ধারাবাহিক উপন্যাস- কিস্তি ০৬

ধারাবাহিক উপন্যাস- কিস্তি ০৬





গল্পটি শুনতে চেয়ো না
সোহেল নওরোজ

নাহিদের বদলে যাওয়া একরৈখিক ছিল না। নিজের অজান্তেই সে অন্য কারো বদলে যাওয়ার প্রভাবক হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে আরেকজনের জীবনের গতিও বাঁক নিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে নিরানন্দ দিন কাটিয়ে অভ্যস্ত তাহিয়া যেন তার উপস্থিতিতে জীবনকে ভিন্ন ভাবে দেখার সুযোগ আর উপলক্ষ্য পেয়েছিল! যেখানে সাদা-কালোর ছোপ ছোপ রঙের আধিক্য নয়, বরং হরেক রঙের মাখামাখি। লাল, সবুজ, বেগুনি...
হাফিজুল হকের হাতের ছবিটি তাহিয়ার। ছবিতে তার মুখ হাসিহাসি। ছবিতে কেবল একটা অবয়ব নয়, তিনি ওই সময়টাকেও ধরতে চেয়েছিলেন। মায়াবী সময়। তা কতটা পেরেছেন অনাগত সময়ই বলে দেবে। অর্পা এ ছবিটার ব্যাপারে কখনোই মুখ খোলেনি। যেন সিদ্ধান্ত দেওয়ার ইচ্ছা বা অধিকার তার নেই। লেখককেই গুরুত্বের বিচারে নির্মাণ করতে হবে নিজের মতো করে। তিনি তাহিয়ার মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এমন কারো সঙ্গে কি তার কখনো পরিচয় ঘটেছে? ঠিক মনে করতে পারছেন না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতন মনের স্মৃতিগুলো ঝাপসা হতে শুরু করেছে। মানুষ চাইলেই কিছু বিষয় এড়াতে পারে না, অস্বীকার করতে পারে না তার প্রভাব। বয়স সে বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।

তখন আকাশে ওড়ার বয়স পার করছে নাহিদ আর তাহিয়া। স্কুল থেকে ফিরে তারা একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। কাছেই একটা নদী। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিটের পথ। তারা অর্ধেক সময়ে পৌঁছে যায়। তাহিয়ার ভাষায় এটাকে বলেÑ প্রজাপতিছুট। ঠিক হাঁটাও নয়, আবার দৌঁড়ও নয়। সে আগে আগে চলবে, তার পিছু পিছু নাহিদ। তাল-লয় একই থাকবে। দূরত্ব সারসাম্যপূর্ণ। কেউ কাউকে ছুঁতে পারবে না। তবে তারা দুজনেই প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেয়, কিংবা প্রকৃতি তাদেরকে। শরতে কাশফুল, বর্ষায় কূল উপচানো টলমলে জল, গ্রীষ্মে মন উচাটন করে দেওয়া মাতাল হাওয়াÑ এ সব তারা তরিয়ে উপভোগ করে। কোনো মানা নেই, নিয়মনীতির বালাই নেই। ঠিক সন্ধ্যায় আগে ফিরে এলেই হয়। এরপর আর কোনো কাজ নেই। কেবল পড়াশোনা। তাতে দুজনের কেউ তাতে অবহেলা করত না। তাহিয়ার পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় আয়ত্ত করতে নাহিদ সাহায্য করত। যে কোনো বিষয় সহজে বোঝাতে পারা এবং বুঝতে পারার দ্বিমুখী ক্ষমতার কারণে পাঠ্যবইও তাদের কাছে আনন্দের জগত হয়ে উঠত। তাতে কবিতা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। সারাদিন গানের স্কুল, টিউশনির ধকল সামলে বাড়ি ফিরে স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত থাকত। এ সময় ওদের পড়াশোনার তদারকি করা বেশিরভাগ সময় সম্ভব হতো না। নাহিদ থাকায় বিরাট চিন্তার হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে। হুট করে খেই হারিয়ে ফেলা কবিতার জন্য এমন নির্ভরতা পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।

এসএসসি পরীক্ষার আগের রাত। নাহিদ অনিকেতের চিঠি নিয়ে বসেছে। যখনই বড় কোনো উপলক্ষ্য হাজির হয়, নাহিদ চিঠিটা কয়েকবার পড়ে। অন্যরকম এক শক্তি আছে চিঠিটার মধ্যে। তাকে নতুন করে জাগিয়ে দেয়। লক্ষ্যটাকে সামনে নিয়ে আসে। কতদিন অনিকেতের সঙ্গে দেখা হয় না! সে কোথায় আছে কে জানে! অনিকেতও কি কাল তার মতো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি পড়াশোনা বাদ দিয়ে পথে পথে ঘুরছে? সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। সব প্রশ্নের শতভাগ উত্তর মেলে না। নিয়তির হাতে তোলা থাকে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় জানালা খুলে যায়। বাইরে শুনশান বাতাস। আকাশে আস্ত একটা চাঁদ দখল নিয়েছে। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। যেন দূরে কেউ চাঁদের লাইট হাতে ঘরটাকে তাক করে বসে আছে। নাহিদ মুগ্ধ চোখে চাঁদটাকে দেখছে। এমন চাঁদ অনেকদিন দেখা হয় না। যখন অনিকেতের সঙ্গে মিলে এতিমখানা থেকে পালাত, তখনকার রাতে প্রায়ই এমন চাঁদ উঠত। তারা তরিয়ে সে জোছনারাত উপভোগ করত। চাঁদ আর অনিকেত কে বেশি রহস্যময়? হয়তো চাঁদ, হয়তো অনিকেতÑ নাহিদ তার কিছুই জানে না।

পরীক্ষার পর হঠাৎ করেই নাহিদের ভেতরে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। হঠাৎ করেই কিছু একটা করার জন্য মন উতলা হয়। এ বাড়ির প্রতি, এ বাড়ির দুজন মানুষের কাছে তার অশেষ ঋণ। তবু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাটুকু সে করতে চায়। সে চেষ্টার জন্য যে ভিত্তি দরকার তা এখান থেকেই গড়ে নিয়েছে। সামনের পথ কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারলে সেটাই সবচেয়ে হিতকর হবে। তাতে গর্ব করে বলার মতো অনেক অনুসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যাবে।
নাহিদ কবিতা বা তাহিয়া কাউকেই বিষয়টা বুঝতে দেয় না। ভালো কোনো কলেজে পড়ার ইচ্ছার কথা কবিতাকে জানায়। সে না করতে পারে না। মন সায় না দিলেও তার ইচ্ছার ওপর কথা বলা যায় না। তাহিয়া ঠিক তার উল্টো। নাহিদ সরাসরি বলে দেয় অমতের কথা। এতদিন বাদে তার সমস্যা জেগে ওঠা স্বাভাবিক কিছু নাÑ তাহিয়ার কথায় শ্লেষ থাকে, মায়া থাকে, অভিমান থাকে। নাহিদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবু মনের বিরুদ্ধে সে আসন গাড়তে চায় না। এটা বেশ বুঝতে পারে, এ পরিবার ছেড়ে একেবারে দূরে সরে যাওয়া তার পক্ষেও সম্ভব নয়। কাজটা করতে হবে ধীরে ধীরে। তিনটা মনের ওপর একসঙ্গে আঘাত না দিয়ে। তবু এ কাজে তাকে সফল হতে হবে। দূরে সরে যেতে হবে। একই মায়া বেশিদিন লালন করলে স্থায়ী হয়ে যায়। সে বলয় থেকে আর কখনোই বের হওয়া যায় না। চাইলেও না। বলয়বন্দী হওয়া মানুষেরা অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। ভেতরের শক্তি ক্রমশ ভোঁতা হয়ে পড়ে। কঠিন চ্যালেঞ্জ দেখলে পাশ কাটিয়ে যায়। সে তাদের মতো হবে না। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। একেক চ্যালেঞ্জ একেক রকম। সেগুলো সাফল্যের সঙ্গে পেরোতে হবে। তার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। অনিকেতই ঠিক করে দিয়েছিল সে লক্ষ্য। তাকে শুধু সেখানে পৌঁছাতে হবে, শুধু মাথাটা উঁচু করে।
                                                                                                                     (............ক্রমশ)

সাহিত্য সংবাদ

সাহিত্য সংবাদ





ভালবাসার গান কবিতা ও গল্পকথা’র 
মাসিক সাহিত্য আড্ডা অনুষ্ঠিত

গত ১৭ নভেম্বর শুক্রবার সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, পরিবাগ, ঢাকায় দেশের জনপ্রিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠন ‘ভালবাসার গান কবিতা ও গল্পকথা’ পরিবারের নিয়মিত আয়োজন মাসিক সাহিত্য আড্ডা বেগম সুফিয়া কামাল’র জীবন শীর্ষক উন্মুক্ত আলোচনা, কবিতা ও ছড়া পাঠ এবং সংগীত সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়।
ভালবাসার গান কবিতা ও গল্পকথা’র প্রধান সমন্বয়ক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহানের সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় পর্ষদের সদস্য আবু সাহেদ সরকারের সঞ্চালনায় ও কেন্দ্রীয় পর্ষদের পরিচালক মাসুদ পারভেজের সাংগঠনিক শুভেচ্ছা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও এম ফিল গবেষক মীম মিজান  বেগম সুফিয়া কামাল’র জীবন শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ছড়াকার সৈয়দ রোকন, বিশিষ্ট ছড়াকার, কবি ও সাংবাদিক আতিক হেলাল। অতিথিগণ বেগম সুফিয়া কামাল এবং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন।
উপস্থিত কবি লেখকদের মধ্যে কেন্দ্রীয় পর্ষদের পরিচালক কবি মাহবুবা লাকি, কেন্দ্রীয় সদস্য লুৎফর রহমান রবি, কেন্দ্রীয় সদস্য জাহিদ আল হাসান, ঢাকা বিভাগীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মনির ইসলাম, সমন্বয়ক কাজী এনামুল হক, কবি অভিলাষ অভি, কবি আবদুল কাদির, কবি শেখ বিপ্লব হোসেন, কবি সাহানা পারভীন, কবি মাসুদা আক্তার লিজা, শিশু আবৃত্তি শিল্পী তাসনিম মেহজাবীন মুমু, কবি ইখতিয়ার হুসাইন, কবি আই জামান চমক, কবি বশির আহমদ, কবি কবীর আনোয়ার, কবি শাহজাহান মোহাম্মদ, কবি সিয়ামুল হায়াত সৈকত, কবি মোঃ শরীফ উদ্দীন, কবি হোসাইন মোঃ মিরাজ, কবি সাগর, কবি ও বাচিক শিল্পী ফাতেমা সুলতানা সুমি, মীর হেলাল প্রমুখ।
উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবিগণ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এবং কবিতা পাঠ করেন। এছাড়াও উপস্থিত শিল্পীরা মনোরঞ্জন সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করেন।
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আমন্ত্রিত অতিথিদের হাতে সংগঠনের ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী ‘আমাদের গল্পকথা’ এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা তুলে দেন কেন্দ্রীয় পর্ষদের পরিচালক মাসুদ পারভেজ। উক্ত অনুষ্ঠানে কবি ও গল্পকার শেখ বিপ্লব হোসেনের গ্রল্পগ্রন্থ ‘পথ জানা নেই’ বই এর মোড়ক উন্মোচন করা হয় এবং সদ্য প্রকাশিত বই সম্পর্কে তিনি তার অনুভূতি প্রকাশ করেন।
পরিশেষে অনুষ্ঠানে আগত আমন্ত্রিত অতিথি সহ সবার কাছে কৃতজ্ঞ স্বীকার করে সমাপ্তি ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান।



                                                                                          মীম মিজান

গল্প- নীলচে ফড়িং

গল্প- নীলচে ফড়িং















নীলচে ফড়িং
সুজন সাজু 
 

রুমার আজকে কেন জানি অন্যরকম লাগছে। মনের ভিতর কে যেন তাড়া দিচ্ছে। কে আবার সেই? কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা খুলে। মা, টাও কেন জানি কিছু বললে পছন্দ মত উত্তর পেয়ে মনকে একটু হালকা করবে তেমন নই। আরো উল্টো বকাঝকা শুরু করে দেবে। এই ভয়ে নিজেকে একাকীত্বে আবদ্ধ রাখতেই সাচ্ছন্দ বোধ করে। মাকে যা কিছু বলে না কেন, উনার শাসন বার্তা হরহামেশা শুনেই থাকে রুমা। সেই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, আচ্ছা সব মা কি এমন হয়? আবার নিজেই উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে, আসলে সব মা-বাবাই চায় সন্তানের মঙ্গল কামনা। আরে বাবু, ভালো চায় তো বুঝলাম, তাই বলে কী বনের পশুর মত কাছা ঘরের মতো বন্দী থাকা? মেয়ে বলে কী স্বাধীনতা শব্দটা আমার ব্যবহারের উপযোগ্য নয়? এমন কত হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইয়ত্তা নেই। সবে মাত্র এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে রুমা। কখন পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে ? তারপর পাশ করলে, কলেজে ভক্তির পর বাইরের মুক্ত হাওয়ায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পাবে,এই ভরসায় প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে রুমা। বাবা পড়ানোর আগ্রহী হলেও মা কিন্তু বাবাকে না পড়ানোর উৎসাহটা দিতে কার্পণ্য করে না সবসময়। শেষ পর্যন্ত জানি না কে জয়ী হয়। মা জয়ী হলে তো আরো স্থায়ী সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রুমার। আর বাবা জয়ী হলে তো কথায় নেই। তবে রমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত বাবাই এগিয়ে থাকবে। কারণ বাবা যেটা ভালো মনে করে ওটা করতে পিছ পা হয়না। বাবার এ গুণটাই রুমাকে  আশান্বিত করছে। বাবার লেখাপড়ার চেয়ে মা’র বেশি, বেশি মানে মা এইচ এস সি শেষ করেছে। বাবা কিন্তু এস এস সি ও শেষ করেনি। তবুও মেয়েকে লেখাপড়ার দিকে ধ্যান ধারনার লক্ষণটা বাবারই বেশি। মাঝে মাঝে অন্য রকম প্রশ্ন জাগে রুমার মনে। মা, এতটুকু লেখাপড়া করলেও কেন তিনি মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করার আগ্রহী নয়? হতে পারে উনার শিক্ষা জীবনে কোন অপছন্দনীয় অনাকাক্সিক্ষতস্মৃতি জড়িয়ে আছে। হয়ত কোন আঘাতের ফল উনার ভিতর জমাট বেঁধে আছে। যেই আঘাত উনার মেয়েকে বিদ্ধ করতে না পারে, এমনটাই কাজ করছে মা’র ভিতর।মাকে এমন কিছু জিগ্যেস করার মত সাহস তৈরী হয়নি রুমার। শুধু এটি নীরব ভাবনা হয়ে দোলা দেয় রুমার হৃদয়ে। আর রুমা তো এমন কিছু করেনি যে, যার অপরাধে অপরাধী হিসাবে বিবেচনায় আনবে মা-বাবা। নিজে সবসময় পরিশুদ্ধ থাকতে চেষ্টা করেছে। অন্য বান্ধবীদের দেখেছে ছেলে বন্ধুদের সাথে ছুটির পর কত আনন্দ করে ঘুরে বেড়াই। নিজের ইচ্ছে হলেও সেদিকে কখনো পা বাড়ায়নি রুমা। সোজা ঘর আর স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিল স্কুল জীবনটা।তবুও মা’টা কী ভাবছে, বোধগম্য নয় রুমার কাছে। স্কুলের সহপাঠি শুভ নামের এক বন্ধুকে ভীষণ ভালো লাগে রুমার। কিন্তু এই ভালো লাগাটা কখনো প্রকাশ করেনি রুমা। শুধুমাত্র মনের কোনেই জমা করে রেখেছে এই ভালো লাগাটা। শুভ এবার পরীক্ষা দিয়েছে একই সাথে। হয়ত উপরের ক্লাসে উঠলে শুভ ও থাকবে একই ক্লাসে। কাছাকাছি দেখবে, আনন্দ করবে ঘুরে বেড়াবে আরো কত কী স্বপ্ন। স্কুলের অন্য বান্ধবীরা এই নিয়ে কত না ঠাট্টা মসকরা করত। সেই দিকে কোন কর্ণপাত করত না রুমা। শুধুমাত্র মা-বাবার কাছে অভিযোগ যাবার ভয়ে। কিন্তু শুভকে যে কত ভাল লাগে তা খুলে বলার মত মাধুর্র্য ভাষা রুমার কাছে জানা নেই। শুধু শুভর ভালোবাসাটাই নীরবে লালন করেছে বুকে। এদিকে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। যদি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হয়,তখন বাবার ইচ্ছায় আবারও কলেজে ভর্তি হবে। পরীক্ষা সবই ভালো হয়েছে, পাশ না করবে এমন নই।তবুও একটু ভয় জাগছে মনে। বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরত্ব কলেজের। স্কুল আর কলেজ জীবনটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। স্কুলে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়েছে শিক্ষকদের ভয়ে। কলেজে তো সেই ভয় নেই। তবুও নিজে যে, ভুল পথে পা বাড়াবে এমন কোন ভাবনা মাথায় কাজ করছে তেমনও নয়। নিজের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে এটাই। কাল বিকেলে পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হবে। মনের ভিতর কেমন জানি লাগছে। সেদিন বাবাকে বলতে শুনেছে, মেয়ে তো এবার কলেজে পড়বে। খরচটা একটু বাড়বে। উত্তরে মা বলল, কী দরকার আর পড়ানোর? ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়েটা সেরে ফেললেই ভালো। আজকাল সময়টা সকলের পক্ষে দাঁড়ায় না। বাবা বললো, বিয়ে তো দিতে হবে এটা জানি। মেয়েকে যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি,তাহলে সেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা কুটি পাবে। নিজের মনোবল শক্ত থাকবে। এই যে তুমি বললে, সময়টা  আজকাল সবার পক্ষে না। ভালো পাত্র দেখে দেব আমরা।কিন্তু কর্মের ভাগিদার তো সৃষ্টিকর্তা। মা বললো তোমার যা খুশি। এটা শোনার পর রুমার ভিতর একটা আনন্দ কাজ করছে। তাহলে বাবার কথায় থাকবে। আজকে রেজাল্ট দেবার কথা, রুমা স্কুলে যায়নি। পাশ্ববর্তি অন্য একজন সুখবরটা নিয়ে এলো,রুমা ৪.২ পেয়েছে। খুশি আর রাখে কই? রুমার মা’র মেয়ের পাশের খবরে তেমন কৌতুহল নেই। বাবা আসবে রাত্রে চাকরী শেষে। যদিও মিডিয়ার বদৌলতে পাশের খবর পেতে অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। বাবাই খুশিটা বেশি হবে। রাত যখন ঘড়ির কাটা আটের ঘরে পৌঁছে মিনিট বিশ হলো তখন ঘরের দরজায় টোকা পড়ল, রুমা দৌঁড়ে গিয়ে খুলে দিল দরজা। যদিও খবরটা আগেই জানল মোবাইলের কল্যাণে। তবুও নিজের মুখে বাবাকে বলা তো আনন্দের রুমার কাছে। বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে পাশের খবরটা বলল। ¯েœহের পরশে ভরিয়ে দিল মেয়েকে।মেয়েও বাবার আদরে খুশি। বাবা বলল, ভালো করে পড়ো, আরো ভালো করতে হবে তোমাকে। আপনার দোয়া থাকলে অবশ্যই পারব বাবা। তার মানে কলেজে যাচ্ছে রুমা। এটা বাবার কথায় বুঝতে কষ্ট হয়নি। পরদিন খবরটা অন্য বান্ধবীদের জানিয়ে দিল, সেইও কলেজে ভর্তি হবে। পাশাপাশি খবর নিল, শুভ’র কী অবস্থা ? শুভ এমনিই ভালো ছাত্র। এক বান্ধবীর কাছে শুনল শুভ নাকি শহরের এক ভালো কলেজে ভর্তি হবে। শুনে মনটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে গেল রুমার। তাহলে যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন তাকে আর কাছে দেখার সুযোগটা হচ্ছে না। পাশ করার আনন্দের চেয়ে শুভর এই খবরে বেদনার কাঁটাই বিদ্ধ করল হৃদয়ে। আহা, আমিও যদি শহরে ভর্তি হতে পারতাম শুভর মতো। কী না আনন্দ হতো। রুমার ভিতর শুভর ভাবনাই কাজ করছে বেশি।কী আর করা,কিছুই করার নেই। ঠিক ঠিক একদিন কলেজে যাবার পথে শুভর সাক্ষাত মিলল। আগে দুই একবার কথা হলেও দূরত্ব বজায় রাখতো রুমা। আজকে সরাসরি জিগ্যেস করলো শুভকে,তুমি নাকি শহরে ভর্তি হচ্ছো। কে বলল তোমাকে?শুনছি। শুভ বলল, বাবা বলল শহরে ভর্তি হতে। আমার ইচ্ছা এখানেই ভর্তি হওয়ার।ভালো এখানেই হও। দেখি,বাবার ইচ্ছাকেও তো প্রাধান্য দিতে হবে। তা ঠিক। কলেজে ক্লাস শুরু হবে কিছু দিনের মধ্যেই। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ। ক্লাস শুরুর প্রথম দিন ক্লাসে যায়নি রুমা। দ্বিতীয় দিন কলেজে গিয়ে রুমা আচমকিত! দেখে শুভ ক্লাসের টেবিলে বসা। তাহলে শুভ এখানেই ভর্তি হলো ? জিগ্যেস করলে শুভ উত্তরে বলল,শহরে খরচের টাকাটা বেশি,শেষ পর্যন্ত বাবা বলল, এখানেই ভর্তি হতে। ভালো, শুভ ভালো। হাসে রুমা, হাসে শুভ। এভাবে হাসাহাসিতে কেটে গেল বছর। একদিন শুনতে পেল রুমাকে দেখতে আসবে ইতালী প্রবাসী এক পাত্র। মায়ের ইচ্ছে বিয়েটা দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে। পাত্র দেখে রুমাকে পছন্দ করে ফেলল। শুনে চোখে অশ্রু ঝরাচ্ছে রুমা। স্বপ্ননা অধরা’ই থেকে গেল । 

গল্প- ইজিবাইকের গোপন সুখ

গল্প- ইজিবাইকের গোপন সুখ



                                                                                                                          অলঙ্করণ : :  শতাব্দী জাহিদ

 
ইজিবাইকের গোপন সুখ
আবু উবায়দাহ তামিম




ইজিবাইকের নামকরণ.
বাবা আমাকে ইজিবাইকটি কিনে দিয়েছিলেন ত্রিশ দিন আগে, এক মেঘলা দিনে দুপুরে। সেদিন আকাশ মেঘলা থাকার কারণে, বাবা বড় উঠোনে বসে বসে বলেছিলেন ইজিবাইকের নামটি যেন আমি মেঘলা আকাশ নামে রাখি। অর্থাৎ মেঘলা আকাশ পরিবহন বা এই জাতীয় কোনো নামে। অথচ এ নামটি রাখার সিদ্ধান্তে আসতে গিয়ে আমার আপত্তি ঠেকল একখানে গিয়ে- মেঘলা নামের একটি মেয়ের কারণে। সে আমাদের এলাকার খুব অল্প বয়সে বেড়ে ওঠা ও মা চলে যাওয়া একটি মেয়ে। চলে যাওয়া বলতে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া। এবং মেয়েটি ফর্সা শরীরের অধিকারী ও অতিরিক্ত হাসি অনিয়ন্ত্রণকারী। তাকে দেখে আমার মা দাদীরা প্রায় প্রায়ই বলত, এ মা ছাড়া মেয়ে খুব বেশিদিন ভালো থাকে না, খারাপ হয়ে যায় রে, দেখিস একদিন। আমি বাড়ির মহিলাদের এভাবে কথা বলা মানতে পারতাম না। কেননা একে তো তারা আজীবনই যুক্তিহীন কথা বলতে অভ্যস্ত, তাছাড়া একটি নিরীহ মেয়ের উপরে আমিও যেন অহেতুক দোষ দিতে পারতাম না। কিন্তু বছর দুয়েক যেতে না যেতে দেখা গেল- আমার মা দাদীদের কথাই অনেকটা সত্যি হয়েছে। মেয়েটির মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে।
আমাদের গ্রামের হ্যাঙলা পাতলা গড়নের ছেলেটি, যার বাবার ও তার চরিত্র সম্পর্কে গ্রামের মানুষের সম্মিলিত ধারণা একই এবং তা নেতিবাচক ছাড়া আর কিছু নয়। নেতিবাচক বলতে বাবার মতো ছেলেরও অতিরিক্ত নারী ঘেঁষা স্বভাব বা আঞ্চলিক পরিভাষায় বলতে গেলে ‘মাগিখোর’ স্বভাব; যা সবার কাছে ঘৃণিত এবং কারো কাছেই তা অজানা নয়। ছেলেটির নাম স্টিমার। সেই ছেলেটির সঙ্গে- মেঘলার কিভাবে কিভাবে যেন প্রণয় তৈরী হয়ে গেল এবং প্রকাশ্যে তারা প্রণয়ের বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। কিন্তু আমার কাছে একটা হ্যাঙলা পাতলা কিংবা চরিত্রহীন ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রণয় তৈরী হওয়া কোনো দোষ বা অপরাধ ছিল না। বরং দোষ বা অপরাধ ছিল কিংবা আমার ইজিবাইকের নাম মেঘলা আকাশ নামে নামকরণের ব্যাপারে আপত্তির মূল কারণ ছিল মেঘলার একটি পৈচাশিক ঘটনা। ঘটনাটি এমন যে, শেষ পর্যন্ত মেঘলা ও স্টিমারের প্রেম-পরবর্তীতে বিয়ে হলো এবং কয়েকমাস যেতে না যেতে স্টিমারের ঔরসে মেঘলার গর্ভে একটি নবজাতকের প্রাণ এল। তারপর ধীরে ধীরে মেঘলার পেট ফুলতে থাকলে মানুষ সাধারণভাবে জানতে পারল তাদের ঘরে এবার সন্তান আসবে। সেই সঙ্গে স্টিমারও মানসিকভাবে বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। এর বিপরীতে মেঘলা চার মাসের অন্তঃসত্তা হওয়া সত্ত্বেও হয়ত সন্তানের মা হবার প্রস্তুতি নিল না বা মা হতে চাইল না। কিন্তু তার এই মা হতে না-চাওয়ার কারণ সবার কাছেই অজানা রয়ে গেল। সুতরাং এই মা হতে না-চাওয়ার প্রেক্ষিতে একদিন সে হুট করেই কাউকে না জানিয়ে গর্ভের বাচ্চাটি অপসারণ করে ফেলল। তারপর, মেঘলার এই জঘণ্যতম কা-ে তার প্রতিবেশীরা ‘বলতে হয় তাই বলা’র মতো করে কয়েকদিন ছিঃ ছিঃ বলে চুপ রইল এবং তাতে যেন মেঘলার কিছুই এল না বা কিছুই গেল না ভাব নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই দিন যাপন করতে লাগল।
মেঘলার পৈচাশিক ঘটনা এটাই, এতটুকুই। যার কারণে সেদিন, অর্থাৎ যে ত্রিশ দিন আগে ইজিবাইকটি কেনা হয়েছিল, সেদিন আমার নতুন ইজিবাইকের জন্য বাবার দেয়া ‘মেঘলা আকাশ’ নামটি রাখতে গিয়ে আপত্তি উঠে এল। বাবা বললেন,
এ নামে অসুবিধা কী?
অসুবিধা বুঝতেছি না, কিন্তু এই নামটা আমার পছন্দ হইতেছে না।
তো কী নাম রাখবি? শুনি।
দাঁড়ান দেকতেছি, কী নাম রাখা যায়! কী নাম রাখা যায়!
কী নাম রাখা যায় ইজিবাইকের জন্য, তাই ভাবতে ভাবতে অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার ডান হাতের তর্জনী আঙুলটি আমার থুতনীর নিচে- কবুতর যেমন ঠুক ঠুক করে ধান খায় তেমন ভাবে- ঠুক ঠুক করে যাচ্ছিল। আর বাবা চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এ অপেক্ষায় যে, কখন আমি নামটি বলব।
একসময় নামটি আমার মাথায় নামল।
হ, পাইছি।
কী?
সুখী পরিবহন।
তার মানে?
মানে হইল, সবাই যেহেতু সুখী হইবার চায়। তাই যখন অনেকগুলি গাড়ির ভেতরে আমার ইজিবাইকে সুখী পরিবহন লিখা দেকবে। তখন তারা সবগুলি থুইয়া আমার ইজিবাইকের দিকেই আসতে চাইবে।
বাহ, দারুণ বুদ্ধি তোর।
বাবা আসলেই আমার প্রশংসা করলেন কিনা, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি কিছুটা বোকা বোকা ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম উঠোনের পরে, ইজিবাইকের সাথে হেলান দিয়ে। তারপর বাবা মধ্যম গতির একটি নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আচ্ছা, তাহলে তাই রাখ, ‘সুখী পরিবহন’ই রাখ ইজিবাইকের নাম। আমি বাবার কথায় হ্যাঁ সূচক কাঁধ নাড়ালাম। তারপর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের কাছে নিজেই একটি প্রশ্ন করে বসলাম, আমি এই নাম দিলাম কেন! কেনইবা নামের ভেতরে এই সুখ শব্দটা নিয়ে এলাম?

এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলেও, কিছু সময় পরে আমি আমার নিজের মতো করে একটি উত্তর গুছিয়ে আনলাম এবং তারপর মনে হলো সেটাই হয়ত এর সম্ভাব্য সঠিক উত্তর।
‘সুখী পরিবহণ’ নামে নামকরণের কারণ.
সুখী নামটার উদ্ভব, ধরে নিই যে আমার অসুখী হওয়া থেকেই হয়েছে। এখন কিভাবে আমি অসুখী হয়েছি অথবা আদতেই কি আমি অসুখি হয়েছি নাকি কেবল নিজেকে অসুখি অসুখি ভাবছি! হ্যাঁ, হতে পারে আমার দুটি দিন-যাপনের চিত্র একেঁ দিলে হয়ত এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে। 
অতীতের দিন-যাপন ঃ
যখন আমার বন্ধুরা- যাদের পাতলা পাতলা দাঁড়ি গোফ উঠে বড় হয়ে যাচ্ছে এবং তখনো প্রথমবার শেভ করেনি- তাদের কেউ কেউ জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেম করছে ও প্রেমের শুরুর দিকে তারা খুব আনন্দময় মুহূর্ত কাটাতে শুরু করেছে নিজেদের প্রেমিকাদের সঙ্গে। তখন আমি প্রেম না-করে নিতান্তই নিরীহ একটি ছেলের ভূমিকা পালন করছি যেন। কেন প্রেম করছি না? কেননা তখনো আমার ভেতরে প্রেমের তাড়না আসেনি বা ভেতরে এমন আবেগও তৈরী হয়নি যে, আমার একটি প্রেম করা দরকার কিংবা আমার একটি প্রেমিকা থাকতে হবে। তারপর হঠাত একদিন কেন যেন মনে হলো, আদতে কি আমি নিজ থেকেই প্রেম করছি না, নাকি আমি এ প্রেম করতে অক্ষম বলেই তা আমার সঙ্গে মিলছে না? এই হঠাত করে নিজেকে কোনো বিষয়ে অক্ষম মনে হওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, অথবা সাইক্লোজিক্যাল সাইড থেকে বলা যায়- এটা নতুন উদয় হওয়া একটি মানসিক সমস্যা।
তো অতীতের এইসব দিনে, আমার অসুখী হয়ে ওঠা তখন থেকেই শুরু হলো, যখন আমি আমি আমার অক্ষমতা অস্বীকার করে সক্ষমতা প্রমাণের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। এভাবে যে, আমাদের আশেপাশে থাকা মেয়েদের একজনকে বা সক্ষমতা প্রমাণের তাগিদে জোর পূর্বক পছন্দ করে নেয়া একজন মেয়েকে আমার সঙ্গে প্রেম করবার প্রস্তাব দিয়ে ফেললাম। মেয়েটি সম্মতি প্রকাশ না করে প্রত্যাখ্যান করল। আমি আমার সক্ষমতাকে আবারও প্রমাণের জন্য দ্বিতীয় আরেকজন মেয়েকে প্রস্তাব করলাম, অনুরূপভাবে সেও প্রত্যাখ্যান করল। তারপর তৃতীয়জন, সেটিও হলো না। ঠিক সেভাবেই না হতে হতে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠজন পার হয়ে গেলে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আসলেই আমি এ প্রেম করতে অক্ষম। আমাকে দিয়ে এ প্রেম ট্রেম হবে না। সেদিন আমি বুঝে গেলাম, আমি এখন অসুখী রোগে আক্রান্ত। তারপর প্রেমের এ চিন্তা-ধারায় ক্লান্তি নেমে এলে আমি ভাবতে লাগলাম, তাহলে এ প্রেমের বিকল্প কিছু আছে কি আমার জন্য? যেটায় আমি সক্ষম?
হ্যাঁ, আছে। বিয়ে। এর বহুদিন পরে একদিন, যখন আমার বয়স চব্বিশে পদার্পণ করল, আমি নানাবাড়ির এলাকার একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফেললাম। কেননা সেই বিয়েতে মেয়ের কোনো মতামতের সুযোগ ছিল না। মেয়ের বাবামার মতামতই সব। মতামতের এই ধারায় আমি নিজেকে সক্ষম ভাবারও একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলাম যেন তখন। অথচ আমি তখনও বুঝতে পারলাম না যে, এ বিয়েই আমার জীবনে দ্বিতীয়বার অসুখী হওয়ার সূচনা করে গেল।
বর্তমানের দিন-যাপন ঃ
দ্বিতীয়বার অসুখী হওয়ার সূচনা হলো আমার বিবাহ পরবর্তী সংসার-জীবনে। এখন আমার একটি সংসার আছে। সংসারে একজন বউ আছে, তবে বাচ্চা কাচ্চা নেই। এই সংসারের বয়স মাত্র পাঁচ মাস। বিয়ের আগে বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতাম। কিন্তু বিয়ের পর কিছুদিন পার হতে না হতে আমার আশঙ্কা হলো, হয়ত আমার বউয়ের কোনো কাজ-কর্ম দ্বারা আমার বাবা মা শুধু শুধু হতাশায় ভুগবেন বা আমাকে নিয়ে বিচলিত হবেন। যেমন তার একটা অভ্যাস ছিল, একটু দেমাগ চড়ে গেলেই সে খেকিয়ে খেকিয়ে কথা বলে উঠত। বিপরীত দিকের মানুষটি তার বয়সী কিনা, তার সঙ্গে এভাবে কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা- এসব কিছু সে ভাবত না। যেকোন মানুষের সঙ্গেই এমন রূঢ় ব্যবহার করতে বাধত না তার, না আমার সঙ্গে, না আমার বাবা মায়ের সঙ্গে। সেজন্য আমি বুদ্ধি সুদ্ধি করে একদিন বাইরে ঘর ভাড়া নিলাম। বউকে বললাম, চলো, তুমার সুখীর জন্যিই আলাদা হইছি। বাপমা বাপমার জাগায় থাকুক, তুমি তুমার জাগায়।
সুতরাং বলতে পারি, এই পরিবার বিচ্ছেদও আমার অসুখী হওয়ার একটি কারণ।
তাছাড়া সংসার জীবনে- মূল যে সমস্যাটায় আমি ভুগছিলাম, তা হলো আমার উপার্জনাক্ষমতা। আমার একটি ভুল ছিল যে, আমি উপার্জনের শক্ত কোনো পথ ঠিক না-করেই বিয়ে করে ফেলেছি। কেননা তখন আমার প্রেম না করতে পারার অক্ষমতা আমাকে বিবাহের দিকে ঠেলে দিয়ে উপার্জনের কোনো পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। আর আমার বউ এই বড় দূর্বলতাটিকে কাজে লাগিয়ে, সে আমার সংসার জীবনকে আরো অসুখী করে তুলছে। তাই এবার পরিস্কারভাবে বলতে পারি, আমার জীবনের এই অপূর্ণতাগুলি বা না-পাওয়াগুলি অর্থাৎ, প্রেম করতে না পারা, বিবাহের পর বউয়ের কারণে পরিবার বিচ্ছিণœ হওয়া এবং আমার যথাযথ উপার্জন না-থাকাই আমার অসুখী হওয়ার কারণ। আর আমার ভেতরের এই অসুখী অসুখী ভাব থেকেই অথবা সুখী হবার আশা থেকেই- যখন আমার বাবা উপার্জনের যন্ত্র হিসাবে ইজিবাইকটি কিনে দিয়েছিলেন তখন সেটার নামকরণের সময়- সুখী পরিবহন নামটি নির্গত হলো। এবং শেষ পর্যন্ত ইজিবাইকটির নাম ‘সুখী পরিবহন’ নামেই নামকরণ করা হলো।
ইজিবাইক চালানোর একদিন.
সাধারণভাবে ইজিবাইক চালানোর মধ্য থেকে আমার কাছে বিশেষ হয়ে উঠল একটি দিন। সেদিনের সকালটি ছিল মন খারাপের। মানে আমার বউয়ের সঙ্গে ঠুনকো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেছিল আর তাতে সকালের কোমল মনটা যেন বিষিয়ে উঠল। রাগের তীব্রতা এত হলো যে, আমি আর ভাত খেতে পারলাম না। তখনি ইজিবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

আমি খুলনা শহরের ভেতরেই লোকাল যাত্রী নিয়ে ঘুরি। এ স্টেশন থেকে ও স্টেশন। শিরোমণি বাজার থেকে রূপসা পর্যন্ত। তারপর আবার উল্টোভাবে, রূপসা থেকে শিরোমণি বাজার পর্যন্ত।
সেদিন সকালে বেরিয়ে মনে হলো, আজ যেহেতু মন খারাপ। সুতরাং একটু ভিন্ন নিয়মে গাড়ি চালালে হয়ত মন খারাপের কথা ভুলে থাকা যাবে। এবং ভেতরে ভালোলাগা সৃষ্টি হবে। গাড়ি নিয়ে ফুলবাড়িগেট বাজার পর্যন্ত এসে আমি একটি চায়ের দোকানে বসলাম। সকালের হালকা পাতলা নাস্তা করতে। তখন আমার ইজিবাইকটি বাইরে থামানো ছিল। কিছুক্ষণ পরে আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হঠাত দেখতে পেলাম, ত্রিশের কাছাকাছি বয়স এমন একজন নারী ও একজন পুরুষ একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমার বন্ধ ইজিবাইকের সামনে উঁকি ঝুকি মারছে। তাদের ভঙ্গী দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে, তারা স্বামী-স্ত্রী এবং তারা ইজিবাইকে কোথাও যাবে বলে ড্রাইভার খোঁজ করছে। যেহেতু আজকে এখনো কোনো যাত্রীই আমার গাড়িতে ওঠেনি এবং তারাই প্রথম, তাই আমি ভাবলাম, তাদেরকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। তারপর আমি বেরিয়ে এলাম।
আপনারা যাবেন কোনে?
তুমি রিজার্ভ যাবে? লোকটি প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, আপনারা চালি যাব। কোনে যাবেন? কন।
এই ধরো... আমরা নির্দিষ্ট কোথাও যাব না।
তালি?
আমরা ঘন্টা দুয়েক তোমার গাড়িতে করে ঘুরব। তুমি এই মেন রোড ধরে, দুই ঘন্টার ভেতরে যতদূর পারো আমাদের ঘুরাবে। পারবে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পারব।
কত দিতে হবে?
২৫০টাকা দিয়েন।
তুমি কিন্তু এর ভেতরে কোনো লোকাল যাত্রী উঠাতে পারবে না।
ঠিকাছে, ঠিকাছে, বুচ্ছি।
তারা দুজন ইজিবাইকে উঠে বসলে আমি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে চালানো শুরু করলাম। বললাম, কোনদিকি যাব?
তুমি যেদিকে ভালো মনে করো। আমাদের দুঘন্টা ঘুরালেই হবে। কী বলো জান?
লোকটি তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে তার সম্মতি নেয়ার চেষ্টা করল। লাজুক চেহারার মহিলাটি নিঃশব্দে মুচকি হেসে দিল। আমি বললাম, আচ্ছা।
আমি ইজিবাইকের চাকা যশোরের দিকে অগ্রসর করলাম। ভাবলাম ওদিকে ফুলতলা পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আবার এদিকে সোনাডাঙা বা গল্লামারী পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনলে আমার দু ঘন্টা পূর্ণ হয়ে যাবে। তাতে আমার ভাড়া মিটে যাবে।
ইজিবাইক চলতে থাকল মধ্যম গতিতে। ভেতরে তারা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কথাবার্তা বলছে, যার আওয়াজ আমার কানেও মাঝে মাঝে ভেসে আসছে পেছন থেকে। ফলে ভুলক্রমে আমার চোখ লুকিং মিররের মাধ্যমে তাদের উপর পড়ছে। এটা যে অপরাধ, এই ভেবে আমি আবার চোখ ফিরিয়ে আনি তখনি। হঠাত করে পুরুষ লোকটির একটি কথায় আমার ভাবনা যেন একটু নড়ে চড়ে ওঠে। কথাটি সে আমায় বলেনি বা নিজে নিজেও বলেনি। সে তার স্ত্রীকে বলল, ছেলে মেয়েগুলি কেমন আছে?
হ্যাঁ, ভালো আছে।
আমি এই কথাটুকু শুনে ধারণা করে নিলাম, তাহলে নিশ্চয় তাদের ছেলেমেয়েগুলি মায়ের কাছে থাকে, এবং ছেলেমেয়েগুলি বাবার চোখের আড়ালে থাকে। নয়ত পুরুষ লোকটি কেন জিজ্ঞাসা করবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে?
মহিলাটি বলল আমাকে উদ্দেশ্য করে, আচ্ছা জানালার পর্দাগুলো কি ফেলে দেয়া যাবে?
হ্যাঁ, ম্যাডাম অবশ্যই যাবে।
আমি ইজিবাইকের ব্রেকে পা রেখে দু’পাশ থেকে পর্দাগুলি ছেড়ে দিলাম। এবং বুঝতে পারলাম তারা এতে কিছুটা স্বস্তি পেল। আমি গাড়ি ছেড়ে দিলাম।
তারপর,
ইজিবাইক তার নিজস্ব গতিতে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমরা স্টার্নগেট পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। এবং আমাদের দু’ঘন্টা সময় থেকেও প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় অতিবাহিত হয়েছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে গলার স্বর একটু মোটা করে বললাম, ভাইজান সুমায় কিন্তু প্রায় শ্যাষ হয়ে আইছে। তারা আমার এই কথার উত্তর দিল না। আমি কিছু সময় উত্তরের অপেক্ষা করে অভ্যাস মতো অথবা বদাভ্যাস মতো লুকিং মিররে আবারো চোখ উঠালাম। তখন দেখতে পেলাম তাদের একটি হৃদয় ছোঁয়া দৃশ্য। এবং আমি সব ভুলে যেন এ দৃশ্যই দেখতে মগ্ন হয়ে গেলাম।
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে, এবং দুজনের চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। পুরুষ লোকটি বলল,
তোমার কি মনে পড়ে আমরা কিভাবে সেই প্রথম প্রেমের দিনগুলি কাটিয়ে ছিলাম?
হ্যাঁ, সবই মনে আছে। তা কি আর ভুলা যায়!
এখনো আমায় ভালোবাসো?
না বাসলে কি এতদূর আসতাম।
তোমায় খুব মিস করি, হয়ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই না-পাওয়ার আফসোস থেকে যাবে।
তোমার স্ত্রী কেমন আছে? সে তোমার যতœ নেয়?
হুম, ও আমার খুব খেয়াল রাখে।
আমার হাত স্টেয়ারিং-এ, কিন্তু আবারো মনোযোগ চলে গেল তাদের কথায়। তার মানে কী? এরা ডিভোর্সড কাপল! কিন্তু ওদের ভেতরে যে কত ভালোবাসা! তবুও ডিভোর্সড হলো কেনো?
হঠাত আমার মনে হলো, নাকি পরকিয়া করছে তারা?
ধুর, আমি কী সব ভাবছি। যা হবে হোক গিয়ে। আমার কী তাতে। আমার দু’ঘন্টা হয়ে গেলে এবং ২৫০ টাকা পেলেই যথেষ্ট। হঠাত পেছন থেকে পুরুষ লোকটি বলল,
আচ্ছা ঐ সামনে যে গাছটি আছে, দুইজন লোক দাঁড়ানো। ওখানে আমাদের নামিয়ে দাও।
আমি ইজিবাইক স্লো করে মেন রোড থেকে বাঁ দিকে নেমে গাছের পাশে থাকা লোক দুজনের সামনে স্টপ করলাম। দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুজনের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। আমার ইজিবাইকটি থামতে না থামতেই লোকদুটি ইজিবাইকের কাছে এসে গেল। আমি ভাবলাম, যাক ভালোই হবে। একটা ভাড়া শেষ হতে না হতেই অন্য যাত্রী ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু না, লোকদুটি এসে আমার ইজিবাইকের ভেতরে থাকা দুজনকে বলল, আরে এসে গেছ? নামো, নামো, চলো।
আমি তাদের কথাবার্তার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তুমুল আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। এদের সঙ্গে ওদের কী সম্পর্ক? যদি এরা পরকিয়াই করে তবে তো লুকিয়ে লুকিয়ে থাকার কথা। তারপর পুরুষ লোকটি বলল আমাকে,
এই নাও ৩০০ টাকা, তোমাকে ৫০ বাড়িয়ে দিলাম।
আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একশ’ টাকার তিনটি নোট। আমি তার দিকে স্মিত হেসে টাকাটি ড্রয়ারে রাখতে গেলাম। ঠিক তখন উনি আবার এক বাক্যের একটি কথা বলে চলে গেলেন।
লুকিং মিররে এতবার তাকিয়েও বুঝতে পারলে না আমাদের সম্পর্ক কী?
আমি লজ্জায় যেন আর মাথা ওঠাতে পারলাম না। ঝিম ধরে বসে রইলাম। এর কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখতে পেলাম, তারা চারজন দুটি জোড়ায় বিভক্ত হয়ে খূব ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল একটি পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে- তা হলো, ইজিবাইকে থাকা মহিলাটি গাছের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষের হাত ধরে হাঁটছে। আর ইজিবাইকে থাকা পুরুষ লোকটি গাছের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির কাধ ধরে হাঁটছে। আমি তাকিয়েই রইলাম তাদের দিকে। যেন আমার চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হলো না তাদের উপর থেকে। আমার মনে হলো, ওরাই কি তাহলে পৃথিবীর সুখী মানুষ?? আচ্ছা, ওরা কি একবারও দেখেছিল, আমার ইজিবাইকের নাম ‘সুখী পরিবহন’। আমি আবারও স্টার্ট করলাম ইজিবাইক।
ফাঁকা রাস্তা। ‘সুখী পরিবহন’ চলছে দ্রুত গতিতে। আমারও ধীরে ধীরে মনে হলো, আমিও আজ অনেক সুখী। অনেক সুখী। তবে কেনো এত সুখ বিরাজ করছে আমার মনে? প্রকৃত সুখী মানুষ দেখেছি বলে?
তারপর দেখলাম, ইজিবাইকটি আর রাস্তায় চলছে না। ধীরে ধীরে সেটা অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে। আমি স্টেয়ারিং ছেড়ে দিলাম। ব্রেক থেকে পার উঠিয়ে আনলাম। এবং উপলব্ধি করতে লাগলাম এক সুখ। যে সুখ পরম সুখ। ইজিবাইকের গোপন সুখ।

হেমন্তের পদাবলি

হেমন্তের পদাবলি










হৈমন্তী
জালাল জয়

শিশিরে ভিজে ছুঁয়ে দেয় কুয়াশা।
ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে দেয় ডাক,
রাস্তার দু’পাশে বৃক্ষের সমারোহ,
তারপরেই জল আর জলের খেলা
জলের পরেই জমি।যেখানে করি চাঁষ।
বৃক্ষগুলো আদ্র ছোঁয়ায়,পরশ মেখে দেয়।
জমিতে সুর,ধানের কন্ঠে ,
লিখে দেই কবিতা
আমি চাঁষি গো, আমি চাঁষি।

জীবনের সমস্ত ক্লান্তি, দেবো তুলে
যদি এ জমিনের চাঁষে বপন করো
হৃদয়ের বীজ। মূল্যহীন।

পুকুরে ¯œান শেষে, ভেজা দেহে
জমিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাও,
রুপালি মুখে, যেন সূর্যের ঢেউ
থরথর কম্পন, শুরু হয় বুকে।
কন্ঠে তোমার মায়ারস শুনি
চেয়ে থাকি বোবা হয়ে,
ভেজা চুলে শব্দ আঁকি
ভালোবাসি ভালোবাসি...



হেমন্তের রূপ
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

কার্তিক আর অগ্রহায়ণ হেমন্ত কাল
রাশি রাশি সোনালি ধান
ছড়ায় আনন্দ প্রবল।

নবান্নের বাংলাদেশ উৎসবে মাতে
নতুন চালের পায়েস ওঠে সবার পাতে।

ব্যস্ত সব কৃষাণিরা কাজের শেষ নাই
আমন ধানে ভরা গোলা, দেহে যেন
প্রাণ ফিরে পাই।

কুসুম কুসুম শীত এখন লাগে বড্ড ভালো
অনাহারী শিশুটির মুখখানি কালো।

আকলিমা চোখের পাতায় স্বপ্ন বোনে
সুদর্শন পোকাটি যেন তার কথা শোনে।

গাশশির কাঁচা হলুদ গায়ে পরে নারী
আয়নাতে দেখে মুখ লাগেনা কোনো কড়ি।

মার্বেল খেলা নিয়ে ছেলেরা সবাই ব্যস্ত
একটি খোয়া গেলে রাখবেনা আর আস্ত।

কুয়াশা চারদিকে সকালটা হয় শাদা
শিশিরের জলে ভিজে পায়ে জমে কাঁদা।

আকাশটা পরিষ্কার ¯িœগ্ধ রাত
কাঁশফুল ঝরা ঐ পূণিমার চাঁদ।


পহেলা প্রেম
বিটুল দেব

রাতদুপুরে ঝিঁঝিঁ পোকার স্বরলিপি আর ব্যাঙ-ব্যাঙানির রূপকথার বয়ানে প্রিয়ার নাম । সবুজাভ পাতারা বাতাসের সাথে মিতালী । ভরা চাঁদে দেখি মায়াময় অবয়ব । জোৎ¯œার স্বচ্ছ জলেও চুরি করে টোল পড়া হাসি । আমি চেয়ে-চেয়ে শুধু প্রণয় জ্বরে ভোগি । গুনগুনে গায় দোলা চলে দোলে রে মন... ।
হাত চিঠির প্রত্যাশায় খুঁজি নিজস্ব খেঁজুরে শব্দ । মন ধরা বিশুদ্ধ বিবরণ গাঁথি শব্দফুলের মালা । চিঠির শরীরে জমে উঠে তুমি... তুমি ডাকের গন্ধ । গোপন বুক পকেটে পুষে চলার পথে করি ঘুরঘুর । অপেক্ষমাণ সরল সকাল আর হ্যাঁ সূচক প্রতিউত্তর ।




দাওয়াই
আশিক বিন রহিম

মাথার উপর ঝুলে থাকা চাঁদ, খুঁঁটিহীন নীল আসমান
মেঘ ভেঙে সূর্য হাসে; অথচ কি আশ্চর্য প্রেম-
যেখানে ক্ষত আঁকে সেখানেই লিখে দেয় দাওয়াই
মসৃণ মমতা।

ভালোবাসায় ক্ষত, রক্তাক্ত মনে যতোটুকু দহন-অসুখ
প্রেমেই চুর্ণ হয়- পূর্ণ হয় হৃদয়।

প্রেম; বড়ই আশ্চর্য দাওয়াই।


হেমন্তের ঠিকানায় খোলাচিঠি
ইউসুফ কবিয়াল

আউশ ধানের সোনামুখ ঘরকে করল আলো
নতুন ধানের শুভক্ষণে যাক মুছে সব কালো।

শিউলি ফুল উঠল হেসে নতুন ধানের গন্ধে
ফিরনি হবে পায়েশ হবে বাতাস বলছে ছন্দে।

নাগরদোলা দুলবে দেখো শখের চুড়ি বাজবে
কৃষাণবধূ বাউলগানে নাচবে দেখো নাচবে।

শিউলিমালা কামিনী ফুলে সাজবে বধূ সাজবে
নবান্নের এই উত্সবে বাঁশের বাঁশি বাজবে।

সবুজ পাতায় চিঠি লেখে পাঠিয়ে দিলাম যেমন-ত
খোলা ডাকের চিঠি পেয়ে আসল শেষে হেমন্ত।


ডেকে আনি দীর্ঘ আঁধার
যাহিদ সুবহান

এই মাঠে এই প্রান্তরে একদিন
ধেঁয়ে আসবে শিকারি খেচর
ওরা এসে লুটে পড়বে আমাদের ফসলের মাঠে
ছিড়ে ছিড়ে খাবে আমাদের সোনালী ধানগুলো
আর যতেœ গড়ে তোলা সবুজ ফসল
আমাদের অবনতি দেকে দেখেও আমরা একদিন
না জেনে অথবা না বুঝেই উল্লোসিত হয়ে
আমাদের অগোচরে আমরা ডকে আনি দীর্ঘ আঁধার...



কথা ছিল দু’জনার
স্বপন শর্মা

হেমন্তের দাপটে হিমেল হাওয়া
আমার অবসাদ; তোর উন্মত্ত মন,
দিতে চেয়েছিলি সবুজ আকাশ- দিলি কই?
সবুজ মাঠ, অন্ততঃ একটা বৃক্ষ; তাও না।

চল আজ দু’জনে রোদ কুড়িয়ে সূর্য বানাই--
সেটাই না হয় আমায় দিস..



অরণ্যের আর্তনাদ
নাবিল তুরাব

গভীর রাতে নীরবে ঝরে পড়া পাতাদের হাহাকার
জীবনে শুনেছি অনেক বার।
ছাদের ওপর জমে থাকা জলের টুপ করে নিচে পড়ার ব্যথাও
অনুভব করেছি বহুবার।
আমি দেখেছি মাটির কষ্ট, পাহাড়ের কষ্ট, নদী ও সমুদ্রের কষ্ট।
দেখেছি আকাশের, জোসনার, নীলিমার কষ্ট।
রাতের প্রগাঢ়তায় গহন অরণ্যের আর্তনাদ
আমাকে বহুকাল বিহ্বল করেছিলো।
আমি ভাঙা দেয়ালের খাঁজে গুটিয়ে নিয়েছি
নিজেকে অসংখ্য বার।
আমার ভগ্ন হৃদয়ের চিৎকার পুঁতেছি মাটির ভেতর।





হেমন্তকাল
শরীফ সাথী

ষড়ঋতুর স্বর্ন ফলা হেমন্তকাল জানে,
গ্রাম বাংলায় পার্বন এলে বলতে কথা কানে।
সবুজ হাসির সুখের ছোঁয়া ঝরে সর্ব খানে,
নদীর জলে মাঝির দলে আনন্দে দাঁড় টানে।
মেঠো পথের সরু মাঠের সকল বামে ডানে,
পাল¬া দিয়ে ধান কাটানোর তাকাও দৃশ্য পানে।
গাছে গাছে মুখরিত পাখির নানা গানে,
হেমন্তের এই মধুক্ষণে গোলা ভরে ধানে।
চাঁদের আলোয় স্বর্নালী ধান জ্বলে গো উঠানে,
বউ দিদিরা হেঁসিল পাড়ে ঢেঁকিতে ধান ভানে।
আলো চালের সাদা আটা করতে গো সমানে,
রাত্রী জেগে পড়শিরা সব গড়তে রুটি ছানে।
সারা বাংলার পাড়া ঘরে ভরে পিঠার ঘ্রাণে,
নতুন মিঠা হরেক পিঠা তৃপ্তি আনে প্রাণে।
হৈ হুলে¬াড় আনন্দ সব কিশোর কলতানে,
গরম পিঠা’র সজিবতা হেমন্ত-কাল আনে।


হেমন্ত দিন কই হারালো
মাহদী হাসান

দপ দপাদপ শব্দে আমার ঘুম হতো না- একি!
রান্না ঘরে ঠুকতো মাথা আমার মায়ের ঢেঁকি।
পায়ের ছন্দে সুরের লহর চলতো তালে তালে
ধানভানা সেই দৃশ্যগুলো দেখি না এই কালে।

ঢেঁকিঘরের ধানভানা গান বাজছে আজো হৃদে
নতুন ধানের গন্ধে ব্যাকুল বাড়তো আমার খিদে।
হেমন্ত আজ যন্ত্রে ছোঁয়া, হারিয়ে গেছে ঢেঁকি
দপ দপাদপ শব্দগুলো, কই হারালো- একি!

হিম সকালের শিশিরগুলো জ্বলতো রুপোর মতো
দৌড়ে গিয়ে সবুজ ঘাসে, পা ভেজাতাম কতো!
দৌড়ে চলা আলপথে সেই মটরশুঁটির ক্ষেতে-
শিশিরবিন্দু, রোদের আলো- উঠতো খেলায় মেতে।

ঘাসফড়িঙের সাথেই ছিলো, সুখের মাখামাখি!
পুকুর ঘাটের চালতা গাছে ডাকতো দোয়েল পাখি
ধানশালিকের জোড়ায়, হৃদয়- ওঠতো মেতে কতো!
দোয়েল শালিক কই হারালো, পাই না দেখা অতো!

কাট্টা ঘুড়ির পেছন পেছন, সেই যে ছুটে চলা—
নাটাই হাতে গোত্তা মারা, থাকতো হাজার কলা।
ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা মেরে, সেই যে বাড়ি ছাড়া,
বিকেল গড়ায় সন্ধ্যা নামে খেতাম মায়ের তাড়া।

সেদ্ধ ধানের গন্ধে হৃদয়, নবান্ন স্বাদ পেতো-
বইয়ের পাতায় চোখটা রেখে মন হারিয়ে যেতো।
স্মৃতির পাতায়, বাস্তবতায়- কত্তো ফারাক দেখি!
হেমন্ত দিন কই হারালো, পাই না খুঁজে-একি!


মখমল হেমন্ত
রিক্তা রিচি

হেমন্ত,
তোমার ঝলমলা আকাশে পাখির ওড়াওড়ি
শাদা পায়রার বুকে উপচে পড়া প্রেম
সাতসকালে ঘাসের আবরণে পা ভিজানো
ঐ দূরের ঠিকানায় না পাঠানো চিঠি
আমার চোখের জল
সবই সোনালী, মখমল।

হেমন্ত,
কৃষকের জ্বলে জ্বলে একজোড়া চোখ
কৃষকের ঘরে ঘরে তোমার প্রার্থনা
অবিরত প্রার্থনা নতুন ধানের
কৃষাণীর ঠোঁটে মধুমাখা হাসি
ধানের শীষে জমে থাকা শিশির
মনে জাগে প্রেম কিশোরির।

হেমন্ত,
বিলের বুকে কাগজের নৌকা
আঁখের গুড়ের সাথে সকাল শুরু
দাওয়ায় দাদুর কোরআন পড়া
তারপর মুড়ি, খই নিয়ে জমপেশ আড্ডা
প্রজাপতিময় দিন
মনে খুশির বীণ।