দিনশেষে একটা মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারি; এটাই তৃপ্তি : মামুন বিশ্বাস
দিনশেষে একটা মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারি; এটাই তৃপ্তি...
-মামুন বিশ্বাস
সময়ের দুর্বার এক সাহসী যোদ্ধার নাম ‘মামুন বিশ্বাস’। সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান ‘মামুন বিশ্বাস’ ফেসবুকের মাধ্যমে গরীব-দুঃখী, অসহায়, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের কাছে প্রতিনিয়তি পৌছে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী । দিনরাত প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় অসহায় মানুষের অভাব মোচনের যে কঠিন ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন ‘মামুন বিশ্বাস’ সেটা সত্যি মানব ইতিহাসের এক বিরল উদাহরণ। তার এই মানবিক সেবা অব্যাহত থাকুক সারাজীবন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করে যেভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ‘মামুন বিশ্বাস’ সে বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন ‘সাপ্তাহিক ধানশালিক’ সম্পাদক ‘জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ’ ।
১.কেমন আছেন ভাইজান ?
মামুন বিশ্বাস : করোনা দুর্যোগের মধ্য আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি। সবাইকে ঈদ মোবারক।
২.দিনকাল কেমন যাচ্ছে ?
মামুন বিশ্বাস: আলহামদুলিল্লাহ ভাল। পুরো রমজানে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে যমুনার চরাঞ্চলের ছুটে চলেছি মানুষের ভ্যান গাড়ি, গরু, ছাগল সহ ঈদ খাদ্যসামগ্রী উপহার বিতরণ করার জন্য ।
৩.আপনি ফেসবুকের মাধ্যমে অসহায় মানুষদের সহায়তা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত । এই মানবিক সেবা কিভাবে এবং এর কবে থেকে শুরু করলেন ?
মামুন বিশ্বাস: ২০১৪ সালে আমার সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৩৮ ঘন্টা দুনিয়াতে বেঁচেছিল। এই ৩৮ ঘন্টায় ৪ টা হাসপাতালে নিয়েছিলাম তবুও সন্তানকে বাঁচাতে পারি নাই। সেই অর্থে সেদিন আমার পরিবারে টাকার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার ছেলেকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
আমার একমাত্র বড় বোন প্রতিবন্ধী ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বাবা-মা তাকে নিয়ে কত হাসপাতালে ছুটেছে চিকিৎসার জন্য । সেই অর্থে সেদিন আমার পরিবারে টাকার অভাব ছিল না।
আর যাদের টাকা নেই তাদের তো আরও কষ্ট। আমার এই কষ্ট থেকেই অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার কথা তখনই মাথায় আসে। তখন থেকেই ছুটে চলি অসহায় মানুষের জন্য কাজ করতে। দুনিয়াতে সব চাইতে কষ্ট তার যার প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। আর যাদের টাকা নেই তাদের তো আরও কষ্ট। সব কষ্ট থেকেই অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার কথা তখনই মাথায় আসে। তখন থেকেই ছুটে চলি ফেসবুকের মাধ্যমে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করতে।
পাশাপাশি ২০১২ সাল থেকে বন্যপ্রাণী জন্য গাছে গাছে মাটির কলস বেঁধে বাসা বানানো, আটক বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও মানুষকে সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছি।
৪.আপনি একা নাকি আপনার সাথে আরো কেউ আছে ?
মামুন বিশ্বাস : যখন আমি ফেসবুকের মাধ্যমে কাজ শুরু করি তখন পোস্ট দিলাম সাবেক শাহজাদপুর ইউ এন ও শামীম আহম্মেদ ও সাবেক এসিল্যান্ড আরিফুজ্জামান ব্যবস্থা করে দিতে সেই অসহায় মানুষদের পাশাপাশি ফেসবুকের বন্ধুদের পাঠানো টাকা দিয়ে চলতো প্রতিটি কাজ। ২০১৬ সালে জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত ইত্যাদি ‘ফেসবুকের ভিন্নতর ব্যবহার’ আমার একটি প্রতিবেদন প্রচার করে যা দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। এর পর দেশ-বিদেশের প্রত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচার হয়।
আমাদের প্রতিটি কাজে বাংলাদেশ ও প্রবাসী ভাই বোনেরা টাকা পাঠায়। প্রতিটি কাজের হিসাব ছবি আপডেট পোস্ট ফেসবুকে দেওয়া হয়।
আমার প্রতিটা কাজে ফেসবুক বন্ধুরা, সাংবাদিক ভাই/বোন, সরকারি কর্মকর্তারা অংশ গ্রহণ করে। আমি শুধু প্রতিটি কাজ মাধ্যম থেকে শেষ করি। আমি একা না লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালাবাসায় চলছে এই কাজ গুলো।
৫.এই এতদিন হলো মানবিক সেবায় নিয়জিত আছেন ? কোনো বাঁধা-বিপত্তি কিংবা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন কি কখনো ?
মামুন বিশ্বাস : ভাল কাজে বাধা আসবেই। প্রথমে অনেকেই আমাকে পাগল বলতো। যেমন কাউকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভতি করি তখন ঝামেলায় পরি ওই রোগির কেউ হাসপাতালে আসতে চায় না। আমি ও আমাদের স্বেচ্ছাসেবক বেশিভাগ হাসপাতালে থাকা লাগে। আবার যখন কোন আটক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করতে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়, যদিও উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী গুলো বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরের জমা দিয়ে দেই।
৬.এই মানবিক সেবা নিয়ে আপনার একান্ত ভালোলাগার কথা জানতে চাই !
মামুন বিশ্বাস: দিন শেষে একটা মানুষের মুখে যখন হাসি ফুটাতে পারি, একটা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করতে পারি, কিছু মানুষকে স্বাবলম্বী করতে পারি ও আটক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে মুক্ত আকাশে উড়াল দিতে পারে এটাই তৃপ্তি, এটাই ভাললাগা।
৭.এই আধুনিক সময় এবং আধুনিক মানুষ সম্পর্কে কিছু বলুন ।
মামুন বিশ্বাস : ভালো মানুষের কিন্তু অভাব নেই, কিন্তু বিশ্বস্ত মানুষের অভাব। আজ অবধি আমাদের কোন পোস্ট টাকা অভাব হয় নাই। আমি চেষ্টা করছি ফেসবুক দিয়ে ভাল কিছু করা যায় সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি। তবে করোনা দুর্যোগের সময় স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রাম অঞ্চলের যুবকরা গেমের নেশায় আসক্ত হচ্ছে। প্রতিটি বাবার নিকট অনুরোধ আপনার সন্তানের প্রতি খেয়াল করবেন ও ভাল কাজের সাপোর্ট দিবে। আমি বিশ্বাস করি পরিবারে সাপোর্ট পেলে অবশ্যই প্রতিটি মানুষ এই সমাজের জন্য ভাল কিছু করতে পারবে। আমাকে বাবা ও ভাইয়া আমাকে যে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য আজকে এত মানুষের কাছে যেতে পারছি। ধন্যবাদ ফেসবুক বন্ধুদের তাদের জন্য প্রতিটি কাজ শেষে সেই অসহায় মানুষ গুলোর মুখে হাসি ফুটাতে পারি।
৮.আপনার প্রিয় রং, প্রিয় পাখি, প্রিয় মানুষ এবং প্রিয় বাণী ?
মামুন বিশ্বাস : আমার প্রিয় রং কালো, প্রিয় পাখি ময়না, প্রিয় মানুষ আমার বাবা। আমি স্বপ্ন দেখি অসহায় মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জন্য সবাই এগিয়ে আসবে নিজেদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায়। জয় হবে মানবতা।
১০.আপনি এই সময়ের একজন দুর্বার সাহসী এক তরুণ। আর দেড় লক্ষ তারুণ্যের ভালোবাসার নাম ‘ধানশালিক’ । ধানশালিক নিয়ে কিছু বলুন মামুন ভাই ?
মামুন বিশ্বাস : ভালোবাসা ভালোলাগার প্রিয় ‘ধানশালিক’ যে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তারুণ্যের শক্তি ‘ধানশালিক’ দেশ-বিদেশে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। ধানশালিকের ভালো ভালো লেখায় ভালো কাজে অনুপ্রেরণায় পাবে সবাই। আশা করি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি আছে যারা ভালো কাজে যুক্ত এবং তাদের ভালোগুলো ধানশালিক বিশে^ও কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরবে ।
১১.সবশেষে ধানশালিকের পক্ষ থকে অনেক অনেক ভালোবাসা এবং শুভ কামনা ।
মামুন বিশ্বাস : ধানশালিকের জন্যও ভালোবাসা ।
বুমেরাং
বুমেরাং
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে ‘আমেরিকা’ মানে পৃথিবীর স্বর্গভূমি। প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে জীবনে একবার হলেও আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন থাকে। শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বের কেন, বলতে গেলে সারা পৃথিবী জুড়ে অগণিত মানুষ উন্নত জীবনযাপনের জন্য আমেরিকাতে আসতে চায়। কেউ বৈধ পথে আসে আবার কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করে। কেউ কেউ ভিজিট ভিসায় এসে অ্যাসাইলাম আবেদন করে থেকে যায়। আমেরিকাতে অবৈধভাবে বসবাসের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ নগরীর নাম নিউইয়র্ক সিটি। এখানে অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে পুলিশি তৎপরতা অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেকাংশেই কম। তাই অবৈধ অভিবাসীরা অনেকটাই নির্বিঘ্নে নিউইয়র্ক নগরী বসবাস করে।
আবুল কাশেম সাহেব আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে ভিজিট ভিসায় আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে আসেন। যখন তিনি এসেছিলেন, তখন তিনি তেত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। এখানে এসেই কাজে লেগে যান কিন্তু কিছুদিন যেতেই ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। তিনিও হয়ে যান এই নগরীর একজন অবৈধ অভিবাসীদের একজন। তখন তিনি একজন আইনজীবীর সহযোগিতা নিয়ে অ্যাসাইলাম আবেদন করেন। আইনজীবীর পরামর্শ মোতাবেক সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবুও বছরের পর বছর যায়, তিনি বৈধ হতে পারছেন না। গ্রিনকার্ড না থাকার কারণে দেশে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে।
আশায় আশায় পনেরোটা বছর কেটে গেল। তবুও স্বপ্নের গ্রিনকার্ড অধরাই থেকে গেল। অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করে বৈধ হওয়ার জন্য কোনো পাত্রী খুঁজে পাননি। নিজেকে খুব অভাগা মনে করতে লাগলেন। ঠিক তখনই উনার মনের আঙিনায় উঁকি দেয় কেইলি নামের কৃষ্ণবর্ণে এক গাইনিজ নারী। কাশেম সাহেব তখনও মরুর বুকে মরীচিকাই দেখছিলেন। তবুও চেষ্টা করে গেলেন। যদি কোনো ভাবে আমেরিকান নাগরিক কেইলিকে পটিয়ে বিয়ে করা যায়, তাহলে গ্রিনকার্ড যেন হাতের মুঠোয়। কেইলি ডিভোর্সি দুই পুত্র সন্তানের জননী। সে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে কাশেম সাহেবের আকুতি অগ্রাহ্য করতে পারেনি।
সুযোগ সন্ধানী কাশেম সাহেব নিয়মিতভাবে কেইলির বাসায় যাতায়াত শুরু করে। কেইলিকে পটানোর কিছুদিন পর তার দুই সন্তানদেরও পটিয়ে ফেলেন। একসময় তারা দুজনেই একসঙ্গে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। কাশেম সাহেব নিজের তল্পিতল্পা গুছিয়ে কেইলির বাসায় গিয়ে উঠেন। তখন তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিলে কেইলি অসম্মতি প্রকাশ করেন। চতুর কাশেম সাহেব তখন আপাতত বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে একসঙ্গে সুন্দর ভাবে বসবাসের ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেন। এভাবে বছরখানেক চলে গেল, আবারও বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কেইলি তখনও অসম্মতি প্রকাশ করে। এভাবে আরও একটা বছর কেটে গেল। তবুও বিয়ের ব্যাপারে কেইলির কোনো আগ্রহ নেই।
এবার বুদ্ধি করে কাশেম সাহেব একটা ফন্দি বের করলেন। তিনি একদিন কেইলিকে খুব ইমোশনাল হয়ে বললেন, ‘আমার বয়েস হয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি আমার সন্তানের মা হও, তবে এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হবে।’ কেইলি তখন রাজি হয়ে যায়। কিছুদিন যেতেই কেইলির গর্ভে কাশেম সাহেবের সন্তান আসে। দেখতে দেখতে একদিন কেইলির গর্ভে কাশেম সাহেবের একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। যদিও কাশেম সাহেবের মনে ভিন্ন ফন্দি কিন্তু বাইরে থেকে তিনি খুব খুশি দেখালেন। ইতিমধ্যে কাশেম সাহেবের উপর কেইলি অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাই কাশেম সাহেব আবার যখন বিয়ের প্রস্তাব দেন, কেইলি আর না করতে পারেনি।
কেইলিকে বিয়ে করার পর কাশেম সাহেব মাত্র আড়াই বছর তার সঙ্গে ছিলেন। উনার কাগজপত্র সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর গ্রিনকার্ড নিয়ে তিনি দীর্ঘ একুশ বছর পর বাংলাদেশে যান। দেশে প্রায় চার মাস থেকে নিউইয়র্কে ফিরে এসে তিনি কেইলির বাসায় ফিরে না গিয়ে অন্যত্র গিয়ে উঠেন। বাংলাদেশে যাওয়ার পর থেকে কেইলির সাথে তাঁর কোন যোগাযোগ নেই। একদিন তিনি কেইলিকে ফোন করে জানান কেইলির সাথে আর থাকবেন না। এতে কেইলি খুব কষ্ট পায় এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কদিন পরেই তিনি কেইলিকে আইনানুগভাবে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। কাশেম সাহেবের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে কেইলিও সবকিছু মেনে নেয়। একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে তাদের আইনানুগভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। কাশেম সাহেবের ছোট্ট মেয়েটি কেইলির কাছেই থেকে যায়। নিজের ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটির প্রতিও তিনি বিন্দুমাত্র টান অনুভব করেননি। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এবার তিনি মনস্থির করলেন দেশে গিয়ে খুব সুন্দরী এক তরুণীকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পারিবারিকভাবে দেশে পাত্রী দেখা শুরু হয়ে যায়। কাশেম সাহেব আবারও দেশে ফিরে নিজের পছন্দমত পঁচিশ বছর বয়সি এক সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে করলেন। তখন কাশেম সাহেবের বয়েস চুয়ান্ন বছর। অল্প বয়সি সুন্দরী বউ পেয়ে তিনি মনের আনন্দে আত্মহারা। নিউইয়র্ক ফিরে এসেই নতুন বউকে নিয়ে আসতে আবেদন করেন। প্রায় সতেরো মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রী ভিসা পেয়ে যান। যদিও এর মধ্যে তিনি দুবার দেশে গিয়ে ছিলেন। ইচ্ছে ছিল সন্তান নেওয়ার কিন্তু তার স্ত্রীর একটাই দাবি, নিউইয়র্কে যাওয়ার পর সন্তান নিবেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তাঁর সুন্দরী স্ত্রীর কথা ফেলতে পারেননি।
প্রবাদে একটি কথা আছে, ‘নিয়তি কাউকে ক্ষমা করে না।’ আসলেই হলো তাই। নিউইয়র্কে আসার মাস ছয়েক পর কাশেম সাহেবের স্ত্রী যেন ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। সে তাঁর কাজে ব্যস্ত এবং সংসার ও কাশেম সাহেবের প্রতি একদম উদাসীন। ফোনে প্রায় সময় ভিজি থাকে। যেকোনো বিষয়ে কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যায়। একদিন কাশেম সাহেব আবিষ্কার করেন, তাঁর স্ত্রী নিউইয়র্কে অ্যাসাইলামে বসবাসরত একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। সেই ছেলেটা তাঁর স্ত্রীর দূর্সম্পকের মামাতো ভাই। মাঝেমধ্যে সে কাশেম সাহেবের বাসায় আসে, যখন কাশেম সাহেব বাসায় থাকে না। যা হোক, এসব নিয়ে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে নিত্য কলহে জড়িয়ে পড়েন। একদিন রাগের মাথায় উত্তেজিত হয়ে স্ত্রীকে বেদম মারধর করে রক্তাক্ত করে দেন।
তখন তাঁর স্ত্রী ৯১১ নম্বরে কল দিলে পুলিশ এসে কাশেম সাহেবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এবং কাশেম সাহেবের স্ত্রীকে পুলিশ জানায়, তিনি যদি কাশেম সাহেবের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে না করেন, তাহলে আইনানুগভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তারা তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে। কাশেম সাহেব নিউইয়র্কে নতুন বউ নিয়ে মাত্র বছরখানে সংসার করতে পেরেছিলেন। ওই ঘটনার পর কাশেম সাহেবের স্ত্রী পুলিশের সহায়তায় ফ্যামিলি কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের আবেদন করেন। তারপর তিনি তাঁর ওই দূর্সম্পকের মামাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে উঠেন। কাশেম সাহেবের সাথে ডিভোর্স সম্পন্ন হয়ে গেলে তারা দুজনে বিয়ে করে নেন। প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সে কাশেম সাহেব উপলব্ধি করেন, কারো সাথে প্রতারণা করে কখনো নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না। নিয়তি বুমেরাং হয়ে আবার নিজের কাছেই ফিরে আসে।
কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা
অযাচিত উইল !
অযাচিত উইল
ইয়াকুব শাহরিয়ার
এখানে এসেও কুসুমকে পাবো সেটা ভাবিনি। খেলার মাঠে কোনোদিন দেখবো তো দূরে থাক্, কোনোদিন খেলার কথাও ওর মুখে শুনিনি। যাও শুনেছি দুএকবার, তাও ফুটবলের কথা। ফুটবল আমার প্রিয় খেলা নয়। আমার প্রিয় ক্রিকেট। ক্রিকেট কেনো প্রিয় তার শত কারণ বলতে পাবরো কিন্তু ফুটবল কেনো প্রিয় নয় সেটা বলতে পারবো না। তবে ফুটবলও দেখি। খেলি না। আমার দিকে এগিয়ে এসেই নিজের দেহের মতো নাদুস নুদুস প্রশ্ন। তুমি এখানে খেলা দেখছো? কবে এলে? কোন দলের সমর্থন করো? শেষ প্রশ্নের উত্তর দিলাম। বললাম বাংলাদেশ। তার বান্ধবি তানজিনা বললো- আমরা সবাই ইংল্যান্ডের সমর্থক।
ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ এ দলের খেলা চলছিল সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। আমাকে বললো- চলো কিছু খেয়ে আসি।
যাও, আমি যাবো না।
কেনো?
জানি না। খেলা দেখবো। খেলা দেখলে খাই না। একসাথে দুই কাজ করি না।
আমাদের সাথে বসবে?
হ্যাঁ, বসতে পারি। তবে মাত্রাতিরিক্ত কথা বলা যাবে না।
ওকে।
খেলা চলছে। কুসুম আমার কাছের চেয়ারে বসে খেলা দেখছে। তানজিনা আর রোজি গপাগপ পপকর্ন গিলছে। খেলায় বাংলাদেশের হয়ে ইমরুল কায়েছ সেঞ্চুরি করেছে। বাংলাদেশ খুব ভাল খেলেছে। আমার মন খুব ভাল। কুসুম আমার হাতে হাত রেখে খেলা দেখছে। আমি বার বার হাত সরিয়ে দিচ্ছি। আমার এলার্জি আছে। কুসুমকে ভালবাসি। কিন্তু এতো ঘেঁষাঘেঁষি পছন্দ করি না। বেকুব ছেলেরা এমন করে। মেয়েরাও বেকুব ছেলেদের তেমন পছন্দ করে না। কুসুম আমাকে চালাক করার চেষ্টা করে কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়। খেলা শেষে বাংলাদেশ জয়ী হওয়ায় তৃপ্তি সবার মুখে। কুসুম, তানজিনা আর রোজির মনেও আনন্দ। জানি না কেনো। একসাথে সিএনজি করে আসার প্রস্তাব নাখোশ করায় আমার প্রতি রাগ নিয়ে বাসায় চলে যায়।
আজ দুপুর তেমন দুপুরের মতো না। বৃদ্ধ দুপুর। সন্ধ্যার মতো সাজ সেজেছে। রিকশার হুড তোলে চৌহাট্টায় এসেই সেন্ট্রাল ফার্মেসীর সামনে আমাকে ডাক দিলো।
আমু। এদিকে আসো।
কুসুম আমাকে আমু বলেই ডাকে। আহমেদ মুনসুর আমার নাম। দুই নামের প্রথম দুই বর্ণ নিয়ে তৈরি করেছে শর্ট নেম। আমু। এগিয়ে গেলাম।
এখানে কি করো?
রিকশা গুনি।
অ।
আমার আজব কথায় কুসুম অবাক হয় না। কারণ পাঁচ বছর থেকেই সে আমাকে চেনে। এসব কথাবার্তায় সে অব্যস্ত হয়ে গেছে।
রিকশা থেকে নামতে নামতে বললো- কয়টা গুনলে?
হিসাব রাখি নি। ড্রাইভারদের কষ্ট দেখি। মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট দেখা অনেক কষ্টের। তাছাড়া এক সাথে দুই কাজ করা যায় না। তাই হিসাব বাদ দিয়েছি। মনমরা দিনেও তাদের ঘাম ঝড়ছে। তবু তারা কত শান্ত। বিনয়ী।
রিকশা ভাড়া দিচ্ছিল। নবাবরোড থেকে চৌহাট্টায় বিশ টাকা ভাড়া। বললাম আরো দশ টাকা দাও। দিয়ে দিলো। ও জানে রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের যে টাকা টিপ্স দেওয়ার কথা সেটা রিকশার ড্রাইভারকে দেওয়াই হচ্ছে আমার একটা শখ।
আমু, চলো কলেজে যাই।
না। আজকে শহিদ মিনারে যাবো।
কেনো?
শহিদ মিনারের সামনে এক পাগলী এক নতুন বাচ্ছার জন্ম দিয়েছে। তার বাবার নাম জানার চেষ্টা করছি। পত্রিকায় লিখবো।
কুসুম কিছুই বললো না। সামনে হাটতে হাটতে মালঞ্চের কাছে স্টেশনারীর দোকান থেকে একটি সবুজ রঙের কলম কিনে দিলো। বললো
লেখাটি এই কলম দিয়েই লিখো। আই এম প্রাউড অব ইউ।
আরেকটা রিকশা ডেকে চলে গেলো। হুড তুললো কি না খেয়াল করি নি। আমি শহিদ মিনারের দিকে হাটা শুরু করলাম।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ
পদাবলি : ০১
বিষাদ
মহাজিস মন্ডল
বিস্তর বিষাদ মেখেছি দুই হাতে
এক একটা রাতের ওপারে রাত
দিনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে দিন
অশ্বক্ষুরের শব্দেরা জমে যায় পাথরের মতো
আজকাল ছায়া দেখলেই পালাই
পায়ের ভারসাম্য রাখে না কোনও মাটি
শিকড়সহ উপড়ে আসে শুধুই
ডানাহীন মৃত্যুর যবনিকা
আশ্বিনে জলের টান
হাসান মাহমুদ
শরতের মাঝে ডুবে থাকে আশ্বিন। হঠাৎ করে দেখা যায় নদ-নদীতে জল থইথই
পানি নেই। জলপ্লাবনের রেশ নেই।
ভাটার টানে কমে যায় পানি। প্রকৃতির মাঝে শুকনো একটা রেশ কাজ করে।
আশ্বিনে দৃষ্টিজুড়ে পানিতে ভাসে
লাল শাদা শাপলা। হৃদয়ের প্রতিবিম্বেও ভেসে ওঠে যেন আশ্বিনের জল ফুরিয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই
মেঘ ভিড় করে আকাশে। ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি পড়ে আশ্বিনে হঠাৎ করেই।
আশ্বিনের মুগ্ধতার রেশ ধরে পড়ন্ত বেলায় বেরুলে চোখে পড়ে শিউলি আর শাদা শাদা কাশফুল। শাদাটে আকাশ
আর শাদা কাশফুল যেন প্রণয়ের মেলবন্ধন নিয়ে খেলা করে। ভাদ্র আর আশ্বিনের মাঝেই শরতের লুকিয়ে থাকা।
ঋাদ্র শরতের পূর্ণতা আরম্ভ করে আর আশ্বিন এসে তাতে পূর্ণতা মেলে দেয়।
পরিপূর্ণ করে তুলে আশ্বিন শরতরানিকে।
আশ্বিন অপূর্ণা শরতকেও পূর্ণতার রূপ পরিয়ে দেয় সজ্জিত রূপে। ভাদ্রের সাথে
শরতের মেলবন্ধন হওয়ার আগেই
আশ্বিনের আগমন বিচ্ছিন্ন করে দিতে
তৎপর হয়ে ওঠে—আর ভাদ্রের স্বপ্নকে
নিজের করেই গড়ে তুলে আশ্বিন।
তবে আশ্বিনের সে মধুপূর্ণতা বেশিক্ষণ থাকে না। ক্ষণিকের আগমন। ক্ষণিক পরেই আশ্বিনের প্রস্থান। আশ্বিনের
প্রস্থান দ্রুত হলেও আশ্বিন শরতের সুরভিতে জড়িয়ে নেয় আপন মনে—
শিউলির শিশির ফোঁটা, শাদা শাদা মেঘ,
শান্ত শীতল সরোবর, নদী, কাশফুল,
আর ভাদ্রের তালপাকা উষ্ণতা সব মিলিয়ে শরতের অপরূপ শোভা আর প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য মনে সত্যি
অপার মুগ্ধতা আনে। গরমের তীব্রতা
আশ্বিনে কমে আসে। মাঝে মাঝে
প্রকৃতি আশ্বিনে বিপর্যস্তও হয়।
ভাদ্রমাসে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, সেই
সাথে আর্দ্রতাও বাড়ে। যার ফলে
সহনীয় হয়ে যায় তাপমাত্রা। তীব্র গরমের ভাব আশ্বিনে অনেকটা কমে আসে।
নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
মাটির সিক্ততাও কমে যায়। বর্ষার নিরন্তর বর্ষণের ধারা শরতে এসে আর তেমন
দেখা যায় না। চারদিক ক্রমেই শুকোতে থাকে। একদিকে নদ-নদীর পানি কমতে থাকে, বৃষ্টির পরিমাণও কমতে থাকে।
আকাশের শাদা শাদা মেঘ আর শরতের ডাক প্রকৃতিকে আনন্দের হিল্লোল
বইয়ে দেয়। আশ্বিনের এই অপূর্ব রূপকে
সবাই যার যার মতো করে উপভোগ করতে পারে। গোলাপ, বকুল, শিউলি, কামিনী, মল্লিকা, মাধবী ফুলের সৌরভে
মুখরিত থাকে প্রকৃতি। বাতাসে শীতের
স্পর্শ লাগে আশ্বিনের প্রভাতে।
বিষাদপক্ষ
বঙ্কিমকুমার বর্মন
এই যে তুমি বিষাদ রেখে গেলে যেন গাঢ় মেধাবী বন। হাঁ-হুতাশ সূর্যের দহন চিত্রত মনে । কিছুতেই হাসিনা যেন, খুঁজে খুঁজে মরি কোথায় পড়ে আছে ঘাসে তোমার নাকফুল । ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উডড়ে চলে যায় কোন বনে তোমার অভাবে । শুনি একা একা শুকনো পাতার অক্ষম উড়ান । বসন্ত নেই গাছে , কিছু বুনোলতা মুছে দেয় বৃষ্টির ক্ষত । বিনিদ্র রাত্রির শেষে আলো পারাবার এই আশ্চর্য হৃদয় খোঁজে স্পর্শের কায়া। এখনো লেগে আছে আমার ঠোঁটে তোমার প্রতিভা ।
প্রত্যাবর্তনের গন্ধ
আহরাফ রবিন
যে দস্যি ছেলেটি লাটাই হাতে উড়ে গিয়েছিল আকাশে
আজ তার ফেরার পালা- আজ সে ফিরবে।
দিগন্তবিস্তৃত হলুদ সর্ষের মাঠ; মধুকরের অবাধ গুঞ্জন
যে সমস্ত মৌমাছিরা একদিন ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিল
আজ তার ফিরছে গুন্ গুন্ শব্দে।
নদীর ধারে চালতা তলায় যে নৌকোটি বাঁধা ছিল,
আজ সেই নৌকোটি আর বাঁধা নেই; নদীতে ভাসছে।
সময়ের পরিমাপ
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ
সময়ের হিসেব যোগ বিয়োগ গুণের অঙ্ক কষে পরিমাপ করাটা.. জ্ঞানীর
জ্ঞানের মানদন্ডে পড়ে না বরং বোকামী।
সময়ের কাজ সময়ে করে যাওয়া
ফাঁকির আশ্রয় অজুহাত দূরে ছুঁড়ে..
মনোবল সাহস একান্ত মন মননে..
সময়ের চুড়ান্ত ফলাফল। বৈ কিছু নয়।
শুদ্ধ ধ্যান-ধারণায় সামনে এগিয়ে যাওয়া
প্রকৃত জ্ঞানীর সোনালী অধ্যায়।
সময় বদল
সোহেল রানা
আমি যেদিন পৃথিবীর আলোয় চোখ খুললাম,
মায়ের জঠুর-ছিঁড়ে কান্না করছিলাম!
তার পরক্ষণেই ‘তাঁর, তাঁহাদের’ দৃষ্টির সিক্ততায়
আমি মুষ্টিবদ্ধ হাতে দৃঢ়প্রত্যয় আর সুখের হাসি হেসে
চোখ মুদে- সুখের বাগান রচনা করেছি!
যে সুখ আমার মায়ের শীতের শরীরে
ছড়িয়েছিল খুশির ফোয়ারা!
বাবার চোখেমুখে লেপ্টে এক-আকাশ উচ্ছ্বাস্!
এবং পরিবার-পরিজন সবাই সুখানুভূত ও সুখ আরোহীও;
তাঁদের দৃষ্টির উপশম আর হৃদয়স্থলে সমাদৃত আমি...
তারপর দিন গড়ালো, মাস, বছরও...
বছর থেকে বছরান্তে- আমি ছুটে বেড়িয়েছি
সেই সুখের উদ্যানে- পাখিডানা আকাশের পারে...
এবং আমার বাগানের আমি কলি হয়ে ফুটেছি!
কিন্তু মাস, বছর, দিনান্তে- কালের মহাপরিক্রমায়
সময়ের মেজাজে আসে বদল কিম্বা
অদৃষ্টের বিধানের ঘটন :
বাগানের সৌন্দর্যের পরিবর্তন!
এমনকি বাগান থেকেই ছিটকে পড়লো
বাগানের কলি!
মাটির জরায়ু-ছিঁড়া শীত!
পদাবলি : ০২
ইচ্ছেরা খুঁজে ফিরে
রফিকুল ইসলাম
ইচ্ছেরা খুঁজে ফিরে
যখন দুধমাখা চাঁদের রুপালি আলো
রাতে অদৃশ্য আঁধারে ঝরে ,
স্বপ্নগুলো নক্ষত্রের মত নিরন্তর জ্বলে
ইচ্ছেগুলো সাঁতরায় কল্পনার অসীম নীলে
আর, সুগন্ধ-স্মৃতির ফেনার সাগরে।
ইচ্ছেরা খুঁজে ফিরে
যেখানে দূরের পথ অদৃশ্য ধোঁয়াটে কুয়াশায়
উচ্ছ্বাসিত না বলা গল্পের ভীড়ে,
নীল দহনে বেলা-অবেলা সারাবেলা
পড়ন্তবেলা যখন পাখিরা ফিরে নীড়ে।
ইচ্ছেরা খুঁজে ফিরে
একগুচ্ছো স্বপ্ননদীর মায়াময় প্রহরে
যে নদী ডুবে গেছে সমুদ্র গভীরে,
যার বালুকায় সাধের ঝিনুক কুড়িয়েছিলে
কনক জোছনাতে হেঁটেছিলে অনেক দূরে।
আজও ইচ্ছেরা খুঁজে ফিরে ...
নিজেকে লুকিয়ে রাখি
মো. আরিফুল হাসান
নিজেকে লুকিয়ে রাখি মানুষের কাছে
অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে পাছে
সমাজের চোখ থেকে হয়েছি আড়াল
জীবন গহীনে বয়ে গম্ভীর বেগে
পড়ে আছি স্থিত হয়ে ধীর অনুরাগে
অজানা শঙ্কা এক দিচ্ছে উড়াল
আপন অলখপুরে দীপ জেলে যাই
কার আছে রূপ-সুধা কার রোশনাই
আছে কিবা না-ই আছে ভাবিনা এবার
ধীবর চক্রবালে, নিজ জালে ধরা খেলে
গোপন সখিরা আর কি যাতনা মেলে
ত্রাসের রাজত্বে রাজা অদ্ভুত আঁধার
দুঃখের স্বরের মতো দিনরাত অবিরত
যে বরষা স্মৃতিপাঠে এঁকে যায় ক্ষত
তার আছে নিপুনা দু’হাত
রথের কারিশমা দিয়ে, রংধনু রং পিয়ে
যথা সর্বস্ব নিয়ে, দেখে শুধু চেয়ে চেয়ে
মাছের মায়ের মতো করে অশ্রুপাত
হে বিদিশা, ওহে সুর, আপনভূবনপুর
আছে এক ঘনাবিষ্ট ঘন ঘোমঘোর
নিভে যায় চাঁদে চাঁদে জ্যোতি
তরাসে গগন সাজে, নির্জাত অভিলাজে
প্রীতির বন্ধন যেনো মৌন নাদে বাজে
শূন্য কলসি এক, নেই তার দ্যুতি।
আয়ু
ইয়াসিন আরাফাত
১
অনন্ত অনিদ্রা চোখে-
সবেগে দৌঁড়ে চলেছে একটি জন্মান্ধ ঘোড়া।
আজন্ম দেখিনি তারে, কেবল আওয়াজ শুনি।
চির দুর্নিবার গতি তার! থামে না কখনো।
খুড়ের আঘাতে দাঁত চেপে ধরে অনাবাদি মাটি!
গন্তব্যঃ একটি ঘর; অতলান্ত মৌলিক আঁধারে।
এই নূরানী উপমা হতে সাড়ে তিন হাত নিচে;
অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুটিয়ে কোনো রকমে শোবার মতো।
২.
সমুদয় প্রাপ্ত আবাদের আয়োজন নিয়ে
একদিনে তৈরি হয় একটি খড়ের গাদা
অতঃপর ইতরের নিত্য ক্ষুধা মেটাতে মেটাতে
ক্রমাগত লীন হয় উলম্ব গাদার দম্ভ।
অবশেষে একদিন ক্ষয়িষ্ণু যজ্ঞের গ্লানি নিয়ে
উপক্ষায় পড়ে থাকে নিষ্প্রাণ উলঙ্গ এক খুঁটি।
বিবসনা
শেখ একেএম জাকারিয়া
আমার দেহজুড়ে তোমার সৃষ্টির
গোপন তত্ত্ব প্রচ্ছন্ন আছে ঈশ্বর
অব্যক্ত আছে তোমার বংশজন্মের ইতিহাস
যদি আমায় বিবসনা করো
হাস্যপরিহাসে কিংবা অগোছালো সাজে
তবে আমায় পরমেশ্বরী বানিয়ে
অন্বেষনা করো না একটি দিনে
কালের সিঁদুরে আংটা পরাও
তোমার এমন কাট-খোট্টা
যাপিত জীবনে হাঁপিয়ে উঠি নিত
আমার পঞ্চবায় বেরিয়ে আসে
তোমার অপত্যের মা হওয়ার অভিশাপে!
শব্দমালা : মিসির হাসনাইন
শব্দমালা
মিসির হাছনাইন
শিরোনামহীন ০২
প্রিয় মানুষটা কত কাছাকাছি এই সময়ে
ইচ্ছে করলেই দু’চোখ ভরে দেখা যায়।
আর কত সময় গেলে আসবে এমন দিন
ইচ্ছে করলেই তাঁকে ছুঁতে পারবো
বলতে পারবো যা ইচ্ছা তাই, যখনতখন..!
চুপচাপ নিজের দুঃখ পুষে রাখো রবীন্দ্র সংগীত বিকেলে,
এসব সময়ে তুমি আমি কত ভালো থাকি,
তবুও, তোমার আমার দুঃখের শেষ নাই...।
একই অমাবস্যার নিচে জীবন কাটাই
তবুও, আমাদের দুঃখের শেষ নাই..
একই আকাশের মেঘে দুইজন ভিজে
উড়ে আসা বৃষ্টি গান গাই...।
প্রিয় মানুষটা কত কাছাকাছি এই সময়ে
ইচ্ছে করলেই নানান নামে ডেকে কথা বলা যায়
অথচ, তোমার আমার দুঃখের শেষ নাই..।
...ও রাখাল
একদা আকাশের চাঁদে একটা পাখি উড়ে গেল। মানুষ তখন অসভ্য, বিশাল আকৃতির মোটাতাজা কালো আফ্রিকান নিগ্রো মানুষ গরুর মতন হাঁটে বাজারে বন্দরে বিক্রি হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে কোন এক জঙ্গলে বাস করতো একদল মৃত্যু মানব। তাঁরা গরু বলি দিয়ে তাজা লাল রক্ত গায়ে মেখে মানুষ খুন করতো।
রাখাল দেখলো, চাঁদ থেকে উড়ে উড়ে একটা পাখি কয়েকটা গরু খেয়ে ফেললো। এই দৃশ্য দেখে রাখাল আকাশে উড়াল দিলো, তার পরেরদিন ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়, সে জানতো বিশ্ব সাহিত্যে এই খবরটুকু অজানাই থেকে যাবে...
গভীর রাতে
আমার ঘুম আসে না
তুমি ঘুমাইছো কিনা জানি না
কিছু সময় পর পর আকাশ গুড়–ম দেয়
মনে হয় সেসব বুকের ভেতর গুড়ুম নেয়
টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ রাত ঝালাপালা
শব্দ শুনি বুকের ভেতর কচি হাতের বালা।
শূন্য উঠানের কোলে মায়ের হাতে বোনা
নকশীকাঁথা নাকেমুখে জড়িয়ে দিন গোনা..
শেষ হোক জীবনের একা থাকার দিন
ভালোবেসে হাতের রেখা ঢেকে যাক মীন।
একজোড়া শালিক
একজোড়া শালিক
কে.এম. ওমর ফারুক
রাত যত গভীরের দিকে যেতে শুরু করে এই পরিবেশটার প্রতি আমার ততই ভালোলাগা বাড়তে থাকে। চারপাশে কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা, থমথমে অবস্থা। শব্দের মধ্যে; ঝিঁঝি পোকার ডাক এবং রুমের মধ্যে ছোট্ট পাখার ঘুরতে থাকার আওয়াজটা কানে আসে। আর মাঝেমধ্যে কোথা থেকে যেন আচমকা পাখির ডানা ঝাপটানো শব্দ ভেসে আসে, মনেহয় খুব কাছে কোথাও, কিন্তু দিনের বেলা শতো খোঁজাখুঁজি করেও তার হদিস মিলে না। এগুলো বাদে বাকিটা থমকে থাকে, মনেহয় পৃথিবীটাও সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এখন মনের সুখে ঘুমোচ্ছে। সারাদিন লোকজনের চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড় জাঁকজমক আওয়াজে মানসিকভাবে খুব নির্যাতিত হচ্ছি! কোনোকিছু ভাবতে গেলেই কোথা থেকে একটা অসহ্য শব্দ এসে হাজির হয় শেষে আর কিছু ভাবতেই পারি না, রাগ করে আর লেখাও হয় না। তাই এই সুযোগে আমার মনের মধ্যে শুধু বাক্যের ঝঙ্কার বাজতে থাকে। আগেকার দিনের বর্ষাকালে বিল-ঝিল,পুকুর, ডোবায় যেমন মাছে মাছে চারদিক কিলবিল করতো লোকজন কোনটা রেখে কোনটা ধরবে তার কোনো দিশা খুঁজে পাওয়া যেতো না। আমারও এই সময়টা তেমন একটা অবস্থা হয়। কিন্তু পরের দিনের কথা ভাবতেই আর লেখা হয়ে ওঠে না।
কাল আমার সারাদিন ফ্রি, তাই আজকের রাতটা বাক্যের সাথেই কাটাবো বলে ভাবছি। কিন্তু কী লিখবো তা ভাবতে ভাবতেই চোখের নজর গিয়ে জানালার ওপর পড়লো। মনে পড়ে গেলো সেই বন্ধুদের কথা। যারা নিত্যদিন আমার খোঁজ খবর নিতো। মনে পড়ে গেলো সেই কিচিরমিচির করে ডাকার ধ্বনি। ঠকঠক করে কাঁচের জানালাটা ঠোকরাচ্ছে আর আমাকে ডাকছে শুনছো?বন্ধু শুনছো আমাদের ডাক?
আরে ভোর হয়েছে এখনও কী ঘুমাতে হয়? বলি আজকে কী অফিসে যাবে না? নাকি বন্ধ?
কি হলো এখনও উঠো না কেনো! উঠো!!
ওদের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল কোনো এক শুক্রবার সকালে। তখন আমার অফিস বন্ধ ছিলো। শীতের সকাল। চারদিকে ঘন কুয়াশার জন্য দুই-তিন মিটার পরে গাছপালা, বাড়ি, গাড়ি ঠিক বোঝার উপায় নেই। উত্তরা ঠা-া হাওয়া শোঁশোঁ করে আসছে। ভোর ৬ টা ৭ টার দিকে কাঁচের জানালাটার খটখট শব্দ আমাকে ঘুম ভেঙে দেয়। প্রথমে একবার ঘুম থেকে জেগে জানালার কাছে যেতেই ভয়ে ওরা উড়ে যায়। অফিস বন্ধের কথা ভেবে আবার শুয়ে পড়ি, কিন্তু পুনরায় ঠকঠক শব্দ আর ঘুমাতে দিলো না। এবার জানালার কাছে গেলাম কিন্তু ওরা আর উড়ে গেলো না আস্তে আস্তে জানালা খুলে একটু ফাঁক করলাম তাও ওরা সরলো না, অথচ কিচিরমিচির করে সজোরে চেঁচামেচি শুরু করলো যেনো আমি কোনো অপরাধী আর ওরা আমাকে বকা দিচ্ছে! ওদের এই আচরণে আমি হতবাক হয়ে পড়লাম! কী ব্যাপার আমাকে দেখে যাদের ভয়ে পালানোর কথা অথচ না পালিয়ে উল্টো আমাকেই একগাদা কথা শোনায়! ভাবলাম ওদের মনেহয় অনেক ক্ষুধা পেয়েছে তাই একমুঠো ভাত এনে আস্তে করে জানালার ফাঁক দিয়ে ওই পাশে রাখতেই ওরা গাপুসগুপুস খেতে লাগলো। ওদের এরকম খাওয়া দেখে আমার অনেক মায়া লেগে গেলো। আরও একমুঠো ভাত এনে বললাম কিরে খুব ক্ষুধা পেয়েছে তাই না নে পেট ভরে খেয়ে নে। ওরাও পেটভরে খেয়ে চলে গেলো সেদিন আর এলো না।
পরেরদিন ঠিক একই সময়ে আবার জানালার কাঁচের গ্লাসে ঠকঠক শব্দ। জানালার ওপর এতই ঠোকাচ্ছিলো যে ঘুম থেকে না উঠে আর পারলাম না। উঠেই জানালা খুলে দিলাম। খুলতেই ওরা কিচিরমিচির চেঁচামেচি শুরু করলো। ওদের এ ভাষা যেনো আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। ওরা বলছে; গতকালের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ তোমাকে গতকাল না বলেই চলে গেছিলাম কারণ আমাদের বাচ্চারা ক্ষুধার্ত ছিলো। আমি বিস্মিত হয়ে ওদের দিকে চেয়ে ভাবলাম মাত্র দুমুঠো ভাতের কারণে আমি ওদের কাছে এতো প্রিয় হয়ে গেলাম যে ওরা আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এলো! জীবনে কত মানুষকেই তো কতকিছু দিলাম ক'জনেই বা এলো সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকু জানাতে! তারা তো মানুষ, তাদের কত বুদ্ধি,বিবেক,আত্মসংযম দিয়ে গড়েছেন মহান আল্লাহ। অথচ তাদের থেকে কতই না উপরে স্থান নিলো এই পাখি দুটি। আমি পাতিল থেকে দুমুঠো ভাত এনে দিলাম। বললাম নে খেয়ে নে তোরা। ওরা খেতে লাগলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম; তোদের কয়টা বাচ্চারে?
খেতে খেতে বললো; ৪ টা।
আচ্ছা ওদের আগে কী খাওয়াতিস? খাবার কোথা থেকে আনতি?
আগে খাওয়াতে হতো না, তিনদিন হলো ফুটলো। দুজনে এখান সেখান থেকে খেয়ে নিতাম।
দুপুরে কী খাওয়াস?
এগুলোই কোনোমতে সারাদিন চলে।
ওহ্! আচ্ছা তাইলে তোরা দুপুর ১ টার দিকে আসিস কেমন? তখন আমি অফিস থেকে দুপুরের খাবার খেতে আসি।
আচ্ছা, তুমি বুঝি চাকরি করো?
হ্যাঁ।
তাহলে আমরা এখন যাই বন্ধু বাচ্চারা অনেক ক্ষুধার্ত এই বলে চলে গেলো।
আমি একটু জোরে বললাম; দুপুরে একবার আসিস কিন্তু।
যেতে যেতে বললো; আচ্ছা বন্ধু।
ঘড়ির সময় দেখতে গিয়ে দেখি এখনও অনেক সময় আছে অফিসে যেতে তাড়াহুড়ো করতে হবে না।আগে যেমন ঘুম থেকে উঠতাম তাতে প্রায় দিনেই না খেয়ে যেতে হতো নইলে দেরি হয়ে যাবে তাই।ওদের কারণে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে তো পারি এই ভেবে অনেক ভালো লাগলো।
দুপুরে বাসায় গিয়ে ওদের দেখতে পেলাম না। আশেপাশে খুঁজলাম কিন্তু কোথাও দেখা মিললো না।
পরেরদিন আবার জানালার কাঁচের গ্লাসে ঠকঠক শব্দ। ঠকঠক করে কাঁচের জানালাটা ঠোকরাচ্ছে আর আমাকে ডাকছে শুনছো?বন্ধু শুনছো আমাদের ডাক?
আরে ভোর হয়েছে এখনও কী ঘুমাতে হয়? বলি আজকে কী অফিসে যাবে না? নাকি বন্ধ?
কি হলো এখনও উঠো না কেনো! উঠো!! আমি ঘুম থেকে উঠে ওদের জিজ্ঞেস করলাম; কিরে তোদের কত করে বললাম দুপুরে আসিস তা এলি না কেনো?
বললো আর বলো না বন্ধু আমাদের দুটি বাচ্চা খেয়ে ফেলেছে একটা হুলোবেড়াল এসে! (বলেই দুজনে কাঁদতে শুরু করলো)
কী বলিস!
হ্যাঁ গতকাল আমরা আসবো এমন সময়ে দেখি একটা হুলোবেড়াল গাছ বেয়ে উঠছে আমরা দুজনে দুটো ছানা নিয়ে পালালাম আর দুটো খেয়ে ফেলেছে শয়তান বেড়ালটা! এজন্যই আসতে পারিনি,যখন এসেছি তখন তোমাকে পাইনি।
তোদের বাসা কোথায় ছিলো?
-এই বাঁশ বাগানের ওইপাশে একটা মোটা নিমগাছে।
তো এখন কোথায় থাকিস?
-ওখানেই ছিলাম আজকে নতুন জায়গায় বাসা বাঁধবো।
আচ্ছা তোরা এই বাঁশ বাগানের ওই উঁচু বাঁশঝাড়টা দেখতে পাচ্ছিস?
-হ্যাঁ
ওখানেই উঁচুতে বাসা বানা তাহলে তোদের পাত্তা পাবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
শোন, আজ থেকে বেশি করে খাবার দিবো তোরা পেটপুরে খেয়েদেয়ে যখন ইচ্ছা এসে নিয়ে যাবি।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
এরকম করে কিছুদিন চলার পরে হঠাৎ একদিন ওরা ছানা দুটোকেও সাথে নিয়ে আসে। ছানা দুটো খেয়েদেয়ে বেশ মোটাতাজা হয়েছে। বয়স আন্দাজে অনেক বড়ই দেখা যায়। তেমন ভালোভাবে উড়তে পারে না। পড়ে যায় যায় এমন একটা অবস্থা। ছানা দুটো আমাকে দেখেই এমনভাবে চেঁচামেচি শুরু করছে মনেহয় আমাকে ওরা হাজার বছর ধরে চেনে। পরক্ষণে ওদের মা-বাবা বলে উঠলো; ওরা তোমাকে চেনে আমরা তোমার সম্বন্ধে সবসবময়ই ওদের সাথে গল্প করি। ছানা দুটো বললো; আপনার সম্বন্ধে আব্বু-আম্মু সবসময়ই আমাদের সাথে গল্প করে। তাদের মুখে সবসময়ই আপনার সুনাম থাকে। তারা বলে আমরা সারাজীবন জেনে আসছি মানুষ এক হিংস্র জাত। এরা সবসময়ই আমাদের উপর হিংস্রতা দেখায়। আমাদের গোশত খাবার জন্য, আমাদের মারার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। ওদের জন্য কোথাও শান্তিমতো থাকতে পারি না। অথচ আমরা এমন একজন মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি যার ব্যবহারে বোঝা যায় আসলে মানুষকে কেনো আল্লাহ তাআ’লা শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনোনীত করেছে। মানুষটা চাইলে আমাদের খাঁচায় বন্দী করতে পারতো,মারতে পারতো,আমাদের জবাই করে রান্না করতে পারতো। অথচ সে তা না করে আমাদের সাথে উল্টো বন্ধুত্ব করেছে,সাহায্য সহযোগিতা করে, আমাদের খাবার দেয়,কতোই না যতœ করে। তার এই ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারবো না। প্রতিদিন তাদের মুখে আপনার এতো প্রশংসা দেখে আমরা আগেই আসতে চেয়েছিলাম একনজর দেখার জন্য। যদি আগে উড়তে পারতাম তাহলে আগেই দেখতে চলে আসতাম। আমি ওদের মুখের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইলাম আর সব কথাগুলো শুনলাম। ওদের কিছু বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কোনো পাখির মনে ঠাঁই পাওয়া একটু-আধটু সুখের কথা না। এর চেয়ে বড়ো সুখ আর কী হতে পারে!
শুধু বললাম; শোনো সোনামণিরা মানুষ কখনও খারাপ হয় না, হিং¯্র হয় না, যারা এরূপ তারা অমানুষ। চেহারা যতই মানুষের হোকনা কেনো মনুষ্যত্ব বোধ ছাড়া কখনও সে মানুষ হতে পারবে না। মানুষের কাজই জীবকে সেবা করা। আমি তোমাদের সেবা করাতেই সুখ পেয়েছি,বন্ধু পেয়েছি,সকালবেলা ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে অফিসে যেতে পেরেছি, আমার একাকিত্ব অনুভব দূর করতে পেরেছি। বলো তোমাদেরও কি কম কৃতিত্ব আছে? তোমরাও তো আমার অনেক উপকার করলে।
কিছুদিন পর বিশ্বের চারদিকে শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ‘করোনা ভাইরাস’। চারদিকে হইচই পড়ে গেলো। ভয়ে সবাই জড়সড়! বাঙলাদেশেও ছড়িয়ে পড়লো এ মরণঘাতী ভাইরাস। ঘোষণা করা হলো দোকানপাট,অফিস-আদালত,যানবাহন, স্কুল-কলেজ সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সবাইকে ঘরে থাকার জন্য বলা হলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা কিছু লোক থেকে গেলো বাকি সবার একটাই কথা মরবো যখন বাড়ি গিয়ে মরবো এখানে মরলে লাশটাও দেখার কেউ নাই। আমিও চলে গেলাম। মহামারি ধাই ধাই করে বাড়তেই থাকলো কমার কোনো নাম নাই। এদিকে টাকা-পয়সা সব শেষ করে আরও ঋণ করে ফেলেছি। এখন আর জীবন চলে না। এদিকে অফিসও খোলার অনুমতি দিলো সরকার। করোনার মধ্যে অফিস খুললো প্রায় দেড়-দুইমাস পরে। পেটের দায়ে পরিবার বাঁচাতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে আবার ঢাকায় আসতে বাধ্য হলাম। এসেই খুঁজতে শুরু করলাম ওদের। সকাল গেলো সন্ধ্যা এলো কিন্তু কোথাও ওদের পাত্তা পেলাম না। ছুটে গেলাম বাঁশ বাগানে বাসা খুঁজতে কিন্তু বাসাটাও আর পেলাম না। চারিদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও ওদের হদিস পেলাম না।
প্রায় ভুলেই গেছিলাম শালিক জোড়ার কথা। একদিন দুপুরে লাঞ্চ করতে এসে হঠাৎ করে দেখতে পেলাম একটা শালিক ডিশের তারের ওপর বসে আছে। আমায় দেখতে পেয়েই এমন চেঁচামেচি শুরু করলো মনেহয় অমূল্য এক হারানো ধন ফিরে পেলো।
জিজ্ঞেস করলাম; তোর সাথের আরেকটা কই? আজ একা এলি যে? এতোদিন কই ছিলি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও পেলাম না যে? দেখতে পেলাম ওর দু-চোখে অশ্রু টলটল করছে। আমি আরও বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিরে কিছু বলোস না কেনো!
-ও বললো, আমার সব শেষ হয়ে গেলো।
কী! সব শেষ হয়ে গেলো মানে?
-হ্যাঁ, আমরা দুদিন তোমার এখানে এসে তোমাকে পাইনি তার পরেরদিনই এক ভয়ঙ্কর ঝড়ে আমার বাসা উড়িয়ে নিয়ে যায়। বাসার সাথে বাচ্চাদেরও নিয়ে যায়, কোথায় যে নিয়ে গেলো তার কোনো সন্ধান আজও পর্যন্ত মিললো না। আমি কোনোমতে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, আর স্বামী আসতে গিয়ে বাঁশের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায়। তার একদিন পরেই সে মারা যায়।
ওর কথা শুনে আমার গা শিউরে ওঠে! ওদের জন্য খুব মায়া হয়।আহা কত সুন্দরই না ছিলো ছানা দুটো! কতো সুন্দরই না ছিলো ওর স্বামীটা! নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে গেলো। বুকের ভেতরটা খা খা করতে লাগলো। মনেহলো যেনো আমি আপন কোনো মানুষকে হারিয়েছি। মানুষই তো! এদের তো কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষের চেয়েও অধিক জ্ঞান। মানুষ যদি মনুষ্যত্বের অভাবে অমানুষ হয় তাহলে এরা কেনো বিবেকবান হয়ে অমানুষে থেকে যাবে? এরাও মানুষ।
আচ্ছা তাহলে তুই কই ছিলি এতোদিন? তোকে তো পেলাম না!
-আমি বাসা বেঁধেছি এই শহর থেকে দূরে বহুদূরে একটা বিশাল বড়ো গাছে। সেখানে চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। ঝড়-তুফান হলেও ঝুঁকি কম। তোমার কথা অনেক মনে পড়লো তাই দেখতে এলাম। এর আগেও কয়েকবার এসেছিলাম পাইনি। আচ্ছা বন্ধু এখন তাহলে বিদায়, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, আমার আবার ফিরতে হবে, ভালো থেকো বন্ধু। (যেতে যেতে বললো) আমিও চিৎকার করে বললাম আবার আসিস বন্ধু, নিজের খেয়াল রাখিস।