আয়না
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
আয়না
হেমন্ত হাসান
বাস থেকে নেমে আমি একটা রিক্সা নিলাম। অনেক দিন পর আজ আমি নিজের বাসায় যাচ্ছি। হ্যাঁ, অনেক দিন পর, প্রায় এক বছর। গত এই এক বছরে পরিবারের কারো সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি জানিনা বাসার সবাই কেমন আছে? তারা নিশ্চই আমার জন্য ভীষণ অপেক্ষা করে আছে। মা, ছোটবোন তুলি, আমার পাঁচ বছরের কন্যা রুহী আর রূপা। রূপা- আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। না জানি বেচারি এই একটা বছর আমাকে কত খুঁজেছে! না জানি কত রাত না খেয়ে থেকে থেকে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরেছে! যা কাঁদতে পারে মেয়েটা! খুব সামান্য কারনেই কেঁদে ফেলে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এই কান্নাটাই খুব ভালো লাগত আমার। রূপা একটু কাঁদলেই আমার চোখেও জল এসে টলমল করতে থাকত। তারপর রুহীর জন্মের পর থেকে রূপার কান্নাকে আমার অকারণ আদিখ্যেতা মনে হতে লাগল। একটা মেয়ে যে কিনা নিজেই একটা সন্তানের মা, সে কেন অতি তুচ্ছ কারণে ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁদবে?
আমার মেয়ে রুহীও জন্মের পর ছয় মাস খুব কান্নাকাটি করেছে। এত বিরক্ত লাগত আমার! সারাদিন অফিস করে রাতে ঘরে এসে শান্তিতে একটু ঘুমানোর উপায় ছিল না। এই নিয়ে খুব রাগারাগি করতাম আমি। আহারে! ছয় মাসের শিশু, কথা বলতে পারেনা, কান্নাই যার সকল অনুভূতির ভাষা; কত অসহায় সে, আর আমি কিনা ওর উপরে রাগ করতাম! ভাবতেই আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি রিক্সাটাকে একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড় করাতে বলি। রিক্সাওয়ালাটির হাতে এক কাপ লেবু চা ধরিয়ে দিয়ে আমি একটা সিগারেট ধরাই। এটা আমার পুরনো অভ্যাস। কোন কারণে বুকে একটু দুঃখ অনুভব হলেই আমি সিগারেট খাই। সিগারেট একেবারে পছন্দ নয় রূপার।
কত বার এ নিয়ে মান-অভিমান হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে- কিছুতেই কিছু হয়নি। সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার মনে হলো, কাজটা ঠিক হলো না। আজকের দিনে অন্তত নিকোটিনের গন্ধ গায়ে মেখে রূপার কাছে না গেলেই পারতাম। কিংবা রুহী যখন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পরবে, বাবা বলে ডেকে আমার গালে চুমু খাবে তখন সিগারেটের গন্ধটা ওর কাছে বিশ্রী লাগবে না? পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ধুর! এতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে- সবাই নিশ্চই আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরবে, আলাদা করে আমার গায়ের গন্ধ নিয়ে নয়।
এই এক বছর আমি কোথায় ছিলাম, কেন ছিলাম, কেমন ছিলাম, কেন কেউ আমার কোন খোঁজ পায়নি- সেসব যখন আমি বাসায় গিয়ে সবার কাছে বলব, নিশ্চই সেসব শুনে এবং আমাকে ফিরে আবার অশেষ আনন্দে সবাই হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। দিক। আজ আমি আর রাগবো না। ঐ কান্না তো আমাকে ভালোবেসেই বাড়বে। প্রত্যেককে বুকে চেপে সেই কান্নায় আমি নিজেও বিলীন হয়ে যাব। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার আবার চোখে পানি এসে যেতে থাকে। কি আশ্চর্য! আজ আমি নিজেই কাঁদছি নাকি!
২
সদর দরজায় ছিটকিনি খোলা। আমি নির্দ্বিধায় বাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম। কোন সঙ্কোচ নেই আমার, বরং বুক ভরা উত্তেজনার বারুদ। এটা আমার নিজের বাড়ি! বাড়ি জুড়ে কোথাও কারো কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সবাইকে চমকে দেব বলে আমিও কারো নাম ধরে ডাকব না ভাবলাম। বাসার চারটা রুমের তিনটার দরজাই হা করে খোলা। একটা ঘরের দরজা শুধু অল্প করে ভেজানো। আমি সবগুলো খোলা রুম ঘুরে এলাম। নেই, কেউ নেই। মা, রুহী, রূপা সবাই গেল কোথায়! এমন হতে পারে মা আর তুলি রুহীকে নিয়ে পাশের বাসায় গেছে, কিংবা মোড়ের দোকানে। আর রূপা নিশ্চয়ই অন্য ঘরটিতে একটু ঘুমিয়েছে দুপুরে ভাত খেয়ে। দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়া ওর পুরনো অভ্যাস।
কী করতে হবে আমি এক মূহুর্ত ভেবে নিলাম। প্রথমে দরজাটা খুলতে হবে নিঃশব্দে যেন তার ঘুম ভেঙে না যায়। তারপর ওর কপাল ছুঁয়ে আলতো স্বরে ডেকে ওর ঘুম ভাঙাতে হবে। ঘুম ভেঙে তাকিয়েই যখন সে আমায় দেখবে, কেমন হবে তখন? নিশ্চই তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হতে চাইবে না। হুড়মুড় করে উঠে বসবে বিছানায়। তারপর হাউমাউ করে বুকে ঝাঁপিয়ে পরবে? আমি তাকে বুকে ধরে রাখব শক্ত করে। আদর করে চুমু খাব তার কপালে। উত্তেজনায় আমার ঘাম হতে থাকে!
খুব সাবধানে আমি দরজাটা খুললাম। আমার সামনে অনন্য সুন্দর এক দৃশ্য ফুটে উঠল। ঘরের ভেতর অল্প আলো। একটু করে খুলে রাখা জানালার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে শুয়ে আছে বিছানার মাঝামাঝি। হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে প্রায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রূপা। তবু এই অল্প আলোতেই আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি। রূপা ঘুমুচ্ছে। তার আঁচল খসে পড়েছে বিছানায়। নাভীতে এসে মিশেছে অপরাহ্নের আলো। সেই আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভালো করে আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি রূপার দিকে হাঁটি। কাছাকাছি যেয়ে রূপার মুখের দিকে তাকাতেই আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। ভয়াবহ বিষ্ময় এবং দুঃখ নিয়ে আমি দেখতে পাই রূপার গলাটা জবাই করা! আমার নিজের গলা শুকিয়ে আসতে থাকে। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে থাকে আমার। আমি রূপার পাশে বসি। তার মাথাটা কোলে তুলে নিই। তারপর হাত রাখি তার গালে এবং চিবুকে। আমার আঙ্গুলে রুপার রক্ত লেগে যায়। আমি স্পষ্টত অনুভব করি, সেটা এখনো উষ্ণ। সারা ঘরে আমি কোন আয়না দেখতে পাইনা। ঘরে কোন আয়না থাকলে, আমার ঠোঁটের কোণে কোন হাসি ফুটে উঠেছে কিনা- হয়তো আমি তা দেখতে পেতাম!
নিশ্চুপ এসে দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মা হঠাৎ আমাকে ডাকেন- খোকা! এতদিন পর আমাকে দেখে তার কন্ঠে ঘোরলাগা বিস্ময়। মা আবার বলেন, “খোকা তুই!” প্রায় সাথে সাথেই ঘরের প্রতি ইঞ্চি থেকে আমার স্মৃতির আয়না ঝুরঝুর করে ভেঙে পরতে থাকে। মূহুর্তেই আমি ফিরে আসি ভাবনা থেকে বান্তবে। আমি বিছানায় বসে থাকা নিজেকে আবিস্কার করি সম্পূর্ণ একা। রূপা নামের কেউ সেখানে নেই। আমি দরজায় দাঁড়ানো মায়ের দিকে তাকাই। জল ভরা চোখ নিয়ে তখনও তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
টাঙ্গাইল।
আনন্দ বেদনা....
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
আনন্দ বেদনা
মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম
দুপুরের প্রচন্ড রৌদ্রের তাপ এখনও খুব একটা কমেনি। বারবার ঘরে ঘরে বাইরে যাওয়া আসা করছে মাহমুদা। এখনও রান্নার কোনো গোছগাছ হয়নি। হাঁটু গেড়ে চুলার পারে বসে আছে খালিদ। বিলের থেকে পুটি, চিঙরি, দারকিনা সহ ইত্যাদি মাছ ধরে এনেছে সে। আর সাথে এনেছে কয়েকমুঠ কলমি শাক। সেগুলো-ই রান্নার জন্য তাড়াহুড়ো করছে মাহমুদা। আজ ত্রিশে রমজান। বেশ কয়েক বছর পর এবারের রোজা ত্রিশটা পূর্ণ হলো। কাল ঈদ। তবে পেটে অসুখের কারণে আজকের শেষ রোজাটা সম্পন্ন করতে পারেনি খালেদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু সকাল থেকে তেমন কিছুই খায়নি। এজন্য একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছে মাহমুদা।
পাকঘরের কোণা দিয়ে পুকুর পারে নুয়ে পরা লেবু গাছটায় অনেকটি ছোট ছোট লেবু ধরেছে। গরম গরম ভাত সাতে পুটি মাছ দিয়ে কলমিশাক আর কচি কাগজি লেবু। এভাবে খাবারের স্বাদ কল্পনা করতে করতে মুচকি হাসে খালেদ। এমনিতেই কড়া রোদ তার উপর চুলার গরম, নেয়ে ঘেমে খারাপ অবস্থা হলেও খালেদের এমন শিশুসুলভ হাসি চোখ এড়ায়না মাহমুদার। ভিতরটা কেঁপে উঠে যেন। দারিদ্রতার কাঠখড় পোড়ানো কত কষ্টের সংসার। অভাব অনাটন আর অসুখ বিসুখ তো লেগেই থাকে একটার পর একটা। তবুও এই সাদাসিধা মানুষটার সহজসরল হাসির জন্য সব মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় মাহমুদা। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হতে চেলেছে। এখনও যেন মানুষটাকে দেখে তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। পরিশ্রমী, কঠর অথচ কত বিনয়ী আর উধার চিত্তের অধিকারী। একদমই সহজসরল। হিংসা বিদ্বেষ তো দূরে থাক। সামান্য তম খারাপত্ব যেন তার ভিতরে নেই।
মাহমুদা জিগ্যেস করে; কার কথা ভাবতাছেন মুখ বাকিয়ে? সংবিৎ ফিরে পায় খালেদ। বেচারা একটু লজ্জাও পেলো বোধ হয়। একগাল হেসে উত্তর দেয়; আরে না, তেমন কিছু না। বলেই উঠে ঘরে চলে যায় সে। ঘরে চৌকিতে ঘুমিয়ে আছে ফাহাদ। বয়স চার বছর। খালেদ ও মাহমুদা দম্পতির এক মাত্র সন্তান। খালেদ তাকায় তার দিকে। কি সুন্দর ফুটফুটে একটি মানব শিশু। শিশুদের মাঝে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। পৃথিবীর সব শিশুরাই সুন্দর। কপালে হালকা ঘাম জমে আছে। হাত পাখা নিয়ে ছেলের পাশেই শুয়ে পরে খালেদ।
বিকেলে অনেক জোরাজোরি করার পরও খালেদ কিছুই খায়নি। রোজা রাখেনি বলেই যে খেতে হবে এরকম তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া এইটুকু সময় না খেয়ে থাকা কোনো ব্যাপারই না। খালেদ আক্ষরিক অর্থে গরিব। সহায় সম্পত্তি তেমন কিছু নেই। তবে সে ভীষণ আত্মমর্যাদাশীল, ধার্মিক। মাগরিবের আজান হয়। স্বামী স্ত্রী এক সাথে ইফতার করে। কাল ঈদ। ভীষণ আনন্দের দিন। খালেদ তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে- বাজার থেকে কি কি আনতে হবে। এক এক করে প্রয়োজনীয় সব কিছুর কথা বলে মাহমুদা। এবং কড়া সতর্ক করে দেয় সে যেন, তার জন্য যেন কোনো কিছুই না আনে। আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ নেই। কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। গতবছরের ঈদের কাপড়-ই এখনো পরা হয়নি। যেমনটা তেমনই পরে আছে ট্রাংকে। তাছাড়া ইদানীং আয় রোজগারও খুব একটা ভালো না। ধানের দাম কম ছিলো। আর হঠাৎই মহাজনের আড়তে আগুন লেগে সব পুড়ে যায়। সব মিলিয়ে অবস্থা খুবই শোচনীয় বলা যায়। ঘর থেকে বের হয় খালেদ। পিছন পিছন ছুটে যায় মাহমুদা। আর শোনেন; ছেলেটার জামা আনতে কিন্তু ভূইলেন না। রাত যত হয় হোক জামা না নিয়ে ফিরবেন না কিন্তু। চিৎকার দেয় মাহমুদা। কালকে ঈদ। সেই কবে জামা বানাতে দেয়া হয়েছে টেইলার্সে। দেয়ার কথা ছিলো আরও দুইদিন আগেই। ঈদের সময়ে টেইলার্সের এই এক সমস্যা। ঠিক মতো কাপড় বানিয়ে দেয় না। আজ না কাল, কাল না পরশু এমন করতেই থাকে। কে জানে আজকেও দেয় কি না।
ঠিক যেমনটা ধারণা করা হয়েছিলো। জামা এখনও সেলাই করা-ই হয়নি। সেদিন গভীর রাত করে বাড়ি ফেরে খালেদ। টেইলার্সের দোকানে বসে ছিলো। বসে থেকে একটা জামা আর প্যান্ট বানিয়ে এনেছে। কাল ঈদ। খালেদ মাহমুদা কেউ নতুন জামা নেয়নি। শুধু ছেলেটার জন্যই এই জামা কাপড়। বাচ্চা মানুষ। ওর জন্য না হলে কি আর চলে। বাড়িতে আসতে আসতে ছোট বেলার কথা ভাবে খালেদ। তাদের অভাব অনাটনের সংসার। তার উপর সেবছর বন্যায় একটা গরু মারা গেছে। পরিবারে সদস্য সংখ্যাও বেশি। সবার জন্য নতুন জামা কাপড় বানাতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা তো বাবার কাছে নেই। যে কোনো কারণেই হোক জামা বানানো হয়নি খালেদের জন্য। ঈদের দিন সব বাচ্চারা নতুন কাপড় পরেছে। তা দেখে সে কি কান্না খালেদের। মনে পরলে এখনও হাসি পায়। বাড়িতে এসে এরকম আরও অনেক স্মৃতি স্মরণ করতে করতে ঘুমিয়ে পরে খালেদ।
আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। ভালো ভাবে গোসল করে পরিস্কার কাপড় পরে খালেদ। মাথায় চিরুনি দিতে দিতে তাকিয়ে থাকে ছোট ছেলেটার দিকে। মাহমুদা তাকে ধরে নিয়ে গেছে কলতলায়। তারপর সেখানে বসিয়ে ভালো ভাবে সাবান দিয়ে গোসল কারাচ্ছে মাহমুদা। ছেলেটা আজ একটুও কাঁদছে না। অন্য দিন হলে হয়তো কাঁদতো। ঈদের আনন্দের নিচে চাপা পরে গেছে তার এই সামান্য পরিচ্ছন্নতার কষ্ট। অতঃপর গোসল শেষে ঘরে এনে নতুন কাপড় পরায় ফাহাদকে। খালেদ হাসি হাসি মুখে প্রিয়তমা স্ত্রীকে সালাম দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা পুত্রের এমন আনন্দ যাত্রা দেখে চোখে পানি এসে যায় মাহমুদার। আঁচল দিয়ে মুছে নেয় কয়েকবার। এই জীবনে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। ছোটবেলায় এক্সিডেন্টে বাবা মায়ের একত্রে মৃত্যুর পর সে ভূলেই গিয়েছিলো আনন্দ কি। আজ তার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা আসলেই বড্ড সুন্দর, ভীষণ আনন্দের। অন্ততঃ এই দু’টো মানুষের জন্য হলেও সে বেঁচে থাকতে চায় দীর্ঘকাল।
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
পদাবলি
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে
রুদ্র সাহাদাৎ
খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আর শেষ নিঃশ্বাসে কাঁদে আদমজীবন
তওবা তওবা বলছে মুখ,এখন স্বীকার করতেই হয় বাস্তবতা,
রাত্রির কালো ছায়া,
কালো রাত্রির মায়া
এতো হিসেবনিকেশ এতো এতো কাজ স্বার্থহীন নয় কিছু, স্বার্থের অন্তরালে আরও স্বার্থ
শেষ প্রান্তে শেষ কথা - লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
দাগ নেই, অভিশাপ
অলোক আচার্য
হাতের আঙুল কেটে রক্ত পরছে
এক ফোঁটা
দুই ফোঁটা
অজ¯্র ফোঁটা
আশ্চর্য! নিচে কোনো রক্তের দাগ নেই
সেখানে অভিশাপ, ধ্বংসের-ক্লান্তির।
একটা চুমুর অভাব
রফিকুল নাজিম
একটা চুমুর আয়ূ থাকে বড়জোর মিনিট পাঁচেক
নিউরন কেন্দ্রের উত্তেজনার পারদও নিম্নমুখী হয়
ক্লান্তি নামে চোখের পাতায়; আলস্যের ধূলো জমে
গাণিতিক ছাঁচে গল্পেরও সীমারেখা থাকে সুনির্দিষ্ট।
বিছানার চাদর রাতকে সহনশীলতার গল্প শোনায়
কল্পনায়-আবছায়ায় তোমাকে আধেক পাই; অথবা পাইনা
হাতে পাই তো বুকে পাইনা, চোখে পাই তো ঠোঁটে পাইনা
ঠোঁটে পেলেও আরো অনেক কিছুই থেকে যায় অসমাপ্ত!
তারপর সারাদিন আমি শুদ্ধ সূত্রে যাপিত জীবনের অংক কষি,
অথচ ভেতরে ভেতর আমি একটা চুমুর অভাবে প্রায়শ’ই মরি!
গাব গাছে ভবিষ্যৎ বক্তা
মিসির হাছনাইন
দূর গ্রামে বসে আজিজুল খনকার
গাছের সাথে করল মানুষের বাণটানা,
কুফুরী কালাম লিখে শেষবার
পানিতে ভাসায় অতীত অভিশাপ।
তারপর থেকে বাড়ির পাশের
গাব গাছটায় পাখি বসে না,
কি এক ভবিষৎ তাতে ভর করেছে,
কেউ তাকে দেখছে না, কেউ আর-
ভাবছে না। তবুও, স্বার্থপর কেউ ভালো নেই
অদেখা ফুলের লোভে খুঁজছে জীবনের মানে।
আরো কত ভালো থাকায় উড়ে গেল
বাদুড়ের কান্না, ফেলে আসা স্মৃতিপ্রেম,
নষ্ট জীবনের লেনদেন, অতিরিক্ত আহ্লাদ,
ক্ষমা চাওয়া করুণ মুখের অসহায় চাহনি,
হৃদয়ের সব অপরাধ তুলে নিয়েছে গাছটি
এক ঘোর অমাবস্যার সন্ধ্যায়
কি এক ভবিষ্যৎ তাতে ভর করেছে
গাব গাছটার মৃত্যু হলে-
এই মানুষটাও জীবন্মৃত শুধু হাসে আর কাঁদে।
একটি চারাগাছ
মনোজ চৌধুরী
ক্ষুধার্ত পাখির মতো-
একটি চারাগাছ সালোকসংশ্লেষ ভিক্ষে চাইছে
অধীনতা দেশ ও নারীর মতো নয়
মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইছে গনগনে আগুনের মতো ভিড়ে
বাঁচতে চাইছে...
মাটির হাত পা ধরে
পাতাঘরের অকথ্য ধ্বনির উপর বারবার আঘাত চিহ্ন
আগামীর সাইরেন সূচিত করে যায়...
এক যূথবদ্ধ ক্যাকটাস
একটি চারাগাছ নগ্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে- পড়ে থাকলো
আর্তনাদ করতে করতে।
কোন জেলে পাঠাবে
ফাহিম আহমদ ছামি
তারপর, আমাকে জেলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো-
কিন্তু কোন জেলে? তাদের মাঝে দ্বন্দ বেধে গেলো!
আমি সীমাহীন মামলার এক আসামী; রায়ের উর্ধ্বে
ছুটেছি রাজপথে, জয় করে ভয় উঠেছি গর্জে
সত্যের নেশায় মিথ্যাকে চুরমার, তোয়াক্কা না করা-
নির্ভয়ে উড়েছি, ছুড়েছি; তবু দেইনি ধরা।
আমাকে শাস্তি দিতে নতুন বিধান লিখতে হবে
বিচারক; হাতে কলম ধরা আগে শিখতে হবে-
আমি জালেমের গৃহ পোড়া ছাইয়ে মেজেছি দাঁত,
সোনার গুদাম ভেঙ্গে- গরিব খাবে তাই এনেছি ভাত
প্রণামের বদলে লাল চোখ ছিলো ধূর্তের আতঙ্ক
যুদ্ধের জন্য ভরেছি গর্ত, খুড়েছি সুড়ঙ্গ।
এবারে আমাকে ফাসি দাও, নয় ফেলে দাও গর্দান
মরে যাবো আমি; অমর হয়ে থেকে যাবে প্রাণ!
ছায়া ছাড়া চলা দায়
নাহিদ্র ইমন
শৈশবে কৈশোরে বাবাদের ভালো লাগে
এর বাদে বয়সের নাদানিতে কাল লাগে
কিছুদিন যেতে যেতে বট ছায়া খুঁজে ফিরে
গ্লানিমাখা পুত্রেরা আসে ফের বাপ-নীড়ে
বুঝে যায় বাপ ছাড়া, ছায়া ছাড়া চলা দায়
বাবাদের ভরসায় ছেলে সব, সব পায়।
জোনাকি বা জোছনা
মাসুদ পারভেজ
স্তব্ধ সময়
নিরুত্তের জানালায় হাজারো প্রশ্নের হাওয়া,
শুধু আমার নির্বাক চেয়ে থাকা;
নিথর নির্জীব এক কাগুজে হৃদয়, যার কবিতা ছাড়া কিছুই নেই
তবুও ঐ বেহায়া চাঁদ হেসে যায়- কারে বুঝাই এই অবসাদ!
ধীরে ধীরে হেঁটে যে পথ জীবনকে দিয়েছে রঙ- কিভাবে ভুলে যাই, ভুল করি বিভ্রম বেহাত আলোয়;
কিভাবে বলি আকুলতার প্রখর প্রার্থনা তোমার পায়ের নূপুর হয়ে রয়, কীভাবে বুঝাই!
তুমি জানো না, যে জীবন কান্না দিয়ে লেখা সে রঙধনুতে হাত বাড়ালেও বৃষ্টি ঝরে।
এই যে আমাদের ছোট ছোট ঢেউ বুকের জমিন না ছুঁয়ে চোখের কিনারে ভীড় করে
এই যে মুহূর্ত গুলো যাচ্ছে আমাদের অন্তরের চেনা জানা কিন্তু অনন্ত দূরত্বের
ভালোবাসা সে তো কান্নার প্রতিশব্দ
সুখ সে বাস করে দুঃখের বিরান ভিটায়
সম্পর্ক সেটা নিবিড় হয় অশ্রুর জলরাশিতে
অশ্রুর ফোঁটায় ফোঁটায় তোমার ছবি বুকের ভাজে ভাজে মেঘের মত চর হয়ে যায়,
দেখো একদিন আমাদের উঠোনে অনেক বৃষ্টি হবে অনেক!
আরো বারো বছর পরে,
যখন কান্নার রঙ বদলে যাবে, যখন স্বপ্নের অবশিষ্ট বলতে কিছুই থাকবে না
আমি সেদিনও বলব জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি তুমি;
তুমিও বলতে পারবে তোমার সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি- সেটা আমি।
স্মৃতি বন্ধি অতীত
মাঈনুদ্দিন মাহমুদ
পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট কুঠিরে
স্মৃতি বন্ধি অতীত,
হেঁটে যায় কিশোর বেলার সোনালী বিকেল।
ইচ্ছে করে
কাঁদা মাখা উদোম গায়-
আরো একবার ফিরে যেতে বাঘমারা গাঁয়।
আজও অমলিন ফেলে আসা দিন
দুপুরের সোনা ঝরা রোদ
ডেকে নিয়ে যায় স্মৃতি ঘেরা গাঁয়
মনটা যে মানে না প্রবোধ।
হিম ঘরনার কবিতা
শেখ একেএম জাকারিয়া
এখনও হিম পড়েনি পৌষের মতো
তবু হেমন্তে লিখা হয় হিম ঘরনার কবিতা
এই হেমন্তে ধুলোবালির পথে,
এখনও শিশির-কুয়াশায় স্যাঁতসেতে হয়ে উঠেনি
কখনো-সখনো শিশিরবৃষ্টি ছুঁয়ে দেয় ঘাসের সবুজ শরীর
লঘু কুজ্ঝটিকার প্রাতে সহসা দেখা মিলে
পিয়াইন নদে, ডুবে আর ভাসে একঝাঁক পানকৌড়ি
নরম ঢেউের বুকে কুয়াশার কু-লী ভাসে
গরম জলের ধোঁয়া দেখি হাওয়ার বুকে উড়ে
সূর্যের আলো চুপিচুপি ঢেকে দেয় কুহেলিকা
¤্রয়িমাণ আলোর ঝলকে মাকড়সার ঝাল
কেঁপে ওঠে পৌষের হিম আসার সংবাদে
বিমর্ষ চোখে হেমন্ত বসে থাকে নদীর তীরে
কুজ্ঝটিকার বুক চিঁড়ে একটু রোদের অপেক্ষায়
যদি এই হেমন্তে সুখের দেখা মিলে।
আমি রয়ে যাব
ইউনুছ ইবনে জয়নাল
আমি রবে যাব-
এখানে অবারিত মাঠে,
পাড়ার সাথিদের নিয়ে দুরন্তপনায়
মেতে উঠব বাংলার স্থলে জলে ঘাটে।
তোমাদের যেখানে খুশি- চলে যাও
ফিরে ফিরে ডেকো না আমায়,
না, টেনো না আমায় জামা ধরে, জেনো
আমার মাতৃকোল এখানে এ বাংলায়!
আমি প্রথম কাঁন্না কেঁদেছি এ মাটির পরশে
শৈশব থেকে পৌড় ছুটেছি এ পথে ভাই,
আজ অন্তিম তরী ভিড়িয়ে এ ক্ষিতির পরশেই
মাতৃকোল সম চির নিদ্রায় নয়ন মুদিতে চাই।
তোমাদের যেখানে খুশি- চলে যাও
অগ্নিগর্ভ নেত্রে অন্বেষণে দিক বেদিক,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত সূর্যদগ্ধ হতে চাই না আমি
বাংলায় আমার প্রাণ জুড়ায়, মাতৃভূমি ঠিক।
আহা! অমৃত স্বাদ, স্বপ্নের বনুন জীবনানুভূতি
এর প্রতি হৃদে জাগে সতত হাজারো আকূতি,
প্রাণের স্পন্ধন প্রেমের সঞ্চালন নাড়ীর গতি
কুলে ক্ষণে মানবাগমন মমতায় গাঁথা মতি।
আমি রয়ে যাবো-
এখানে অবারিত মাঠে একেলা,
হৃদয় চিরে চিরে দেখাতে পারি, দেখ
আমি ঢের ভালবাসি আমার জন্মভূমি বাংলা।
স্মৃতিতে আল মাহমুদ
স্মৃতিতে আল মাহমুদ
তাজওয়ার মুনির
‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র আল মাহমুদ এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে মহান রবের দরবারে পাড়ি জমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল এই কবি। লম্বা সময় ধরে অসুস্থ থাকা এ কবির জন্য সাহিত্যপ্রেমীদের সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটে ফাল্গুনের তৃতীয় রাতে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
সাল ১৯৩৬। জুলাই মাসের ১১ তারিখ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইলের মোল্লাবাড়িতে ভূমিষ্ঠ হোন একটি শিশু। যাকে পরবর্তীতে আমরা আল মাহমুদ নামে চিনি । যার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তাঁর পিতার নাম আব্দুর রব মীর ও মাতার নাম রৌশন আরা মীর। তাঁর দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা, যিনি হবিগঞ্জ জেলার জমিদার ছিলেন।
আল মাহমুদ কুমিল্লার দাউদকান্দির সাধনা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকু- উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তার লেখালেখি শুরু।
বিচিত্র কবি-জীবনের সূত্রপাতঃ
বৈচিত্র্যময় তাঁর জীবন। কখনো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন, কখনো প্রুফ রিডার ছিলেন, কখনো কবিতা লিখে গেছেন নিরন্তর। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, স্বাধীনতার পর জেল খেটেছেন। এরপর নিয়োগ পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমিতে। এক জীবনে বহু জীবনের স্বাদ নিয়েছেন এ কবি।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকায় আসেন। তখন থেকেই তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। কবি ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা করে একের পর এক সাফল্য লাভ করতে থাকেন। সে নিজেই বর্ণনা করেছেন সে অভিজ্ঞতা। দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ইমরান মাহফুজ এর নেয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্রাম থেকে শহরে আসা নিয়ে কবি বলেন- “আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পায়জামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল, বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ। যেমন, জাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। আমার ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনো কখনো হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আমি এখনো এই শহরেই আছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ। আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের সৌভাগ্য হয়নি। এই মহানগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারণ করেন না।”
কবি হওয়ার আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ছন্দ-অন্ত্যমিলের এই রাজাকে।
কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লিখতে থাকেন। পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নেন। পরে ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দৈনিক গণকণ্ঠ প্রকাশিত হয় তারই সম্পাদনায়। এ সময় এক বছরের জন্য কারাবন্দি থাকতে হয় তাকে।
আল মাহমুদের প্রথম বই ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এই কাব্যগ্রন্থ সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। দ্বিতীয় বই ‘কালের কলস’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। এ দুটি কবিতার বইয়ের জন্য তিনি ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। মুক্তিযুদ্ধের পর গল্প লেখায় মনোযোগী হন আল মাহমুদ। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্পের বই ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। পরে তিনি পরিচালক হন। ১৯৯৩ সালে তিনি অবসর নেন।
সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ এবং কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘ময়ূখ’, ‘কৃত্তিবাস’ ও ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা ও কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ তার আত্মজীবনী গ্রন্থ। ছড়া রচনাতেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- সবকিছুই তার ছড়ায় উঠে এসেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঢেউ তুলছে।
স্বকীয়তা:
আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ অনন্য এক জগৎ তৈরি করেন। সেই জগৎ যন্ত্রণাময় শহরজীবন নিয়ে নয়, স্নিগ্ধ-শ্যামল ও শান্ত গ্রামীণ জীবন নিয়ে। গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির চিরায়ত রূপ নিজস্ব কাব্যভাষা ও সংগঠনে শিল্পিত করে তোলেন কবি আল মাহমুদ।
তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদী নির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। বলা যায়, আল মাহমুদ ছিলেন যৌবন ও প্রেমের কবি।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।
কবি তাঁর কবিতায় যে মৌলিকত্ব, ক্ষমতা ও শক্তির সাথে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের লোকসত্ত্বাকে ধারন করেছেন, তা আর কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব হয় নি। আধুনিক বাংলা সাহিত্য কলকাতার বাংলা ভাষার ধার করে আনা ছাঁচ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পূর্ববঙ্গীয় যে চেহারা ধারণ করেছে, তার পেছনে আল মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য । পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছিলেন, “বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেনি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।”
১৯৯০-এর দশক থেকে তাঁর কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এজন্য তিনি তথাকথিত প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাঁর লেখায়। ফলে এক শ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী মহল তাঁর সমালোচনায় মেতে ওঠে। ইসলামি রাজনীতির দিকেও কবি কিছুটা ঝুঁকে পড়েন। ফলে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে সেদিকে কবির ভ্রƒক্ষেপ ছিল না। তিনি আপন জগতে সমানতালে চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞ। কবি অবজ্ঞাভরে বলেছিলেন, “দাড়ি রাখলে আর ধর্মভীরু হলেই যদি কেউ মৌলবাদী হয়; তবে অবশ্যই আমি মৌলবাদী!”
অবহেলিত কিংবদন্তীঃ
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তাকে একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একেবারে নেপথ্যের কয়েকজন মানুষের কথা যদি বলতে হয়, তবে তাদের ভেতর সাংস্কৃতিক পরিরুলে আল মাহমুদের নাম রাখতেই হবে।
তবে তারপরেও এই কবি যেন কিছুটা অবহেলিত! কবির প্রাপ্য সম্মানের অনেকটাই হয়তো তিনি পান নি; অন্তত কবির ধারণা এমনই।
তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থে তিনি বারবার এই কথাটাই বলেছেন।
‘তোমরা আমাকে বোঝোনি। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকবো না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস।”
সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবে আল মাহমুদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, জয় বাংলা পুরস্কার, হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার, কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদকসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
পরিশেষঃ
কবিদের কি আসলেই মৃত্যু হয়? সেটা কীভাবে সম্ভব? তাদের কথামালা তাদের অমর করে রাখার গুরুভার তুলে নেয় কাঁধের ওপর!
কবি আল মাহমুদ। একটি নাম, একটি ইতিহাস! আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে! সোনালি কাবিন, লোক-লোকান্তর, বখতিয়ারের ঘোড়া, কালের কলস, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, পাখির কাছে ফুলের কাছে, কাবিলের বোনের মাধ্যমে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিবেন অনন্তকাল। কোটি কোটি সাহিত্যপ্রেমীদের ভিড়ে এখনো তিনি স্বমহিমায় বিরাজমান। সফেদ কাগজে কৃষ্ণ অক্ষরে এখনো তিনি সোনার নোলক খুঁজে ফেরেন সারা বাংলাদেশে।
‘আমি চলে গেলে এ পারে আঁধারে কেউ থাকবেনা আর;
সব ভেসে গেছে এবার তবে কি ভাসাবো অন্ধকার?
আলো-আঁধারির এই খেলা তবে আমাকে নিয়েই শেষ
আমার শরীর কাঁপছে যেমন কাঁপছে বাংলাদেশ।’
-আল মাহমুদ
আল মাহমুদ কখনোই মৃত্যু বরণ করবেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্ত কাল। যতদিন বাংলা থাকবে। যতদিন বাংলায় কথা বলার মানুষ থাকবে।
আমাদের মাঝে চিরজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ।
উত্তর মৌড়া, দোহার, ঢাকা-১৩৩২