গাঙ ভাঙা চরে বুক ভাঙা মানুষ !
গাঙ ভাঙা চরে বুক ভাঙা মানুষ
মিসির হাছনাইন
তখন মাঘ মাসের মাঝামাঝি। উত্তরের বাতাস মনে হয় চলমান মানুষটাকে উড়িয়ে নি যেতে পারবে। ভরদুপুরে সুরেলা গাছের পাতা কণ্ঠে একটানা ডেকেই যাচ্ছে ঘুঘুপাখি। উত্তাল মেঘনা কেমন শান্ত এক পুকুর, পরিষ্কার জলের গায়ে কতগুলো বক উড়ে উড়ে নদীটা পাড়ি দিয়ে ঐ চরের কেওড়া বনে চলে গেল। নদীর জল জোয়ারেও খাল পর্যন্ত আসে না, জুতা পায়ে খাল পেরিয়ে গেলেই মাঠ, দশ কদম হাঁটলেই নদী। ঐ তো ভাঙা টিলার উঁচু জায়গায় বিন্দি জালে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরছে সবুজ মাঝি। তিনি এই গাঁয়ের জামাই, পুবের চর মানিকায় ঘর, সৎ বাপের ঘরে মায়ের ছলছল চোখ আর দেখবে না বলেইথ বছর দুয়েক আগে বর্ষার এক বৃষ্টিতে নৌকার গুন টানতে টানতে... এতদূর মায়ের দেশ নদীর পাশে বেড়ীবাঁধ, মামা ছলিমের নৌকায় ওঠে মাছ ধরতে যায় সাগরেরও আগে, যৌতুকের দেড় লাখে একখানা নৌকায় বিশ বছরের নয়া যৌবনের ঘর পেতেছে বাবলা গাছের তলে। আর কখনও সে চর মানিকায় গিয়েছিল কিনা তা অজানাই থাক। উচ্চতায় গুল্ম বৃক্ষের সমান, কালো গায়ের রঙ মেখে কত সহজসরল এই মানুষটা বছরের পর বছর ধানিয়াপুর গাঁয়ে বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁটে হেসে হেসে জীবন ভাঙছে মেঘনা নদীর কূলে।
তিন বছরের সংসার, বীণার বয়স পনেরো থেকে ষোলতে পড়েছে.. তখনই তাঁর বিয়ে হয়। লাজুক স্বভাবের এই ষোড়শী কখনও কোন পুরুষের ছায়ায় দাঁড়িয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল, কত সহজ, আর, কত ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া তাঁর। পড়াশোনা ক্লাস ফাইভ, কোন রকমে দুই বেলা খাওয়া তিন বোনের অভাবের সংসারে, মা তাঁরে উপজেলা শহরে কাজে দেয়থ পৌর কাউন্সিলর জলিল মুন্সীর ঘরে। মফস্বল শহরের হাওয়ায় বছর ঘুরতেই বীণাকে যে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না নদীর কূলে ঘর। বুকের ওড়না ভালোমতন জড়িয়ে নিতে গেল পাশের ঘরের কলেজ পড়–য়া রিপনের তাকিয়ে থাকা প্রেম লুকিয়ে রাখা চোখথ ধরা পড়ে গেলে বীণা চলে আসে গাঁয়ে। এর কয়েকদিন পরই বীণার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের বছরই তাদের প্রথম সন্তান মারা যায়, কখনও মনেই হয়নি, মৃত জন্ম দেওয়া ছেলে বুকে জড়িয়ে কেটে যাওয়া শোক মুছে বীণা আবার আগের মতন হাসবে, পরাণের স্বামীর জন্যে একলা ঘরে শুয়ে শুয়ে চেরাগ জ¦ালা আলোয় শ্যামলা মুখখানা অপেক্ষায় অপেক্ষার রাত জাগবে, বিছনার ফুল কত সুন্দর সাজবে।
বুকের শোক গোপন করে আবার মা হয় বীণা।
সেবার ইলিশের মৌসুম। নিজের ছোড নাওখান বেচে দিয়ে আবার মামার নৌকায় ওঠে সবুজ। নদীর এদিকটার চেয়ে সাগরের আগে নদীর ¯্রােতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। তার কারণে অনেক নৌকা এক মাসের খরচে সাগরের কাছাকাছি সামরাজ যায় মাছ মারতে। মামার নৌকা এক মাস পর, সামরাজ থেকে ফেরার দিনে মামাতো ভাই আকরামকে বলে সে চিটাগাং চলে যায়। ততদিনে ফোনে ফোনে কথা হতো বীণার সাথে, বীণাদের ঘর ছিল দুই ঘর পরেই, পনেরো দিন পর পর সবুজ দুই হাজার করে টাকা পাঠাতো। আন্তরিকতায় ভরপুর এই মানুষটা ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে, দূর দেশের মানুষকে করেছে আপন। বাপ মরা এতিম এই ছেলেটার কাহিনী আমি লিখছি.. তার আগে চলুন গায়ের মাঝখান থেকে ঘুরে আসি।
২.
নদীভাঙা ধানিয়াপুর গাঁও। মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা পুবে মেঘনার বেড়ীবাঁধথ উত্তর-দক্ষিনে চলে গেছে নদী ঘেঁষে আর পশ্চিমে আনন্দ বাজার হয়ে উপজেলা শহরের দিক চলে যাওয়া রাস্তার দু ধারে পাশাপাশি নদীভাঙা মানুষের ঘর, এদের প্রায় সবাই ছিল এককালে কৃষক, সময়ের চলে যাওয়া দিনে এখন কেউ কেউ বাজারের ব্যাবসায়, তিন, চার ঘরের কেউ শিক্ষক, চৌকিদার, দলিল লেখক, গাঁয়ের মেম্বার। নদী থেকে বের হওয়া বিশাল বড় খালটা এখন বাঁধ দিতে দিতে হয়ে গেছে ছোট ছোট পুকুর। পুরো গাঁয়ে একশো খানা ঘর, বেড়ীবাঁধের উপর নদীর আয়ে খাওয়া মানুষের এক কালের কষ্ট, না খেয়ে থাকার দিন অনেকটা মুছে গেছে। এই একশো কি তার একটু বেশি পরিবারথ ধনিয়াপুর মতলব হাজী হাওলাদার জামে মসজিদে সব পেশার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক আল্লাহর উপসনায় নিজের জানা দুঃখে নীরবে কাঁদে, আহা! সবাই খোঁজে পরকালের সুখ।
একটু আগে ঘরের সামনে রাস্তায় ওঠে পুকুরের ঐ পাড় মেম্বার বাড়ির ঘাটে, রতন মেম্বার দেখলাম বসে আছে। হঠাৎ হৈ চৈ আওয়াজ আর কান্নার বিলাপে আকরাম এক ভোঁ দৌড়ে চলে আসে মেম্বার বাড়ির উঠানে। মেম্বারকে কাঁধে ভর করে ঘরের বিছনায় শোয়ানো হল, ডাক্তার আসবে বাজার থেকে, একটু চেকাপ করে ওষুধ দিলেই ত সুস্থ, এর আগেও অনেকবার এই অবস্থায় পড়তে হয়েছিল তাঁকে। মাথায় তেলে পানি দিতে দিতে সিলিং ফ্যান ঘুরলেও অনেকে বাতাস দিচ্ছিল, হঠাৎ শোয়া থেকে ওঠে বসে, তারপর বমি করে, এবং চিৎকার দিয়া বলে- “ওরে বুকটা বুঝি গেলো রে”.... পুরো শরীর একবার ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ দিয়ে প্রাণপাখি উড়ে গেছে ঐ আকাশে। আহা! দিব্যি সুস্থ মানুষটা দুনিয়া থেকে পাড়ি দিল পরপারে। হায়রে!! মানুষের মৃত্যু, কত সহজ, কতটা সত্য
যেমন দেখি না পিঠের দাঁগ, পোড়া হৃদয়।
শোকে ঢাকা পুরো গাঁয়ের পশুপাখি, গাছপালা দিনের সূর্য আর রাতের অমাবস্যা। চিটাগাং থেকে খবর পেয়ে সবুজ গাঁয়ে আসছে পরশু। বীণা পোয়াতিথ অন্য সবার মতন তাঁরও জানতে ইচ্ছা হয় পেটের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে।
তবে, যা হা হোক বীণা তাতেই খুশি। সেদিন সন্ধ্যায় ছোট ছোট চুল আর লাল রঙের শার্টে সবুজকে দেখেই বীণার শরম লাগে, এতদিনে সে তাঁর স্বামীর মুখ দেখেনি, শুধু হৃদয়ে খুঁজেছে, যখন তখন কাছে চেয়েছে, আজ হয়তো হঠাৎ দেখায় বুকের ভেতরকার শরম নাকি অন্যকিছুথ
বুঝে ওঠার আগেই বীণা মুখ লুকায়।
“আরো কয়দিন পরে আসতেন। আমি ত ভালোই আছি। দেখবেন, দেখবেন নকশিকাঁথা সেলাই করছি, এই যে ঐখানে দেখেন কতগুলো টাকা জমাইছি...আমগো বাবু হওনের সময় লাগবো, আপনে অনেক হুকায় গেছেন”। একদমে কথাগুলো বললো বীণা।
“হইছে হইছে তুমি এখন রেস্ট লও, এই যে ফল এগুলা খাবা, মামা আর তোমাদের ঘরের জন্যও আনছি, এখন শুয়ে থাকো, উঠতে হবে না, ফল ধুয়েমুছে কেটে দিচ্ছিথ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ব’লে সবুজ একটা সিগারেট ধরায়, তারপর, বাজারে যায়।
তার ঠিক সাতদিন পর, গভীর রাতে বীণার প্রচন্ড ব্যথা ওঠে। অনেক কষ্টে একটা অটো রিকশা জোগাড় করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সবুজের জমানো সব টাকা সে লুঙ্গির প্যাঁচে বেঁধে নেয়। সমস্ত টাকা আর সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়েও সেদিন বাঁচতে পারে নি বাণী ও তার পেটের ফুটফুটে নয়মাসের কন্যা সন্তান। কত অল্পতেই মিলে গেলো তার ছোট্ট সংসারের সুখ দুঃখের হাসিমাখা রাতদিন।
সবুজের বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া মুখ যে কেউ দেখলেই মনে হবে আকাশ ভাঙা অপরাধ তাঁর।
এক মাস পর বিয়ে করে রেজিনা নামের এক মেয়েকে।
রবি মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ, তিন মাস অবরোধ। এখন জেলেরা রাতদিন বাগদা পোনা ধরছে। একটা কম্বল গায়ে মুড়ে গুটিশুটি নদীর কূল ঘেঁষে উঁচু জায়গাতে যেখানে এক সময় বসতবাড়ি ছিল জোনাক জ¦লা আলোতে দক্ষিণা পিনপিনে বাতাসে সবুজ মাঝি বড় একটা প্লাস্টিকের বাটি থেকে থালাতে পানি নিয়ে হাতের চামচ দিয়ে বাগদা পোনা আলাদা করে পাশের ছোটো বালতিতে রাখছে। রাতদুপুরে পোনা বেশি পাওয়া যায়। একশো পোনার দাম পঁচিশ টাকা। হকার এসে পোনা নিয়ে যায়। রাতদিন মিলে হাজার পোনা ধরতে পারলেই চলে, মাঝেমধ্যে অনেকের পরিশ্রম আর মেধায় হাজার ছাড়িয়ে যায়।
বাগদাথগোলদা পোনা বৈধ ভাবে ধরা নিষেধ আছে, কারণ হাজার হাজার ছোট ছোট মাছ জালে আটকা পড়ে, শুধু পরিনিত পোনা রেখে বাকি জলসহ মাছ ডাঙায় ফেলে রাখে, ফলে সব মাছ মরে যায়। সরকারি ভাবে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও অনেকে চুরি করে মাছ ধরে।
এই সময় নদীতে কোস্টগার্ড নৌকা নিয়ে টহল দেয়। যখন তখন যে কেউ ধরা পড়তে পারে, তাই সবাই সতর্ক থাকে।
সবুজ মনে মনে রেজিনার কথা ভাবতেছিল, ঐ তো কাল রাতের ঘটনায় হাতের থালাভর্তি চোখে বাগদা চিংড়ির পোনা রাখতে রাখতে একটা বিড়ি ধরায়, হঠাৎ করে হা হা হা করে হাসে। কিন্তু, কেন হাসলো সে কথা বুঝতে পারে না সবুজ। চারদিকের অন্ধকার আর শীতের বাতাস বারবার মনে পড়ছে রেজিনার মুখ। নদীর ঘোলা জলে লম্বা বাঁশের সাথে বাঁধা বিন্দি জাল, এক ঘন্টা পর পর টান দিয়ে তুলতে হয়, মাঝখানের বিশ্রামে মাঝির ছোট্ট টঙ ঘরে গিয়ে সোজা শুয়ে পড়েথাকতসব কি জানি হাবিজাবি দেখতেছিল হঠাৎ চোখ খোলে রেজিনাকে দেখতে পেয়ে সবুজ দৌড়ে পালায়।
কিছুদূর গিয়ে একটা উল্টে যাওয়া খেঁজুর গাছের গুড়ির উপর বসে একটা বিড়ি ধরায়। মনে মনে বলে- “শ্লার পুতের শান্তি নাই! কান্তি নাই! তারপর হা হা হা... করে হাসে। কেন যে বারবার হাসিটা চলে আসে বুঝতে গেলেই মনে পড়ে রেজিনার মুখ। না, না বীণার করুণ চোখ
কে যেনো ডাকে, এমন একটা ডাকে তাঁর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, এক জীবনে কত পাপ করেছে সে, এক নারীকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে, পেতেছে সংসার গাঙ ভাঙা চরে, তবুও ছোট্ট বুকে কতটুকু আশা লয়ে মানুষ নদীর জলে গান গায়থ বুক পোড়া দুঃখে বেঁচে থাকে, তাকিয়ে থাকা চোখে কেমন মুখখানি দেখে দেখে মানুষটা জীবনভর হা হা হা... হাসে।
ডুমুরের ফুল
ডুমুরের ফুল
নেহাল অর্ক
আমার স্বামীরে ওরা মাইরা ফালাইছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তহন কিছু বুঝি নাই; নইলে কী তারে যুদ্ধ করতে দিতাম! আমাগো কি লাভ হইছে কিছু? যা হইবার হেগু হইছে। বলতে বলতে ভগীরথী বাজারে যাচ্ছে। সংসারে আয়-রোজগার নাই; একটা গাভীর দুধ বিক্রি করে কোনোরকম চলছে জীবন। যৌবনের চঞ্চলতাকে সে বিসর্জন দিয়েছে একাত্তরের সাথেই।
মাসি কী নিতে বাজারে এলে? সজল, একজন ব্যবসায়ী, জিজ্ঞেস করতেই ভগীরথী কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বলে। ভগীরথী তার কাছ থেকেই সওদা করে কখনও নগদ দেয়; কিছুটা বাকিও থাকে। নগদ বাকির দেনা-পাওনার মাঝেই নিঃসন্তান ভগীরথী কখন যৌবন পেরিয়ে স্বামীর ঘর ভালোবেসে দত্তপুর গ্রামে পড়ে আছে তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু তার এই ত্যাগের মূল্য কই? ক’জনই জানে ক্ষুধা আর জীবনের চাহিদা তাকে যে পরাজিত করে দিয়েছে তার কাহিনী? সজল বাবার কাছ হতে ভগীরথীর কাহিনী শুনে চোখের জলও ফেলেছে; কিন্তু এ পর্যন্তই। একদিন দোকানে বসে ভগীরথী বলেছিলো, রেডিওতে শেখ সাহেবের ভাষণে কিভাবে মোহিত হয়ে নবযৌবনের কোল হতে তার স্বামীকে ছেড়ে দিতেও সেদিন কুণ্ঠাবোধ করেনি। এসব গালগল্পের মাঝেই কেউ একজন বললো, সজল কেমন আছো?
স্যার ভালো আছি; বলেই সজল চেয়ারটা এগিয়ে দেয় জব্বার সাহেবের দিকে। উনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। জব্বার সাহেবকে দেখেই ভগীরথী চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একাত্তরের সময়ের কথা বলতে থাকে জব্বার সাহেব। স্যারের মুখের দিকে চেয়ে সজল বলে, লোকমুখে শুনেছি ইদন চাচার ঘরে নাকি অনেক হিন্দু পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলো? আয়ুব আলীর গোষ্ঠীর লোকজন নাকি পাকিস্তান বাহিনীর কাছে হিন্দুদের সব তথ্য দিতো?
ঠিকই বলেছো সজল; এরা এখনও দাপট নিয়ে চলছে। এইতো কদিন আগে তাদের গোষ্ঠীর লোকজন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে; কিন্তু উল্টো মেয়েকেই শাস্তি পেতে হলো।
ঠিকই বলেছেন স্যার, বলেই সজল ও স্যার ভগীরথী ও সমকালীন ঘটনার পূর্বাপর আলাপ করতে লাগলো; আরও দুএকজন এসে যোগ দিলো। এই আলোচনার শুরু হয়; শেষ হয় না। জব্বার সাহেব বাহিরে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কেউ একজন বিড়বিড় করে বলে ভগীরথীরা আজ খেতে পায় না ঠিকমতো; অথচ রাজাকার ও তাদের দোসররা আজ রাষ্ট্রীয় সুবিধা কুক্ষিগত করছে। জব্বার সাহেব মাথা নাড়ে আর বলে, নদীর ¯্রােতের মতোই সময়ের ডানায় চড়ে স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছরের জন্মের ইতিহাস পেরিয়ে এলো; কিন্তু ক’জন এর সুফল পেলো? ভগীরথীর মতো আরও অনেক দরিদ্র মানুষ বঞ্চনা বুকে ধরে ক্ষুধার আর্তনাদে চটফট করছে। তাদের কাছে স্বাধীনতার সুখ ডুমুরফুলের মতোই দুর্লভ ; যা আজন্মকাল অধরাই থেকে যায়।
হবিগঞ্জ।
পদাবলি : ০১
প্রেম
আনোয়ার কামাল
শুকনো নদীর তলদেশে
জলের ধারা ঘুমিয়ে থাকে
আবারÑ
সুপ্ত নদী কখনো
আগ্নেয়গিরির মতো জেগে ওঠেÑ
প্রেমও কী তাই?
তালগাছ ও শিশুতোষ বই
দ্বীপ সরকার
শিশুতোষ বইয়ে
পুরনো একটা তালগাছ
পৃষ্টার এক কোণায়
একটা বাবুই এসে তালগাছে পড়তেই
বইটা নড়ে ওঠে
পাঠরত শিশু বই চেপে ধরে
বাবুইটা শিশুতোষ প্রাণী আগে জানিনি
আমি তালগাছ ধরতে গিয়ে ধরে আনি বাবুই
বাবুই ধরতে গিয়ে তালগাছ
অথচ শিশুদের ধরা শিখলে
গোটা জাতিকে ধরা শিখতাম
কবি ও কবিতা
আদ্যনাথ ঘোষ
এই খোলা চোখ দুটো
কেবলই শূন্যে
পড়ে থাকে।
শুধু কবিতার মাঠ সবুজের বুকে
একাকী ঘুমহীন জেগে থাকে।
খোলা চুলে দুয়ারে দাঁড়ায়
পরাণে উথলিয়া ওঠে
ঢেউ-নোনা জল
যেমন মাধবী লতা দোল খায়
বাতাসের গন্ধে মেতে
ভরা জোছনায়।
অথচ ঝিলের কান্না
মিশে যায় গাঙুরের জলের ভিতর।
চাঁদের বুকখানি কাঁদে
শিবহীন পূজায়।
যতনে শিল্পের ঢেউ খুঁজে চলে কবি
ছন্দ উপমার ভেতর
শব্দের দোলায়।
তবুও মনসার ছোবলÑ
ভেঙে যায় কবিতার
বুকের গড়ন।
আর তার রূপ রস
ধ্বনির শরীর ঘেঁটে
নারীর ভেতর
যুবতী সংসারে করে ডুবুরি যাপন।
একটি অপূর্ণ ভালবাসা
ফারিহা ইয়াসমিন
শুনেছি ভালোবাসা নাকি রং বদলায়।
বিশ্বাস করো, যদি তাই হতো বদলে যেতাম আমি।
এই ছকে বাঁধা জীবনের অপূর্ণ ভালোবাসা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে তুমি।
ভালোবেসেছি বটে, তবে তোমার কোন চাওয়াই করতে পারেনি পূরণ।
সত্যিই অভিমান হওয়ারই কথা, আর অনুরাগেরও আছে হাজার কারণ।
কেনই বা ভালোবাসবে আমায় আমি যে বড্ড বেমানান,
কতটুকু ভালবাসি তোমায় কখনো দিতে পারিনি প্রমাণ।
যে ভালবাসায় পূর্ণতার পরিতৃপ্তি নেই,
পাশে থাকার অঙ্গীকার নেই;
যে প্রেম এত বৈচিত্র্যময়।
সেখানে তো থাকবেই প্রতিমুহূর্তে তোমাকে হারানোর ভয়।
আমি তো তোমার কঠিন দুঃসময়ে পাশে থেকে নির্বিঘ্নে বাড়াতে পারেনি দু হাত।
তোমার কষ্টের সঙ্গী হয়ে কখনো জাগতে পারিনি রাত।
তাহলে কেনই বা মনে রাখবে আমায়,
আমি যে ভালোবাসাকে দিতে পারিনি পূর্ণতার স্বাদ।
তাইতো হৃদয়ের গভীরে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে শ্যাওলা জমেছে রোজ রোজ,
হয়তো মনের অজান্তে তুমিও করে চলেছো এক অজানা সুখের খোঁজ।
সত্যিই যদি তাই, হয় তবে তাই হোক।
আমার জন্য ভিজবে না আর তোমার দুটি চোখ।
যত কষ্টই হোক আমার, আমিও নিয়ন্ত্রণ করবো আমার অবাঞ্চিত আবেগ।
তবে হ্যাঁ শুধু এতোটুকুই মনে রেখো, আমার মনের গভীরতায় চিরদিন রবে তুমি।
এই পবিত্র ভালোবাসার প্রতিটি পরতে সুখের লীলাভূমি।
সাধক কৃষাণ
রতন ইসলাম
কিণাঙ্কে শ্রমের মানচিত্র
বাস্তবতার অপাঙ্গ চাহনি
চোখের কোণে জমানো ক্লান্তির কাদম্বিনী
বুকে চাপা পড়া স্বপ্ন-কোঁড়ক
পিঠ বেয়ে নেমে আসে বাহুচরে
রোদ পোড়াগন্ধ
বর্ণহীন জীবনকে জিইয়ে রাখার
জোড়াতালি প্রচেষ্টা
নিঃসীম ধৈর্যে গিরিপথ ধরে তবুও চলা;
অন্যের উদরে তৃপ্তির-মুক্তির পিদিম জ¦ালাতে
ওখানেই যেন বিরাট স্বার্থকতার শিখর-ছোঁয়া
সে স্বার্থকতা....
বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণার মন্ত্র জোগায়।
পদাবলি : ০১
প্রস্তাব
অসীম মালিক
উনুনে ফিরিয়ে দাও,
হিংসার আগুন !
সাঁঝ প্রদীপের দিকে তাকিয়ে
সলতে হও।
ইজরায়েল, ফিলিস্তিনের রান্নাঘরে এসো,
মায়ের হাতে রান্না খেতে খেতে
দু’জনে হব -
রান্নাঘরের দেশলাই কাঠি।
স্মৃতি সত্তা ও ভবিষ্যৎ
ধীমান ব্রহ্মচারী
আমি মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম বিকেল ঠিক পৌনে চারটে নাগাদ
ফসিলের আস্তারণ সরিয়ে ভাবলাম এবার ঘরে ফিরতে পারব
অথচ পারলাম কি ?
বার বার কালো ছায়ার মতো প্রশ্ন গুলো আমাকে ঘিরে পাক খেল পূর্ব থেকে পশ্চিমে
ঘড়িটার কাঁটা ততক্ষণে আরো একটা ঘর পেরিয়েছে
অথচ আমি মরলাম কি?
কফিনের ভেতরকার স্থবির হয়ে পড়ে থাকা মৃত দেহ গুলো যেন ফিরে পেতে উৎগ্রীব তাদের জীবন
অথচ জীবন ফিরে পাচ্ছে ওরা?
শ্লোগান দল তন্ত্রের ভিত্তি প্রস্তর, আর আমরা জনগণ গড়ছি ইমারত
অঝোর বর্ষায় মাঠ ভেসে যাচ্ছে, জলে হাবুডুবু খাচ্ছি, তবুও শালা মরছি না
হয়তো মৃত্যু আমাদের ডাক দ্যায় না
ক্ষয়
তামিম হাসান
রং পেন্সিলের মতো হচ্ছি ক্ষয়,
কিভাবে যেনো হয়েছিলো হঠাৎ
আমাদের পরিচয়।
বরষার জলধারায়,
কে যেনো মেঘের রেলিং ছুঁয়ে দাড়ায়!
বিদ্যুৎ চমকে ক্ষনিকেই হারায়।
কিছু দৃষ্টি হঠাৎ আকর্ষনের সৃষ্টি!
এই মেঘময় শহরে শিলাবৃষ্টি।
তোমারে আজ দ্যাখবো
রোদ্দুর রিফাত
তোমারে দেখিনা অনেকদিন আজ দ্যাখবো;
পুষ্পশরীর নিয়ে এসো— আমি উল্লাস মোড়ের
পাশে জলাশয়ের কাছে রেইন্ট্রিতলায় দাঁড়িয়ে থাকবো।
আজ চুল খোলা রেখে মেরুন হিজাব আলনাতে তুলে
আমার দেওয়া কালো টিপের পাতা থেকে একটা টিপ
ললাটে চেপে নির্ভুল কাজল রেখা টেনে আমার সামনে দাঁড়িয়ো।
তোমারে আজ দ্যাখবো; যেভাবে দ্যাখে নারী
স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে পছন্দের নেকলেস—
দ্যাখতে দ্যাখতে তোমার হাত ছোঁব, নাকে নাক ঘষে
নাকফুল থেকে সোনালী উজ্জ¦লতা ধার নিবো,
চিবুকের তিলে রাখবো আঙ্গুল আলতো করে
তখন নিসর্গ কালিমা পাঠ করবে আর আমি তোমার ভিতর যাবো তারপর নির্ভুল বানানে
লিখে দিবো এক দীর্ঘ কবিতা যেখানে হেরে যাবে একটি সন্ধ্যা।
আর কিছু হলো না;
রাকিবুল হাসান রাকিব
তার সাথে...
ক’দিন আগে দেখা হলো
ক’দিন আগে কথা হলো...
তার সাথে...
কিছু রাগ; অভিমান; ঝগড়াঝাটি;
কখনো হাসি; কখনো কান্নাকাটি।
কভু পাশে; কভু দূরে; কভু মাঝামাঝি।
তার সাথে...
সবকিছু হলো জমানো হলো ঋণ;
কখনো আপন; কখনো পর বাজে বীণ
যাবার বেলা হলো... মন উদাসীন।
তার সাথে...
আর কথা হলো না; দেখা হলো না;
দিন কেটে রাত হলো দিন হলো না?
তার সাথে কিছু হলো না।
কারও প্রতি আমার প্রতি কারও
রাগ; অভিমান; ভালোবাসা; বদনাম!
আর কিন্তু হলো না; আর কিছু রইলো না।
হেমন্তের বিকেলে
আহরাফ রবিন
হলুদ হেমন্তের বিকেল।
পাতা ঝরা ক্ষণে
ভেসে যেতে চাই চলে যেতে চাই।
হলুদের ভেতর আজ গুমোট
হাওয়া। অস্থির মাতাল সময়।
মাঠে কার্তিকের ধান-
ইছামতি আর কালিগঙ্গায়
শান্ত জল- মৃদু শীতল স্রোত।
নবনীতা
বৃক্ষ
নদী
কবিতা- আমি চলে যাচ্ছি
এই হেমন্তের খোলা হাওয়ায়।
বেদনার নীল বালুচর
জান্নাতুন নাহার নূপুর
আজ আমি বলতে চাই
আমার স্বপ্নের পুরুষের কথা
স্বপ্নে আসা সেই পুরুষটি একজন বীর পুরুষ
স্বপ্নের ভেতর দেখি তাকে অনিমিখ লোচনে
কি মায়া! তার চোখে
কি ভালোবাসা! প্রশস্ত চওড়া বুকে
যে বুকে ঠাঁই পেয়েছিল এই বাংলা
ঠাঁই পেয়েছিল কুলি-মজুর
ঠাঁই পেয়েছিল কৃষক-শ্রমিক
ঠাঁই পেয়েছিল অনাহারে থাকা, কষ্টে থাকা
বঞ্চিত, লাঞ্চিত বেদনাহত মানুষগুলো।
ঠাঁই পেয়েছিল এই বাংলার প্রতিটি মানুষ।
অষ্টরম্ভা এই জন্মভূমিতে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীনতার
বপন করেছিল সোনার দেশ, বাংলাদেশ।
সোনার দেশে আমার স্বপ্নের পুরুষটিই একদিন ‘বলি’ হলো,
তাঁকে শুইয়ে দিলো চিরনিদ্রায় লাল পাঞ্জাবী পরিয়ে
তাঁকে আর তাই ছুঁয়ে দেখা হলোনা আঙ্গুলের ডগায়।
স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে আজীবন
তাঁর স্মৃতিকে শূন্য বুকে আকড়ে ধরে বাকিটা পথ
হাঁটতে হবে অজানার পথে.....
ভালো থেকো স্বপ্নের প্রিয় পুরুষ আমার,
আমি থেকে গেলাম
বেদনার নীল বালুচরে!
শব্দমালা : সাদিক আল আমিন
শব্দমালা
সাদিক আল আমিন
জেঠ মাস
জেঠ মাসে ওরা বিয়ে করে। জেঠ মাসে ওরা পানপাতা চিবিয়ে বৃষ্টিতে নাচে তা-ধিনধিন। বৃষ্টি থামলে ওরা হলদে সালোয়ার পরিহিতা নির্লিপ্ত বালিকাকে ভিজে চপচপ হেঁটে যেতে দেখে। দেখতে দেখতে মেঘ ঘনিয়ে শুরু হয় ঝড়। জেঠ মাসে ওরা ঝড়ের বিপরীতে নিজেদের দেহ ঋজু রাখার চেষ্টা করেÑ উড়োচুল সারিসারি ডাবগাছের মতো। জেঠ মাসে সব হলুদ ভিজে যায়। জেঠ মাসে সব গাছে মৌসুমি ঘ্রাণ। জেঠ মাসে ওরা টিনের ছাউনিওয়ালা টাঁটির বেড়ার ঘর বানিয়ে থাকে ফাঁকা কান্দরেÑ তালগাছের বাবুই পাখি যেন। একটু পরেই আবার উড়ে যায় টিন, তাঁতিবাবুইয়ের বাসা, হলুদ সালোয়ার। জেঠ মাসে শ্বশুরঘর থেকে আব্বার বাড়িতে ফিরে আসে ঘরজামাই সোলটেশ। গত জেঠেই ওর বিয়ে হয়েছিলÑ মনে করতে করতে বৃষ্টিতে ভিজে আর পানপাতা চিবায় সে।
অতীতকাল
বুনোহাঁস খুঁটে খুঁটে খায় মানুষের
মাটিতলে লুকিয়ে রাখা অতীত
খেয়ে বড় হয়; হতে হতে
বুকভর্তি পালকে মেলে দেয় সমস্ত শাদা
শাদার ভিতরে লুকিয়ে থাকে ধরণীর ওম
ওমের ভিতরে থাকে সুখ, অন্তিম আমোদ
বুনোহাঁস আমোদে ডানা মেলে উড়ে যায়
ফেলে যায় তার নিজের অতীত
মানুষ সেই অতীত চুমে কবিতা লেখে উপমায়
অথচ নিজের অতীত নিজের কাছে
কেন এত তেতো লাগে প্রিয়?
গন্ধবকুলের শুভ্রশোক
আমার ভীষণ রোগা দাদীমার ক্রমেই কমছে আয়ু
সেই সাথে দাদাও পাল্লা দিয়ে যুবক হয়ে ওঠে
কী করুণ জীবন দান করে আবার থেমে গেছে জরায়ু!
ভাঙা রাতের ভেজানো কপাটে জীবনকথা ফোঁটে
আমি ছোট শিশু হবে বয়স চার কি পাঁচ
আলোহীন কলহাস্যে দেখছি কতো শোক
ভুলে থাকো যদি, পারবে না কখনো করতে আঁচ
দেখে ফেলেও না দেখার ভান করা অসতর্ক চোখ
নিভু নিভু চেরাগের কেরোসিন মৃদু হাওয়ায় কাটায় রাত
দেখে নিও তখনÑ হাফপ্যান্ট-পরা আমাকে, ভাবুক
জীবনের জানা নেই আছে তখনো কতো ঘাত-প্রতিঘাত
আমি গালে হাত দিয়ে একা বসে থাকি উজবুক
দাদা পিঠে শীর্ণ হাত চাপড়ে বলে, ‘বেটি সে কার?’
আমি অকস্মাৎ খুব চমকে লজ্জায় মুখ চেপে ধরি তার
বিরতি
আরও একটু সময় দিলে
হাসবো আমরা
আপাতত বিষাদ নিয়ে
থাকতে দাও
কিছুটা সময়
কে জানে!
হয়তো-বা বিষাদেই লুকোনো আছে
তোমার হারানো গ্রাম, সবুজ ধানখেত
আমি কেবল-ই কৃষক হয়ে
চষে বেড়াই তোমার ভূমি
সহস্র বর্গমাইল
আপাতত বিষাদেই থাকি নিহিত
বৃষ্টিরাত, ঝড়গ্রাম, বোশেখ, রাতের বাতাস
কেমন শূন্যসুখের লোভ জাগায়!
তোমাকে পাওয়ার থেকেও
লোভনীয় সে লোভ
আরও একটু সময় দাও
বিষাদ চুমি
তারপর না’হয় মিথ্যে হাসি
হাসবো দু’জন!