আকাশটার আজ হয়েছে কি? মনে হয় যুগ যুগ ধরে কাঁদেনি অথবা যুগ যুগের জন্য কেঁদে নিচ্ছে।
একটু কমছে তো আর একটু বাড়ছে।যারা ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে তারাও বৃষ্টিতে ভেজা থেকে রেহাই পায়নি। বৃষ্টি যে তালে হচ্ছে একই তালে বাতাসও।
আজ
বাড়ি থেকে বেরোনোটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।যারা বাজারে এসেছে তাদের অধিকাংশই
এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পারেনি।বাড়িতে হয়তো গৃহিনীরাও রান্না বসাতে
পারেনি।রাত ন'টা বাজতে চলেছে। পড়ার সময়টা আজ দু'ঘন্টা দেরি হয়ে গেল।
ভাগ্যিস
কাল শুক্রবার।ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া যাবে।বাড়িতে গেলেই মা-বাবা বকাবকি শুরু
করে দেবে।সন্ধ্যার পর কখনও বাইরে থাকিনা অথচ আজ রাত ন'টা! যাক,বৃষ্টি
হওয়াটা তো আর মানুষের হাতে নয়। সব ওপর ওয়ালারই ইচ্ছে।
মহিম
ভাবছে আর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁটছে।হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট টুকুই
অবলম্বন। ক্ষণে ক্ষণে বিজলি চমকাচ্ছে। তখন অবশ্য লাইটের প্রয়োজন হয়
না।রাস্তার চারপাশে একবার তাকিয়ে নিতে গিয়ে গাছের আড়ালে মহিমের কি যেন চোখে
পড়লো। বিজলি চমকানো তখন বন্ধ হয়ে গেছে। মহিম মোবাইলের আলোটা এবার তুললো
গাছের আড়ালে। দেখলো সাদা একটা কাপড়। দেখে যা মনে হলো তাতে শাড়ির আঁচল কিংবা
ওড়না হবে হয়তো।টাপুর-টুপুর করে বৃষ্টি পড়ছেই।তবে এই মুহূর্তে কিছুটা
কমেছে।মহিম চিৎকার করে বলল, কে ওখানে,ওখানে কে?মহিমের চিৎকারের সাথে সাথেই
মনে হলো কাপড়টা আরো গাছের আড়ালে চলে গেলো। মহিমের কৌতূহল বেড়ে গেল।
ভূত-পেত্নী নয়তো!
ধুর,এখন
আবার ওসব আছে নাকি।তবে মহিম গাছটার ওপাশে গেল না।সেখানে দাঁড়িয়েই জোরে
জোরে বলতে লাগল কে ওখানে, বেরিয়ে আসুন বলছি।বেরিয়ে আসুন, কে ওখানে? কে,কে
ওখানে----।
বলতে
বলতে আলোর বিপরীত পাশ থেকে কে যেন বেরিয়ে এলো।মহিম আলোটা ঘোরালো।দেখলো
একজন মেয়ে মানুষ। বৃষ্টিতে ভেজা।দুই হাতে বুক ঢেকে রেখেছে। মেয়েটি মাথা
নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে অচেনা একটা মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে
হয়তো ভয় করছে।লজ্জাও পাচ্ছে হয়তো। কারণ তার শরীর বৃষ্টিতে একদম ভিজে গেছে।
মহিম আলোটা অন্য পাশে ঘোরালো। তারপর জোরে জোরে বলছে, কে আপনি?ওখানে কি
করছিলেন?মেয়েটি মাথা নিচু করেই বলল, বাসায় যাচ্ছিলাম।বৃষ্টির মধ্যে আটকা
পড়ে এখানে লুকিয়ে ছিলাম।
মহিম
কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল।তারপর বলল, আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।আপনার যদি
কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সাথে আমার বাড়ি যেতে পারেন।নয়তোবা এত রাতে
কোথায় যাবেন। মেয়েটি এবার মুখ তুলে মহিমে দিকে তাকালো। আলোটা নিচে ছিল।
অন্ধকারেই মহিমের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি ভাবছে-সত্যিই তো এত রাতে সে কোথায়
যাবে,রাতটা কাটাবেই বা কিভাবে। এখন যে পরিস্থিতি তাতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের
প্রশ্নটা বহুদূরে।কিন্তু এত রাতে একটা অচেনা,অজানা মানুষকে কেন জানি
মেয়েটির নির্ভয় মনে হলো।তাছাড়া সে বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিতে
ভিজছে।বৃষ্টি কখন শেষ হবে তা তো বলা যায় না। তার চেয়ে বরং এই লোকটির সাথে
তার বাসায় যাওয়াটাই সমীচীন। মেয়েটির নীরবতা দেখে মহিম আবারো বলল, নিশ্চয়ই
ভয় হচ্ছে এত রাতে একটা অজানা মানুষের সাথে তার বাড়ি যেতে। তবে আমি আপনাকে
অভয় দিচ্ছি। বিশ্বাস করে আপনি আমার সাথে যেতে পারেন।আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি,
আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা আমি কখনোই করবো না।
তারপর
মহিম মোবাইলটা মেয়েটির হাতে দিয়ে সামনে চলতে লাগল। তাকে অনুসরন করে
মেয়েটিও চলতে লাগল। কিছুদূর সড়কপথে হাঁটার পর এবার আলে নামতে হবে।নামার আগে
মহিম জুতা খুলে মেয়েটিকেও জুতা খুলতে বলল। মেয়েটি বলল সে জুতা
খুলবেনা,এভাবেই যেতে পারবে।মহিম আর কিছু না বলে চলতে লাগল। মেয়েটি পেছন
থেকে আলো দেখাচ্ছে। কয়েক পা হাঁটার পরই মহিম আর আলো দেখতে পেল না,পেছন থেকে
কিসের যেন শব্দ শুনতে পেল।টাপুর-টুপুর বৃষ্টি তো পড়ছেই।পেছনে ফিরে দেখলো
মেয়েটি কাদার মধ্যে পড়ে গেছে। মহিম কাছে এসে বলল,আপনাকে যে বললাম জুতা
খুলতে।বুঝলেন তো এবার।
উঠুন।
দেখি মোবাইলটা আমাকে দিন।জুতা খুলে আমাকে দিন।আপনি সামনে যান পেছন থেকে
আমি দেখাচ্ছি। আর হ্যাঁ,আঙ্গুল টিপে টিপে হাঁটবেন।বুঝতে পেরেছেন? সামনে
যান।এবার আর মহিমের কথার অবাধ্য হলোনা মেয়েটি।
বিকেল
থেকে বৃষ্টি হওয়া রাস্তার অবস্থা একেবারেই কাহিল।সারারাত বৃষ্টি হলে লোকে
তো আর সারারাত বাজারে থাকবেনা। তাই বৃষ্টিতে ভিজেই সবাই বাড়ি ফেরা শুরু
করেছে। কেউ আসছে আবার কেউ হয়তো আগে গেছে। এরই মধ্যে আল পিচ্ছিল হয়ে গেছে।
যার কাদা মাটির পিচ্ছিল রাস্তায় হাঁটার অভ্যাস নেই তারা এ রাস্তায় আঁছাড়
খাবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই।মেয়েটির হাঁটার ধরন দেখে মহিম মনে মনে
এত
ধীরে ধীরে হাঁটছে -----ভাবার মাঝে মহিম লক্ষ্য করল মেয়েটি হাত উপরে তুলে
পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। মহিম দুই হাত পিছনে ছিল। তাড়াতাড়ি করে এসে বাম হাত
দিয়ে মেয়েটির কোমরে ধরলো। না ধরলে চিৎপটাং হয়ে জমিনের মধ্যে পড়ে যেত।
কিন্তু
রাস্তা যে পিচ্ছিল, তাতে অপ্রস্তুত অবস্থথায় কাউকে এভাবে ধরলে সেও যে পড়ে
যাবে তাতে কোন সন্দেহ থাকেনা।সেটা ভেবে মহিম ডান হাত দিয়েও মেয়েটিকে
ধরলো।
ঠিক সে মুহূর্তে আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো।মেয়ে মানুষ রাতে বিড়ালের জলন্ত
চোখকে বাঘের চোখ মনে করে ভীত সন্ত্রস্ত হতে পারে।আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো কেন
নয়!
মেয়েটি ভীষণ ভয় পেয়ে মহিমকে জড়িয়ে ধরলো। মহিম বুঝতে পেরেছিল যে সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে ছে।
মেয়েটি ধীরে ধীরে মহিমকে ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি এভাবে হাঁটতে পারবো না।এরকম বাজে রাস্তায় আমি কখনো হাঁটিনি।
মহিম বলে,তাহলে কিভাবে হাঁটবেন শুনি।
মেয়েটি বলে,আমি আপনার হাত ধরে হেঁটে যাবো।
মনে হচ্ছে ছোট্ট বাচ্চার আবদার,হাত ধরে যাবে!
তবে
এ মুহূর্তে সে আবদার না মানার কোন অবকাশ নেই।বারবার এভাবে পড়তে থাকলে বাড়ি
পৌঁছাবে কখন। তাছাড়া এরকম রাস্তায় যে কেউ হাঁটতে পারবেনা।হাঁটার জন্যে
প্র্যাকটিস লাগবে। অবশেষে মহিমকে সে আবদার মানতে হলো। মহিম ভাবছে,কি যে
ঝামেলায় পড়লো সে!তাও আবার মেয়ে মানুষ ----মেয়ে মানুষ মানেই হাজারটা ঝামেলা।
তবে এতে মেয়েটির যে উপকার হচ্ছে সেটা ভেবে মনকে প্রবোধ দিল।
মেয়েটি মহিমের হাত ধরে চলতে লাগল। এভাবে এই বৃষ্টি ভেজা রাতে দুজনে ভিজতে ভিজতে বাড়ি পৌঁছল।
গ্রামের বাড়ি। বাড়ির দরজা অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
বাড়ি পৌঁছে মহিমরা সোজা টিউবওয়েলের কাছে গেল।
মহিম
টিউবওয়েল চাপল।মেয়েটি হাত-পা ধুয়ে টিউবওয়েল চাপতে চাইলো যাতে মহিম হাত-পা
ধুতে পারে।মহিম বলল,তার আর দরকার হবে না,সে নিজেই পারবে।
তারপর বারান্দায় এসে মহিম মা,মা বলে ডাকতে লাগল।
মহিমের মা ঘর থেকে বের হয়ে আসতে আসতে বলে, আজ এত দেরি হলো কেন বাবা,তুমি তো এত রাত পর্যন্ত বাইরে ------বলেই থমকে গেল।
অচেনা মেয়ের দিকে চোখ পড়তেই তিনি হকচকিয়ে গেলেন।
ছেলের দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন।
মহিম
মাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলল,মা তোমাকে পরে সব বলছি।তার আগে
উনাকে কাপড় পাল্টাবার ব্যবস্থা করে দাও।তিনি অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে
ভিজছেন।তাকে আমার ঘরে নিয়ে যাও।তাড়াতাড়ি যাও।পরার জন্য তোমার কিছু কাপড়
দাও।
মহিমের মা চিন্তায় পড়ে গেল কি কাপড় দেবে।তার তো একটা মাত্র শাড়ি তোলা আছে।
তাও
আবার পরে পরে পুরানা হয়ে গেছে। এমন একটা শাড়ি মেয়েকে কি দেবে।মহিমের মা
ভাবছে,দেখে তো মনে হয় কোন বড়লোকের মেয়ে। ফর্সা, লম্বা লম্বা চুল,ছিপছিপে
গড়ন। কি পরতে দেবে।মহিমের মার এবার মনে পড়ে গেল তার একটা বিয়ের শাড়ি আছে
শাড়িটা খুব সুন্দর। তেমন টা তো পরা হয়নি।
দুই-একবার যা পরেছিল,তবে নতুনই আছে।
তাহলে সেটাই দেয়া যাক।কেথাকার কোন মেয়েকে যে মহিম এত রাতে আনল আল্লাহই জানে।
কী কান্ড যে করলো! তবে নিজের ছেলের প্রতি সম্পূর্ন বিশ্বাস আছে মহিমের মা'র।
আর কোন চিন্তা-ভাবনা না করে বিয়ের শাড়িটা বের করে দিলেন।
মেয়েটি লক্ষ্য করল,খুব সাধারণ ভাবে ঘরটা সাজানো।
একটা খাট,খাটের সাথে লাগানো মহিমের পড়ার টেবিল,একটা শোকেস,একটা আলনা আর দুটো চেয়ার।
দেখতে
যতই সাধারন হোক না কেন এত সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো যে তার মনটা খুব
সহজেই বসে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মহিম ঘরে প্রবেশ করলো। ঢুকেই দেখলো
মেয়েটি লাল ঝিকিমিকি একটা শাড়ি পরেছে। এটা নিশ্চয়ই মায়ের। তবে এত সুন্দর
শাড়ি যে মায়ের ছিল সেটা তো কখনো মহিম দেখেনি।বৃষ্টিতে ভেজা চুলগুলো পিঠে
মেলে দিয়েছে। শাড়ির আঁচলটা এক পাশে ছেড়ে দিয়েছে। কারেন্টের আলোয় মহিম
মেয়েটিকে খুব ভালভাবে দেখলো। মনে হচ্ছে শহরের কোন এক মেম সাহেব বুঝি তার
ঘরে বসে আছে। শাড়ির আঁচলটা মাথায় দিলে মনে হবে যেন এক সুন্দরী রাঙা
বধু।মহিম আরো দেখলো ডাগর ডাগর দুটি নেত্র যেন তার পানে চেয়ে রয়েছে। মহিমের
নেত্রও অচেনা দুটো নেত্রের পানে।তবে মা যে তার পাশে রয়েছে সেটা মহিমের
খেয়ালই ছিলোনা।মা'র কথা মনে হতেই চোখ নামিয়ে নিলো।
মেয়েটি বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।
মহিম বসলো সে মুহূর্তে তার বাবাও ঘরে ঢুকলো।
ইতোমধ্যে মহিম তার বাবাকে সব বলেছে। বাবাকে বসতে বলল।
আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম। সালাম দিয়ে মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো।
বস মা বস,আমি মহিমের কাছ থেকে তোমার বিপদের কথা শুনলাম।তেমার নাম কি মা?
মহিমের মা তাড়াতাড়ি করে বলল, ওর নাম অর্থি।তোমরা বসে গল্প করো আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
তোমার বাড়ি কোথায় মা,বাবার নাম কি?
কমলপুর,বাবার নাম মোসলেম উদ্দীন।
কী করেন তোমার বাবা?
জ্বী আঙ্কেল, বাবা নৌবাহিনীতে চাকরি করেন।
এভাবে কিছুক্ষণ গল্প করার পর মহিমের বাবা ওকে বলল, বাবা তোমরা গল্প করো আমি দেখি তোমার মা কি করছে।
মহিমের বাবা উঠে যাবার পর অর্থি মহিমকে জিজ্ঞেস করলো, কিসে পড়ছেন?
অনার্স তৃতীয় বর্ষ।আপনি?
আমি এবার এইচ.এস.সি পাশ করলাম। এডমিশন হয়নি এখনো কোথাও।
ও,ভালো।
বাসায় আর কে কে আছে?
আমরা এক ভাই এক বোন। বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে।
ওহ্...
তো,তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
গিয়েছিলাম নানুর বাসায়,প্রাণপুরে।
বাসায় ফোন করে দাও। নয়তো সবাই চিন্তা করবে।এই নাও ফোন।
না,না।ফোন করা যাবেনা। এ বিপদের কথা শুনলে মা কান্নাকাটি করবে।কাল তো যাচ্ছিই।
যাই হোক,আমাদের বাড়িতে তোমার খুব কষ্ট হবে।কষ্ট করে ম্যানেজ করে নিও।
ছি!ছি!কষ্ট বলছেন কেন। কষ্ট আর কেথায় হবে।কষ্ট হবে তখনই যখন ------
অর্থি বাকি কথাটা বললনা।চুপ করে রইলো।
যখন?কখন কষ্ট হবে শুনি।
না,না থাক এমনিতেই বললাম।
এমনি বলো আর যাই বলো কষ্ট তোমার হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।আচ্ছা,তুমি বস আমি দেখি মা কি করছে।
মহিমের
মা ডিম ভাজছিল।ভাজা শেষ। এখন ওদের জন্য খাবার নিয়ে যাবে।মহিম মার কাছে এলে
প্লেট আর পানির জগ নিয়ে যাওয়ার আদেশ হলো। টেবিলের ওপর ওগুলো রাখার পরই
মহিমের মা ঘরে ঢুকলো।
শুধু ভর্তা আর ডিম ভাজা দিয়েই খেতে হবে মা।তোমার নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে।
কি যে বলেন না আন্টি, অসুবিধে হবে কেন।ডিম ভাজা আর ভর্তা আমার খুব প্রিয়।
আচ্ছা মা খাও।মহিম বস বাবা।খেয়ে নাও তারাতারি।অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।
খাওয়ার পর মহিম বলল, মা তোমরা এখানে থাক। আমি আর বাবা ওই ঘরে।
রাতটা সেভাবেই কেটে গেল।
পরদিন
মহিমের ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে সাতটায়। উঠে ব্রাশ করে রান্না ঘরে মা'র কাছে
গেল। সকালের নাস্তার জন্য পায়েস রান্না হচ্ছে। মহিমের মা ওকে অর্থিকে
ডাকতে বলল নাস্তা করার জন্য। উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিতে।
মহিম ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কি আসতে পারি?
অর্থি আস্তে করে বলল, আসুন।
উঠে পড়ুন, নাস্তা করবেন।
কোন উত্তর পেল না।মহিম দিনের আলোয় অর্থির চোখে চোখ রাখল।দেখলো চোখ দুটো কেন যেন লাল হয়ে গেছে। আবার বলল,তারাতারি উঠে পড়ুন।
অর্থি আস্তে করে বলল, আমি উঠতে পারছিনা।মনে হচ্ছে আমার খুব জ্বর এসেছে। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে।
জ্বর এসেছে! মহিম এবার কাছে এলো। আমি কি তোমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে পারি কতটা জ্বর এসেছে?
এত সংকোচ করছেন কেন? কাল যখন আমি আপনার হাত ধরে পুরোটা রাস্তা এলাম কই আমি তো সংকোচ করিনি।
মহিম
আর কিছু না বলে কপালে হাত দিল।দিয়েই হাত নামিয়ে নিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
সেকি! জ্বরে তো তোমার কপাল পুড়ে যাচ্ছে!মাকে বলোনি কেন, আমাকে বলোনি
কেন?তারপর দৌড়ে গিয়ে অন্য ঘর থেকে দুটো কাঁথা এনে গায়ে দিয়ে দিলো।
রান্নাঘরে গিয়ে মাকে টেনে নিয়ে এসে বলে,মা তুমি ওকে দেখ আমি ডাক্তার ডাকতে
যাচ্ছি। বলেই দে ছুট।কারও কোন কথা শুনার প্রয়োজন মনে করলো না।
খানিকক্ষণ পর এসে মহিম দেখে তার মা অর্থির কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। ডাক্তার রোগীর অবস্থা দেখে ওষুধ দিয়ে চলে গেল।
মহিম মাকে বলে, খাইয়েছ কিছু?
-খেতেই চাচ্ছে নাতো।
আমি খাবোনা,খেতে ইচ্ছে করছেনা -অর্থি কাথার ভেতর থেকে আস্তে আস্তে জবাব দেয়।
কিছু খেয়ে নাও বলছি, না খেলে শরীর আরো ভেঙে পড়বে।মা,একটু পায়েস নিয়ে আসতো। ও খাবে আমি বলছি।
আমি খাবো না প্লিজ।
অর্থি, না খেলে তুমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। একটু খেয়ে নাও।
মহিমের
মা পায়েস নিয়ে এসে অর্থিকে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিচ্ছে। সে এক পলক মহিমের
দিকে আর এক পলক তার মায়ের দিকে চেয়ে খেতে খেতে প্লেটের সব পায়েস খেল।মহিমের
মা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে অর্থির মুখ মুছে দিল।
এইতো লক্ষ্মী মেয়ে, এখন ভাল লাগছে না?মহিম একটু মুচকি হেসে বলে।
অর্থি মাথা নেড়ে সায় দিল।
আজ
সারাদিন অর্থির বিছানায় শুয়েই কাটলো। বাড়িতে যাওয়ার কোন কথাই সে বলল না।
মহিমরাও এ বিষয়ে কিছু বলল না।জ্বরটা পুরোপুরি না ছাড়লেও একটু লেগেই ছিল।
রাতে এর প্রকোপ টা বেড়ে গেল।জ্বর এতই বেড়ে গেল যে সে জ্বরের চটে প্রলাপ
বকতে শুরু করেছে। কখনও বলছে, রাজন স্কুলে যা,রাস্তায় সাবধানে যাবি,কারো
সাথে ঝগড়া ঝাটি করবি না।আবার মহিমের মাকে জড়িয়ে ধরে বলছে,মা ঐ গানটা একটু
গাও না,"সুখ তুই যাসনে এ সংসার ছেড়ে, আলো হয়ে থাকিস তুই আধারের মাঝে। " গাও
না মা, গাও,গাও।
এ অবস্থাটা মহিমকে কেন যেন পীড়া দিচ্ছে। কি
করবে ভেবে উঠতে পারছেনা।সে তার মাকে অর্থির কপালে জলপট্টি দেওয়ার জন্য বলল।
ডাক্তারকে ফোন দিল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলো। ওষুধ দিল।ওষুধ খাইয়ে দিয়ে
মহিমের মা অর্থির মাথায় হাত বুলাতে লাগল। আর তাতেই ও স্নেহকর প্রশান্তিতে
ঘুমিয়ে পড়ল।কিন্তু মহিম আর ওর মা ঘুমাতে পারলো না।ওর মা ধারাবাহিক ভাবে
জলপট্টি দিচ্ছে আর ও চেয়ারে বসে বই পড়তে লাগল। দুইদিন ধরে ওর পড়া হয়নি।এখন
আর পড়া হচ্ছে কই।একবার বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছে তো আরেকবার অর্থির দিকে।
কি হলো এটা। মেয়েটাকে আনলাম আমার বাড়িতে অথচ এসেই এই অবস্থা। এতে তো কারো
হাত নেই।রোগ, সুস্থ্যতা সবই তো আল্লাহর ইচ্ছেতেই হয়।আর মানুষের কর্মটা
উপলক্ষ্য মাত্র।ওর বাড়িতে একটা ফোন পর্যন্ত করা হলোনা।না জানি বাড়ির সবাই
কি চিন্তাই না করছে।
সেটা না হয় পরে,আগে ওর সুস্থ্যতাটা।
ওর
ঘুম পাচ্ছেনা।ঘুমালে যদি আবার অর্থির জ্বর বেড়ে যায়। এমন টা ভাবতে ভাবতে
রাত অনে----ক টা হয়ে গেল। মহিমের মা অবশ্য ওকে বলল ঘুমিয়ে পড়তে কিন্তু ও
বলল এখন ঘুম আসছেনা,ঘুম পেলেও চলে যাবে।
অর্থির কপাল টা কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। জ্বর অনেক টা কমে গেছে।
মহিমেন
মনোযোগ এবার বইয়ের পাতায়।পড়তে লাগল মনোযোগ দিয়ে। এরই মাঝে লক্ষ্য করল মা
চেয়ারে বসেই খাটে মাথা পেতে ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু ও ঘুমালোনা।
তখন
প্রায় রাত ১ টা।অর্থির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখে আন্টি চেয়ারে বসেই
ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার একটা হাত ওর শরীরে। মহিম বই পড়ছে। তাহলে কী মহিম
ঘুমায়নি!ও উঠে বসতে চাইল।মহিম দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,উঠছো কেন?শুয়ে
থাক,শুয়ে থাক।
এখন কি অবস্থা,জ্বর সেরেছে?অর্থি উঠেই বসল।বলল,এখনও জেগে আছেন,ঘুমাননি?
আমার কথা বাদ দাও। তোমার কেমন লাগছে এখন?
কপালে হাত দিয়ে দেখুন দেখি জ্বরটা এখন আছে কি নেই।
মহিম একটু মুচকি করে হাসল।বলে তোমাকে দেখেই বুঝেছি তুমি ভালো হয়ে গেছো।এরই মাঝে ওর মায়ের ঘুম ভেঙে গেল।
মা,এখন
কেমন লাগছে মা?দেখি জ্বর ছেড়েছে কি না।কপালে হাত দিয়ে দেখলেন একদম জ্বর
নেই।দেখেই কী খুশি! মা এখন কেমন লাগছে সুস্থ্য লাগছে না?
আন্টি,আপনার মত একজন মায়ের সেবা পেলে সুস্থ্য হতে কতক্ষণ সময় লাগবে!
আমার খুব ভাল লাগছে আন্টি। আমি সুস্থ্য হয়ে গেছি।
আচ্ছা মা ঘুমিয়ে পড়।মহিম তুমি এখনও বই পড়ছিলে বাবা। ঘুমাতে যাওনি কেন?
না মা,ভেবেছিলাম হঠাৎ করেই যদি আবার অর্থির জ্বরটা বেড়ে যায় তাই বসেছিলাস।এখন যখন সম্পূর্ন সুস্থ্য তাহলে যাই।
তোমরা
শুয়ে পড় মা।বলেই মহিম চলে যাচ্ছিল।যাওয়ার পথে দরজার কাছে গিয়ে থমকে
দাঁড়ালো। পেছন ফিরে অর্থির দিকে একবার চেয়ে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
মহিমের মা অর্থির পাশে শুইলো।অর্থি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো
কিন্তু ওর ঘুম আসছে না।ও ভাবছে এ পরিবারের মানুষ
গুলোর কথা। ভাবছে মহিমের কথা।ইশ,এতরাত পর্যন্ত সে আমার জন্য জেগে আছে আমার জ্বর বেড়ে যায় কি না!
অজানা
একটা লোককে বিশ্বাস করাটা আমার একদম মিছে যায়নি। ওর যেন কিছুতেই ঘুম
আসছেনা। এপাশ-ওপাশ করতে করতে মহিমের মাকে জড়িয়ে ধরলো।ঠিক যেন মায়ের পরশ
পেয়ে সন্তানের ঘুম আসলো। কিছুক্ষণ পর ও ঘুমিয়ে গেল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে
ওর বাড়ির কথা মনে হলো। এবার তো বাড়ি যেতে হবে।বাড়িতে ফোন দিয়ে আপাদমস্তক
সব বলল। মহিমদের বাড়ির ঠিকানাও বলল। ঐ মুহূর্তেই আসতে বলল যেন,এসে নিয়ে
যায়।
তারপর মহিমের মাকে গিয়ে বলল যে,ওর মা আসছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মহিমের মা বলে সেকি! মা আজকেই যাবে?
হ্যাঁ আন্টি, আজকেই যাব।
মহিমের
মা থাকার জন্য জোর করলো না।কারণ অচেনা-অজানা একটা মেয়ে বাড়িতে থাকলে
গ্রামের লোকে খারাপ ভাবতে পারে।তবে তাকে চিন্তিত মনে হলো এই জন্য যে,বাড়িতে
নতুন মেহমান আসবে তাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করাবে।পয়সা তো নেই যে,বাজার থেকে
কিছু কিনে নিয়ে আসবে।বিষয় টা অবশ্য তিনি মহিম আর ওর বাবাকে গিয়ে
জানালেন।মহিম বলে,একটা যে মুরগী ছিল সেটাই রান্না করতে।ওর মা তাই
করলো।মুরগীর সাথে সাথে পোলাও রান্নার বন্দোবস্ত করলো।
সকাল দশটার দিক অর্থির মা আর ছোট ভাই রাজন আসলো। মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না!
দুপুরের
খাওয়া-দাওয়ার পর বিকেল বেলা অর্থিকে এখন বাড়ি যেতে হবে। এই মানুষ গুলোকে
ছেড়ে চলে যেতে হবে।তাদের স্নেহ-ভালবাসা,সেবা-শুশ্রুষা পেয়ে সেও যেন তাদের
হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ,আনন্দ-বেদনার সাথে একাকার হয়ে গেছে।
তাদের ভালোবাসার ভাগীদার হয়ে গেছে। কি করে ছেড়ে যাবে এদের।কষ্ট হবে যে ভীষণ!
বাড়িতে
যাওয়ার আগে সবাই মিলে মহিমের ঘরে বসে গল্প করছে।অর্থি সবার কাছ থেকে বিদায়
নিচ্ছে। মহিমের মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল।
কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলে,আন্টি এই দুইটা দিন আপনি আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি।
বুকে আগলে ধরে আপনি আমার সেবা করেছেন।
নিজের
সন্তানের মত ভেবেছেন।মহিমের মা অর্থির চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত
দিয়ে দোয়া করলেন।মা,কখনো যদি এই বাড়ির মানুষ গুলোর কথা মনে পড়ে তাহলে চলে
এসো।
ভাল থেকো মা,বেঁচে থাকো।
ঘর থেকেই বের হওয়ার আগে অর্থি ওর মাকে বলে,মা তোমরা একটু বাইরে যাও আমি আসছি।সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শুধু মহিম রইল।
অর্থি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
মহিম,জানি
না আমি আপনাকে কতটা বিরক্ত করেছি সেই প্রথম থেকে, কতটা অসুবিধার মধ্যে
ফেলে দিয়েছি।তবে যাই করিনা কেন আমাকে মাফ করে দেবেন।বলে দু 'হাত উঠালো।মহিম
নিজের অজান্তেই ওর হাতের উপর হাত রাখলো। ছিঃ ছিঃ অর্থি,এভাবে বলোনা।
আমরা কি কখনো তোমাকে পর ভেবেছি।
তুমি তো আমাদের মাঝে পরিবারের সদস্য হয়েই ছিলে।
অর্থি
কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,এই দুইটা দিন ভাবিনি আমি অপরিচিত বাড়িতে,অপরিচিত
মানুষের সাথে ছিলাম।আপনাদের উদার ভালোবাসা পেয়ে আপনাদের মাঝে আমি মিশে
গেছি।ছেড়ে যাচ্ছি,কষ্ট হচ্ছে।
অর্থি,তুমি যখন জ্বরের ঘোরে
প্রলাপ বকেছিলে তখন আমার মাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলে,মা আমাকে ঐ গানটা
শুনাওনা,"সুখ তুই যাসনে ----------------
আমার কথা না হলেও সেই মায়ের কথা কখনো ভুলে যেওনা।কখনো যদি মনের অজান্তে মনে পড়ে নির্দ্বিধায় চলে এসো।
ছি!এভাবে বলছেন কেন। মনের অজান্তে!, আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তা আমি ইহজগতে ভুলবনা।
এ গরীবের ঘরে না জানি তোমার কত কষ্ট হয়েছে। পুতুল খেলা মনে করে সেটা ভুলে যেও।
পুতুল
খেলা না!ঠিকই বলেছেন।নয়তো কষ্টের মাত্রা যে বেড়েই যাবে।কখনও যদি মনে হয়
আপনার জীবনে আকস্মিকভাবে কেউ এসেছিল তাকে এক নজর দেখার ইচ্ছে করবেনা বুঝি?
অর্থির বাড়ির দরজা সব সময় এই মহৎ, আদর্শবান,বিশ্বাসী মানুষটার জন্য খোলাই রবে।
অর্থি!
ভাল থাকবেন, খুব ভাল। আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি।
বাইরে চলো,তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
মহিমরা অর্থিদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলো। মহিম এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রইলো। অর্থিও বারবার পেছনে ফিরে তাকালো।
সেদিন
রাতে মহিমের চোখে ঘুম আসছেনা। বারবার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া
দৃশ্য গুলোর কথা মনে পড়ছে। অর্থির জড়িয়ে ধরা, হাত ধরে আসা,লাল বেনারসি পরে
বসে থাকা, কপালে হাত দিয়ে জ্বর অনুভব করা,ডাগর-ডাগর চোখে চেয়ে থাকা।
"অর্থি, তুমি চলে গেলে কিন্তু যে স্মৃতি গুলো রেখে গেলে সেগুলো যে পিছুটান
হয়ে আমায় ডাকবে!কি একটা অকস্মাৎ হাওয়া বয়ে গেল জীবনে।
কোথাকার
কোন শহরের একটা মেয়ে এসে আমার মৃত অনুভূতির জীবনে প্রাণ সঞ্চার করে চলে
গেল। অনুভবতাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল। অর্থি!তুমি আমার জীবনে এভাবে কেন এলে?তুমি
অর্থি না হয়ে অন্য কেউ তো হতে পারতে।অর্থি,তুমি আমার কাছ থেকে কি নিয়ে
গেলে জানিনা কিন্তু দিয়ে গেলে কিছু আবেগ,অনুভূতি,ভালো লাগা আর সুখ জড়ানো
ব্যথা।
জানিনা তোমার সাথে কখনো দেখা হবে কিনা। যখন হবে তখন আমাকে কি তোমার মনে পড়বে?এই গরীব ছেলেটাকে কি কখনও দেখার ইচ্ছে করবে?"
পূর্ব বালাগ্রাম,জলঢাকা,নীলফামারী।