বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় করোনার প্রভাব
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় করোনার প্রভাব
লাভলী ইসলাম
চীনের উহান প্রদেশ থেকে যে বিষাক্ত করোনা ভাইরাসের উত্পত্তি হয়েছে তা আজ বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে অতি দ্রুত। চায়না থেকে যে মৃত্যু ফাঁদ সৃষ্টি হয়েছে তা আজ কেড়ে নিচ্ছে শিশু কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল শ্রেনীর সকল ধরনের মানুষের প্রাণ দেশ থেকে দেশে। তবে আক্রান্ত অনেকেই সুস্থ হচ্ছে এটাই আশার কথা ।
বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাস আতংকে সুস্থ সুন্দর মানুষ গুলো চরম অস্বস্তি অশান্তি আর মানসিক চাপে ভেঙ্গে পড়ে অনাআক্রান্ত মানুষেরাও মানসিক শক্তি হারিয়ে দ্রুত অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা।
এ রোগ শনাক্ত হবার পর রোগীকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখতে হয় সবার কাছ থেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এ এক নতুন জীবন্ত বনবাসের মত।
অনেক দেশ তাদের স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে। জন সমাবেশে একত্রিত হতে বারন এসেছে।
অনেক দেশ এ সংক্রামক ভাইরাস ঠেকাতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্থগিত করেছে। পৃথিবীময় আকাশ যাত্রীদের অবাধ চলাফেরার উপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে ভয়ে ডরে নিজেদের নির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল করেছে।
ইউরোপ আমেরিকা সহ ভ্রমণ বিলাসী মানুষদের ভ্রমণ কমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়।
আমার চেনা দেশ চেনা শহর ইটালীর রোম সহ অন্যান্য দেশের টুরিষ্ট এলাকায় লোকজন নাই বললেই চলে। যেখানে টুরিষ্টদের পদভারে মুখরিত হতো পিয়চ্ছা নাভানা, পিয়চ্ছা ভেনেসিয়া, ফোনটানা ডি ট্রেভি, কলোসিয়াম ভ্যাটিকান সিটি সহ সব ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহের জনপ্রিয় স্থাপনা ও ইতিহাসের প্রসিদ্ধ স্থান গুলো। সেখানে পথ ঘাট হয়ে আছে বলা যায় অতি ফাঁকা।
পৃথিবী জুড়ে এখন প্রাণ বাঁচাতে এই মরন ভাইরাস এড়াতে সবাই যতটুকু সম্ভব আত্মগোপন করার চেষ্টা করছে পথ ঘাট জনপদে মানুষের সংস্পর্শ থেকে।
আর এ সুযোগে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা ধপাস করে নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে দ্রুত বেগে।
টুরিষ্ট প্রধান দেশ গুলো টুরিষ্ট শূণ্য হয়ে পড়ছে প্রায়। রমরমা হোটেল ব্যবসা জিরো পয়েন্টে নেমে আসছে। খাবারের দোকান রেস্টুরেন্ট সহ সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলোতে নেমে এসেছে খুব খারাপ অবস্থা। বিশেষ করে চায়না রেস্টুরেন্ট সহ সকল চায়না প্রতিষ্ঠানে লোক সমাগম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অনেকেই ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছে অনেকে হারানোর পথে।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে লক্ষ লক্ষ কর্মচারী কর্মকর্তা অচিরেই বেতন ভাতা না পেয়ে পড়ে যাবে বড় ধরনের অর্থ সংকটে।
সারা পৃথিবীতে শুরু হয়ে যাবে অর্থনৈতিক মন্দা।
এক দেশ আরেক দেশের সাথে আসা যাওয়া বন্ধ করে হয়ে যাচ্ছে একেলা।
আর ধারনা করা হচ্ছে এ খাতে সব চেয়ে বেশি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে চায়না।
চায়নার খাদ্য পোষাক সহ যে সব জিনিস বাইরের দেশে রপ্তানি করে রমরমা বানিজ্য করতো তা বর্তমানে বন্ধ হয়ে আছে।
এক দেশের সাথে অন্য দেশের সম্পর্ক পৃথিবীর এই নিয়মের চাকাটা হঠাৎ এ ভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে যা সহসায় কাটানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
চায়না চরম অভাব অনটনে পড়লে সেখানে দেখা দিতে পারে ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ। যা একদিন হয়ত পৃথিবীতে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। আর তার খেসারত হিসেবে পৃথিবীর অনেক দেশেই পড়বে তার প্রভাব।
অপরাজিতা
অপরাজিতা
তমসুর হোসেন
একটি বিষয় নিয়ে খুব ভাবে রুমা। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়। বিশ বছরের একটানা শূন্যতায় তার জীবন থেকে কি অন্তরীণ হয়ে গেছে সুখ নামক বস্তু ? নিরাশার আঁধারে বাস করে সে ভাবতে পারেনা জীবনে আবার স্বপ্নের রুপালী চাঁদ আসবে। দেয়ালের আড়ালে নিশ্চুপ হয়ে থেকে আলোর উজ্জলতা ভুলে গেছে সে। কখন দিন ফুরিয়ে রাত আসে কখন ভোর হয় কিছুই সে বুঝতে পারেনা। সেই গতিহীন জীবনের কপাটে সহসা কার যেন কড়া নাড়ার শব্দ পায় সে। কে যেন দ্বিধাগ্রস্ত হাতে মাঝে মাঝে মনের দরজায় কড়া নেড়ে যায়। মানুষকে বিশ^াস করা ভুলে গেছে রুমা। বিশেষ করে পুরুষ মানুষকে। বুকের ভেতরের সমস্ত আবেগ দিয়ে যৌবনের প্রথম দিনগুলোয় যে মানুষটিকে সে পাগলের মতো ভালোবেসেছে সেই তার অন্তরে অবিশ^াসের বীজ পুতে গেছে। সেই বীজ থেকে গজিয়ে ওঠা চারা এখন পরিণত হয়েছে বিশাল মহীরুহে। দশ বছরের দাম্পত্য জীবনের ফসল একমাত্র কন্যাসহ তাকে অনিশ্চয়তার রাজ্যে ছুঁড়ে ফেলে আরিফ অন্য নারীর হাত ধরে সুখের ঘর বেঁধেছে।
কিছুদিন থেকে রুমার কাছে কল আসে অচেনা নাম্বার থেকে। সে যখন স্কুলে ক্লাশ নেয় অথবা ঘরে এসে জানালা খুলে নিসর্গ দেখে তখন মোবাইলটা হুহু করে বেজে ওঠে। বেজে বেজে মোবাইল আপনাতেই বন্ধ হয়ে যায়। রুমা নাম্বারটা ডিলেট করে দেয়। ডিজিটগুলোর দিকে একটু চোখও রাখেনা সে। বেশ বিরক্ত করছে একজন তাকে। লোকটা যে খুবই বাজে তার আচরণ থেকে বুঝতে পারে রুমা। মাঝে মাঝে সে কলটা ধরতে চায়। আবার ভাবে কী হবে কল ধরে! একবার লাই পেলে গল্প ফাঁদিয়ে বসবে। আরিফের সাথে সেপারেশনের পর অনেক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। বিদেশে অবস্থানরত এক ভদ্রলোকের ছেলেকে টিউশনি পড়াতো রুমা। সেই লোক প্রায় তাকে বিরক্ত করতো সিঙ্গাপুর থেকে। কেমন করে নাম্বার সংগ্রহ করেছে তা সে ভেবে পায়না। ‘তোমাকে মারাত্মক ভালোবাসি। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবোনা’ এসব ধাঁচের কথা বলে ভোলাতে চেষ্টা করেছে লোকটা। সেই লোকটাকে কল করা থেকে নিবৃত করতে তার বেশ সমস্যা হয়েছে। অনেক অর্থ ছিলো লোকটার। মস্তান টাইপের চেহারা আর বিদেশি টাকার গরমে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। কিন্তু রুমা তাকে একদম পাত্তা দেয়নি। অনেকদিন ঘ্যান ঘ্যান করে কেটে পড়েছে শেষ পর্যন্ত।
এই লোকটাকে আচ্ছা করে ধমক দিতে হবে। যখন তখন কল করে বসে। বিকেলে বেলকনিতে বসে সে যখন ফেলে আসা স্মৃতিকে রোমন্থন করতে চায় তখন বেখাপ্পা বেজে ওঠে মোবাইলটা। তখন রুমার আছড়ে দিতে ইচ্ছে করে মোবাইল। বিয়ের পর বেশ ক’টা বছর আরিফের সাথে ভালোই কেটেছে তার। বিকেল হলে আরিফ বাজার সেরে বাসায় ফিরতো। মিশু তখন চার বছরের। গুড়ি গুড়ি পা ফেলে হেঁটে বেড়াতো মেয়েটা। ফিরে এসে আরিফের কাজ হলো মিশুর সাথে খেলা আর রুমার মন জোগানো। কী খেতে চায় রুমা? প্রতিটি মুহুর্ত ওর পছন্দের পেছনে ছুটে বেড়ানো ছিলো আরিফের কাজ। দেশের বাড়ি থেকে ওর চাচাতো ভাই বেড়াতে এসেছে সে সময়। হাবাগোবা গ্রাম্য যুবক ক’টা দিন ভালোই বিরক্ত করে গেছে। তখন আরিফের সাথে ভেতরে ভেতরে প্রচুর মনোমালিন্য চলছিলো রুমার। সেই ছেলেটার সাথে বীচে যাবার বেশ চাপ দিয়েছে আরিফ। অমন একটা আনকালচারড ছেলের সাথে বীচে যেতে বয়ে গেছে রুমার। প্রকাশ্যে না বলে দিয়েছে সে। তাতে দু’জনের তিক্ততা আরও বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সেপারেশন কেউ ঠেকাতে পারেনি। কিছু না বুঝে সেই ছেলেটাকে হুট করে একটা চিঠি লিখেছে রুমা।
তখন রুমার মাথায় যতোসব হঠকারী চিন্তার উদয় হতো। তড়িঘড়ি বিয়ে করে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো তারও জীবন সুখে চলতে পারে। জিদের বসে সেই গ্রাম্য যুবককে সে চিঠির পর চিঠি লিখতো। বিনিময়ে সেও পেতো কবিত্বে ভরা প্রচুর চিঠি। অন্যের লেখা নকল করে ভালই লিখতো ছেলেটা। অমন নিদারুণ শূন্যতায় চিঠিগুলোকে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরেছে রুমা। একটার পর একটা চিঠি তার ভেতরের অগোছালো মনটাকে বড়ই সান্তনা দিয়েছে। তারপর কী যে হলো চিঠি দেয়া বন্ধ করে দিলো আপন নামের ছেলেটা। হৃদয়ের অবরুদ্ধ যন্ত্রণা নিয়ে অনেক লিখলো রুমা। কিন্তু একটা চিঠিরও জবাব পেলোনা সে। একবুক হতাশা নিয়ে শুকনো মৃত্তিকায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলো রুমা। সেই আপন তাকে পাগলের মতো কল করছে সুদীর্ঘ বিশ বছর পর। সেদিন প্রচুর ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরেছে রুমা। দুপুরের খাবার কলিগদের সাথে টিফিন রুমে বসে খেয়ে নেয় সে । রাতে খুব একটা খায়না। বিস্কিট আর এককাপ চা তার রাতের খাবার। সন্ধ্যার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে রুমা। অন্যদিনের মতো মোবাইল বেজে উঠলো। কল রিসিভ করে সাটানো গলায় প্রশ্ন করলো সে,
‘কেন কল করছেন জানতে পারি?’
‘অবশ্যই। জানানোর জন্য তো কল করেছি।’
‘সময় নেই। ঝটপট বলে ফেলুন।’
‘আপন নামের কাউকে মনে আছে?’
‘আপন? কোথাকার আপন। বলুন কি দরকার?’
‘দরকার পরে। আগে তো চিনুন।’
কন্ঠ শুনে রুমার মনে হলো সেই আপনই হবে। তখন চিঠি লিখে মনের ভাব প্রকাশ করা হতো। বিশ বছর আগে মোবাইল ছিলোনা মানুষের হাতে। কতো সুন্দর করে চিঠি লিখতো। মাঝপথে থেমে গেলো। রুমার বুকে নতুন দিনের স্বপ্ন জাগিয়েছে সে। সেই মনে হয় কথা বলছে। খুব রাগ হয় রুমার। তার সন্তানের বাবা হতে চেয়েছিলো সে। তখন আপন বিয়ে করেনি। সব জেনেও রুমার সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো। কী কারণে হঠাৎ থমকে গিয়েছিলো আজো জানা হয়নি রুমার!
‘আপনাকে চিনে লাভ কি? পাক্কা প্রবঞ্চক আপনি।’
‘আমি মোটেই প্রবঞ্চক নই। আপনাকে অনেক লিখেছি।’
‘মিথ্যে বলার জায়গা পাননা? আমিতো ঠিকানা পাল্টাইনি।’
‘কেউ বেহাত করেছে চিঠি। আপনি ভুল বুঝেছেন।’
কথাটা বিশ^াস হয় রুমার। সে জানতে পেরেছে আরিফের হাতে আপনের লেখা পড়েছিলো । তখন রুমা আলাদা হয়ে গেছে। ওর বিষয়ে আরিফের মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। এ নিয়ে বাড়িতে অনেক ঘটনা হয়েছে। আরিফ চায় না ছোট ভাই তার বউকে নিয়ে সংসার পাতুক।
‘মোটেই ভুল বুঝিনি। সবটা কপাল।’
‘নিজকে দোষী করছেন কেন? না বুঝে পিছানো ঠিক হয়নি।’
বিশ বছর পর কেন আপন এসব বলছে। তার রাতের ঘুম যে কেড়েছে তাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিলো। আরিফ তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে বলে মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিলো রুমার । বাজে মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো আরিফের। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তবলা বাজাতো আরিফ। তবলায় হাত ছিলো ওর। সেখানেই পরিচয় শানু নামের সংগীত শিল্পীর সাথে। টিভিতে প্রোগ্রাম করতো শানু। আরিফ ঢাকায় বদলী হলে শানু যোগাযোগ করতো ওর সাথে। আরিফ অনেক মেয়ের সাথে অবাধ মেলামেশা করতো। এসব বিষয়ে প্রমান ছিলো রুমার কাছে। তার এতোটা স্খলন সে কোনক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। সেই সব দিনের শূন্যতা আপনের লালিত্যে ভুলতে পেরেছিলো রুমা।
তারপর ঘোরের মতো কেটে গেছে সময়। মিশুকে বুকে জড়িয়ে দিনগুলো বয়ে যেতে থাকে। মিশুর পড়াশুনা বিয়ে ভবিষ্যত করতে জীবন থেকে কখন সময় চলে গেছে বুঝতে পারেনি রুমা। বাবা অন্যখানে বিয়ে দিতে চেয়েছে। তার একটা জবের জন্য তাকে বিয়ে করতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তার পাণীপ্রার্থীদের অনেকের বউ ছিলো। আর যাদের বউ ছিলোনা তাদের অনেকেই ছিলো রিটায়ার্ড পারসোনেল। সবক্ষেত্রে প্রবল বাঁধ সেধেছে মিশু। সব সময় রুমাকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছে সে। সে এমন সিন ক্রিয়েট করেছে রুমাকে সব অকেশন থেকে সরে আসতে হয়েছে। মাকে কোনক্রমেই হাতছাড়া করতে চায়নি মিশু। সে এমন ভাষা ব্যবহার করতো অথবা এমন সব আচরণ করতো যার জন্য রুমা ঘুনাক্ষরেও বিয়েসাদীর কথা ভাবতে পারেনি। বাবা না থাকলে বাচ্চা মানুষ করতে প্রচুর কষ্ট হয়। সব কষ্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মিশুকে বড় করে তুলেছে রুমা। মিশুর বিয়ে হয়েছে উচ্চপদস্থ অফিসারের সাথে। স্বামীর সাথে দিন কাটাচ্ছে মিশু। একটি মেয়ে জন্মেছে মিশুর। রমজানে জন্মেছে বলে নাম রোজা রাখা হয়েছে।
এখন রুমার জীবনটা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। দিনগুলো বয়ে যেতে চায়না। মিশু হৈ চৈ অট্টহাসি করে বাসাটা মাত করে রাখতো। এখন সবখানে অন্ধকার আর স্থবিরতা। ভোর পাঁচটায় ফজর নমাজ পড়ে জানালা খুলে ঘুমের অতলে নিমগ্ন জগত অচেনা লাগে রুমার। কতো সুন্দর ঘুমিয়ে আছে সমস্ত শহর! অথচ তার চোখে ঘুম আসেনা। বিয়ের পর রাত জেগে সংসারের কাজ করা অভ্যেস হয়েছে রুমার। কোথায় মাকড়সার ঝুল কোথায় ময়লা সতর্কভাবে পরিষ্কার করতো সে। সকালে তাকে স্কুলে ছুটতে হয়। সব কাজ সে রাতেই গুছিয়ে রাখতো। বিছানায় যেতে দেরী হলে আরিফ তাকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুম পাড়াতো। রাতে দেরীতে খাবার খেতো রুমা। কাটাওয়ালা মাছ গিলতে পারতো না। গলায় কাটা লাগিয়ে তোলপাড় করে ফেলতো। শুয়ে পড়লে রাতে খাওয়া হতোনা তার। আরিফ তাকে মাছের কাটা বেছে খাওয়াতো। রুমার পছন্দের জিনিষ সংগ্রহ করা ছিলো আরিফের নেশা। সেই আরিফ তাকে কষ্টে রেখে নতুন বউ নিয়ে সুখে আছে। দু’টো সন্তান আরিফের। আরিফ আগের জব বাদ দিয়ে মার্চেন্ট শিপে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। কেন এমন হলো। কেন আরিফকে নিয়ে সুখী হতে পারলোনা রুমা।
রুমাকে কল করে হয়রান হয় আপন। সে বিয়ে করেও ঘর করতে পারেনি। ভালবেসে করেছিলো আপন বিয়েটা। কিছুদিন সংসার করে বউ বাবার বাড়িতে চলে গেছে। সেই থেকে সে প্রতিজ্ঞা করেছে দারিদ্র দূর না হলে বিয়ে করবে না। বিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আপন। সে একথাও ভেবেছে রুমা ছাড়া কাউকে বউ করবে না। আপনের কথা বিশ^াস হয় রুমার। আপন রুমার চেয়ে চার বছরের বড়। সেজন্য ওকে আপনি করে বলে সে। আর আপন বলে তুমি করে । সারাদিন রুমার সেটে মেসেজ পাঠায় আপন। তার মেসেজের বড় অংশ জুড়ে থাকে নজরুল সংগীত আর পুরণো দিনের গান। রুমার মনের অবস্থা বুঝে সে মেসেজের বাণী নির্বাচন করে। ‘সুরের ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়েছিলে’ ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তারে’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ’ এসব কালজয়ী গানের কলি যখন রুমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন সে অবাক হয় আপন কি করে বুঝতে পেরেছে কী অপরিসীম আবেগে এই গানগুলো তাকে টানে। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত হয় যখন আপন লেখে,‘তোমার সজল কালো কাজল চোখে কার ছবি ভাসে বলো সেকি আমি সেকি আমি। দেবতার কোন অভিশাপে জনমে জনমে এলো বিরহ আর কতো আছে বাকি বলো তুমি শুনি আমি।’ কেঁদে কেঁদে সজল মেঘের মতো বিহ্বল হয়ে পড়ে রুমা। তার হৃদয়ে মেঘের আনাগোনা হয়। আপন তার মনের মৃত নদীতে নতুন করে জলের ধারা বইয়ে দেয়। একটা হতচ্ছাড়া মাথাব্যথা প্রতিদিন তাকে বড় কষ্ট দিতো। আপনের সরস সম্ভাষণ আর কোমল পরশ তার সে কষ্টকর শীরঃপীড়া দুর করে দিয়েছে। এখন রুমার মনে সারাক্ষণ আনন্দের সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। আপনের সাথে বিদ্রোহী কবির কালজয়ী প্রেমের গানগুলো নিয়ে গভীর মত বিনিময় হয় রুমার। একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে সহজেই তারা পৌঁছে যায়। ‘আজি মধুর বাঁশরী বাজে, মলিন সাঁঝে বুকের মাঝে’ এ গানের বেদনা রুমাকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরের এক নির্জন নদীতটে যেখানে প্রাণের আপন তাকে নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় বাঁশী বাজায়। আপনকে ভালবেসে ফেলে রুমা। ওকে ভেবে আত্মবিস্মৃতের মতো তন্ময় হয়ে পড়ে।
আপনের সাথে জড়িয়ে মড়কলাগা পল্লবের মতো কুঁকড়ে যায় রুমা। মেয়েকে একই শহরে বিয়ে দিয়েছে সে। জামাই একটা ফার্মের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। ইপিজেড এলাকায় তার অনেক ফ্লাট আছে। সেগুলো ভাড়ায় খাটিয়ে অনেক টাকা রোজগার করে। রোজা নামের ফুটফুটে নাতনি হয়েছে তার। মোবাইলে কথা বলে রুমাকে ব্যস্ত করে রাখে রোজা। এতোটা মমতার বাঁধন ছিঁড়ে আপনের টানে কী করে সাড়া দেবে সে। এসব কথা শুনে জামাই যদি মিশুর সাথে খারাপ আচরণ করে। অথবা মেয়ে যদি নিগ্রহের স্বীকার হয়। মেয়ের কষ্ট সে কেমন করে সহ্য করবে। এসব কথা ভেবে মরমে মরে যায় রুমা। আপনকে নিয়ে বেড়ে ওঠা ভাবনাটা লবণদেয়া জোঁকের মতো চুপসে যায়। চোখের জলে বুক ভাসানো ছাড়া কোন উপায় থাকেনা তার। অনেক থমথমে সন্ধ্যা নিশব্দ রাত কাটিয়ে দেয় এসব কল্পনা করে। তার পক্ষে আপনকে নিয়ে ঘর বাঁধা সম্ভব হবেনা। আরিফকে বিয়ের সময় নিজের জিদকেই প্রাধান্য দিয়েছে রুমা। বাবার সম্মানের কথা সে একটুও খেয়াল করেনি। সেপারেশনের পর বাবা সে কথাটাই স্মরণ করে দেয় তাকে। সেদিন রুমা লজ্জায় এতোটুকু হয়ে যায়। বাবার খোঁজে শিক্ষিত বর ছিলো। ওসব রুমার মনে ধরেনি। সে ভেবেছে একমাত্র আরিফকেই দরকার তার। অন্যকে দিয়ে জীবন সুশোভিত হবেনা। আবারো ভুল পথে পা দিলে তার দায় নিজকেই নিতে হবে। সন্দেহ নেই আপন তাকে ভালবাসে। শুধু ভালবাসা দিয়ে তো জীবন চলেনা। সমাজ পরিবেশ সংস্কৃতি এডজাষ্ট না হলে ভালবাসার বুলিটা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। আরিফ কি তাকে কম ভালবাসতো! তার ভালবাসা আবেগঘন ধু¤্রজাল ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি তাকে।
এতকিছু ভাবলেও আপনের কলের আশায় ব্যাকুল থাকে রুমা। আপন কল করবে ভেবে সময় গড়াতে চায়না। এনজিওতে কাজ করে আপন। অফিস হতে বের হতে আটটা বেজে যায়। মেসেজে রুমাকে সান্তনা দেয় সে। একটি বাক্য গুরুত্ব দিয়ে বারবার লেখে। ‘তোমাকে ভালোবাসি খুব ভালোবাসি’। এই বাক্যের বৃষ্টিতে রুমার অন্তর ভিজিয়ে দেয়। আগামীর অনেক স্বপ্ন রুমার অন্তরে মুর্তমান করে তোলে। রুমার জন্য বাড়ি তৈরী করবে সে। যার সামন দিয়ে বয়ে যাবে নদী। পশ্চিমে থাকবে খোলা ফসলের মাঠ। প্রাণখোলা বাতাস লাফিয়ে পড়বে বাড়ির বারান্দায়। গাছপালা আর মেঘের ছায়ায় বাড়িটি শান্তির নিভৃত ঠিকানা হবে। রুমাও চায় শহর হতে দূরে এমন একটি বাড়িতে হৃদয়ের শান্তি খুঁজবে। কোন মানুষ সহজে যে বাড়ি খুঁজে পাবেনা। আপনের কথায় আপ্লুত হয় রুমার মন।
‘রুমা তুমি আসবে আমার কাছে?’
‘আসবো না কেন? অবশ্যই আসবো।’
‘একটি বাগান থাকবে। সেখানে ফুল ফুটবে।’
‘চন্দ্রমল্লিকা থাকবে সেখানে?’
‘সেটা তোমার পছন্দ?’
‘খুব পছন্দ চন্দ্রমল্লিকা।’
‘আর কি পছন্দ তোমার?’
‘টগর রক্তচন্দন জবা ঝুমকোলতা অপরাজিতা। এসব আমার পছন্দ।’
‘একটি কথা মনে পড়লো।’
‘কি কথা?’
‘আমি তোমার নতুন নাম দিতে চাই।’
‘কি নাম?’
‘অপরাজিতা। এ নামে খুব ভালো লাগবে তোমাকে।’
‘কি দরকার?’
‘আমার ভালো লাগছে তাই।’
‘রুমা নাম কি খারাপ? ও নামে ডাকলে বেশি খুশি হবো।’
ক’দিন থেকে মিশু একটা জিদ ধরেছে। রুমাকে ওদের সাথে একই ফ্লাটে উঠতে হবে। বেশ কাছেই বাসা নিয়ে থাকছে ওরা। জামাই অফিসে গেলে রোজাকে নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। জামাই রোজাকে নার্সারীতে রেখে যায়। সমস্যা ওকে নিয়ে আসা নিয়ে। ছুটির সময়ে রাস্তায় জ্যাম পড়ে যায়। এক ফ্লাটে থাকলে সমস্যা মিটে যাবে তা কিন্তু নয়। মিশুর অভ্যেস যে কোন বিষয়ে কান ঝালাপালা করা। সব ঝামেলা মায়ের মাথায় গড়িয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে চায়। মেয়ের বাসায় থাকা রুমার পছন্দ নয়। মিশু কথা শুনলে তো। এমন চেঁচামেচি করবে যে কান রাখা যাবেনা। ওর ইচ্ছে হয়েছে করে ছাড়বে। মায়ের কথার দাম নেই ওর কাছে। ক’দিন আগে বলেছে চাকুরি করা চলবে না। টিচারের জব করলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। মা কাছে থাকলে মিশু বাচ্চা নিতে পারবে। রোজাটা একা কতো খেলবে। লোক পাঠিয়ে বাসা খুঁজছে মিশু। জামাই সমেতও সে বাসা খুঁজতে যায়। রুমাকেও ডাকে। সে কিছুই বলেনা। এসব করে জীবন সেদ্ধ হয়ে গেছে। সংসারের মালপত্র টানা হ্যাঁচড়া করে কয়লা হয়ে গেছে অন্তর । এখন ওসব একটুও ভালো লাগেনা। জীবনের প্রথম থেকে দু’কক্ষের বাসাটা সে আঁকড়ে ধরে আছে। এর প্রতিটি ইটের সাথে তার সখ্যতা। প্রশস্ত বেলকনি ঘেষে ঝাঁকালো নারকেল গাছ। যার ডালপালা সারাক্ষণ আল্পনা এঁকে যায়। সেই আল্পনায় ডুবে রুমার মন ভরে যায়। বাসাটা ছাড়ার কথা মনে করলে বেদনায় ভরে যায় রুমার মন। এ বাসার নিরবতায় আপনকে নিবিড় করে পায় সে। অফিস শেষে প্রতিদিন মোবাইলে মন খুলে কথা বলে আপন। জীবনের গভীর স্বপ্নগুলো সে রুমার মনের মাঠে বিছিয়ে দেয়। মিশুর সাথে থাকলে আপনের সাথে কথা বলবে কেমন করে। মেয়ের দৃষ্টির সামনে কেমন করে হৃদয়ের আবেগ গোপন করে চলবে। আপনের প্রেম চরণে এনেছে সীমাহীন জড়তা। চলতে ফিরতে সে হোঁচট খায়। আপনের মেসেজ ডিলেট করতে ভুলে যায় সে। মিশু যেভাবে মোবাইল ঘাটাঘাটি করে ওর চোখ বাঁচিয়ে ঠিকটাক থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবেনা। তারপরও মেয়ের জেদে এক বাসায় ওঠতে হবে রুমাকে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসা খুঁজে জিনিষপত্র টেনে হিঁচড়ে তুললো হাসান । মাকে কাছে এনে মিশু অনেক স্বস্তি পেলো।
সকাল ছ’টায় হাসান জগিঙ করতে যায়। বাসার নিকটে জিমনেসিয়াম আছে। হাসানের সাথে মিশুও যায় জগিঙ করতে। রোগাটে মিশুটা কেমন মুটিয়ে গেছে। সংসারের কাজে ডুবে থাকে মেয়েটা। রান্নাবান্না কাপড়কাঁচা চোখের নিমিষে করে ফেলে। কাজ শেষে মায়ের কাছে নসটিখসটি করে। মায়ের মোবাইল ঘেটে ঘুটে দেখে। মোবাইল নিয়ে বাইরেও চলে যায় মিশু। স্যামসাাং গ্যালাক্সির চেয়ে কমদামী সেটের আসক্তি বুঝতে পারেনা রুমা। সকালে জগিঙের সময়ও সে মায়ের সেটটাই নিয়ে যায়। মেয়েকে নিষেধ করতে পারেনা সে । তার অভ্যেসও নেই। মুখের ওপর হুট করে কিছু বলতে পারেনা। এর মধ্যে আপন যদি কল করে বসে। মিশু যদি জানতে পারে মায়ের অভিসার চলছে তাহলে হয়েছে! এমন কথা বলবে কানে হাত দিতে হবে। মিশু মোবাইল নিয়ে গেলে রুমার প্রাণ হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। মনে হয় জানটা আর ধড়ে ফিরে আসবে না। পাখিকে দিয়ে যদি আপনকে খবর পাঠানো যেত। সে যেন কোনক্রমেই কল না করে। আর বাসায় আসার পর থেকে রোজাটা সারাদিন লেজে লেজে থাকে। ওর সামনে কাউকে কল করার জো নেই। কথা বলা শুরু করলেই ও চিল্লাতে শুরু করে,‘কার সাথে কথা বলছো, ও হ্যাঁ কার সাথে কথা বলছো?’ চিল্লার শব্দে জামাই মিশু ছুটে আসে। তখন সংকোচে এতোটুকু হয়ে পড়ে রুমা। দরজা লাগিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয় তার। রোজাকে রুমে নিয়ে দরজা দেয় মিশু। স্বামী কন্যার সঙ্গে রাত যাপন করে সতেজ চোখে সকালের অরুণিমা প্রত্যক্ষ করে সে। কিন্তু রুমা বাইরের ভুবন দেখে নিজের ভেতর কুঁকড়ে যায়। মেয়ে তার সম্পর্কে গোপন কিছু জেনে ফেলেছে কিনা? অতটুকু রোজা সেও তাকে আগলিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। জামাইর চোখের সামনে সে সংকোচবোধ করে। মেয়ের মাধ্যমে জামাই কিছু জেনে ফেলতে পারে। অফিসের কলিগ, প্রতিবেশি আর তিনজোড়া চোখের সামনে সে নিজকে কেমন করে আড়াল করে রাখবে। সতর্ক হতে চেষ্টা করে রুমা। আপনকে বলে দেয় যাতে সে যখন তখন কল না করে । সাবধানে চলে সে লালিত স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
মায়ের দিকে খুব খেয়াল রাখে মিশু। যে মাকে অবলম্বন করে সে দিনের পর দিন বেড়ে ওঠেছে তার সুখের দিকে নজর রাখে সে। মায়ের মুখে হাসি নামক জিনিষটি দেখতে পাায়নি মিশু। মা যেন অনুভুতিহীন জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। চরম খুশির দিনেও মা পুতুলের মতো নিস্পৃহ হয়ে থাকে। যা দেখে মিশুর মন হাহাকার করে ওঠে। মা কী কোনদিন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠবে না! পৃথিবীর আলো বাতাসের সাথে মিতালি করে জীবনের মহা আয়োজনে মা কী ফিরে আসবেনা! মায়ের লক্ষ্য ছিলো মিশুকে বড় করে তোলা। আজ সে স্বামীর ঘর করছে। একটি ফুটফুটে মেয়ে এসেছে তার কোলে। মেয়েকে বুকে নিয়ে সে তার ভেতরের মাতৃহৃদয়ের সন্ধান পায়। তার স্বত্তার গভীরে যে একটি মমতার তটিনী বয়ে যাচ্ছে তার ঢেউয়ের গর্জন সে শুনতে পায়। মায়ের নিরাবেগ মুখের দিকে তাকিয়ে গোপনে অশ্রুপাত করে মিশু। মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাবার প্রাণপন চেষ্টা করে সে। সারাদিন সে রোজাকে নিয়ে মায়ের বিছানায় গড়াগড়ি খায়। মায়ের মোবাইল ঘেটে সে মায়ের পছন্দের মানুষের খোঁজ করে। বাবার পরে মায়ের কী কোন পছন্দের পুরুষ নেই! মা কী চোখ খুলে এই শস্যশ্যামল ধরণীর ঝলমলে রুপের সমারোহ দেখেনা! আশাহীন তরী বেয়ে মা অবসন্ন দেহখানা কোন ঘাটে ভিড়াবে। অনেক খুঁজে মায়ের মোবাইলে একটি নামের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে মিশু। আপন নামের একজনের সাথে মায়ের ফোনালাপের বিষয় আঁচ করতে পেরে সে মনের ভেতরে আনন্দই অনুভব করে। মা তাহলে হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত হতে চায়না। কোন সহৃদয় মানুষের হাত ধরে মা যদি জীবনের পথে হেঁটে যেতে চায় তা হলে মিশুর মনটা প্রসন্নই হবে। মাকে ঘুণাক্ষরেও বিষয়টি বুঝতে দেয়না সে। বরং তার গোপন হৃদয়বৃত্তির সন্ধান লাভের মানসে সে আরও মনোযোগী হয়ে ওঠে।
প্রায় রাতে মায়ের দরজায় কান পাতে মিশু। ছিটকিনি লাগানো মায়ের অভ্যেস নেই। দরজাটা আধভেজা হয়ে থাকে। মিশু শোনে মা যেন কার সাথে কথা বলে একান্ত আগ্রহের সাথে। খুব প্রাণবন্ত মনে হয় মায়ের কথাগুলো। কথার মাঝে মিষ্টিমধুর হাসে মা। হৃদয়ের বাণী কার উদ্দেশ্যে যেন ছুঁড়ে দেয় অতুলনীয় মাধুর্যের সাথে। সবকথা শুনতে পায়না মিশু। মা এতোটা নি¤œস্বরে কথা বলে যে বুঝতে অসুবিধা হয়। তবু বাড়ি, বাগান, চন্দ্রমল্লিকা, অপরাজিতা, রক্তচন্দন শব্দগুলো হতে মায়ের হৃদয়ের সুপ্ত বাসনার প্রতিধ্বনি শুনতে পায় সে। মায়ের নিশব্দ আলাপচারিতা খুবই উপভোগ্য মনে হয় তার। মা তাহলে জীবনের বৈচিত্রময় আহ্বান শুনতে পায়? এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি মায়ের প্রাণশক্তি? মিশু ভেবেছিলো মাকে আর চাকুরি করতে দেবেনা। তার তো আর কোন সন্তান নেই। তার বেতন, উৎসব ভাতা, লাম্পগ্রান্ড, জিপি ফান্ড এবং পেনশনের সব টাকার মালিক সেই। সব উপার্জন হস্তগত করার জন্য মাকে নিজের কাছে টেনে এনেছে। তার দিন ফুরিয়ে গেলে আলাদীনের প্রদীপের মতো আশ্চর্যজনক উপায়ে অনেক সম্পদের অধিকারী হতে পারবে। বাসা ভাড়ার অর্দ্ধেক টাকা সে মায়ের কাছ থেকে আদায় করে। লজ্জার কারনে অনেক অর্থ প্রতিমাসে খরচ করে মা। কিন্তু রোজাকে বুকে জড়ালে মায়ের বিধ্বস্ত হৃদয়ের জরাজীর্ণ প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করতে পারে সে। সে কি পারবে অমন দুরাবস্থায় মায়ের মতো করে রোজাকে বড় করে তুলতে? একেকটা বুভুক্ষ দিন মায়ের মনে কতোটা রুক্ষতা ঢেলে গেছে তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী তো নিজে। আজ মিশু এতোটা নীচে নেমে গেছে। মায়ের অন্তিম প্রশ^াসের অপেক্ষায় দিন গুনছে? এমনটা হওয়া তার পক্ষে কি শোভনীয় হচ্ছে? ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যায় মিশু। মাকে সে আগের মতো প্রাণময় এবং টগবগে দেখতে চায়। সে চায় বাবার মতো হৃদয়বান কেউ আবার মায়ের জীবনে আসুক। যাকে সে বাবা বলে ডাকতে পারবেনা সত্য কিন্তু মাকে কেন্দ্র করে তার সাবলীল বিচরণকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে। রাতের অন্ধকারে দরজা খুলে অতি সন্তর্পণে মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে মায়ের ফোনালাপ শোনে সে। মায়ের কথা সে স্পষ্ট শুনতে পায়। অনেক সময় ধরে মা এবং আপনের নিবিড় আলাপ শ্রবণ করে। মায়ের প্রশ^াসের উষ্ণতা, কামনার গভীরতা এবং আকাঙ্খার তীব্রতা তাকে দারুণভাবে আহত করে। মায়ের হৃদয়ের চাপা আর্তনাদ মিশুর অন্তরের কঠিন শিলা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। মিশু যেন আরেক মিশু হয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। মেয়েকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় এতোটুকু হয়ে যায় মা। মিশু তাহলে সব জেনে গেছে? এতোবড় অপমান নিয়ে সে কেমন করে মেয়ের সাথে বাস করবে। কিন্তু মিশু মাকে অন্য কথা বলে। মায়ের তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে তাকে সামনে চলার মন্ত্র শেখায়। জীবনের অনিশেষ আনন্দের বিপুল তরঙ্গে সে তাকে ভাসিয়ে দেয়।
সরকার মঞ্জিল, কলেজ রোড
ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম
খোলাচুল
খোলাচুল
আনোয়ার রশীদ সাগর
-এই ওট্, তোর বাপের বাড়ি যা।
-ক্যান বাপের বাড়ি যাবো? হাড় খাবো-মাংস খাবো, তারপর যাবো।
-দেকিরে শালির মাগী, আবার মুকি মুকি কতা?
-কতা না কইয়ি কইয়ি, তো ঘাড়ে উইটিছো, একুন আর ছাইড়বু নানে।
-বউয়ের কথা শুনে হালিমের মেজাজ আরো গরম হয়ে যায়। সে নিজ জায়গা থেকে উঠে গিয়ে বলে, কী করবি-কী করবি তুই।
-মামলা কইরবু, মামলা। তারপর মূন্সী দাদারে দিয়া পিটাইবু।
মূন্সীর কথা শুনা মাত্র হালিমের মাথায় খুন চড়ে যায়।
সে ফস-ফস করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, ছইরনের চুল চেপে ধরে, ঝ্যাটকা দিয়ে টেনে বলে, মামলা করার আগিই তোকে এই মাটিতে পুঁইতি রাইকবুনি মাগী, পুঁইতি রাইকবুনি। হাপাতে থাকে হালিম। এর পর ছইরনের চুল ছেড়ে দিয়ে, তারই ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে, চোখ পড়ে, পাশে রাখা ভাতের থালার উপর। চোখ পড়ার সাথে সাথে, ফুটবলে জোরে লাথি মারার মত, পা দিয়ে লাথি মারে ভাতের থালায়। থালাটি উড়ে গিয়ে উঠানে পড়লে, ভাত গুলো, আঁকা-বাঁকা বয়ে চলা নদীর মত লাইন দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর থালাটি ঘুরতে ঘুরতে কুমড়া মাচার নিচে খুঁটিতে গিয়ে মৃদু ধাক্কা লেগে থেমে যায়। হালিমের তিন চার বছর বয়সের মেয়েটা আধো-আধো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে, থালার পাশে বসে এবং থালাটা হাতে নিয়ে, ছোট-পায়ে হেঁটে হেঁটে এসে, মেয়েটি ঠোঁট নড়িয়ে,আলতো করে বলার চেষ্টা করে, আবা-আব্বা...।
তার বাবার দিকে থালাটি এগিয়ে দিয়ে ধরে রাখে ও হালিমের মুখের দিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকে। হালিমের চোখ মদিনার চোখে পড়ায়, সে গুজ-গুজ শব্দ করতে করতে বেরিয়ে যায় পূর্বদিকে। মদিনা আবারও বসে পড়ে এবং তার ছোট কচি দু’খান হাত বিছিয়ে, ছিটিয়ে থাকা ভাত গুলো কুড়াতে থাকে। এবার খুব আবেগের সাথে, দু’হাতে পরণের কাপড় গুছিয়ে, ছইরননেছা উঠে এসে, তার মেয়ে মদিনাকে কোলের ভিতর নিয়ে হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকে।
হালিম হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে খোলা মাঠে পা রাখে। তার চোখে পড়ে, একটি মা-শালিক পাখির পিছনে পিছনে একটা বাচ্চা শালিক, পাখা উঁচু করে খুব কষ্টে ঘুরছে। কখনো পিছনে-কখনো সামনে থাকছে বাচ্চাটি। বাচ্চাটা দু’ঠোঁট ফাঁকা করে, চ্যাঁচ্যাঁ শব্দ করে ডাকছে। মা-শালিকটা মুখের ভিতর মুখ দিয়ে, খাবার খাওয়ায়ে দিয়ে, দু’ঠ্যাঙ তুলে, নাচতে নাচতে একটু দূরে গিয়ে, খাবার সংগ্রহ করছে। ঠিক তখনই বাচ্চা শালিকটা দু’পাখা খানিক উঁচু করে, কর্কশ গলায় চ্যাঁচ্যাঁ করছে। মা শালিকটা চেষ্টা করছে, দূরে যাবার, কিন্তু যাচ্ছে না। হালিম বুঝলো, বাচ্চা শালিকটাকে তার মা, মাটি থেকে খাবার কুড়িয়ে খাওয়া শিখাচ্ছে। হালিম ক্লান্ত মনে একটি ধানক্ষেতের পাশে বসে পড়ে। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
হালিম অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ধান ক্ষেতের দিকে। বার বার মনে পড়ছে মায়ের কথা। তার মা, দু’চালা ঘরের আড়াতে, গলায় জড়ানো শাড়িতে ঝুলেছিল। ঘাড়টা নিচের দিকে হেলেছিল। মাথার খোঁপা-খোলা বড় বড় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়েছিল পিঠের উপর। হালিমের বাপজান ঘরে ঢুকে, ঝুলন্ত মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল, কী করলিরে মোমেনা, তুই কি করলি?- আমার ছেলিডাকে এতিম কইরি থুইগেলি। বলে, হুঁ-হুঁ করে কাঁদতে কাঁদতে, হালিমের ঝুলন্ত মায়ের লাশের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বুক থাপড়াচ্ছিল। সে দৃশ্য হালিম তার চোখে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ধানের আলে বসে হালিম আবেগে তার চোখ মুছতে থাকে এবং মনে মনে বলতে থাকে, মাগো মা, খুব দুঃখে আছি-মন চাই তোর পাশে কবর খুইড়ি, শুইয়ি পড়ি, তোর শাড়ির নিচি।
তারপর ঝুলন্ত মাকে ঘরের আড়া থেকে নামিয়ে, গ্রামের মানুষে গোরস্থানে রেখে এসেছিল, এসেই বাপজান বার বার হালিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল, বাপরে তুই আর তোর মাকে পাবি না। তখন হালিম না বুঝেই, তার বাপজানের কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল। মা মারা যাওয়ার পর, ছোটবেলায় থেকেই দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে সে। তখন থেকেই গ্রামের আহাম্মেদ মূন্সীর বাড়ি বান্দা কাজ করে আসছিল। হঠাৎ একদিন তার বাপজান দ্বিতীয় বিয়ে করে, শ্বশুর বাড়িতে (দ্বিতীয় মা বাপের বাড়ি) চলে যায়। তখন হালিম আরো একা হয়ে যায়।
তার জায়গা হয়, গ্রামের মসজিদের মূয়াজ্জ্বীন মজিবরের বাড়ি। মজিবরও থাকতো, আহাম্মদ মূন্সীর আশ্রয়ে। আহাম্মদ মূন্সী এ গ্রামের মন্ডল মানুষ। তার অনেক বড় গৃহস্থালী রয়েছে। গ্রামের অনেকেই তার বাড়ি জনখেটে খায়। তবে মজিবর মসজিদের মূয়াজ্জ্বীন হওয়ায় তার আলাদা সম্মান আছে। তাই আহাম্মেদ মূন্সী, তার সবচেয়ে বড় দাগের জমির পশ্চিম আলে, একটু জমি মজিবরকে দিয়ে, বাড়িও করে দিয়েছে। সে বাড়িতে মজিবর, তার বউ কুলসুম এবং একমাত্র মেয়ে ছইরননেসাকে নিয়ে বসবাস করে। পাশাপাশি আহাম্মেদ মূন্সীর বড়দাগের জমিটার ফসলাদিও দেখাশুনা করতে পারে। এখানেই হালিমের থাকার জায়গা হয়।
হালিম একটু স্বাবালক হলে আহাম্মেদ মূন্সী নিজেই ছইরনের সাথে হালিমের বিয়ে দিয়ে দেয়। সংসার জীবনে পা রেখেই হালিমের চোখে পড়ে অনেক ঘটনা।
হালিমের শাশুড়ি কুলসুম খাতুনের আর সন্তানাদি হয়নি। দেখতেও সুন্দরী। ছইরননেসা আর কুলসুম খাতুনকে এক জায়গা দাঁড় করিয়ে দিলে, মা ও মেয়েকে দেখতে মনে হয়, পিঠাপিঠি
দু’বোন। হালিমের চোখে প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে, তার বিয়ের দু’বছর পর। যখন তার শ্বশুর, আযানের পূর্বে ঘুম থেকে উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে, মসজিদের দিকে যায়, সে সময় ওই জমির পশ্চিম আলে, আহাম্মেদ মূন্সী এসে পায়চারী করে। প্রায় প্রতিদিনই আহাম্মেদ মূন্সীকে আসতে দেখে, হালিম একদিন তার শাশুড়ির ঘরের কোণে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। তার যা সন্দেহ হয়, ঠিক তাই দেখতে পায়। জানালার ফাঁক দিয়ে, হালকা পূর্ব আকাশের আলোয়, দিব্বি দেখা যায়। কুলসুমের নগ্নবুকের উপর উন্মত্ত হয়ে, খেলা করতে থাকে আহাম্মেদ মূন্সী। ডান হাতে, কুলসুমের এক পা উঁচু করে ধরে, অনর্গল নড়তে থাকে আহাম্মেদ আলীর প্রায় নগ্ন পাছা। এরপর আহাম্মেদ আলী উঠে দাঁড়িয়ে থাকে কুলসুমের সামনে। আর কুলসুম খোলাবুক সম্মূখের দিকে ঠেলে দিয়ে দু’হাত দিয়ে, তার লম্বা চুলগুলো গুছিয়ে পিছনে খোঁপা বাঁধতে থাকে। তখন মূন্সী তার দু’হাত দিয়ে নেড়ে দেয়, কুলসুমের খলবলিয়ে দুলে বেড়ানো স্তন দুটো। এ দৃশ্য দেখে, হালিম স্থির থাকতে পারে না, সে দ্রুত নিজ ঘরে ঢুকে, ছইরননেসাকে নগ্ন করে সঙ্গমে মত্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে আহাম্মেদ মূন্সী খোস মেজাজে, বাম হাতে নিজের লুঙ্গির শেষ অংশ ধরে, উঁচু করে, বাইরে বেরিয়ে, মুখ উঁচিয়ে, থু শব্দ করে, থুথু ফেলে চলে যায়।
সকাল হলে, হালিমের মন বিরক্ত ও অভিমান-অভিযোগে ভরে থাকে। কাজে তেমন মন বসে না। এভাবেই কেটে যায় আরো দুটি বছর।
দ্বিতীয় ঘটনা দেখে হালিমের মনে সন্দেহ আরো দানা বাঁধে। হালিমের বউ রইছননেসাকে নাতনী সম্মোধন করে ডাকে আহাম্মদ মূন্সী। প্রায় মশকরাও করে। এ মশকরাতে অংশও নেয় ছইরন। সেদিন সন্ধ্যা-ঘোরে, আহাম্মেদ মূন্সীকে ছইরননেসার ঘর থেকে বের হতে দেখে হালিম। হালিমের সামনাসামনি হওয়ায়, আহাম্মেদ মূন্সী হালিমের পিঠে হাত দিয়ে বলে, নাইতজামাই সকাল-সকালই তো বাড়ি আইসি গিছো!- ভালো ভালো, বউ’র প্রতি ভালোবাসা থাকা ভালো। দেকি রাইকু আমার নাতনীডারে...,।
হালিমের শরীরের ভিতর আগুন ধরে যায়। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। মনে মনে ভাবে, মূন্সীরই খায়-পরি, মূন্সীর বাড়িই থাকি।
আল্লার উপর বিচার দেয়, আল্লা গো, তুমি বিচার কইরু।
ভাবতে ভাবতেই চোখের আড়ালে চলে যায় আহাম্মেদ মূন্সী। হালিমের চোখের সামনে, শাশুড়ির দুলানো নগ্নবুক আর পিছনে কাইত হয়ে দু’হাতে, চুল বাঁধার দৃশ্য, বার বার ঘুরেফিরে ভেসে আসে। চোখ থেকে মুছতে গিয়ে, মনের মধ্যে ভেসে ওঠে নিজ বউয়ের নগ্নবুক আর খোলা এলোমেলো চুলগুলো।
না; হালিম আর বসে থাকতে পারে না, দ্রুত উঠে পড়ে। সে তার বাপজানের মত, এই গ্রাম ছেড়ে, ছইরননেসা আর মদিনাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।
উঠানে পা দিয়ে দেখতে পায়, ছইরননেসার পিঠের উপর চুলগুলো বেয়াড়া হয়ে ছড়িয়ে আছে। আর মদিনা তার ছোট দুটি হাত দিয়ে, তার মায়ের চুলগুলো যত্ম করে গুছিয়ে দিচ্ছে।
শব্দমালা : সালমা বিনতে শামছ
শব্দমালা
সালমা বিনতে শামছ
সে
আমার নগরীর আজ চিন্তাগুলো বিবর্ণ।
রং নেই, রূপ নেই,
আছে শুধু এক আকাশ উজ্জল অভিপ্রায়।
আমি তো কখনো হেরে যাই নি;
আমি হারবো না।
তার কষ্ট আর হতাশাগুলো আমার বক্ষে চাষাবাদ করছি প্রতিনিয়ত,
কেন’ই করবো না?
সে তো আমার অন্ধকার শহরে,
এক উজ্জল ল্যাম্পপোষ্ট।
অপেক্ষা
স্বপ্ন বোনার ব্যেলকুনিতে দাঁড়িয়ে,
এক পশলা বৃষ্টি ছোঁয়ার অপেক্ষায়।
ক্ষনিকেই ক্লান্ত আমি;
কান্ত, পরিশ্রান্ত।
দীর্ঘ নিশ্বাস,
অফুরন্ত আশ্বাস;
অসঙ্গায়িত বিশ্বাস।
এইতো আছি,
বেঁচে থাকার তাগিদে।
কৃত্রিমতা
পৃথিবীর এ প্রান্তে গড়ে উঠা সভ্যতা,
তিল তিল করে সৃষ্ট,
আরেক প্রান্তের ধ্বংস।
প্রযুক্তি গিলছে আমাদের,
হৃদপিন্ডের নিঃশ্বাস যান্ত্রিক,
বোরটিক জীবনে স্বাদ পাই কেবলই কৃত্রিমতা।
প্রেম
আসমানি রং এর পর্দা টানিয়েছি বাতায়নে,
মৃদু বাতাসে উড়ে চলে এক গুচ্ছ কেশের ন্যায়।
তুমি ও পথ ধরে হেঁটে চলো,
কখনো দ্রুত,
কখনো ক্ষীণ।
আমি দন্ডায়মান; বাতায়নের কূল ঘেঁষে,
তুমি আসবে, হেঁটে যাবে,
আকাশ দেখার নাম করে আমার
দৃষ্টি সিমানা তোমার ওই পথ অব্দি।
ধ্বংস
আমরা বিবাদ করে যাই
ধরি, মারি, ধ্বংস করি,
পথে পথে প্রতিবন্ধকতা
আমাদের নেই কোন স্বকীয়তা।
ভুলে যাই ধর্ম জ্ঞান
খুঁজে বেড়াই অর্থহীন সন্মান।
মুখে বলে বেড়াই ; ছড়িয়ে সততা,
ভিতরে পশুত্ব, দেখাই মানবতা।
কত কাল ধরে রবে বিচ্ছিন্ন সব অংশ
জাতী, দেশ, মহাদেশ ; বয়ে বেড়াবে ধ্বংস।
পদাবলি
মা আমার জন্মধাত্রী মা
জুবায়ের দুখু
নাভি ছিঁড়ে- ভূমিষ্ঠ হল তোমার উদর থেকে মা
আমি তোমার সাতরাজার ধন।
যুগে যুগে কত তাপস্য করে-- আমাকে ডাকলে
অবশ্য এর একাংশ বাবার দায়িত্ব।
মা আমার জন্মধাত্রী মা
পৃথিবীতে আমাকে আনতে তোমার এতো কষ্ট আমি
কিভাবে পরিশোধ করব- তুমিই বলে দাও
চুমকে দিয়ে চুমু দাও ওষ্ঠরে
এলিয়ে দাও তোমার কোল আবারও প্রাণ জুড়াই
দুদন্ড সেই কোলে মাথা রেখে।
মা আমার রাগ করো না
আমি সইতে পারি না তোমার বিষন্ন মুখ গম্ভীরতা।
ডবভ্রান্তিকর তুচ্ছ আবেগের কফিলতে
যারা মাকে ভুলে যায়- তার অবিশোধিত ঋণ
ওরা মানুষ নয় এক-একটি করোনা ভাইরাস।
অপূর্ণতা
সানাউল্লাহ বিপুল
পূর্ণতা পেলো না মন পূর্ণতা পেলো না
বেলা বয়ে গেলো তবু পূর্ণতা পেলো না
ছোট ছোট আশা কত পূর্ণতা পেলো না
আশায় ছিলাম আশায় আছি
দূরে বহু দূরে গেছি
লক্ষ্য ছুতে পারি না
কালের ¯্রােতে দাড়িয়ে আছি
হিসাব নিকাশ বেজায় কৃষি
শূন্য তো মেলে না
খেয়া পাড়ে বসে আছি
মাঝি তোমার আশায় বাচি
তবু তুমি এলে না।
অন্য চোখ
লুৎফুন নাহার লোপা
একবার চোখদুটো রেখে এলাম যেখানে
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আবিষ্কারের পর
সেই পথে পরে রইল তার অমোঘ ঘ্রাণ।
মেহগনি, আম কিংবা কাঠালচাপার ডালে
যে উদ্বেগ পাশাপাশি হেটে ফিরে গেলো
বাড়ি ফিরে নানা আসবাব হাতরিয়ে
খুজে দেখলাম তার পরিচয় মেলে কিনা।
পরিবর্তে চোখের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলো
একটি নিগূঢ় গল্প।
যেমনটা সময়ের ব্যাবহার শিখে নিয়ে
দুর্বোধ্য হয়ে উঠে ভালোবাসা।
ভাষণের অপেক্ষায়
শরিফুল ইসলাম
বাংলার আকাশে ঝলমলে সূর্য!
পূর্ব কোণের হলদে রঙের রং খেলায়-
শুরু যে হয় একটি দিনের দিন হিসাব।
আজকে আকাশ চুপ করেছে এই বেলায়
চুপ করেছে আকাশ আলো সে কার্যকলাপ।
বাংলায় আজকে স্তব্ধ আলোয়-
নিবুনিবু সে, ঘটছে কি ভাই স্তব্ধ আলোয়?
নীরব বাওয়ে সুর পড়েছে কিসের লাগি?
এখন দেখো ছুটছে সবাই রুদ্ধ কালোয়
ময়দাতে যে যাচ্ছে সবাই, সবাই জাগি।
বাংলায় আজকে সূর্য উঠবে!
ভাষণ হবে শাসন ভেঙে বজ্র প্রপাত-
আসছে তুফান লব্ধ কেতন জয় করিতে।
হাত তুলেছে বঙ্গবাসীর লৌহ সে হাত
তৈরি সবাই বঙ্গবন্ধুর ডাক শুনিতে।
আমার সরল ইচ্ছেগুলি
সাজেদুর আবেদিন শান্ত
১
বেশি কিছু চাওয়া পাওয়া নেই আমার
একটা ছাচের বেড়া আলা ঘর চাই
ঘরে একটা কাঠের টেবিল চাই
যার দুই-তিনটা পাওয়া ঢোকা আর ব্যান্ডেজ এ দারানো।
যার উপর কয়েকটি বই থাকবে
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, নজরুলের অগ্নিবীণা, বিভুতিভুষনের পথের পাচালি, জীবনানন্দের বনলতা, জসিমউদ্দীনের নকসীকাথা, হুমায়নের শ্রাবণ মেঘের দিন।
একটা মাটির কলস চাই, একটা মাটির পেয়ালা চাই।
ছোট একটা উঠান চাই, বাশ ঝাড় চাই, ঝাড়ের নিচে একটা টঙ চাই,
গ্রীষ্মে ফ্যান কিংবা এসি না
চাই বাশঝারের নিচে টংগের উপর বসে মৃদু শীতল বাতাস
২
শীতকালে রুম হিটার চাই না
চাই বেলকুনিতে আসা রোদ কিংবা উঠানে আসা রোদে গা এলিয়ে দিতে
প্রযুক্তিময় যুগে আমার বেশি কিছু চাই না।
টুঙ্গিপাড়ার রাজপুত্র
কাব্য কবির
টুঙ্গিপাড়ায় সোনার চামুচ মুখে নিয়ে
জন্মেছিলো এক রাজপুত্র।
সব সময় তার মুখে থাকতো শিউলি
পুষ্পের মতো হাসি। ভালোবাসার জালে
বেধে রাখতো সবাই কে।
বৃত্তহীনদের অশ্রুজল দেখলে
মুছে দিতো ভালোবাসার রুমাল দিয়ে।
আকাশের মতো খোলা মন
ছিলো তার।
ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের শিকল
ভেঙে ফেলতো।
একদিন পাকিস্থানী শকুনেরা ঝাঁপিয়ে
পড়ে এদেশের মানুষের ভালোবাসার মানচিত্রে।
সবাই হয়ে গিয়েছিলো দিশেহারা,
চেয়েছিলো মুক্তির আত্মতৃপ্তি।
রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে রাজপুত্র
শোনালেন মুক্তির এক কবিতা
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার
সংগ্রাম।
কবিতার প্রতিটি শব্দ ছিলো আগুনের
ফুলকার মতো। কবিতা শুনে মানচিত্রের প্রতি
ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, অন্যেয়ের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়াবার শত্তি, মুক্তির চেতনা
খুঁজে পায়।
রাজপুত্র দূর আকাশে চলে গেছে, রেখে
গেছে কালজয়ী কাব্য, এদেশের ষোল কোটি
ফুল কখনো ভুলবেনা রাজপুত্র কে, হৃদয়ের
গভীরে তার ছবি একে
রাখবে কাল, মহাকাল.........
একটি কন্ঠ
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ
একটি কন্ঠে গর্জে ওঠে
যেন নদীর ঢেউ,
একটি কন্ঠেই পালাবদল
জানতো নাতো কেউ।
দমকা বাতাস কণ্ঠে ওড়ে
একটি বিশাল ঝড়,
ভাষণ শুনে আমজনতা
ছাড়ছে তাদের ঘর।
আঙ্গুল তুলে ডাক দিয়ে যায়
ফুটে মুখের বোল,
স্বাধীনতার জন্য সবাই
করে হুলুস্তুুল।
সেই যে কন্ঠ চিনে সবাই
মুজিব নামটি যার,
স্বপ্ন তাদের একটি দেশের
স্বপ্ন পতাকার।
শোক
কিশলয় গুপ্ত
হাত গুটিয়েছে শব্দরা- আমিও মূক
রাত বেড়ে চলে মন্থরে- অলীক সুখ
সহজিয়া সুর যন্ত্রনাতে আত্মীয়
জানালায় দুটি চোখ রেখে রোজ দেখে নিও
হিসাব ছাড়া বদলে চলে দৃশ্যপট
দর্পন ভাঙে, বর্ষনে ভাসে লক্ষ্মীঘট
দর্শন ধরে শব্দরা শব- নিষ্পৃহ
ঘর্ষনে আর আগুন জ¦লে না, ছাই গৃহ
অট্টহাসির উল্লাস বাড়ে ধড়কনে
হাতে হাত বাঁধা সাত পাকে চুপ বরকনে
মূকের এবং বুকের লেখা মরমিয়া
ছাই’ এর স্তুপে রুপকথা খুঁজি, জ¦লে জিয়া
এইসব আধারের নৈঋত
এইসব আধারের নৈঋত
নৃ মাসুদ রানা
জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েই সোজাসুজি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হাজির। পরিচিত কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। মুখটা চুপসে বিবর্ণমুখ। কপালে বুঝি একটা বিড়িও জুটবে না।
পকেটে টাকা নেই। চায়ের দোকানে বসে শুধু এদিকসেদিক তাকাচ্ছে। যদি পরিচিত কাউকে পাওয়া যায়। দোকানে অল্পবয়সী এক ছেলে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার আব্বায় কই গেছে? দোহানে আয়ে নাই?’
আব্বায় তো খাইতে গেছে। আইয়া পড়বো। কিছু লাগবো? আমারে বলেন।
দুপুর বিকেলের মাঝামাঝি। দূর থেকেই বলে উঠলো – ওস্তাদ নাকি? কখন আইলেন?
হ রে মজনু, আমিই। তোর পোলাই কইলো তুই নাকি খাইতে গেছোস।
হ ওস্তাদ। খাওনের পর চোখটা লেগে আইছিলো। সেজন্য একটু...।
তা ওস্তাদ বাসায় গেছিলেন নাকি? ভাবি একদিন আইছিল কিছু ট্যাহা লইয়া গেছে।
নারে মজনু। এখনো যাই নাই। পকেট খালি একটা বিড়িও...।
বিড়ি ধরিয়েই হাঁকিয়ে টানতে শুরু করলো। মজনু মিয়া বিড়ি টানা দেখে হা করে চেয়ে দেখছে।
কি রে মজনু! কি দেখছিস?
না ওস্তাদ। কিছুই না। অনেকদিন অইলো আপনারে বিড়ি টানতে দেহি না।
আর কইস না। নেশা লাগছে। জব্বর নেশা লাগছে।
ওস্তাদ! আর কিছুর নেশা লাগছেনি।
হ, মনের কথাডাই কাইড়া নিলি। অনেকদিন খিদা লাগছে। পরানডায় খুব চাইতেছে।
মজনুর ফোন বাজছে। ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না...
কেডায় ফোন দিছেরে মজনু?
ওস্তাদ আপনে চিনবেন না। পোলাডা নতুন। কাজকামে খুবই ভালা। মরতুজের গ্যারেজে থাকে। বাস চালায়।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। ওপাশ থেকে বলছে
আইজকা কড়া একটা মাল পাইছি ওস্তাদ। নাদুসনুদুস গোলগাল দেখতে। কচি বয়স। সেইরহম অইবে।
কি কস! কথা সত্যি? এতো ভালা খবর।
হ ওস্তাদ! একদম হাঁচা কথা। আপনে দেখলে মেলা খুশি হইবেন।
কোত্থেকে আনছোস? কেউ দ্যাহে নাইতো।
না ওস্তাদ। কেউ দ্যাহে নাই। মুখ চেপে ধরে আনছি।
চিল্লায় নাই?
হ, খুব চিল্লাচিল্লি লাফালাফি করছিল। পরে গামছা দিয়ে চোখমুখ বাইন্ধা...। আমাগোর লগে কি আর পারবোনি (হেসে হেসে)?
তোরা কাজ সারছোস?
লাল্টু শুরু করতে নিছিলো ধমক দিয়া থামাইয়া রাখছি। আমি বলছি আগে ওস্তাদ, তারপরে আমরা। না কিতা কন ওস্তাদ?
হ, ঠিক কথাই কইছোস।
তাইলে ওস্তাদ আপনের পাওনের টেহা...
ঠিক আছে। আর দিতে অইবো তোকে। কি খুশিতো?
হ, ওস্তাদ। খুশি মেলা খুশি অইলাম।
কথা বলা শেষ। মজনু আরেকটি বিড়ি ধরাইয়া রহিমের হাতে দিলো। মজনু নিজেও একটি বিড়ি ধরিয়ে হাঁকিয়ে টানতে শুরু করলো।
কি রে মজনু? কোন খবর আছেনি?
হ ওস্তাদ। আপনের কপালডা খুবই ভালা। মেলাদিন পরে একটা পাখি পাইছি। খেয়েদেয়ে তারপর বাসার দিকে রওনা দিয়েন। না কি কন ওস্তাদ?
হ, এতোদিন পরে সুযোগটা হাত ছাড়া করা উছিত অইবো না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে কিছুটা রাত। গ্যারেজের দিকে হাঁটছে দুইজন। কথা জমেছে বেশ। হেঁসে হেঁসে কথা বলছে।
গ্যারেজের পিছনে পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘর। টায়ার, গাড়ির এটাসেটা দিয়ে ভরা। তালা খুলেই মজনু মিয়া বলতে শুরু করলো – ওস্তাদ! আপনিই আগে মজা লইয়া আহেন। পরে আমরা যাবো। না কি কস লাল্টু।
হ, ওস্তাদ। ঠিকই কইছেন।
সুইচ টিপে লাইটটা জ্বালালো। মেয়েটি গুটিসুটি হয়ে টায়ারের পিছনে চুপটি করে বসে আছে। চোখ ভিজে ভিজে অশ্রু ফোঁটা বেঁয়ে বেঁয়ে পড়ছে। হঠাৎ আলোর কারণে চমকে উঠলো সে। ভয়ে আরও গুটিসুটি হয়ে বসে রইলো। বুক ধড়ফড় করছে। হাতপা কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটির।
শামসু টায়ার সড়িয়ে মেয়েটিকে ধরতেই সে মোচড়ামুচড়ি করতে শুরু করলো। চুল দিয়ে ডাকা মুখখানি তখনো চোখে পরেনি শামসুর। সে ধস্তাধস্তি জাবরদস্তি করে গামছা খোলা মাত্রই মেয়েটি চিৎকার করে উঠলো। শামসু মেয়েটির মুখ চেপে ধরতেই মেয়েটি বলে উঠলো - বাবা তুমি।
আজব ঘুম
আজব ঘুম
এ আই জাজাকী
চিটাগাং রোডে দাঁড়িয়ে আছি। যাব গুলিস্তান। চাকরির সুবাদে প্রতিদিন গুলিস্থানস্থ অফিসের দিকে ছুটতে হয়। এই অফিস টাইমে বাসে ওঠা খুবই দুর্বিষহ। সিট পাওয়া তো কল্পনার অতীত। সকাল আটটায় এখানে দাঁড়াই সিলেট কিংবা চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে আসা গুলিস্তানগামী লোকাল বাসের জন্য। সুযোগ পেলেই ঝুলে পড়ি বানরের মতো। তারপর আস্তে আস্তে পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সামনের মৌচাক, সাইনবোর্ড বা শনির আখড়ায় কোনো সিটওয়ালা যাত্রী নেমে গেলে টপ করে বসি পড়ি। তবে এরূপ খুব কমই হয়। বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়েই যেতে হয়। আজ আবার ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু করছে। গতরাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। আমার চার বছরের ছেলেটা জ্বরে সারারাত কান্নাকাটি করেছে। আতঙ্কে চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সকালে অবশ্য জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। তাই নিশ্চিন্ত মনে অফিসের দিকে ছুটছি। অবশ্য ঘুমের চাপে দাঁড়িয়ে থাকাটাও দায় হয়ে পড়েছে। জানি না আজ কীভাবে অফিস করব।
অল্প সময় দাঁড়িয়ে থাকতেই সামনে এসে একটা বাস দাঁড়াল। ভেতরে সিট ছাড়া দেখছি পুরো বাসই ফাঁকা। দাঁড়ানো যাত্রী একটাও নেই। আমি আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত উঠে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম শেষের সারির কোনায় একটা সিট ফাঁকা আছে এখনও। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? আবার আমার পেছনে গেট দিয়ে হুড়মুড়িয়ে লোক উঠছে। পাঁচ সেকেন্ড দেরি করলে হয়ত সিট হারাতে হবে। দ্রুত সিটে বসে গেলাম। এক মিনিটের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল পুরো বাস। দরজায়ও ঝুলছে কিছু লোক। বাস ছেড়ে দেয়ার পরও কিছু লোক দৌড়াচ্ছে উঠার জন্য। তবে আমি আর সেইদিকে দৃষ্টিপাত করছি না। সুযোগ যেহেতু পেয়েছি একটু কাজে লাগাই। অফিস ব্যাগটা কোলের উপর রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলাম। গুলিস্তান পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক ঘণ্টায় একটা ঘুম হয়ে যাবে। ক্লান্তির অন্তত কিছুটা হলেও দূর হবে।
সুপারভাইজারের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন বাস মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের উপরে। আছি সায়েদাবাদ টার্মিনাল বরাবর। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অগণিত গাড়ি। বিশাল জ্যাম। এখানে জ্যাম হয় দুইটা কারণে। প্রথমত অনেক গাড়ি একসাথে ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে দিয়ে ইউ টার্ন নেয় বলে। দ্বিতীয়ত এক লেনে একটিমাত্র টোল প্লাজা থাকার কারণে। একটি টোল প্লাজার মাধ্যমে একসাথে এত এত গাড়ির টোল আদায় করা বেশ সময়সাপেক্ষ। যতটুকু লম্বা জ্যাম দেখা যাচ্ছে তাতে আধ ঘণ্টার আগে শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাবে। যদিও মনে হচ্ছে অফিসে কিঞ্চিৎ দেরিতে ঢুকতে হবে। যাকগে, এতটুকু পথ হেঁটেও যাওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য। তারচেয়ে বরং এখানে আরামসে আর আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই। পঁচিশ টাকা ভাড়া পরিশোধ করে আবারও চোখ বন্ধ করলাম।
সুপারভাইজারের চিৎকারে ঘুম ভাঙল। সামনের সিটের একজনের সাথে ভাড়া নিয়ে তর্ক করছে সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলাম। এ কী! বাস সবেমাত্র শনির আখড়া পার হয়ে ফ্লাইওভারে উঠছে। বিষয় কী? আমি না একটু আগেই সুপারভাইজারকে ভাড়া দিলাম। নাকি আগেরটা স্বপ্ন ছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য পকেট থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখে নিলাম। এবার তো আমি ডাবল ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলাম। সময় ১১ টা বেজে ২৫ মিনিট। আমার সাথে কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। সুপারভাইজার এসে বলল, মামা ভাড়া দেন। আমি বললাম, বিষয় কী? আমি তো একবার ভাড়া দিয়েছি কিন্তু....। সে বলল, ধুর কী বলেন? এই ট্রিপে ভাড়া তো এখনই কাটতেছি। আমি বললাম, আমিও তাই বলছি ফ্লাইওভারের জ্যামে বসে তোমাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিলাম। তুমি পঁচিশ টাকা ফেরত দিলে। মানিব্যাগ চেক করে দেখলাম তোমার দেওয়া সেই পঁচিশ টাকা যেভাবে রেখেছিলাম ঠিক সেভাবেই আছে। জ্যাম লেগেছে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সুপারভাইজার বলল, তাই বলুন। ঐ জ্যাম পার হয়ে তো আবার মদনপুর গিয়ে ঘুরে এলাম। আপনি কি কোনায় এতক্ষণই ঘুমিয়েছিলেন? আমি বললাম, আমি তো জ্যাম দেখে একটু চোখ বন্ধ করেছিলাম। তা তুমি আমাকে ডাক দিবে না? সে বলল, গেইটে থেকে তো ডাক দিয়েছি। আপনি যে এই কোনায় পড়ে ঘুমিয়ে আছেন সেটা তো দেখিনি। আমি বললাম, গত রাতে ঘুম হয়নি তাই বাসে একটু ঘুমিয়েছিলাম। এই ঘুম যে কাল হয়ে দাঁড়াবে এটা কে জানত? অফিস তো পেলামই না, তার ওপর আবার আক্কেল সেলামি। আচ্ছা, তোমাকে আক্কেল সেলামি কত দিতে হবে? সে বলল, জ্বী কী বললেন? আমি বললাম, তোমাকে আর কত টাকা দিতে হবে? সে বলল, গুলিস্তান পর্যন্ত তো ভাড়া দিয়েছিলেন। তা গুলিস্তান থেকে মদনপুর চল্লিশ টাকা, আবার মদনপুর থেকে গুলিস্তান চল্লিশ টাকা। আচ্ছা, আশি টাকা তো হয়। যেহেতু ঘুমিয়েছিলেন, ভুল হয়েছে। দেন পঞ্চাশ টাকা দেন। আমি একশো টাকার একটা চকচকে নোট তার হতে দিয়ে বললাম, নাও একশো টাকাই রাখ। এখন অফিসে ঢোকার চেয়ে না ঢোকাই ভালো। এখন গেলে লেট হওয়ার জন্য বসের কথা শুনতে হবে আর না গেলেও কাল বসের কথা শুনতে হবে। তাছাড়া এই ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে অফিসে না গিয়ে বরং বাসায় গিয়ে ঘুমাই। আর যেতে যেতেও আরও এক-দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই। তুমি কিন্তু মনে করে চিটাগাং রোড গিয়ে আমাকে ডেকে দিও। তা নাহলে আর ভাড়া দিতে পারব না। সুপারভাইজার বত্রিশ দাঁত বের করা একটা হাসি দিয়ে বলল, ঠিক আছে মামা, আপনি তাইলে ঘুমান।
সুপারভাইজারের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে নিশ্চিন্তে আবার চোখ বন্ধ করলাম।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)