বিমুখতা ও বখে যাওয়া তরুণ সমাজ...
বিমুখতা ও বখে যাওয়া তরুণ সমাজ...
ইফতেখার শামীম
রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে। কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।
দেহ এবং মন দুয়ে মিলে মানুষ। দেহের সুস্থতার জন্য যেমন খাদ্য প্রয়োজন, ঠিক তেমনি মনের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন বই পড়া। বই মানুষের মনে আনন্দ-বেদনার কাব্যিক দার্শনিক সত্যবোধ জাগিয়ে তুলে। বই পাঠে খুলে যায় মানুষের মনশ্চক্ষু। বইয়ের মাধ্যমে বিলীয়মান চঞ্চলমান অতীত ও বর্তমানের মানবসভ্যতার সেতু গড়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাকোঁ বেধেঁ দিয়েছে। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ গিবন বলেছেন, Books are those mirror that reflect our mind, the mind of sages and heroes.
জীবনের নানাবিধ অভিঘাত যখন মানুষকে উন্মক্ত করে তোলে, তখন শান্তনা সহানুভূতি ও আনন্দের জন্য বই পাঠের বিকল্প নেই। বারট্রান্ড রাসেল এর মতে ‘সংসারে জ্বালা যন্ত্রণা এড়ানোর উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভূবন সৃষ্টি করে নেয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়ানোর ক্ষমতা তার তত বেশি হয়। বই পড়া নিয়ে Vincent Staretএর উক্তিও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য- ÔThen we buy a book we buy pleasureÕ
এবং এই বই পাঠে আপ্লুত হয়ে আনাতোলে ফ্রাস বলেছেন, নানা জ্ঞান বিজ্ঞান যত’ই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই একটা একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে। উল্লেখ্য যে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম নিভৃতে বৃক্ষতলে স্বর্গরচনার জন্য উপকরণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন তাতে একখানা কাব্যেরও স্থান ছিলো। তার মতে বই ছাড়া স্বর্গীয় আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়।
এভাবে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অব্দি যত মনিষী ইতিহাসের পাতায় অমর হয়েছেন, সবার সফলতা এবং অমরত্বের পেছনে বই কোনো না কোনোভাবে সহায়তা করেছে। বই মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাণসত্ত্বা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তেতো সত্য এই যে, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এই যুগে বই পাঠ থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ বইপ্রেমী না হয়ে, ডিজেপার্টি প্রেমে মত্ত হয়ে আছে। আজকাল পরিবারের কর্তা তার সন্তান জন্মানোর সাথে সাথেই তার নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট খুলছেন, শিশু যখন ২-৩ বছরে পা দিচ্ছে, তখন তার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে স্মার্টফোন। এবং সেই স্মার্টফোনে ডাউন করে দেয়া হচ্ছে নানাবিধ গেমস। এবং আমাদের দেশের ৭০ ভাগ শিশুই বইয়ের সাথে পরিচিত হবার পূর্বে প্রযুক্তির অপব্যবহারে জড়িত হচ্ছে। প্রযুক্তি অবশ্যই আমাদের জন্য আশীর্বাদ কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের সমগ্র জাতির জন্য অশনি সংকেত। ইদানিং আমাদের তরুণ সমাজের ৯৫ ভাগ যত সময় স্মার্টফোন সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায় তার একভাগও বই পড়ে কাটায় না। ফলশ্রুতিতে আজকালকার তরুণ’রা যখন মনের আনন্দ পাচ্ছে না, নিঃসঙ্গতার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে, তখন তারা মনের আনন্দের জন্য সঙ্গী খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েদের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহের চেষ্টা, ইমো- ওয়াটসআপ-ফেসবুকে মেয়েদের একাউন্ট সার্চ করে ইনবক্সে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্ঠা কিংবা ইন্টারনেটে ডিজে গান অথবা পর্ণো ভিডিও দেখা’ই তাদের মনের প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বই বিমুখতার পাশাপাশি আজকালকার তরুণ’রা ব্যস্ত বিভিন্ন নোংরামি ট্রল এবং ইস্যু নিয়ে। বই বিমুখতার কারণে তরুণরা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে, জঙ্গিবাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। বিভিন্ন নোংরামি ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে । এবং অবশেষে অধিকাংশ তরুণ’ই জীবনের উপর প্রচন্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের গোটা সমাজ, আমাদের স্বপ্নবাজ তরুণ যাদের মেধা আর বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রগতিতে রাষ্ট্র ও সমাজ অগ্রগতির স্বপ্ন দেখতে পারতো, তারা আমাদের চোখের সামনেই ধ্বংস হচ্ছে। এই ধ্বংসপ্রায় তরুণ সমাজকে উদ্ধারের এক এবং অন্যতম পথ তরুণদের বই পাঠে অভ্যস্ত করে তোলা। বই যে আমাদের মনের ভেতর চমৎকার জগত তৈরি করে দেয়, তা এই তরুণ সমাজ যদি বুঝতে পারে তাহলে এই তরুণদের নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়াঁনোর স্বপ্ন এবং আশা রাখতে পারে । একমাত্র বই’ই যুগে যুগে ত্যাগের দীক্ষা, সত্য ও সুন্দরের সাধনায় মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে । তাই মানবজীবনে বই পাঠের মূল্য গভীর ও ব্যাপক।
কোনো এক কবি লিখেছেলেন,
পড়িলে বই আলোকিত হই
না পড়িলে বই অন্ধকারে রই
অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া তরুণ সমাজকে আলোর ধারায় ফিরিয়ে আনতে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র বই, বই এবং বই’ই আমাদের এই বখে যাওয়া তরুণ সমাজকে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চায় মনোনিবেশ করাতে বাধ্য করতে পারে।
আরও এক বিপন্ন বিস্ময় !
আরও এক বিপন্ন বিস্ময়
আরিফুল হাসান
: তোমার এ নামটির জন্য তোমার আপত্তি লাগে না?
: না, লাগবে কেনো? এটি আমি ভালোবেসে গ্রহণ করেছি।
: আমি তোমাকে আগের নামে ডাকি?
: না, কখনো না।
: তাহলে বৃষ্টি ও বাতাস, ভেজা লাবণ্য, আর তোমার ঠোঁট সত্য নয়, সত্য নয় এই চেয়ার টেবিল, সত্য নয় এ বিহালা রেস্টুরেন্ট?
: আমি যে গ¬াসে চুমুক দিচ্ছি, এই সুমিষ্ট হুইস্কি আর আর মুখোমুখি তোমার চোখ হয়ে সত্য । সত্য এও যে আমরা দুজন জীবনকামী। সুতরাং তা বলে এই নয় যে মৃত্যু আসবে না।
: শুনো, তোমার ওসবে মৃত্যু মৃত্যু খেলা আমার ভালো লাগে না।
: তাহলে কী চাও?
: আসো, উপরে আসো।
উপরে? এই বিহালা রেস্টুরেন্টের উপরে চার তলায়? মানে তুমি আমাকে চন্দন আবাসিকে নিতে চাচ্ছো?
: না, মানে...
: কী মানে মানে করছো? গ¬াসে চুমুক দাও জীবন। আমি তোমার পাশে আছি।
: পাশে আছো বলেই তো কাছে পেতে চাই।
: কাছে পেলে কী করবে?
: জরিয়ে ধরবো, ব্যাস!
: শুধু জরিয়ে ধরবে, আর কিছু করবে না?
: তোমার অমতে?
: না, ঠিক থাকবে না তোমার কথা জীবন। তুমি আমাকে পেতে চাইবে। সম্পূর্ণ রূপে নিঃস্ব করে পেতে চাইবে। আমিও হয়তো চাইবো। তখন তোমার ইচ্ছেরও বালাই থাকবে না; আমিও হয়তো উদাসীন হবো। তখন মেঘ জমে থাকবে বৃষ্টিতে। তোমার আমার শরৎকালেও দেখা হবে না।
: না হলে নাই। তুমি আসো।
: তুমি কি আমার উপর জোর করছো?
: জোর আমি কোনদিনই বা করলাম?
: এইযে, এখন করছো। রেস্টুরেন্টে। এরকম করলে সামনে কিন্তু আর পানের সঙ্গী হিসেবেও পাবে না। কিন্তু আমি হারাতে চাই না তোমাকে।
: আমিও চাই না, মৃত্যু। তোমাকে আমি ভালোবাসি। নাম তোমার ছদ্মনাম মৃত্যু হলেও আসলে তুমি আমার জীবন।
: জীবন কী রকম? কতো প্রকার? আর উত্তরগুলো সহজ?
: তোমার কাছে হয়তো সহজ। তুমি আপোস করো না। নাহলে এমন এক রোখা হতে না।
: জী...বন! তোমার কাছে ঠিক একই কথা। ওই দেখো, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
: থেমে যাবে, শরতের মেঘ। কিন্তু তোমার মনটা টানা খরা, অথবা বর্ষার মতো একই প্রবাহে।
: কী করবে, কী করবে তুমি আমাকে পেলে? ল্যাংটা হবা? নিজে : লেংটা হয়ে আমাকে লেংটা বানাব। তারপর!
: তারপর, তারপর কী, বলো? তুমি শুনছো আমি ইতিমধ্যে চাপর মেরেছি টেবিলে আর দুটো গ¬াসই কেঁপে উঠেছে।
: হ্যা, ভেঙেও যেতে পারতো। এ তুমি পারতে, কারণ তোমার মধ্যে এখন উন্মাদনা বাস করে। হা হা হাহ.এ হাসি তোমার মাঝে কাম ছড়ায়, আবার উন্মাদনাও ছড়ায়।
: হ্যা, ভাঙতে পারতাম। কিন্তু তোমার ও হাসি, আমাকে পাগল করেছে নিশ্চয়ই। আবার শান্তও হয়েছি। ভালো। একটা সিগ্রেট দেবো তোমাকে।
: লাগলে... নেবো আমি। আচ্ছা জীবন, এই যে আমি তোমার দিকে এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি, চেয়ে আছি নিস্পলক, এতে কী অর্থ পাও।
: তোমাকে পাই।
: মিথ্যা জীবন, তুমি মিথ্যে বলছো।
: আমি মিথ্যে বলছি না।
: বাইরে তাকিয়ে কেনো? তুমি আমার দিকে তাকাও।
: এই, তাকালাম।
: তোমার চোখের পাতা কাঁপছে কেনো?
: কই, নাতো?
: তোমার চোয়াল কি শক্ত হয়ে এসেছে
: না..আ।
: তুমি পরাজিত হয়েছ। তোমাকে আরেক পেগ দেই?
: দাও।
: তুমি তো আবার র খাও; এই দেখো স্বর্ণালি জল, কলকল ঝর্ণামুখর!
: তা তুমি দেখো। এখন এমন তীর্যক চোখে চেও না।
: তোমার রাগ এখনো পড়েনি, জীবন। আচ্ছা, আমাকে নেবে কয় মিনিটের জন্য?
: মানে উপরে যদি আমাকে নিতে চাও, সেখানে কতক্ষণ তোমার সাথে থাকতে হবে?
: এই...পাঁচমিনিট।
: না, পাঁচমিনিট না। আমি একমিনিটও থাকতে পারবো না তবু তোমার যেহেতু আব্দার, আমি না হয় মিনিট পাঁচেক থাকলাম তোমার সাথে। তো এই পাঁচমিনিটের জন্য তুমি পঁচিশ হাজার টাকা খরচ করবে? তুমি জানো, চন্দন আবাসিকের একটি বুকিংয়ের দাম কতো আর দেশে কতো মানুষ না খেয়ে আছে, দেখছো?
: কিসের মধ্যে কি নিয়ে আসলে হঠাৎ? তারচে বরং বৃষ্টিগুলো ভাগ করে খাই, চলো উপরে উঠি।
: যেতেই হবে?
: চলো না।
: এই, তুমি হাত ধরছো যে!... দেখো, এখানেই তুমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছো। যাক, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আচ্ছা, তোমার ব্যবসাপাতি কেমন যাচ্ছে?
: এই যাচ্ছে!
: কেনো, তোমার তো এখন রমরমা ব্যবসা হওয়ার কথা। পৃথিবীর অনেক দেশেই যুদ্ধ নগ্নতার সভ্যতা রূপে প্রকাশ পেয়েছে বেশি। তোমার তো অস্ত্রের ব্যবসা আরও জমে উঠার কথা।
: সে জন্যই জমছে না তেমন। এদিকটায় এখন সরবরাহ কম। তাছাড়া ভারত সংগ্রহ করছে বেশি।
: এ রকম কম পাওয়া জনমানুষের জন্য হীতকর।
: হাসালে, মৃত্যু। আসলে আমরাও জনহিতকর কাজটিই করি। মূলত করার শক্তি ও প্রেরণা যোগাই।
: শক্তি দিয়ে জয় করা যায় না, তুমি জানো।
: তাহলে কী দিয়ে যায়? তোমার কবিতা দিয়ে?
: কবিতা তো তুমিও লেখো।
: হ্যা, লিখি তো।
: এবং খুব বিখ্যাত কবি। সে তুলনায় আমাকে কেউ চেনে না।
: তা ঠিক। অথচ তুমি আমার চেয়ে কতো ভালো লেখো!
: তোমাকে আরেক পেগ মদ দেবো জীবন? আমিও নিচ্ছি, দু টুকরা বরফও নিচ্ছি সাথে।
: মদ আর না খেলেই কি নয়?
: তাহলে কি উঠবে?
: তোমাকে ছেড়ে? আশ্চর্য! অনন্ত কাল বসে থাকবো।
: হে অনন্ত অনাদি, তুমি সাক্ষী থাকো।
: এই মাতোয়ালা রাতে তুমি আবার প্রার্থনা শুরু করলে কেনো?
: তুমিই তো আমার প্রার্থনা।
: আচ্ছা, পুষ্পে ও সবুজ কুঞ্জে তোমাকে যে ভালোবেসেছিলাম, মনে আছে?
: আছে, তবে পুষ্পে নয়, শিরিষেও নয়, আকাশের রংধনু আর মেঘের ক্যানভাসে।
: তাহলে অন্তত অমন বৃষ্টিভেজারাতে, চলো।
: বাইরে?
: উপরে।
: আহা, বাইরে চলো। বৃষ্টিতে ভিজবো।
: আমি তোমার ঝড় হবো।
: হা, হা, হাহ্...তুমি আবারও ঠকলে জীবন!
: দাও, মৃত্যু, আমাকে আরেক পেয়ালা মদ দাও।
: মদই বেঁচে থাকা।
: হ্যা, মদে মজি। কবিতা বলি একটা?
: না, থাক। তারচে বরং তোমার বাসার ঠিকানাটা বলো।
: কেনো? জুলির সাথে গিয়ে দেখা করবে নাকি?
: দেখা করলে কি কোনো ভয় আছে? জুলি আমার বান্ধবী না? ওর সাথে একবছর পড়েছি। তোমার সাথেও পড়েছি। তোমাদের বিয়ে হলো। এ আমি মেনে নিয়েছি। ভাগ্য! কিন্তু কী করার আছে, তোমাকে ভুলতে পারছি না।
: ভুলতে আমি তোমাকেও পারছি না। কিন্তু কী করবো বলো? বিয়ে করে সংসারি হলাম। অস্ত্র ব্যবসাটাতেও মার খাব খাব করছে। এ অবস্থায় পুঁজি উঠিয়ে নিলে একেবারেই ধরা। এখন সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ওসব ব্যবসাপাতি ছুড়ে ফেলতে পণ হয়। পণ ভাঙি; আবার নাগরিক জীবনে ফিরে যাই। অস্ত্রের একটা বড় চালান আসছে রাশিয়া থেকে।
: আসলে অস্ত্রব্যবসাটা, সরি টু সে, আমি আমি তোমার ব্যবসার উপর তিলেক জ্ঞানও রাখি না, তবু বলছি, এ ব্যবসাটা আসলে একটা তীর্যক ব্যবসা। দেখো কেমন শত্রুকেও বন্ধ করে আর নিজেদের নোয়াজ-নওয়াজিদেরকে দেয় জব'র কারবার। এসব ভাবতে ভাবতে আমি যখন মানসিক হ্যারাসমেন্ট-এ ভুগি, তখন তুমি হয়তো নতুন কোনো চুক্তিপত্রে সাইন করছো, ফিল করছো বারুদের গন্ধ।
: হা, হা হাহ্। বিষয়টিকে এভাবে দেখো না। একটু সহজ করে দেখো। আমিও বান্ধব। তোমার অবাধ্য হইনি। আজও হবো না। আসো, উপরে আসো।
: আচ্ছা, যেতে পারি এক শর্তে। রুম থেকে ফিরে তুমি আবার আমার সাথে বসবে। এই বিহালা রেস্টুরেন্টে আমরা আরও একঘন্টা বসবো।
: আচ্ছা, অবশ্যই।
: তাহলে চলো। এই সিঁড়ি উঠবো। লিফটে এসব বৃষ্টির দৃশ্য দেখতে পাবো না। তখন হয়তো রোমাঞ্চটা থাকবে না আমাদের। থাকবে হয়তো কাম। আচ্ছা, চলো।
: চলো। দেখেছো, মৃত্যু, এখানে কতো মানুষের দুঃখ?
: ফাউ কথা, কারো কোনো দুঃখ নেই। সবই ভরং।
: তুমি কীভাবে বুঝলে?
: নেমে এসে বলবো। আচ্ছা, বিহালা রেস্টুরেন্ট তো চারতলায় না?
: হ্যা।
: পাঁচ তলায় হলে ভালো হতো। আরো কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখতে পেতাম।
: হ্যা, এই তো, দেখতে দেখতেই চলে এলাম। চার হাজার এক নম্বর, প্রিমিয়াম রুম।
: বাব্বাহ, খুব রাজকীয়!
: তোমার পছন্দ হয়েছে?
: খুব পছন্দ হয়েছে।
: তোমার পছন্দের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।
: আর কী করতে পারো? আচ্ছা, তোমার কিন্তু পাঁচমিনিট সময় অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে।
: হ্যহ হ্যহ হ্য, তুমি কি স্টপওয়াচ চালু করে রেখেছো নাকি?
: হুম।
: একটু বসবে না?
: হুম, বসবো তো অবশ্যই।
: এসো, প্রিয়তমা।
: সেকি! আবার হাত ধরেছো। আচ্ছা, ধরো।
: জরিয়ে ধরার কথা ছিলো।
: ধরছো না কেনো?
: সত্যি?
: তুমি কি আমাকে মৃত ভাবো? আমারও কাম আছে।
২.
: কেরুর অর্ডার করবো? তুমি তো আবার এ ছাড়া অন্য ব্র্যান্ড নিতে চাও না।
: না, একটু চুপচাপ বসো। ...আচ্ছা, জীবন! এই যে আমরা এতক্ষণ চন্দনের প্রিমিয়ামে ছিলাম, তুমি যা যা চেয়েছো সব দিয়েছি। হয়তো নিয়েছিও। আচ্ছা, তুমি কি মনে করো এখন আমরা একঘন্টা এক সাথে বসে থাকতে পারবো?
: কেনো নয়, অবশ্যই পারবো।
: না জীবন, পারবে না। পারবো না আমিও। দেখো।
: নাও, সিগারেট খাও।
: কী সিগারেট?
: ট্রেজারার।
: আমি ট্রেজারার খাই না।
: সেকি, এতক্ষণ না খেলে। উপরে উঠার আগে তো চারপ্যাকেট ট্রেজারারই পুড়লাম।
: হ্যা, খেয়েছি। তখন তো তুমি মদ নিয়েও প্রশ্ন তোলোনি।
: কী রকম?
: ওই যে বললে, ‘তুমি তো আবার এছাড়া অন্য কিছু নিতে চাও না।’ তার মানে তুমি অন্য কিছু খেতে। হয়তো অনেক দামি, তোমার ওই ট্রেজারার সিগারেটের মতো। কিন্তু বিশ্বাস করো জীবন, আমি এই কেরুর হুইস্কি আর গোল্ডলিফ সিগারেট ছাড়া অন্য কিছুতে মজা পাই না।
: গোল্ডলিফ সিগারেট আনিয়ে দেবো?
: না, দরকার নেই। মজা করলাম, দাও একটা ট্রেজারারই দাও।
: কেরু আনাবো:
: না, আজকে বরং তোমার ব্র্যান্ডটা খাই। তুমি কী খেতে পছন্দ করো?
: ইয়ামাজাকি।
: জাপানি ব্র্যান্ড?
: হুঁ।
: আচ্ছা, জীবন! আমাকে তোমার কী মনে হয়? নিছক বেশ্যা?
: কেনো? হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো?
: না, এমনিতেই জানতে চাইলাম। ...হা...আ। আমার ঘুম পাচ্ছে কেমন।
: ইয়ামাজাকিটা ভালো জিনিস। মুহুর্তেই চাঙ্গা হয়ে যাবে।
: না, বেশি ভালো লাগেনি। মিষ্টি লাগে। মদ যদি মিষ্টিই লাগবে তাহলে আর মদ খেয়ে লাভ কী? একটু জ্বলতে হবে, একটু পুড়তে হবে।
: মৃত্যু, তুমি না, আসলে জীবনটাকে এভাবে চিন্তা করো। জীবন কিন্তু অন্যরকমও হতে পারতো।
: হুঁ, পারতো তো। কিন্তু তুমি বলো, তুমি থাকলে আজ আর আমার এই পরিণতি হতো?...তুমি বিয়ে করলে, আমারই বান্ধবিকে! হ্যা, বিয়ে অবশ্য আমিও করেছিলাম। টেকেনি।
: সে কথা মনে করে ঘা দিও না।
: ঘা দিচ্ছি না। তোমার কি মনে হয় না আমি তোমার জন্য সংসার করতে পারিনি? সারাক্ষণ শুধু তোমার কথা ভেবেছি, স্বামীকে সময় দিতে পারিনি মন থেকে। তারপর ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন আমি এলিটদের সখের সামগ্রি। নাম পাল্টে মিতা থেকে হয়েছি মৃত্যু;Ñবড় লোকেরা ডাকে মৃ। অবশ্য তুমি আমাকে মৃত্যুই ডাকছো।
: আমি কিন্তু তোমাকে সেভাবে ভাবি না।
: তাহলে কীভাবে ভাবো? তুমিও তো আমাকে উপরে নিলে।
: সেটি আমি ভালোবাসা থেকে নিয়েছি।
: না, তুমি ভালোবাসা থেকে নাওনি জীবন। আমাকে ছাড়াও তুমি অনেক বিলাসীনীকে নিয়ে গিয়েছো। আমিও গিয়েছি অনেক এলিটদের সাথে। কিন্তু অন্য দিনের যাওয়া এবং আজকের যাওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে।
: তফাত তো আমার পক্ষ থেকেও থাকতে পারে। বুঝতে কেনো পারছো না?
: এই তো , দূরত্ব শুরু হচ্ছে। জীবন, এখন আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না, একটু পরে তুমি আমাকে বুঝতে পারবে না। আসলে আমরা বুঝতে চাচ্ছি না আর পরস্পরকে। আমাদের যেটুকু বুঝার তা হয়ে গেছে। তাই আমাদের ক্লান্তি লাগে। জীবনানন্দের ভাষায়, ক্লান্ত, ক্লান্ত করে...।...জীবন, তফাৎ হয়তো তোমার নেয়ার মধ্যেও ছিলো। হয়তো প্রেমই ছিলো সেটি। কিন্তু তবু তো তুমি আমাকে ঘরে নিতে চাইলে না, চাইলে চন্দন আবাসিকের প্রিমিয়ামে।
: চলো উঠি।
: সেকি! পাঁচ মিনিটও তো হলো না?
: না মৃত্যু, পঁচিশ মিনিট হয়ে গেছে।
: কিন্তু আরও পয়তাল্লিশ মিনিট তো বাকি আছে?
: ঠিকাছে, বসো।
: না, তারচে বরং চলো যাই। আমারও ক্লান্ত লাগছে খুব। ঘুমোবো।
ঘুড়ির আকাশে ঘুরি...
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ঘুড়ির আকাশে ঘুরি...
মোঃ তাইব হাজারী
আমার ঘরের বাতিটা নষ্ট হয়ে আছে বেশ কিছুদিন যাবত । সারাদিনে এই কথাটি একবারের জন্য হলেও আমার মনে পড়ে না। ছোট বেলায় একটা গল্প প্রায়ই আমার দাদির মুখে শুনতাম। মাঘের শীতে নাকি শিয়ালের খুব কষ্ট হয়। রোজ রাতের বেলা শীত অসহ্য হলে শিয়াল মনে মনে ভাবে যেভাবেই হোক সকাল হলেই লেপ কাঁথার জোগাড় করবো। কিন্তু সকালে রোদ উঠলেই শিয়ালের আর সে কথা মনে থাকে না। আমারো হয়েছে সেই গল্পের শিয়ালের মতো দশা। তবে অন্ধকার ঘরে থাকতে যে খারাপ লাগে তা কিন্তু নয়। চলতে ফিরতে সমস্যা হয় প্রথম একটু আধটু। অন্ধকার ঘরে প্রথমদিন কেউ থাকলে তার মনে হবে কেউ হয়তো তার গলা টিপে ধরছে! দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন হাঁসফাঁস অবস্থা। বেশ কিছুদিন থাকলে সেই সমস্যার সমাধানও হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোনোকিছুই স্থানী নয়। আমাদের সমস্যাগুলোও না। আজকে রাতে ঘরে বাতির প্রয়োজন অনুভব করছি কারণ আমার মাথায় ঘুড়ি বানানোর হুজুগ এসেছে। সাঁইত্রিশ বছরের একটি লোকের প্রকাশ্যে ঘুড়ি বানানোর অধিকার নেই। পাশের রুমের বাতেন ভাই দেখে ফেললেই বলে বসবেন রিপন তোমার বয়স দিনকে দিন নিচের দিকে নামছে ! এখন সম্ভবত চৌদ্দ পনের হবে কী বলো?
উনি এমনই। কয়েকদিন আগে বৃষ্টির ভেতর অল্প বয়সী ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলছি এমন সময় বাতেন ভাই ছাতা মাথায় আসছিলেন। আমাকে দেখেই ডেকে নিয়ে একগাদা কথা শুনিয়ে দিলেন। আপাতত তার ভয়েই দিনের বেলা ঘুড়ি বানানো হচ্ছে না আমার। এদিকে রাতে ঘরে বাতি নেই। আজ আর ঘুড়ি বানানো হবে না। অন্য কোনো সময় হলে নিউমার্কেট গিয়ে একটা ঘুড়ি কিনে নিয়ে আসা যেত। সারাদেশে এখন লকডাউন চলছে। ঘর থেকে বের হলেই পুলিশি জেরায় পড়তে হচ্ছে। স্থান বিশেষে সেনাবাহিনীর লাঠির আঘাতে কারো কারো পশ্চাৎদেশে কালশিটে পড়ে যাচ্ছে। অথচ অতদিন ঘুড়ি কেনার সহজ সুযোগ ছিল কিন্তু আমার ঘুড়ি উড়ানোর সময় হয়ে উঠেনি। সময় হয়ে উঠেনি কথাটা সম্ভবত ভুল হলো। ইচ্ছে থাকলেই সময় হয়ে উঠে। অফিসের নিয়মে বাঁধা কর্মঘণ্টার বাইরে যেটুকু সময় পাওয়া যায় তাতে আর কৈশোরে ফেরার পাগলামি করা হয়ে উঠে না। পৃথিবীর বর্তমান দূর্যোগে ঘরে বন্ধ দিনগুলোয় যখন মন হাপিত্যেশ করছে তখন এমন ইচ্ছাকে নিজে নিজেই সাধুবাদ জানাতে ইচ্ছা করছে। আমার নিজের কাছে যদি কোনো কাজ ভালো মনে হয় এবং সেই কাজ যদি আমি নিজেই করি তাহলে নিজেই নিজেকে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ দেই। কে কবে কোন কাজের জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেবে সেই আশায় তো উৎসাহে ভাঁটা ফেলতে পারিনা। তাই নিজে নিজেই এই উপায় বের করে নিয়েছি। তাতে কে কী বললো শোনার দরকার নাই আমার। আজ আর নিজেকে ধন্যবাদ দিতে পারছি না। বরং নিজেকে এখন একখানা কাগজের ঘুড়ির জন্য তিরস্কার দিতে ইচ্ছে করছে।
যখন যে জিনিসটা পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে তখন তার প্রতিই মানুষের অনুরাগ আর আক্ষাঙ্খা প্রবল হয়।
পুরো পৃথিবীর মানুষ এখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। একটি ভাইরাস আজ পৃথিবীর মানুষের সব সাফল্যের অহমিকাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাসের প্রকাশ ও বিস্তার হলো। প্রথম প্রথম চীন সরকার ভাইরাসটির কারণে সেদেশে মৃত মানুষের সংখ্যা গোপন করতে থাকে। মারাত্মক ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণে উপসর্গ হিসেবে সর্দি কাশি জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হয়। সাধারণ ফ্লুর মতো উপসর্গ হওয়ায় বিশ্বের তাবড়-তাবড় দেশগুলো প্রথমে পাত্তা দেয়নি করোনাকে। বাংলাদেশের এক জেনৈক মন্ত্রীই ঘোষণা করে বসলেন আমরা সম্মিলিত জাতি করোনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তখন সবারই কম বেশি মনে হচ্ছিল করোনা কারো কিছু করবে না।
কিন্তু যত দিন গড়ালো করোনা ততই শক্তিশালী এবং প্রাণনাশী হয়ে উঠল। চীনের সাথে সারাবিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্র ধরে খুব কম সময়ের মধ্যে সারাবিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল। করোনা বৃদ্ধ রোগীদের জন্য খুবই খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করে বসল। তাছাড়া যে সব লোকের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রোগ আছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের জন্যও করোনা ভয়াবহ হয়ে উঠল। চীনের পর ইতালি স্পেন জার্মানীতে করোনার ভয়াল থাবা পৃথিবীবাসীকে বিচলিত করে তুলল। তারপর তার থেকে রক্ষা পেলো না যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ফ্রান্সের মতো দেশগুলোও। স্বল্প সময়ে পুরো পৃথিবীতে মানুষের আতংকের নাম হয় উঠল করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাস তখন মর্যাদা লাভ করলো ডঐঙ থেকে। ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরংধঃরড়হ কোভিট -১৯ নাম দিলো। কোভিট- ১৯ আক্রান্ত রোগীর সর্বশেষ অবস্থা ক্রোনিক নিউমোনিয়ায় সারাবিশ্বে মরতে শুরু করল প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ। পৃথিবীর মস্ত বড় বিজ্ঞানী ডাক্তার নার্সদের ঘুম হারাম হয়ে গেল মূহুর্তের মধ্যে। বার বার জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে করোনা তার প্রতিষেধক তৈরীর সমস্ত চেষ্টাকে ভেস্তে দিতেই থাকল। জেনেটিক পরিবর্তনের সূত্রেই পরবর্তীতে শিশুরাও আক্রান্ত হতে শুরু করল। প্রতিষেধক যেখানে নেই প্রতিরোধই সেখানে একমাত্র উপায় মেনে পুরো পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউন জারি করলো সরকার। করোনা মোকাবিলা নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের জের ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা রোজ হাসির পাত্র হয়ে উঠলেও সেই হাসিতে তো ছিন্নমূল মানুষের পেট চলে না। তাই কাজের খোঁজে আর সাহায্যের আশায় করোনার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে এসব মানুষ বের হচ্ছে প্রতিদিনই। সরকার দিনরুজি মানুষের জন্য যে ত্রাণের বরাদ্দ দিলো সেই ত্রাণের চাউল দেশের জনপ্রতিনিধিরা চুরি করে নিলো! ক্ষমতাসীন দলের নেতা, চেয়ারম্যান মেম্বারের গোপন আস্তানায় পুলিশের তল্লাশিতে বের হতে লাগল টন টন চাউল। দেশের এমন পরিস্থিতিতে যারা গরিবের হক মেরে খায় তাদেরকে যে পশুর সাথে তুলনা করা হবে সেই পশুরই জাত যাবে। ভোটের সময় শুধু ধোয়া কাপড়ে আতর মেখে চারিত্রিক শুদ্ধতা প্রচার করলেই হলো। এখন দেশের মানুষ গোল্লায় যাক। এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার বালাই বলেও কিছু নাই। যদি থাকতো তাহলে এই সব চোরেরা প্রতিনিধি হতে পারতো না। দ্বিতীয়ত্ব করোনা মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগ জানা সত্ত্বেও দল বেঁধে আড্ডাবাজি না করলে এদের কারো পেটের ভাত হজম হয় না।
সরকারি বেসরকারি সব অফিস আদালত বন্ধ। ওষুধ মুদিখানা আর কাঁচামালের দোকান ব্যতীত সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বার বার বলা হচ্ছে সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ছিন্নমূল লোক রাস্তায় বের হচ্ছে নিছকই পেটের দায়ে আর কিছু পাতি আমজনতা রাস্তায় রঙ তামাশা করে বেড়াচ্ছে কোন আগ্রহে তার কোনো সঠিক ব্যাখা নেই। হুজুগে বাঙালি না দেখে শিখবে আর না ঠেকে শিখবে। ভাব খানা এমন যে যারা জন্ম থেকেই বিদ্যাসাগর তাদের সামান্য করোনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু থাকতে পারে না। তাদের জানা উচিত করোনা কিন্তু পাগল ছাগল কিছু মানে না। তখন যে দাঁত কেলিয়ে বলবেন আমি পাগল ছাগল মানুষ আমারে ছেড়ে দাও বাপু করোনা। নাহ, সেটা হবে না।
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহআপাতত ঘুড়ি বানানোর কাগজ কাঠি আর আঁঠা গুছিয়ে রেখে দিলাম। বাতেন ভাই আমার অফিস কলিগ। দুজন পাশাপাশি দুইটা রুমে ভাড়া থাকি। আমি এমনিতে স্মোক করি না। তাই সিগারেট কেনার বালাইও নাই। মাঝেমধ্যে বাতেন ভাইয়ের থেকে নিয়ে খাই। কখনো অর্ধেক পোড়া সিগারেট বাতেন ভাই কাউকে দেন না, দিলে পুরোটাই দেন। আমি গিয়ে বাতেন ভাইয়ের কাছে এক শলাকা সিগারেটের আবদার করলাম। বাতেন ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন কী ব্যাপার তোমার মন খারাপ নাকি? বাতেন ভাই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন বলে লজ্জিত হলাম। অথচ মন খারাপ কম বেশি সবারই হয়। এখানে লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো ব্যাপার নেই। আমি বাতেন ভাইয়ের কথায় শুধু ঘাড় নাড়লাম। বাতেন ভাই বললেন তামাক হচ্ছে শরীরের বিষ। খারাপ অভ্যাস না করাই ভালো। তারপর প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন এক শ্রেণীর লোক আছে যাদের জীবন অন্যকে ভালো হওয়ার উপদেশ দিতে দিতেই কেটে যায়, তারা নিজে ভালো হওয়ার সময় পান না। কথাটি কার বলতে পারবে? আমি থমথম খেয়ে বললাম আপনার। বাতেন ভাই মুচকি হেসে বললেন কথাটি হচ্ছে সাহিত্য সম্রাট হুমায়ুন আহমেদের। এই যে আমি নিজে একজন চেইনস্মোকার অথচ তোমাকে উপদেশ দিলাম সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তৈরী করো না। কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? আমার থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে লাগলেন, সাহিত্যের প্রতি একটু অনুরাগী হও। জীবনের অর্থকে খুঁজে পাবে এখানে। বাতেন ভাইয়ের কাছে জোড়াগোল খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার অন্ধকার ঘরে কোথায় কী রাখা আছে আমি জানি। টেবিল থেকে লাইটার খুঁজে নিয়ে সিগারেট ধরালাম। জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। বাতেন ভাই ঠিকই বলেছেন। আমি সাহিত্য বুঝি না। এই যে আমার এখন মনে বাজছে-
পৃথিবীটা সুস্থ হলে
তুমি আমি ফের আরেকবার দেখা করবো।
আমার জন্য রবি বুধের মাঝামাঝি
একটি বিকেল রেখো।
অথচ আমার সাথে সেই বিশেষ কারো কোনো দেখা হয়নি। তার কাছে কোনো বিকেলের প্রার্থনা সুস্থ পৃথিবীতেও কোনোদিন করিনি। কোনো কোনো ব্যাপারে অধিকারের প্রয়োজন পড়ে। আমি আজ অবধি সেই অধিকারের হদিস করে উঠতে পারিনি। আর রবি অথবা বুধবার আমার কাছে বিশেষ কোনো দিনও না।
পরেরদিন ঘুড়ি তৈরির কাজ শেষ হলো।
প্রথমদিন যখন আমি লাটাই নিয়ে ছাদে ঘুড়ি উড়াতে বসলাম তখন আশে পাশের ছেলে বুড়োরা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যেন আমি একজন অপরাধী যে কিনা কিছুক্ষণ হলো জেলের প্রাচীর টপকে অথবা পুলিশের ভ্যান থেকে পালিয়েছি! পাশের বাসার এক মহিলাকে বলতে শুনলাম এমন দূর্যোগের দিনে আধবুড়োর কান্ড দেখে অবাক হতে হয়! মানুষের স্বভাব হচ্ছে যখনই কেউ ভালো কাজ করে আশেপাশের লোকজন তার সমালোচনা করে। তারপর তাকেই আবার অনুসরণ করতে থাকে। আমি দমে গেলাম না এতটুকুও। রোজ সকাল বিকেল দুই বেলা করে ভাড়া বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াতে থাকলাম। সপ্তাহ না ঘুরতেই একজন দুজন করে আশেপাশের প্রায় সমস্ত বাসার ছাদে ছেলে বুড়োর দল ঘুড়ি উড়াতে শুরু করল! নিয়ম ভেঙে কোনো কিছু শুরু করাটাই কঠিন, একবার শুরু হলে চলতেই থাকে। বিকেল হলে এখন আমার চারপাশের আকাশটা নতুন করে সাজে। মূহুর্তেই আমার মন মৃত্যুভয়ের আড়ষ্টতা মুছে ফেলে ঘুড়ির সাথে আকাশে ভেসে বেড়ায়। খুশীরা ঘুড়ির মতোই এঁকেবেঁকে চলে। আমরা যতসময় খুশি থাকি ততটুকুই বাঁচার স্বাদ পাই।
পদাবলি : ০১
তোমার কাছে
তমসুর হোসেন
যতবার তোমার কাছে যাই শুধু হোঁচট খেয়ে বেদনার কাজলে
সিক্ত হয়ে ফিরে আসি জনহীন নিরালায়
ঘাঘটের পুরণো মঠের ব্রতচারি ঋষির মতো
আত্মদ্রোহে ফেটে পড়ি শোকের উত্তাপে।
প্রশস্ত মাঠের পারে সাদা বকেরা পাখায় রোদ মেখে তৃপ্ত হয়
সতেজ নিশ্বাসে বুক ভরে ডানা মেলে উড়ে যায় আপন নীড়ের উষ্ণতায়
তোমার দেয়া অনুপম কষ্টগুলো দু’হাতে ছড়িয়ে দিয়েছি সবুজ ঘাসে
আশ্বিনের ফুরফুরে মেঘে।
উঁচু পাঁচিল ঘেরা ছায়াঢাকা বাড়ির প্রান্তঘেঁষে লজ্জাশীলা বালিকার
বাড়ন্ত দেহের মতো বিকশিত গ্রামের বাজার
নিশব্দে চলে গেছে দূরের লোকালয়ে আঁকাবাঁকা মাটির সড়ক
তোমার মধুর স্মৃতি স্বপ্নভেজা সেই পথে খুঁজে ফিরি রোদপোঁড়া সারাটা প্রহর।
এভাবে কতদিন পুঁড়ে পুঁড়ে ক্ষয়ে যাব স্মৃতির বিবর্ণ অঙ্গারে
আমার ললাটে অগোচরে খোদাই হয়ে গেছে বেদনার দীর্ঘ ইতিহাস
মৃত্তিকার অন্ধকারে সুকুমার বোধগুলো পুতে রেখে
শূন্য হাতে আপন নিলয়ে অশ্রুভেজা চোখে ফিরে আসি আমি।
জোছনার আঁচল
আদ্যনাথ ঘোষ
রাত্রির গায়ে জড়িয়েছিল জোছনার আঁচল।
এই আঁচল কে ধরেছিল?
এবং একটি প্রজাপতি
আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে এঁকেছিল রঙিন আলপনা।
দহনে মাতাল প্রজাপতি
রাতের আলোয় আলপনায়
খুঁজেছিল প্রণয়ের ডালা।
আর এরই সাথে পাখিদের নীরবতায়
নির্জন ছিল রাত্রি-কুসুম।
কাঁপা কাঁপা স্বরে পুড়ে গেল
জোছনার আঁচলখানি
আর মনে হলো রাত্রিভোরে সেজেছিল
প্রসন্ন স্বপনের বাসরকুঞ্জ।
মেয়ে-টি তার মা- এর অনুরূপ
মনিরুজ্জামান প্রমউখ
থুতনি’র প্রকাশ, চাহনির তেজস্বতা,
কথনের দায়-ভার যেমন তার ।
চলনের দৃঢ়তায়- অনুভূতির সকল ধাপে,
তার জননীর অবয়ব প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে ।
উচ্চতার উচ্চতায়ও এক ।
অন্য-তার প্রবাহে ফুরসৎ থাকলেও
মেয়ে-টি তার মা’- এর অনুরূপ।
ইদানীং আমার নেশা
নেহাল অর্ক
ইদানীং আমাকে খুব নেশায় ধরেছে
নিষ্কলঙ্ক চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আঁকার নেশা;
নদীরস্রোতের বাঁধভাঙা টানে নিরুদ্দেশ হওয়ার নেশা
কারো চোখের গভীর মায়ায় ডুবে যাওয়ার নেশা।
ইদানীং আমি বনে যাই খুব
আমি কারো টুলের মায়ায় পথ হারাই রোজ;
আমি দেখি লাল টুকটুকে স্বপ্নের গায়ে সংশয়ের আহাজারি
কুয়াশার ঘেরাটোপে রাতের জড়োসড়ো অঙ্গভঙ্গি।
অতঃপর, আমি পরিভ্রাজক হই
অপভ্রংশ থেকে ভাষা খোঁজে আনি, তারপর
প্রেয়সীর চুমুকহীন বিবর্ণ বিছানায় আঁধার নামে;
তোমাকে কেবল পরিচয়হীন রাখি
শুধু আমার নামহীন পরিচয়টুকু তোমাতে আঁকি।
বিন্যস্ত বর্ণমালা
মহাজিস মণ্ডল
কথাগুলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে
অন্ধকারের শরীর ছুঁয়ে
গড়িয়ে যাচ্ছে গভীর রাত্রি
শূন্যতার শব্দেরা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে
ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অজস্র মুখ
আর নিস্তব্ধ গ্রীবাদের আনাগোনা
তবুও জীবনের চৌকাঠে সাজিয়ে রাখি স্তবগান
আর আকাশে নক্ষত্রের বিন্যস্ত বর্ণমালা...
পদাবলি : ০২
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
উলঙ্গ রাজা
সমাজ বসু
গালিচার পরিবর্তে যদিও মাদুরের আসন ছাড়া
আজ তাঁর কিছুই নেই,
জরির জামা জুতো কিংবা টুপি-
শুধু একজোড়া পাথরের উবু সিংহের মৃত অরণ্যের
সোঁদা ঘ্রাণ ভাসে-
দেয়ালের একাধিক তেলচিত্রে।
এরকমই ভিখিরি আঁকড়ে থাকা ভাঙা থালার মত
হাঁটাহাঁটি কন্ঠস্বর ইত্যাদিতে আজো বেজে যায়
তাঁর ঝাড়লন্ঠনের কারুকাজ করা সারেঙ্গি।
ধরো আমার অন্তিম যাত্রাও তোমার দিকে
জোবায়ের সরকার
(নিবেদিত : তাসনিম ফারিয়া আশা)
ধরো, আইজ থিকা আরও কুড়ি বছর পার
এমনই বাতাস
হিম রাত
ঘেঙর ঘ্যাঙ
ব্যাঙের ডাক
ধরো
চাঁদ
কুয়াশা
অবশ হাইওয়ে
ধরো
ছুটছি
প্রিয়গান ধরে
বরাবরের মতো
তোমার দিকে
ধরো
ফোন
ক্রিং ক্রিং
ব্রেকফেইল
মৃত্যু সংবাদ হয়ে।
জল
আহরাফ রবিন
জল। কাদা। নদীর ধারেই শ্মশানঘাট-
শব-পোড়া কঙ্কালগ্রন্থি মাথার খুলি।
শ্রাবণে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি;
বৃষ্টির শীতল জল- বৃষ্টিধোয়া হাড়গোড়।
নদী; জলের ¯্রােত- উত্তাল তার ঢেউ;
কুমারীর ভরাট যৌবনের মতন।
জনম মোহ
নাসিমা হক মুক্তা
নক্ষত্রের গায়ে আধুলি মাখে
কিছু অভিমানের জল তৃষা
মনের চৌকাঠে ডুবুরি হয়ে মেদুর মৌতাত
গলা উচু করে আকাঙ্খার যাত্রী- পোষাকে
ভোগ-পথ্য নিষ্প্রাণের মত দীর্ঘতম অপেক্ষায়
ডাগর- ডাগর চোখে কাক-কাক করে
গাছ থেকে ডগার সারস!
ফেরার পথে পা আটকে ধরে
এক টুকরো- জনম মোহ
যার পর্দায় প্রেমহীন সোনা মাছি নেশার উজ্জ্বলে
টুকরো টুকরো বরফ গুলানো মুখে
নিভৃতে- জীবন ছাইপাঁশ, জীবন ছাইপাঁশ বলে
চাষ করে অতৃপ্তির চিবুক
পরচুলা সুখ লুটোপুটি খায়
অমানিশার অন্ধকারে
প্রেমহীন সংসার মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণা।
সে আসে; সে আসে না
নাঈমুল হাসান তানযীম
স্বপ্নের ভেতর দেখা দাও
কোন সে অনন্যা তুমি গো
খানিক মুহূর্তের জন্য এসে
তোলপাড় তুলে যাও
আমার হৃদয়রাজ্যে
অস্পষ্ট, আবছায়া হয়ে
কেন বারংবার এসে
যন্ত্রণা সৃষ্টি করো আমার
বুকের বাঁপাশে
আসবে তো কেন আসো না
জীবনের রাজকুমারী হয়ে
কেন আবছায়া হয়ে আসো
অধরা স্বপ্নের ভেতরে
খানিক মুহূর্তের মৌতাতে
অনধিকার
হোসেইন দিলওয়ার
বখেড়া বলয়ে পলি- জমেছে প্রাণরসে
অবৈধ খেলায় দখল হয়েছে সাম্রাজ্যে,
উত্তাপ দেখি জলজ মাটির কলসে!
তৈলাক্ত দহনে আজ সুখ পরিত্যাজ্য।
মুক্তির ত্রিশূল যেন অসুরের হাতে-
সপ্রতিভ মহিমায় আশ্চর্য সফেন,
সব খায় ছিঁড়ে খুঁড়ে ধারালো ইস্পাতে-
চুপসে যায় জীবনের বিশুদ্ধ লেনদেন!
সমস্ত শান্তির দূত ঘুমায় কবরে-
অনধিকার প্রবেশে চলে বলাৎকার,
নেতৃত্বের হাহাকার অবনি চত্বরে-
পথে প্রান্তরে লক্ষিত- বেসুরো চিৎকার।
সমস্বরে দানবেরা গেয়ে যায় গান-
বাঁচার তাগিদে কাঁদে মানবিক প্রাণ।
একলা একা
মমতাজ রোজ কলি
বড্ড ভারী বিপরীত পাল্লাটা...
রোজ উল্টে পাল্টে দেখি- অসম ছিদ্রের খোঁজে।
তবু বেহুশে গাছ নির্দ্বিধায় হাঁটে ছাঁটা ডাল নিয়ে বুকে।
কেউ ভালো নেই। প্রকৃতিও পিপাসিত আজ...
কোথাও কেউ নেই- বটের ছায়ায় বিলি কেটে
বেঙ্গমা বেঙ্গমীর সোনার কাঠি রুপার কাঠির সন্ধান দেবার।
সব আলাদিনের চেরাগে পুড়ে পুঁতে রাখে
উচ্চাকাক্সিক্ষত পাঁজরের মাংসল খাদে।
যেন তালগাছ হয়ে বেড়ে ওঠে একলা একা!
সব গাছ ছাড়িয়ে...
ঝড়
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ঝড়
মুহাম্মদ বরকত আলী
মোরগ ডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে মিতু। বাড়িতে অনেকগুলো মুরগির মধ্যে বেশ মোটা তাজা একটা লাল মোরগ আছে। প্রতিদিন ভোরে কুকরুকুউউ করে ডেকে ওঠে। সেই ডাকে জেগে ওঠে খুশিদা খাতুন। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে। গরুকে খেতে দেয়। এরই মধ্যে ঘুম ভাঙ্গে হাসেমর। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে। পান্তা ভাত খায়। দুটো মরিচ, পেয়াজ আর একটু লবন দিয়ে গবাগব পান্তা ভাত খেয়ে লাঙ্গল জোঁয়াল কাঁধে ফেলে গরু দুটো তাড়িয়ে ছোটে মাঠের দিকে। এই হল নিত্যদিনের রুটিন। মিতু ওঠে সকালে। কিন্তু আজ সে ভোরেই উঠেছে। মনে হয় রাতে ঘুম হয়নি। খুশিদা খাতুন চুলার কাছে ভিড়েছে। হাত শেমায় রান্না করা হয়েছে। মা মেয়ে এই কদিন ধরে হাতে দিয়েই তৈরি করেছে সেমাই। ময়দা ভিজিয়ে হাড়ি বা ঘটি উপুড় করে এক ধরনের বিশেষ কায়দায় হাতের সাহায্যে এই সেমাই তৈরি করা হয়। এরপর দু একদিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। গায়ের সকলেই এই সেমাই তৈরি করেছে। পহেলা বৈশাখে এই সেমাই তৈরি করার একটা রেওয়াজ আছে।
আজ পহেলা বৈশাখ। তাই বাড়িতে এত আয়োজন। শুধু মিতুদের বাড়িতেই না, সারা গায়ে, সারা শহরে, সারা দেশেই কত্ত আয়োজন।
মিতু ঢাকঢোল মার্কা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে। একটা ছোট কলসি নিয়েছে কাখে। কলসিতে আলপনা এঁকেছে মিতু নিজেই। হাতে পায়ে আলতা দিয়েছে। কিছুক্ষণপর বের হবে মঙ্গল সোভাযাত্রা। গ্রামের স্কুল থেকে একটা র্যালি বের হবে। শহরের বড় র্যালির সাথে একত্রিত হবে।
সকালের সূর্য উঠেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে পড়ছে মিতুদের উঠোনে। হাসেম উঠানে বসে বাঁশ কাটছে। দঁড়ি পাকাচ্ছে। ঘরটা একটু মেরামত করতে হবে। আজ মাঠে যাবে না। আজকের দিনটার জন্য কাজ আপাতত বন্ধ। আগে ঘর এরপর মাঠ। খুশিদা খাতুন রান্না ঘর থেকে হাক ছাড়ে, ‘মিতু, মা মিতু, একটু সেমাই মুুখে দিয়ে এরপর যাস মা।’
মিতু সাজগোজ করে বাইরে আসে। রান্না ঘরে যায়। মায়ের কাছে গিয়ে বসে। আবদার করে, ‘ওমা, চুলটা একটু বেধে দাও না। দেরি হয়ে যাচ্ছেতো’
খুশিদা চুলোয় লাকড়ি ঠেলে দিয়ে বলে, ‘ইমা, আমার মেয়েকে কত্ত সুন্দর লাগছে গো।’ মেয়ের সাজ দেখে খুশিদার ভালো লাগে। আনন্দ হয়।
মেয়েকে কাছে বসিয়ে চুল বেধে দেয়। শাড়ির কুচি ঠিক করে দেয়। এরপর গরম সেমাই কিছুটা মুখে দিয়ে বের হয় মিতু।
খুশিদা তাকিয়ে থাকে মেয়ের চলে যাওয়ার পথে। একমাত্র মেয়ে। ছোট সংসার। খুশিদার মনেপড়ে যায় এই শাড়ির জন্য গতবছর মেয়েটা কতই না কান্নাকাটি করল। কিনে দিতে পারেনি। গত বৈশাখে মেয়ের আবদার ছিল একটা মাত্র বৈশাখী শাড়ি চায়। ঢাকঢোল ছাপানো শাড়ি। কিনে দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি সেবার। সারাদিন কিচ্ছুটি মুখে করেনি। খুশিদা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিল, ‘পরের বার কিনে দেবো। কথা দিচ্ছি। তোর বাপ না দিলেও আমি কিনে দেবো।’
খুশিদা কথা রেখেছে। মুরগির ডিম বিক্রি করে টাকা জমিয়েছে। কথা সে রেখেছে। এসব কথা মনে হতেই চোখের কোনে এক ফোটা জল এসে হাজির হয়। আচঁল দিয়ে চোখ মুছে।
মিতুর বাড়ি ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। বাড়ি এসে মাকে গল্প শোনায়। মঙ্গল সোভাযাত্রার গল্প। কত্ত মানুষ লাইল ধরে রাস্তায় বের হয়েছে। নানা রকম পোশাক পরা। কেউ কৃষক সেজে হাতে হুকা নিয়ে বের হয়েছে। আবার কেউ নতুন বর বৌ সেঁজেছে। কত্ত রকমের সাজ। ঢাকঢোল বাজিয়ে গায়ছে বৈশাখী গান। শহরের বড় বড় কর্তরা পান্তা ভাতের আয়োজন করেছে। পান্তাভাত, পেয়াজ, মরিচ, আলু ভর্তা যে যার মত নিয়ে খাচ্ছে। মিতু তার স্কুলের সহপাঠিদের সাথে পান্তা খেয়ে এসেছে।
বিকেলের শেষ ভাগ। হাসেম সারাটাদিন বাড়িঘর মেরামত করেছে। নতুন বাঁশ দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছে চালা। তার দিয়ে টানা দেওয়া হয়েছে চালা।
খুশিদা খাতুন বলল, ‘কি গো, মুদির দোকানে হালখাতা করতে যাবা না? সন্ধ্যে যে হয়ে এল।’
হাসেম কাজ গোছাতে গোছাতে বলে, ‘না গিয়ে উপায় আছে। যেতেত হবেই। এজন্যইত ঘরের খড়টা বদলাতে পারলাম না। দেখি ভালোই ভালোই কয়েক মাস গেলে তো হয়।’
মাঝ রাত। আকাশে গুড়–ম গুড়–ম মেঘের আওয়াজ। হাসেম ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তার মনে আগেই সন্দেহ হয়েছিল এমন কিছু একটা হবে। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা তার। পূর্বে এমন পরিস্থিতির মধ্যে অনেকবার পড়তে হয়েছে তাকে। কিছুই করার নেই। গরিব মানুুষের খেটে খেয়ে দিন চলে। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারে না। চাওয়া যায় না। গতবছর পহেলা বৈশাখের রাতে প্রচুর ঝড় হয়েছিল। হাসেমের ঘরের একদিকে চালা উড়ে গিয়ে পড়েছিল মাঠে। সেজন্যই আজ তার এত সতর্কতা। এবার যেন একই ঘটনা না ঘটে। প্রস্তুতি হিসেবে আজ সে সকাল থেকেই ঘরের মেরামত করেছে। নিজে যতটুকু পেরেছে করেছে। গুড়–ম করে মেঘ ডেকে উঠল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
খুশিদা ঘুমাচ্ছে। মিতু ঘুমে বেভর। শহরে গিয়ে অনেকটা পথ হাটাহাটি করেছে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম হয় বেশি।
হাসেম ঘর থেকে নেমে আসে উঠানে। আকাশ অন্ধকার। মেঘের গর্জন। গোয়াল ঘরের দিকে গিয়ে দেখে গরু দুটো জাবর কাটছে। পশুরা কি বুঝতে পারে প্রকৃতির কথা? ওরা ঘুমায়নি। নাকি ওরা ঘুমায় না।
হঠাৎ বাতাস শুরু হল। হাসেম ঘরে উঠল। বাতাসের বেগ বাড়ছে। খুশিদাকে না ডেকে পারল না হাসেম। এরি মধ্যে শুরু হল তান্ডব। শনশন বাতাস শুরু হল। অল্প সময়ের মধ্যে গতি বাড়িয়ে ঝড় শুরু হল। এক ঝাপটায় বাইরের যতধুলা ঘরের ভিতরে ঢুকে সব অন্ধকার করে দিলো। কিছুক্ষণপর বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির মধ্যে ধুলা ওড়া বন্ধ হয়েছে। মেঘের প্রচুর গর্জন। কাল বৈশাখী ঝড়। ঝড় বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে শুরু চলছে। বাইরে মড় মড় শব্দে গাছ ভাঙ্গার শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। হাসেম আর খুশিদা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝ ঝাপটা আসছে। সেই ঝড়ের ঝাপটায় চালা উঠে পড়ছে। এবার মনে হয় ঘরের চালা উড়ে যায় যায়। ভরসা পায় না। খুশিদা আর দায়িড়ে থাকতে পারে না। ঘরের চালা ধরে ঝুল খায়। গরু দুইটা হামবা হামবা ডাক ছাড়ে। বাতাসে সেই ডাক ভেসে আসে হাসেমের কানে। হাসেম চিন্তা করে গরু দুইটার জন্য। অবলা পশু। দুটো রুটি রোজগার হয় ওদের থেকে। ঝড় থামে না। কালবৈশাখী তার নিজের গতিতে চলতে থাকে। হাসেম পশ্চিম দিকে মুখ করে। দুই কানের কাছে হাত নিয়ে যায়। শুরু করে আজান। আজান দিলে ঝড় থেমে যায়। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শিখেছে সে। মিতু ঘুম থেকে জেগে ওঠে। বাবা আজান দিচ্ছেন। মা ঘরের চালা ধরে ঝুলে আছে। বাইরে ঝড় বৃষ্টি। মিতু কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা বলেন, ‘মিতু মা, ঘরের মাচানের তলে গিয়ে বসে থাক। ভয় নেই কো আমি আছি। যা মা যা।’
মিতু মায়ের কথা শোনে। মাচানের নিচে বসে থাকে গুটিশুটি মেরে। ঝড় থামার অপেক্ষায় থাকে মিতু।
অন্যদিনের মত আজও ভোরে মোরগ ডাকে। খুশিদা ঘুম থেকে ওঠে, গোয়ালঘরে যায়, পরিষ্কার করে। গরু দুটোকে খেতে দেয়। হাসেম বাসি পান্তা খায়। খাবার খেয়ে লাঙ্গল জোয়াল কাধে ফেলে গরু দুটোকে তাড়িয়ে মাঠের দিকে ছোটে। মিতু ঘুমিয়ে থাকে। বৈশাখের নতুন শাড়ির স্বপ্ন দেখে। সকালের সূর্য ওঠে। নতুন সূর্য। এভাবেই চলে বছরের পর বছর।
শব্দমালা : অনন্ত পৃথ্বীরাজ
শব্দমালা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
সেন্টমার্টিন
সূর্যাস্তের পেছনের গল্প পাঠের পর মনটা বিষণ্নতায় ভরে ওঠে
কোথায় পাই তুষারের হিমেল স্পর্শ! রাত নিঝুম বড্ড একাকী লাগে।
যে দেশে পাখিদের বিরহ থাকে না; সেখানে বেদ, বাইবেল, কুরআন নেই!
যে তরিতে উঠেছিলাম আমরা সেটা মাঝিবিহীন নিরুদ্দেশের ভেলা
চকিত চাহনিতে শুধু সমুদ্রের স্বাদ; অক্ষির লোনাজলে চলে বেহুলা ভাসান।
নিমগ্ন বেদনার দুঃসহ সময় আঁকড়ে দুঃখ পুশে কোনো লাভ নেই।
ব্রজেন দাশের আগে-পরে কত শত সামুদ্রিক পাখি পাড়ি দিয়েছে বাংলা চ্যানেল
সেন্টমার্টিন আর কত দূর...!
জিয়োনকাঠি
নিশিরাতে শিশুর কান্না কারও ভালো লাগে না-
কোনোদিন ভাবে না কেউ অন্তরঙ্গ সঙ্গমের পরিণতি
সন্তান; মিলনানন্দের পর অনাবিল প্রশান্তির পরশ
সম্পর্কের বন্ধন দু’জন মানুষকে আরও গাঢ় করে
উত্তরাধিকারের প্রশ্নে রক্তের স্রোত বংশ পরম্পরা
কেবল প্রবাহিত হয় যুগ থেকে যুগান্তরে...
বাউকুড়ানি
এক বছর পর তোমাকে দেখলাম-
মনে হলো, কত শত যুগ কেটে গেছে
নিজেকে আঁড়াল রেখে কী সুখ পাও!
তোমার শুভ্রতায় ধুয়ে যায় মনের পঙ্কিল
স্নিগ্ধ হাসি শ্বেত; পায়রার মতন মুগ্ধতা ছড়ায়
হৃদয়ের কাঁপন কেউ দেখে না-
অনুভবে বুঝে নিও জড়তার নীল।
তোমাকে দেখার পর যাইনি আর শোভিত কাননে
তোমার কেশের ঘ্রাণ আমার চারপাশ মোহিত রাখে।
হ্যালুস বলে যে অপবাদ মোরে দিয়েছে শিরে;
বাউকুড়ানির ঘোর কেটে গেলে-
নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো!
আল্টামর্ডান
বিমূর্ত ভাবনা, পোস্টমর্টেমের মত পোস্টমর্ডানিজম
বিক্ষিপ্ত কতগুলো অঙ্গপ্রতঙ্গ দিয়ে কী ভেবেছিলে!
সমুদ্রস্নানে জ্বালা জুড়াবে? তবে নদীসঙ্গম করে-
সমুদ্রমন্থনে যাও, দেখবে পৃথিবীর উলঙ্গ চেহারা।
লোপামুদ্রার চাঁদ তুমি, চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ বুঝে নিও
পৃথিবীর সব জীবের শ্রেষ্ঠ অঙ্গ নিয়ে দেহের অবয়ব
তুমি কী মানবী হে, ষোড়ষী নারী! আমি চিনি না তোমায়;
চিনি না এ আধুনিক সময়, বিবেক বর্জিত বেহায়া নগরসভ্যতা।
হারিকেন
এককালে রাতে গ্রামে আঁন্ধার থাকত; বিদঘুটে অন্ধকার-
সেই আঁধারে আলো হয়ে আসতো জোনাকি মেয়েরা।
তারপর এলেন রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া।
তখন থেকে এখানে একটু করে কুপি জ্বলতে শুরু করেছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ইংরেজ রাজ কোষাগারের লোভ ছাড়নি।
জোনাকি থেকে সূর্য আলো ধার নিয়ে ছড়িয়ে দিল বিশ্বময়
তারপর স্বামীজি এলেন, নবাব সলিমুল্লাহ এলেন, নাথান কমিশন হলো।
বাবা কোলকাতা থেকে একটা হারিকেন কিনলেন।
ঢাকার রেসেকার্সের পাশে হারিকেল জ্বালানো হলো।
সেই আলোতে একটা মোটা ফ্রেমের চশমায়
বাবা কাগজের জমিন দেখে পড়তেন:
‘‘কাআ তরুবর পাঞ্চবি ডাল
চঞ্চলঅ চি-এ পৈঠা কাল!!
জুয়াড়ি
এই বর্ষায় ধুয়ে দেবো যত রক্তের দাগ
তেল চিটচিটে বালিশ অথবা কর্দমাক্ত জামা।
রূপোর গ্লাসে হুইকি ঢেলে দাও।
তোমার কোমরে কার যেন হাত নড়াচড়া করে।
নৃত্যের তালে তালে জলে নেমেছি
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার পর কে বীণ বাজায়
পিঁপড়ের রাজনীতিও তোমরা বোঝ না।
হাতিকে পরাভূত করে এবার গডজিলা তারা গিলে ফেলতে চায়;
পাহাড়ের কান্না যেন শোকের নদী।
একটি রাজনৈতিক ইফতার দেবো ভাবছি-
বাংলাদেশ, ভারত ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে
জমজমাট আড্ডা হবে।
তোমার কোমরে কার যেন হাত অবিরত নড়াচড়া করে!!