পদাবলি

পদাবলি


লেট মর্নিং বেল
আরিফুর রহমান


আহা, এমনই রোদের হৃদয়ে ঘুণপোকা মেঘ জমলে শস্যবতী ক্ষেতের বুকে ছায়াদের স্মতি জমা হয়। নেচে ওঠে ধানফড়িং। ঘুড়ি ওড়া হাওয়ায় একটা সকাল পাখি দেয় বহুদূর পথ।

শরতের ঘাসে জমে উঠা শিশির উড়ে গেলে পথ ফুরিয়ে যায়। তখনই পাঁজর খামচে ধরে বয়সী বেলার খিদে।

দূর বসতি বৃক্ষে আসমানি রঙ ডানা ঝাপটালে একঝাঁক পাখি উড়ে আসে। জানিয়ে যায়, ও পাড়ার গির্জায় ঘণ্টা বাজল গুনে গুনে  দশবার।


ঠিকানা
সাইয়্যিদ মঞ্জু

অস্তমূখী পথ গন্তব্য বটতলী বাজার
ডানে ফিরেলে অন্তিম ঠিকানা
উত্তর-দক্ষিনে শুয়ে পূর্বপুরুষ
মুয়াজ্জিনের সুরেলা সুর করে শ্রবন।

প্রার্থনার স্বরে খুঁজি এই ঠিকানা
আর্তনাদের ভাষায় অন্তিম কোনো মুহুর্তের কাছে
আবারো সেই কোলাহলের ভেতরে রেখে গেছি আমাকে।


মানুষ হতে পারিনি
নাফছি জাহান

আমি মানুষ হতে পারিনি-
অবেলার স্মৃতি আঁকড়িয়ে পুনরায় তাকে
ফিরে পাবার অন্বেষণে ব্যস্ত থেকে
মানুষ হবার নিয়মাবলী হারিয়েছি বছর খানিক আগে,
আমি মানুষ হতে পারিনি আদৌ।
মানুষ হবার মন্ত্ররা সব নির্বাসনে গিয়েছে সেই কবেই
ঘূর্ণায়মান জীবনে নিজের প্রকৃত অস্তিত্বকে খুঁজে দেখিনি
তাই মানুষ হওয়ার নকশাকে আপন করতে পারিনি,
দুশ্চিন্তাগ্রস্থ এ মন- আঘাতে আঘাতে
নিরুপায় হয়ে পড়েছিল ধ্বংসস্তুপে
সামান্য জলের ছোঁয়া পেয়ে-
জীবন পেয়েছি কোনো এক উপায়ে
কিন্তু মানুষ আমি হতে পারিনি।
মানুষ হতে হলে অপরকে আঘাত করার কলাকৌশল আয়ত্বে নিতে হয়
মনুষ্যের হৃদয় টুকরো টুকরো করার বাসনা থাকতে হয়,
আমিতো এ সবের কিছুই আয়ত্ব করতে পারিনি
তাহলে মানুষ হবার দ্বিতীয় কোনো পথ কি খোলা আছে?
এ নিষ্ঠুর ভূবনে আজো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।




ভালোবাসা ভুলে গেছি
বাবুল চৌধুরী

শিকেয় তুলেছি ভালোবাসা।
একদিন নদীর দুই কূলে কলার ভেলার মতো
ভাসিয়েছিলাম তাকে –ভেসে যাক দোল খেয়ে।
চড়ায় মুখ গুঁজে দিয়েছিল সে।

শেকলে বেঁধেছি ভালোবাসা।
একদিন তাকে পাহাড় টিলা দেখাতে নিয়ে গেছি,
ফ্রক-পড়া কিশোরী আনাড়ি হেলদোল খায়
ঘাস ফড়িঙের নেশায় পাহাড়ে গড়িয়ে যায়।
স্মৃতিতে রেখেছি ভালোবাসা।
একদিন নদীকে সমুদ্র ভেবে মেতেছিল ডুবসাঁতারে
নদী ও সাগর দু’জন হলেও শেষে এক হয়ে যায়
এ কথা বোঝেনি ডাগর, হেঁয়ালি ভেবেছিল সে।

ভুলে গেছি ভালোবাসা।
একদিন ঝড়ের গল্প শুনিয়েছিলাম তাকে ভেজা সন্ধ্যায়
অপটু সে কপট ঝড়ের ঝাপট বোঝেনি
আঁচল উড়িয়ে ঝরা পাতার সাথে হারিয়ে গেছে।


বাহাদুরি খতম
মিনহাজ উদ্দীন শরীফ

উদিত শক্তি;
ক্রমে ক্রমে ক্ষয়ের সম্ভাবনা রাখে
সূর্যের আলো সর্বদা তীক্ষè হয় না
ক্ষনিকের জীবন স্বল্পমেয়াদী।

এতেই এত ভাব;
গায়ের জোরে চাঁদ ধরা যায় না
আজ গায়ে জোর আছে
কাল তো না ও থাকতে পারে।

নির্লজ্জ মানব;
সামনে মানুষ রূপীর বেশ ধরে
আড়ালে ছাইপাঁশ ইচ্ছা মতো গিলে
পাগল ছাগল ও রেহাই পায় না।

বিবেক আজ সুপ্ত;
চোখের পর্দায় মরীচিকা ধরেছে 
তাইতো ঝাপসা লাগে সব কিছু
জং ছাড়ানোর উপায় জানা নেই।

কিসের বাহাদুরি;
রঙ্গমঞ্চ বন্ধ হলেই খেল খতম
একই পথের পথিক মোরা সবে
তাহলে এতো বৈষম্যের মানে কী?


নাম
নূরনবী সোহাগ

তোমাকে দেয়া নামটা চুরি হয়ে গেছে
এই ভয়ে তোমাকে এড়িয়ে চলছি কতযুগ

সচেতন চোখ রাখি হাওয়ার বলাবলিতে
সেখানে তোমার নাম নেই
খুলে দেখি আকাশের নীলকৌটা
ছুঁতে না, ধরতে না— এমন কোথাও নয়
অথচ কোথাও হদিস নেই নামের
খেয়াল হলোÑ তবে তুমি দিব্যি সাড়া দিচ্ছো কোন ডাকে!

তোমাকে আমার যেন কোনো নামেই ডাকা হয়না
শুনছি, তোমাকে দেয়া নামটি
সাবলীল ছুটে যাচ্ছে তোমাকে ছুঁতে



জীবনী

নীলেশ গায়েন

কী হবে জীবনী লিখে ?
কেইবা লিখবে।
তার চেয়ে হারানো সময় আর স্মৃতি গুলোকে গুঁজে রাখি
অনেক গানের খাঁজে খাঁজে
মিশেই দিই প্রিয় কিছু গন্ধের কাছে।
অবসর পেলে
শুনে নিই গান অথবা শুকে নিই গন্ধ
স্মৃতিরা হয়ে ওঠে জীবন্ত ।

কী হবে জীবনী লিখে!


কে ?
মিলন মাহমুদ

কে আসে-
এভাবে পথ করে দিয়ে যায় মনিকোঠায়, চঞ্চলতায়,
শতাব্দীর মাথা খুলে নির্বাচিত করে পোকার একশো
একটি হাত, আর অজস্র বাদপ্রতিবাদ।

জানালার আলবেয়ে উঠে আসে পর্দার ছাপে ত্রিভুজ মুখ
প্রিন্ট করে দিয়ে যায় নিঃশব্দ বিষের পেয়ালা, সাজানো
পাতার ডালে,

যেখানে চাঁদের পেলবতা মাটি হয়ে নামে আর অঙ্কিত হয়
চোখের কোণে, ঐরকম শিরোনামহীন যুদ্ধ চলে আগুনে আর জলে।

কে বলে যায়-
অসময়ে বৃক্ষ ফোঁটার সংগ্রাম, নদী মরে যায়-
যায় কি তার ঢেউ?

অসুখের নামগুলো আছড়ে পড়ে আমাদের পায়ের প্যাঁচে,
যেনো আমরা জবুথবু কচ্ছপের পিরামিড
দারুণ হেসে মরতে প্রস্তুত রৌদ্র পোহাতে।

কে দিয়ে যায় গোপন মন্ত্র-
প্রেমিককে কাছে টেনে নেয় অর্ধেক মানবী
বাকিটা ঈশ্বর, তখন খুলে পড়ে বই ঘরের কপাট,

জপে জপে সাদা পৃষ্ঠার অক্ষর ধূসর হয়ে যায়
সভ্যতার যোনী থেকে শেষ পেন্ডুলাম ছিঁড়ে পড়ে।


অপেক্ষা
অতনু নন্দী

চারিদিকে নাক্ষত্রিক রোদ!  রোদ পেরিয়ে হেঁটে চলে রোদ্দুর।
বুকের বাঁদিকে দগদগে স্মৃতি;
রক্ত উঠে আসে চোখে।
সময়ের ক্ষরণে উদরে নৃত্য করে চলে একটা ইঁদুর;
পানকৌড়ি গন্ধটুকু মেখে অপেক্ষায় মৃত্যুর পলক, অমৃতের হাতছানি।

আমার নদীটি খরস্রোতা;
বৃষ্টি নেমেছে তার শরীরে।
মুদ্রনের গন্ধে মাতোয়ারা বাগিচায় ধ্রুপদী ঘরণার গজল
গেয়ে চলেছে সে ।

ফিরে আসবে বলেছিল অমাবস্যা তিথি ফুরালে,
এখনও নৌকা বাঁধা পড়ে আছে ঘাটে
স্নেহময় মাঝি উপবাসী কান্না নিয়ে গুনে চলেছে প্রতীক্ষার প্রহর !

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৩


জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
পরদিন খুব ভোরেই অন্তর প্রস্তুত হয়ে গেল। বাবাও প্রস্তুত।
মা’র মুখ মলিন। অভিমানে রাঙা। অভিমানটা বাবার ওপর। তারপরও সবকিছু বেঁধে-টেধে দিল। বড় একটা ব্যাগে শুধু খাবার। ভাত-রুটি-মাংস-সবজি-গুড়-মুড়ি-ফল আরও কত কি। কাপড়-চোপড়ের জন্য আরও দু’টি ব্যাগ। অন্তর বুঝতে পারছিল না যে, এত ব্যাগ বহন করবে কে। বাবা নিশ্চয় তার কাঁধেও দু/একটা তুলে দেবেন। এরকম ব্যাগ কাঁধে করে বন ভ্রমণ আনন্দের হবে?
নিচে নেমে অন্তর তাজ্জব বনে গেল। মা নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। তার বিস্ময়ও সীমা ছাড়িয়ে গেল। নিচে নীল রঙের একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে ড্রাইভার বের হয়ে বাবাকে স্যালুট করার মত করে সালাম ঠুকল। মা বলল, গাড়ি কোথা থেকে?
বাবা বলল, আমার বন্ধু মঞ্জুর আহসানের কাছ থেকে। সেবার অন্তরের জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে এসেছিল না?
তুমি বন্ধুর কাছে গাড়ি ধার চাইতে গেলে? মানুষ তো পায়ে হেঁটেও বিশ্ব ভ্রমণ করে।
আমি ধার চাইনি। ছেলেকে নিয়ে বন ভ্রমনে যাচ্ছি শুনে সে নিজে থেকেই গাড়ি পাঠাতে চাইল।
আর তুমি নিতে রাজি হয়ে গেলে?
না, আমি বলেছি-দরকার নেই। এতটুক পথ পাবলিক বাসেই যেতে ভালো লাগবে। কিন্তু সে আমার নিষেধ শুনল না। আর এ নিয়ে এত মাথা ঘামানোরও কিছু নেই। একটু সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে আবার বন্ধু কিসের?
ড্রাইভার বাবার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জি স্যার, জি স্যার।
 গাড়ি ছুটে চলছে গাজিপুরের দিকে। বাবা কি একটা ম্যাগাজিন বের করে তার পাতা উল্টাতে শুরু করল। অন্তরের মনে নানা প্রশ্ন। চন্দ্রা পৌছুতে কত সময় লাগবে? বনটা কি খুব বড়? শুধু কি গাজারি গাছ, নাকি অন্য কোনো গাছও আছে? সেখানে কী ধরনের পশু-পাখি আছে? হিংস্র প্রাণী আছে কি না।
বাবা ম্যাগাজিন থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল, সকাল সকাল রওয়ানা হয়ে খুব ভাল করেছি, তাই না?
ড্রাইভার বলল, জি স্যার, জি স্যার।
নাহলে মহাখালি পৌছুতেই এক ঘন্টা বসে থাকতে হত।
জি স্যার, জি স্যার।
আমার মনে হয় এদেশের ট্রাফিক জ্যাম সমস্যা কখনো দূর হবে না। উড়াল সেতু দিয়ে দেশ ঢেকে ফেললেও না।
জি স্যার, জি স্যার।
দূর হবে কী করে, যারা দূর করবে তাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে তো।
জি স্যার, জি স্যার।
আমার মনে হয়, যেদিন এদেশের দুর্নীতি দূর হবে, মানুষ সবাই সৎ হবে সেদিন আপনা থেকেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
জি স্যার, জি স্যার।
আমাদের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীদের বিশেষ ব্যবস্থায় রাস্তা খালি করে না নিয়ে যদি একদিন জ্যাম ঠেলে কোথাও নেয়া যেত তাহলে তারা বুঝতেন সাধারণ মানুষের কষ্ট।
জি স্যার, জি স্যার।
সেদিন পত্রিকায় একটা কলামে দেখলাম কলামিস্ট লিখেছেন, এ দেশের রাজনীতিবিদরা জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করে না, তারা রাজনীতি করে আপন স্বার্থে।
জি স্যার, জি স্যার।
বাবা যে কোনো প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে রাজনীতিতে গিয়ে ঠেকে। এ দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ওপর বাবার বিরক্তি চরম।
অন্তর দেখল, এ এক মহাসমস্যা। হয়ত সারা পথই বাবা একটা করে মন্তব্য করবে আর ড্রাইভার ‘জি স্যার-জি স্যার’ বলে যাবে।
অন্তর ড্রাইভারকে বলল, আঙ্কেল, আপনি কি বাবার সব কথায়ই এভাবে ‘জি স্যার-জি স্যার’ করে যাবেন?
নাহ! তা করবো কেন? যেখানে ‘না স্যার-না স্যার’ করার দরকার হবে সেখানে ‘না স্যার-না স্যার’ করব।
ধন্যবাদ আপনাকে।
বাবা আবার ম্যাগাজিন খুলল। বাবার এ ব্যাপারটাও অন্তরের ভাল লাগছে না। সে বাবার সাথে বেড়াতে বের হয়েছে। একটু গল্প-গুজব হবে অথচ.....।
হঠাৎ বাবা বলল, বিভূতিভূষনের পথের পাঁচালীর অপু বাবার সাথে সর্ব প্রথম গ্রামের বাইরে পা দিয়েছিল গরুর গাড়িতে করে, আর তুই সর্বপ্রথম বাবার সাথে ঢাকার বাইরে পা দিচ্ছিস মোটর গাড়িতে করে।
বাবার কিছু কথাবার্তা অন্তরের কাছে খুবই অদ্ভূত লাগে। অন্তর বলল, আমি বুঝি এই প্রথম ঢাকার বাইরে পা দিচ্ছি? এর আগেও তো কত জায়গায় বেড়াতে গেছি।
তখন তো তোর মা সাথে ছিল। এবারই শুধু বাবার সাথে বনবিহারের উদ্দেশ্যে.......।
তাই বলো।  
ড্রাইভার বলল, স্যার, একটা জায়গায় ভুল হয়েছে।
কোথায়?
অপু কিন্তু বাবার সাথে গরুর গাড়িতে গ্রামের বাইরে যায়নি, গিয়েছিল পায়ে হেঁটে।
তুমি পথের পাঁচালী পড়েছো?
জি স্যার। বইটা আমার প্রায় মুখস্তের মত। অপু জন্মিয়া অবধি কোথাও কখনো যায় নাই। এ গাঁয়েরই বকুল তলা, গোঁসাইবাগান, চালতে তলা, নদীর ধার, বড় জোর নবাবগঞ্জ যাইবার পাকা সড়ক এই পর্যন্ত তাহার দৌড়। মাঝে মাঝে বৈশাখ কি জৈষ্ঠ্য মাসে খুব গরম পড়িলে বৈকালে দিদির সঙ্গে নদীর ঘাটে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকিত। দিদি ঘাট হইতে উঠিলে অপু আঙুল দিয়া ঘাটের ওপাড়ের ঝাউ গাছটা দেখাইয়া বলিত-দিদি, ঐ যে ঐ গাছটার পেছনে অনেক দূর, তাই না? দিদি হাসিয়া বলিত-অনেক দূর তাই দেখাচ্ছিলি? ধুর, তুই একটা বোকা। আজ সেই অপু সর্ব প্রথম গ্রামের বাহিরে পা দিল। কয়েকদিন আগে হইতেই উৎসাহে তার রাত্রিতে ঘুম হওয়া দায় হইয়া পড়িয়াছিল। দিন গণিতে গণিতে অবশেষে যাইবার দিন আসিয়া গেল।
তাহাদের গ্রামের পথটি বাঁকিয়া নবাবগঞ্জের সড়ককে ডাইনে ফেলিয়া মাঠের বাহিরে আষাড়–-দুর্গাপুরের কাঁচা রাস্তার সঙ্গে মিশিয়াছে। দুর্গাপুরের রাস্তায় উঠিয়াই সে বাবাকে বলিল-বাবা, যেখান দিয়ে রেল যায়, সেই রেলের রাস্তা কোন দিকে?
বাবা ড্রাইভারকে থামিয়ে বললন, থাক আর বলতে হবে না। তুমি কি তাঁর এই একটা উপন্যাসই পড়েছো না আরও.........?
বিভূতিভূষনের প্রায় সব উপন্যাসই আমার মুখস্তের মত। আরণ্যক থেকে বলবো?
না, বলতে হবে না। বিভূতিভূষনের বাইরে......?
বাংলা সাহিত্যের প্রায় সবাইকেই আমার পড়া। বিশ্বসাহিত্যের অনেককেও। আলবেয়ার কাম্যু, গ্রন্টার গ্রাস, হোসে সারামাগো, গী দ্যা মোঁপাসা, অরুন্ধতী রায় আরও অনেককে আমি পড়েছি এবং পড়ছি। কাম্যু’র ‘আউট সাইডার’ আর অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অব স্মল থিঙ্কস’ আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। বর্তমান শতাব্দীতে সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক কে জানেন স্যার?
কে?
ফ্রানৎস কাফকা। একশ’জন নবেল পুরস্কার বিজয়ীর বত্রিশজনই স্বীকার করেছেন যে, তাঁরা সরাসরি কাফকার দ্বারা প্রভাবিত। অথচ......।
অথচ কী?
অথচ কাফকা তাঁর বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে লিখেছেন মাত্র চল্লিশটা গল্প, তিন/চারটা অসম্পূর্ণ উপন্যাস এবং কিছু চিঠিপত্র ও ডায়েরিতে কিছু নোট।
তোমার লেখাপড়া কতদূর?
বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স।
বাবা নড়েচড়ে বসল। অন্তরও বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে একবার বাবার মুখে, একবার ড্রাইভারের মুখে। না, ড্রাইভারের মুখ দেখা যাচ্ছে না। অন্তর তাকাচ্ছে ড্রাইভারের পিঠে। ড্রাইভারের পিঠটাই অন্তরের কাছে মুখ হয়ে উঠেছে।
বাবা বললন, বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স হয়ে তুমি ড্রাইভারের চাকরি করছো!
স্যার, সেই কৌতুকটা শুনেছেন?
কোন কৌতুক?
এক বাংলায় মাস্টার্স চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিল একটা চাকরির জন্য। নিয়োগকর্তা বলল-আমাদের গরিলার খাঁচাটা শূন্য আছে, কারণ গত মাসে গরিলাটার মৃত্যু হয়েছে। তুমি যদি গরিলা সেজে সেই খাঁচায় থেকে মানুষকে আনন্দ দিতে পার, তাহলে ভাল বেতন পাবে। নিয়োগকর্তা যে বেতনের কথা বলল, বাংলায় মাস্টার্সের জন্য বেতনটা মন্দ নয়। সে চাকরিটা নিয়ে নিল। গরিলার খাঁচার পাশের খাঁচাটা সিংহের। মাঝের যে রেলিং-এর পার্টিশন তার উপরের অংশ ফাঁকা। সে গরিলা সেজে দর্শনার্থীদের ভালই মজা দিতে শুরু করল। সারাদিন রেলিং ধরে লাফায়। কখনো উপরে উঠে সিংহকে  উত্যোক্ত করে। সিংহ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তেড়ে এলে সে লাফ দিয়ে নিজের খাঁচায় চলে আসে। দর্শকরা এই ব্যাপারটাতেই বেশি মজা পায়। একবার সে সিংহের লেজ ধরে টান দিয়ে দ্রুত রেলিং বেয়ে উঠতে গিয়ে হাত ফসকে সিংহের খাঁচায় পড়ে গেল। পরে গিয়ে তো তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়। জীবনের মায়ায় সিংহের খাঁচার মধ্যে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো। সিংহও ছুটছে তার পিছে পিছে। এক সময় ভয়ে সে চিৎকার করে উঠল। উপস্থিত দর্শকরা তো হতবাক। গরিলা ঠিক মানুষের মত বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করছে কিভাবে? পেছন থেকে সিংহ ফিসফিস করে বলল-থাম বেটা, আমিও বাংলায় মাস্টার্স। চিৎকার করে নিজের চাকরি তো খেয়েছিসই, আমারটাও খাবি।
কৌতুকটায় অন্তর খুব মজা পেল। সে ফিক করে হেসে দিয়ে বাবার মুখে তাকাল। দেখল বাবার মুখে হাসি নেই। বাবার মুখ বিমর্ষ। ড্রাইভার যেন খুব দুঃখের কিছু বলেছে। এই  হল বাবা।
বাবা বলল, তোমার আর কে আছে?
বাবা আছেন, মা আছেন-অসুস্থ-বিছানায় শোয়া। একটা ভাই আছে। একটা বোন আছে।
ছোট ভাই-বোন লেখাপড়া করছে?
ভাইটা এবার এবার এইটে উঠবে। বোনও এইটে, তার থাকার কথা ছিল টেন-এ।
দুই বছর লস হল কেন?
স্যার, আপনি ছেলেকে নিয়ে বন ভ্রমনে যাচ্ছেন। এখন আনন্দে থাকার সময়, দরিদ্র মানুষের দুঃখের কাহিনী শোনার সময় এটা না।
আনন্দ করবো বনে গিয়ে। এখন গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে কথা বলা ভাল। আমি কবি-লেখক না হলেও জীবন ব্যাপারে আমার আগ্রহ সীমাহীন। আমি তোমার জীবনের গল্প শুনতে চাই। এখানে তুমি বেতন কত পাও?
সাকুল্যে দশ হাজার। থাকা-খাওয়া ফ্রী। বছরে বেতনের সমপরিমাণ দু’টো উৎসব ভাতা। আমার স্যার খুবই ভাল মানুষ। আমাকে ভীষন ভালোবাসেন। ভালোবেসে মাঝে মাঝে কিছু উপহার দেন। মাঝে মাঝে ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়া বাবদ বাড়তি কিছু দেন, মায়ের চিকিৎসার জন্যও কখনো কখনো কিছু দেন।

তুমি অন্য কোনো চাকরি খুঁজবে না?
না, দশ হাজার টাকা বেতন, দু’টো উৎসব ভাতা, ফ্রী থাকা-খাওয়া, ভালোবাসা মাখা কিছু উপহার নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, আমি এখানে অবসরে বই পড়ার সুযোগ পাই। এরই মাঝে আমি দেড় হাজার বই জমিয়েছি। একজন মানুষ যদি ষাট বছর বেঁচে থাকে, এবং প্রতিদিন একটা করে বই পড়ে তাহলে সে জীবনে একুশ হাজার নয়শ’ বই পড়তে পারবে। আমি বাইশ হাজার বই সংগ্রহ করতে চাই। হয়তো প্রতি দিন একটা করে বই পড়া হবে না......।
কিন্তু তুমি এত বই রাখবে কোথায়?
আমি আমার স্যারকে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়েছি। তিনি বলেছেন, তিনি আমাকে একটা ঘর দেবেন বই রাখা ও পড়ার জন্য। এতবড় সুযোগ হাত ছাড়া করে আমি অন্য কোথাও চাকরি করবো না।
তোমার নামটা কিন্তু জানা হয়নি এখনো।
পারভেজ-পারভেজ হাসান।
পারভেজ, আমি যতদূর জানি, এই দেশে দুইভাবে মানুষ বড়লোক হয়। এক-অসৎ পথে, মেধা ও শ্রম ব্যবহার না করে। দুই-সৎ পথে, মেধা ও শ্রম ব্যবহার করে। প্রথম পদ্ধতিতে ধনী হয় রাতারাতি এবং এদেশের বেশির ভাগ ধনীই এই পদ্ধতিতে হয়েছে। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ধনী হয় ধীরে ধীরে। তোমার স্যার, মানে আমার বন্ধু মঞ্জুর আহসান বড়লোক হয়েছে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে। বর্তমানে আমার চাকরির বয়স বিশ বছর। আমার চাকরিতে ঢোকার পাঁচ বছর আগে থেকে মঞ্জুর ব্যবসা শুরু করে-হ্যাঁ, সেটা ছাত্র জীবন শেষ হবার আগেই। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, তার মাস্টার্স আর শেষ হবে না। কিন্তু অবাক হলাম ওর পশুর মতো খাটুনি দেখে। দিনে গরুত্বপূর্ণ ক্লাশ করেই চলে যেত নিজের তেহারি ঘরে। সেখানে একজন মাত্র কর্মচারি ছিল। সে নিজ হাতে  থালা-বাসন ধুয়ে কাস্টমারদের তেহারি খাওয়াতো। সারাদিন এই কাজ করে এসে রাতে পড়তে বসতো। মাস্টার্স শেষ করার আগেই তেহারি ঘর হয়ে গেল বিরিয়ানি হাউজ। তারপর রেস্টুরেন্ট। ক’দিন পরে তার সাথে যুক্ত করল  অডিও-ভিডিও’র দোকান। তারপর অডিও প্রকাশনা। সেখান থেকে সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনা। এখন তো রেডিও, টিভি, পত্রিকা সবকিছুরই মালিক। তার ব্যবসা বিস্তৃতির জন্য সে কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছে যায়নি। কাউকে এতটুকু তোষামদ করেনি। এখন যদি কোনো মিডিয়াকে নিউট্রাল ধরা হয় তার রেডিও-টিভিকেই ধরতে হবে।
অন্তর উসখুস করছিল। এইসব বিষয় তার ভাল লাগছিল না। গল্পগুলো বড়দের। বনভ্রমণে যাওয়ার সময় এরকম গল্প উপযুক্ত নয়। সে গল্পটা নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে চাইল। হয় তার আর বাবার মধ্যে গল্প হোক, অথবা তাদের তিনজনের মধ্যেই হোক। আর এ জন্য গল্পের বিষয় পরিবর্তন করতে হবে।
[ক্রমশ...]

ক্ষণপ্রেম

ক্ষণপ্রেম


ক্ষণপ্রেম
মোহাম্মদ অংকন

ডিসেম্বরের শুরুতেই আমার সপ্তাহখানেক ছুটির ফুসরত মেলে। ক’দিনের জন্য গ্রামে যাবো কি যাবো না, এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। তাই আর ট্রেনের অগ্রীম টিকেট কাটা হয় না। কিন্তু ছুটি শুরু হলে মন আর শহরে একদম টানে না। শীতের আমেজ ও মায়ের হাতের শীত-পিঠার প্রতি লোভ আমাকে গ্রামে ছুটে যেতে বাধ্য করে। তাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে সেদিন সকালে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে চলে যাই। আমি বেশ ভাল করেই জানি, দশ দিন আগে ট্রেনের টিকেট না কিনে রাখলে সীট পাওয়া যায় না। তখন স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটতে হয়। নিরুপায় হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে একটা স্ট্যান্ডিং টিকেট কিনে ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’ ট্রেনের জন্য প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মোবাইলে দু’একটা সেলফি তুলছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কমলাপুর হতে ট্রেনটা কখন রওনা করে। বাংলাদেশী ট্রেন! বলা যায় না, কতক্ষণ যে লেট করে তার হদিস নাই। ততক্ষণে মা’কে ফোন করে জানিয়ে দেই, ‘হ্যাঁলো মা, আমি আজ বাড়ি আসছি।..’

মায়ের সাথে কথা বলা শেষ করে পূর্ব দিক হয়ে দাঁড়াতেই দেখি আমার পাশে একজন যুবতী মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আমার দিকেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ তা সু-নিশ্চিত। আমি লজ্জায় কিছু না বলে মুখ ফেরাতেই সে আমাকে ডেকে বসল।
-আপনি উত্তরবঙ্গের লোক?
-জ্বি। আপনি বুঝলেন কেমন করে?
-একটু আগে আপনি মোবাইলে কথা বলছিলেন। সেসব শুনে আমি নির্ণয় করেছি আপনি উত্তরবঙ্গের মানুষ। আর আমিও উত্তরবঙ্গের..
-বাহ! আপনার স্বজাতিবোধ বেশ প্রসংশনীয়। ভাষা শুনেই চিনতে পেরেছেন। আজকাল তো মানুষজন এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে।.. নীলসাগরে ফিরবেন বুঝি?
-হ্যাঁ। তবে আমি এখন বিপদগ্রস্থ। মিরপুর হতে এখানে আসার পথে আমার পার্সটা হারিয়ে ফেলেছি। যাতে আমার টাকা, টিকেট ও মোবাইল ছিল। আমার পরিবারের কারও নম্বর আপাতত মুখস্থ নাই বলে আমি তাদের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি ঢাকায় একটি বেসরকারি  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি এবং ছাত্রীনিবাসে থাকি। সেখানে ফিরে গিয়েও লাভ হবে না। পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে সবাই ইতোমধ্যে বাড়ি চলে গেছে। আপনি যদি যাত্রা পথে আমাকে সামান্য সাহায্য-সহযোগিতা করেন, তাহলে আমি আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
আমি মেয়েটির কথা-বার্তায় হতবাক না হয়ে পারলামই না। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এমনও হতে পারে!  আবার মাঝে মাঝে অবিশ্বাস হচ্ছিল। আমি কি বিপদের মধ্যে পতিত হচ্ছি না? পরিশেষে আমি অতিব বিশ্বাস প্রবণ বলে তার সহযোগিতা প্রার্থনার বিষয়ে আমি সম্মতি প্রদান করে ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিলাম। আমার হ্যাঁবোধক সম্বোধনে মেয়েটির মলিন মুখে একটু হাসির রেশ দেখা গেল। একটু পূর্বের ঘটনাসমূহ যেন সে সব ভুলে গেল। অক্ষত লাগেজটা নিয়ে দিব্যি আমার যাত্রাসঙ্গি হয়ে পাশে দাঁড়ালো। আমি ফেসবুকে চেক ইন দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম, নিরুপায় সুন্দরী মেয়েটা আমার থেকে কি ধরনের সহযোগিতা পেতে পারে? ট্রেনে নাস্তা খাওয়ার জন্য টাকার সহযোগিতা? না। আমার সীটে বসার সুযোগ নেওয়া? ভেবে পাচ্ছি না। আর নিরাপত্তার সুযোগ নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কেননা, যে কি না ঢাকায় পড়াশোনা করে, সে তো অনেক সাহসী, চালাক, সচেতন হবেই। হয়তো কোনো অখেয়ালবশত পার্সটা খোয়া গেছে আজ। এটা নিছক দূর্ঘটনা। সাহসীরাও অনেক সময় দূর্ঘটনার শিকার হয়।
ট্রেন আসছে কি না মেয়েটি প্লাটফর্ম হতে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছিল। আমি মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে তার সাথে একটু ইজি হওয়ার প্রচেষ্টা চালালাম। আমি সহজে মেয়েদের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলি না। তবে সেদিনের প্রসঙ্গটা ভিন্ন বলেই আমার কথা বলার আগ্রহবোধ অপরিমেয় ছিল।
-আচ্ছা, আপনি সহযোগিতার কথা বলছিলেন তখন। তবে আমি ভেবে পাচ্ছি না যে আপনাকে আমি কিভাবে সহযোগিতা করব?
-আপনি তো পুরুষ। তাই ট্রেনের সীটটা দখল করতে আপনাকে আমার ভীষণ দরকার হতে পারে।
-আমি বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
-বুঝলেন না তো! দাঁড়ান বলছি। আমি যে টিকেট কিনেছিলাম, তার বগি ও সীট নম্বর আমার বেশ মুখস্থ আছে। তাই ট্রেনে উঠে বলে কয়ে সীটটা উদ্ধার করে দিবেন। জানেন তো, বাঙালীরা কেমন? টিকেট থাকুক বা না থাকুক সীট ফাঁকা থাকলে তারা দখল করে বসে।
আমি সীট উদ্ধার করতে পারব কি না তার নিশ্চয়তা নেই; আমি অন্যকে খুব সহজে বিশ্বাস করলেও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না। তারপরও আমি মাথাটা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে দিলাম। কেননা, তার সুললিত কণ্ঠ নিংসৃত প্রতিটি কথাই আমার মাথা পেতে নিতে মন চাচ্ছিল। ক্রমশ আমার মনে ও শরীরে সাহসের সঞ্চারণ হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম, রাজধানীতে আমি কোনো দিন বাসের ভাড়া নিয়ে কন্টাক্টারদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করি না। ট্রেন ভ্রমণে কখনও বিনা টিকেটে যাই না। সেই আমি কি না দখলকৃত ট্রেনের সীট উদ্ধার করব! তারপর আবার কোনো প্রমাণ নেই যে সীটটি আমাদের। ট্রেনের ভেতরে হুলস্থুল কা- হয় কি না তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম।
-আর হ্যাঁ, আমি যে বগিতে উঠব, আপনিও সেই বগিতেই উঠবেন। আমার পাশেই আপনি টুল পেতে বসতে পারবেন। আমি কোনো আপত্তি করব না। বরং গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। আমরা তো এখন বেশ পরিচিত।
আমি তার এ কথাটিও অনায়াসে মেনে নিলাম। আর যে কথাটা বলা দরকার, আমি যখন ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটি তখন একটা ফ্লোডিং টুল সঙ্গে করে রওনা করি যাতে সারা সময় দাঁড়িয়ে যাওয়া না লাগে। মেয়েটি আমার ফ্লোডিং টুলটা দেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছে আমি সীটবিহীন টিকেট কিনেছি। বিষয়টি বুঝে ফেলায় আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। যেহেতু সে প্রথম থেকেই আমাকে আবিষ্কার করে চলেছে; তাই আমি তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। সেই বিশ্বাস থেকে আমার ব্যাগপত্র রেখে পানি কিনতে মুদি দোকানে চলে গেলাম।
প্রায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট বিলম্ব হওয়ার পর কাঙ্খিত ট্রেন চলে আসলো। আমরা তাড়াহুড়ো করে ‘ঞ’ নং বগিতে উঠলাম। মেয়েটার সীট নং ছিল ৪২। ভীড় ঠেঁলে সেখানে সরাসরি চলে গেলাম। অবিশ্বাস্য যে সীটখানা দিব্যি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আমি তো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সীটের জন্য কারও সাথে দু’দ- ঝগড়া করতে হল না। বিনা উপকারে একজন অপরিচিতার নজরে আমি ‘পুরুষ’ রুপে প্রতীয়মান হলাম। মেয়েটি ব্যাগপত্র ট্রেনের ডালায় রেখে বসে পড়ল; আমিও ব্যাগপত্র ডালায় রেখে ফ্লোডিং টুল বিছিয়ে নিয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। ততক্ষণে মেয়েটার উৎফুল্লতা কাজ করছিল।
-ভাগ্যিস, পার্স হারালেও ট্রেনের সীটটা হারায় নি।

আমিও তার আবেগপ্রবণতা ও বন্ধুসুলোভ আচরণে বিমোহিত হতে লাগলাম। অতঃপর ট্রেন ছেড়ে দিল। আমাদের দু’জনের গল্পগুজব শুরু হয়ে  গেল। যেন আমরা হাজার বছর ধরে একে অপরকে চিনি, জানি। যে আমি মোবাইলে গেম ও ইন্টারনেট ব্রাউজিং বলতে পাগল, সেই আমি এক অপরিচিতার সাথে সখ্যতায় মেতে উঠেছি। মনে হল, বহুকাল পর নিজেকে বদলে নিয়েছি।
ইতোপূর্বে আমি ট্রেনে বহুবার ভ্রমণ করেছি। কিন্তু কখনও এমনটা হয় নি। একাকী বাড়ি গিয়েছি, একাকী শহরে এসেছি। এসব নিয়েই তার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প চলছিল। তার সর্ম্পকে আমিও পুরোপুরি জানি নি, সেও আমার সর্ম্পকে পুরোপুরি জানে নি। ব্যাপারখানা বড়ই অদ্ভুত ছিল। তবে তার আর আমার অসংখ্য কথা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এমন হৃদ্যতা হয়েছে যে অন্যান্য যাত্রীরা শতভাগ ধরে নিয়েছে যে আমি আর সে মেয়েটা সদ্য বিবাহিত দম্পতি! কিন্তু প্রসঙ্গটি যে শতভাগ মেকি, তা প্রথম হতে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝার অবকাশ নাই।
সেদিন ট্রেন জার্নিটা আমার কাছে খুবই সংক্ষিপ্ত মনে হয়েছিল। খুব কম সময়ের ব্যবধানে আমি নাটোরে পৌঁছে যাই। মেয়েটি ট্রেনে থেকে যায়। তার গন্তব্য কোন স্টেশন অবধি, তা আমার জানা হয় না। আমি যখন নাটোর স্টেশনে নামছিলাম, মেয়েটি তখন আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমাদের মাঝে যেন একটা ব্যবচ্ছেদ হচ্ছিল। আমি হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিলাম। হঠাৎ সে আমাকে ডাক দিয়ে বসে।
-এই শোনো, তোমার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যাও, প্লিজ।
ততক্ষণে ট্রেনের বাঁশি বেজে ওঠে। আমি পকেট থেকে টিকেট বের করে তার বিপরীত পাশে মোবাইল নম্বরটা লিখে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে দিয়ে আসি। টিকেটটা দিতেই তার কোমল হাতের স্পর্শ আমাকে এক গভীর অনুভূতির জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আমার মধ্যে তারপর থেকে অবিসম্ভাব্য পরিবর্তন আসতে থাকে।

আমি বাড়ি ফিরে যাই। তারপর কয়েকটা দিন কেটে যায়। কিন্তু অপরিচিতার প্রেমময় মানবিক আচরণ আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না তার হাসি, তার ছোট ছোট অভিব্যক্তি, খুঁনসুটি। ক্রমশ মনে পড়ে, ট্রেনে বসে তার নিজ হাতের রান্না করা ডিম-খিচুড়ি ভাগাভাগি করে খাওয়ার দারুণ মুহূর্তটা। কতই না স্বাদ মেশানো ছিল খিচুড়ি ও তার স্বচ্ছ হাসিতে। তার টোল পড়া মুখ-অবয়ব কতই না পবিত্র ছিল! আমি গ্রামের দিনগুলো খুব শূণ্যতায় অতিক্রম করতে থাকি। তার কথাগুলো নিরালায়, নির্জনে ভাবতে থাকি। তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে চেষ্টা করি। তবে কবিতারা শেষ হয় না। মনে হয়, তার সাথে আমার এক জনমের ভালোবাসার মেলবন্ধন ছিল এবং আছে। কবিতার লাইন শেষ করা মানেই তা যেন অস্বীকার করা! তাকে নিয়ে বিচ্ছিন্ন এমন ভাবনায় আমি নাওয়া, খাওয়া ভুলতে বসি। শরীরের যতœ নেই না। কারও সাথে মিশতে চাই না। আমি যেন বারবার ব্যর্থ হয়ে যাই। আমার মানসিক পরিস্থিতি দেখে মায়ের মনটাও বিচলিত হয়ে ওঠে।
-বাজান, তোমার কি হয়েছে? শহর থেকে আসার পর থেকেই তুমি যেন উদাস মনে আছো? কতগুলো পিঠা বানালাম, একটিও এখনও মুখে তুললে না?
আমি মায়ের কথায় কোনো উত্তর করতে আগ্রহ বোধ করি না। এ কথা যে কাউকে বলা যায় না, মাকে বোঝাব কি করে? বিষন্নতা দূরীকরণের আশ্বাসে নদীর ধারে হাঁটতে চলে যাই। ভাবতে থাকি, সেদিন কত শত কথা হল। তবে কেন আমি তার পরিচয় নিলাম না? নামটাও জানার খেয়াল করতে পারি নি। আমি এত বোকা কেন? অতঃপর হাঁটতে হাঁটতে মনে আশ্বাস জন্মে, সে আমাকে হয়তো একদিন না একদিন কল করবে। কিন্তু ছুটির সপ্তাহ অতিক্রম হলেও তার কোনো সারা-শব্দ না পেয়ে আমি বেসুরে গাইতে থাকি-
এ যে আমার মিছে প্রেম, কি সে আমি আশা করি
শীতল হিমে েেথমে থেমে কেন বারবার প্রেমে পড়ি?

ঢাকা হতে গ্রামে ফেরার ১২ দিন অতিক্রম হয়ে যায়। আমার ছুটি ফুরিয়ে আরও পাঁচদিন অতিক্রম হয়ে যায়। শরীরে প্রচ- জ্বর আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। তবুও ঢাকায় ফিরে যেতে উঠে পড়ে লাগি। কিন্তু  এবার আর স্ট্যান্ডিং টিকেট নয়, সপ্তাহখানেক আগেই ৩২০ টাকায় টিকেট কিনি। টিকেট হয় ‘ঞ’ বগির এবং সীট হয় ৪২ নং। আমি হতচকিত হয়ে পড়ি। সেই দিনটির কথা ভুলতে েেচয়েও পারি না। জ্বরাক্রান্ত মনে ভাবতে থাকি, যাত্রা পথে যদি তার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়? তবে আর ভুল করব না। আমার মনের কথাগুলো তার মনের অগভীরে সযতেœ পৌঁছে দিবো। তারপর শুভ্র-দুপুরে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে রওনা করি।
জ্বরাক্রান্ত শরীরে জানালার পাশে বসে একটি বই পড়তে পড়তে শহরের দিকে যেতে থাকি। ঝকঝক শব্দে ট্রেন চলতে থাকে। আমি বই হতে কি পড়ছি তা আর আমার মনে খেলা করে না। শুধু খেলা করে হারিয়ে ফেলা নেই মেয়েটির নূপুর কিংবা চুড়ির শব্দ। চোখ মিলিয়ে তাকে উপলব্ধি করতে থাকি। আমার মোবাইলে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। ও পাশ থেকে ‘হ্যাঁলো’ বলতেই আমি নির্ণয় করে ফেলি, ও সেই অপরিচিতা!
-ও গো প্রিয়, তুমি কি চিনতে পেরেছো আমায়?
-কেন চিনবো না হে মোর প্রেয়সী? তুমি এখন আমার ভাবনার শীর্ষ বিন্দুতে মিশে আছো, মিশে আছো আমার লেখা শতশত প্রেমের কবিতায়। কবিতাগুলো যখন ব্যর্থ হতে চলেছে, তখন তোমার সম্মোহনে প্রাণ পেতে চলেছে।
-ও আচ্ছা, তাই না! তবে এখন রাখছি। ঢাকায় ফিরে কথা হবে। এখন ট্রেনে আমি। এটা আমার নম্বর।

তার ট্রেনে থাকার কথাটিতে আমি যেন দেহে প্রাণ ফিরে পাই। আমার রক্তের গতিবেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
-কোন ট্রেন?
-দ্রুতযান।
-কোন বগি? কোন সীট?
-‘ক’ বগি, ১০ নং সীট।
তারপর আমি আমার সীটখানা ত্যাগ করে, পাঁচসাতটা বগি ডিঙিয়ে অতিব সন্তপর্ণে তার কাছে ছুটে চলে যাই। তার পুলকিত হাসিমালা আমাকে সাদরে বরণ করে নেয়। তারপর সীটবিহীন আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বিরহের দিনগুলোর কথারাশি ব্যক্ত করতে থাকি। সে আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনে আর ছোট ছোট করে ঢোক গেলে। তার অভিব্যক্তিতে আমি আশ্বস্থ হই। সে-ও যেন আমার মতো প্রেম-যাতনায় এতদিন কাতর ছিল। হয়তো নারী মানসের কারণে বুক ফাটলেও তার মুখ ফোঁটে নাই।
তারপর কোন এক সময় পর তার পাশের সীটে বসা ভদ্রলোকটি কোনো এক স্টেশনে নেমে যায়। সীটটা ফাঁকা রয় বিধায় আমি তার পাশাপাশি বসার সুযোগ পাই। তার লম্বা চুলের দুলনি আমার হৃদয়ে অযাচিত দোলা দিয়ে যায়! তার নরম হাতের স্পর্শ আমাকে হিম শীতল আবেস দিয়ে যায়! দখিণা বাতাসে তার বুকের ওড়না আমার মুখের উপর ছুটে আসে। ঘন সাঝে যমুনা সেতু পার হতে হতে সে যমুনার বুকে জলের ঢেউ দেখে আর আমি তার বুকে ভালবাসার ঢেউ অবলোকন করি। লজ্জার মাথা ঠুঁকে ট্রেনের টিমটিম আলোয় ঝাঁপটে ধরি রমনীর কচি দেহ। ও যেন নিমিষে বিছিয়ে পড়ে আমার শরীরে। আমার চুম্বনে ও যেন স্বর্গসুখ পায়। ওর ঠোঁট বেয়ে নেমে আসে অমিত লালা! রঙিন ঠোঁট বিবর্ণ হয়! আমাদের পবিত্র ভালবাসার মিলন যাত্রীরা সুদৃষ্টিতে বিচার করে। তারপর চিরচেনা যান্ত্রিক শহরে দু’জন চলে আসি। এখন অবসরের দিনগুলোতে অপরিচিতার সাথে কফি আড্ডায় কোনো রেস্টুরেন্টে বসি, অথবা কোনো পার্কে যাই। রাত জেগে কথা হয়।..
অতঃপর রাত দশটায় ট্রেন থেকে সবাই নেমে যায়। আমার পাশে বসা লোকটি বলে, ‘ভাই, কমলাপুর এসে গেছি। নামবেন না?’ আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারি না। রাতের আঁধার শহরটাকে ঘিরে নিয়েছে। জানালা ভেদ করে তাকিয়ে দেখি সত্যই এটা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি। হায়! রে আমি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে এসেছি। অতঃপর ডালা থেকে ব্যাগটি নিয়ে প্লাটফর্মে নেমে যাই। একটি শিশু এসে হাত পেতে জানায়, ‘কয়ডা টাহা দেন। ভাত কিন্না খামু। সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই।’ তাকে পাঁচটা টাকা দিবো ভেবে পকেটে হাতটা ঢুকাই। কিন্তু ম্যানিব্যাগের কোনো সন্ধান মেলে না। মাথাটা তখন ভীষণ চিনচিন করে। কাঁধের ব্যাগটা প্লাটফর্মে ফেলিয়ে তার ওপর বসে পড়ি। ভাবতে থাকি, এই শহরে আমি সারা মাস কিভাবে চলবো? আমি কিভাবে বাসা ভাড়া দিবো? আমি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি দিবো?
পথশিশুটি আমার ভেঙ্গে পড়ার অভিব্যক্তিতে বলে ওঠে, ‘কি হয়েছে, ভাইয়া?’

পদাবলি

পদাবলি


কচুরিপানা
শাহীন মাহমুদ

পোয়াতি রাত বোবা দোচালা টিনের ঘর কাঁপে
শেকড়ের সমাধি ।
কচুরিপানা দুর্ধর্ষ লুফে নেয় ধানের ডগা
ঝড়আকাশ নয় শিকড়ে ।
প্রভু সামন্তবাদ
বিদ্রুপে জন্মান্ধ বিটপী ।
ফের এসো অমাবস্যা রাতে
ঈশ্বর ক্লান্ত হও;কচুরিপানা ফিরে যাও 
শেকড় আজ রক্ত তালুতে বন্দী ।




পাঁচ বসন্ত পেরিয়ে
সুমন আহমেদ

ঝরাপাতার মর মর শব্দের দিনশেষে- নতুনত্বের পথ ধরে হেঁটে
চলে চঞ্চলা বালিকা... পড়ন্ত বিকেলে গোধূলি লগ্নে
রংধনুর সাঁতরঙে রাঙা- বসন্তের যুবতী আকাশের ঠোঁটে মৃদু হাসি।
পাঁচ বসন্ত পেরিয়ে দীর্ঘ প্রত্যাশা- তোমার অঙ্গে জড়ানো
লাল শাড়ির মুগ্ধতায় বসন্ত রঙে রঙিন হবে আমার মনকুটির।
অমাবস্যার ঘনান্ধকারে ডুবে যাওয়া চাঁদ- আবারও তার
রূপালী আলোয় আলোকিত করবে মনের উঠোন।
সুখের উচ্ছ্বাসে- বৈতরণীর কূলভাঙে ঢেউ যুগল,
দুঃখের তারকাটার ব্যারিকেড ভাঙে- সুখের উন্মাদনায়।
বসন্তিকা, তুমিহীন শূন্যতা বুকে নিয়ে কতটা প্রহর গত হয়েছে
তার হিসেব রেখেছো কী কোনোদিন?


বাংলাদেশ
স্বপন শর্মা

এদেশ আমার অনেক কল্পনায়
স্বর্গভূমি, যেন অনেক কথায়,
কন্ঠ দিয়ে গল্প বলা।

ভুল হবে না তা জানি...
এখানে আকাশ জমিন ছোঁয়,
নজর রাখি যত শ্যামল শোভায়,
পাখ-পাখালি ঘুরর্ছে অবিরত।

বলতে গেলে অনেক বলতে হয়
হটাৎ কালো মেঘ, উড়ন্ত বলাকা,
ছুটছে ঝড়ের গতিবেগ।

তবু শেষ হয় না বলা
‘বৌ কথা কও’ পাখি জাগিয়ে দিল
ভোরের আকাশ মূহ মূহ ডাকি।

কল্পনায় ভেসে এলো এদেশ আমার
যেন নিপূন শিল্পীর হস্ত নির্মিত
স্বর্ন-হার স্বরূপ এক মূর্ত ছবি।

বসন্ত দিনের পোড়া মন

বসন্ত দিনের পোড়া মন

বসন্ত দিনের পোড়া মন
এইচ এম সিরাজ

তখন মাঘ মাস। শীতের বেশি স্থায়িত্ব আর নেই বললেই চলে। ক’দিন পরেই শুরু হবে ঋতুরাজ বসন্তের। এই সময়ে রাজধানীর একটা গ্রুপ অব কোম্পানীতে নতুন চাকরি হয় সুমনের। ভালো বেতন। ফুরফুরে সময় কাটবে।
এই সময়ে মনের কথা শেয়ার করার মতো কারো অভাব বোধ করে সুমন। কিছু দিনের মধ্যে সে অভাবও পূরণ হয় তুলিকে পেয়ে। একসাথে আসা-যাওয়া আর লাঞ্চ করাতে কোম্পানীর অনেকের চোখেই সুমন-তুলি জুটি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। তুলি প্রায়ই ফোনে বলত- সুমন, কি লাঞ্চ করা লাগবে না?
লাঞ্চ করার পরে একটা পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল তুলির। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করতে না পারলে তুলির যেন পেটের ভাত হজম হতো না। পান খাওয়া মুখে তুলিকে লাগতও বেশ। তাই লাঞ্চ সেরে দোকান থেকে দু’একটি পানের খিল্লি তুলির হাতে এনে দিলে তুলি বেশ খুশি হতো।
একদিন অরিন্দকে লাঞ্চের বাটি হাতে কারো জন্য অপেক্ষা করতে দেখে সুমন। জিজ্ঞেস করলে অরিন্দম জানায় সে তুলির জন্য অপেক্ষা করছিল। অরিন্দমও তুলির অফিস-কলিগ। তুলির জন্য অপেক্ষা করার কথা শুনে শরীরের ভেতরে ভীষণ একটা তাপ খেলে যায় সুমনের। কয়েক সেকে-ের মধ্যেই সুমনের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে। ঠিক তখনই তুলির কল আসে―কই তুমি? লাঞ্জে যাবে না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমন ভেবেছিল, যাক বাঁচা গেল। তুমি আমারই। তুমি আমাকে ছাড়া আর কারো কাছে যেতে পারো না, তুলি।
তখন ফাগুন মাস চলছে। প্রকৃতির মাঝে চলছে পরিবর্তনের চিরন্তন ক্রিয়া। শিমুলের লাল ফুলে ভরে গেছে শাখা প্রশাখা।  গাছের ডালপালা থেকে শুরু করে মানুষের দেহ-মনেও পরিবর্তনের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। শীতের আড়মোড়া ভেঙে কারো মনে এসেছে চঞ্চলতা। কোনো কোনো গাছের ডালে দেখা দিয়েছে নতুন পাতা। বাগানে বাগানে শোনা যাচ্ছে কোকিলের কুহুতান। প্রকৃতি আপন মনে বাউরি বাতাস বইয়ে দিয়ে যাচ্ছে কখনো-সখনো। ঝরঝর করে উঠছে গাছের পাতা। শুকনো পাতা পড়ে ভরে যাচ্ছে কারো বাগানবাড়ি, গাছের তলা। ভোরবেলা ও স›ধ্যায় এই বাউরি বাতাস গায়ে লাগলে একটু ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগে; ভালো লাগে মনে ও শরীরে।
এমনি পরিবর্তনে মানুষের মনে যেমন পরিবর্তন আসে, ঠিক তেমনি দেহেও নানা রকম রোগের দেখা মেলে। ফাগুনের শেষ দিকে তুলি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বসন্তের এই ক্ষণে তার গায়ে গুটি বসন্ত ওঠে। তিনদিন পরে তুলির ছোটভাইয়ের মুখে ওর অসুস্থতার কথা জানতে পেরে সুমন দ্রুত ছুটে যায় তুলিকে দেখতে। তার আর তর সয় না। একনজর তুলিকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সুমনের বাসন্তী-মন।
সুমনকে রিসিভ করতে তুলি মেইন-রোডে এসে দাঁড়ায়। তুলির পরনের সবুজ সেলোয়ার-কামিজ আর গায়ে-মাথায় ধবধবে সাদা ওড়নায় সেদিন তুলিকে বড্ড ভালো লাগছিল। তুলির এমন রূপ সুমনের মনে বসন্তের বাউরি বাতাস বইয়ে দেয়।
সুমনকে তুলি তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় তখন তুলির ভাই কিংবা অন্য কোনো লোক ছিল না; একদম নির্জন পরিবেশের একটি বাসা। সুমনের সাথে অনেক সময় ধরে চোখে চোখ রেখে গল্প করেছিল তুলি। সুমনকে পেয়ে তুলির সব অসুখ ভালো হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তুলি সার-পানি দেয়া গাছের মতো সজীব হয়ে উঠেছিল।
এসব কেবলই ধুসর স্মৃতি। কথায় আছে―জীবনের সবদিন সমান যায় না। ঠিক তাই। তুলির সাথে এতো মধুরতা মনে হয় বিধাতাও সইতে পারল না। হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে তুলি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। আবার ফিরে আসবে, ভালোবাসবে, ঘর বাঁধবে বলে কথা দিয়ে গেছে। কিন্তু সেই কথা, শুধু কথা-ই থেকে যায়। বাড়িতে যাবার পরে তুলির নাম্বারে আজো কোনো সংযোগ পায়নি সুমন।
অবসরে তুলির দেয়া টেক্সটগুলো সুমন নীরবে-নিভৃতে আওড়ায়। ফাগুনের মধুর স্মৃতি বুকে নিয়ে বয়ে বেড়ায়। বুকটা তার কাছে পাহাড়ের মতো ভারী লাগে। বুকভাঙা নিঃশ্বাস ফেলে বুকের জমিনে। কখনো আকাশের দিকে তাকায়, কখনো বা সেলফোনের দিকে; পথ চলে পাগলের মতো উদাস হয়ে। গায়ে কোনো ভালো জামা-কাপড় পরে না। শরীরের কোনো যতœ নেয় না। ইদানীং পায়ে থাকে ছেঁড়া স্লিপার, গায়ে মলিন টি-শার্ট।
সুমন আজকাল চারপাশের বন্ধুদের সাথেও আড্ডায় গা ভাসায় না। ফাগুন ঘিরে তুলির সাথে তার সব স্মৃতি এখন চুরুটের আগুনের মতো একটু একটু করে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে তার ভেতরের সবকিছু। সার-পানি ছাড়া নেতিয়ে পড়া লাউয়ের ডগার মতো সে এখন। ইদানীং সিগারেটের নিকোটিনে বারবার আহত করছে নিজেকে, ক্ষত-বিক্ষত করছে ভেতরটাকে। গভীর রাতে বাসায় ফেরে। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই; চোখমুখ যেন গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে সুমনের। দেখলে মনে হয় কোনো এক মানসিক সিডরে সে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
সুমন এখন আর চাকুরিতেও যায় না। তুলিহীনতাই তার অস্তিত্বকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার যাবতীয় কার্যক্রম যেন হাতে তুলে নিয়েছে। তুলির বিরহে মাঝে-মাঝে মনটা তার হুহু করে কেঁদে ওঠে। তুলির সাথে আর কোনোদিন কি দেখা হবে না সুমনের?

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০২

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০২

জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ...
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
তারা আমাদের বাড়িতে......।
আরে বোকা ছেলে! তারা বলতে তাদের বইকে বুঝিয়েছি। আরও বলবো, হালজমানার সব লেখক ছিল আমাদের বাসার ডাল-ভাত। হুমায়ূন-জাফর ভাতৃদ্বয় তো আলুভর্তা। আমার বাবা মানে ছেলের দাদা গল্প/উপন্যাস লিখতেন। তার লেখা এখনও ট্রাঙ্কে তালাবদ্ধ আছে। তার ‘প্রেমের বাসনা’ উপন্যাসটা তো আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। আর আমার দাদাও ছিলেন গীতি কবি। তিন গ্রামের লোক এক নামে চিনতো-কবি সৈয়দ ইমদাদ আলীকে। আমার মধ্যে অবশ্য লেখালেখির কিছু নেই। ছেলে লেখালেখিটা পেয়েছে তার দাদা-পরদাদাদের কাছ থেকে।
তুমি এসব মিথ্যা কথা বলবে?
প্রিপারেশন ছাড়া আর কী বলবো বল? এক হাতে ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে পুঁই শাক, গোল আলু, টমেটো, পুঁদিনা পাতা আরও অনেক কিছু। আরেক হাতে দুইটা দেশি মুরগি। অনবরত কক কক করছে। এরকম অবস্থায় সাংবাদিক ধরলে .......। বাদ দে তোর গল্প লেখা। চল কোথাও থেকে বেরিয়ে আসি।
সে কথাই তো গতকাল বলতে গিয়েছিলাম। বললে, সাতশ’ ত্রিশ দিন পর রিক্রেশান লিভ পাবে তখন যাবে।
তাই বলেছি? কি আশ্চার্য! আমার ক্যাজুয়াল লিভ-ই তো কত পড়ে আছে। রিক্রেশান লিভের জন্য অপেক্ষা করব কেন? কখন বলতে গিয়েছিলি?
ঐ যে, যখন বই পড়ছিলে।
বই পড়ার সময়!
বাবা মুখ ভেঙচাল। তারপর বললেন, বই পড়ার সময় তুই এরকম কথা বলতে গেলি কেন? লেখকরা গল্প/উপন্যাসে পাঠকদের একটা ঘোরের মধ্যে ঠেলে দেয়। আমি হয়তো তখন কোনো ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এরকম সময় কেউ বেড়াতে যাবার কথা তোলে? তুই ভীষন বোকা ছেলে। এরকম বোকা ছেলে লেখক ছাড়া আর কী হতে পারবে তা বলা মুশকিল।
লেখকরা বুঝি বোকা হয়?
অবশ্যই। বোকা না হয়ে আকাশ-পাতাল কল্পনা নিয়ে সারা জীবন থাকতে পারতো না। গঠনমূলক কিছু করতো।
এখন বলো, কোথায় বেড়াতে যাবে?
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
বাবা ঝট করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দেয় না। একটু ভেবে নেয়। ভেবে নেবার সময় সে পায়ের ওপর আঙুল ঠুকে ঠিক তবলা বাজানোর মত করে। অবশ্য তাতে কোনো শব্দ হয় না। বেশ একটু ভেবে নিয়ে, এবং পায়ে আঙুল দিয়ে শব্দহীন তবলা বাজিয়ে বাবা বলল, সমুদ্র দেখেছি। নদী দেখেছি। পাহাড় দেখেছি। পাহাড়ি ঝর্ণা দেখেছি। শহর-বন্দর-গ্রাম দেখেছি। অনেক বিনোদন কেন্দ্র দেখেছি। একটা জিনিস দেখা হয়নি এখনও। সেটা হল       বন-জঙ্গল। বনের ভেতর বসে গল্প করতে কেমন লাগে তা জানি না। বনের ভেতর বসে খাবার খেতে কেমন লাগে তা জানি না। বনের ভেতর বসে বই পড়তে কেমন লাগে তা জানি না। বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে কেমন লাগে তাও জানি না। বনের ভেতর........।
বাবা, তুমি কি সুন্দরবন যেতে চাচ্ছো?
বাংলাদেশের বনের রাজা তো সুন্দরবনই। এ বন বিশ্বেরও একটা বিস্ময়। সে বন দেখা না হলে তো বন দেখা হয় না। তবে এবার অতো দূরে যেতে চাচ্ছি না। দিনে দিনে বেরিয়ে আসা যায় এমন ছোট-খাটো বনে আগে যাই।
কোন ছোট-খাট বনে যেতে চাও?
এই ঢাকার আশেপাশেই। ধর, গাজীপুরের চন্দ্রার গজারি বনে যাওয়া যায়, তুই গল্পে যে বনের কথা বলেছিস।
অন্তর অবাক হল, সেই সাথে খুশিও হল। সে গল্পের প্রথম লাইন লিখেছিল-একদিন চন্দ্রার বনে। লাইনটা লিখতে না লিখতেই তার চন্দ্রার বনে যাওয়ার সুযোগ এসে গেল! তাহলে বন থেকে ফিরে এসে গল্পটা শেষ করা যাবে। গল্পটা নিশ্চয় সাহিত্য মানে উৎরে যাবে।
অন্তর বলল, আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা। আমার খুব ভাল লাগছে যে, তুমি সেধে আমাকে চন্দ্রার গজারি বনে নিয়ে যেতে চাচ্ছো। থ্যাঙ্ক ইউ বাবা, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। ইউ আর গ্রেট। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের চেয়েও গ্রেট।
এই চুনোপুটিকে অত বড় ব্যক্তির সাথে তুলনা করে ফেললি?
আলেকজান্ডার নিশ্চয় তার ছেলেকে সেধে কোনো জঙ্গলে বেড়ানে নিতে চায়নি।
তার কি তোর বয়সী ছেলে ছিল? শুনেছি সে অল্প বয়সে মারা গেছে। আর ছেলে থাকলেও তার সে সময় হত না। সে ছেলেকে নিয়ে যেতে রাজ্য জয়ের জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে। তবে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর ছেলেকে নিয়ে শালবনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ছেলের সাথে শালবনে বেড়ানোর সময়ই তিনি নবেল প্রাপ্তির খবর পান।
আমাকে নিয়ে বেড়ানোর সময় তুমি কোনো খবর পাবে না বাবা?
আমি কী খবর পাব? আমার জন্য এই জগতে কোথাও কোনো খবর নেই। যাকগে, কথা কম কাজ বেশি। কাল সকালেই আমরা চন্দ্রার বনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছি। আজকের দিন-রাত্রিটুকু প্রস্তুতির জন্য।
মাকে জানাবে না?
তাকে রাতে জানালেও চলবে।
বাবা ঘর থেকে চলে যেতেই অন্তর গল্পটা সাথে যুক্ত করল কয়েকটা লাইন-সেখানে ফ্লাইং সসারে করে ভিন গ্রহের এক প্রাণী নেমে এল। তবে সে সেখানে ইচ্ছে করে আসেনি। তাকে ফেলে রেখে গেছে তার পৃথিবীর এক খারাপ লোক। প্রাণীটার চেহারা অদ্ভূত। গায়ের রঙ সবুজ। ছোট ছোট দুটি হাত। প্রতি হাতে তিনটা মাত্র আঙুল। চোখগুলো পিটপিটে। তাতে কোনো পাঁপড়ি নেই। প্রাণীটার উচ্চতা মাত্র সারে তিন ফিট।
তারপর সে গল্পের খাতা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দিল। ওর মনে তখন খুব আনন্দ। আনন্দে ওর নাচতে ইচ্ছে করছিল। নেচে নেচে গাইতে ইচ্ছে করছিল, আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে।
কিন্তু সে তা করতে পারবে না। দরজার ফাঁক দিয়ে মাজেদা তার নাচ দেখে ফেলতে পারে। আর তাতেই সে বাঁধিয়ে দেবে ঝামেলা। এই পাবলিক থাকে শুধু ঝামেলা বাঁধানোর তালে। ছুটে গিয়ে মাকে বলবে, খালাম্মা, ভাইজানের মাথা আউলা হয়ে গেছে। কেমন জানি উথাল-পাথাল লাফাইতেছে।
রাতে কথাটা মাকে জানানোর কথা ছিল। কিন্তু মা জেনে গেল আগেই। বিকেলে মা এসে চড়া গলায় বলল, কী শুনছি এসব?
কী শুনছো মা?
অন্তর ভাবল, লেখাপড়ার কোনো ব্যাপার। হয়তো অংকের টিচার আশুতোষ বাবুর সঙ্গে মা’র দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, এবারও অন্তর ম্যাথমেটিক্স-এ থার্ড পজিশনে আছে। ম্যাথমেটিক্স-এর মত মধুর একটা বিষয় ছেলেটার মাথায় ঢুকছেই না। আইনস্টাইনের মত একটা অটিস্টিক পাবলিক......।
আশুতোষ স্যারের কাছে ম্যাথমেটিক্স বিষয়টা মধুমাখা। এর প্রমাণ, আইনস্টাইনের মত অটিস্টিক পাবলিক ম্যাথমেটিক্স-এ অতিশয় দক্ষ ছিলেন। আইনস্টাইন অটিস্টিক ছিলেন আশুতোষ বাবু এ কথা কোথায় পেয়েছেন কে জানে। 
না, মা অংক স্যার বিষয়ক কোনো কথা বলল না। বললন, তুই আর তোর বাপ নাকি জঙ্গলে যাচ্ছিস?
এ কথা তোমাকে কে বলল মা?
দেয়ালেরও কান আছে।
দেয়ালের কান নেই মা। এ কথা তোমাকে মাজেদা বলেছে। ও দরজায় কান পেতে ছিল। আমি আর বাবা কথা বলেছি তা ও শুনেছে। মা, তুমি ওকে এ অভ্যাস বাদ দিতে বলো। অন্যের দরজায় কান পাতা ঘোরতর অন্যায়।
ও আছে বলেই তোদের বাপ-বেটার গোপন প্ল্যান-প্রগ্রামের কিছু খবর আমার কাছে আসে।
এটা কোনো গোপন প্ল্যান-প্রগ্রাম না মা। আমরা পালিয়ে জঙ্গলে যাবার প্ল্যান করিনি। রাতে এ ব্যাপারে তোমার সাথে আলোচনা হত। তুমি মাজেদাকে সতর্ক কর প্লিজ।
মাজেদা দরজা ঠেলে ঘরে এসে হাজির। সে নিশ্চিত কান পেতে ছিল দরজায়। বলল, আমি কান পাতি নাই ভাইজান। এইসব বদ অভ্যাস আমার মধ্যি নাই। ছোট বেলা থিক্যাই বাপ-মা আমার মধ্যি সব ভাল অভ্যাস ঢুকাইছে। আমি আপনের ঘরে আসতেছিলাম টিস্যু পেপারের জন্যি। নাক দিয়া খুব সিনাত ঝরতেছিল। তখনই কথাগুলা শোনা গেল।
আর তুই মাকে বলে দিলি?
ওমা! বলবো না? আমি কার আন্ডারে চাকরি করি?
রাতে খেতে বসে বাবা কথাটা তোলার আগেই মা বলল, তোমরা কাল জঙ্গলে যাচ্ছো?
বাবা বলল, এভাবে বললে কেমন যেন শোনায়?
কিভাবে বলবো?
সমুদ্র ভ্রমণে, নদী ভ্রমণে বলে না মানুষ? তেমনি বন ভ্রমনে বা বন বিহারে বলতে পারো।
তোমরা নাকি কাল বন বিহারে যাচ্ছো?
হ্যাঁ, আমরা কাল বন বিহারে যাচ্ছি। গাজীপুরে চন্দ্রার গজারি বনে। সারাদিন বাপ-বেটা মিলে বনে বনে ঘুরবো। পাতার মর্মর শব্দ শুনব। পাখির কূজন শুনবো -অবশ্য পাখি যদি থাকে। এদেশের বনেও নাকি আশঙ্কাজনক হারে পাখি কমে যাচ্ছে। তারপর বনের মধ্যে বসে গল্প করবো। ক্ষিধে পেলে খাব। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। তুমি যদি ইচ্ছে.......।
কিন্তু এতদিন ঘরে বসে ঘামাচি গালিয়ে কাল বন বিহারে যাবার দিন করলে কেন?
এতদিন ঘামাচি গালিয়েছি! আচ্ছা, না হয় গালিয়েছি। তো কাল গেলে সমস্যাটা কী?
কাল না ছেলের স্কুল খুলছে, এবং কালই রেজাল্ট বের হবে।
আ!
বাবা হাঁ করে মুখে ভাত তুলতে যাচ্ছিল। তার আর মুখে ভাত তোলা হল না। হাত মাঝ পথে এক মুঠো ভাত নিয়ে আটকে গেল। মুখও হাঁ হয়ে রইল। সেই হাঁ-এর ভেতর দিয়ে বের হল একটা শব্দ-আ...!
অন্তরের মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। স্কুল বন্ধের পর থেকেই সে বলছে, হাতে সপ্তাহ খানেক সময় অবসর আছে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক যে কালই শেষ-এ কথা তার মনেই আসেনি। সে নিশ্চিত হল, তার সাধের প্ল্যান ভেস্তে যাবে। চন্দ্রার গজারি বন দেখা হবে না। গল্পটা যদি শেষ করতেই হয় তো কল্পনাকে সাথী করেই চলতে হবে, না হলে স্টপ।
বাবা এবার বাঁ হাতের আঙুল টেবিলে ঠুকতে লাগলো। এবার একটু শব্দও বের হচ্ছে। অবশ্যই শব্দটার একটা তাল আছে। যে তবল বাজাতে পারে সে বলতে পারবে এটা কী ধরনের তাল। কাহার্বা, দাদরা, নাকি ত্রিতাল, না অন্য কোনো তাল। বাবা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবছে। কিছুক্ষণ টেবিলে আঙ্গুল ঠুকে বাবা বলল, কুচপরোয়া নেহি!
মা রেগে বলল, উর্দু বলছো কেন? তুমি কি রাজাকার ছিলে? তোমার মধ্যে কি এখনও পাকিস্তান প্রীতি রয়ে গেছে?
এটা উর্দু ভাষা? দুঃখিত-খুবই দুঃখিত। দাঁড়াও কুলি করে আসি।
বাবা কুলি করে এল। অন্তর বলল, বাবা, অন্য ভাষা বললেও কি কুলি করতে হবে?
না। কারণ অন্য ভাষা আমাদের ওপর কেউ চাপিয়ে দিতে চায়নি। এই উর্দু ভাষাটা কুচক্রিরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। এই ভাষা চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ভাষা তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সব কিছুকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতি হিসেবে পৃথিবী থেকে আমাদের চিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছিল। এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। তাই এই ভাষা মুখে এলে কুলি করতে হবে।
মা বললন, এখন বলো, কাল বন বিহারে যাবে কিনা?
যাবো।
যাবে?
রেজাল্টের দিন যে রেজাল্ট গ্রহীতাকে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে এরকম কোনো বাধ্য-বাধকতা নেই। তুমি যাবে-তুমি গিয়ে ছেলের রেজাল্ট জেনে আসবে।
ছেলের ভেতর তো একটা টেনশন কাজ করবে।
টেনশন কেন?
রেজাল্ট কী না কী হয়।
বাবা তাকাল অন্তরের দিকে। বললন, কিরে, টেনশনে থাকবি?
অন্তর কিছুতেই ভ্রমণটা মিস করতে চায় না। কারণ, এরকম সুযোগ সব সময় আসে না। সে বলল, না, রেজাল্টের ব্যাপারে আমার কোনো টেনশন নেই। আমি পরীক্ষা ভাল দিয়েছি। হয় একটু খারাপ হবে, নয় একটু ভাল হবে। যাকে বলে ঊনিশ-বিশ পার্থক্য। এ নিয়ে টেনশনের কিছু নেই।
বাহ! চমৎকার কথা! ভেতরে কথার ভান্ড না থাকলে লেখক হওয়া যায় না। এখন মনে হচ্ছে তুই লেখক হতে পারবি। লেখক মানে কথাশিল্পী। কথার জাদুকর। আর টেনশন একটু থাকলেও ক্ষতি নেই। যে কোনো ঘটনার সাথে অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যুক্ত থাকলে দু’টো ঘটনাই স্মৃতিতে বসে যায় জবরদস্তভাবে। যখন তোকে কেউ জিজ্ঞেস করবে, চন্দ্রার বনে যেন কবে গিয়েছিলি? তুই বলবি, যেদিন সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট হল। আবার যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তোর সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট যেন কবে হল? তুই বলবি, যেদিন চন্দ্রার বনে বেড়াতে গেলাম। বনে বসেই তো মা’র ফোন পেলাম যে, আমি ফার্স্ট হয়েছি।
ফার্স্ট হব এমন কথা বলো কী করে?
হতেও তো পারিস। শোন, আমার স্কুলের অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের কথা তেমন মনে নেই। কিন্তু যেবার এইট থেকে নাইনে উঠলাম......।
বাবা!
অন্তর বাবাকে থামিয়ে দিল। কারণ বাবা এইট থেকে নাইনে উঠেছিল এক বিষয়ে ফেল করে। বাবা অংকে ফেল করেছিল। দাদা তাকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিলেন। অন্তর চায় না যে, মা এই কথা জানুক। তাহলে মা উঠতে বসতে বলবে, তুমি অংকে ফেলটুস ছিলে বলেই তো ছেলের অংকে মাথা নেই। তোমার কাছ থেকেই এসেছে এটা।
মা বললেন, মনে হচ্ছে তুমিও কথার জাদুকর হয়ে যাচ্ছো। মুখে এমন খই ফুটছে কেন শুনি?
বাবা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, রেজাল্ট পাওয়া মাত্র তুমি ফোন করে জানিয়ে দিও।
ছেলে যদি প্লেস পায় তাহলে কি আমি বিজয় স্তম্ভে দাঁড়াবো?
ছেলের হয়ে যদি মাকে বিজয় স্তম্ভে দাঁড়ানোর অনুমতি দেয় তো দাঁড়াবে। না হলে ওখানটা খালি থাকবে।
তবু তুমি যাবে?
হ্যাঁ যাবো। প্ল্যান ইজ প্ল্যান। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার না যে শুধু প্ল্যান করবো কিন্তু বাস্তবায়ন করবো না।
তুমি দিন দিন খুবই বদলে যাচ্ছো-অদ্ভূত হয়ে যাচ্ছো।
মানুষ তো বদলাবেই। বদলায় না পশু-পাখি। একটা বাঘ কিংবা সিংহ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই আচরণ করে যায়। তাদের জীবনে নো চেঞ্জ-নো ডিফারেন্স। একটা ভাবসম্প্রসারণ পড়েছো না-তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি, মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ। এই মানুষ হওয়াটাই চেঞ্জ। এই চেঞ্জের কারণেই আমরা হোমোসেপিয়েন্সরা পৃথিবীর বুক থেকে নিয়ান্ডার্থালদের বিতারিত করে টিকে আছি।
তুমি এতদিনে মানুষ হচ্ছো?
না, অধিকতর মানুষ হচ্ছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষ হতেই থাকব।  
[ক্রমশ..]

হৃদবাসিনী

হৃদবাসিনী


হৃদবাসিনী
আল-আমীন আপেল

১.
নিশিকে বিদায় জানিয়ে প্রভাত ডেকে এনেছে চিরযৌবনা সূর্যটা। সূর্যকরোজ্জ্বল এইপ্রভাতে গোমড়ামুখো হয়ে ঘরের পাঁচিলে পিঠ ঠেকিয়ে আছে রিমি। যে চঞ্চল দুহিতা অবকাশের দিবাভাগে সচরাচর মায়ের অভিনিবিষ্ট সহকর্মী হিশেবে রান্নাঘরে অবস্থান করে, সে আজকে অনাবিষ্ট হয়ে আছে; ব্যাপার কি? সৌমিকের সাথে গোলমাল হয় নি তো! নাহ, সৌমিক তো ন’টার আগে বিছানা ছাড়তেই নারাজ। এ হতচ্ছাড়াটাকে নিয়ে হয়েছে যত দিকদারি! নানা, দাদা, বাপ- কারো জীনে এমন আলসেমির অভ্যেস আছে বলে শুনি নি; এটা হয়েছে একেবারে উল্টো! জাতে অজাত!
‘জিতুও ছোটবেলায় অমন করত, আর ওর মা ইচ্ছে মতোন বকা দিত; প্রাকটিসে আসতে দেরি হত, তাই প্রায়শ ওর গন্ডদেশে আমাদের ‘শ্রদ্ধেয় গুরু’-এর পাঁচ আঙ্গুলি আল্পনা আঁকত। আহ! কি ফিলিংস হত মাইরি!’
‘দ্যাখো কান্ড! মানুষে কষ্ট পেত আর শিমু কেমন মজা নিত! কোন জাতের মেয়ে মানুষ গো তুমি, জোয়ান একটা ছেলে মাইর খাইত আর তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চুপার মহা-ভূমিকা পালন করতে!’
‘ইচ্ছে করেই করতাম, ভালো লাগত। সে ভালো লাগার মজা তুমি কি বুঝবে! বুঝবে না।
এই যাহ! রিমির কথা ভুলেই বসেছি; নাকি পিরিয়ডের সময় হয়েছে? নাহ, সে তো দিন দশেক বাকি, চেহারাও তো সে কথা বলছে না। হলো কি মেয়েটার? নাকি সুমন রাস্তায় একা পেয়ে... ছি: নিজের মেয়ের সম্পর্কে কি সব নোংরা কল্পনা প্রসব করছি!
‘তবে জিতু কিন্তু জোস ছিল; লম্বায়, চেহারায়। উফ! শরীরটা কেমন টানত ওর দিকে। ছি: ভাববে না আমি চরিত্রহীনা ছিলাম। শরীরটা টানত, বলতে: নাচের প্রাকটিসের সময় মনে হত, ওর সাথে যদি প্রাকটিস করতে পারতাম! কিন্তু সে কপাল হয় নি কোনোদিন। ও অনিমার সাথে নাচত। এক্সপ্রেশনের চে’ ঢের এক্সপ্রেশন দিত অনিমা। দেখেই গা জ্বলত!’
‘দিদি, এই প্রসঙ্গ পাল্টাও; ভাল্লাগছে না!’
‘ওকে, প্রসঙ্গ চেঞ্জ; এখন বলো চা দেবো এক কাপ?’
‘দাও দিদি, টিভিটা অন করে দিও প্লিজ, রাজনীতির একটু খোঁজ নেই।’
‘ধ্যাত! তোমার রাজনীতি, ভাল্লাগে নাহ! জাস্ট থ্রি মিনিট ওয়েট করো, চা চলে আসবে। আর তোমার বামহাতের কাছে হাত দাও, দ্যাখো, রিমোটটা তোমার দিকে চেয়ে আছে।’
‘তোমাকে ধন্যযোগ, পেয়েছি দিদি।’
আল্লাহর দুনিয়ায় এই কিসিমের মানুষও আছে? কেমন বেহায়া রে বাপু! স্বামীর এত টাকা এরপরও অন্যের ঘরে চা খোঁজে!

সত্যি বলতে কি, এই বেআক্কেলি কাজগুলো সইতে সইতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। গুরুর যেমন চায়ের কাপে চুমুর সাথে মাঝেমধ্যে সিগারেটে টান দেয়ার অভ্যেস ছিল; একটা সময় মনে হত, ঠিক’ই আছে, ছেলে মানুষ দু’এক টান দিতেই পারে। এ নিয়ে রাজনীতি করার কিচ্ছু নাই!
২.
‘মা, তুমি আসলেই খারাপ! তোমাকে সেইদিন কতবার বললাম: চলো কুড়িগ্রাম যাই, সৈয়দ শামসুল হককে দেখে আসি; নাহ! তোমার কান অবধি গেল’ই না কথা; বেগম রোকেয়া ভার্সিটিতে গতবার আসলো, তখনো নিয়ে গেলে না।’
‘সকাল  সকাল এতো চিল্লাস ক্যান? আচ্ছা, যাবো এবার, প্রমিজ।’
‘রাখো তোমার প্রমিজ! এবার গিয়ে তো তাঁর কবর দেখতে হবে!’
‘কবর..! হায় আল্লাহ! বলিস কি! তিনি মারা গেছেন?’
‘তুমি তো আছো তোমার পরানের দিদিকে নিয়ে, জানবে কেমনে? খবরে দেখলাম।’
আসলে আমি একটা খারাপ মানুষ! না মা হিশেবে, না স্ত্রী হিশেবে- কোনো দিক দিয়েই উপযুক্ত নই আমি।
‘বলিস কি রিমি? ক্যামনে কি! বুঝলাম না!’
দিদির চোখে জল টলমল করছে। কেঁদে দিবে- এমন একটা ভাব; ভাব না, সত্যি জল গড়িয়ে পড়ছে, আমারও। দু’বার তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম, কোনো ছবি তোলা হয় নাই, তাঁর সাথে। ইস! মেয়েটার এই ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পেলাম না। দিদি, আমি আর রিমির পছন্দের কবি ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।
মেয়েটা কাঁদছে, কাঁদুক। কাঁদলে মন হালকা হয়। ওকে ডিস্টার্ব না করাই ভালো এখন।
৩.
বরফগলা সকাল। কঠিন শীত নেমেছে এবার। জানালা খুললেই মেলে থাকা চোখের দৃষ্টিকে আলিঙ্গন করে শাপলাচত্বর, শাপলা সিনেমা হল, এতটা কাছে। সেটাও দেখা যাচ্ছে না আজ।
রিমি কলেজে গেছে, কারমাইকেল কলেজে; যেটাকে বাবার দেশের লোকেরা ‘লালবাগ গরুহাটী কলেজ’ বলত। অবশ্যি যে ভুল বলত, তা কিন্তু নয়! কলেজের পাঁচিল ঘেঁসে হাট; রবিবার, বুধবার- হাটবার। আনিসুল হকের ‘লাল পিরান’ নাটকেও এ হাটের নাম আছে, শুনেছিলাম মনে কয়।

আর ছেলেটা রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ছে, এবার চান্স পেল। এমন ভাগ্য খুব কম বাচ্চাদের হয় যে, নিজের  জেলাতেই পড়ার, বিশেষ করে মেডিকেলের ক্ষেত্রে। সে খেয়ালে ছেলেটার আমার কপাল ভালোই!
‘স্বামী তো কাজ আর কাজ! স্ত্রীকে ছুঁয়ে দ্যাখারও ইচ্ছে হয় না! জিতুকে কত ছুঁতে চাইতাম, ব্যাটার কত্ত দেমাক! আমারে ছোঁয়ই না।’
‘হুম, এই কথাটা তুমি ঠিক বলছ; আমি তোমার ভাইকে কত্ত চান্স দিতাম কলেজ পড়ার সময়, চান্স নিত না। কত পহেলা বোশেখে, কত আগুনঝরা পহেলা ফাগুনে- আমার যতœ নিয়ে সাজা রূপচর্চা বৃথা গ্যাছে! সব সময় বলত- বিয়ের পর। এখন অবশ্য আদরই করে। থাক, বেশি না বলি; বললে আবার তোমার মনে আগুন লাগবে!
‘বাহ! তুমি ভালোই..
‘চুপ পাজি!
‘হুম, ঠিক বলছ; থাক, চুপ মারলাম। দেখো দেখি কান্ড! শীতে বাচ্চাগুলি যে ক্যামনে বাহিরে গেল!
‘ঠিক, ওদের মতো বয়সে আমিও কত দুরন্তপনা দেখিয়েছি!
‘তুমি বসো, আমি কফি বানাই, কি বলো?
‘আচ্ছা, রোজ এভাবে জ্বালাই, কিছু মনে করো নাকি?
‘ধুর, তুমি আমার দিদি না! কি মনে করব আবার! তুমি বসত চুপটি করে, আমি আসছি।’
‘দেখলেন তো কি পরিমাণ মিথ্যে বলতে পারি আমি, ভিতরে ভিতরে ইরিটেড হই আর মুখে বলি ভালো কথা। আসলে কেনো বলি, সেটা ক্লিয়ার করা দরকার। এই যে ভদ্রমহিলা - যার স্বামী গত দু’মাস আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। অথচ তিনি গত পরশু-ও বললেন তার স্বামী নাকি তার জন্য কত কি কিনে এনেছেন; আসলে তো..
ডাক্তার বলেছেন: ওনার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। প্রচন্ড মানসিক চাপে, কষ্টে তার এ অবস্থা হচ্ছে; এমন পরিস্থিতিতে তার মনের বিপরীতে কিছু করা বা বলা-দুটোই খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে।
‘মানুষটাকে, পর করে দেবার কারণ তাই খুঁজে পাই না!
‘এই যা! কফি তো পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়! নাহ, পোড়ে নি; আর একটু দেরি হলেই সব নষ্ট হত।
৪.
আচ্ছা, শীতের রাত এত লম্বা হয় কেন! বিচ্ছিরি লাগছে। শরীরটা কেমন পোড়াচ্ছে! অথচ বৈবাহিক বন্ধনসূত্রে পাওয়া স্বামীটা সেটা কিছুতেই বুঝতে পারে না; পাশ ফিরে শুয়ে আছে। প্রথম প্রথম অবশ্য রেসপন্স দিত ভালোই, নইলে রিমি আর সৌমিকে আমদানি কেমনে করলাম!
কেনো জানি সৈয়দ শামসুল হকের ঐ কবিতাটা মনে পড়ছে, ঐ যে-
‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,’
জীবনের সাথে যেন মিলে গেছে কবিতাটা। কলেজে থাকতে আমি এই একটি কবিতাই যে কতবার আবৃত্তি করেছি; তার হিশেব কষা কঠিন। এই কবিতাই, এখন আমার জীবনের জাতীয় সঙ্গীত। হায় রে দুনিয়া! কল্পনা কেমনে বাস্তব হয়! তাহলে কল্পনা করা কি পাপ? যার ফল বয়ে বেড়াতে হয় চিরকাল! তবে সব কল্পনা বাস্তব হলে, আমার কাচ্চা-বাচ্চারা তাদের দাদি-দাদার মুখও দেখতে পেত।
আচ্ছা, জিতু এখন কি করে, কোথায়, কেমন আছে? অনিমার সাথে কি বিয়ে হয়েছে ওর- আমার আধমরা মনে এর কোনো উত্তর নেই।
প্রথম যেদিন ডান্স ক্লাবে জিতু আমাকে দেখল, কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ও। সে ভাষা আমি বুঝতাম না, কেবলেই মনে হলো- এই তো একটা মুখ, এইতো একজোড়া ঠোঁট, যে ঠোঁটে আমি নিশ্চিন্তে চুমু আঁকতে পারি।
জীবনে একজোড়া ঠোঁটেই চুমু আঁকতে হয়, দ্বিতীয় জোড়ায় চুমু আঁকা মানেই চরিত্রহীনতা? যদি ভাগ্যরেখার হেরফের হয়! দ্বিতীয় জোড়ায় ঠোঁট রাখতেই হয়; তা হলেও কি ‘চরিত্রহীনতা’ ?
৫.
‘না, আমার ইশারায় সাড়া দেয় নি জিতু, অনিমাকে ভালোবেসেছে ও।’
‘ধুর, তুমি আবার সে ছেলের কথা মনে করে চোখ ভেজাও? তুমি একটা ম্যাড! এসব করতে হয় না রে পাগলি, স্বামীকে কাছে টানার চেষ্টা করো, আরো বেশি ভালোবাসো।’
‘হুম, তাই তো করি দিদি। আজ চলো, তাজহাট রাজবাড়ি যাই, সেই বিয়ের পর একবার গিয়েছিলাম; আর যাওয়া হয় না!’
‘হা হা! তোমার মাথা গ্যাছে। এজ কত হইছে, সে খেয়াল আছে! কত বড়ো বড়ো দুই সন্তানের মা হইছ আর শখ করছ তাজহাট যাবা!’
‘তাতে কি হইছে, আজব!
‘তুমি সত্যি যাবে?
‘নাহ, যাব না। এবার চুপ যাও, প্লিজ।’
দ্যাখেন কান্ড! কেউ বলবেন এই মহিলা অসুস্থ! যেকোনো সময় যে পাগল হয়ে যেতে পারে! আল্লাহ মালুম, কি আছে তার কপালে। চল্লিশ বছর বয়সের ছাপ পড়েছে তার চোখের নিচে, গালে, চুলে। সে খেয়াল তার রাখার ফুসরতই নেই যেন!
‘দিদি, চলো হাঁটতে হাঁটতে কলেজের দিক যাই। কতদিন যাই না!’
সিম্পল ঘটনাকে প্যাঁচিয়ে ‘কাহিনী’ না বানিয়ে,  রাজি হয়ে গেলাম। সৌমিক মেডিকেলে আর রিমি প্রাইভেট পড়তে গেছে লালবাগের দিকে। ও- কে না হয় ডেকে নেয়া যাবে আড্ডায়।
হাঁটছি, আমি আর দিদি; মানে সাবিনা ভাবি-যাকে দিদি বলতেই ভালো লাগে আমার। চোখগুলো কেমন জ্বলজ্বল করছে দিদির! বাহ! ভালো লাগছে বোধ হয়, আমারো বেশ লাগছে।
‘আচ্ছা, তোমার জীবনটা এমন হলো ক্যান?’
‘ক্যামনটা লাগে! শালীর কাজ নাই, খালি আমার পাস্ট-হিস্টোরি ঘাটাঘাটি!
রাগটাকে দমিয়ে রেখে, মুখে বললাম: দিদি, রবির দোকানের চা’টা দারুণ। চা খেয়ে, কলেজের দিক হাঁটতে হাঁটতে বলব।
৬.
সেদিন আর বলা হয় নি। বলেই বা কি হত! যা হবার তা তো হয়েই গেল। তবে এটা যে হবে, তা কল্পনাও করি নি। কারণ, রিমি আর সৌমিক কত বড়ো হয়েছে, ওদের দিকে তাকিয়ে হলেও এটা অসম্ভব। কার মুখে কি শুনল, নাকি সাবিনা ভাবি কিছু বললো; বুঝতে পারলাম না।
বাড়িতেই রেখে গিয়েছি, টিভি দেখছিল। ছেলেমেয়ে দু’টো তাদের জায়গায়- কলেজে, মেডিকেল।  আধা-ঘন্টা খানিকের মাথায় লালবাগ থেকে বাজার করে, ঘরে ঢুকেছি-
‘তুই চরিত্রহীনা, তোর জিতুর সাথে সম্পর্ক ছিল। তোকে আমি তালাক দিলাম- এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক...’
‘চুপ করো, রিমির বাবা চুপ করো। কি বলো এসব!
খরচের ব্যাগটা হাত থেকে ফ্লোরে, সদ্য কেনা আলু-শিম-টমেটোগুলো প্রচন্ড ঝাঁকুনি পেল, ব্যাগের ভিতরে।
পায়ে পড়ে কত কান্নাকাটি করেছি, হাত জোড় করেছি, শোনে নি সেদিন। যেই মানুষটার জন্যি বাপ-মা ছেড়ে আছি, সে এটা কিভাবে বললো!
৭.
বাবা সেই বার ইলেকশন করছেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান’ পদের জন্যি।
সে উপলক্ষে আমাদের গ্রামে নাট্যদল, নৃত্যশিল্পী আনলেন বাবা। রোজ সন্ধ্যেবেলা যারা নাচ-গানে মাতায় গ্রামের মানুষদের; জায়গায় জায়গায় নির্বাচনী প্রচারণার অনুষ্ঠানের পর বাড়িতে ফেরা মানুষদের জন্য বাড়তি আনন্দ। নৃত্যশিল্পী হিশেবে এসেছিল ‘আখতারুল’ নামে একজন।
‘এল’ প্যাটার্নের আধাপাকা প্রকান্ড বাড়ি। দুপুরবেলা, বাবা প্রচারণায় বেরিয়েছেন, মা-ও বেরিয়েছে বাবার সাথে। নাট্যদলের সবই একটু বাজারের দিক গেছে। বাড়িতে ভোলার মা, আমি আর সেই আখতারুল।
পড়ন্ত বিকেল। বাড়িটা এখন অনেকটা সুনসান।
আমার পাশের ঘরটাতেই ভাতঘুম দিয়েছে আখতারুল। আমার মাথায় আবার কি যে ভূত চেপেছে, নাচ শিখব। ভাবলাম, জেগে আছে কিনা দেখি, নিজের ইচ্ছের কথা বলি তাকে।
নির্ভয়ে ঘরে ঢুকলাম, আস্তে আস্তে। দেখি, শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বসলাম। বাহ! কি মায়াভরা মুখটা! কত স্মার্টভাবে কথা বলে, কি সুন্দর নাচে! গতকাল স্কুল মাঠে প্রাকটিস করার সময় দেখেছি। 
আমি দুষ্টামি করে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা থেকে পানি নিয়ে, আখতারুলের মুখে ছুড়লাম, একটু; ভয়ে চমকে উঠল সে!
ভাগ্যিস ভোলার মা বাড়ির পিছনের পুকুরপাড়ের দিক ছিল! আখতারুল চিৎকার করতে যাবে- অমনি আমি তার মুখ চেপে ধরলাম। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষেকে ছুঁইলাম। সে উঠে বসতে চেষ্টা করলো; হাত সরিয়ে নিলাম আমি, তার মুখ থেকে। চলে আসব- ঠিক, ঐ সময় হাতটা আস্তে করে চেপে ধরল আখতারুল। লজ্জা লাগছে ভীষণ!
তারপর.... নাচ শেখানোর নাম করে, দরজা বন্ধ করে..
আর বলতে পাচ্ছি না! কারণ, জীবনের প্রথম ভালো লাগার পুরুষ এই রকম স্মৃতি উপহার দিবে, ভাবি নি। হ্যাঁ, বলতে পারেন চিৎকার কেন করি নি? চিৎকার করার সুযোগ কি ছিল? চিৎকার করতে চেয়েছিলাম, আমার গলা টিপে ধরেছিল। বুকটা তছনছ করে দিয়েছে সেদিন, ইচ্ছে মতো হাত চালাচ্ছিল বুকে। দম বন্ধ হবার উপক্রম...
এ ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ভোলার মা। ও তো চিৎকার করতেও পাচ্ছে না! লোক জানাজানি হলে এ বংশের মান শেষ হবে- এই ভয়ে। এই ভোলার মায়েই আমাকে স্কুল নিয়ে যাওয়া-আসা করত। কত আদর করত!
ভোলার মা কোনো মতে ঘরে ঢুকতেই, আখতারুল নিজেকে সামলে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে।
‘ঐ খানকির ব্যাটা, কই যাস! খাড়া!
‘না, ভোলার মা তাকে ধরতে পারে নি তাকে, পালিয়েছে।
আশপাশে লোকেদের বাড়ি নেই বললে চলে, আছে কিছু দূরে দূরে। আমাদের বাড়ির আশপাশে খালি পুকুর আর বাঁশঝাড়। বাড়ির পাশে বিশাল বাঁশঝাড়, এটা গিয়ে লেগেছে স্কুলের পাশের রাস্তায়; কোনো মতে বাঁশঝাড় পেরুতে পারলেই- পগার পার! কে চেনে!  চিনলেও ভাববে, বোধ হয় বিড়ি খেতে যাচ্ছে বাজারে।
ছেড়া কামিজটা লুকিয়ে ফেলা, জঘন্য লীলার ঘরটাকে ঠিক করে রাখা, সব কাজ করেছে ভোলার মা। আমার ঘরের বিছানায় আমাকে শুয়ে দিল সে। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বুকটা কেমন জ্বলছে, চিরে গ্যাছে দু এক জায়গায়, মনে হয়। ভোলার মা চোখ মুছতে মুছতে ঘর ছেড়ে বের হলো।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বাবা মা ফিরলেন। জানোয়ারটা সত্যি পালিয়েছে।
ভোলার মা, আমার মাকে ফিসফিসিয়ে বললো: ভাবি, বেটির মনে হয় স্রাব হইচে, পোথথোম পোথথোম তো! জ্বলা-যনতোনা কইরবার ধচ্চিল। মুই অসুদ আনি খিলি দিচো। শুতি আচে, উয়ার কাচে যাবার দরকার নাই।
আমি ঘুমের ভান করে সব শুনছি, কাঁথার নিচ থেকে।
‘আচ্ছা, তুই তাহলে ওর সাথেই থাকিস রাতে, খেয়াল রাখিস। কিছুক্ষণ পর আমরা দক্ষিণপাড়ায় যাব, তোর সাহেবও যাবেন। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত।’
বাবা ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করেন নি; বাবা অস্থির তার গুণধর ভাড়াটে নৃত্যশিল্পীর জন্যি। বিরোধীদলের চেলাদের হুমকির মুখেই কি আখতারুল পালিয়েছে? -এমনটাই ভাবছে সবাই। বাবা বললেন: আমার খাসা দুই হাজার টাকা গেল রে!
বাবা সেইবার হেরে গেলেন। বাবা ভেঙে পড়েছেন। বড়ো ভাইয়েরা ইংল্যান্ডে, দেশে যে আসবে সে সুযোগ সহজে হয় না।
‘বাবা আর যেন নির্বাচন করতে না দ্যাখি আপনাকে; কি দিয়েছে নির্বাচন: ফোনে রাগ নিয়ে বললো কথাগুলো, ভাইয়েরা।
রাগে জ্বলছি আমিও, এই রাগে আমি কেমন করে শীতল হই! এই একটা কারণে সবাই আমাকে ভয় পায়, সেটা হলো- জেদ। জেদ চাপলে কারো সাধ্য ছিল না আমাকে আটকায়। ভাইদের বলে দিলাম: ক্লাশ এইট, এই গ্রামে পড়ছি না আমি! রংপুরে পড়ব। স্ট্রেটকার্ট বললাম কিন্তু! নো চান্স টু চেঞ্জ ইট।
৮.
কেরানিপাড়া। শীতের সকাল। মিষ্টি রোদ, ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে।
‘হন্নে হয়ে খুঁজলাম আখতারুলকে, পেলামও দু’মাস খুঁজে; পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে। কিন্তু না চেনার ভান করলো সে।’
‘বলো কি দিদি! আখতার ভাই তোমাকে চিনল না?’
‘না, আমাকে দেখে যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়ল। আমিও ছাড়ার পাত্রী নই, উচ্চ মাধ্যমিক অবধি পড়ার পাশাপাশি ডান্স শিখলাম। হ্যাঁ, ওরই ডান্স ক্লাবে। জীবনের প্রথম পছন্দের পুরুষকে ‘স্বামী’ হিশেবে পেতে কার না ইচ্ছে থাকে! আমারো ছিল।’
‘দিদি, তুমি পারোও বৈকি! পরে কি তুমি বিয়ে করে নিলে?’
‘হুম, তবে বাবা মা কেউ রাজি ছিলেন না, ভাইয়েরাও না। আর সে-ও তো অনেক টালটি-বালটি করছে, তাই তো জিতুর সাথে মিশতে চেয়েছিলাম; ও-কে ক্ষ্যাপানোর জন্য, দেখানোর জন্য। কেরানিপাড়ায় মামা বাসায় থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি, অনার্স ভর্তি হয়ে বিয়ে।’
‘তাহলে মামাই তো সব খরচ চালাত তাই না? মামী কেমন?
‘আজ্ঞে, না জনাবা; আমি তিনটে টিউশনি করাতাম, সে সময়ে। তিনটে মিলে তিনশ টাকা পেতাম; নিজের যৎসামান্য প্রসাধনী, টুকিটাকি খরচ, পড়ার বই- সব ওই টাকা দিয়েই ম্যানেজ করতাম; ম্যানেজ হত না, তবুও করে নিতে হত। মামীটা ভালোই ছিল, রোজ দুইবেলা খেতে দিত, আরেক বেলা না খাইয়ে রাখত; বেশ তাই না?’
‘এটাকে কেউ বেশ বলে! তুমি যে কি বুঝি না!’
‘আমি তোমার দিদি, হা হা!’
‘হা হা’
৯.
শালবন মিস্ত্রীপাড়া।
দোচালা বাড়ির মধ্যবিত্ত উঠোনটায় লাগানো আম্রপলি গাছটায় মুকুল এসেছে। রক্তগাঁদার গাছটা একটুখানি নেতিয়ে পড়েছে, রিমি লাগিয়েছিল শীতে।
আজ কত বছর হয়ে গেল; অথচ সাবিনা ভাবির কোন খবর নাই! তার বাবা-মা নিয়ে গেলেন বাড়িতে, চিকিৎসা করানোর কথা বলে। আর কই ফিরে আসলো দিদি! আমার জন্য আজ কত্ত আনন্দের দিন! দিদি থাকলে খুব খুশি হত। রিমি আর সৌমিক- আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে; সরকারি খরচে। রিমি যাচ্ছে পলিটিক্যাল সায়েন্সে ছ’মাসের একটা কোর্স করতে; আর সৌমিক পি.এইচ.ডি. করতে। ভাবছি ওদের এবার লেখাপড়ার পাঠটা চুকে গেলে বিয়ে দিয়েই দিব; বয়স তো কম হলো না, ওদের।
মানুষটাকে ছাড়া কি সুখের দিন গ্যাছে সেটা আর কত বলি! বাবা বিছানায় পড়েছেন, মা-ও অনেক দূর্বল হয়ে গেছে; ভাইয়েরা খোঁজ নেন না। কিছু জমি, দুটো পুকুর বর্গা দিয়ে-যা আসে তা দিয়ে মা-বাবার দিব্যি চলে। রমেশ কাকুর সাথে সেদিন সিটি মার্কেটে দেখা হলো; কেমন বুড়ো বুড়ো ভাব চলে এসেছে চেহারায়। তার কাছেই বাবা-মার খবর শুনলাম।

রিমি, সৌমিকদের একটা বড়ো কষ্ট- নানা, নানিকে দেখল না তারা।  ভাবছি- অনেক বছর তো হলো, নিজেও সেই কত বছর থেকে বাপের মুখ দেখি না, মায়ের কোলে মাথা রাখি না; যাব নাকি ওদের নিয়ে আজ! রাগ কত পুষে রাখি?
ছেলে-মেয়ে দুটো জীবনে অনেক কিছুই পায় নি। কত কি খেতে চাইত, ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যেতে চাইত; কিন্তু শেষ অবধি যাওয়া হত না। নিজেরা টিউশন করিয়ে টুকটাক নিজের খরচাপাতি চালাত। একটা বেসরকারি স্কুলে পড়িয়ে যা পাই; তা দিয়েই এই বাড়াবাড়িতে থাকছি, ওদের নিয়ে। চেয়েচিন্তে চলতে হয় প্রায়শ, তবু বাবার কাছে যাওয়া হয় না।
‘মা, বাবাও কিন্তু কম নয়। মা হয়ত আমার জন্যি কাঁদে, খুব কাঁদে! সে কান্নার কোনো ভ্যালু নিশ্চয়ই দেন নি বাবা! দিলে মা ঠিক আমাকে খুঁজত, এখানে আসত। আর মামা- সে তো আমার বিয়ের আগেই পৃথিবীকে ‘গুড বাই’ বলে দিয়েছেন; হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। মামী তো মামার লোকান্তরে চল্লিশ দিনের মাথায় বাবার বাড়ি গেছে, আর ফেরেনি; ফিরেই বা কি হবে! ছেলেপুলেও তো নেই; একটা মেয়ে দু’বছর বয়সে নেকমরদের মেলায় হারিয়ে গেল, বড় ছেলেটা কোন ফটকাবাজ মেয়ের পাল্লায় পড়ে পালালো আর কোনো খবর নাই; বোধ হয় বিয়ে-শাদি করেছে।
ছেলে মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে, আখতারুলের প্রিয় সেই স্মৃতিমাখা বাড়িটা ছাড়তে হয়েছে আমাকে। মিস্ত্রীপাড়ায় এসে উঠতে হয়েছে এই বাড়িতে। কতবার বাড়ি করতে চাইল ওরা, কিন্তু করা হয় না। তবে এবার বানাতেই হবে, ওদের জন্যি।
‘আচ্ছা, রিমির বাবা কোথায় আজ? আমার কথা কি একটা বারও মনে ওঠে না! আমি তো একজোড়া ঠোঁটেই চুমু এঁকেছি, অথচ সে বুঝল না!
দেখতে- সত্যি স্মার্ট ছিল আখতারুল, জিতুর চে’ ঢের স্মার্ট। পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটার দু’গাল জুড়ে শোভা পেতো চাপদাড়ি; গায়ের রঙটা ফর্সা।
নিশ্চিত আর একটা বউ পেয়েছে, যে তার চাহিদার রাতের উপযোগ মেটায়; ভেজা চুলে ঘুম ভাঙায় হয়ত!
১০.
কাজলা, রাজশাহী।
রাত বারোটা।
গত পরশু রংপুর টাউন থেকে ফেরার পথে, কুড়িয়ে পাওয়া এই ডায়েরিটা নতুন নয়, পুরনো; নৃত্যশিল্পী  জপিদ খানের কাছে। চোখের পানি ঝরছে, দু’গাল বেয়ে। ডায়েরিটার শেষে লেখা: ০৫-১১-১৮; আর আজ ০৯-১২-১৮। তার মানে.. ওই অনুষ্ঠানে সে এসেছিল, বেঁচে আছে এখন।
এটা স্কুল শিক্ষিকা শিমু আহমেদের ডায়েরি নয়, এটা জপিদের প্রথম স্ত্রীর লেখা ডায়েরি, অংশুর ডায়েরি। নিজের নাম, স্বামীর নাম, বাচ্চাদের নাম, দিদির নাম- সব কাল্পনিক; ‘জিতু’ আর ‘শ্রদ্ধেয় গুরু’ শব্দ দুটো সত্য, হিমালয়ের মতোন সত্য।
সেদিন অংশু বাজারে গিয়েছিল। অংশুর শোবার ঘরের টেবিলে পড়েছিল ডায়েরিটা; পড়ল জপিদ। সংকীর্ণ মনে সন্দেহ জন্মালো, মাথায় আগুন উঠল - ব্যস! মুখের উপরে তালাক! কতটা বোকামি করেছে জপদি, কতটা জঘন্য মানুষের পরিচয় দিয়েছে অংশুর কাছে- এখন বুঝতে পাচ্ছে। আচ্ছা, ফিরে যাবে ওর কাছে! না, কোন মুখ নিয়ে যাবে?
যে মেয়ে সেই ছোট্টবেলায়, তার সাথে ঘটে যাওয়া নোংরা স্মৃতিকে মনে চেপে ধরে, আবেগের বশবর্তী হয়েছে; নিজের সাথে স্ট্রাগল করে, বাপ-মা, ভাইদের ছেড়ে, শত অপমান সহ্য করে- এই অমানুষটাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল; সেই মহতী রমণী অংশুর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে জপিদ? আর অনাদরে, চেয়েচিন্তে, খেয়ে, না খেয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েগুলো! ওদের কি জবাব দেবে? ফিরে যাবার কি আসলেই রাস্তা খোলা আছে?
বাইশ হাজার টাকায় কেনা কড়াই কাঠের দৃষ্টিনন্দন বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে রাইসা, শুধু আজ নয়; বিয়ের পর থেকে গত দশটা বছর! প্রায়শ ওইভাবে শোয়- জপিদের দ্বিতীয় স্ত্রী। কোনো ছেলেপুলে হয় নি রাইসার; সমস্যাটা বউয়ের, ডাক্তার বলেছেন।
বাবা-মায়ের কথায় অসম্মতি জানানোর পথ ছিল না; বাধ্য হয়ে স্বামীপরিত্যক্তা রাইসাকে তাই বিয়ে করতে হয়েছে জপিদের। বিয়েটাই করা হয়েছে; কিন্তু, মনে তো অংশু-ই বাস করে, ওর জন্য চোখ জোড়া ভেজে কত রাত, সে কথা কি অংশু জানে?
আজ অংশুর ডায়েরিতে লেখা সেই কবিতাটা.. হ্যাঁ, সৈয়দ শামসুল হকের সেই কবিতাটা মনে পড়ছে জপিদের-
‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
 ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়, ’

জীবনবোধের সফল চিত্রকল্প : বনলতা সেন

জীবনবোধের সফল চিত্রকল্প : বনলতা সেন


জীবনবোধের সফল চিত্রকল্প
বনলতা সেন
 
মোস্তফা কামাল

বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত চরিত্রের জনপ্রিয়তা যাচাই করলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বনলতা সেন চরিত্রটি নির্বাচিত হবে বলেই আমার মনে হয়।  কবি জীবনানন্দ দাশের চেয়েও বনলতা সেন চরিত্রটি বেশি জনপ্রিয়। বনলতা সেন আসলে একটি স্বপ্ন, একটি  গান, একটি নাটকীয় চরিত্র। প্রেমিকের কাছে বনলতা তার প্রেমিকা, প্রেমিকার নিজের কাছে সে নিজেই বনলতা। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৩৬ সালে কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত তৎকালীন ‘কবি’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায়। পুস্তকাকারে প্রকাশ পায় ১৯৪২ এ বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ কবিতা সিরিজে। এতে জীবনানন্দ খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন কবিতাটির সম্মানজনক একটি স্থান। অবশেষে ১৯৪৪ এ জীবনানন্দের ‘মহাপৃথিবী’ নামে নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়; বনলতা সেন এর স্থান হয় এই কাব্যগ্রন্থটির শুরুতেই। এতেও কবির মনোতুষ্টি হয়নি। কবি হয়তো তখনই অনুমান করতে পেরেছিলেন কবিতাটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে; মর্যাদা সম্পর্কে, এর দীর্ঘায়ু সম্পর্কে। তিনি চেয়েছিলেন নিজের এই সৃজন কর্মটির উচিত মর্যাদা দিতে। সবশেষে ১৯৫২ তে বনলতা সেন নামে তাঁর পূর্ণাঙ্গ একটি কাব্যগ্রন্থই আলোর মুখ দেখে; এবং গ্রন্থটির প্রচ্ছদ আঁকেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।  জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর পা-ুলিপি ঘেঁটে দেখা যায়, কবিতাটি লেখা হয়েছিলো ১৯৩৪ সালে। সিটি কলেজের সহকারী লেকচারারের চাকরি হারানো সত্ত্বেও কবি জীবনানন্দ কলকাতায় বাস করতেন। তিনি সর্বদা রুল করা খাতায় লিখতেন। কবিতাটি আট নম্বর খাতার (কবি নিজেই সেই খাতাগুলোকে ১, ২, ৩ করে নম্বর দিয়ে রাখতেন) ২৪ তম পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বনলতা সেন কবিতার  পা-ুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে ।
কবিতার মূল ভাবটিকে অনেকে ১৮৩১ সালে লেখা এডগার এলেন পোর টু হেলেন কবিতার সাথে তুলনা করেন, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে ভাবতে ভালবাসেন। যারা পো’র নাম শুনেন নি বা ইংরেজি কবিতার প্রতি আগ্রহ কম, তাদের একটি তথ্য জানা প্রয়োজন যে, হলিউডের জনপ্রিয় নায়ক টম হ্যাঙ্কস দি ‘লেডিকিলার’ মুভিতে এই কবিতা কিছু অংশ আবৃত্তি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রভাব কাটিয়ে কল্লোলযুগের পাঁচ কবি যে আধুনিকতার অনুসন্ধান করছিলেন তার যোগ্যতম প্রতিনিধি বনলতা সেন কবিতা। তাই এই কবিতাটি বাংলা কবিতায় একটি নতুন যুগের সন্ধান দেয়। অথচ এই কবিতায় কোনো বিদ্রোহ নেই, সদম্ভ উচ্চারণ নেই, নিজের অনন্যতা ঘোষণা করার কোনো সূক্ষ্ম প্রচেষ্টাও নেই। কবিতাটির বুনোট অত্যন্ত নিবিড়, রোমান্টিকতার মড়োকে কবি পুরো মানবসভ্যতার পরিভ্রমণ আর গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনটি স্তবকের আঠারোটি লাইনের মাধ্যমে। কবিতাটি পাঠে মনোরম, শব্দচয়নে ঐতিহ্যনির্ভর, ভাবে মিলনোন্মুখ। হাজার হাজার বছরের অবিরাম সন্ধান শেষে ‘বনলতা সেন’ রূপী নারী অথবা প্রকৃতির কাছে মানবসভ্যতার স্বস্তিময় আত্মসমর্পণই কবিতার মূলসুর হিসেবে বেশিরভাগ পাঠকের কাছে ধরা পড়ে। কবি বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করেছেন বিদিশা নগরীর আঁধারের রহস্যময়তার সাথে, মুখশ্রীকে তুলনা করেছেন ‘শ্রাবন্তী’র কালজয়ী শিল্প উপাদান হিসেবে। ‘বেনলতা’র চোখ পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়দাত্রী, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়া মধ্যযুগের শিল্প-ঐশ্বর্য্যের ধারক ‘বিদিশা’র অমোঘ আকর্ষণের মতো। নেশা ধরানো চুল, শ্রাবন্তীর হাজারো স্থাপত্য আর লাখো শিল্পীর সযতœ প্রয়াসে আঁকা মুখচ্ছবির মতো তার রূপ। সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ পেছনে ফেলে পাখি যেমন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে তৃপ্তি পায়, ‘বনলতা’র চোখ তেমনি আশ্রয়।

কবি নির্মিত এই অপার্থিব নারীর অবয়ব নির্মাণে মাটির পৃথিবীর কোন নারী রসদ জুগিয়েছে তার রহস্য অনেকেই জানতে চান।
কেউ কেউ মনে করেন বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে । নামটির দু’টি অংশ হলো- বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই শান্তি খোঁজার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি বনলতা সেন নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র। আবার, বিশিষ্ট আমলা আকবর আলী খান তার ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে বনলতা সেনের ‘সেন’ উপাধি আর তার বাসস্থান নাটোর এই দুইয়ের সংযোগে আরেকটি ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যাটিও যথেষ্ট কনভিন্সিং। তাঁর  মতে, ‘নাটোর’ শব্দটির ব্যবহার শুধু বনলতা সেনের ঠিকানা নির্দিষ্ট করতে নয়, তার পেশা নির্দিষ্ট করতেও এ নামটি ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায় এ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর কাঁচাগোল্লার জন্য নয়, বিখ্যাত ছিলো রূপা জীবিনীদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে। ‘সেন’ শব্দটি তার বংশের পরিচয় বহন করছে, পেশা গ্রহণ করবার পর ‘বনলতা’ নামের আড়ালে সে তার নিজের আসল নাম গোপন করেছে। ‘দু দ- শান্তি কথাটির মূল অর্থ আদিম অভিসার, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রশ্নটি এই হাহাকার প্রকাশ করে যে, কবিতার ‘আমি’ আগে দেখা দিলে, বনলতা রূপাজীবা’র পেশাটি গ্রহণ করতেন না। দুঃসময়ে কেন পাশে ছিলেন না, এই হাহাকার বনলতার বুক জুড়ে। আর এই কবিতায় আরােপিত ‘অন্ধকার’ বলে দেয়, বনলতা সেন’দের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে পাওয়ার সুযোগ নেই। ‘অন্ধকারে মুখোমুখি বসবার’ স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে পাখির মতোই ঘরে ফিরে যেতে হয়; যেখানে অপেক্ষা করে সাধারণ নারী।

 বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন, তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন। কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন। কিছুদিন আগে জীবনানন্দের ডায়েরির প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতায়। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দের ডায়েরি রাখা রয়েছে । সেই ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্ হিসেবে ণ নামে
এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তাঁর নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন ণ= শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের চাচাতো বোন শোভনার প্রতি কবি বেশ দূর্বল ছিলেন। এই শোভনাই হচ্ছেন বা শচী বা বনলতা সেন। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়গুলোতে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শোভনা, দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শোভনাকে কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা। আসলে বনলতা সেন  কবিতায় বনলতা সেন কবির বিলুপ্ত কিন্তু শাশ্বত জীবনবোধের একটি চমৎকার চিত্রকল্প। আজন্ম বিষন্নতায় ডুবে থেকে কবি দেখেছেন বাংলার ধূসর সবুজ বৃক্ষের ডালে হলুদ পাখি। শুনেছেন ঘুঘুর ডাক। শরতের শুভ্রতায় লীন হওয়া ভোরের আকাশ। বিষন্ন মন অজান্তেই জলময়ুরের নাচ দেখে অতি সন্তর্পণে, নীরবেই ভেসে চলে প্রমোদতরী। স্ফটিকস্বচ্ছ কপালের নিচে মায়বী চোখ খোঁজে রূপালী চাঁদের আলো। দুলে ওঠে স্বপ্নের শাড়ি আর পৃথিবীটা ভরে ওঠে পরাজিতের কবরে। থাকে শুধু অন্ধকার। কবিতা লিখতে এসে জীবনানন্দকে বার বার চরম বঞ্চণা আর হতাশায় নিপতিত হতে হয়েছে; অপমানে নীলকণ্ঠ হয়েছেন অনেকবার। অথচ লোকটি ছিলেন চরম মৃদু, স্বল্প ও মিষ্টভাষী; জীবনের মারপ্যাচ, গলি-ঘুপচি অতোটা বুঝতেন না, বোধকরি বোঝার ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। বনলতা সেনই প্রথম এই কবিকে উঁচুতে তুলে ধরেন। এই কবিতাটিই প্রথম পাঠকের কাছ থেকে কবি স্বীকৃতি, জনপ্রিয়তা এনে দেয়; জীবনান্দ সেখান থেকেই কবি হয়ে ওঠেন। এমনকি জীবদ্দশায় তিনি যে একমাত্র স্বীকৃতিটি পান সে ঐ ‘বনলতা সেন’ এর জন্যই। ১৯৫৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে ‘বনলতা সেন’ ১৯৫২-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যের স্বীকৃতি পান।