পদাবলি
অভিসার একান্ত
মীম মিজান
আকাশের মেঘ হতে ঝরে পড়া বৃষ্টিকণা
পিষ্টটানের ফলে গোলাকার হয়ে আমার শুষ্ক অবয়বে পড়ছে।
মেঘমালা তাদের ভালোবাসা পাঠিয়েছে পিষ্টটানে গোলাকার স্বচ্ছ ফোটায়।
আমি সে ভালোবাসা অঙ্গে মেখে ঝুমঝুম আওয়াজে বুঁদ।
মাথা থেকে পুষ্টগাল বেয়ে বুককে ভিজিয়ে চুয়ে চুয়ে আমাকে শীতল করছে মেঘের ভালোবাসা।
পল্লব স্নানে যেমন চিকচিক করে
আমার থেকেও চিকচিক রশ্মি বেরিয়ে মেঘমালাকে জানাচ্ছে ভালোবাসার প্রাপ্তি স্বীকার।
স্নাত এ সন্ধ্যায় কদমগাছের কাছে একগোছা ফুলের আবেদন করলাম।
সে নিরাশ করেনি।
আমি প্রেয়সীর হাতে কদমফুল গোছা দিয়ে আবার নেমে পড়ি ভালোবাসা মাখতে গায়ে।
‘তুমি কি একাই ভিজে সিক্ত হবে কবি?
আমাকে কী করবে না সাথি?
আমিও চাই ভিজতে!’
আমি দৌড় দিয়ে সেই কদমতলায় আবার।
আমি যে অভিসারে মিলেছি মেঘমালা
সেখানে সে বসাতে চায় ভাগ।
আমি এই অভিসারকালে শুধুই তোমার।
তোমার পরশে আমি হিম-শীতল।
আমি তোমার প্রেমিক।
প্রেমিক হয়ে চাই অভিসার একান্তই।
নূরলদীন ও কিংবদন্তিরা ইতিহাস নয়
খান মুহাম্মদ মেহেদী হাসান
কোথায় মানবতাবাদী বিপ্লবী কবিরা?
বিপ্লবের যে সময় হয়েছে?
তোমাদের কলম আজ ঘুমিয়ে কেনো?
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাকে কবিতা বলেনা
দু’চারটা পদক পেলেই কবি হওয়া যায় না
নারীর আলতো স্পর্শই শুধু কবিতার সুর নয়
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাও কবিতা
কিশোর সুকান্তের দুরন্তপনাও কবিতার সুর।
প্রত্যেক কবি মানবতাবাদী ও ন্যায়ের প্রতীক
তবে কি ভুলে গেছো নিজেদের কবিতা?
৫২, ৭১ যাদের প্রেরণা
তারাও কি ভুলে গেছো তারুণ্যের কামনা?
তবে আজ রাজপথে তোমাদের আসন শূণ্য কেনো?
কেনো আজ বাকরুদ্ধ তুমি?
‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি'
কিংবদন্তিদের উত্তরসূরিরা আজ রাজপথে
‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়'
সেই নূরলদীনেরা আজ নিজেদের অধিকারের জন্য লড়ছে
রাজপথে এসে দেখো না নূরলদীনের কথা মনে পড়ে কিনা?
স্বার্থের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রেখে কবিত্বকে অপমান করো না।
কারণ নূরলদীন ও কিংবদন্তিরা ইতিহাস নয়
এরা অন্যায় কে রুখে দেয় যুগে যুগে !
স্বপথে অনড়
ইমরান লাবিদ
স্বপথে সুপথে চলেছি সতত
না, কোনো ঝঞ্ঝাট বিঘনতায় কিঞ্চিৎ নেই পরোয়া!
তিরষ্কার তিক্তাচার আসতেই পারে কত লোকের থেকে!
শব্দহীন সবকিছু মাথা পেতে নিয়ে
থাকব তবু― ন্যায়, নিষ্ঠা, সত্য ও সততার পরে সতত!
কটু বাক্যের স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করুক আমার কানের কাছেই
ধরে নেব, ‘আরে বলছে কাকে! কে জানে?
আমি তো সুপথে আছি, আমাকে বলছে না।’
নির্বোধ, মূর্খ আর ইতর লোকের তিরষ্কারে
প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন না করাই উচিৎ শিক্ষা,
নিরুত্তর পাশ কেটে যাওয়াই লা-জবাবকর জবাব!
আধ্যাত্মিক
আধ্যাত্মিক
ফারুক হোসেন সজীব
আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে কেউ বিশ্বাস করেন?
করলে ভাল না করলে নাই! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর! বিশ্বাস না করলে খোদাও মিলবে না এমনই কথা বলে গেছেন কত যে মনীষী তার ইয়েত্তা নেই। মওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর বক্তব্য এখানে তুলে ধরা যেতে পারে তিনি বলেছেন, ‘বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়। বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চিনা, বুঝা, ও পাওয়া যায় না। বরং এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি! তিনি আরও বলেছেন, সৃষ্টি দিয়ে কখনও অসৃষ্টিকে বোঝা যায় না! আমরা মানুষ হলাম সৃষ্ট বস্তু কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ অসৃষ্ট সুতরাং আমরা অসৃষ্টকে কোনদিন বুঝতে পারব না। তাই আল্লাহকে চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন।’
আধ্যাত্মিক বিষয়ে বিশ্বাস করা আসলে কঠিন যতক্ষণ না তা নিজ চোক্ষে দেখা যায়। তাই নিজের চোখকে কীভাবে অবিশ্বাস করব যখন পুরো ঘটনাটাই ঘটেছে আমার চোক্ষের সামনেই!
তাহলে খুলেই বলি- আমার বয়স তখন ষোল কিংবা সতের। ভাল-মন্দ বোঝার অন্তত কিছু জ্ঞান আমার হয়েছে আর কী! তখন গরম কাল ছিল মনে আছে আমি আর আমার দাদিজান অনেক রাত অবধি উঠানে শুয়ে শুয়ে গল্প করতাম। দাদিজানকে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি হাতে তস্বি জপতে। খুব কম কথা বলতেন। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে অন্য গ্রাম থেকে ছুঁটে আসতেন দাদিজানের কাছে কীসব পানি পরা, তাবিজ সুঁতো নিতে। এগুলো দেখে দেখে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবতাম, এ আবার এমন কী! কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিষয়টি আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হতে লাগল। দাদিজানকে মনে হতে লাগল উন্মাদ একটি মানুষ। আমি কোন কিছু দেখে ভয় পেলে কিংবা পরীক্ষা দিতে যেতে নারভার্স ফিল করলে, তিনি আমার বুকে কী সব বলে বলে ঝাড় ফুঁক দিতেন। ঝাড় ফুঁক দেওয়া শেষ হলে বলে দিতেন, এখন তবে যা শরীর বন্ধ করে দিলাম! শরীর বন্ধ মানে কোন খারাপ আত্মা জ¦ীন, ভূত এমনকী খারাপ মানুষের কুনজর থেকে আমি মুক্ত! শুনে বেশ হাসি পেয়ে যেত আমার। তবু দাদিজানকে এ বিষয়ে কিছু বলতাম না! কী দরকার বুড়ো একটা মানুষকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার। তিনি তো আর কারও কোন ক্ষতি করছেন না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনতাম দাদিজানের পানি পড়া খেয়ে অনেক মানুষ নাকি সুস্থ হয়ে যেতেন। শুনে আমি নীরব থাকতাম। আসলে মানুষের বিশ্বাসে হাতুড়ি পেটানো উচিত না। আমার স্কুল, বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে হওয়ায় খুব ভোরেই আমি টিফিন ক্যারিয়ার আর কাঁধে বইয়ের জীর্ণ ব্যাগটি ঝুলিয়ে বেরিয়ে যেতাম। তারপর আসতাম সেই সন্ধ্যা নাগাদ। আসা-যাওয়ার পথে তেমন কোন বাড়ি ঘর ছিল না। বলতে গেলে একটা মস্ত বিল পার হয়ে যেতে হত আর আসতে হত। বিল পার হওয়া কোন সমস্যা ছিল না, সমসা ছিল বিলের মাঝখানে একটি প্রকান্ড বটগাছটিকে নিয়ে। বুড়ো বটগাছটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। গাছটির চারিদিকে অসংখ্য বটের ঝুরি। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে পথে মানুষ বেশ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে গামছা বিছিয়ে বেশ আয়েশ করে জিরিয়ে নিত গাছটির ছায়ায়। আমি মাঝে মাঝে বটের ঝুরি ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো ঝুল খেলতাম। কিন্তু সন্ধ্যার সময় যখন বটগাছটির পাশ দিয়ে বাড়ি আসতাম বুকটা ঢিবঢিব করত। মনে হত এই বুঝি পিছন থেকে কেউ ডাক দিবে আমাকে, না হলে ঘাড় মটকাবে!
বটগাছটিকে নিয়ে অনেক কুৎসা রটনো ছিল। তবে এটা নাকী সত্যি গ্রামের ‘লবা’ ডাকাত অনেক মানুষ খুন করে গাছটির গোড়ায় পুঁতে রাখত। কেউ কেউ অমাবস্যা রাতে বট গাছটির উপরে আলোও দেখেছে। তবে এটা অবশ্য ঠিক গাছটির গোড়ায় অনেক পশুপাখির হাড়গোড় পড়ে থাকত সব সময়। একদিন আমি ভয়ে ভয়ে দাদিজানকে বললাম, দাদিজান আমার ভীষণ ভয় করে ঐ বটগাছটির কাছ দিয়ে যেতে। শুনে তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন আর তস্বি জপতে লাগলেন। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকাতেন। সেই বড় চোখ দেখে আমি ভয় পেতাম। দাদিজান বলতেন, হ্যাঁ ভয় আছে গাছটিতে! অনেক অভিশাপ বহন করে চলেছে গাছটি! অনেক মরা মানুষের সাক্ষী হয়ে নীরব দাঁড়িয়ে আছে! একদিন সে সব বলে দিবে! এসব শুনে আমার আরও ভয় ভয় করত, শরীরে কাটা দিয়ে উঠত। দাদিজান আমাকে বলতেন, তবে তোর কোন ক্ষতি হবে না! ওরা চেনে যে, তুই আমার নাতী!
ওরা কারা দাদিজান? আমি জিজ্ঞেস করতাম।
দাদিজান পান চিবাতে চিবাতে বলতেন, ওরা জিন-ভূত! অতৃপ্ত আতœা!
শুনে আমার আরও ভয় করত।
রাত বেশি হয়ে গেলে দাদিজান বলতেন, ঠিক আছে এখন ঘরে গিয়ে ঘুমা। আমরা সাধারণত উঠানে পাটি বিছিয়ে গল্প গুজব করতাম।
দাদিজানের মুখে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনে কেন যেন আমার ঘুম আসত না। আর রাতে হিসু করতে কিংবা ইয়ে করতেও ভীষণ ভয় করত, কারণ আমাদের বাসায় কোন এট্যাস্ট টয়লেট এসব ছিল না! অবশ্য এসের কথা গ্রামের কেউ চিন্তাও করত না। আমাদের পায়খান, প্রশাবে ব্যবস্থা ছিল বাইরের তেতুল গাছটির নিচে! চারিদিক টিন দিয়ে ঘেরা আধা-পাকা বলা যায়! রাতে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিলেই আম্মুকে ডাকতাম। আম্মু বলতেন যা আমি দাঁড়িয়েই আছি! আসলে কিন্তু আম্মু দাঁড়িয়ে নেই! তিনি শুয়েই থাকতেন! এভাবে বলে তিনি আমাকে সাহস দিতেন।
দেখতে দেখতে আমার এসএসসি পরীক্ষা চলে এল। পড়াশুনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগলাম। গ্রামে আমিই একমাত্র তখন এসএসসি দিচ্ছি। সবার কুদৃষ্টি- সুদৃষ্টি দুটোই আমার ওপরে আছে।
একদিন পড়তে পড়তে বেশ রাত হয়ে গেছে। আসলে আমি স্কুল থেকে ফিরেই খাবার খেয়ে পড়তে বসতাম। রাত নয়’টা পর্যন্ত পড়তাম। গ্রামে রাত নয়’টা মানে কিন্তু অনেক রাত। পরিশ্রমী মানুষগুলো ঘুমের গভীরে তলিয়ে থাকে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। দরজা খুলে বাইরে চলে এলাম। সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল দেখলাম, দাদিজান একা একা উঠানে তখনও বসে আছেন। আমি আস্তে আস্তে দাদিজানের কাছে গিয়ে জিঙ্গেস করলাম, দাদিজান কি করো?
দাদিজান বোধহয় বসে থেকেই ঘুমিয়েই পড়েছিলেন তবু বললেন, নাহ! জেগেই আছি! আয় বোস! তোর পড়া শেষ?
আমি বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, সামানে এসএসসি পরীক্ষা ভাল রেজাল্ট করতে হবে। এটা ভাবলেই দুচোখের পাতা এক হয় না দাদিজান!
খুব চিন্তায় আছি! (আমার দাদিজান লিখতে পড়তে জানতেন। তিনি তাদের সময়ে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলেন) দাদিজান আমাকে আশ্বস্ত করতে বলতেন, চিন্তা করে কাজ নাই, তুই ঠিক ভাল পাশ দিবি!
মনে মনে বলতাম, দিন বদলাচ্ছে দাদিজান ভাল রেজাল্ট না করতে পারলে কোথায় ভর্তি-চান্স পাওয়া যায় না। কম্পিটিশান! দারুণ কম্পিটিশান!
পূর্ণিমা রাত। চারিদিক দিনের আলোর মতো ফর্সা। বাড়ির চারিদিকে যদিও ঝোপঝাড় তবু সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমাদের উঠানের সামনে তিনটি সুপারি গাছ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সুপারি ঝুঁলছিল। সুপারিগুলো পেকে একদম ঝুনাপাকার মতো লাল হয়ে আছে। দাদিজান পান খেতেন। মাঝে মাঝে দেখতাম তিনি সুপারিগুলো যাঁতি (সুপারি কাটার যন্ত্র) দিয়ে কাটছেন।
দাদিজান সুপারিগাছগুলোর দিকে মুখ করে বললেন, আজ পূর্ণিমা রাত!
আমি বললাম, হু জানি!
আজ তোকে আমার কেরামতি দেখাব! কী দেখবি?
কেরামতি! মানে?
আমার ক্ষমতা! কী দেখবি?
আমি নড়েচড়ে বসলাম অবাক হয়ে দাদিজানের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার মাথা ঠিক আছে?
দাদিজান হাসতে হাসতে বললেন, তুই তো আমার ক্ষমতাকে বিশ্বাস করিস না! তাই আজ তোকে আমার ক্ষমতার একটি নজির দেখাব!
শুনে আমি হ্যাঁ না কিছুই বলছি না!
দাদিজান বললেন, এই যে সুপারিগাছগুলো দেখছিস, আমি আজ আমার ক্ষমত বলে সুপারি গাছগুলো থেকে সুপারির কাঁদি এক ঝাপটায় তোর সামনে এনে ফেলব!
দেখবি নাকী আমার ক্ষমতা?
আমি জোর সাহসে বললাম, দেখব! হঠাৎ অনুভব করলাম আমার বুকের ভিতরে ঢিবঢিব করছে। হয়ত অজানা কোন আশঙ্কা আমাকে ভর করছে! তবে টের পাচ্ছি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে!
দাদিজান আমাকে বললেন, সুপারিগাছগুলোর দিকে চেয়ে থাক!
আমি চেয়ে আছি সুপারিগাছগুলোর দিকে! মাঝে মাঝে দাদিজানের দিকেও তাকাচ্ছি!
দেখলাম, দাদিজান তস্বি হাতে উঁচু করে বৃত্তের মতো কী যেন করছে! হয়ত শূন্যে বৃত্ত-ই আঁকছেন তিনি!
হঠাৎ কীভাবে কোত্থেকে সুপারিগাছ তিনটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল! যেন সূর্যের আলো-রশ্মি উপচে পড়ল গাছগুলোর মাথায়! তাপরপর এক ঝাঁপটায় একটি সুপারির কাঁদি এসে পড়ল আমার ঠিক সামনেই! ভয়ে আমি লাফ দিলাম! দাদিজান আমাকে বললেন, ভয় পাস না! ওরা তোর কোন ক্ষতি করবে না!
আমি পুরো হতভম্ব হয়ে গেছি দেখে! দাদিজান আমাকে বললেন, যা ঘর থেকে একটি ডালা (বেত দিয়ে তৈরি জিনিস) নিয়ে আয়! সুপারিগুলো তুলতে হবে!
আমি আচমকা ভয় পেয়ে একবার সুপারিগাছগুলোর দিকে আর একবার দাদিজানের দিকে তাকাচ্ছি। দাদিজান সুপারি গাছের দিকে তাকিয়ে আবারও বৃত্ত আঁকলেন। আমি দেখলাম, আস্তে আস্তে আলো রশ্মি নিভে যাচ্ছে! হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে গেল!
দাদিজান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলি তো! এবার বিশ্বাস হয়েছে?
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না! আসলে আমার ঘোর তখনও কাটেনি!
দাদিজান সুপারি কুড়াতে লাগলেন। আমাকে আবারও বললেন, যা ডালা নিয়ে আয়! আমি এক ছুঁট ঘরে চলে গেলাম। জানালা খুলে উঁকি দিয়ে দাদিজানকে দেখতে লাগলাম!
দাদিজান তখনও সুপারি কুড়াচ্ছেন উঁবু হয়ে, যেন সাদা শাড়ি পরা অপিরিচিত কেউ একজন! আমি হ্যাঁপাতে হ্যাঁপাতে আম্মুর রুমে গিয়ে সব খুলে বললাম। শুনে আম্মু বাহিরে চলে এলেন। দাদিজানের দিকে তেড়ে এসে বললেন, নাতীকে ভয় দেখিয়েছেন কেন? ওর যদি কোন ক্ষতি হয়?
দাদিজান আমায় কাছে ডাকলেন, আমি ওনার কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছিলাম! তিনিই আমার কাছে এসে আমার বুকে ফুঁ দিলেন! বললেন, এখন ভয় গেছে? আমি অনুভব করলাম, সত্যি আমার আর কোন ভয় লাগছে না! হঠাৎ কী হল আমার! সত্যি কোন ভয় লাগছে না! মনে হচ্ছে সুপারিগাছে এক পৃথিবী আলো এসে পড়ল, তাতে আমার কী! এ আর এমন কী ক্ষমতা! তারপর থেকে আজ অবধি আমার কোন ভয় নেই। বলতে গেলে দারুণ সাহস হয়েছে আমার!
আজ কত বছর পার হয়ে গেছে। আমার দাদিজান এখন আর পৃথিবীতে নেই! আমাদের বাসার পাশেই কবরস্থান। সেই কবরস্থানেই আমার দাদিজান ঘুমিয়ে আছেন! জন্মের পর থেকে দেখে এসেছি তিনি কোন দিন কারও কোন ক্ষতি করেননি! বরং মানুষের উপকার করেছেন।
আহা! বড় ভাল মানুষ ছিলেন আমার দাদিজান! মাঝে মাঝে আমি নিশিরাতে কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকি, কারণ অনেক বছর তো হয়ে গেল আমার দাদিজান মারা গেছেন! তিনি কেমন আছেন? বড্ড জানতে ইচ্ছে করে!
আহা! আমার বাল্যকালের খেলার সাথি ছিলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তার কাছে দুহাত তুলে এখনও মাঝ রাতে তার জন্য দোয়া করি! আর মনে মনে বলি-তোমার অনেক ক্ষমতা ছিল দাদিজান! আজ আমি সত্যি-ই বিশ্বাস করি তোমার অনেক ক্ষমতা ছিল! সেই ক্ষমতা বড়ই অলৌকিক! সেই ক্ষমতা আধ্যাত্বিক !
ভাবগাম্ভীর্যে নির্ভেজাল প্রাকৃতিক কবিতার কবি : ব্যঞ্জন মৃ
ভাবগাম্ভীর্যে নির্ভেজাল প্রাকৃতিক কবিতার কবি
ব্যঞ্জন মৃ
মাহমুদ নোমান
মায়ের গর্ভে প্রত্যেকটা সন্তানের একেকটা পৃথিবী। সেখানে আনমনে শুনতে উদগ্রীব থাকে মায়ের মুখের কথাগুলো। কী এক ভাবুক,উন্নতর রুচিসম্পন্ন শ্রোতা জ্ঞানভারে গাল ফুলা রেখে, যেন মায়ের গর্ভে সবাই কবি...
সত্যিই, কবি। সবাই কিছু বলতে চাই। কল্পনাশ্রয়ী হয়ে বুনতে চাই মনের কথামালা। সেখান থেকে যাঁরা নিজেদের সময়- শ্রম ব্যয় করে কথামালা সাজানোর চেষ্টায় একেকজন আলাদা হয়ে যায় একেকজন থেকে ভাবে আর বোধে...
সত্য কথা এই, আমরা কেউ নিজের আসা মায়ের পথকে দেখি না বা প্রমাণ করার জন্য পথটা কাউকে দেখিয়ে দিতেও পারবো না। কবিতার উৎপত্তিও তো তেমন। প্রথম লাইনগুলো কোত্থেকে আসবে, শুধু অনুভব করবে, মনে ধাক্কা দেবে। সেটা সাজিয়ে বোধের দরজা খোলে একাগ্রতায় লেখা হয় একেকটি কবিতা; তাই, জন্মদাত্রী মাকে অস্বীকার করে কবি হয়ে ওঠা অসম্ভবরকম বাড়াবাড়ি। বরঞ্চ কেউ ভাবতে চাইলেও বিরক্তিকর। কেননা আজকাল অনেকে কবিতাকে ইট-পাথরে বন্দি করে কি যে নির্যাতন করে নিষ্পাপ শব্দরাজিকে। ভাবতেও বমি আসে...
সেই জায়গা থেকে কবি ব্যঞ্জন মৃ আমার কাছে শ্রদ্ধার আসনে। সে এক মায়ের ছেলে। সত্যিকারের এক মায়ের ছেলে। নিজের মায়ের ‘আচিক’ ভাষাকে বুকে লালন করেছে গর্বভরে। এটা আমার কাছে অজানা থেকে যেত। সেজন্য অকৃত্রিম বন্ধু চুনিয়ার পূর্ণিমার কাছে আমি ঋণী। নতুন একটা ভাবের পৃথিবীর দ্বার খুলে দিয়েছে আমার কাছে...
চুনিয়ায় না গিয়ে ব্যঞ্জন মৃ এর কবিতা যতোই পড়তাম, বোধে সুঁড়সুঁড়িও দিতে পারতো না হলফ করে বলতে পারি। কেননা আমি ‘আচিক’ ভাষাটা কী, সেটাও জানি না। পূর্ণিমা যখন চুনিয়ার শালবনে, আনারসের বাগানে নিয়ে যায় মাটি ঘেমে যাওয়ার গন্ধে, এরপরে ব্যঞ্জনের কবিতাগুলো মনে এসে আলাদা পরিবেশ তৈরি করে দিল। এটাও সম্ভব হয়েছে মান্দিদের উলে¬খযোগ্য কবি পরাগ রিছিলের অনবদ্য বাংলা অনুবাদের কল্যাণে। বলাবাহুল্য যে, পরাগ রিছিল মান্দি হলেও আচিক ভাষার পাশাপাশি বাংলায় পারদর্শিতার স্বাক্ষর ইতোমধ্যে রেখেছে। কেননা পরাগ রিছিলের কবিতা চর্চা মূলত বাংলা ভাষায়। এবং স্মরণ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে রাজীব নূরের ভূমিকা লিখে দেওয়াটা, এই বইয়ের জন্য অমূল্য ও অভূতপূর্ব সংযোজন। এসব মিলেই ব্যঞ্জন মৃ এর কবিতার বই ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ ।
সত্যিকার অর্থে, ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ বইটি সর্বাত্মক আন্তরিকতার ফসল। পরাগ রিছিলের ভালোবাসাময় অনুবাদে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ থেকে সবজায়গায় ভালোবাসার ছড়াছড়ি, এক সুতোয় গাঁথা মালা...
ব্যঞ্জনও বইটার শুরুতে ভালোবাসার আহ্বানে লিখেছে ‘চলো’ কবিতাটি-
....হ্যা চলো,
কাছাকাছি-ই পৌঁছে গেছি
বসলে এখন হবে দুর্বল অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ,
অন্ধকারেই উঠেছে ফুটে মিল¬াম স্ফি’র স্ফুলিঙ্গ।
[চলো (রি'রিমারি) ৯ প]
আমি যখন প্রথম চুনিয়ায় যাই, মান্দিদের আতিথেয়তা আমার অতীত অতিবাহিত জীবনধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। সত্যিকারের মানুষ যে এখনো এই বাংলাদেশেই আছে, সেটাই দেখেছি চুনিয়ায় গিয়ে। তাই কেউ সেখানে গেলে একা যেতে দেবে না। আপনাকে ছোটশিশুর মতো হাত ধরাধরি করে হাঁটা শেখাবে। সত্যিই তো, নতুন পৃথিবীতে চলতে শেখাল, সেটাই ব্যঞ্জনের উপরোক্ত কবিতায় আন্তরিকতায় বলে গেল। মনে পড়ে গেল, আমার মতো সেই মুগ্ধতায় এই চুনিয়ায় এসে কবি রফিক আজাদ লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা- ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’...
মাতৃসূত্রীয় মান্দি জীবনের জীবনধারার সামান্য কিছু আমার নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। মান্দিদের নারীরা যখন আনারস বাগানে বা রোদেগরমে পুড়ে মাঠে, উঠোনে এমনকি ঘরের কাজকর্ম সামাল দিতে দেখেছি; তখন পুরুষদের দোকানে বসে ঝিমিয়ে থেকে আড্ডা দিতে দেখেছি স্বয়ং নিজের চোখে! এখানে ব্যঞ্জন মৃ নিজ মায়ের বন্দনা তদুপরি মান্দিদের নারীজীবনের এসব দিক প্রায় সব কবিতায় অকপটে তুলে ধরেছে। আমারও হাজার সালাম জানাই, মান্দিদের এসব নারীদের...নিজের মা বিজন্তা মৃ’কে নিয়ে অনবদ্য ও অন্যমাত্রার আর ভাববিন্যাসের অপূর্ব গাঁথুনিতে লিখলেন-
বি- হলো আত্মা
জ- চোখের জল মুছিয়ে দেয় নিজ হাতে
ন্ - প্রতিদিন সেবা করো
তী- তাঁর সম্মান খুব উঁচুতে
সা- জ্বলজ্বলে রাখে জোনাকির মতো নিখিলের শ্রী
ং- চারদিকে বওয়ায় মাহারির সুনাম
মা- আমি আদরের সন্তান, ব্যঞ্জন মৃ ।
-আমার মা বিজন্তী সাংমা মৃ [(আংনি আমা বিজন্তী সাংমা মৃ) ২৭ পৃ]
কিন্তু এই আদিবাসী যখন নিজ বাসভূমে নিপীড়িত, এমনকি নিজেদের সারল্যতার সুযোগে ভূমিদস্যুরা খেতের মাঠ- জমি বেহাত করেছে। ব্যঞ্জনের কবিতায় তখন আদিবাসী বীরদের কথা, নিজেদের বাসভূমের জন্য জীবন দেওয়া শহীদদের কথা দৃপ্তকণ্ঠে ধ্বনিত; ব্যঞ্জনের মনে কষ্টের আবাদ হয়েছে। কেননা একজন কবির আলাদা চোখ থাকে, আলাদা মন থাকে। সেখান থেকে সমাজের, পরিবেশে আগত সমস্যা সবার আগে চোখে ও মনে ধরা পড়ে। তাই ব্যঞ্জন মৃ লিখলেন-
ধান শুকিয়ে ময়ূর
কান পেতে শুনছে
সেটি দেখে গাছ যেন
ধীর পায়ে এগোচ্ছে!
[শিরোনামহীন (বিমুং গ্রি) ১৩ পৃ]
কী মারাত্মক ভাবগভীর উপরোক্ত লাইনগুলো। উপমা- উৎপ্রেক্ষা- প্রতীকে ব্যঞ্জন মৃ একেবারে প্রাকৃতিক। প্রকৃতির বিশুদ্ধ নির্যাসে উদ্ভূত ভাব। নির্ভেজাল আকুতিগুলো, চিত্রকল্পগুলো কাব্যরসিকদের অন্য জগতে মাতিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে-
মামাদের পুকুরে
শাপলা ফুটেছে,
সেটি তুলতে গিয়ে
পেটে জল ঢুকেছে
[মামার পানসুপুরি (মামানি পানগুয়া) ১৭পৃ]
ছন্দোবদ্ধ অন্তমিলে সহজাত বিষয়কে অসাধারণ বলনে এটি একেবারে চালাকি নয়। কেবল পরিবেশ- প্রতিবেশ ব্যঞ্জনের বলার রিদমে ও ভাবে মাটিমাখা; ব্যঞ্জনের কবিতা পড়তে পড়তে পাঠকরা ব্যঞ্জনের সাথে পুরনো আত্মীয়তার টান অনুভব করবে। ভালোবাসার কথা লিখতে পাঠকের সাথে খুনসুটি করে হাসায়েও দেয় মুহূর্তে-
ক.
কান- চুল কেমন এলোমেলো
মোছ ওঠেনি ঠিকমতো,
হৃদয় শুধু আছে বলে
হৃদয়ে হৃদয়ে কথা হলো -
[স্বামী (আংশি) ২১ পৃ]
খ.
সাহস নেই ভোলাব তোমায় নানা ঢঙে...
প্রিয়তমা তোমার জন্য সত্যি হৃদয় ভাঙে
কুষ্ঠের দাগ কী ফর্সা শরীরের সাথে তুল্য
হৃদয়ের ঔজ্জ্বল্যই সত্যিকারের ঔজ্জ্বল্য...
[বিশ্বাস-অবিশ্বাস (বিবি রা’মা রা’জা) ১৯ পৃ]
গ.
কি সুন্দর পেখম মেলো
বর্ণিল গোল গোল!
দু’মি গুঁজতে গুঁজতে দেখি
তোমারি ভূগোল
[দু’মি গুঁজতে গুঁজতে (দু’মি খা’রারাম) ৪৩ পৃ]
ব্যঞ্জন মূলত ভাবগাম্ভীর্যে কবিতার সাধক। রক্তে বয়ে চলা মায়ের ‘আচিক’ ভাষার অক্ষরগুলো প্রতিনিয়ত নতুন কবিতা লেখার ধ্যাণে ধাবিত করে। পরাগ রিছিলের মহৎ অনুবাদে মধুপুরের চুনিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মান্দিদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বাংলাভাষায় নানান রসদের যোগান দিয়েছে ব্যঞ্জন মৃ এর ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ কবিতার বইটি। ব্যঞ্জন মৃ কেবল আকুতি জানিয়ে রেখেছে বাংলাভাষীদের কাছে, এমনকি পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে, নিজের বাসভূমে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা। মান্দি জাতির আচিক ভাষায় সেই আকুতি বাংলাদেশীদের কাছে সম্মানীয় আসনে নেবে নিঃসন্দেহে ‘ময়ূরব্যঞ্জনা’ বইটির মাধ্যমে...
ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৬
(গত সংখ্যার পর)
জাকির সাহেব তার জরিপের কাজ তখনও শেষ করতে পারেনি।
সুমি বলল, ‘কী নির্জন গ্রাম। প্রকৃতি এখানে ক্যামন নিস্তরঙ্গ। আর প্রকৃতির সন্তানরা। আহ।’
নাজনীন বলল, ‘আমার গ্রামের মতো!’
উর্মিলা বলে, ‘দিদি, আমি তো এ জীবন দেখিনি।’
আর এ সময় মঞ্জু রহমান দৌড়ে এলেন।
‘বস সবাইকে গাড়িতে উঠতে বলেছে।’
ক্লান্ত, বিষণœ, তিক্ত মন নিয়ে উর্মিলা যখন নাখালপাড়ার বাসায় ফিরে এল তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে।
রুবীর প্রশ্ন করার আগেই উর্মিলা বলল, ‘রুবী, জীবন এতো গ্লানিকর, জানা ছিল না।’
০৬.
অফিসে যাবার আগে বাবার দেয়া পোস্টকার্ডে চোখ বুলিয়ে নেয় উর্মিলা। বাবার জন্য মমতায় বুক টন টন করতে থাকে। বাবা লিখেছে,
‘কল্যাণীয়া উর্মিমালা,
তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি চলিয়া যাবার পর থেকে মনে হইতেছে, সংসারে আমার প্রয়োজন শেষ। তোমা বিহীন এ জীবনের অর্থ খুঁজিয়া পাইতেছি না। তারপরও আশায় আশায় রহিয়াছি। জগতে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি জগতের কল্যাণের জন্য তিনি যেন তোমাকে নিয়োগ করেন। জীবের মঙ্গলের জন্য যে কোনো কর্ম বিধাতা খুশি হোন। তুমি জন্মের পর মাতৃহীন। বেবী জননী, তোমার মাতৃরূপিনী। আমার প্রণাম তাঁকে পৌঁছাইয়া দিও। ভালো থাকিও। মনে রাখিও, জগৎ বড়োই বিচিত্র জায়গা। ইতি তোমার কাঙাল বাবা।’
উমিলার চোখে জল চলে এল।
অনেকক্ষণ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে উদাস মনে হয়। বুক ভরে কান্না আসে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেল লাইনের সমান্তরাল পথরেখা নজরে আসে। যতদূর চোখ যায় পাশাপাশি একা।
রুবী উর্মিলাকে নিয়ে অফিসে ঢোকে।
ঢুকেই দেখতে পায় রুবীর টেবিলের পাশে আরেকটি চেয়ার টেবিল।
ঢুকতেই পিয়ন বলে, ‘নতুন ম্যাডামের জন্য।’
উর্মিলা শুধু একবার রুবীর দিকে তাকায়।
দু’জনের চোখে বিস্ময়।
উর্মিলা নতুন চেয়ারে বসতেই বাবার মুখ মনে পড়ে। মাথার ভেতর জলতরঙ্গের শব্দ শুনতে পায়। অনেক শব্দ-সুর অচেনা। চোখ ছাপিয়ে জল আসে। মৌনতা নিয়ে মাথায় হাত রেখে বসে থাকে কতক্ষণ।
রুবী বলে, ‘তোর জন্য সবকিছুই সহজ।’
‘না রুবী। বাবাকে মনে পড়ছে। আমাকে নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই।’ বিষণœ কণ্ঠস্বর উর্মিলার।
‘আমারো মনে পড়ে। বীথির কথা। পিঠাপিঠি জন্ম আমাদের। ওর খুব নায়িকা হবার স্বপ্ন।’ রুবীর কণ্ঠ উদাস। এ সময় উর্মিলার খুব হাসি পায়। রুবীর বলার ভঙ্গি যেন নায়িকা হবার জন্য এ মানব জন্ম।
‘রুবী তুমি খুব সরল! আমার মতো।’
‘উর্মি তুমি আমার মতোন না। অন্যরকম।’ ওরা স্মিত হাসে।
সাড়ে নয়টার দিকে দীপু ভাই ঢোকে। ক্ষীণলয়ে হাসি দিয়ে উর্মিলা টেবিলের সামনে বসে, ‘দেবীর নতুন চেয়ারে বসতে না জানি ক্যামন আনন্দ। জীবনের প্রথম চেয়ার তো!’
উর্মিলা দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘সংবাদ ভালো দেবী। এক দিনেই মাত! নাজনীন, সুমি তো রীতিমতো ফ্যান। মন্ত্র জানেন নাকি?’ দীপু ভাই বলে যাচ্ছে।
উর্মিলার এই প্রথম মনে হলো দীপু ভাই সাধারণ পুরুষ না। সবকিছু আলাদা। চাউনি ভিন্ন, কথা বলা স্যাটায়ার সমৃদ্ধ, যা কাউকে আঘাত করে না। আন্তরিক।
আর উর্মিলার প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত।
‘বসুন দেবী। ওই চেয়ার আপনার জন্য।’
দীপু ভাই তার রুমে ঢুকে যায়।
উর্মিলা দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুবী গদগদ কণ্ঠে বলে, ‘দেবীর সকল দরজা খোলা। দীপু ভাই তোর প্রতি বেশি হ্যাংলামো করে।’
উর্মিলা কথা বলে না। ও বুঝে গেছে রুবী রোমান্টিক। সাড়ে দশটার পর হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকলেন বেবী আপা আর জাকির সাহেব।
উর্মিলার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তার রুমে ঢুকে যায়। জাকির সাহেব, দীপু ভাই, নাজনীন, সুমি, মঞ্জু সাহেবকে নিয়ে একটানা মিটিং করে দুটো পর্যন্ত। সারা অফিস থমথমে হাওয়া বইতে থাকে। বেবী আপাকে এরকম উদ্বিগ্ন দেখেনি কেউ। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও শান্ত থাকার দৃঢ়তা তার রয়েছে।
সারাদিন উর্মিলার কী কাজ? শুধু পিয়ন কিছু কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যায়। প্রায়গুলো এক লহমায় মধ্যে পড়ে ফেলে। অনেকগুলো স্পষ্ট নয়। তবে বেবী আপার স্বপ্নের পৃথিবী নির্মাণের গল্প আছে। অসম্ভব স্বপ্নতাড়িত বোধ চোখের কর্নিয়ায় ছায়া ফেলে।
বেবী আপা রুম থেকে বের হয় সাড়ে তিনটের দিকে। দীপু ভাইয়ের রুমের দিকে যায়। বের হয় মিনিট পাঁচেক পর।
উর্মিলার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর পা থর থর করে কাঁপছে।
‘তোমার বাবার চিঠি পেয়েছ। ক্যামন আছেন উনি?’
উর্মিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘পেয়েছি। বাবা আপনাকে প্রণাম জানিয়েছে।’
‘ঋষি মানুষ। লিখে দাও। আমিও তার কন্যার মতো। সব ঠিকঠাক হলে ঢাকায় ঘুরে যেতে।’
‘জ্বি আপা।’
বেবী আপা দরজা ঠেলে লিফটের দিকে হেঁটে যায়। উর্মিলা কোনোকিছু না বুঝেই লিফট পর্যন্ত হেঁটে যায়।
লিফট থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রুবী এ কথা সে কথা শোনাতে চায়।
উর্মিলা বলে, ‘রুবী, কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না। বুকের ভেতর শূন্যতা বিরাজ করছে। আমি বোধহয় বেশিদিন বাঁচব না।’
রুবী হাসে।
এ সময় দীপু ভাই উর্মিলাকে ডেকে পাঠায়। নিজেকে আতঙ্কিত মনে হয়। দীপু ভাইয়ের রুমে ঢুকে অবাক হয় উর্মিলা। অসম্ভব সুন্দর পরিপাটি সবকিছু সাজানো। কম্পিউটারের স্ক্রিনজুড়ে আরব সাগরে ভাসছে মার্কিন রণতরী। সুনসান নীরবতা। কমেন্টেস লিখে দীপু ভাই উর্মিলার দিকে তাকায়। উদাস চাউনি।
‘দেবী, শেষ পর্যন্ত আপনার দায়ভার আমার ওপর। কী আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, দিবস-রজনী আমি যেন কার আশায়-আশায় থাকি।’
‘জি?’
‘না না বেবী আপা কওলা করে দেননি। বসুন।’ উর্মিলা সামনের চেয়ারে বসে।
‘আপনার মার্কশিট আর দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে এক রিকশায় বসে তেজগাঁও উইমেন্স কলেজে যেতে বলেছে। বাকি দায়িত্ব কলেজের। বেবী আপা বলে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল আপা, বেবী আপার বান্ধবী।’
টেবিলে চা চলে আসে।
‘জি।’ উর্মিলা উদাস তাকায়। ওর মনে হয় আগ্রহ নিয়ে দীপু তাই তাকিয়ে আছে।
প্রথমে দীপু ভাইয়ের মুখ জাকির সাহেব মুখ হয়ে যায়। কিন্তু ওই চোখ বলে ওরকম না। মমতা আছে।
‘আমি তো গ্রাম থেকে উঠে এসেছি। আমার অনেক কিছুর অভাব আছে।’
‘দেবী, সবাই গ্রাম থেকে নগরে আসে। আমিও মাদারীপুর থেকে এসেছি। সংসারে বাবা নেই। জন্মান্ধ বোন আছে। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভালো ছাত্র ছিলাম। ভার্সিটি শেষ করেই বেবী আপার কাছে চলে এসেছে। আপনার মতো। সংসারে মা কুন্তি কই পাবেন! বেবী আপাই মা দুর্গা।’
হঠাৎ উর্মিলা অনুভব করে ওর চোখ ছাপিয়ে জল আসছে।
‘দেবী সংসারে চোখের জলের মূল্য নিতান্ত কম। এ মাইলস টুগো বিফোর আই স্লিপ।’
‘সংসারে বাবা ছাড়া কেউ নেই।’
‘তাইলে তো আরো ভালো, পুরোটাই মানুষের জন্য।’
‘আমি কিছু বুঝতে পারি না।’
‘দরকার নেই। কলেজে ভর্তি হোন শিক্ষাই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে।’
‘খুব বেশি খারাপ মানুষের সাক্ষাৎ এ জীবনে পাইনি।’
‘সমাজে খারাপ মানুষের কম। পারবেন দেবী। শিব মহাশয় আপনার জন্য রথের লাগাম টেনে ধরবে।’
উর্মিলা খুব বিস্ময় নিয়ে বলে, ‘আপনি আমাদের এত কিছু জানলেন ক্যামনে?’
‘দেবী আপনাকে জ্ঞান দান করি, এ জনগোষ্ঠীর মানুষ সব জানে?
উর্মিলার মনে হয় দীপু ভাই আশ্চর্য রকম তরুণ। উর্মিলার মতো মেয়েদের এ মমতার প্রয়োজন আছে। (চলবে)
আলো বিসর্জন
আলো বিসর্জন
মুনঈম রাব্বি
মহসিনের ছোট্ট উঠোন ভাড় হয়ে আছে। সমস্ত মানুষের নিশ্বাসের উষ্ণতায় ফাল্গুনের শেষ শীত টুকুনও কেটে গেছে। দুপুর গড়াতে এখনও অনেক দেড়ি। এবাড়ি, ও বাড়ির বউ ঝিয়েরা মুখে আঁচল গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে. ঢেঁকিঘর আর মাচাল ঘড়ের আবডালে। বহু মানুষের গুনগুনানি যেন অট্টোরোলের মত শোনায়। হাতেম মুন্সি হাঁকছেড়ে আজান দিলেন। বড় অদ্ভুত তাঁর ধ্বনি। লেটু কোবরেজ এর মতই একটানা কি যেন পড়ে গেলেন। ফাগুনের শুকনো দুপুরে উছলডাঙ্গি গ্রামের পুবপাড়ায় আজ যেন সবার বড্ড তাড়াহুড়া। আজান দিতে না দিতেই দোচালা ঘড়ের মসজিদ ভরে গেল। গ্রামের সমস্ত মানুষ যেন ছুটে এসেছে পঙ্গপালের মত। বড়বাড়ির কাসেম গাজী, স্কুলপাড়ার মোখলেস ব্যাপাড়ী, মুন্সি বাড়ির মোতালেব মুন্সি এমনকি হালিম ওরফে হালু পাগলাও এসে হাজির। মহসিনের বড়চাচাও ব্যস্ত। বাদ যোহর শালিস বসবার কথা।
গেল বৈশাখের এক দুপুরের ঘটনা। মাঠ থেকে কোনরকমে বাড়ি ফেরে মহসিন। অমন কাঠফাটা রোদ্দুরে মহসিনকে মাঠে যেতে বারন করেছিল আলো। আলোর অনুরোধ মহসিন অগ্রাহ্য করে। মাজায় গামছা বেঁধে গোয়ালের গাদায় রাখা ঝাঁকা আর নিড়ানী নিয়ে থর থর করে নেমে যায় বিলের মাঠের আল পথ ধরে। কাসেম গাজীর বড়দাগের জমি বর্গা নিয়েছে মহসিন। একাই চাষ দেবে। একটা পোরেতও খাটাবেনা। দিন পাঁচেকের জন্যে জোগাল খেটে ছিল বড় চাচার ছেলে মুরাদ। এজন্য তাকে একশটাকা দিতে হয়েছে। বড় দুঃশ্বাহস মহসিনের। বড় দাগের জমিন একলা চাষ দেয়া মুখের কথা না। যদিও সোনার মত মাটি তবুও মহসিন ঝুঁকিই নিয়ে নিল। তবুও হত, যদি মুরাদের সাহায্য আরো কিছুদিন পেত। মুরাদ কাজের বেলায় ফাকিবাজ। একদিন কাজে গেলে বাকি পাঁচদিন ওকে আর পাওয়া যায় না। দোপপাড়ার দক্ষিনের বাগানে সারাদিন পাশা খেলে। নেশাতুর চোখ আর সমস্ত শরীরে মদের গন্ধ।
তারপড়েও মহসিন এই অসাধ্যও যেন উতরে যায়। পারেও সে। কালো চামড়ার আস্তরণে যেন নিখুত কিছু মাংশ পেশী এক তাগড়া জোয়ান পুরুষ মহসিন। হালের এক বলদ আর ধামরী গাই দিয়েই পুরো জমিন আলগা করে ফেলেছে মহসিন। নাদাঘের অগ্নিবারিষায় যেন চোখ দুটো শুধু লাল হয়। কিন্তু সেদিন কি যেন হলো।
মাথার উপড় আগুন উরাচ্ছে টনটনে সূর্য। আলো শাড়ির আচল গুছিয়ে ডোয়া লেপছে। পানি নিয়ে যাবার কথা কিন্তু এ অবস্থা কি ভাবে যাবে সে? বাড়ির একপাশে শুপাড়ি পাতার আস্তরন খচ খচ করে উঠল। সরলা আলো মাথা উকি দিলে একটা চতুর চাহুনি তড়িহড়ি সটকে পড়তে চাইল। আলো মুরাদকে দেখতে পেয়ে ডাক দিল। মুরাদ যেন খানিক ঘাবড়ে গেল। আলো হাত ধুয়ে কাসার জগে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসল। ঢাবের উপর ছড়ানো ছেড়া একটি গামছায় কিছু মুরকি পেচিয়ে মুরাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, যা না ভাই, তোর ভাই বড়দাগের জমি নিড়াচ্ছে, বেজায় রোদ তার হাতে একটু কাজ করে আয়! মুরাদ মৃদু পায়ে এগিয়ে চেলল। দস্যি মুরাদ এত সন্তর্পনে হাটে না।
জমি চষে রোব বারের হাট ধরবে মহসিন। হাটের বেলা চলে যাচ্ছে। তবুও মাঠ থেকে ফেরার নাম নেই। আলোর কপাল ঘামে না কিন্তু মন ঘামতে থাকে। তাহলে কি মহসিন হাটে যাবে না? কাল সন্ধ্যায় যে বলেছিল আজ হাটে গেলে মোটা লাল পারের শাড়ী কিনবে, হলুদ, কমলা আর লাল রঙের চুল বেনী করার ফিতা কিনে আনবে? আলোর মন পরন্ত বিকেলের বুজে আসা আকাশের মত চুপসে আসে।
বিকেলটা গড়িয়ে গেছে বেশ। হঠাৎই মহসিন দৌড়ে এসে পড়ে গেল খরের গাদার উপর। কি হলো মহসিনের? চোখ দুটো যেন ইট ভাটার আগুন উৎড়াচ্ছে। গোবর লেপা উঠোনে দু পা আর হাত বার বার আছড়ে পড়ছে মহসিনের। আলো ছুটে আসে। ঢেঁকি ঘড়ের ডোয়া লেপতে গিয়ে মেহেদি রাঙা হাতের রঙ ধুয়ে গেছে। বিয়ের পড় শুক্লা চাদের এক পক্ষও গেল না। আলোর লাজ ভেঙে ছিল সবে। নতুন হৃদয়ে যেন রং লেগেছিল। বিয়ের পর থেকেতো কথাই হতনা মহসিনের সাথে। লাজ্জায় যেন নিশ্বাস আটকে যেত। এইত কাল বিকেলেই সাহস পেল কিছু।
মহসিনের কপালের সামনে বেঁকে আসা চুল ভাল লাগে আলোর। মাঝে মাঝেই সেই দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সেই ত শুরু প্রেমে পড়ার। আলো সবে মাত্র মহসিনের চোখের দিকে চাইতে পেড়েছে। আঁখির কাজলে যেন মহসিনের প্রাণটা বাধতে শিখেছে। কালই প্রথম আলো তার স্বামীর কাছে বায়না করেছে। লাল পেড়ে শাড়ী আর চুল বেনী করার ফিতের। চুল বেনী করে রাখে আলো। কি ভেবেছিল আলো? কালো দীঘল চুলে তিনটে রং মিশাবে সে। কিন্তু কি হয়ে গেল মহসিনের?
নবীন প্রেম প্রাণ পেল না। মহসিনের দেহে নীলোৎপলের ছায়া পড়েছে যেন। নীল রঙ এ ঢেকে যাচ্ছে মহসিনের মুখ। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে কালো রক্ত। মহসিনের চোখের আলেয়া যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মহসিন চোখ পাকায়, মুখ নাড়ায়। কি যেন বলবে, ললাট চেপে আসে মহসিনের। দিগন্তের অস্তগামী সূর্যের মত মহসিনের চোখ যেন দিকহারায়। মহসিনের শক্তিহীন মাথা আলোর কোলে নেতিয়ে পরে। আলো তবুও বোঝেনা। দাঁত মুখ চেপে আসে আলোর। তারো যেন কথা বলার শক্তি নেই।
বৈশাখের শেষ বিকেল সন্ধ্যা টেনেছে। মহসিনের শরীরে পৌষের অসম্ভব শীতলতা। আলোর চিৎকারে ভেসে যায় পুরো গ্রাম। সবাই ছুটে আসে। মহসিনের বাপ হড়িমরি করে ধেয়ে আসে, মা গিয়েছিল মোমেনাদের বাড়িতে, সেও কাল বিলম্ব করেনা। মহসিনের বড় চাচা চাচি ও ছুটে আসে। আশে পাশের দশ ঘরের সবাই ছুটে আসে। কিভাবে কোত্থেকে যেন মুরাদও এসে গড়াগরি শুরু করে। ভাই ভাই আমার বলে আহাজাড়ি করতে থাকে। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে না। কিভাবে কি হয়ে গেল। মহসিনের মত জোয়ান মর্দ ছেলের কিভাবে এমন হলো এমন পরিনতি।
মহসিনের মরে যাওয়া কেউই মেনে নিতে পারেনা। আলোও না। তাঁর নবীন চোখ কাদতে জানে না। সবাই আলোকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু আলো চুপ। আলোর মুখ যেন মরে গেছে। আলোর চুলের বেনী যেন শুকনো বেলী ফুলের মালার মত প্রাণহীন। পায়ে আলতাঁর পদ্মরাঙা ডেউরীতে ধুলো জমে গেছে। গাঢ় লাল ছাপার শারীরেও আলো যেন সফেদ, ফ্যাকাসে এক অবশাদের মূর্তি।
চাঁদ যখন প্রায় মধ্য গগনে দ্বিক-বিদিক জোছনা বিলোচ্ছে, তখন মহসিনের দাফন হলো বাড়ির পূব পাশের চালায়। জোছনা বিহারে তাঁর কবরের নয়া বাশের বেড়া ধফ ধফ করে। তারপর চাঁদ ডুবে যায়।এক দিন, দুই দিন গত হয়। সবার মাঝেই কৌতুহল মহসিন কেন, কিভাবে মারা গেল?
চাঁদের যৌবন শেষের দিকে। রুপেলী আভা ধীরে ধীরে তামাটে হয়ে যাচ্ছে। তখোনো আলোর কান্না থামেনা। বালিসে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদে। এই ঘর, এই সাজানো সংসারে যেন প্লাবিত সাগর পারের আর্তনাদ। মাঝরাতে ঠক ঠক করে কড়া পরে দরজায়। অতি নীশ্বব্দের মাঝে যেন কান ছাপিয়ে যায় আলোর। আলো জানেনা রাত কত গভীর কিংবা সকাল হয়েছে কি না। আলোর কাছে হঠাৎ কি যেন মনে হয়। তাঁর ভ্রম হয়। আলো ভাবে মহসিন এসেছে বুঝি। সে দরজা খুলে দেয়। আলো অবাক হয়। এত রাতে মুরাদকে সে েেখতে চায়নি। এই মুরাদ অন্য মুরাদ। তার চোখ দুটো যেন চোখের কুঠরে আটছে না। বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আকষ্মাৎ মুরাদ আলোর ঘরে ঢুকে গেল। আলোর হাত ধরে নেশাতুর লোলুপ দৃষ্টিতে আলোর কাছে আসতে চাইল। আলো সম্বিৎ ফিরে পেল। মুরাদ কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল উঠোনের বাইরে। ছিমছিমে মুরাদ যেন আস্তাকুড়ের মত ধপাস করে পড়ে গেল। আলো দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে মুরাদের হিংসার স্পষ্ট গোঙানী শোনা যাচ্ছে। মুরাদ যেন তাকে ছিড়ে খাবে। আলো শক্ত করে দরজায় খিল লাগায়।
স্বামীর শোক সে ভুলতে পারে না। এর মধ্যে মুরাদের এমন বেহাপনায় সে আরো ভেঙে পড়ে। আলো বাপ আসে তাকে নিয়ে যেতে। আলোও যাবে। যাওয়া ছাড়া তাঁর আর উপায় নাই। কিন্তু আর দু চারদিন বাদেই সামনের শুক্রবার বাদ জুমা মহসিনের জন্য দোয়া আছে। দোয়া সেরেই স্বামির ঘরকে বিদায় দিতে চায় আলো।
সেদিনের পর মুরাদকে আর দেখা যায়নি। কিন্তু মুরাদ বসে থাকেনি। চার দিকে বলে বেড়িয়েছে গত দু দিন ধরে। এত দিন তেমন কিছু শোনা না গেলেও আজ সকাল থেকে মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে পরতে থাকে। কানা ঘষা ছড়িয়ে দেয়ার এই দায়িত্ব নিজ মুখে গ্রহন করে মুরাদ আর মুরাদের মা। ধ্রুব সত্য কথা যেন। গ্রামেরর চরম কৌতুহলী মানুষেরা ঘটনাটা যেন নিজ চোখে দেখেছে। সবাই দম পেল বুঝি। অজানা এক কৌতুহলের তবুওত একটা কারন পাওয়া গেল! মহসিনের চাচা হঠাৎ আলেয়ার উঠোনে এসে চেচিয়ে ওঠে। সাথে মুরাদ আর গ্রামের দুই চার জন। মহসিনের চাচা রক্ত চোখে রাগ ঝারতে থাকে। চেচিয়ে চেচিয়ে বলতে থাকে, হারামীর বাচ্চা কৈ? আমার শোনার লাহান ভাইজতারে মারলি ক্যা বেজম্মা? তোর নাগর ভালা লাগে নাই তুই যাইতি তোর ভাতারের লগে! আমার মহসিন রে বিষ দিলি ক্যা?
মহসিনের চাচা যেন বেদ বাক্য আওড়ালেন। তার সাথে গলা মেলাল সবাই। মহসিনের ছোট্ট দেহলি জুড়ে আবার মানুষের আনাগোনা। মুরাদ আজ বেজায় খুশি। তার চোখ যেন শান্ত হয়েছে। সে ভাবেনি তাঁর গুজব এতটা রটে যাবে। আলেয়া ভাষা হারিয়ে ফেলে আবারো। তার যে ভাগ্য বেজায় খারাপ। স্বামীকে হাড়িয়ে আজ সেই স্বামীকে খুন করার দায়টাও নিতে হবে বুঝি।
গ্রামের লোক বহুদিন পর একটা উপলক্ষ পেল। লোক মখে ঘটনা দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের মোড়লেরাও বাদ গেল না। গ্রামের মানুষের দাবি উঠে গেল, এই খুনের একটা শাস্তি হওয়া চাই। মোড়লেরাও সেই দাবি উপেক্ষা করতে পারল না। তারা দিন তারিখ ধার্য করলো সামনের রবিবার শালিস বসবে। বাদ যোহর মহসিনের বাড়িতে।
আজ সেই রবিবার। কানায় কানায় ভরে গেছে দোচালা মসজিদ ঘর। নামাজ শেষ হয়। হাতেম মুন্সি এসে গেছে। মোতালেব মাতব্বর উঠোনে বসে বসে ঘামে আর মুরাদ হাত নেড়ে নেড়ে পাখা ঘুরায়। লোকে লোকারন্য মহসিনের উঠান। মহসিনের চাচা হাক ছাড়ে। মাগী কোই? মাগীরে আন!
মহসিনের মাও থেমে থাকে না। থেমে থেমে গাজন গায় যেন। খুব বেশিদিন হয়নি আলো এই বাড়িতে এসেছে। যা কিছু বন্ধুত্ব, সম্পর্ক হয়েছে তাঁর সবই মহসিনের সাথে। আজ তাঁর পাশে কেউ দাড়ালো না। কেউ দায় নিল না।
লোকের জমায়েত বায়বাড়ি অব্দি পৌছে গেছে। সালিশ শুরু হবে। কিন্তু আলোকে ছাড়া সালিশ কিভাবে শুরু হবে। আলো যে ঘরে নেই। আলোকে খুজে পাওয়া যায় না। হাজার হাজার চোখের অতন্দ্র পাহাড়া এড়িয়ে আলো কোন আঁধারে লুকালো?
ঘন্টার পর ঘন্টা পাই পাই করে খুজেও আলোকে পাওয়া গেল না। আলোর হাড়িয়ে যাওয়াকে সবাই পালিয়ে যাওয়া ধরে নিল। তারা যেন আরো নিশ্চিত হয়ে গেল। আলোই মেরেছে, না হলে পালাবে কেন?
অবলা আলোর ললাটে অপবাদ জুটে গেল। সে জানে সে না লুকালে তাকে অপদস্থ হতে হবে। স্বামী হত্যার মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে তাকে পুরো গ্রামময় ঘুরানো হবে। তাকে বুঝবার মত এখানে আর কেউ নাই। মরা গাঙের শেষ জল টুকুও যেন শুকিয়ে যায়। আলোর চোখ আঁধারে ঢেকে যায়। সে হাটতে থাকে দিগন্তে। সে পালতে চায়না, শুধু হাড়িয়ে বাচতে চায় এই পৃথিবীর অন্ধকার হতে। আলো হাটে আর হাটে। নতুন শাড়ীতে অজস্র দুঃখ জড়িয়ে। আলো ছুটে যায় , আলো জানে তাঁর স্বামীর গন্তব্যে যেতে আরো অনেকটা পথ বাকি!
দাসত্ব
দাসত্ব
জুয়েল মাহমুদ
আত্নাকে জয় করা মানে বিশ্বজয় করা। অন্যের দাসত্বে পরিপূর্ণ আত্না কখনো মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারে না। অথচ কবি বলেছেন বাদশা আলমগীর যদি তাকে শাস্তির কথা বলেন আমি বলব
‘ভয় করি নাক, ধারি নাক কোন ধার, মনে আছো মোর বল
বাদশাহ শুঁধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল’।
অথচ যারা জাতির কারিগর তারাই আজ দাসত্ব করে বেড়ায়। আজ দাসত্ব এতটুকু বাড়ন্ত যার ফলে ওস্তাদের হাত আজ ছাত্রের পায়ে। অথচ এই হাত থাকার কথা ছাত্রের মাথায়।
‘দাস’ মানে গোলাম। আর দাসত্ব শব্দের অর্থ অন্যের গোলামী করা। সভ্যতার অগ্রগতিতে আজও দাসত্ব বাঙ্গালির মনোভাব ইতিবাচক করে তুলেছে। তারা মনে করে দাসত্বই যতই সুখ। হয়ত আপনারা বলতে পারেন দাস যেহেতু আছে আত্বসমালোচক নিশ্চয় আছে? ভালো দিক দেখুন। আসলে হ্যাঁ, আমাদের ডাক্তার, মন্ত্রী, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে তারা আবার আন্তর্জাতিকের দাসত্ব করে। যার ফলে অগ্রগতির ছোঁয়া যেখানে লাগে সেখানেই বাঁধা।
আতœসমালোচনা হলো আতœার শুদ্ধি। আর আত্নার সমালোচকরাই জীবনের সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছে। তারা নিজেকে করেছে জয়। বিল গেটস, আইন স্টাইন, আব্রাহাম লিংকন, মাশরাফি বিন মর্তুজাদের সাফল্যতার পিছনেই রয়ে আতœসমালোচনা, দাসত্ব পরিহার ও পরিশ্রমের ইতিবাচক ফলাফল। প্রতিবন্ধী ছেলে যাকে মা কোলে করে নিয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছে সেই ছেলেটি আজ নিজের প্রতি সুবিচারক। আমরা নেতার পিছনে থেকে স্লোগান দিতে পারি অথচ নিজের ভিতর লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা আজও পারিনি উপস্থাপন করতে। আমরা আতœসমালোচক না হয়ে হয়েছি আতœার সমালোচক। এর অর্থ যে আত্না অন্যের আমার নয়। আমরা পারিনি উৎসাহ দিতে আমরা শিখেছি অন্যের প্রতিভায় মরীচিকার প্রতিসরণ ঘটাতে। নিজের আলোয় আলোকিত না হয়ে রয়েছি দাস হয়ে। আমরা নিজের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে সাত গ্লাস পানি পান করতে হয় অথচ মাকাল ফলের সৌন্দর্য বর্ণনায় আমরা পারদর্শী। যেখানে ছাত্র এসে শিক্ষককে সম্মান করত আজ আমরা শিক্ষক হয়ে ছাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমরা অন্যের সৌন্দর্য্যকে যে হারে উপস্থাপন করতে চায় যেন শয়ন খালিক। আজ আমাদের দাসত্ব মনোভাবের কারণেই আমরা উচুজাত নিচুজাতে পরিণত করেছে।
এজন্যই নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এই জাতিকে ব্যাঙ্গ করে প্রবন্ধ লিখেছেন- ‘নিরীহ বাঙ্গালী’। অথচ এই জাতিকে কবি নজরুল বলেছেন ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’। যারা রাঙ্গা প্রভাত আনার মত যুতসই জাতি। হয়ত নজরুলও দেখেছেন এই জাতির দাসত্বের মাঝে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে। পরশ্রীকাতরতার মাঝে খুঁজে পেয়েছেন আতœার সৌন্দর্যকে। অথচ আমরা আজ মেধাবী হতে চাই না আমরা মেধাসত্ত্ব চুরি করে আজ বিখ্যাত হতে শিখেছি। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন- ‘বই মানুষকে আলোর পথ দেখায়’।
উনি তাঁর লাইব্রেরি প্রবন্ধ লিখতে লিখতে হয়ত ভেবেছেন এই প্রবন্ধ পড়ে জনতা বলবে আমাকে বই দাও আমি লাইব্রেরি গড়ে তুলবো। বা মানুষ লাইব্রেরীর গুরুত্ব বুজতে পারবে। অথচ আজ মানুষ বলছে ‘আমাকে রিমোট দাও, আমি সিরিয়াল দেখব’। যে জাতি আজ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ আজ সেই জাতিই, ধর্ম, বর্ণের পার্থক্য খুঁজে বেড়ায়। এর মূলই দাসত্ব আর পরশ্রীকাতরতা। এই দাসত্বের জন্য আজও আমরা দেশ চালাতে গিয়ে অন্য দেশের নীতিমালা ধার করি। অথচ আমরা মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীন করে রেকর্ড বইয়ে নাম লেখিয়েছি। আমরা আজও স্বপ্ন দেখি জাত, ধর্ম, বর্ণ, দাসত্ব, পরশ্রীকাতরতা পরিহার করে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলে বিশ্বের মাঝে মাথা উচু করো দাঁড়াতে। আমরা শুধু মানুষের দাসত্ব করিনা আমরা পরের সৌন্দর্য রূপেরও দাসত্ব করি। আর বর্ণবাদ আচারণ আজ আমরা খুবই বাড়ন্ত। আমরা মোলায়েম ভালোবাসি আর কাকের গায়ের রঙ নিয়ে কত না বৈষম্যমূলক আচারণ করি। কে খাটো কে লম্বা কে মোটা কে চিকন এসবের দিকে আমরা অনেক এগিয়ে থাকি এক্ষেত্রে আমরা বিশে¬ষক। ডিগ্রী থাক বা না থাক। সৌন্দর্যের দাসত্বে আমরা খাটো আর কালো মানুষগুলোর মেধাকে মূল্যায়ন করতে পারিনা অথচ জনৈক ব্যক্তি বলেছেন- ‘তোমরা কারো চেহারাকে নয় মাথাকে মূল্যায়ন কর। আমি বলি মাল থাকলে মালদার হওয়া যায় আর মেধা থাকলে যশ খ্যাতি পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত বর্ণবাদের স্বীকার। অথচ এই বর্ণবাদ দূর করার জন্য নেলসন মেন্ডেলা কত না নির্যাতিত হয়েছেন। বর্ণবাদের মূল কারণেই বাহ্যিক সৌন্দর্যের দাসত্ব। আজ যদি নেলসন বেঁচে থাকত হয়ত আমার পাশে এসে দাঁড়াতেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বলতাম নেতা আমিও আজ বর্ণবাদের স্বীকার। তিনি হয়ত তবুও বলতেন- ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
আর আমিও বলি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)