পোড়ামাটির ঘ্রাণ...
পোড়ামাটির ঘ্রাণ
শফিক নহোর
ক.
কামারহাটের বাতাসে একটা গোপন খবর ইদানীং খুব ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিয়েই মানুষ কানাঘুষা করছে। জোয়ারের পানি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসের বেগও বাড়ছে। পদ্মার-ঢেউয়ের আঘাতে বাহির বাড়ির ঠাকুরঘর ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। ভগবানের নাম জপতে জপতে এ যাত্রায় ঠাকুর রক্ষা করেছে, না হলে গাঙের জলে পতিমার মতো নিজেও বিসর্জন হয়ে যেতে হতো এতোদিনে। মন্দির রক্ষা করবার জন্য উপজেলায় কাগজ পত্র জমা দিলাম। তা কোন কাগজের নিচে চাপা পরে আছে কে জানে। আজ ক’দিন নিজের শরীর ভাল যাচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্যের খোঁজখবর নিতে পারছি না, ঠিকঠাক মতো। টাকা ছাড়া কি কোন কাজ হয়। ‘সব মানুষই গু খায় দোষ হয় ঘাইড়া মাছের।’ টাকা পয়সা দিয়েও তো নদী ভাঙন রোধ করতে পারছে না গ্রামের মানুষ। এই নদী ভাঙনে আমাদের স্বপ্ন ভেঙে যায় বুকের ভেতর থেকে।
বিশু পোদ্দার দানবীর, গ্রামের মানুষের হৃদয়ে তার নাম খোদাই করে লিখে রাখছে। পরের ভালো আজকাল মানুষ সহজে সহ্য করতে পারে না। কতোবার ফিকির-ফন্দি করে রাতে পোদ্দার বাড়িতে ডাকাতি করেছে, ফটিক সরকার। মানুষের জীবন সবচেয়ে আলাদা জীবন পশু-পক্ষীর মতো না, দিন এনে দিন খাওয়া। মানুষের জীবনে সংসার আছে, ছেলেপেলে আছে। বাড়তি চিন্তা আছে, ভবিষ্যতের জন্যে কিছু জমাতে হবে। না হলে শেষ বয়সে ছেলেপেলের উপর চেয়ে থাকতে হবে।
পুরুষ মানুষের কাজকর্ম করতে লজ্জা কিসের? সৎ ভাবে বেঁচে থাকলেই হল। ঠাকুর রক্ষা করুক।
নিমাই, লক্ষ্য করেছিস, রীতার বিষয়টা নিয়ে গ্রামে কু-কথা ছড়িয়ে পড়ছে। ‘কথা বলাবলি করছিল মানুষজন পথদিয়ে যাবার সময়। রাম রাম, এসব কথা মুখে আনাও পাপ।’ হিন্দুদের পুটকি মেরে সরকার বাড়ির মানুষ এখন সাধু সাজছে, যুদ্ধের সময় পোদ্দার বাড়ির সয়-সম্পত্তি নিয়ে শহরে গাড়ি, বাড়ি করে চাষার লেবাস খুলে অফিসার হয়েছে, বছরে একবার বাড়ি আসবে। বড়ো চার পাঁচটা ষাঁড় কোরবানি দিলে বাড়ির পথে কুত্তার মতো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর গ্রামের গরীব মানুষ মনে করবে এরা দেবতা, অন্য মানুষের মতো না। তাদের মুখে এখন কত কথা শোনা যাবে। মানুষ সাধু সেজেছে প্রকৃত সাধু না।
নিমাই, মন্দ বলিস নাই। তুই তা হলে যা, পরে আলাপ করবো।
বক্কার মিয়ার সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির পর আসতে বলিস।
পাটের গদিতে আজ কদিন যেতে পারছি না।
কাকা শোনলাম,
বক্কার মিয়া বিয়ে করছে?
হ, আমাকে তো তাই বলেছিল, ওদের গ্রামের মাতুব্বরকে বলেছিলাম।
রীতা মোসলমান ঘরের মেয়ে, তার একটা দোষ বের হলে আমাদের সমাজের জাত যাবে। হিন্দু হোক মোসলমান হোক সে তো আমার প্রতিবেশি। বক্কার রীতাকে বিয়ে করলে করুক। বক্কার ছেলে হিসাবে সহজসরল, ধর্মভীরু। বিয়ের জন্ন্যিই তাহলে আজ দুদিন বাজারে আসছেনা। বাজার সদাই করতেও তো একজন মানুষ দরকার। গরীব মানুষ এতো বিয়ে করবার শখ জাগে কেন?
পুরুষ মানুষের আসলে বদঅভ্যাস একবার জড়িয়ে পড়লে নেশার মতো অতো সহজ আসা কঠিন। বিয়ে কী বদঅভ্যাসরের কারণে করে বিশু বাবু; ‘তা না হলে কি?’
বক্কার মিয়া, সকালে নতুন বউয়ের সঙ্গে ভাত খাওয়া নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। আপনার এখানে আসার পথে শুনে আসলাম।
নিমাই, তা কি জন্ন্যি বাড়ির পর আসছিস কিছু তো বললি না। আমার হাজার পাঁচেক টাকা হাওলাত দিলে বড় উপকার হবে। সামনে সোমবারে নাজিরগঞ্জের হাটে ধান বিক্রি করে টাকা দিবো দিব্য করে কচ্ছি,
ভাল কথা মনে করেছিস,
সামনে দূর্গাপূজো খই, মুড়ির জন্য এক মণ ধান আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিস। তুই বাজারে গিয়ে আমার কথা বলিস, কুঠিতে ক্যাশিয়ার থাকে তাকে কাগজ লিখে দিচ্ছি তোর টাকা দিয়ে দিবে। বিশু পোদ্দার কোন মানুষকে কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, এমন কথা মানুষের কাছে শোনা যায় না। যখন যে কাজের জন্য মানুষ গিয়েছে, কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। সে বছর উদয়পুরের মিয়া বাড়ির লোকজন বাঁশ নিয়ে গেল চার ভ্যান মাদ্রাসা না-কি জালসার জন্য পরের দিন দেখলাম। গোয়ারিয়ার হাটে কার্তিক পাল সেই বাঁশ কিনে নিয়ে গেল। দলীয় লেবাস লাগিয়ে গ্রামে দেখছি কেউ কেউ রাজপ্রসাদ গড়ছে।
আজকাল বক্কার মিয়ারে দেখলে কষ্ট হয়।
পোদ্দারের পাটের কুটিরে সকাল থেকে সন্ধ্যা অদধি কাজ করে যে টাকা পায় তা- দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। বক্কারের বাপ একসময় নৌকা চালাতো, বয়স্ক মানুষ শরীরে কুলায় না। ছেলের সংসারে বসে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই এখন। বক্কারের মা গখেন সাহার বাড়ি ঝির কাজ করে, কীর্তন পূজা, অথবা বিশেষ কোন বড় আয়োজন হলে বারতি খাবার বেচে থাকলে বাড়ি নিয়ে যায়। বক্কারের বাপের জন্ন্যি, তার ভালোবাসা চোখে পরবার মতো। গবীর মানুষের সখ-আহ্লাদ বলতে আর কি পেটে চারটা পানি ভাত পড়লেই হয়। সারাদিন খাটনির কাম করা লাগে।
দেখতে দেখতে কী ভাবে বছর পার হয়ে যাচ্ছে; বক্করের বিয়ের বয়স সারে তিন বছর, বাচ্চা-কাচ্চা তিনজন। নিয়ম নাই, পরিকল্পনা নাই, সংসারে অভাব তো থাকবেই।
সকাল বেলা চলে শুধু এক গেলাস পানি খেয়ে, দুপুরে ঢেঁকিতে ধান ভানলে কুলার উপর কয়ডা চাল ঝেড়ে মুখের ভেতর দিয়ে চিবিয়ে দুপুর পার করা। সাঁঝের সময় সমস্ত কামকাজ শেষ করে খেগেন সাহার বউ শাড়ির আঁচলে খুদ, অথবা চিটা ধানের বাড়া দিলে বাড়িতে এসে চুলাই চুড়িয়ে তা লবণ মরিচ দিয়ে অথবা কোন কোন দিন পেঁয়াচ-মরিচ ছেনে রাতের খাবার খেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে শুয়ে পড়ে।
খ.
পোদ্দার বাড়ির শান বাধানো ঘাটে গোসল করবার পর ভেজা কাপড় শরীরে পেচিয়ে বাড়িতে যাওয়া একটু কষ্ট হয়, এই শীতের দিনে রীতার।
‘কি গো বক্কার মিয়া, তোমারে বললাম পোদ্দারের কুটির থেকে আমার সঙ্গে ঢাকায় চলো গেলে না। শোনলাম,
‘বউ বাচ্চার খাবার দিতে পারছো না সংসারে অভাব বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে অসুস্থ। তার উপর তোমার বাপ তোমার ঘারে চাপছে।
‘নিমাই, কাকা আমি মুর্খ মানুষ। ঢাকা গিয়ে কি করবো, ঢাকা না-কি অনেক মানুষ থাহে সবাই ধনী।
‘ধূর বেটা ঢাকার শহরে তোর চেয়ে ফন্নি মানুষের অভাব নাই। তোর ত চরিত্র ভাল আছে, শহরে বিভিন্ন এলাকার বদচরিত্র মানুষ এসে বস্তী বানায় ফেলছে। খারাপ ভালো সবি আছে শহরে।
তোর বউ সকালে পোড়া মাটি খায়, ভাত খেতে না পেরে এ কথা একজনের কাছ থেকে গ্রামের সবাই জানে। তোর বউরে দেখতে আসে। মানুষ মুখের সামনে কিছু বলে না। পিছনে মজা নেয়। মানুষ জাতটাই এমন বেহায়ার মত। কেউ উপকার করতে পারলেও করবে না। এখন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় কওে মানুষকে বনের বাঘের চেয়ে।
‘নিমাই কাকা, রীতা সকালে পোড়া মাটি দিয়ে দাঁত ঘষতে-ঘষতে অল্প অল্প করে খাওয়া শিখে গেছে। আমি যেমন বিড়ি খাই, বিড়ি না টানতে পারলে মাথা ভার ভার লাগে। আমার বউ পোড়া মাটি না খেলে ওর না-কি ভাল লাগে না। একটা কিছু খেয়ে বেঁচে আছে তাতেও মানুষের কত কথা।’
‘নিমাই কাকা তুমি যাও, তোমার লগে পরে কথা কবোনে।
বউয়ের শরীরটা ভাল না। ভাবছি, কবিরাজ বাড়ি নিয়ে যাবো। পরনের কাপড় খানা প্রায় ছিড়ে গেছে, পথের লোকজন বউয়ের শরীরের দিকে চাইয়া থাহে। লাজ শরম কিচ্ছু নাই। সংসারের কোন আয় উন্নিতি নাই, সারা জীবন পরের বাড়ি কাম করেই চলি গেল। বউরে কোনদিন এক জোড়া কাঁচের চুড়ি কিনে দিতে পারলাম না। নিজের মনের ভেতরে আফসোসের ঢেউ গড়াগড়ি খায় বক্কার মিয়ার মনে।
ঘরের ভেতর ঢুকতেই বউ বমি করতে করতে উঠোনে বের হয়ে গেল। কুয়া থেকে পানি তুলে বউয়ের মুখে, মাথায় দিতেই মাটিতে শুয়ে পড়ল। সারাদিন কিছু খায়নি বড় মেয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলছে,
‘বাজান আমিও মায়ের সঙ্গে মাটি খাওয়া শিখে গেছি।
আমার চোখ ভিজে ওঠে। পদ্মাপাড়ের সমস্ত পানি আমার চোখের ভেতেরে পোড়া মাটি হয়ে ঢেউ খেলে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আমার কাছে তখন নরক যন্ত্রণার মতো মনে হয়। ভোর বেলা থেকেই গাছের ডালে কাক পক্ষী ডাকছে, আমার তখন থেকেই মনে হয়েছিল, ‘আজ একটা খারাপ কিছু হবে।’
‘বউরে আমার দিকে একটু দ্যেখ। রীতার চোখ গুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুখ মলিন হয়ে পরে আছে মাটিতে। কথা বলছে না, মনে হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। নাক দিয়ে মৃদু বাতাস বের হচ্ছে দাঁত লেগে আছে। ঘর থেকে পানের বোটা নিয়ে এসে যেই রীতার কানের ভেতর দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া দিয়ে উঠে পড়ল। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাড়ি ঘরের দিকে কেমন তাকিয়ে রইল। ভাব চক্কর দেখে মনে হচ্ছে রীতা এ বাড়িতে নতুন এসেছে। বউ বাচ্ছার দিকে তাকালে মায়া করে, মায়া করে লাভ কি ভাল কোন কিছু কিনি দিবার তো পারছি না।
‘নিমাই কাকা, আমার বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে বাড়ির উপর আসছিল। রীতা রাক্ষসের মতো নিমাই কাকার মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ!
‘বক্কার তোর বউয়ের জন্য ডাব নিয়ে আসলাম, আর হাকিম কবিরাজের কাজ থেকে একটু তেল পড়া নিয়ে আসলাম। মাথায় দিয়ে দে ঠিক হয়ে যাবে। কথা গুলো কেমন যেন রীতার শরীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধল।
‘রীতা জোড়ে চিৎকার করে বলল,
‘এই ডাকাত আমাগো বাড়িতে ক্যান। পোদ্দার বাড়ির তা খায়ছে নিমকহারামি,
তাকে দেখেই আমি চিনছি, সেই তো ফটিক সরকারের সঙ্গে ডাকাতি করে।
বক্কার ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিমাই অদৃশ্য হয়ে গেল।
মহাব্বত আলীর উপলব্ধি
মহাব্বত আলীর উপলব্ধি
প্রকৌ. আমিনুল ইসলাম
মহাব্বত আলী এক ফার্মেসী থেকে আরেক ফার্মেসী ছুটছেন। থানা সদরের সব বড় বড় ফার্মেসীতে একটি ওষুধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও তা খুঁজে পাচ্ছেন না।
দুই মাস আগে মহাব্বত আলীর ঘর উজ্জ্বল করে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিলো। প্রথম সন্তান বলে নাম রেখেছেন প্রথমা। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। দেখতে অবিকল মহাব্বত আলীর মত হয়েছে। তাই মহাব্বত আলীর আনন্দের সীমা নাই।
এই আনন্দ তার বেশি দিন রইলো না, কারণ কয়েকদিন ধরে বাচ্চাটি জোরে জোরে কাঁদছে। একবার কান্না শুরু করলে আর থামানো যায় না। কান্নার ধরন দেখে মনে হচ্ছে সে কোথাও ব্যথা পাচ্ছে। এতে মহাব্বত আলীর খুব টেনশন হচ্ছে। সবাই বলছে এটি খুব সাধারণ বিষয়, আস্তে আস্তে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে; ডাক্তার দেখানোর দরকার নাই। কিন্তু মহাব্বত আলীর মন সইছে না, প্রথম বাবা হয়েছে বলে কথা। তিনি তার কন্যাকে থানা সদরের প্রায় সব ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু বাচ্চাটির কান্না কোন ভাবেই থামছেনা। বরং দিনে দিনে কান্না আরো বেড়ছে। কেউ বলছে হুজুরের পানি খাওয়ালে ঠিক হবে। তাই তিনি বড় হুজুরের পানি পড়া এনে খাওয়ালেন বাচ্চাটিকে, কিন্তু কোন উন্নতি হয় নাই।
মোহাব্বত আলীর এক আত্মীয় ঢাকায় একটি হাসপাতালের ডাক্তার। তিনি ঐ ডাক্তারের সাথে ফোনে তার কন্যার বিষয়ে কথা বলেছেন। ডাক্তার সাহেব তার বাচ্চাকে একটি ওষুধ খাওয়াতে বলেছেন। সাত দিন খাওয়ানোর পর যদি উন্নতি না হয় তবে বাচ্চাকে ঢাকায় এনে বিভিন্ন টেষ্ট করাতে হবে। আর এখন সেই ওষুধটি খুঁজে খুঁজেই হয়রান হচ্ছেন মোহাব্বত আলী। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওষুধ না পেলে মহাব্বত আলী নিজেই হয়তো কেঁদে ফেলবেন।
এই থানা সদরে আর বাকি মাত্র একটি বড় ওষুধের দোকান, যেখানে মোহাব্বত আলী এখন যাচ্ছেন। তিনি ভাবছেন, ওষুধটি এখানে পাওয়া না গেলে থানা সদরের আর কোথাও পাওয়া যাবেনা, তখন তাকে জেলা শহরে গিয়ে খুঁজতে যেতে হবে। এই বড় ওষুধের দোকানের আগে একটি ছোট ওষুধের দোকান আছে। সব কাস্টমার ছোট দোকানের সামনে দিয়ে বড় দোকানে যায়। যে লোকই এই ছোট দোকানটির সামনে দিয়ে যায় তাকে দোকানদার বলেন ‘আসেন, আসেন, এখানে আসেন।’ যথারীতি মহাব্বত আলী অস্থির হয়ে এই দোকানটির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, দোকানদার বলে উঠলেন ‘আসেন, আসেন, ভাই এখানে আসেন।’ মোহাব্বত আলী মনে মনে ভাবছেন,
‘সদরের সব বড় বড় দোকানে ওষুধ খুঁজে পাচ্ছিনা। আর তিনি আমাকে তার এই দুই হাতের দোকানে ডাকছেন।’ বড় ওষুধের দোকানে গিয়ে মহাব্বত আলী জিজ্ঞেস করেন,
‘ভাই, এই ওষুধটা আছে?’
‘একটু দাঁড়ান। খুঁজে দেখছি।’
‘নাই। শেষ হয়ে গেছে।’
‘ভাই, কই পাবো বলতে পারবেন?’
‘ঐ ছোট দোকানটিতে দেখতে পারেন।
‘ভাই, সব বড় বড় দোকানে খোঁজ করে কোথাও পাচ্ছি না। আর আপনি বলছেন, ঐ ছোট দোকানে দেখতে!’
‘ভাই, অনেক সময় ছোটরাও উপকারে আসে।’
মহাব্বত আলী যেতে চাইলেন না ছোট দোকানটিতে, কিন্তু বড় দোকানের লোকটি তার দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে। সে চক্ষুলজ্জায় ছোট ছোট পা দিয়ে ঐ ছোট দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ভাবলেন দোকানে না জিজ্ঞেস করেই চলে যাবেন, ঠিক তখনই পিছনে ফিরলেন মোহাব্বত আলী। দেখলেন লোকটি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ভাই, এই ওষুধটা চিনেন?
‘হ্যাঁ।
‘আছে?
‘দাঁড়ান, দেখি।’
‘মনে হয় নাই আপনাদের কাছে, যাই।
দোকানের কর্মচারী পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘এই ওষুধ আছেতো।’
মোহাব্বত আলী একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভাই আমাকে বাঁচালেন।’ এতো ছোট দোকানে ওষুধটি পেয়ে মোহাব্বত আলী অবাক হলেন।
ঐ ওষুধটি খাওয়ানোর পর থেকে তার কন্যার কান্না কমতে থাকলো।
এরপর মোহাব্বত আলী আর কখনো ছোট বলে কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেনি।
পদাবলি : ০১
শিরোনামহীন
মাজরুল ইসলাম
[কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণে]
কোনদিক থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে
সটান আমার কানে কানে বলে গেল
আপনি দিকশূণ্যপুরের দিকে পা বাড়িয়েছেন।
এই খবর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
এখন প্রতিটি মূহুর্ত কাটে চোখের জলে
কিন্তু আপনার শাশ্বত পঙতিমালা
অশ্রু মুছায় কিংবা অনুরণিত হওয়ায়
কত-ই না
প্রশান্তি এনে দেয়।
বাজি
দেলোয়ার হোসাইন
লোকটা পাগল।
নিজের সাথে হাসাহাসি আর
মাতামাতির তুমুল বিরোধ নিয়ে
সারা দেশ চষে বেড়ায়...
সব্জির মাচাং, দোকান ঘরের বারান্দা
অথবা নিজস্ব নির্ভরতায় যেখানে খুশি
সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে, লম্বা ঘুম...
জেগে ওঠে কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটে
আয়েশ করে টান, হাসাহাসি, মাতামাতি...
লোকটা পাগল
লোকটা ঘুমিয়ে
লম্বা ঘুম...
আমরা একজন আরেকজন নিজেদের
পাগল হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বাজী ধরেছি...
লোকটা মরে গেলে আমি নিজেকে
লোকটা বেঁচে গেলে আমি নিজেকে
‘পাগল হিসেবে ঘোষণা দেবো’
লোকটা মরে গেলে
লোকটা বেঁচে থাকলে
আমাদের কয়েকজন নিজেদের
পাগল হিসেবে ঘোষণা দিতেই হবে...
লোকটা পাগল
লোকটা মরে গেছে
লোকটা বেঁচে আছে...!
সহচর
আহাদ আদনান
তোর দেশে নিবি?
পাসপোর্ট আছে?
তাও বুঝি লাগে পাখিদের?
একটাই তো আকাশ,
উড়ে গেলেই হয় তো,
এখান থেকে ওখানে,
সবুজ যেখানে শেষ হয়,
পাথরে পাথরে রাজপথ,
অয়োময় দেশ তোর।
তুই পাখি হলি কবে,
আমি ভেবেছিলাম তটিনী,
বাঁধ দিয়ে গতিপথ পালটে দেওয়া
কলকল জলধারা।
কিংবা সবুজ
ঘন অরণ্য, গহীন স্যাতস্যাতে,
জড়াজড়ি করে বেড়ে ওঠা
বিষে ভরা খয়েরী ছত্রাক।
অথবা নির্ঝর,
আজও অবাক স্বপ্নভঙ্গে
হুড়মুড় কাছে টানা।
তোকে কিন্তু কখনোই
এতসব আবোলতাবোল
ভাবাভাবি অবকাশ
হয়নি আমার।
শুধু বেসে বেসে চেয়ে থাকা
শুধু চেয়ে চেয়ে শ্বাস ফেলা
শুধু শ্বাসে শ্বাসে অনুভব
শুধু অনুভবে কাছে টানা
শুধু কাছে টেনে ভালো বাসা।
তোর দেশে নিবি বল,
আকাশটাই সীমানা,
একদিন ছুট দিয়ে দিগন্তে উড়াল,
তোর জন্য এই জন্মে
সেজেছি অ্যালবাট্রস,
মেঘের মত শীতল পারিজাত।
আমি আকাশে তীর তাক করে
বসে আছি চিরকাল
আর যাই হস
পাখি হতে যাসনে সুহৃদ,
সেন্সরে জমা চলতি কোনো
সিনেমার হোর্ডিং নইরে
বন্যপাখি সংরক্ষণের আশ্বাস নিয়ে
বসে থাকিনি কোনোদিন।
আসব তবুও।
আসতেই হবে? আত্মহনন?
তোর বিষাক্ত কণ্টকে ফালিফালি হব
এতেই সার্থক আমার খেচরকাল।
হড়াই নদীর বাঁকে
সোহেল রানা
মাছরাঙা মন।
ফিঙের বহতা পাখায়
তার কুচকুচে শরীর ও জ্বলজ্বলে চোখে
এক দূরন্ত কিশোর। ঘুঘু-ডাকা-দুপুর।
নরম বিকেল-
শারদ-সুন্দর কাশফুলের আকাশ!
ডানা মেলেছে শাদা-শাদা বকের পাল!
কানাকুয়া কুপ কুপ করে উঁচু থেকে নিচু স্বরে
ডেকে ডেকে সঙ্গিনিকে খোঁজে।
ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি
আর গাঁও-গেরামের পল্লিগীতি, মুখর-
পাখিডাকা সকাল-
জুঁই-শাপলা-টগর-বেলির অপরিম্লান মুগ্ধতা-
ছুটে যাই, উড়ে যাই বারবার, বারবার--
হড়াই নদীর বাঁকে।
নিভৃতে আঁধার
আশ্রাফ বাবু
সব চোঁখে চড়াই-উতরাই পথে
ফিরে ফিরে বিষাদ চোরা¯্রােতে,
ঘোরে বুঁদ হয়ে থাকে অন্ধকার
আঁকা স্বপ্ন হৃদপিন্ডে ভাঙচুর।
জীবনের জটিল প্রাণবন্ত প্রেরণা
প্রয়োজন প্রাণশক্তির রেখাটানা,
কালো ঘর থেকে দূরের বনভূমি
আছো উপভোগ্য বিষাদ তুমি।
মন আর মনের বিড়ম্বনা বাড়ায়
দূরত্ব বাড়ে; অস্তিত্বের গুরুত্ব খাতায়,
মেঘ ছায়ার সবভাষা শব্দে ফোঁটে
উড়াল আকাশে অবিচল আধখানা ঠোঁটে।
সব চোঁখে ভুলদেখা শিউলিতলা মনে
অযাচিত কথার মূল্য ভেঁজা দৃষ্টিগানে,
অঝোর ধারায় পরিপাটি চাঁদের কাছে
কুড়িয়ে ছলাকলা যা বুকে জমে আছে।
সাদা আবিরের কুয়াশা
স্বপন গায়েন
জোনাকির কোলাহল ফসলের মাঠ থেকে ভেসে আসে
ঠান্ডা হাওয়ার সাথে মিশে যায় রংচটা শরীর
অগ্রহায়ণের প্রহর শেষের মায়াবী রাত
চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে সাদা আবিরের কুয়াশা।
মেঠো পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে অচিন দিগন্তে
জোছনার আলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে তৈরি হয় আঁধার বলয়
রঙচটা শরীরের ক্ষত কেউ দেখতে পায় না
অমানিশার মধ্যেও খুঁজে বেড়ায় আলোর রথ।
শীত বাড়ছে, শীর্ণ জীর্ণ রোগগ্রস্ত উপত্যকা
ধ্বস নামবে যে কোনো সময়-
তবুও বাঁচতে ইচ্ছে করে সব কাঁপন উপেক্ষা করে
অগ্রহায়ণের আলো চিরকাল ছুঁয়ে থাকুক হৃদয়ের বালুচরে।
পদাবলি : ০২
অপূর্ণতা
এ এম তোফায়েল
তাঁকে নিয়ে আমি কতো কবিতা লিখি, হয়তোবা
সে জানে হয়তোবা জানে না! হয়তোবা সে দেখে হয়তোবা দেখে না! তাঁকে ঘিরেই আমার কতো আয়োজনতাঁকে ছাড়া সকল আয়োজন অপূর্ণ
থেকে যায় কেমন!
যে ফুল অবেলায় গেছে ঝরেতাঁর জন্য মানুষ কি যুগ যুগ ধরে কেঁদে মরে? প্রকৃতি যেমন শূন্যস্থান পছন্দ করে না তেমনি প্রকৃতির কল্যানেই শূন্যস্থান পূরণ হয়!
তাঁকে নিয়ে আমি কতো কবিতা লিখি, হয়তোবা সে জানে হয়তোবা জানে নাহয়তোবা সে দেখে হয়তোবা দেখে না!
বার্তা
নাসিমা হক মুক্তা
ভোরে বার্তা এলো
কানে বাজলো পাখপাখালির খই ফুটা ডাক
ভেতরকার চান্দিনা আলো কখন থেকে উপবাসী
তা জানে কেবল ঈশ্বর!
সে খেলে যায়
আর আমিও নাচি
মনের ঢোল বাজিয়ে, চিৎকার করে জানাই যে
আমি তো মানুষ
সব রঙেই আমাকে খেলায়!
সে সব দেখতে মজা লাগে
এইখানে বটমূলে জায়গায় হলেও- মানুষ বড় বিশ্রী
মনে কাদা, পুরো মাথা ছাইপাঁশ
এসব পতন দেখলে কেউ কারো কাছে ভিড়ে না
দূর থেকে- সালাম, নমস্কার ও কল্যাণের
এপাশ- ওপাশ দু’ পাশেই- মন বলে ওঠে
কী অসহায় মানুষ
কী করুণ এ মানবজীবন!
এক ইঞ্চি সুখ
এক গজ মায়া
এক মগ জলভরা ছায়া;
এসব দিয়ে পুরো মানুষ বানানো সৃষ্টি
নিজেও আফসোস করে বলে-
আমার মানব মোরগ লড়াই শিখেছে
স্বর্গের মত বাগান দেখার ইচ্ছে থেকে- এরা পালিয়ে বেড়ায়!
তিনি দু’ গালে হাত আলতো বুলিয়ে- বলে ওঠে
হায় মানুষ
আফসোস- আফসোস- আফসোস!
অটল বিশ্বাস
মোঃ নুরুজ্জামান সবুজ
হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে জীবন বৃক্ষের
হলুদ পাতারা ঝরে যায়
সবুজেরা প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে অটল বিশ্বাসে-
বৃক্ষবাকলে বয়সের প্রতিচ্ছবি
চিরধরে ধ্বসে যাওয়া ঢিলে ঢালা ত্বক
বেলা শেষে মেলার মতো, হাট শেষে-
পড়ে থাকা উদোম হাট হয়ে।
হেমন্তের আঙিনা এখন শুধুই ফিকে
দিগন্তে নিঃশব্দেরা শব্দভূমি খুঁজে খুঁজে হয়রান
মৌপোকা, ঘাসফরিং প্রজাপতি ডানামেলে
কোথাও গেছে চলে-
যেখানে যেমন খুশি তোমরা যাও
আমি এখানেই রয়ে যাবো; এ নির্জনতায়-
একদিন সম্ভাবনার মাঠ জুড়ে ফুল পাখি
অটল বিশ্বাসে আমাকেই ভালোবাসবে
অন্তহীন, অনন্তকাল।
সওয়ারি
রহিত ঘোষাল
দুটো কণ্ঠস্বর একে অপরকে সঙ্গ দিয়ে যায়,
এইসব জটিলতা আমার আর ভালো লাগেনা,
সোনার ফসল ভরা মাঠে আগুন লাগিয়ে যায় বিকেলের সূর্য, আমি ছুটতে থাকি, নরকের মধ্যে যে উদ্যান সেখানে বসে দু’দ- গলা ভিজিয়ে নিই,
আমার মনে পড়ে বৈঠা ঠেলেতে ঠেলেতে ফাগুন মাসের কথা, অগ্রায়ন মাসের নদীর ধারের কাদামাটি,
সাদা মেঘের আঁচল বিছানো,
ফিরে যেতে চাই যেখানে আমার মায়ের পায়ের ছাপ,
আমি সেই মাটির কিছুটা হাতে তুলে নিই
কপালে লাগিয়ে আম-জামরুল বনের মধ্যে দিয়ে, ধান খেতের উপর দিয়ে, ছোট ছোট ঢেউয়ের সওয়ারি হয়ে
মরা পদ্মার ওপারে যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায়।
পদাবলি : ০৩
রূপকথা
নজর উল ইসলাম
রোদ্দুরের গা-ধরে উঠতে চেয়েছি, মন-নুপুর ভেঙেছে
কাদামাটির লেপন বরাবরই স্মৃতিভ্রষ্ট হয় দেখেও
লজ্জার মাথা খেয়ে ফের উড়ন্ত হাওয়াকে বলেছি
যোজনা-প্রীতি থেকে আলাদা করে দাও
কারণ, এমন ভাসান হয়তো বা নিতে পারবো না
আদি থেকেই চুষে খাচ্ছো স্তন ও ঠোঁটের মধুমন
ফাটলের গভীরতায় চোখ রেখে দেখি বিস্তর ফন্দি
নিপুন নিভৃতিহীন শুধু চাবুকেই শেষ কথা বলেছে
আটকে গেছে সমস্ত সন্ন্যাস বোধ, প্রীতি
যে পৃথিবী আসছে তার গালে কোন চামচ
কোন ফটিকজলবাস বসত না জ্বালার সাধন
এভাবেই গড়াবে প্রাণপ্রিয় জলমা-মাতৃকা
আর উড়ে যাবে সর্ষে ফুলের রেণুরা রূপকথায়...
কসম
সুশান্ত হালদার
কখনো কখনো নিজেকেই খুন করতে ইচ্ছে করে
পারি না বলে শত খ- হতে হতে নিজেকে লীন করি
এখন আমি মানুষ নই
ঝড়ের তা-বে উড়ে চলি হাওয়ায় ভর করে,
স্পর্শাতীত যদি ভাবো
ভালোবাসার কসম! একবার ছুঁয়ে দেখো
কতটা বেদনাদগ্ধ হলে প্রেমানল হয়ে জ্বলি
পঞ্চাশোর্ধ এই আমি
শতবার রক্তাক্ত হয়েও যিশু হতে পারিনি
আঘাতে আঘাত, খুনের বদলা খুন
ধর্ষিতার প্রচ- প্রতাপ, যুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ হাত
শোষণে দারুণ প্রতিবাদ,
কবিতা ঘেরা জীবন আমার
যদি চাও অগ্নিগর্ভ ভিসুভিয়াসও হতে পারি
মায়ের কসম! ছুঁয়ে দেখো
কতটা জ্বলার পরে নিভে যাওয়া অনল আমি!
আমাদের টেলিভিশন
মিনহাজ উদ্দিন শপথ
তুমি চলে যাবার পর আমাদের দীর্ঘদিনের
টেলিভিশনটা নষ্ট হয়ে গেল। ওটা আর
কোনদিনই চালু হবে না। কোনদিন পর্দা
হবে না
সবুজ- সুনীল। এখন চোখে চোখে নিদ্রাহীন
নূহের প্লাবন। অন্য চোখে উল্লাস প্রবল
ফাঁকা ছায়াহীন একটা ঘর কেবল
মায়ার টানে কপিকল ঘুরে।
আমার বাবা বললেন, দেখো এর চেয়ে ভালো
একটা টেলিভিশন তোমাদেরকে এনে দেব
আমরা তখন একসাথে বলে উঠি না না না...
গোধূলি জলে পাখি জীবন
অক্ষয় কুমার বৈদ্য
ডেকে গেছে যে নূপুর মাটি বেয়ে বেয়ে
তার টানে বেজেছে বেলা
চোখদুটো ভেসে ওঠে কাজলরেখাতে
সবটুকু অন্তঃক্ষরার খেলা।
আকাশে ওড়ে মেঘ,
তারে ভাবে কেউ ডানা
একটু আঘাতে বয় জল, অবিকল জলের আবেগ
আয় জল, ছলছল
নদী বেয়ে বেয়ে, মাঝি জানে
ফেরার ক্ষণ আলো হারালে
কেউ তো সন্ধ্যা সাজায শিখায় শিখায়
ঝিঁঝিঁ ডাকে, হাওয়া নির্জন
গোধূলি তো সন্ধ্যার আভাস
ফেরে পাখি, ফেরে জীবন...।
বন্ধক
হুসাইন আহমদ
কপালের ভাঁজ বেয়ে মুছে যাচ্ছে আয়ু
কালের বুদ্বুদে মলিন হয়ে ওঠছে দোহারা নদী
মৌরিফুলের সন্ধ্যা
এবং টলটলে জলের চোখ
ধ্রুপদী প্রেমের রঙে সবুজ হয়ে ওঠে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রেম
২৩ কোটি বছর ধরে হাওয়াদের কণ্ঠে বিরহী গান
তুমি নেই
কিম্বা আছো
অথচ দ্যাখো, তোমাকে ছুঁয়ও ছুঁতে পারি না
তোমাকে পড়তে না পারার আফসোস আমাকে কুরে খায় নিশিদিন
ধূসর কার্পেট বুকে শায়িত হে গোলাপ কুসুম
এক পৌষের রাতে পাতা মর্মর গানের লয়ে
যে জীবন বন্ধক রেখেছিলাম তোমার নাকফুলের কাছে
তা ছাড়াবার সাহস আমার আর কোনোদিনই হয় নি
পদাবলি : ০৪
জলের ঝলকানিতে
মিলন ইমদাদুল
জলের ঝলকানিতে
লাফিয়ে ওঠে ইলিশের দল
শরীরে যার জলের স্পর্শ
জলই তার একমাত্র প্রেম।
আষাঢ় মাসে গাঙে থইথই উঠোন ভরা পানি
কারেন্ট জালের ফাঁকে ফাঁকে ইলিশের ফালি
আবুল মাঝি বেজায় খুশিমন করে উচাটন
আম্বিয়া বিবির উঁকিঝুকিতে কমলার হাতহালি।
নির্বাক শব্দ চাষি
নুশরাত রুমু
একটি কবিতা, ফেনিল স্নায়ুতে যার উত্তপ্ত অঙ্কুরোদগম ..
একটি কবিতা শব্দমালা খোঁজে ভূমিষ্ঠের অপেক্ষায়,
কলমের শরীর বেয়ে ঝরে পড়বে তৃষিত কাগজের বুকে..
একটি কবিতা, যার শব্দবাণে জেগে ওঠে ঘুমন্ত বিবেক,
মননশীলতায় ধুয়ে যাবে পীড়িত মনের পঙ্কিলতা,
শুদ্ধ হবে মুকুলিত নিষ্পাপ ভাবনাগুলো!
তেমন একটি কবিতা লিখতে চাই।
তারুণ্যের দীপ্ত পদশব্দে কবিতারা উদ্ভাসিত হতে চায়,
হায়! স্লোগানের টুঁটি চেপে আছে শোষকের কালো থাবা।
দামালের মুষ্টিবদ্ধ হাত কুঞ্চিত করতে চায়
সংঘবদ্ধ কুটিল আশীর্বাদ,
শানিত প্রতিধ্বনি বিবর্ণ যন্ত্রণায় কাঁতরায় রাজপথে..
বন্ধ্যা সময়ের আঁধারে ভাবনারা পর্যুদস্ত হয় গুজবের ঝুলিতে;
অন্তর্গত বোধ বুকে চেপে শব্দেরা
বিষাদে উড়ে চলে শোকাহত বাংলায়,
পতাকার আড়ালে দাঁড়িয়ে এক নির্বাক শব্দ চাষি!
সুস্থ জাতিই সুশৃঙ্খলার জন্ম দেয়
হিলারী হিটলার আভী
যে জাতির মাথা আলুর মধ্যে থাকবে
যে জাতির মাথা মরিচের মধ্যে থাকবে
যে জাতির মাথা পিঁয়াজের মধ্যে থাকবে
কসম- সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না!
কারণ?
আলু-মরিচ-পিঁয়াজ হলো মৌলিক অধিকারের একটির একাংশ মাত্র!
চাল ডাল লবণ তৈল পানি এদের সাথে মিলিত হবার পরেই তো মৌলিক অধিকারের একটি হয়!
আর হ্যাঁ - এখানে কিন্তু মাছ মাংস ডিমের কথা উহ্য রাখলাম!
আলু-মরিচ-পিঁয়াজ নিয়েই আমাদের মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছে
আমাদের ঘোলা মাথার জন্যেই তো -
আমরা ভোট নিয়ে, জোট নিয়ে, নোট নিয়ে, কোর্ট নিয়ে এতোসব বিশ্রী বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছি!
শ্রদ্ধেয় দেশবাসী
আপনারাই বলুন তো
সুস্থ মস্তিষ্ক কখনও কি ভোট নিয়ে, জোট নিয়ে, নোট নিয়ে,
কোর্ট নিয়ে এতোসব বিশ্রী বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে?
সুস্থ মস্তিষ্ক নিয়েই তো সুস্থ জাতি তৈরি হয়
আর সুস্থ জাতিই তো সুশৃঙ্খলার জন্ম দেয়!
আপনারা কেউ ভাববেন না প্লিজ
আমি কিন্তু বাঙালি জাতিকে অসুস্থ জাতি বলছি না!
আমাদের স্ব-স্ব স্বৈরাচারী খাসলতের দিক থেকে আমরা অসুস্থ জাতি!
লখলাইনে কেটে যায় গলা
রবীন বসু
তোমার বেড়ার পাশে ফুটে আছে জুঁই
আমার বাগানবাড়ি নিলামে উঠেছে
দুঃখের সে রাত্রিজল টুপটাপ ঝরে
ভগ্ন ডানায় উড়ানের সাধ নেই
ক্ষতচিহ্ন ধরে রাখে বুক
সমূহ বিচ্ছেদ নিয়ে সম্পর্ক দাঁড়িয়ে
এইবার তারাগোনা খেলা
এইবার গাঢ় মনখারাপ ফিঙেপাখির লেজ
ক্যানভাসে ফুটে ওঠে হাজারো হিজিবিজি
ছবিআঁকা চেষ্টার বাতুলতা
গময়ের সুতো ধরে টান মারে অপটু লাটাই
লখলাইনে কেটে যায় আমাদের গলা.
অবাচ্য শব্দের অভিধান
খৈয়াম কাদের
হাঁটতে নেমে দেখছি
পায়ের সীমানা থেকে সরে যাচ্ছে পথ
উড়ে যাচ্ছে ঘর, বাতাসে আটকে আছে প্রাপ্য সকাল
চোখ মানছে না মগজের নির্দেশনা
দৃশ্যগুলো হয়ে যাচ্ছে বিনয়ী মাতাল!
কথারা ছুটছে অবাচ্য শব্দের অভিধান বুকে নিয়ে
কানে বাজছে না আর শ্রাব্য ধ্বনি
অসার বয়ানে দুলছে রক্তে রঞ্জিত স্বপ্নপাড়া
গুণিন খুঁজছে ঘুরে ঘুরে, কোথায় হারালো তার
পুরাণ খচিত সেই বসুন্ধরা!
পদাবলি : ০৫
শীত আসবে বলেই
রফিকুল ইসলাম
শীত আসবে বলেই
পৌষের শীতার্দ্র দাপটে পথের মতো
তোমার পায়ের চিহ্ন আঁকে,
হিমেল হাওয়ায় হলুদ পাতার মতো
ঘরে ফেরে পাখি বিষণ্ন মেখে।
শীত আসবে বলেই
ইচ্ছেগুলো শীতের সকালের মতো
উষ্ণতা হারায় কুয়াশার আবরণে,
আমার বিষাদগুলো লাল সূর্যের মতো
ক্লান্তিতে ডুবে সন্ধ্যার উদাসী রণনে।
শীত আসবে বলেই
ও চোখের কাজল, রাত্রি জাগে হিমঘরে
কেঁদে ঝরে সবুজ পাতার পরে,
শুকিয়ে গেছে চুম্বন ঠোঁট, গোধূলির প্রেম
উত্তুরের রুক্ষ হাওয়া ফিরে ।
শীত আসবে বলেই
ফেরারী সুখগুলো নরম বিড়ালের মতো
বরফ-রাত্রি ওম খোঁজে লেপের ভাঁজে,
শৈত্য হিমরাতে জেগে থাকে পুকুরের জল
ঘাসের শিশির, রোদ্দুরের খোঁজে।
অসুখের আমি
আবু বকর সিদ্দিক
এখানে সবাই ঘুমিয়ে গেছে রাতে,
সভ্যতার এই দেশের শহর কিবা গাঁ-তে,
পথের কুকুর, গলির বিড়াল আছে যত,
নিঃস্ব, অনাথ পথশিশু আরও আছে শত।
গাছের ডালেও চুপটি করে ঘুমায় পাখি,
আকাশে তারা মুদে আছে তব আঁখি।
এই শহরে আমার মতো কেউ কি আছে?
এই পুরানো স্মৃতির দালানকোঠার কাছে
খুব অসুখী সুখান্বেষী অসংসারী
চায় না যে— বিত্ত, যশ ও দুনিয়াদারি,
সুখের খোঁজে ছুটে চলা এই ছেলেটি,
ভাবনা করে পায় না দিশা তার করোটি ;
কোথায় আছে সুখের বাড়ি? কোন সে খানে?
যেথায় আঁধার নামলে পাবো সুখের মানে।
ভালো থেকো
খায়রুল আলম রাজু
ভালো থেকো ভালোবাসা খুনসুটি ভুল,
ভালো থেকো উড়ো চিঠি, ভিজেভিজে চুল।
ভালো থেকো প্রিয় মুখ হাসি আর খুশি!
টগবগে রাগ যদি- দিব কিল-ঘুষি....
ভালো থেকো ঘুমহীন আবেগিয় কথা
ভালো থেকো ছোট-বড়ো শত নীরবতা...
ভালো থেকো চুপিচুপি গলা ছেড়ে গান
অভিমান করো যদি ছিঁড়ে নিব কান!
ভালো থেকো নাশতার সকালের রুটি-
ভালো থেকো ঝুলে মাখা ভাজা সরপুঁটি।
ভালো থেকো দুপুরের তরকারি, ভাত
কাঁদো যদি অকারণে ভেঙে দিব দাঁত!
ভালো থেকো সাজুগুজু হিল-অলা জুতো;
ভালো থেকো বেশি বেশি, হাসিকাতুকুতো...
ভালো থেকো দুষ্টুমি চিমটি ও ল্যাং—
ঠিকমত খাবে, নয়। ভেঙে দিব ঠ্যাং...
অসৎ নেতার আদর্শ কর্মী
আসহাবে কাহাফ
কাকের রাজ্যে কাকে খায় কাকের মাংস-
দেখে আড়ালে হাসে গণতান্ত্রিক না-ভোর্ট;
দলপতি মাইক্রোফোনে আওড়ায় কাক স্বজাতির মাংস খায় না
এভাবেই পনের বছর, নেতার পারফিউমে এখন নর্দমার গন্ধ!
অন্ধ হাতির মতো দলীয় প্রতীক ছুঁয়ে সমর্থকের অনুমান-
সে মানুষ না; আসমানের ফেরেশতা
কে জান ত? এ দাবি ঐতিহাসিক মিথ্যে-
সকলে রাজনৈতিক দলের অসৎ নেতা; আদর্শ কর্মী!
মহামান্য জীবনানন্দ
সাজেদুর আবেদীন শান্ত
তীব্র ঘোরে শুনতে পেলাম
মহামান্য জীবনানন্দ,
আমাকে ডাকছেন।
আমি অতিক্ষুদ্র এক কবি
মহামান্যের ডাক কেমনে উপেক্ষা করি
আমার তীব্র কাশি, বুঝলাম-
আসলে কাশি কোনো ব্যাধি না
জীবনানন্দের না বলা কথাগুলো
গলা দিয়ে বের হতে চাচ্ছে মাত্র।
আমি কাশতে থাকি
কাশতে কাশতে গলা ফেটে রক্ত আসে
মহামান্য জোর দিতে থাকেন
বলেন এই বের হবে, আরেকটু
তাহলেই গলা দিয়ে বের হবে
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা।
আমি ছটফট করি
আমার কষ্ট হয়
কিন্তু মহামান্য আমাকে ছাড়ছেন না
আজ আমাকে দিয়ে কিছু লেখাবেই
হয়তো তার অব্যক্ত কোনো কবিতা
রুপালী আকাশে জোসনা উঠেছে ভেসে
সুগন্ধি পোকা উড়ছে উত্তরের বাতাসে
একা দুপুর চিলের ডানায়,
স্বপ্নরা কাতরায়
হে মহামান্য জীবনানন্দ!
আপনি কোথায়?
রম্য গল্প : ডাক্তার সমাচার
ডাক্তার সমাচার
আকিব শিকদার
আমাদের কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল সৈয়দ সানোয়ার স্যার একজন হাঁপানির রোগী। এজমাট্যিক সমস্যা। রোগ বেড়ে গেলে তিনি হাসপাতালে যান ঠিকই, তবে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেন না। চেম্বারের সামনে বসে থাকা রোগীদের সাথে আলাপ করে দেখেন কার সাথে তার সমস্যা হুবহু মিলে যাচ্ছে। তারপর সে রোগী ডাক্তার দেখিয়ে এলে প্রেসক্রিপশন থেকে ঔষধের নামগুলো টুকে নিয়ে ফার্মেসি ঘুরে ঔষধ কিনে বাড়ি চলে যান। ঔষধও যথার্থ পাওয়া গেল, ডাক্তারের ভিজিটও দেওয়া লাগলো না।
জীবন চলার পথে একটু চালাক না হলে কি চলে! ডাক্তারদের যা মোটা অংকের ভিজিট, আর যতো টেস্ট! আঙুল কাটা নিয়ে হাসপাতলে যাবেন, হয়তো পাঁচটি টেস্ট দিয়ে দেবে, যার মাঝে তিনটিই অপ্রাসঙ্গিক। টাকা কামানোর ধান্দা।
পাশের ফ্লাটের মুহিবুর ভাই। যিনি কোট-টাই না পরে অফিসে যান না; তাঁকে দেখি লুঙ্গি পরে হাসপাতাল থেকে ফিরছে। হাতে এক্স-রে প্লেট, প্রেসক্রিপশন ও ওষুধপত্র।
জানতে চাইলাম- “লুঙ্গি পরে কেন?”
বললেন- “আর বলবেন না। গরিব মানুষ দেখলে ডাক্তারদের মায়া হয়। ভিজিট কম নেয়। প্রেসক্রিপশনে ছয়টি ঔষধের নাম লিখে জিজ্ঞেস করলো আমি কি করি। বললাম, একটা গার্মেন্টসে কাজ করি। সাথে সাথে দুটি ঔষধের নাম কেটে দিলো।
বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের কোম্পানির সেলস বৃদ্ধির জন্য ডাক্তারদের ফ্রিজ, টিভি, এসি এমনকি নগদ টাকা উপহার দেন। বিনিময়ে চুক্তি হয় রোগীদেরকে তার কোম্পানির ঔষধ সাজেস্ট করতে হবে। যে ঔষধগুলোর উপকারিতা বা অপকারিতা নেই। ডাক্তার মনে হয় আমাকে লুঙ্গি পরা গরিব ভেবে তেমন দুটি ঔষধের নাম কেটে দিয়েছেন।”
একদিকে বাঙালি হলো অতি মেধাবী জাতি। সিনট্রম দেখে ডাক্তার যে ঔষধ দেন, তারা তা মনে রেখে অন্যের অসুখে নিজেই ডাক্তার সেজে পরামর্শ দেওয়া শুরু করে। যেমন, বুক ব্যথা? মনেহয় গ্যাসটিক, এন্টাসিড খান। চোখে-চামড়ায় এলার্জী? এলাট্রল দুই বেলা। পায়ুপথে রক্ত ঝরে? পাইলস, ডিমোরাইড খেলে পনেরো দিনে সমাধান। মাঝেমাঝে ভাবি ওপেন হার্ড সার্জারিতে ডাক্তার রোগীকে পরিপূর্ণ অজ্ঞান না করলে হয়তো রোগীরা বুক কাটা শিখে এসে আত্মীয় স্বজনদের সার্জারি করতে ডিসপেন্সারি খুলে বসতো।
আমার বন্ধু আরিফের বাবা একজন দাতব্য চিকিৎসক। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ রোগাক্রান্ত হলে তার সেবা-চিকিৎসায় সুস্থ্য জীবন পায়। হাজিপুর বাজারে তার ফার্মেসি। ফার্মেসির নাম নিরাময় কেন্দ্র, যার সাইনবোর্ডে লেখা- “আমি কোন ডাক্তার নই; আমি একজন অভিজ্ঞ রোগী। জীবনে নানান পীড়ায় ভুগিতে ভুগিতে নিজেই এখন ডাক্তার হইয়া গিয়াছি।”
হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।
বন্ধুত্ব
বন্ধুত্ব
তারিকুল আমিন
সন্ধ্যা তারাগুলো আলো মেলে প্রবেশ করছে নিরুর ঝরোকার পর্দা ফুঁটো করে। সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝিপোকার আনাগোনা। মোরগের ডাক। তারপর হাসের প্যাক্ প্যাক্ শব্দ করে ঘরে ফেরা। দূরে বাতাসে ভেসে আসা শেয়াল প-িতের হুক্কাহুয়া শব্দ। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায়। সন্ধ্যার সাঁজবাতি জ্বালায় প্রতিটা বাড়িতে। চারপাশে খাঁ খাঁ অন্ধকার। তার ভিতরে দূরে দেখা যায় একটি জানালার কাছে কুপি বাতি জ্বলছে আপন ত্যাজে। পাশে একটি স্বাধীনতাহীন টিয়াপাখি বন্ধখাচায় বন্ধী। কোন একটি বাড়ি থেকে ভেসে আসে “মা আমারে আরাকটা পোড়া রুটি দিবা?” বাহিরে জোনাকি পোকার পিটপিট আলো জ্বলেই চলছে। এমন সময় বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠবে “না না মম আর লাগবে না!” ধীরে ধীরে শব্দগুলো হারিয়ে যায়। সব ঘরের কুপি নিভে যায়। জ্বলে থাকে ঐ জানালার সেই আপন গতিতে জ্বলতে থাকা হারিকেন। হঠাৎ একটি শব্দÑ না..! না..! আমায় ছাইড়া দেন সাব! আমার এতো বড় ক্ষতি কইরেন না! হঠাৎ মিলিয়ে যায় খাচা আর নিভে যায় হারিকেন। চিৎকারের শব্দে কলাবাদুরের ছুটোছুটি দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর সেই জানালার থেকে কী জানি লাফিয়ে পড়ে। কে হতে পারে? সেই মেয়েটা? নাকি ভদ্রতার আড়ালে থাকা অভদ্র মানুষটা?
আজান শোনা যায়। রোজিনা বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। রোজিনা বেগম নামাযের জন্য ওজু করতে যায়। ওজু করে নামায আদায় করে। নামায শেষ করে ঘর ঝাড়– দেয়।
-বাবা করিম। উঠ বাজান। কামে যাবি না। দেরি হইলে তোরে মারবো। যা বাজান।
দেখে ঘরে করিম নেই। অনেক আগেই চলে গেছে কাজে। কারণ কাজ না করলে হাজিরা পাবে না। আর ঘরে চুলাও জ্বলবে না। রোজিনা মনে মনে বলল, পোলাঢার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এই বয়সে পড়াশোনা করার কথা। সেখানে ও কাজ করে। কাজে একটু দেরি হইলেই মারে মহাজন। হায় খোদা! কান্নায় ভেঙ্গে পরে।
-ও আল্লাহ মেলা সময় হইল দেহি। আমার সাহেব তো অফিসে যাবু। যাই তাড়াতাড়ি কাজে যাই।
-পারু ও পারু। কই গেলা। দরজা খোলো।
এদিকে কাজ করে রোজিনা। চা বানায়। রুটি বানায়। সবজি আর ডিম ভাজি করে।
-বুয়া! এই নাও এই রুটি তুমি খাও। মনে হয় সকালে কিছু খাওনি। দুটো রুটির একটি রোজিনা খায়। আরাকটা ছেলের জন্য নিয়ে যাবে তাই শাড়ির আঁচলে গিট দিয়ে রেখে দিয়েছে। এভাবে রোজিনা ছেলের জন্য খাবার নিয়ে যায় বাসায়।
সন্ধ্যা। বারান্দায় দেখা যায় একটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। মাঝে মাঝে চাঁদের সাথেও কথা বলে। কিছুক্ষন পর পর বারান্দায় হাটতে দেখা যায়। একা একা কার সাথে জানি কথা বলে। তবে কার সাথে কথা বলে তা দেখা যায় না। বারান্দার ব্যালকনিতে থাকা সেই টিয়া পাখি বললÑ নিরু! আজ তোমায় এতো খুশি দেখাচ্ছে। নিরু বললÑ কই খুশি। আরে এমনি সই। টিয়া বললÑ না সই তুমি যতই লুকাতে চাও তুমি আমার কাছে লুকাতে পারবে না। আমি তোমার মুখ দেখে সব বুঝতে পারি। এমন সময় চুলের মুঠি ধরে দে টান। নিরুকে মারছে। আর টিয়া চেচাচ্ছে। ছাড়ো! ছাড়ো! দুষ্ট মেয়ে ছাড়ো! টিয়া পাখিকে রাগে খাচা খুলে যেই ধরতে যায়। অমনি কামড় দিয়া টিয়া চলে যায়। তারপর টিয়া উড়ে পাশের বাড়ির বারান্দায় বসে। এদিকে নিরুকে গরম খুরচুন দিয়ে পিঠ পুড়িয়ে দেয়। সেদিন নিরুর চিৎকারে টিয়া শুধু বললÑ হায় আল্লাহ! সখি! ও সখি! তোমায় ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। দরজাল মহিলা পাখিটাকে তাড়ানোর জন্য সব সময় গরম পানি মারে। কিন্তু টিয়া যায় না। টিয়া নিরুর কষ্ট দেখে আল্লাহকে সব সময় বিচার দেয়। টিয়া কষ্ট সহ্য করতে পারে না নিরুর। একেই বলে বন্ধুত্ব।
জন হচ্ছে বড়লোক ঘরের একমাত্র সন্তান। জনের কোন অভাব নেই। জন দেখতেও যেমন তেমনি ভালো একটি ছেলে।
-ড্যাড গাড়িটা নিয়ে কোথায় ঠিক করাবে? আমাকে নিবে ড্যাড?
-ওকে চল।
সেখানেই পরিচয় হয় করিমের সাথে। একই বয়স। কিন্তু নিয়তির কী অভিনয়। কেউ পেটের ক্ষুধার জন্য ছোট বয়সে ধরতে হয় পরিবারের দায়িত্ব। আর কেউ এর কিছুই জানে না। ওদের দুজনের প্রথম দেখাতেই ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। দুজন অনেক কথা বলে। এমন সময় ডাক আসে।
-করিম...! ঐ শালার বেটা করিম। ঐহানে গল্প করলে কী তোর পেটে ভাত হইবো। শালা জানোয়ারের ছাওয়াল।
-ড্যাড! লোকটা করিমকে এসব বকা দিচ্ছে কেন? ছি কী খারাপ মানুষ। তার কি ওর মত সন্তান নেই।
-থাক বাবা এসব নিয়ে চিন্তা করো না।
পরে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু জনের মাথায় বন্ধুর সেই কথাগুলো ঢুকে রয়েছে। এরপর খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে ওদের বস্তিতে।
- করিম! করিম! তুমি বাসায়?
-হ্যা! কে?
-আমি জন? শুনলাম তুমি অসুস্থ নাকি?
-কাল তোমায় মেরেছে ঐ দুষ্ট লোকটা মনে হয়। তখন দেখে শরীরে অনেক আঘাত।
-কে বাবা তুমি। আর আমার পোলারে তুমি চিন কীভাবে?
-আন্টি আমি জন। আন্টি ওকে আমি নিতে এসেছি।
জনের গাড়ি দিয়ে ঘুরে করিম। জন করিমকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। পুরা জায়গাটা ঘুরায়।
-করিম তুমি স্কুলে পড়বে?
-হ্যা!
-আচ্ছা, তুমি আজ থেকে ঐ দুষ্ট লোকটার কাছে যাবে না ঠিক আছে।
-না গেলে ভাত খামু কী কইরা।
-সেটা তোমার চিন্তা না। এই কলমটা নাও। প্রতি রাতে তুমি এটার কাছে চাবে। দেখবে সকালে তোমার বাসার কাছে রোজ টাকা চলে আসবে।
-কী বল? সত্যিই!
-হ্যা, সত্যি!
পরে করিমকে বরাবর মোহনপুর সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করায়। রোজ সকালে দেখে ওদের বাসার সামনে টাকা আর কিছু ফল ও সবজি রাখা থাকে। কে দেয়? কীভাবে আসে? এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না করিম। কারণ ও জানে ওর কাছে জাদুর কলম আছে সেটাই দেয়। এভাবে পড়াশোনা চলতে থাকে করিমের। অন্য দিকে জন ও করিমের বন্ধুত্ব আরো গভীর হচ্ছে। দুজন দু স্কুলে পড়ে। আর করিমের মা নতুন বাড়িতে কাজ করে। এখন ওরা ভালো সুখেই আছে।
বন্ধু টিয়া একদিন বলল- আল্লাহ তুমি আমাকে নিরু বানিয়ে দেও আর নিরুকে টিয়া করে দাও। ঐ শয়তান বুড়ো আর বুড়িকে এবং ওদের দুষ্ট সন্তানকে শাস্তি দিবো?
আল্লাহ সাথে সাথে কবুল করে নেয়। পরে এক এক করে পাখি নিরু দুষ্ট বুড়ো আর বুড়িকে এবং ওদের সন্তানকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। আর মহিলাটাকে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর হাওয়া হয়ে যায় পাখি নিরু আর মানব নিরু। তবে শোনা যায় ওদের দুজনকে প্রায় দেখা যায় জানালার পাশে গল্প করতে। খিল খিলিয়ে হাসতে।
এভাবে অনেক বছর কেটে যায়। করিম এখন কয়েকটি ছেলেকে পড়ায়। অন্যদিকে জন বিদেশে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। একদিন বুঝে যায়। আসলে কলমটি জাদুর নয়। বন্ধু জন রোজ লুকিয়ে ওসব রেখে যেতো। এখন করিমের মাকে আর বাসা বাড়িতে কাজ করতে হয় না। করিম প্রাইভেট পড়ায়। সেখান থেকে ভালো টাকা আয় করে।
-হ্যালো! কে বলছেন?
-আমি জনের বাবা..!
-আসসালামু আলাইকুম আংকেল!
-জন আর নেই বাবা! বলেই চিৎকার করে কান্না করে জনের বাবা।
পাশের ঘর থেকে শোনা যায়। আমেরিকায় একটি বড় শপিংমলে ডাকাতির হামলায় বাংলাদেশী ছাত্র জন নামের একটি ছেলে মারা যায়। বাকরুদ্ধভাবে বসে পড়ে করিম। আর কোন শব্দ বের হয় না..!
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অভিনয় ও আবৃত্তি শিল্পী।
বাড়ি#২১, ফ্লাট#এ-৩, রোড#২, ব্লক-এ, ঢাকা উদ্যান
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৩১০২৭৫৬৩৩
শব্দমালা : আসিফ আহমদ
শব্দমালা
আসিফ আহমদ
মহানগর
মুদ্রা বিলাপীর হাহাকার! নগরীর কুঠুরি হতে প্রাচীরে। এখানে মানবজনম থেকেও দ্বিগুণ, পাথুরে ভবনের জন্ম। তার সাথে সাথে কেমন নিরেট পাথুরে হয়ে উঠছে লোকেদের মখমলে মনটা!
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রকৃতি হত্যার মহোৎসব।
বহুতলা ভবনের আধিপত্যে দেখা মেলে কই নীলিমার? প্রভাকরেরও সাক্ষাৎ নেই তাই।
এখানে মানুষ আসে মুদ্রা অন্মেষণে,
শেষে মুদ্রা হয়ে উঠে জলজ্যান্ত মানুষ।
আর মানুষটা হয়ে যায় কচকচে নোট!
হায়রে নগর, মহানগর! সব সমাপ্তির পর ধরলি আবার নয়া নাগর। তো এই নাগরের নাচন কদ্দিনের? আমিও তো একি নাওয়ের নাবিক। কয় নম্বর নাগর আমি, মহানগরী হে?
এখন
কাকভোরে মক্তব পালানো ছেলেটি এখন জীবন থেকে পালাতে চায়।
বুক পকেটে কলম রাখা কিশোরটি এখন,
প্যান্ট পকেটে রিবালবার নিয়ে ছুটদেয় স্কুল পথে। তাঁর বুক পাশে এখন আর পকেট নেই, পকেট ছেঁটে পুরে নিয়েছে একবুক প্রতি হিংসা জগৎ-জাতির পরে।
সদ্য বলতে শেখা শিশুটি এখন টিকটক লাইকির বাজিমাৎ। ব্যস্ত সময় পার করে ফ্যান ফলোয়ার মেইনটেইনে।
মোস্তফা ভাইসিটি খেলা বালকটি এখন
এলাকার বড় ভাই, মানুষ নিয়ে খেলে হরহামেশাই।
পাশের পাড়ার, সকিনার প্রেমে মত্ত হয়ে কবিতা লেখা যুবকটি এখন পৌর মেয়রের ডান হাত।
সন্ধ্যোর বাজার চা আড্ডায় মাতানো বয়োজ্যেষ্ঠটা এখন নিজ মেয়ের সমান,
মেয়ে গুলোর সাথে বাবু সোনা আলাপে মেতে উঠে অবলীলায়।
লাশের সারি!
গোরস্থানে লোকেরা মরিচীকা ধরা কোদাল নিয়ে অপেক্ষারত। আর ডোমেরা শ্মশানে ঘাটে আধভেজা কাঠ ও মাচিশ ভর্তি শলা নিয়ে। যেন তাঁরা প্রতিক্ষায় শত সহস্র বছর একটি লাশের।
এখন কোদাল ভেঙে যায়, গোরস্থান পুড়ে যায়। শ্মশানে কাঠ মাচিশে অনল জ্বেলে রয়। তবুও ফুরায় না শেষ হয়না অযুত লাশের সারি!