ইপেপার : ধানশালিক। । সংখ্যা ১৮৯

ইপেপার : ধানশালিক। । সংখ্যা ১৮৯

তারুণ্যের শিল্প সরোবর । ধানশালিক । সংখ্যা ১৮৯ 

শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩ আশ্বিন ১৪৩০, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ 




























নুন-পূর্ণিমা : মুঠি করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা !

নুন-পূর্ণিমা : মুঠি করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা !



নুন-পূর্ণিমা : মুঠি করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা

মো. আরিফুল হাসান

 

 “মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন,/ চিকন লিকলিকে একটা সাপ যেমন ছিদ্রপথ গলিয়ে/ টুক করে খসে পড়ে ঘরের মেঝেয়,/ এই পংক্তিটি হঠাৎ/ হাসান চৌধুরির করোটিতে হিল হিল করে উঠে।” সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য “নুন-পূর্ণিমা” অপ্রকাশিত কাব্য হিসেবে প্রকাশ হয় তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকীতে। মৃত্যুর পরে উনার ল্যাপটপ থেকে পাওয়া যায় নভেম্বর ২০০২ থেকে জানুয়ারি ২০০৩, গুলশান, ঢাকায় লিখিত এ অমূল্য কাব্যআখ্যানটি। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত চমৎকার প্রচ্ছদের বইটির ব্যাক কাভারে লেখা আছে, “সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের কবিতার ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতা ও জীবন যাপনের বহুকৌণিক দিক উন্মোচন করে। তাঁর কাব্যভূবন নাগরিক জীবনের অভিঘাত এবং অন্যদিকে স্মৃতির তাড়ণায় উজ্জ্বল। বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালায় তিনি জীবনযন্ত্রণার, বিবমিষার, ক্রোধের, সময়ের স্পন্দনে ও উচ্চারণে হয়ে উঠেন আমাদের কাব্য-আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ কবি।.......মৃত্যুর আগে রচিত নুন-পূর্ণিমা কাব্যগ্রন্থে এই বহুগুণান্বিত কবি দীর্ঘ এক কবিতার প্রবাহমান জীবন ও নারীর প্রতি ভালোবাসার যে ছবি অঙ্কন করেছেন তা তীব্র, সুক্ষ্ম সংবেদনে বাংলা কবিতায় এক নবীন মাত্রা সংযোজন করেছে। কতিার সৃজন, মননধর্মে ও স্বাতন্ত্র্যে তিনি যে কত শক্তিমান এ কাব্যগ্রন্থে তার বিচ্ছুরণ আছে।”


নুন-পূর্ণিমার শুরুতে আমরা দেখতে পাই কবি ও সাংবাদিক হাসান একটি পঙক্তি দ্বারা তাড়িত হয় এবং সে সাপেক্ষ সংসারের খবরাখবরের মাঝে শতগুণ অধিক আলোর ভিড়ে রাজপথে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে। কিন্তু বাড়ি কোথায়? কবির ভাষায়Ñ “এই হাসানকে আমরা এক্ষুনি দেখতে পাব/ বিজন খাঁ খাঁ ঘরে একা দাঁড়িয়ে,/ অপেক্ষায়Ñ

এই অপেক্ষার আর শেষ হয় না। হাসান তার স্ত্রী মায়মুনার জন্য প্রতিক্ষিত থেকে বালক পুত্রের কাছে এসে দাড়ায়, তার চুলে হাত রাখে। ভাত রেধে রেখে গেছে বুয়া। সে ভাত ঠা-া হয়ে হিম কড়কড়ে হয়। বুকের ভেতর থেকে ডাক আসেÑ মায়মুনা! মায়মুনা! ডাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় পুত্র মোহিতের। ‘অস্পষ্ট জড়িত কণ্ঠে সাড়া দেয়, বাবা।/ খেয়েছিস? সাড়া নেই।/ মা ফোন করেছিলো? ঘুমের ভেতরে আরও ডুবে যায় বালক মোহিত।’ সাংবাদিক কবি হাসান টেবিলে বসে দ্রুত হাতে লিখে রাখে পঙক্তিটি হারিয়ে যাবার আগেই।


তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা কতকাল, কতদিন পর আমরা আবার হাসান চৌধুরির দেখা পাই হরিষাল গ্রামে। হরিষাল গ্রামের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেন, জলেশ্বরী থেকে আধকোশা নদী পার হয়ে গো-গাড়িতে/ প্রথমেই মান্দারবাড়ি,/ তারপর হাগুরার হাট,/ তারপর পাথারের পর পাথার/.....ধুঁকতে ধুঁকতে এক সময় পৌছে যাবে হরিশাল গ্রামটিতে। হরিষালের ওপারেই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র।’

হরিষালে যেতে যেতে লেখক মানবের চিরাচরিত চরিত্র বর্ণনা করেন এক দারুণ অভিঘাতে। তিনি বলেন, কোনো কেন্দ্র বিন্দুতে নেই আমরা। না পাপের, না পূণ্যের জীবন ধারন করি আমরা। ফলে আমাদের চরিত্র লেখতে গেলে, কোনো প্রশংসা বা নিন্দে কোনোটাই একপেশেভাবে করা যাবে না। লেখকের ভাষায়Ñ না পোশাকে না নগ্নতায়, না গার্হস্থ্যে না লাম্পট্যে,/ না আলোয় না অন্ধকারে,/ না পাপে না পূন্যে! আমরা এসব যুগলের প্রতিটির মধ্যভাগে আছি।’ লেখক বলেন, ‘নববর্ষে মানুষের উৎফুল্ল মিছিলের রঙিন ছবি/ আর বটতলায় বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন লাশÑ/ সেটিও রঙিন।


এই অন্ধকারেই পা ভুল পথে যেতে যেতে আমরা দেখতে পাই প্রাচিন হরষিত নামের হরিষালে কোনো হর্ষ নেই। ‘মনে হবে বহুকাল আগেই এ জনপদ থেকে উঠে গেছে বসবাস।’ তবুও মানুষের দেখা পাবার আশা রেখে আমরা যখন আরও গভীরে পৌঁছাবো হরিষালের, দেখবো কালাপীরের মাজার, মাজার ঘিরে কিছু বাড়িঘর বাশের ও চৌচালা  আটচালা। আমরা আরও দেখি গভীর রাতে কীভাবে জেগে উঠে হরিষাল গ্রাম। দিনের বেলায় খোলসছাড়া সাপের মতো গ্রামটি রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে চোরা ব্যবসায় মেতে উঠে।

মাজারের উপরে সবুজ ত্রিকোণ আন্দোলিত পতাকাগুলো বহু মানুষকে ডেকে আনে এখানে। লোকে বলে. কালাপীরের মাজারে পূর্ণিমার তিন রাত্রি বাস করলে বন্ধ্যা নারী সন্তানবতী হয় আর অমাবস্যার তিনরাত বাস করলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বশীভূত হয়। 


সম্ভবত এ জন্যেই আমরা শুনশান হরিষালে কালাপীরের মাজারের চালাঘরে দুটো পরিবারের দেখা পাই। তারা কেউ এসেছে পূর্ণিমা শুরু হওয়ার আগে কেউ পৌঁছেছে অমাবস্যার অনেক পরে। তারা অপেক্ষা করছে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার। লেখক এ যায়গায় মানুষের চিরন্তন আকাঙ্খাকে ব্যক্ত করেন এভাবেÑ “বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তির চিৎকার প্রতিটি মানুষের,/ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিরূপকে বশে আনবার দিকে যাত্রা।”

কিন্তু এই ‘না পাথরে না পলিতে, না গোলাপে রা কণ্টকারীতে’ আমরা তারপর মগ্ন হই এক যুবতীর সাথে। তার সাথে আমরাও প্রবেশ করি হরিষাল। ‘পালিশ করা কালো পাথরে দুপুরের রোদ্দুর যেনো,/....এই যুবতীর নাম কী? পরিচয় কী? কে সে?” প্রশ্নগুলো থেকে যায় আর সৈয়দ হক একেএকে উত্তরগুলো মেলে ধরেন আমাদের কাছে।


‘যৌবন তার শরীরে যেন সৃষ্টির সংবাদে তোলপাড়।’ যুবতীটি জানায়, তার নাম পুষ্প কাহার। পুষ্প কাহার অতঃপর গ্রামের রমনীদের সহযোগীতায় তার পোড়াভিটিতে ঘর তোলে। ‘কতকালের একটা দিঘির ওপরে যেনো আলো পড়ে,/ আয়না হয়ে যায়। সে আয়নায় আমরা দেখতে পাই যে খুশবো নিয়ে পুষ্প কাহার এসেছিলো সে খুশবো ক্রমাগত বদবু হতে থাকে। পুষ্প কাহারের ঘরে দুপুরের রোদে পুরুষের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। মাঝরাতে চোরাকারবারীরা দল বেঁধে তার ঘরে আসে। পুষ্প খরিদ্দার সামাল দিতে শহর থেকে আরও নারীদের নিয়ে আসে। তাদের মসৃণ দেহ, চুলের ভাঁজ দুপুরের রোদে পুকুরের পানিতে ঢেউ তুলে। গ্রামের রমনীরা লজ্জায় মরি মরি হয়ে জিভ কাটে।

‘মান্দারবাড়ির ভাঙা প্রাসাদ এখনো যাদের সাক্ষী,/ সেই কাহারেরা নেই/ যাদের বংশধরেরা অন্নের জন্যে ত্যাগ করেছে গ্রাম।/ এবং যারা ত্যাগ করেনি গ্রাম,/ তারা এখন পরিণত হয়েছে সীমান্ত-চোরে।’ এখানে লেখক এ ভূমির অতীত ইতিহাসকে নান্দনিক বর্ননায় তুলে ধরেন। কবি এক অনির্বচনীয় আখ্যান বর্ণনার মধ্যে আমাদের মনে করিয়ে দেনÑ ‘এখনো আমাদের কারো কারো ঘরে আছে পুরনো কালের লাঠি/ আছে পালকির ভাঙা টুকরো, মরটে ধরা বল্লম টেঁটা/ এখনো খুঁজলে পাবে।’


মফস্বল থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কবি-সাংবাদিক হাসান চৌধুরির চোখ একদিন আটকে যায়। কালাপীরের মাজারে তিন রাত অমাবস্যা কাটালে নাকি ফিরে পাওয়া যায় হারানো মানুষকে। কবি হাসান চৌধুরির অবচেতনে মায়মুনার মুখ ভেসে উঠে। গভীর রাতে মোহিতকে ডেকে তুলে তাই সে রওয়ানা দেয় হরিষালের দিকে। 

জলেশ্বরীর নদী আধকোষা পার হয়ে হাসান চৌধুরী হরিষালে এসে পৌঁছে। ‘শব্দের মরুভূমিতে সে উটের মতো সারারাত হাঁটে।/ মাঝে মাঝে সে মাজারের সেবকের কাছে গিয়ে বসে।/ বাবা, এ সকল সত্যি কি? ফিরে আসে? একদিন যে চলে গেছে সে আবার ফেরে? খাদেম নিমিলিত চোখে জোড়াসন হয়ে বসে থাকে। খাড়া পিঠ, কঞ্চির মতো চিকন তার দেহটি, হাতে তার জ্বলন্ত ছিলিম। উচ্চস্বরে সে হেঁকে ওঠে, ‘পুষ্প, তুমি সত্য, তোমার বাণী সত্য।’

সীমান্তবর্তী হরিষালে মোহিত একাকী হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে পিলারের কাছে পৌঁছে যায়। হঠাৎ কে যেনো ডাকে। মোহিত পেছন ফিরে দেখে একটি বালিকা। বালিকাটি দৌঁড়ে এসে মোহিতকে প্রতিহত করে। ‘করছো কি? এক্ষুনি সোলজার এসে যাবে। ভয়ে ভয়ে বালক তাকায় পিলারের ওপারে দূর বিস্তৃত ধূসর পাথার। তারা ভয় পেয়ে ফিরে আসে।

হাঁপাতে হাঁপাতে তারা এসে একটি পাকুরের ছায়ায় স্থির হয়। সেখানে আমরা নাম জানতে পারি বালিকাটির। তার নাম ময়না। বুকের কাছে ছোট্ট চুপড়িতে সাপের বাচ্চা ধরে আছে সে। মোহিত চুপড়িটি দেখতে চায়। বুকে চেপে রাখা চুপড়িতে সে হাত দেয়। ময়নার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। “আগামী নারীর ঘণ কণ্ঠে সে বলে ওঠে,/ তুমি আমার বুকে হাত দিলে যে!”


কাব্যোপখ্যানের শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখি হাসান পুষ্প’র ঘর থেকে বিধ্বস্ত হয়ে আসে। তারপর ময়নার মা খোদেজা ও হাসানকে রাতের অন্ধকারে পাকুরের তলায় মুখোমুখি দেখা যায়। হাসান এসেছে হারিয়ে যাওয়া মায়মুনার খোঁজে কালাপীরের মাজারে। আর ময়নার বাবা মোজাফফর খোদেজার ভাষায়Ñ আমার বরের নাম রাক্ষসকে মানাত!” 

এদিকে চাঁদ তার হিং¯্র সহাসৗ মু-ু তুলে নক্ষত্রের অরণ্য ভেদ করে লালা ঝরিয়ে চলেছে অবিরাম। “না জমিতে না পানিতে,/ না সৌরম-লে না কৃষ্ণগহ্বরে,/ না পাথরে না পলিতে,/ না গোলাপে না কণ্টকারীতে,” আমরা জীবনকে একটা মাঝামাঝি পর্যায় থেকে দেখি। এবার কি হাসানের করোটিতে তার সেই প্রথম পঙক্তির পর দ্বিতীয় পঙক্তিটি লিকলিকে সাপের মতো ঝুপ করে খসে পড়বে? অতঃপর “খোদেজা আর হাসানকে দেখি হাত ধরে চালাঘরে যেতে।/ আমরা তাদের দেখতে পাব ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে।/ দূর থেকে আমরা দেখবো আলোর নির্বাপণ।/ আমরা পাথারের ওপর দিয়ে বহে যেতে শুনবো/ পুষ্প কাহারের হাসি।/ আর শুনতে পাব কালাপীরের সেবকের কণ্ঠেÑ/ মুঠো করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা!


কুমিল্লা, বাংলাদেশ



ওল্ডহোম এবং গোলাপজানের গল্প

ওল্ডহোম এবং গোলাপজানের গল্প

 

    অলঙ্করণ : জান্নাতুল ফেরদৌস তন্বী  


ওল্ডহোম এবং গোলাপজানের গল্প

রফিকুল নাজিম


‘শুনছো ? কাল থেকে আবার আমাদের রোজ দেখা হবে। আমরা কিন্তু প্রতিদিনই দেখা করবো। কোনো অজুহাত দাঁড় করাবে না। জানো তো-তোমার সাথে কথা না বলে আমি বেশিদিন থাকতে পারি না। অথচ সেই আমাদের কথা হয় না অনেকদিন হলো। হুম, আগামীকাল ঠিকঠাক সময়ে কিন্তু তুমি চলে এসো।’

বালিশের নিচ থেকে ছবিটা হাতে নিয়ে গোলাপজান মন ভরে ছবির মানুষটাকে দেখছে। মানুষটার সাথে বিড়বিড় করে কথা বলছে। এভাবে তাদের রোজ কথা হয়। আগে অবশ্য রাতের তারাদের আড়াল থেকে কথা বলতো সাদিক সাহেব। গোলাপজান জিরাফের মুখ বাড়িয়ে দাঁড়াতো ঘরের পশ্চিম দিকের জানালায়। জানালার সামনে ঝুলে থাকতো মস্তবড় খোলা আকাশ। বিস্তৃত আকাশে তারকারাজি মিটিমিটি হাসতো। সবার অগোচরে কথা বলতো গোলাপজান আর সাদিক সাহেব। তাদের সেই র্দুদান্ত দিনের কিশোর কিশোরী প্রেমের মতোন। ছেলের বউয়ের কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারির পরও গত দু‘বছরে গোলাপজান গোপনে দু‘তিনবার ঘরের পশ্চিম দিকের জানালা খুলেছে। তাও খুব সর্তকতার সাথে; বিড়াল পায়ে-সাবধানে।


গোলাপজান এই মহল্লার শেষ মাথার দোতলা বাড়িতে থাকেন। ছেলে ফাহিমের সাথে। ফাহিম সরকারের ঊর্ধ্বতন একজন আমলা। কয়েকবছরে তার বেশ নাম-ডাক হয়েছে। তিন বছর আগে এই বাড়িটা কিনেছে সে। বাড়ি কেনার বছরখানেক পর ফাহিম হঠাৎ এক বিকেলে বালিয়াডাঙ্গা যায়। গ্রামটা ঠিক আগের মতো আর নেই। প্রমত্ত নদীর শরীরটা ক্রমেই শীর্ণ হয়ে এসেছে। ছেলেবেলার কদমগাছটা পশ্চিমপাড়ার শতায়ু বারিক দাদুর মতো কংকাল শরীরে একা দাঁড়িয়ে আছে। সবুজের আর বিন্দুমাত্র ছটা নেই তার গায়ে। ফাহিমের স্কুলে যাওয়ার সেই মাটির আইলপথ এখন চওড়া পিচঢালা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে শো শো করে চলে যাচ্ছে দূরের যাত্রীবাহী গাড়িগুলো। গ্রামের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছে সরকার। রাতে দূরের ঘরবাড়িগুলোতে বিজলি বাতি জ্বলে। গ্রাম জুড়ে বিজলিবাতির মিটমিটে আলো আর জোনাকি পোকাগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা হঠাৎ কষ্টসাধ্য বৈকি! বালিয়াডাঙা এখন আর গ্রাম না। আংশিক নগরে রূপ নিয়েছে। তাই বুদ্ধি করে ফাহিম পৈত্রিক ভিটা ছাড়া সব জমাজমি বিক্রি করে শহরের দোতলা বাড়িটা কিনেছে। অবশ্য এখনো তার কিছু দেনা রয়ে গেছে। তাই বাপের ভিটেমাটি বিক্রির পুরো বন্দোবস্ত করেছে সাদিক। একসপ্তাহ পর সব কাগজ কলম হবে। তাই গোলাপজানকে শহরের এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে ফাহিম। রসুইঘরের পেছনের রক্তকরবী গাছটা বালিয়াডাঙ্গার এই বাড়িতেই গোলাপজানকে বউ হয়ে আসতে দেখেছে। আবার বালিয়াডাঙ্গাকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে যাওয়াও দেখছে। সময়ের স্বাক্ষী এই রক্তকরবী গাছটা দু‘দিনই গোলাপজানকে শিশুর মত কাঁদতে দেখেছে!


শহরের এই দোতলা বাড়িটা কখনোই গোলাপজানের আপন হয়ে ওঠেনি। গোলাপজান মনে মনে বিশাল একটা দূরত্ব ভেতরে ভেতরে লালন করেছে একা। সে বালিয়াডাঙ্গার বিশাল আকাশ পেছনে ফেলে এসেছে। তবুও আজো আকাশটার জন্য তার পরাণ পোড়ে। বিয়ের সময়কার সবুজ রঙের ট্রাংকটা খুলে গোলাপজান। লাল টুকটুকে কাতান শাড়িটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে অনেকক্ষণ। এই শাড়িটা পরেই সে নতুন বউ সেজে এসেছিল বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে। তখন তার বয়স কতোই আর হবে? তেরো কি চৌদ্দ বছরের কিশোরী তখন সে। তামাটে শরীরের সেই মানুষটাকে দেখলে প্রথম প্রথম তার খুব ভয় হতো। সাদিক সাহেব-মানুষ হিসেবে কিন্তু বেশ রসিক ছিল। গোলাপজানের সংসারের সাত বছর স্বপ্নের মত কেটে গেল নিমিষেই। সেইবার খুব বান ডাকলো জলেশ^রী নদীতে। ঘোলাপানি উপচে এলো গ্রামের ফসলি জমিতে। আটাশ দিনের বন্যায় পঁচে গেলো মাঠের সব ফসল। শূন্যগোলা থেকে মানুষের ক্ষুধার চিৎকার শোনা যেত। চারিদিকে মানুষের সে কি হাহাকার! চারিদিকে মানুষ ক্ষুধায় কাতর। সাদিক সাহেবের চোয়াল ছিলো বেশ শক্ত। দাঁতে দাঁত কামড়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। কিন্তু  এক দুপুরে মাঠ থেকে এসে ঘরের দাওয়ায় শুয়ে পড়লেন। সেই শোয়া থেকে আর ওঠতে পারেনি সাদিক সাহেব। গ্রামের লোকেরা বলে কলিজার কামড়ে নাকি মারা গেছে। সেই থেকে পাঁচ বছরের ফাহিমকে নিয়ে গোলাপজান একার যুদ্ধ শুরু।


-আপনার গোছগাছ কতো দূর হলো? এই স্মৃতির বাক্স নিয়ে বসে থাকলে চলবে? চোখের জল মুছে সব কিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নেন।

-‎হ্যাঁ গো, বউমা। সেই সন্ধ্যাত্তে গুছাইতাছি। তুমি চিন্তা কইরো না।

-‎আপনি না পারলে আমি রহিমাকে বলি হাত লাগাতে। সকাল সকাল গাড়ি চলে আসবে। রাতেই গোছগাছ শেষ করে রাখেন।

-‎না, ন।  রহিমাকে লাগতো না। আমি পারমু। ফাহিম কি আইছে বাসাত?

-‎না। আসতে নাকি দেরি হবে। অফিসের কী কাজে আটকা পড়েছে।

-‎ফাহিম আইলে আমারে একটু কইয়ো, বউমা।

-‎ ড়য ফরংমঁংঃরহম! ও ংধু ধমধরহ,হবাবৎ পধষষ সব বউমা। ক্ষেত ক্ষেত শোনায়। তাড়াতাড়ি গোছান তো সব। যত্তোসব!


ফাহিমের বউ হনহন করে কিচেনের দিকে হেঁটে গেলো। আবার ট্র্যাংক খুললো গোলাপজান। সবুজ রঙের ট্র্যাংক হাঁতড়ে খুঁজে পায় ফাহিমের একটা ছবি। সাদাকালো। পাসপোর্ট সাইজ। সম্ভবত এসএসসির ফরম ফিলাপের জন্য তোলা হয়েছিলো ছবিটা। তখন গোলাপজান ফাহিমকে খোকা নামে ডাকতো। সে‘বার খোকার ফর্ম ফিলাপের জন্য গোলাপজান কানের দুলজোড়া বিক্রি করতে হয়েছিলো। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে অনেক যুদ্ধ করে মানুষ করেছে ফাহিমকে। সারারাত কাপড় সেলাই করা, সকালে খোকাকে স্কুলে পাঠিয়ে গঞ্জের দোকানগুলোতে কাপড় ডেলিভারি দেয়া। খুব হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে গোলাপজানের। তিলে তিলে আজকের এই মস্ত অফিসারকে হিসেবে গড়ে তুলেছে গোলাপজান। গোলাপজান এসব ভেবে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলে থাকে। নিজের বুকটা টান টান হয়ে যায় গর্বে। ফাহিম আজ কত্তো বড় অফিসার!


গোলাপজান জায়নামাজ আর তসবিহ তুলে রাখে ট্র্যাংকে। মা মা ডাকতে ডাকতে হুড়মুড় করে গোলাপজানের ঘরে ঢুকে ফাহিম। বেশ ভড়কে গেছে গোলাপজান। শেষ কবে যে ফাহিম এই ঘরে এসেছে! শেষ কবে এভাবে মা মা করে বাড়ি মাথায় তুলেছে-মনে করতে পারছে না সে। ছোটবেলায় ফাহিম মা মা করে পুরো বালিয়াডাঙ্গা গ্রামটাকে মাথায় তুলতো। ইদানিং খোকার অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিন গোলাপজান দরজার আড়াল থেকে ছেলেকে লুকিয়ে দেখে। ‘আজ কিনা হুট করে তার সে ঘরে চলে আসলো! কিছু হয়নি তো আবার। অজানা একটা শল্কা সুঁইয়ের মতো ফোঁড় কাটে মনে। না হয়তো। আগামী হয়তো চলে যাবো তাই হয়তো খোকার মন খারাপ। তাই হয়তো এমন করে করে জড়িয়ে আছে। তবুও থাকুক। কতোদিন খোকার শরীরের এই ঘ্রাণটা নিতে পারে না। খোকা এমনি করে আরো কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাক।’ কথাগুলো একমনে ভাবে গোলাপজান।


-মা, ঘরের বাইরে চলো। অনেকদিন হয় তুমি বাবাই‘র ঘরে আসো না। চলো আজ আমরা অনেক গল্প করবো।

-হ্যাঁ রে খোকা, তোর শরীর খারাপ করছে না তো? 

-আমি ঠিকঠাক আছি। ‎চলো তো, মা।


ফাহিম গোলাপজানের হাত শক্ত করে ধরে ড্রয়িংরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে অনেকটা ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নের মতোই এসব ঠ্যাকছে। ঐতো বাবাই ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। মটু পাতলু তার প্রিয় কার্টুন। দশ বছরের বাবাই তার চোখ ছানাবড়া করে দ্যাখছে দাদুকে। গত দু’বছরে বড়জোর চার পাঁচবার দাদি-নাতিনের সরাসরি দেখা হয়েছে! কি অদ্ভুত! যেন নিজ ভূমে পরবাসী তারা।


-হাই বাবাই, আজ থেকে তুমি তোমার গ্র্যান্ডমায়ের সাথে গল্প করবে। রূপকথার কিচ্ছা শুনবে। ডু  ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?

-‎সরি,পাপ্পা। মাম্মি মাইন্ড করবে। খুব রাগ করবে। আর দি’দার কিচ্ছা নাকি সেই সেকেলের গালগপ্পো। এসব রাবিশ ফেইরিটেইল শুনতে বারণ করেছে মম।

-‎আমি বলছি। আজ থেকে তুমি দি’দার সাথে গল্প করবে। ওকে?

- ‎ওকে,পাপ্পি।


গোলাপজান কিছুই বুঝতে পারছেন না। কিসব হচ্ছে এসব! রিনা গরম গরম এক গ্লাস দুধ নিয়ে এলো।

-মা, গরম গরম দুধটা এক ঢুকে গিলে ফেলুন তো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন। ছিঃ বাবাই, এসব কথা বলে না। তুমি অবশ্যই দি’দার সাথে বসে গল্প করবে। আমি কেন নিষেধ করবো? বোকা ছেলে আমার। গুছিয়ে এখনো কথা বলতে শিখেনি।


গোলাপজানের বিস্ময়ের ঘোরের সুতো আরো পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে এসব! এসব তো আগামীকাল সকালের ফর্মালিটি। তো এখনই কেন এমন করছে ফাহিম আর রিনা? নয় ক্লাস পাস করা এই ষাটের ঘরের বৃদ্ধা কিভাবে এই জটিল অংকটা মিলাবে? অথচ এই গোলাপজানের জন্যই রিনা ফাহিমকে প্রায় ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছিলো। ঘরে থাকা প্রাচীন মুদ্রার কোনো মূল্য থাকে না। নেহাত শোপিচের চেয়ে বেশি কিছু না। শেষমেশ গোলাপজানকে ওল্ডহোমের রেখে আসার শর্তে রিনা আবার গত পরশুদিন এই বাসায় পা রেখেছে। হঠাৎ সেই রিনা গোলাপজানকে মা ডাকছে! তার জন্য নিজ হাতে কিচেন থেকে গরম গরম দুধ নিয়ে আসছে! কিছুতেই ঘোরটা কাটে না গোলাপজানের।


-হ্যাঁ রে খোকা, কি হয়েছে রে, বাপ? কোনো সমস্যা হয়েছে?

-‎না, মা। সবকিছু ঠিকঠাক আছে।

-‎শোন খোকা, এখন আমাকে ছাড়। সাথে কয়েকটা বই নিতে হবে। সব বই নিয়ে রাখমু কই? তাই কিছু বই বাছাই করতে হবে। সকালে আবার গাড়ি চলে আসবে। আমি যাই রে,বাবা। গোছগাছটা শেষ করতে হবে।

-‎বসো তো, মা। তোমাকে ব্যাগ গোছাইতে হবে না। সকালে গাড়ি আসবে না। 

-‎কি যে বাজে বকছিস তুই! 

-‎হ্যাঁ মা। আগামীকাল তোমার গাড়ি আসবে না। আর কোনোদিনও ওল্ডহোমের গাড়িটা আমাদের বাসায় আসবে না।

-‎আমি তোর কথার মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝছি না। ওদের গাড়ি না আসলে আমি কিভাবে একা ওল্ডহোমে যাবো?

-‎ওখানে আর তোমাকে যেতে হবে না। করোনার ছোবলে সারাবিশে^ লাখ লাখ লোক মারা যাচ্ছে। গতকাল আমার এক কলিগ হাসিবও মারা গেছে। জানো-ওর মা ওকে দ্যাখতে ওল্ডহোম থেকে পালিয়ে এসেছে! তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি-আমরা একত্রে বাঁচবো। মাগো,আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।

-খোকা, ‎তোর কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দ্যাখছি রে! এসব কী আর বাস্তবে হয় রে! বউ মা আর বাবাইকে নিয়ে মাঝে মাঝে আমাকে ওল্ডহোমে দ্যাখতে আসিস। তোর কাছে আমার শেষ একটা চাওয়া-দাদুভাইকে একটু দ্যাখার জন্য মাঝেমধ্যে ওল্ডহোমে নিয়ে আসিস। ওর সাথে একটা বেলা গল্প করতে দিস।


গোলাপজানের গলা ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে বাবাই। মাথা নিচু করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে ফাহিম। বৃষ্টির দিনে বালিয়াডাঙ্গার ঘরটার চালা দিয়ে যেমন টুপটুপ করে জল পড়তো, ঠিক তেমন করে নোনতা জলে ভিজে গেছে ফাহিমের বুক।

অনুতাপের আগুনে পুড়তে পুড়তে কাঁদছে রিনা। গোলাপজানের হাত টিপতে টিপতে বললো, ‘সরি মা। আমাকে ক্ষমা করে দেন। সব দোষ আমার। আমি লজ্জিত, মা। আজ থেকে আপনি আমার মা হয়েই এই বাসায় থাকবেন। তবে আমার একটা শর্ত আছে- আমাকে কিন্তু বউমা বলেই ডাকতে হবে। এখন আমরা ড্রয়িং রুমে সবাই মিলে টিভি দ্যাখবো। বাবাইকে কিন্তু রোজ রাতে কিচ্ছা শোনাতে হবে, মা। আমরা চারজনে বসে লুডু খেলবো। কি গো মা,আমাদের সাথে খেলবেন না?’


চারজনই একসাথে কাঁদছে। তবে গোলাপজানের চোখের জলে আনন্দের গাঢ় রঙ লেগে আছে। গোলাপজানের বুক থেকে মাথা তুলে রিনা বললো, ‘ওহ মা, আরেকটা কথা-আজ থেকে আপনি দক্ষিণের ঘরেই থাকবেন। ব্যালকনি থেকে প্রতিদিন আপনি আকাশ দ্যাখবেন।’ কথাটা শেষ হতেই গোলাপজান দক্ষিণের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতের আকাশটা আয়নার মতোই আজ পরিষ্কার। কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিতে ঝরে গেছে ঈশানকোণে জমাট বাঁধা মেঘমালা। মুছে গেছে মাটির ধূলো। ঐতো পরিষ্কার দ্যাখা যাচ্ছে সেই তারাটা। গোপালজানে চোখে তারাটা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসে।


পলাশ,নরসিংদী। 


কৃতজ্ঞতাঃ অভিনেতা ও কবি ইন্দ্রনীলকে। 

তাঁর ‘করোনার মা’ কবিতার ছায়া অবলম্বনে লেখা আমার গল্পটি।


দুই কূল

দুই কূল

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
 


দুই কূল

সাদ্দাম মোহাম্মদ



ওরা সবাই শান্তি চায়, শান্তি কামনা করে। ওদেরকে বোঝাতেই পারি না যে শান্তি চাওয়ার কিছু না পাওয়ার কিছুও না। শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়, প্রতিষ্ঠার কাজ। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ওদের ভূমিকা শূন্যের কোঠায় হলেও শান্তি প্রাপ্তির অভিপ্রায় ওদের আকাশ ছোঁয়া। এটাকে নির্লজ্জ অভিপ্রায় বলতেও লজ্জা হয়।

সবার কাছে নিজেকে ছোট করার তো কোনো মানেই হয় না! যারতার কাছে নিজেকে ছোট করতে নেই; ছোট তো তার কাছেই হওয়া উচিৎ, যার কাছে ছোট হয়েও বড় হওয়া যায়।

পরিশুদ্ধতার শিখরে কেবল তারাই পৌঁছায়, সমালোচনাকে যারা গ্রহণ করতে জানে।

সময় কাউকে জেতায় না, আবার ঠকায়ও না; শুধু প্রাপ্তিটুকুন বুঝিয়ে দেয়।

এই সমাজে আমি অপ্রতিষ্ঠিত বলে, আমার সত্য কথাও প্রতিষ্ঠিত হয় না ততটা; যতটা হয় প্রতিষ্ঠিত লোকগুলো মিথ্যা বললে সেই মিথ্যা।

 

রোজ কাকডাকা ভোরে বিড়বিড় করে এমন সব নীতিবাক্য আওড়াতে আওড়াতে রিকশা নিয়ে উপার্জনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায় অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন কাশেম মিয়া। অবশ্য কাশেম মিয়া বলে আজকাল কেউ আর তাকে ডাকে না। ডাকতো তার মা! এ বিষয়টি ভেবে প্রায়ই সে ডুব দেয় ব্যথার জলে। ব্যথিত হন দারুণরকম। দীনহীন অবস্থা সমাজে শুধু মানুষের আত্ম-সম্মান বা মানুষকেই ছোট করে ক্ষ্যান্ত হয় না, সুন্দর নামগুলোকেও অসুন্দর করে দেয় কখনো কখনো। কাশেম মিয়ার মতে, দরিদ্র ব্যক্তিদের নাম সুন্দর হওয়া খুব সম্ভবত বেমানান, বেখাপ্পা। তার মায়ের পক্ষ থেকে দেওয়া উপহার এই কাশেম মিয়া নামটাকেও খাটো করা হয়েছে, ব্যঙ্গ করা হয়েছে। সবাই এখন তাকে চেনে, জানে এবং ডাকে কাইশ্যা নামে।

 

অন্ধকারের ঘনত্ব একটু একটু করে হ্রাস পাচ্ছে, বাড়ছে পাখির কোলাহল, কমছে নীরবতা। কোথাও কোথাও থেকে বাতাসে ভেসে আসছে আজানের পবিত্র ধ্বনি। নামাজের দিকে, কল্যাণের দিকে আহ্বানরত মুয়াজ্জিন। নিত্যদিনের মতো দোকান খুলে প্রথম খদ্দের কাশেম মিয়ার জন্য প্রতিক্ষা করছেন চায়ের দোকানি সুশীল। শুরু করেছেন প্রাত্যহিক জীবনের আয়োজন। ছক করা জীবন তার। নিত্যদিনের সবকিছুই তিনি করে থাকেন নিয়ম মাফিক। মানসিকতার দিক থেকে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন প্রকৃতির মানুষ। এমন পরিচ্ছন্ন রকমের মানুষ সবকালে, সব সমাজে থাকে হাতে গোনা ক’জন। দু’চারটে কালো এবং দু’চারটে সাদা, এই হচ্ছে চুল এবং গোঁফের ধরন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল। না নিজে কারো সাথে কখনো কোনো বিষয়ে ঝামেলায় জড়ায়, আর না তার সাথে জড়াতে দেয় কাউকে। এক বাক্যে বলা চলে, বল থাকা সত্ত্বেও সয়ে যাওয়া মানুষ! এমন মানুষ আজকের পৃথিবীতে মেলে ঢের কম।

 

প্রতিদিন কোন কাষ্টমার কখন আসবেন, কি খাবেন, কি বলবেন এসব বিষয়ে তার সব জানা। চায়ের কাপে প্রথমে বা একবার দেওয়া দুধ চিনিতে সন্তুষ্ট নন, এক চুমুক মুখে নিয়ে পুনরায় একটু দুধ চিনি দিয়ে নেড়ে দিতে বলেন এমন কাষ্টমার এলাকায় বিদ্যমান কতজন তাও তার জানার বাহিরে নয়। বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়ে বাকিতে কার্য হাসিল করবেন কে কে সেটার একটি তালিকাও আছে তার কাছে।

 

রোজকার প্রথম কাষ্টমার কাশেম মিয়া দোকান ঘেঁষে রিকশাটা রেখে দোকানি সুশীল এর উদ্দেশ্যে বললেন ‘চা দেন ভাইজান’। কিছুকিছু মানুষের কথা বলার ধরনটা বা বচন ভঙ্গিটা বেশ হৃদয়গ্রাহী, শ্রুতি মধুরও বটে! এরা যখন কথা বলেন, তখন তাদের কথা যত শোনা হয়,  আরো বেশি শোনার অভিপ্রায় জাগে। অবশ্য এমন মানুষের সন্ধ্যান পাওয়া আজকাল দুষ্কর।

খুব মিষ্টি করে কথা বলে দুই শ্রেণির মানুষ। এক শ্রেণি মিষ্টভাষী, অন্য শ্রেণি প্রতারক। কাশেম মিয়া মিষ্টভাষীদেরই একজন! সুশীল চা বানাচ্ছে আর অপেক্ষা করছে আজ কাশেম মিয়া তাকে কি কথা শোনায়। চা খেতে এসে সারাদিন অনেক মানুষই তার দোকানে বসে অনেক কথা বলেন, গল্প করেন। কিন্তু সুশীল সারাদিনের সব কাষ্টমারের তুলনায় অনেকটা বেশিই গুরুত্ব দেন কাশেম মিয়ার কথাগুলো শোনায়। অপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কথা সত্য, গুরুত্বপূর্ণ, এবং মূল্যবান হলেও তা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কর্ণ কুহরে খুব করে পৌঁছায় না!

 

সুশীল এই দিকটা থেকে বেশ ব্যতিক্রম। এত ভোরে কাষ্টমার কম হওয়ায় কাশেম মিয়ার গুরুত্ব পেতে এবং সুশীলের দিতে সমস্যা হয় না কারোরই। কাশেম মিয়া রিকশা চালক হলেও তার সৃজনশীল মেধা আছে, সূক্ষè চিন্তাশক্তি আছে, নিঃñিদ্র বিচার বিশ্লেষণের সক্ষমতা তার প্রবল। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র নিয়ে আছে তার অগাধ মোহ, অনুরাগ, দায় এবং ভাবনা।

নিত্যদিন চা খেতে এসে তিনি এমন সব জ্ঞানগর্ভ কথা বা নীতিবাক্য বলেন যা শুনে সুশীল রীতিমতো নড়েচড়ে বসেন বা হিমসিম খান। অবশ্য মুগ্ধও যে হন তা একেবারেই মিথ্যে নয়। নতুন কিছুর প্রতি মানুষের আকর্ষিত হওয়ার বা দুর্বল হওয়ার পুরাবৃত্ত অনেক শক্তিশালী এবং পুরোনো। কোনো কিছু অনুকূলে আসা বা হাতে পাওয়া মাত্রই ধীরেধীরে তার গুরুত্ব শূন্যের কোঠায় নামতে থাকে, আর আগ্রহ বাড়তে থাকে নতুনের প্রতি। সুশীলকেও কাশেম মিয়ার নিত্যনতুন কথা, বাস্তবতা নিংড়ানো বাণী, আত্ম-সংশোধনমূলক এবং আত্ম-উন্নয়নমূলক কথা খুব টানে, আকর্ষণ করে, ভাবায়।

 

সুশীল কাশেম মিয়ার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে তার দিকে অগাধ আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছেন তিনি কি বলবেন তা শ্রবণের অভিপ্রায়ে। কাশেম মিয়া হাতে কাপ নিয়ে হেলান দিয়ে বসে চায়ের কাপে একটি চুমুক দিয়ে সুশীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ আমাদের দেশে একটি কথার শ্রুতি আছে যে, ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়। এই কথা কেউ মানুক বা না মানুক! আমার কথা হচ্ছে একজন পুরুষের এক ফোটা দেহের নির্যাস থেকেও সন্তান জন্ম হওয়া খুব সম্ভবত অসম্ভব নয়। কিন্তু এই নির্যাসের তেমনটা আর ব্যবহার হচ্ছে কৈ! একজন পুরুষ তার সমস্ত দাম্পত্য জীবনে দুই বা একটি সন্তান নিলে এই সন্তান নেওয়া ব্যতীত তার নির্যাসের সবটুকুই নষ্ট হচ্ছে বা ব্যবহারহীন স্খলিত হচ্ছে। হিসেব করলে দেখা যায়, একজন পুরুষের দেহের নির্যাসের শতকরা প্রায় নব্বই ভাগই কোনো কাজে আসে না”।

 

কাশেম মিয়া কিছু বলবেন, এজন্য তার মুখের দিকে হাজার বছরের প্রতিক্ষা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন সুশীল। একবার কাউকে ভালো লাগলে, তার সবকিছুই ভালো লাগতে থাকে। এমনকি সে একটি কথা বলবে, আর তা শোনার জন্য হাজার বছর প্রতিক্ষায় থাকাও আনন্দের হয়ে ওঠে। কাশেম মিয়া উপরোক্ত কথাটি বলে চায়ের কাপে পুনরায় চুমুক দিতে ব্যস্ত হলেন। সুশীল কাশেম মিয়ার কথা শুনে মাথাটা উপরে নিচে ঝাকিয়ে হ্যাঁ বোধক সায় দিলেন। তিনি আজকাল ভালো মন্দ সব মানুষের সব কথাতেই সায় দেন, কিন্তু রায় দেন না। তার বোধ এই যে, রায় প্রদানের তুলনায় সায় প্রদানে ঝামেলা কম। তিনি কোনো ঝামেলার আগে পিছে থাকতে নারাজ, তাই এমনটা করে থাকেন।

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


কাশেম মিয়া চা শেষ করার লক্ষ্যে চায়ের কাপে চুমুকের পর চুমুক দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে সুশীল কাশেম মিয়ার কথাটা নিয়ে ভাবছেন, খুব ভাবছেন! ভাবের তরঙ্গে আত্ম ডুবিয়ে কাশেম মিয়ার কথার অর্থ, গুঢ়ার্থ, সারাংশ এবং সারমর্ম রপ্ত  করার চেষ্টা করছেন। জীবনে অনেক কিছু নিয়েই ভেবেছেন। কখনো কোনো বিষয়ে ভেবেছেন বাধ্য হয়ে,আবার কখনো কোনো বিষয়ে ভেবেছেন স্বেচ্ছায়। অথচ নিজে পুরুষ হয়েও পুরুষের নির্যাস নিয়ে তার কখনো ভাবা হয়নি। হাতের কাছে ভাবার মতো এমন অনেক বিষয়ই থাকে, যা নিয়ে মানুষ কখনো ভাবে না, মানুষের ভাবনা কাজ করে না। মানুষ কাছের বিষয়ের চেয়ে দূরের বিষয়ে এবং সাবলীল বিষয়ের চেয়ে শক্ত বিষয়ে ভাবতে তুলনামূলক বেশি আগ্রহী।

 

কাশেম মিয়া চা শেষ করে দ্রুত টাকা দিয়ে রওনা হলেন বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। বৃহস্পতিবার, তাই ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী, দিনমজুর এবং শিক্ষার্থী সব শ্রেণি পেশার মানুষকে ঘিরেই আজ থাকবে ব্যস্ততা। সুশীল আজ তার দোকান উন্মুক্ত রাখবেন আধবেলা। আগামীকাল শুক্রবার, দিনের পুরোটাই থাকবে তার দোকান বন্ধ। আজ দীর্ঘদিনব্যাপী তার দোকান বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে আধবেলা, আর শুক্রবার বেলার পুরোটা। এই বন্ধ থাকার এবং বন্ধ রাখার পেছনে রয়েছে স্বল্প দৈর্ঘের এক ইতিবৃত্ত। যা সুশীলের জীবনে লাগিয়ে দিয়েছে বিবর্তন এবং পরিবর্তন উভয়ের ছোঁয়া। কিছুকিছু দিক থেকে সুশীল এখন অনেক বিবর্তিত, আবার কতিপয় দিক থেকে সে পূর্বাপেক্ষা অনেকটাই পরিবর্তিত। জীবনে কিছুকিছু ঘটনা ঘটে পুরো জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। তা স্বর্গের দিকেও হতে পারে, বা পারে নরকের দিকেও হতে।

 

স্বাভাবিকত দৈর্ঘের দিক থেকে প্রচ- দীর্ঘ এবং প্রস্থে বেশ সরু দেহ নিয়ে বহমান একটা নদী। অত্যন্ত শান্তরকম এর বয়ে চলা, মুগ্ধকর এর মোহনা, প্রাণ জুড়ানো এর আর্দ্র বাতাস। সবাই একে ডাকে সাধুর নদী বলে। বিছানো বুকটা নদীর ছোট হলেও এই ছোট বুকেই ধারণ করে আছে এক প্রকা- ইতিহাস। কোনোকালে কোনো এক সাধুর সাধনার জোরে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো মৃতপ্রায় এই নদীটি। সেই থেকে এই নদীর নামকরণ হয় সাধুর নদী।

 

নদীর দুই কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দুটি গ্রাম। চোখ পড়তেই মন বলে, কোনো আঁকিয়ে হয়তো আন্তরিকতার প্রাচুর্য নিয়ে সবুজ তুলি দিয়ে এঁকেছেন গ্রামদুটো। গ্রামের যেখানেই চোখ পড়ে, চোখ ফিরিয়ে আনা দায়! প্রজ্ঞা এবং সুশীল, দুই গ্রামের বাসিন্দা দু’জন।

 

প্রায় বেশকিছু বছর পূর্বে দুই পরিবারের অভিপ্রায়ে দুইকূলের দুটি সত্তাকে এককূলে আনার ব্যবস্থা হয়। সুশীল এবং প্রজ্ঞার হয় বিবাহ বন্ধনের আয়োজন। বিয়ের পর সরল প্রকৃতির সুশীল বিয়ে করে বউ পেয়েছেন নাকি স্বর্গ পেয়েছেন তা তার উল্লাস দেখে আচ করা ছিলো শক্তকাজ। বিবাহ বন্ধনটা এমন একটি বন্ধন, যে বন্ধনের মাধ্যমে একজন মানুষ তার নিজেকে হারান অন্য একজন মানুষের মাঝে এবং অন্য একজন মানুষকে আবিষ্কার করেন নিজের মাঝে। এক-আধটু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে অজানা অচেনা বা স্বল্প চেনা জানা একটি মানুষকে জড়িয়ে নিতে হয় জীবনের সাথে, সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার সাথে।

 

সুশীলের খুব ইচ্ছে ছিলো, তার জীবন অভিধানে ‘তুমি’ শব্দটি যুক্ত হোক, তার এমন একটা মানুষ হোক যে করবে তার অপাদমস্তক দখলদারিত্ব। তার মতে, প্রতিটি মানুষেরই এমন একজন কাছের মানুষ থাকা চাই, যার কাছে হাসি কান্না ভালো মন্দ সবটাই প্রকাশ করা যায় অসঙ্কোচ, দ্বিধাহীন। এমন একটা মানুষ যার নেই, সে মস্ত বড় অভবী। সে ভাবতো, যদি কেউ একজন তুমি সম্বোধন করে কথা বলে, অন্ত্যত এইটুকুন পাওয়ার আনন্দেও হাজার বছর বেঁচে থাকা যায়।

 

কিন্তু এমনটা আর হয়ে উঠলো না! অবশ্য না হয়ে ওঠার পেছনে সুশীলের অণুমাত্র ব্যর্থতা নেই, পুরোটাই তার অদৃষ্টের নারাজী। মানুষ তার অদৃষ্ট সম্পর্কে আজন্ম অজ্ঞান। অনেক কিছুর সাথে পেরে উঠলেও মানুষ পেরে উঠতে পারে না তার অদৃষ্টের সাথে। মাথা পেতে নিতে হয় অদৃষ্টের সব শাসন। বিয়ের আয়োজন তাকে মানুষের একটি খোসামাত্রই দিয়েছিলো। তার প্রত্যাশিত মানুষটি দেয়নি! দেহ এবং মনের সমন্বয়ে গঠিত যে সত্তা, সেই সত্তার সাক্ষাৎ বা দর্শন সে পায়নি। কারণ, খাচার বাহিরে মন থাকলে, খাচার ভেতরে প্রাণ রাখা দায়!

 

দুপুর হবার পূর্বেই চলে আসলেন কাশেম মিয়া। মনটা আজ তার কেমন কেমন যেনো করছে। কখনো কখনো এমন অবস্থা হয় মানব মনের যা ব্যাখ্যা করার মতো না। মনের নিয়ন্ত্রণ হারালে মানুষ দেহের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে না। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে কাশেম মিয়া সুশীলের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কখনো আশার মৃত্যু, কখনো চলার মৃত্যু, কখনো বলার মৃত্যু, কখনো মৃত্যু স্বপ্নের। মানুষ আসলে মৃত্যুর মাঝেই বেঁচে থাকে। এক জীবনে মানুষ অসংখ্যবার মরে, কিন্তু সমাধিত হয় একবার’। সুশীল কাশেম মিয়ার কথায় সায় দিয়ে চা বানাতে শুরু করলেন।

 

বিয়ের প্রথম তিথি প্রতিটি নারী পুরুষের জন্য সমানভাবে গুরুত্বের, প্রাপ্তির এবং প্রত্যাশার। এ রাতটি ঘিরে প্রতিটি মানব মানবীর ভেতরে বাসা বেঁধে থাকে অগণিত এবং সীমাহীন জল্পনা কল্পনা। সঞ্চিত থাকে অপরিমেয় আবেগ। সুশীলও এই দলের মানুষগুলোর বাইরের কেউ ছিলো না। তারও ছিলো ঢেঢ়!

 

বাড়িতে নতুন বউ বা নবাগত সদস্যকে অনেকে বরণ করে নিয়েছে অনেকভাবেই, বাকি শুধু সুশীল। সুশীল আবেগের প্রাচুর্য, মুখে হাসি এবং হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ে নতুন বউয়ের মলিন মুখম-ল। যেখানে আলোর ছড়াছড়ি থাকার কথা সেখানে আঁধারের দখলদারিত্ব। সুশীল হাসিমুখে প্রজ্ঞার সম্মুখে গিয়ে ফুলগুচ্ছ এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘নতুন জীবনে স¦াগতম’। প্রজ্ঞার দৃষ্টি নি¤œমুখী, তখনও সুশীলের চোখেমুখে লেপ্টে আছে সহজ সরল হাসি। অব্যক্ত অনিহার সাথে প্রজ্ঞা শুভেচ্ছা গ্রহণ করলেন। প্রজ্ঞার অব্যক্ত অনিহা কিছুটা স্পর্শ করে গেলো সুশীলের চোখ। কিন্তু চোখকে তিনি সেই অনিহা, সেই অনাগ্রহ, সেই অন্যমনস্কতা দেখতে বারণ করলেন।

 

তারপর দীর্ঘক্ষণ সুশীল একাই অনেক কিছু বললেন। এক-আধটু গানও গাইলেন। কিন্তু প্রজ্ঞার সাড়া নেই! সুশীলের ইচ্ছে ছিলো তার ফুলসজ্জা রাতটিতে বিশেষ বিশেষ কিছু করবেন। তার অভিপ্রায় ছিলো এমন একটি বিশেষ রাতে ঘরকে সোডিয়াম লাইটের কৃত্রিম আলোয় আলোকিত না করে মোমবাতির অকৃত্রিম আলোয় দ্যুতিময় করবেন। সমগ্র রাতব্যপী পুরো ঘর জুড়ে থাকবে আধো আলো আধো অন্ধকারের এক অপূর্ব মিশ্রণ। রকমারি পুষ্পত্যাগী সুরভী আগলে রাখবে ঘরখানা এবং ঘরের মানুষ দুটোকে। থাকবে বাংলা ইংরেজি গানের বিরাট সংগ্রহ। থাকবে নানা কথা, আরো নানা কিছু। কিন্তু এমনটা হয়ে ওঠেনি। তার সব ইচ্ছের গুড়ে পরেছে বালি।

 

মনোভাব ব্যক্ত করতে মানুষ কথা বলে। ভাষা হচ্ছে মনোভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। এক সময় মনোভাব ব্যক্ত করতে মানুষ ইশারা দিতো, বা উদ্ভট শব্দ করতো। কথা বলার জন্য প্রয়োজন শব্দ, বর্ণ বা রঙ। পৃথিবীতে প্রায় আড়াই হাজার ভাষা আছে। এবং প্রত্যেক ভাষারই শব্দ বর্ণ এবং ব্যাকরণ হয়তো আছে, থাকার কথা। কিন্তু এমন একটি ভাষা আছে যা মনোভাব প্রকাশ করতে সক্ষম, খুব সূক্ষè করেই প্রকাশ করতে সক্ষম। কিন্তু সে ভাষার লিখিত কোনো শব্দ বর্ণ এবং ব্যাকরণ নেই। আর সেই ভাষা হচ্ছে চোখের ভাষা। এই ভাষা শব্দহীন, বর্ণহীন, ব্যাকরণহীন প্রকাশ করে যায় মনোভাব। এই ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, আবার ঢের দুরুহ!

 

সুশীল প্রজ্ঞার চোখে চোখ রেখে পাঠ করলেন তার অব্যক্ত মনোভাব। বুঝলেন তার চোখের ভাষা। নিজেকে নিবৃত করলেন পড়ে বিরক্তির বাক্য। অধিকার, প্রেম, সম্পর্ক এগুলো হচ্ছে একেবারে নবীন অঙ্কুরের মতো; অঙ্কুরকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন কোমলতা, এর সাথে তাড়ন পীড়ন একেবারেই চলে না। কিছুক্ষণ স্থির থেকে এক পৃথিবীর হতাশা নিয়ে মৃদু কন্ঠে প্রজ্ঞার উদ্দেশ্যে সুশীল বললেন, ‘ভালো হোক বা হোক মন্দ, প্রায় সব কিছুই ইতিহাস ধারণ করে তার গর্ভে। এখনকার এই সময়টি, আজকের এই রাতটি, ইতিহাস তার ভালোর তালিকায় ধারণ করবেন নাকি করবেন মন্দের তালিকায় লিপিবদ্ধ তা জানা নেই। চাইলে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন’।

 

তারপর! অতঃপর রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়, নতুন সূর্য ছড়ায় দ্যুতি। পাখপাখালির কলরবে সমাপ্তির ঘন্টা বাজে তাদের ফুলসজ্জা তিথির।


বায়ান্নদিন পর


সুশীলের চা বানানো শেষ। সে কাশেম মিয়ার হাতে চা তুলে দিচ্ছে আর বলছে, ‘ভাই, এই পৃথিবী নিয়ে আপনার অভিমত কি’?। সুশীল সাধারণত কাউকে প্রশ্ন খুব একটা করেন না। মাঝেমাঝে করেন, তাও শুধু কাশেম মিয়াকে। এ পৃথিবীর আর কারো কাছেই তার কোনো প্রশ্ন নেই, জানতে চাওয়া নেই, অনুযোগ বা অভিযোগ নেই। তাদের দুজনের বয়সের দিক থেকে বেশ অমিল হলেও মতের দিক থেকে দুজনের বেশ খাপ খায়। মতের মিলই একপর্যয়ে মনের মিলে রূপ নেয়।

 

কাশেম মিয়া হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলেন। চায়ের কাপে ছোটছোট চুমুক দিচ্ছেন। তার মুখম-লে জমাট বাঁধলো ভাবনার মেঘ। যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নেওয়া বা ভেবে দেওয়া জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য। কাশেম মিয়া চায়ের কাপটা টেবিলে রাখলেন, তারপর বললেন। ‘জানেন ভাই, কিছুকিছু বিষয়ে যতই জানতে চাই, যতই জানি, ততই অজ্ঞতা জাগে। অনেক জেনেও একটা না জানার হাহাকার থেকেই যায়। জীবন এবং পৃথিবী, এই দু’টো নিয়ে ভেবে কোনো কূলে উঠতে পারিনি আজও। মাঝামাঝিই থেকে গেছি। এরা বোধ হয় কাউকে কূলে উঠতে দেয় না।

তবে আমার মতে পৃথিবী হচ্ছে স্বর্গ এবং নরক দু’টোই। দুই প্রকৃতির মানুষ পৃথিবীকে দুই রকম করে পায়। পৃথিবীর নারকীয় অনলে দগ্ধ হন এবং নারকীয় চিত্রগুলো দেখতে পান ভালো মানুষেরা, শুদ্ধ মানুষেরা। আর এই পৃথিবীটাকে স্বর্গের মতো করে পায় এবং উপভোগ করে মন্দ মানুষেরা, অশুদ্ধ মানুষেরা’। বলতে বলতে বিদায় নিলেন কাশেম মিয়া। সুশীল ডুবে গেলেন কাশেম মিয়ার কথার গূঢ়ার্থ খোঁজার ভাবনায়।

 

কোনো সম্পর্কের ধরনই চিরকাল এক থাকে না; হয়তো হালকা হয়, নয়তো হয় গাঢ়। হয়ই হয়। সম্পর্কের অবস্থার এই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন একটি অলিখিত প্রথা। অলিখিত হলেও বেশ শক্তিশালী বটে! নতুন বিয়ে করা সুশীল একমাস বাইশদিনের অন্যমনস্কতা থেকে নিজেকে উত্তরিত করে মানসিকতাটা একটু ঝরঝরে করলেন। এতগুলোদিন একসাথে এক ঘরে থেকেও কথা হয়নি করো সাথে কারোর। হয়নি এক আধটু চোখাচোখিও। পাশে থেকেও কাছে থাকা হয়নি কেউ কারোর। মনের সাথে মনের নৈকট্য থাকলে, দেহের সাথে দেহের দূরত্ব থাকলেও সে সম্পর্ক থাকে বসন্তের পত্রপল্লবের মতো প্রাণবন্ত, প্রভাতের শিশির ভেজা ঘাসের মতো সজীব, শস্যভরা মাঠের মতো চোখ শীতলকরা। আর মন থেকে মনের দূরত্ব থাকলে, দেহের খুব কাছে দেহ থাকলেও সে বন্ধন, সে সম্পর্ক হয় প্রাণহীন, রুক্ষ, উত্তপ্ত মরুভূমির মতো চোখ ঝলসে দেয়া। এই ক’দিনে এই কথাগুলো খুব ভালো বোধে এসেছে সুশীলের।

 

মেয়ে মানুষের জীবনটা কেমন যেনো! অবাক করার মতো বলা চলে। জন্মদাতা বাবা, গর্ভেধাত্রী মা, প্রাণপ্রিয় ভাই বোন স্বজন সব ছেড়ে চলে আসতে হয় একজন স্বল্প জানা বা একেবারেই না জানা মানুষের কাছে। স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসে জন্মের বাঁধন, গড়তে হয় আরেক নতুন বন্ধন। এই বোধটা যে পুরুষের মাঝে জাগে বা থাকে, সে পুরুষের পক্ষে স্ত্রীর প্রতি যতœবান হওয়া ঢের সহজ হয়ে আসে।

নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়তো কষ্ট হচ্ছে। যারা কাছে আসতে সময় নেয়, তারা দূরে যেতেও সময় নেয়। আর যারা খুব সহজেই কাছে আসে, তারা খুব সহজেই দূরে চলে যায়। পরিবার পরিজন ছেড়ে চলে আসা মানুষটার এক আধটু অস্বস্তি লাগতেই পারে! একটু বিষাদ জাগতেই পারে! যারা ‘জান’ বলতে সময় নেয় না; তারা ‘যান’ বলতেও সময় নেয় না। প্রজ্ঞা হয়তো একটু বিলম্বেই শোনাবেন ভালবাসার স্বর্গীয় বাণী। পান করাবেন অনুরাগের সুধা। এসব ভেবে ভেবেই এই ক’দিন খুব একটা গায়ে পড়ে কথা বলতে এবং কাছে ঘেঁষে চলতে চায়নি সুশীল। যদিও গত হয়েছে বায়ান্নটি দিন।

 

যে আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলে, তার আর হারানোর মতো মূল্যবান কিছু থাকে না। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে, থাকে, যারা আত্মসম্মানের ঢের যতœ নেয়; যেমনটা নেয় দেহ এবং প্রাণের। প্রাণ হারানোর মতোই আত্মসম্মান হারানো সম্পর্কে তারা থাকে বেশ সচেতন। সুশীল এই প্রকৃতির মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম।

 

এই ক’দিন দূরেদূরে থাকলেও আজ গায়ে পরেই কথা বলবো। বলবোই তো, আমার বিয়ে করা বৌ বটে! সব নীরবতার অবসান ঘটাবো আজ। এই মনস্থির করে বাড়ি রওনা হলেন সুশীল। বেশ কিছুদিন এক ঘরে থেকে একটু হলেও মোহ এবং অনুরাগ জন্মেছে। হয়তো সেটা এক পাক্ষিক। মোহ এবং অনুরাগের পরিমাণ কোনো কালে কোনো সম্পর্কেই দ্বি-পাক্ষিক বা দুইজনের সমান ছিলো না, থাকে না। কারো একটু বেশি থাকে, আবার কারো থাকে একটু কম।

 

এতদিন নাম ধরে ডাকেননি, দরজায় কড়া নেড়েছিলেন শুধু। আজ মোহ এবং ভালবাসার নিকট পরাজিত হয়ে দরজা খোলার জন্য সুশীল বাইরে থেকে নাম ধরে ডাকলেন ‘প্রজ্ঞা’ ‘প্রজ্ঞাআআ’ ‘প্রজ্ঞাআআআ’। মানুষ জীবনে সবচেয়ে বেশি পরাজিত হন মোহ এবং ভালোবাসার নিকট। বেশ ক’বার ডাকলেও সাড়া নেই প্রজ্ঞার। খানিকটা ভাঁজ পরলো সুশীলের কপালে। দরজায় আলতো করে ধাক্কা দিতেই কপাট দু’টো দুদিকে হলো সহজে। ঘরে প্রবেশ করেই অবাক হন সুশীল। প্রজ্ঞার ছায়াও নেই ঘরটায়। ঘরে বাহিরে কোথাও খুঁজে না পেয়ে পুনরায় ঘরে এসে খাটের উপরে হতাশ হয়ে বসতেই তার চোখ যায় টেবিলে। চৈত্রের হয়রান কুকুরের মতো হাপাচ্ছে সে।

 

টেবিলে কালো চিরুনির নিচে দেখা যাচ্ছে একটি সাদা কাগজ। এমন স্থানে এমন সাদা কাগজ কেমন করে এলো তাই ভাবছেন সুশীল। জানালা ভেদ করে আসছে দক্ষিণা বাতাস, স্পর্শ করছে তার শরীর। ছোটাছুটির পর ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে খাটে বসতেই দেহটা প্রায় ভারসাম্য হারিয়ে শক্তিহীন হয়ে এসেছে। বাতাসে কাগজের কোণাগুলো উল্টে-পাল্টে নড়ছে অবিরাম। সৃষ্টি করছে গভীর রহস্য। যে রহস্যের উৎঘাটন না করলেই নয়। আগ্রহ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কাগজটি হাতে নিলেন সুশীল। তাতে লেখা,


‘‘শব্দ বর্ণের উপর ভর দিয়ে মানুষকে মনোভাব ব্যক্ত করতে হয়। ভেতরটাকে বাহির করতে হয়, অশরীরীকে করে তুলতে হয় শরীরী। কিন্তু মনের ভাব বা সুপ্ত কথা যখন জমে গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয়ে ওঠে, তখন সেই ভাবকে, সেই কথাকে কোনো শব্দ বর্ণ ধারণ করতে পারে নাকি আদৌ জানা নেই। ভেতরের ভারটা পুরোপুরি বহন করতে পারে এমন শব্দ বর্ণের উদ্ভব আজও ঘটেছে নাকি তাও অজানা।

 

শব্দ বর্ণ নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের যে ভাবনা, সে ভাবনালব্ধ ধারনা থেকে বলছি। মানুষের মনোভাবের প্রাথমিক যে স্তর, অভিধানের শব্দগুলো সেই প্রাথমিক স্তরটাকেই ধারণ করতে পারে, এর বেশি পারে না। এই কাগজের শব্দগুলোও আমার মনোভাবের প্রাথমিক স্তরকে অতিক্রম করে ধারণ করতে পারেনি গাঢ় ভাবটাকে। প্রকাশ ঘটাতে পারেনি সেই সব কথাগুলোর, যেগুলোর ব্যক্ত করাটা ছিলো এই সময়ের উপযুক্ত চাওয়া।

 

মানুষ এবং মহামানুষ, এই দু’টোর মধ্যে ব্যবধান গড়ে দেয় যে জিনিসটি, তা হচ্ছে চরিত্র। চরিত্রের উপর ভর দিয়ে মানুষ অমানুষে পরিণত হয়, আবার চরিত্রের সিড়ি বেয়েই মানুষ পৌঁছে যায় মহা মানুষের স্তরে। কোনো মহা মানবের সাক্ষাৎ পাওয়ার যে ইচ্ছে আমার লালিত ছিলো দীর্ঘকাল ধরে, সে ইচ্ছে বা অভিপ্রায় কতটুকু পূর্ণ হলো তা জানি না; তবে বিন্দুমাত্র অপূর্ণতা নেই এটা জানি এবং জানবো আগামীর সবকাল ধরে।

 

এই চিঠি যখন আপনি হাতে পাবেন, তখন আমি আপনার থেকে অনেক দূরে। অবশ্য কাছে ছিলাম কখনো তাও নয়! দেহের পাশে থাকাই তো আর কাছে থাকা নয়, মনের কাছে থাকাই মূলত কাছে থাকা। দেহের পাশে থাকাই যদি কাছে থাকা হতো, তাহলে কোনো মানুষেরই মৌনতা বোধ জাগতো না কখনো, একলা একলা লাগতো না কখনো। আশেপাশে অনেকে থাকা সত্ত্বেও আমাদের একলা একলা লাগে তখনই, যখন মনের কাছে থাকে না কেউ!

 

এই কূলে দেহ থাকলেও ঐ কূলে পড়ে ছিলো আমার মন। মনকে এই কূলে বাঁধার চেষ্টা করেছিলাম খুব, কিন্তু বায়ান্ন দিনেও কাজ হয়নি! না হবারই কথা। মনের বিরুদ্ধে চলা শক্তকাজ। মনের বিরুদ্ধে চলতে সক্ষম এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে বড্ড কম। যারা বলে, মানুষ মনের নিয়ন্ত্রক, মন মানুষের নিয়ন্ত্রক না। তাদের মনটাও তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায় কখনো কখনো! জান্তে বা অজান্তে। যে বলে হারায় না, তাকে হয়তো মিথ্যুক বলা যায়!

 

প্রায় প্রত্যেকের জীবনেই এমন একজন মানুষের আগমন ঘটে, যে মানুষটা স্বল্প সময়ের জন্য জীবনে আসলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য দাগ রেখে যায়। সেই দাগ যায় না মুছে ফেলা কখনো। আপনার জীবনে আমি এমন মানুষ হয়ে না থাকলেও আমার জীবনে আপনি তেমন মানুষ হয়েই থাকবেন।

আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার ক্ষমাই আমার সুখের যোগান দেবে। নিঃশর্ত ক্ষমা.. .”


অতঃপর গত হয়েছে কতদিন তা সংখ্যায় ঢের। বৃহস্পতিবার আধবেলা, এবং শুক্রবার দিনের পুরোটাই এখন বন্ধ থাকে সুশীলের দোকান। তার আশেপাশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া শক্ত কাজ যে এই খবরটা সম্পর্কে অবগত নয়। সুশীল এখন বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে এবং শুক্রবার সকাল থেকে ঘুরে বেড়ান গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, খুঁজে বেড়ান বিয়ে বাড়ি। বিয়ে বাড়ির খোঁজ পাওয়া মাত্রই ছুটে যান সুশীল, এবং পাত্র পাত্রীর অভিভাবকদের বলেন,

“ওদের দুজনার দু’টি মন যদি দুই কূলে থাকে,

তাহলে জোর করে দুজনার দু’টি দেহ এক কূলে আনা ঠিক নয়”.. .



পদাবলি

পদাবলি

 অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ




তুমিও একদিন মহানাগরিক হবে

সম্পা পাল


তোমার শহরে এত রাস্তা !

রাস্তা কি কোনো বিশেষ আবেগের নাম ?


ইচ্ছের মৃত্যু পুড়ে গেলে দ্বিপ্রহর ডাকে।

বৃষ্টি হয়তো তোমারই সেই পুরোনো বান্ধবীর নাম।


আমি ভুলতে বসেছি

ট্রেনের গায়ে লেখা যাত্রীদের জীবনপঞ্জি।

তারাও তো কোনো গন্তব্যে নামবে!

তারা কি জানে এই সিটে কত যাত্রী কেঁদেছিল ?

কাঁদতে কাঁদতেই বা কত রাত্রি ভোর দেখেছিল ?


তোমার নগরেও পাগলের কিছু প্রলাপ থাকে

সেও হয়তো তোমার রাস্তার পুরোনো সাথী ছিল।

তার হাতে দিয়াশলাই দিয়ে তুমিও একদিন মহানাগরিক হবে...



বাবা 

মনিরুজ্জামান প্রমউখ 


আছে, 

সব আছের দিবাকর আকাশ হচ্ছে বাবা। 

না থাকার নিরাকার গভীরে 

তবু এক ইঞ্চি আরাধ্য নমস্যের 

জায়গা নিয়ে উর্বর দাঁড়িয়ে থাকেন বাবা। 


যখন থাকবেন না নিরন্তর 

মনে হবে বিবাদাঙ্ক পৃথিবীর 

দরজাটা, বারান্দাটা, জানালাটা সর্বাধীন্য একা, 

নিথর একা, দুর্বোধ্য একা, একলা পথের একা। 


মিথ্যে করে আদাবরে 

আর সব বলা গেলেও 

কাউকে নরাধমেও যায় না বলা বাবা। 


ঘুম পাড়ানী মাসী পিসির আনোখা গল্পগুলোর 

স্মৃতিনিড়ানোর বেদাবদ্ধ অধিকর্তী মা হলেও 

বোধালঙ্কারের চলাতে, বলাতে, লড়াতে, সয়াতে 

জীবনের পূর্বজ বাণীবদ্ধ অঙ্কগুলো কষিয়ে দেন বাবা। 


যতোক্ষণ থাকেন সওগাত বলবৎ ভূমি, জীবন আর পলিতে 

জানদেখা দিয়ে যান অবিনাশী অনির্ণীত হীরক পরশ সরস বাবা।





জীবনের মানচিত্র

সাগর আহমেদ


কাক্সিক্ষত মৃত্যুতে বিভোর একজোড়া চোখ

রাত্রির উৎসবে মৃত্যুরা করে আত্মহত্যা 

পৃথিবীর আকাশ যেন নীলে নীলে রূপান্তরিত

অভিমানে দূরে সরে যায় নক্ষত্ররা।


আমি বেদুইন রূপে হাঁটি পৃথিবীর সরল পথে 

সৃষ্টির থেকে নিভে যাই গভীর অন্তে।

মিথ্যের মতো মৃত্যুতে জর্জরিত হই নিরন্তর

অদৃশ্য আত্মার অস্তিত্ব অবিশ্বাস্য মনে হয়।

 

যেহেতু মরে যাইনি-

ভোরের স্নিগ্ধতায় চোখ খুলে দেখি মায়ারোদ্দুর হাসে অনাদৃত হাসি।

মহা উল্লাসে ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যুর দূরত্ব 

নীরব নদীর স্রোতে ভাসে জীবনের মানচিত্র।



পাখির ঠোঁট

আসহাবে কাহাফ 


ধনেশের ঠোঁটে দেখলে মনে পড়ে তোমার ঠোঁট

আরো একবার চুমু খেতে ইচ্ছে করে

এমন ইচ্ছে থেকেই বাড়ে অসুখ

শরীরের জ্বরে ভীষণ ভীতসন্ত্রন্ত 

ক্যাপসুল গিলতে পারি না, তোমাকে পারি!

তুমিই কি জ্বরের মেডিসিন-  নাপা এক্সটেন্ড?

তোমার হাতে মায়ের জলপট্টির স্পর্শ 

মাথায় হাত রাখো, গা ঘেঁষে শুয়ে থাকো

থার্মোমিটারের পারদ আরো নিচে নামুক

আরো একবার চুমু খেতে খেতে বলি

পাখির ঠোঁটে চুমু খায় না, মানুষের ঠোঁটে অবিরাম খায়!

গোপনে প্রকাশ্যে যে যেভাবে পারে।



ফাঁকা কথা

মাজরুল ইসলাম


শরতের সকালে আকাশ জুড়ে মেঘ বেজে উঠল

ভালোবাসা দেখাতে, কিন্তু-

ফাঁকা ডাক ছাড়া

এখানে এখনও বৃষ্টির পানি ঝরল না !



সন্ধা প্রদ্বীপ

গৌর


সন্ধা প্রদ্বীপ আজ অসুখে ডুবে

তোমার অচেনা চাহনিতে

এখানে শুধু একবেলা বদনাম কুড়াই

আর প্রত্যহ সমীকরনে, সময় শেষ হয়ে আসে।

জানা ভয়, বুকের পাশে এসে

কান্না করে, মাঝে মাঝে হেসে উঠে

তিমির বিদারি কালো রাত কলঙ্ক করতে সাহস জোগায়

তুমি তাই রেখে গেছ পরা শূন্য খোলা মাঠ

দূর দিশারে তাকিয়ে আমি চলে যাই

তোমার কাছে

নিজের বদনাম নিজে নিজে করি




রৌদ্রস্নান

সানাউল্লাহ বিপুল 


-কবিতা, তুমি আর খবর নাও না কেন?

-আমি এখন প্রখর রোদ্দুরে

দুঃখ শুকোতে ব্যস্ত

তুমি আমায় ডেকো না প্রিয়

আমি তো জলে ভিজে একাকার

বানের ডাকে পথ ভুলে পথ হারিয়েছি

যে পথে পেয়েছি শত দুঃখ

দুঃখ’ই এখন আমার আবরণ।


সেই পথে আর হয় নাকো ফেরা

পাইনা তোমার ঘ্রাণ

ঘ্রাণে আচ্ছন্ন থাকতাম লেপ্টে

পাগল প্রায় আমি আর ঘ্রাণ খুঁজে পাইনা।

তুমি ডাকলে

আমার আর দুঃখ শুকানো হবে না

ডেকোনা প্রিয়, আমাকে দুঃখ শুকোতে দাও।



অভিমান

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


কোনো বেদনা আমাকে আর স্পর্শ করে না

বেদনার সাথে সন্ধি করে নিয়েছি যখন

ঠিক তখনই তুমি আবারও এলে ফিরে

সেই আগের মতই আমার আপন নীড়ে।


বৃথাই যাবে; যতই চেষ্টা করো না কেন?

তবে হ্যাঁ, আমার অনুভূতি যেন এখনো হয়নি শূন্য

এখনো আমি শীতল বাতাসে শিহরিত হই

ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠে চঞ্চল প্রাণ

বৃষ্টির আবেশে গুনগুন করে গাই সুমনের গান।


আমি এখন আর সেই আগের মত নই

আগুনে পোড়া ছাই হতে আবারও উঠেছি জেগে

মাথা নুইয়ে চলে যাওয়া মানুষটাই আজ প্রতিবাদী

যার হারানোর নেই ভয়, তার কী আর হবে ক্ষতি?


তুমি বরং যাও ফিরে; হয়তো এটাই শেষ দেখা

যখনই পড়বে মনে, স্মৃতির আঙিনায় হেঁটে যেও

ইচ্ছে হলে আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও

জেনে নিও, তুমিই ছিলে আমার ভীষণ প্রিয়।



ফেরা

নেহাল অর্ক



বৃষ্টি বিহীন হিমেল বাতাস

নেংটা আঁধার, চায়ের কাপ;


পরশ ঠেকায় গহীন বুকে

চিঠির খামে মায়ার ছাপ।


আঙ্গুলের ফাঁকে চুলের ডগা

উন্মাদ সময়, ক্লান্ত চোখ;

প্রেমের পাশে শরীর ঘুমায়

বাতির নিচে লাজুক মুখ।


মনের ভিতর ভীষণ তৃষ্ণা

পানির গ্লাস, নিঃশব্দ রাত;

আঁধার মাঝে চোখের হাসি

ছাড়তে চাইলে টানে হাত।


টানাহেঁচড়ার আদিম খেলা

সন্ন্যাস জীবন, বিমর্ষ সময়;

কালের গর্ভে লুকিয়ে কাঁদে 

পথের মাঝের সব পরিচয়।


সাদৃশ্য

বঙ্কিমকুমার বর্মন


বসে আছি একা, পাশে কেউ নেই তবুও বুকে বাঁধি শুক্লপক্ষের গান । মনে হয় প্রতিটি রাত্রি আনন্দে লাফিয়ে উঠছে দুই চোখে। পথে ঘাটে জোনাকির আলোর মহড়া, ঝলকে ওঠে হৃদয়ের গভীর বনভূমি। আড়ালে কত পাখি নিবিড় যাপন বুনে চলেছে রোজ কোমল আশ্রয়। বেদনাহত চাঁদ নেমে আসে গোবরজলে নিকোনো উঠোনে, পরম মমতায় হাত ধরাধরি করে বসাই চায়ের টেবিলে । দেখি আমাদের দু’জনেরই অনেক দুঃখ জমে আছে জামার বোতামে।



মিঠে গন্ধে ভরা রুদ্র পারাপার

রওশন রুবী


তোমার সাথে কোনদিন দেখা 

করবো না করবো না করেও করে ফেলেছি সেদিন।

তুমিও ছিলে অদ্ভুত অপেক্ষায়, নিরুত্তর। 

নীল সিঁড়িস্বর খুলে বলো নি-আছি! 

একবার হাত বাড়িয়ে দেখ অসম্ভব সুন্দর 

তোমার অপেক্ষায়। একবার চোখ বুজে দেখো- 

রাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চেয়ে 

আনমনা হয়েছে সব প্রগাঢ় প্রচ্ছদ। 

কত কতবার ফিরিয়েছি আনমন। 

ভুল করে একবার না হয় ডেকেই দেখ 

স্বপ্নের কুসুম কী ব্যাকুল বেগে ফুটে ওঠে, দেখো!


পরাজয় নিবে না জেনেও পরাজিত হল 

মিঠে গন্ধ ভরা এ রুদ্র পারাপার।



কালচিত্র

ঝুটন দত্ত 


ভালোবাসার নামে চারপাশে গজিয়ে যাচ্ছে ব্যাঙের ছাতার মতো  

দেয়াল ঘেষা সম্পর্ক,

যেন চৈত্রের সঙ্গম।

বৈশাখী ঝড়ের মতো অঞ্চল জুড়ে তর্জন-গর্জন;


অদৃশ্য টান না থাকলে 

এসবের ভিত কতটা গুরুত্বপূর্ণ, 

কতটা আঁধার ভেদ করতে পারে নিয়ন আলো,

তা আমার জানা নেই। 


সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, পরিবার প্রেম ছাড়া সব অচেনা অচল;

 প্রকৃত জীবন বয়ে চলে মানবিক প্রেমের ধারায়।



কদমপ্রেম ও বিরহসমগ্র

কদমপ্রেম ও বিরহসমগ্র

     অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


কদমপ্রেম ও বিরহসমগ্র

জুয়েল আশরাফ


অনেকক্ষণ হলো কনস্টেবল মাহেরের হাত চুলকাচ্ছে। হাত চুলকালে টাকা আসে, বিথী বলেছিল। কোন হাত চুলকালে টাকা আসবে সেকথা বলেনি। মাহেরের অবশ্য দু’টো হাত-ই চুলকাচ্ছে। টাকা আসবে দূরের কথা, সাত হাজার টাকা ঋণ করে বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে। এই মাসে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। খরচাখরচের সংসার না, দুজন মানুষ মাত্র। তবু সংসার তো, এর মুখে যত ঢালো হাঁ করে থাকে আরও গিলে ফেলার জন্যে। বিথী মেয়েটা ভালো, অযথা খরচের অভ্যাস নেই। অপচয়কে দু চোখের বিষ মনে করে। সেদিন রাতে বাসায় এক কেজি আদা সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছিল। দেখেই বিথীর সেই কী রাগ! রেগেমেগে আগুন হয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে তো বলেছি আদাটাদার দরকার নাই। অল্প আদাতেই তরকারি রান্না হয়ে যায়। এম্নিতেই যা দাম!’ মাহের বলল, ‘ঠিকমত মশলা না হলে কী তরকারি স্বাদ হয় বলো?’ বিথী বলল, ‘মশলা হলেই তরকারি স্বাদ হবে এই ধারণা ভুল। যিনি রাঁধতে পারে দুটো পেঁয়াজ আর একটুকরো আদা দিয়েও তরকারিতে স্বাদ আনতে পারবে। যিনি পারবে না, তার মুখেই শুনবে মশলা নিয়ে ধানাই-পানাই।’

ধানাইপানাই কী মাহের জানে না। বিথীকে জিজ্ঞেসও করেনি কখনও। মাঝে মাঝেই বিথী কোনো কিছু উদাহরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই শব্দটা ব্যবহার করে। আজ বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। দুই বছর হলো বিথীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। এখনো অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। যেমন- বিথীর প্রিয় খাবার কী, প্রিয় রঙ কী মাহের এসবের কিছুই জানে না। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। মাহের অবশ্য বিথীর প্রিয় ফুলের নাম গোপনে জেনে গেছে। ‘গোপনে জানা’ ব্যাপারটা হলো- স্কুল জীবন থেকে বিথী একটি ডায়রি ব্যবহার করছে। সেখানে তার পছন্দ অপছন্দ লেখা থাকে। বিয়ের পর ডায়রিটা বাবারবাড়ি থেকে নিয়ে আসে। লুকিয়ে রাখে আলমারিতে এবং লেখেও লুকিয়ে। একদিন কৌতূহলবশে মাহের আলমারি থেকে ডাইরিটা লুকিয়ে বের করে আনে। পৃষ্ঠা উল্টাতেই প্রথম লেখাটা পড়ল- ‘আমার হাতের লেখা ভয়ংকর বাজে। হাতের লেখা অসুন্দরের জন্য জীবনে অনেক মার খেয়েছি। প্লিজ, কেউ আমার ডাইরিটা পড়ো না। লজ্জায় মরে যাব!’

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

এরপর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টাতেই পড়ল- ‘আমার প্রিয় ফুল কদম।’ মাহের সেই ডাইরির আর তৃতীয় পৃষ্ঠা উল্টায়নি। বিথীর লাজুক মুখটা মনে এলো ঠিক সেই মুহূর্তে। এক ধরনের ভাললাগার তীব্র আবেশ নিয়ে ডাইরিটা সে জায়গা মতো রেখে দিল।

হাত চুলকাতে চুলকাতে হল ঘড়িটার দিকে তাকায় মাহের। রাত পৌনে দুইটা বেজে চলেছে। সে অপেক্ষা করছে এস আই আবদুল মালেক স্যারের জন্য। আজ রাতে ডিউটি শেষে বাসায় গিয়ে খেতে বসেছে, তখনই ফোন আসে। খাওয়া অর্ধেক রেখেই থানায় এসে হাজির। থানার পাশেই বাসা। স্যারের ফোন পাওয়া মাত্রই আসা যায়। রোজই ছুটে আসে সে। ছুটে আসতে হয়। চাকরিটাই এরকম, দিনরাত নেই, রোদ-ঝড়বৃষ্টি নেই। এখন তো করোনাকাল, এই মহামারীকালেও পুলিশের খাকী পোশাকে কোথাও নেই অখন্ড অবসর। বের হওয়ার সময় রোজকার মতো বিথী তিরিক্ষি গলায় বলল, ‘চাবি পা-পোছের নিচে রেখে দিলাম।’ আজও ভোর হওয়ার আগে বাসায় ফিরতে পারবে না হয়তো। অবশ্য বিথী ভোর হওয়ার আগেই জেগে যায়। উঠে ফজরের নামাজ পড়ে। বাড়িতে এসে পা-পোছের নিচ থেকে চাবি বের করে তালা খুলতে হয় না মাহেরের। তালা খোলা-ই থাকে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিথীর মিহি সুরে কোরআন পড়ার শব্দ পায়। আপাতত এখন এটাই প্রতিদিনকার চিত্র।

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে থানার অফিস ঘরে মাহের বসে আছে। থানায় এসেই শুনতে পায় আবদুল মালেক স্যার বাথরুমে। এখনও বের হচ্ছে না। আজকে কোথায় যাবেন জানা নেই। লকডাউন আসার পর থেকেই শহরে নতুন নতুন ঝামেলা আরম্ভ হয়েছে। পুলিশবাহিনীর দিনরাত পরিশ্রম বেড়ে গেছে। সাথে আক্রান্তের ভয় তো আছেই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যারা সামনে থেকে কাজ করছেন ভয়টা তাদেরই বেশি।  চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এদের আক্রান্ত হওয়ার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মৃত্যুর এমন ঝুঁকি নিয়েই করোনা প্রতিরোধে কাজ করে যেতে হচ্ছে সবার। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সংবাদকর্মীসহ যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন, তাদের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। যতক্ষণ সে বাইরে থাকে, মাহের জানে দুশ্চিন্তায় বিথী ঘুমাতে পারে না। সেদিন তো মন খারাপ করে বলেই ফেলল, ‘আগে জানলে কোনোদিনই পুলিশের বউ হয়ে আসতাম না। জীবনের নিরাপত্তা নেই। কখন করোনা ধরে বসবে!’ বলতে বলতেই বিথীর চোখ ভিজে উঠল। বিথী খুবই আবেগপ্রবণ মেয়ে।

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

মাঝে মাঝে মাহেরেরও আবেগে চোখ ভিজে ওঠে। গত মাসের এক রাতের সামান্য ঘটনাতেই তার চোখে পানি চলে এসেছিল। মফস্বলের এই এলাকায় এক ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালা জবরদস্তি রাতারাতির মধ্যে ঘর খালি করতে চাপ সৃষ্টি করে। ভাড়াটিয়া একজন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবি মানুষ। দেশে লকডাউন চলছে। আয়ের সব পথ এখন বন্ধ। স্ত্রী অন্তঃস্বত্তা। দুই মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। সংসারে খাওয়ার টাকা-ই যোগাড় হচ্ছে না। বাসা ভাড়া দেবে কোথ্থেকে! বাড়িওয়ালা এসব শুনবে কেন? বাড়ি ভাড়ার টাকায় তার সংসার চলে। স্বামীর সঙ্গে অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীকেও রাত বারোটায় ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা লাগাল। খবর পেয়ে এস আই মালেক স্যার এলেন। স্যারের সঙ্গে মাহের পৌঁছে দেখে অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী বৃষ্টির রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য জীবনে সে সিনেমাতে অনেক দেখেছে। কিন্তু বাস্তব জীবনেও এমন ঘটনা ঘটে থাকে সেদিন দেখল। প্রথমে বাড়িওয়ালাকে খুব বোঝানো হলো। বাড়িওয়ালা সব রকম বুঝ মানতে নারাজ। তাকে রাজি করাতে হলে দুই মাসের ভাড়া দিয়েই ঘরে ঢুকতে হবে। আবদুল মালেক স্যারের কাছে এতো টাকা ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে মাহের বুঝে ফেলেছিল, তার কাছে থাকলে সে নিজেই বাড়িওয়ালাকে দিয়ে স্যারের শিশুসুলভ কোমল মুখ থেকে দুশ্চিন্তা দূর করত। যে কয়টা টাকা ছিল বাড়িওয়ালাকে দিয়ে সেই রাতটিতে একটা সমাধান করলেন মালেক স্যার। সেদিন রাতে একজন অন্তঃস্বত্তা নারীকে আশ্রয়হীন হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা দৃশ্যে তার চোখ ভিজে ওঠেনি, বরং একজন পুলিশ কর্মকর্তার মানবতার দৃশ্যে তার চোখে জল এসেছে। সেদিনই মাহের টের পায়, বিথীর মতো সে নিজেও খুব আবেগপ্রবণ। আবেগপ্রবণ বলেই সামান্য ঘটনায় তার মতো একজন পুলিশের চোখে জল এত সহজে আসতে পারে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই এস আই আবদুল মালেক মাহেরকে দেখা মাত্রই বললেন, ‘সেই বুড়োটা মারা গেছে।’ 

কদিন থেকেই মনে ধরেছিল কথাটা, বুড়োটা বাঁচবে না। করোনায় নয়, পারিবারিক অত্যাচারেই বাঁচবে না বুড়ো। দুই সপ্তাহ আগে করোনা রোগী শনাক্ত হবার পর একটি বাড়িকে লকডাউন ঘোষণা করার জন্য আবদুল মালেক স্যারের সঙ্গে মাহেরও গিয়েছিল। সেই বাড়ির দোতলায় একজন বুড়ো স্ত্রী ছেলে বউ নাতি নাতনীদের সঙ্গে থাকতো। বাড়িটি লকডাউন ঘোষণার দুদিন পর বুড়োর জ্বর শুরু হয়, সঙ্গে কাঁশি। পরের দিন শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। বাড়ির সবার ধারণা বুড়োকে করোনায় ধরেছে। অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না দেখে, পরিবারের সবাই বুড়োটাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। রক্তের সম্পর্ক কীভাবে রক্তকে ছেড়ে পালায়! অবাক লাগে। যত দিন যাচ্ছে মায়া মমতা মানুষের ভেতর কেমন ফিকে হয়ে আসছে।

আবদুল মালেক স্যার বললেন, দুপুর পর্যন্ত লাশ একা ঘরেই ছিল। দুপুর থেকে বুড়ার স্ত্রী এসে লাশ নিয়ে বসে আছে। লাশের গোসল, কাফন-দাফন করবে, কেউ সাহস পাচ্ছে না। 

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। বজ্রপাত আর বৃষ্টি। এখন প্রায় রোজ রাতেই বৃষ্টি হচ্ছে। মরা বাড়িটা দেখে মাহেরের বিথীর কথা মনে পড়ল। বাড়িটার সামনে একটি কদম গাছ। প্রবল বর্ষণে কদমফুলগুলো অযাচিত ভিজছে। মাহের মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, এই বরষায় বিথীকে একটি কদম ফুল উপহার দেবে। নিশ্চয়ই কদমফুল পেয়ে বিথী বিস্ময় আর অভিভূত হয়ে তাকাবে। অবাক হয়ে জানতে চাইবে- ‘কদমফুল আমার প্রিয় তুমি জানলে কীভাবে?’ মেয়েটা বৃষ্টির রাতে একা ঘরে কী করছে কে জানে! খুব মায়া হচ্ছে মেয়েটাকে  ভেবে। এস আই আবদুল মালেক স্যার বরফ শীতল গলায় বললেন, ‘মাহের, রেডি তো? করোনার ভয় লাগলে লাশ ধরো না।’

মাহের লাজুক মুখে বলল, ‘মরতে আমার ভয় নেই স্যার।’

বৃষ্টি কমেনি, বরং আগের চেয়েও বেড়েছে। বাড়ন্ত বৃষ্টিতে লাশ নিয়ে চলেছে দু’জনে। মাহেরের কাঁধে লাশ। চোখে পানি। মৃত্যুতে তার ভয় নেই। তবু সে কাঁদছে। স্যার দেখে ফেললে খুব লজ্জায় পড়বে! স্যারের কাছ থেকে চোখ আড়াল করার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতি জল ঢেলে ে চোখের জল মুছে দিয়ে তার লজ্জা আড়াল করে দিচ্ছে।