বাংলা সাহিত্যে
চর্যাপদ
তারেকুর রহমান
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। চর্যাপদের মূল নাম ছিল ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। চর্যা শব্দের অর্থ হলো ‘আচরণ’। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত চর্যাপদ মূলত গানের সংকলন। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধধর্মের তত্বকথা। চর্যাপদ রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মচর্চা। চর্যার প্রধান তত্ব মহাসুখরূপ নির্বান লাভ। এটি রচনা করেন বৌদ্ধসহজিয়াগণ। সহজিয়া সম্প্রদায় ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় সহজান পন্থী। সাধন পদ্ধতির ভিন্নতার কারনে সহজিয়া সম্প্রদায় পৃথক ছিল। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাথে বাউলদেরও ঘনিষ্ঠতার কথা ছিল বলে জানা যায়।
চর্যাপদেদে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীন বাংলা ভাষা। এতে হিন্দি, অপভ্রংশ (মৈথিলী), অসমিয়া ও উড়িয়া ভাষার প্রভাব রয়েছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের ভাষা বঙকামরূপী। দ্ব্যর্থক ও রূপকাতুর ও অস্পষ্টতার জন্য চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষা বা সান্ধ্য ভাষা বলে। সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা হলো, যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি। যে ভাষার অর্থ ও একাধিক। এ ভাষাকে আলো আঁধারির ভাষাও বলা হয়। এর ভাষা দুর্বোধ্য হওয়ার কারন এতে তন্ত্র ও যোগের প্রতাপের জন্য।
১৯০৭ সালে নেপালের রাজগ্রন্থাগার থেকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। নৈহাটি, পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেয়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিনবারের প্রচেষ্টায় চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। চর্যাপদের সাথে তিনি ডাকার্ণব ও দোহাকোষ নামে আর দুটি গ্রন্থ উদ্ধার করেন। তিনি এই সবগুলো বইকে নিয়ে ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
চর্যাপদ নেপালে কেন পাওয়া গেছে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। সত্যজিৎ চৌধুরীর মতে, তুর্কি আক্রমণের সময় পুঁথিপত্র নিয়ে বাংলার প-িত মানুষেরা নেপালে, তিব্বতে চলে গিয়েছিল। আবার তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এক সময় নেপালে বসবাসরত বাঙ্গালীরা বাংলা লিপিতে পুঁথি লিখতেন। তাই নেপালে বাংলা অক্ষরে বাঙ্গালি লিপিকারের লেখা পুঁথির অস্তিত্ব পাওয়া অভাবিত ব্যাপার না। এ দুটি মতের মধ্যে প্রথম মতটাই অধিক গ্রহণযোগ্য।
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ভাষাও অপরাপর লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মত দিয়েছেন। তার মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। অপরদিকে ভাষা বৈশিষ্ট্যের আলোকে ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মত দিয়েছেন। তার মতে, চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। চর্যাপদে কতজন পদকর্তা রয়েছে তা নিয়েও মতভেদ আছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘ইঁফফযরংঃ গুংঃরপ ঝড়হমং’ গ্রন্থে ২৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। অপরদিকে সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে ২৪ জন পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন। সে হিসেবে চর্যাপদের মোট পদকর্তা ২৩ জন মতান্তরে ২৪ জন। চর্যাপদের পদ সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে পদ সংখ্যা ৫০, অপরদিকে ড.সুকুমার সেনের মতে পদসংখ্যা ৫১ টি। তবে সর্বমোট সাড়ে ছেচল্লিশটি উদ্ধার করা গেছে। চর্যাপদের ২৪ নং, ২৫ নং ও ৪৮ নং পদ পাওয়া যায়নি। এবং ২৩ নং পদ খ-িত আকারে পাওয়া গেছে।
ড.মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে প্রথম পদটি রচনা করেন লুইপা। প্রথম পদটি হলো-
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল।।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ
লূই ভণই গুরু পূচিঅ জাণ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই
সুখ দূখেতেঁ নিচিত মরিঅই।।
এড়িঅই ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস
সূনু পাখ ভিড়ি লাহু রে পাস।।
ভণই লূই আম্ হে ঝাণে দীঠা
ধমণ চবণ বেণি পি-ী বইঠা।।
আধুনিক বাংলায় রূপান্তর :
কায়া তরুর মত, পাঁচটি তার ডাল,
চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করেছে।।
দৃঢ় করে নাও, মহাসুখ পরিণাম
কবি লুই বলছে, গুরুকে জিজ্ঞেস করে জান।।
সমস্ত সমাধিতে(সমর্পিত) কি করে,
সুখ দুঃখে নিশ্চিত মরা (অবস্থান) ।।
এড়িয়ে যাওয়া যায় ছন্দ ও করণের পারিপাট্য,
শূন্য পাখা পাশে চেপে ধর।।
লুই বলছে, আমি স্বপনে দেখেছি,
ধমণ, চমণ দুই পিঁড়িতে আমি বসে।।
চর্যাপদের কোন পদ কোন পদকর্তা লিখেছেন তা নিচে দেওয়া হলো ।
আর্যদেব পা > পদ নং ৩১
ভাদেপা> পদ নং ৩৫
ভুসুখুপা>পদ নং ৬/২১/২৩/২৭/৩০/৪১/৪৩/৪৯
চাটিল্লাপা>পদ নং ৫
দারিকপা>পদ নং ৩৪
ধর্মপা>পদ নং ৪৭
ঢে-ণপা>পদ নং ৩৩
ডোম্বীপা>পদ নং ১৪
গু-ুরীপা>পদ নং ৪
জয়নন্দীপা>পদ নং ৪৬
কাহ্নপা>পদ নং ৭/৯/১০/১১/১২/১৩/১৮/১৯/২৪(পাওয়া যায়নি)/৩৬/৪০/৪২/৪৫
কম্বলাম্বরপা>পদ নং ৮
কঙ্কণপা>পদ নং৪৪
কুক্কুরিপা>পদ নং ২/২০/৪৮(পাওয়া যায়নি)
লুইপা>১/২৯
মহীধরপা>পদ নং ১৬
শবরপা>পদ নং ২৮/৫০
শান্তিপা>পদ নং ১৫/২৬
সরহপা>পদ নং ২২/৩২/৩৮/৩৯
তাড়কপা>পদ নং ৩৭
তন্ত্রীপা>পদ নং ২৫(পাওয়া যায়নি)
বীণাপা>পদ নং ১৭
বিরুপা>পদ নং ৩
(সূত্র : ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘ ইঁফফযরংঃ গুংঃরপ ঝড়হমং’ ১৯৬৬:পৃ.১৪৩)