চিনের মরমী কবি : বেই দাও
চিনের মরমী কবি
বেই দাও
অনুবাদ : আকিব শিকদার
বেই দাও একজন নির্জনতাপ্রিয় কবি। চিনের যে ক’জন কবি কবিতায় মরমীবাদ আগলে রেখেছেন, কবি বেই দাও তাদের মাঝে একজন। বেই দাওকে বলা হয় রহস্যবাদী কবি।
বেই দাও শব্দটির অন্য উচ্চারণ “পেই তাও” এবং শব্দটির অর্থ “উত্তরের দ্বীপ”। কবির জন্ম ১৯৪৯ সালের ২ আগস্ট বেইজিং এ হলেও কবির শিকড়টি চিনের উত্তরের একটি দ্বীপে প্রোথিত। বেই দাও এর প্রকৃত নাম ঝাও ঝোনকাই। কবি নির্জনতা পছন্দ করেন বলেই হয়তো ‘বেই দাও’ ছদ্মনামটি বেছে নিয়েছিলেন। মরমী এ কবি চিনের লোকদের হৃদয়ে হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন।
সময়ের গোলাপ
যখন দারোয়ান নিদ্রিত থাকে ফটকে
আর তোমরা দল বেঁধে ঝড়ের সাথে বাড়ি ফিরে আসো
এই যে আলিঙ্গনে চলার বয়স- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন পাখিদের চলাচল আকাশকে সাজায়
আর তোমরা পেছনে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখো
এই যে অন্তর্ধানের মাঝে প্রত্যক্ষ- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন তলোয়ার বেঁকে যায় ডুবো জলে
আর তোমরা ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে তোলো বাঁশিতে সুর
এই যে বাঁধাবিঘেœ সজোর আর্তনাদ- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন কলম আঁকে দিগন্তের রেখা
আর তোমরা প্রাচ্যের ঘণ্টাধ্বনীতে বিস্ময়ে জেগে ওঠো
এই যে ধ্বনির অনুরণনে কম্পন- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
মনের আয়নাতে বিম্বিত যে-কোনও মুহূর্ত
যা পৌঁছে দিতে পারে পুনর্জন্মের দরজায়
খুলে দিতে পারে সাগরের কপাট- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
ফিরে আসা ধ্বণী
আকাশের পাখিগুলো সোনালী আলোতে উড়ে
ফিরে এসে বসে পাহাড়ি গাছের ডালে
রাতের ফানসগুলো নিভে গিয়ে
পরে যায় মাটিতে।
আমাদের ডাক, হে প্রভু, ফিরে যায় তোমার কানে।
আমাদের চিৎকার পাহারে সাগরে নদীতে
কত ধ্বণী প্রতিধ্বণী হয়ে ফিরে আসে পুণরায়।
হে প্রভু, তোমার গোপন সুর ফিরে যায় তোমার কানে।
জানালার ওপাশে বিকেল...
জানালার ওপাশে বিকেল...
সৈয়দ নূরুল আলম
দিনের আলো মরে এসেছে। একটু পরে জানালার ওপাশে বিকেল নামবে। এইমাত্র রুবী রুম থেকে বের হয়ে গেল। ওকে হাসান আজ আপনি থেকে তুমি বলেছে। একত্রে বসে দু’জনে ড্রিং করেছে। শূন্য দূরত্বে এসেছে কিনা হাসান তা মনে করতে পারছে না। প্রথম দিন, বে-হিসেবি হয়ে ও একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিল।
ইদানিং মেয়েরা অফিসে নানা কিছু বিক্রয় করতে নিয়ে আসে। কখনও মোটা মোটা দেশি-বিদেশি বই, কখনও কসমেটিক্স। কখনও বা শাড়ি-থ্রি পিচ। অফিসের মেয়ে কলিগরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এসব কিনে থাকে। ভাসমান বেঁচা-কেনা। সো-রুমের দরকার হয় না। কর্মচারি নেই। ভ্যাট-টেক্স দিতে হয় না। স্বাভাবিক ভাবে এসব জিনিসের দাম কিছুটা কম থাকে। এতে করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের লাভ।
বনানী পনের নম্বর রোডে টাচ এন্ড ফেয়ারের অফিস। এরা বিভিন্ন ধরনের প্রশাধনী সামগ্রী তৈরি করে। বছর পাঁচেকের মধ্যে ভালো একটা মার্কেট পেয়েছে। প্রথমে একতলা-দোতলা মিলে অফিস ছিল। এখন তিনতলাটাও অফিস হিসেবে নিয়েছে। হাসান ভাবছে, আগামী দু’বছরের মধ্যে পাঁচতলা পুরো বাড়িটা-ই অফিস হিসেবে নিতে পারবে।
হাসান এ অফিসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। ডাইরেক্টর এডমিন ও ফাইন্যান্স। ওর ওপরে আছে মল্লিক সাহেব। এ কোম্পানীর চেয়ারম্যান। এ দু’জনই কোম্পানীকে টেনেটুনে, জল হাওয়া দিয়ে বড় করেছে।
গুলশান, হাসানের রুমে এসে বলে, স্যার ইনি রুবী আপা। শাড়ি বিক্রি করেন। এ শাড়িটা ভাবীর জন্য নিতে পারেন। মিতু ভাবী তো সুন্দর। মানাবে ভালো।
হাসান শাড়ি চেনে না। না সুতো, না রঙ। কিনতে কিনতে মানুষ এসব চিনে ফেলে। কিন্তু হাসান বিয়ের আগে শাড়ির মার্কেটে কখনও যায়নি। এমনকি বিয়ের পরেও। যা কেনার মিতু নিজেই কেনে। মার্কেটে যেয়ে হাসান শুধু পাহাড়াদার হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
গুলশান শাড়িটা ভালো বলাতে হাসান আস্থা পায়। বলে, তুমি যখন বলছো, দিয়ে দাও।
রুবী একটা প্যাকেটে শাড়িটা ভরে, হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ধন্যবাদ স্যার।
হাসান বাড়ি ফিরে মিতুকে শাড়িটা দেখালে মিতু খুব খুশি হয় এবং বলে, এককাজ করলে কেমন হয়, আমি তো বাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার সময় মা-ভাবী-মিনু ওদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাই। তুমি এ শাড়িটা অনেক কমে পেয়েছ। এটা বসুন্ধরা মার্কেটে তিন হাজার-সাড়েতিন হাজারের কমে পাবে না।
‘ঠিক আছে, গুলশানকে বলব।’
‘খালি গুলশান-গুলশান করো কেন?’ ওকে কী দরকার। রুবী না কি যেন মেয়েটার নাম বললে, ওকে বাসায় আসতে বলো। দেখে শুনে পছন্দ করি।’
হাসানের প্রথম ইস্যু। প্রথমবার মেয়েরা মায়ের কাছে যায়। তাই মিতুও দিনাজপুর মায়ের কাছে যাবে।
হাসান বলে, ঠিক আছে, মেয়েটাকে আগামী শুক্রবার আসতে বলব।
‘শুক্রবার কেন? তার আগে আসতে বলো। আমি তো শনিবার চলে যাব। আর শোন অনেকগুলো শাড়ি আনতে বলবা। ওর মধ্য থেকে কয়েকটা বেছে নেব।’
‘শুক্রবারই আসতে বলি। শুক্রবার ছাড়া তো আমি বাসায় থাকি না।’
পরের দিন হাসান অফিসে যেয়ে গুলশানকে শাড়ি নেয়ার কথা বললে, গুলশান রুবীকে ফোন করে বলে, শুক্রবার বেশ কিছু শাড়ি নিয়ে তোমাকে স্যারের বাসায় যেতে বলেছেন। ভাবি নিজে পছন্দ করবেন। স্যারের বাসার ঠিকানা আমি তোমাকে টেক্স করে দিচ্ছি।
‘ধন্যবাদ গুলশান আপা। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করছেন। ওদিন স্যারের কাছে না নিয়ে গেলে, স্ট্রং রিকোমেন্ড না করলে, স্যার শাড়ি কিনতেন? রুবী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে।
‘আমি আর কী করলাম! এমনিতে তোমার ব্যবহার ভালো। অল্পতে সবাই গলে যায়। তোমার জন্য শুভকামনা।’
‘ওকে আপা। ভালো থাকবেন।’
কিন্তু শুক্রবার যাওয়ার কথা থাকলেও রুবী ওদিন হাসানের বাসায় যায় না। কোন সংবাদও দেয় না।
মিতু কুমড়োর মতো মুখ করে বলে, কই তোমার মেয়েটা তো এলো না। এখন! আমি বাড়িতে মা- বোনদের বলে রেখেছিÑ তোমাদের জন্য শাড়ি নিয়ে আসছি।
এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান কিছুই বলতে পারে না। মেয়েটি এমন করবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিল।
মিতু ফোসফাস করতে থাকে।
হাসান দুখিদুখি মুখ করে বলে, বুঝতে পারলাম না। মেয়েটার কী হলো। ফোন করব তারও উপায় নেই। ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। ঠিক আছে, আমি যখন সামনে মাসে তোমাকে দেখতে যাব, তখন নিয়ে যাব।
মিতু হ্যাঁ-না কিছু বলে না। এ সময় রাগ-অভিমান করে শরীরের ওপর চাপ নিতে চায় না মিতু। তাই মন খারাপ করে, পরের দিন বাবার বাড়ি চলে যায়।
ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। হাসান কমলাপুর ষ্টেশনে যেয়ে মিতুকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে। হাসান দিনাজপুর পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল।
মিতু বলেছে, আমি একা যেতে পারব। বাবা তো ষ্টেশনে এসে নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া তুমি তো ঘনঘন ছুটি পাবে না। দু’সপ্তাহ পরে আমাকে দেখতে যেতে চেয়েছ না?
তবু হাসানের মন খারাপ হয়। এ সময়ে একা একা যাওয়া! যদিও এখন তিন মাস বাকি।
যত সময় ট্রেন না ছাড়ে, হাসান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন চলা শুরু করলে হাত নেড়ে মিতুকে বিদায় জানায়।
হাসানের অফিস সকাল ন’টায়। মিতুকে সাতটায় ট্রেনে তুলে দিয়ে হাসান আর বাসায় যায় না। সরাসরি অফিসে চলে আসে। হাসান মাঝে মধ্যে বেশ আগে অফিসে চলে আসে। এসে আগেরদিনের জমা ফাইলগুলো ছেড়ে দেয়। গতকালকের দু’টো ফাইল টেবলে পড়ে আছে কিন্তু ফাইল দু’টো দেখতে হাসানের মন চাচ্ছে না। ভেতরটা গজ গজ করছে। কতক্ষণে গুলশান অফিসে আসবে।
এ সময় পিয়ন হারুন এসে বলে, স্যার কফি দেব?
‘না।’
‘না’ শব্দে বোম্বাই মরিচের ঝাঁঝ ছিল, সেটা বুঝতে পেরে হারুন আর কোনো কথা বলে না। ওদিনের দু’টো নিউজ পেপার টেবলে রেখে রুম থেকে বের হতে যায়।
হাসান হারুনকে ডেকে বলে, এই শোন, গুলশান ম্যাডাম এসেছেন?
‘জ্বি স্যার।’
‘ডাকো তাকে।’
হারুন গুলশান ম্যাডামের রুমে যেয়ে বলে, ম্যাডাম, হাসান স্যার মনে হয় খুব রেগে আছেন। আপনাকে ডাকে।
গুলশান ভয়ে ভয়ে হাসান স্যারের রুমে ঢুকে বলে, গুড মর্নিং স্যার।
‘গুড মর্নিং। ওই মেয়েটাকে বলেছিলেন, শুক্রবার বাসায় আসতে?’
‘কেন যায়নি স্যার! আমি তো বলেছিলাম।’
‘বাসার এডড্রেস বলেছিলেন?’
‘জ্বি স্যার। এডড্রেস টেক্স করে দিয়েছিলাম।’
‘ও তো যায়নি। তোমাদের ম্যাডাম তো খুব রাগ করেছে। বাবার বাড়ি খালি হাতে যেতে হলো। ভেবেছিল মা-বোনদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাবে।’
‘স্যার আমি এখনই রুবীকে ফোন দিচ্ছি।’
গুলশান রুম থেকে বের হয়ে রুবীকে ফোন দেয়। ফোনে উত্তর আসেÑ সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকবার ফোন দেয়। প্রতিবারই একইÑ সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গুলশান কাচুমাচু হয়ে, রুমে এসে বলে, স্যার রুবীকে ফোনে পাচ্ছি না। ফোন যাচ্ছে না।
‘লিভ দিস।’
‘স্যার আপনাকে কফি দিতে বলি?’
‘না। যান, কাজ করেন গিয়ে।’
গুলশান মন খারাপ করে রুম থেকে বের হয়ে আসে। হাসান স্যারের কাছ থেকে এধরণের ব্যবহার এই-ই প্রথম পেল।
শুক্রবার হাসানের বাসার ডোরবেল বাজলে, হাসান এসে দরজা খোলে। দরজায় রুবী দাঁড়িয়ে।
‘তুমি!’
হাসান রুবীকে না-চেনার ভান করে বলে।
‘স্যার আমি রুবী। ওই যে অফিসে ভাবির জন্য শাড়ি নিলেন।’
‘তো?’
‘গুলশান আপা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, আরও কয়েকটা শাড়ি নেবেন, তাইÑ’
‘ভেতরে আসুন।’
ভেতরে আসুন কথাটা এমন ঝাঁঝ মিশিয়ে হাসান বলে, তাতে রুবী বুঝে যায়, সামথিং রং।
রুবী ড্রয়িং রুমের এক কোনে যেয়ে ভেজা বেড়ালের মতো বসে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে পায়ের কাছে রাখে। দু’টো ব্যাগই বেশ ভারি। একটা কাধে, একটা হাতে নিয়ে রুবী সবসময় বেরোয়। এতেকরে কেউ বুঝতে পারে না, ও শাড়ি ফেরিকরে বিক্রয় করে।
হাসান নিজের রুমে চলে যায় এবং পাঁচ মিনিট পরে ফিরে আসে।
রুবী লক্ষ করে, দরজা খোলার সময় হাসান স্যারের গায়ে গেঞ্জি ছিল। চুল ছিল এলোমেলো। পড়নে ছিল লুঙ্গি। এখন একটা হাফসার্ট পড়ে, চুল আঁচড়িয়ে, লুঙ্গি পাল্টে, প্যান্ট পড়েছে।
রুবী ভেবেছিল, পোষাকের এ পরিবর্তনের সাথে সাথে, হাসান স্যারের ভেতরের রাগটাও পাল্টাবে। কিন্তু না। হাসান আগের শক্ত স্বরেই বলে, কবে আসবেন গুলশান বলেনি?
‘বলেছিল, শুক্রবার।’
‘তো?’
‘আজ তো শুক্রবার।’
‘শুক্রবার তো মাসে চারটে থাকে। বছরে থাকে অনেকগুলো।’
‘বুঝলাম না, স্যার।’
‘গত শুক্রবার আসার কথা বলেছিলাম।’
‘স্যার গুলশান ম্যাডাম তো নির্দিষ্ট করে বলেননি। শুধু বলেছেন, শুক্রবার দেখা করতে। বিশ্বাস না হয়, আমার ফোনে রেকর্ড করা আছে, শুনবেন স্যার?
‘দরকার হবে না। তবে যখন বলা হয় শুক্রবারের কথা, তখন পরের শুক্রবারকেই বুঝায়।’
‘স্যরি স্যার। আমি বুঝতে পারিনি। আমি আপার ফোন পেয়ে, আমাদের বাড়ি রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম,আরও ভালো ভালো কিছু শাড়ি আনতে।’
‘তুমি ফোনও ধরোনি।’
‘স্যার আমাদের বাড়ি রাজশাহী শহর থেকে অনেক ভেতরে। একটা অজপাড়াগাঁ। ওখানে প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি থাকে না। ফোনে চার্জ ছিল না।’
‘বুঝলাম। কিন্তু যিনি শাড়ি নেবেন, তিনি তো চলে গেছেন।’
‘কোথায় গেছেন স্যার? আসবেন না?’
হাসান একথার আর উত্তর দেয় না। বলে, আজ তুমি ফিরে যাও। তোমার ফোন নম্বর রেখে যাও। প্রয়োজন মতো আমি ডাকব।’
একথা শুনে রুবীর ভেতরটা ছেৎ করে ওঠে। কতো আশা নিয়ে এসেছে, সামনে ওর থার্ড সেমিস্টারের ফি জমা দিতে হবে। কয়েকটা শাড়ি বিক্রয় করতে পারলে, বাকিটা টিউশন ফি মিলে হয়ে যেত।
তবে আশার আলো, হাসান স্যার ওকে ‘তুমি’ বলেছে। নিশ্চয় আগের রাগ আর পুষে রাখেনি।
তাই ভেবে রুবী সাহস নিয়ে বলে, স্যার নতুন কিছু শাড়ি এনেছি, আপনি একটু দেখেন।
‘আমি তো শাড়ির কিছু বুঝি না।’
‘স্যার ম্যাডাম কি, ভাই বাড়ি গিয়েছেন? কবে আসবেন?’
‘হ্যাঁ। ওদের বাড়ি গিয়েছে। প্রথম ইস্যু। আসতে বেশ দেরি হবে।’
দেরি হবে শুনে রুবী দ্বিতীয় বারের মতো ধাক্কা খায়। ও নিজের বুকের মধ্যে ধক ধক ঢেঁকির পাড় শুনতে পায়। ওর সব যোগবিয়োগ এলোমেলো হয়ে যায়।
রুবী শেষ চেষ্টা করে বলে, স্যার এক কাজ করলে হয় না, ম্যাডামকে ভিডিও-তে শাড়ি দেখান।
‘না, সেটার আর দরকার নেই। আমি সামনের মাসে সতের তারিখ ওদের ওখানে যাব। তার আগে একদিন আসো। এর মধ্যে আমি একদিন মিতুর সাথে কথা বলে নেবো।’
‘কিছু মনে করবেন না স্যার। তার আগে মানে, ডেটটা যদি নির্দিষ্ট করে বলতেন। না হলে, আজকের মতো ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।’
‘সতের তারিখের আগে দশ তারিখ, শুক্রবার।’
‘ওকে স্যার। তবে আজ একটু যদি দেখতেন। কষ্ট করে এসেছি, আমার ভালো লাগত। আর ম্যাডামকে কিছু বর্ণনাও দিতে পারতেন।’
কিছু সময় থেমে রুবী আবার বলে, স্যার আমি আরেকটা জিনিস বিক্রি করি।
‘কী?’
‘অভয় দিলে বলতে পারি।’
‘আমি কি পুলিশ, না র্যাব?’
‘না। আপনি পছন্দ করেন, কী করেন না, তাই ভাবছি।
‘আমি তো অভয় দিয়েছি।’
রুবী আর কোনো কথা না বলে, ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে,টি টেবলের ওপর রেখে বলে, অনেকে চায়। তাই মাঝে মধ্যে সাথে রাখি।
‘আমি কখনও খাইনি। অভিজ্ঞতা নেই।’
‘তা হলে রেখে দেই।’
‘তাই করো।’
রুবী কোনো দ্বিরুক্তি না করে, যেখানে বোতলটা ছিল, সেখানে রেখে দেয়।
‘স্যার, আজ উঠি তা হলে।’
‘বোতলটা নিতে পারলাম না বলে, মন খারাপ করেছো?’
‘না স্যার। খুশি হয়েছি। আমারই ভুল হয়েছে। আপনার অনুমতি ছাড়া আনা ঠিক হয়নি।’
‘তোমার তো এটা ব্যবসা। নানা ধরণের পন্য সাথে রাখতেই পারো।’
রুবী হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, স্যার আপনি একদিনের জন্যও খাননি?
‘বললাম তো। আমি ওসবের গন্ধ শুকতে পারি না।’
‘স্যার এটা হোয়াইট লেডিস ওয়াইন। খুব সফট। একবার ঠোঁট ছোঁয়াতে পারেন।’
‘না। ওকে।’
‘উঠি স্যার।’
‘অনেক দূর থেকে এসেছ। এক কাপ কফি খেয়ে যাও।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি কফি খাই না।’
‘তা হলে অন্য কী খাবে?’
‘কিচ্ছু না।’
তুমি বসো, আমি দেখি, এই বলে হাসান ভেতরে যেয়ে কিছু সময় পর দু’টো প্লেট হাতে করে ফিরে আসে। একটায় দু’পিচ কেক। অন্যটায় কয়েকটা চকলেট। প্লেটটা রুবীর সামনে টেবলে রাখতে রাখতে হাসান বলে, কোনো বাসা থেকে খালি মুখে যেতে নেই।
ধন্যবাদ স্যার। না ভাবলাম বাসায় ম্যাডাম নেই। আপনার কষ্ট হবে। রুবী ওড়নার আঁচল খুটতে খুটতে বলে।
কষ্টের অপর নামই তো জীবন। এই যে তুমি কষ্ট করছো না? আচ্ছা, গুলশান বলছিলÑতুমি নিজের আয় দিয়ে পড়াশুনা করছ। একটা ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছ।
রুবী হাসানের একথার কোনো জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে থাকে।
আরে লজ্জা কিসের! কোনো কাজকেই হালকা করে বা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কাজ তো কাজই। তাছাড়া তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়াশুনা করছ, এটাতে ভাববার কী আছে। আরও মুখ উঁচু করে বলবে নিজের পড়ার খরচ নিজে যোগার করছ।
হাসানের একথায় রুবী মুখ তুলে বলে, স্যার আমার বাবা তো কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেন না। প্রতি মাসে আমার মামা কিছু পাঠান আর আমাদের স্কুলের হেড মাষ্টার স্যার কিছু পাঠান। বাকিটা আমার টিউশনি আর এই শাড়িটাড়ি বিক্রি করে যা হয়।
রুবীর একথা শুনে হাসানের মন নরম হয়। হাসান বলে, শোন, কখনও মন খারাপ করবে না। কোন কাজই ছোট না। শোন তয়, আমি আমার স্কুল-কলেজ জীবনে প্রায় ছ’বছর বাসায় বাসায় পেপার বিলি করেছি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, বাসায় বাসায় পেপার পৌঁছে দিয়ে, তারপর ক্লাসে যেতাম। এতে আমার কোনো লজ্জা ছিল না। এখনও নেই। আমার বাবাও তোমার বাবার মতো গরীব ছিলেন। আমার লেখাপড়ার খরচ দিতে পারতেন না।
হাসানের একথা শোনার পর রুবীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে, স্যার ওই বয়সে আপনি জীবনকে বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আজ এতবড় হতে পেরেছেন।
‘ঠিক তাই। তুমিও একদিন বড় হবে।’
একথা বলে হাসান কী যেন ভাবে। কান চুলকায়। তারপর বলে, ঠিক আছে শাড়িগুলো দেখাতে চেয়েছিলে, দেখাও। আর তোমার পছন্দ মতো পাঁচটা শাড়ি রেখে যাও। আমি তোমাকে চেক লিখে দিচ্ছি।
হাসানের একথা শুনে রুবীর চোখ-মুখ সকালের কাঁচা রোদের মতো ঝলমল করে ওঠে। ও খাওয়া রেখে ব্যাগ খুলতে যায়।
হাসান বাঁধা দিয়ে বলে, আরে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আগে কেক খেয়ে নাও। আর চকলেটগুলো পকেটে ঢোকাও। রুমমেটদের দিও।
লজ্জা ও আনন্দ মিশ্রিত একটা আদল ফুটে ওঠে রুবীর সাড়া মুখে। রুবী বুঝতে পারে, স্যারের এ ধরণের একটা অতীত আছে দেখে, বিষয়টাকে এতসহজ, এতআন্তরিক ভাবে নিয়েছেন।
রুবী একটা কেকের অর্ধেকটা খেয়ে বলে, স্যার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তবে আমাকে যদি বানাতে দেন, তবে।
‘তুমি যে বললে কফি খাও না।’
‘একেবারে খাই না বললে, ভুল বলা হবে। মানে, পরিবেশ পরিস্থিতি ফেবারে থাকলে মাঝে মধ্যে খাই। তখন খাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক বেড়ে যায়। দমিয়ে রাখতে পারি না।’
‘তা হলে বলতে চাচ্ছো, পরিবেশ এখন তোমার ফেবারে?’
রুবী একথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলে,স্যার, যতই সময় যাচ্ছে, যতই আপনাকে দেখছি, ততই আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে।
হাসান রুবীর একথার কোনো উত্তর দেয় না। দেয় না মানে, কী বলবে খুঁজে পায় না। কয়েক সেকেন্ড দু’জনই নিরব থাকে। পরে নিরবতা ভেঙে রুবী বলে, স্যার কফি বানানোর অনুমতি দিলেন তো?
‘যাও, কিচেনে সব কিছু আছে। কফি এখন আমি নিজেই বানিয়ে খাই। মিতু যাওয়ার সময়, কাজের মেয়ে হাসিকে ছুটি দিয়ে গেছে। আমি একা থাকবÑতাই।
একথা বলে হাসান একটু মৃদু হাসে।
কথার অর্থ রুবী বুঝতে পেরে, রুবীও চোরা হাসি হাসতে হাসতে রান্না ঘরে যায়। চার মিনিটের মাথায় রুবী এককাপ কফি বানিয়ে এনে হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। হাসান তখন একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে কফির কাপটা নিয়ে বলে, তোমার কফি?
‘স্যার এককাপই বানিয়েছি।’
‘কেন?’
‘স্যার, আপনার সামনে বসে কফি খেতে আমি পারব না, তাই শুধু আপনার জন্য বানিয়েছি।’
‘আমার সাথে বসে কফি খেতে লজ্জা কিসের! তোমাকে তো বললাম। তুমিও ব্যবসা করছো। আমিও ব্যবসা করছি। শুধু তোমারটা একটু ছোট, আমারটা একটু বড়, এই যা পার্থক্য।
হাসান একটু থেমে, কফির কাপে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, ঠিক আছে, কফি না খাও, তোমার ব্যাগে যে লেডিস ওয়াইন আছে, ওটা বের করো। আমরা দু’জনে একটু খাই।
রুবী হাসানের কথা শুনে, হা করে হাসানের দিকে চেয়ে থাকে। চট করে ব্যাগটা খুলতে পারে না। ওর হাত কাঁপতে থাকে।
পদাবলি : ০১
শুধু তোমাকে ভালোবাসি
রৌদ্র রাকিব
বহুবার বলেছি; বহুকাল অপেক্ষা করেছি;
বহুদিন দেখেছি; বহুবার কতকথা শুনেছি;
শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে।
তবুও ভালো আছি; তবুও বেঁচে আছি;
তবুও হাসিখুশি আছি; তবুও সুখে আছি;
শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
তুমি চলে যাও- তুমি ভুলে যাও!!
তুমি কিছু রেখে যাও- তুমি হারিয়ে যাও-
শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
চলে যাবো
মাসুদ পারভেজ
তোমাদের এই ঝঞ্ঝাট জমকালো কৃত্তিম কোলাহলপূর্ণ শহর ছেড়ে চলে যাবো,
চলে যাবো তোমাদের দেয়া কবি নামের এক অভিশাপ নিয়ে
জানো তো, কঠিন দুঃখবোধ না থাকলে নাকি কবি হওয়া যায় না,
আমি আজীবন সে প্রয়াস চালিয়ে যাবো।
যদিও তোমাদের প্রতি অনেক অভিযোগ আছে আমার, অনেক কথা বলবার আছে;
বলবার আছে- তোমাদের শহরে পাখিদের ঠাঁই নেই, বৃক্ষ নেই, সহস্র মানুষের ভেতর একটিও মানুষ নেই।
সুন্দরী অনেক ললনা আছে একটিও প্রেমিকা নেই,
অনেক অনেক প্রেমিকা আছে একটিও প্রেম নেই।
অনেক পুরুষ আছে কিন্ত একজনও বিশ্বস্ত সঙ্গী নয়।
তোমাদের শহরে সবুজ বিছানি নেই আছে চকচকে মার্বেল পাথরের অহংকার।
পুকুরের বা নদীর ঘোলা পানি নেই আছে পিত্তরংয়ে সুইমিংপুল।
তোমাদের দালানগুলো আকাশ দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা এখন চরমে।
বলবার আছে তোমাদের শহরে গণহারে মানুষ মেরে গণতন্ত্রের চর্চা হয়
নারীর যৌনতার আবাদ করে নারীবাদের চর্চা হয়।
বেতনধারী স্বীকৃত বুদ্ধিজীবীদের পানশালা হয় রাজদরবারে।
চলে যাবো এই কাগজে প্লাস্টিকে মোড়ানো শৌপিচের অভিনয় ছেড়ে।
তোমাদের কুকুরগুলো নাকি নবজাত মনিষ্যপুত্রেরও বেশি আদর অভিলাষ নিয়ে লালিত হয়।
তোমাদের অভিজাত শোবার ঘরে, বারান্দায় কুকুরের আশ্রয় থাকতে পারে একজন কবির নয়।
তোমাদের দালানের ছাদে বায়োপ্ল্যাগে মৎসকুলের অভিশাপ নিয়ে আমি এক মুহুর্তও থাকতে চাই না।
আমি সবুজ পাতার ফাঁকে বেরিয়ে আসা একমুঠো রোদ্দুরের জন্য চলে যাবো,
ঝিলে ফোটা রক্তকমলের পাশে মিটিমিটিয়ে হাসা একটুকরো চাঁদের জন্য চলে যাবো।
চলে যাবো ছাগলছানার তিড়িং-বিড়িং নাচের খোঁজে অথবা গরু বাছুরের নিষ্পাপ চাহনির জন্য।
নীল আকাশের তলে দলে দলে পাখির ডানা মেলা সুন্দরের জন্য
চলে যাবো সবুজের আঁচল ছিঁড়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নদীর জন্য।
চলে যাবো সোঁদামাটি, পলিমাটির গন্ধে ভরা মানুষের কাছে,
চলে যাবো একটি স্নিগ্ধ বিকেল এর কাছে
চলে যাবো শিশির ভেজা একটি সকালের কাছে
চলে যাবো একটি সুন্দর নিশ্চুপ নিশ্চল নিষ্পাপ পৃথিবীর কাছে।
প্রেমিক বলতে এখনো তোমাকেই বুঝি
রফিকুল নাজিম
অনেকদিন হয় তোমার নাগাল পাই না
কই পালাইছো?
আমাদের এইদিকে কি আর আসো না?
কেরামতের টং দোকানের চায়ের তৃষ্ণা মিটে গেছে
তোমার রং চায়ের নেশাটা কেটে গেছে?
আজকাল কি তবে দুধ চায়ে ঠোঁট ভিজাও?
জানো?
এখনো সেই শালিকটা বিকেলে আমার বারান্দায় আসে,
রেলিংয়ে বসে। তারপর আমার চোখে মায়া মেখে দেয়
আমি এটা ওটা খেতে দেই,
শালিকটা ঠোঁট বাড়িয়ে খায়।
আহা! উড়াল পাখিটাও আমার পোষ মেনেছে;
কেবল তোমাকে আমার বশে আনতে পারিনা,
কেবল তুমি আসো না,
কেন্ আসো না, নাগর?
অথচ আমি নিয়ম করে বারান্দায় আসি
আড়চোখে ইতিউতি তোমাকে খুঁজি
তবুও কোত্থাও তোমাকে আর পাই না।
আচ্ছা-তুমি কি এখন অন্য মহল্লায় যাও
হাতে ফুল নিয়া কি অন্য গলিতে দাঁড়াও
অন্য কোনো বারান্দার দিকে বিড়ালের মত মুখ দাও?
চুকচুক করো?
কার জানালার পর্দা গলিয়ে অন্দরমহলে চোখ বাড়াও?
অথচ আমার চোখ কেবলই তোমাকে খুঁজে...
আকুলিবিকুলি মনটা তোমাকেই প্রেমিক মানে;
অন্য কোনো সিটি প্রেমিক সে খোঁজে না
প্রেমিক বলতে এখনো সে শুধু তোমাকেই বুঝে।
স্বকীয়তা হারিয়ে
জহির খান
ঝড়ের বেগে চলছে সময়
অসমাপ্ত গল্পের পিছনে
তবুও নিষ্ঠুর গল্পের নায়ক
দেখার চেষ্টাই করলো না তোমাকে!
পদাবলি : ০২
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর
রিয়া সাহা অর্পা
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর কিনেছি তো জন্মতেই,
ধরা যখন খুব ক্লান্ত নিয়ে আমায়,
ঠাঁই সে ঘরেতেই,
অতলে একলা কায়া আমার ,
ভবঘুরে আত্মা খুঁজে চেনাজন না পায় ।
নাই প্রদীপ,
তো অন্ধকার-ই বা কই !
চিৎকার নেই কাঠের বাক্সের বাইরে,
অন্দরে নিস্তব্ধ সংসার।
আধভেজা হয় না মাটি ,
আসে না দ্বারে কেও !
আসে তো অতীত !!
ডাকে আমারে,
ফুসরত নাই একলা সঙ্গের !
দেখো তবে সঙ্গ দেয় আজ কে তোমারে !!
এলোমেলো চুল, ফ্যাকাশে দাগ
মা দেখলে শাসনে টেনে নিতো আঁচলে।
অচেতন মন,
কোথায় গেল শত নিয়ম !
বাবা থাকলে রাগ করতো বেশ করে।
প্রিয় যদি আজ কথা মিটাতে আসেই-বা,
গভীর অতলে দেখেও দেখে না আমারে।
নিসর্গ ঘরখানা আঁকড়ে ধরে বলে,
শান্তির ঘুম দাও, রজনী !
কায়াও যে থেকে যাবে ধরণীর-ই।
অনন্তকাল নয় সকল তা তো তুমি জানতে !
আপন আমার,
নিঃশেষ চিহ্ন অক্ত ,
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর !!!
আমার অজানা অন্বয় !!
ধাওয়া
সুজন আরিফ
অঘোষিত সিস্টেম দাঁড়িয়ে যায়
কার ইশারায়?
পুঁজির মিছিল বের করে
কেউ লুকিয়ে কেউবা বন্দনায়।
শতভাগ জয় নিয়ে ঘরে ফিরে ঈশ্বর
নেই কোনো হাওয়া
আহা! মানুষ সন্ধ্যার মত মরে যায়
খেয়ে রাত্রির ধাওয়া।
উদয়াস্ত
সেলিম খান
সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আমিও যাবো।
শুধু সময়ের অপেক্ষা।
পাখিরা সারাদিন ঘুরে ফিরে একসময় তার আপন নীড়ে ফিরে যায়,
শুধু জেগে থাকে নিশাচররা।
আমিও আমার আপন নীড়ে যাবো,
অবশ্যই যাবো, সময়টা আসতে দেও।
তখন হয়তো তোমার অপেক্ষা করে,
কফির মগটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করা হবে না।
কে জানে ওখানে কফির ব্যবস্থা আছে কিনা?
থাকতে পারে, জানা নেই।
আমি চলে গেলে পৃথিবীর ভার কমবে না হয়তো,
আমার জায়গা দখল করবে অন্য কেউ।
হয়তো পৃথিবীর ভার কমার নয়।
আমি অস্ত যাবো নিশ্চিত, আজ হোক, কাল হোক, কিংবা পরশু।
এসেছে নতুন সূর্য জায়গার অভাবে করছে আনছান,
আমি বরং অস্ত যায় বাঁচুক নতুন প্রাণ।
ব্যবধান ভুলে হৃদয়ের চাওয়া
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ
অনেক ব্যবধান মধ্যিখানে..
তুমি অনেক দূরে নাগালের বাইরে
কুয়াশাবেদে মেঘপুঞ্জ সপ্তআকাশ ওপরে
তবু.. ডাকলেই যেন কাছে পাই
একান্ত নিভৃতে নিরবে কথোপকথনে।
প্রতিরাত তুমি খুব কাছাকাছি আছো..
ব্যবধান ভুলে হৃদয়ের চাওয়ায়। মন
থেকে মনের গভীরে...খুব কাছে।
রঙহীন মরিচীকা
রুদ্র সাহাদাৎ
মানুয়ের ভিড়ে থেকেও আজও মানুষ চিনি না
জীবন জীবন চিল্লাতে চিল্লাতে জীবনের অর্ধেকই কেটে গেলো অজান্তে কেউ জানে না
প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে দেখি রণক্ষেত্র, যে যার মতন গন্তব্যের সন্ধানে ছুটছে
মুখোশের মেলায় হাট বসে রঙিণ আয়োজন
মাঝেমধ্যে সব কিছু অচেনা লাগে ফ্যাকাশে চারিধার রঙহীন মরিচীকা
কেমন করে বেঁেচ থাকছি,কেউ জানে না ।
গল্পের শুরু এখানেই...
গল্পের শুরু এখানেই...
ইয়াকুব শাহরিয়ার
আজকে টিউশনিতে যাবো না। ভালো লাগছে না। ভাবি ফোন দিলেন। ভাবি মানে- স্টুডেন্টের মা। যে ছাত্রকে পড়াই তার মাকে ভাবি ডাকি। তিন বছর ধরে পড়াই। কেজি টু’তে পড়ে। ফোন পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরক্তির ছাপ মুখে নিয়ে উঠে যাই। বাসা থেকে বেড়িয়ে রিকশার অপেক্ষা করছি। অফিস থেকে ফোন এলো। সন্ধ্যায় বসের ফোন পেয়ে পিলেচমকে উঠার মতো অবস্থা। আরেকটা অফিসে চাকরি করি। আমার মূল পেশা চাকরি। টিউশনি না। ভাল লাগে তাই করি। দরকারি কাজে অফিসে যেতে হবে। অফিস আমার বাসা থেকে বেশ দূর না হওয়ায় হেঁটেই চলে গেলাম। একটা হিসাব বসকে বুঝিয়ে দিয়ে টিউশনিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
অফিস থেকে বের হতেই রিকশার ড্রাইভার একজন বলল- মামা কই যাবেন? রিকশা পেয়ে যাই। রিকশাতে চড়ে বসে টিউশনিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বাসায় ঢুকতেই দেখি আবির বসে পড়ছে। আবির আমার ছাত্রের নাম। তিন বছরে একদিনও দেখিনি আমি আসার আগে এভাবে পড়তে বসেছে। কিছুটা অবাক হলাম। আমি ঢুকতেই আবির বলল- গুড ইভেনিং স্যার। রিপ্লাই দিয়ে কিছু বলতে না বলতেই মনোযোগ অন্যরুমে গেলো। চিকন গলায় কে একজন বলছে- এমন টিচার বাবার জন্মেও দেখিনি। নিজের ইচ্ছা মতো আসেন। দায় দায়িত্ব বলতে কিছু নাই। কি দরকার উনাকে রাখার। দেশে আর টিচার নাই, নাকি? বলতে বলতে এদিকেই আসছে। কাছে এসে বলছে- আবির, আজ তোর বাবাকে বলবি টিচারকে...... বলতেই আমার সামনে এসে হাজির। হাতে হরলিক্সের গ্লাস। তবে তাতে হরলিক্স আছে বলে মনে হয় নি। কারণ আবির হরলিক্স খায় না। সে চা খায়।
আমাকে দেখে থমকে গেলো মেয়েটি। কোনো কথা নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হরলিক্সও দিচ্ছে না। আবির বললো- সোনামনি, দিবে? গ্লাসটা দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো। আমার চোখ ছানাভরা! চিপচিপা গড়নের আরো মেয়ে দেখেছি, এতো সুন্দরি দেখিনি। চমৎকার চোখ, মুখ, চুল আর কণ্ঠ। আমিও কিছু বলিনি। শুধু মুচকি হাসছিলাম। এতোক্ষণে বুঝে গেলাম যে, সে ভাবির বোন। মানে আবিরের খালা হয় সম্পর্কে। সোনামনি ডাকে আবির। অনেক প্রশংসা শুনেছি সোনামনির।
কিছুক্ষণ পড়িয়ে নিলাম আবিরকে। তার মা চা নিয়ে আসলেন। সাথে সোনামনি। আবিরের আম্মু হাসছেন। ভদ্র মহিলা খুব ফ্রিয়ার। ভাল। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন- ও হচ্ছে কুসুম। আমার ছোট বোন। এমসি কলেজে গনিতে অনার্স করছে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। তার কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। ও এরকমই। তিনি চলে গেলেন। কুসুম সরি বললো। বললাম- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আমু। কিসে পড়ছেন, সিলেটে কোথায় থাকা হয় এরকম কথায় কথায় অনেক কথা হলো। আবির আমার আর কুসুমের মুখের দিকে বার বার তাকাচ্ছিল আর হাসছিল।
সমাজকল্যাণ ভূমিকায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)...
সমাজকল্যাণ ভূমিকায়
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন
মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন । জীবন ব্যবস্থার মহান আদর্শ শিক্ষক ও মডেল হিসেবে অবিস্মরণীয়। মহানবী (সা.) মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ প্রেরিত পুরুষ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে সর্বোত্তম শিক্ষক ও আদর্শ মানব হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি এ জীবন ব্যবস্থা প্রচার করেছেন, শিক্ষাদান করেছেন, নিজে এর অনুসরণ ও প্রয়োগ করে নমুনা স্থাপন করেছেন। সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি, কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন যা কেয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্বর ও অমলিন থাকবে। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘‘হে নবী আপনি নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত’’। আর মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আদর্শ তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ২১)।
রাসূল (সাঃ) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একটি সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন ও উন্মুক্ত পরিবেশে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন তা-ই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। সমাজকল্যাণে মহানবী (সা) কর্তৃক গৃহীত কিছু ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা।
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা) এর প্রধান কর্মসূচি ছিল নৈতিক ও কল্যাণমূখী শিক্ষার বিস্তার । শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন সে যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় এ যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয়ে থাকে। রাসূল (সা.) শিক্ষাদানের মাধ্যমে অজ্ঞতাকে দূরীভূত করেন। তিনি জ্ঞানার্জন করাকে বাধ্যতামূলক করেন। কারণ বিদ্বান বা জ্ঞানীরাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। নৈতিক ও কল্যাণমূখী শিক্ষার মাধ্যমে একটি চরিত্রবান জাতি উপহার দিয়েছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা)।
রাসূল (সা) একটি সুন্দর ভারসাম্য অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়ন করে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক উন্নয়ন তথা ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে একটি উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে গেছেন। আর সুদমুক্ত সমাজ গড়তে সুদ প্রথা বিলুপ্ত করেন। সুদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আজকের বিশ্বে বিরাজ করছে অস্থিরতা, ধনী-গরীবের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি। রাসুল (সা) সুদ দেয়া, নেয়া এমনকি সুদের দলিল লেখক ও সাক্ষীকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা দিলেন। তিনি আরো বলেন, সুদের ৭০ টিরও বেশি গুণাহ আছে। তার মধ্যে নিম্নেরটি হল নিজের মায়ের সাথে জিনা করা।
রাসূলে পাক (সা) সমাজে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সমাজে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজকের সমাজের অর্থনৈতিক মেকানিজম হল যাকাত ব্যবস্থা চালু করা। রাসূল (সা.) বলেছেন- নিশ্চয় আল্লাহ সাদাকাহ ফরজ করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দারিদ্র্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। যাকাত আদায় ও বটনের মাধ্যমে আয় বৈষম্য দূর হয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অভাব-দারিদ্র মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
সমাজে নবী করীম (সা) শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কেননা শ্রমিকরা তাদের শ্রমের মাধ্যমে সমাজে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাই রাসুল সাঃ এর নীতি ছিল মনিব ও শ্রমিকের সম্পর্ক হবে ভাইয়ের সম্পর্ক। এখানে শ্রেণী সংঘাত, শ্রেণী সংগ্রাম কিংবা শ্রেণী বিদ্বেষের কোন সুযোগ নেই। শ্রমিকদের অধিকারকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে তাদের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই ন্যায্য পাওনা আদায় করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রাসূল (সা.) শ্রমজীবিদের অধিকারকে নিশ্চিত করেছেন। শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) এমন পরিমাণ ভাতা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন যদ্বারা সে নিজে ও তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করা চলে। মহানবী (সা.) বলেন: মজুর ও শ্রমিকের খাদ্য ও বস্ত্র দিতে হবে মালিকের তথা রাষ্ট্রের।
সমাজকল্যাণের জন্য সুষম ব্যবসায় নীতি প্রণয়ন করেন। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা অবলম্বন করতে এবং সর্বপ্রকার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সুসংবাদ। অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৫২; সুনানে দারেমি, হাদিস : ২৫৩৯)
মহানবী (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহকে ভয় করে এবং ব্যবসায় সততা ও সত্যবাদিতা অবলম্বন করে তারা ব্যতীত কিয়ামতের দিন অন্য ব্যবসায়ীরা পাপিষ্ঠ রূপে উত্থিত হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২১০; ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২১৪৬)। এক হাদিসে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন উপার্জন সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং নিষ্ঠাপূর্ণ বেচাকেনা।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭২৬৫; মিশকাত, হাদিস : ২৭৮৩)। কাতাদা (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ব্যবসা করে, তার জন্য ব্যবসা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক ও হালালকৃত একটি বিষয়। (আস-সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি, হাদিস : ৫/৪৩২)
মূল্যবৃদ্ধির আশায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুদ রাখাকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। ইহার বিরুদ্ধে রাসূল (সা.) ঘোষণা করেছিলেন- মহানবী (সা.) আরো ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী’ (মুসলিম)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ আরো বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে’ (ইবনে মাজা)। নবী করিম (সা.) মজুদদারকে কঠোর শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন, ‘যে মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দূরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন’ (ইবনে মাজা)।
মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী মজুদদারদের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ করবে তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ নবীজি আরো বলেছেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট’ (মিশকাত)।
পণ্যের ত্রুটি প্রকাশ করার গুরুত্ব দিয়ে রাসুল সাঃ বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি দোষযুক্ত পণ্য বিক্রির সময় দোষ প্রকাশ করে না ফেরেস্তারা তার উপর অভিশাপ দিতে থাকে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা না করার জন্য সতর্ক করে দিয়ে রাসুল সাঃ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি (বেচা-কেনায়) ধোঁকা দিবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়!
এমনিতেই মিথ্যা শপথ করা মারাত্মক গুণাহের কাজ। তার ওপর ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর নিষেধাজ্ঞা আরো বেশি। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে অন্যের হক সংশ্লিষ্ট থাকে। হযরত আবু যর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদেরকে মার্জনা করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল তারা কারা? তারা তো বড় বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা হলো অনুগ্রহ করার পর তা প্রকাশকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। অতঃপর রাসূল (সা.) এই আয়াত পড়েন। (মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ ২৪৩)। অপর এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা দ্বারা কারও হক নষ্ট করে সে নিজের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত করে নেয়। তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। বর্ণনাকারী আরজ করলেন, যদি বিষয়টি সামান্য পরিমাণে হয় তবুও? উত্তরে তিনি ইরশাদ করেন, তা গাছের একটি তাজা গাছের ডালই হোক না কেন।’
ব্যবসার ক্ষেত্রে সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা উচিত। রাসূল (সা.) বলেন, শপথ পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে ঠিক, কিন্তু তা ব্যবসার বরকত নষ্ট করে দেয়। অপর বর্ণনায় আছে ‘তোমরা বেচাকেনার ক্ষেত্রে অধিক শপথ থেকে বিরত থাক, কেননা তা পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও বরকত নষ্ট করে দেয়।’ (মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ ২৪৩)
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা) এর অন্যতম কর্মসূচী হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধ। সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদে জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এ জঘণ্য অপরাধ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার ব্যাপারে রাসুল সাঃ এর নীতি ছিল অতুলণীয়। তিনি পরকালিন শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষদের দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। ঘুষের লেনদেন করে কাজ করিয়ে নেয়া বা দেয়ার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত রসূল (স.) বলেন, ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামে যাবে (তাবারাণী)। হযরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত অন্য হাদীসে আছে যে, ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়কেই রসূল (স.) লানত করেছেন (আবু দাউদ)। হযরত ছাওবান (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রসূল (স.) ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা এবং ঘুষের দালাল সকলের ওপর লানত করেছেন (আহমদ তাবারানী)।
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা) কর্তৃক আরেকটি কর্মসূচী হচ্ছে মদ ও জুয়া নিষিদ্ধকরণ। মদ ও জুয়া সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এটা পরীক্ষিত যে, মদ-জুয়া স্ত্রী-স ন্তান, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শীর মধ্যে সম্পর্কের ভীত নষ্ট করে দেয়। মদ ও জুয়া মানুষকে কা-জ্ঞানহীন করে তোলে। মানুষকে ব্যক্তিত্বহীন হতে বাধ্য করে। মদ ও জুয়ার কারণে আর্থিকভাবে দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে এমন নজির অসংখ্য। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রাসুল সা.) লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে আছে মহা পাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; কিন্তু এগুলোর পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২১৯)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ওহে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর হচ্ছে ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কারসাজি। সুতরাং তোমরা এসব বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার (মায়িদা ৯০)।
আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ, ‘নিশ্চয় শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বিরত রাখতে চায়; তবু কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না (মায়িদা ৯১)।
মদ ও জুয়া সম্পর্কিত আল্লাহ পাকের দেয়া বিধানকে কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে রাসুল সাঃ তৎকালীন সময়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন , ‘নেশা জাতীয় যে কোনো দ্রব্যই মাদক। আর যাবতীয় মাদকই হারাম। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মাদক সেবন করে, অতঃপর নেশাগ্রস্থ অবস্থায় মারা যায় এবং সে তওবা না করে, আখিরাতে সে মদপান করা থেকে বঞ্চিত হবে (মুসলিম :২০০৩)।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলো ইলম লোপ পাবে, অজ্ঞানতার প্রসার ঘটবে, মদ্যপান ও মাদকের বিস্তার ঘটবে, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খ-, হাদিস: ৮০)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মাদক ও নেশা পান করো না। কেননা, এটা সব অপকর্ম ও অশ্নীলতার মূল (ইবনু মাজাহ, ৩৩৭১)।’
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা) এর অন্যতম কর্মসূচির মধ্যে সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরোধের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ উপহার দিয়েছেন। ইসলাম কখনোই হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না। রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, “কবীরা গোনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।” [বুখারি : ৬৮৭১, মুসলিম : ৮৮]
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, একদল ভিন্ন মতের ওপর দিনের পর দিন অস্ত্রাঘাত কিংবা নির্যাতিত করে যাচ্ছে। এমনকি বিনা দোষে দিনের কারাগারে বন্দী রাখা হচ্ছে। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) ওপর অস্ত্র উঠাবে, সে আমাদের (ধর্মের) দলভুক্ত না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮৪৪)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো মুসলমানের হত্যার চেয়েও অধিক সহনীয়।’ (নাসায়ি শরিফ, হাদিস : ৩৯৯২)
চারিত্রিক সংশোধনের মাধ্যমে সন্ত্রাস নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্ত করার জন্য রাসুল সাঃ এর নীতি ছিল অসাধারণ। সন্তানদের চরিত্র গঠনে মাতাপিতাকেই বেশি দায়িত্ব দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাথে সম্মানবোধের মাধ্যমে আচরণ কর এবং তাদেরকে আদব ও মূল্যবোধ শেখাও।’
সমাজে তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ছিল অনন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা দূরীভূত করে শান্তিপূর্ণ একটি কল্যাণমূলক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে সুপথে রাখা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত রাখার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলেন হিলফুল ফুযুল নামক একটি সংগঠন। যা বিশ্ববাসীর জন্য অনন্য শিক্ষা।
শাহেন শাহ !
শাহেন শাহ
নন্দিনী আরজু রুবী
ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো শাহেন শাহর চোখে পড়ছে। বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে পাশ ফিরলো। অনেক রাত অবধি ঘুম হয়নি, খিদেয় ছটফট করেছে। কাজ নাই, কাল দুপুর থেকে শুধু পানি খেয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না, পিপাসা পেয়েছে খুব ইস্টিশনের কলটাও নষ্ট, শূন্য বোতল পানি আনতে যেতে হবে দূরে। পেটের ভিতরে ক্ষুধার জ্বালায় চো-চো করছে। ঠিক সেই সময় আকালীর ডাক, ‘গুরু ওঠো বেলা বেড়েছে, আর কত ঘুমাবে।’
চোখ কোচলে উঠে বসলো শাহেন শাহ তার আধ ছেঁড়া প্যান্টের দড়ির গিঁটটা আর একটু কষে বেঁধে নিলো। পেটে খাবার নাই ঢিলে হয়ে গেছে।
আকালী বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল ‘কও তো গুরু, কী খবর আছে?’
জানিনে, ‘তুই বল।’
ওই যে মাঠের ওপাশের গ্রামে আজ বিয়ের মেজবানি, যাবে?
শুনেই শাহেন শাহর খিদে বেড়ে উঠলো, দোনোমোনো করে বললো ‘হ্যাঁ যাবো, চল যাই দুজনে।’
এটা রাজশাহীর সীমান্তবর্তী ছোট একটা ইস্টিশন ‘বীরকুৎসা’ ভিড় নাই চারিদিকে খোলা, মাঠের পর মাঠ ধানের আবাদ। কিছুদুর গেলেই দেখা যায় বিশাল পরিত্যক্ত হাজারদুয়ারি বীরকুৎসা রাজবাড়ী। এরপরে আর একটা ইস্টিশন আছে তার পরেই ভারতের সীমান্ত।
প্রতিদিন একটা ট্রেন যাতায়াত করে। এখানে রুটির দোকানে কাজ করে শাহেন শাহ। দোকানের মালিক আকবর আলি গরীব মানুষ দোকানের যৎসামান্য আয় দিয়ে কোন মতে সংসার চলে। শাহেন শাহ নাম তার দেওয়া।
আকালী চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটে।
সকালে ট্রেন যাওয়ার সময় যাত্রীরা রুটি সিঙাড়া চা খায় তাতেই কোনমতে এখানকার দোকান চলে। মাত্র তিনটে দোকান দুটো চা আর এটাতে রুটি সিঙাড়া বিক্রি হয়।
বেশ কিছুদিন ট্রেন বন্ধ তাই দোকানও বন্ধ। খাবারের খুব কষ্ট।
শাহেন শাহ শূন্য দোকানে রাতে ঘুমায়। দুদিন খাবারের কোন জোগাড় নাই। কদিন আকবর আলি খাবার দিয়েছে, এখন আর পারছে না।
তার অন্যকোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নাই, এখানে ছোট্ট ইস্টিশনে মায়াপড়ে গেছে। নিজের ঘর বাড়ি বাবা-মা কোন ঠিকানা জানা নাই।
সুবোধ শান্ত চেহারা মায়াবী মুখ শাহেন শার, বড় বড় চোখে সারল্য গলায় মাশাল্লাহ দারুণ সুর। আগে ট্রেনে গান গাইতো যাত্রিরা খুশি হয়ে যা দিতো তাতেই চলে যেতো। এই ইস্টিশনে এসে একেবারে থেকে গেছে, ভেসে বেড়াতে আর ইচ্ছে করে না। আকালীও শাহেন শাহর মতো তারও কেউ নেই। ইস্টিশনে অন্ধ এক ভিক্ষুকের সাথে ভিক্ষে করতো। সে মারা যাওয়ার পরে চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে। দুজন প্রায় সমবয়সি সবে কৈশরে পা দিয়েছে।
সাতপাঁচ ভাবার সময় নাই, রংচটা গেঞ্জি তালি দেওয়া প্যান্ট আর খালি পায়ে দুজনে হাঁটা শুরু করলো, আজ খুব গরম, রোদের তেজ চড়চড় করে বেড়ে উঠছে। তাতে আবার দুদিন দুজনের পেটে দানাপানি কিচ্ছু জোটেনি।
চারিদিকে সবুজ চারা ধানে মাঠ ভরে আছে। কোনো গাছ নাই ছায়াহীন খেতের সরু আলপথ ধরে হেঁটে চললো সটকাট। রোদে কাদামাটি থেকে ভাপ উঠছে ভ্যপসা গরম। পেটের খিদে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চললো। মনে আশা গেলে কিছু খাবার জুটবে।
মাঠ পেরিয়ে ঘামে ক্লান্ত শ্রান্ত দুই কিশোর মেজবান বাড়ির প্রায় কাছে এসে পৌঁছালো। দূর থেকেই ভাত আর মাংসের ঘ্রাণ নাকে ঝাপটা দিলো। পেটের ভিতর রাক্ষুসে ক্ষুধাটা নড়েচড়ে জাকিয়ে বসলো। শাহেন শাহ প্যান্টের দড়ি আর একপ্রস্থ টাইট করে নিলো। দুজনের চলার গতি শ্লথ হয়ে গেছিলো। খাবারের ঘ্রাণ তাদের শক্তি এনে দিলো। ক্ষুধার্ত দুজনের চোখাচোখী হতেই হাসি উপচে পড়ছে খুশিতে। এই খুশি আনন্দ একমুঠ ভাত খেতে পাওয়ার আশা।
হায়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্দশা মানুষকে কত অসহায় করে দেয় সে শুধু ক্ষুধার্ত কর্মহীন মানুষ জানে।
ক্ষুন্নিবৃত্তির তাড়না মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। ক্ষুদ্র কাজ অন্যায় অনৈতিক কাজ করতে দ্বীধা বোধ করে না।
বড় প্যান্ডেল ভদ্র সুবেশী লোকজন খাওয়া দাওয়া করছে। হতদরিদ্র দুই কিশোর ধীর পায়ে প্যান্ডেলের গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন খেকিয়ে উঠলো এই যা ভাগ কোথা থেকে সব ভিক্ষিরি এসে জুটেছে। যা ওদিকে...
দুজন দূরে এসে গাছের নীচে বসে রইলো। দেখছে মানুষ খাচ্ছে তাদের হাক ডাক ভাত আনো মাংস, ডাল, মাছভাজা, দই..
ক্ষুধা আর পিপাসায় কাতর হয়ে দুজন প্রতীক্ষায় বসে রইলো। তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকালো না।
উচ্ছিষ্ট এঁটোকাঁটা একজন ডালায় করে এনে ঢেলে দিয়ে গেলো পথের কুকুর গুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। শুকনো মুখে শাহেন শাহ বললো চল আকালী ফিরে যাই। এখানে খাবার দেবে না কেউ। এতোটা পথ ফিরে যেতে হবে তৃষ্ণায় কাতর আকালী বললো আর একটু দেখিনা অপেক্ষা করে! বেলা প্রায় গড়িয়ে এলো...
একটা দীর্ঘছায়া পড়লো দুই কিশোরের গায়ে, কেউ এসেছে ওদের পেছনে। খাবারের গন্ধ ছাপিয়ে একটা অন্য মা মা গন্ধ তাদের নাড়িয়ে দিলো। পিছনে তাকিয়ে দেখলো একজন মাঝবয়সি মহিলা, পরনে পুরাতন ছেঁড়া শাড়ি। আঁচলের তলে থালায় ভাত তরকারি। হয়তো এই বাড়িতে কাজ করে। মহিলা ভাতের থালা বের করে দুজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাও বাবা আহা মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।’
এই স্নেহের পরশ টুকু পেয়ে অন্য এক তৃষ্ণা জেগে উঠলো মমতা দরদ এই যে অচেনা তবুও মাতৃত্বের স্নেহময় ভালোবাসা দুজনের চোখে জল চলে এলো। শাহেন শাহ বলল, মা তুমি খাবে না।’
তোমরা দুজনে ভাগ করে খাও। আমি খাবো না বাবা।
আকালী আর শাহেন শাহ পেট পুরে খেলো। মাগো গেলাম বিদায় নিয়ে দুই কিশোর ক্ষেতের আল দিয়ে ফিরে চললো। অপরিচিত মা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো...
হঠাৎ দূরে ট্রেনের হুইশেলের শব্দ শোনা গেলো, ট্রেন চলাচল আবার শুরু হয়েছে..
দুই কিশোর খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, বাতাসে তার উল্লাস খেতের আল পথে দৌড়াচ্ছে দুহাত ছড়িয়ে একরাশ সবুজের ভিতর যেন উড়ছে..।
পদাবলি : ০১
প্রতিশ্রুতি
কামরুন্নাহার বর্ষা
হয়তো এভাবেই কেটে যাবে কয়েকটি বছর,
হারিয়ে ফেলবো কিছু প্রিয় অপ্রিয়র হাত
তবুও রয়ে যাবে কিছু ভাঁজ করা কথা
যেটা হয়েছিল কিছু অঙ্গীকার নামা চুক্তির মতো।
সেখানে হয়তো আমিও কালো মেঘে ঢেকে যাব
কোন এক অচিনপুরের কল্প কাহিনী হয়ে,
কোন ঢেউ হীন নদীর তীর ঘেঁষে হয়তো দাঁড়িয়ে পড়বো
কোন এক অকালের দৃষ্টান্তে ,
সেখানে কেবল একটাই লক্ষ্য আমাকেই কথাগুলো রাখতে হবে।
কিন্তু মাঝ পথে যদি হঠাৎ কখনো জোয়ার আসে
যদি কোন অজস্র ঝড় এসে তোলপাড় করে নেয় আমার হৃদয়ের ক্ষত,
সেদিন আমাকে বেঁচে নেওয়ার জন্য তোমরাও ছুটো অবিরত।
ছুটো আমার গন্তব্যের কুল ঘেঁষে উড়ন্ত পালক মেলে,
ভেবে নাও তোমাদের ও ছুটতে হবে আমারি মতো।
ঈদে মিলাদুন্নবী
হাফিজুর রহমান
ঈদ, মিলাদ ও নবী
এই দিনে এসেছিলেন প্রিয় মোহাম্মদ,
দ্বীনের রবি দেখেছিল মুসলিম উম্মত;
খুশির ছিলো সবি।
জাতির ক্লান্তিকালে
সত্যের আলোয় আলোকিত এই ধরণী,
দেখিয়েছে, কী করে নারীও হয় জননী;
শিশির সিক্ত সকালে।
প্রিয় সে নবীর জন্মদিনে
মুসলিমের ঘরে-ঘরে হয় আনন্দ-উৎসব,
নামাজ - রোজায় অনেক বেশী সওয়াব;
সেরা মহামানবের সম্মানে।
আমি জীবান্ত জীবাশ্ম
মোহাম্মদ আবদুর রহমান
জানি এই রঙিন পৃথিবীর মায়াবী জীবনে
তোমার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না
তবুও তোমার কথা ভুলতে পারিনা
অধিকাংশ রাতে স্মৃতির পাতায় খুঁজি তোমাকে
নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে করতে কেটে যায় রাত
আমি যেন একটি ছোট বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ
সুস্থ অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে আসে
আমার কর্মক্ষেত্রের পাশে যে দোকানে তুমি বসতে
প্রতিদিন সেই দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকি
এই বুঝি তুমি ডাকছ একসাথে বাড়ি ফেরার জন্য
কিন্তু সেই সুমধুর ডাক আর শুনতে পাই না
আলোহীন চাঁদ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি।
জানো আব্বা তুমি চলে যাওয়ার পর
আমার নাম ধরে আর কেউ ডাকে না
কোন দিন বাড়ি ফিরতে দেরি হলে কেউ ফোন করে না
বাইরে থাকলে ফোন আসলেই বুঝি তোমার ফোন
কিন্তু ভুলে যায় তোমার ফোন আর আসবে না
আর তুমি রাগবেনা কোন দিন
কেনো রাগবে?
আমি তো অনেক বড় হয়ে গেছি
সাম্রাজ্য বিহীন এক রাজাতে পরিণত হয়েছি।
তুমি চলে যাওয়ার পরে
চেনা পৃথিবীটাকে ভীষন অচেনা লাগে
মুখোশ পরা মানুষ গুলো নিজের রূপে ফিরে আসে
যে মানুষ গুলো এক সময় তোমার বন্ধু ছিল
আমি যেন মরিচিকার পিছনে ছুটছি।
সারাক্ষন ভয়ে থাকি
হঠাৎ কোন বিপর্যয় এলো বুছি
সামান্য একটু রৌদ্রের কাছে হেরে যায় বার বার
আসলে তুমি ছিলে আমার একমাত্র মজবুত ঢাল
তাই জীবন যুদ্ধে কোন দিন একা লাগেনি
অনায়াসে জয় করে ছিলাম সকল বিপর্যয়
বার বার মনে আমি জীবান্ত জীবাশ্ম।
পদাবলি : ০২
রাহুর দশা
মাজরুল ইসলাম
ভুল বুঝিয়ে এখন আবার
সে নতুন চাল চালায় মত্ত
অথচ
এই চালের ক্ষুদ্র পরিসরে
চাঁদের পাহাড় অনাবৃত শুয়ে আছে
প্রলয়ের কোল ঘেঁষে।
উথাল পাথাল যাপিত জীবন।
এসো,
আগে-পিছে যে রাহু অক্টোপাসের মতো লেগে আছে
তার গতিটা মেপে দেখি...
পঙ্গুত্ব হৃদয়
সাগর আহমেদ
ক্রমশ ভুলে যাই বেদনার রং কি?
কষ্টগুলো মনের গভীর হতে উত্তির্ন হয়ে
চোখজোড়া ভাসিয়ে বুকে এসে মরে,
মেরুদ-হীন স্বপ্নগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে
হুইলচেয়ারে বসে কত আর বেঁচে রবে
চাঁদের প্রভায় আলোকিত সমগ্র পৃথিবী
অথচ স্মৃতির বারান্দা জুড়ে গাঢ় অন্ধকার।
নিস্তব্ধ রজনীতে জোনাকিরাই সঙ্গী ছিলো,
আজ দূরের পথটার মতোই নিঃসঙ্গ আমি
বেদনার মিছিলে পথ খুঁজে পঙ্গুত্ব হৃদয়।
খেলাঘর
জাহিদ আজিম
খেয়াল বশেই তুমি বানাও খেলাঘর
খড়কুটো-স্বপ্নেতে ছাউনি গাঁথো,
প্রণয়ের সুরে ডাকো যে হেতায়
সুখ-গল্প আমাকে শোনাবে যতো!
নিরব নিশিতে নিঝুম পৃথিবীটা
মোহনীয় মুগ্ধতায় জড়িয়ে রাখো,
জোছনা ঢেলে মায়াবি জালে
এ হৃদয়ে গভীর আবেশ মাখো।
আপন আঙ্গিনায় এক্কাদোক্কা খেলো
আমাকেও দোলাও হেয়ালী মনে,
উচ্ছাসে ভাসি, বেখেয়ালে কি যে বকি!
কতো কথা উড়ে আসে গল্পের টানে।
হঠাৎ দেখি ঐ চাঁদ-মুখে গ্রহণ
আধারেই ঢেকে যায় সব আয়োজন,
হাত বাড়িয়ে খুঁজি, কেউ যে নেই!
একা ফেলে তুমি দূরে! একি প্রহসন?
ক্রিড়া-হেতু যে বায়ু বহে বাতায়নে
তাকেই তো তুমি ভাবো ভীষণ ঝড়!
যদি বাঁধন ছিড়ে এতো সহজেই
কেনো তবে বাঁধো এমন খেলাঘর?
ভাবনা বৃত্তান্ত
আকিব শিকদার
কী ভাবছো ফজলুল, কী ভাবছো বলো?
তোমার তিনটি সন্তান।
একজন ভিনদেশে, একজন সুদূর রাজধানীতে স্বস্ত্রীক, অন্যটা
সাথে থেকেও খবর নেয় না তোমার। এই তো...?
বন্ধু জাহিদ, তার মৃত্যুতে জানাজা পড়িয়েছিল
তার বড় ছেলেটা।
তোমার কী দুর্ভাগ্য, তোমার বেলা
মোল্লা আনতে হবে কর্জে। কেননা একটি ছেলেও
যোগ্য হয়ে উঠেনি।
চেয়েছো তুমি সন্তানেরা হোক বড় বিদ্বান, করুক
বংশের মুখ উজ্জ্বল, যোগাক অর্থ অঢেল।
বিনিময়ে স্ত্রী-সন্তান একত্রে বসবাসে কী যে স্বর্গসুখ
তা পাওনি কখনো।
আজকাল প্রতিবেশিদের কেউ
যখন নাতি-নাতনি নিয়ে ঘোরে, করে খেলা এটা ওটাÑ
অথবা গল্পগুজব। বড়ো লোভ হয়Ñ তাই না...?
তোমার শহুরে দৌহিত্র, গ্রামকে করে ঘৃণা, তোমাকে ভাবে
সেকেলে মানুষ...!
মানুষের ছেলেরা বৃদ্ধ বাবাকে হাত ধরে বসায় রোদে, সযতনে
করায় গোসল, যায় মসজিদে, ঈদের নামাজ পড়ে
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে; অসুস্থ হলে ছুটে হাসপাতালে।
তোমার বেলা একটা দাসী আর একজন নধর মরদ, যারা
টাকার বদৌলতে দেখায় কৃত্রিম শুশ্রুষার ভান।
কত লোকের ঔরস গোরস্তানে
হাত তুলে কাঁদে, করে কোরান পাঠ। তোমার ভাগ্যে জুটবে
এক আঁটি ফুলÑ বছরে-দু’বছরে একবার।
তোমার উত্তরাধিকার শিক্ষিত, সুতরাং ফকির খাওয়ানোতে
বিশ্বাসী নয়। মৃত্যুদিবসে তারা
করবে বাদ্য-বাজনার আয়োজন...! যা চাওনি তুমি।
কী ভাবছো ফজলুল, জীবন সায়াহ্ণে কী ভাবছো বলো...?
মাওলার সান্নিধ্য...
মাওলার সান্নিধ্য
সুলতান আহমদ
আনমনে বসে আছি পুকুর পারে। ধান ক্ষেতের সবুজ। নীলাভ আকাশ। মেঘের লুকুচোরি। হিমেল বাতাস। প্রাণ জুড়িয়ে দেখছি আকাশ। অশান্ত হৃদয়। কিসের যে বড্ড অভাব!
মনে হলো সুহাসের কথা। আহা! পাহাড়সম ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে। তার চেয়ে তো আমি হাজার গুণ ভালো। আল্লাহ আমায় ভালো রেখেছেন। সেদিন হঠাৎ বাজারে দেখা। উদ্ভ্রান্ত, উদাস। সুহাস, তুই বেঁচে আছিস? কোনো খুঁজ-খবর নাই। অনলাইন-অফলাইন কোথাও পাওয়া যায় না। ব্যাপার কি?
চল, চা খেতে খেতে গল্প করি। বাজারে আমার পরিচিত এক রেস্তোরাঁ আছে, নিরিবিলি। একপাশে গিয়ে বসলাম। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। তার মন খারাপ। ভিষণ খারাপ। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ওয়েটার এসে ফেন চালিয়ে দিল। মিষ্টি হেসে বললো কিছু দেব ভাই? দু’কাপ কড়া চা-নিয়ে আয়। সাথে দুটো সিঙ্গাড়া। চলে গেল। সুহাস বল কি হয়েছে? ইদানীং তর গতিবিধি কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। সেই যে চাকরির খবর দিয়ে লাপাত্তা হলে। দেখা নেই, কথা নেই, নেই আমাদের আগেকার সে আমেজ। কারণ কি? চোখে পানি টলমল করছে। বুঝতে পারলাম তার সাথে কিছু হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা যাকে বলে। যে ছেলেটা দেখলেই বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরত। হাজার কথায় হাসাতো। সে আজ নিরব। কত ব্যাদনা তার অন্তরে। হৃদয়ে হারানোর শোক।
দুস্ত বলে আর কি হবে। যা ঘটার ঘটেই গেছে। কি হয়েছে বল? জানিস, মা-বাবাকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। চাকরিটাও চলছিলো ভালো। বেতন ও কম নয়। একদিন আব্বা বললেন, সুহাস একটা জিনিস বলবো, শুনবে বাবা? জি, বলুন। মেয়ে দেখেছে তর মা । পরিবার ভালো। দ্বীনদার। মেয়েটিও খুব ভালো। সুন্দরী, গুণবতী। এবছর দাওরা সমাপন করেছে। তুই একদিন দেখে আয়। ‘মা’ এসে বললেন আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুই কবে দেখতে যাবে বল। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকুই বললাম তোমাদের পছন্দ হয়েছে আমি দেখে আর কি করবো। তা কি হয়? তুই যাকে নিয়ে সারাজীবন সংসার করবে, তাকে না দেখে আনবি? ‘মা’ তোমার পছন্দই তো আমার পছন্দ। না, তা হয় না বাবা। তুই কবে দেখতে যাবে এটা বল। আচ্ছা মা! তোমরা যেদিন বলবে সেদিনই দেখতে যাব। ঠিক আছে তুই পরশু গিয়ে দেখে আয়।
মেয়েটা মাশাআল্লাহ। যেন কোন হুর। সুন্দরে কোনো কমতি নেই। ‘লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানি তাক্বওয়ীম’। দেখলাম। চলে এলাম। ‘মা’ জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে মেয়ে কেমন লাগলো? ভালো, খুব ভালো। আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে তো কোন সমস্যা রইল না। এবার বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করি। সব কিছু ফাইনাল। বিয়ে আগামী মাসের দশ তারিখ। ভাবছিলাম বিয়েতে খুব আনন্দ করবো। তোদের সবাইকে বলবো। কেউ ওযর দেখালে জোর করে নিয়ে যাব। ভাগ্য- এসব কিছুই হতে দিল না। কি আর করা।
এদিকে চা-ঠান্ডা হয়ে জুস বনে গেছে। কোনো খেয়াল নেই। ভগ্নহৃদয়ে শুনছি তার কথা। চা-সিঙ্গাড়া কখন যে দিয়েছে খেয়াল করিনি। ওয়েটার এলো কাপ নিতে। এসে কাপ দেখে চোখ বড়সড় করে বলল ভাই, চা!
অহ, তুই কবে চা-দিলি? সেই কখন দিয়ে গেলাম আপনারা খেলেন না? আচ্ছা, যা ভাই আরো দু’টা কড়া চা-দেয়। এগুলো নিয়ে যা। চলে গেল।
বল সুহাস তারপর? হঠাৎ মায়ের শরীর খারাপ হলো। নিয়ে গেলাম ডাক্তারে। ডাক্তার দেখে হতবাক! কি যেন আশংকা করছেন। টেস্ট দিলেন লিখে। ফাইল পত্র নিয়ে সন্ধ্যা পর আবার চেম্বারে। ডাক্তার নীরবে রিপোর্ট গুলো দেখছেন। কপালে ভাঁজ পড়ল। যেন খুব চিন্তিত। আমার হৃদয় নাড়া দিল ডাক্তারের অবস্থা দেখে। মনে মনে আল্লাহকে বললাম, ‘ইয়া শাফিয়াল আমরাদ’ ভালো কিছু শুনাও। ডাক্তার বললেন বাবা দেখ, হায়াত মওত আল্লাহর হাতে। তিনি যতদিন যাকে হায়াত দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, এর একদিন এক সেকেন্ট বেশি কেউ বাঁচবে না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি ওগুলো সেবন করাও। আল্লাহকে বলো। জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে আমার মায়ের? বললেন কিছুই হয়নি। কমে যাবে। আল্লাহ কমিয়ে দিবেন। চলে এলাম। মন দুরুদুরু করছে। আম্মা বললেন কিরে ডাক্তার কি বললো। কিছুই বলেননি। বললেন ‘ইনশাআল্লাহ’ সেরে যাবে। বাড়ি ফেরার পথে মোবাইলটিও চোর নিয়ে গেল। কি করবো, ভাবলাম আরেকটা কিনে নিব। বাড়িতে এসে মায়ের অসুস্থতা বেড়ে গেল। ওষুধ কোন কাজ করছে না। বিয়ের মাত্র আট-দশদিন আছে। কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। মাকে নিয়ে আবার গেলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি সব খুলে বললেন। ওষুধ কিছু বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ আল্লাহ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। হতাশ আমি। কি করবো। নিরাশার চাদর সরিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আম্মাকে কিছুই জানাইনি। বাড়িতে গিয়ে আব্বাকে সব বললাম। তিনি তো পড়ে গেলেন মহা চিন্তায়। আমি বিপাকে কি করবো, একদিকে বিয়ে আরেকদিকে ‘মা’। ভাবলাম কাউকে বলব না। দু’চার জন গিয়ে নিয়ে আসবো। আব্বার সাথে পরামর্শ করে এটাই ফাইনাল। আজ বিয়ে। মায়ের অবস্থা একেবারেই নাজুক। ভুলে গেলাম বিয়ের কথা। শুক্রবার দিন। জুমআ পর বের হওয়ার কথা। নামাজ পড়ে বাড়িতে এসে দেখি ‘মা’ মুখে কালিমা জপছেন। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বললেন কাঁদিস না বাবা। যা বৌমাকে নিয়ে আয়। আমি কি যাবো? না, পাশেই বসে থাকলাম। আস্তে আস্তে চোখ ছোট হচ্ছে। চোখের পলক নড়ছে। কালেমার আওয়াজ ক্ষিণ হচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। জমিন সরে গেল পা থেকে। যখন আব্বা বললেন বাবা তর মা নেই। এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে মাওলার সান্নিধ্যে....!