এক রহস্য সমীকরণ।
মৌন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।
কিন্তু আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, তা এখনো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। সোম মজুমদারকে মানসিক রোগি ভেবে প্রায় সবকিছুকেই ওরা অগ্রাহ্য করেছে। ওর কথা ও লেখার অনেক সত্যতাও মিলেছে।
হুম। বিষয়গুলো প্রকাশ পাওয়া উচিত। আমি ভাবছি সোম মজুমদারের লেখার উপর আলোচনা ও ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখব। মৃদু ভাইকে নিয়েও কিছু লিখতে হবে।
মৌন, সোম মজুমদারের লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। ঢাকায় গিয়ে আমরা প্রকাশকদের সাথে আলোচনা করব।
হুম, সেটা আমিও ভাবছি।

ছাই রঙের শেপ

ওরা প্রায় স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রোডের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো লাল আগুনে জ্বলছে। হঠাৎ সৌরক বলল, আরে মৌন! রিয়ন সাহেবের ঐ ঘরটার কয়েকটা ফটো তোলা উচিত। লেখার সাথে ছবি খুব প্রাসঙ্গিক। পাঠকের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করবে? ক্যামেরাটা কেন নিয়ে এসেছিলি? মনে আছে?
ওহ্ গড! কোনো ছবিই তো তোলা হয়নি।
চল ব্যাক করি। কয়েকটা পিক তুলেই চলে আসব।
ওদিকে আবার যাব? সন্ধ্যা যে প্রায় নেমে এল। তাছাড়া ওই বাড়িটা ভয়ানক থমথমে।
ভয় নেই। খালি পড়ে আছে বাড়িটা তাই এমন থমথমে। চল।
ঠিক আছে।

মৌন একটি রিকশা থামাল। রিকশাঅলাকে রিয়ন সাহেবের বাড়ি বলতেই বলল, ওঠেন ভাই। দশ টাকা ভাড়া।
ওরা দু’জনই ওঠে বসল।
যখন রিকশাটা রিয়ন সাহেবের বাড়ির সামনে পৌঁছল, তখন সন্ধ্যা। তবে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে ওঠেনি। খোলা আকাশের আলোয় ফর্সা পরিবেশ। টিনের গেইট খোলাই ছিল। ওরা ভেতরে ঢুকল। চমকে ওঠল সৌরক।
একটি পদ্মগোখরো ঘাসের উপর গা এলিয়ে সন্ধ্যা দেখছে।
মৌন বলল, এটাই কি সোম মজুমদারের পোষা সাপ?
হতে পারে। নাও হতে পারে। এমন বন জঙ্গলে সাপ থাকাটাই স্বাভাবিক।
তা ঠিক।
সাপ দেখে মৌন খুব উৎফুল্ল! কিছুক্ষণ আগের ভয় সে নিমেষে ভুলে গেল। বলল, সৌরক দেখ, সাপটাকে দারুণ লাগছে। আমি সাপটার কয়েকটি পিক নেব।
এ কথা বলেই মৌন ওর স্মার্ট ফোন বের করে ক্যাচ ক্যাচ শুরু করল।
দ্রুত কর। দোতলায় ওঠতে হবে।
একটু দাঁড়া একটা ভিডিও করে নেই। সবাইকে দেখানো যাবে। খুব এনজয় হবে।
মৌন মুঠোফোনের ক্যামেরায় ভিডিও অপশন অন করে, পদ্ম গোখরার দৃশ্য রেকর্ডিং শুরু করল। সাপটাকে হালকা খোঁচা দেওয়া দরকার, একটু নড়াচড়া করলে ভাল হত। মৌনর কথা শুনে সাপটা মাথা উঁচু করে তাকাল।
দেখলি সৌরক, কি মায়াবী চোখ। সোম মজুমদার ঠিকই লিখেছে। সাপের প্রতি তাঁর ব্যাপক ভালবাসা এমনিতেই জন্মেনি। আসলে, সাপ বিষাক্ত হলেও, তার মধ্যেও মায়া আছে।

মৌনর সর্পপ্রীতি দেখে সৌরক বিরক্ত হলো। বলল, এসব কি খেলা শুরু করলি। উপরে চল।
আঃ সৌরক, তুই যা না। ঝটপট কিছুু ছবি তুলে নে। ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি ভিডিওটা কমপ্লিট করে নেই।
সৌরক আর কথা বাড়াল না। খানিকটা রাগ নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

অন্ধকার এখনো ঘরটিকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। আবছা আলো বিরাজমান। প্রথমদিকে সে ফ্ল্যাশ ছাড়াই কয়েকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছবি নিলো। তারপর ফ্ল্যাশ অন করে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে পাঁচ সাতটি ছবি তুলল। হঠাৎ ওর খুব গরম অনুভূত হলো। ঘরের তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে ওঠছে। অসহ্য তাপ! ওর পুরো শরীর ঘেমে ভিজে একাকার! সৌরক খানিকটা ভয় পেল।
বলল, এসব কি হচ্ছে, সোমের মতো আমিও কি বিপদে পড়লাম?
আলমারির পেছন দিক থেকে একটি ছাই রঙের শেপ বেরিয়ে এল।
মিঃ সোম, তুমি আবার এসেছ। গুড!
না, আমি সোম নই।
তবে কে তুমি?
আমি সৌরক।
তুমি দারুণ মিথ্যে বলতে পারো। নাম পরিবর্তন, হা হা হা! আমার স্নায়ুতন্ত্র তাই বলছে।
অযুতের শেপ কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় তর্জন গর্জন স্বরে বলল, রিয়ন সাহেব আমাকে বোকা বানিয়েছে। তাঁকে আমি হত্যা করেছি। তুমিও আমাকে বোকা বানিয়েছ। আমাকে স্থির বিকল করে দিয়েছ। আমি আমার জগতে ফিরে যেতে পারছি না। তোমাকে আমি বাঁচতে দেবো না, হত্যা করব! কি ভেবেছিলে? পেরিয়ে যাবে? কক্ষণো না। আমার মতো বহু অযুত পৃথিবীতে আসবে। একদিন তোমাদের ত্রিমাত্রিক জগতকে, আমাদের বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে। হা হা হা।
অযুতের স্যাডোটা ক্রমেই সৌরকের দিকে এগিয়ে আসছে।
সৌরক খানিকটা পিছিয়ে গেল। ওর মুখে আতঙ্কের ছাপ।
মিথ্যে বলিনি অযুত। আমি সোম নই।
সোম বা সৌরক যেই হও। তুমি থাকবে এই বাংলো বাড়িতে।
একথা বলেই অযুতের ছাই রঙের হাত সৌরককে স্পর্শ করতে উদ্যত হলো।
অযুত, থামো, বলছি।
সোম, এবার তোমাকে ফিরে যেতে দেবো না। তুমি চিরদিন এখানেই থাকবে।
না অযুত, এদিকে এসো না।
পেছনে যেতে যেতে সৌরক দেয়ালে ধাক্কা খেল।
নীলা, কোথায় তুমি? আমাকে বাঁচাও। ক্রিটিনা, ক্রিটিনা....।
ক্রিটিনা, ও আসবে না। দ্বিমাত্রিক জগতের নিকৃষ্ট প্রাণীটা এখন এদিকে আসবে না।
না, অযুত। আমাকে ফিরে যেতে দাও।
না, সোম। আমি, তুমি ক্রিটিনা এখানে একসাথে থাকব। রিয়ন সাহেবের ডায়েরি সার্চ করব। খুঁজে বের করব, ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা। আর এখানে প্রবেশের প্রধান ফটক হলো মৃত্যু! এটাকে তোমার অতিক্রম করতে হবে। হা হা হা।
মৃত্যু! না, অযুত না।
ছাই রঙের শেপটা কু-ুলি পাকিয়ে সৌরককে জড়িয়ে ধরল। ওর মাথায় প্রচ- চাপ অনুভূত হলো। ক্যামেরাটা হাত থেকে পড়ে গেল।

প্রতিরক্ষা বলয়

অযুতের মতো চতুর্মাত্রিক জগতের বহু প্রাণীর শক্ত অবস্থান ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে। পৃথিবীবাসীর অজান্তে এগিয়ে যাচ্ছে শত্রুর ষড়যন্ত্র ও চালচক্র। যা এই সুন্দর পৃথিবীকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে, সময়ের অপেক্ষা রাখে মাত্র।

একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। পরের সময়গুলোও ভারি বিপদের দিকে মোড় নেয়, তবে সেই সাথে শুরু হয় অনুসন্ধান ও সচেতনতার আরম্ভ।
কয়েক শতাব্দী ধরে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা চতুর্মাত্রিক জগতের প্রাণীদের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করছে। বিভিন্নভাবে পৃথিবীতে তাদের বিচরণের প্রমাণ মিলেছে। এই অবাধ বিচরণ যে পৃথিবীবাসীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য মহাহুমকি। সেই থেকে এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য পৃথিবীর বিজ্ঞান মহল ওঠে পড়ে লেগেছে। গবেষণা চলছে, ওদেরকে কিভাবে প্রতিহত করা যায়, কিভাবে শত্রুদের প্রবেশ ঠেকানো যায়?

অতঃপর পৃথিবীর ইতিহাসকে জয় করল এক নব্য প্রাচীন পদার্থ বিজ্ঞানী, তিনি প্রফেসর ড. মাহিদ। ড. মাহিদের লেখা গ্রন্থে পাওয়া যায় দুটো মহামূল্যবান তত্ত্ব। এর মধ্যে একটি হলো ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা, অন্যটি হলো প্রতিরক্ষা সমীকরণ। তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, এই সমীকরণটি সমাধানের জন্য আবশ্যক ক্রাইটেরিয়ন সূত্র।
ড. মাহিদ তাঁর লেখায় একটি গল্প উল্লেখ করেছেন।
“ছোটবেলায় শুনেছি বহুবছর আগে এক অদ্ভুত ভদ্রলোক আমাদের গাঁয়ে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন এক রহস্যময় মানুষ। একা থাকতেন। মানুষের সংস্পর্শ থেকে যোজন যোজন দূরত্বে তাঁর অবস্থান। তাঁর মৃত্যুর পর সে বাড়িটি ফাঁকা হয়ে যায়। আমাদের অঞ্চলের মানুষজন বাড়িটির নাম দিয়েছিল রিয়ন সাহেবের বাড়ি।

তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন বনের ভেতর একজন অচেনা লোককে দেখতে পাই। তিনি হন্তদন্ত হয়ে গভীর বনে ছুটে যাচ্ছিলেন। কয়েকদিন আগে থেকেই বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ গভীর বনের ভেতর যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কারণ একটি পাগলা হাতি সাফারি পার্ক থেকে বেরিয়ে বহু দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বনে প্রবেশ করে।
আমি লোকটাকে থামিয়ে দেই ও পরিচিত হই। জানতে পারি তিনি রিয়ন সাহেবের বাড়িতে থাকেন। সেদিন তিনি আমাকে যেতে বলেন।

রিয়ন সাহেবের বাড়িতে আমি কখনোই যাইনি। জনশূন্য বাংলো বাড়িটি ভূতুড়ে বলে পরিচিত ছিল। তাছাড়া বনের ঐপাশটা বেশ থমথমে। একদিন আমার কাজিনকে নিয়ে সে বাড়িতে যাই। লোকটার সাথে গল্প করি।

কিছুদিন পর এক সকালে মাথায় ভূত চাপল, স্কুলে যাব না। আম্মুর ভয়কে এড়িয়ে যাবার জন্য ঐ বাড়ির দিকে পা বাড়াই। ভদ্রলোককে বাড়িতে পেয়ে যাই। কথা গল্পে সময় এগোতে থাকে। তিনি কতগুলো মার্বেল পাথর দেখান। যা দেখে খুব অবাক হই। সে মার্বেলগুলো সূর্যালোকের স্পর্শে তীব্রভাবে ঝলমল করে ওঠে। মার্বেলগুলোর মধ্যে একটি সরল আলোকরশ্মির সম্পর্ক ছিল। যা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। প্রতিটি মার্বেলের ভেতর গাণিতিক সংখ্যা ও চিহ্ন ছিল।

আলোকরশ্মিকে অনুসরণ করে পাথরগুলো এক সারিতে রাখতেই দেখি, একটি গাণিতিক সমীকরণ জাতীয় কিছু ফুটে ওঠেছে। তখন তিনি মার্বেলগুলো একটি প্যাকেটে ভরে আমার হাতে দেন। বলেন, এটা তিনি ব্রিফকেসে কাপড়ের সাথে রাখবেন। অন্যদিকে ভদ্রলোক শহরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সবকিছু গুছাচ্ছিলেন।

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তিনি কারোর সাথে কথা বলছেন। তখন তাঁকে খুব আবেগ আপ্লুত লাগছিল। আমি সেখানে কাউকেই দেখতে পেলাম না। তিনি ঐ অদৃশ্য অস্তিত্বকে একটি ডায়েরি দেখালেন। সম্ভবত বলেছিলেন, এখানেই আছে ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সমীকরণ সমূহ।

তিনি আমাকে কফি কিনে আনতে পাঠালেন, নিজে গেলেন চা বানাতে। কফি নিয়ে ফিরে আসার পর, তিনি আমাকে দোতলায় পাঠালেন চায়ের কাপ নিয়ে আসার জন্য। সেখানে গিয়ে দেখি বারান্দায় টেবিলের উপর ঐ ডায়েরিটি জ্বলছে, যা তিনি কিছুক্ষণ আগে কাউকে দেখিয়েছিলেন। ততক্ষণে ডায়েরিটি প্রায় পুড়ে গেল। দৌড়ে নিচে নেমে গেলাম। ভদ্রলোককে বলার পর, তিনি দ্রুত উপরে এলেন। তখন তাঁকে ভারি বিধ্বস্ত লাগছিল। পানি এগিয়ে দিতেই, আগুন নেভালেন। তারপর তিনি ঐ অদৃশ্য অস্তিত্বের সাথে দীর্ঘ সময় সংলাপ চালিয়ে গেলেন। একসময় তাঁকে প্রচ- রাগান্বিত হতে দেখলাম! কিছুক্ষণ পরেই তিনি অচেতন হয়ে পড়লেন। চেতনা ফেরার পর অনেকটা স্বাভাবিক হলেন। অন্যদিকে শহরে ফিরে যাবার প্রস্তুতিও শেষ করলেন। ভদ্রলোককে বিদায় দেবার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে ছিলাম। তিনি কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এক সময় সে ঘরে অদ্ভুত কা- শুরু হয়। মনে হচ্ছিল, প্রলয় শুরু হয়েছে। তৎক্ষণাৎ একটি আলমারি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। দেখতে পাচ্ছিলাম ভদ্রলোককে কেউ আক্রমণ করছে। তিনি হেলেদুলে পড়ে যাচ্ছেন প্রায়। সে মুহূর্তে তিনি কারোর প্রতি রাগান্বিত হয়ে ওঠেন। তখন আমি ভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসি। দেখি তাঁকে কেউ দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তিনি চিৎকার করে ওঠেন, দেয়ালে আঘাত পেয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়েন। তিনি আরেকবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আমি আবার এগিয়ে যাই। তাঁর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেবার পর, তিনি জেগে ওঠেন।
ভয়ার্তস্বরে বলেন, মাহিদ এখান থেকে চলে যাও।
একটুপর আলমারির বই পত্র, ডায়েরি, খাতা ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়তে থাকে। বইপত্রের স্তুপে হঠাৎ বাইরের সূর্যরশ্মি কু-লী আকারে আলো জড়ো হয়। যা আমি অবাক দৃষ্টিতে দেখেছিলাম। কয়েক মিনিট পরেই মেঝেতে আগুন ধরে যায়। ওখানে থাকতে খুব ভয় হচ্ছিল। আমি বাইরে এসে লোকজনকে আগুনের কথা বলি। তখন একজন ভদ্রলোককে দেখি, তিনি গাড়ি থেকে নেমে রিয়ন সাহেবের বাড়ির দোতলায় ওঠে যান।

মার্বেলের প্যাকেটটা আমার হাতেই থেকে যায়। সেগুলো দিয়ে কখনো কখনো আমি খেলতাম। বন্ধুরা আমার এই মার্বেলগুলো দেখে খুব হিংসে করত, তা ভাল বুঝতে পারতাম। রিয়ন সাহেবের বাড়ি থেকে আগুনের শিখা বনে ছড়িয়ে পড়ে। সে অগ্নিকা- ছিল ভারি ভয়াবহ! আমাদের বাড়িটি বনের পাশে থাকায়, আমরাও রক্ষা পাইনি। আমাদের বাড়ি ঘর ও গরুর গোহাল আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সেই সাথে সবচেয়ে বড় বেদনা ছিল, আমার বৃদ্ধা দাদিকে হারানো। তিনি অসুস্থ হয়ে ঘরে ছিলেন। যখন তাকে আগুনের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হলো, তখন তিনি মৃত। বাবা বললেন, এই ভিটায় আর থাকবেন না। আমরা পাড়ি জমালাম দেশের দক্ষিণ প্রান্তে।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর একদিন মার্বেলগুলো বের করলাম। ভাবলাম, ঐ গণিতটা খাতায় তুলে রাখব। যেই ভাবা সেই কাজ, সারিবদ্ধ মার্বেল পাথরগুলো যখন সূর্যালোকে রাখলাম তখন খেয়াল করলাম বৃত্তাকার মার্বেলের যে পাশে ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা আছে, এর বিপরীত পাশে আরেকটি গাণিতিক টার্ম রয়েছে। দুটোই খাতায় তুলে রাখলাম।
আমি এই সূত্র বা সমীকরণ দুটো নিয়ে বহুবার গবেষণার চেষ্টা চালিয়েছি, তেমন কিছু উদ্ধার করতে পারিনি। এখন তা ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছুঁড়ে দিলাম। সম্ভব হলে, তোমরা এ রহস্য উদ্ধার করো।”

ড. মাহিদের লেখার পরেই ঐ অভেদ ও সমীকরণের গাণিতিক রূপ উল্লেখ ছিল। প্রাচীন গ্রন্থের এই সমীকরণটি পৃথিবীর প্রধান প্রধান বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতে থাকে সমাধানের প্রচেষ্টা। বহুকাল কেটে যায়। সেই সাথে যোগ হয় নতুন চ্যালেঞ্জ, চতুর্মাত্রিক প্রাণীদের উৎপাত। দিন-রাত ব্যাপক গবেষণা ও পরিশ্রম চলতে থাকে। বাঘা বাঘা মহান বিজ্ঞানীদের মহাতপস্যায় এক সময় তা সাফল্যের মুখ দেখে। গড়ে ও ওঠে প্রতিরক্ষা বলয়। যে বলয় টপকে কোনো ভিন জগতের প্রাণীই পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারবে না। সেইদিন থেকে চিরতরে মুছে গেল অযুতদের ষড়যন্ত্র। স্বার্থক হলো, ক্রিটিনার আত্মত্যাগ ও পূরণ হলো দ্বিমাত্রিক জগতের শান্তি স্বপ্ন।

[সমাপ্ত]

ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : শেষ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : শেষ পর্ব


অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
২১.
দু’চোখে প্রবল অন্ধকার মেখে কতটা সময় কেটে গেছে তা সে খেয়াল করেনি। সে দেয়ালে তাকিয়ে দেখল ঘড়ির কাঁটা বারোটা পার হয়ে গেছে। তখন আবার সেই গোখড়া সাপের ফোঁস ফোঁস। সে সিদ্ধান্ত নিল, ফোনটাকে আছড়িয়ে ভেঙে ফেলবে। তাহলে হয়তো গোখড়া সাপটা মরে যাবে।
সে গোখড়া সাপের কাছে গিয়ে দেখল আসাদ স্যার ফোন করেছেন। কেমন একটা শান্তির ¯্রােত তার হৃদয়ের কিনার ঘেষে বয়ে গেল। একটু হলেও সহানুভূতি মিলবে নিশ্চয়। সে বলল, স্লামালিকুম স্যার।
অলাইকুমস্লাম।
স্যার, আপনি ফোন করবেন আমি তা ভাবতে পারিনি।
কেন ?
আপনি তো কখনো ফোন করেন না আমাকে।
ফোন করলাম তোমাকে একটা খবর দিতে।
কী খবর স্যার?
তোমাকে বলেছিলাম না আমি একটা উপন্যাস লিখবো, নাম হবে-স্মার্ট ফোন।
জি স্যার, বলেছিলেন।
এই মাত্র সেই উপন্যাসটার প্রথম লাইনটা লিখলাম-সে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। কেমন হয়েছে লাইনটা?
ভালো হয়েছে স্যার।
কিন্তু উপন্যাসটার নাম স্মার্টফোন রাখবো না-সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছি।
কী রাখবেন স্যার?
নাম হবে, অনিঃশেষ অন্ধকার। কেমন হয়েছে নামটা?
খুব সুন্দর হয়েছে স্যার। যুক্তিসঙ্গত একটা নাম।
তুমি কি আলবেয়ার কাম্যু’র নাম শুনেছো ?
জি না স্যার। কে তিনি?
তিনি একজন বিখ্যাত লেখক। তিনি লেখক ছিলেন না। লেখক হবার ইচ্ছাও ছিল না তাঁর মধ্যে। ঘটনাক্রমে লেখক হয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন আলজেরিয়ার্স ফুটবল টিমের গোলকিপার। একবার খেলতে গিয়ে তাঁর হাতের আঙুল ভেঙে যায়। তিনি খেলতে পারেন না কিছু দিন। এই অবসর সময়ে তিনি একটা উপন্যাস লেখেন, নাম-দ্য আউটসাইডার। এই উপন্যাসেই তিনি নবেল প্রাইজ জিতে নেন। উপন্যাসটা আমার খুব প্রিয়। তুমি কি গলস্ওয়ার্দির নাম শুনেছো?
জি না স্যার। তিনিও নিশ্চয় লেখক, নবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
তিনি ১৯৩২ সালে সাহিত্যে নবেল প্রাইজ পান ‘ফর সাইট সাগা’ লিখে। তিনি অক্সফোর্ডে আইন শাস্ত্র পড়েছিলেন। সামুদ্রিক আইন তাকে টানতো খুব। সামুদ্রিক আইনে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বের হন সমুদ্র পথে বিদেশ ভ্রমণে। জাহাজে দেখা হয় যোশেফ কনরাডের সাথে। আলাপচারিতা। তারপর বন্ধুত্ব। এরপর সামুদ্রিক আইন শুধু নয়, আইনের জগতেই তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাকি জীবন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সাহিত্য চর্চায়। তাই ঘটনাক্রমে..........।
স্যার, আপনিও ‘অনিঃশেষ অন্ধকার’ উপন্যাসটার জন্য সাহিত্যে নবেল পেয়ে যেতে পারেন।
না, তা পারি না।
কেন স্যার ?
কারণ, নবেল কমিটিতে সরাসরি বাঙলা ভাষায় লেখা কোনো গ্রন্থ জমা দেয়া যাবে না। সেখানে চারটি ভাষা চলে। ১. ইংরেজি। ২. সুইডিস, ৩. স্প্যানিস ৪. জার্মান।
স্যার, আপনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে..........।
সেটা সম্ভব নয়।
কেন স্যার? আপনি এত ভালো ইংরেজি জানেন।
সেটা তোমার কাছে। আমার ধারণা রবীন্দ্রনাথের মতো ইংরেজি জানলে মানিক, বিভূতীভূষণ, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক এবং বাংলা ভাষার আরও কেউ কেউ নবেল পেতেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক ইংরেজ পন্ডিতের চেয়েও বেশি ইংরেজি জানতেন। আর আমি তো পুরস্কারের জন্য এটা লিখছি না। আমি লিখছি এই জন্য যে, আমার উপন্যাসটা এ দেশের মানুষ পড়–ক।
এটা প্রকাশ হবার পর আমিও পড়বো স্যার।
শোন, যা হবার হয়েছে। তুমি আবার নতুন করে প্রস্তুতি নাও।
কিন্তু স্যার......।
কিন্তু কি আবার? মানুষ কি ফেল করে না? এই দেশে কি তুমি একাই ফেল করেছো?
স্যার কিন্তু.....।
কোনো কিন্তু নেই। ফেইলর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস। অন্ধকার না থাকলে আলোর কোনো দাম আছে? রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটে আসে। ফর এভরি ডার্ক নাইট, দেয়ার ইজ এ্যা ব্রাইটার ডে।
স্যার, কোনো কোনো অন্ধকার বোধহয় কিছুতেই সরানো যায় না। কোনো কোনো রাত যেন কিছুতেই ভোর হয় না।
কী বলছো তুমি! একটু খুলে বলবে কি হয়েছে?
খুলে বলার কোনো দরকার নেই স্যার। আমার বিশ্বাস, আপনি এই অন্ধকারকে ঠিকই অনুমান করতে পেরেছেন। তা না হলে আপনি উপন্যাসের নাম ‘স্মার্ট ফোন’ থেকে ‘অনিঃশেষ অন্ধকার’ রাখতেন না। ‘অনিঃশেষ অন্ধকার’ মানে, যে অন্ধকারের কোনো শেষ নেই, আমি তা বুঝতে পেরেছি স্যার।
পেটের মধ্যে আবার সেই নড়াচড়া। আবার সেই বমি বমি ভাব। আবার সেই মাথা ঘোরা। এ অবস্থায় আসাদ স্যার ফোন কেটে দিলেন। সে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিলো দূরে। আবার সেটা গোখড়া সাপ হয়ে গেল। আবার সেটার বেজে ওঠার শব্দ হয়ে যাবে গোখড়া সাপের ফোঁস ফোঁস। একমাত্র আসাদ স্যার ফোন করলেই সেটা সুললিত রিংটোন হয়ে যাবে, না হলে নয়।
সে ভালো করেই জানে, আসাদ স্যার আর তাকে ফোন করবেন না। কেন করবেন? এক ভালোবাসার নাম করে তাকেও তো কম অপমান করা হয়নি। তার ভেতর সেই কান্না ভেজা কন্ঠে কে যেন গেয়ে উঠল-এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে আমার পৃথিবী থেকে।
গানটা মা শোনেন মাঝে মাঝে। এতদিন গানটা তার বিন্দুমাত্র ভাল লাগেনি। কোনো অর্থ-টর্থও বুঝতে পারেনি। গানটা বাজলে সে প্রায়ই বিরক্ত হতো। কিন্তু এখন..............!

[সমাপ্ত]