ফিরে পাওয়া...
ফিরে পাওয়া
মো. আরিফুল হাসান
রাত তিমির। কুয়াশার চাদর ভেদ করে দুজন মানুষ চলছে। হেমন্তের রাতে তাদের পায়ের নিচের ভেজা পাতাগুলো মচমচ করে ভাংছে না। তবু সামান্যতম শব্দে তারা চমকে চমকে উঠছে।
করিমের বৌকে ভাগায় নিয়ে যাচ্ছে রহিম। রহিম এ বাড়ির কাজের ছেলে। করিম বিয়ে করেছে আজ ছয় বৎসর হলো। কোলে ছেলেপুলে নেই। গেরামের ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে আমেনাকে। কিন্তু কাজ হয়নি। আসলে ওষুধ উল্টো জাগায় পড়েছে। অসুখটা করিমের।
করিম মুন্সি এ গায়ের জমিদার। হ্যা, জমিদারই বলা চলে। তবে ইতর জমিদার। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ জমিজিরাত করিমের নিজের নামের। বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের আমলে কী করে যে এত জাগা-সম্পদ তাদের হাতে চলে এসেছে তা কেউ জানে না। তবে বুঝতে শিখে, করিমকে দেখে তারা বুঝতে শিখে কী করে ধন-সম্পদ বাড়াতে হয় এবং রক্ষা করতে হয়। ছাব্বিশ দোন ক্ষেত করিমের। অথচ কোনোদিন দোকানে বসে এক কাপ চা পর্যন্ত খায়নি। ধান পেকে গেলে, যখন কামলারা সবাই দুই হাতে ধান কাটে করিমের ক্ষেতের, তখন করিম পিছা হাতে তাদের পেছনে পেছনে ঝাড় দেয়। মাটিতে লুকিয়ে থাকা পাখিদানাটুকুও করিম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোলে। নিজের শষ্যের একবিন্দু সে ছেড়ে দিতে রাজি নয়।
আশ্বিনের রোদ। আমেনা বধু হয়ে আসলো এ বাড়িতে । ঘোমটা পড়া চামেলি ফুলটা এত বড় বাড়ি দেখে খুশি হয়েছিলো। ভেবেছিলো স্বর্গ হয়তো সয়ং নেমে এসেছে তার কপালে। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই। দু’তিন জন রাখাল। সারাবছর ক্ষেত-খামারি দেখার জন্য জনাতিনেক বছর কামলা। আর সকল কামলার কামলা করিম মুন্সি, সে তো নিজেই একশো।
কিন্তু সুখ স্থায়ী হয়নি আমেনার। বিয়ের বছরই শ্বশুরটা মরলো। সেও এক ভয়ানক পিচাশ ছিলো। একমাত্র ছেলে করিমকে নিতে দেয়নি তাকে ডাক্তারের কাছে। লোকে বলে, বুড়োটা চিকিৎসা না করাতে মারা গেছে। করিমের এসব শুনতে লাগে। সে নিতে চেয়েছিলো, কিন্তু বাপটা গো ধরল কি ধরলো! না, ডাক্তারের কাছে সে কিছুতেই যাবে না। হায়াত না থাকলে মারা যাবে। কিন্তু ওষুধ কিনে অপচয় করার মতো ফালতু লোক সে কিছুতেই নয়। করিমও কি কম কৃপন। বাবা একবার বলাতেই রাজি হয়ে যেতো, কিন্তু আমেনা কি মনে করবে? তবু সে দু’তিন বার সেধেছে, বলেছে, মরার সময়ও কি মানুষের ধনের লোভ যায় না। বৃদ্ধ কষ্টে হেসে বলেছে, না যায় না।
আসলে ধনের লোভ আমেনারও যায় না। তাই তার কষ্টটাও বাড়ে। রাত হলে করিম ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে পাশ ফিরে। রাতের বেলায় করিমের দেহে জরও আসে প্রতিদিন। আমেনা গা হাত টিপে দেয়। করিম এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কখনো কখনো বানচিলিকের মতো করিম হয়তো জেগে উঠে। কিন্তু সে ওঠাকে ওঠা বলে না। আকাশের বিদ্যুত চমকেরো স্থায়িত্ব আছে, কিন্তু করিমের নাই।
এভাবে একের পর এক দীর্ঘ দিবস-রাতগুলি পাথর হয়ে গেলে আমেনার মনে বিষ ডুকতে থাকে। বিষের জ্বালায় আমেনা অস্থির হয়। ছোবল মারে কাজের লোক রহিমের উপর। আমেনার বিষ রহিমের সারা দেহে ছড়িয়ে গেলে তারা চুপি চুমি মিল করতে থাকে যোগফলের। একদিন অংক মিলে গেলে তারা পরস্পরের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে নিঃসীম দিগন্তের রাতের অন্ধকারে।
আমেনা হাতটা শক্ত করে ধরে রহিমের। রহিমের পেশিবহুল হাত আমেনার হাতটাকে পেঁচিয়ে ধরে। গ্রামের অন্ধকার ভেদ করে তারা চলছে। রাত বারোটা অবধি তারা হেঁটেছে তিন ঘন্টা, পাড়ি দিয়ে এসেছে তিন ক্রোষ পথ। পথ তবু তাদের ফুরায় না। তাদেরকে যে আরও দূরে যেতে হবে। আরো দূরে, আরো আরো দূরে। অনেক দূরে হারিয়ে যাবে তারা। অনেক দূরে। কোনো এক উপত্যকার তীরে ছোট্ট একটি বাসা বাঁধবে তারা। তাদের কোল জুড়ে খেলা করবে ছোট্ট ফুটফুটে শিশু। সেসব অস্থির ভাবনায় তাদের রাতের পথ তেমন যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় না। তারা পরস্পরের হাত ধরে পরস্পরের হৃদস্পন্দন অনুভব করে পথ এগোয়।
ভোরের আগে আগে তারা ছাব্বিশ মাইল পথ চলে এসেছে। আখাউড়া থেকে ভোরের প্রথম ট্রেনে চেপে বসেছে কুমিল্লা গন্তব্য করে। কুমিল্লা এসে তারা সকালের সোনারোদে একটি বাসাও পেয়ে যায়। নদীর ধারে। পালপাড়া ব্রিজের কাছে ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরটি তাদের আশ্রয় হয়ে উঠে। ধর্মমতে বিয়ে তাদের হয়নি। কিন্তু মনের ধর্মই বড় ধর্ম। স্বামী-স্ত্রী সংসার করতে থাকে। রহিম সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় আসে। আমেনাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে কোয়েল পাখির মতো। চুমুতে চুমুতে আমেনার উজ্জ্বল মুখ রাঙা হয়ে উঠে।
আমেনার এ সুখও সয় না। একদিন দুপুরের নজর পড়ে আমেনার উপর বাড়িওয়ালার। তার নজর তীক্ষè। আমেনাকে বিদ্ধ করে যেনো। আমেনা দ্রুত রোদের আঁচলে শাড়ি মেলে দিয়ে দৌঁড়ে ঘরে পালায়। বাড়িওয়ালা মিটিমিটি হাসে। আরেকদিন দুপুরের বেলায় বাড়িওয়ালা এসে আমেনার কাছে জল চায়। বাড়িওয়ালা চেয়েছে, আমেনা না দেয় ক্যামনে। দরজা খুলে পানি দিতে গেলে ইচ্ছে করে আমেনাকে ছুঁয়ে দিয়েছে বাড়িওয়ালা। আমেনা দ্রুত দরজা ভেজিয়ে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে। রহিম বাড়ি আসলে সবকিছু খুলে বলেছে রহিমকে। রহিম আশ্বাস দিয়েছে খুব শীঘ্রই তারা নতুন বাসা দেখে উঠে যাবে। আমেনা যেনো সাবধানে থাকে সে ইঙ্গিতও দিয়েছে তাকে। কিন্তু ইঙ্গিত কাজ হয়নি। সেদিন রাতেই আমেনাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়িওয়ালা। হাত-পা বেঁধে, মুখ বেঁধে মারতে মারতে অজ্ঞান করে রহিমকে গাড়ির ডিকিতে তুলে নিয়ে ফেলে দেয় গোমতি নদীর ভাটিতে। তারপর আমেনাকে নিয়ে বিশ্বরোডের এদিকে একটি হোটেলে উঠে বাড়িওয়ালা।
রাতভর অকথ্য বর্বর আনন্দে মেতে থেকে সকালের দিকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় তাকে হোটেলের লোকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। হোটেলে সারাদিন তালাবদ্ধ থাকে আমেনা। কাস্টমার এলে বাহির থেকে দরজা খুলে দিয়ে আবার বাহিরে তালা মেরে দেয়া হয়। হোটেলের চার দেয়ালে আমেনার আকাশ দেখা হয় না। সময়ে সময়ে খাবার দিয়ে চলে যায় একটা মানুষ। তাও দরজার তল দিয়ে। কে যায়, কে দিয়ে গেলো কিছুই দেখার সুযোগ নেই আমেনার। কেবল মুখ বুঁজে সহ্য করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
ভাবে, পুলিশ এসে একদিন উদ্ধার করবে তাকে। কিন্তু পুলিশ আর আসে না। হোটেলের এ অংশটা ব্যাজমেন্টের নিচে। ফলে পুলিশ আসলেও উপর দিয়ে সাজানো গোছানো আবাসিক হোটেল দেখে তারা ফিরে যায়। অথবা পুলিশও জানে ব্যাপারটা। হয়তো এ ব্যবসায় তাদেরও হাত আছে, আছে লাভালাভের হিসাব। তাই নির্বিগ্নে চলতে থাকে নগর সভ্যতা ও পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে নগর কদর্যতা।
করিমের বাপের বংশের আর কেউ নেই। নিজের বংশের কেউ হওয়ার আগেই বৌটা ভেগেছে। করিমের কেমন যেনো উদাসীন উদাসীন লাগে আজকাল। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কাজকর্মে মন নেই। জমির ধান শুকিয়ে তামা হতে থাকে। কামলারা বলে, প্রভু, আবার বিয়া করেন। সব ঠিক হয়া যাইবো। কিন্তু কিছুই ঠিক হয় না। করিমের আর বিয়ে করতেও ইচ্ছে জাগে না। কেমন যেনো বৈরাগ্য ভাব চলে আসে তার ভেতর। কেবল রাত হলে প্রবলভাবে মনে পড়ে আমেনাকে। চোখের তারায় তখন আমেনা ভানুমতি-খেল হয়ে দেখা দেয়। তার রাতের ঘুম চলে যায়। একটা গরম আগুন তখন মেরুদ-ের ভেতর দিয়ে জেগে উঠে। প্রবলভাবে নাড়ায় তাকে। একসময় লাভাবিস্ফোরণ করে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ে করিম। আহা, সুখ। এই সুখের জন্যই তো আমেনা আজ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। আগে এমন সুখের মজা বুঝলে তার হয়তো চামেলি ফুলের মতো বৌটাকে হারাতে হতো না।
ডাক্তারের কাছে যায় করিম। ওষুধ খায় যৌনশক্তি বাড়াতে। তারপর প্রস্টিটিউটের খোঁজে যায় শহরের দিকে। বাড়ি থেকে ছাব্বিশ কিলোমিটারের পথ আখাউরা। সিএনজিতে যেতে বড়জোড় ঘন্টাখানেক লাগে। তারপর ট্রেনে উঠে সোজা কুমিল্লায় গিয়ে নামে। এ হোটেল ও হোটেল করে অনেক মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছে সে। কিন্তু সে তৃপ্ত হয়নি। কোথায় যেনো একটা গোপন অতৃপ্তি থেকেই যায় শেষমেষ। যার কাছেই উদগমিত হয়, তার মুখেই সে আমেনার মুখ খোঁজে। কিন্তু আমেনার মতো চামেলিফুলের শোভা কয়জনের আছে। সুখ পায় না করিম। ভ্রমরবিভ্রান্তি নিয়ে এ ফুল থেকে সে ফুলে, ও ফুল থেকে অন্য ফুলে হন্যে হয়ে মরে।
করিমের মা মারা গেছে শৈশবে। লোকে বলে জন্মের তিন দিনের মাথায়ই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে সে। এ নিয়ে অবশ্য অনেক কথা আছে। লোকে বলে, বাঞ্জা বুইড়ার ঘরে সন্তান? অসম্ভব। এই সন্তান কোনো কাজের লোকের টোকের হইব। এই কলঙ্ক ঢাকতেই নবপ্রসূতা বিষপান করে। আজ করিমের মনে মায়ের কথা ভাসছে ভীষণ। কেমন ছিলো তার মা। তার মা কি সত্যিই কারো সাথে শুয়েছিলো? সে কি অন্য কারো সন্তান। হলেই বা হলো কি? তার মাকে মরতে হলো কেনো? ছেলেসহ মাকে বের করে দিতো। বড় হয়ে করিম মায়ের চোখের জল মুছে দিতো গভীর মমতায়।
আজ হোটেলে বড় কোনো খদ্দের এসেছে। সাবসুবা মানুষ। হোটেলের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। করিমকে আজ পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। এ ব্যাপারটি করিমের মনে খুব লাগে। সে জানে, এরকম সাবসুবা সে দুচারটা কিনে ফেলতে পারে। হ্যা, সে হয়তো সাহেবদের মতো কোট টাই পড়ে না। তার হয়তো ফটাস ফটাস ইংরেজি বলার বিদ্যা নেই। কিন্তু তার ধন সম্পদের কমতি তো নেই। সে এগিয়ে যায় মেনেজারের দিকে। মেনেজার তাকে অবজ্ঞাভরে দূরে সরাতে চায়। করিম সরে না। বলে, অই লোক কত দিবো। দশ হাজার। করিম বলে আমি দিমু চল্লিশ হাজার। মেনেজার হেসে বলে, কন কি স্যার? আর দুই গুন বাড়ালে তো আপনাকে সারাজীবনের জন্য দিয়ে দিতে পারি। হ, পছন্দ হইলে সারা জীবনে জন্যই কিন্যা লইয়া যামু।
অন্ধকারে মুখটা ঠাহর হয় না করিমের। এই কি আমেনার মুখ? না, না, এমন হতে পারে না। বিছানার এক কোণে বাঁশি ফুলের মতো লুটিয়ে আছে আমেনা। আমেনাও চিনতে পারে না করিমকে। না না, এ হতে পারে না। যেই লোক ছয় বছরে ছয়বারের মতো জেগে উঠতে পারেনাই সেয় কীভাবে মাইয়া মানুষ খুঁজতে হোটেলে আইসবো? না না, এ হতে পারে না। কিন্তু তারপরেও এ-ই হয়। করিম চিনতে পারে আমেনাকে। আমেনাও চিনতে পারে করিমকে। তারা পরস্পর গলাগলি করে কান্দে। আমেনা পায়ে পড়ে করিমের। আমারে তুমি মাফ কইরা দাও। করিম আমেনাকে টেনে বুকে নেয়। আমিও আর নিষ্পাপী নই। কত রমনীর কাছেই তো গেছি, নিজেরে নষ্ট করছি আমিও! চল, এই বার ঘরে ফিইরা চলো। আমেনা বিস্ময়ের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে করিমের মুখের দিকে।
মো. আরিফুল হাসান
কুমিল্লা, বাংলাদেশ
পদাবলি ০১
নতুন ভোরের অপেক্ষায়
শাহ জালাল শামীম
পরিচিত মুখগুলোর অনেকে হারিয়ে গেছে
পেটের তাগিদে ছিটকে গেছে অনেক মেধাবী মুখ।
স্বামীর অত্যাচার মেনে নিয়ে গুমরে পড়ে থাকা মেয়েটির চোখ জ্বলছে।
সবাই ভাতের হোটেলে কাজ নিতে চায় কেন!
অনেকে ফিরতে পারে না
ইচ্ছে হলেই ফেরা যায় না।
বলা যায় না ভালো আছি
বলা যায় না ভালোবাসি!
তবুও চাই, নতুন ভোর আসুক।
বুকের বাঁ পাঁজর ভেঙে যায়
রুদ্র সাহাদাৎ
বুকের বাঁ পাঁজর ভেঙে যায় অজানা শঙ্কায়
পাখিদের গান শুনি না কোনোখানে
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনি নৈঃশব্দ্যে অন্ধকার পথে
জোনাকিপোকাও অভিযোগে অভিমান করে আছে।
আলীশান রোড়ের মোড়ে বসে থাকি
হারিয়ে ফেলেছি সব স্মৃতি চিহ্ন।
মানুষ জন্মসূত্রে নিজে নিজেই একা
স্বার্থে অভিনয় মানুষে মানুষে দেখা।
দম ফুরালে সবই শেষ
সাড়ে তিন হাত মাটিতে নিঃশেষ
বুকের বাঁ পাঁজর ভেঙে যায় অজানা শঙ্কায়
কখন কে আসে কখন কে যায়
হিসেব নেই জীবনপাঠে...
আফসার স্যার
মিসির হাছনাইন
চোখ ভিজে গেছে নীরব দাঁড়িয়ে থাকা গাছদেরও কি এক গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন স্যার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে.. এতো এতো করে যে ডাকলাম মনে হল, এখনই চোখ খুলে তাকাবেন, সাদা কাপড়ের যে ফুল ঝরে পড়ে আছে ঠান্ডা হিম ঘরেথ কতটা প্রিয় সে চেনা হাসিমুখ দোল খায় হৃদয়ে হৃদয়ে দূর আকাশের নক্ষত্রথ জীবন জানে কিনা জানি না! যে সান্নিধ্য কখনও মনে হবে না ফুরিয়ে গেছে আপনাকে হারিয়ে এই শরৎ ভাঙা সময়ে চলে যাবে দিন যদি কখনও নক্ষত্র জীবনের মানে বুঝতে পারি, দেখা হবে নক্ষত্র জীবনে।
পদাবলি ০২
অহংকার
হাফিজুর রহমান
এই নে-রে ভাই, একা খাবে তালের রস;
সিন্দুকে তুলে রেখে তোর অর্জিত যশ,
একটি কথা জেনে রেখো তবে
কোনকিছুই নয় অবহেলার
প্রয়োজনে আছে সবে।
কার ঘরের দুয়ারে, কখন যে যাবে কে!
কী প্রয়োজনে কেন, সময় বলবে ডেকে,
বড়াই করো না অর্থ- সম্মানের
নিমিষেই যাবে ধূলায় মিশে
সবেই হবে অপমানের।
দুর্ভিক্ষের নায়ক
আহমাদ সোলায়মান
জীবনের দিনে আর সূর্যের আলো নেই
চোখ দু’টো যেন এক কঙ্কাল নদী
সময়ের ঘড়িটার ফুরিয়েছে ব্যাটারি
দিক ভুলে সকালের ঘুম ভাঙে যদি!
কৃত্তিম হাসিগুলো ঠোঁট খুজে ক্লান্ত
পা দুটির কোনোদিন ভাঙলো না ভ্রান্ত
এই যদি হয় এক জীবনের সংগ্রাম
দুর্ভিক্ষের নায়ক দেওয়া যায় এর নাম।
মৃত্যু মায়াবিনী
সাকিব জামাল
মৃত্যুকে আমি বেশ কাছে থেকে দেখেছি, কয়েকবার।
শান্ত, শুভ্র প্রেমিকার মতো ভীষণ মায়াবিনী।
ভালোবেসে আমাকে জড়িয়ে নিতে চায় বুকে অনন্তকাল।
না, ভৌতিক কোনো রূপ নেই তার,
নেই ভয়ঙ্কর কোনো কর্কশ স্বর।
কেবল লজ্জাবতীর মতো রহস্যময়তা আছে-
কাছে আসে আবার আসে না!
তবে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, অলৌকিক মায়ায়-
একদিন কাছে আসবেই। আলিঙ্গন হবে বিরামহীন প্রেমে!
এ কেমন নীরবতা?
মাহতাব উদ্দিন
হে সাগর,
এ কেমন নীরবতা?
তব বক্ষে চলছে না তো কোনো পোত
বিশাল জলরাশির মাঝে
তুমি আজ খরস্রোতা।
মড়মড় শব্দে ভেসে চলা ঢেউগুলো থেকে
কান্নার আওয়াজ আসছে ধেয়ে!
যেন এক মৃত্যুপুরী।
দূর আকাশের নীচে নৌযানে মাঝির কণ্ঠে;
ভাটিয়ালি সুর ভেসে আর আসে না যে!
নদীতটে বৃক্ষরাজি,
নির্বাক দাঁড়িয়ে যেন অশ্রুপাতে।
অতিথি আসন !
অতিথি আসন
শফিক নহোর
রাইপুর বাসস্ট্যান্ডে আমি দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির অপেক্ষায়। চোখের পলকে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমি পা সামনে বাড়িয়ে দিলাম। তখন একটি অটোরিকশা এসে আমার পথ বাঁধাগ্রস্তকরল। গাড়িটি আর একটু সামনে এগিয়ে গেল। আমি হাত উচিয়ে হেলপারকে ইশারা করলাম। গাড়ি থেমে গেল।
গাড়িতে উঠে একটি অষ্টাদশী মেয়ের চোখে আমার চোখ আটকে গেল । নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আমি আবারও তার চোখের দিকে তাকালাম। অবশ্য মেয়েটি তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল।
মেয়েটির মুখোমুখি ছিটে আমি বসে রইলাম। একটু মাথা উঁচু করে তাকালে সোজাসুজি দৃষ্টি চলে যায় মেয়েটির বক্ষে । গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমি মেয়েটার পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। এবং বুকের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম এবং তার মুখের দিকে তাকালাম। এমনভাবে তাকালাম মেয়েটি বোঝার কথা নয় কিন্তু মেয়েটা অত্যন্ত আধুনিক এবং ট্যালেন্ট মনে হল। আমি অনুভব করতে পারলাম, মেয়েটি আমার তাকানো বুঝতে পেরেছে। দৃষ্টি সংযত করে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
আমি গাড়ির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটা আমার দিকে দু'বার তাকিয়েছে, সেই তাকানোর ভেতরে বিরক্ত মিশ্রিত ছিল।
হঠাৎ তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। মেয়েটি ফোন কেটে দিল। তের সেকেন্ড পর মেয়েটির মোবাইল ফোন আবার বেজে উঠল।
মেয়েটি দ্বিতীয় বার ফোনটা কেটে দিল।
তার পর ফোনের ডাটা অন করে সে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ল। ডাটা সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নোটিফিকেশনের শব্দ শুরু হল। মেয়েটি ফোনের বাটন চেপে সাউন্ড কমিয়ে দিল।
কন্টাক্টর একজন ভাড়া কম দিয়েছে খিস্তি দিয়ে বলে উঠলো,
আগে কইবেন না মিয়া! হুদাই ক্যাচাল করলাম ।
মামা আপনি কই যাইবেন। ভারা দ্যান।
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
সামনে যাবো, পরে দিচ্ছি।
এইযে আপা কই যাইবেন? ভাড়াটা দেন?
মেয়েটি তার কথায় কর্ণপাত না করে মনোযোগ দিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে চ্যাট করছে; আমার দৃষ্টি আবারও তার চোখের দিকে আটকে গেল। মেয়েটির চোখের কোণায় শিশিরবিন্দুর মতন জল জমে আছে। এক ফোটা জল গড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে পড়ল।
মেয়েটি তার জর্জেট ওড়না বুকের কাছে হাত দিয়ে টেনে ধরল।
আমার যেখানে নামার কথা সেখানে না নেমে আমি মেয়েটিকে ফলো করতে শুরু করলাম।
মেয়েটির সম্ভবত ডাটা অফ করে ফোনটি ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর রেখে দিল।
জর্জেট ওড়না তার বুক থেকে বারবার বাতাসের সরে যাচ্ছে। সে বারবার নিজের ওড়না ঠিক করছে আর চোখের জল মুছছে।
গাড়ি থেমে গেল শেষ স্টেশনে এসে। ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম
মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে একটি ফ্লেক্সিলোডের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো ।
আমি তার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তার শরীর দিয়ে মিহি সবরি কলার ঘ্রাণ বের হচ্ছে ।
আমি পিছন থেকে বলে উঠলাম; ভাই আমার নম্বরটা একটু দ্রুত লিখুন ।
মেয়েটি পাশ কেটে বেরিয়ে গেল।
পাশের দোকান থেকে একটি সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করতেই পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
আমি হ্যালো হ্যালো বললাম, ওপাশ থেকে কোন সারা শব্দ এলো না। নেটওয়ার্ক সমস্যা ভেবে আমি ফোনটা রেখে দিলাম।
সিগারেট শেষ করে ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বরটা ডায়াল করলাম।
একজন বয়স্ক বৃদ্ধ মহিলা তার কণ্ঠ শুনে মনে হল সে হাঁপানি রোগী। কথা বলতে তার সমস্যা হচ্ছে ।
আমি বিনয়ের সাথে তার কাছে জানতে চাইলাম।
আপনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন? কে বলছেন, কোথা থেকে বলছেন?
সে জোরেশোরে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
দীপা, দীপা দেখ তোকে কে যেন ফোন দিয়েছে।
ফোনের লাইনটি বিচ্ছিন্ন হয়নি আমি প্রত্যাশায় ছিলাম; কেউ একজন হ্যালো বলে উঠুক। অতঃপর কর্কশ গলায় বলে উঠল,
মানুষের আর ফোন দেবার সময় নেই। হুট হাট যখন তখন ফোন দেবে।
ফোনটি হয়তো তখনো মেয়েটির মায়ের হাতেই আছে। এই শব্দটি দূরবর্তী একটি শব্দ হয়ে আমার ফোনে বেজে উঠলো।
হ্যালো কে বলছেন?
আমি রাসেল বলছি,
কোন রাসেল?
তার শেষ বাক্যটি শুনে মনে হল সে বেশ কয়কজন রাসেল নামের ছেলেকে চেনে।
আমি কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে তাকে অভয় দিয়ে বললাম,
ভয় পাবার কিছু নেই। আমি রাসেল, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী থাকি। আপনি কোথা থেকে বলছেন?
এ কথা শোনার পর,
মেয়েটি ফোনের লাইন কেটে দিল।
আমি পুনরায় নম্বরটা ডায়াল করে ফোন দিলাম । অযাচিত কণ্ঠে ভেসে আসলো। “আপনি যে নম্বরটিতে ডায়াল করেছেন, এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
অযাচিতভাবে মাথার ভেতর ঢেউয়ের প্রলেপ এসে আমাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটির কমল ঢেউ দোলানো শরীরের তক মোহনীয় আবেশ আমাকে ঘিরে ধরলো। মাল্টা আকারের আকর্ষণীয় বক্ষদ্বয়, জোনাকি আলোর মত সে দৃশ্যমান হতে লাগল চোখের সামনে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় আমি তার অবয়ব ভুলে অফিসের পথে রওনা দিলাম।
তিনদিন পর আজ আমার অফিস। কাকতালীয় ভাবে বৃহঃপ্রতিবার সরকারি ছুটি ছিল। ব্যাংক তো দু’দিন বন্ধসেটা সবার জানা। হাফ ওয়াল বিল্ডিং, উপরে টিনের ছাওনি গরমের দিনে মনে হয় কেউ গরম বালু শরীরে ঢেলে গিয়েছে। এর ভেতর পানি নেই, রাস্তার কাজের জন্য গ্যাস লাইন বন্ধ। কাজের বুয়া দুদিন এসে ফিরে গেছে । ছুটির এ তিনদিন আমার সঙ্গে ঘটে গেছে বেশ কয়েকটি ঘটনা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে গাড়ির সেই মেয়ে! সে আমার কাছে নামহীন, ঠিকনাহীন থাকলেও আজ সকালে নিশ্চিত হয়েছি, মেয়েটির নাম দীপা ।
ভেতরে ভেতরে একটা অনুভূতি কাজ করল। আমার মুখ দিয়ে দু’লাইন রবী ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের কথা বের হয়ে আসল।
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’
অফিসের ডেস্কে আমার সামনে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। আমি চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে মনিটরে চোখে রেখে কাজ করছি। হালকা একটু মাথা উঁচু করে তাকাতেই একটি মেয়ের আগমন ঘটল। সামনের জনের জন্য তা অদৃশ্য আমি দ্রুত কাজ শেষ করে একজনকে বিদায় দিতেই, পরের জন্য তার ফিক্সড ডিপোজিটের ড্রাপটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
-স্যার আমার টাকা কী আজ তুলতে পারবো?
আমি তার মুখ ও চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
- টাকা তুলছেন কেন? আপনার নমিনির নাম কি?
- স্যার নমিনির নাম আমার স্বামী ।
- ঠিক আছে, আপনার স্বামী বুঝলাম। তার নাম বলেন।
মেয়েটি আমার কথা শুনে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। আমি তাকে আবারও তাগাদা দিয়ে বললাম, আপানার স্বামীর নাম বলুন। সে একটু লজ্জা পেয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল, জালাল ।
পরের কাস্টমারের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ উপরে উঠে গেল । আমার গলা শুকিয়ে গেল। হাতের কাছে পানির পট ছিল তা মুখে লাগিয়ে ডক ডক করে পানি খেয়ে নিলাম। মিনি স্ট্রোক রোগীর মত আমার কথা অর্ধেক বের হচ্ছে অর্ধেক আমার গলার ভেতর কাটা ধিঁধে থাকলে যেমন লাগে ঠিক তেমন হতে লাগল। আমি তার মুখের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী নাম আপনার?
-দীপা !
- শুধু দীপা?
তার প্রতি উত্তরে কোন জবাব সে দিল না। পাথরের মত আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
- নমিনির নাম বলুন,
-মনিকা দীপা সাহা
- টাকা তুলছেন কেন? রেখে দিলে তো ভালো হতো ।
- আমার ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে বলেছি ?
মেয়েটি আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে কথাটা যখন বলল, তখন মনে হল কানের ভেতর কেউ গরম লোহার রড ঢুকিয়ে দিচ্ছে । আমি তাকে ইশারা করে ক্যাশ দেখিয়ে দিলাম। সে কতটা সাহস নিয়ে আমাকে এমন করে বলল, আমি শুধু তাই চিন্তা করতে লাগলাম।
অফিস ছুটির পরে সিন্ধান্ত নিলাম আজ দীপাদের বাসায় যাবো । শহরে আসলে কারো বাসায় খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি মিষ্টির দোকান খুঁজতে লাগলাম ।
মনের ভেতর থেকে বলে উঠল, মিষ্টির
চেয়ে ফল নেওয়া সবচেয়ে বেশি ভালো হবে । এক কেজি আঙ্গুর আর এককেজি কমলা কিনে একটা রিকসা নিয়ে সোজা চলে গেলাম। দীপাদের বাসায় ।
পুরনো একটা বাসা আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হল এখানে অনেক মানুষ আসে । আমি দীপাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল দিলাম। ভেতর থেকে দীপার মা দরজা খুলে আমাকে বলল,
- কাকে চাই?
-এটা কি দীপাদের বাসা ।
-জি!
- আপনি কে?
- আমি রাসেল ।
- এ নাম তো কোনোদিন শুনিনি ।
-তা দীপা তো আজ বাসায় নেই, আপনি দীপাকে ফোন করে আসেনি?
আমার শরীরটা ভালো না, শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে। বয়স হলে যা হয় । শরীরে রোগের অভাব নেই। কদিন আর বাঁচব। মেয়েটা খুব চেষ্টা করছে, আমাকে বাঁচানোর ।
আমার হাতের পলিথিন ব্যাগ দীপার মা সামনের ট্রে-টেবিলে রেখে আলাপ শুরু করল, দীর্ঘ আলাপ। এ বয়সে মানুষ কথা বলতে বেশি ভালোবাসে হয়তো।
-প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আপনি কি বাসায় একাই থাকেন?
দীপার মা হেসে বলল,
-একা থাকব কেন? আমার সঙ্গে দীপা থাকে । ওর যেদিন বাহিরে কাজ থাকে সেদিন রাতে আমি একাই থাকি ।
-সরি আপনার মেয়ে কী কোনো জব করেন? মানে গোয়েন্দা বা সরকারি কোনো জব।
-না ।
-তাহলে কীসের জব করে।
-মানুষের সেবা।
-মানে?
-শরীর সেবা।
-সরি আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার কথা।
-কেন দীপা আপনাকে কিছু বলেনি?
-আমার চিকিৎসার জন্য দীপা পেশাটা গ্রহণ করেছে ।
-আপনি কি পানি খাবেন?
-জি!
-কাঁপছেন কেন?
-না, ঠিক আছে ।
-দীপা তো শিক্ষিত,সুন্দরী ।
-শিক্ষিত মানুষই তো বেশি আসে।
কলিং বেল বেজে উঠল।
-এই অসময়ে আবার কে এলো । আপনি বসুন, আমি দেখছি ।
-কী রে দীপা ফিরে আসলি যে।
-সে ফোনে না করে দিয়েছে, কিন্তু টাকাটা বিকাশ করে দিয়েছে।
-তার টাকা নিয়েছিস কেন?
-কাজ না করে পরের টাকা নেওয়া ঠিক হয়নি ।
একটু সামনে এগিয়ে এসে তার মাকে প্রশ্ন করল,
-মনে হচ্ছে বাসায় কেউ অপেক্ষা করছে ।
-ও হ্যাঁ। তোকে বলা হয়নি।রাসেল এসেছে।
-কোন রাসেল?
-তোর বন্ধু?
-আমার বন্ধু!
দীপা সামনে এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কী যেন বলতে চেয়ে থেমে গেল। আমিও দীপাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
সে বিনয় স্বরে বলল,
-দাঁড়িয়ে গেলেন কেন?
-বসুন ।
- মা’ তাকে নাশতা দাও ।
-আপনি একটু কষ্ট করে বসুন। আমি ভেতর থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি ।
আমার জন্য দীপার মা প্লেট ভর্তি নাশতা নিয়ে এলেন । আমার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে সে তার রুমে গিয়ে খিল এঁটে দিল। কিছুক্ষণ পর দীপা আমার সামনে এলো।
দীপার দিকে তাকিয়ে আমি আরো অন্ধকারে ডুবে গেলাম। ঠোঁটের গাঢ় লিপিস্টিক গায়ে বিদেশি পারফিউমের ঘ্রাণে আমার নাক বন্ধ হয়ে আসছে। দীপা আমার হাত স্পর্শ করল। আমি পুলকিত হলাম। কী মোলায়েম হাত ওর।
দীপা আমাকে হাত ধরে তার অতিথি আসনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
আমি দীপাদের পেছন দরজা দিয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলাম ।
সেদিনের পর থেকে আমি এখনো দৌড়াতে দৌড়াতে পৃথিবীর পথ শেষ করেছি, তবুও দীপার গায়ের সেই ঘ্রাণ আমার নাকে এসে লাগছে এখনো।