ক্লেদজ কুসুম
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ক্লেদজ কুসুম
আবদুল্লাহ আল-হারুন
দু সপ্তাহ আগে বিকেল পাঁচটায় পাশের শহরে হজপিসের একটি আঞ্চলিক সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল। আমি যখন (১৯৯৭) হজপিসের কর্মী হিসেবে এ সংগঠনে যোগদান করি সে সময় সদস্য-সদস্যাদের গড় বয়েস ছিল পয়ষট্ট্রি কাছকাছি! যে গ্রুপে আমি প্রশিক্ষন নেই সেখানে আমিই ছিলা সে সময় সর্বকনিষ্ঠ (৫২)। কর্মীদের মধ্যে মহিলাই ছিলেন শতকরা ৯০/৯৫ জন! বিধবা, নি:সঙ্গ বা স্বামীর সাথে বিচ্ছিন্ন প্রৌঢ়া-বৃদ্ধারা মৃত্যুসঙ্গ দিয়ে হয়ত নিজেদের একাকি জীবনে কিছু কর্মচাঞ্চল্য বোধ করতেন। ইউরোপে রিটায়ার করার পর বয়স্ক-প্র্রজন্মটি সমাজের মূল স্রোত থেকে সরে যান বা সরে যেতে বাধ্য হন। এখানে জীবনের মূলমন্ত্র, ’গাহি যৌবনের গান’! যে কাজ করে না বা পেনশনের টাকায় অবসর জীবন যাপন করে, তাদের দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে যারা এখনও কাজ করছে, তারা ইংগিত করে, ’তোমরা তো পরগাছার দল’। কথাটা কিছুটা সত্যি। তাদের পেনশন টাকা যারা এখন কাজ করছেন তাদের বেতনের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ’পেনশন-বীমার’ টাকা থেকেই আসে। এটাই জার্মানির গত শতাব্দীর বিসমার্ক কৃত বিখ্যাত ’প্রজন্ম-চুক্তি’ (এবহবৎধঃরড়হ- ঠবৎঃৎধম)। যার অধীনে বর্তমান কর্মরত প্রজন্ম, গত প্রজন্মের অবসর জীবন যাপন নিশ্চিত করে। এক সময় এরাও পরের প্রজন্মের বাঁকা চোখের শিকার হবে। এটাই নিয়ম। ঢিলটি মারিলে পাটকেলটি----, জেনেও কেউ গা করে না!
পেনশনভোগীদের মধ্যে যারা সুস্থ বা কর্মক্ষম (এদের সংখ্যা মোটেও কম না), তারা হজপিস বা এ ধরনের অনেক সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশগ্রহন করে, সমাজে যে এখনও তারা ’প্রয়োজনীয়, পরগাছা নন’, তা প্রমান করেন। এ শতকে হজপিসে বেশ কিছু তরুন তরুনীও এসেছে। মৃত্যু সম্পর্কে ধ্যানধারনা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আলাপ আলোচনা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, টিভি ডকুমেন্টারী (এমন কি ছবিও) হচ্ছে। বলা যায়, মৃত্যু-প্রসঙ্গ এখন ইউরাপে ’সযতনে এড়িয়ে যাবার সনাতন ধারাটির’ টাবু উত্তীর্ণ
হয়েছে। মৃত্যু নিয়ে টিভি রেডিওতে নিয়মিত টক শোও হচ্ছে।
আলোচনা শেষ হতে রাত আটটা হয়ে গেল। শনিবারের সন্ধ্যা। তিন-চারজন তরুন-তরুনী সভাভঙ্গের পরেই
তড়িঘড়ি উঠে গেল। আজ সর্বত্র ডিস্কো নাইট। ভাবখানা, মৃত্যু নিয়ে তো অনেক ভাবনা হলো, এবারে জীবনভোগের পালা! প্রবীন-প্রবীনারা কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে যুত করে বসে গল্পগুজবে মেতে উঠলেন। আমিও তো এখন তাদেরই দলে। বাড়ীতে তো আর কেউ দরজার দিকে তাকিয়ে নেই। নিরম্বু একা বসবাস!
আমিও সবার সাথে গলাবাজি করে তাবত বিশ্বের সমস্যা সমাধানে লেগে গেলাম।
রাত দশটা বাজার পর খেয়াল হল, সপ্তাহান্তে বাসের সংখ্যা রাতে কমে যায়। ছোট্ট শফস্বল শহর। কে জানে এখন বাস পাই কিনা। তা নাহলে ঝাড়া দশ কিলোমিটার হাটতে হবে! অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে পড়লাম।
কয়েক মিনিট হাটার পরই বাস স্ট্যান্ড। বাসের টাইটেবল একটি লোহার থামে দৃষ্টি সীমায় টানানো থাকে।
দুর থেকেই নজরে এল বিদ্যুতালোকে উদ্ভাসিত বাস স্টপে থামটিতে গা লাগিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নভেম্বরের রাত। হেমন্ত শেষ, শীত এলো বলে। সকালে-সন্ধ্যায় কুয়াসায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে থাকে।
ও কেন থামটির সাথে গা সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে, তা বুঝতে পরলাম। গায়ে একটা পাতলা জ্যাকেট, যা দিয়ে এখনকার শৈত্যটি ঠেকানো সম্ভব না। থামের উপরেই শেড এবং এর সাথেই একটা ছোট হিটার ফিট করা। মিউনিসিপালিটি থেকে অপেক্ষারত রাতের বাসযাত্রীদের ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা। মেয়েটি তার স্বল্প কাপড়ের ঘাটতিটি হিটারে পুরন করার জন্য থামটিতে গা ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। বেঞ্চে বসে নেই। ওটি হিটার থেকে একটু দুরে। আমার গায়ে মোটা জ্যাকেট। ঠান্ডার বিরুদ্ধে ভালো ব্যবস্থা করেই ঘর থেকে বেরিয়েছি।
আমি থামের কাছে গিয়ে বললাম, সরে দাঁড়াও প্লিজ, বাসের সময় দেখবো। এখানে শিশু, কিশোর- কিশোরীদের বয়স্করা প্রথম থেকেই তুমি করে বলে। যা আবার পচিয় নেই এমন তরুন-তরুনীদের বা অন্য বয়স্কদের বলাটা সখ্ত বেয়াদবী। এর বয়েস কোনমতেই ১৪/১৫র বেশী না। মেয়েটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, কোথায় যাবে তুমি? সেও বিনা দ্বিধায় আমাকে তুমি বলল। আমি বেশ আশ্চর্যই হলাম। ওর বয়সী কেউ আমাকে প্রথমে তুমি বলে না। শুধুমাত্র শিশুরাই এ নিয়ম মানে না। কিন্ত ওতো শিশু নয়। বুঝলাম কিছু গড়বড় আছে। এ বািলকার ব্যবহারটি আর দশজনের মত নয়। আমি আমার শহরের নাম নিতেই ও বলল, এখনও চল্লিশ মিনিট আছে বাসের। আমিও ওদিকেই যাবো। তার কথায় স্পষ্ট ইংগিত, ’আমার থাম থেকে সরার দরকার নেই। তোমার এখানে যা জানার, তাতো জেনেই গেলে।’
এবারে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু শিউরে উঠলাম। চোখে মুখে প্রসাধনের যে চিহ্ন ততে কোন যতœ নেই। মনে হয় সব লেপ্টে আছে। বেশ লম্বা চুল। রং বোঝা যায় না। কবে যে শেষ কেশচর্চা করেছিল, তা বলার কোনই উপায় নেই। চুলগুলি বেশীর ভাগ খড়ির মত উঁচিয়ে আছে। তেল বা শ্যাম্পু কোনটাই যে এ এলাকায় দীর্ঘদিন পড়ে না, তা সুস্পষ্ট। মুখের চামড়া কোঁচকানো। কিশোরীর মত নিষ্পাপ দুটি চোখ। ভুঁড়– আর পাঁপড়ীতে কালো রং। তারপরও চোখের মণিতে শিশুর কৌতুহুলের আনাগোনা। বুঝলাম, মুখে যে তার বয়সের ছাপ তা একান্তই চাপিয়ে দেয়া। প্রসাধনে সৌন্দর্যচর্চা নেই, আছে শিকার ধরার পাঁয়তারা। মেয়েটি নিজে শরীরের প্রতি কোনই খেয়াল করে না। আরেকজনের দৃষ্টি তার দিকে আকর্ষন করাই তার প্রধান কৌশল। এক কথায় মেয়েটি বারবণিতা। এ বয়সে? কত হবে ওর বয়েস?
আমি বেঞ্চে বসার কিছুক্ষন পরে ও দেখলাম একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে থামটি ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আমি কি তোমার পাশে বসতে পারি?
স্বচ্ছন্দে। আমি বুঝলাম, ও শুধু বসতেই চাচ্ছে। আমি যে তার মক্কেলদের মধ্যে পড়ি না, তা ও জানে। ওর চাউনীতে শিকারীর মনোযোগ নেই।
তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করলাম। মারিয়া। মানে মেরী, মাতা মেরী। যীশুখৃষ্টের মা। মনে কোথায় যেন একটা ব্যাথার খোঁচা! সারা দুনিয়ার ত্রাণকর্তা, মহান যীশুর মার নাম ওর। উনি তাহলে রাস্তার জীবন থেকে ওকে রক্ষা করেন না কেন?
তোমার নাম কি? তুমি কি এই শহরে থাকো? আমার উত্তর শুনে বলল, তুমি কি আমার বাসের টিকিটটি কিনে দেবে? আমার আজও কোন রোজগার হয় নি। টিকিট ছাড়া অনেক সময় ড্রাইভার বাসে উঠতে দেয় না।
আমার সাথে আজ যদি তোমার দেখা না হতো, তুমি কিভাবে বাসে যেতে? আমি জিজ্ঞেস কললাম।
ড্র্রাইভার রাজী না হলে বা কোন যাত্রীর দয়া না হলে, এখানে শহরের মধ্যে গিয়ে কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হতো। তবে এ শহরটা ছোট। সম্ভাবনা কম। কিছুই না হলে, রাতটি কোথাও কাটিয়ে সকালে আবার বাস ধরার চেষ্টা করতাম।
থাকো কোথায় তুমি? এ শহরে এসেছো কেন?
আজ দুপুরে একজন এখানে নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যায় বিনা নোটিশে ওর বান্ধবী এসে পড়াতে আমার চলে আসতে হল। আমি বললাম, তোমার বন্ধু তোমাকে কোন টাকাপয়সা দেয় নি? বন্ধু নয়, ফ্রায়ার (মক্কেল)। শয়তান একটা। বান্ধবী আসার পর আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। ভান করলো, যেন আমাকে চেনেই না। বলে একটা লম্বা হাই তুললো। গত দুরাত ধরেই ঘুমানোর জায়গা পাচ্ছি না। হাই তোলার একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা ওর। তুমি স্কুলে যাও না? স্কুলে গিয়ে কি হবে? ঐ সব স্কুল পাশ করে চাকরী করে মাসে যা রোজগার হবে, তা কোন কোন সময় আমি এক রাতেই পেয়ে যাই। পড়াশুনার বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তি!
তোমার বয়স কত? সত্যিটা বলব না, আইডি কার্ডের? এতক্ষনে মারিয়া বেশ সহজ হয়ে এসেছে। দুটিই। সামনের মাসে পনরোয় পড়ব। কিন্ত এই দ্যাখো আমার কার্ড, উনিশ বছর। আমার ধারনাই ঠিক। ফলস-কার্ড কোথায় পেলে? আমার এক বন্ধু ছিল, রাশিয়ান। ও করে দিয়েছে। তোমার বাবা মা? বাবাকে তো মাই চেনে না, আমি চিনবো কি করে? সেকি? হ্যাঁ, মা এক উৎসবে সারাদিন মদটদ খেয়ে রাতে কার সাথে জানি শুয়েছিল। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। আামি পেটে আসার পর আমার নানী অনেক বলে কয়ে মাকে গর্ভপাত করা থেকে নিবৃত্ত করেছিল। বুড়ি কট্টর ক্যাথোলিক। গর্ভপাতকে মহাপাপ মনে করে। আমি হবার পর থেকেই নানীর কাছে থাকি। তোমার নানী এখন কোথায়? গতবছর থেকে ফ্রাংকফুর্টে এক ওল্ডহোমে থাকে। হার্টের শক্ত অসুখ। মনে হয় এবারে ক্রীসমাস (ছয় সপ্তাহ পরেই) বেচারীর কপালে নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে কোন রকম চিন্তাভাবনা না করেই বলল। মনে হল, মৃত্যুভয়কে সে কোন হজপিস-প্রশিক্ষন ছাড়াই জয় করে ফেলেছে! তুমি কোথায় থাকো? নানীর একটা ছোট্ট বাড়ী আছে গ্রামে। ওখানে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। থাকি এক এক রাত এক এক একজনের সাথে। এ শহর ও শহরে। মাঝে মাঝে আন্ডারগ্রাউন্ড ষ্টেশানেও রাত কাটাই। সব রাতই তো আর সমান না! বলে হেসে ফেলল। ও নিজেও জানে না, ওর এসব কথার মধ্যে অনেক গভীরতাও আছে। কোন লেখক এটা লিখলে নতুন দর্শনও হয়ে যেত হয়ত!
নানীকে দেখতে যাও না? প্রতি সপ্তাহে একবার যাই। মনে হয় শীঘ্রী এ যাতায়াতটিও বন্ধ হয়ে যাবে।
তোমার মা কোথায় ? দু বছর হলো বার্লিন থাকে। কি করে? এক মুহুর্তও না থেমে বলল, বেশ্যাাবৃত্তি! আরও বললো, মাই তো আমাকে শিখিয়েছে, স্কুলে গিয়ে সময় নষ্ট না করে সরাসরি রাস্তায় নেমে টাকা কামাতে। মার সাথেই তো আমি প্রথম রাস্তায় নামি। বুুঝলাম, তাকে এ বিদ্যাদানটি তার মাই করেছেন। সংসার করে নি। বিয়ে,স্বামী বা প্রেম ও নিজেও জানে না। সন্তান-¯েœহ, মাতৃত্ব তার কাছে অজ্ঞাত। মেয়েকেও তাই তারই পথে নিয়ে এসেছে।
বললাম, এভাবই কি সারাটা জীবন কাটাবে? জানি না, বলে চুপ করে গেল। পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে গেল। ১৫/২০ মিনিট ধরে আলোচনার স্বচ্ছন্দ ধারাটি আমার এ প্রশ্নে যেন কোন বাঁধে আটকে গেল। দেখলাম, মুখে একটু বিষন্নতা। কি একটা চিন্তাা করছে। ২/৩ মিনিট পরে বলল, কিছু টাকা জমাবো। তারপর গ্রামে নানীর বাড়ীতে গিয়ে থাকবো। বুড়ী আমাকে লিখে দিয়েছে। বাগানে শাকসব্জির চাষ করবো। নানীর কাছে এসব শিখেছি। একটা গাই পুষবো। টাটকা দুধ খাওয়া যাবে। বলে খিল খিল করে হেসে উঠলো। বুঝলাম, স্বপ্ন দেখার অধিকার আন্তর্জাতিক, বিশ্বের সর্বত্র এর উপস্থিতি। কোন ভুগোল বা ইতিহাস দিয়ে এর সীমারেখা টানা যায় না। বর্ণ, ধর্ম, দেশ-কাল-পাত্রের উর্ধে স্বপ্নের পরিসীমা। বললাম, শুধু শাকসব্জীর চাষ আর গরুর দুধ খেয়ে কি জীবন কাটানো যায়? মনে হল একটু হুচোট খেল! ওর এই একান্ত স্বপ্নটিতে যে এতবড় একটা ফাঁক আছে তা সে হয়ত কোনদিন ভাবে নি। বলা যায় না, হয়ত একটা পেশা শিখবো। কি পেশা?
কিন্ডার গার্ডেনে টিচার বা কোন শিশুসদনে বাচ্চাদের কেয়ার টেকারীর। আমার সাথে ফ্রাংকফুর্টের একজন সমাজকর্মীর ভালো পরিচয় আছে। ও বলে, আমি চাইলে তিনবছর একটা স্কুলে পড়ে এবং পরে একবছর শিক্ষানবীশি করে বাচ্চাদের দেখাশুনার পেশায় ঢুকতে পারবো। কয়েক বছর পরে ওদের টিচারও হতে পারবো। ওর নানীর গ্রামের বাড়ী ফ্রাংকফুর্টের পাশে। ও এ শহরেই বেশীর ভাগ থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তো ফ্রাংকফুর্টে থাকো। এখন আমার শহরে যাচ্ছো কেন? যাবার ইচ্ছা তো ফ্রাংকফুর্টেই ছিল। কিন্ত এত লম্বা রাস্তা বাসে বা ট্রামে বিনাভাড়ায় যাওয়ার খুব অসুবিধা। তোমার শহরে মিউনিসিপালিটি ভবনের নিচে গাড়ী রাখার জায়গায় কোনমতে রাতটা কাটিয়ে সকালে দেখি ফ্রাংকফুর্ট যাওয়া যায় কিনা। কপাল ভালো থাকলে হয়ত কোন গাড়ীর দরজা খোলা পাবে। তাহলে রাতটা ভাল কাটবে। বলেই আবার সেই শিশুর মত হাসি! পরে আমাকে অবাক করে বলল, তোমার সাথে আলাপ করার পর আজ রাতে আর মক্কেল ধরতে ইচ্ছা করছে না। আজ রাতটা বিশ্রাম নেবো। আজ আমার ছুটি। বলেই হো হো করে হেসে উঠলো।
বাস এসে গেলো। আমি বললাম, যাও উঠে সিটে বসো। আমি দুজনের টিকেট কিনে আসছি। হাসিমুখে ধন্যবাদ বলে সে বাসে গিয়ে পেছনের একটা জায়গায় বসলো। বাসে দু একজন মাত্র যাত্রী।
আমি ওর কাছে গিয়ে পাশে বসে ওর হাতে টিকেট দিয়ে বললাম, এটা ফ্রাংকফুর্টের টিকেট। ড্রাইভার বললো, এ বাসটি সোজা সুদ-বানহোফে যাবে। ওখান থেকে এস-বানে তুমি ফ্রাংকফুর্টে রাত এগারোটার মধ্যে পৌছে যাবে। তারপর ইচ্ছা হলে এ টিকেট দিয়েই বাসে তোমার নানীর বাড়ী যেতে পারবে। ড্রাইভার বলেছে রাত বারোটা পর্যন্ত ওখানকার বাস আছ্।ে এই নাও ছয় ইউরো, ফ্রাংকফুর্টে সামান্য কিছু খেয়ে নিও। সব মিলিয়ে দশ ইউরোর মত লাগল আমার। আমি নিজেও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। থাকলে হয়ত আরো কিছু দিতে পারতাম। সারাজীবনই আমার ইচ্ছার সাথে সঙ্গতির বিরোধ! মারিয়ার অবাক হওয়া দৃষ্টিতে বিরাট এক শুন্যতা। মনে হল আমার কোন কথাই সে শুনে নি। সে আবার স্বপ্ন দেখছে। কিন্ত চোখের চাউনিতে রাজ্যের অবিশ্বাস। এ বয়সে তাকে কেউ এমনিতে কোন টাকা পয়সা দেয় নি। পিতুøেহ কি তা সে জানেনা। এক নানী আদর করত। সেও এখন মৃত্যুশয্যায়! মা সুদুর বার্লিনে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
বাস ছেড়ে দেবার পর আস্তে আস্তে বলল, আমি তো শুধু তোমার শহর পর্যন্ত টিকেট চেয়েছিলাম। তোমার এতগুলি টাকা খরচ হলো। আমি হয়ত পরে তোমাকে ফেরত দিতে পারবো। কিন্ত আমি তো জানি না তুমি কোথায় থাকো। আমি বললাম, আমি কোথায় থাকি তা তোমার জানার দরকার নেই। তবে পৃথিবী এখন খুবই ছোট। আবার হয়ত পথিমধ্যে কোথাও তোমার সাথে দেখা হবে। তোমার নানীর বাড়ীতে শাকসব্জীর চাষ শুরু করে গরু কেনার পর, যখন তুমি বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য একটা পেশা শিখবে, সেদিনই আমার এ সামান্য টাকাটা পুরো সুদসহ শোধ হয়ে যাবে। ভালো থাকার চেষ্টা কর। বেস্ট অব লাক। টেক কেয়ার।
নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি
পদাবলি
মহাকালের কাছে
শরীফ এমদাদ হোসেন
বৃষ্টির সাথে পূর্ণিমার চাঁদ দোল খায় পদ্মবিলে
নয়ন মাঝি কৈয়া জাল পাতে লক্ষীদিঘার নাড়ায়
দিঘা চালের পান্তাভাত আর কৈ পুঁটির ঝোল কিংবা ভাজা,
আহা! টাক্কুস করে জিহ্বায় জল আসে
বাড়ির দক্ষিনে কুটোর পালা, ছাতিম গাছ ভোকসা পুকুর পাড়,
থই থই জলের কিনার, মনের ডিঙ্গা বেয়ে চলে হুটহাট,
অজান্তে চালিতার ফুলে নামে ঘুম
ভোরে ঝরা শিউলি কুড়ায় বালকবালিকা।
শাপলা তোলা ভোর চলে গেছে অতীত ঘরে,
দূরে এখনো রাত্রির দ্বিপ্রহরে বাজে ঢোল করতল
কোনদিন লাটিখেলার থালায় বাড়ি হেইয়ো হেইয়ো-
হোসেনের পুঁথি পাঠ, আদু মিয়ার হুক্কার কুড় কুড় আওয়াজ,
মথলুর গল্প বলা। আহারে! হারিয়ে যাওয়া দিন!
মানুষ সাগর পাড়ি দিতে দিতে কোথায় চলেছে মহাকাল?
বাঁধো তোমার আউলা কেশ
মজনু মিয়া
উদাস দুপুর উতলা বাও চটপটে খুব মন;
ছুটছ কোথায় অসময়ে এমন কালো ক্ষণ?
পাগলা কুকুর শেয়াল আছে খামচে ধরবে,
কাঁদবে শেষে চিৎকার করে আঁখি ঝরবে!
আটঁকে রাখ সোনার যৌবন বেঁধে রাখ চুল,
মনের ভুলেও আগলা রেখে করবে না ভুল।
ইহকাল আর পরকালের সব পথ হবে বন্ধ ;
বিচার দিনের বিচারক সেদিন থাকবেন অন্ধ!
আগে বাঁধো মনকে সেই লোভ লালসা থেকে,
ভুল পথ থেকে ঠিক হলে থাকবে আলো মেখে।
জীবন হবে সুন্দর সফল সবাই বলবে ভালো,
এসো এবার জ্বালি জীবনে শুদ্ধতার আলো।
শরতের আকাশ
পান্থ মুসাফির
ছেঁড়া ছেঁড়া শুভ্র মেঘে
দিগন্ত জোড়া শরতের সুনীল আকাশ
মেঘের ভেলায় ভেসে মন্থর বেগে
টেনে নেয় সামিয়ানা ধূসর ফ্যাকাস।
মাছের পোনার মত ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টি
ঝরে গিয়ে ওই দূর গাঁয়,
নদী তীরে কাশফুল কেড়ে নেয় দৃষ্টি
সোনা রং রোদ ঝলকায়।
আমনের কাঁচা শীষে দুধগালা
শস্য সুধা,
শিশির ফোটা গাঁথে শস্য দানার মালা
মিটাতে ক্ষুধা।
পানি কমা নদী খালে বড়শি ও জালে
রূপালী পুঁটি পড়ে ধরা,
লাঙ্গল জোয়ালে গরু জুড়ে দেয় হালে
ফসলে জমি হবে ভরা।
শরতের আকাশটা উঁচু হয় খুব
মাটির সাথে তবু করে মিতালি,
এ ঋতুতে আকাশ নেয় বহু রং রূপ
ভোরের পাখিরা গায় গীতালি।
নাবিক
মাঈনুদ্দিন মাহমুদ
তরঙ্গে তরঙ্গে জীবনের গতি
বার বার ভূপতিত হয়
বিকৃত করে তুলে স্নায়ুবিক প্রশান্তির দেশ।
কূল কিনারাহীন নাবিক
ব্যকুল হয়ে ওঠে বিরহী সুরের মূর্ছনায়।
আচমকাই গেয়ে ওঠে
“মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না”
অবেলায় হৃদয় বিদরিয়া উঠা বেদনার সঙ্গীত
উপহাসের খোরাক জোগায়
কূলহারা নাবিকের অন্তঃপুরে।
“পরের জমি চষতে চষতে নিজের জমি হয় বেহাল”
ও দয়াল গেলনা”
পুকুর পাড়ের শিউলি গাছটা রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী
মিসির হাছনাইন
মেয়েটাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি,
যদি, পাশে গিয়ে ইচ্ছা করে জড়িয়ে ধরি?
স্বপ্ন না, তারে নিয়া লেখা একটা কবিতা পড়ি?
কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পরি আবার, গেছি মরি!
হেমন্তের গানে সে হয় ঋতুবতী এক কুমারী,
ফুলে ফুলে পুকুরের জল শাড়ি পড়া হৈমন্তী,
শিউলিগাছ বইয়ের ভাঁজে রেখে যাওয়া ফুল,
আমার খালি মনে পড়ে গল্পের ঝরে পড়া চুল।
শুকনো পাতার মর্মরেথ শীতের পায়ে নূপুর নাচে,
ময়ূর তখন উচ্চস্বরে ডাকে.. মাঝরাতে বন পাশে,
চাঁদ ছাড়া আকাশে হিজল গাছ পাখির ভাষায় হাসে,
পুকুর পাড়ের শিউলি গাছটা যে রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী,
সেই মেয়েটা তো গাছ হবে না, আমাকে ভালোবেসে..।
সেতু
রঞ্জন ভাওয়াল
ওপর দিয়ে হাজার টনের রেলগাড়ি
যান্ত্রিক আওয়াজে ছুটে চলে যায়,
নীচ দিয়ে বহে খর¯্রােতা নদী
সারাদিন কলকল জল কল্লোল ধায়।
কত নাটবোল্ট হয়েছে ঢিলে
বুকে ওজন নিয়ে যায় নীচে হেলে,
অসুস্থ সেতু পড়ে থাকে চিৎপাত
আর কতকাল এই ভাবে যাবে চলে।
বুকের ভেতর আগুন যন্ত্রণা
দেহের অস্থিকোটরে চিড় ধরে,
ভেঙে পড়ার জন্য আর কতদিন?
বুকে রেলগাড়ি, সেতু পড়ে থাকে নিঃসাড়ে।
মনের বৃত্তে কালো ছায়া
অরুণ বর্মন
আমার তুমি কেন আমার থেকে দুরে সরে যাচ্ছে?
কেন তোমার মনের বৃত্তে তৈরি হচ্ছে একটা মিথ্যা মোহের নীলাভ ছায়াপথ?
যে ছায়াপথে ক্রমশ স্পষ্ট হতে হতে একটা কালো প্রতিবিম্ব তৈরি হতে চলেছে।
তোমার হৃদয়ে প্রিয়র উজ্জ্বল উপস্থিতি হয়ে যাচ্ছে বিবর্ণ।
অতিতের সেই সোনালী সময়
ঘারিয়ে যাচ্ছে মনের অজান্তে।
তোমার হৃদয় ব্যলকনিতে আমার ব্যকুল হৃদয়ের আককুতি দিন দিন মূল্যহীন হয়ে পড়ছে।
নিরবধি পাওয়ার যন্ত্রনায় উপেক্ষিত হচ্ছে
নিত্য দিনের আবেগঘন আবেদন।
আরামের ফুসকড়ি রূপ নিচ্ছে বিষফোঁড়ায়।
আপন সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে ঠুনকো অভিমানের মোহে
হাজারো রঙের ভীড়ে সবুজ হয়ে
যাচ্ছে গাঢ় নীল।
এই নীলই যেদিন মিলিয়ে যাবে
আকাশের নীলের নীলিমায়
সেদিনই অনুভুত হবে কি পেয়েছিলাম
কি হারালাম।
সেদিন সময় কথা বলবে অনুশোচনায়।
স্মৃতি বলবে মিথ্যা অভিমানের ভানে যা হারিয়েছো অবহেলে
তা আর ফিরে আসবে না শত চোখের জলেও।
অতৃপ্ত বাসনা
অনার্য আমিন
সেদিন বিকেলবেলা,
শত ইচ্ছেরা পুড়ে মরছিলো
ভালোবাসার বাইপাসে আগুনলাগা যানে
স্থির দাঁড়িয়ে ছিলাম তোমার সামনে
নিজেকে সংযত রেখে।
তোমার ঘন কালো চিকচিকে চুলে কালবৈশাখী বইছিলো আকাশে
হিজলবন পেরিয়ে শতফুলের গন্ধমাখা মাধবী লতায়
দুলছিল তোমার লম্বা কানের দুল
ট্রান্সপারেন্ট নেলপলিশে সাজানো
কয়েকটা নখ অকারণেই ছুঁয়েছিল আমায়
কিন্তু, আমি পারিনি।
ফুলঝুরি কথায় সুবিন্যস্ত দাতের সাথে
নাকমনিও দ্যুতি ছড়ায়
কথায় কথায় ভালোবাসার সেল বিদ্ধ হয় বুকে
ইচ্ছার বিপরীতে তোমায় ছুঁতে পারিনি।
৯৩৬ নাম্বার বেড
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
৯৩৬ নাম্বার বেড
আকিব শিকদার
মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই, যা আমি পেয়েছি অসুস্থ থাকা দিনগুলোতে। সুচিকিৎসার জন্য মাদ্রাজ নিতে হবে বলে ডাক্তারেরা যখন আমাকে ঢাকা মেডিকেল থেকে রেফার করে দিল, আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের বাড়িতে। পাশাপাশি তিন গ্রামের লোকেরা প্রায় প্রতিদিন রোগী দেখতে আসতো। সাথে নিয়ে আসতো তাদের গাছে ধরা টাটকা ফলমূল, শাকসবজি। কিন্তু আমিতো কিছুই খেতে পারতাম না। মুখে নিলেই নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতো।
আমাকে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, ডাক্তারেরা টেস্টের রিপোর্ট দেখে বলেছিলো- হারপিক খেয়ে ছিলেন নাকি! পাকস্থলীতে এত ঘাঁ আগে দেখিনি!
আসল কারণটা বলি। আমি ছিলাম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এজেন্ট। সকালে মালামাল নিয়ে মার্কেটে যেতাম, ফিরতাম সন্ধ্যায়। দুপুরে বাইরে খেতে হতো পুরি-সিঙ্গারা, পুরাতন তেলেভাজা সমচা। প্রায়ই পেট ব্যথা করত। ভাবতাম আলসার, হয়তো সেরে যাবে। কিন্তু যেদিন মধ্যরাতে বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দেখি রক্ত, সেদিন মেসের কয়জন আমাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। টানা একানব্বই দিন মুখে কিছু খেতে পারিনি। স্যালাইন পুশের উপর বেঁচে ছিলাম। যে আমি ইনজেকশনের সুচ দেখলেই কুকড়ে যেতাম, সেই আমি কি না হাত পেতে নিতে থাকলাম একের পর এক ভ্যাকসিন। প্রতিদিন সাতটি করে সুচের গুতো। হাতের রগগুলো চালুন এর মত ঝালাপালা। দুই হাতে দুটি ক্যানোলা। মুখে কিছু খেতে পারি না, তাই সেলাইনই ভড়সা।
সাড়ে-চার মাসে জীবন সম্পর্কে এত দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার যা কিনা দীর্ঘ ত্রিশ বছরেও হয়নি। আমার বন্ধুরা প্রথম কদিন খুব খবরা-খবর নিলেও সপ্তাহখানেক পর ভুলে যেতে থাকলো। শুরুতে তারা রেগুলার এসে আমার পাশে বসে সেলফি তুলে ফেইসবুক মাতিয়ে সিমপ্যাথি ক্রিয়েট করতে চাইতো। তারপর আর খবর নেই। মেস-মেম্বাররা প্রথম প্রথম ফলমূল নিয়ে দেখতে যেত, পরে তো ভুলেই গেল। এবং দ্বিতীয় মাসে আমাকে জানালো তারা আমার সিটে নতুন মেম্বার তুলেছে। মার্কেটিং এর চাকরি তো, এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে কম্পানি জানালো আমার পোস্টে নতুন লোক নেবে। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলাম অর্পিতার কাছ থেকে। অর্পিতা আমার প্রেমিকা। ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাবার পথে রাজশাহীতে প্রায়ই রাত কাটাতাম অর্পিতার সাথে। হোটেলে পরিচয় দিতাম স্বামী-স্ত্রী। কথাটা এমনই ছিল, আমরা পরস্পর পরস্পরকে ছাড়া বিয়ে করব না। অর্পিতার পরিবার থেকে বিয়ের চাপ আসলে সে রাজী হচ্ছিল না। কিন্তু যখন জানালো আমার এই দশা, বাচি কি মরি ঠিক নেই, তখন সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেল। মুমূর্ষ রোগীর মৃত্যু দেখার জন্য অপেক্ষা করে কী লাভ!
ঢাকা মেডিকেলের নয়শো’ ছত্রিশ নাম্বার বেডে শুয়ে থেকে যখন খুব অস্বস্তি লাগতো, মাকে বলতাম- মা আমাকে একটু ছাদে নিয়ে যাবে? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি নেই তাই বিকেলে ডাক্তারেরা যখন অফ-ডিউটিতে থাকে, মা আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ছাদে রেখে আসতেন। আমি আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাবতাম- গাছ মরে যাবার আগে তার উঁচু ডালপালা আর দূরবর্তী শেকড়গুলো মরে যেতে থাকে। মানুষের মরা শুরু হয় তার স্বপ্ন ও আশা গুলোর মৃত্যু থেকে। তবে কি বিধাতা আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন!
কিন্তু আমার মা তো আমাকে মরতে দিবেন না। যমদূতের থাবা থেকে তার ছেলেকে বাঁচাতে সবসময় পাহারায় থাকছেন, প্যাঁচার ছোঁ থেকে বাচ্চাকে বাঁচাতে যেমন সতর্ক থাকে মেঠো-ইঁদুর।
মাদ্রাজ নিতে হলে অনেক খরচ। পাসপোর্ট, ভিসা-প্রসেসিং। বাড়ি-ভিটা ছাড়া আমাদের যা ছিল মা সব বেচে দিলেন। একমাত্র ছেলেই যদি বেঁচে না থাকে সম্পত্তি দিয়ে কি হবে!
এদিকে বিধাতার কি খেলা! তিনি হয়তো মায়ের ভালোবাসা পরীক্ষা করতে চাইছিলেন। আমার মা সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে গেল। যেদিন জমি-জিরাত বেঁচা শেষ, সেদিনই আমি দু’চামচ ডাবের পানি মুখে নিয়ে গিলে ফেললাম, নাড়িভুঁড়ি উল্টে বমি এল না। তারপর ক্রমে ক্রমে চামচের সংখ্যা বাড়তে থাকল এবং এক সপ্তাহের মাঝে আর সব খাবারের দিকেও হাত বাড়ালাম।
এখন ঢাকা মেডিকেলের দিকে গেলে নয়শো’ ছত্রিশ নাম্বার বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভাবি- কী দিন গিয়েছে আমার! সাড়ে চার মাসে জেনেছি এমন অনেক কিছু যা ত্রিশ বছরেও জানতে পারিনি। অসুস্থতার কালে যেসব নার্সদের সাথে কিছুটা খাতির হয়েছিল, তারা আমায় টুকটাক কুশল বিনিময়ের পর বলে- যে দশা হয়েছিল আপনার, ঈশ্বর নিজ হাতে রেখে না গেলে বাঁচার কথা ছিল না...
হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।
জোড়াসাঁকো
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
জোড়াসাঁকো
আহাদ আদনান
ভরা বর্ষায় খাল জলে টইটুম্বুর। আমি বসে আছি মল্লিকদের সাঁকোর ধারে। ক্রোশখানেক দূরে ঘোষদের সাঁকো। সাঁকো অদলবদল করলে এখানে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যায়। যদিও সাঁকো না, আমরা মন অদলবদল করেছিলাম।
মাঝরাত। ঘোষদের খাল ঘেঁষে পুরনো এক অশ্বত্থ বৃক্ষ। এখনো ওখানে আমার যাওয়া বারণ। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছের নীচে। হাতে লম্বা কাপড় কিংবা শাড়ি। তড়তড় করে ডাল বেয়ে কাপড়টার মাথা বেঁধে ফেলল শক্ত উঁচু একটা ডালে। আরেক মাথা গলায়। আমি বুঝতে পারছি কী হচ্ছে। মেয়েটাকে আমি চিনি। আমি এক্ষুনি গিয়ে ওকে আটকাতে পারি। ‘এমন করে না শিউলি। আত্মহত্যা মহা অন্যায়। এত সুন্দর জীবনটা নষ্ট করতে নেই’। কিন্তু কপালের দগদগে রক্তের জমাটে হাত পড়তেই মনে হলো, ‘যাকগে। মরলে মরুক’।
- কীরে বদ। বসে বসে আমার মরণ দেখছিলি? বাঁধা দিলি না কেন?
- ঘোষদের মেয়ে হয়ে মল্লিকদের সাঁকোতে এসেছিস যে বড়? তোর জ্যাঠারা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে আমাকে মেরে ফেলল, কই ছিলি তুই তখন? কপালে দেখ রক্ত লেগে আছে এখনো। তোকে ভালোবেসেছি। পালিয়ে বিয়ে করেছি। অন্যায়টা কী হয়েছে? তোদের আজ অনেক পয়সা। আমাদের সাথে কথা বলতেও বাঁধে। আমরা অচ্ছুৎ? বেশ করেছি ঘোষের মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছি। আবার জন্ম হলে আবার করব।
- আহারে, বাবুর রাগ কমেনি এখনো। আমার কথাটা একবার ভাব। আফিমের নেশাটা কাটতেই চিৎকার করি। পিটিয়ে আমাকেও শাস্তি দেওয়া হয়। যখন শুনলাম তোকে মেরে ফেলেছে আর কিছু চিন্তা করিনি। তোকে ছাড়া বাঁচব আমি গাধা। শোন, ভূতেদের রাগ থাকতে নেই। রাগ, ক্ষোভ, অহংকার, বংশ গৌরব, প্রতিশোধ এগুলো থাকে মানুষের।
- আর ভালোবাসা?
জোড়াসাঁকোর খাল পাড়ে মাঝরাতের বাতাসে উষ্ণ আন্দোলন খেলতে থাকে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।