তারুণ্যের লেখা পদাবলি

তারুণ্যের লেখা পদাবলি




ঢুকে পড়ছে স্বভাবে
সুজিত মান্না

কালরাতে হাজার যৌথ প্রস্থচ্ছেদ ঘটিয়েছি আমার
নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছি
―আমাকেও কি একদিন হিমঘর বেছে নিতে হতে পারে

বিজয় এসে বলে গেছে
―জীবনের আশ্চর্য মাত্রা দিয়ে কীভাবে
     কুয়াশার স্টেশন পেরিয়ে
                                 সমতা বজায় করে চলতে হয়

আমি তো এভাবে ঘাসপাতা বেছে বেছে ঠোক্কর খেতে চাইনি
ঘুমোবার আগেও দেখে নিয়েছি
মাড়িয়ে দেওয়া দৌড়ে কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো

এভাবে রোজই কতবার শরীরের লোডশেডিং হয়
পেছনে ছুটতে গিয়ে মনে হয়
আমিও কালিগহ্বরে ঢুকে পড়ছি স্বভাবে এবং বৃষ্টি চুষে

আমার বেঁচে থাকা
পরান জহির

চর্যাপদ লালন হাসন রাধারমণ শীতলাং ফকির জ্বালালের
গীতিসমুদ্রে সিক্ত সমগ্র বাংলাদেশের অমরাত্মাগণ।
আপামর পাখির কণ্ঠে কণ্ঠে নতুন ধানের গান।
ধানের ভিতর প্রোথিত স্বপ্নের নবান্ন।
এইসব বুকে ধরে বেঁচে আছে প্রাণ স্ব সংস্কারেই।

তাঁতি কামার কুমোর চাষার স্বপ্নে বিদেহী মাকড়।
কোন অদৃশ্য নখরবাজের কোপানলে এ শিকড়।
গানশালিকের তুলতুলে ডানায় না ছুঁক অন্ধকার
বৃহত্তর বদ্বীপের ওষ্ঠে জেগে থাক সুর কবিতারা !

পৃথিবীর জন্মদিন-০১
আহমেদ ইউসুফ

পাখিরা গান শুনাবে- পৃথিবীর জন্মদিনে, প্রজাপতিরা রঙ ছড়াবে ফুলে ফুলে, সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলেরা সৌরভ ছড়িয়ে দিবে বাতাসে, নির্মল বাতাসের সমুদ্রে প্রত্যুষের সূর্যকুসুম এক গাল হাসি হেসে বলবে- শুভ জন্মদিন তোমার...

ঝিরিঝিরি হাওয়ার তালে তালে পাতারা নেচে ওঠবে- পৃথিবীর জন্মদিনে, মৃদু তরঙ্গে নদীতে নেচে ওঠবে ডিঙিনৌকা, পালতোলা নায়ে মাঝিরা গেয়ে যাবে ভাটিয়ালি গান, সেই গান শুনে সম্মোহিত মাছেরা বলবে- শুভ জন্মদিন তোমার...

শুভ্রনীল আকাশে মেঘের ভেলা ভেসে যাবে- পৃথিবীর জন্মদিনে, মেঘের খামে কাশফুল শুভ্রতা মেখে দিবে, শাদা বলাকা উড়ে যাবে দূর থেকে সুদূরে, বলাকার জলছায়া পথে হেঁটে যাবে দুরন্ত জলপিপি, পদ্মপাতায় বসে থাকা ক্ষুদে সোনাব্যাঙেরা সহসা হাসিমাখা মুখে হেসে বলবে- শুভ জন্মদিন তোমার...

হাওয়ার তালে তালে ধান কাউনের মাঠ জল তরঙ্গের মতো নেচে ওঠবে- পৃথিবীর জন্মদিনে, ঘাসফড়িঙ হেসে খেলে নেচে যাবে পাতায় পাতায়, ধান ক্ষেতে পুঁতা বাঁশের কঞ্চিতে বসে থেকে কালোজিরা কালো ফিঙেরা লেজ নাচিয়ে নাচিয়ে বলবে- শুভ জন্মদিন তোমার...

সর্ষে ফুলের হলুদ মাঠখানি সোল্লাসে হেসে ওঠবে- পৃথিবীর জন্মদিনে, মোহমুগ্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দিবে আনন্দধ্বনি, হৃদয়ের মাঠে চাষ হবে গল্পের রাঁধুনী, হলুদ খাম খুলে চিঠি পড়তে থাকবে প্রিয়জন, রৌদ্রস্নান করবে শিশুফুল, দন্তবিহীন বৃদ্ধেরা শিশুর মতো মুখে হেসে বলবে- শুভ জন্মদিন তোমার...


রিং অথবা আংটি
সৈয়দ শরীফ

সেইদিন থেকে আপনাকে বড় নাট্যকার মনে হয়
হে উপভোগ্য জীবন-(অনেকটা ঈশ্বরের মতো)
যেদিন একটি আংটি কিনে দিতে না পারায়
আমার প্রথম প্রেমিকা আঙুল ভাবতে শুরু করেছে
বন্ধু রাসেলের আঙুল- আহা কী স্বর্ণের আঙুল !
ওর ছোট বোনের বিয়েতে যৌতুক দিতে না পারায়
মেয়েটিকে সহ্য করতে হচ্ছে শাশুড়ির অত্যাচার-
কিছু মানুষ খাওয়াতে ভাঙতে হয়েছে, ছোট ভাই
আতিকের নামে করা- চল্লিশ হাজার টাকার এ্যাকাউন্ট;
হঠাৎ ওর সরকারি চাকরিটা চলে যাওয়ায়,
সংসারে ভেসে উঠলো অভাবের ছায়াচিত্র;
(যদিও চাকরী চলে যাওয়ার পেছনে দায়ী রয়েছে
আঙুলবাজি অথবা নৌভ্রমণ।)
রাসেল এখন অসুস্থ-
শুনেছি হার্টের কোথায় যেন তিনটি ছিদ্র
ধরা পড়ায়, ওখানে এখন রিং বসানো প্রয়োজন;
অপারেশনেও বেশকিছু লাগবে বলে
ওর বাবা বিক্রি করে দিলেন একমাত্র রিক্সার গ্যারেজ
এবং গ্রামে অবশিষ্ট তিনকাঠা জমি।
(যদিও এসবের ক্রেতা ছিলেন প্রেমিকার বাবার একমাত্র ছোট মেয়ে)
এরপর,
প্রেমিকের নিজেরই রিং প্রয়োজন বুঝতে পেরে
অসুস্থ প্রেমিককে কেবিনে ফেলে, কোথায় যেন চলে গেলেন
মহামান্য প্রেমিকা— হয়তো নতুন কোনো
আংটির প্রয়োজনে....


সুখ ডানা
রুমান হাফিজ

দ্রুততার সাথে তুমি কাছাকাছি এসেছ
খুব কাছে বসে তুমি প্রাণ খুলে হেসেছ

সুখ, দুখ, রাগ ক্ষোভ সবটাই বলেছ
আনমনা হলে পরে কানটাকে মলেছ!
স্বাধীনতা ছিল তাই ইচ্ছাতে চলেছ
আধারেই ডাকা মনে আলো হয়ে জ্বলেছ।

মান অভিমান করে দূরে কভু ঠেলেছ
পড়ে যাই ভয়ে তাই সুখ ডানা মেলেছ।

তৃষ্ণার্ত
সাজিয়া সুলতানা মিম

রঙ্গিন গ্রীল তবু ময়লা
আকাশ বোবা মেঘে ঢাকা,
ফাল্গুনে গাছ নগ্নতার শিকার
রংচটা দেয়ালে ভুলেও টিকটিকি আসেনা।
মাকড়সা পরিবার খুঁজে নির্জন স্থান
নৌকার পেরেক জলকে ছিন্ন করতে ভয় পায়
স্বপ্ন মাতাল বাস্তব হওয়ার নেশায়!
মুহূর্ত যুদ্ধ করে স্বার্থপর ঘড়ির কাটা ভাঙ্গবে বলে
অক্ষর মিথ্যের েেবড়াজালে আটকানো,
ভেজা বিড়ালের কাকের ডাকে অবাক মৃত্যু
ভালোবাসার কপাটের সামনে অনুভবের বিকৃত ছাঁই।
ইট গুলো আবারো পুড়তে চায় আত্মশুদ্ধির জন্য
বৃদ্ধের পাকাচুল সাক্ষী দিতে রাজি শতযুগের গল্প
অবাধ্য মন ও রাত্রি জাগা এলোমেলো ভাবনাই,
মুক্ত মাটির বিলাসী চাওয়ার অন্ত নেই
ভাঙ্গা কন্ঠে নীল চিরকুটের মিছিল
অপরাধী সর্প ক্ষমা চায় তার বিষে মৃত ব্যক্তির কাছে।
মাইক আর পারছেনা নিত্য শোকের  ভাষা বলতে
জীবন ক্লান্ত এই দেহের চাহিদা মেটাতে
তৃষ্ণার্ত বড্ড তৃষ্ণার্ত !


মাগো তুমি ক্যামন আছো ?
নূরনবী সোহাগ

এ্যাহানে বিষ্টি নামে না বাড়তের লাহা, 
ঝরনা ঘুরাইয়া দেলে পানি পরে হাঙ্গা গা ভেজে
হাঙ্গা বুকটা ভেজাইতে পারি না এ্যাহানে ছাওয়া নাই
রৌদের গন্ধ থাহে- আন্দার অইলেও
নুন, প্যাঁজ কচলাইনা পান্তা নাই, কতদিন খাইনা মাচার হাক !
এ্যাহানে ক্যামন জানি খাওন না খাইতে না খাইতেও খাইতে অয়;
এ্যাহানে হাটবার নাই, মামাবাড়ি যাওন নাই, মাছধরা নাই,
বোনভাত নাই, গতরে জিরান নাই, মানুষগুলা ক্যামন জানি!
ইংরাজী খবরের লাহান কতা কয়
চোহে ঘুম আইতে চায় না, ব্যাবাক রাইতে
রাইত্তা দুফার অইলে মনে চায় নাড়ায় ঘুমাই; জন্মের লাহান
বিদ্যাশ মরণের লাহান এতো দূর ক্যান?
কতোদিন মায়রে দেহিনা, ডাহিনা- মাগো তুমি ক্যামন আছো ?




ভালো আছি
আলমগীর কবির

একশত আলোকবর্ষ দূরের
মিটিমিটি জ্বলে থাকা
তারাটির মতো,
মুখে হাসি নিয়ে
আমি ভালো আছি।

না চঞ্চলা না কাব্যিক,
সাগরকে জানবার
সাধ নেই তিলেকমাত্র
সে নদীটির মতো,
বুকে ব্যথার ঢেউ নিয়ে
আমি ভালো আছি।

প্রেমিকা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

মাঝরাতে মিস কল !
শিশুর কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে
যেমনটা বিরক্ত আসে
ভ্রু কুচকে তেমনই প্রতিক্রিয়া আমার ।
পরপর আরও তিন বার !
তখনও  বুঝতে পারিনি কে হতে পারে-
ফের নিজেই ডায়াল করি এগারো ডিজিট
শুধু হ্যালো.... !
অদ্ভুত মায়া-জড়ানো একটি নারী কণ্ঠ- 
কেমন আছো তুমি ?
আমি আদৌ ভালো ছিলাম না
কিন্তু ভালো হয়ে গেলাম।
চিরচেনা সেই পুরানো স্বর
কেমন আছ তুমি ?
বুকের ভেতর কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠল
আমি কী সত্যি শুনলাম ? না কল্পনা !
নিজেকে নিজেই চিমটি কাটি ।
ভালোবেসে ভালো থাকা দায়-
আমি পারিনি ধরে রাখতে
ধরে রাখা দায় না, অপরিণত প্রেম ।
কিছু আলাপের পর-
পুরাতন দিন মনে পড়ে, কিছু পুরানো স্মৃতি।
বাঙালির গৃহস্থ কেচ্ছা, লবণ ভাত
অতঃপর, ভাড়াবাড়ি তাদের
মাস তিনেকের সংসার মাত্র।
গত তিন দিন হলো-
স্বামীকে খুঁজে পাওয়া  যাচ্ছে না। 

বৃষ্টি
মিসির হাসনাইন

চৈত্রের মাঝরাতে যখন বৃষ্টির শব্দ শুনি
বুকের ভিতরের বৃষ্টি হঠাৎ থেমে যায়।
মেঘে উড়ে কালো মেঘের মেঘচিঠি
আচমকা, আলো চমকায়, বিবট এক শব্দ হয়।
মনে হয় কোন এক রাজমিস্ত্রি হাতুড়ির
আঘাতে কেটে নিচ্ছে বুকের হাঁড়।
তবুও, খুব ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে কাকভেজা হই।
তোমার বৃষ্টি নিয়ে পথিক সেজে ছাতার খোঁজে
শৈশবের বৃষ্টিতে উঠানের রাজহাঁসের পাল
হঠাৎ উড়ে যায় আকাশের উদ্দেশ্যে...

রাজহাঁসের দলনেতা ঈশ্বরের ভূমিকায়
অভিনয় করেন, জন্ম নেয় মানবশিশু
তাঁর চোখের ইশারায় ধ্বংস হয় নগর।
তবুও,নারীর প্রেমে মাতাল দেবতারা
গান গায়, উড়ে আসে মর্ত্যের উদ্দেশ্যে...

তোমার ভিতরে আমাকে খুঁজতে গিয়ে
দেখি- মেঘে উড়ে কালো মেঘের েেমঘচিঠি,
বুকের ভিতরের বৃষ্টি হঠাৎ থেমে যায়।
তোমার বৃষ্টি নিয়ে ভেজা রাস্তা হেঁটে যায়
গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দ শুনে মনে হয়-
                                       নূপুরের আওয়াজ।
এসব বৃষ্টিতে যেদিন তোমার ভিজতে ইচ্ছে হবে
বুঝবে, বুকের ভিতরের বৃষ্টি
কতটা ভয়ানক কষ্টের হতে পারে।

স্বর্গের বৃষ্টিজলের নহরে ভেসে থাকা
পদ্মফুল অবিকল এক মর্ত্যের নারী।
ভুল করে, দেবতারা শরাব পান করে
এবং ঢেলে দেন মর্ত্যের মাতালদের উদ্দেশ্যে...
বোধ হয়, এই বৃষ্টিতে ঝিনুকে মুক্তা জন্মে?
চাতাক পানি পান করে?
একজন প্রেমিকের ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে কাকভেজা হই

আর ঐ দিকে,
মর্ত্যের কিছু বেকুব মাতাল এসব বৃষ্টির নাম খোঁজে
ঈশ্বরের দরজায়।

বুনোফুল
মাহদী হাসান

অযতেœ বড় হচ্ছে পাহাড়ের বুনোফুল। একটু ছোঁয়ায় তারা লজ্জাবতী গাছের মতোন নুয়ে পড়ে। মায়া পেলে অঙ্কুরোদগম হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। কালবোশেখি ঝড়ে তাদের চুল বেয়ে অশ্রু নামে সুডৌল পাহাড় গড়িয়ে সোজা চেঙ্গী নদীতে। এখানে বিন্নি চালের রঙিন স্বপ্নেরা হামাগুড়ি খায় তাদের পায়ের নিচে। তাদেরও দীর্ঘশ্বাস আছে। সুযোগ পেলে, তারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর বিপরীতে ছড়িয়ে দিবে ফুলের সৌরভ।

আকাশ বদল
সুমন আহমেদ

পৃথিবী, তোমাকে ঘিরে কতইনা স্বপ্ন ছিলো আমার !
তোমার সীমাহীন বিশালতা নীলাভ আকাশের নিচে হবে-
সুখের স্বপ্নপুরী; যেখানে থাকবে অনন্তকাল বেঁচে থাকার
প্রশান্তির আয়ুকাল- সুখের স্বর্গের অসীম দরিয়া।

রাত্রির শহর আলোকিত হয়ে থাকবে জোনাকির আলো,
অসলতার ঘুমভেঙে মুক্ত নভপ্রঙ্গনে ছুটে যাবে ভোরের পাখি।
সূর্যের মিষ্টি কিরণ গায়ে মেখে পুষ্পের নব জীবন...
হৃদ সাগরে অবিরাম সুখের উচ্ছ্বাসে বয়ে যাবে ছলাৎছলাৎ ঢেউ।
উদাস দুপুর পেরিয়ে- মৃদু সমীরণ বয়ে যাওয়া সোনালি বিকেলে
মনের উঠোনে অনন্ত সুখে পাখনা মেলে নেচে উঠবে ময়ূরী।

ভাবতেও পারিনি; পৃথিবীর সমস্ত আয়োজন মিথ্যে করে-
গোধূলি লগ্নে রঙধনুর সাজ হারিয়ে- হয়ে যাবে আকাশ বদল। 


সুকন্যা
সালমা নাসরীন এনডিসি

যে কন্যা স্বপ্ন দেখে সন্তর্পণে শৈশবে
বড় মানুষ হবে, শুধু মাতা-জায়া নয়
পরিপূর্ণ আত্মপরিচয় ! নয়, ‘কেয়ার অফে’
একান্ত নিজস্ব পরিচয়ে হবে সুকন্যা !

সে কন্যার সামনে বাঁধার প্রাচীর
থাকে অচলায়তন তবুও অকুতোভয়
আছে তার মমতায় উষ্ণ হৃদয়
শীতল মস্তিষ্কে ভর করে চলে বহুদূর...

বিশ্বাসের আলোয় কেবল নিজেকে বদলায়
কোন প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নয়
মানেনা সে পরাজয় নির্ভয়ে পথচলে
পেছনে তাকায় না, শুনেও না কে কি বলে!

সে যখন হাসে গোটা দুনিয়া হাসে
প্রতিকূল অবস্থায় থাকে বাবা-মার পাশে।
সে আর কেউ নয় আমাদেরই কন্যা, সে
আমাদের চারপাশে- জয় সুকন্যার জয়।



পরিমাপ
বিটুল দেব

খুন করার পরে
দুধের চৌবাচ্চা ডুবে
ধুয়ে সারা শরীর!
নাইট পার্টিতে আমোদে ভুলতে
মৃত মানবের মুখ।

দান করে, জ¦ালাই মোম
হারিয়ে গেলে পরাণ হাওয়া
দাঁড়িপাল্লায় হিসেব
পাপের পরিমাপ।

আমি প্রেম
নূরে জান্নাত

আমার চোখে তাকিও না, প্রেমে পড়ে যাবে।
আমার হাসির মানে খুজো না, দিশেহারা হয়ে যাবে।
আমার এলো কুন্তলের মায়ায় পরো না, লোভী হয়ে যাবে।
আমার সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে এসো না, অন্ধ হয়ে যাবে।
আমার স্বাদ নিতে এসো না, মৃত্যু হবে, ঠিক মৃত্যু হবে।
আমি যে প্রেম, আমি প্রেম, হ্যা আমিই প্রেম।
আমার হীম শীতল প্রবাহে ডুঁব সাতারের ইচ্ছে পোষণ করো না
তলিয়ে যাবে আরো অতল থেকে অতলে।
মরে যাবার পর ও ভেসে উঠতে চাইবেনা।
বাঁচতে হলে ভাসতে হবে
বাঁচার জন্য প্রয়োজন তাপ ও অক্সিজেন।
আমাতে যে আগুন আছে তাও শীতল,
যে আগুনে পোড়ালে তুমি তাপ অক্সিজেন দুটোই পাবে।
তবে সাবধান!!! শীতল আগুনেও অদৃশ্য প্রগাঢ় উত্তাপ
যাতে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে তোমার অস্তিত্ব।
পরিশুদ্ধতা পেতে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার পরেই
প্রমাণিত হবে ‘তুমি ও প্রেম’
প্রমাণ শেষে আমার সফেট আলিঙ্গনে
ফিরে পাবে চির অমর, নব উদিত তোমাকে !


গল্প : সে কি ভার্সিটির মেয়ে?

গল্প : সে কি ভার্সিটির মেয়ে?

 সে কি ভার্সিটির মেয়ে?
সিরাজ অনির্বাণ

পৃথিবীতে মানুষের সহযোগিতায় মানুষ ধর্ম-কর্ম সবকিছুতেই প্রেরণা লাভ করে থাকে। এক মানুষ অন্য মানুষকে পথ দেখায়, অজানাকে জানায় আবার দুর্বলকে করে সাহসী। এই পরিক্রমায় চলে আমাদের সমাজ। এখানে কারো সহযোগিতা ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না হোক সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ।

রুবেল। মাথাগরম একটি ছেলের নাম। সে উল্টাপাল্টা কিছু দেখতে পারে না, সইতেও পারে না। কেউ তার সাথে অন্যায় বা অনিয়মের কিছু করলেই বাঘের মতো গর্জে ওঠে। গর্জে ওঠাই তার স্বভাব। এরই জন্য এলাকায় সে ‘বাঘা রুবেল’ নামে পরিচিত। তবে বাঘের মতো সে হিং¯্র নয়। অনেকে তাকে ‘বাঘাই’ বলেও ক্ষেপায়। ‘বাঘা রুবেল’ না বলে শুধু ‘বাঘাই’ বললে সে মাইন্ড করে। সহজ-সরল লোকগুলো একটুমোটা মাথাওয়ালা হয়। লোকের কথায় কখনো প্রচ- ক্ষেপে যায়।

বন্ধুদের মাঝে টিপু বেশ রহস্য জনক। মাঝে-মাঝে কোথায় যায়, কী করে রুবেল জানেও না। রুবেলকে সাথে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু তাকে একবারও নিতে পারেনি টিপু। আজ রুবেলকে সে এমন করে ধরেছে যে রুবেল তাকে ‘না’ করতে পারেনি।

রুবেল আর টিপুকে নিয়ে রিকশা গিয়ে একটি বহুতল ভবনের নিচে থামে। রুবেল রিকশা থেকে নেমে আশপাশে তাকিয়ে বলে, ‘কীরে এ কোথায় নিয়ে এলি?’টিপুর হাস্যোজ্জ্বল জবাব, ‘আরে চল। এখানে আমার এক ফ্রেন্ড ঢাকা থেকে এসেছে। ওর সাথে দেখা করব।’

রুবেলের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় টিপু। লিপ্টে করে তারা উঠে যায় পাঁচতলায়। দুইজন সুপারভাইজার রয়েছে ওখানে। তারা পুরো ফ্লোর দেখাশুনা করে। পুরো ফ্লোরে বিশটা রুম।তাদের দুইজনের সাথেই টিপুর খুব সখ্য। এখানে নতুন মেহমান আসামাত্রই তারা টিপুকে জানায়। টিপুও তাদের ডাকে এখানে এসে সময় কাটায়।তারা টিপুকে পেয়ে খুশি হয়। হাতে হাত মেলায়। সুপারভাইজার একজন টিপু ও রুবেলকে সাথে নিয়ে একটা রুমে ঢোকে।

এখানে রুবেল কোনোদিন আসেনি। তার কাছেরুমের ভেতরটা বিরক্তিকর মনে হয়। সুপারভাইজার ভেতরে গিয়ে ‘ঠিক আছে? আপনারা কথা বলেন, আমি বাইরে আছি’ বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রুবেল টিপুর সাথে ভেতরে ঢুকতেই খাটের ওপরে বসা এক সুন্দরী মেয়ে দেখতে পায়। মেয়েটি বেশ পরিপাটি। রুমের ভেতরে চেয়ার-টেবিল ও টিভি রয়েছে। খুব উন্নতমানের রুম। মেয়েটি দেখতে পরীর মতো।কাঁধ পর্যন্ত স্টাইল করে নায়িকাদের মতো কাটা চুল। পরনেতার লাল রঙের আটসাঁট সালোয়ার-কামিজ আর বুকের একপাশে পাতলা একটা ওড়নাতৈরি করেছে এক চৌম্বকীয় দৃশ্যের। টেবিলের ওপরে ডিগ্রি-ক্লাসের সমাজবিজ্ঞান ও দর্শনের দুইখানা বই এবং একটি ব্যাগপ্যাক পড়ে রয়েছে। ধবধবে সাদা বেডের ওপরে এক কোণায় পড়ে রয়েছে একটি কালো বোরকা, হিজাব ও কালো চশমা। মেয়েটি টিপুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলে, ‘ভাইয়া কেমন আছেন?বসেন ভাইয়া।’

‘এই তো ভালো আছি। কেমন আছো শান্তা?’ টিপুর জবাব। শান্তা একটু নড়ে চড়ে বসে টিপুকে জবাব দেয়, ‘ভালো আছি ভাইয়া।’ টিপু রুবেলকে দেখিয়ে শান্তাকে  বলে, ‘আমার বন্ধু রুবেল। ভালো ছেলে। তবে একটু রাগী কিন্তু। খুশি করার চেষ্টা করবা, ঠিক আছে?’

এরপরেশান্তাকে দেখিয়ে রুবেলকে বলে, ‘রুবেল, ও শান্তা।আমার বান্ধবীর বোন। খুব ভালো মেয়ে। এখানে খুবই কম আসে। আমি তোর কথা বলাতে ও ঢাকা থেকে এসেছে। আশা করি তুই খুব দারুণ সময় কাটাবি।’

রুবেলের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কোনো কথা বলে না।টিপু রুবেলের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কী চিন্তা করছিস? খারাপ লাগছে? আরে খারাপ লাগার কিছু নেই। এই দেখ, কত সুন্দর জায়গা। এসি রুম। দেখেছিস কত সাজানো-গোছানো বিলাসী রুম! কত আরামদায়ক বেড! এখানে সবাই আসতে পারে না। এখানে আসতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার! আমার বিশ্বাস এখানে কিছুক্ষণ থাকলে তোর মনে কোনো বেদনা-ই থাকবে না। মাঝে-মাঝে বেদনা ভুলে যাবার সাধনা করতে হয়। এটা সেই সাধনা করার একটা জায়গা। এখানে সুখের শেষ নেই।’

রুবেল এবার মুখ খোলে, ‘আমি কি তোরে বলেছি আমার সুখের খুব অভাব? তুই আমারে সুখের কোনো এক জায়গায় নিয়ে যা।’
-‘ঠিক তা বলিসনি। তবে মৌ তোরে যে আঘাত দিয়েছে তা তো আমি জানি। বিনা দোষে তুই সে আঘাত সইতে না পেরে ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরে যাচিছস। কোনো কাজে মন বসাতে পারছিস না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না।বন্ধু হয়ে আমি তোর এই অবস্থা কেমনে দেখি বল? এবার তোর সব জ্বালাযন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে। একবার এই সুখের সাগরে ডুব দিয়ে দেখ! আরে, মৌ এর থেকে শান্তা অনেক বেশি শিক্ষিত। মেলামেশা করলে উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের সাথে করতে হয়। ও কীসে পড়ে জানিস?’

-‘আমার জানার দরকার নেই টিপু। প্লিজ চল, চলে যাই।’

-‘আরে শোন। ও ভার্সিটির মেয়ে, অনার্সে পড়ে। এবছর সেকেন্ড ইয়ারে! একদম ফিটফাট! তোরে একদিন বলেছিলাম না, ভার্সিটি পড়–য়া মেয়েরা এ লাইনে অনেক আছে। তোরে বলেছিলাম, একদিন তোরে ভার্সিটিপড়–য়া এ লাইনের মেয়েদের দেখাব। এই দেখ সেই প্রমাণ! তুই তো আমার সে-কথা উড়িয়েই দিয়েছিলি। বিশ্বাসই করলি না। এবার নিজের চোখে দেখলি তো।’

শান্তাকে আবারো হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় টিপু।হ্যাঁ, ঘটনা সত্য। রুবেল মৌ’কে খুব গভীর করে ভালোবাসত। মৌ তাকে ফাঁকি দিয়ে রোমেনকে বিয়ে করেছে। মৌ রুবেলের ভালোবাসার মূল্যায়ন করেনি। সরলতার সুযোগে তার কাছ থেকে অনেক দামি গিফট, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। মৌ ছিল দুনিয়ার স্বার্থপর। স্বার্থপর এমন একটি মেয়ের কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয়ে রুবেল ভীষণ আঘাত পেয়েছে। নিজেকে শেষ করে দিতে তার মনে চেয়েছে বারবার। শুধু আত্মহত্যা মহাপাপ মনে করে তা করেনি। বিষণœদিনাগুলোতে টিপু তাকে সিগারেট ওরঙিন পানি খাইয়েছে।

একরাতে টিপুদের বাসার ছাদে টিপু ও রুবেল বসে গল্প করছিল। কথার মাঝে টিপু রুবেলকে  এ লাইনে ভার্সিটি পড়–য়া মেয়েদের কথা বলে। রুবেল বিশ্বাস নাকরে বলে, ‘ধুর, আমার বিশ্বাস হয় না, টিপু। আমার মনে হয় ওরা মিথ্যা বলে। কাস্টমারের কাছে নিজেদের দাম বাড়ানোর জন্য এটা হতে পারে ওদের চাপাবাজি।’

টিপু বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে দোস্ত। তোরে আমি সরাসরি একদিন দেখাব। তাহলে বিশ্বাস করবি তো?’ রুবেল ‘ঠিক আছে’ বলে সেই গল্পে ইস্তফা দেয়। টিপু তার কথা রাখার জন্যই আজ রুবেলকে নিয়ে এখানে এসেছে। রুবেলের হাত ধরে টিপু শান্তার পাশে বসায়। শান্তা রুবেলকে বসতে বলে। রুবেল মুখ কালো করে পা ঝুলিয়ে খাটের ওপরে বসে। টিপু বলে, ‘বিল-টিলের কোনো চিন্তা করিস না। ওসব আমি দেখব, কেমন? তুই থাক।’

টিপু মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। মেয়েটি বেড থেকে উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে রুবেলের পিঠের ওপরে হাত রাখে। রুবেল শান্তার দিকে বেশ কয়েকবার তাকায়। এতো সুন্দর মেয়ে সে এর আগে আর দেখেছে বলে মনে হয় না। রুবেল সবকিছুবুঝতে পারে। শান্তা রুবেলকে বলে, ‘ভাইয়া তৈরি হয়ে নিন। আর বকশিসটা দিন, প্লিজ।’

রুবেল বলে, ‘বকশিস! কীসের বকশিস?’ এ লাইনে কাজ করার আগে ওরা বকশিস নেয়, রুবেল এটা জানে না। পৃথিবীতে এটাই মনে হয় বকশিস নেয়ার একমাত্র উল্টো রীতি। এই রীতি তার জানার কথাও নয়। কারণ, সে এখানে নবাগত। এখানকার নিয়ম-কানুনে সে পুরোটাই অজ্ঞ।শান্তা রুবেলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আহারে কচি খোকা! কিচ্ছু বোঝে না দেখো। এখানে এসে কাজ করলেবকশিস দিতে হয়।’

রুবেল ধাক্কা মেরেশান্তাকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে বলে, ‘ধুর আমার এসব ভালো লাগে না। গায়ে হাত দেবে না বলছি।’
পুরুষের মনে দুর্বলতা সৃষ্টি হয় এমন সুরে শান্তা বলে, ‘হাত দিব না মানে! আমি হাত না দিলে গায়ে কে হাত দেবে শুনি? আর এখানে এলে সবারই এই কাজ করে যেতে হয়। এবার ভদ্রলোকের মতো ভালোয় ভালোয় বকশিসটা দিয়ে দিন।’ শান্তা আবার রুবেলের কাছে আসতে থাকে। রুবেল বাধা দিয়ে বলে, ‘দূরে দাঁড়াও। কাছে এসো না।’

শান্তারুবেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। রুবেল বলে, ‘তুমি কী করো সত্যি করে বলো।’শান্তা জবাব দেয়, ‘ভার্সিটিতে পড়ি। কেন বিশ্বাস হয় না?’ রুবেল ভেতরে একটা উত্তাপ অনুভব করে। কণ্ঠ তার চড়া হয়ে ওঠে। বলে, ‘কী বললে তুমি, ভার্সিটি! কোন ভার্সিটিতে পড়ো বলো।’ শান্তা বলে, ‘ওটা তো বলা যাবে না। যা করতে এসেছেন, তা করে যান।’

শান্তানিজেকে কাপড়ের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। রুবেলের ভেতরে উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকে। বলে, ‘সব বানোয়াট। মিথ্যাবাজি। তুমি ভার্সিটি তো দূরের কথা, হাইস্কুলেও পড়োনি। দাম বাড়ানোর জন্য তুমি মিথ্যা বলছো। ভার্সিটিতে আমি না পড়লেওস্কুল-ভার্সিটিপড়–য়া মেয়ে আমি চিনি। আমাকে মেয়ে চেনাতে হবে না। এ লাইনে আবার ভার্সিটি কীসের? ভার্সিটির মেয়েরা এসব করেনা।’

শান্তা মুহূর্তেই ক্ষেপে উঠে বলে, ‘সবাইকে কি রাস্তার মেয়ে মনে হয়? আমি ভার্সিটিতে পড়ি,পাড়ার সস্তার মেয়ে আমি নই। পাড়ার মেয়েদের কাছে যেতে যেতে সবাইকে আপনার পাড়ার মেয়ে বলে মনে হয়, তাই না? বিশ্বাস না হলে চলে যান। বিশ্বাস না হলে এসব করতে এসেছেন কেন?ভার্সিটির কয়জন মেয়ে দেখতে চান? এ্যাভেইল্যাবল আছে।’

‘তোরা কাস্টমারের কাছে ভার্সিটির মেয়ে বলে পরিচয় দিস বলে তারা ভার্সিটির মেয়েদের খারাপ ভাবে’ বলেই রুবেলশান্তার গালে জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। শান্তা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে,চোখ গরম করে রুবেলের দিকে তাকায়।রুবেলের শার্টের কলার ধরে। রাগে রুবেলের রক্ত মাথায় উঠে যায়। ‘অসভ্য বেয়াদব!’ বলে রুবেল আরেকটা চড় ও ধাক্কা মেরে শান্তাকে ফেলে দেয়। শান্তা ফ্লোরে উপুড় হয়ে পড়ে। রুবেল শান্তার নিতম্বে একটি লাথি মারে। শান্তা চিৎকার করে ওঠে। রুবেল দরজার সিটকানি খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজার সামনে সুপারভাইজার দুইজন দৌড়ে এসে হাজির হয়। বয়সে বড় সুপারভাইজার এসে রুবেলের শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই শালা, মাস্তানি করার জায়গা এটা?’

টিপু ‘ভাই থামেন, থামেন। আমি দেখছি’ বলে দুজনকে ছাড়িয়ে দিয়ে রুবেলকে দূরে সরিয়ে দেয়। সুপারভাইজার বলে, ‘ভাই এটা আপনি কী করলেন? এ রকমপাগল-ছাগল কেউ এখানে নিয়ে আসে?’

টিপু তাকে সান্ত¦না দিয়ে বলে, ‘ভাই সোরি, এক্সট্রিমলি সোরি। আমি ওকে দেখছি।’রুবেল দূরে দাঁড়িয়ে সাপের মতো ফুঁসছে। হাত মুঠ করছে আবার খুলছে। চোখেমুখে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠছে তার। টিপু রুবেলের অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে রুবেলের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে বলে, ‘তুই এরকম করবি জানলে এখানে তোরে আনতাম না। আমি সোরি দোস্ত।’

রুবেল টিপুর সাথে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে টিপুকে বলে, ‘তুই তো জানিস আমি ধাপ্পাবাজি, চাপাবাজি একদম সহ্য করতে পারি না।ওদের কাছে মিথ্যা শুনে শুনে ভার্সিটির নির্দোষ মেয়েদের মানুষ খারাপ ভাবে। ভার্সিটি তো দূরের কথা, ওতো স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি! ওকেনা মেরে পারা যায়?শালির নটি কোথাকার! এখন মনে চায় তোরেও একটা লাথি মারি শয়তান।’

তাদের দুইজোড়া পা ধপধপ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।



গল্প : শহরের অসম প্রেম

গল্প : শহরের অসম প্রেম


শহরের অসম প্রেম
মোহাম্মদ অংকন

প্রতিদিন সকাল হতেই পাশের বাসার ছাঁদগুলোতে রোদ এসে পড়ে। ছাঁদে জমে থাকা সারা রাতের বৃষ্টির পানিতে যখন রোদ পড়ে, বিশুদ্ধ পানি তখন ঝলমল করে ওঠে। বাতাসের ধাক্কায় মৃদু ঢেউ খেলে যায়। সেই পানিতে পড়া সূর্যের তীর্যক রশ্মি সোজা সুবোধের চোখে গিয়ে লাগে। তারপর সুবোধ ঘুম থেকে জেগে ওঠে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বিশাল আকাশের একাংশ দেখে। পরিষ্কার আকাশ। আকাশ দেখতে দেখতে সময় বয়ে যায়। তবুও সে বিছানা ছাড়ে না। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকেই বুঝতে পারে প্রতিদিনের মত আজও হাজার হাজার লোকজন অফিস, আদালত ও হাট-বাজারের দিকে ছুটছে। খোলা জানালা দিয়ে গাড়ির হর্ণ ও রিক্সার বেলের টুনটাং আওয়াজ কানে আসে। সবাই যেন ব্যস্ত, সে বোধটুকু সুবোধের হয় তখন। তারপরও তার চোখের ঘুম ছুটে পালালেও স্বপ্ন দেখা একদমই থেমে থাকে না। সারা রাতেও তার স্বপ্ন দেখা হয়ে ওঠেনাই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল হয়তো। স্বপ্নরা কাছে ভিড়তে পারে নাই। তাই এই শেষ সকালে শহরের মত জেগে ওঠেতার হাওয়ায় ভাসানো সাদাকালোকয়েকশত অগোছালো স্বপ্ন। এগুলোকে ঠিক স্বপ্ন বললে ভুল হবে বোধহয়। এগুলো তার বিচ্ছিন্ন কিছু ইচ্ছে, কিছু আশা।

সুবোধ ক্যাম্পাস থেকে ফিরে সাঝবেলা দু’টো টিউশনি করায়। মাস শেষে কিছু টাকা-পয়সা হাতে পায়। নিজের খরচখরচাদির টাকা রেখে বাড়িতেও পাঠাতে হয় সেসব টাকা।বলা চলে, মাস শেষে আবার খালি হাতে পড়ে যায়। তবুও তার ইচ্ছে হয় কিছু টাকা জমিয়ে একটি দু’চাকারগাড়ি নেওয়ার। কেন এমন ইচ্ছে হয় সুবোধের? সে প্রতিনিয়তই দেখে তার শহুরে বন্ধুরা নামি দামি গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া করে। তারা সহপাঠিদের নিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে যায়। তাই সুবোধ মনে করে,‘তারও যদি একটি গাড়ি থাকতো তাহলে তারও অনেক বন্ধু-বান্ধবি জুটতো। হয়তো তাদের সঙ্গে নিয়েকোনো একদিনবহুদূরে চলে যাওয়া যেত। সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা দেখা যেত।’ এসব ভাবার সময় সুবোধ তার দরিদ্র পরিবারের কথা একদমই ভুলে যায়। তার স্বপ্ন বিলাসী মনে তাকে তাড়া দেয়। ‘গ্রামে থাকুক নাপরে গর্ভবতী বোন কিংবা অসুস্থ বাবা। কিছুটা সময় হারিয়ে যাই না হয় অচিনপুরে।’প্রতিটি মুহূর্তে¦ এমনই কয়েকশত ইচ্ছে ভাসে সুবোধের নিজস্বআকাশে। মেসে যখন একাকী থাকে, তখন কল্পনার জগতে চলে যায়। আবার যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে তখনও কল্পনায় যেন হোঁচট খায়। কেউ হয়তো হাত আগলে বাঁচায় তাকে। সম্মানবোধ থেকে ‘সরি’ বলে আবার হাঁটতে থাকে। কিন্তু সে যতই স্বপ্ন দেখুক আর ইচ্ছের বীজ রোপন করুক, দিনের শেষে সেসব ইচ্ছে রং হারিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। স্বপ্ন দেখার জন্য আবার রাত লাগে। ফিরেও আসে শহরের রঙিন রঙিন রাত।কিন্তু স্বপ্নগুলো আর বাস্তব হয় না। শুধু প্রেক্ষাপট বদলে যায়।

নয়টা বেজে যায়। সুবোধ তখন ভীড় বাসেতে বাদুড় ঝোলা হয়ে ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দিয়েছে। ছাত্র মানেই হাফ পাশ। আর তাইতো কন্ডাক্টররা সিটের বন্দোবস্ত করে দেয় না। ব্যস্ত সময়ে অনেকেই সুবোধের মত ঝুলে ঝুলে গন্তব্যে পাড়ি জমায়। কেউবা অফিস আদালতে, কেউবা সুবোধের মত ক্যাম্পাসে ছুটেছে।ঘামের ঘ্রাণেতে নারী-পুরুষরা মাখামাখি হয়ে যায়। কেউ নাক আটকে ধরে। আবার কেউ ম্যানিব্যাগ সামলায়। সুবোধের সেসব দিকে কোনো নজর থাকে না। কেননা, তার তো কোনো ম্যানিব্যাগই নাই। দু একশত যা আছে তা ডান পকেটের কোনো এক ভাজে পড়ে আছে। সুবোধেরই নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তাই দৃষ্টি তার অন্য দিকে খেলা করে। সিটে বসে থাকা কোনো এক যুবতির দিকে তার চোখ চলে যায়। মনে মনে সেই যুবতির সৌর্ন্দযের প্রশংসায় বিভোর হয়ে পড়ে। দু’চার জন যাত্রী ধাক্কা দিয়ে পাশ কেটে চলে গেলেও তার বোধোদয় হয় না। সে ভাবে, ‘শহরের মেয়েরাই ঝুঝি সকল সৌর্ন্দযের আধার।তাদের অঙ্গে সবসময় বেলী ফুলের গন্ধ শোভা পায়।’ তারপর কারো কারো সাথে সময় বুঝে একটু আধটু চোখাচোখি হয়। শহরের যুবতিরা মৃদু হাসে। আবার কেউ কেউ নাক ছিটকায়। পরের স্টপেজে যখন মেয়েরা নেমে যায়, তখন তার অপ্রাসঙ্গিক ঘোর কাটে। তাদের উষ্ণ সিটে বসে বাস্তব জগতের কথা ভাবে। ‘শহরের মেয়েদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা অন্তত আমার মানায় না।এ এক অসম প্রেম। এতে শতভাগ ব্যর্থতা রয়েছে।’

শহরের রাজপথ ধরে বাস চলে অবিরাম গতিতে। আর একটু পাড়ি দিতে হবে। তারপর রংধারী সুবিশাল ক্যাম্পাস। মোবাইলের ঘড়ির দিকে সুবোধ তাকায়। সময় দেখে। মোবাইলের আলো নিভতে না নিভতেই একটি ম্যাসেজ আসে। ইনবক্স খুলতেই ইরানির নামটি ভেসে ওঠে। ‘আজ নোমান স্যারেরক্লাসটাবাদ দিও সুবোধ। প্লিজ, প্লিজ! আমি আর তুমি ক্যাফেটেরিয়াতে বসব। তোমাকে আমার আজ কিছু বলার আছে।’ ম্যাসেজটা দেখে সুবোধের জ্ঞান ফেরে। তারপর তার ডান হাতটি প্যান্টের পকেটে ঢুকায়। আগুলের ভাজে নোটগুলো ফেলে গণনা করে কতটাকা আছে। মোবাইলে তারিখ দেখে, আজ কত তারিখ চলছে। এই ইরানি হল শহরের বড়লোকের দুদালি। সুবোধের সাথে সখ্যতা আছে। হয়তো সুবোধের প্রেম প্রত্যাশী। সুবোধ তা মেনে নিতে পারে না। তার হাত খরচ দেখলে সুবোধের মাথা ঘুরায়। সুবোধ ভাবে, ‘ওর থেকে দূরে থাকাটাই আমার জন্য নিরাপদ।’ কিন্তু ইরানি তাকে সর্বত্র খুঁজে বেড়ায়। ইরানি নানা কারণেই সুবোধকে বন্ধু বানিয়েছে। আবার ভালোও বাসতে চায়। ক্লাসের যাবতীয় পড়ার খোঁজখবর জানা, এ্যাসানমেন্ট করা, কবে কোনো বিষয়ের ক্লাস টেস্ট সব তথ্য যেন সুবোধ জানে। তাই অনেকেই তার পেছন ছাড়ে না। সুবোধ ভালো ছাত্র। তাই এসব বিষয়ে সে বরাবরই বন্ধুসুলোভ। কিন্তু ভয় তার ওদের সাথে মিশলে কখন যে কিসের ট্রিট দেওয়া লাগবে তা বুঝে উঠা মুশকিল। ওরা সারাক্ষণ এর জন্মদিন, ওর পার্টি ইত্যাদি নিয়ে থাকে। এসব করতে যেমন টাকার দরকার, তেমনি সময়েরও দরকার। তার আরওভয়, ইরানির মত আরও কেউ যদি তার প্রেমে পড়ে যায়, তাহলে তাকে নিয়ে শহরের নামিদামি রেস্টটুরেন্টে যাওয়া লাগতে পারে।শহরের কসমেটিক্সের দোকানেও যাওয়া লাগতে পারে। যা সুবোধের জন্য জুলুম।

প্রতিদিন বিকালের দিকে সবার ক্লাস শেষ হয়।অনেকেই বাসায় চলে যায়। অনেকে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে, চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়। কিন্তুসুবোধের তন্নিম্যাডামেররুমে ডাক পড়ে যায়। তন্নি ম্যাডাম দেখতে যেন সুবোধের সহপাঠিদের বয়সী। চেহারায় চেনা যায় না যে তিনি একজন শিক্ষিকা। কিন্তু বয়স তা হবে বত্রিশের উপরে। তারপর আবার তাঁর এখনও বিয়ের কাজটি সমাপ্ত হয় নাই। সুবোধকে তিনি কি কারণে প্রতিদিন ক্লাস শেষে ডাকেন তা নির্ণয় করা কারও সম্ভব নয়। তবে যে কাজগুলো হয় তা সর্ম্পকে টুকিটাক জানা যাক এখন। সুবোধ ভালো ভালো কবিতা লিখতে পারে। বিশেষ করে রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। তবে সে আবৃত্তিতে একদমই কাঁচা। যতদূর অনুধাবন করা যায়, সেগুলো শুনতে সুবোধকে ডাকেন তিনি। তাই বলে প্রতিদিন? একবার সুবোধ বলেছিল,
: ম্যাডাম, রোজ রোজ কবিতা আবৃত্তি আমার ভালো লাগে না। আর আপনিও জানেন, আমি ভালো করে আবৃত্তি করতেও পারিনা।
তখন ম্যাডাম উত্তরে বলেছিলেন,
: তুমি কি ভালোভাবে পরীক্ষায় পাশ করতে চাও হে যুবক?
তারপর থেকে সুবোধের অন্তরে ফেল করার ভয় ঢুকে যায়।সে ভাবে, ‘যেনতেন ভাবে হলেও আমাকে কবিতা আবৃত্তি করতেই হবে।’আবার সুবোধ এরকমও ভাবে, ‘ম্যাডামের মন অন্য কিছু চাচ্ছে না তো?’ তারপর নিজের জিহ্বায়কামড় দিয়ে তওবা করে।

সুবোধযখন তার ম্যাডমের কক্ষে কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়, তখন সে কেমন যেনহাঁফিয়ে উঠে। যেন তার মাথায় মালামাল, শ্রমিকের মত বহন করছে। ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসএসির বাতাসেও তার শরীরকে ঠান্ডা করতে পারে না সে। ম্যাডাম তার থেকে বেশি দুরে বসে নয়। আবার সে যখন আবৃত্তি করে, তিনি তখন টহল দেন, কণ্ঠ মেলান।সুবোধের হাফিয়ে ওঠা দেখে ধমক দেন। ধমক শুনে আবার কবিতা আবৃত্তি শুরু করে। তখন তার চোখে ম্যাডামেরচুলগুলো ভাসতে থাকে। লক্ষ্য করে দেখে, ম্যাডামের কপালের টিপটা কেন্দ্র বরাবর নাই। হাত দিয়ে টিপটা ঠিকঠাক করে দিতেই ম্যাডামই তাকে আলতোভাবে স্পর্শ করে জরিয়ে ধরে। যেন সুবোধের দেহে জোয়ার বয়ে যায়। তারপর সেছন্দহীন একটি কবিতা আবৃত্তি করে। আর ভাবে, ‘যাক বাঁচা গেল!ফেলটাঠেঁকালাম।’ এমন করে প্রতিদিন এক ঘন্টা করে সুবোধের অসম প্রেমের পরীক্ষা চলে। এসব কেউ জানতে পারে না।

ততক্ষণে বেলা গড়ে যায়। সুবোধ ফিসফিস করে নিজেকে বলে, ‘আজওআমার বাসায় ফিরে যেতে সন্ধ্যা হবে।কখন যে ওদের পড়াতে যাব তা ভেবে পাচ্ছি না।’ সারাদিনের ক্লাস শেষে সুবোধের ক্ষুধা লেগে যায়। এ ক্ষুধা ফুসকা, চটপটির ক্ষুধা নয়।ডাল-ভাতের ক্ষুধা। কিন্তু ম্যাডামকে বোঝাতে পারে না। ম্যাডাম কি যেন এ ফাইলে ও ফাইলে রাখারাখি করে। আর সুবোধ ঠায় বসে থাকে।অতঃপর সুবোধের মোবাইলে ইরানির কল আসে। কিন্তু সুবোধ ধরে না। আবারফোনের পর ফোন আসে। ফোনের কম্পনে তার শরীরও যেন কম্পিত হয়।ইরানি শহরের মেয়ে হলে কি হবে সুবোধের ভালোই খোঁজখবর রাখে। তার চোখ বলে, সুবোধকে সে সত্য সত্যই মন দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সুবোধ তা কখনই মানতে রাজি নয়।

ইরানি সুবোধের সবই জানে। সে এও জানে, ম্যাডাম তাকে ইচ্ছে মতন তার পেছনে ঘুরায়। কখনও একটুখানি তাঁরকথা না শুনলে তিনিযখন তখন সুবোধকে ধমক চড়ায়। সুবোধের অবুঝ কষ্টগুলো দেখে ইরানির ভীষণ মায়া হয়।শুধুমাত্র ম্যাডামের কারণে সে সুবোধের সাথে ভালভাবে মিশতে পারে না। সরাসরি বলতেও পারে না তার হৃদয়ে জমানো কথাগুলো। ম্যাডাম একদিকে যেমন প্রতিদ্বন্দি, অন্য দিকে সুবোধের অনীহা লক্ষ্য করে। অনেক সহপাঠিই সুবোধের সাথে মিশতে চায়। কিন্তু ম্যাডাম তাদেরকে সুযোগ দেয় না। ম্যাডামের কাছে সুবোধ সবচেয়ে প্রিয়। শ্রেণিতে যখন সি.আর নির্বাচন করা হয়, তখন অন্য কোনো ছেলেমেয়েকে নির্বাচন করা হয় না। প্রতি সেমিস্টারে সুবোধকে সি.আর বানানো হয়। যাতে করে সুবোধ আর ম্যাডামের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকে। ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা সুবোধকে ক্ষেপায় আর বলে, ‘সুবোধ রে তোর তো কপাল খুলে গেছে, মামা। স্বয়ং ম্যাডামই তোর প্রেমে হাবুডুব খাচ্ছে।’ সুবোধ ওদের কথায় একদমই কান দেয় না। সে ভাবে, ‘এই ক্যাম্পাসে আমি যতই সুদর্শন হইনা কেন, আমি কখনইঅসম প্রেমকে মেনে নেব না।’

অতঃপর বিকাল সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে আসে। তখন মুক্তি পায় একুশ বছরের সুবোধ নামের নির্বোধ ছাত্রটা। তার আর দেরী সহ্য হয় না। ‘কখন বাসায় ফিরে যাব?’ কেউ পেছন ফিরে ডাকলেও যেন তাকানোর সময় থাকে না। তার মন তখন উদাস হয়। তার মনে তখন একটাই প্রার্থনা, ‘সাঁঝনেমে আসুক। আঁধারে ঢেকে যাক আমার দেহের অদৃশ্য ময়লাগুলো। আর পারছি না। শরীরটা বেশ ক্লান্ত। সারাদিন প্যান্ট আর শার্টের চিপুনিতে শরীরে যেন কয়েকশত দাগ বসে উঠেছে।বড্ড বিশ্রাম প্রয়োজন।’ তারপর আবার সেই চিরচেনা বাসে ওঠে। শরীরখানা সিটে বিছিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরে।

তারপর..অন্ধকারের পর্দা নামে শহরে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন বাতিগুলো ঝলসে ওঠে। সুবোধইচ্ছে করে বসে থাকে অন্ধকারে। সেদিন আর টিউশনিতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। ক্লান্ত শরীরে যেন শহরের বাতির আলোগুলো এসে অকপটে ঝিলিক দেয়।সুবোধের মনের ভেতর অনেক কথাই লুকিয়ে থাকে। বলা হয় না কাউকে। প্রতিবাদও করতে পারে না। গ্রাম থেকে মায়ের ফোন আসে।
: বাজান, তুমি কি ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরেছ? দুপুরে কি খাবার খাইছ?
: মা, আমি ব্যস্ত আছি এখন। তোমাকে আমি পরে কল করব।
এই বলে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। মায়ের সাথে মিথ্যা কথা বলায় তারপর তার মনটা ভীষণ পোড়ে। অতঃপর তার মনেরগ্লানিগুলো চাঁদেরবিচ্ছিন্ন কপালে গিয়ে আঘাত করে। তার মনটা মরে যায়। জেগে থাকে নিস্তব্ধ রঙিন শহর। সুবোধের চোখের ক্লান্তির ঘুম আসে। তারপর আসে কয়েকশত স্বপ্ন, এসে আঘাত করে। কিন্তু ঘুমের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না। তারাও সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে। শহরের মেয়ে ইরানির মত তারাও সুযোগ খোঁজে। কিন্তু ম্যাডামের মত করে তাকে কেড়ে নেয় ঘুম।

প্রতিনিয়ত এভাবেই অসম প্রেমের কিছু উপাক্ষান নিয়েই জেগে থাকে সুবোধের শহর। তার দুঃখগুলো যুগান্তরের বাহনেরা নিজ দায়িত্বে বহন করে চলে।আর তার ইচ্ছেগুলো চুপসে যায়, সে খোঁজ কেউই রাখে না। সবাই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে মনটাকে নিয়ে খেলতে চায়। তার শরীরকে টক তেঁতুলের মত করে চুষতে চায়। তার শরীরে যে হৃদয়টা দারিদ্রতার কষাঘাতে মরেগিয়েছে, তার খোঁজ কেউ রাখে না। সে তার মেধার বিকাশের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে তাও কেউ অনুধাবন করে না। সুবোধ পরক্ষণে শান্ত¡না পায় এই ভেবে যে হয়তো তার মত অনেকেই আছে এই শহরে যারা কি না তাদের ইচ্ছে কে বির্সজন দিয়ে অসম প্রেমে গা ভাসাচ্ছে। অতঃপর সুবোধের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বিছানায় পড়ে রয় সুদীর্ঘ দেহ। আর ঘুমের ঘোরে সুবোধ বলতে থাকে, ‘কবে আমি মুক্তি পাবো?’ অপরদিকেঅপেক্ষায় থাকে আরেকটি সকাল সুবোধকে জাগিয়ে ব্যস্তময় অসম প্রেমের শহরে নিক্ষেপ করতে।


মুক্তগদ্য

মুক্তগদ্য


মানুষের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখি !
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

মানুষের পড়ে থাকা দেখলে আগভাতের ওম জাগে শরীরে। রাশি রাশি পোড়া রোদের শনিকও বিঁধে হাড়ে হাড়ে; শিরা-উপশিরায়। আজকাল আরেকটু বেশি বেশিই হচ্ছে এরকমটা; কেন হচ্ছে, আন্দাচ করতে পারছিনা । মানুষের প্রতি বিশ্বাস কমে আসছে নাকি মানুষের প্রতি ঘৃণা জুমছে নাকি মানুষের প্রতি আলাদা এক প্রকার বিরাগের সৃষ্টি হয়েছে; অনেক ভেবে ভেবেও যখন কোনো কারণ বের করতে পারলাম না; তখন নিজের প্রতি দোষ দিতে শুরু করলাম; নিজেকেই বিশ্বাসের জ্যামিতিক রেখার সাথে গরমিল করে নিলাম । দু পায়া মানুষের প্রতি এমন বর্ণবিরোধের কারণ খুঁজতে নিজেকে একটু সময় দিতে চাই; একটু সময় নিতে চাই ।

কালু চাচার সাথে পানাইমোড়ে এক ছোট টঙ দোকানের মাচাঙে বসে লাল চায়ে ঠোট ভিজিয়ে ভিজিয়ে বলছিলাম লাল-নীল কতকথা । এক পর্যায়ে চাচা আমায় প্রশ্ন করে- ভাতিজা; এখন কি করছো ? অবাকই হলাম বটে । ছোট থেকে বড় হতে দেখল । কখন কি করছি, কখন কি করতে যাব, সব জেনেছে; আর এখন আমি কি করি কালু চাচা সেটা জানেনা; উদ্ভট এক রাগও হলো। চেপে গেলাম। বললামÑ এই তো চাচা, অনার্স শেষ করলাম। চাকরি-বাকরি করব ভাবছি । কালু চাচা আমার তাকিয়ে সহজ স্বাভাবিক উত্তর করে- ভালো; ভাতিজা, তয় আমি বহুত দেখছি পড়াশোনা কইরা কিছুই হয় না; আমগো সময় পড়াশোনার দাম ছিল; নাম ছিল; আর এখন পড়াশোনা কইরা মানুষ চোর হয়, বাটপার হয়, সবচে বড়কথা টাকাখোর হয় মানে ঘুষখোর হয়; যা আমি কোনোদিন চিন্তাও করতে পারিনি; এখনকার মানুষগুলারে ভাবতে গেলে অস্থির হয়ে যাই, থাক, ভাতিজা, আমার একটা কাজ আছে; পড়ে কথা কমু; আর আমি বুঝতে পারছি আমার কথা তোমার ভালো লাগে নাই, ভালো না লাগারই কথা । সময় করে সব কমু তোমারে; থাক, ভাতিজা ।
কালু চাচায় আমায় কথা বলার কোনো সুযোগ দিল না বলে কিছুটা মনক্ষুন্ন হলাম । আবার অবাক হলাম; পড়াশোনা নিয়ে অগত্যা তার সব ব্যাক্তিক মতবেদ শুনে ।

চোখ খুলে একটু চারপাশ তাকাই; মানুষ দেখি। কত রঙের মানুষ; কত ঢঙের মানুষ, আহ ! এই মানুষের মুখের আরো কত মুখ; লাল মুখ, নীল মুখ, কালো মুখ, সাদা মুখ, আহা ! মানুষের মুখের উপর কত মুখের ছড়াছড়ি, কত মুখের বসতি ! মানুষের ভেতর কত মানুষ ! মানুষের ভেতর কত পশু ! মানুষের ভেতর জানোয়ার ! মানুষের মিছিলে হাটতে হাটতে মানুষ দেখি ! মানুষের ভীড়ে মানুষ দেখি ! মানুষের কেমন যেন হয়ে গেছে ! মানুষেরা সুন্দরের বিপরীতে আছে ! মানুষেরা সরলের বাহিরে আছে, মানুষেরা আলো ছেড়ে অনেক দূরে আছে ! আজকাল মানুষেরা মানুষ নেই ! মানুষের দ্বৈরথে মানুষে সেজে আছে, আহা ! মানুষ, আহা ! মানুষ ।
এতদিনে মানুষের প্রতি অনিহা, ঘৃণা, বিরাগের কারণ খুঁেজ পেলাম; কালু চাচার অর্ন্তপ্রয়াসগুলোও আজ বুঝতে পারছি; মানুষের প্রতি আমার যেমন বাঁকা দৃষ্টি তৈরি হয়েছে; তেমনি কালু চাচার মত হাজার মানুষের ভেতরেও অন্য মানুষের প্রতি এমন অনিহা, অশোভন ব্যক্তিক ভাবনা তৈরি হয়েছে যা; আমরা মানুষ নিজেরাই করেছি আমাদের অনৈতিক; অপাঙক্তেয় রীতি-নীতির আবাস ছড়িয়ে চারপাশ ।

দীর্ঘ কবিতা

দীর্ঘ কবিতা


 তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না
অসীম মালিক

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না ,
তোমাকে আর ‘জলপরী’,‘নীলপরী’বলতে ইচ্ছে করেনা ।
এবার তোমাকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করব,
এতকাল তোমাকে দেখে এসেছি খ-গ্রাস চাঁদের মত ।
অশরীরী আত্মায় তোমাকে খুঁজেছিÑ
সিংবিহীন বাইসনের মত ।
আবার খুঁজতে খুঁজতে চলে গেছিÑ
ইতিহাসের আলতামিরা গুহায় ।
আসমুদ্র হিমাচল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও
তোমাকে খুঁজে পাইনি ।
আগামী পৃথিবীর স্বপ্ন ধারন করা যে মেয়েটি
লালন করে মমতা । সেই মেয়েটির চোখের তারায়
এক রোদ ঝলমলে আকাশ ।  যে আকাশের নীচে
আসন্ন নবান্নের সোনালী ফসল,
আর চেতনার ওম নিয়ে অপেক্ষা করে ভ্যালেন্টাইনস ডে ।

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না ,
এবার তোমায় বৃষ্টি বলেই ডাকব ।
মেঘের গর্ভেই তো বৃষ্টির জন্ম ,
ঊৃষ্টি বলে ডেকে যদি তোমার সৃষ্টিকে খুঁজে পাই
পোয়াতি ধানের নিঃশব্দ চেতনায়
শব্দের খামারে, শব্দের গোলায়,
চেতনার অক্ষরে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়
আর কলেজস্ট্রিটের অদৃশ্য ইশারায় ।

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না,
তোমাকে রাগিণী বলেও ডাকব না ।
আবার বাঘিনীর উপমাও হৃদয়ে ধারণ করতে পারব না ।
এবার তোমায় অনুরাগ বলেই ডাকব ,
আর অনুরাগ বলে ডেকে যদি তোমাকে খুঁজে পাইÑ
আমার রোমান্টিক কবিতায়Ñ রেফ, কমা, কোলন !
সেমিকোলন আর অপরিহার্য পূর্ণচ্ছেদের বার্তায় ।
কালজয়ী কবিতার বিস্ময়সূচক চিহ্নে । 

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না,
তোমায় অভিমান বলেই ডাকব।
আর অভিমান বলে ডেকে, যদিÑ
আমি খুঁজে পাই, আমার উহ্য অতীতকে ।
যেখানে অভিমানী মেয়েটি
ম্যাসেজ পাঠালে রিসিভ করে না ।
অথচ বিনিদ্র রাতের বিছানায় সারারাত জেগে,
আমায় মিসডকল মারে ।
আর কলেজ ক্যাম্পাসের ছাতিমতলায় ইশারা করে ।

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না,
তোমাকে মায়াকাজল বলেই ডাকব।
আর মায়াকাজল বলে ডেকে যদি আমি খুঁজে পাইÑ
কাজললতার ঠিকানা । আমি দুচোখে পড়ে নিয়ে
সমস্ত মায়াবী চোখের কাছে;
আজন্ম নতজানু হয়ে থাকব ।
আর মায়ার পাথ নিতে নিতে
সমব্যথী পাখির মত জেগে থাকব ।

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না,
তোমায় রাঙাপথ বলেই ডাকব।
আর রাঙাপথ বলে েেডকে, যদি
আমি খুঁজে পাই চরাচর ।
যে চরাচরের একটিই পথ ,আমাকে হাতছানি দেয়
আর ভালবাসার সিগন্যাল দেখিয়ে
জীবনের প্রোতাশ্রয়ে,
জোয়ারের জলে ভাষায় শব্দের ভেলা।

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না,
তোমায় রোদ্দুর বলেই ডাকব।
যদি রোদ্দুর বলে ডেকে প্রাণের উৎসে পৌঁছে যাই,
আর খুঁজে আনি অঙ্কুরোদগমের শর্ত ।
অথবা রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে
আকাশগঙ্গা পথে দাঁড়িয়ে,
যদি পৃথিবীর জন্য লিখি মনকেমনের কবিতা ।

তোমাকে আর মেঘবালিকা বলে ডাকব না,
তোমায় চেতনা বলেই ডাকব ।
আর চেতনা বলে ডেকে যদি
আমি ছুঁয়ে ফেলতে পারি ।
সমস্ত সম্পর্কের ভগ্ন-হৃদয় ।
আর বিপ্লবের তাজারক্তে ভেজা নদীতে
যদি গড়ে দিতে পারি সম্পর্কের সাঁকো
যে সম্পকের সাঁকো পার হতে হতে তুমি বলবে-
না, আমায় মেঘবালিকা বলে ডেকোনা ।