বাঙালির ঐতিহ্য মসলিন
বাঙালির ঐতিহ্য মসলিন
ওবায়দুল মুন্সী
মসলিনের প্রাচীন নাম মলমল।
বাংলা মসলিন শব্দটি আরবি, ফার্সি কিংবা সংস্কৃতমূল শব্দ নয়। মসলিন শব্দটি এসেছে দমসূলদ থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হলো মসূল। এই মসূলেও অতি সূক্ষ্ণ কাপড় প্রস্তুত হতো। এই দমসূলদ এবং দসূক্ষ্ণ কাপড়দ -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ণ কাপড়ের নাম দেয় দমসলিনদ। অবশ্য বাংলার ইতিহাসে দমসলিনদ বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অ লে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ণ একপ্রকার কাপড়কে।
অতি সূক্ষè সূতায় তৈরী বলে মসলিন হতো খুবই স্বচ্ছ। মসলিন প্রস্তুত করা হতো পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও অ লে। কথিত আছে যে মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সুক্ষ্ণ ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।
মুঘলদের পরাজিত করে বাংলা দখল করল ব্রিটিশ বেনিয়ারা। রাজ্য ক্ষমতা দখলের পূর্বেই তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের বিলেতি শাড়ীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হল ঢাকার মসলিন। তাই তারা মসলিনকে চিরতরে দূর করে দিতে চাইল। প্রথমেই তারা মসলিন কাপড়ের উপর অত্যধিক শুল্ক বা ট্যাক্স চাপিয়ে দিল। বিলেত থেকে আমদানী করা কাপড়ের উপর শুল্ক ছিল ২-৪%। কিন্তু মসলিনসহ দেশি কাপড়ের উপর তারা ট্যাক্স বসাল ৭০-৮০%। তাই দেশে যেমন বিলিতি কাপড় সুলভ হল, একই সাথে ব্যয়বহুল হয়ে উঠল মসলিনসহ দেশি কাপড়। প্রতিযোগিতায় তাই মসলিন টিকতে পারছিল না। কিন্তু তারপরও টিকেছিল মসলিন। যখন ইংরেজ শাসকগণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে মসলিন তৈরির উপর। তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও চলত মসলিনের উৎপাদন। তখন ব্রিটিশরাজ চড়াও হল মসলিনের কারিগরদের উপর। তারা মসলিন কারিগরদের ধরে ধরে তাদের হাতের আঙ্গুল কেটে দেয়া শুরু করল যাতে গোপনে গোপনে তারা মসলিন তৈরি করতে কিংবা এর নির্মাণকৌশল অন্যদের শিক্ষা দিতে না পারে। আর এভাবেই একদিন বাঙালিরা হারিয়ে ফেলল তাদের গর্বের মসলিন তৈরির প্রযুক্তিজ্ঞান।
যাদুকরী ঢাকাই মসলিন হারিয়ে গিয়েছিল ১৭০ বছর পূর্বে। বাঙালিরা তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের যে সামান্য কিছু বিষয় বা বস্তু নিয়ে গর্ববোধ করত এবং এখনো করে তাদের মধ্যে প্রধানতম হলো মসলিন কাপড়।
ফুটি কার্পাস তুলা থেকে তৈরি এ কাপড় তার সূক্ষ্ণতার জন্যই সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। ভারতের মুঘল রাজপরিবার তো বটেই এমনকি ব্রিটিশ রাজরানীদেরও নাকি প্রথম পছন্দের কাপড় ছিল ঢাকাই মসলিন।
মসলিনকে আলাদা করা হতো সূক্ষ্ণতা, বুননশৈলী আর নকশার পার্থক্যে। এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকার মসলিনের আলাদা আলাদা নাম হয়ে যায়। যেমন-
মলবুস খাস
দমলবুস খাসদ মানেই হলো খাস বস্ত্র বা আসল কাপড়। এজাতীয় মসলিন সবচেয়ে সেরা আর এগুলো তৈরি হতো স¤্রাটদের জন্য। আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাসের মতো আরেক প্রকারের উঁচুমানের মসলিন তৈরি হতো, যার নাম দমলমল খাসদ। এগুলো লম্বায় ১০ গজ, প্রস্থে ১ গজ, আর ওজন হতো ৬-৭ তোলা। ছোট্ট একটা আংটির মধ্যে দিয়ে এ কাপড় নাড়াচাড়া করা যেতো। এগুলো সাধারণত রপ্তানি করা হতো।
সরকার-ই-আলা
এ মসলিনও মলবুস খাসের মতোই উঁচুমানের ছিলো। বাংলার নবাব বা সুবাদারদের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন। সরকার-ই-আলা নামের জায়গা থেকে পাওয়া খাজনা দিয়ে এর দাম শোধ করা হতো বলে এর এরকম নামকরণ। লম্বায় হতো ১০ গজ, চওড়ায় ১ গজ আর ওজন হতো প্রায় ১০ তোলা।
ঝুনা
দঝুনাদ শব্দটি, জেমস টেইলরের মতে, এসেছে হিন্দী ঝিনা থেকে, যার অর্থ হলো সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হতো, তবে সুতার পরিমাণ থাকতো কম। তাই এজাতীয় মসলিন হাল্কা জালের মতো হতো দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, পাঠানো হতো মোঘল রাজ দরবারে। সেখানে দরবারের বা হারেমের মহিলারা গরমকালে এ মসলিনের তেরি জামা গায়ে দিতেন।
আব-ই-রওয়ান
আব-ই-রওয়ান ফার্সি শব্দ, অর্থ প্রবাহিত পানি। এই মসলিনের সূক্ষ্ণতা বোঝাতে প্রবাহিত পানির মতো টলটলে উপমা থেকে এর নামই হয়ে যায়। লম্বায় হতো ২০ গজ, চওড়ায় ১ গজ, আর ওজন হতো ২০ তোলা। আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর সত্যতা নিরূপন করা না গেলেও উদাহরণ হিসেবে বেশ চমৎকার। যেমন: একবার স¤্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে তার মেয়ে উপস্থিত হলে তিনি মেয়ের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বললেন তোমার কি কাপড়ের অভাব নাকি? তখন মেয়ে আশ্চর্য হয়ে জানায় সে আব-ই-রওয়ানের তৈরি সাতটি জামা গায়ে দিয়ে আছে। অন্য আরেকটি গল্পে জানা যায়, নবাব আলীবর্দী খান বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তার জন্য তৈরি এক টুকরো আব-ই-রওয়ান ঘাসের উপর শুকোতে দিলে একটি গরু এতোটা পাতলা কাপড় ভেদ করে ঘাস আর কাপড়ের পার্থক্য করতে না পেরে কাপড়টা খেয়ে ফেলে। এর খেসারৎস্বরূপ আলীবর্দী খান ঐ চাষীকে ঢাকা থেকে বের করে দেন।
খাসসা
ফার্সি শব্দ খাসসা। এই মসলিন ছিলো মিহি আর সূক্ষ্ম, অবশ্য বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁ বিখ্যাত ছিলো খাসসার জন্য। ১৮-১৯ শতকে আবার জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। তখন একে দজঙ্গল খাসসাদ বলা হতো। অবশ্য ইংরেজরা একে ডাকতো দকুষাদ বলে।
শবনম
দশবনমদ কথাটার অর্থ হলো ভোরের শিশির। ভোরে যদি শবনম মসলিন শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেতোনা, এতোটাই মিহী আর সূক্ষ্ম ছিলো এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা।
নয়ন সুখ
মসলিনের একমাত্র এই নামটিই বাংলায়। সাধারণত গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে এর ব্যবহার হতো। এজাতীয় মসলিনও ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ চওড়া হতো।
বদন খাস
এজাতীয় মসলিনের নাম থেকে ধারণা করা হয় সম্ভবত শুধু জামা তৈরিতে এ মসলিন ব্যবহৃত হতো, কারণ দবদনদ মানে শরীর। এর বুনন ঘন হতো না। এগুলো ২৪ গজ লম্বা আর দেড় গজ চওড়া হতো, ওজন হতো ৩০ তোলা।
সর-বন্ধ
ফার্সি শব্দ সর-বন্ধ মানে হলো মাথা বাঁধা। প্রাচীন বাংলা উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন, যাতে ব্যবহৃত হতো সার-বন্ধ। লম্বায় ২০-২৪ গজ আর চওড়ায় আধা থেকে এক গজ হতো; ওজন হতো ৩০ তোলা।
ডোরিয়া
ডোরা কাটা মসলিন দডোরিয়াদ বলে পরিচিত ছিলো। লম্বায় ১০-১২ গজ আর চওড়ায় ১ গজ হতো। শিশুদের জামা তৈরি করে দেয়া হতো ডোরিয়া দিয়ে।
জামদানী
জামদানি কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত একধরনের পরিধেয় বস্ত্র। প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙ্গালী নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের উপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণতঃ শাড়িকেই বোঝান হয়। তবে জামদানি দিয়ে নকশী ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হত। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এছাড়া, মুঘল নেপালের আ লিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হত। তবে আগেকার যুগে দজামদানীদ বলতে বোঝানো হতো নকশা করা মসলিনকে।
মসলিন গবেষকদের মতে, ইতিহাস গ্রন্থে সর্বোচ্চ ১২০০ কাউন্ট সুতার মসলিনের কথা লিখা আছে এবং ‘রঙ্গদ, দআলিবালিদ, দতরাদ্দামদ, দতনজেবদ, দসরবুটিদ, দচারকোনাদসহ সবমিলিয়ে প্রায় ১০০ প্রকার মসলিন আছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে বিভিন্ন দেশের কলকারখানা থেকে সাশ্রয়ী কাপড় আমদানি করায় এবং অতিরিক্ত কর বা ভ্যাট আরোপের কারণে একসময় হারিয়ে যায় আমাদের ‘বাঙালি ঐতিহ্য মসলিন!’
সেই মসলিন ফিরিয়ে আনতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৫, সালে ১২৪০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। ২০২১ সালের ইতিহাসের পাতায় আজকের বাঙালিরা জানবে যে, অনেক বছর পূর্বে তাদের হারিয়ে যাওয়া ‘মসলিন’ দুনিয়াময় যে খ্যাতি ছড়িয়ে ছিল, বাংলদেশ জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘মসলিন’ আবার নতুন করে নতুনভাবে তার মূল স্থানে ফিরে এসেছে।
বাঙালির হারিয়ে ফিয়ে পাওয়া এই ‘মসলিন’ আবার তার পূর্বখ্যাতি অর্জন করে, পদ্মা সেতুর মতো সারা বিশ্বকে অবাক করে দেবে সেই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
সাধারণ সম্পাদক (সুসাস)
সুনামগঞ্জ।
অঘোর ফাগুন
অঘোর ফাগুন
আহাদ আদনান
(চিঠিটা তার পকেটে ছিল,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা। মাগো ওরা বলেঃ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)
শীতটা এবার পড়েছে জাঁকিয়ে। ভোরের কুয়াশায় দুনিয়াটা সেজে থাকে ভীষণ এক ঘোলা পুকুর। রানু’র নিজেকে মনে হয় মাছ। পুঁচকে পুঁটি। ভেজা ভেজা সরিষা খেতের আইল ধরে যখন সে বের হয় মক্তবের দিকে, সাথে জুটে যায় আরও কয়েকটা মাছ, বুলি, সেতু, আনু; হেঁটে নয়, ওরা যেন সাঁতরে সাঁতরে এগুতে থাকে। উঠতে গিয়ে মিহি সূর্যটা হেরে যায় পলাশপুর গ্রামের প্রতিটা দিনে।
কুয়াশা মাখা সূর্যটা মাথায় করে রানু ফিরে আসে। ‘মা, কুমড়ো গাছে ফুল আইছে। পিচ্চি হলুদ একটা ফুল’। ‘আইতে দে। হাত দিবি না। তাকাবি না বারবার। নজর লাগব। কায়দা’টা রাইখা হাত মুখ ধুইয়া আয় রসুইঘরে। পিঠা বানাইছি’। মাটির সানকিতে ছোট একটা গোল পিঠা। ধোঁয়া উঠছে গরম গরম। ছোট আঙুল দিয়ে পিঠাটার মাঝখানে একটা চাপ দেয় রানু। নারকেল, চালের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে বেয়ে পড়ে তরল গুঁড়ের ধারা। সেই পিঠা মুখে দিয়ে রানু বলে, ‘ ভাইজান কবে আইব, মা? গেল বিষ্যুদবার চিঠি আইছিল। আবার কবে চিঠি আইব? বড় আর মেঝ আপাও তো আসে না। বেড়াইতে আইতে লেখো না। চার ভাইবোন মিলা পিঠা খাই না কতদিন’। ‘হ, তোর ভাইজানের তো আর কাম নাই। সামনে পরীক্ষা। রাত জাইগা পড়ালেখা করতে হয়। কইলেই আসা যায়’? ‘আবার নাকি কি মিটিং করে? পোস্টার বানায়’? ‘পাগলের কথা কি বুঝি সব? সেই বছর কী বলল? পশ্চিম থেকে কোন গাধা আইসা নাকি বলেছিল, এখন থেকে আর বাঙলায় কথা বলা যাবে না। সবাইকে উর্দুতে কথা বলতে হবে। ফুলের গন্ধ, নদীর জল, পাতার রঙ, মায়ের ভাষা, বদলে দেবে সব। তোর ভাইজান ছিল সেদিন। ওরা বন্ধুরা মিলে চেঁচিয়ে উঠেছিল না, না বলে। গত বর্ষায় কি বলল মনে নেই? পশ্চিমারা আমাদের আলাদা জাত মনে করে। আসলেই আমরা আলাদা। মায়ের ভাষা ভিন্ন। এই ভাষার অধিকারের জন্য যা দরকার সব করতে হবে’।
দুপুরের আগেই ফিরে আসে রানু’র বাবা। সারারাত লঞ্চ চালিয়ে ভোরে তার ছুটি। হাতে বাজারের থলে। নিশ্চয়ই মাছ এনেছেন আজ। বাবাকে দেখেই দৌড়ে জড়িয়ে ধরে রানু। মায়ের সাথে মাছ কুটতে বসে যায় তারপর। বেল গাছটার ডালে বসে কয়েকটা ময়না পাখি ডাকতে থাকে। মাছের গন্ধে কা কা করতে করতে জুটে যায় গোটা দশেক কাক। উনুনের আগুনটা উসকে দিয়ে মা কড়াইয়ে চড়িয়ে দেন সবুজ কলমি। ‘ভাইজান, কুমড়া ফুলের বড়া পছন্দ করে, না, মা’? ‘করে তো। আর আলু, টমেটো দিয়া টেংরা মাছের পাতলা ঝোল। উপরে বেশি করে ধনে পাতা। কালাইয়ের ডাল দিয়ে বড়ি, ছোট ছোট বড়ি। বেগুন দিয়ে নলা মাছের তরকারিতে এই বড়ি থাকতেই হবে। শেষে সজনে ডাটা দিয়া মসুর ডাল’।
আনুদের বাড়িতে আজ মহা হইচই। ওদের কালো গাই’টা এক বাছুর দিয়েছে। মায়ের মতোই কুচকুচে কালো। রোদে চিকচিক করছে। সেই উঠোনে দাঁড়িয়েই পোস্টমাস্টার কাকুকে দেখে ফেলে রানু। ‘কাকু, ও কাকু, চিঠি আইছে, ভাইজানের চিঠি’? ‘এমনি এমনি তো কওয়া যাইব না, রানু বিবি। মুখ মিঠা করাইতে হইব’। হাসতে হাসতে থলে থেকে একটা হলুদ খাম বের করে কাকু। ‘ভাইজানের চিঠি, ভাইজানের চিঠি’, সুরে ঈদ নামে পলাশপুরের বিকেলে।
‘ঢাকার অবস্থা ভালো না। দানা বাঁধছে ক্ষোভ। মিটিং করছি আমরা রোজ। লুকিয়ে ছাপিয়ে। দেখলেই পুলিশের ধরে নিয়ে যায়। ছিঁড়ে ফেলে পোস্টার। তবে আমরা কি ভয় পাবার ছেলে? ভেবে দেখো, কত বড় সাহস! সবার কথা কেড়ে নিতে চায়। মা’কে মা বলে ডাকতে দিবে না। মায়ের ভাষায় গল্প শুনতে দিবে না। ভাষাই যদি না থাকল, তবে জীবনের কি আর মূল্য থাকে? দাঁড়াও, আমরাও বসে থাকার ছেলে না। মাগো, তুমি দেখে নিও, তোমার জন্য এবার কি আনি। ভাষা আনব, কথা আনব, এত্ত বড় এক ঝুড়ি কথা। তাই তো দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা। রাগ করোনা, লক্ষ্মী মা। এই তো কয়েকটা দিন আর। কেটে যাবে দেখতে দেখতে’। মা পড়ে, আর হাসে। চোখে তার জল।
শীত কমতে শুরু করেছে। সূর্যটা জ¦লতে শুরু করেছে বেলায় বেলায়। উঠোনে বসে মা নারকেলের চিড়ে কুটছেন। মিহি মিহি সাদা নারকেল। খেতে মিষ্টি মধুর মত। কায়দা’টা রেখে রানু মুড়কি চিবুতে চিবুতে এসে পড়ে। উড়কি ধানের মুড়কি। ‘এই মুড়কি তোর ভাইজানের জন্য রাখছি। আর ধরবি না। একসাথে পরে খাবি’। ‘কুমড়ো গাছ তো হলুদ হইয়া গেছে। ফুল আর ফুল। সজনে গাছটাও ঝুঁইকা পড়ছে। ডাটাগুলান ডাগর হইয়া গেছে। পুঁই গাছে বীচি গুলান কালা কালা। তুমি না কইছিলা, আইজ চিঠি লেখবা ভাইজানের কাছে। এগুলার কথা লিখবা না, মা’? ‘লেখুম তো’।
ফাল্গুনের আট তারিখ। বৃহস্পতিবার। গনগনে দুপুর। রানু দাঁড়িয়ে আনুদের উঠোনে। চুপচাপ কাঁদছে দু’জন মিলে। কালো বাছুরটা মরে গেছে। কি একটা অসুখ করে দুম করে মরে গেলো প্রাণীটা। মা একা বসে আছেন রসুইয়ের দাওয়ায়। হাতে তার খোকার চিঠি। সেই চিঠিটা। কথা নিয়ে ফিরে আসার আশ্বাসে মা আশায় বুক বাঁধেন, প্রতিদিন, কয়েকবার করে। হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠেন মা। আকাশে ঘুরঘুর করছে কয়েকটা শকুন। আনুদের বাড়ি যাবে বোধহয়। এখানে কেন উড়ছে মরার শকুন। একটা ঢিল নিয়ে ছুড়ে মারেন মা, ‘বালাই ষাট’।
শকুনিদের নাকি তখন প্রজননের ভরা মৌসুম। বাঙলার আকাশে আকাশে খাদ্যের গন্ধে উড়তে থাকে অপয়া পক্ষীকুল।
মাতুয়াইল, ঢাকা।
প্রহসিত দেশপ্রেম
প্রহসিত দেশপ্রেম
কে.এম. ওমর ফারুক
জামিল হোসেন এক থালা পান্তাভাতে গোটাদুই মরিচ-পেঁয়াজ ডলে কয়েক লোকমা মুখে পুড়ে চিবোতে থাকে, গোলপাতার ভাঙা ছাউনির ফুটা দিয়ে সূর্যের আলো সরলরেখায় এসে ছোট্ট ঘরের ভেতর এমনভাবে পড়েছে যেন ছাউনিতে কতোগুলো উন্নতমানের টর্চ লাইট বসিয়ে সাজানো হয়েছে, কিছুটা আলো তার গায়ে পড়েও যেন বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ছে। জামিল হোসেন কিছুটা উদ্বিগ্ন ভাবনায় ডুবে আনমনা হয়ে পড়ে। গরগর কইরা শীতকাল শ্যাষ অইয়া গ্যালো, সামনে বসন্তকাল। এরপরেই শুরু অইবো ঝড়বৃষ্টি! বসন্তের মধ্যে যদি ঘর সারাইবার না পারি তাইলে সব আমার গা দিয়া যাইবো। এ্যাতো কষ্ট কইরা খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া মানুষের বাড়ি যাইয়া, হাডের দিন হাডে যাইয়া তসবি-টুপি বেইচা যা পাই তাতে আমার খাওনও অয় না! লাঠিতে ভর দিয়া বেশি সময় হাঁটতেও পারি না। বাম পাওডা যদি নষ্ট না অইতো তাইলে কী আইজ এই হাল অইতো! গায় খাইটা টাহা জমাইয়া ঘরডা সারতে পারতাম। মানুষের ধারে এইরহম ঠ্যালা-গুঁতা খাইয়া জীবন পার করোন লাগতো না। এরই মধ্যে ডাকহরকরা এসে ঝুলি থেকে একটা হলুদ খামের চিঠি বের করে ডাক দিলে জামিল সাহেব তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে চিঠিটা হাতে নেয়। খামের ওপর চেয়ে দেখে বন্ধু কামাল হোসেন শহর থেকে চিঠি পাঠিয়েছে। দেশ স্বাধীনের দু’বছর পরে বন্ধু স্বপরিবারে গ্রাম ছেড়ে শহরে গেছে আজ অবধি এমুখো হয়নি, শুধু ডাক চিঠিতে যোগাযোগ করে। জামিল হোসেন তাড়াতাড়ি খামটা খুলে দেখে গোটা কয়েক হাজার টাকার নোট আর একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা;-
প্রিয় বন্ধু জামিল,
আসসালামু আলাইকুম। আমি জানি তোমার অবস্থা খুব খারাপ! আমি তোমাকে কতোবার বললাম আমার কাছে আসো তবুও তুমি আসলে না। আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বিশাল একটা অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি। উক্ত অনুষ্ঠানে অবশ্যই তোমার উপস্থিতি কামনা করছি। তাই তুমি দ্বিধা না করে আমার চিঠি হাতে পাওয়া মাত্রই (.......) এই ঠিকানায় রওয়ানা করবে যাতে আগে ভাগে পৌঁছাতে পারো। অবশ্যই তোমার উপস্থিতি চাই। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি তোমার বন্ধু
কামাল হোসেন
বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়ে জামিল হোসেন হ্যাঁ-না করতে করতে সপ্তাখানেক পরে রওয়ানা হলো শহরের দিকে।
এদিকে কামাল হোসেন পথের দিকে চেয়ে থাকে কখন যেনো বন্ধু জামিল হোসেন আসে! অপেক্ষা করতে করতে অনুষ্ঠানের দিন চলে আসলো, কিন্তু বন্ধুর আসার কোনো খোঁজ খবর নাই। আগে চিঠির উত্তর দিতো, কিন্তু এবার কোনো উত্তরও দিলো না। কামাল হোসেন চিন্তা করতে থাকে আল্লাহ না করুক বন্ধুর কোনো অঘটন ঘটলো না তো! আমার বন্ধু বেঁচে আছে তো! কী হলো বন্ধুর? তাহলে কী আর কোনোদিন ওকে দেখতে পাবো না? আর কোনোদিন ওর চিঠি পাবো না? এরকম ভাবতে ভাবতে কামাল হোসেনের মনটা মলিন হয়ে যায়।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো। পিঁপড়ের মতো দলে-দলে লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। এমন সময় লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেটের দিকে আসছেন এক পা ওয়ালা এক বৃদ্ধ। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি, সাদা উসকোখুসকো চুলগুলো কিছুটা বাগে আনার জোর চেষ্টা চলেছে, জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে মাংস ঝুলে পড়া গালে মোলায়েম প্রাপ্তির কিছুটা হাসি লাগানো। পরনে পুরোনো লুঙ্গি আর একটা শতচ্ছিন্ন সাদা পাঞ্জাবি, তবে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের পুটলি। গেটের দারোয়ান একবার তার স্বভাব আর পরিচ্ছন্নতা দেখে আরেকবার তার কাঁধের ঝুলি, উসকো-খুসকো চুলদাড়ি আর ছেঁড়া পোশাক। বৃদ্ধ লোকটি গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান আচমকা পথ আঁটকে বললো ভেতরে ঢোকা যাবে না। বৃদ্ধ লোকটি বললো; ‘এইডা কি কামাল হোসেনের বাড়ি? হ্যাঁ, তাতে তোমার কী?
-আমি তার লগে দ্যাহা করবার আইছি।
-স্যার এখন অনেক বিজি আছেন, তুমি পরে আসো।
-হে আমারে আইসতে কইছে।
দারোয়ান চিৎকার করে বললো; আরে যাও! কোত্থেকে কোন ভিক্ষুক আসছে স্যারের সাথে দেখা করবে! দূরে যাও, বলছি না স্যার এখন কারো সাথে দেখা করবে না?
দূর থেকে কামাল হোসেন দারোয়ান আর বৃদ্ধ লোকটির অবস্থা দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে ডেকে বললো তাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। ‘এতো লোক আসছে আর একটা ভিক্ষুক আসলে সমস্যা কী!’ বিড়বিড় করে এই বলে সে নিজ কাজে মনোযোগ দেয়। দারোয়ান বৃদ্ধ লোকটিকে ঢুকতে দিলে সে গিয়ে অনুষ্ঠানের ভেতর ঢোকে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই তার পরিচ্ছন্নতায় কিছুটা অবাক হয়, কিন্তু ছেঁড়া পোশাক, চুলদাড়ি আর কাপড়ের ঝুলি দেখেই বিরক্ত হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই কয়েকজনের শুরু হয় উত্যক্ত করা। একজন তাকে ইংরেজিতে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। উত্তর না দিতে পারলে বলে; ‘বাপের জনমে কোনোদিন ইংরেজিতে কথা বলেছো?’ একজন বলে তোমাকে দাওয়াত করলো কে? বৃদ্ধ বললো; আম্নেগো যে দিছে হে আমারেও দিছে। বৃদ্ধের কথায় ওরা জোরে হেসে বলে গ্রামের খ্যাত কইত্তা আইছে! একজন পুটলি ধরে বলে এটাতে কী আনছো? পঙ্গু পা দেখে বলে; ‘কোথায় কী কুকাম করতে গিয়ে পঙ্গু হয়েছো?’ এভাবে আরও অনেক হেনস্তা করতে লাগলো। এসব প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ লোকটি অশ্রুসিক্ত চোখে ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মঞ্চের সামনে চলে গেলো। মঞ্চে একজন ভাষণ দিচ্ছিলো ইংরেজি এবং বাংলা মিলিয়ে। তার ভাষণ শুনে রাগে-ক্ষোভে নিজেকে সামলাতে না পেরে কাঁপতে কাঁপতে মেঘের গর্জনে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো;-‘থামো! এইডা কী অইতাছে? দেশটা কী মগের মুল্লুক পাইছো তোমরা?’ তখন সবাই থ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো। একজনে দৌঁড়ে এসে তাকে ধরলো এখান থেকে বের করে দিতে। বৃদ্ধ লোকটি ঝাড়ি দিয়ে বললো;- ‘আরে ছাড়ো! আমি কোনো ভিক্ষুক না, ভিক্ষা করবার লাইগা আমি আহিনাই।’ বলেই সে মাইকের মাউথের কাছে গিয়ে বললো;- ‘এইহানে আমি বিনা দাওয়াতে আহিনাই। আর ভিক্ষা করবার লাইগাও আহিনাই। আম্নেগো বিরক্ত করোনের লাইগা মাফ চাই। এইহানে আসোনের পর থাইকা আম্নেরা আমারে ম্যালাকিছু জিগাইছেন আমি তার জবাব দেওনের লাইগা আম্নেগো একটু বিরক্ত করলাম। আম্নেরা আমারে ইংরেজিতে ম্যালাকিছু জিগাইছেন, আমি জবাব দিতে পারিনাই দেইখা কইছেন; ‘বাপের জনমে কোনেদিন ইংরেজিতে কথা কইছো ! ‘আমারে কইছেন গ্রামের খ্যাত! গ্রামের খ্যাত অইলেও আমি আমার মায়ের ভাষায় কতা কই। জন্মের পর আমার মা আমারে এই ভাষাই শিখাইছে। এই ভাষায় আমি আমার মার গন্ধ পাই, এই ভাষায় আমি আমার মারে দ্যাখতে পারি। এই ভাষায় আমি দ্যাহি মায় আমারে ডাকতাছে, কইতাছে; বাবা জামিল, আয় বাবা এহন কয়ডা খাইয়া ল খ্যালোনের ম্যালা সময় অইবো। আমি গ্রাইম্যা খ্যাত অইলেও আম্নেগো মতোন আরাক দ্যাশের ভাষা হাওলাত কইরা কতা কই না। ১৯৫২ সালে আমার ভাইরা এই খ্যাত ভাষা রক্ষার লাইগাই শহীদ অইছিলো। কিন্তু আম্নেরা! আম্নেরা আইজকার এই দিনেও বিদ্যাশের ভাষায় ভাষণ দিতাছেন! তাইলে পশ্চিমারা রাষ্ট্র ভাষা উর্দু অবে বইলা কী দোষ করছিলো? আম্নেগো কি শরম লাগে না? আম্নেরা আমারে জিগাইছেন; ‘কী কুকাম হরোনের লাইগা আমার পাও কাইট্টা দিছে! ‘হ আমি কুকামই হরছিলাম। যুদ্ধের কালে আমার মতোন গ্রাইম্যা খ্যাত আর ভিক্ষুকরা যদি পশ্চিমাগো লগে যুদ্ধ না হরতো তাইলে আইজ আম্নেগো মতোন ইংরেজগো দালাল জন্মাইতো না। আমি যদি কুকাম না হরতাম তাইলে আমার মায়রে অরা পশুর মতো গুলি করতে পারতো না, আমার বাজানরে অরা অইরম রাইফেল দিয়া পিডাইয়া বেহুঁশ কইরা গুলির উপার গুলি কইরা মারতে পারতো না! অই শব্দ গুলা আইজও আমার কানে বাজে! এহনও আমি ঘুমের মইধ্যে বাজান বাজান কইয়া কাইন্দা উঠি। অরা আমার বুবুজানরেও ছাড়েনাই! হায়েনার মতোন খাবলে খাবলে খাইছে! হ্যাগো বাঁচাও বাঁচাও চিক্কার আইজও মনেঅয় আমি স্পষ্ট শোনতাছি। আমি যদি ওই কুকামডা না হরতাম তাইলে আমার এতো সুন্দার পরিবারডা হারাইতাম না। আমি হারাইতাম না আমার এতো সুখের জীবনডা। আমি যদি খালি যুদ্ধে না যাইতাম, পশ্চিমাগো বিরুদ্ধে দল না বানাইতাম তাইলে আইজ আমার এই হাল অইতো না। কিন্তু না, আমার ধারে আমার জীবনেরতা দ্যাশ ম্যালা বড়ো, আমার পরিবারেরতা আমার দ্যাশ বড়ো, আমার ভাষা বড়ো। আমি আমার দ্যাশরে ভালোবাসি। আম্নেগো মতোন আমি মা'রতা খালারে বেশি দরদ দ্যাহাই না। আগে আমার দ্যাশ আপন তারপর বাইরের জগৎ। (সেখানে উপস্থিত সবাই বৃদ্ধ লোকটির দিকে অপলক চেয়ে তার কথা শুনতেছে আর তাদের গাল বেয়ে বেয়ে অশ্রু ঝরতেছে।)
তারপর সে পুটলি থেকে একটা হলুদ খামের চিঠি বের করে বললো;- আমি কোনোদিন এই শহরে আসবার চাইনাই, খালি এই চিঠির মালিকরে একবার দ্যাহোনের লাইগা আইছি। এই চিঠির মালিকের লগে বিশটা বচ্ছর কাডাইছি, এই চিঠির মালিক ছাড়া আমার আর আপন কেউ নাই। আইজ পঞ্চাশ বছর ধইরা অরে দেহি না। আমার বন্ধুডারে একবার দ্যাহোনের লাইগা এইহানে আইছি। একথা বলতেই পেছন থেকে বন্ধু কামাল হোসেন দৌঁড়ে এসে ‘জামিলরে’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দেয়। কেঁদে কেঁদে বলে; ‘আর কইও না বন্ধু আমি আর সইতে পারি না, ওই কথা আর মনে করাইও না বন্ধু।’ কিছুক্ষণ পর একটু থেমে বলে; ‘তোমারে এতোদিন পরে দেইক্ষা আমি চেনতে পারিনাই, তুমি অনেক বদলাই গ্যাছো, আমারে মাফ কইরা দ্যাও। মাফ কইরা দ্যাও বন্ধু।’ জামিল কান্নাচাপা কণ্ঠে বললো তুমিও অনেক বুড়া অইয়া গ্যাছো অনেক বদলাই গ্যাছো, আমিও তোমারে চিনিনাই বন্ধু।’ যারা জামিল হোসেনকে বিদ্রুপ করেছিলো তারা সবাই নিজেকে আড়ালে নিয়ে মুখ লুকাতে লাগলো আর নিজেদের দোষ দিয়ে বলতে লাগলো হায় এ কী করলাম আমরা! যাঁদের এতবড় ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ আসলো আজ তাদেরই একজনকে আমরা উত্যক্ত করলাম! একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করলাম! সত্যিই তো আমরা মায়ের চেয়ে খালাকে বেশি মায়া দেখাচ্ছি! সত্যিই তো আমরা বিদেশের দালালি করছি! আমরা এ দেশের সবকিছু ভোগ করে দেশপ্রেমিক হতে পারিনি! আমরা বড়োই অপরাধী! আজকে আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যতœ করতে পারিনি! আমাদের এ মুখ কোথায় লুকাবো! আজ মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমরা রাজার মতো আরাম-আয়েশ করছি! তারপর; তারা দৌঁড়ে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা জামিল হোসেনকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিলো! নিজেদের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে লাগলো আর বলতে লাগলো এমনটা আর কখনো কারো সাথে করবো না, আর কখনো ইংরেজি নিয়ে বড়াই করবো না, আমরাও দেশকে ভালোবাসবো, দেশের যে কোনো প্রয়োজনে আমরা নিজেদের বিলিয়ে দেবো। তাদের কান্না এবং আকুতি-মিনতি দেখে জামিল হোসেনের মন গলে যায় এবং ক্ষমা করে দেয়। জিতে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা জামিল হোসেনের দেশপ্রেম।
থানাঃ কোটালীপাড়া
জেলাঃ গোপালগঞ্জ
একুশের পদাবলি : ০১
দূরত্ববিষাদ-২
আরিফুর রহমান
দু’টো ছায়ার মাঝে দূরত্ব বাড়তেই
অন্ধ হয়ে গেল আগুন পোহানোর দিনটি!
অথচ সে-ই থেকে
চোখে চোখে লেখা হচ্ছিল পঙ্ক্তিমালাÑ
‘এই বিকেলটা এমনই আলোয় থাক
মনের উঠোনজুড়ে’
‘সন্ধ্যে নামুক অন্য কোনো গ্রহে,
অন্যখানে যাক উড়ে
চোখ গেলÑপাপিয়ার দল’
‘ওম ছড়াই চলো হিমে; প্রেমে ও দ্রোহে!’
নিয়রে ভিজতে ভিজতে
পা দুটোয় জমে গেছে না চলবার ছল।
এখন, তোমার দেওয়া
অনাকাক্সিক্ষত এই ‘দূরত্ব-বিষাদ-রঙ’
কীভাবে মুছে ফেলব, বলতে পারো?
প্রভাত ফেরিতে যাব
মাহতাব উদ্দিন
প্রভাত ফেরিতে যাব আমি,
আমাকে ডেকো না, মাগো।
গগনবিদারী ধ্বনি আজ উচ্চকিত হবে!
প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মনের অগ্নিকে-
প্রজ্বলিত করে আকাশে ছড়াব।
সালাম জব্বার, বরকতের রক্ত, শকুনেরা
যেখানে ঝড়িয়েছিল, সেখানে মিছিল হবে,
দিতে হবে তাদের ফিরিয়ে। ঘুমাতে পারি না
আমি, বারবার ডাকে অসহায় আত্মাগুলো।
মনের অস্ফুট বেদনারে কী করে বোঝাই?
সবুজপাতায় মোড়ানো একগুচ্ছ লাল গোলাপ,
তোমাদের দেবো বলে কতকাল হলো!
মনের গহীনে যতনে রেখেছি।
হে বিধাতা, পাশে থেকো, ওসব জীবন্মৃতদের।
শিরোনামহীন
নুরুল ইসলাম বাবুল
দিশেহারা হয়ে গত বিকেলের শোকে
ঝিঁঝিরা ছেড়েছে তাদের মুখের গান
আমাদের ঘুম দিয়েছি ঝিঁঝির চোখে
আঁধার এনেছে নীরবতা শুনসান-
এমন মাতাল মধ্য রাতের ডাকে
আমরা ভুলেছি বিগত সকল রাত
একটা দোয়েল ঘুলঘুলিটার ফাঁকে
ছড়িয়ে পালক জানায় সুসংবাদ।
তখন শীতের শিশিরেরা থরে থরে
গলে গলে যায় ফাগুন দিনের ছলে
বুকের পকেট উষ্ণতা দিয়ে ভরে
আরাম আরাম হৃদয় আকাশ বলে।
একুশ
বনশ্রী বডুয়া
একুশ এলেই মিছিল আসে
আসে রক্তধারা,
একুশ এলেই বর্ণরা সব
হয় যে পাগলপারা।
একুশ এলেই কান্না আসে
আসে মাতৃভাষা।
একুশ এলেই কবিতারা সব
পায় যে ফিরে আশা।
একুশ এলেই সূর্যোদয় আসে,
আসে পুষ্পমাল্য হাতে,
একুশ এলেই আসাদ আসে
রাজপথ ভাসে রক্তে।
স্বাধীনতা তোমাকে জানাই ধিক্কার
জোবায়ের সরকার
স্বাধীনতা তবে কি তুমি ভুলে গেছো?
ভুলে গেছো মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য,
ভুলে গেছো আমার ধর্ষিতা মা-বোনের আর্তনাদ,
মনে কি নেই সেই রক্তাক্ত সময়, গণহাত্যার রাত?
চেয়ে দ্যাখো-
পুরনো শকুনেরা আজো হাড্ডি চাবায় অসহায়দের,
স্বাধীনতা তোমাকে জন্ম দিতে গিয়ে-
আমার মায়ের শরীর থেকে ঝরেছে রক্তের সাগর, কান্নার সাগর।
অথচ আজও সে শকুনদের নির্মম হাতে সপিত-
আমার মায়ের বুকের উপকূল।
স্বাধীনতা তোমাকে জানাই ধিক্কার
স্বাধীনতা তুমি খাঁচায় বন্দি,
মোহগ্রস্ত তুমি বিত্তবানের অর্থে,
ক্ষমতাবানদের ননীর পুতুল তুমি,
তোমাকে জানাই ধিক্কার।
স্বাধীনতা তুমি মুজিবদের মরণফাঁদ,
পা-চাটাদের বাঁচবার কৌশল,
তোমাকে জানাই ধিক্কার।
নিজভূমে নির্বাসিত
মিশির হাবিব
খুন করে পার পেয়ে যায় খুনি,
প্রকাশ্য রৌদ্রালোকে জখম করে ছাড় পেয়ে যায় ঘাতক;
আর কত রক্ত বইলে বলা হবে রক্তবন্যা!
আর কত ধর্ষিতার কবর খোড়া হলে বলা হবে ধর্ষিত হচ্ছে প্রাণের বাংলা!
একদিন সোনার বাংলা শ্মশাণ হবে।
আবার একটি যুদ্ধ চাই
এ যুদ্ধ ধর্ষক বনাম ধর্ষিতা
ঘাতক বনাম ঘৃত।
বাঘিনীরা জেগে ওঠ,
কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে আয়
শকুনের ঠোঁটে খুবলে ছিঁড়ে খাই চল পিশাচের হৃদপি-।
মহামান্য প্রেসিডেন্ট, হে রাষ্ট্র!
এ আমার রক্তার্জিত কীসের স্বাধীনতা
যেখানে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাই মহাশঙ্কা!
একুশের পদাবলি : ০২
একটি ট্রেন
লাভলী ইসলাম
চলন্ত ট্রেনের বগী গুলো ছুটে চলে
হুইসেল দিয়ে আপন মনে ধাবমান গন্তব্যের পথে
চলতে পথে কোথাও থেমে যায় ক্ষনিক স্টেশনের উঠোনে
কাউকে বিদায় দিয়ে নতুন কাউকে হৃদয়ের ঘরে বসতি দিয়ে ফের ছুটে চলে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ।
রেললাইনের লোহার সংঘর্ষে এ পথ সেপথ এ শহর সে শহর করে করে দিনের কর্মক্লান্ত দেহটাকে পরিত্যক্ত করে ফেলে রাখে স্টেশনের অচল কোন জং ধরা লাইনের পরিত্যক্ত লৌহদানবের উপর ।
হয়ত নতুন ভোরে নতুন কোন রেললাইনের পথ ধরে চলবে ট্রেনটি নিজের দেহটাকে টেনে হেঁছড়ে ।
আবার রাত আসবে আবার হইত হবে ভোর
এত এত প্রয়োজন তার করতে পারাপার
হায় ট্রেনটা অচল হলে কখন কোনদিন ও কেউ নেয় না আর তার খবর !!
একুশে ফেব্রুয়ারি
সোহেল রানা
‘ভাইয়ের বুকে লেগেছে বুলেট’......
তাজা রক্ত! তাজা রক্তে-ভেজা-বুক...!
শত-সহ¯্র প্রাণের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত, রক্ত-ভেজা-মুখ!
যেন গোধূলির লালিমামাখা সূর্যের নির্মলতর রূপ।
প্রিয়সীর সজলচক্ষু আর বোনের চোখে অগ্নিশিখা --!
শান্ত সাগরের বুকে রক্ত¯্রােতে দাঁড়িয়ে মা!
পাহাড়ের বুকে শূন্যতায় খাঁ-খাঁ হৃদয়ে বাবা!
সাগরের বুক থেকে আর পাহাড়ের হৃদয়
ঝাঁঝরা করে কেঁড়ে নিয়েছে যে দানবে...
আকাশ গহীন অন্ধকারের অতলে,
নক্ষত্র শোকে বিবর্ণ আলোকে -- সেই আলোকে
মোমবাতির ঝড়োকান্না এলোমেলো-এবড়োথেবড়ো শিখায় জ্বলছে --
শত-সহস্র জনতা হয়েছে জড়, ধরণী পরিব্যাপ্ত;
যতোরকমের বাগানের ফুল হাতে নিয়ে, অপেক্ষার প্রহরে --
‘বক্ষপিঞ্জর’ যেন চন্দনকাঠের চিতায় দাউ দাউ জ¦লছে...!
সেই আগুন ঢেলে দেবে! কখন রাত্রির মধ্যপ্রহর অতিক্রম করবে
সেই আগুন ঢেলে দেবে!
ভোর;
আকাশে রক্তের গন্ধ!
ধূসর ডানার চিল এলোমেলো, মাতালের মতো!
বাতাসে করুণ স্পন্দন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত --
মা আর বাবা হারিয়েছে বুকের ধন!
ডপ্রয়সী ভালবাসার জন!
ভ্রাতৃ, ভ্রাতা! ভ্রাতা, সহোদর!
স্বজন হারিয়েছে আপনজন!
ভাষার জন্য যাঁরা দিয়েছেন জীবন!
প্রেয়সী, শীতে-ভেজা কানাকোয়ার চোখে-
যেমন শীতের রাতে বেতঝোপের শীষে ডুবায়
আটকা-পড়া কানাকোয়া রাতভর ছোটাছুটি
করতে-করতে-করতে সকালে নির্জীব, শক্তিহীন;
জীবন আছে তবু প্রাণ নেই!
শুধু ‘সজলচক্ষু’ স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে- পলক পড়ছেনা সেই চোখে;
ভ্রাতৃ দাঁড়িয়ে আছে এবড়োথেবড়ো চুলে; তার
চোখের লেলিহান অগ্নিশিখায় ধুলো বাষ্পের ন্যায় উড়ছে...
ভাইয়ের বুকে লেগেছে বুলেট!
ঢেলেছে তাজা রক্ত! কেঁড়ে নিয়েছে প্রাণ!
ভাইয়ের বুকের বিদ্ধ বুলেটে, সহোদরের হৃদয় খান খান...!
কপালে কাফনের কাপড় বাঁধা- রক্তভা!
বুকে শোকের চিহৃ!
বাঙালি নদী
জহির খান
তোর মায়ায় জড়িয়ে জাতি-বর্ণ চিহ্নিত প্রেম
আমার আজন্মকাল
মায়াময় তোর দেহে উঠে আসে
পশ্চিমাঞ্চলের ¯্রােত ও সময়...
আহ্ কি মায়ায় এই শহরের অসংখ্য জীবন
উঁকি মারে ঢেউ খেলে জরায়ুর খুব গহিনে
তবু এমন সব জলের কথোপকথন
নামমাত্র মুল্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে
বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার অতীত...
আর
ভুলবাল ঠকঠক করে কাটাই সময় সরকার
এখন বাঙালি নদী আমায় নিয়ে চলো
তোমার জলে কিংবা ডাঙায় বর্তমানে
যেখানে মৃত কোন গল্পের নায়ক নেই
আছে জেলে আর তাঁতিদের গভীর প্রেম
আর বুননকৌশল আবিষ্কার ইতিহাস...
হেলায় কাটাও দিন
জামান আহম্মেদ ইমন
কেমন করে যেতে চাইছো
কাগজের নৌকায় বাড়ি,
মাঝি বিনাই, বৈঠা বিনাই
পারবে কি দিতে পাড়ি।
আকাশে পানি মধ্যে মাটি
তার নিচে পানি,
ভাসমান এই পৃথিবীর মাঝে
পড়ছো না বাণী।
রূপের জালে বন্ধি হইয়া
চলছো ভুলের পাড়ায়,
আসিলে আজরাইল কারো জন্য
এক মূহুর্ত কি দাড়ায়।
জীবনের গন্ডি যাচ্ছো পেরিয়ে
হেলায় কাটাও দিন,
অসময়ে পাখি উড়াল দিলে
শোধ হবে নাকো ঋণ।
ঝরছে পাতা মন থেকে
মজনু মিয়া
শীতের ঝির্ণতা মনকে বেদনাবিধুর করে দেয়
ক্লান্ত অবসন্ন শরীর তীব্র ক্ষোভে ভারাক্রান্ত!
নিরলসভাবে গাছের পাতারা হলুদ হয়ে
ঝরে পড়ছে, কান্নার আকুতি লুকাতে ব্যার্থ মন।
একাকী পিরিতের চুলায় অনল জ¦লে উঠে
ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাইয়া বিতৃষ্ণ করে দেয় মন;
যাপিত জীবনে পরিযায়ী পাখির মতো দৌড়
তবুও দুদ- সময় নেই, কাউকে বুঝিয়ে বলবার।
অবুঝ মন থেকে কত ক্ষণ কত দিন মাস বছর
ঝরে যায়, কেউ খবর রাখে না। শীতের করচা করি।
ফাঁদ
ফাঁদ
রফিকুল নাজিম
-কি রে, সুপ্তি; সাজগোছের ইনিংস কি তোর শেষ হলো? ছেলেটা তো মনে হয় সেই সকালেই চলে এসেছে। ভোরের গাড়িতেই তো আসার কথা। তাড়াতাড়ি কর। এখন অপেক্ষা করাটা ছেলেটার কাছে খুবই বিরক্তিকর ঠেকবে।
-ওম্মা! তুমি কি আমার সৎমা! নাকি ঘষেটি বেগম! মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের জন্য দরদ দেখি উতলে উঠছে!
-কি যে বকিস না! তাড়াতাড়ি কর।
-আচ্ছা। এই তো শেষের দিকে। মা, টেবিলে নাস্তা দিয়েছো?
-হ্যাঁ, সেই কখন থেকে তোর বাবা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি আয় তো।
-আচ্ছা, আমি আসছি। যাও।
সুপ্তি আসগর সাহেব ও রুমিনা রহমানের একমাত্র সন্তান। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সুপ্তি তিন সাহিত্যের হাবিজাবি বই পড়তে ভালোবাসে। সেই স্কুল জীবন থেকেই বইয়ের ভিতরে তিন গোয়েন্দা বই রেখে পড়ত। সহজ করে বললে তাকে ‘বইপোকা’ বলা যেতেই পারে। দুরন্ত ও তিন হাত কলিজার মেয়ে-সুপ্তি। এই তো একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় কলেজে আসা যাওয়ার পথে পাড়ার এক বখাটে ছেলেকে একদিন সুপ্তি সেইরকম ধোলাই দিয়েছিল। ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়ার পর সেটাই সুপ্তির এটাই ছিল প্রথম হাতের কারুকাজ। বখাটে কাসুর নাকমুখের ভূগোল এবড়োথেবড়ো করে দিয়েছিল সেদিন। সেদিন শত শত মানুষের সামনে দিয়ে সুপ্তি কাসুকে টেনে হিঁচড়ে শহরের গোলচত্বরের পুলিশ বক্সে নিয়ে যায়। কয়েকদিন সেই ঘটনাই ছিল সারা শহরের হিট টপিক। চায়ের দোকানে আড্ডায় প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল এই সুপ্তির সেই অনন্য কীর্তি। কাগজওয়ালাদের ভীড় সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আসগর- রুমিনা দম্পতিকে। সারাক্ষণ বাসায় সাংবাদিকদের আসা যাওয়া। কখনো অমুক কাগজে সাক্ষাৎকার তো পরক্ষণে তমুক চ্যানেলে সাক্ষাৎকার!
অথচ এই ধিঙ্গি মেয়েকে নিয়ে মা বাবার দুশ্চিন্তার কমতি নেই। চোখের সামনে অন্যায় দেখলেই সুপ্তি সটান দাঁড়িয়ে যায়। যেখানে কোনো পুরুষ মানুষও যেতে ভয় পায়। যেখানে জানের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসে না। সেখানেও সুপ্তির সরব উপস্থিতি থাকে। ঘটনার নিজস্ব দাবী অনুসারে মাঝেমাঝে তাকে হাতপা চালাচালি করতেও হয়। অথচ মেয়েটাকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না। কী সুন্দর, মায়াবতী রূপ তার! পোষা বেড়ালের মত দেখতে নরম তুলতুলে গাল। খুব আদুরে। কাজল টানা চোখের অতলে একরাজ্য রহস্য খেলা করে। গাল বেয়ে নেমে আসে চাঁদের সবটুকু আলো। দীঘল চুলে খেলা করে দুষ্টু বাতাস। ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকে আততায়ী হাসি। দারুণ সংসারী টাইপ চেহারা সুপ্তির। অথচ এই মায়াবতীর হাতেই দশভুজা দুর্গার শক্তি। অন্যায়ের সামনে সে সশস্ত্র বাঙ্কার। ফুটন্ত বুলেট, সোহাগী গ্রেনেড!
সুপ্তি ডাইনিংয়ে আসতে আসতে তার মাকে ডেকে বললো-
-মা, দেখো তো শাড়িটা ঠিকঠাক আছে কিনা? কুঁচিগুলো সমান হয়েছে?
-হ্যাঁ। সবকিছুই ঠিক আছে। মাশাআল্লাহ। তোকে তো পরীর মতোই লাগছে রে।
-সত্যি, মা! পাম্প দিচ্ছো না তো?
-এই দিব্যি কেটে বলছি, তোকে সত্যিই পরীর মতো লাগছে।
-আচ্ছা। বাবা, তুমি তো দেখছি এখনো রেডি হওনি! কখন রেডি হবা? পাঞ্জাবি পরে এসো তাড়াতাড়ি।
-মা’রে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমি তোকে গলির মাথায় গিয়ে রিক্সাতে তুলে দিয়ে আসবো। তুই যা। এসবে আমাকে টানিস না।
-হুম। বুঝেছি। আমার কাজ আমাকেই করতে হবে। আমাকে একাই মোকাবেলা করতে হবে সবকিছু।
আসিফের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সুপ্তি। সকাল থেকেই ধিঙ্গি মেয়েটা বাড়িঘর সবকিছু মাথায় তুলে রেখেছে। প্রথম দেখা বলে কথা! বারো দিনের পরিচয়ের মোড়ক উন্মোচন আজ। উত্তেজনার কোনো কমতি নেই মেয়েটার মধ্যে। সুপ্তি নীল শাড়ি পরতে চেয়েছিল। কিন্তু আসিফের পছন্দের কলাপাতা রঙের একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে। সাথে কপালে পরেছে গাঢ় লাল রঙের একটা টিপ। খোঁপায় পরেছে বেলিফুলের মালা। সত্যিই তো সাধারণেই খুব অসাধারণ লাগছে সুপ্তিকে। নিজেকে কয়েকবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে আয়নায়। এতোটা সুন্দর করে কখনো নিজেকে দেখেনি সে। আজই প্রথম নিজেকে বারবার আয়নায় দেখা। তাও আসিফের জন্য। ছেলেটা সত্যি হয়তো যাদু জানে। না হলে এরকম একটা ডাক্কু মেয়েকে কিভাবে বশীকরণ করলো! গত চব্বিশ বছর ধরে দেখা মেয়েটাকেও আসগর সাহেব ও রুমিনা রহমানের কাছেও বেশ অপরিচিত ঠেকে! আজকাল সুপ্তি ঘরেও মাকে সাহায্য করে। নিজের ঘর নিজে গুছিয়ে রাখে। বারান্দার ফুলগাছগুলোতে নিয়ম করে পানি দেয়। বিকেল হলে ছাদে যায়। গুনগুন করে গান করে। উদাস চোখে আকাশ দেখে। মোবাইলে সারাক্ষণ কথা বলে। একাকী হাসে। মায়ের চোখে চোখ পড়লেই লজ্জায় লাল হয়! দারুণ একটা সময় যাচ্ছে সুপ্তির। রুমিনা রহমান সবই বুঝেন। টেরও পান। মাঝেমাঝে সুপ্তির মাঝেই হয়তো নিজেকে তারণ্যকে দেখে ভড়কে যান। স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে নিজের সময়টাকে তুলে আনে। থরে থরে সাজিয়ে রাখেন মনের গোপন সিন্দুকে; আড়ালে সযতনে।
সুপ্তির আর খাবার টেবিলে বসতে ইচ্ছে করছে না। একটা গোপন উত্তেজনা শরীর ও মনে ঢেউ তুলছে। ক্ষণেক্ষণে রঙ বদলে যাচ্ছে তার মুখের। শরীরের অঙ্গভঙ্গি ও চলনেও এসেছে খানিকটা পরিবর্তন। সুপ্তি মাকে সালাম করে বের হয়। পেছন পেছন হাঁটে আসগর সাহেব। মেয়ের সামনে চলা যাবেনা। আসগর সাহেব সুপ্তিকে সবসময়ই অগ্রগামী রাখে। হঠাৎ সুপ্তির ফোন বেজে উঠল। সুপ্তি কল রিসিভ করল-
-হ্যাঁ, উপল ভাইয়া। হ্যাঁ, হ্যাঁ- আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। আরে না না। চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকঠাক সামলে নিতে পারবো, ভাইয়া। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, ভাইয়া।
আসগর সাহেব মেয়েকে রিক্সায় তুলে দিলেন। মেয়ে তার প্রেমিকের সাথে প্রথম দেখা করতে যাচ্ছে। বাবা হয়ে সকালে ভোরের ঘুম রেখে বেলিফুলের মালা কিনে আনা, মেয়েকে এগিয়ে দেয়া- এমন কাজ কি আর কোনো বাবা করেছে কিনা- আমার শতভাগ সন্দেহ আছে। আসলে আসগর সাহেব মেয়েকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেন। রিক্সায় উঠতে উঠতে আসিফের কল।
-আরে বাবা, আসছি তো। মাত্র দশ মিনিট অপেক্ষা করেই বিরক্ত! সারাজীবন সহ্য করবে কিভাবে?
-আসলে বিরক্ত না। বলতে পারো তোমাকে প্রথম দেখার উত্তেজনা। একটু তাড়াতাড়ি আসো। আর অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না।
-আসছি তো। আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো। ওকে জান, অপেক্ষা করো।
সুপ্তির রিক্সা ইনডেক্স প্লাজার সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকজনের চাপ কিছুটা কম আজ। শহরতলীর মার্কেট হলেও ইনডেক্স প্লাজা বেশ অভিজাত। রাশভারী মুখের জমিদারের মুড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রধান সড়কের পাশে। প্লাজার গেইটে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে দুটো ছেলে। সুপ্তিকে দেখছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত। বারবার দেখছে। সুপ্তির বুঝতে বাকি রইলো না। এদের একজন আসিফ। সুপ্তি আসিফকে ছাই রঙের পাঞ্জাবি পরতে বলেছিল। কিন্তু পরেনি সে। তাই একটু কষ্ট হলো চিনতে। এই আরকি! একটা ছেলে সুপ্তির দিকে আসলো।
-হাই, আর ইউ সুপ্তি? আ’ম আসিফ।
- ইয়া, আ’ম সুপ্তি।
সুপ্তির ঠোঁটে লাজুক হাসি। চোখটা নামিয়ে রাখে সে। আসিফ ডানহাত তার পেছন থেকে সামনে নিয়ে আসে। কয়েকটা লাল টকটকে গোলাপ। একদম তাজা। মনে হচ্ছে সবেমাত্র বাগান থেকে গোলাপগুলো তুলে আনা হয়েছে। সাথে একটা ছোট্ট গিফট বক্স। সুপ্তি হাত বাড়িয়ে নেয়।
-থ্যাংকস অ্যা লট। চলো ভেতরে গিয়ে বসি। আমার পরিচিত একটা রেস্টুরেন্ট আছে এখানে। অনেক জার্নি করে এসেছো।
-আরে না। আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না। আ’ম ওকে, ডিয়ার। চলো বাইরে ঘুরাঘুরি করি। তোমার শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখব।
-আচ্ছা। ঠিক আছে। চলো আগে কিছু খেয়ে বের হই। আমারও খিদে পেয়েছে।
-চলো।
ইনডেক্স প্লাজার ফোর্থ ফ্লোরে রেড চিলি একটা রেস্টুরেন্ট। বেশ নিরিবিলি। পরিপাটি পরিবেশ। খাবারের মানও বেশ ভালো। সুপ্তি, আসিফ ও আসিফের বন্ধু সাফিন রেস্টুরেন্টের পেছনের দিকটায় গিয়ে বসেছে। কয়েকজন বসে খাচ্ছে। সুপ্তি আঁড়চোখে কয়েকবার রেস্টুরেন্টে পরিচিত কেউ আছে কিনা দেখে নিল। কিছু খাবার অর্ডার করলো তারা। খাবার পরিবেশন করলো সুদর্শন একজন ওয়েটার। তিনজনে মিলে খাবারের সাথে টুকটাক আলাপও করছে। এখানকার খাবার একটু বেশিই সুস্বাদু। জিহ্বায় লেগে থাকে। খাওয়ার সময় আসিফ ও সুপ্তি একজন আরেকজনকে আড়চোখে দেখছে। বুঝা যাচ্ছে প্রথম দেখাতেই দু’জন দারুণভাবে রোমাঞ্চিত। আচমকা কিছু লোক সুপ্তিদেরকে ঘিরে ফেলে। আসিফ ও সাফিনের চোখেমুখে ভয়ানক আতঙ্ক। ডিবির পরিচয়পত্র দেখিয়ে সাদা পোশাকে কয়েকজন আসিফ ও সাফিনকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার, ওয়েটার, উপস্থিত খাদকেরা মুহূর্তের ঘটনায় ঝিম মেরে গেল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। উপলও সুপ্তিকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। নরসিংদী সদর থানার অভিমুখে সবাইকে নিয়ে গাড়ি ইমার্জেন্সি হর্ণ বাজিয়ে দ্রুতবেগে ছুটছে।
২.
সুপ্তি সবেমাত্র শায়ার ছেড়ে বের হয়েছে। এইদিকে সেই কখন থেকে আসগর সাহেব ও রুমিনা রহমান ড্রয়িংরুমে সুপ্তির জন্য অপেক্ষা করছে। আজকের সফল অভিযানের গল্পটা শোনার জন্য তারা অধীর আগ্রহে কান পেতে বসে আছেন। সুপ্তি মোবাইলে কথা বলতে বলতে ড্রয়িংরুমের দিকেই আসছে।
-জ্বী, জ্বী, উপল ভাইয়া। এখনই দেখাবে? আচ্ছা। আমি টিভির সামনেই আছি।
কোনোরকম প্রশ্ন না করেই আসগর সাহেব ও রুমিনা রহমানও টিভির স্ক্রিনের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমেনাও মুখ বাড়িয়ে দেখছে খবরটা। চ্যানেলে চ্যানেলে দেখাচ্ছে। শহরতলীর এক তরুণীর সাহসিকতার গল্প। টিভিতে দেখাচ্ছে সুচতুর আসিফ ও সাফিনকে। হাতকড়া পরা। পেছনে পুলিশের অভিযাত্রিক দল। প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে ঘটনার বিস্তারিত সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেছেন সদর থানার অফিসার ইনচার্জ উপল চন্দ্র আচার্য্য। এই সফল অভিযানের জন্য সুপ্তিকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন উপল। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে ‘সাহসিকা’ উপাধিও দিয়েছেন। গত বারোদিন আগে সুপ্তি তার বাসার কাজের বুয়া আমেনাকে সাথে নিয়ে থানায় গিয়েছিল। আমেনার সাথে ঘটা একটা ঘটনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে। একটা প্রতারক চক্র আমেনার কাছ থেকে কৌশলে বিকাশের মাধ্যমে বিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। অনেক কষ্টে তিলে তিলে জমানো তার চৌদ্দ হাজার টাকা এবং মুদি দোকানি রহিম মুন্সীর কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা ধার করে মোট বিশ হাজার টাকা প্রতারকদের নাম্বারে বিকাশ করেছে। বিকাশ করার কিছুক্ষণ পর আমেনা বুঝতে পারে সে লোভের ফাঁদে পা দিয়েছে। তার কান্নাকাটি আহাজারি শুনে সুপ্তি তাকে নিয়ে থানায় গিয়ে অভিযোগ নথিবদ্ধ করে। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে থানার প্রধানকর্তা উপল চন্দ্র আচার্য্য সুপ্তির কাছে সহযোগিতা চায়। পুলিশকর্তার পরিকল্পনা শুনে সুপ্তিও এই গোয়েন্দা অভিযানে সানন্দে রাজি হয়ে যায়। তারপর সুপ্তি আসিফকে প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে নেয়। আর সেই মায়ার জালেই আটক হয় দেশের কুখ্যাত প্রতারক চক্রের দুই সদস্য।
আসগর সাহেব সুপ্তির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কত্তো বড় হয়ে গেছে! তারপর ধীর পায়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে যান তিনি। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। অনেকক্ষণ। বিজয়ের এই আনন্দ পর্বে এসে যোগ দেন রতœগর্ভা মা রুমিনা রহমান।
সুপ্তি আমেনাকে ইশারায় কাছে ডাকে এবং ধমক দিয়ে বলে
-আর এমন বোকামি করবা না, আপু। তুমি খুব সহজ সরল। সাবধানে থেকো। আর এই নাও- এই খামে দশ হাজার টাকার আছে। পুলিশ সুপার স্যার এটা আমাকে সাহসিকতার জন্য পুরষ্কৃত করেছেন। তুমি এই টাকা থেকে রহিম মুন্সীর পাওনা টাকাটা দিয়ে দিবে। কেমন? বাকি টাকায় একটা ব্যাংকে জমা রাখবে।
আমেনা ডান হাতে টাকার খামটা লুফে নিলো। কোনো কথা না বলেই রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যায় আমেনা। কিছু দূর গিয়ে শাড়ির আঁচলটা টেনে সে দুই চোখ মুছে।
পলাশ,নরসিংদী।