ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৯
(গত সংখ্যার পর)
১০.
বেবী আপার বইয়ের প্যাকেট খুলে ভয়ানক আশ্চর্য হয় উর্মিলা। এই বইগুলো পড়তে হবে এবং ভালো করে পড়তে হবে। ছোটদের রাজনীতি থেকে চে গুয়েভারা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, নাজিম হিকমতের কবিতা। আনা ফাঙ্কোর ডায়েরি। হো চি মিনের-এর জীবনী ইত্যাকার গ্রন্থসহ জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। ইতোপূর্বে এ বইগুলোর নামও জানত না। মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলে। শুধু জলের সন্তরণ টের পায়। যেন অবিরল বৃষ্টির মগ্ন সঙ্গীত। দীপু ভাই থাকলে ভালো হতো। আকস্মিক দীপু ভাইয়ের শূন্যতা অনুভব করে। না। এতদিন দীপু ভাইয়ের কথা মনে হয়নি।
জিজ্ঞেস করলেই বলত, ‘দেবী, বই সামনে নিয়ে সরস্বতীকে ডাকুন। তিনি ভর করলে তো চিন্তামণি আপনাকে আমু-ু গিলে খাবে।’
দীপু ভাইয়ের সব কিছুতেই হেয়ালি। কী সরল দুঃখী মুখ!
অনেকক্ষণ বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। কোন বই দিয়ে বেবী আপার পাঠ আরম্ভ করবে বোঝে ওঠার আগেই ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ফ্ল্যাপে উর্মিলার চোখ আটকে যায়, ‘তবে তাই হোক হৃদয়কে পাথর করে বুকের গহিনে বহন করা বেদনাকে সংহত করে দুঃখের নিবিড় অতলে ডুব দিয়ে তুলে আনি বিন্দু বিন্দু মুক্তো দানার মতো অভিজ্ঞতার সকল নির্যাস। আবার আমরা ফিরে তাকাই আমাদের চরম শোক ও পরম গৌরবম-িত মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর দিকে। এক মুক্তিযোদ্ধার মাতা, এক সংগ্রামী দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, এর দৃঢ়চেতা বাঙালি নারী আমাদের সবার হয়ে সম্পাদন করেছেন এই কাজ। বুকচেরা আর্তনাদ নয়, শোকবিহ্বল ফরিয়াদ নয়, তিনি গোলাপকুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপনকার নিভৃততম দুঃখ অনুভূতি তাঁর ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি। তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর আপনজনের গৌরবগাথা। যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো ধারণার সঙ্গে। রুমী বুঝি কোন অলক্ষ্যে হয়ে যায় আমাদের সকলের আদরের ভাইটি, সজ্জন ব্যক্তিত্ব শরীফ প্রতীক হয়ে পড়েন রাশভারি স্নেহপ্রবণ পিতা। কিছুই আমরা ভুলব না, কাউকে ভুলব না।’
এভাবে এক স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোরের মধ্য দিয়ে রুমীকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে ঘুমুতে যায় উর্মিলা।
ওর মাথার ভেতরে অনেক শব্দের মানে না জানা থাকলেও জাহানারা ইমামের ইস্পাতদৃঢ় দেশপ্রেম মাতৃত্বের প্রতীক হয়ে জেগে থাকে। মনে মনে বেবী আপাকে ধন্যবাদ জানায়। দীপু ভাইকেও। ভাবে, তাইতো। যুগে যুগেই সহিষ্ণু মাতারা জন্ম নেবে। জাহানারা ইমাম থেকে বেবী আপা পর্যন্ত। দেবী দুর্গার দশম হস্তের দরকার নেই। মানবিক একটি চাদর দিগন্তের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে বিছিয়ে দিতে হবে। ঘন বর্ষণে ধুয়ে যাবে সব পঙ্কিলতা। সবুজ বৃক্ষলতায় পূর্ণ ক্লোরোফিল গ্রহণ করে নিঃশ্বাস নেবে তার নাম স্বাধীনতা।
রাত এখন এগারোটার কাছাকাছি। রুবী আলোর বিপরীতে মুখ রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কী নিষ্পাপ ওর মুখ। জগতের কোনও কুটিলতা ওকে স্পর্শ করে না। কৃষককন্যার সহস্র চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিযান, আশাভঙ্গের গ্লানি মিশে গেছে দরিদ্রতার মধ্যে। রুবীকে জাগাতে ইচ্ছে করল না। রুবী ঘুমাক। বেবী আপা বলে, ‘এ ঘুমন্ত নারীকুল জেগে উঠলে, সংসারে-রাষ্ট্রে-সমাজের অনেক কুলাঙ্গার পালিয়ে যাবে।’
বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে টাওয়ালে মুখ মুছে দরজা খুলে বাইরে বের হয়। ঢাকার শহরের কেউ ঘুমায়নি। আলোর ঝলকানি গাছ-গাছালি-দালান-কোঠার ফাঁক গলে উপচে পড়তে চায়। আকাশে স্বাতি-র মুখ দেখা যায় না।
নাখালপাড়া নারী মুক্তিকেন্দ্র এ বাড়িটা বেবী আপার স্বামীর। পাঁচ বছর আগে আকস্মিক তার মৃত্যু হয়। এক ছেলে নিয়ে এত বড় বাড়িতে তিনি আর থাকতে চায়নি। কী দরকার! তৌফিক ইকবাল এখন এডিলেডে থাকে। পিএইচডি করছে জীবকোষ নিয়ে। বেবী আপা দু’রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে ফার্মগেট ইন্দিরা রোড থাকেন। ছেলে ফিরবেন কি না তাও জানেন না। আর বাড়িটি হয়ে উঠেছে দুস্থ মানবতার প্রতীক। সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানো বেবী আপার স্বপ্নের নারীকুলের নিরাপদ আশ্রয়। এ বাড়ি থেকেই শুরু করেছিলেন বেবী আপা। এত বছর পর বেবী আপা দেশ-বিদেশে সম্মানিত নারীনেত্রীর নাম। নিচতলার প্রতিটি দেয়ালজুড়ে বেবী আপার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ছবি। দেশে দেশে কীর্তিমান মানুষদের সঙ্গে বেবী আপার সখ্য আছে। তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি মানবিক রাষ্ট্রের।
গ্যারেজ, ড্রাইভারদের থাকার ঘর আলাদা। দু’জন পাহারাদার একজন বুয়া এ বাড়ির বর্তমানে মূল কর্মকর্তা। বাজার-ঘাট দারোয়ান মকীম চাচা করে। বেবী আপার অনেক দিনের দেখভাল কর্মকর্তা। এ সংসারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রুবী-উর্মিলাকে মা জননী বলে ডাকে। দোতলা এ রুমটা বেবী আপা তার অনাথদের জন্য বানিয়েছে। যাতে ওরা দু’জন দখল নিয়েছে। নগরে এমন নিরাপদ আশ্রয় কোথায়?
ভাবতে ভাবতে দরজা আটকে বিছানায় যায় উর্মিলা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ঘুমের আড়ালে হারিয়ে যায়।
সাতদিন পর বেবী আপা ফিরে আসবে। তারও দু’দিন পর উর্মিলার ক্লাস শুরু। বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। শুভপুরের কথা মনে হয়। ইত্যাকার ভাবনার ধোঁয়াশার মধ্যে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’ বুকের ভিতর আমূল প্রোথিত শিকড় বিস্তার করতে থাকে। বইটি পড়া শেষ করে আর কোনও বই হাতে নিতে ইচ্ছে করেনি। রুমী স্কোয়াডের সব সদস্যই যে উর্মিলার একান্ত আপনজন। আর জননী! বঙ্গমাতার এত সন্তান এক রুমী হারিয়ে গেলে ক্ষতি কী? পাষাণ প্রতিমার মৌনতায় ডুবে থেকে ঔরসজাত সন্তান যুদ্ধের ময়দানের পাঠানোর মতো শক্তি দেশপ্রেমের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে।
দীপু ভাই এলে জিজ্ঞেস করতে হবে! শহীদ জননীর সঙ্গে মুখোমুখি হবার অদম্য ইচ্ছে উর্মিলাকে নীলাক্ত বিষে ব্যথিত করতে থাকে।
‘উর্মিলা দুপুরে তুমি রুবী আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে।’ মিতালী দিদি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল।
‘কেন?’
‘এমনি।’
একটু পর নাজনীন আপা হন্তদন্ত হয়ে উর্মিলার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমি কি আজ দুপুরের খাবার আমার সঙ্গে খাবে?’
‘মিতালী দিদি একটু আগে তার সঙ্গে লাঞ্চ করার কথা বলেছেন।’
‘তাহলে তো আরও ভালো। মিতালীর সঙ্গে টেবিলে আমরা একত্রিত হব।’
‘কী ব্যাপার নাজনীন আপা?’
‘এমনি। তুমি হলে গিয়ে রাবণকুল শিরোমণি। তোমাকে ভোগ তো দিতেই হবে।’
‘আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’ উর্মিলা বেশ হতাশ কণ্ঠে বলে।
‘তোমার বোঝার দরকার নেই।’
নাজনীন আপা দরজার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
উর্মিলার বুক দুরুদুরু করতে থাকে। পূর্বাপর প্রত্যেক ঘটে যাওয়া ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে। না এমন কোনো ব্যাপার নেই যা ওকে অপ্রস্তুত করবে।
মিতালী দিদির টেবিলে পাঁচ প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানি। ওরা চারজন সঙ্গে মঞ্জু রহমান এসে জুটেছেন। মিতালী দিদি কলকল করে কথা বলছে। কথার নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই। অফিস থেকে রাজপথ। স্বৈরাচার না তাড়ালে স্বাধীনতা অর্জন ব্যর্থ হবে। ফুঁ দিয়ে তো আর এ দেশটার জন্ম হয়নি। আমরা যারা স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায়। উর্মিলার মিতালী দিদির কোনো কথা বোধগম্য হলো না। ক্ষুধার্ত পেট চো চো করছে। তার মধ্যে কাচ্চির ঘ্রাণ উদরের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘মিতু, তুই কি কথা বলবি! না মেহমানদের খেতে বলবি?’ নাজনীন আপা বলে।
‘আরে তাইতো।’
ওর পাঁচজন মিলে গোগ্রাসে খেয়ে নেয়। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে মুখোমুখি বসে। মঞ্জু রহমান নিজ টেবিলে চলে গেছে। দু’দিন পর বেবী আপা আসবে। অফিসিয়াল পেপারগুলো এগিয়ে রাখতে হবে।
পিয়নকে চার কথা বলে রুমের দরজা চাপিয়ে দেয় মিতালী দিদি। চেয়ারে হেলান দিয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি জাদুকর নাকি?’
‘কেন দিদি! জাদুকর হতে যাব কেন?’
‘তুমি নিশ্চয় জাদুকর। নইলে আমরা বিগত কয়েক বছরে যা পারিনি তা তুমি অল্প ক’দিনই একেবারে নিপাট করে দিয়েছ।’
উর্মিলা অসহায়ের মতো মিতালীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জি। আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?’
‘এখানে ন্যায়-অন্যায়ের কথা নয়। মিরাকল। নারীমুক্তি কেন্দ্রের ভাষা হাব-ভাব চলন তুমি পাল্টে দিয়েছ।’
‘আমি তো কিছু করিনি।’
‘নিশ্চয়ই করেছো নইলে জাকির সাহেবের মতো বদ লোক এমন হতে পারে না।’ মিতালী দিদি হাসতে থাকে।
‘তাই তো! আমাকে দু’দিন যাবত এমনভাবে কথা বলছে যেন এই মাত্র মসজিদ থেকে বেরিয়েছে। পৃথিবীর কোনো পাপ তাকে স্পর্শ করেনি। তা কী করে সম্ভব?’ নাজনীন আপা উৎসাহ নিয়ে বলে।
‘তোমাকে তো গুরু মানতে শুরু করেছি। বেবী আপা আসলে বলব উর্মিলাকে আমার প্রয়োজন। ওকে আমার ডেক্সে দিয়ে দেন।’
উর্মিলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি সত্যিকারে বলো তো কী ঘটেছিল?’ মিতালী দিদি বলে।
[চলবে...]
পদাবলি
মাটি হয়ে গেলি
আহেদুল ইসলাম আদেল
[ স্নেহপ্রিয় ভাই আলিফ আল ইমরানের স্বরণে]
মানুষের দৌড় মৃত্যু অবধি শোকার্ত ভ্রাতার বাণী
অপ্রত্যাশীত ছুটির পত্র লেখালে ভাই তুমি
কৈশোর পদার্পণেই মাটি হয়ে গেলি
চোখ বুঝলেই ইমরানের প্রতিচ্ছবি।
স্মৃতির সাগরে ভাসছি বন্ধু স্বজন ভ্রাতা
মায়া বন্দী ফ্রেন্ডলিস্টের টাইম লাইনে তোর শোকার্ত বার্তা!
আজ চব্বিশে ডিসেম্বর
তোর জেএসসির রেজাল্ট প্রকাশিত হইল সবেমাত্র
চারিদিক হইচই আনন্দিত পাড়া মহল!
কেউ রসগোল্লা কিনছে মন মন
কেউবা আবার দিচ্ছে ডিনার নেমত্রন্ন
তোর মা’ই কেবল তোর বেডরুমের মেজেতে কাঁদছে গড়িয়ে গড়িয়ে
তোর পরনের পোশাক, বইপত্র বুকে জড়িয়ে
এমন একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিল তোর মা
যেন প্রাণ পাখি তার গেল উইড়া।
হায় রে নিয়তি, মুকুলেই ঝরে গেলি
পাশের বাড়ির ভাবি বলল তুই জিপিএ ফোর পেয়েছিস,
শুনে নির্বাক হয়ে গেল মা যেন রু সাহারা
এদিকে বাদশাহ ভাইয়ের হৃদয় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।
তোর স্বরণেই লিখেছে তিনি সূর্যবন্দনা
আহা আর সইতে পারছি না, যেন প্রভাতেই সূর্যগ্রহন
রোজ ফজরের নামাজের পর দেখি
তোর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা করে মোনাজাত
সরাসরি কবুল কর আল্লাহ্ পিতার মাগফিরাত
রোজ হাশর করিও পার মাবুদ সেই অছিলায়
সকল পাপ মার্জন করে আলিফকে নসিব কর জান্নাত।
ইচ্ছেডানা
আদ্যনাথ ঘোষ
বৈশাখের রোদ্রের দহন পুড়িয়ে করেছিল খাক।
শুকিয়ে গিয়েছিল যৌবনাবতী ধান, তৃষ্ণার পরিশ্রুত জল
সব নদী কুলকুল ভেসে গেলে
সব পাখি গগনবিহারী হয়েছিল
সব তারা খসে পড়েছিল পৃথিবীর দিগন্তে
পঞ্চমীর চাঁদ লাল গালিচার নগ্নতায় ডুবেছিল দাহে
রক্তের প্রণয়লীলা অবিরত খেলে যায় বানে ভাসা নদীর মতো
প্রজাপতিগুলো দুপুরের আলোর জোয়ারে নাচে
আমোদিত সম্মোহনী শীৎকারে
ঈর্ষার বিহ্বলে পরানের উড়াল ডানা তার পড়েছিল খসে
গায়ে মেখে রোদ্রের প্রণয় ফেনা।
হকার
আসিফ আলমগীর
বিলবোর্ডটা আজো দাঁড়িয়ে
পাশেই পড়ে আছে, যুবকের লাশ।
দু’ধারে হকারের মাইকে দৃঢ় স্লোগান-
‘ভাইসব...
এ মলম লাগালেই ফিরে যাবে প্রাণ।’
নষ্ট
খায়রুল আলম রাজু
‘নষ্ট বলো’ এই আমাকে!
‘নষ্ট’ আমার অঙ্গ না;
নষ্ট মাটির নষ্ট গাছের
সঙ্গে আমার সঙ্গ না!
‘নদী কি আর নষ্ট হয়?’
নষ্ট নদীর জল;
মাটিও নয়, গাছটিও নয়,
নষ্ট হয় গাছের ফল...
ফুল কি কভু সন্ধি করে?
সন্ধি ঘটায় মনে;
ঘাসের যেমন সন্ধি ঘটে
মিষ্টি রোদের সনে!
নষ্ট শরীর, নষ্ট মগজ,
নষ্ট দেহের ছায়া,
নষ্ট আমি, নষ্ট দেহ
স্বচ্ছ মনের কায়)...
তুমি ডাকছো
মারুফ আহম্মেদ নয়ন
তুমি আমাকে ডাকছো, পাশের বাড়ির সদ্য মাধ্যমিক পেরুনো মেয়েটি সুরেলা কন্ঠে গাইছে রবীন্দ্র সংগীত, আমি যাবো, আকাশে কালো মেঘ, ঝুম ঝুম বৃষ্টি টাপুর টুপুর শব্দে, মনে হয়- তুমি ডাকছো, খুব করে ডাকছো, একটি কালো পর্দার আড়ালে তুমি গাইছো, তুমি পড়ছো, তুমি আয়নার সামনে বার বার দাড়াচ্ছ, চুল ঠিক করছো, কপালে লাল টিপ পড়ছো, বহুকাল ধরে যেনো এইরকম প্রতীক্ষা, তুমি ডাকছো আমি যাবো, আমার ভ্রান্তিতে, আমার ঘোরের ভেতর !
শব্দমিছিল : নাহিদ ধ্রুব
শব্দমিছিল
নাহিদ ধ্রুব
কবিতাকে একটা আশ্রয় বলা যায়
কবিতা আমার কাছে একটা এস্কেপ রুট। জগতে যখন সবকিছু পলকা মনে হয় তখন আমি কবিতা পড়ি, লেখার চেষ্টা করি। এই অর্থে কবিতাকে একটা আশ্রয় বলা যায়। তবে, এই এস্কেপ রুট মানে জগত থেকে পালিয়ে আসা না বরং মাথার মধ্যে আরও অনেকগুলো জগত নিয়ে ঘোরা। এই ঘুরতে ঘুরতে অনেকগুলো পরিত্যক্ত স্টেশনে যাওয়া হয়, পাথর কুড়ানো হয়, কখনও ঘুমিয়ে থাকা হয় রেলের পাতে, তবু ক্লান্তি শেষ হয় না, যাত্রা শেষ হয় না। বারবার মনে হয়, কে হায় মানুষ, কার দিকে গেলে, কতোটুকু জগতেরে ছেড়ে ছুঁড়ে দিলে মনে হবে আমি আরও একটু যাই!
লস্ট
আমার হয়তো হারায়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মনে হয় বাবা হয়তো এখনও দূরবর্তী কোনপুকুরে ফেলতেছে মমতার জাল। আমারে খুঁজতে বের হইছে পাড়াপড়শি- বাইজীপাড়ায় গেছে মসজিদেও ইমাম। মনে আছে এইসব, শুধু মনে নাই কোথায় হারায়ে গেছিলাম; খুব শৈশবে- মা কপালে চুমুদিয়া বলছিল, আর কখনও হারাইস না বাপধন। অথচ, আজ মা বহুদূরে- বাবা মায়ের পাশে শুয়ে বাড়াইতেছে পৃথিবীর ওজন! পাড়াপড়শি নাই এমন কি নাই তেমন প্রিয়জন- হয়তো সকলেই একদিন হারায়ে যায়, হারাতে হয় যখন..
ভুবন মোহনে
সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর,
মনে হয় জগতে দ্বিতীয় কিছু নাই
যতোই লুকাতে চাই অন্ধকারে-
রাত্তিরে ততো প্রকাশিত হয়ে যাই
আমারে কে দেখিলো এই রাতে-
ভুবন মোহনে মিশিয়াছে এক বাড়ি
স্বর্গোদ্যানে ফুটে থাকা কোনো ফুল
কল্পলোকের সব মায়া গেলো ছাড়ি
তবু মনে হয় চাঁদ দেখে চিনবো পথ,
এইখানে খাঁ খাঁ করে ধূসর বালু চর-
সকলের কাছে শুনি অবজ্ঞার ভাষা
আমি আর চাঁদ, দুজনে, পরস্পর;
জল ফুরাইলে- পাই নদীর ছোঁয়া
ঢেউহীন মনে উত্তাল হাওয়া লাগে
নতুনের কাছে যতো সঁপি প্রাণ-
মনে শুধু পুরাতন ব্যর্থতা জাগে!
ফরিয়াদ
কী করে মৃত্যুর পর খুলে যায় চোখ
মানুষ কাঁদতেছে, কাঁদতেছে শ্লোক
একটা মানুষ মরে, কেবলই মরে-
ফানা ফানা হয় দিল কিসের ছলে?
কোনদিন দেখি নাই কী তার ব্যথা
সর্বনাশে ঝরে যায় ফের ঝরাপাতা
নিশুতিতে চৌচির মহামারি ফাঁদ-
আঙ্গুলের ফাঁকে লেখা এই ফরিয়াদ
লুকোচুরি খেলা তবু প্রকৃতির সাথে
মানুষ উঠিতেছে মানুষের কাঁধে
শৈশব পেরিয়ে বৃদ্ধ হইলো রব-
বুকের মধ্যে পোঁতা বিষাদের শব
তারে এড়াতে মুছি চোখের পাতা-
মৃত্যু মানে জীবন চোখে চোখে রাখা
ভ্রমণ
বিকালের কাছে তুলে রাখো তুমি
পাততাড়ি গোটানো একটা ভ্রমণ
পথের ভেতর ঢুকতেছে ঘর-
টানিবে পিছু- কে আছে এমন!
পাহাড়ে লুকানো পান্থশালায়-
মেঘের পেয়ালা দু’হাতে ভরো,
শুকনো ডাঙায় জলের ফোয়ারা
ভুলে গিয়ে সব উৎসব করো;
চিতার পাশে দাঁড়ায়ে থেকে-
আগুনরে বলো আড়াল নিতে
পুড়ছে সব তবু ফুটিতেছে ফুল
তারে নিয়া যাও সুন্দরের দিকে
যদিও দেখবা নিন্দার টিছে
কেহ বলে নাই গোপন কথা
বিকালের কাছে সূর্য যেমন
রেখে গেছে সব অন্ধ বার্তা।
আগুন
যতটুকু দেহ নিয়া করি হাহাকার-
তার অধিক আমার অঙ্গে অঙ্গে ছাই
কে যে পোড়াইলো, চিতা বুকে কার
আগুন জ্বালাই- আগুন জ্বালাই!
শব্দমিছিল : নাঈম হোসেন লেনিল
শব্দমিছিল
নাঈম হোসেন লেনিল
কবিতা হলো স্মরণীয় স্পীচ
আসলে কবিতা কি? ইংরেজ কবি অডেন বলেছেন, ‘মেমোরাবল স্পীচ’ হল কবিতা। আমাদের রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ যা মেনে নেননি। তিনি বলেছেন ‘স্মরণীয় স্পীচ’ মাত্রই কবিতা নয়। তার মতে ‘স্মরণীয় স্পীচ’ শুধু কবিতা হতে পারে না কেননা তখন যেকোন ‘স্মরণীয় স্পীচ’ কবিতা হবে যা হাস্যকর হবে। আর অন্যদিকে ‘অস্মরণীয় স্পীচ’ কোথায় যাবে? জীবনানন্দ দাশের মতে, কবি হবে সমাজবাদী কাব্যচেতনাময়ী। কবিতা হবে ইতিহাসচেতনা, স্বপ্ন ও কল্পনার মহাসাগর। আমার মতে কবিতা হল, লুকায়িত এক আলোকিত জ্ঞান। ছন্দ সম্পন্ন, অথবা ছন্দহীন কিন্তু অলংকার ও উপমা অত্যাবশ্যক এবং স্বপ্ন নিমজ্জিত কল্পনাবদ্ধ অথবা বাস্তববাদী সুললিত পঙ্ক্তিমালার একগুচ্ছ দল বা চরণ যখন কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে স্পষ্ট অস্পষ্ট ধারণা ব্যক্ত করে যেকোন আঙ্গিকে তখন তাকে কবিতা বলে। কবিতার পাঠক ক্রমে ক্রমে কমে যাচ্ছে এটা ঠিক নয়, জীবনানন্দ দাশ যখন কবিতা লিখেছিলেন তখন তিনিও কবিতা পাঠক শূন্যতায় ভুগেছেন তারপরও তিনি কবিতা রচনা করে গেছেন, বলাই বাহুল্য- তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এত পাঠক হয় যা জীবিত অবস্থায় ছিল না।তাই পাঠক না থাকলেও কবিতা লিখতে হবে। কবিতা ছাপানোর বিষয়ে অনেকেই মনে করেন যে, সম্পাদকরা পরিচিতজনদের লেখা ছাপেন। আমিও এ বিষয়ে একমত আবার দ্বিমতও কেননা অনেক সম্পাদক আছেন যারা কবিতার মানের উপর কবিতা ছাপেন তবে এরকম সম্পাদকের সংখ্যা খুবই কম। মানসম্মত কবিতা পত্রিকায় পাঠানোর পর কবিতা ছাপা না হলে একটু বেশী খারাপ লাগে, কেননা এক একটা কবিতা লেখার পিছনে এক একটা কষ্ট থাকে। কবিতা ছাপা হোক আর না হোক তাতেও কবিতা লেখা বাদ দেওয়া যাবে না। কবিতার বিষয় নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করেন তবে আমার মতে, বিষয় যাই হোক তাতে রস থাকতে হবে। আবার অনেকেই মনে করেন সমকালীন কবিতাই কবিতা যা একদমই ভুল। কবিতার বিষয় সমকালীন হলো আর না হলো সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা কবিতার রস কতটুকু।
কবি ও অকবিঃ
আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘যার কল্পনা শক্তি যতই বেশী সে তত শক্তিশালী, ধী শক্তি কল্পনা শক্তির কাছে কিছুই না’। সবাই যে কবিতা লিখতে পারলেও কবি হবে তা না। একজন ব্যক্তিকে যদি বলেন, তুমি কেন কবিতা লিখতে চাও? সে যদি উত্তরে বলে, আমি কবিতা লিখতে চাই কেননা আমার কিছু বলার আছে তাহলে সেই ব্যক্তি আর যাইহোক, অডেনের মতে, কবি হওয়ার আশা করতেই পারেন না। আবার সে যদি বলে, আমি কবিতা লিখি কেননা আমি শব্দের চারধারে থাকতে চাই, শুনতে চাই পরস্পর তারা কি বলে। এক্ষেত্রে অডেন বলেন, অন্তত এটুকু বলা যাবে যে, কাব্যকলা ও মৌলিক বিষয়ে তার আগ্রহ আছে এবং কবি হওয়ার আশা সে করতে পারে। আবার, কবি রবার্ট ফ্রস্টের মতে একজন কবিকে অবশ্যই কাব্যকলা ও কবিতার আঙ্গিকতার চিত্রে অবশ্যই কাব্যপ্রক্রিয়া সুযতেœ সন্তানের মত মমতা আদর দিয়ে লালন পালন করতে হবে। বীরেন মুখার্জীর মতে, কবি সর্বপ্রথম একজন সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ সমাজেই তার বসবাস চিন্তার গভীরতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে কবি হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক। ভাষায় প্রকরণে প্রকাশশৈলীতে কবিমাত্রই স্বতন্ত্রস্বরের অধিকারী কণ্ঠস্বান্ত্রই কবি থেকে কবিকে স্বতন্ত্র কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। হেলাল হাফিজের মতে, একজন স্বতন্ত্র কণ্ঠের কবি হলো সবার থেকে আলাদা কন্ঠস্বরের স্রষ্ঠা। আমার মতে, কবি তো তারাই যারা গভীরতম কল্পনায় মগ্ন হয়ে এবং শব্দ চয়নে দিকটা ঠিক রেখে কাব্যের সকল নিয়ম মেনে কবিতা রচনা করেন, আর যারা একক আঙ্গিকে শক্তিশালী অলংকার ও উপমার সমন্বয়ে কবিতা রচনা কেন তারা হলেন স্বতন্ত্র এবং শ্রেষ্ঠ কবি। আর অকবি এর উল্টা দিকটা। এখন এই অকবির জন্যই আজকাল পাঠকরা কবিতা এরিয়ে যেতে শুরু করেছে এবং এই অকবির কারণে পাঠকরা প্রকৃত কবিকে চিনতে পারছেন না। এখন কবিতা কারা লিখবে? জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, শুধুমাত্র কবিতা তারাই লিখবে যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও ভিতরের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবক্তা রয়েছে। কবির চেয়ে কাকের সংখ্যা বেশী, অনেকেই এই কথা বলে কবিতা উড়ে দেন যা মোটেই ঠিক নয়, যারা কবিতা লিখতে চায় লিখুক তবে এই লেখার ক্ষেত্র অনুযায়ী বেশীরভাগই অকবি। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘মার্জিনে মন্তব্য’ প্রবন্ধে বলেছেন, কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশী এই কথা তারাই বলে যারা কবিতা ভালবাসে না, কবিতা যারা লিখে লিখুক কিন্তু পাঠককে মনে রাখতে হবে যে, কবির থেকে অকবি বেশী প্রকৃত কবির কবিতা পড়তে হবে। আর যারা অকবি তাদের ক্ষেত্রে আমার কথা, অকবি থেকে কবি হতে চাইলে কাব্যের সকল নিয়মকানুন মেনে কবিতা লিখুন কবি হতে পারবেন। আর বড় কথা হচ্ছে, অকবি থেকেই কবি জন্ম নিবে যদি সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন হন। পৃথিবীর প্রথম কবি যার নাম ‘এনহেদুয়ান্না’। তিনি ছিলেন একজন নারী, তিনি আক্কাদের সম্রাট সারগন ও তাঁর স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। তিনি অসম্ভব মেধাবী ছিলেন, তিনি কবিতা ও প্রার্থনাসংগীত লিখতে পারতেন। ২২৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৪২ টি স্তবগান রচনা করেন যা পরবর্তীতে ৩৭টি প্রস্তরখ- থেকে উদ্ধার করা হয়। তিনি ২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পৃথিবী থেকে চলে যান।
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি যে কবিতা লেখ তোমার কবিতায় কি কাব্যপ্রক্রিয়া বিদ্যমান’ । আমি বলব, ‘আমি আমার লেখাগুলোতে কাব্যপ্রক্রিয়ার অন্তরায় বাঁধার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি, প্রথমে উপমা, দ্বিতীয় অলংকার এবং তৃতীয় কবিতার শরীর গঠনের জন্য ছন্দময় করে তুলি, এবং আমি কবিতা এমনভাবে লেখার চেষ্টা করি যেন কবিতার পঙ্ক্তিগুলো একটা একটা করে ভাঙলেও যেন মনে হয় এক একটা পঙ্ক্তি এক একটা অনুভূতিতে হৃদয় ছোঁয় যেন এই এক একটা অনুভূতিই এক একটা কবিতা হয়ে ওঠে।
বিলাপগীতি
আঁধারে তোমার আলোর উদ্ভাসনে উদ্ভাসিত হবো বলে
তৃষ্ণার্ত মন তোমার জলের ফোয়ারায় ভিজাবো বলে
জন্মাবধি আমার দু’চোখের অশ্রুজল ফেলতে ফেলতে
আমি অবিরত তোমার সুশ্রী প্রতিমার তরজমা করি!
অপ্রেম নিষিদ্ধ করে দিয়ে হৃষ্টতার সাথে আলিঙ্গন করে,
এবার তুমি নবীন বঁধু সেজেগুজে প্রস্ফুটন হয়ে আসো
বিগত বছরের সমস্ত অপূর্ণতা ভুলে সঞ্জীবনী হয়ে আসো
এসে ল-ভ- করে দাও ব্যর্থতার বিলাপগীতি।
অভিনব মানুষ করে দাও
প্রিয়তমা তোমাকে বলছি
তোমাকে ছাড়া আমি ভেঙ্গে চুরমার, বিবশ হয়ে যাই
তোমাকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন, জরাগ্রস্থ হয়ে যাই
তোমাকে ছাড়া আমি অনুজ্জ্বল, বিনাশ হয়ে যাই
তোমাকে ছাড়া আমি চাঞ্চল্যহীন, উদাসীন হয়ে যাই
তেমাকে ছাড়া আমি আত্মহারা, মৃত শব্দ হয়ে যাই!
প্রিয়তমা তোমাকে বলছি
আমার পাঁজরের সমস্ত অস্থি আকুল ব্যাকুল হয়ে
শুধু তোমার প্রার্থনায় নিমগ্ন নিনাদিতো
আমাকে গ্রহণ করো, প্রিয়তমা আমাকে গ্রহণ করো!
ভালোবসে তুমি,
আমার নিষ্প্রাণ আত্মায় উজ্জ্বল প্রাণ ফিরিয়ে দাও
ক্লেশিত জীবন থেকে আমাকে অভিনব মানুষ করে দাও!
তোমাকে হারিয়ে ফেলে
শেষ অব্দি মায়াবতী তোমাকে হারিয়ে ফেলে
আমার বিমল বিশুদ্ধ হৃদয়ের রক্তক্ষরনের বেদনায়
আমার উদ্দীপ্ত মস্তিষ্কের দেয়ালে দেয়ালে
সাদা-কালো বর্ণহীন বিলবোর্ডে ছেপে গ্যাছে
আমি যেন নির্বোধ স্থাবর, নিরর্থক নিসাড় নিশ্চল!
শেষ অব্দি প্রণয়িনী তোমাকে হারিয়ে ফেলে
হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে উদ্দেশ্যহীন পথে
আমি যেন বোমায় বিধ্বস্ত কোনো ধ্বংস স্তুপ
আমি যেন বিচ্ছিন্ন পথে পথভ্রষ্ট কোন পথিক
আমি যেন স্পন্দনহীন কোন বিকল অমানুষ!
অবয়ব
সায়েন্টিফিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি
আমার নিজস্ব অসহায় অবয়বের প্রতিবিম্ব
যেন অশান্ত, অস্বস্তিতে ঘেরা বিবর্ণময়
দোমড়ানো মোচড়ানো একটা তরুণের প্রতিচ্ছবি
যেন বিদ্বিষ্টের রোদে পুড়ে তামাটে অলিভ রঙা অবয়ব
যেন সমস্ত শিরদাঁড়ায় ত্রস্তের অস্বাভাবিক গুঞ্জন
যেন হৃদপি- অন্ধকার গহ্বর আলোর ছিঁটেফোঁটাও নাই
যেন সমস্ত রগের রক্তে দ্রুতবেগে প্রভাবিত হচ্ছে অসংখ্য বিষ!
দগ্ধ সত্ত্বা
প্রিয়তমা,
আমার নিষ্পাপ সত্ত্বাকে বিঁধেছে নির্দয় নিষ্ঠুর আগুনের বর্শা
আমি যেন পুড়ে ছাই নিমিষে হয়েছি ছেঁড়াখোড়া
প্রিয়তমা,
তোমার সত্ত্বার রোশনাই ছড়িয়ে দাও আমার দগ্ধ সত্ত্বায়
যেন আমার সত্ত্বার সমস্ত জঞ্জালাটে বিলুপ্ত হয়ে যায়!
আর্তনাদের পঙক্তি
এই থুত্থুড়ে, জরাজীর্ণে জর্জরিত যন্ত্রণাটে জীবন ভালোই লাগে না
এই উল্লাসহীন, জ্বালাময়ী অনুত্তম অপকৃষ্ট জীবন ভালোই লাগে না
এই তমসাচ্ছন্ন, দুর্বিষহ বিশ্রী জীবন ভালোই লাগে না!
শোনো ওগো প্রণয়ী,
আমার চোখে অজস্র আর্তনাদের পঙ্ক্তি
একঝুড়ি অভিমান নিয়ে নিস্তব্ধ, স্তব্ধ থেকো না আর,
আমাকে দাও
তোমার রক্তে লালিত তোমারি আপন জ্যোৎস্না
যেন এই জ্যোৎস্নার বিনিময়ে
আবার আমি ফিরে পাই আমুদের প্রফুল্লময় সাদাটে শুভ্র জীবন।
রজনীগন্ধা
রজনীগন্ধার প্রভাময় প্রাণ কারা যেন নিয়ে গেলো
সাদা, শুভ্র উজ্জ্বল ফুল রক্তাক্ত রক্তে ভিজে লাল
ধূসোর ধুলোয় পড়ে আছে নীরস নিষ্প্রাণ রজনীগন্ধা
এই রজনীগন্ধা কোন নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ তরুণের প্রেমিকা
জানে না কেউ জানে না,
জানে না ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
এই রজনীগন্ধার রক্তাক্ত খ- খ- বিদীর্ণ লাশ থেকে
বাতাস চিড়ে ভাসছে অমসৃণ ছুরির আঘাত
আর একুশটি বুলেটের ঘ্রাণ!
তোমার নন্দিত ললাট
ওগো প্রেয়সী,
তুমিহীনা আমার হৃদয়ের ফুলবন যেন বোমাবর্ষণে বিস্ফোরিত হয়ে যায়!
যেন বেদনায় নিতান্ত বিস্বাদ তিক্ত হয়ে যায়
আমার দুচোখ দিয়ে সারাক্ষণ টলটল করে অশ্রু ঝরে যায়!
ওগো প্রেয়সী,
তোমার রুপের অবয়বে পাতায় পাতায় পৃথিবীর সমস্ত আলো নেচে বেড়ায়
সেই আলো ছড়িয়ে দাও আঁধারী, আলোহীন এই আমায়
তোমার প্রেমময় অধরের স্পর্শে মুছে দাও আমার মৃত্যুময় যন্ত্রণা!
যেন ভুলেও না ছোঁয় আমায় ধূলি মলিনতা কিংবা শূন্যতা।
ওগো প্রেয়সী,
তোমার নন্দিত ললাট ছুঁয়ে দাও আমার অতুষ্ট বিষাক্ত ললাটে
যেন হৃদয়ের সমস্ত বিষাক্ততা তোমার ললাটের বিনিময়ে মুছে যায়
তোমার নরম, কোমল দুটি হাত বেঁধে দাও মন্ত্রে প্রেম বন্ধনে আমার ফিকে দুটি হাতে
যেন অন্ততকাল ধরে আমি হেঁটে যেতে পারি দূর দিগন্তে সমস্ত বিপদময় পথে!
ফিরে এসো
কথা ছিলো-
প্রণয়ী হয়ে আলোর প্রদীপ্তি হয়ে আঙ্গুল ছুঁয়ে থাকবে অনন্তকাল!
অথচ, আমার প্রতিটি ব্যর্থ ভোরে, ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে তুমি নাই!
সমস্ত অতৃপ্তি নিরানন্দ বিমর্ষতা নিশ্চিহ্ন করতে ফের আসবে কি?
তুমি অনুরাগে অভিমান ভুলে গিয়ে প্রণয়ের বোধে ফের আসবে কি?
দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলকণা জড়ো হয়ে ছেপেছে শুধুই তোমার নামের প্রতিটি অক্ষর!
এ জন্মে তুমি তোমার আত্মার কোমল নরম কোলে আমায় করবে কি গ্রহণ?
তুমি কি প্রণয়ের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিবে আমার আত্মার সর্বাঙ্গে?
তুমি কি ফের দীপ্তি হয়ে বিভাতে আমায় উদ্দীপ্ত করবে?
তুমি কি ফের আমায় আত্মিক টানে আত্মিক ভালবাসবে?
আমার আত্মার সর্বাঙ্গে তুমি প্রার্থনায় নিনাদিত হয়ে বয়ে চলছো
ফিরে এসো,
আত্মিক ভালবেসে তৃপ্ত করে দাও এই বিষন্ন আত্মাকে
ফিরে এসো প্রণয়ী তুমি আমার কাছে ফের ফিরে এসো।
ব্রডব্যান্ড
ব্রডব্যান্ড
শফিক নহোর
আমার মেয়ে দিন-রাত লেখাপড়া করে। কিন্তু ওর পরীক্ষার ফলাফল এত খারাপ কেন আসছে বুঝতে পারছি না। লুবনা, মানে আমার মেয়ে সে কখনো ফেসবুক ব্যবহার করে না, মোবাইলে ও তেমন কারো সঙ্গে কথা বলে না। সে সবসময় লেখাপড়ায় ভালো এবং মেধাবী ছিলো। কলেজে সবাই ওর প্রংশসা করতো; হঠাৎ করে মেয়েটার যে কী হলো! আমার সঙ্গে তেমন কথা বলতে চায়না । সারাক্ষণ মন মরা হয়ে বসে থাকে। কেমন যেনো চুপচাপ। রাতে মাঝে মধ্যে ওর রুমে আলো জ্বলতে দেখে আমি ভাবি সে হয়তো রাত জেগে লেখাপড়া করছে। কিন্তু যখন পরীক্ষার ফলাফল আমার কাছে আসে তখন তা দেখে আমার বিশ্বাস করতে কস্ট হয় যে এটা লুবনার রেজাল্ট শীট। ওর রেজাল্ট শীট দেখে আমার মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন জন্ম নিতে থাকে। আসলে ও কি করে? মাঝে মধ্যে রাত জেগে পড়া ছেড়ে আর কি করতে পারে সে?
লুবনার এমন আকস্মিক পরিবর্তন দেখে আমি ওর বাবার সাথে কথা বলি। লুবনার বাবা ঢাকার বাইরে চাকুরী করে। সব শুনে সে অনেক চেষ্টা করেছে ঢাকায় বদলি হয়ে আসতে। কিন্তু পারেনি। মন্ত্রীদের ফোন ছাড়া আজকাল বদলি ও হয়না । মেয়েটি দিন-দিন শুকিয়ে যাচ্ছে । ডাক্তার দেখানোর কথা বললে খুব রেগে ওঠে। প্রচ- জেদি মেয়েটা আমার । এক মেয়ে হবার কারণে, ওর অনেক কথাই আমরা মেনে নিয়েছি অবলীলায়, সব কিছু করেছি ওর পছন্দ মত। তবুও ইদানীং তার মনের ভিতর হাজার টা অভিমানী বাক্য ।
একদিন আমার পাশের বাসার মাইনুল ভাইয়ের সাথে কিছু ব্যাপার শেয়ার করলাম। লুবনার হঠাৎ নিরব হয়ে যাওয়া রেজাল্ট খারাপ করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। তিনি আমাকে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি পরামর্শ এরকম ছিলো আমি যেনো খুব সম্ভব ইন্টারনেট ব্যবহার শিখি। আর এটা যদি শিখতে পারি তাহলে হয়তো লুবনার ব্যপারটা আমি ক্লিয়ার হতে পারবো। মইনুল ভাইয়ের ধারণা লুবনা ইন্টারনেট আসক্ত। তাই আমি তার কাছেই শিখে নিয়েছিলাম ইন্টারনেট অধ্যায়।
ইন্টারনেট শেখার সাথে সাথে আমি খুব লক্ষ্য রাখতাম আমার মেয়ের প্রতি। লুবনা, আমার পড়–য়া মেয়ে সত্যিকার অর্থে রাত জেগে কী করে ?
আমার কম্পিউটার সম্পর্কে তেমন একটা ধারনা ছিলোনা । বাসায় অনেকদিন আগে থেকেই ছিলো ব্রডব্যান্ড লাইন, ওয়াই-ফাই সবকিছু । আমিও ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ব্যবহারের হিস্টোরি গুলো দেখলাম। ছিঃ! ছিঃ!ছিঃ ! আমি তখন খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম নিজেই নিজের কাছে ।
একদিকে চাকরি অন্যদিকে সংসার সব মিলিয়ে মেয়েকে তেমন সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না আমার। তবুও চেষ্টা করি, সেখানেও ফলাফল শূন্য। বুঝতে পেরেছি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে আমার মেয়ে । লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাত জেগে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওয়েব সাইটে পড়ে থাকে। বিভিন্ন দেশি বিদেশী নগ্ন ছবি দেখার নেশায় সে আসক্ত । একটা দিন সে ইন্টারনেট বিহীন থাকতে পারে না। বিভিন্ন ওয়েব সাইটে নিজে নগ্ন হয়ে আপলোড দিয়েছে নিজের ছবি ও ভিডিও । ‘মা’ হিসাবে ব্যর্থতার সারিতে দাঁড় করালাম নিজেকে। যে করেই হোক এ পথ থেকে ফিরে আনতে হবে মেয়েকে । আমার স্বামীকে ভয়ে কিছুই জানালাম না। শুরু করলাম মেয়ের সঙ্গে বন্ধু হিসাবে মিশতে। কিন্তু সে আমাকে সহজে মেনে নিতে পারছিলো না। অবশেষে আমরা ভাল বন্ধু হলাম।
মেয়ে ওয়াদা করলো আমার কাছে, সে কখনো আর এসব সাইট ব্যবহার করবেনা।
ভালোবাসা ও ভাল পরামর্শ দিয়ে ধীরে ধীরে লুবনাকে আমি অন্ধকার জগত থেকে ফিরিয়ে এনেছি। অবসর সময়ে আমি আর লুবনা ঘুরতে যাই ,ওর কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমরা দু’জন যাই । আমাদের দেখে সবাই অবাক হয়; ‘মা’ মেয়ে এত ভাল বন্ধু হতে পারে ?
মাঝে মাঝে ঘুমন্ত লুবনার নিস্পাপ মুখখানা বুকের ভেতর নিয়ে কপালে চুমো দিয়ে বলি আমার লক্ষী মামনি, আমার লুবনা সোনা, যদি সঠিক সময়ে তোমার পরিচর্যা করতাম আরো ভালো দেখাশুনা করতাম তাহলে মামণি তোমার এতবড় সর্বনাশ হতোনা। তবুও থ্যাংকস গড, যে সময় মতো তোমাকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
আজকের দিনে মা-মেয়ের বন্ধু হওয়া বেশি প্রয়োজন।
আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে ফেলছি নিজেদেরকে সঠিক পথ থেকে । শুধু টাকার মোহে সংসার এর মোহে সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকা ঠিক নয় । আজ মেয়ের একজন ভাল বন্ধু হয়ে সেটা বুঝতে পারছি । আমার মেয়ে হয়তো এর চেয়ে খারাপ পথে যেতে পারতো । হয়তো মিশে যেতে পারতো জঙ্গি বা আইএস এর সদস্য হিসেবে । ছেলে-মেয়েদের সময় দিয়ে বন্ধু হতে হবে , সচেতন হতে হবে পরিবারের লোকজনদের । জানতে হবে আমার খোকা বা খুকি ওরা কখন কি করছে, কার সাথে মিশছে। স্বাভাবিক আচরণে যদি হঠাৎ কোন পরিবর্তন আসে তাহলে অস্থির না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি টেকওভার করতে হবে। তাহলে ওরা বিপথগামী না হয়ে সুপথে থেকেই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তৈরী করবে। আর এটা নিশ্চিত করতে হবে পরিবারকে। আর সেটা হলো স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা আর মমতা। এটার কোন বিকল্প নেই।
সানাউল্লাহরা টিকে থাকে
সানাউল্লাহরা টিকে থাকে
উলুল আমর অন্তর
‘মিষ্টি নিয়া আসো জামাই, তোমার বেটাছৈল হইছে!’ শ্বাশুড়ির কথা শুনেই আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠে সানাউল্লাহ। কিছুক্ষণ পর বউ ও সদ্যোজাত পুত্র সন্তানের কাছে যাওয়ার অনুমতি পায়। নাদুস-নুদুস বাচ্চাটা কোলে নিয়ে তার কানটা মুখের কাছে এনে আজান দেয় সানাউল্লাহ। এটা সানাউল্লাহর দ্বিতীয় পুত্র। টানা দুই বছরে দুই সন্তানের জনক হলো সে।
সানাউল্লাহর প্রথম সন্তানের জন্ম অবশ্য ক্লিনিকে হয়নি। শ্বশুরবাড়িতেই ধাত্রী ডেকে বাচ্চা জন্মানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এবারও তাই করা হতো, কিন্তু আয়েশা কাল রাতে হঠাৎই প্রচ- ব্যথায় কাতরানো শুরু করলে তাকে ক্লিনিকে নিয়ে আসে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। খবর পেয়ে সানাউল্লাহ সকালেই এখানে চলে আসে।
সানাউল্লাহ বাচ্চাটার কপালে চুমু খেলো। ডাক্তার আপা এসে সানাউল্লাহর শাশুড়িকে বললেন, ‘মেয়েকে বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়েছেন। তার উপর এত তাড়াতাড়ি দুটা বাচ্চা জন্ম দিতে হলো। মেয়েটাকে কি মেরে ফেলবেন নাকি আপনারা?’ কথাটা শুনে সানাউল্লাহ লজ্জা পায়। মনে হয়, সে একটা কামুক- এটাই বলতে চাইছেন ডাক্তার আপা। ‘আপনাদের সমস্যা হলো নিজেদের মেয়েকে শিক্ষার সুযোগ দিবেন না, কিন্তু সে অসুস্থ হলে কিংবা বাচ্চা প্রসবের সময় আপনাদের মহিলা ডাক্তার না হলে চলবে না। এত মহিলা ডাক্তার কই থেকে আসবে? নিজের মেয়েকে তো ডাক্তার হতে দিবেন না।’ ডাক্তারনীর লেকচারে বিরক্ত হয় সানাউল্লাহ, বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
পরদিন বউ ও দুই পুত্রকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে সানাউল্লাহ নিজের বাড়ি ফিরে আসে। শ্বশুর অবশ্য কয়েকদিন থাকতে বলেছিলেন কিন্তু সে রাজি হয়নি। বলেছিল,‘পৌরসভার চাকরিডা একটু মন দিয়া করিচ্চি আব্বা, যাওয়া লাগবে।’ শ্বশুর আর বাধা দেননি, বরং খুশি হয়েছেন। পৌরসভায় সানাউল্লাহর খ-কালীন কাজটার আসলে কোনো নাম নাই। সকাল বেলা যায়, মেয়রের কাগজপত্র, চিঠি এখানে সেখানে পৌঁছে দেয়, অতিথিদের চা নাস্তা খাওয়ায় এই আরকি। আজ ছয় মাস ধরে এ কাজ করছে সানাউল্লাহ। বেতন কোনো মাসে পায়, কোনো মাসে পায় না।
সানাউল্লাহ বিয়ে করেছে তিন বছর আগে। বিয়ের পেছনের গল্পটা বেশ নাটকীয়। সে গল্পটা বলতে গেলে আরও পেছনে গিয়ে সানাউল্লাহর প্রথম যৌবনের গল্প বলা দরকার। সানাউল্লাহ তখন হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ত। পাড়ার মসজিদ থেকে শখের বসে তিনদিনের তাবলিগে গেল সে। সেই তিনদিনের তাবলিগ সানাউল্লাহর জীবনটাই বদলে দিল। তাবলিগের প্রেমে পড়ে যায় সে। প্রতি মাসে একবার করে তাবলিগে যেতে লাগল, নিয়মিত তাহাজ্জুদসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে লাগল, আর এক কাওমি মাদ্রাসায় গিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন শিক্ষা করতে লাগল। লম্বা দাড়িও রাখল। আল্লাহর নবীর সুন্নাত মেনে সানাউল্লাহ মাথা ন্যাড়া করে ফেলল। তাবলিগে গিয়ে ‘হেকায়েতে সাহাবাহ’ বইতে সাহাবাদের কষ্টের জীবন আর শত প্রতিকুলতার মাঝে ঈমান ও আমল ঠিক রাখার কাহিনী পড়ে সানাউল্লাহ মুগ্ধ হয়ে গেল। দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা সানাউল্লাহকে এতটাই বেচয়েন করে দিল যে স্কুলের লেখাপড়ায় সে আর মনই বসাতে পারল না।
সানাউল্লাহর পিতা হাসমত উল্লাহ ব্যবসায়ী মানুষ, ধর্ম-কর্মে তার মন কোনোদিনই ছিল না। একমাত্র পুত্রের এই বৈরাগ্য তার সহ্য হল না। সানাউল্লাহর এসএসসি পরীক্ষার তিন মাস বাকি। কিন্তু পড়াশুনা বাদ দিয়ে সে দিন রাত মসজিদে তালিম আর মানুষকে দীনের দাওয়াত দিয়ে বেড়ায়। সানাউল্লাহ তখন অন্য জগতের মানুষ, বস্তুজগতের সবকিছু তার কাছে তুচ্ছ। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই পিতা পুত্রের মধ্যে ঝগড়া হতে লাগল।
হাসমত উল্লাহ একদিন রাগ সামলাতে না পেরে থাপ্পড় মেরে বসলেন পুত্রকে। সানাউল্লাহ কিছু না বলে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। চার মাস পর সে যখন বাড়ি ফিরল তখন সে আর কিশোর সানাউল্লাহ নেই, পরিণত হয়েছে এক তাবলিগী হুজুরে। বৃদ্ধ হাসমত উল্লাহ সানাউল্লাহকে আর সরাসরি কিছু বলার সাহস পান না, আত্মীয়-স্বজনকে অনুরোধ করেন পুত্রকে বুঝাতে। খালা, মামা, চাচারা এসে সানাউল্লাহকে বুঝান- ইসলাম তো লেখাপড়া করতে নিষেধ করেনি। আল্লাহর নবী বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও। কিন্তু সানাউল্লাহ দীনি এলেম ছাড়া অন্য কিছু শিখতে নারাজ। এক বছর ধরে অসংখ্য মানুষের উপদেশ শুনে তাবলিগকর্মী এক স্কুল মাস্টারের পরামর্শে শেষমেশ সানাউল্লাহ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেই আবার পড়াশুনা ছেড়ে দিল সানাউল্লাহ।
হাসমত উল্লাহ ধরেই নিলেন- তার পুত্র শেষ হয়ে গেছে, সে জগতসংসারের কোন কাজে আর আসবে না। অথচ একমাত্র সন্তানকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার! হলো না, কিচ্ছু হলো না। হাসমত উল্লাহ শান্তিতে আর মরতেও পারবেন না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে এইসব অপ্রাপ্তির গল্প, মনের দুঃখের কথা একমাত্র বন্ধু নুরুলের সাথে শেয়ার করেন তিনি। একদিন আলাপের মধ্যে নুরুল বলে উঠলেন, ‘বেটারে বিয়া দিয়া দাও দোস্ত, সংসারের প্যারায় পড়লে এইসব পাগলামি দৌড় দিয়া পালাবে।’
বুদ্ধিটা মনে ধরে হাসমত উল্লাহর। সেদিন রাতে খাওয়ার পরে পুত্রকে ঘরে তুলে দরজা লাগিয়ে দিলেন তিনি। তারপর সানাউল্লাহর হাতদুটো চেপে ধরে কাঁদতে লাগলেন। শক্ত মনের পিতাকে হঠাৎই এভাবে কাঁদতে দেখে সানাউল্লাহ অবাক হয়। হাসমত উল্লাহ বলেন,‘ বাপ তোর কাছে জীবনে কিছু চাইনি, আজ হামার একটা কতা রাখ। তোর কোনো কামে হামি বাধা দিমুনা, তুই খালি একটা বিয়া কর।’
সানাউল্লাহ না করতে পারেনি, তবে একটা শর্ত ঠিকই জুড়ে দেয়- হাসমত উল্লাহকে আগে তাবলিগে গিয়ে তিন চিল্লা দিয়ে আসতে হবে, তবেই সানাউল্লাহ বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। হাসমত উল্লাহর রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। পরের সপ্তাহেই তাবলিগে চলে যান তিনি।
হাসমত উল্লাহ তিন চিল্লা পুরো করে ফিরে আসলে অনেক দেখেশুনে করিমগঞ্জের মকসুদ আলীর কন্যা আয়েশা সিদ্দিকার সাথে বিয়ে হলো সানাউল্লাহর। আয়েশা বয়সে ছোট হলে কি হবে, খুবই গুণবতী মেয়ে। কুরআনে হাফেজা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির খেদমত করে, নামাজ কালাম ঠিকমত পড়ে, পর্দা ছাড়া পরপুরুষের সামনে যায় না- এমন দ্বীনদার বধু পেয়ে সবাই খুশি।
বিয়ে যখন সানাউল্লাহ করেছে, সংসারের দায়িত্বও তো নিতে হবে। সানাউল্লাহর একটা কাজের দরকার পরলো। কাজের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেলো সানাউল্লাহর প্রথম পুত্রের জন্মের পর।
হাসমত উল্লাহ তার চাচাতো ভাই ও সরকার দলীয় রাজনীতিক সাত্তারকে অনুরোধ করলেন সানাউল্লাহকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। সাত্তার সাহেব পৌরসভার মেয়রকে বলে সানাউল্লাহকে কাজে লাগিয়ে দিলেন। তবে চাকরিটা ক্ষণস্থায়ী। পার্মানেন্ট চাকরির জন্য নিয়োগ পরীক্ষার প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর নিয়োগ পরীক্ষা হলেই যে চাকরি হবে তা তো নয়। প্রার্থী তো সানাউল্লাহ একা নইয়। পিয়নের চাকরির জন্য অনেক লোকই দশ থেকে পনেরো লাখ টাকা দিতে এক পায়ে খাড়া।
মেয়রের রুমে ঢুঁকে সালাম দিল সানাউল্লাহ। ওর দিকে না তাকিয়েই মেয়র বললেন, ‘তোমার নিয়োগের কাজ তো শুরু হইছে সানা। এবার পড়াশুনা কইরা ভাল প্রিপারেশন নাও।’ মেয়রের রুমে সাত্তার চাচাও ছিলেন। তিনি সানাউল্লাহকে বললেন, ‘শোন, এই চাকরির জন্য ছয়জন টাকা দিছে, তুই দিছিস দশ লাখ, পনেরো লাখ দেওয়া লোকও আছে। কিন্তু চাকরিডা তোরই হবে। তবে পরীক্ষা দিলে তুই তো ফার্স্ট হবার পারবি না।’
সাত্তার চাচার কথা শুনে সানাউল্লাহ শঙ্কিত হয়। ফার্স্ট না হতে পারলে কি চাকরিটা হবে না?
ওর কপালে দুশ্চিন্তা দেখে মেয়র ও চাচা দুজনেই হাসলেন। চাচা বললেন, ‘ পাঁচ হাজার টাকা দিয়া একটা জ্ঞানী লোক ঠিক করছি। তোর পাশে বসে পরীক্ষা দিবে। তুই খালি তার খাতা দেইখা লিখবি, পারবি না?’
সানাউল্লাহ মাথা ঝাঁকায়।
২। সানাউল্লাহ পরীক্ষার হলে বসে আছে। তার পাশেই বসেছে ভাড়া করা লোকটা। পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে দুজন একসাথে নাস্তা করেছে। সাত্তার চাচা সানাউল্লাহকে বারবার বলেছেন, লোকটার খাতা দেখে সবগুলা প্রশ্নের উত্তর লিখে আসতে হবে। কিন্তু সানাউল্লাহর মন মানছে না। এ যে পাপ! নকল করে চাকরি নিয়ে কি সুখী হতে পারবে সানাউল্লাহ ! আজীবন হারাম টাকায় খেতে হবে যে! ধানী জমি বিক্রি করে আব্বা যখন দশ লাখ টাকা মেয়রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তখনও সানাউল্লাহর মনে পাপবোধ জাগ্রত হয়েছিল। ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে আপত্তিও জানিয়েছিল সে। তখন সাত্তার চাচা বললেন, এইডা ঘুষ না বাপ, ব্যবসা। টাকা ছাড়া কোন চাকরিই হয় না বাংলাদ্যাশে। চাকরিডা যারা বিক্রি করবে, আর যে কিনবে তাদের মধ্যে দামাদামি হয়। যার টাকায় চাকরি দেওয়ার লোক খুশি হবে, তার কাছেই বিক্রি করবে। এইডা ঘুষ না।’
সানাউল্লাহর বাধা দেওয়ার উপায় ছিল না। তাকে না জানিয়েই আব্বা জমি বিক্রি করে মেয়রকে দিয়েছিলেন। তাছাড়া আব্বার বয়স হয়েছে, আগের মত আর খাটতে পারেন না। সানাউল্লাহও দুই বাচ্চার বাপ হয়েছে। সংসারের হাল ওকেই ধরতে হবে। চাকরিটা ওর বড় দরকার।
আল্লাহর অলৌকিক শক্তির উপর সানাউল্লাহর অগাধ আস্থা। তার মনে ক্ষীণ আশা কাজ করছে- নকল করে চাকরি নেওয়ার পাপ থেকে আল্লাহই ওকে বাঁচাবেন । যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। হয়ত দেখা যাবে যে, সানাউল্লাহ কারো খাতা না দেখেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে!
পরীক্ষা শুরু হলো। সানাউল্লাহ এক নজরে পুরো প্রশ্নপত্র পড়েই হতাশ হয়ে পড়ল। পাঁচটা প্রশ্নেরও সঠিক জবাব লিখতে পারবে কিনা সন্দেহ ! উপায়ন্তর না দেখে ভাড়া করা লোকটার খাতার দিকে তাকালো। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে? জবাব সানাউল্লাহর জানা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের বানান নিয়ে তার দ্বিধা আছে। তাই লোকটার খাতা দেখে দেখে লিখলো। পরের প্রশ্ন -বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি কি কি? প্রশ্নটা সানাউল্লাহর মাথার উপর দিয়ে গেলো। পাশে বসে থাকা লোকটার খাতার দিকে তাকাতেই কেউ একজনএসে সানাউল্লাহর খাতা তুলে নিলো। সানাউল্লাহ অবাক হয়ে কোট টাই পরিহিত লোকটার দিকে তাকায়।
রাগী গলায় লোকটা বলে,‘ কি করছেন আপনি? হুজুর মানুষ হয়ে নকল করতে লজ্জা করে না?’
সানাউল্লাহর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর খাতা নেওয়া লোকটা বললো , ‘আসেন’। সানুল্লাহকে তুলে নিয়ে গিয়ে একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসানো হলো। লজ্জিত সানাউল্লাহ প্রশ্নপত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু চোখে কোনো লেখা দেখতে পাচ্ছে না সে। পাপ করলে আল্লাহ তো শাস্তি দিবেনই। একই সঙ্গে পাপের ভয় ও লজ্জার মিশ্র অনুভূতিতে কান্না পেলো সানাউল্লাহর। বিমর্ষ চিত্তে সে পরীক্ষার এক ঘণ্টা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সময় যেন আর ফুরাতে চায় না।
মাগরিবের নামাজের পর মুনাজাতে অনেকক্ষণ ধরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইল সানাউল্লাহ। মন শান্ত হলে বাড়ি ফিরে দেখল - আব্বার সাথে বসে সাত্তার চাচা বিস্কুট চানাচুর খাচ্ছেন। ওকে দেখেই সাত্তার চাচা বলে উঠলেন, ‘ শোন, কাম তো গাধার মতই করছিস। ম্যাজিস্ট্রেট তোর খাতা না হয় নিছে বুঝলাম, কিন্তু তুই দশ নম্বরের এন্সারও নিজে নিজে করবা পারলি না ! সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের একজনের নামও তো লিখতে পারিস নি। সবচেয়ে খারাপ পরীক্ষা মনে হয় তুই ই দিছিস।’
সানাউল্লাহ জবাব দেয় না।
বাটি থেকে এক মুঠো চানাচুর মুখে ঢোকালেন সাত্তার চাচা। কিছুক্ষণ চিবিয়ে বললেন , ‘যা হবার হইয়া গেছে। ম্যাজিস্ট্রেটকে ম্যানেজ করছি। পঞ্চাশ হাজার টাকা শালারে খাওয়ান লাগবে। না হলে ভাইবায় তোক আটকাবে।’
‘চাকরিডা হামি করমু না চাচা’।
কি! একই সঙ্গে চেঁচিয়ে আব্বা ও সাত্তার চাচা।
আব্বা বললেন, ‘ দশ লাখ টাকা দিছি, এখন তুই চাকরি করবি না? বউ বাচ্চারে খাওয়াবি কী? টাকা পাবি কই?’
সানাউল্লাহ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘জমিতে হাল বইয়া খামু আব্বা। অনেক পাপ করছি, আর না। ওই চাকরির যে যোগ্য সেই করুক, হামি না। হামি জমি চাষ কইরা সংসার চালামু।’
সানাউল্লাহ প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। ওর মনে এখন মুক্তির আনন্দ।
জীবন যেখানে যেমন
জীবন যেখানে যেমন
মিনহাজ শোভন
দিনের শেষভাগ উপস্থিত। আকাশের নির্লিপ্ত সূর্য আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে গভীরে। সমস্ত পৃথিবীতে নেমে আসছে অন্ধকার। আচ্ছা এই সূর্য তলিয়ে কোথায় যায়? বিজ্ঞানের কথা মানতে মন চাইনা। ইচ্ছে হয় একটু অন্যরকম ভাবতে। সে অন্যরকমটা কেমন? আকাশটাকে একটা বিশাল সমুদ্র ভাবতে ইচ্ছে হয়। যার একভাগ হতে ভেসে ওঠে সূর্য। সারাদিন মেঘেদের সাথে সমুদ্রজলে সাঁতার কেঁটে আর খুনসুটি করে বিকেলে নির্লিপ্ত হয়ে ফিরে যায় নিজের ঘরে। যেমন সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত মানুষ ঘরে ফিরে আসে।
সন্ধ্যা। সূর্য ফিরে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। সকালে কাজে বের হওয়া মানুষগুলো ফিরছে নিজের ঠিকানায়। পাখিরা ছুটে চলেছে তাদের নিজ ঠিকানায়। একটা জিনিস কখনো খেয়াল করেছেন? মানুষ আর পাখিদের জীবনযাত্রা মাঝে অনেকটা মিল রয়েছে। প্রতিদিন সকালে মানুষেরা যেমন নিজের এবং পরিবারের রিজিকের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি পাখিরাও বেরিয়ে পড়ে নিজের এবং পরিবারের রিজিকের খোঁজে। আবার রোজ সন্ধ্যায় সবাই ফিরে আসে আপন ঠিকানায়। আচ্ছা সবাই কি ফিরে আসে? হয়তো আসে নয়তো না।
অনেকে খুব সহজেই ফিরে আসে, কেউ ফিরে আসে অনেক সংগ্রামের পর, আবার হারিয়ে যায় অনেকে। আকাশে কিংবা অন্ধকারে। হারিয়ে যারা যায়, তাদের কেউ কেউ অনেক চেষ্টা করে ফিরে আসার, আবার অনেকে নির্লিপ্ত হয়ে থেমে থাকে একেবার। কারো পিছনে টানটান করে বাঁধা থাকে তাদের হাত। ছাড়াতে গেলে খুব কষ্ট হয়, ব্যথা অনুভূত হয়। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয় তখন। আচ্ছা পাখিদেরও কি এমনটা হয়? তাদের কেউ কেউ কি অন্ধকারে হারিয়ে যায়? নাকি সবাই ফিরে আসে? আমাদের কারো হয়তো জানা নেই। আমরা কেউ হয়তো কখনও কোন পাখির জীবনধারণ পর্যবেক্ষণ করিনি।
সূর্য অস্ত গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে তবুও আকাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। টিপটিপ করে গাছের ডগা থেকে বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ছে। দল থেকে ছিটকে পড়া পাখিগুলো একে একে নিজ আস্তানায় ফিরছে। সেখানে অপেক্ষায় রয়েছে তাদের পরিবার। অনেক ব্যস্ত শহরের মাঝে সুনসান একটা এলাকা। দূরে বড় রাস্তা দিয়ে চলতে থাকা বড় গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তা থেকে ছোট গলির ভেতর ঢুকতে মোড়ের ওপর একতলা শীর্ণ বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা ছোট খেলার মাঠ। সন্ধ্যা নামায় কেউ সেখানে নেই। সবাই ফিরে গেছে নিজের ঠিকানায়। খেলার মাঠের একপাশে বৃষ্টির পানি বেঁধে আছে। একটা কুকুর এই ভরা সন্ধ্যায় ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোতে পিপাসা মেটাচ্ছে। অদ্ভুত রকমের একটা শব্দ হচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে একটা বাড়ি। বাড়িটা পেরলেই একটা পুকুর। পুকুরের পাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে একটা ঝোঁপ। সেখান থেকে ঝিঁঝিপোকারা ডেকে চলেছে অবিরাম।
ঝোঁপঝাড় থেকে ঝিঁঝিপোকার শব্দ কানে আসলেই আমার মনে পড়ে, গ্রামের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেত, পানিতে টুইটম্বুর ছোট ছোট ডোবা; যা কচুরিপানায় একেবারে পরিপূর্ণ থাকে। সন্ধ্যার আগে যেখান থেকে ভেসে আসে বক কিংবা পেঁচার কণ্ঠ। ধানের ক্ষেতের অদ্ভুত রকমের গন্ধ। শো শো করে বয়ে চলা দক্ষিণা বাতাস। সন্ধ্যার মেঘমুক্ত আকাশের তারার মেলা। কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। ঝিঁঝিপোকার শব্দ। কিছুক্ষণ পর পর দূরের কোন কলমি কিংবা কাঁশবন থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ আসে না কানে। চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় কতশত জোনাকি পোকা। এসব দেখে আনন্দে মেতে উঠতো আমার সমস্ত তনুমন। কিন্তু ইট পাথরে ঘেরা এই কোলাহলময় শহরে এসব শোনার ইচ্ছা একেবারেই অর্থহীন। এগুলোর কিছুই এখানে নেই। এখানে যা আছে তার সবকিছুই কৃত্রিম।
ভেজা রাস্তা চলতে থাকা বিভিন্নরকম গাড়ির ফাঁকফোকর গলিয়ে বড় রাস্তা পার হয়ে এই গলির মাঝে ঢুকেছি আমি। ঠিক গলি বলা যায় না এটাকে। একপাশে খেলার মাঠ। অন্যপাশে কিছুদূর পরপর একেকটা বাড়ি। আর ফাঁকা যায়গাগুলোতে বিভিন্নধরনের গাছ। মেহগনি, শিমুল, সেগুন, বরই সহ আরো অনেক ধরনের গাছের সমাহার। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানি। মেঘলা আকাশের কারণে চারিদিকের অন্ধকার আরো বেশি গাঢ় হয়ে পড়েছে। যদিও চারিদিক বিভিন্ন রকমের আলোতে ভর্তি থাকায় অন্ধকার দেখা যায় না এশহরে। গলির মাঝে একেবারে সুনসান পরিবেশ। খুব একটা শব্দ শোনা যায় না। বড় শহরগুলোতে সাধারণত এরকম যায়গা পাওয়া যায় না। কিন্তু এশহরে আছে।
আমি খেলার মাঠের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ঝিঁঝিপোকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনকার মতো আজও দূরের কোন এক বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রবীন্দ্র সংগীত, ‘আমারো পরানো যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো। আমারো পরানো যাহা চায়। তুমি ছাড়া আমার এ জগতে, মোর কেহ নাই কিছু নাই গো।আমারো পরানো যাহা চায়।’
কি চাই আমার পরান? হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাই। সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি চাই। সমস্ত ক্লান্তি-ক্লেশ, সমস্ত অপমান অপদস্থতা ঝেড়ে ফেলতে চাই শরীর থেকে। বিশাল এই জগতে আমাদের মতো মানুষদের জীবনে কিছু নেই। না আছে ইচ্ছা পূরণের পরিতৃপ্তি; না আছে ঘুরে দাঁড়াবার সামর্থ্য। ইচ্ছে পূরণের পরিতৃপ্তি কিংবা ঘুরে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই বলে আমাদের জীবন যে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমরা সফল মানুষ; সংগ্রামী মানুষ।
২.
রাতের আকাশ পরিস্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে। তারা ফুটে উঠছে। পাশের পুকুর থেকে মাঝে মাঝে পানির শব্দ কানে আসছে। পাশের ঝোপের আড়ালে ঝিঁঝিপোকারা ডেকে চলেছে এখনো। গাছ, বাড়িঘর, ঝোঁপঝাড়, খেলার মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। দূরের বাড়ি থেকে ভেসে আসা গানের শব্দ এখনো শুনতে পাচ্ছি কিছুটা।
‘তুমি শুখো যদি নাহি পাও; যাও সুখেরো সন্ধানে যাও। আমি তোমারে চেয়েছি হৃদয়ো মাঝে আরো কিছু নাহি চাই গো। আমারো পরানো যাহা চাই।’
আমি কি কাউকে পেয়েছি? যাকে আমার সমস্ততা উজাড় করে দিতে পারি? আমার আশেপাশে এমন কেউ কি আছে, যে আমার সমস্ততা জুড়ে আছে। না; তেমন কাউকে দেখছি না। আমার মতো মানুষের কাছের মানুষ বা শুভাকাক্সক্ষী থাকতে নেই। আমি নিজেই অন্যের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারি না। অন্য কাউকে জড়াব কি করে? তাছাড়া আমার কৃষক বাবার অনেক স্বপ্ন,অনেক আশা আমাকে নিয়ে; অনেক বিশ্বাস আমার ওপর। বাবা মানে বিশাল আকাশ। যাকে বাদে কল্পনা করা যায় না আমার পৃথিবীকে; বাবা তো আমার মেরুদন্ড যার ওপর ভরসা করে আমি দাড়ানোর সাহস পাই। যার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছি আমি। আমি আমার আকাশ, মেরুদন্ড কিংবা আশ্রয়দাতার স্বপ্ন, আশা বিশ্বাস কি কোন ভাবে ভাঙ্গতে পারব না।
ঝোঁপঝাড়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে পুকুর পেরিয়ে তিনতলা স্কুলের পাশে যেখানে গলিটা মোড় নিয়েছে ঠিক তার উল্টো পাশের দোতলা বাড়িটা আমার গন্তব্য। এইতো বছর দুই হতে চলেছে আমি জড়িয়ে পড়েছি এই বিশ্বাস পরিবারের সাথে। এবাড়িতে আসা যাওয়া শুরুর আগে শহরের ধনপতিদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা ছিল আমার। আগে ভাবতাম, ধনপতিরা তাদের ধনের মোহে গরীব কিংবা আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মানুষ মনে করে না। ডাস্টবিনে পঁচে যাওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা গুলোর মতো মনে করে। এরকম ভাবার কারণ আছে। তার আমি প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু এদের সাথে জড়িয়ে যাবার পরে আমি বুঝতে পেরেছি আসলে পৃথিবীর সব ধনপতিরা এক নয়। কারো কারো কাছে টাকার থেকে মানুষ পরিচয়টাই বেশি মূল্যবান।
বছর দুই হতে চলল এই বিশ্বাস বাড়ির বড় ছেলে একমাত্র ছেলেকে পড়াচ্ছি আমি। ছেলেটার নাম আবির। এবার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে। আবিরের রঙের মতই রাঙা তার জীবন। দুষ্টামি, খুনসুটি আর অভিমানে অতিবাহিত হয় তার জীবন। তাকে দেখা মাত্রই আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। কত আনন্দময় ছিল আমার শৈশব! সকালে মায়ের আদরে ঘুম থেকে জেগে পাড়ার সমবয়সীদের সাথে খেলতে ছুটে যাওয়া। মায়ের হাতে মার খেয়ে ক্লাসের বই মাথায় তুলে স্কুলে ছুটে যাওয়া। স্কুলে খেলাধুলা, মারামারি, খুনসুটি করে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফেরা। মায়ের হাত থেকে খাবার মুখে পুরে বিভিন্ন খেলায় মেতে ওঠা, বিকেলে ঘুড়ি আর নাটাই হাতে ফাঁকা মাঠে ছুটে যাওয়া, সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে কেরোসিনের বাতির সামনে পড়তে বসেই ঘুমিয়ে যাওয়াই ছিলো প্রতিদিনের রুটিন। দিনেরপর দিন কোন পরিবর্তন ছিল না তার। কোথায় সেইদিনগুলি! কোথায়! কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেল! হয়তো আর কোনদিন ফিরবে না সেদিনগুলি। এখনকার ছেলেরা পায়না সেরকম সুযোগ। শৈশব-কৈশরের অনেক আনন্দ থেকে এখন বঞ্চিত এরা। এদের নিজস্ব জগত নিয়ে এখন ব্যস্ত এরা।
৩.
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ার ইচ্ছায় এসেছি এই ইট-পাথরের শহরে। বাবার অনেক বড় স্বপ্ন আমি বড় মানুষ হবো। সে ইচ্ছে পূরণ হবে কি তা জানি না। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? চেষ্টা করতেই পথে নেমেছি। সফলতা, বিফলতা কিংবা গন্তব্য অনেক দূরে। ধীরে ধীরে এগোতে হবে আমাকে। কৃষক বাবার কষ্ট কমাতেই টিউশনি করি। আজ মাসের প্রথম। বেতন পাব। গতবার বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম, বাবার পরনের পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে গেছে; জোড়া লাগানো সেখানে। মায়ের শাড়ির আঁচলটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। সামনে ঈদ আসছে।
পুকুর পেরিয়ে তিনতলা স্কুলটা পেরিয়ে আমার গন্তব্যের কাছে পৌঁছেছি। কলিংবেল চাপা মাত্রই ওপাশ থেকে আবির বলে উঠল,
-কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন স্যার। আমি আসছি।
পুকুরের পাশের ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ পাচ্ছি কিছুটা। দূর থেকে সেই গানের মৃদু সুর ভেসে আসছে। তার কোন শব্দ বোঝা যাচ্ছে না। আমি দাঁড়িয়ে আছি আবিরের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর আবির এসে দরজা খুলেই আমার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিল। আমি ওর হাসির জবাবে কিছু না বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আবির আস্তে করে দরজা লাগিয়ে দিল।
সাহিত্যবিশারদ আবুল মনসুর আহমেদ
সাহিত্যবিশারদ
আবুল মনসুর আহমেদ
হালিমা মুক্তা
“ব্যঙ্গ সৃষ্টিতে অসাধারন প্রতিভার প্রয়োজন এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা সুরও বেরু বে, তার ও ছিঁড়বে না”। হ্যাঁ এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। কোন এক ব্যঙ্গ শিল্পিকে নিয়ে। এখন আমরা জানবো কাকে উদ্দেশ্য করে এ উক্তিটি করেছিলেন আমাদের প্রিয় কবি। হয়ত আমরা কিছুটা অনুধাবন করতে পারছি। সে আর কেউ নন আমাদের প্রিয় “ব্যঙ্গ” গল্পকার আবুল মনসুর আহমেদ। সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অসাধারন পন্ডিতের অধিকারী আবুল মনসুর। তিনি লেখালিখির জগতে আবুল মনসুর নামেই খ্যাত। আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যান্য শেষ্ট ব্যঙ্গ গল্পকার শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যের ও একজন শেষ্ট ব্যঙ্গ গল্পকার। সাহিত্য শিল্পির যা প্রধান ঐশর্য ভাষা-সম্পদ, তা আবুল মনসুর আহমেদের ছিল। আবুল মনসুর আহমদ শিল্পের জন্য শিল্প নয়- জীবনের জন্য শিল্প নীতিতে বিশ্বাস ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি লেখালিখি করে আসছেন। মাসিক আল ইসলাম পত্রিকায় স্পেনের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তি ওপর একটি অনূদিত রচনা প্রকাশিত হয়। এটিই আবুল মনসুর আহমদের প্রথম প্রকাশিত রচনা। আবুল কালাম শাসসুদ্দীন সম্পাদিত সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ-এ নিয়মিত লেখা শুরু করেন।
আবুল মনসুর হাইস্কুল থেকেই তার লেখার হাতেখড়ি শুরু। তার সাহিত্য জীবন শুরু হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই সওগাত পত্রিকায় নিমক-হারাম নামে প্রথম তার গল্প প্রকাশ। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন ভাবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। শেরেবাংলা ফজলুল হকের মালিকানাধীন দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় সম্পাদকের দ্বায়িত্ব গ্রহন। পেশাগত জটিলতার কারণে তিনি বেনামীতে এই দ্বায়িত্ব পালন করতেন। জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় সম্পাদনায় দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। একই বছর ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তিনি সাহসিও বটে। তার বিভিন্ন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, শিরোনাম পড়লে আমরা বুঝতে পারি। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘গোলামী সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি তারপর থেকেই সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ এ নিয়মিত লেখা শুরু করেন। ‘ছবি বড় তৈয়ুব নামা’ নামে পুঁথি-প্যারোড এবং সভ্য তার দ্বৈত্য শ্বাসন’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। আবুল মনসুর আহমদ প্রধানত গদ্য-লেখক আবুল মনসুরের দীর্ঘ একাশি বছরের জীবনের মধ্যে রচিত হয়েছে তার বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। সব ধরনের লেখা মিলিয়ে আবুল মনসুর আহমদের শুধু পুস্তক আকারে ছাপা বইয়ের পৃষ্টাই সাত হাজারের কাছাকাছি। তার বিখ্যাত ব্যাঙ্গ গল্প গন্থের সংখ্যা চার টি। (১) আয়না, (২) ফুড কনফারেন্স, (৩) আসমানী পর্দা, (৪) গালিভরের সফর নামা। মূলত এই চারটি ব্যাঙ্গ গল্প গ্রন্থের উপরেই কিছুটা আলোক পাত করবো। আয়না সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায় বলেন “আয়না” লিখা আবুল মনসুর আহমেদ প্রাপ্তঃস্বরনীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন। গল্প গুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাঙ্গবিদ্রুপ ও পরিহাস প্রিয়তা। তবে নিছক পরিহাসই লেখকের উদ্দেশ্য নয় পক্ষান্তরে আবুল মনসুর আহমদের গল্পের পেছনে তীক্ষè সমাজ ও সমাজ কল্যান উদ্দেশ্য কাজ করেছে। তার দুঃখকে তিনি পরিহাস দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। সমাজের অসংগতি লেখকে পিড়া দিত। তাই তার প্রত্যেকটি কর্মে তার পরিস্কার ছাপ পরস্ফুটিত হয়। লেখক সম্পর্কে সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক আবু জাফর শামশুদ্দিন বলেন “তার জীবন বৈচিত্রময়, আমি তাকে ক্ষুরধার প্রতিভাশালী লেখকরুপে আজীবন শুদ্ধ করে এসেছি। “আয়না” তার অবিস্বরনীয় কীর্তি”।
ফুজ কনফারেন্স গল্পে লেখক ব্যঙ্গ করে বলেছে এইসব রাস্তায় আগে গাউন শাড়ি পরা পরীর ভিড় হতো আর আজি কিনা সেখানে অসুন্দর, অসভ্য, কুৎসিত, অর্ধোলঙ্গ স্ত্রী লোকেরা ভিড় করছে। কি অন্যায়!
“কোথাও মোটর বা ট্রেন থামলে চারদিকে হতভাগা ও হতভাগীনিরা যেভাবে গার উপর পড়ে ভিক্ষে দাও বলে জ্বালাতন করে তাতে একেবারে ঘেন্না ধরে যায়। কি উৎপাত” আমরা দেখি লেখক এ গল্পে ব্যঙ্গ করে সমাজের বড় শ্রেনীর পুজিবাদি মন কিভাবে শোষন করবে নিজেদের হাতে ক্ষমতা রাখবে কিভাবে নিজের
ভাল থাকবে এর চিত্র তুলে ধরেছেন। নিচু শ্রেনীর লোকেরা না থাকলেই যেন উচ্চ শ্রেনীর লোকেরা বেঁচে যায়। এখানে নি¤œ শ্রেনী ও উচ্চ শ্রেনীর বৈষম্যের দিক গুলো লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন। লেখক গল্পের ভাবধারা ব্যঙ্গ উপমার মধ্য দিয়ে শেষ করিয়াছেন। যেমন ছাগলে- বাঙলাটা দাড়ি নেড়ে বললেন! তা হল বটে কিন্তু শেরে বাঙলা হাতীয়ে বাঙলা প্রভৃতি শুধু জানোয়ারে বাঙলাতেই আমরা বেঁেচে রইলাম । মানুষে বাঙলারা যে, সবাই মরে গেল। সকলে জয়ধ্বনি করলেন জানোয়ার-বাঙলা জিন্দাবাদ। মানুষে-বাঙলা মুর্দাবাদ।। তেমনি ভাবে আমরা দেখতে পাই গালিভরের সফর নামা গল্পটিতে লেখেক ব্যঙ্গ করে সুন্দর ভাবে বুদ্ধিমান ও নিরবুদ্ধিতার উত্তাপন করে গেছেন। লেখক গালিভরের সফর নামাই বিরাট সত্য উদঘাটন করেছেন। সাহসের সাথে তিসি লেখার মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে তিনি আমাদের সমাজের অসংগতি দেখিয়ে গেছেন। লেখক যদি আর কোন সাহিত্য কর্ম সৃর্ষ্টি নাও করতেন তবুও তিনি এই চারটি ব্যঙ্গ গল্প গন্থের জন্য বাংলা সাহিত্য অমর হয়ে থাকতেন। গ্রন্থ গুলোতে ভাব ছাড়াও অন্যান্য রস-রচনাও রয়েছে। “ফুড কনফারেন্স মোট নয়টি ব্যঙ্গ গল্পের সমাহার ঘটেছে। গালিভরের সফর নামাই নাট্য চিত্র দুটো, ব্যাঙ্গ গল্প সাতটি। আসমানী পর্দা’র মোট দশটি রস-রচনার মধ্য তিনটি প্যারোডি-কবিতা, দুটো নাট্য চিত্র এবং পাঁচটি ব্যঙ্গ গল্প রয়েছে। আয়নার সাতটিই ব্যঙ্গ-গল্প”।
আবুল মনসুর আহমেদের ব্যাঙ্গ গল্পের পটভূমি মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়। (১) ধর্মীয়, (২) রাজনৈতিক, (৩) আর্থ-সামাজিক।
ধর্মীয়ঃ তিনি এই ধরনের গল্প গুলোতে ধর্মান্ধত, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মের নামে ভন্ডামি এবং ধর্ম-ব্যবসায়ের মুখোস উম্মোচন করেছেন।
দ্বিতীয় ভাগের গল্প গুলোতে তিনি সমকালীন রাজনীতি ও রাজনীতিক নেতাদের অন্ধাকার দিক ব্যাঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যেমন গালিভরের সফর নামা।
আর্থ-সামাজিকঃ পর্যায়ের ব্যঙ্গ গুলোতে তিনি প্রধানত বাঙালি সমাজও বাঙালি চরিত্রের অসংগতি বা দোষত্রুটি সমূহ বার বার প্রয়াস করেছেন। আবুল মনসুর আহমেদ কে আমরা একজন প্রখর দৃষ্টি সম্পন্ন শক্তিমান ব্যঙ্গকার হিসাবে দেখতে পাই। আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ গল্পে দুটো মুখ্য বিষয়। (ক) রস-রচনা হিসাবে এর সার্থকতা বা রস বিচার এবং (খ) এই ব্যঙ্গের পিছনে লেখকের সমাজ-দৃষ্টি। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভাবে লিখেছেন। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের আঘাতে সমাজ ও দেশের চৈতন্য জাগরোন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। হাসতে হাসতে কাঁদতে যাওয়ার মতো ব্যাপার ও তার রস-রচনার ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট হয়। ‘তার আদু ভাই একটি জমৎকার হিইমার চরিত্র।
তার উপন্যাস জীবন ক্ষুধা, আবে হায়াত প্রকাশ হয়। ১৯৭৫ : আল কোরআনের নসিহৎ নামে কোরআন শরিফের বিষয়ভিত্তিক সংকলন প্রকাশ। ১৯৭৮ : আত্মকথা প্রকাশিত হয়। (১) ১৯৩৫ : গল্প গ্রন্থ আয়না প্রকাশ। ২। ১৯৪৪ : গল্প গ্রন্থ ফুড কনফারেন্স প্রকাশ। ৩। ১৯৫৭ : গল্প গ্রন্থ আসমানী পর্দা প্রকাশ। ৪। ১৯৫৯ : গল্প গ্রন্থ গালি ভরের সফর নামা প্রকাশ। আবুল মনসুর সাহিত্যর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার করতে চেয়েছেন। অকুতভয় এক যোদ্ধার নাম ছিলো আবুল মনসুর আহমদ। ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময়ে তার সাহসী উচ্চারনে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। নন্দিত এই ব্যাক্তি আয়নার মতো গল্প গ্রন্থ লিখে যে, সৎ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যি বিস্ময় কর ব্যাপার। হুজুর কেবলা নায়েবে নবী বা মুজাহেদীনের মতো গল্প লিখতে এবং তা প্রকাশ করতে কতটা সৎ সাহসের প্রয়োজন আজকের দিনে তা কল্পনা করা অসম্ভব। এমনি গুনি মানুষের লেখা ও জীবন চিন্তা আধুনিক সমাজে আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষনার প্রয়োজন বোধ করি। তিনি ছোট গল্পের জন্য বাংলা একাডেমীতে পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর সমকালীন সমাজের অন্ধকার দিকের উন্মোচনে লেখকের বড় সাফল্য। ছাত্র বয়সেই তিনি কবিতা ও প্রবন্ধের জন্য পুরস্কৃত হন।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)