ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৩৪

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৩৪
তারুণ্যের শিল্প সরোবর : : ধানশালিক : : সংখ্যা ১৩৪
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০





























সূর্য গ্রহণ নিয়ে গ্রামীণ কুসংস্কার

সূর্য গ্রহণ নিয়ে গ্রামীণ কুসংস্কার


সূর্য গ্রহণ নিয়ে গ্রামীণ কুসংস্কার
ওবায়দুল মুন্সী

সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে কত যে মিথ ছড়িয়ে আছে তা আমাকে এখনো ভাবায়। আমাদের হাওরাঞ্চলে সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের আঞ্চলিক নাম হচ্ছে ‘গন্না’। অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে এই গন্নার সময় কোনো কাজ বা খাওয়া-দাওয়া করতে নেই। কারণ-এই সময় এসব করলে নাকি অমঙ্গল হয়। গর্ভবতী মহিলাদের গ্রহণকালে সুপারি কাটা, মাছ কাটা একথায় কোনো কাটাকুটি করা যাবে না! এসময় কাটাকুটি করলে, তাদের সন্তানাদিও বিকলাঙ্গ হবে। এরকম কতো যে কুসংস্কার লোকেরা বিশ্বাস করতেন যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই ছিল না। গ্রহণ বিষয়ক কুসংস্কার সম্পর্কে যতো টুকু জানা যায়- আদি মানুষের কাছে গ্রহণ ব্যাপারটাই ছিল দেবতার অভিশাপ। গ্রহণ চলাকালিন সময়ে খাবার না খাওয়া, বাইরে বের না হওয়া, গর্তবতী মহিলাদের নানা নিয়ম-নীতি মেনে চলা। কিন্তু জানার ব্যাপার হচ্ছে-বিজ্ঞান এই বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ  কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস হিসাবে প্রমাণ করেছে। তবে যেটা হয়- সেটা হলো সমুদ্রে  জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন ঘটে।

চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে খুব ছোট করে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, পৃথিবী যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে তখন পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করে। আর পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে কোন মানুষের কাছে চাঁদ আংশিক বা সম্পূর্ণরুপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। আর এই ঘটনাকে চন্দ্রগ্রহণ বলে

অধিকাংশ সময়ই আমাদের দেশের মানুষেরা অত্যন্ত আনন্দ আর কৌতুহল নিয়ে সূর্যগ্রহন এবং চন্দ্রগ্রহন প্রত্যক্ষ করে থাকে। অথচ বিষয়টি আনন্দের নয়, ভয় ও ক্ষমাপ্রার্থনার।

সূর্য ও চন্দ্র যখন গ্রহনের সময় হয় তখন আমাদের নবীর (সা.) চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেতো। তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে নামাজেরমাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।

আরবীতে সূর্যগ্রহণকে ‘কুসূফ’ বলা হয়। আর সূর্যগ্রহণের নামাজকে ‘নামাজে কুসূফ’ বলা হয়।

দশম হিজরীতে যখন পবিত্র মদীনায় সূর্যগ্রহণ হয়, রাসূল (সা.) ঘোষণা দিয়ে লোকদেরকে নামাজের জন্য সমবেত করেছিলেন। তারপর সম্ভবত তার জীবনের সর্বাধিক দীর্ঘ নামাজের জামাতের ইমামতি করেছিলেন। সেই নামাজের কিয়াম, রুকু, সিজদাহ মোটকথা, প্রত্যেকটি রুকন সাধারণ অভ্যাসের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিলো।


অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা প্রথমে যখন মহানবীর (সা.) এ আমল সম্পর্কে জানতে পারলো, তখন তারা এটা নিয়ে বিদ্রুপ করলো (নাউযুবিল্লাহ)। তারা বললো, এ সময় এটা করার কি যৌক্তিকতা আছে?

সূর্যগ্রহণের সময় চন্দ্রটি পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে বলে সূর্যগ্রহণ হয়। ব্যাস এতটুকুই! এখানে কান্নাকাটি করার কি আছে? মজার বিষয় হল, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন এ বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু হলো, তখন মহানবীর (সা.) এই আমলের তাৎপর্য বেরিয়ে আসলো।
আধুনিক সৌর বিজ্ঞানীদের মতে, মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহ দু’টি কক্ষপথের মধ্যবলয়ে রয়েছে এস্টিরয়ে (অংঃবৎড়রফ), মিটিওরিট (গবঃবড়ৎরঃব) ও উল্কাপিন্ড প্রভৃতি ভাসমান পাথরের এক সুবিশাল বেল্ট, এগুলোকে এককথায় গ্রহানুপুঞ্জ বলা হয়।

গ্রহানুপুঞ্জের এইবেল্ট (ইবষঃ) আবিষ্কৃত হয় ১৮০১ সালে। এক একটা ঝুলন্ত পাথরের ব্যাস ১২০ মাইল থেকে ৪৫০ মাইল। বিজ্ঞানীরা আজ পাথরের এই ঝুলন্ত বেল্ট নিয়ে শঙ্কিত। কখন জানি এ বেল্ট থেকে কোন পাথর নিক্ষিপ্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে আঘাত হানে, যা পৃথিবীর জন্য ধ্বংসের কারণ হয় কিনা?

গ্রহানুপুঞ্জের পাথর খন্ডগুলোর মাঝে সংঘর্ষের ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরখন্ড প্রতিনিয়তই পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। কিন্তু সেগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এসে জ¦লে ভস্ম হয়ে যায়। কিন্তু বৃহদাকার পাথর খন্ডগুলো যদি পৃথিবীতে আঘাত করে তাহলে কি হবে?

প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এমনই একটি পাথর আঘাত হেনেছিলো। এতে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর তাবৎ উদ্ভিদ লতা গুল্ম সব ধ্বংস হয়ে গিয়ে ছিলো। আপনজনের (অৎরুড়হ) এ যে উল্কাপিন্ড এসে পড়েছিলো তার কারণে পৃথিবীতে যে গর্ত হয়ে ছিলো তার গভীরতা ৬০০ ফুট এবং প্রস্থ ৩৮০০ ফুট।

বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণের সময় ঝুলন্ত পাথরগুলো পৃথিবীতে ছুটে এসে আঘাত হানার আশংকা বেশী থাকে। কারণ হচ্ছে, এসময় সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী একই সমান্তরালে, একই অক্ষ বরাবর থাকে। ফলে তিনটির মধ্যাকর্ষণ শক্তি একত্রিত হয়ে ত্রিশক্তিতে রুপান্তরিত হয়।

এমনি মুহূর্তে যদি কোন পাথর বেল্ট থেকে নিক্ষিপ্ত হয় তখন এই ত্রিশক্তির আকর্ষণের ফলে সেই পাথর প্রচন্ড শক্তিতে, প্রবল বেগে পৃথিবীর দিকে আসবে, এ প্রচন্ড শক্তি নিয়ে আসা পাথরটিকে প্রতিহত করা তখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাড়াবে।

ফলে প্রথিবীর একমাত্র পরিণতি হবে ধ্বংস। একজন বিবেকবান মানুষ যদি মহাশূন্যের এ তত্ব জানে, তাহলে তার শঙ্কিত হবারই কথা।

এই দৃষ্টিকোন থেকে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় মহানবীর (সা.) সেজদারত হওয়া এবং সৃষ্টিকূলের জন্য পানাহ চাওয়ার মধ্যে আমরা একটি নিখুঁত বাস্তবতার সম্পর্ক খুঁজে পাই। মহানবীর (সা.) এ আমলটি ছিলো যুক্তিসঙ্গত ও একান্ত বিজ্ঞানসম্মত। তাই এটিকে উৎসব না বানিয়ে আল্লাহকে ভয় করুন। আর নামাজ আদায় করুন।     

কবি ও প্রাবন্ধিক 
হাছননগর, সুনামগঞ্জ 

শব্দমালা : মোহাম্মদ ইমাম হোসেন

শব্দমালা :  মোহাম্মদ ইমাম হোসেন


শব্দমালা
মোহাম্মদ ইমাম হোসেন


ওহে প্রেমিক! রজনী যে তোমার যায় যে বয়ে!

ওহে প্রেমিক, বসন্তের রাত্রি বয়ে যাই,
মনের মাঝে মধুরাত্রের দোল খেলে যায়
তুমি আছো দীর্ঘ চিন্তামগ্ন হয়ে,
ঐদিকে তোমার লগ্ন বয়ে যাই,
দীর্ঘশ্বাসে তোমার অতিত ভুলে
তোমার অপ্রস্ফুটিত ভাষণা গুলোকে
অবকুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে হেলা কর না,
জীবনকে সদ্য ফুটন্ত লাল গোলাপের মত না ফুটিয়ে তুলে
এই মূল্যমান রজনীকে চলে যেতে দিও না।

ওহে প্রেমিক! রজনী তোমার যায় যে বয়ে,
কোথায় তুমি? কি ভাবছো?
এখনি তোমার প্রশান্তির পথ খোজে নাও,
নিরব নিঃস্তব্দ কোলাহলহীন রজনীতে
কত শত বেদনা বিধুর অতিত মনে হবে
সবকিছু ভুলে এই রজনীকে শুধু তোমার করে নাও,।


আমায় ভালোবেসো..


আমি তোমার কাছে সর্বক্ষণ সুখ চাই না
মাঝে মাঝে কষ্ট দিও,
গভির সঙ্কট পূর্ণ মুহুর্তে যখন কষ্ট গ্রাস করবে
তখন আমায় আপন করে নিও।

যখন তোমায় নিয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে সপ্ন দেখি,
তখন তুমি আমার হবে বলে আশা দিও,
শত জনম সে আশায় আশায় অপেক্ষা করব,
ইচ্ছে হলে ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে দিও।

ভালোবাসায় শুধু সুখ আমি চাই না,কষ্টের অনলে পুড়ে,
নিজের ভালোবাসাকে খাঁটি করে,
আমার হৃদয় মাঝে আপন নীড়ে,
তোমায় পেতে চাই আপন করে।

তোমার নিষ্পাপ মনের ইচ্ছে মত আমায় ভালোবেসে আপন করে নিও,
ভালোবেসে তোমার দুটি হাত বাড়িয়ে দিও।


যে কবিতা বুঝে না 


যে কবিতা বুঝে না, সে ভালোবাসা বুঝে না,
যে কবিতা বুঝে না, সে প্রেম বুঝে না,
যে কবিতা বুঝে না, সে নিষ্ঠুর
যে কবিতা বুঝে না, সে অবুঝ।

যে কবিতা বুঝে না, সে কারো মন বুঝে না
যে কবিতা বুঝে না, সে কারো দূঃখ বুঝে না
যে কবিতা বুঝে না, সে আনন্দহীন
যে কবিতা বুঝে না, সে বে-রসিক।

যে কবিতা বুঝে না, সে মানুষের নিরব ভাষা বুঝে না,
যে কবিতা বুঝে না, সে চোখের ভাষা বুঝে না,
যে কবিতা বুঝে না, সে অনূভুতিহীন
যে কবিতা বুঝে না, সে উপলব্ধিহীন।

যে উপলব্ধহীন সে প্রকৃত ভালোবাসা বুঝে না,
আর যে ভালোবাসা বুঝে না, সে মনুষ্যত্বহীন পাষাণ।



মিথ্যা আশ্বাস

   
বলছো তুমি, তোমায় ছাড়া
থাকব কেমনে বল,?
মিশে গেছ হৃদয় মাঝে
মন যে কেমন হল।

বলছো তুমি, তোমায় আমি
অনেক ভালোবাসি,
তুমি ছাড়া মুছে যাবে
আমার সকল হাসি ।

বলছো আরো, আমাকে খুব
ভালোবাস তুমি,
আমায় ছাড়া শূণ্য তোমার
হৃদয় মরুভূমি ।

এতকিছু বলেও এখন
আছো সুখে বেশ,
এগুলো না বলেও এখন
আমার জীবন শেষ।




গন্তাসী মানেই ধর্মহীন 

মানুষের মাঝে কিসের এত হিংসা
কিসের এতো বিবেদ,
কিসের এতো খুন-খারাপি
কিসের এতো বেদাবেদ।

কিসের জন্য নিরিহ মানুষ
একের পর এক হয় লাঞ্চিত,
কিসের জন্য প্রতিটা মানুষ
নিজেদের অধিকার হতে বঞ্চিত।

কিসের জন্য এতো খুনাখুনি
চতুর্দিকে বেয়ে চলে মানুষের রক্ত
সৃষ্টি সেরা জীব মানুষের মন
পাষাণের মত হয়েছে শক্ত।

কিসের জন্য মসজিদ, মন্দির গীর্জা
উপাসনালয়গুলো আজ নিরাপত্তাহীন
সন্ত্রাসী কোন ধর্মে তুমি,কোন বর্ণে
আসলেই সন্ত্রাসী তুমি ধর্মহীন,বর্ণহীন।

নাই কোনো ধর্ম, আর নাই কোনো বর্ণ
নাই তোমার দেয়ার মত কোনো পরিচয়
তুমি সন্ত্রাসী, তুমি নির্বোধ, তুমি পাষাণ
তুমি কি জানো ? একদিন তোমার হবে ক্ষয়।



সে তুমি নন্দিনী 

নন্দিনী
লক্ষ মানুষের ভিড়ে যে ছবিটা ভেসে উঠে
সে হলে তুমি,
হাজার ব্যস্ততায় যে মানুষটির কথা মনে পড়ে সে হলে তুমি
প্রতিটা মূহুর্তে যাকে আমি মিস করি সে হলে তুমি,
বিষন্ন মনে যাকে মনে পড়লে মন ভালো হয়ে যায় সে হলে তুমি,
বুকে হাজার কষ্ট নিয়েও যার কথা স্মরণ হলে আমি আনন্দিত হয়ে যায়
সে হলে তুমি,
রোজ রাতে যে আমার সপ্নে বিরাজ করে সে হলে তুমি
যার কথায় আমার মন ছোঁয়ে যায় সে হলে তুমি,

নন্দিনী,
তুমি আমার প্রতিটা মূহুর্তের ভাবনা
তুম মিশে আছো আমার হৃদয়ের প্রতিটি রক্তের কণায় কণায়
আজ তোমাকে ছাড়া আমি আমাকে কল্পণা করতে পারি না
আমি আমাকে তোমার মাঝে খোঁজে পায়,
শত জন্মের সপ্ন তুমি, তুমি আমার সুখ
তোমায় পেলে মুচে যাবে যত আছে দুঃখ।

শব্দমালা : এনাম রাজু

শব্দমালা : এনাম রাজু


শব্দমালা
এনাম রাজু


আপনালয় এই দেশের নিরাপদ জেল

তোমরা বেহুশ হয়ে ঘুমাইও না
নিদ্রা ভেঙে গেলে দেখবে ঢুকে আছো
ডিমের ভেতর...

হয়তো ভেবে নিবে
সে আর এমন কি.
জেনে নিও বেহুলার ঘরের মতোও খুঁজে পাবে না
কোনো নিঃশ্বাস গাছ
কেননা তোমরাই বন্ধ করেছো শুইয়ের দরজাও।

তোমরা ঘর থেকে বের হইও না
কেননা আপনালয় এই দেশের নিরাপদ জেল
এখানে চিরায়ত নিয়মে মৃত্যু আসে।

সহজকে গ্রহণ করো,
সারিবন্ধ হও ধানক্ষেত কিবা আলুর আইলের মতো
অন্তত দেখতে পাবে-
যাবতীয় কায়দায় একে অপরের মৃত্যুর কারণ।


প্রশংসা 

আমার যা কিছু প্রশংসা পাচ্ছে জগৎময়
মাটির নিচে সুপারী গাছের শিকড়ের মতো দৈর্ঘ্য তার
সেই শিকড়ের শক্তিতে আকাশ ছোয়ার স্বপ্নে বেড়ে উঠা গাছটি
আমার পাপাচার।

আমার কর্ম দ্বিখ-িত হয়েছে
একভাগ দিনের আলোর মতো ব্যস্ত প্রশংসা প্রচারে
বাকিভাগ রাতের মতো আড়াল, একাও
তোমরা কেউ জানো না, জানতে চাও?
মানুষ সামান্য পূর্ণতা বিক্রির করে গড়ে মিথ্যের পাহাড়
সে পাহাড় গাছের সাথে প্রণয় করে
সম্পর্ক রাখে জল ও বায়ুর সাথে
এই পাহাড় উঁচুতে বাস করে
কেননা মিথ্যেরা সাতবোন, প্রেয়সি সবার
অথচ তোমরা কতোটা বোকা
সামান্য সত্যকে পুঁজি করে চলতে চায় এই মুখোশপাহাড়!

সত্য ও মিথ্যা পাশাপাশি বসে
একজন এক একটুরো পাথরকে সঙ্গি করে
অন্যজন মেঘের সাথে দোস্তি করে

সত্যের ক্ষমতা অস্পষ্ট বলেই
বসে থাকে নিজের জায়গায় সময়ের অপেক্ষায়
কখন আরেকটুকরো পাথরের ঘর্ষণে জ¦লবে আগুন

মেঘও অপেক্ষা করে খুব গোপনে সাথীকে নিয়ে
তবে ছুটে চলে পৃথিবীকে জেলখানা বানিয়ে
তবুও অপেক্ষা তার দুই পাথরের মিলনে যে শক্তি উৎপন্ন হবে
তাকেই সামনে রেখে তার যে বিস্তার হবে।



সম্ভম লুন্ঠনের চুম্বন

শহরে আকাশে চাঁদের উদারতা যেমন মূল্যহীন
সাধারণের জীবনও রাজনৈতিক এর চোখে এমন...

বরফ পিঠে বসে প্রার্থনায় লাভ নেই
এরচে ভালো সাপকে আঙুলের ডগায় নৃত্য শেখানো
যেনো জেনেশুনে শেষে তার ছোবলেই আসে নীলমরণ
হেমন্তের আহ্বানে যেমন ঝি ঝি রা মিছিল করে
এদেশের সীমানা বাইরে দিয়ে তেমনি ছুটে যায় বসন্ত
কেননা দেশের প্রত্যেক পকেট সেলাই হয়েছে তৃতীয়বার

পাথরের ওজনে যে বাতাস আটকে পড়ে আলোয়
মধ্যরাতে রজনীগন্ধার পায়ে তার শ্বাপদের ঠোঁট এঁকে দেয়
সম্ভম লুন্ঠনের চুম্বন।


দেনমোহরের হাট

পুষ্পবৃষ্টির গুজবে নির্বাসিত ব্যাঙ
তাই ভয়ার্ত মাছেরা বৈঠকে বসেছে বেহুলার ঘরে
কতিপয় পাখি আড়াল হয়েছে ব্যাঙের গর্তে
সুযোগ বুঝে কাক দখলে নিয়েছেÑ
রাস্তাঘাট, দেনমোহরের হাট!

প্রস্ফুটিত ফুলের পাখায় ভর করে ছুটছে মিথ্যা
নদীরাও সাক্ষর দিচ্ছে হালাল বলেই
তোলাপোকার আয়ু তাই ধ্বংসপ্রীতির ধমনীতে...

প্রচ্ছদগল্প : চশমার পা

প্রচ্ছদগল্প : চশমার পা


চশমার পা
ইব্রাহীম রাসেল

চশমার দুই পায়ের এক পা কে ভেঙেছে এই নিয়ে মেছের মধ্যে হুলস্থুল কা-। মিজান মামা তার খাটে বালিশের পাশে চশমাটা খুলে রেখে গোসলে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে চশমার এই হাল দেখে চিৎকারে পুরো মেছ মাথায় তুললেন। রুমের সবাইকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। বাড়িওয়ালার কাছে নালিশ জানাবেন-কেন এই ধরনের অভদ্র ব্যাচেলরদের তিনি রুম ভাড়া দিয়েছেন? মিজান মামা চেঁচামেচি করেই যাচ্ছেন। রুমের সাবাই স্বাভাবিক যে যার কাজ করছে। তার কথায় কারো কোনো ফিলিংস নেই দেখে তিনি আরো ক্ষেপে গেলেন। চেয়ারের হাতলে ঝুলিয়ে রাখা শার্টটা একটানে তুলে গায়ে ঢুকাতে ঢুকাতে বাড়িওয়ালাকে নালিশ জানাতে ঘটঘট করে বেরিয়ে গেলেন।

খন্দকার বাড়ির মেছের সবচেয়ে সিনিয়র মেম্বর মিজান মামা। মধ্যবয়স্ক। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ে আছেন। লোকটার সারা অঙ্গজুড়ে সীমাহীন ব্যস্ততা। কাজে অকাজে তার ব্যস্ততার শেষ নেই। এতো ব্যস্ততা যে বিয়ে করার সময়টুকুও বের করতে পারেন নি। এই নিয়ে রুমবাসীরা প্রায়ই হাসি-ঠাট্টা করে। যদিও মিজান মামার অগোচরে। কারণ তার সামনে করলে চিৎকার করে মেছ বাড়ি মাথায় তুলবেন সেটা সবার জানা।

তিনবার কলবেল চাপার পর মুখে ব্রাশ নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে দরজা খুললেন বাড়িওয়ালা। মিজান মামাকে দেখে বললেন-কী ব্যাপার মিজান সাহেব, এতো সকাল-সকাল! মিজান মামার মাথাতো হট হয়ে আছে। তিনি চড়া কণ্ঠেই বললেন-কী ধরনের ছেলেপেলের কাছে রুম ভাড়া দেন? আপনার টাকার কী খুবই অভাব। বাদ-বিচার নাই, যতসব অভদ্র পোলাপানরে রুম ভাড়া দিয়া রাখছেন?

মিজান মামা যতটাই চড়া, বাড়িওয়ালা ততটাই কোমল সুরে টেনে টেনে বললেন-মিজান সাহেব, আগে তো বলবেন ঘটনাটা কী ঘটেছে? মিজান মামা চশমার ভাঙা পা দেখিয়ে বললেন- দেখুন, সকাল সকাল কী অঘটন ঘটিয়েছে। বাড়িওয়ালা বাসার ভিতর মুখ বাড়িয়ে তার ছোট ছেলেকে ডাকলেন। ছোট ছেলে দেয়াল ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে মিজান মামার সামনে এসে দাঁড়াল। তার পায়ে ব্যান্ডজ। বাড়িওয়ালা বললেন-এক সপ্তাহ আগে দুই ভাই খেলতে খেলতে বড়টার ধাক্কায় পরে গিয়ে এই অবস্থা।এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, কই আপনি কী কিছু টের পেয়েছেন? হইহুল্লোড়? চেঁচামেচি? আপনি এসেছেন একটা চশমার পা নিয়ে নালিশ জানাতে! আপনি তো সবচেয়ে সিনিয়র মেম্বর। আপনাকে তো সবার রেসপেক্ট করার কথা। কেন করছে না বুঝতে পারছেন কিছু?

যতটা উত্তেজিত হয়ে নালিশ জানাতে গিয়েছিলেন মিজান মামা তার তিনগুণ শীতল হয়ে রুমে ফিরলেন। রুমবাসীকে উদ্দেশ্য করে বললেন-তোমরা হয়তো কেউ ইচ্ছে করে চশমার পা ভাঙোনি। আমি আসলে দুঃখিত এমন আচরণের জন্য। রুমবাসী তো বিস্ময়ে হা... একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ফিসফিস করে বলছে-কী ব্যাপার! মামার হঠাৎ এই পরিবর্তন!
পরেরদিন রাতে মিজান মামা অফিস থেকে ফিরে নিজের খাটে বালিশের পাশে অবিকল তার চশমার মতো একটা নতুন চশমা দেখে অবাক। রুমবাসীকে দেখিয়ে বললেন-এটা কার? রুমবাসী সবাই একসাথে চেঁচিয়ে বলল-মামা এটা আপনার। সবাই মিলে আপনার জন্য এই সামান্য উপহার। মিজান মামা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গড়গড় করে বলতে লাগলেন-না, না, কি দরকার ছিল? তোমরা আমার ছোটো ভাই, ভুল করে চশমার একটা পা না হয় ভেঙেই ফেলেছ। কেন আবার তোমরা কিনতে গেলে। তোমরা আর কয় টাকাই ইনকাম করো। এসব না করলেও পারতে ইত্যাদি ইত্যাদি......

দু’টি অণুগল্প : আরিফুর রহমান

দু’টি অণুগল্প  : আরিফুর রহমান


দু’টি অণুগল্প
আরিফুর রহমান


ম্যাজিক লেন্স

-ও চা-চা, ক্যামন আছেন?
আলম সাহেবের কাছাকাছি এসে দু’জন যুবকের একজন বেশ জোরেসোরে প্রশ্নটা করল। তিনি বিরক্ত হলেন। কিন্তু মুখে সে ভাব প্রকাশ করলেন না।
-আপনার চোখে এমন চশমা ক্যান? অনেকটা ওই চোখের পাওয়ার পরীক্ষা করা ডাক্তারের মতো। আবার হাতে হোমিও ডাক্তারের ছোট্ট বাক্সও দেখি!
আলম সাহেবের বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর হঠাৎ পিঁপড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ বেড়েছে। যেদিন জেনেছেন কোরআন শরীফের একটি সুরার নাম নমল, যার অর্থ পিঁপড়া, সেইদিন থেকে। সুযোগ পেলেই ম্যাজিক লেন্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পিঁপড়ার জীবন-যাপন দেখতে।
-তুমি হানিফ ঠিকাদারের ছেলে না? দুর্জয়?
-জ্বী চাচা, আর ও আমার বন্ধু।
-আহ্, আস্তে কথা বল। আমি তো কানে কম শুনি না।
-অ! তা চাচা দেয়ালের মধ্যে কি দ্যাখেন? এট্টু কন।
-পিঁপড়া দেখি, পিঁপড়া। তোমরা তোমাদের কাজে যাও বাবা। যাও।
তিনি দেয়ালে সারিবদ্ধ পিঁপড়া দেখায় মনযোগী হলেন। দুর্জয় তার বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে গলাটা একটু নামিয়ে বিষোদ্গার করতে লাগল, ‘পাগল হইছে, পাগল। অবসর নেয়ার পর এমন হইছে, বুঝলি? চাচিরে দেখতে পারে না, উনি পিঁপড়া দ্যাখে। বুঝলি, আমাদের বাসা থেকে উনার বাসার দূরত্ব খুব বেশি না। আমরা সব জানি...’
আলম সাহেব সব স্পষ্ট শুনতে পেলেন। বুঝলেন, দুর্জয় তাঁর শ্রবণ যন্ত্রের বিষয়ে কিছুই জানে না। ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও তিনি মুখে কিছুই বললেন না। ওরা রাজনৈতিক পাওয়ার পাওয়া ছেলেপেলে। শুধু লেন্সের ছোট্ট বক্সটা খুলে আগের লেন্স পাল্টে দু’টো নতুন লেন্স লাগিয়ে ওদের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে আলম সাহেবের থেকে ওদের দূরত্ব এক ঝটকায় অনেকটা বেড়ে গেল।
-আমরা যাইগা চাচা। আপনিও বাসায় যান। পিঁপড়া দেইখা কাম নাই।
যেন অনেকটা দূর থেকে কথাগুলো বলল দুর্জয়। আলম সাহেব একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।


প্রকৃতির প্রতিশোধ

-সালাম বস।
-হুম। বিকালে যারে আন্ছোস তার খবর কি?
-ওয়েটিং রুমে রাখছি। এট্টু পর পর খালি জিগায় ‘আমার পোলা কখোন আইবো?’
-হু। শোন্, অপারেশন আজই করন লাগবো। উত্তরার পার্টি চাপ দিতাছে। জসীম উদ্দিন রোডের লুলা বুড়াডা মইরা গ্যাছে। তার জাগায় নতুন লোক বহাইবো তারা।
-আইচ্ছা।
-কি আইচ্ছা! শোন্, শরবতের সাথে কড়া ডোজ দিবি, য্যান হাত পা কাটলেও ঘুমায়া যায় দশ মিনিটের ভিত্রে।
-ঘুমানোর পর অপারেশন করন যায় না?
-আহ্, তোরে কতদিন কইছি ঘুমন্ত মানুষের মুখ দ্যাখলে আমার আব্বার কথা মনে হয়। নিজের আব্বার চোখ উপড়ামু আমি? শালা!

বয়স্ক লোকটার হাত পা শক্ত করে বাঁধা। মুখে সেঁটে দেয়া হয়েছে মোটা টেপ। একটা উত্তপ্ত শিক হাতে নিয়ে তৈরি কোরবান আলী। কিন্তু অজানা কারণে এই প্রথম তার হাত কাঁপছে।

একুশ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তারা গ্রামে ফিরছে। তারা মানে কেরামত আলী, কোরবান আলী এবং আব্দুল আজিজ। ষোল বছর আগে, কেরামত আলীর দ্বিতীয় বিয়ের পরদিন সকালে মিথ্যা অভিযোগে মার খেয়ে বাড়ি ছেড়েছিল কোরবান। আজিজ, জ্যেঠাত ভাই কোরবানের সঙ্গী হয়েছিল নিদির্¦ধায়। আজ তিনজনই গ্রামে ফিরছে। তবে টাকা-পয়সা, প্রভাব-ক্ষমতা খুইয়ে। আরো খোয়া গেছে কেরামত আলীর বাম আর কোরবান আলীর ডান চোখ।

কোন আলো লাগল চোখে...

কোন আলো লাগল চোখে...


কোন আলো লাগল চোখে... 
আহাদ আদনান

ভালোই তো ছিলাম। নিজের মত করে সাজানো পৃথিবী । তাতে সারাটা দিন উথালপাতাল  সাঁতার। অবশ্য দিন রাতের ব্যাপারটাই ছিল না। মন্দ ছিলাম না। খাওয়ার চিন্তা নেই, ঘুমের চিন্তা নেই, কোন দুঃখ নেই (সমান্তরালে কোন সুখও নেই)। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, ক্লান্তি শব্দগুলোই ছিলনা অভিধানে। কোন অভিধানই ছিলনা হয়ত।
আমার দৃষ্টি শক্তিও ছিলনা সেই দিনগুলোতে। চোখ দুটো ছিল বুঁজে। তার নিচেই যে নাসিকা, তার কাজও ছিল অজানা। বুকটার ধুকধুকানি ছিল অবশ্য। সেই বন্ধ চোখ দিয়েই অনুভব করতাম আমার আকাশ। আমার ছোট্ট পৃথিবীতে ছোট্ট একটা আকাশ। শুধু আমারই আকাশ। সেই প্রিয় আকাশটার রং আমি কখনো দেখিনি। তাতে মেঘ জমে কিনা, আঁধার করে রাত জাঁকিয়ে বসে কিনা, সেই রাতের আকাশে মিটিমিটি তারারা জ্বলে কিনা, আমি কিছুই জানিনা। তবু সেই আমার সব।
আমার পৃথিবীটাতে পুরো চার ভাগই পানি। সেই পানি ছিল একেবারেই নিন্তরঙ্গ। কখনো সেই শান্ত পানিতে খেলতে খেলতে ইচ্ছে মত পা ছুড়তাম। আর সাথে সাথে খুব কাছের কোনস্থান থেকে অনেক যন্ত্রণা মেশানো ‘উহ!’ শব্দ ভেসে আসত। কে করত সেই হৃদয় চেরা ‘উহ’ ? আমার এত সুন্দর পৃথিবীটাকে এত যতেœ কেইবা আগলে রেখেছিল। আজ অবশ্য সব জানি। ‘যে আমাকে চিরকাল ভালবেসেছে, অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি...’
সেই পৃথিবীটা একসময় মনে হল ছোট হয়ে আসছে। আমিও বড় হচ্ছি, আবার পানিও কমে আসছে। অমৃতে অরুচি বলে একটা কথা আছে। আমারও কি নতুন কোন ভুবনে যেতে ইচ্ছে করেনি? কে যেন কানে ‘স্বপনপারের ডাক’ দিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন খুব কষ্ট শুরু হল। পৃথিবীটার বাইরে খুব হৈচৈ হচ্ছিল। কারা যেন ছুরি কাঁচি নিয়ে আমার প্রিয় আকাশটাকে বিদীর্ণ করে দিল। গলগল করে পানিগুলো বেড়িয়ে গেল। সেই স্বপনপারের লোকেরা আমাকে টেনে বের করল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার বুকটা শ্বাস নেওয়া শুরু করল। অসহ্য সুন্দর আলোয় আমি তাকাতে পারছিলাম না। এরপর পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম আমার ‘স্বপনপুর’। আমার প্রথম দেখা নতুন ভুবন।

সেই প্রথম দেখা ‘স্বপনপুর’ আজ আমার নির্মম বাস্তবতায় মোড়া দৈনন্দিন পৃথিবী।

মাতুয়াইল, ঢাকা।

ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : পর্ব ০৪

ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : পর্ব ০৪


অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
৮.
সত্যিই জায়গাটা মুগ্ধ হবার মতো। বিরাট জলাশয়। তাতে টলটলে জল। জলে তেলাপিয়া মাছ ভেসে থাকে। মানুষের সাড়া পেলে ঝুপ করে শব্দ তুলে একযোগে ডুব দেয়। সেই জলের ওপর রিসোর্ট। ঘরগুলো আলাদা আলাদা, যেন অনেকগুলো নৌকা ভাসছে। ঘরগুলো কাঠের। প্রতিটা ঘর সুন্দর করে সাজানো। ঝকঝকে, তকতকে বিছানা, বালিশ। ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফাসেট, স্যাটেলাইট সংযোগসহ টিভি, সিডি প্লেয়ার এবং রকিং চেয়ার।
চব্বিশ ঘন্টা মানে এক রাত এক দিন। এই সময়টার জন্য তূর্য রুম ভাড়া করে ফেললো। তারা জানে, রাত তারা থাকতে পারবে না। তারপরও এই সময়ের জন্যই ভাড়া করতে হল, কারণ প্যাকেজ টাইম এটাই, এর কম সময়ের জন্য ভাড়া করা যায় না। সে খুব খুশি। বলল, যতক্ষণ থাকব এখানেই কাটাবো, বাইরে কোথাও যাব না।
ঠিক আছে, তাই হবে।
ঘরে বসে দু’জন গল্প করব, বাইরে বেরিয়ে জালের ওপর পাটাতনে হাঁটব, জলে হাত-পা ভিজিয়ে আনন্দ করব, পাখির গান শুনব, তোমার গানও শুনব।
সেই প্রথম সে তূর্যকে ‘তুমি’ সম্বোধন করল। বলেই সে জিহ্বায় কামড় দিল, হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
তূর্য বলল, ঠিকই তো আছে। আমি এটাই চাচ্ছিলাম।
খাবার খেতেও বাইরে যাব না। অর্ডার করে এখানে খাবার আনাবে।
তুমি যেমন চাও তেমনই হবে।
দুপুরে খাবার আগে দু’জন জলের ওপর পাটাতনে হাঁটছিল। পাটাতনের ওপর বসে গল্প করছিল। গল্প করতে করতে তূর্য গান শোনলো। আবৃত্তি শোনালো। এক পর্যায়ে তাদের মাথায় দুষ্টুমি চাপলো। একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে মজা করতে লাগলো। মজা করতে করতে সে তূর্যের জামাটা একেবারেই ভিজিয়ে দিল। তূর্যও ছেড়ে কথা বলল না। তাকে একেবারে না ভেজালেও আধভেজা করে দিল।
বাড়তি কাপড় তো কেউই নেয়নি। ঘরে গিয়ে তূর্যের জামাটা সে টেনে খুলে ফেলল। বলল, ভেজা জামা পরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
তূর্য বলল, তোমারও তো ঠান্ডা লাগতে পারে। তোমারও জামা খুলে ফেলা উচিত।
ফাজলামো করবে না বলছি।
দুপুরে খাওয়ার পর তারা পাশাপাশি বসে টিভি দেখছিল। টিভি দেখতে দেখতে খুনসুটি করছিল। টিভিতে চলছিল এইচবিও চ্যানেল। তাতে দেখাচ্ছিল দ্যা পিয়ানো ছবিটি। হার্ভে ক্যাটেল আর হলি হান্টারের দীর্ঘ চুম্বন দৃশ্য তাদের মনকে কাঁপিয়ে দিল, শরীরকে জাগিয়ে দিল। তারা কেউ আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। এরকম অবস্থায় বোধহয় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়ও না।
সে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, কিছুতেই ভার্জিনিটি হারাবে না। বলা যায়, নিজের কাছে সে প্রমিজ করে রেখেছিল। কিন্তু নিজের কাছে করা প্রমিজ সে রক্ষা করতে পারল না। আসলে এক পর্যায়ে প্রমিজের কথা তার মনেও থাকে না।
যখন শরীর একেবারে চাহিদা শূন্য-নিস্তেজ তখন সে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ঘরের দরজা খুলে একাকি কাঠের পাটাতন বেয়ে মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে ঠিক লেকের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল, সে ভুল করেছে কি না। কোনো দোষ করেছে কি না। ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল তাদের ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল শান্ত মেয়ে শান্তার কথা। শান্তা বলেছিল, হ্যাঁ হয়েছে, তিনি আমার টিচার। ব্রিলিয়ান্ট পার্সন। সুদর্শন পুরুষ। তার প্রতি আমার আবেগ থাকা অসম্ভব নয়। আমার প্রতিও বিশেষ মুহূর্তে তার আবেগ জাগতে পারে। বিশেষ আবেগময় মুহূর্তে আমরা কাছাকাছি এসেছিলাম। এরকম অবস্থায় যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সে চাহিদা শূন্য মানুষ। আমি যা করেছি তাতে কার কী হয়েছে? কার বাপের ঘরে আগুন লেগেছে তাতে? আমি ব্রিলিয়ান্ট গার্ল। ক্লাশে আমি ফার্স্ট। লেখাপড়ার বাইরেও আমার মেধা আছে। এবার বিজ্ঞান মেলায় যে দলের প্রজেক্ট প্রথম হয়েছে আমি সে দলের দলনেতা। এবার আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যে স্কুলদল প্রথম হয়েছে, আমি সে দলের দলনেতা এবং প্রধান বক্তা। আমি আবৃত্তি করতে পারি। ছবি আঁকতে পারি। ছে! আমি কাঁটাহীন-গন্ধবিহীন গোলাপ হতে চাই না। আমি গন্ধ বিলাবো, কিছু কাঁটা থাকতেই পারে। কাঁটাসহই মানুষ আমাকে মাথায় তুলে নেবে। আর গন্ধ না থাকলে কাঁটা আছে কি না আছে সেটা কোনো বিষয় না, মানুষ সে ফুলকে কাছে টেনে নেবে না। ইতিহাস তাই বলে।
শান্তার কথাগুলো মনে করে সে অনেকটা শান্তি ও সান্ত¡না পেল। তবে কিছুটা অশান্তিও জাগল মনে এই ভেবে যে, সে গন্ধ বিলানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শান্তার মত অতোটা না হলেও ক্লাশে তার স্থান দশ জনের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন সে সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারপরই তার চোখে-মুখে অস্বাভাবিক দৃঢ়তা জেগে উঠল। সে নিজের মত বলে উঠল-আমি কি হতে পারি বা না পারি সেটা পরের কথা, আমিও কারও বাপের ঘরে আগুন দেইনি। তাকে আমি ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। ভালোবাসার মানেই এই। আমি পারতাম না নিজেকে আগলে রাখতে। যে পারতো সে ভালোবাসা কি তা জানে না।
তূর্যও মনের দিক থেকে কিছুটা দমে গিয়েছিল। সে এমনটা চেয়েছিল না। এমন কোনো উদ্দেশ্য নিয়েও সে আসেনি। কেমন করে কি হয়ে গেল সে তা বুঝতে পারেনি।
তূর্য তার একা থাকার মুহূর্তে সেখানে গেল না। তাকে সান্ত¡না সূচক কোনো কথাও বলল না। তার মনে কিছুটা অস্বস্তি ভাব।
ফেরার পথে গাড়িতে উঠে সব স্বাভাবিক।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। বাসায় ফিরেই ক্লান্ত শরীরটা সে বিছানায় এলিয়ে দিল। তখন মা এলেন তার ঘরে। বললেন, এত দেরি হল যে?
পরীক্ষা শেষ হবার পর বন্ধুদের সাথে একটু কথা বললাম। চা খেলাম।
পরীক্ষা কেমন হয়েছে ?
ভাল, তবে এখন প্রশ্ন দেখতে চেও না মা। ভেরি টায়ার্ড।
না না, আমি এখন প্রশ্ন দেখব না। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর শোও।
না, একটু রেস্ট নিয়ে নেই। এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
ঠিক তখন তার ফোন বেজে উঠল। সে ফোনের দিকে এক পলক তাকিয়েই দেখল তূর্যের ফোন। তখনই বাবা এসে দাঁড়ালেন মায়ের পাশে। সে একবার বাবার মুখে, একবার মায়ের মুখে আর একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে মাকে বলল, আমাদের কোচিং-এর ইংলিশ টিচার ফোন করেছেন। কথা বলবে?
মা কল রিসিভ করে বললেন, হ্যালো।
ঠিকমতো বাসায় পৌছেছো তো ?
আমি সুমাইয়ার মা বলছি।
অ্যা! ও, স্লামালিকুম স্লামালিকুম।
অলাইকুম সালাম। ওর পরীক্ষা কেমন হয়েছে আজ?
পরীক্ষা! ও হ্যাঁ পরীক্ষা। এখনও তো খাতা চেক করিনি। তবে মনে হয় ভালই হয়েছে। আমি খাতা চেক করে পড়ে আপনাকে জানাবো।
ও লেখাপড়া কেমন করছে?
ভালোই তো, ইদানিং ও লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগি।
একটু খেয়াল রাখবেন। আমাদের একটাই সন্তান। ওকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।
সিওর সিওর।
একদিন বাসায় আসুন বেড়াতে-একটু চা খেয়ে যাবেন।
আসবো-আসবো একদিন।
মা ফোন রাখতেই বাবা বললেন, দেখলে, একেই বলে টিচার। আবার ফোন করে খবর নিচ্ছে ছাত্রী ঠিকমতো বাসায় পৌছেছে কি না। সাধেই বলে না-টিচার ইজ দ্যা বিল্ডার অব এ্যা নেশন।
সত্যিই খুব ভাল। কি সুন্দর করে কথা বললো!
আর তুমি তো আছো মেয়েকে চার্জ করার তালে। আজকালকার মা-গুলো স্বৈরাচারীর রূপ পেয়েছে-স্বৈরাচারী হুসাইন মুহাম্মদ এশাদের চেয়েও বেশি। আমাদের সময়ে এরকম ছিল না।
চার্জ করলাম কোথায় ?
শোন, মেয়ে আমার লেখাপড়া করতে করতে ক্লান্ত। এই ক’দিনে মেয়ে কিন্তু অনেক শুকিয়ে গেছে। তুমি ওর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ যতœ নিও।
খেতেই তো চায় না কিছু।
চাইবে না, তারপরও খাওয়াতে হবে। বেশি করে টাকা দিয়ে দিবে যাতে বাইরে ভাল খেতে পারে।
তারপর বাবা তার কাছে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মা, আজ আর পড়ার দরকার নেই। দুইটা পরীক্ষা দিয়ে এসেছো, একটু রেস্ট নাও। তারপর উঠে খাও। তারপর ঘুমাতে যাও। না ঘুমিয়ে-না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি ফেলে দিয়েছো। শোন, তোমার যা খেতে মনে চায় আমাকে বলবে। আমি ঠিক ঠিক এনে দেব। শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি মনে রাখবো তোমার চাওয়ার কথা।
ঠিক আছে বাবা।

৯.
পরীক্ষা একেবারে নিকটে চলে এসেছে। ঠিক দরজায় টোকা দিচ্ছে। বাবা বলেন, নকিং এ্যাট দ্যা ডোর।
কোচিং ক্লাশ বন্ধ হয়ে গেছে। তূর্যের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেছে। তার ফোন আসাও কমে গেছে। সে নিজে ফোন করলেও অনেক সময় তূর্যের ফোন বন্ধ পায়। 
তবে এ নিয়ে সে শঙ্কিত বা বিরক্ত নয়। মাঝে মাঝে একটু মন খারাপ হয় এই আর কি। এক্সামিনেশন ইজ নকিং এ্যাট দ্যা ডোর। এ সময় তূর্য নিশ্চয় তাকে বিরক্ত করতে চায় না-তার সময় নষ্ট করতে চায় না। সে নিজেও জানে, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এখন একটু মন দিয়ে পড়া উচিত।
সে গিয়েছিল বইয়ের দোকানে। কলম, পেন্সিল, ইরেজার, সার্ফনার, স্কেল এরকম কিছু দরকারি জিনিস কিনতে।
প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রগুলো কেনা শেষ হলে তার মনে হল, কোচিং সেন্টারে একটু ঘুরে আসে। কোচিং সেন্টার বইয়ের দোকানের খুব কাছে। গেলে তূর্যের সাথে দেখা হবে নিশ্চয়। তাদের ক্লাশ বন্ধ হলেও অন্য সবার ক্লাশ তো চলছে। কতদিন তার সাথে দেখা হয় না! পরীক্ষার আগে তো আর দেখা হবেও না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল এরকম। এমন সময় তাকে চমকে দিয়ে কে যেন বলল, তুমি এখানে?
সে সচকিত হয়ে দেখল, পাশেই তূর্য দাঁড়িয়ে। আনন্দে নেচে উঠল তার মন। খুশিতে ঝলমল করে উঠল তার মুখ। এ যে রোদ না চাইতেই সূর্য। ভাত না চাইতেই পোলাও। সে বলল, তোমার সাথে দেখা করতে কোচিং-এ যাব ভাবছিলাম।
আচ্ছা, চলো কোথাও বসি।
না না, এখন বসতে পারবো না।
বসতে পারবে না মানে? কি এত তাড়া তোমার?
প্রশ্ন দু’টির মধ্যে সে কঠিনতার ছোঁয়া পেল। কন্ঠটা কেমন নিরস। সেও কিছুটা কঠিন কন্ঠে বলল, কিসের তাড়া বোঝ না? পরীক্ষার আর ক’দিন আছে?
হয়েছে, ঘোরাঘুরি করতে সময় নষ্ট হয় না। আমি একটু বসতে বললাম আর........।
ঘোরাঘুরি করছি!
সে ঘুরতে বের হয়নি। সত্যিই সে একান্ত দরকারে বের হয়েছে। তূর্যের এরকম আচরণে সে সত্যিই খুব অবাক হল। দুঃখে ভরে গেল তার মন। কিন্তু চরম দুঃখ এল আরও একটু পর। তূর্য বলল, কার জন্য অপেক্ষা করছিলে?
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
না বোঝার কি আছে? কারও জন্য অপেক্ষা করছিলে নিশ্চয়?
তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?
হ্যাঁ করছি, প্রথম থেকেই তোমাকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল।
কেন?
সত্যি বলতে কি, তোমার আচরণ আমার ভাল লাগে না। সন্দেহজনক মনে হয়।
কিন্তু কেন ?
ফয়সালের সাথে তোমার এতটা লদকালদকি আমার ভাল লাগছিল না।
ফয়সালের সাথে.............! সে আমার ক্লাশমেট। জাস্ট ফ্রেন্ড। তুমি ওকে জড়িয়ে আমাকে সন্দেহ করতে? এত ছোট মন তোমার? আমি এত নিচে নেমে যাইনি যে, ক্লাশ টেনের একটা ছেলের সাথে প্রেম করতে যাব। আর দুই/তিন বছর পরই আমি ইচ্ছে করলে বিয়ে করতে পারি। এ বয়সেও তো অনেক মেয়ের বিয়ে হয় এই দেশে। কিন্তু ফয়সাল তা পারে না। মনটা উচু ছিল বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের প্রেম প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। হ্যাঁ, আমিও তার প্রেমের কাঙাল ছিলাম তা ঠিক। এখন আমার ভুল ভেঙেছে। ক্লাশ টেনের ছেলে ফয়সালের মন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের চেয়ে অনেক উন্নত। উন্নত এই জন্য যে, সে আমার খুব কাছের বন্ধু হয়েও আমাকে প্রেম প্রস্তাব দেয়নি।
আসলে তোমাকে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তুমি সবার সাথে এত ফ্রিলি কথা বলো যে....।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে বিশ্বাস করো না। আমাকে বিশ্বাস করার জন্য আমি তোমার পায়ে ধরতে যাচ্ছি না।
অতো দেমাগ দেখিও না। কী আছে তোমার?
যা আছে তা তো কুকুরের মতো খুবলে খেয়েছোই। তারপরও আমার কি আছে তা তোমাকে দেখানোর দায় পড়েনি আমার। তুমি কি দেখেছিলে আমার ভেতর সে প্রশ্নও আমি করতে পারি। কিন্তু তা করবো না। চলে যাও আমার সামনে থেকে।
রাগ করো কেন? চলো কোথাও বসি।
তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। আমি তোমাকে আর এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারছি না।
যদি না যাই ?
আমি লোক জরো করবো। লোক জরো করে তোমাকে গণধোলাই খাওয়াবো। আমার চোখের সামনে জনগণ তোমার হাড়-মাংস সব এক করে ফেললেও আমার এতটুকু খারাপ লাগবে না।
শোন, শান্ত হও।
তুমি আমার সামনে থেকে চালে যাও বলছি। গেট লস্ট। গেট লস্ট।
ততক্ষণে লোক জমে গেছে। দ’ু/একজন এগিয়ে এসে বলতে শুরু করেছে-কী সমস্য? কী সমস্যা আমাদের বলুন? হ্যালো ভাই, আপনে তার সাথে ঝামেলা করতেছেন ক্যান? রাস্তাঘাটে মাইয়া মাইনসের সাথে ঝামেলা করেন, ব্যাপার   কী ?
সে লোকজনকে নিরস্ত করে বলল, ভাই, এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার।
একজন বলল, পার্সোনাল বুঝলাম। দরকার হইলে ডাইকেন। ব্যাটারে বুঝায়া দিমু কত গমে কত আটা, কত আটায় কত রুটি। কত আখে কত গুড়, কত গুড়ে কত শরবত।
আসলে তেজপাতা আর কাঁঠাল পাতার একটা হিসাব তূর্যের কাছেও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইয়ার নিচের স্বপ্নার সাথে তার কলেজ জীবন থেকে সম্পর্ক। শারীরিক সৌন্দর্যে স্বপ্না তার থেকে কিছুটা পিছিয়ে। কিন্তু এগিয়ে অন্য সব দিকে। স্বপ্নার একাডেমিক রেজাল্ট খুবই ভাল। বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু থেকেই সে ভাল করছে। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সে অন্যদিকেও ভাল। ভাল ছবি আঁকে। আবৃত্তি করে। আর বই পড়া তো তার নেশা। রাজ্যের বই গোগ্রাসে গিলে। বই পড়ার চেয়ে ভাল অভ্যাস পৃথিবীতে আর কি হতে পারে ? ফ্রানৎস কাফকা স্বপ্নার প্রিয় লেখক। আর সে সারা জীবনে কোনোদিন ফ্রানৎস কাফকার নাম জানবে কিনা সন্দেহ। সুতরাং, নিঃসন্দেহে বলা যায় স্বপ্নার উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যত আছে। সম্মানজনক ক্যারিয়ার হবে তার।
আর সে? সে পড়াশোনায় যে কোথায় নেমে গেছে তা তো তূর্য খুব ভালোই জানে। যে পাস্ট টেন্স বোঝে না, কী যে তার এস.এস.সি’র রেজাল্ট হবে তা তূর্যের জানা। এই রূপ-সৌন্দর্য কি সারা জীবন থাকবে? তূর্যের মনে পড়ল লাল সালু উপন্যাসের মজিদের একটা কথা-মানুষের রূপ কয় দিনের?
জীবন কোনো পদ্ম পাতার শিশির নয়। জীবন অনেক বড়। জীবন অনেক মূল্যবান। এই দীর্ঘ ও মূল্যবান জীবনে সে এমন একজন পার্টনার চায়, যে তার ক্যারিয়ারকে গড়তে সাহায্য করবে। যার জন্য তার নিজের কিছুই করতে হবে না, কিন্তু পাবে অনেক কিছু। ভবিষ্যত সন্তান-সন্তাদির ব্যাপারও তো আছে। শিক্ষিত মা শিক্ষিত জাতি গঠন করে। উচ্চ শিক্ষিত মা নিশ্চয় উচ্চ শিক্ষিত জাতি গঠন করে। স্বপ্না যে উচ্চ শিক্ষিত মা হবে তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
রাত নয়টা। দরজা ভেজানো। সে খাটের উপর বসেছিল হাঁটুর মধ্যে মাথা গুজে। তার মুখ দেখার উপায় ছিল না। তাই তার মুখের অভিব্যক্তি পড়া যাচ্ছিল না। সেখানে ঘৃণা অথবা ক্রোধ ছিল। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্র বলেই সে তূর্যের বশ্যতা স্বীকার করেছিল তা নয়। সে সত্যিকারে প্রেম নিয়েও গিয়েছিল। সেই প্রেমকে তূর্য এইভাবে পায়ে পিষে মারল!
সেলফোনটা পাশে নামানো ছিল। বেজে উঠল তার স্বরে। সে মাথা তুলল। মাথা তুলতেই রেশমি চুলের গুচ্ছ ঢেকে দিল তার মুখ। সে বাঁ হাতে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে তাকাল ফোনের দিকে। বিতৃষ্ণায় ভরে গেল তার মন। সে ফোন হাতে তুলে নিল না। কল রিসিভ করল না। ফোন বাজতে বাজতে থেমে গেল।
মুহূর্তকাল পরে আবার বেজে উঠল। বাজতে থাকল। তখন মা এলেন দরজার পাশে। বললেন, ফোন বাজছে শুনতে পাচ্ছো না? রিসিভ করছো না কেন?
মা ফোন রিসিভ করলেন। ওপাড় থেকে কন্ঠ ভেসে এল-ফোন ধরছো না কেন?
আমি সুমাইয়ার মা বলছি।
ও স্লামালিকুম-স্লামালিকুম।
অলাইকুমসালাম।
আমি ওর ইংলিশ টিচার তূর্য।
আমি চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন আপনি?
জি ভালো। ও লেখাপড়া কেমন করছে?
করছে তো ভালই।
এখন ও কোথায় ?
কাছেই আছে, দিচ্ছি।
মা তার হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে চলে গেলেন। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে এসে পূর্বের স্থানে বসল। তূর্য বলল, ফোন ধরছো না কেন?
প্রয়োজন বোধ করছি না তাই।
এত রাগ তোমার ?
আমি চাইনি যে, আপনি আমাকে ফোন করুন।
আমি তা জানি। তাই আর কখনো ফোন করে তোমাকে বিরক্ত করব না। আজই শেষ। একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি।
আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছা আমার নেই।
আমি তাও জানি। তোমার ইচ্ছা না থাকলেও আমি বলবো আমার কথা। অনিচ্ছা নিয়েই তোমাকে শুনতে হবে।
বলুন।
তুমি নিশ্চয় ভাবছো-আমার যা পাওয়ার তা পেয়ে গেছি, তাই চলে যাচ্ছি। স্বার্থ হাসিল করে আমি চলে যাচ্ছি। বাস্তবিক ব্যাপারটা তা নয়। সেদিন যা হয়েছে তা আমাদের অজান্তেই হয়েছে। তুমি চাইলেই স্মরণ করতে পারবে যে, আমি নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। নিজেকে সামলাতে পারোনি তুমি। তুমি হয়ে পড়েছিলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন। তোমার বয়স কম, সে সুযোগ আমি নেইনি। তুমি তোমার শরীরের দাবীর কাছে হেরে গিয়েছিলে।
কারণ আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার সাথেই শরীরের সম্পর্ক। আমি যতটা না শরীরের কাছে হেরে গিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি হেরে গিয়েছিলাম আমার ভালোবাসার কাছে। এখন আসুন আমার কাছে, এসে দেখুন শরীরের কি দাবী। থুথু ছাড়া কিছু জুটবে না আপনার কপালে।
তুমি খুব সুন্দর কথা বলেছো। খুব যুক্তিসংগত কথা। তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। আমিও তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায়না। হয়তো আমি ছিলাম তোমার প্রথম প্রেম। তাই তুমি বেশি আবেগাক্রান্ত ছিলে।
কথাটা ঠিক না, আমি আপনার মোহাক্রান্ত হয়ে সত্যিকারে ভালোবাসাকে ছেড়ে এসেছিলাম। এটাই ছিল আমার ভুল। আমি একজনের সাথে যে ব্যবহার করেছি, আরেকজনের কাছ থেকে সেই ব্যবহার পেয়েছি। যেমন কুকুর তেমন মুগুর। এর ইংরেজিটা যেন কি?
টিট ফর ট্যাট। আমার প্রিয় কবি ও কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদ বলেছেন-প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রেম বলে কোনো প্রেম নাই। সব প্রেমই প্রথম প্রেম। প্রতিটা প্রেমই সম্পূর্ণ নতুনত্ব নিয়ে জীবনে হাজির হয়। আমাকে তোমার যতটা ভাল লেগেছিল, তার চেয়ে অধিক ভাল যে আর কাউকে লাগবে না তা নয়। এখন হয়তো সেটা উপলব্ধি করতে পারবে না, যখন আসবে তখন বুঝবে। প্রেম আসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে।
আর কিছু বলার আছে ?
তাই বলছি-আমাকে ক্ষমা করতে না পারলেও ক্ষতি নেই। তুমি নতুন জীবন পথে এগিয়ে যাও।
আমি কারও কাছে উপদেশ চাইনি। গেট লস্ট।
ফোন কেটে দিয়ে সে আবার আগের মত হাঁটুর মধ্যে মাথা গুজে বসে রইল।
বেশ একটু পর আবার বেজে উঠল ফোন। এবার তার বিরক্তি চরমে পৌছুল। প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে ফোনটার দিকে তাকাতেই তার মুখে জেগে উঠল অনেকটা প্রশান্তির ছায়া। সে কল রিসিভ করে বলল, হ্যালো নিলয় ভাই, কেমন আছেন?
এত নরম কন্ঠ!
কেন, আমি বুঝি নরম কন্ঠে কথা বলতে পারি না?
পারো, নরম-মোলায়েম কন্ঠে আমার সঙ্গে অনেক দিন কথা বলেছোও। মাঝখানে বেশ কিছু দিন তো আমার সাথে নরম কন্ঠ ছিল না। আমার ফোন রিসিভ করেই স্যাঁৎ করে উঠতে-আপনি আবার ফোন করেছেন? আপনাকে না বলেছি, আমাকে ফোন করবেন না তারপরেও.......। আপনার একটু লজ্জা থাকা উচিত।
হি-হি-হি।
কত দিন পর তোমার হাসির শব্দ শুনলাম। কিন্তু হাসিটার মধ্যে একটু দুঃখ, কিছুটা রাগ, কিছুটা অপমান মেশানো যেন।
আপনি অনেক বুদ্ধিমান। মানুষের কন্ঠ থেকেই অনেক কিছু ধরে ফেলতে পারেন।
আমি কেমন বাপের ছেলে বোঝ না? সত্যি তোমার আগের হাসি থেকে এই হাসি কিছুটা ভিন্ন। ব্যাপারটা কি বলবে?
তেমন কিছু না।
কেচিং-এর সেই অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট টিচারের সাথে কি সব চুকেবুকে গেছে?
তাকে যা ভেবেছিলাম সে তা নয়।
তুমি যা ভেবেছিলে সে তাই।
মানে?
মানে সে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, গুড টিচিার, অওনার অব এক্সট্রা মেরিট, সবই তার আছে।
সে একটা চিটার-প্রতারক-ক্রিমিনাল।
ভেতরের প্যাঁচটা আমি আগেই ধরেছিলাম।
কী ধরেছিলেন নিলয় ভাই ?
তোমার যেমন ত্যাজপাতা আর কাঁঠাল পাতার হিসাব আছে, তারও তেমন আছে নিশ্চয়। তুমি যেমন ত্যাজপাতা ফেলে কাঁঠাল পাতার কাছে গিয়েছিলে, সেও এখন নিশ্চয় আম পাতা, জাম পাতা কিছু একটা পেয়েছে। ঐসব টিচাররা প্রেম করার ব্যাপারে যতটা হ্যাডম, বিয়া করার ব্যাপারে তেমন না। বিয়া করার কথা বললেই ওরা কুঁইচ্যা মুরগীর মতো মোচরাইতে থাকবো।
কুঁইচ্যা মুরগী কি নিলয় ভাই?
এখন কুঁইচ্যা মুরগী চিনা লাভ নাই। আমি যা বলেছি তাই ঠিক।
আপনি সত্যিই খুব ব্রিলিয়ান্ট।
আমার ধারণা ভুল না। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বন্ধুবান্ধদের দেখছি না?
বাদ দেন এসব কথা। আপনি ভাল আছেন তো?
এতদিন ভাল ছিলাম না। মনের মধ্যে একটা দুঃখ, পরাজয়ের ব্যথা বয়ে বেড়িয়েছি। এখন তোমার পুরনো কন্ঠ, পুরনো হাসি আমাকে অনেকটা ভাল করে দিল।
আপনি বেড়াতে আসুন না একদিন।
কতদিন পর আবার সেই আহ্বান! এই আহ্বান এড়ানো কঠিন। তবে এখন আসব না। তোমার পরীক্ষা খুবই নিকটে। নকিং এ্যাট দ্যা ডোর। পরীক্ষা শেষ হোক, তারপর আসব।
পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে তার পরের দিনই চলে আসবেন। তখন তো আমার একেবারে ফ্রি টাইম। খুব মজা হবে।
আচ্ছা তাই আসব।
[চলবে...]

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৪

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৪


ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
সকাল দশটায় মিজান মিয়া এসে হাজির। জানাল, তার বাবার চিকিৎসা চলছে। বাজারে যাবে বলতেই, ওকে টাকা দিলাম, দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। মিজান মিয়া তড়িঘড়ি চা বানিয়ে দিয়ে বাজারে চলে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি গতরাতের কথা। নীলা ও আমি ঘুরে বেড়িয়েছি গভীর শাল-গজারি বৃক্ষের সুবিশাল সাম্রাজ্যে। আমাদের যুগল জীবনে এমন একটি অ্যাডভেঞ্চারময় দিন আসবে, আগে কখনো ভাবতেও পারিনি। মা প্রায়ই কেঁদে কেঁদে আমাকে বলত আবার বিয়ে করার জন্য। খাপছাড়া এ জীবনটাকে গুছিয়ে সাজানোর জন্য। যদি আমি তাই করতাম, আজ নীলার সামনে যে কী হত? ও এসব শুনে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেত। সে তখন আমাকে বলত, সোম তুমি আমার জন্য কিছু দিন অপেক্ষা করতে পারলে না? কেন এমন করলে? আমাকে কেন এতটুকু সময় দিলে না?
তখন আমার কাছে প্রতি উত্তর বলতে কিছুই থাকত না। আচ্ছা, এসব শুনে তখনও যদি নীলা আমাকে কাছে টানতে চাইত, আমি কী করতাম? গতরাতের মতো ওকে ফিরিয়ে দিতাম? নাকি বলতাম, নীলা আমার কাছে এসো না, দূরে সরে যাও, আমাকে গ্রাস করো না, প্লিজ.. আমি বিবাহিত।
একটা প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো আমার কাছে খুঁজে পাইনি। গেস্টহাউজে নীলা আমাকে খুব কাছে টেনেছিল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল, কিন্তু আমি কেন ওর থেকে দূরে সরে ছিলাম? অথচ এই আমি নীলাকে কত অসীম ভালবাসি। নীলাহীন সোম ধূ-ধূ মরুভূমি। অথচ, ওকে কাছে টেনেও আমি সে মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করেছি, কেন এমন করেছি?
আমার ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠল, অস্তিত্ব! অস্তিত্ব রক্ষার জন্য! শূন্যে, পরম শূন্যে বিলীন হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
কে? কে কথা বলছ?
নিজেকে প্রশ্নটা করে কোনো উত্তর পেলাম না। হঠাৎ বলে ওঠলাম, হ্যাঁ আমি, আমিই তো বলছি।

দুপুরের পর উৎসবকে কল দিলাম। জানাল, আজই সে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরছে। এখনো ঢাকায় ফিরে যাইনি শুনে ভীষণ রাগ করল। ওর স্ত্রী মোহনা ও দু’সন্তানকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে নেপাল যাবে। আমি সাথে যাব কিনা জানতে চাইল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, শুধু আমি নই, আমার সাথে আরও একজন আছে। সেটা এখন বলছি না। তার আগে একবারের জন্য শালবনে আসতে হবে তোদের। তোদের জন্য একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।
উৎসব ঠাট্টা করে বলল, ঐ অঞ্চলের কোনো মেয়েকে শাদী করে ফেলেছিস নাকি?
তারচেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছে। ঠিকানা তো তোর ম্যাসেঞ্জারে দেয়াই আছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে রোড ধরে ছুটতে থাক, তারপর আমি তো আছিই।

আজ নীলা আসেনি, একা একা কেটেছে সারাটা দিন। ও কি গতরাতের ঘটনায় এখনও অভিমান করে আছে? জানি না। তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতা যে ভালবাসাকেও দূরে ঠেলে দেয় তা আমি গতকাল নিজের কাছে জানলাম। আচ্ছা, উষ্ণতা কি সঙ্গমকে ত্বরান্বিত করবে? কাছে টানবে খুব সহজে? চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে? জানি না, কী সব ভাবছি, যুক্তি নাকি যুক্তিহীনতা।
নিম্ন তাপমাত্রার মতো উচ্চ তাপমাত্রার আচরণও একই রকম হবে। এটা খুব সহজ ও স্বাভাবিক যুক্তি।
দিশেহারা ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিতে বিকেলে মিজান মিয়ার সাথে বাইরে থেকে বেরিয়ে এলাম। মিজান মিয়া স্থানীয় মানুষদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে গভীরে প্রবেশ করলাম। আমি আপন মনে খুঁজে চলেছি, রাতের সে গেস্টহাউজ। আমাকে দিগি¦দিক হাঁটতে দেখে, মিজান মিয়া বলে ওঠল, স্যার, ভেতরে যাবেন না, পথ হারায়া গেলে, খোঁজা মসিবত হইব।
তার দিকে তাকালাম, আশঙ্কা-দ্বিধার ছাপ মিজান মিয়ার চোখে-মুখে।
এখানে, বনবিভাগের গেস্ট হাউজ কোথায় বলতে পারো?
স্যার, এখানে কোনো গেস্ট হাউজ নাই। ফরেস্ট অফিসারের অফিস আরো অনেক দূরে মেইন রোডে। এইখান থেকে সাত মাইল পথ।
মিজান মিয়া যে এই এলাকা সম্পর্কেও অনভিজ্ঞ তা তার কথায় স্পষ্ট প্রমাণিত। গতরাতে ঘুরে গেলাম, দেখে গেলাম, আর এখন সে বলছে এখানে কোনো গেস্টহাউজই নেই।
মিজান মিয়াকে কিছুই বললাম না। বরং বাড়িতে ফিরে এলাম।
সন্ধ্যায় ডায়েরি পড়ায় মন দিলাম। একটানা রাত একটা পর্যন্ত পড়ে গেলাম। ১৯৩৫ সালের ডায়েরিটি পড়তে গিয়ে চোখের পাতায় ঘুম ঘুম ভাব এসে জড়ো হচ্ছে। দাদাজান এ ডায়েরিতে গণিত নিয়ে তাঁর নানা কৌতূহল ও প্রশ্ন একে একে তুলে ধরেছেন। গাণিতিক লেখার পাশে মাঝে মাঝে তিনি নোট আকারে মেঘাদ্রিকে নিয়ে লিখেছেন। আমার বুঝতে বাকি নেই, দাদাজানের কৈশোরের সে প্রেমিকা মেঘাদ্রি ব্যতীত অন্য কেউ নয়।
ঘুম আসতে না আসতে আমি স্বপ্নের জগতে ডুবে গেলাম। আজকের স্বপ্নে নীলা নেই, কলেজ ক্যাম্পাসের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কে আছে আমার স্বপ্নে? জানি না, কাউকেই খোঁজে পাচ্ছি না।
আমি এখন কোথায়?
এই তো, আমি দাদাজানের ঘরে ঘুমিয়ে আছি। লক্ষ্য করলাম, আমার খাটের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। আমার অনুমতি ব্যতীত কেউ ঘরে ঢুকেছে। ইচ্ছে করছে রেগে ওকে জিজ্ঞেস করি, কে তুই? কেন এখানে এসেছিস? কিন্তু আমার রাগ জাগছে না। চুপি চুপি ওঠে বসলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম চেয়ারের দিকে। এই তো দেখতে পাচ্ছি, কে এটা? দেখে মনে হচ্ছে একুশ বাইশ বছরের কোনো তরুণ।
এই কে তুমি? আমি স্বশব্দে প্রশ্নটা করে ফেললাম।
তরুণটি আমার দিকে ফিরে তাকাল। কিছুই বলছে না। আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কাকে দেখছি। ওর চেহারা তো দেখতে ঠিক আমার মতো। এটা তো সেই আমি, যে বয়সে আমি ভার্সিটিতে পড়েছি। গায়ের জামাটাও পরিচিত। এই শার্ট আমি ষোল বছর আগে পড়তাম। যখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।
তুমি আমাকে চিনবে না। তরুণটি ওর স্বাভাবিক গলায় বলল।
ভয়, কৌতূহল ও প্রশ্ন আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।
কী চাও এখানে?
মিঃ সোম আমি তোমাকে এখান থেকে চলে যাবার জন্য আদেশ করছি।
কেন?
ড. রিয়ন সাহেবের ডায়েরিগুলো আমার চাই।
কে তুমি? তোমার পরিচয় দাও। রূঢ়ভাবে বললাম।
আমার নাম গঞ৬৬৯, চতুর্মাত্রিক জগতে আমার বাসস্থান। যেখানে দৃশ্যমান কিছুই নেই, অথচ সবই আছে।
এ ডায়েরিগুলো তোমার কেন প্রয়োজন?
রিয়ন সাহেব, সারাজীবন তপস্যা করে ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা তৈরি করেছেন। এ ফর্মূলার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে এমন কিছু গোপন সমীকরণ রয়েছে, যা বহুমাত্রিক জগতে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করবে। তাই ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার খোঁজে আমি তোমাদের ত্রিমাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছি, ও রিয়ন সাহেবের ডায়েরিগুলো পড়ে দেখছি।
চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালাম। নির্ভীক ভঙ্গিতে বললাম, না, তুমি এটা করতে পারো না। তুমি বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করেছ। এটা তোমার প্রথম অপরাধ। কারোর ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়া নিঃসন্দেহে অন্যায়। তোমাকে এখান থেকে চলে যাবার জন্য আদেশ করছি। এখান থেকে বিদেয় হও, নইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।
তরুণটি হেসে ওঠল।
হা হা হা
আমি চরম বিরক্ত হচ্ছি।
কী ব্যাপার পাগলের মতো হাসছ কেন?
হাসছি, তোমার বোকামির মাত্রা দেখে। শোনো চতুর্মাত্রিক জগতের জীব তোমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী। তোমাদের পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী আমাকে কিছুই করতে পারবে না। ইচ্ছে করলেই তোমাকে আমি হত্যা করতে পারি।
তরুণটির কথা শুনে এবার স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে। এক মুহূর্তে ভাবলাম এ ঘর থেকে আমার বের হওয়া উচিত। ধীর পায়ে দরোজার কাছে চলে এলাম। তরুণটি আমার বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আড় চোখে সে আমাকে দেখছে, ওর দেখার ভঙ্গি খুব সুন্দর! অথচ এ ভঙ্গিটা আমার কাছ থেকেই নকল করেছে। ঠিক এভাবেই আমি রহস্য ভরা চোখে নীলার দিকে তাকাতাম।
পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই মিঃ সোম। তুমি তো ঘুমিয়ে আছো বিছানায়। এই মুহূর্তে নিরুপায় তুমি।
বিছানার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। একি, আমি তো বিছানায় শুয়ে আছি। তাহলে এখানে আমিটা কে? এসব কী ঘটছে? একই আমি তিনটি স্থানে কিভাবে সম্ভব?
আমার ছদ্মবেশী ঘাতক আমার সম্মূখে আমার চেহারায় দাঁড়িয়ে। এখন আমি আমাকে কিভাবে রক্ষা করব? চিৎকার করে ডেকে ওঠলাম, সোম, ঘুম থেকে ওঠো, সোম। তোমার সামনে বিপদ।
আমার ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। এখন উপায়?
তরুণটি দীর্ঘবাহু প্রসারিত করে আমার বিছানার দিকে এগোচ্ছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তীব্র বেগে তরুণটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ওকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুষি মারতে লাগলাম। অনবরত মাথায় আঘাত করছি। ও কাতরাচ্ছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ওকে দুর্বল করতে পেরে আমি যেন আরো শক্তি খোঁজে পেলাম। আহত তরুণটি মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় গোঙাচ্ছে। আমি বিছানায় ওঠে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছি। আমার গভীর ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। আমার মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো আমি কি মারা গিয়েছি? এটা কি আমার মৃতদেহ? না, তা হতে পারে না।
হঠাৎ দেখলাম, তরুণটি মাথা তুলে জেগে ওঠেছে। ওর করুণ মুখ দেখে আমার ভেতরটা হু হু করছে। একি করেছি, বাইশ বছরের আমাকে আমি মেরে কী করেছি। খুব মায়া হচ্ছে ওর জন্য।
তরুণটি বিছানার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আমার গলা চেপে ধরতে চাইছে। আমি আমার ঘুমন্ত দেহকে টেনে খাটের কিনারে নিয়ে গেলাম। সে আমাকে ছুঁতে না পেরে বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা চেপে ধরল। মুঠোফোনটাও ধরতে চেয়েছিল, তার আগেই সরিয়ে নিয়েছি। ওর হাতের মুঠোয় প্রচ- চাপে ঘড়িটি মুহূর্তে ধুমড়ে-মুচড়ে গেল।
ভয় হচ্ছে, সে কি আমার দেহটাকেও এভাবে বিকৃত করে ফেলবে? ধুমড়ে মুচড়ে দেবে?
আমি আমার গায়ে তীব্র জোরে ধাক্কা দিতেই সজাগ হয়ে গেলাম।
নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছে?
তুমি বিপদগ্রস্ত, এখান থেকে পালাও।
আমি বিছানা থেকে নেমে তরুণটির দেহ ডিঙিয়ে দরোজা খুলতে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, ও মুচকি হাসছে। জানি না কি মায়া সে হাসিতে লেপটে আছে। ইচ্ছে করছিল ওকে জড়িয়ে ধরি। আমার তারুণ্যকে, আমার হারিয়ে যাওয়া অতীতকে আদর করি। অথচ সে আমার ঘাতক।
দরোজা খুলে বেরিয়ে এলাম। চিৎকার করে ডাকছি, মিজান মিয়া আমাকে বাঁচাও.....। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, মিজান মিয়া নেই, ওকে তো ছুটি দিয়েছি।
এখন কটা বাজে?
শেষ রাত হয়তো।
নিরুপায় দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই।
সোজা হয়ে বসতে চাইলাম, পারলাম না। পা অবশ লাগছে। হামাগুড়ি দিয়ে করিডোরের শেষ প্রান্তে এগিয়ে গেলাম। সুনসান নিরবতা! ঘাসের উপর মেঘে ঢাকা চাঁদের কিঞ্চিত আলো ছড়িয়ে পড়ছে। আবার নিভে যাচ্ছে। আমার ঘুম আসছে, দু’চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।
অনেকক্ষণ পর হাতে বরফের মতো ঠা-া কিছুর ছোঁয়া পেলাম। চোখ খুলে দেখি, একটি বাচ্চা সাপ আমার আঙুল প্যাঁচিয়ে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করছে। হালকা চাঁদের আলোয় ওর দেহের রেখা-বর্ণ দেখতে পাচ্ছি। রঙধনু রঙে ঝলমল করছে। এটা সেই শিশু সাপ, যাকে প্রথমদিন দেখেছিলাম। অচেনা আগুন্তুকের শব্দে পালিয়ে গিয়েছিল। আগেই বলেছি সর্পভীতি আমার মধ্যে নেই। তাই নির্বিঘেœ ওকে দেখতে লাগলাম। বাচ্চা সাপটি আমার ডান হাতের অর্ধমুঠোর ভেতর কু-লি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ আগে আমার মনে জন্ম নেওয়া মরণ ভীতি ভুলে গেলাম, মনে প্রচন্ড মায়ার উদ্রেক হলো। মনে হচ্ছে, এ শিশু সাপটি আমার শিশু সন্তান শশী। এই মুহূর্তে সে আমার বাহুডোরে ¯েœহের পরশে শুয়ে আছে। আমিও ঘুমাচ্ছি, শশীও ঘুমাচ্ছে, সজাগ কেবল চাঁদ।


সদর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। পুরো ত্রিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটালাম। আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ্যবোধ করছি। গতকাল সকালে মিজান মিয়া আমাকে নিচতলায় বারান্দার মেঝেতে ঘুমন্ত বা অজ্ঞান অবস্থায় পায়। তখনই সে ট্যাক্সি ডেকে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার জানিয়েছে, আমি সম্পূর্ণ আশঙ্কা মুক্ত। কেবল পায়ের গোড়ালীতে সামান্য চোট লেগেছে। ডাক্তার আমার ঘটনা শুনে বলল, পুরো ব্যাপারটা অনিদ্রা জনিত অসুখ। সুতরাং সুস্থ্য হবার জন্য প্রতিদিন আট ঘণ্টা ঘুমানো আবশ্যক।
মিজান মিয়াকে দেখে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম, জানাল ভাল আছে। কিছু সময় চুপ থেকে মিজান মিয়া বলল, স্যার আপনার হায়াত আছে বইলা, বাঁইচ্যা গেলেন।
এ কথা বলছ কেন?
সাপ, স্যার, বিষাক্ত সাপ! আপনার শরীরের উপর বইস্যা ছিল। কাছে যাইতেই আমার দিকে ফোঁস কইরা ফণা তুইল্যা আগায়া আইল। ধীরে ধীরে পিছনে গেলাম। রান্নাঘরে হাতের কাছে একটা বাঁশের লাঠি পাইলাম। এটা লইয়া দিলাম বারি, এক্কেবারে খতম।

সাপের বাচ্চাটা মিজান মিয়া মেরে ফেলেছে, শুনে খুব কষ্ট লাগল। আমি যেন আজ, আবার শশীকে হারালাম। নীলার কথা মনে পড়ল, ও হয়তো আমাকে খুঁজতে এসেছিল। না পেয়ে মন খারাপ করে নিশ্চয়ই ফিরে গিয়েছে।
এদিকে মিজান মিয়া একটানা বর্ণনা দিয়েই যাচ্ছে।
প্রথমে তো ভাবছিলাম স্যার, আপনারে সাপে কাটছে। হাতে-পায়ে কোত্থাও কোনো চিহ্ন নাই, পরে ভাবলাম আপনি সাপ দেইখ্যা অজ্ঞান হইছেন। তাই তাড়াহুড়া কইরা হাসপাতালে নিয়া আসছি।
মিজান মিয়াকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাল সকালে নীলা এসেছিল?
সেটা আবার কে স্যার?
প্রতিদিন যে মহিলাটা আমার সাথে দেখা করতে আসে, ভুলে গেলে?
স্যার প্রতিদিন কে আসে?
মিজান মিয়ার বেখেয়ালিপনা আমার মধ্যে রাগের উদ্রেক ঘটালো। রূঢ়ভাবে বললাম, প্রশ্ন রেখে বলো কেউ এসেছিল কিনা।
মিজান মিয়া ভয়ে চুপসে গেল। কাঁপতে কাঁপতে বলল, না, স্যার কেউ আসেনি।

মিজান মিয়া বিড়ি সিগারেট খায় বটে, আর কী ধরনের নেশা করে তা ঠিক জানি না। তার মাথায় যে কিছুটা গ-গোল আছে, তা বিগত দিনগুলোতে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। নীলা আমার সাথে দেখা করতে আসে, বিষয়টা মিজান মিয়া পছন্দ করে না। চা নাস্তা দিতে বললে দেরি করে, কখনো শুধু আমার জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে আসে, নীলাকে অগ্রাহ্য করে। তাই মিজান মিয়ার প্রতি আমার প্রায়ই কিছুটা রাগ হয়। বেশিরভাগ সময় পুনরায় ধমকে বলার পর আবার সে এক প্রকার বাধ্য হয়ে নীলার জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে আসে। নীলাকে দেখেও সে না দেখার ভান করে বা ওর দিকে তাকাতে চায় না। এটা নীলার প্রতি এক ধরনের অপমান। এর পেছনে আমি একটি কারণ ও যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। মিজান মিয়া চায় না, নীলা এই বাড়িতে আসুক। সে হয়তো ভাবছে আমাদের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এটা দেশের চোখে সমাজের চোখে যেমন অপরাধ, মিজান মিয়ার চোখেও তাই। মিজান মিয়া যদি আমার আর নীলার অতীতকে জানতে পারত, তাহলে হয়তো এমনটি করত না।
সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম। মিজান মিয়া আমাকে বাড়িতে নিয়ে এল। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে দোতলায় ওঠলাম। বারান্দায় সে চেয়ার এনে আমাকে বসার সুযোগ করে দিলো।

পূর্বাকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। পশ্চিমাকাশের লাল রঙের আবছা ঢেউ সেখানে আছড়ে পড়েছে। আবির রাঙা মেঘগুলো দাদাজানের সমীকরণের মতো, বামপাশে একদল রাশি, ডানপাশে আরেকদল। ওদের মধ্যে সমান চিহ্নের সম্পর্ক। কখনো কখনো অসমান সম্পর্কও তৈরি হয়।
বাসার কথা মনে হতেই আব্বুর সাথে ফোনে কথা বললাম। হঠাৎ আমার অসুস্থতার কথা শুনে আব্বু ভীষণ রাগ করল। বলল, দ্রুত শহরে ফিরে যেতে। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা। যেখানে নীলা আছে, সেখান থেকে আমি চলে যাই কি করে? তাই আব্বুকে সরাসরি না বলে দিলাম।
মিজান মিয়ার সাহায্যে ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় যেতেই হাতঘড়িটা চোখে পড়ল। ঘড়িটা ধুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। সে রাতে আমার সাথে কী ঘটেছিল? মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, মনে পড়ছে। একজন আমি তিনটি স্থানে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছিলাম। আমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলাম, কৌশলে আমাকে বাঁচিয়েছি আমি নিজেই। এটা কী করে সম্ভব? এমনটা ঘটার পেছনে একটাই কারণ ছিল, তা হলো দাদাজানের ডায়েরি। অদ্ভুত!
আচ্ছা, এমনটিও তো হতে পারে। সবকিছুই স্বপ্ন ছিল, স্বপ্নেই আমি নিজেকে তিনটি পৃথক চরিত্রে সাজিয়েছি। কিন্তু, অবাক করা বিষয় হলো ঘড়িটা। সেটা তো দৃশ্যমান।
না, আমিই ঘড়িটাকে ঘুমের মধ্যে প্রচ- জোরে চেপে ধরেছিলাম? যার ফলে এমনটা ঘটেছে। তারপর হয়তো ঘুমের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছি। তারপর যা হলো, সবই স্পষ্ট মনে আছে।
রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ গান শুনলাম। পত্রিকাতে পড়েছিলাম, দাদাজান তাঁর সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তিনি গাণিতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময় কখনো কখনো বিরতি দিয়ে গান শুনতেন। বেশিরভাগ ফোক গান হাসন-লালন ও রবীন্দ্রসংগীত তাঁর খুব পছন্দ। অঙ্ক কষার সময় শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতে তাঁর ভীষণ ভালোলাগত। দাদাজানের কথা ভাবতে গিয়ে ডায়েরির কথা মনে পড়ল। বিছানা ছেড়ে নিজেই আলমারির কাছে ওঠে গেলাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই ১৯৮৩ সালের ডায়েরিটা নেই। ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটি আগের অবস্থানে আছে। আমি সে ডায়েরিটি তুলে নিলাম।
প্রথমদিকের কতগুলো পৃষ্ঠা একেবারে ফাঁকা। কিছুই লেখা নেই। অন্য পৃষ্ঠাগুলো খুলে দেখলাম। থিওরিগুলো লেখা থাকলেও, লেখার পাশে গাণিতিক সমীকরণগুলো নেই। দেখে মনে হয়, চিত্রগুলোকে কেউ অস্পষ্ট করে রেখেছে। আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগল, সে রাতে যা ঘটেছিল, সবই সত্য। ডায়েরি চুরির ঘটনার প্রমাণ আমার কাছে পূর্ণাঙ্গ সত্য। আমার ছদ্মবেশী সে তরুণ ডায়েরিগুলো পড়ে যাচ্ছে আর গাণিতিক সমীকরণগুলো মুছে ফেলছে। সে রাতে তরুণটি বলেছিল সে চতুর্মাত্রিক জগত থেকে এসেছে। সেটা আবার কেমন জগত? আর এ ডায়েরিগুলোই বা তার কী এমন ক্ষতি করেছে? কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
মিজান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে বাড়িতে চলে যাবে কিনা? সে বাড়ি যেতে অস্বীকৃতি জানাল। নিচের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বললাম। সে বলল, স্যার, আমি এখানেই থাকি। আপনার কখন কী লাগবে কে জানে? মেঝেতে চাটাই বিছায়া থাকমু।
মিজান মিয়ার কথা শুনে সন্তুষ্ট হলাম। বললাম, ঠিক আছে। তোমার যেখানে খুশি থাকতে পারো।
মিজান মিয়া আমাকে ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলো। ডাক্তারের দেয়া ব্যথানাশক ও ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তখন হয়তো রাত ১০টা বাজে।

[চলবে...]