পদাবলি
নোনাজলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে বালিশ
শহিদুল আলীম
দু’চোখের নোনাজলের ঝর্ণা বুকে চুষে নেয় নিরীহ বালিশ, যেমন করে নিতাম চুষে তোমার ঠোঁটের অতুল্যতেজ বিষ, অবাক লাগে এতো জল কী করে ধরে তার বুকের অধরে, দিনের জমানো বিন্দু বিন্দু গ্লানি মাথা রেখেই ঢালি তার সদরে
নদী নয়, সাগর নয়, রোজ রাতে ঝর্ণা নামে বালিশের বুকে-
নিষ্প্রাণ জড়-কাপড়-তুলো তবুও ভিজে যে কারো দুঃখে, নোনাজলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে বালিশ। কখনো করেনি দ্রোহ, প্রবঞ্চিত হৃদয়ের আগুনের ঝাঁজে ভেঙে দিলো সুখের মোহ;
ভালোবাসা ভুলে লাথি দিলো হৃদপি-ে- মাংসের পুতুল, অবুঝ জড়পদার্থ বালিশ প্রেম বুঝে না; তবুও কেমন অতুল!
হায়- বিধি; মিথ্যে মায়ার সংসারে জোড়েন এ-কেমন জোড়, নিমিষেই অর্ধাঙ্গ হয়ে যায় নাগিন; সাধের সংসার বিষফোঁড়!
আমার পরিচয়
তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন
যে নাবিক পথ হারিয়েছে, আমি সেই নাবিকের সহযাত্রী-
যে নদী চাঁদের আলোয় স্নান করে আমি সেই নদীতে সাঁতার কাটি।
যে প্রেমিকা পুড়িয়ে ফেলেছে তার প্রেমিকের চিঠি;- আমি তার প্রেমিক!
যে কবির কাব্যের পা-ুলিপি হয়ে গেছে ধূসর; নিভে গেছে জীবনের সব রঙ,
সে কবি হবার জন্য আমি বুক চাপড়াই।
রক্তের দামে যে দেশ কিনেছে স্বাধীনতা-
আমি সে দেশের পরাধীন নাগরিক।
ধর্ষিত নারীর গর্ভে যে শিশু জন্মাবার আগেই মৃত্যুকে করেছে আলিঙ্গন;
পৃথিবী জেনে রাখুক, আমি সেই ধর্ষিত মায়ের সন্তান!
বাবার হাত
আহমদ মেহেদী
তোমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকা আমার ডানপিটে দিনগুলো,
আজ কত দূরত্ব এ পারের বয়ে চলার ষ্টেশনগুলোতে-হুলস্থূল ভিড়ে
তোমার হাতে বাঁধাই করা আমার ছেলেবেলার বইয়ের খোঁজে,
তোমার আনা দেয়াল ঘড়িটার নিরবচ্ছিন্ন স্রোত- আমাকে ভীত করেনা
আমার একাকিত্বে চান্নির সাথে হাটতে তুমিই শিখেয়েছিলে-
কোন এক চাতক পাখির সাথে।
তোমার যতা দুঃখ আর গ্লানিমুক্তির জন্যে তুমি আমায় জন্ম দিয়েছিলে,
এ সংসারের বেদখল উৎকণ্ঠায় বরাবরই আমার ললাটে রাজ তিলক
দেখার আজন্ম গোপন ইচ্ছে,
দেখিলে না, দেখিতে পারিলে না- জানিতে পারিলেনা তোমার আধুনিক
ছেলেটি তোমার জন্যে বৃদ্ধাশ্রমের কথা একটি মুহূর্তের জন্যেও ভাবেনি !
চারপাশে এত কোলাহল-মধুরতা-বিশালতা, তুমি ছাড়া মনে বিন্দুমাত্র সাড়া দেয় না,
আমার সঞ্চিত স্বপ্নের মাঝি, বাবা- তুমি নেই !
জীবনের মহাসংকটে, প্রভু-অর্থের মহান মিছিলে একটি বুলেটের ভয়ে,
বাবা তোমার পূণ্যময় দুটি হাতের স্পর্শ পেতে বড় বেশি ইচ্ছে করে !
একাকীত্ব আজ বহুদূর!
কোহিনুর আকতার
নিঃসঙ্গতার তাড়নায়
গোপন বেদনার যেই নৃত্য ছিল হৃদয়ে;
সেই চাপা ক্ষত থামলো আজ-
কবিতার প্রণয়ে,
ভালোবেসে কে যেন ডেকে ডেকে যায় !
মন হয় উচাটন;
চুপিসারে সারাক্ষণ-
কবিতায় মাথাগুঁজে আয়েশে ঘুম যায়!
যতটুকু পাবো কবিতার ছোঁয়া
হৃদয়ে তার আবিষ্ট সুর
পাওয়া না পাওয়া- নেই বিভ্রম
আর নয় বিচ্ছেদ কাতরতা-
একাকীত্ব ছুটি নিয়ে আজ বহুদূর !
সুন্দরী মেয়ে
স্বপন শর্মা
প্রাতঃ ভ্রমন, প্রতিদিনের মতো চলতে চলতে;
হঠাৎ দেখি ফুটপাতে এক মৃত দেহ!
চমকে উঠি করুণ বীভৎস মূর্তি দেখে।
ঠাওর করি মৃত মেয়েটির বয়স কত হতে পারে...
ষোল যে পেরোয়নি তা নিশ্চিত-
এই সময়ে সে পৃথিবীকে দেখেছে
লুণ্ঠনের অবাধ উপনিবেশ; মানুষ রূপি পশুর
শ্যেন দৃষ্টি, তীব্র লোভ আর দস্যু প্রবৃত্তি।
ফুটপাতে মুখগুঁজে পড়ে আছে।
কোথায় থাকত মেয়েটি? তার সুতীক্ষè চীৎকার,
হয়ত সমাজ শুনতে পায়নি।
বিক্ষত দেহ দেখে... ভাবি, বাঁচার আকুতির কথা,
সেই প্রার্থনা, কেউ শুনেনি-
অনেককে ছাড়িয়ে একা একা-
পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক দূরে।
আজ থেকে সে নিরাপদ;
নিরাপদ তার গোটা পরিবার সমাজ সংসার
আর ছুটতে হবেনা খাদ্যের জন্য
কিংবা অন্যের খাদ্য-হতে ত্রন্ত,
নিরাপদ কারণ আজ সে মৃত।
আজ আর কেউ নেই ডিস্টার্ব করবার,
মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের মতো
পড়ে রইল ফুটপাতে,
শীতল, রক্তাক্ত, বিকৃত দেহে।
যাদের হাতে ফোন, ক্যামেরা ছিল-
ফটোগ্রাফার আজকে সবাই,
নিরব, নিস্তব্ধ আঙ্গুলে চেপে এগিয়ে গেল;
নিষ্ঠুর বিদ্রুপের মতো পিছনে ফেলে
জীবনচ্যুত এক সুন্দরী মেয়েকে।
নেবে কি সেই দায়িত্ব?
রেজাউল রেজা
দেখিবার তরে ব্যাকুল হিয়া, বুঝাইব কি দিয়া!
প্রথম দেখার পরেই নেশায় পড়িয়া গিয়াছি প্রিয়া।
এখন বার বার দেখিতে ইচ্ছা করে।
কোথায় লুকাইয়া রহিয়াছ তুমি? আমি যে খুঁজিয়া মরি!
একবার কি দেবে দেখা?
আর একটা বার কি আসিবে আমার অক্ষির সম্মুখে?
দেখিতে চাই, আমি প্রাণ ভরিয়া দেখিতে চাই।
আমার শুকনা মরু সদৃশ হৃদয়টাকে তোমার দর্শনের ৎ
স্বচ্ছ জলকণায় ভিজিয়া নিতে চাই,
দেখার ব্যাকুল ইচ্ছেটাকে দমন করিতে চাই।
নেবে কি সেই ইচ্ছা দমানোর দায়িত্ব?
একটা বার দেবে কি দেখা?
রচিত হোক ঐতিকহাসিক প্রেম
এম এ ওহাব মণ্ডল
যেখানে সীমান্ত তোমার
সেখানেই হোক আমার শরণার্থী জীবন।
দুঃখ গুলো ধুয়ে যাক
মেঘের জলে।
রোদেলা আসমানে হেসে ওঠুক
একফালি আলো।
বুনো হাঁসেরা দল বেঁধে ছুটে যাক
উছলে পড়া জলের কোলে।
ব্যালকুনির টবে চাষ হওয়া ক্যাকটাস ফিরে পাক
সবুজ তারুণ্য।
রাতের হেলাল ক্যান্ডেলের মতো গলে পড়ুক
তোমার কাঁঠবাদামি অবয়বে।
আর আমি!!
তোমার কাজলমাখা জোড়া চোখের কালজয়ী কবিতা লিখে
ইতিহাসে বুনে দিই একটি নাম।
গল্প : উত্তরণ
উত্তরণ
কবির কাঞ্চন
ওমায়েরের মনটা আজ ভীষণ রকমের খারাপ। ওর কিছুই ভাল লাগছে না। দিন-রাত বই নিয়ে পড়ে থাকে । কিন্তু একদিনও স্কুলে স্যারদের কাছে পড়া দিতে পারে না। প্রতিদিন স্যারদের বকা খেতে হয়। আজ তো গণিতের স্যাার ওর পিঠ ফাটিয়েই দিয়েছেন। মাঝে মধ্যে ওর নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। স¤্রাটরা একটু বইয়ে চোখ রেখেই স্যারদের পড়া বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে। ফয়সালটা তো বড়ই ফাজি। কিন্তু একদিনও ও স্যারের মার খায় না। স্যারকে আসতে দেখলে অমনি মনোযোগী ছাত্রের মতো পড়াশুনা শুরু করে দেয়। স্যাররাও ওর ফাজলামো ধরতে পারেন না। আবার স্যাররা পড়া নেয়ার আগে কয়েরক মিনিট পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকেন। এই স্বল্প সময়ে ওরা জোরে জোরে শব্দ করে পড়ে। আর স্যার পড়া ধরলে ঝটপট বলতে পারে। ওমায়ের আবার ভাবে -নাকি ওরা কোন যাদু-মন্ত্র জানে! বিদ্যা-শিক্ষাকে সহজে আয়ত্বে আনার কোন যাদু সত্যি আছে কী! ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে কখন যে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে সে দিকে ওর একদম খেয়ালই ছিল না। শেষে ক্লাশরুমের দরজায় তালা দিতে এসে স্কুলের পিয়ন মাওলা ভাই ওকে দেখে বলেন,
-কী করছেন, ওমায়ের ভাই?
ওমায়ের অপ্রস্তুতভাবে বলল, না কিছু না। এমনিতেই আজ ক্লাশ শেষে বসে বসে ভাবছিলাম।
-কী ভাবছিলেন?
ওমায়ের রাগত স্বরে বলল,
-ওটা তোমাকে বলে কোন কাজ হবে না, বুঝলে?
ওর কথায় মাওলা ভাই খুব কষ্ট পেয়েছেন। উনার চোখেমুখে তা স্প্ষ্ট। ওমায়ের জানে, এই মাওলা ভাই স্কুলের পিয়নের চাকরি করলে কী হবে। নিজে এই স্কুলেরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-ফাইভও পেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর অভাবের সংসারে যেখানে ছোট ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণই চলছিল না সেখানে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। ওদের আত্মীয়দের অনেকেই বিত্তবান ছিলেন। কিন্তু কেউই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এই ¯কুলের স্যাররা ওকে খুবই আদর করতেন। বিশেষ করে হেডমাষ্টারের প্রিয় ছাত্রদের তালিকায় ও ছিল এক নাম্বার। সব সময় ওকে নিয়ে ক্লাশে উচ্চ বাক্য করতেন। বলতেন এই মাওলা-ই হবে আমাদের এই স্কুলের গর্ব।
অবশেষে কী আর করা! লেখাপড়া ছাড়া যে আর কোন কাজ ও শিখেনি। তাই নিরুপায় হয়ে স্কুলের হেডস্যারের সাথে দেখা করে। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলে সে। শেষে স্যারের পায়ে পড়ে বলে, স্যার আপনি আমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিন। যাতে করে আমি আমার মা ভাই-বোনদের খেয়ে-পরে কোনমতে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। অন্যথায় আমি মরেও শান্তি পা না। আমি যে সংসারের বড় ছেলে।
এই কচি বয়সের একটি ছেলে নিজের মা ভাই-বোনদের বাঁচিয়ে রাখতে নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখা জীবনের ইতি টানতে চাইছে। হেডমাষ্টার সাহেব ভাবেন, এই মুহূর্তে আমার পক্ষেও তো ওর পরিবার চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আজ যদি ওর পরিবারে সচ্ছলতা থাকতো তাহলে যত কষ্টই হোক না কেন আমি ওর পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যেতে পারতাম। কারণ এমন ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলে এরা এক সময় সম্পদে পরিণত হবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এখানেই বর্হিবিশে^র সাথে আমাদের তফাৎ। এমন মেধাবীদের সাহায্যার্থে ধনী লোকেরা এগিয়ে আসতো। কিংবা রাষ্ট্র তার সকল ব্যয়ভার বহন করতো। ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে স্যার মাওলার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, দেখ মাওলা, তুমি খুব মেধাবী ছেলে। এ আমি জানি। কিন্তু সবেমাত্র এইচএসসি পাস করেছ। এখন তোমার উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সময়। আমার স্কুলে আমি আপাতত তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি । তাতে তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে।
মাওলা চোখের জল মুছতে মুছতে বলতে লাগল-স্যার, আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আমি আমার বাবাকে হারিয়ে অভিভাবক শূন্য, স্যার । আপনি আমার স্যার। আমার অভিভাবক । আপনি যা করতে বলবেন আমি তা-ই করবো।
স্যার বললেন, তাহলে আপাতত তুমি আমাদের স্কুলের পিয়নের একটা পদ খালি আছে। ওটাতে যোগ দাও। আর চাকরির পাশাপাশি আমিই তোমার পড়াশুনা চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেব। পড়ালেখা শেষে বাইরে ভাল কোন চাকরি না হলে এই স্কুলেই শিক্ষক পদে তোমাকে আমি নিয়োগ দিয়ে দেব। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এইটাই তোমার জন্য ভাল হবে।
মাওলা স্যারের প্রস্তাবে আনন্দে রাজি হয়ে যায়। এরপর থেকে মাওলা এখন এই স্কুলের একজন আদর্শ পিয়ন। নিয়মিত লেখাপড়া আর চাকরির মধ্যে নিজেকে ডুবে রেখে ও এখন বিএসসি ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। পিয়ন হলে কী হবে স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী ওকে বেশ পছন্দ করে। ওমায়েরও ওকে পছন্দ করে। হঠাৎ সে ভাবে, আজ এভাবে খোচা মেরে কথা বলা-টা মনে হয় ঠিক হয়নি। তাই তড়িগড়ি করে বলল,
-মাওলা ভাই ,শুনেছি আপনি এক সময় খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্যাররা আপনাকে খুব ভালবাসতেন।
মাওলা দীর্ঘ একটা নিঃশ^াস ছেড়ে বলল,
হ্যাঁ, ওমায়ের ভাই আপনার কথা ঠিক। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর আমার সব তছনছ হয়ে গেছে। এখন বলুন, আপনার সমস্যাটা কী?
-আমার তো মহা সমস্যা।
-আগে আমাকে একটু বলে দেখুন না।
-তুমি তো জান, আমার বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী। আমাদের টাকা-পয়সার কোন অভাব নাই। আমার বাবা-মার একটাই চাওয়া যেকোন মূল্যে আমি যেন ভাল রেজাল্ট করি। এই জন্য বাসায় লজিং মাষ্টারসহ বেশ কয়েক জায়গায় প্রাইভেটও পড়াচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমি পড়া মনে রাখতে পারি না। রোজই স্যারদের বকা খেতে হয় আমাকে। আজ তো মোক্তার স্যার মেরে আমার পিঠই ফাটিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য স্যারের উপর আমার একটুও রাগ নেই। দোষটা তো স্যারের না। রোজই আমি পড়া দিতে পারি না। এভাবে একদিনও পড়া না পারলে তো মারবেনই।
-আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আপনি চাইলে মেধাবী ছাত্রে পরিণত হতে পারবেন।
-কিভাবে!
-স্যার আপনাকে মেরে পিঠ ফাটিয়ে দিয়েছেন। তারপরও আপনি বলছেন স্যার সঠিক কাজটি করেছেন। তার মানে আপনি নিজের প্রতি মূল্যায়ন করতে পারেন। আর যে নিজের কাজের মূল্যায়ন করতে জানে সে কখনও পিছিয়ে থাকে না। আপনিও পিছিয়ে থাকবেন না।
-তাহলে উপায়টা বল কিভাবে আর কী করলে আমি মেধাবী ছাত্র হতে পারবো। স্যাররা আমাকে আর বকা দিবেন না। আর মারবেন না। আমাকে দেখে পাড়ার দুষ্ট ছেলে! ডামিস ডামিস! বলে কেউ আর শ্লোগান দিবে না। আর মাওলা ভাই, আপনি আমার বয়সে বড়। এখন থেকে আপনি আমাকে তুমি করে বললে আমি খুশি হব।
-তাহলে শোন। প্রথমে তোমাকে তোমার সাথের বন্ধুদের পাল্টাতে হবে। তুমি কী তা পারবে না?
-অবশ্যই পারব।
-সাথে সাথে তোমার সবগুলো প্রইভেট বাদ দিতে হবে।
-দেব।
-তুমি আমাদের স্কুলের যে যে স্যারকে তোমার খুব ভাল লাগে মানে যাদের কথা শুনতে তোমার খুব ভাল লাগে তাঁদের সাথে কথা বলে তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়বে।
-পড়বো। আর----
-আর, আমি জানি তুমি একজন ভাল ছেলে। কিন্তু তুমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় কর না। তোমাকে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে হবে। ¯্রষ্টার পথে চললে কাজে বরকত থাকে, বুঝলে?
ওমায়ের মাথা নেড়ে বলে উঠে, তুমি ঠিক বলেছ, মাওলা ভাই। আমি তোমার সবগুলো কথা ভেবে দেখেছি। আমি যাদের সাথে চলি তারা কেউ-ই নামাজ পড়ে না। লেখাপড়ার পথে হাঁটে না। আর যে স্যারদের কাছে পড়ি উনাদের ‘ভাইয়া’ বলে ডাকি। উনাদেরকে আমি ভয় করি না। ফলে উনাদের পড়া শিখতে বসি না। লজিং মাষ্টার পড়ার জন্য মারেন বলে রোজই তার বিরুদ্ধে মিথ্যে মিথ্যে কতো নালিশ করি। কিন্তু বাবা উল্টো আমাকে বলেন, যত অভিযোগই কর না কেন এই মাষ্টারের কাছেই তোমকে পড়তে হবে। আমি এখন বুঝতে পেরেছি তখন কেন আব্বু-আম্মু আমার কথার গুরুত্ব দিতেন না। আর মাওলা ভাই, আমি আপনার কাছে একটা আবদার করবো যদি আপনি কোন কিছু মনে না করেন।
মাওলা আরও উৎস্যুক হয়ে বলল,
-না, কিছুই মনে করবো না। এই তোমাকে কথা দিচ্ছি। বল, কী তোমার আবদার?
-আগে বল, তুমি আমার কথা রাখবে।
-এই কথা দিলাম, তোমার কথা রাখবো।
-আমি জানি, তুমি প্রাইভেট পড়াও। আমি চাই, তুমি আমাকে তোমার থেকে একটু সময় দেবে। আমি ভাল ছাত্র হতে চাই। আজ থেকে তুমি যেভাবে বলবে আমি ঠিক সেভাবে চলবো।
মাওলা আনন্দে রাজি হয়ে যায়। ও ভাবে, আমার সামান্য উৎসাহে যদি একটি ছেলে মানুষ হতে পারে তবে সে অনেক ভাল।
এই সব ভাবতে ভাবতে ক্লাশরুম বন্ধ করে মাওলা। তারপর মাওলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে ওমায়ের। রাতে বাবা-মার কাছে সব খুলে বলে। ওমায়েরের বাবা মাওলার গল্প বেশ আগে থেকেই ভালভাবে জানেন। তাই ছেলের আনন্দকে নিজের মনে রাঙিয়ে বললেন, এতদিন পরে আমাদের ছেলের মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি হয়েছে। ঠিক আছে তাহলে কালকে থেকে তোমার ভাল ছাত্র হবার মিশন শুরু কর।
শুরু হলো ওমায়েরের ভাল হওয়ার সংগ্রাম। মাওলার কথামতো চলতে শুরু করে সে। স্কুলের তার প্রিয় স্যারদের সব খুলে বলে প্রাইভেট শুরু করে। নিজের বখাটে বন্ধুদের ছেড়ে স্কুলের ভাল-মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাথে পথ চলতে শুরু করে। যেখানে যায় শুধু পড়াশুনা আর আল্লাহর অপার মহিমা আর নেয়ামতের শোকরান করেই সময় কাটে তার। মাওলাও তার ব্যস্ত জীবনের মধ্য থেকে এক দুই ঘণ্টা করে প্রতিদিন সময় কাটায় ওমায়েরের সাথে।
ওমায়ের এখন পড়াশুনা ছাড়া কিছুই বোঝে না, খোঁজে না। পাল্টে গেছে ওর পড়াশুনার পরিবেশ। আর পাল্টে গেছে ওর প্রতি চারপাশের মানুষের মূল্যায়ন। ইতোমধ্যে স্কুলের অভ্যন্তরীন পরীক্ষায় ওমায়ের ভাল করেছে। স্যাররাও ওকে এখন অনেক আদর করেন। ডামিসের অপবাদ ধীরে ধীরে তার উপর থেকে সরে গেছে। বাবা-মাও ওকে নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। মাওলাও ইতোমধ্যে বিএসসি পাশ করে এই স্কুলেরই সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দিয়েছে। মাওলাকে শিক্ষক হতে দেখে ওমায়েরের সে কী আনন্দ! যে তার মতো দুর্বলের জীবনের অধ্যায়কে পাল্টে দিতে পারে সেই মানুষটি শিক্ষক হতে পারলে কার না আনন্দ হয়! সেল্যুট তোমাকে মাওলা ভাই।
ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ০৯
রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ
(গত সংখ্যার পর)
কদিন পরেই সব স্বাভাবিক। আকাশের তলায় সূর্যটা যথারীতি পুবদিক থেকেই ওঠে। মাটিও সবুজময়। কোনো গাছেই ফুল-ফল আটকে নেই। যাপিত জীবনও মন্দ চলছে বলে মনে হয় না। মুখে বিষাদ ছড়িয়ে রাখলেও, বাজারের কোনো পণ্য থেমে নেই। কলেজপাড়া, ব্যাংকপাড়া, মাগীপাড়া কোনো পাড়াতেই খরার চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়ে না। পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টও চমকপ্রদ। পাশের হার সাতানব্বই-আটানব্বই। এসএসসি’তে প্রতিষ্ঠান মাত্রই ‘এ-প্লাস’-এর ছড়াছড়ি। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা দিয়ে কিনে নেয় পত্রিকার পাতা। ফোর কালারের ছবিতে ভেসে যায় পত্রিকার শরীর। আনন্দে ভেসে ওঠে সারাদেশ। আনন্দ নেই কেবল বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠে। তাঁরা বলে—‘হচ্ছে না, কিছুই হচ্ছে না। কোমলমতি শিশুদের মেধা নিয়ে এতোবড়ো জোচ্চোরি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’ আমাদের সরস্বতী সেদিকে কান দেন না। তিনি তো খুশিতে বাকবাকুম। বলেন, জাতির মেধাকে আকাশে তোলার জন্যে স্বয়ং মহাদেব তাঁকে পাক-কাদার দেশে পাঠিয়েছেন। শুনে খুশি আমরাও। অভিভাবকরা দৌড়ে যায় ময়রার দোকানে। মিষ্টি খেতে খেতে মনে হয়, আমরা যেনো কোনো সিরামিক কারখানার মেশিন থেকে বেরিয়ে এসেছি। দেহ মনে নতুন নকশার ঝিলিক। পুরোনো স্মৃতি ভুলে গিয়ে মগজে তখন নতুন প্রত্যয়। নতুন প্রত্যয়ে বিভোর হয়ে অভিভাবক বাচ্চা নিয়ে পাড়ি জমায় কলেজের সবুজ ঘাসের আঙিনায়। কিন্তু তাদের ছেলে-মেয়েরা সরকারি কলেজে ভর্তি হতে পারে না। আইন-গাইন আর কোটার ভিড়েই সরকারি কলেজের শ্রেণিকক্ষগুলো ফেটে যায়। তখন জনসাধারণকে দৌড়াতে হয় প্রাইভেট পট্টিতে। এ-দেশে এটা একটা চমৎকার ব্যবসা। কোনো রিক্স নেই। প্রতিবছরই সরকার শতকরা হার বৃদ্ধির জন্যে পোনার ঝাঁকের মতো লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে এসএসসি পাশ করিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়। যাদেরকে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি করানোর মতো পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান সরকারের হাতে থাকে না। তখন বাধ্য হয়ে দিশেহারা শিক্ষার্থীরা ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট কলেজ নামে বেড়জালে প্রবেশ করে। প্রবেশ করার পর বুঝতে পারে ভুল গলিতে ঢুকে পড়েছে তারা। তখন কিছুই করার থাকে না। দু’বছরের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকতে বাধ্য। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া যেমন-তেমন হিসাবের খাতা কড়া। এক টাকা বকেয়া রেখে একজন শিক্ষার্থীও এসব গরাদ থেকে বের হতে পারবে না।
এমন গলাকাটা ব্যবসার রহস্যটা আমাদের কাছে উন্মোচিত হওয়ার পরও আমাদের কিছু করার থাকে না। অভিভাবকগণ ছেলে-মেয়েকে প্রাইভেটে দিয়েই শুরু করে স্বপ্নের চাষাবাদ। আর গোপনে গোপনে জায়নামাজের দেনাও শোধ হতে থাকে। রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও, ওয়াফিল আখেরাতে হাসানা, ওকিনা আজাবান্নার। হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যাণ দান করো এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো। সে-সাথে চোখের পানি তো রয়েছেই। এভাবে দিন চলতে থাকে। এবং এক ধরনের আরামবোধও লাগে। যদ্দূর বুঝতে পারি, সবাইকেই একধরনের ভালোলাগা পেয়ে বসেছে। আরামের জাজিমে পিঠ লাগিয়ে অলস বসে থাকতে ভালো লাগে। সকালে পত্রিকা এলে সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর পড়তে ভালো লাগে। টিভি দেখতে ভালো লাগে। চ্যানেল থেকে চ্যানেলে দৌড়াতে ভালো লাগে। এমন ভালো আগে কখনো লেগেছে বলে মনে হয় না। যা দেখি, যা খাই সবই ভালো লাগে। কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। ভারতীয় সিরিয়াল নিয়েও অভিযোগ নেই। দেশি-বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনে এমন সব দৃশ্য দেখায়, রীতিমতো পর্নোছবির মতো লাগে। সে-সাথে রয়েছে মর্দনা শক্তি বৃদ্ধির বিজ্ঞাপনও। বেশ সময় নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ দেখায়। এসব বিজ্ঞাপনে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোর চোখ বড়ো করে চেয়ে থাকে। তাতেও আমাদের কোথাও কোনো মন্দ লাগে না। ধীরে ধীরে আমরা মুক্তমনা হতে থাকি। অসংখ্য যুক্তি এসে ভর করে মাথার মগজে। যুক্তি-তর্কে এক সময় রেজাল্ট বেরিয়ে আসে, জন্মনিয়ন্ত্রণে এ-চ্যানেলগুলো বেশ কার্যকর। শুরুতেই যদি শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের যৌনগতভাবে বিকলাঙ্গ বা অক্ষম করে দেয়া যায়... ইত্যাদি ইত্যাদি। যুক্তিটা বেশ জুতসই লাগে। মনে মনে বলি, তাহলে তো এসব বিজ্ঞাপন নির্মাতাদেরকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেয়া উচিত। যেসব ব্যবসায়িক-শিল্পপতি এসব বিজ্ঞাপনে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন, তাদেরকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানীত করা উচিত। আমরা বিজ্ঞাপনগুলো দেখি আর মগজের সুতায় একের পর এক যুক্তি গাঁথতে থাকি। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে সস্তা কৌতুক নির্ভর নাটক দেখি। ইতিহাস বিকৃত চলচ্চিত্র দেখি। এখানেও আমাদের চমৎকার যুক্তি আছে, সিনেম্যাটিক দেখাতে হলে একটু-আধটু ইতিহাস বিকৃত হবেই।
তখন আর মুখ ঠেলে বমি আসে না। টিভি দেখতে দেখতে বোরিং লাগলে বাইরে বেরিয়ে পড়ি। ক্লাবে যেয়ে আড্ডা মারি। আগেই বলেছি, আমাদের আড্ডায় সমকালীন প্রসঙ্গের অনেককিছুই উঠে আসে। আড্ডার সদস্যদের মধ্যে রাজনীতি সচেতন বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীও আছে। তাদের বিশ্লেষণও চমৎকার। এই তো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক মাহমুদ রেজা কথা প্রসঙ্গে শোনালো, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে কেবল একটি লক্ষ্যই জড়িত—ভিশন-মিশন। সে-রাতেই আমি বাসায় এসে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকি, বললো কী সে! আসলে কি তা-ই। আমি তখন এক লাফে দুহাজার নয় সালের নির্বাচনে চলে যাই। তারপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে পিলখানা-ডেসটিনি-হলমার্ক-কালোবিড়াল ইত্যাদি ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকি। বিশ্লেষণে যুদ্ধাপরাধ-শাহবাগ-মতিঝিল-আমার দেশ-রামু এগুলোও উঠে আসে। কিন্তু আমার চোখে কিছুই ধরা পড়ে না। সবখানেই যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাই। পরদিন ক্লাবে মাহমুদ রেজার সাথে বিষয়গুলো শেয়ার করলে, সে শব্দহীন হাসে। তখন তার মুখে এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে, যা দেখে আমার নিজেকে তার সামনে অবোধ বালকের মতো মনে হয়। বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, মহল্লার মানুষগুলো কেমন যেনো বদলে যাচ্ছে। কেউ কারো সাথে আগের মতো ভাব নিয়ে কথা বলে না। পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কেমন যেনো হতাশা হতাশা ভাব। কী হয়েছে? যাকেই জিজ্ঞেস করা হয়, বলে—ভাল্লাগে না।
বিষয়টা নিয়ে আমাদের সুহৃদ বিশিষ্ট সাইকোলোজিস্ট ডা. মুহিত কামালের সাথে কথা বললে তিনি জানান, এটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার। অর্থাৎ বিষণœতা রোগ। এটা সাধারণত চরম হতাশা থেকে জন্ম নেয়। এ রোগের সিমটম হচ্ছে—প্রতিদিনকার স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। নিজের কাছে নিজের অস্তিত্বকে অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন মনে হয়। প্রতিটি দিন ক্লান্ত-অবসাদ-অস্থিরতার বৃত্তে ঘোরপাক খায়। আশপাশের লোকজনকে চরম বিরক্তিকর লাগে, কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেউ যেচে কথা বলতে গেলে এক-দুই শব্দের ভেতরই সে ইতি টানতে চায়। তারপরও কেউ যদি তার কথা লম্বা করতে চায়, তখন সে ক্ষ্যাপে ওঠে। কারো কারো অবস্থা এমনো হতে পারে, হঠাৎ পরিচিত এলাকা ছেড়ে উধাও হয়ে যাবে। অবস্থার উন্নতি না হলে অথবা একান্ত দায়ে না পড়লে কখনো ফিরে আসবে না। এ-থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হচ্ছে; পরস্পর পরস্পরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। যে-কোনো প্রকারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সমস্যাটা জেনে তাকে সাহায্য করা। যে-কোনো কৌশলে তাকে সমষ্টির ভেতর নিয়ে আসা। তবেই অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
মুহিত ভাই যখন এ-কথাগুলো বলছিলেন, তখনই মনে হচ্ছিলো সম্ভবত এসব কারণেই মহল্লার লোকসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ময়রার দোকানের ক্ষিতিশ দা নেই। কোথায় গেলো? খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, বাসা-বাড়ি বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। কারণ কী? তখন তার প্রতিবেশি পান-বিড়ি দোকানি কুদ্দুস জানায়, মহল্লার ছেলেরা নাকি প্রতিরাতেই তার দোকানে যেয়ে বিনা টাকায় মিষ্টি খেতো। টাকা চাইলেই পিস্তল দেখাতো। সে ভয়েই বেচারা...। আমাদের আফসোস—কাজটা ভালো করেনি ক্ষিতিশ দা। ছেলেরা অন্যায় করে থাকলে বিচার চাইতে পারতো। আমরা কিছু না করতে পারলেও ওদেরকে বিচার করার মতো মহল্লায় আরো লোক আছে। তারা নিশ্চয় হাত গুটিয়ে বসে থাকতো না। অন্তত রাজনৈতিক কারণে হলেও তাদের একটা বিচার হতো। তা না করে ক্ষিতিশ দা যে-পথে পা বাড়িয়েছে, তা কিছুতেই সমাধান নয়। আমাদের বিশ্বাস ক্ষিতিশ দা ওখানেও স্বস্থি পাবে না। এর আগেও যারা দেশ ছেড়ে গেছে, তারা কেউই ভালো অবস্থায় নেই। প্রফুল্ল-গণেশ-পরিমল তারা মাঝে-মধ্যে ফোন করে জানায়—দিদি, ভুল করে ফেলেছি। একূল-ওকূল দুটোই হারিয়ে এখন হাতের ওপর ভরসা। হাত চললে পেট চলে। বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না, মাছ-মাংস-দুধ শেষ কবে যে খেয়েছিলাম, মনে পড়ে না দিদি।
পরিমলরা এক বিন্দুও মিথ্যে বলেনি। মাস দুয়েক আগে কবি রানোয়ারা আপা কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে যেয়ে তিনি প্রফুল্ল দা’কে খোঁজ করতে থাকেন। দেশ থেকে যাওয়ার সময় প্রফুল্ল দা নাকি তাঁকে বাসার ঠিকানা দিয়ে যান। সেই ঠিকানা ধরে দু’তলা বিশিষ্ট একটা দালান পেয়েছেন বটে কিন্তু তাতে প্রফুল্ল নামে কেউ থাকে না। শেষে কলকাতা থেকে ফিরে আসার পথে এক বটগাছ তলায় প্রফুল্ল দা’র ছেলে তনয়ের সাথে দেখা হয়। সে বটগাছের ছায়ায় একটা ভাঙা চেয়ার পেতে ক্ষুরকর্ম করছে। তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে কিছু কেনা-কাটার জন্যে ধারে-কাছে কোথাও একটি শপিং মলে যাওয়ার জন্যে একটা রিক্সা খোঁজ করছিলেন, রিক্সা না পেয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি বটগাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ান। তখনই চোখে পড়ে প্রফুল্ল দা’র ছেলে তনয়। প্রথমে তো তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারেননি। স্কুলে পড়ার সময় ছেলেটা কতো নাদুস-নুদুস ছিলো। জুয়েলারি ব্যবসায়িক হিসেবে প্রফুল্ল দা’র সাফল্যও ছিলো ঈর্ষণীয়। সেই মানুষের ছেলে আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্ষুরকর্ম করছে। এটা বিশ্বাসের বিষয়! পরে জানতে পারলেন, যে-লোকটাকে বিশ্বাস করে প্রফুল্ল দা টাকা-পয়সা দিয়েছিলেন, সে নাকি মেরে দিয়েছে। যে-কারণে তিনি পথের ভিখিরি হয়ে নানা রোগে ভুগে এখন বিছানায় শোয়া। একমাত্র ছেলেটা লেখাপড়া ছেড়ে সংসারের হাল ধরেছে। এভাবে সে কতোটুকু এগুতে পারবে আল্লা মালুম। বেশিদূর এগুতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ ওটা তার দেশ নয়। দেশহীন মানুষদের যে কী সিদ্দত, যারা ভুক্তভোগী শুধু তারাই জানে।
শুনলাম, আবদুল করিমও শহর ছেড়ে হোম ডিস্ট্রিক ময়মনসিংহ চলে গেছে। চলে গেছে মোয়াজ্জেম হোসেনও। মোয়াজ্জেম হোসেনের যদিও শহরের বাসা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, সেজন্যে সে ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে ধর্ম-কর্মে নাম লিখে তিন চিল্লার জন্যে তাবলিগে চলে গেছে। কে জানে তার মনে কী? হয়তো সেটা তার জীবন চিল্লাও হতে পারে। বাসা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছে মাহবুব রেজাও। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, অনেকদিন ধরেই নাকি তাদের বাসার সামনে শাদা পোশাকধারী লোকদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিলো। একদম হলিউড ফিল্মের পিশাচদের মতো। চুপচাপ ঘুরে বেড়ায় আর মাঝে মাঝে আড়চোখে বাসার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কী সব যেনো বলতো, দুতলা থেকে স্পষ্ট বোঝা যেতো না।
মাহবুব রেজাকে নিয়ে ভীষণ ভয় ছিলো আমাদেরও। এমন একটা কিছু হতে পারে, এটা আমরাও টের পাচ্ছিলাম। সে যেখানে সেখানে যার-তার সাথে তর্কে জড়িয়ে যেতো। মৃত্যু যে পেছনে ছায়ার মতো লেগে রয়েছে—বুঝতেও চাইতো না। কিছু বলতে গেলেও হেসে উড়িয়ে দিতো। বলতো—‘বাংলাদেশ হলো নরম মাটির দেশ। নরম মানুষের দেশ। এখানে কেউ যতোই হামকি-ধামকি করুক না কেনো সময় হলে ঠিকই দেখবেন কোমল হয়ে যাবে।’ কিন্তু দিন যে বদলে গেছে, কিছুতেই তাকে বোঝানো যাচ্ছিলো না। অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলো—একটা উপন্যাস লেখবে। মগজের মধ্যে নাকি সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা আর চরিত্রের মহড়া চলছে। সেটাকে দৃশ্যমান করতে হলে ছোটগল্পের মতো হা-ডু-ডু মাঠে চলবে না, চায় কুরুক্ষেত্র অথবা পানিপথ প্রান্তর। শুনে আমাদের হাসি পায়। আবার ভয়ও লাগে। না জানি কী থেকে কী লেখে ফেলে। স্রোতের বাইরে ঊনিশ-বিশ হলেই সর্বনাশ। এ-নিষিদ্ধ সময়ে সরকার বিরোধী কিছু লেখা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। ক্রসফায়ারে ফেলে জঙ্গি বা চরমপন্থি বলে চালিয়ে দেবে।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই বললাম, যা-ই লেখো আমাকে একবার দেখাইও। তখনই সে অফিস ব্যাগ থেকে স্টেপলিং করা ‘এ ফোর’ সাইজের কয়েকটা কাগজ বের করে দেখাতে দেখাতে বলতে লাগলো, প্রথমে যা ভেবে বসি, কিছুক্ষণ লেখার পর তা আর খুঁজে পাই না। কল্পনাগুলো মগজ খালি করে কোথায় যেনো পালিয়ে যায়। তার স্থলে অন্য আরেকটি কাহিনি এসে চরিত্রের পালসহ হাজির। তখন অনু পোকা হয়ে মগজের কোষে কোষে আগের চরিত্রগুলিকে শত খুঁজে বেড়ালেও পাই না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যাও দু-একজনকে ধরে এনে কলমের ডগায় তুলে ধরি কিন্তু কাজ হয় না। ভয়ে জবুথুবু হয়ে গুটিয়ে থাকে। কোনো চরিত্রই জীবনের ঝুঁকি নিতে চায় না। যতোই জোর করি ততোই কড়াবাঁশের ঝিংলার মতো বেঁকে বসে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমি যেনো ওদের পায়ে শেকল পরিয়ে আবুগারিব কারাগার অথবা হাবিয়া দোযখে নিয়ে যাচ্ছি। জান থাকতে সেখানে যাবে না। তার চেয়ে মগজের তপ্ত কড়াইয়ে পুড়ে পুড়ে মরণই যেনো ভালো। সুযোগ পেয়ে আমিও বলি—বাদ দাও। অন্য কিছু ভাবো। প্রকৃতি নিয়ে লেখো। ‘আম পাতা জোড়া জোড়া মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া’ অথবা ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়ার ডুম সাজে’—এসব লেখো। আমার কথা শুনে সে তখন এমন এক ভাব ঝুলিয়ে চেয়ে থাকতো; যেনো আমি তার সাথে মশকরা করছি। আমি তখন তার বাড়িয়ে দেয়া কাগজগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিই। দেখি—যা ভেবেছিলাম তাই। একাত্তরের পরবর্তী বিব্রতকর বিষয়গুলো নিয়ে সে উপন্যাস লেখতে চায়। নিশ্চিত মৃত্যুর ছায়া পড়েছে তার ওপর। তা না হলে আর কোনো বিষয় খুঁজে পেলো না?
(চলবে)
সীমন্তিনীর বিবৃতি
সীমন্তিনীর বিবৃতি
পুষ্পিতা দাস পিউ
দেখো! দেখো! সূর্যের আলো তোমার মুখে পড়েছে অন্ত !। আমি জানালায় দু’পাশ খুলে দিয়েছি। চারদিকে কেমন যেন মায়ায় আবছানি, তারই উপর তোমার মুখম-ল এর ঝলসানো মিষ্টি হাসি, এ যেন সোনায় সোহাগা আমার।
কী সুন্দর করেই না আত্মতৃপ্তির মৃদুস্বরে ডেকেছিল সীমান্ত, তবুও অন্তু চোখ খোলেনি সহজে।
উফ! সীমান্ত...! ডাকছো কেন আমায়? আমি ঘুমাবো বলে চেচাচ্ছিল অন্তু । সীমান্ত আহ্লাদ করে বলেছিল -ওঠো সোনা, বেলা গড়িয়ে এলো।
প্লিজ! যাও তো সীমান্ত, শুধু শুধু বিরক্ত করোনা।
এবার সীমান্ত ভারী গলায় বলল, অন্তু সোনা; তুমি উঠবে না তো? আমি কিন্তু সত্যিই চলে যাবো, আর ডাকতে আসবো না কখনোই....।
অন্তু ঘুম চোখে বলে উঠলো.. এতো বড় স্পর্ধা তুমি কোথায় পেলে সীমান্ত? বলবে কি?
এসো এদিকে এসো...!
আসবো কেন বলো? তুমি তো এখনো চোখ খোলোনি। আদরের সহিত সীমান্তকে ডেকে বলছে, আসোই না একবার, ধরো একটিবার আমার হাতখানা। সীমান্ত বললো, এসেছি সখা, এবার তোমার আঁখি খুলো। অন্তু হাতে হাতে ধরে বলল-
‘তুমি আমার প্রতিটি ভোরের আলোকিত সূর্য, আমি তোমাতেই সপিতে চাহি আমার দেহ। তোমাতেই চাহি বিসর্জনের অর্জন, তোমাতেই দেখিয়া শুরু যেন হয় আমার দিন, তোমাতেই যেনো আমি ডুবিয়া মরি।’
মা অন্তু, সকাল হয়ে গেলো যে, উঠ মা... তোর বাবা বাজার করে নিয়ে আসলো, আর তুই এখনো ঘুমে?? অন্তু বিরক্তিবোধ স্বরে বলে উঠলো, দিলে তো আমার সুন্দর স্বপ্নখানা ভেঙ্গে।
সকাল ১০ টা বেজে ঘড়িতে, ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় মা? আমি তো কত স্বপ্নই দেখেছি ভোরবেলা, কই একটা ওতো পূরণ হয়নি! বলে অন্তু চা’য়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে দিলো...।
কিছুক্ষণ পর অন্তুর মা বলে উঠলো- কি রে, এখনো বসেই আছিস, ভালো করে স্নান করে নে; ওনারা আজ আসবেন তো। অন্তু গলা চেঁচিয়ে দাঁতে দাঁত রেখে ওর ছোট বোনকে বলল, আমার জন্য একটা প্যারাসুট নারিকেল তেলের বোতল নিয়ে আয়, আমি মাথায় তেল দিবো !
অন্তুর মা অন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মা এমন করিস না, তোর বাবার খুব পছন্দ হয়েছে ছেলেকে। ছেলে এমবিবিএস কমপ্লিট করে এখন সার্জারি ডিপার্টমেন্টে আছে। অন্তু ওর মা’কে বুঝিয়ে বলল, মা এখুনি কেন? এসব কেন করছো তুমি? আমি একটা চাকুরী পেয়ে যাই, তারপর না হয়....! অন্তুর মা প্রতিউত্তরে বলে উঠলো, মেয়েদের তো বিয়ে একসময় দিতেই হয়, আর এখন তো পারফেক্ট সময়, সবসময় ভালো ছেলে পাওয়া যায় না। অন্তু দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে বলল, যাচ্ছি মা। অন্তু ওর বাবার প্রতি এতটাই দুর্বল ছিলো যে একটি কথাও বলতে পারেনি। অন্তু সীমান্তকে নিয়ে কতই না ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো.. কিন্তু সীমান্ত....!
এতক্ষণে অন্তু স্নান করে ভিজা চুলে দর্পনের সম্মুখে এসে বসেছে, আর নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে আছে দর্পনের প্রতিচ্ছবিতে....!
তখন অন্তু কেমন যেন কল্পনায় ভাবালুক হয়ে বলেছিল, সীমান্ত! তুমি এসেছো? হুম, অন্তু! এই যে, আমি তোমার পাশে.....।
অন্তু ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো, মিথ্যে বলো না, ছলনা করছো তুমি?
সীমান্ত অন্তুর ঠোঁটপৃষ্টে আঙ্গুল দিয়ে বলল, চুপ করো অন্তু!! শশশশশশ! কি হয়েছে আমার অন্তু সোনার? চোখের নিচে এতো কালি যে, কেঁদেছো বুঝি? অন্তু ভারীকন্ঠে বলে উঠলো, হুম কেঁদেছি।
তাতে তোমার কিছু এসে যায় বলো? তুমিতো আমায় কবেই ছেড়ে চলে গিয়েছো। কেঁদো না অন্তু.....আমার যে আর কোন অনুভূতি নেই। বলে সীমান্তের অদৃশ্য দর্পীয়মান দেহ অস্পৃশ্য হয়ে গেল। তারপর অন্তু হুম বলে, ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো।
আজ কার্তিক মাসের শেষ দিন, সংক্রন্তি। আবার কার্তিক পূজার আয়োজন ও চলছে। সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় পূজা শুরু হবে, তারপর ওনাদের আগমন হবে।
আদরের সহিত অন্তুর বাবা বলে উঠলেন, মা অন্তু, আজ তুমি তুলসীর বেদিতে এই ঘি এর প্রদীপখানা জ্বালিয়ে দিয়ে প্রণাম করে আসো। তোমার জীবনে মঙ্গল বয়ে আসুক। অন্তু প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো। ঐ দিকে ঠাকুর মশাই এসে গেলেন। আস্তে আস্তে পূজার মন্ত্রপাঠ শুরু হলো।
মা অন্তু, শাড়িখানা পড়ে নে, এবার ওনারা চলে আসবেন তো, তোর বাবাকে ফোন দিয়েছিল। অন্তু চোখ লাল করে বলে উঠলো, মা, আমি শাড়ি পড়বো না। পাশের রুম থেকে অন্তুর বাবা শুনে বলছে, এ কেমন কথা মা.. ওনারা আসবেন আর তুমি শাড়ি পড়বে না, এটা কেমন করে হয় মা। যাও পড়ে নাও, শাড়িই তো, ছোটবেলা একা একা কত সুন্দর করেই না শাড়ি পড়তে, বউ সাজতে।
অন্তুর চারদিক স্তদ্ধকার হয়ে আসছিল, লালের উপর কালো রঙের ডোরাকাটা সিল্কের শাড়িটি অন্তকে খুব মানিয়েছিল সেদিন। চোখে কাজলের গাঢ় আর নাকে নথ, গোলাপি ঠোঁটে লালের আবছানি আর কপালে একখানা ছোট্ট কালো টিপ। অনেকক্ষণ ধরেই অন্তু খালি ঘরে চুপ করে বসেছিল। তারপর ওর বিবাহিত মেজদি অন্তুকে বললো, চল অন্তু! ওনারা তোকে ডাকছেন।
এবার যেতে হবে। আর শোন, যা জিজ্ঞেস করবে সুন্দর করে উত্তর দিবি বুঝলি।
পাশ থেকে অন্তুর মা বলে উঠলো, তোর বাবার মান সম্মান এর ব্যাপার, বিন্দুমাত্র বিরক্তিবোধও যেন না দেখি আর তোর মধ্যে ওনাদের সামনে। তারপর অন্তু মাথা নেড়ে মেজদির সহিত হাটা শুরু করলো !
তারপর অন্তু একে একে সবাইকে প্রণাম করলো, শুরু হলো শ্বশুর মশাইয়ের একের পর এক প্রশ্ন। তুমি কি চাকুরী করবে? তোমার নামের অর্থ কি? তোমার উচ্চতা কত?
এক পর্যায়ে বলে উঠলো, তোমার বন্ধু তালিকায় কতজন বন্ধু? অন্তু মনে মনে ভাবছে, এ কেমন প্রশ্ন?? শ্বাশুড়ির খুব পছন্দ হয়েছিল অন্তুকে। উনি অন্তুকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়েছিল।
মনে মনে এমন ভাব যেন আজই নিয়ে যাবে।
পরদিন সকালে শ্বশুড় মশাইয়ের ফোন, অন্তু বাবাকে বলল, অন্তুর নাম্বারটা দেন। অন্তুর বাবা খুশি হয়ে নাম্বার দিলেন, তারপর অন্তুকে শ্বশুর মশাই ফোন দিয়ে বলল, মা কেমন আছো তুমি? আমি তোমার...!
অন্তু মিথ্যে হাসিতে বলে উঠলো, নমস্কার! ভালো আছি, আপনি? ওপাশ থেকে শ্বশুর মশাই বলে উঠলো, ভালো আছি মা, আচ্ছা তুমি দুপুর বেলা ঘুমাও? অন্তু আঁতকে উঠে বলে, না! মানে! হঠাৎ হঠাৎ ঘুমাই আবার নাও। শ্বশুর মশাই বললো, ও আচ্ছা! আজ তোমায় রাজদ্বীপ ফোন দিবে, নাম্বারটা লিখে রাখো, কেমন?
অনেকক্ষণ পর, কাক্সিক্ষত সেই ফোনের বেল বাজলো... ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল, হ্যালো আমি রাজদ্বীপ! চিটাগাং থেকে বলছি, আপনি কি অন্তু??
সময়, পরিস্থিতি, ঋতু গুলো মানুষকে অবেলায় পরিবর্তন করতে বাধ্য করে অজানাতেই।
একজন নারী তার সমস্ত বেদনাকে অস্পৃশ্য করে দেয় বাস্তবতাকে বিচার করতে গিয়ে । তবুও সমাজ সীমন্তিনীদের নিয়ে কট্টাক্ক করে চলে দিনের পর দিন। আর তারা সহ্য করতে করতে নিজের ইচ্ছাগুলোকে দাফন করে ফেলে।
বছর খানেক পর, ঠিক বেলা দুপুর ২ টা বেজে ঘড়িতে। বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠলো,
মা-অন্তু, দেখ তো! কে আসলো এই অসময়ে, বলে অন্তুর মা চলে গেলেন ।
দেখছি মা বলে, অন্তু দরজা খুললো। অদৃশ্য আবছা ঘেরা একখানা মুখ, বহু পরিচিত সেই মুখম-ল, যার চরিত্রের লোমহর্ষক ছোঁয়া দর্পনেও ঝলঝল করতো।
অন্তু মাথা বাড়িয়ে বলল, কে?
তখন পিছন পাশ মোড়ে বলল, অন্তু! আমি সীমান্ত ! চিনতে পেরেছো?
খানিকক্ষণ পর, অন্তু শাড়ির পাড় দিয়ে চশমার ভেজা গ্লাসগুলো মুছে। তারপর চোখে সযতœ করে চশমাখানা দৃষ্টিগোচর করে বলল, কে আপনি?
আমি চিনতে পারছি না যে!
কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। আপনি এবার আসতে পারেন।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)