কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন

কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন


কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন
সাদিক আল আমিন

এক.

আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার পারিপার্শ্বিক জগৎ জেগে ওঠে। নিত্যকার মতো অফিস যায়, জ্যামে পড়ে, শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরে। যখন আমি ঘুমিয়ে থাকি, অবচেতনে কর্মরত আমার পারিপার্শ্বিক জগৎকে স্বপ্নে দেখি। ওরা শুধু একজন বা কয়েকজন নয়, হাজার হাজার জন। হাজার হাজারটা স্বপ্নের আদলে গড়ে ওঠে তারা। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম যখন আমি ঘুমোতে শিখি, জন্মের প্রথম দিনে মায়ের কোলে ঘুমিয়েছিলাম যেদিন, তখন থেকে আমার পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তু কিংবা ব্যক্তিসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তবে এ জগৎ আমি ব্যতীত অন্য সাধারণ মানুষজন নয়, অর্থাৎ সাধারণ পরিবেশে বসবাসরত ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তারা নিরস্তিত্ব। কেবল আমার অবচেতন কিংবা অচেতন মনেই তারা বিদ্যমান; যার অনুভব কেবল আমিই টের পাই।
এখন আমার বয়স ৩০ চলছে। বেসরকারি একটা কোম্পানিতে কাজ করি। ৩০ বছর বয়স মানে ১০৯৫০ দিন। গণনানুসারে আমার দশ হাজার নয়শত পঞ্চাশটি পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তু বা পদার্থ কিংবা ব্যক্তি থাকা উচিত। কেননা, নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন ঘুমোনোর ফলে এক এক করে বহিঃজগৎ সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু না, আমার ততোগুলো নেই। আমার সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেকের মতো হবে। অনেক রাত গেছে, আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। এরকম অনেক রাত হয়তো আমাকে জাগিয়ে রেখেছে, নয়তো আমি রাতকে জাগিয়ে রেখেছি; নিজের মতো করে উপভোগ করেছি। ডিটেকটিভ বই পড়ে, রঙ চা আর কফি উইথ ব্রাউনির সাথে ওয়েস্টার্ন মুভি দেখে সময় কাটিয়েছি। কারণ আমি আমার পারিপার্শ্বিক জগৎকে বাড়তে দিতে চাইনা। এর কারণ মূলত দুটো-

১.
আপনার পারিপার্শ্বিক জগৎ যখন আপনার মনোজাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি মাত্রায় বেড়ে উঠবে, তখন আপনি ক্রমশ বুড়ো হতে থাকবেন। মৃত্যুর কাছাকাছি গড়াবে আপনার আয়ু।
২.
ঘুমোনোর মাধ্যমে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতার প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হওয়ার ফলে আপনার পরাবাস্তববাদের প্রতি তিক্ততা এসে যাবে। তখন আপনার কন্সাস মাইন্ড সাবকন্সাস মাইন্ড থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইবে। ফলত আপনার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে। দার্শনিক অর্থেই হোক কিংবা প্রকৃত অর্থেই হোক, স্বপ্নমৃত্যু ঘটা মানুষ বেশিদিন টিকতে পারেনা।


এই কারণ দু’টোর কথা স্মরণে আমি আমার বহিঃজগৎকে আয়ত্বে রেখেছি। কারণ আমি জানি বাহ্যিকজগৎ অন্তঃজগতের চাইতে বেড়ে উঠলেই খসে পড়ে আত্মা। আপনাদের হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারে যে, যেহেতু ঘুমোনোর ফলে অবচেতনে দেখা যে জগৎটা বেড়ে ওঠে তাকে অন্তঃজগৎ বা মনোজগৎ বললাম না কেন? কেন-ই বা বহিঃজগৎ বললাম যেখানে বহিঃজগৎ বলতে আমরা শুধুমাত্র বাস ট্রাকে ভরা যান্ত্রিকীয় জগৎকে বুঝে থাকি! এর উত্তরটাও অনেক সহজ। ধরুন আপনার বাবা-মা কিংবা অতিপ্রিয় েেকউ আজ মারা গেলো। সেই মৃত্যু ঠেকানোর সাধ্য কিন্তু আপনার নেই। এটা কিন্তু বহিঃজগতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। পক্ষান্তরে যদি মনোজগৎকে বাহ্যিক জগতের স্থান দিতেন, তবে যা ঘটতো সবকিছু হতো অবচেতনে। বান্তবে এর কোনো বিরুপ প্রভাব ফেলতো না...।
সুতরাং তত্ত্বানুসারে অন্তঃজাগতিক বাস্তবতার চাইতে বহিঃজাগতিক কল্পনার মাত্রা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মৃত্যুসময় ঘনাতে থাকে।যেমন পুষ্টতার চাইতে রুক্ষতা বেশি হলে ঝড়ে পড়ে পাতা। ঠিক তেমনি একদিন, পক্ষান্তরে বহুদিনের রুক্ষ এক পাতার মতো ঝড়ে পড়েছিলো মেয়েটা। এক কুয়াশাভোরে হঠাৎ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করে সে। আমি তখনো ঘুমিয়ে ছিলাম মেঝেতে। শীতের রাত ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে কাটাতে আমার পছন্দ ছিলো। আট বছর আগের ঘটনা। তখন আমার বয়স বাইশ। আমার ঘুম ভাঙালো একটা বুনো মেষের উৎকণ্ঠা। দরজায় এসে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারছে আর যেন চিৎকার করে বলছে, ‘হে মানব ওঠো, তোমার প্রতিবেশী মানবী কিছুক্ষণ হলো মারা গেছে। তাকে এখন নিয়ে যাওয়া হবে নো ম্যানস ল্যান্ডে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে চাইলে ওঠো।’ আমি যেন মেষটির কথা শুনতে পেলাম! ঘুম ভেঙে গেল। দরোজা খুলে দেখলাম ঠিকই একটা মেষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে নির্বাক চেয়ে। বাইরে বেশ তুষারপাত হচ্ছে। হালকা একটু কুয়াশা। সেই কুয়াশার মধ্যে দেখলাম, ওবাড়ির লোকজন সবাই গ্রেভ ইয়ার্ডে যাবার আয়োজন করছে। কালো কফিনের বাক্সে ভরে রেখেছে মেয়েটাকে। সেই মেয়েটা, কাল রাত্রে যে আমাকে এক বোয়াম কফিবিন দিয়ে গেলো। বলে গেলো, ‘সকালে একমগ হাতে নিয়ে বেরোবেন। ঝিরঝিরে তুষারপাতে দারুণ খেতে লাগবে...।

দুই.
আমি তৈরি হয়ে নিলাম মেয়েটার গ্রেভে যাওয়ার জন্য। শোকাভাব প্রকাশ করার জন্য পরলাম ব্ল্যাক স্যুট। যাবার পথে রাস্তারদোকান থেকে একতোড়া অর্কিড কিনলাম। যেতে যেতে ভাবলাম, ওর বহিঃজগৎ কি অন্তঃজগতের চাইতে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছিলো? অথবা কি তার স্বপ্ন দেখা নির্দিষ্টতার সীমা ছাড়িয়েছিল! যার কারণে নিঃস্বপ্ন হয়ে হঠাৎ মেয়েটাকে দুটো জগৎ ছেড়েই চলেযেতে হয়েছে...!
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হলে তার টম্বের উপর ফুলগুলো রেখে দিলাম। আর বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তার মৃত্যুর কারণ; কি হয়েছিলো তার! নিউমোনিয়া বা এজাতীয় কিছু রোগ কি ছিল! নাকি সব পারস্পরিক জগতের কারবার! ভুক্তভোগী ছিল নাকি সুবিধাভোগী! শিকারি ছিলো নাকি ছিলো শিকার! ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে চলে আসছি, এমন সময় মনে হলো সেই মেয়েটা যেন কথা বলছে পেছন থেকে, ‘কফি কিন্তু প্রতিদিন খাবেন। বিশেষত খাবেন রাতে। জেগে থাকবেন। আমাকে ভুলবেন না’।  পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সব নিস্তব্ধ, নিশ্চল। মেয়েটা সেদিন কেন মরেছিল সে রহস্য বের করতে আমি দুটো বছর নষ্ট করি। সে দু’বছর আমি একদম ঘুমোইনি। তার মৃত্যুর কোনো কারণও আমি দেখিনা। কারণ মেয়েটা কখনো ঘুমোতো বলে মনে হয়না। তার ঘরের রাতজাগা ল্যাম্পের আলো আমার জানালায় এসে পড়তো। এছাড়াও যেদিন রাতে সে কফি দিতে এলো, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কালসিটে ছায়ায় ঢেকে ছিল চোখ; ব্যাপক ডার্ক সার্কেল। এর অর্থ দাঁড়ায় মেয়েটা অনেকদিন ঘুমোয়নি। অথচ পারিপার্শ্বিক জগৎকে অপ্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও ওর আত্মা খসে পড়লো কেন? পরিবারের সংশ্লিষ্ট লোকদের থেকে অবগত হলাম তার কোনো অসুখও ছিলোনা। আর তাকে মনে রাখারও বা কি আছে! তার সাথে তো আমার কোনো প্রণয় ছিলোনা কোনোদিন!

তারপরের চারবছর আমার ঘুম ছিল খুব সামান্য। চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র এক কি দু’ঘণ্টা ঘুমোতাম। মনে হতো যেন এক অদ্ভুত বাহ্যিক জগতের আশ্রয়ে বেঁচে আছি। পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে সেসব অনুভবের চেষ্টা করতাম। কখনো মনে হতো সবকিছু বস্তুসদৃশ নির্জীব; আবার কখনো মনে হতো যেন অলৌকিক কিছু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি! কিন্তু কোনোভাবেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না যে আমার আবিষ্কৃত দুটো তত্ত্ব মেয়েটির ক্ষেত্রে মিললো না কেন! সুতরাং সিদ্ধান্তক্রমে এটা কি বলা যেতে পারে যে, বহিঃজগত অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে মনঃজগত আবার নতুন করে সৃষ্টি হয়! পূর্বরুপ ডালপালা ছড়িয়ে আবার পারিপার্শ্বিক জগতের চেয়ে বড় হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে! এটাকে যদি তৃতীয় তত্ত্ব ধরি, তবে সবগুলো তত্ত্বের একটিই পরিণতি; সব তত্ত্ব সমান ক্রমধারা মেনে অবশেষে এক অনন্য পরিণতিতে পরিণত হয়; এবং তা হলো মৃত্যু। মৃত্যু উপলব্ধি করার পর থেকে আমি একদিন জেগে থাকি, একদিন ঘুমোই। কেননা এর অন্তিম পরিণতিও হয়তো মৃত্যুই হবে। যদি হয়, তবে এটা আমার আবিষ্কৃত চতুর্থ তত্ত্ব হবে। যদি না হয়, তবে অমরণশীলতার এক সফল তত্ত্ব হিসেবে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সফল হবার কারণ হতে পারে আয়ুবৃদ্ধির সাম্যাবস্থা। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক জগৎ ও অন্তঃজগৎ সর্বদাই ধ্রুব থাকছে।
চতুর্থ তত্ত্ব আবিষ্কারের পর থেকে মেয়েটার দেয়া বোয়ামের কফিবিন দু’চামচ করে গরম পানিতে মিশিয়ে এক দিন অন্তর অন্তর রাতের বেলা খাই। মেয়েটা মারা যাবার আট বছর হলো। আশ্চর্যজনকভাবে তার দেয়া সেই একবোয়াম কফি এখনো ফুরোয়নি।

গল্প- পথের বাগড়া

গল্প- পথের বাগড়া


পথের বাগড়া
শাদমান শাহিদ


     কারওয়ান বাজারের সবকটা বস্তিকে একে একে পেছনে ফেলে ট্রেনের গতি তখন প্রায় পূর্ণমাত্রা। যাত্রীদের বিরস কোলাহল আর গিজগিজে ভিড়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি চোখটাকে বাইরে সারিবদ্ধ বস্তিদর্শন থেকে সরিয়ে তারই পাশে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা বিচিত্র কাঠামোয় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন দালানগুলোর দিকে ফিরিয়ে নেন। সেখানে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন কোম্পানির রুচিবোধ শৈল্পিক দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, নগরায়নে এমন নান্দনিক সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা দশ-বারো বছর আগেও ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের মাথায় আসে নাই। অথচ এখন...
     ঢাকা শহরের দ্রুত উন্নয়নের বিষয়টা নিয়ে এভাবে ভাবতেই বুক ফুলিয়ে একটা তৃপ্তিকর শ্বাস বেরিয়ে যায়। ‘যাক, শেষ পর্যন্ত এই শহরে আমারও একটা ঠিকানা হলো। ধন্যবাদ সরকারকে। সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ফ্ল্যাট-বাসা বরাদ্দ না দিতো, অজপাড়া গাঁর একজন স্কুলশিক্ষকের পক্ষে এই শহরে ফ্ল্যাট-বাসা, কল্পনা করা যায়!’ ভাবতে গিয়ে টের পান আরও একটা তৃপ্তিকর ঢেউ বুকের ভেতর ইতি-উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন দৃষ্টিটাকে বাইর থেকে ধরে এনে ফাইলবদ্ধ কাগজগুলোয় ছেড়ে দেন। শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের সনদ। ওটাতে তাকালেই সব সময় মোটা কালিতে লেখা নিজের নামটা আগে নজরে আসে। গর্বিত নাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল হাসান। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা নামও মনের ভেতর উঁকি মেরে যায়। গ্রুপ কমান্ডার জসিম উদ্দিন। তিনিই তাকে যুদ্ধে নিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনি যখন মহকুমা সদর দখলে নিয়ে আশ-পাশের গ্রামগুলোয় আগুন জ্বালাতে শুরু করে দিলো, তখনই এক অন্ধকার রাতে ঘরে এসে বলেছিলেন, আবুল, লও নাম লেখাইয়া ইন্ডিয়া যাই। ট্রেনিং ছাড়া বন্দুক ধরন যাইবো না।
    তারপর কত ঘটনা। কত স্মৃতি। সবই আজ বিস্মৃতির অতলে...
    বছর তিনেক হয় জসিম ভাই মারা গেলেন, মতের ভিন্নতার কারণে রাষ্ট্রীয় সম্মান তো দূরের কথা রাষ্ট্রের কোনো কাক-পক্ষীও তাঁর জানাযায় এলো না। দল-মতের বিরুদ্ধে যাওয়া যেনো এমনই জঘন্য অপরাধ। পাপ। সহযোদ্ধা আবদুল আজিজ তো এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতিটাই আদায় করতে পারছে না। কতো করে বলা হয়, পার্টিতে যোগ দাও। স্বীকৃতিও পাবা, সাথে সাথে আরো নানান সুযোগ-সুবিধার রাস্তাও খুলবো। শুনে না। বলে, যেইডা আমার অধিকার, হেইডা অতো সিস্টেম কইরা পাইতে অইবো ক্যান? দেশ কি কারো বাপের জমিদারি? যা কইবে তা-ই হুনতে অইবে?
     মুর্খলোক। দেশের কোনো কিছুই যে স্বাভাবিক চলছে না, এটা তাকে কে যাবে বোঝাতে? মনে মনে কথাগুলো উচ্চারণ করে আবার ফাইলটা খুলেন। এতো দৌড়াদৌড়ির ভেতর কোথাও কোনো কাগজ মিসিং হয়নি তো? ঈষৎ উদ্বিগ্নের সাথে কাগজগুলোয়  চোখ বোলাতে থাকেন।  
     ঠিক এ-সময় ট্রেনের গতি অনেকটা নরম হয়ে আসে। বাইরে তাকিয়ে দেখেন ট্রেন বিমান বন্দর স্টেশনের প্লাটফর্মে উঠে গেছে। তারপরই চিরাচরিত দৃশ্য। ট্রেনটা থামতে না থামতে যুদ্ধাক্রান্ত দেশের শরণার্থীদের মতো আপাদমস্তক গিলে নেয়। কি বাইরে  কি ভেতরে। পা ফেলারও জো থাকে না। বিরক্তিটা চরমে পৌঁছার আগেই দেখেন একঝাঁক তরুণ-তরুণী ফাইল-পত্র বগলদাবা করে অসম্ভব ভিড় ঠেলে তাঁর সিট বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত সরকারি কোনো অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। তাদের সবার কণ্ঠেই বিষাদের বুদ্ বুদ্। ‘কবে যে কৌটা প্রথা শেষ হবে আর আমাদের মতো সাধারণ ঘরের সন্তানরা চান্স পাবো! আল্লাই জানে। কেউ একজন বললো, কামাল ভাই চার-চারবার ভাইবাতে যেয়ে ফিরে এলো; অথচ মনির ভাই তার চেয়ে অনেক দুর্বল স্টুডেন্ট হয়েও শুধু কৌটার কারণে প্রথম চান্সেই চাকরি পেয়ে গেলেন। আহ! আফসোস। তারা যদি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেন, তখন কোন যোগ্যতায় কার্যালয় চালাবেন?’
      তাই তো! কোন যোগ্যতায় ওসব ল্যাঙ-মারা লোক পদের প্রতি সুবিচার করে কর্মপরিচালনা করবে? ওদের মুখ থেকে প্রশ্নটা এক প্রকার কেড়ে নিয়ে আপন মনে ভাবতে লাগলেন। তখনই মনে পড়ে ছোট বোন জাহানারার ছেলে মারুফের কথা। এসএসসি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত সবকটা পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এসেছে ছেলেটা। অথচ তার মতো মেধাবী ছেলের চাকরি হলো না। তিন তিনবার বিসিএস-ভাইবায় পর্যন্ত ফেইস করলো। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, কাউকে ধরতে হবে না। ওর নিজের যোগ্যতায় পেয়ে যাবে।  

শেষে দেখা গেলো আশায় গুড়েবালি। পরে তিনিও কয়েক জায়গায় ওর হয়ে কথা বলেছিলেন, কাজ হয়নি। এখন সে পাগল প্রায়। কোথায় যায়, কী করে, কোনো কিছুরই ঠিক-ঠিকানা নেই। অথচ নিজের মেয়ে শাকিলার জন্যে কোথাও ধরনা দিতে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কৌটায় প্রথম  চান্সেই চাকরি পেয়ে গেলো। এ নিয়ে আরো কী যেন ভাবতে যাবেন,
এমন সময় আরেকজন তরুণ বলে উঠলো, আফসোস, বিদেশে না যেয়ে কেনো যে লেখাপড়া করতে গেলাম! ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করে। নরসিংদীর আগে আর কোথাও  থামবে না। সেজন্যে গতিটা নিশ্চয়ই আগের মতো পূর্ণমাত্রায় গিয়ে উঠবে। তখন জানলার বাতাসে ফইলের কাগজ-পত্রগুলো এলোমেলো হয়ে যাবার জোর সম্ভাবনা। সে আশঙ্কায় তাড়াহুড়ো ফাইলটা গুটিয়ে নিতে নিতে টের পান কার যেনো এক দলা গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়লো।
সাথে সাথে মাথা তোলে দেখেন কাঁধ ঘেষে দাঁড়ানো ছেলেটা জানলা দিয়ে লক্ষ্যহীন বাইরে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে কী যেনো বলছে, কোলাহলের কারণে বোঝা যাচ্ছে না। তবে পাশের ছেলেটা নিশ্চয়ই কিছু একটা বুঝেছে।
তাই তো সে বলতে লাগলো, তুই ইচ্ছে করলে পারতি কিন্তু আমি? আমার তো সে-ক্ষমতাও নেই। তুই তো সবই জানিস, কীভাবে যে আমাদের সংসারটা...কথাটা শেষ করতে পারে না ছেলেটা, তার আগেই বুক উঁচু করে একটা লম্বাশ্বাস ফেলে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। 
     টের পাচ্ছেন, ছেলেদের কথাগুলো কোথায় যেনো নড়ে-চড়ে উঠছে। একে একে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। সবার চোখে-মুখেই সেঁটে রয়েছে এক ধরনের বঞ্চনার প্রচ্ছদ। মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেন, কোনো লাবণ্য নেই। একজন তরুণকে মোহাবিষ্ট করে রাখার মতো কোনো লক্ষণই তাদের চোখে-মুখে নেই। যতোই দেখছেন ততোই শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠছে। সে-সাথে হাত-পাও অবাধ্য স্প্রিং-এর মতো কাঁপতে লাগলো। কী হচ্ছে এসব? কোথায় যাচ্ছি? ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন বটে; কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। কেবলই মনে হতে লাগলো, কোথায় যাচ্ছি আমরা! এজন্যই কি একদিন রাইফেল কাঁধে হারিয়ে গিয়েছিলাম ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের পরতে পরতে? সব সম্ভাবনা এভাবে দীর্ঘশ্বাসে তলিয়ে যাওয়ার জন্যেই কি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম দানবের মুখে?
    আর ভাবতে পারছেন না। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এমনিতেই ডায়াবেটিসের রোগী, তার ওপর সারাদিনের ধকল। তিনদিন ধরে ঢাকায়। ফাইল-পত্র তৈরি, এ-অফিস থেকে ও-অফিসে কখনো রিক্সায়, কখনো হেঁটে বারবার ছুটে যাওয়া, কীসের খাওয়া কীসের কী? তিনদিন ধরে ঠিক মতো ঘুমোতেও পারেননি। তারপরও স্ত্রী রোকেয়ার মামাতো ভাই শিকদার সাহেব ছিলো বলে রক্ষা। তা না হলে হোটেলে থাকতে হতো। ঢাকা শহরের হোটেলে থাকা-খাওয়ায় কত যেতো, ভাবা যায়!
    চোখ বুজে কপালের বামপাশ টিপতে থাকেন।
    ঠিক এসময় গা ঘেঁষে দাঁড়ায় টিকেট চেকার।
    তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন, উঠতি বয়সের যুবক। বুকের বাঁপাশে মুক্তিযুদ্ধের মনোগ্রাম অঙ্কিত ব্যাজ থাকা সত্ত্বেও পাশের ভদ্রলোকের কাছে টিকেট আছে কিনা জানতে চায়। পূর্ব অভিজ্ঞতায় তিনিও জেনে ফেলেছেন, এমনটিই হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ট্রেনে যাতায়াত ফ্রি হলেও টিকেটের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত হয়নি। যে-কারণে এ-ধরনের বিড়ম্বনা কিছুতেই পাছ ছাড়ছে না। টিকেট চেকার একটা না একটা কথা শোনাবেই। সে অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি কখনো এ-ভুলটি করেন না। শত কষ্ট হলেও টিকেট সংগ্রহ করেন। আজকেও করেছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে বাত ধরে এসেছিলো, তারপরও টিকেট ছাড়া ট্রেনে উঠার নাম করেননি।
    পাশের ভদ্রলোক মনে হয় টিকেট করেনি। তাই কণ্ঠে যদ্দূর সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে বললেন, আমি এফ এফ। ‘এফ এফ’ শব্দটা শুনেই টিকেট চেকার এমনভাবে তাকালো, যেনো তিনি বিরক্তিকর কিছু একটা উচ্চারণ করে ফেললেন। সে-সাথে তিনি ছেলেদের দিকেও তাকালেন। ভাবলেন, ওরা নিশ্চয়ই টিকেট চেকারের উদ্দেশ্যে কোনো প্রতিকার দেখাবে। কিন্তু না, ওরা টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।
   তখন ভাবলেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়, এ-বিষয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দেবেন।  পরক্ষণেই মনে হলো, এটা স্কুল নয়। আর ওরাও তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থী নয়। তাছাড়া ওরা একটা স্বাধীন দেশের সন্তান হয়ে একটা নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর খাবি খেয়ে মরছে। এই অন্ধকার ভেদ করে কখন তাদের জীবনে ভোরের সূর্য উঁকি দেবে, তারও কোনো সম্ভাবনা আপাতত চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে কোন ভরসায় নীতিবাক্য আউড়াতে যাবেন?
    এ আশঙ্কায় আর দাঁড়াতে সাহস করলেন না। বসে বসেই ভাবতে লাগলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা মিসিং হয়ে গেছে। কিন্তু মিসিংটা কোথা থেকে শুরু হলো? প্রশ্ন মাথায় রেখে যখন অনুসন্ধান চালাতে যাবেন, এমন সময় কে যেনো ডেকে উঠলো, কী ভাবছো?
    কে আপনি?
    তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? আমি আবুল হাসান। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল হাসান। যে কোনোদিন কারো কাছে ছোট হয়নি। বহরমপুরে যার জনপ্রিয়তায় চেয়ারম্যান সাহেব পর্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়; তুমি এখনো চিনতে পারলে না আমাকে?
    চিনবো না কেনো? হা চিনেছি। তুমি বহরমপুর হাই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শত্রুর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে। বিশ্বাস না হয়, এই দেখো তোমার পরিচয়। মনে মনে উচ্চারণ করেই হাতের ফাইলটা জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলেন। ট্রেন তখন টঙ্গী-পোবাইল-আড়িখোলা পেরিয়ে শীতলক্ষার ব্রীজের উপর দিয়ে সোজা ছুটে যাচ্ছে নরসিংদীমুখী। বিষয়টা যারা খেয়াল করলো, তারা দেখলো ফাইলটা পানিতে পড়ে ঢেউয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সার্ফিং করতে করতে চোখের অন্তরালে চলে যাচ্ছে।
     তরুণ-তরুণীরাও  অবাক। বললো, আঙ্কেল, এইটা কী ফেললেন?
     মুখে এখন দেবতার হাসি। ছেলেদের উদ্দেশ্যে ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগলেন, ওটা তেমন কিছু নয় বাবারা। অনাবশ্যক কিছু কাগজ ছিলো, ফেলে দিলাম। যেতে হবে অনেক দূর, শুধু শুধু পথের বাগড়া বাড়িয়ে লাভ কি।

পদাবলি

পদাবলি


জ্যোৎস্না
শারমিন আক্তার

এখনো; এখনো দূর কোন মরুভূমে মরীচিকা ওঁৎ পাতে। কাগজের নৌকোয় পাল তোলে খেঁয়ালী স্বপ্ন যত। কাঁচা রোদে চোখ মেলে যে নকশিকাঁথার পোঁড়া গ্রাম,  সেখানে সন্ধ্যেবেলায় পাহাড় ঘেঁষে নীরবতা নামে। ওদিকে জোৎস্না কোন সুবোধ বালকের মত খুলে বসে নিযুত কবিতার পাঠ্যবই। এখনো তুমি হেঁটে যাও মেঠোপথ আমার চোখের ভাঁজ গলে, সেখানে আমার কত জনমের মেঘ জল হয়ে গড়ায় বিশ্বচরাচর। এখনো...



শীতের বিকেল
মাহমুদ নোমান

পাখিদের ডাকাডাকিতে
পথ হারিয়ে
যাদুটোনার ছলে
ওয়াবীলতা ফুলের ঝলওয়া
দস্তানায় দিলখুশÑ
প্রজাপতির খেলা দেখতে দেখতে
পেটকাটা ধানগাছের ফুঁঝায়
দুলে উঠে নাইওরির
পাঁজরে আটকা কষ্ট,
কদমে কদমে এগোয় অন্ধকার



তুমি এবং তোমরা
সৈয়দ শরীফ

তোমার চোখে স্বপ্ন দেখি-
স্বপ্ন ভেঙে হৃদয়টিতে হচ্ছে এ কী?
প্রায় সেখানে কোরছে ব্যথা; কান্না শোনো?
ছিঃ ছিঃ কীসব বলছি, আজব !
তুমি তো আজ অন্য চোখে স্বপ্ন বোনো..

যাচ্ছে কেমন দিন তোমাদের?
চাঁদনী রাতে- জ্যোৎস্না মেখে;
ওর দু’হাতে হাতটি রেখে-
থাকছো কেমন? বড্ড সুখী?
কষ্ট কভু সুখটা ভেঙে দেয় না উঁকি?

এই তো আমার চাওয়া ছিলো-
দু’চোখ মেলে দেখবো তোমায়
সুখেই আছো.. সুখেই আছো..
আজ আমার আর কষ্ট তো নেই;
কারণ- তুমি সুখী হয়ে
আমার মতো আরেকজনার
বুকেই আছো ! বুকেই আছো !


বাসস্ট্যান্ড
অসীম মালিক

আগমন ও প্রস্থানের কোলাহল গায়ে মেখে
রাস্তাগুলি ছড়িয়ে গ্যাছে চাদ্দিকে ...

যারা এসেছিল ,
কাজ সেরে ফিরে গ্যাছে ঘরেÑ
বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, প্যাসেঞ্জার ও ফেরিওয়ালার ডাকে,
বাসস্ট্যান্ডের অলিতে-গলিতে
থেকে গ্যাছে কিছু নমুনা .....

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাস্তাগুলিকে
এক ছাতার তলায় এনে
আদর্শ হিন্দু হোটেলের গলিতে হারিয়ে যায়নি বাসস্ট্যান্ড !

সম্প্রীতির ঈপ্সিত ইচ্ছেগুলি
বাসের সিটে সিটে ছড়িয়ে দিয়ে
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে
একাকী , নীরব বাসস্ট্যান্ড...

প্যাসেঞ্জার ঘরে নিয়ে আসেনি বাসস্ট্যান্ডের মুখ !

মৃত্যুর ডাকপিয়ন
শাহিন আলম

মেহেদী রাঙা বউয়ের মতো মৃত্যুকে বেসেছি ভালো
মাঝরাতে জোনাকীর আলোয় হেঁটে হেঁটে
মৃত্যুর শহরে গড়েছি ঠিকানা।
এ শহরের প্রতিটি কলোনীতে
সকালের রোদের সাথে নেমে আসে মৃত্যুদূত
দস্ত আর নখের ভিতরে গেঁথে রাখে
শত মানুষের প্রাণ।
প্রতিটি গলির মোড়ে মৃত্যুর ডাকপিয়ন থাকে দাঁড়িয়ে
নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে দেয় চিঠি।
আমি দরজার কপাট রেখেছি খুলে
রঙিন খামের অপেক্ষায় চেয়ে আছি পথ।



কামনা
নাবিল তুরাব

তারচেয়ে ভালো তুমি ঘুমিয়ে পড়ো; হে রজনীসন্ন্যাসী... অলুকপাড়ায় সূর্য নামে যখন। রমণীর মুখ চেয়ে কাটানো যায় যখন কয়েক প্রশস্ত রাত্রি এবং অনাহারে কাটানো যায় কয়েক তুচ্ছ মাঝারি জীবন। ফুসফুসের কষ্টে ভোগা রজনী, তৃষ্ণাতুর বালকের গড়াগড়ি করা। এ সবই জরাজীর্ণ মূর্তির সবল পরশ্রীকাতর কামনার ফসল।


পাপ
অপু সরকার

ভালোবেসে বিছানায় গেলে পাপ হবে!
তোমার হবে যা, তাও কী আমার?
কোন এক সূর্য খুনের পরে
বুকের ভেতরে লেগে থাকা তামাটে অন্ধকার
আমি ভাবি; তুমি কার !
আমি কার !
আমাদের পাপগুলো
কীভাবে কেন শুধু আমার।
এভাবে দিন গেলে
নিঃসঙ্গ হতে আর কতো দেরী?
সঙ্গী কী কখনো ছিলে আমার ?
জলের প্রথম ভাগে পাপ ধুতে যেয়ে
হে প্রতিবিম্ব সঙ্গী প্রশ্ন আমার...




শব্দের পাঠ
মীর সাহাবুদ্দীন

পৃথিবীর মুদ্রনচলে
প্রতি পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠ হয় উচু উচু দালান।
এ বাংলায় ধান, পাট নিচু হতে থাকে
ডুবতে থাকে রেডিমেড গার্মেন্টস।
মানুষ গুলো ছুটে চলে আরব, নিউইয়ার্ক,
লন্ডন বা আরো কোন প্রবাসী পথে
চিটা ধানের মত ঝড়ে পরে উড়ে চলে বাতাসে বেগে...
তবুও কম্পন বাড়তে থাকে,
গাড়ির হর্ন ছুতে থাকে বহুতল ভবন।
জাপানের উপকূল বা দক্ষিণ প্রশান্ত
পাঠ না হতেই ফেটে যায় লাভা
আমাজানের গভীরের মতই মধ্যে
দুপুরে শব্দগুলো দ্রুত ছুঁতে পেয়ে বাংলা
ধান গম কিংবা জবের মাঠগুলো হয়ে উঠে উত্তপ্ত বালি।



ভরাডুবি
অভিষেক ঘোষ

প্রত্যুষের বিভূতি ছড়ানো, আভিজাত্য
আলোতে মাখামাখি নৈঋত কোণ
ঘেঁষে বয়ে যাওয়া আমার কল্পনার নদীতে
ভ্রাম্যমাণ শখের পানসীটার
ভরাডুবি ঘটলো আকস্মিকভাবে।।


পথিক
পাপুল চৌধুরী

অজানা দূরের দেশে আমি এক গন্তব্যহীন পথিক,
হাঁটিতেছি অচেনা পৃথিবীর পথে ভাগ্যের সন্ধানে,
সমাপ্তির জীবনে অসমাপ্ত ইচ্ছে পূরণে;
দিগন্তরেখার সীমান্ত পানে খুঁজেছি অবিচল, চির প্রশান্তির স্থল।
পথে মাঠে ঘাটে, সুদূর সাগর ললাটে
হেঁটেছি বহুদূর, চির প্রশান্তির খোঁজে;
ভোরের সূর্যোদয় থেকে, প্রিয় গোধূলির সাঁঝে
খুঁজে খুঁজে নিরাশায়, আমি আজ ক্লান্তির দলে।
পথকেই বানিয়েছি আশ্রয়, দুদ- বিশ্রামের ছলে
শয্যাতল রেখেছি মাটি,উপরে নীল আকাশ পরিপাটি।
আহার করিবো কিসে! ক্ষণিকের তৃষ্ণা মেটাই
অপূর্ণ এক ঘটি জলে।
চোখের চাহনিতে ঝাঁপসা আলোয়,
স্বলকিত জ্যোৎস্নার পর, নিশিথের কালোয়;
তবুও খুঁজেছি, খুঁজে চলেছি পৃথিবীর দ্বারে
চেয়েছি অনুরোধে, কড়া নেড়েছি শান্তির দুয়ারে;
আমায় একটু শান্তি দাও! হোক না সে ক্ষণিকের
তবুও আমার চাই; কিন্তু সে কোথায়?
চারদিকে শুধু হিংসা আর প্রতিহিংসার আগুন;
জ্বালিয়ে দিচ্ছে বিবেক, জ্বলছে মনষত্ব পৃথিবীর রোষানলে!
প্রেমিকের ভালোবাসায়, আসেনা প্রেম বসন্তের ফাগুন।
এ কেমন স্বার্থান্বেষী পৃথিবী!
চির প্রশান্তির আশায়, যেদিকেই তাকাই
শেষ থেকে সূচনায়, শুধু স্বার্থের সমারোহ;
স্বার্থান্ধ মনুষ্য কূলে, হিংসা- প্রতিহিংসা ভুলে
খুশির বার্তাবাহী প্রতিটি ফুলে,
এই তৃষ্ণার্ত মনের সাধ মেটাবো;
এমন দুদ- শান্তি এই পৃথিবীর কোথাও নাই।



একবার যদি ডাকো
অনার্য আমিন

একবার যদি ডাকো দেখবে তুমি
কতোটা উচাটন হৃদয় আমার
কতোটা কাঙাল ভালোবাসার।

দেখবে তুমি রিক্ত ভূমি
সেজেছে আবার সবুজে
ফুল ফুটবে; মধুপায়ীর অবাধ বিচরণে
মাতবে মালী।

শত কষ্ট ভুলে ছুটে চলে আসব
ছুঁতে সেই প্রণয়ের মুকুট।

একটি ডাক পেলে সবকিছু ফেলে
পাড়ি দেব সাত সমুদ্দুর,
হবো নাবিক নয়তো পাখি
দেখবো তোমায় ভালোবাসায়
জুড়িয়ে যুগল আঁখি।


বৃষ্টি সেতো কবেই থেমে গেছে
ঊষার মাহমুদ

ঝুমবৃষ্টিময় একটি দুপুর গুঁজে রাখি হৃদয়ের সিলিং জুড়ে;
খোলা বাতায়ন, উন্মুক্ত পথ; স্নিগ্ধবাতাসে বোতাম খোলা বুক।
ভেজাকাকের নয়নের কাতরতায় ভরাডুবি স্বপ্ন আমার;
দেয়ালের কার্নিশে বেড়েউঠা বটপাতার সংসারে
আটকে থাকা দৃষ্টি হতাশার ঘোর।
যোগল পাখির লেনাদেনায় ইচ্ছেগুলো ফেরারি হয়
অস্তিত্ব জুড়ে অচেনা স্পর্শে মাতাল ঘোড়ার ছুটেচলা;
বৃষ্টি, তুমি আরো জোরে আসো, অন্ধকার করে আসো
একটি লালশাড়ি আর নীল শার্টের বিনিময় হোক তোমার গভীরতায়....
চড়–ই পাখি উড়ে যাওয়ার শব্দে ধ্যান ভাঙে, 
বৃষ্টি সেতো কবেই থেমে গেছে, দ্যাখো, 
বাঁশপাতা চুয়ে চুয়ে এখনো ঝরছে জল কণা;
আমার আকাঙ্খা শেষ হয়েও হয়না...


অণুগল্প- বিলকিছ

অণুগল্প- বিলকিছ


বিলকিস
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

বিলকিসের বয়স সাত বছর। তবে ওর কোনো জন্মদিন পালন হয় না। সবাই যখন স্কুলে বান্ধবীদের বার্থডে উইস করেÑ তখন ওর খুব মন খারাপ হয়। বিলকিসের বাবা মা কেউ নেই।
বিলকিস গ্রামের এক কোণে  নানির সাথে থাকে। ওর  নানিও খুব অভাগী। কলেরা রোগে আপন সবাইকে হারিয়েছে। নানি অন্যের বাড়িতে সারাদিন কাজ করে। বিলকিস স্কুলে যায়। বাড়ির সব ছোট ছোট কাজ সে একা করে। নানি তাকে সব কাজ শিখিয়ে দিয়েছে। তবে সে আগুন আর পানির কাছে ঘেঁষে না। বিপদ হতে পারে।
 বর্ষাকাল। খুব বৃষ্টি। বিলকিস স্কুলে যায়নি। ঘরের মধ্যে একাকী তার ভালো লাগছে না। বৃষ্টি থেমে গেলে সে বাইরে বেড়িয়ে আসে। একদিনের বৃষ্টিতে চারদিকে যেন বন্যা হয়ে গেছে। অনেকেই মাছ ধরছে। ছোট বড় কত রকম মাছ।
হাঁটতে হাঁটতে বিলকিস রেললাইনের কাছে চলে আসে। সামনে নদী। রেলসেতুর নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে পানির প্রবাহ ছুটছে। সারাদিন বৃষ্টি ছিল। আজ এ দিকটায় কেউ আসেনি। এখন তার রেলগাড়ি দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
বিলকিস দেখতে পায় তীব্র ¯্রােতে রেলসেতুর পাশে মাটি সরে গেছে। চাপচাপ মাটি ভেঙ্গে পড়ছে নদীতে। রেললাইন আগলা হয়ে ঝুলে আছে। বিলকিস ট্রেনের হুইসেল শুনতে পায়। সে দূরে রেলগাড়িটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এখন কী করবে সে ঠিক বুঝতে পারছে না!
সর্বনাশ! এখন সেতুর উপর ট্রেন উঠলে সেতু ভেঙ্গে সবাই মারা যাবে। বিলকিস আশেপাশে কাউকে দেখতে পায় না। এখন সে কী করে! কিন্তু এত ভাবনার সময় এখন নাই। সে একটু সামনে এগিয়ে যায়। পরনের লাল জামাটি খুলে উঁচু করে তুলে ধরে।
রেল চালক সামনে লাল বিপদ সংকেত পেয়ে ট্রেন থামিয়ে দেয়। নির্ঘাত দুর্ঘটনা হাত থেকে ট্রেনটি রক্ষা পায়। বেঁচে যায় শত প্রাণ। তখন বিলকিসের আনন্দ যেন আর ধরে না!
উপদেশ : আমরা সর্বদা ভালো কাজ করার চেষ্টা করব।

গল্প- মাকাল ভ্রমর

গল্প- মাকাল ভ্রমর




মাকাল ভ্রমর
বিবিকা দেব

নূর খালেক ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে । খুশিতে গদ গদ হয়ে বাঁশ ঝাড়ে একটা সোমত্ত বাঁশ কাটতে গেলেন । সামনে যাকে পাচ্ছে খুশির সংবাদ মুখে মুখে প্রচার করছে । নিকষ কালো রাত শেষে নতুন ভোরের মতো তার একখানা পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে । তার আগের বার একটা মেয়ে জন্মে ছিল । মেয়ের নাম রেখে ছিল জুঁই ফুল ।  নূর খালেক ফুল বড় ভালোবাসে । যদিও পৃথিবীতে কোথাও পাওয়া যাবে না , এমন ব্যক্তি যেই ফুল ভালোবাসে না । ছোট বড় সকলেই ফুল খুব ভালোবাসে । ছেলে জন্মেছে বলে আনন্দে আহল্লাদে আটখানা । মেয়ে জন্মেছে শুনলে মনে হয় মেয়ের মুখ দর্শন করতো না । এই গ্রাম থেকে আশে পাশে প্রায় পাঁচ গ্রামে চাউর হয়ে গেছে । গোদা নূর খালেকের ঘরে পুত্র সন্তান জন্মেছে । এই গোদা নামটা নিয়ে নূর খালেকের ভারী আপত্তি । কে যে এই নামটা প্রচার করেছে । আজো নূর খালেকের অজানা । যাক ! এই নাম নিয়ে আপাতত কোন মাথা ব্যথা নেই ।
নূর খালেক এখন বেজায় খুশি । বাপ দাদার পর বংশ পরম্পরায় সেই সহায় সম্পত্তি পেল । তাতে খেয়ে পরে দিব্যি বেঁচে থাকা যাবে । কোন ধরনের অভাব থাকবে না । তবু নূর খালেক কৃপন ! ছেলে হয়েছে বলে পাড়ার সবাই ছেলের বাপকে উদ্দেশ্য করে বললো কি মিয়া, পয়লাবার মেয়ে ছিল কিছুই খাওয়ালে না । এই বার ছেলে আসলো । মিষ্টিমুখ করাও । নূর খালেক হ্যাঁ সূচক উত্তরে বললো । তা বাদ থাকবে কেন , নিশ্চয় মিষ্টিমুখ হবে । তবে দোয়া করেন চাচা ছেলে যেন আমার বীর হয় । বিকাল বেলা বাজার থেকে ফেরার পথে হিসাব কষতে থাকে ।  রসগোল্লা খাওয়ালে কত খরচ পড়বে । হাঁটার গতির প্রতি কদমের তালে তালে হিসাব করে । যদি রসগোল্লা খাওয়াই তাহলে পকেট থেকে নতুন কড়কড়ে হাজার টাকা বেড়িয়ে যাবে । আর জিলাপি, কচরি খাওয়াই তাতে খরচ কম পড়বে । কিছু অর্থ নিজের সঞ্চয়ে থাকবে । বাড়ী ফিরে উঠোন থেকে হাঁক ডাক শুরু করে । কইগো আমার মা, আমার জুঁইফুল কোথায় ?
বদনা করে পানি দিয়ে গেল শেফালী । শেফালী নূর খালেকের শ্যালিকা । বউয়ের নাম শিউলী । দুটো ফুলের নাম পছন্দের তালিকায় আছে । বউটা সুন্দরী বটে , বাচ্ছা দুটো জন্মানোর পর রুপের ভাটা পড়েছে । আগে ছিল বাঁধানো শরীর । সারাদিন খাটা খাটুনির পর রোদে গায়ের ঘাম পিছলে পড়তো । দেহখানা খাঁটি সোনার মতো চকচক করতো । এখন সেই সৌন্দর্য নেই । তবু শিউলীর মুখটা ভরাট ও মায়াতে পরিপূর্ণ ।
হাত মুখ ধুয়ে বেশ পুরানো গামছা দিয়ে মুখ মুছে বউয়ের পাশে মোড়া পেতে বসে । শিউলী তখন পরম মমতায় বুকের অমৃত পানে ব্যস্ত । ছেলের বাপ আসাতে শাড়ীর আঁচলটা সরিয়ে কচি মুখটা দেখিয়ে বলল, দেখো তোমার ঘরের মানিক , তোমার সন্তান এবং বংশধর । খুশিতে আত্মহারা নূর খালেক বলে হ... আমার বাপজান আইছে আমাকে শাসন করবার লাইগা । আমার বংশের বাতি । এই সময়ে শেফালী চা নিয়ে হাজির । মৃদু হেসে হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চা পান করে । দেখ শেফালী, আমার বাপজানের মুখ চান্দের লাহান । যেন চান্দের আলো ফকফকা হইয়া মাটিতে পড়ছে । এবার যাই গ্রামের সকলের জন্য একটু মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা করি । আমার অনেক কাজ পড়ে আছে । নূর খালেক আঁতুড় ঘর থেকে বের হয়ে গেল । শেফালী বড়ো বোনের জর‌্য গরম ভাতের সাথে কচি লাউয়ের তরকারি খেতে দিল এবং বললো বেশী করে খেতে হবে । তুমি খেলে বাচ্চার শরীর ঠিক থাকবে । উত্তরে শিউলী বললো পাকা বুড়ি হয়েছিস না । এই সব কথা কোথা থেকে শিখলি । কেন আপু মা বলেছে এই সব কথা ।


জুঁই মায়ের কাছে আর ঘেষে বসে না । কিছুটা দূরত্বে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে । একবার মাকে দেখে , আরেক বার মায়ের খোলে ভাইটাকে দেখে । শিউলী বললো জুঁই এসো । দেহো তোমার ভাই তোমার দিকে চাইয়া আছে । জুঁই কিছু বলে না । অনড় হয়ে আছে । মায়ের ডাকাডাকিতে চুপটি করে বসে । এক হাতে ছেলে ঘুমাচ্ছে, অন্য হাতে শিউলী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পরম ¯েœহ মমতায় । অনেক দিন হয়ে গেছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে না ।
জুঁই ছোট খালা শেফালীর সাথে ঘুমায় । শেফালী রাতের খাবার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত । এমন সময় নূর খালেক এসে জিলাপি ও কচরি  এনে বলে শেফা... ও ...শেফা... এই গুলান ধরোত । হাত আমার বেদনা হয়ে গেল । নূর খালেক কয়েক দিন ধরে শেফালীকে শেফা বলে ডাকে । শেফা নাম স্বামীর মুখে এই প্রথম শুনলো । মনে মনে ভাবলো নিজের কোন ছোড বইন নাই । তাই বোধয় আদর করে শেফা বলে ডাকে । সে স্বামীকে কিছুই বললো না । শেফালী প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে বলে এই গুলো আমি কি করবো ? কি করবা মানে ! গ্রামে সকলের ঘরে ঘরে পাঠায়া দিবা । আর লগে বলবা যেন আমার ছেলের জন্য দোয়া করে । বুঝছো , নাকি আবার বলতে হবে । শেফালী হ্যাঁ সূচক বললো জি বুঝেছি আর বলতে হবে না ।
আমি এক্ষুণি যাচ্ছি । তয় এত রাতে আমি একা যামু । আপনিও সঙ্গে চলেন । আপনি সাথে থাকলে আমার ভয় ডর কিছুই লাগবো না ।
কি বলো শেফা দেহো বাইরে দুধ শাদা চাঁদ উঠছে । চারদিকে ফকফকা আলোর নাচন । আর তুমি কিনা ভয় পাও ।
হেইডা ঠিক আছে তয় আপনি আমার লগে যাবেন । না হয় আমি একা একা যাইতে পারুম না ।
ঠিক আছে । লয় এহন যাই । হাতে জিলাপি ও কচরির প্যাকেট সমেত দুজনেই রওনা দেয় । যাওয়ার সময় শেফালী বোনকে খাবার দিয়ে যায় এবং আরো বললো বুবু তুমি তাড়াতাড়ি খাইয়া ঘুমাইয়া পড় । রাত জাইগো না । শরীর খারাপ হবে । আমি আর দুলাভাই যাচ্ছি মিষ্টি বিলি করতে । আমরা জলদি ফিরা আমু । উত্তরে শিউলী বলে যা তাড়াতাড়ি আইসো ।
শেফালী ও নূর খালেক একসাথে বের হয় । যথা শীঘ্রই মিষ্টি বিলি করে বাড়ীতে ফিরে । আসার সময় নূর খালেক বলে আচ্ছা শেফা আমি মানুষটা কি বদ ?
এই কথা কইলেন ক্যান ?
না এমনি কইতাছি। শেফা তুমি খুব সোন্দর ।
হ দুলাভাই । সকলে এই কথা কয় আমি নাকি সোন্দর আছি ।
ক্যান শেফা তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো না ।
করি তো । আপনি হইলেন গিয়া এক নম্বরে খাঁটি মানুষ । চাঁন্দের আলোয় শেফার মুখখান দুধের সরের মতো জমে আছে । আরো বেশি মায়াবী দেখাচ্ছে । কারো মুখে কোন বাক্যর ব্যবহার নেই । নিস্তব্ধ নির্বাক্ তাকিয়ে আছে ।
একসময় মৌনতা ভেঙে দুজনেই বাড়ী ফিরে আসে । শেফালী রাতের ভাত খেয়ে চটজলদী ঘুমিয়ে পড়ে । এপাশ ওপাশ করে কিন্তু চোখের পাতায় ঘুম আসে না । অনেক চেষ্টা করে কিছুতেই ঘুম আসে না । পাশে জুঁই ঘুমিয়ে আছে । গভীর ঘুমে জুঁইকে আরো বেশী সুন্দর দেখাচ্ছে । মনে হচ্ছে চাঁন্দের দেশের রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে আমার পাশে । জুঁইয়ের ঘুমের মৃদু মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দে শেফালী অনেক দূরে নিজেকে নিঃশ্বাসের পতঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । শেফালী গ্রামের আর দশ জন সুন্দরী মেয়েদের একজন ।
প্রথম যৌবনে শাহীন নামে প্রতিবেশীর মন কেড়ে নেয় । নিতান্তই চোখে চোখে এক পলক দেখা তার বেশী কিছুই নয়। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখে একান্ত আত্মকথা । শাহীন ও কোন উদ্যোগ নেয় নি । ভাটা পড়ে এক তুবড়ি প্রেমের । আরো বিগত কিছু দিন পরে বড়ো বোনের বাড়ীতে রওনা দেয় । বড়োবোন গর্ভবতী তার দেখাশুনা  করার জন্য অস্থায়ী  ভাবে আছে । কয় মাস থাকতে হয় জানি না । অনেক দিন থাকাতে ঘরবাড়ী, গাছপালা, পুকুর, গরুবাছুর, মানুষজন সবাইকে আপন করে নিয়েছে । দিন কাটতে থাকে হাসিতে খুশিতে । বড়ো বোনের ছেলে হয়েছে । তাই আরো বেশী আনন্দে আছি । আত্মীয় স্বজন দুলাভাই সবাই খুশি । তবুও কোথাও শূন্যতা বিরাজমান !
চৈত্রের খাঁ খাঁ করা রোদ্দুর প্রভাব পড়েছে হৃদয়ে । যেন প্রথম বৈশাখী ঝড়ের এক ফোঁটা বৃষ্টির সজীবতা জীবনে আসবে । এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না । খুব ভোরে আকাশের এক চিলতে ফর্সাভাব বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি দেয় । তখন দড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে । সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি ভর করে সারা শরীরে । ঢুলুঢুল চোখে প্রত্যহ কাজ করতে এগোয় । অবসন্ন বিষাদ মন ছুটে চলে শাল হিজলের বনে । ভরা পূর্ণিমা রাতে আকাশের চাঁদ অন্য রাতের থেকে আলাদা হয় । চাঁদের ষোলকলা পরিপূর্ণ । তেমনি এক চাঁদনী রাতে নূর খালেক শেফাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে ।  এবং বললো শেফা... ও শেফা... তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ?
শেফালী ঘুম থেকে উত্তর দেয় জি শুনতে পাচ্ছি । তয় এতরাইতে আপনি না ঘুমাইয়া এইহানে কি ? নূর খালেক বললো কথা আছে বাইরে চলো । শেফালী বললো বাহিরে ক্যান যামু । নূর খালেক বলে বাহিরে এসে দেখ, আকাশে কি সোন্দর চাঁন উঠছে । না দেখলে আপসোস করবা । আপত্তি থাকার শর্ত্বেও শেফালী ঘুম থেকে উঠে । বাহিরে এসে শেফালী সত্যি অবাক হয়ে যায় । চাঁদকে কোন দিন এত গভীর রাতে উপভোগ করেনি । শেফালীর প্রতিমুহূর্ত গুলো ভালো লাগছে । নূর খালেক আরো বললো চলো সামনে হালদা নদী । নদীর বাঁকে চর জেগেছে । সেখানে একটি নৌকা বাঁধা আছে । তুমি আমি নৌকায় ঘুরে বেড়াব ।
দুরু দুরু বুকে শেফালী এগোয় দুলাভাইয়ের সাথে । বড়বোন শিউলী সন্তান বুকে পরম তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছে । এখন শেফালীর নূর খালেককে বোনের স্বামী হিসেবে মনে হয় না । চারদিকে চাঁদের দুধ শাদা জোসনা আলোকিত । নৌকায় উঠে শেফালী নদীর স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নেয় । আরো মোহনীয় মায়াময়, দেখে বাতাসের আলিঙনে নদীর মৃদু মৃদু ঢেউ । চাঁদের রুপালী আলোয় ভাসমান । দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে । নূর খালেক বললো কি হইচে তোমার আমার লগে ঘুরতে শরম লাগে । শেফা আরো কাছে আসো । আমি তোমার শরম দূর করে দেবো । এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে নূর খালেক একজন প্রেমিক । যার স্পর্শের জন্য অনাদিকাল অপেক্ষায় থেকেছে ।
দুটো হৃদয় কাছাকাছি এসে নিবিষ্ট হতেই শরীরে লোমকূপে উদ্মাদনায় তরঙ্গে দুকুল ভাসিয়ে প্লাবন প্রবাহিত হয় । মানবে না কোন বাঁধা কেবল অথৈই প্লাবন । হঠাৎ বাচ্ছার কান্না শুনে শিউলী ঘুম চোখে ডান হাতের স্পর্শে ছেলের নকশী কাঁথার ছোপ ছোপ পানির স্বচ্ছ ধারা । তাড়াতাড়ি জবজবে ভেজা নকশী কাঁথা পরিবর্তন করে । কচি দুটো ঠোঁটের স্পর্শে অমৃত পানে আঁচলের নীচে আবদ্ধ । মা এবং ছেলে ঘুমের অতল গহ্বরে আড়াল হয় । এদিকে ভোর আসন্ন । শেফা নিজেকে ছাড়িয়ে শাড়ীটা ঠিক করে । বাড়ীর পথে পা বাড়ায় । শাড়ীর আঁচল টেনে ধরে নূর খালেক । অনেক দিন পর একটু তৃপ্তির স্বাদ পেলাম । লজ্জা রাঙানো মুখে শেফা কিছু বলতে পারেনি । শুধু শরীর জুড়ে কাঁপুনি । এত কাঁপুনি যে কোথায় থেকে আসে নিজেও জানে না ।
সকাল বেলা বিছানা ছাড়তেই শেফালী বুঝতে পারে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে । তখনি মনে পড়ে গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা । তবুও কষ্টে রান্না করে বড়বোনকে সকালে খাবার দিতে যায় । হটাৎ শিউলী জিজ্ঞেস করে শেফা তুই কি রাতে ঘুমাসনি ? চোখ মুখ ফোলা ফোলা ক্যান ? শেফালী মাথা নিচু করে বলে কিছু না আপা । রাতে ঘুমাতে গিয়ে মা-বাবা ভাই সবার কথা মনে পড়ে । আসলে এহানে মেলাদিন আছি । তাই ওদের জন্য মনটা কেমন যেন করে । তাই ঘুম কম হইছে । ও কিছু হবে না । বুঝেছি দাঁড়া । তোর দুলাভাইকে দিয়ে খবর পাঠাব । মা-বাবা যেন আসে । তাহলে তোর ভালো লাগবে । কি বলিস ? জি আপা । তুমি যা ভালো মনে কর । শেফালীর মনে ভয় এবং লজ্জা ঢুকে পড়ে । কি করবে শেফালী বোনকে সব কিছু খোলে বলবে না গোপন রাখবে । অস্থিরতায় ভুগতে থাকে । এভাবে মাসের পর মাস পেরুতে থাকে । এদিকে নূর খালেকের প্রবৃত্তির ক্ষুধা দিন দিন বাড়তে থাকে । শেফালী রাতের পর রাত নিজেকে উজাড় করে । বোনের শিশু পুত্রটা বড় হতে থাকে ।
বড়বোন আগের তুলনায় অনেক সুস্থ । একটু মোটা হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে মুখের লাবণ্যতা বেড়েছে। আর এদিকে শেফালী ধীরেধীরে মলিনতা ও দুর্বলতা বেড়েছে । তলপেটে যেন কারো বসবাস শুরু হয়েছে । মাঝে মাঝে এমন মোচড় দেয় যে, শরীরের নাড়িভুড়ি এখনি বেরিয়ে আসবে । খাবার খেতে পারে না ঠিক মতো । কাউকে কিছু খুলে বলতে পারে না । গোপান কথা গোপন রয়ে গেল । হঠাৎ একদিন সকালে ছোট ভাই সোহেল উপস্থিত । শেফালী বুঝতে পারে সোহেল তাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবে । বিকেলে নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে ভাইয়ে সাথে বাড়ী ফিরে যায় । শেফাকে দেখে মা বলে কি রে , তোর কি শরীর খারাপ ? প্রতিউত্তরে শেফালী না বলে । তাহলে মুখ চোখ এত শুকিয়ে গেছে ক্যান ? শেফা বললো তেমন কিছু হয়নি । আসলে অনেক কাজ করছি । ছেলে জন্য রাত জাগছি আর অনেক দিন পর বাড়ী আসছি । তো তাই তোমার এই রহম মনে হইতেছে । আইচ্ছা যা আর কিছু বলা লাগবে না । ভাত রান্দা আছে খাইয়া ঘুমাইয়া পর সব ঠিক হইয়া যাইবে ।  
আসার বেশ কয়েক দিন পর শেফালীকে ঘন ঘন বমি করতে দেখে । খাবার খেতে দিলে বলে আমার খেতে ভালো লাগে না । ঘরের কাজ তেমন করে না । উদাস হয়ে বসে থাকে । কখনো ঘুমিয়ে থাকে । মায়ের মনে সন্দেহ হয় । পলকা শরীরটা দিনদিন বাড়তে থাকে । পেটটা ফুলে উঠে । হঠাৎ একদিন শেফালী দুপুর বেলা শুয়ে আছে । মা চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে বললো হারামজাদী বল কে তোর সর্বনাশ করেছে ? আইজকে তোকে মেরেই ফেলব । বংশের মুখে চুনকালি দিলি । বিয়ে না হইতে পোয়াতি হইছিস । এই বাচ্চার বাপ কেডা হবে বল ? এই কথা উচ্চারণ করতে করতে সমান তালে মারতে থাকে । শেফালী নির্বাক্ তাকিয়ে আছে । চোখের কোণে কান্নার জল নেই । বাবা মাঠের কাজ শেষ করে দুপুরে বাড়ীতে ভাত খেতে আসে । দেখে শেফালী মাটিতে বসে আছে । মায়ের মুখ থেকে সব শুনে জিভ কামড়ে ধরে । যেন এখনি মৃত্যু হোক । মাটির সাথে মিশে যাক !
এক কান দুই কান করে সমস্ত গ্রামে শেফালী পোয়াতি হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে । পুকুর ঘাটে, কলতলায়, গ্রামের বৌ-ঝিদের ফিসফিসানি শুরু হয় । এমনকি চায়ের দোকানে পর্যন্ত সমালোচনা হতে থাকে । নূর খালেক খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস । প্রথমে মাঠের ফসলি জমি দেখতে যাই। তারপর গোয়ালের বাঁধা গরু , পুকুর পাড় আশে পাশে ঘুরে বাড়ী ফিরে আসে । এসেই ছেলেকে কোলে নেয় । আয়েশ করে বসে চা-রুটি শেষ করে এবং পান চিবুতে থাকে । এমন সময় শশুড়-শাশুড়ী সাথে শেফা । শেফার চোখের নীচে কালি জমেছে । দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ঘুমাইনি । বুকে হাড় ভেসে উঠেছে । কিন্তু পেট ফুলে উঠেছে । শাশুড়ি ঘরে ডুকেই শিউলীকে ডাকে । শিউলী মা-বাবা আর ছোট বোন শেফাকে দেখে বলে তোমরা কহন আইছো ? কেমুন আছো ? মা-বাবা তোমরা বস । বোন শেফা তুই কেমন আছিস ? উত্তরে কেউ কিছু বলে না । সবাই চুপচাপ !
মা শিউলীকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে । ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিলাপ করে আর কাঁদে । মায়ের মুখ থেকে সমস্ত কথা শুনে শিউলী নিস্তব্ধ হয়ে যায় । চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে । এত কিছু ঘটে গেল আমি কিছুই জানতে পারলাম না । মা বলল শেফাকে আমরা কিছুতেই বাড়ী নিয়ে যাবো না । নূর খালেক যখন এক মেয়ে ঘরে থাকতে আরেক মেয়ের দিকে নজর দিছে । নূর খালেক শেফার দায়িত্ব নিবে । শিউলী স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বলে তুমি ক্যামুন পুরুষ মানুষ তোমার কোন ধৈর্য নাই । ঘরে বউ থাকতে তুমি শালীর দিকে নজর দাও । তোমাকে আমি খুব ভালো মনে করতাম । চরিত্রবান মানুষ বলে জানতাম । আর অহন তুমি ভালো মানুষের সুন্দর পরিচয় দিলে ?
আর কথা বাড়াইনি । এভাবে কেটে গেলো কয়েকদিন । করো সাথে কেউ কথা বলে না । বাড়ীতে কোন জনমানব নেই বলে মনে হয় । হঠাৎ ছেলেটা কান্নার শব্দ শোনা যায় । সকালে স্বামী নূর খালেককে উদ্দেশ্য বলে আমি তুমার কাছে থাকতে পারব না । তুমি আমার বইনকে নিয়ে থাক । সুখে সংসার করো । জুঁই আর ছেলেটা তোমার কাছে থাকল । আমি বাড়ী ছেড়ে চলে যাচ্ছি । ভেবো না বাপের বাড়ীতে যাবো । ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যখন মায়ের প্রয়োজন হবে । তখন আমার কাছে যাবে । এই কয়েকটা কথা বলে এক কাপড়ে শিউলী স্বামীর বাড়ী ত্যাগ করে । পরের দিন সকাল বেলা  নূর খালেক আট মাসের পোয়াতি শেফাকে বিয়ে করে । একজনের হৃদয় নতুন কিছু পাবার আনন্দে পূর্ণ হলো । আর অন্যজন সব কিছু পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে গেলো । অন্ধকার কষ্টের অতল গহ্বরে ।

পদবলি

পদবলি


দিনান্তের ব্যবসায়ী হিসেব
ইলিয়াস বাবর

ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে থাকে বাঁধ-
বিশ্বাসের নিগূঢ় দালানে ঢুকে শত্রুসেনা
মিথ্যের দোহাই দিতে দিতে
একদিন টুপ করে, আষাঢ়ে গল্প বুনবেনা!

তা রবীবাবু বলুন, আমার নয়
প্রতিদিনের চাহিদায় থাকে অপূর্ণ সবক-
ক্রমাগত আশ্বাসের বিফলে
সোনালী দিনে কিনে রাখি হাবিয়া-দোযখ!



অতঃপর
রেবেকা ইসলাম

যখন দিন চলে গেল রাতের পিছু পিছু
আলো নিষ্প্রাণ হল আঁধারে
ঠিক তখনই হাতে হাত ধরে
নেমে এল রূপজ্বলা তারাদের দল
এ পাড়ার ও পাড়ার, এ গলির ও গলির
ঝিম ধরে থাকা জড়াক্লিষ্ট সব ছাদে,
হিজিবিজি অন্ধকার ঘরে,
নারীর আঁচলের ঢিলেঢালা খুঁটিতে
অসুখী আবজাব নগরে।

তারপর আনন্দের শঙ্খজলে ভাসল ওরা,
ওরা কয়জনা যৌবনপূজারী
দুরন্ত চোখে যাদের স্বপ্নধরার জাল
কণ্ঠে ঘুড়িওড়া বিকেল
অতঃপর,ঠোঁটের কোণে ফেরারি সুখ নিয়ে
এক সাগর নিদ্রাকে চৃর্ণ বিচূর্ণ করে
জেগে রইল ওরা অনন্তকাল।


                                                   
দাকা-যম
বঙ্গ রাখাল
(উৎসর্গঃ তেভাগা আন্দোলনের সাঁওতাল যোদ্ধা দীনেশ মুর্মকে)

এই যে আসুন, দেখে যান ধানক্ষেত। ধানক্ষেত
যৌবনা হচ্ছে, দুধের গোলায় জমছে দুধ। ধান
থেকে জš§ নিচ্ছে অজস্রচারাগাছ। মাটি ভেদ
করে গান গাইতে গাইতে জš§ নিচ্ছে যত সব
পাতারি ধানের নীলহলুদ পাতাগাছ।

গান হয় শরীরে, মনে, হৃদয়গভীরে।
বৃক্ষপত্রে কথা হয়, নদী মিতালী খোঁজে
বীজের অঙ্কুরে।
কৃষক দাকায় তৃপ্তি খোঁজে অলসদুুপুরে হেলেপড়া রৌদ্রে।
যমের যোনী বেয়ে বের  হয়ে আসে সোনালীবাদামীভোর।
দাকাযম পেয়ে উল্লাসে সাজে কাগজের স্বেতকুকুর
গান হচ্ছে, কোথায় গান?
চোখে-মুখে একটা বিষণœসুখ
আমি অবাক
কোথাও ঝামেলা করোনা।
শহুরে মানুষ কি পারে গান শুনতে?
এ চাষাঢ়ে গান আমরা শুনি যারা গ্রামে থাকি...



ঘনীভূত শূন্যতা
বজলুর রশীদ

যুবতী চাঁদের গায়ে অমৃত ফুলের স্বাদ;
অসভ্য লালসার বেহায়া প্রজাপতির দল-
চুমু খায় বিশ্বাসের রাজত্বে।

প্রত্যাশার স্বপ্নযুগল নয়ন অবিশ্বাসের পরিসরে
পাড়ি দিয়েছি আরণ্যিক সময়;
আলোকবর্ষ থেকে অনেক দূরে
অমাবস্যার দরজায় দাঁড়িয়ে।

স্বার্থপরতার প্যাঁচে
ভোরের সিতানে অপেক্ষার পরতে পরতে
হতাশায় কেটেছে কতদিন, কতমাস,
এভাবে বছরের পর বছর।

অতঃপর অসময়ে গোধূলির রঙ মেখে
জোছনানিশি খেলা যদি খেলতে চাও
তাহলে শৈশব উল্লাস ফিরিয়ে দাও?

অতৃপ্ত বাসনায় ডুব সাগরে সাঁতার কেটে
জন্মেছে ভালোবাসার শেষকৃত্য ।
নিস্তদ্ধতার নিরিখে নিরাপদ জোছনা-তারা
কিংবা ভোরের প্রত্যুষে
চাই না  কসমেটিকস সময়ের ফেলে আসা দিনগুলো;
তোমাকে ফিরে দিলাম নষ্টজলের কাদা সাঁতারে।
আর আমায় নিঃশব্দ নিরালায়
ঢেলে যাও আরণ্যিক সময়ে;
বিপদ ঘনীভূত শূণ্যতার গ্রাস।



রাস্তাকে আঁকড়ে ধরেছি
সুজিত মান্না

ছায়াহীন দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু অচেনা লাগে
দেওয়ালগুলো বলে ওঠেÑ
যেভাবে জোনাকি ডেকে প্রেমের গল্প সাজাই
একদিন ¯্রােতে ভেসে আমি কৃত্রিম হয়ে যাবো

এভাবে বারবার এমন দেওয়াল গড়ে উঠতে দেখেছি
আমি কি দিনদিন কৃত্রিম হয়ে উঠছি ?

আমার অপেক্ষার কষ্ট একটু বেশিই’ লেখা আছে
উল্টেপাল্টে সেখানেও আশ্রয় নেয়
                                                কিছু মাকড়শার গল্প ।

আমিই সেই দূরে থেকে যাওয়া জোনাকি
রোজ পশুদেরদের জলাশয়-পরিচিতি দিই
অথচ তাদের আপন ছায়ায় উঠি না...

আমি আসলে এমনই একটা মেঘ
যাকে দেখলে শুকনো জলাশয়ও বিদ্রুপ করে ওঠে
দূর্বা ঘাস ফিরেও তাকায় না...

অফিস বেলার সকাল দুপুর, গঙ্গার বিকেল
কিংবা প্লাবনভূমির রাত্রি ধরে,
                                       আমি হেঁটে চলি তবু...
মুখ তুলে , আমার শূন্যতা দেওয়াল ছুঁয়ে নিয়েছে

হারানোর সত্যিই কি কিছু আছে ?


প্রেম
নূর নিহাল

মুখে জমানো এক দলা থু থু আমার অহংকার
চারপাশ উলঙ্গ- উদাম শরীরকেও মনে হয় শ্রেষ্ঠ পোশাক
ভাতের আগুনে পুড়ে যাওয়া কুঁচকানো মানচিত্র
দু’বেলা দুঃখ- মাংসল হাসি
রোমালে ঢেকে মুখ- আহা! আত্মার অসুখে পুড়ি

তাবৎ ফুল নরম আগুনের জাত
সমুদ্র যেমন মাটির আপন বোন
ওসব গর্দভ গৃহস্থ আমাদের নতমুখ
দূরবীনে পুড়ে যাচ্ছে দূর্বাঘাসের চোখ,
পাপই প্রেম- আঘাতই আগুনের শ্বাস
অসময়ে বেজে যাই ঘৃণার তালুতে
জাতের মুখোশে থু থু ছিটাই...


কাটেনা আঁধার, দিন কেটে যায়
মাহবুবা নাছরিন শিশির

ভেতরে-বাইরে দুর্যোগ খুব পরিত্রাণের নেই উপায়
চলতে চলতে থেমে যায় গতি বেড়ি দিলো কে দু’পায়!
আষাঢ়ে বৃষ্টি,  শ্রাবণে বৃষ্টি, শরতে বৃষ্টি, নাই নিস্তার,
কার্তিকে ফের ভয় সংকেত কী করে হবো এই পথ পার!
ঘনিয়ে আসে কালো মেঘমালা আমার পথের কিনারায়
অঝর ধারায় ঝরে পড়ে জল অদৃশ্য কারোর ইশারায়।
ধোঁয়াশা জলে দ্বিধা জাগে মনে ডুবে যায় যেন কোন শঙ্কায়
ডুবে যাই জলে, ডুবে যাই ধীরে, ডুবে যাই ভীত মন-গঙ্গায়।

জীবনের পথে ঘোর মুসিবতে হাত-পা অচল আমি নিরুপায়
দিকভুলো হয়ে থমকে দাঁড়াই রঙহীন এই ম্লান-তমসায়।
ঠোঁট নড়ে কার, কোন দাদীমার সুদূরের বাণী নিকটে গড়ায়
‘কালা মেঘে নালা পানি, ধলা মেঘে গলা পানি’ শ্লোকে-ছড়ায়।
বদলে যাচ্ছে ঋতু পরিক্রমা বিপদের ঘোর ঘনঘটায়
কাটেনা আঁধার দিন কেটে যায় এক-দুই-তিন-চার ঘনায়।
মাঠ-ঘাট-ডোবা মুখরিত আজ ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যা নামায়,
দশ দিকে দশ প্রহরণ আর ইসরাফিলের শিঙা বাজায়।

কেয়ামত কবে আসবে জানিনা এ তুফান-ঝড় স্মরণ করায়
আমাকে তবুও থাকতেই হবে একটি ভোরের অপেক্ষায়।
মেঘ কেটে গিয়ে ভরবে সেদিন সোনালি রোদের রূপালি আভায়,
এই ঘোর রাতে খোয়াব দেখেছি, তাই’তো আমায় আবার ভাবায়।
 

জলচিত্র
পরান জহির

জলছায়ায় আরো একবার
এঁকে দাও জলচিত্র,
পাঠ করো জললিপি স্বর।

সুগঠিত পল্ললে উত্তীর্ণ হোক
মৃৎ কারুকার্য,
দিগন্ত রেখা নিয়ে বাঁচুক পাঁজর।

পাতারেখার ভাজে ভাজে
বর্ণিল হও,
মৃত্যুর মৃত্যুকে ছিঁড়ে।

জয় করে নাও পৃথিবীর
মাটি ও আকাশ,
সৌকর্য ফিরুক পাখিদের নীড়ে।

গল্পটি শুনতে চেয়ো না- কিস্তি ০৭

গল্পটি শুনতে চেয়ো না- কিস্তি ০৭
  
গল্পটি শুনতে চেয়ো না
 সোহেল নওরোজ

এই পর্যায়ে এসে বেশ নির্ভার বোধ করেন হাফিজুল হক। অনেকটা গাড়ি রানওয়ের ওপর তুলে দেওয়ার মতো অবস্থায় আছেন। তিনি স্টার্ট চালু করে লাইনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য খুব বেশি তাড়া নেই। স্টেয়ারিংটা নিজের হাতে রেখে কমান্ড ঠিকঠাকমতো দিলেই হলো। গাড়ি নিজের মতো চলবে। শর্ত একটাই, কেবল নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে হবে। তিনি কি কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কায় আছেন? কখনোই যা বোধ করেননি, না চাইলেও অজানা সেই শঙ্কাটাই ঘুরেফিরে তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে। তবে তিনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মামুলি কেউ না। শুরু যখন করেছেন, শেষও করবেন এক হাতে। হাতের প্রসঙ্গ এলেই আরেকটা হাতের ব্যাপারটা তার মাথায় আসে। কেন জানি হাতটাকে তিনি অনুভব করছেন কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পেলে একটা সুবিধা হতো, তিনি হাতটার একটা চিত্র আঁকতে পারতেন। তাতে কি খুব লাভ হতো? মানুষকে চেনার জন্য তার একটা হাত কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। একবার হলেও তাকে দেখতে হয়। তিনি কি কখনো অনুভূত হাতের মানুষটাকে দেখেছেন?

নাহিদ নিজের মতো চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার সিদ্ধান্তে প্রভাবক হয়ে আসেনি কেউ। না কবিতা, না তাহিয়া। নিজের চাওয়াকে মজবুত করতে কখনো কখনো দূরত্ব খুব কাজে দেয়। এই দূরত্বের ব্যাপারটা হাফিজুল হকের ক্ষেত্রেও অনেকবার ঘটেছে। তিনি নিজে যেমন দূরত্ব তৈরি করেছেন, তেমনি আবার অন্যের সৃষ্ট দূরত্বের কারণে তাকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। নাহিদের বড় সুবিধা হলো, তার ওপর কেউ এটা চাপিয়ে দেয়নি। বরং অন্যের চাওয়ার বিপরীতে হেঁটেই তাকে এটা বেছে নিতে হয়েছে। তাতে হয়তো মন খারাপের মতো অনুসঙ্গ এসে পড়ে কিন্তু জীবনের হিসেবের কাছে ধরা দেওয়া সহজ হয়। মত আর অমতের দ্বন্দ্বের পরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব পুষে না রেখে হীনমন্যতা পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলার আরেক নাম জীবনÑতা কে না জানে!

হাফিজুল হকের হাতে নাহিদের দুই নম্বর ছবি। আগেরটা শৈশবের, এটা যুবক বয়সের। বয়সের তারতম্য খুব বেশি না হলেও কিছু বদল সহজেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তিনি দুটি ছবি পাশাপাশি রাখেন। কী কী পরিবর্তন এসেছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অর্পা অবশ্য এ কাজটা সহজ করে দিয়েছে। ঝানু শিক্ষকের মতো পয়েন্ট আউট করে দেখিয়ে দিয়েছে ছবি দুটোর মিল-অমিল। সেগুলো একত্র করলে এমন একটা অনুসিদ্ধান্ত দাঁড় করানো যায়।
আগের ছবির সারল্যের ত্রিশ শতাংশ এ ছবিটাতে নেই। তার মানে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদের ভেতর থেকে সারল্যের উপাদানগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
চেহারার মায়াবী ভাবও অনেকটা কমেছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই মায়ার ওপর কাঠিন্যের একটা পাতলা আবরণ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
নিষ্পাপ হাসির স্থলে দৃঢ় একটা সংকল্প প্রতিভাত হচ্ছে। এটা বোধ হয় কাহিনির কারণেই আনতে হয়েছে। পরের অংশ হয়তো তার ভেতর মমতার চেয়ে সংকল্প বেশি দাবি করে। হাফিজুল হক তেমনটাই করতে চেয়েছেন।

কলেজের প্রথম দিনগুলো নাহিদের দুঃসহ লেগেছে। বারবার মনে হয়েছে জীবনের এ পর্যায়ে এসে সে বড় একা এবং নিঃসঙ্গ। অনিকেতের মতো কেউ পাশে থাকলে তার পথচলায় এমন নিঃসঙ্গতা জুড়ে বসত না। অনিকেত একাাই তাকে আগলে রাখত। অনিকেত না হয়ে কবিতা এবং তাহিয়া বা তাদের দুজনের যে কেউ থাকলেও এই অনুভূতির হেরফের হতে পারত। তারাও মায়ার অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রাখত। অনিকেতকে পাশে পাওয়া সম্ভব নয়, কিংবা সে হয়তো পাশে না থেকেও প্রবলভাবেই আছে! কিন্তু কবিতা? আর তাহিয়া! তারা যে পাশে থেকেও নেই! জীবনের কিছু পথ একাই চলতে হয়। বোধ করি নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যই একাকীত্বের পথ ধরে চলতে হয় কিছু দূর, বেশ কিছু দূর! কতদূর তা এ মুহূর্তে নাহিদের জানা নেই।

শুরুর অস্বস্তি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠে নাহিদ। পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য কয়েকটা টিউশনি আর একটা কোচিংয়ে ক্লাস নেয়। তার পরিশ্রম হয়, তাল মেলাতে কষ্ট হয়ে যায়, তবু দিনশেষে এক ধরনের মানসিক স্বস্তি সঙ্গী হয়। এটাই তাকে বেশ কিছুটা প্রশান্তি দেয়।
যে মেসে থাকে সেখানে নাহিদ সবার ছোট। এ বিষয়টা তার পক্ষে গেছে। সবার ¯েœহের ভাগ যেমন পেয়েছে তেমনি বাড়তি কিছু দায়িত্ব থেকেও তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রথম তিন মাসে তাকে একদিনও বাজারে যেতে হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেয় সবাই। তার পড়ার টেবিল ছোট হলেও আলাদা। পড়ার সময় অন্যরা পারতপক্ষে তার রুমে আসে না। রুমমেট মমিন ভাই তাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখে। কিছুদিন আগে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছে। সময়ের মূল্য সবচেয়ে বেশি। এই ঘড়িটা সে কথায় তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে বলে মমিন ভাইয়ের বিশ^াস। পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি তাকে সম্পৃক্ত করেন। সামনে তার ছোট বোন মোহনার বিয়ে। মমিনের কিছু দায়িত্ব নাহিদের ওপরেও এসে বর্তেছে। সে এতে যারপরনাই খুশি হয়েছে। ভেতরে এখন থেকেই একধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

কয়েকদিন যাবৎ একটা বিষয় লক্ষ করছে নাহিদ। কলেজের কিছু বড় ভাই তাকে বেশ সমাদর করে। সেটা বিশেষ কারণে। তারা প্রত্যেকেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একেকজন একেক দলে। তাকে নিজেদের দলে ভেড়াতেই তারা নানা কৌশল অবলম্বন করেছে। দু-একজন ইতিমধ্যেই নানা প্রলোভন দেখিয়েছে। নির্বাচিত হলে ভালো পদ দেওয়ার কথা বলেছে। স্যারদের বেশি নম্বর দিতে বাধ্য করার কৌশলের কথা জানিয়েছে। অবিশ^াস হলেও সে বিশ^াসের ভঙ্গিতে সব কথা শুনেছে। হ্যাঁ-না কিছু বলেনি। ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগে কাউকে কথা দেওয়া উচিৎ নয়। মমিন ভাইকে কথাগুলো বলেছে। তিনি তাদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পড়াশোনায় ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু না করাই শ্রেয়। সে সেটা বোঝেও। তবে নাহিদের চিন্তা অন্যখানে। চাইলেই কি সে তাদের থেকে দূরে থাকতে পারবে? একবারে ‘না’ বলতে পারবে? তারাও কি তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেবে? ভালো ছাত্রের তকমা লেগে যাওয়ার কিছু সুবিধা যেমন আছে, তেমনি মারাত্মক কিছু সমস্যাও রয়েছে। সে তেমন একটা অসুবিধার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

গল্প- ঋণ

গল্প- ঋণ


ঋণ
ফাহমিদা বারী

আওয়াজ টা ভেসে আসছে এদিক থেকেই। একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ। গগনবিদারী চিৎকার। মাসুম শিশুর বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস।
ময়লা কুড়ানোর পলিথিনটাকে মুখের কাছে গিঁট দিয়ে পেটিকোটের ফিতার সাথে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে করিমন। এভাবে বাঁধলে হাঁটতে সুবিধা হয়। এবড়োথেবড়ো পথটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র নুড়ি, ভাঙা শামুকের খোল...বাবলার কাঁটাযুক্ত ঝাড়। পা কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে করিমন নেসার। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে সে হেঁটে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে। তার বুকের মধ্যে যেন ঢাক পেটাতে শুরু করেছে সেই শিশুর কান্না।
পড়ে থাকা একটা বড় গাছের ডাল সরাতেই চোখে পড়লো একটা লাশ। ছিন্নভিন্ন। মাথার খুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছুটা মগজ। চোখ সরিয়ে নিলো করিমন। আরেকটু দূরে পড়ে রয়েছে আরো গোটা পাঁচ ছয়েক এমনি ছিন্নভিন্ন লাশ। বোঝা যায় বেশ কয়েকদিনের পুরনো। লাশের গায়ে পচন ধরেছে, গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। সারাদেশই এখন এমন হাজার হাজার লাশের ভাগাড়। কত লাশ সরাবে মানুষ!
শিশুটির কান্না এখনো থামেনি। তবে এখন কাঁদছে কিছুটা বিরতিতে, থেমে থেমে। করিমন নেসা হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিলো। সামনে একটা ভাঙা পোড়ো ইটের ঘর দেখা যাচ্ছে। কান্নাটা ভেসে আসছে ওদিকটা থেকেই।
দিনের এই ঝকঝকে আলোতেও ঘরের ভেতরটাতে আলো আঁধারির খেলা। সেই আবছা আলোতেও করিমন দেখতে পেল মেঝেতে পড়ে রয়েছে ফুটফুটে একটা শিশু। শরীরে সদ্য পৃথিবীতে আসার চিহ্ন এখনো পরিষ্কার। দেখে বুঝলো শিশুটি মেয়ে। করিমন তার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শিশুটিকে ঢেকে নিলো। করিমনের দু’বছরের সন্তান এখনো বুকের দুধ খায়। বুকে তাই দুধ জমা আছে। শিশুটিকে বুকের কাছে তুলে নিলো সে। তৃষ্ণাকাতর শিশুটি প্রবল বেগে খুঁজে নিলো দুধের উৎস। চোঁ চোঁ করে টানতে লাগলো।
এদিক সেদিকে তাকিয়ে শিশুটির মাকে খুঁজতে লাগলো করিমন। বেশিক্ষণ লাগলো না খুঁজে পেতে। ঘরের এককোণায় রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন শরীরে পড়ে আছে একটা শরীর। বুকের কাছে বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিভৎসতা। সন্তান জন্মদানের চিহ্নস্বরূপ পরনের শাড়িটি রক্তে মাখামাখি। চোখ দুটো খোলা, প্রাণহীন।
শিশুটিকে বুঝি বুক খুলে স্তন্যপান করাতে চেয়েছিল। হারামজাদারা তাই বুকজোড়াকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। শিশুটিকে রেখে গেছে দয়া দেখিয়ে নয়, নিষ্ঠুর পরিহাস করতে।
করিমন এগিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিল নারীটির চোখের পাতা। আঁতিপাতি করে দেখতে লাগলো তার রক্ত জবজবে শরীরটা। তারপরে কিছু একটা খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে উঠলো সে। রেখে দিল নিজের আঁচলে গিঁট দিয়ে।
তারপরে বাচ্চাটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে এদিক সেদিকে আরেকবার দেখে নিয়ে ফিরে এলো নিজের ডেরায়। তার সন্তানটি তখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে মাটিতে শুয়ে কাঁদছে।
করিমন শিশুটিকে শুইয়ে দিল নিজের সন্তানের পাশে। যতœমাখা হাতে পরিষ্কার করে দিতে লাগলো তার শরীরের রক্ত আর পিচ্ছিল আঠালো পদার্থ।
তার বাচ্চাটি তখন কান্না ভুলে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে এই নতুন আগন্তুকের দিকে। করিমন স্বচ্ছ হাসিতে চারদিক আলোকিত করে বললো,
‘তোর বুইন। হ্যার নাম দিলাম আন্না।’ তারপরে ছড়া কাটতে লাগলো সুর করে,
‘এন্না পাতা ভেন্না পাতা...চিরল চিরল গা...ভেন্না পাতায় বসত করে ছোট্ট সোনার ছা...
চল্লিশ বছর পরে
এ্যানা ক্লান্তিহীন পায়ে হেঁটে চলেছে। মাঝে মাঝে থেমে যে একটু পানি খেয়ে নেবে সেই সময়টুকুও যেন তার নেই। প্রতিটি মুহুর্তকেই সে কাজে লাগাচ্ছে। আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সে খুঁজে চলেছে একটি নাম। আর সেই নামের পেছনে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষকে।
দশ বছরের সুলতান মহা বিরক্ত হয়ে তাকে অনুসরণ করছে। শুরুতে সে যতোটা আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, তার সেই উত্তেজনা ফুরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। মনে করেছিল, মেম সাহেব দুদিন খুঁজবে। খুঁজে পাবে না জানা কথা। আর তারপরই খোঁজখুঁজিতে ক্ষ্যান্ত দিয়ে ফিরে যাবে। মাঝখান থেকে সে নিজে কিছু মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়ে নিতে পারবে। কারণ, সফল না হলেও তো আর টাকা না দিয়ে যাবে না! এইসব বিদেশী লোকজন খুব ভালো হয়। এরা সহজে ঠকায় না।
কিন্তু তার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগেনি। এই মেমসাহেব নিজেও পাগল, তাকেও এই ক’দিনে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। যেখান থেকে যে তথ্য পাচ্ছে, তার পিছনেই ছুটে চলেছে। সুলতানকে রেখেছে পথঘাট চিনিয়ে দেবার জন্য। সুলতান মাঝে মাঝে তাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েও ক্ষ্যান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইনি যেন পণ করে এসেছেন, দেখা না করে ফিরবেন না।
এ্যানা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তার গার্ডিয়ান মিসেস সুজানা ক্লিভস তার মৃত্যু শয্যায় তাকে একটা আংটি আর একটা ঠিকানা ধরিয়ে দেয়। কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,
‘আমি এর কাছ থেকেই তোমাকে এনেছিলাম। আমি তাকে সামান্য কিছু অর্থ দিয়েছিলাম। সে তা রাখতে চাইছিল না। কিন্তু তার স্বামী টাকাটা রেখে দেয়। সে ছিল একজন অতি দরিদ্র মহিলা। ময়লা আবর্জনা ঘাঁটতো আর সেখান থেকে বিক্রি করার মতো কিছু পেলে সংগ্রহ করে দোকানে বিক্রি করতো। সে এই ঠিকানাতে থাকতো। আমি জানি না, এখনো সে সেখানে আছে কী না। সে আমাকে তোমার সম্পর্কে সামান্যই বলেছিল। তুমি যার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলে সে তোমার জন্মের পরেই মারা যায়। তুমি জন্মেছিলে সে দেশের যুদ্ধের সময়। আর এই আংটিটা তোমার মা’র কাছে ছিল। সেই মহিলা তার স্বামীর কাছ থেকে এটাকে লুকিয়ে রেখেছিল। তুমি বড় হলে তোমাকে দেবে এই আশায়, তোমার মৃতা মায়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।’
সুজানা ক্লিভসের কাছ থেকে আংটি আর ঠিকানাটা নেয় এ্যানা। সেখানে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের ঠিকানা লেখা। ঠিকানাটি ইংরেজীতেই লেখা। তাই সে বুঝতে পারে।
এ্যানা সুজানাকেই তার মা’র মতো মনে করেছে। তিনি ছিলেন সন্তানহীনা। এ্যানাকে বড় করেছেন নিজের সন্তানের মতোই। কিন্তু তার কাছে তিনি সত্য গোপন করেননি কখনো, যেটা চাইলেই করতে পারতেন। বিবেকের একটা কোনো টানে তিনি এ্যানাকে জানিয়েছিলেন, তিনি এ্যানার প্রকৃত মা নন। তার মা বাংলাদেশ নামের একটা ছোট্ট দেশের মানুষ। সেই দেশের জন্মলগ্নে এ্যানার জন্ম হয়েছে।
এ্যানা সুপ্রতিষ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় ল’ফার্মের সে একজন নামকরা লইয়্যার। তার স্বামীও একজন লইয়্যার। ওদের ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে। এ্যানার স্বামী মার্কিন। তার কাছে এ্যানার প্রকৃত পরিচয় গোপন ছিল না। তিনি সব জেনেশুনেই এ্যানাকে তার জীবন সঙ্গী বানিয়েছিলেন।
এ্যানা তার স্বামীকে জানায়, সে বাংলাদেশ যেতে চায়। হয়তো তার মা’র পরিচয় সে বের করতে পারবে না, কিন্তু যে মানুষটি তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে তাকে সে একবার দেখতে চায়। তার হাত ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়। এ্যানার স্বামী সংবেদনশীল মানুষ। তিনি না করেননি।
বাংলাদেশে নেমে এ্যানা প্রথম যে সমস্যাটি বোধ করে তা হচ্ছে ভাষা। সে মোটেও বাংলা জানে না। তবে এ্যানা বুদ্ধিমতী। সে জানে কীভাবে অপরিচিত দেশে অজানা ভাষায় টিকে থাকতে হয়। সে প্রথমেই যোগাযোগ করে আমেরিকান এ্যাম্বেসীর সাথে। তারা তাকে ভালো কিছু গাইড সাজেস্ট করে। এ্যানা দুদিনেই বুঝতে পারে এদের কাউকে দিয়েই তার আসল কাজ হবে না। সে যা চাচ্ছে তা তো মোটেও সহজ কিছু নয়। কোনো গাইডই তাকে ঢাকা শহরের অলি গলি বস্তি এত সময় নিয়ে দেখাবে না। তারা ব্যস্ত। এত সময় তাদের কারোরই নেই। তখন সে এদের একজনের কাছেই এই সুলতানের সন্ধান পায়।
সুলতান খুব চালু ছেলে। ইয়েস নো ভেরি গুড টাইপের অল্প বিস্তর ইংরেজিও জানে। এ্যানা’র মনে হয় তার কাজের জন্য এই ছেলেই উপযুক্ত।
যেটুকু তথ্য এ্যানা’র কাছে আছে তা যৎসামান্য। একটা বস্তির ঠিকানা আর সেই মহিলাটির নাম। এ্যানা সেই ঠিকানাতে প্রথমেই হাজিরা দিয়েছে। সেখানে এখন সুউচ্চ ভবন। এ্যাপার্টমেণ্ট। সেই এ্যাপার্টমেন্টও নাকি তৈরি হয়েছে দশ বছর আগে। এ্যানা এ্যাপার্টমেণ্টের বিল্ডার্স কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে। তারা এ্যানার কথা শুনে হাঁ হয়ে বসে থাকে। একজন ভুলভাল ইংরেজীতে বলে,
‘ম্যাডাম, সম্ভাবনা খুবই কম আপনি যাকে খুঁজছেন তাকে আদৌ খুঁজে পাবেন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের কথা। সেই মহিলা বেঁচে আছে কী মরে গেছে কে জানে! আপনার গার্ডিয়ান কাদের মাধ্যমে বাচ্চাটির সন্ধান পেয়েছিলেন তাদের খোঁজ জানা গেলে ভালো হতো।’
ভালো প্রস্তাব। এটা বেশ মনে ধরে এ্যানার। একটা চ্যারিটি মিশনারীর মাধ্যমে এ্যানার গার্ডিয়ান সুজানা ক্লিভস এ্যানার সন্ধান পেয়েছিলেন। এটার নাম তিনি এ্যানাকে আগেই বলেছিলেন। এ্যানা তাদের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারাও খুব বেশি কিছু উপকার করতে পারেন না। সব শুনে বলেন,
তখন যিনি এই চ্যারিটি মিশনারীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি মারা গেছেন। তারা যুদ্ধের সময়ে ও পরে জন্ম নেওয়া বেশ কিছু শিশুকে সন্তানহীন এবং দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতিদের কাছে দত্তক দিয়েছিলেন। এ্যানা হয়তো তাদেরই একজন।
কিন্তু এ্যানার জিজ্ঞাস্য ভিন্ন। তাকে যে মহিলাটি এখানে নিয়ে এসেছিলেন তার কোনো সন্ধান তাদের জানা আছে কী না। তারা একটা বড় রেজিস্ট্রার খাতা খুলে বসেন। আশাহত হতে হয়। সেখানে ১৯৭৪ এর পরে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা আছে। এ্যানা প্রচণ্ড নিরাশ গলায় জানতে চাইলো,
‘এর আগের কোনো রেজিস্ট্রার নেই?’
এ্যানার ব্যাকুলতার কারণেই হয়তো তারা আরো খুঁজে দেখতে সম্মতি জানান। এ্যানা অপেক্ষা করতে থাকে। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। একসময় তাকে জানানো হয়, খুঁজতে একটু সময় লাগছে। পুরনো কাগজপত্র অনেক নীচে চাপা পড়ে আছে। এ্যানা একদিন পরে যোগাযোগ করলে তাদের জন্য সুবিধা হয়।
এ্যানা তিন সপ্তাহের ছুটিতে এসেছে। ইতিমধ্যেই একসপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আর আছে মোটে দুই সপ্তাহ। এর মধ্যে সন্ধান না পাওয়া গেলে এ্যানাকে হয়তো ব্যর্থ হয়েই ফিরে যেতে হবে। সে তাদের কাছে অনুরোধ জানায় একটু দ্রুততার সাথে খুঁজে দেখার জন্য।
মাঝের এই একদিনেও বসে থাকে না এ্যানা। যুদ্ধশিশু বা যুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের তৎকালীন সমাজকল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে বাইরে বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে পাঠানো হতো যা বর্তমানে ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর’ নামে পরিচিত। বেশ কিছু তথ্য সে পায় এ্যাম্বেসীর মাধ্যমে। সেখানে গিয়েও খোঁজ নেয় এ্যানা। করিমন নেসার কোনো সন্ধান তারা দিতে পারেন না। যেসব শিশুকে মিশনারীজ অফ চ্যারিটির মাধ্যমে দত্তকায়ন করা হয়েছে তাদের কোনো তথ্য সেখানে নেই।
পরদিন এ্যানা আবার ফিরে আসে সেই চ্যারিটি মিশনারীতে। তারা এ্যনাকে এবার পুরোপুরি হতাশ করে না। করিমন নেসা নামক একজন মহিলা একটি শিশুকে একবার তাদের কাছে নিয়ে আসে। সেটা যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পরে। তার নাম এবং ঠিকানা তাদের কাছে নথিবদ্ধ আছে। একটা অতি পুরাতন ফাইলে।
এ্যানা সেই ফাইলটি খুলে দেখে। হুবহু এই ঠিকানাটিই তার হাতেও ধরা রয়েছে। তবে একটা নতুন জিনিস খুঁজে পায় সে। প্রায় হলদে হয়ে আসা একটা সাদাকালো ছবি। সেখানে একজন মহিলার কোলে একটা ছোট্ট শিশু। দেড় দু’বছর বয়স। মহিলাটির পাশে একজন লোক। সম্ভবত তার স্বামী। ছবিটির উপরে তারিখ দেওয়া। শুধু সালটা বোঝা যাচ্ছে, ১৯৭৩।
এ্যানা তাদের কাছে অনুরোধ জানায়, এই ছবিটি তাকে দেওয়ার জন্য। প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেও একসময় তারা ছবিটি এ্যানাকে দিতে রাজী হন।
চ্যারিটি মিশনারী থেকে বেরিয়ে এ্যানা কিছুটা আশান্বিত হয়। অন্ততঃ তার কাছে এখন একটা ছবি আছে। যদিও দীর্ঘ পুরনো সেই ছবির মানুষকে এখন আর বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তবু আশা ছাড়তে রাজী নয় এ্যানা। এই আশাটুকুই তো তাকে নিয়ে এসেছে এত দূরে...এত বছর পরে।
আরো আগে আসতে পারতো এ্যানা। কিন্তু সুজানার মৃত্যুর পরেই সে যেন প্রথম উপলব্ধি করে জীবনের তাৎপর্য। বেঁচে থাকার মর্মার্থ। আর এই বেঁচে থাকাটা সম্ভব হয়েছে যে মানুষটির কারণে, তার ঋণের ভার সে যেন আর বইতে পারছিল না। তার হাত ছুঁয়ে একবার সে শুধু তার প্রাণভরা কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়।
এ্যানা সুলতানকে ছবিটা দেখায়। কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না তার। না হওয়ারই কথা। এই জনবহুল শহরে এমন হাজার হাজার করিমন নেসার বাস। তাদের বহু অতীতের কোন ছবি দেখে বর্তমানের কোনো কিশোরের মনে কোনো রেখাপাত হওয়ার কথা নয়।
সুলতানের ধৈর্য শেষ। তার বোঝা হয়ে গেছে যে সে এক মহা গাট্টায় পড়েছে। তার স্টকের সেরা ইংরেজী বের করে সে এ্যানাকে বলে,
‘নাইস মিট। নাউ আই গো। মাই মানি।’
এ্যানা সুলতানের মনোভাব মুহুর্তেই বুঝে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘নো নো প্লিজ স্টে। অকে আই উইল গিভ ইয়্যু মোর মানি...’
বলে সুলতানের হাতে ধরিয়ে দেয় কয়েকটি পাঁচশো টাকার নোট। সুলতানের চোখ চকচক করে ওঠে। মন ভরে ওঠে খুশিতে। নিজের মনকে সান্তনা দেয়, হোক একটু ত্যাড়া। মানুষ ভাল আছে। সুলতান থেকে যায়। আবার খোঁজ শুরু হয় এই বস্তি থেকে ঐ বস্তি।
দেখতে দেখতে চলে যায় আরেকটা সপ্তাহ। শেষ সপ্তাহের আজ দ্বিতীয় দিন। এ্যানা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, তাকে হয়তো ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে। তাকে এক মহা ঋণের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে একজন মানুষ এই পৃথিবীর বুকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। যার কাছে সে আজীবনের ঋণী। তার মা তাকে জন্ম দিয়েছে, এই মানুষটি তাকে দিয়েছে জীবন।
ধীরে ধীরে সুলতানও জানতে পেরেছে, এই মেমসাহেব এই দেশেই জন্মেছেন। যুদ্ধের সময়ে। তাকে যে বাঁচিয়েছিল, সেই মানুষের খোঁজেই তিনি এখানে এসেছেন। সেই মানুষটার নামও তিনি ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারছেন না। ক্রেমন্নিসা...এই নাম শুনে বস্তির কোনো মানুষ তার সন্ধান দিতে পারছে না।
মনে মনে কেমন একটু কষ্ট লাগে মেম সাহেবের জন্য। আহারে! মা নাই...বাপ নাই...কারা বাপ-মা তাও জানা নাই! তার তো তবু বাপ-মা আছে। রাতে কাজ শেষে ঘরে ফিরে গেলে মায়ের স্নেহের আঁচলটুকু আছে। তার টাকা নাই এই মেমসাহেবের মতো, তবু মা বলে ডাক দেবার মানুষটা তো আছে!
একদিন খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে ভরদুপুরবেলা বস্তির পাশের পথের ধারেই বসে পড়ে এ্যানা। টিপটপ আধুনিক পোশাক পরিহিতা এক মহিলাকে এভাবে পথের ধারে নোংরা পরিবেশে বসে থাকতে দেখে লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে।
এক রিক্সাওয়ালা কাছে এসে হর্ণ বাজাতে থাকে। সুলতান হাঁক ছাড়ে,
‘যাইবো না। ফুটেন।’
রিক্সাওয়ালা তবু ফুটে না। সুলতানের কাছেই জানতে চায়,
‘ঐ কী হইছে?’
‘হেইডা দিয়া আপনের কী?’
‘ঐ ক কইলাম। দিমু নাইলে এক থাবড়া...’
সুলতান তবু চুপ করে থাকে। রিক্সাওয়ালা ক্রিং ক্রিং করতে করতে চলে যায় একসময়।
এ্যানা অশ্রুসজল চোখে তার ব্যাগে হাত দিয়ে মোটা বাণ্ডিলটার অস্তিত্ত খুঁজে পায়। আগামীকাল সকালে তার ফ্লাইট। চলে যেতে হবে তাকে। তার নতুন দেশ, যা তাকে পরিচয় দিয়েছে সেখানে তাকে ফিরতে হবে। কিছু টাকা এনেছিল করিমন নেসার জন্য। কে জানে কেমন অবস্থায় আছে এখন! হয়তো কিছু কাজে লাগতো! এটা তার ঋণের কিছুমাত্রও লাঘব করতে পারবে না এ্যানা জানে...তবু তার মন কিছুটা শান্তি পেত।
অল্প কিছুক্ষণ ভাবে এ্যানা। তারপরে টাকার মোটা বাণ্ডিলটা প্যাকেটসহ তুলে দেয় সুলতানের হাতে। সুলতান বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ্যানা তার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে। তারপর সুলতানের মতো করে বলে,
‘গো স্কুল। রিড... ওকে? আই গো মাই হোম...’
সুলতান তাকিয়ে থাকে এ্যানার চলে যাওয়া পথের দিকে। বাড়িতে ফিরে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে,
‘মা...দাদী...বাপজান...’
সুলতানের চিৎকারে ছুটে আসে সবাই। ওদের পরিবারটি অনেক ঠিকানা পাল্টে গতমাসেই এই ঝুপড়িতে এসে উঠেছে। এখনো কেউ ওদের তেমন একটা চেনে না। সুলতান প্যাকেট খুলে টাকাগুলো মেলে ধরে প্রত্যেকের হাঁ হয়ে থাকা মুখের সামনে। সবিস্তারে খুলে বলে তার টাকা প্রাপ্তির গল্প আর সেই মেমের ক্রেমন্নিসা কে খুঁজে বেড়ানোর ইতিহাস।
সুলতানের দাদী করিমন নেসা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসে সামনে। টাকাগুলো হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে। নাতির গল্প শুনে তার ছানি পড়া চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।
হোটেলে বসে এ্যানা তখন তার ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। হলদে হয়ে আসা করিমন নেসার ছবিটাকে সে পরম যতেœ তুলে রাখে ব্যাগের বুক পকেটে।
যেন ওর নিজেরই বুকের গহীনে...গভীর মমতায়।

কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য

কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য

কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য
অলাত এহ্সান

‘জাতির জীবনের শিল্পশিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। শিল্পশিক্ষার অভাবে আমাদের রুচি গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি দেশপ্রেম। যে শিক্ষা উৎসের দিকে মুখ ফেরাতে সাহায্য করে, যে শিক্ষা মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে শেখায়, যে শিক্ষা মেরুদণ্ড সোজা করে পৃথিবীর পানে তাকাতে শেখায়, সেই শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরে আমি সত্যি গর্বিত।’
আজকের দিনে মুদ্রণশিল্পের প্রসার কিংবা গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির কল্যাণেই হোক, চারুকলা বাণিজ্য যখন বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে লেখা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ওই কথাটুকুর মতো কতজন শিল্পী ভেবেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশেও চারুকলার বিপুল উল্ফনের পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।
ঢাকায় এখন চলছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে পাঁচ দিনব্যাপী ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। গত বছর ঠিক এই সময়ে, এই উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে বক্তৃতারত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। গতকাল বেঙ্গলের ধ্রুপদী মিউজিক্যাল উৎসবে বসে আমার বারবারই মনে হয়েছে, আগত দর্শককে জিজ্ঞেস করি, তাদের এই সংগীত শুনতে শুনতে কাইয়ুম চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে কি না? আমরা এতটাই বিস্মৃতিপ্রবণ, অনেক ক্ষেত্রে অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্নও বৈকি যে এই গুণী মানুষকে ভুলে যাওয়া বিচিত্র কিছু মনে হয় না।
এ বছরের ৯ মার্চ, যখন প্রথম কাইয়ুম চৌধুরী মৃত্যুর পরবর্তী জন্মদিন উপলক্ষে দৈনিকের সাময়িকীর আয়োজনে তাকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন বা লেখাগুলো হলো, তখন আমার মনে হয়েছে, তার অধিকাংশই স্মৃতির চাদরে ঢাকা। এটা হতেই পরে, ৮২ বছর বয়সে একজন গুণী মানুষের প্রয়াণ হলে, চারপাশে তার স্মৃতি গুঞ্জরন তৈরি হবেই। অনেক সময় এই ধরনের লেখায় কাইয়ুম চৌধুরীর আলোয় নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা, কিংবা সময়ের রেখায় তার পায়ের ছাপ খোঁজার দোষে দুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, অনেক আরো গুণী মানুষের মতোই, এই দীর্ঘ জীবনে তাকে ঘিরে যতটা ঘ্যাঙর নৃত্য হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আবার তাকে ঘরানা বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণও হয়েছে, বাস্তবিক অর্থে তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন হয়নি। আমার এই লেখা সেই শুষ্ক নদীতে স্রোত বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো নয়ই, এত স্বল্প পরিসরে ও সাধ্যে আমার তা সম্ভবও নয়, কিন্তু সূচনা সূত্র খোঁজা মাত্র।
ফ্রান্সপ্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, কিংবা তাকে নিয়ে লেখা থেকে জানতে পারি, বিশ্বে আলোচিত শিল্পীদের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে সম্মানীয় এ কারণে যে, তিনিই সম্ভবত একমাত্র শিল্পী যিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং শিল্পকলাও সফল হয়েছে। বিষয়টা দারুণভাবে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। প্রসঙ্গত মনে করা যায়, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় গঠিত চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি তুলে এনেছেন ক্যানভাসে, মুক্তিযুদ্ধের ধারা করেছেন সম্প্রসারিত। মাথায় গামছা বেঁধে গেরিলা যোদ্ধাদের বলিষ্ঠ এগিয়ে যাওয়া তার মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকৃতি। আবার তার আঁকা কৃষকের দৃশ্যের সঙ্গেও এর মিল পাওয়া যাবে। আসলে এর একটা গূঢ় দিক হলো, আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ যতটা দলীয়করণ হয়েছে, সেই অর্থে সাধারণ মানুষের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের কথা হারিয়ে গেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে অন্তত তার বলিষ্ঠ স্বীকৃতি সব সময়ই দেখা যায়। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং তার চিত্রকর্ম মূল্যায়নের জন্য তাকে কি আমরা বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপনে যথাযথ সচেষ্ট হয়েছি?
এখানে প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, ’৫২-র সেই উত্তাল দিনগুলোতে তার সহপাঠী আমিনুল ইসলাম,  মুর্তজা বশীরসহ অনেকেই ছিলেন প্রতিবাদী আয়োজনের নিরলস কর্মী এবং সকল মিছিলের পুরোভাগে। স্বভাবে অন্তর্মুখী হলেও কাইয়ুম চৌধুরীও সম্পৃক্ত ছিলেন তাতে। ষাটের গণ-অভ্যুত্থানে মুখরিত সংগ্রামের শক্তিতে তার চিত্রকলা হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। কোনো প্রতিরোধই তাকে অবরুদ্ধ করেনি। যেখানে যে প্রয়োজনটুকু আবশ্যক, তা করতে এতটুকু পিছপা হননি। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে শিল্পী-সাহিত্যিকরা যখন নিজেদের বিভিন্ন দলভুক্ত করে বিভিন্ন সুবিধা নিতে উৎসাহী হয়েছেন, সেখানেও তিনি নিজেকে বাইরে রেখেছেন। সে কারণে হয়তো, আমার কাছে মনে হয়, আমরা কাইয়ুম চৌধুরীকে বিশ্বে তুলে ধরিনি। আবার এ কথা ভাবাও নিশ্চয়ই অবাস্তব হবে না যে, যে অর্থে তার চিত্রকর্মকে আমাদের দেশে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা অনেক সময় জাতীয়তাবাদী ও স্থূল। ফলে চিত্রকলার আবিষ্কৃত নতুন নতুন ফর্ম ও ধারণা নিয়ে তার যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল তা অনেক সময় হয়ে ওঠেনি। যে কারণে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান নিজের অনগ্রসরতার ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই কাইয়ুম চোধুরীকে বাংলাদেশের শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিনিধি করার চেয়ে, জাতীয়তাবাদের ঘানিই বেশি বহন করিয়েছে।
বাংলাদেশে চিত্রকলা এবং সাহিত্যে একই সঙ্গে যে দুজন দারুণ সক্রিয়, তারা হলেন মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরী।  ব্যাপারটা ঠিক বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বে এর উদাহরণ বেশি নেই। মুর্তজা বশীরের ছোটগল্প ও প্রবন্ধগুলোর সাহিত্য মান এবং  প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দুই-ই আছে। আর কাইয়ুম চৌধুরীর কবিতাগুলো, একটা বিশেষ ধরন তো বটেই, সাহিত্যেরও মার্গ বহন করে। দৈনিকের পাতায় প্রচলিত কবিতার উন্মাদনার চেয়ে অনেক বেশি সেগুলো সমৃদ্ধ। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দুজনকে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার বাইরে দাঁড়িয়ে যথার্থ মূল্যায়ন জরুরি। প্রচ্ছদশিল্পে দুজনের অবদান অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীর উৎকর্ষ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তুল্য ও স্বতন্ত্র।
আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন কাইয়ুম চৌধুরী। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানকে। তার চিত্রকালায় এই দুই মহান শিল্পীর প্রভাব সুস্পষ্ট। ১৯৫৭ সালে তিনি নিজেও ঢাকা গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসর গ্রহণের পরও ২০০২ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনস্টিটিউটে পাঠদান কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি শিল্পচর্চায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬১-৬২)। ওই বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিল্পকলা প্রদর্শনীতে ‘বটম’ শীর্ষক চিত্রকলার জন্য প্রথম পুরস্কার পান। তিনি আরো সম্মানিত হন এর চার বছর পরে পঞ্চম তেহরান বিয়েনালে রাজকীয় দরবার পুরস্কার লাভ করে (১৯৬৬)। স্বীকৃতি অর্জনের এই ধারায় তিনি লাভ করেন শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৮৬), ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা। ২০১৪ সালে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকে ভূষিত হয়েছেন।

আমার খুব বিস্ময় লাগে, কাইয়ুম চৌধুরী ও কামরুল হাসান সম্পর্ক। শুধু শিল্পকর্ম নয়, ব্যক্তিজীবনেও কাইয়ুম চৌধুরীর ওপর পটুয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। মনে করা যেতে পারে, কামরুল হাসান কিশোর সংগঠন মুকুল ফৌজ-এর কর্মী ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি এর প্রধান হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কাইয়ুম চৌধুরীও মুকুল ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শৈশবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তত দিনে এ দুজন সহকর্মী ও সুহৃদ হয়ে উঠেছেন। যে কারণে আমরা দেখি স্বাধীনতার পরে কামরুল হাসান যখন বাংলাদেশের বুটিকস শিল্পের দায়িত্ব নেন, তার আহ্বানে কাইয়ুম চৌধুরী কিছুদিনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন সেখানে। আশির দশকের আগে ও পরে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারিপনার বিরুদ্ধে দুজনেই সক্রিয় ছিলেন। কি বিস্ময়কর! কামরুল হাসান মারা গেলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে। কাইয়ুম চৌধুরীও মারা গেলেন সংগীত উৎসবে বক্তৃতা দেওয়ার সময়। দুজনের মৃত্যুর মিল কাকতালীয় হলেও বন্ধুত্ব ও সংগ্রামের মিল ছিল একই মূল থেকে উৎসরিত। সেই মিল দর্শনের।
কামরুল হাসান বরাবরই কমিউনিজনের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। সরাসরি পার্টির কর্মী ছিলেন। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রজীবন থেকে। তার চিত্রে লোকশিল্প তুলে আনার প্রেরণা এই কামরুল হাসান। তার হাতেই কালো রং দাপুটে শিল্পে ঘুরে বেড়ায় ক্যানভাসে। সেই কালোও চারপাশের ঔজ্জ্বল্য আরো বাড়িয়ে দেয়। এও ঠিক, দর্শনগত দৃঢ়তা না থাকলে কাইয়ুম চৌধুরীর মতো দৃঢ়ভাবে কেউ এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে রাখতে পারেন না।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আজকের দিনে আমাদের দেশে শিল্পী নিজেও যেমন, তাকে নিয়ে লেখালেখি ও মূল্যায়নেও তেমন, তার চিন্তা-দর্শন একপ্রকার নেই করে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। যা শুধু লেখাই নয়, ওই ব্যক্তি সম্পর্কের বোধের জায়গাটাও ধোঁয়াশাপূর্ণ হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাইয়ুম চৌধুরীকে বুঝতে গেলে, মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের তার দর্শনও বুঝতে হবে।  কিন্তু এ ধরনের মূল্যায়ন আমাদের দেশে খুব বেশি নেই।


অণুগল্প- নিঃশব্দ

অণুগল্প- নিঃশব্দ



নিঃশব্দ
তাসনিম মিসমা
জানালার শিক দু’হাতে শক্ত করে ধরে স্নেহা বিছানায় বসে আছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। দু চোখে ঘুম নেই তার। প্রায়শই এমন হয় তার সাথে। ঘুম আসেনা।বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে এক দু ফোঁটা তার মুখে এসে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি বারবার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেয়েটিকে অঢেল চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে আসার আহবান করছে।
কিন্তু স্নেহা তাতে বিন্দুমাত্র সায় জানাতে নারাজ। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখলো । অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো কিন্তু স্নেহা অতি মৃদু কন্ঠে বলল, ‘আমি ঠিক আছি মা। তুমি গিয়ে শুয়ে পরো। কাল আবার রবির স্কুল আছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।’ মা স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,‘কাল শুক্রবার । স্কুল নেই ওর...। তুই রাতে কিছুতো খেলি না। আমি খাওইয়ে দি..?’ ‘ নাহ, থাক আমার খিদে নেই। দেখলেতো বাহিরের দুনিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ’ই নেই...কবে কোন দিন যায় তাও জানি না। বড় বেমানান হয়ে গিয়েছি দুনিয়ার সাথে। তোমাকেও অনেক কষ্ট দিই আমি। আর সহ্য হয় না। অই দিন মরে গেলেই ভালো হতো; তাইনা, মা..?’ এই বলে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো যেন অনেক দিন পর পাহাড়ের বুক চিরে অঝোরে পানি বইতে লাগল। মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে মাও কাঁদতে শুরু করলো আর বলল, ‘কে বলেছে তুই বেমানান, আমাকে কষ্ট দিস, তুই আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে সুন্দর উপহার। তুই না হলে আমি আর তোর ভাই আজ বেঁচে থাকতাম না। দু’বছর আগে যদি তুই আর তোর বাবা নিজের জীবনের বাজি না রেখে বাস এক্সিডেন্টের সময় বাঁচাতি আমাদের তাহলে আজ হয়ত আমরা সবাই তোর বাবার মতোই অকালে মারা যেতাম। তোরা দুই ভাই-বোন আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। খবরদার আর কখনো এমন বাজে কথা বলবি না।’ এতোক্ষণে স্নেহার কান্না থেমে গিয়েছে । পনেরো ষোলো বছরের এই স্বল্প জীবনে যেন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কিছু দেখে ফেলেছে সে। যখনই সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হয় কিছুটা পিছুটান অনুভূত হয় তার। মন থেকে একটা আওয়াজ আসে যে, তার অনেক কাজ বাকি। এভাবে হাল ছাড়লে চলবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, যে মেয়ের একটা পাই নেই সে আর কতোটুকুই বা সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করতে পাড়বে। বাস এক্সিডেন্টের সময় প্রাণে বেঁচে গেলেও সে, মা-বাবা আর রবি আহত হয়েছিল। তার বাম পা প্রচুর আঘাত পেয়েছিল ফলে পরে তার পা টা কেঁটে ফেলতে হয়েছিল। তার সাথে প্রিয় বাবাকেও ডাক্তাররা বাঁচাতে পারেনি।  সে দিনের কথা স্নেহার মনে পড়লেই সারা শরীর শিউরে উঠে। লাগে যেন দেহটা শক্ত হয়ে আসছে।আর সহ্য করা সম্ভব নয়। তবুও হার মানা চলবে না।বাবা তাকে কখনো হার মানতে শেখায়নি। যেখানে আশার বিন্দুমাত্র আভাস পাবে সে ছুঁটে যাবে; তাকে যেতেই হবে।
দু’বছর ধরে নিজেকে সে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। মার দিকে তাকিয়ে স্নেহা বলল,
‘আমাদের সাথেই কেন এমন হলো মা? আমাদেরতো কতো সুখী ছোট্ট পরিবার ছিল। কি অপরাধ ছিল আমাদের? কেনোই বা সৃষ্টিকর্তা এতো বড় শাস্তি দিলো? বলো না, মা?’ মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, ‘সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তিনি আমাদের সহনশীলতার পরীক্ষা নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আগামীতে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। হতাশ না হয়ে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এই বলে স্নেহার মা চোখ মুছতে মুছতে অন্য রুমে চলে গেল। স্নেহা জানে যে, কিছুই আর আগের মতো ঠিক হবেনা। সে তার বিছানার বালিশের নিচ  থেকে ডায়রীটা বের করে লিখতে বসে পড়লো সারা দিনের সব কথা।ডায়রীটাই যেন এখন ওর সবচেয়ে আপন; যা স্নেহার প্রতিটা অনুভূতি,রাগ-দুঃখ নিঃশব্দে, নির্দ্বিধায় বিনা কোনো প্রতিবাদে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখে।

ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা

ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা


ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা
সকাল রয়

সে রাতে মেঝেতে ক’ফোটা রক্ত দেখে আতঁকে উঠেছিলাম!
তখনও ভাবিনি দেখতে হবে রক্তবন্যা। আমার হাত ধরে তুই আর আমাদের ছোট বোন অলকা ঠিক যেন একসাথে কেঁদে উঠেছিলাম। সে চিৎকারে তুই মুখ চাপা দিয়েছিলি। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা বাবার পাঞ্জাবী ভেজা ছিল রক্তে। দেখি মা ঠিক পুতুলের মতো মেঝেতে পড়ে রয়েছে। ঘরদোর এলোমেলো। যেন কোন ঝড় এসে খেলে গেছে তান্ডবলীলা।
বারান্দা পেরিয়ে কলতলায় এসে দেখি পড়ে আছে বড়’দি’র এক পাটি চটি, গতকাল বাবা যেটা খুঁজে খুঁজে কিনে এনে দিয়েছিল বড় বাজার থেকে। আমি শখের সে চটির পানে তাকিয়ে ভাবছি আর এক পাটি কোথায়? আর কোথায় আমাদের বড়’দি।

কিছুটা বিস্ময়ে আমি যখন গেছি তলিয়ে, তুই বললি চল নিষাদ দৌড়ে পালাই! আর এক মুহুর্তও নয়। আমি বলি বড়’দিকে নিয়ে গেছে যে; তাকে কি ফেলে যাব। তুই কিছু বলিসনি শুধু চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিলি কখনো কখনো এমন হয়। হয়তো সে একদিন ফিরে আসবে, সেদিন বিশ্বাস গেথেঁছিলাম তাবিজ করে গলায়।
সারারাত হাঁটা পথে চলেছি তিনজন। আমাদের চারপাশে কত রকমের মানুষ তখন দৌড়াচ্ছে। কত মানুষের ভীড়! একসাথে এত মানুষকে কখনো মরতে দেখিনি। পিকুদের ময়নার খাচাঁ উল্টে গেছে কেথায় যেন উড়ে গেছে স্বাদের সে পাখি। আমরা তিনটে প্রানী হেটে চলেছি কত চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে।
আমাদের হাটা পথ থেমেছিল গাঁয়ের এক বাজারের কাছে যেখানে ছাইপোড়া নগরী দেখে আতঁকে উঠলাম। আরও কত কি যে চোখ পড়লো তার নেই ইয়াত্বা। তারপর বাসে করে ভোর রাতের শেষে গ্রামের পথে পা রাখলাম।

গ্রাম আর পুরোনো রঙে নেই। আগুনের ছ্যাঁকা ছ্যাঁকা দাগে ভরা কৃষকের ঘরগুলো। দেখি লাউয়ের মাচায় ফুলগুলো কেমন চুপসে গেছে। কারা যেন একদল ছেলে বুড়োকে শুয়েই রেখেছে উঠোনের পাশে। কত রকম বিভৎস সে দৃশ্য। কারো কারো আর্তনাদ মাখা মুখ তখনও আগুন রেখেছে ধরে।

হরিদাস গেটে নেই। আমাদের সে বাংলো ঘর। সব কিছুতেই কেমন যেন শূন্যতা। তবে কি লাগলো পাকিদের আঁচড় এখানেও! আমার হৃৎকম্পন ছড়িয়ে যায় সবখানে। একমুহুর্ত থেমে আবার মিশে গেলাম ভীড়ে। আমরা তিনটে প্রানী উঠে বসে বসে থেমে থাকা ভীড়ে চিরে চ্যাপ্টা হবার জোগাড়।
ভীড়ের মাঝে ঠিক মনে নেই ক্যামন করে হাত ফস্কে দেখি অলকা নেই পাশে। আমি খুব করে খুঁজে নিই চারপাশ। কোথায় অলকা বোন আমার!  নোনা ধরা চোখে তখন নামছে ঝড়। অলকা হারিয়ে গেছে। কি যে ব্যথা আহ! তুই আমাকে শক্ত করে ধরে বললি কোথায় হারালি বোনকে?
অলকা, অলকা কোথাও নেই শুধু অপরিচিত মুখ গুলো আমাদের ফেলে-ফেলে যাচ্ছে।

আমাদের কেঁদে ফেলা দুপুরের পর তুই আমায় টেনে হিচরে নিয়ে গেলি নদীর ধারে। আমাদের সেই নদী যেখানে সাতরে দুজন করেছি কত এপার-ওপার। আজ সে নদী আর নদী ইেন, এক ভাসমান কবরখানা। লাশগুলো ভেসে ভেসে কোথায় যেন যাচ্ছে চলে। আমরা দুটো প্রানী পুরোনো বাঁশের সাঁেকা পেরিয়ে গেলাম মিশে শরনার্থীদের দলে। অনেকদিন ঘরবন্ধি ছিলাম। জানিনা কবে যেন কে বলে গিয়েছিল দেশটা স্বাধীন হবেই, আমরা ফের উড়াতে পারবো আমাদের প্রিয় লাল-হলুদ ঘুড়িগুলো। অপরিচিতজনের অবহেলায়-অবহেলায় কিছু খেতে আর ঘুমোতে দিয়েছিলো। তবুও মঙ্গল হোক ওদের। পাকিদের মতো জানে তো মারেনি আর!

শেষে নয়টি মাস পার হলে ডিসেম্বরের এক সকালে কাঙ্খিত বিজয় এলো। পৃথিবীর বুকে এক নতুন মানচিত্রে লেখা হলো বাংলাদেশের নাম। সবার ঘরে ফেরা দেখে তুই আমায় বললি, চল নিষাদ ঘরে ফিরি। আমাদের বাড়ি ফেরা। কত কিছু দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরা। লাল সবুজ একটা পতাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা। চারপাশে হাহাকার নিয়ে বাড়ি ফেরা।

এক সকালে বাড়ি এসে গেট পেরিয়ে দেখি; আমাদের সে ঘর পাড়ার সবচে’ খারাপ লোকটা দখল করে বসে আছে। পাড়ার লোকেরা ওকে রাজাকার বলে আর আমি বলি দু’মুখো সাপ। হয়তো তব্ওু কম বলা হয়ে যায়। মৃতপ্রায় মাতৃভূমি ছাড়া আমাদের তখন কিছুই নেই, শুধু ভাঙাচোরা এই স্মৃতি ছাড়া। আমার বড়’দিকে তো পাকিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে রাতে। আজও পেলাম না। আর অলকা বোন আমার না জানি কোথায় আছিস? কখনো দেখা হবে কি তোর সাথে? নাকি তুই কোন ফটোগ্রাফারের ফটোতে হয়ে গেছিস অসহায় মৃত কোন শিশু। অলকা, বড়দি যেখানেই থাকিস তোরা ভালো থাকিস।

আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি

আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি


আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি
ইকরামুল হাসান শাকিল

রমজানের প্রথম প্রহর। চারপাশ অন্ধকার। এখনো মুয়জ্জিনের কণ্ঠে ফজরে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনী উচ্চারিত হয়নি। গ্রামের নিরীহ মানুষগুলো যে যা পারছে তাই দিয়েই রমজানের প্রথম সেহরী খাচ্ছে। ভয়ে কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। আমরা আমাদের দীর্ঘ একটি রাত পার করছি আমাদের বয়ড়াতল ক্যাম্পে। ১নং কোম্পানী কমান্ডার লোকমান হোসেনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছি। রাত জেগে নানান পরিকল্পনা আর আর্মস্ প্রস্তুত করছি। আজ ভোরে বল্লা পাক আর্মি ক্যাম্পে আক্রমণ করবো। কোম্পানী কমান্ডার লোকমান হোসেনের নির্দেশ মতো আমির হোসেনের নেতৃত্বে আমরা ২৫ জনের একটি দল আক্রমণের জন্য প্রস্তুত।
আমির হোসেন পাক আর্মি হাবিলদার ছিলেন। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। নকিল বিলের খাল দিয়ে নৌকায় করে আমাদের বল্লার কাছাকাছি নামিয়ে দেয়া হলো। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে যাই। একটি দল পাক আর্মি ক্যাম্পের উত্তর পাশে গোরস্থানে পজিশন নেয়। অপর দলটি বেলাবাড়ি পজিশন নেয়। আমি ছিলাম বেলাবাড়ির দলে। আমাদের কাজ ছিলো, আমরা এ পাশ থেকে ডিফেন্স করবো। আর অপর দলটি উত্তর পাশ থেকে আক্রমণ করবে।
চারপাশ অন্ধকার। ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। আমরাও প্রস্তুত। কমান্ড পেলেই ফায়ারিং শুরু করবো। আমাদের কাছে এল.এম.জি, রাইফেল, টু/থ্রি ইঞ্চি মর্টার, রকেট লংসার ও গ্রেনেড। আমার কাছে এল.এম.জি। আযান শেষে আমির হোসেন আমাদের কমান্ড দিলেন। আমরা ফায়ারিং শুরু করলাম। পাক সেনারাও পাল্টা ফায়ারিং করছে। চলছে তুমুল যুদ্ধ। চারপাশ গুলাগুলির শব্দে কাঁপছে। বারুদের গন্ধ আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছ।
আমাদের দলে আমিই সব থেকে কমবয়সী ছিলাম। সেই কারণেই হয়তো আমির হোসেন আমাকে তার পাশেই রেখেছিলেন। যাতে করে আমি সাহস পাই। ফায়ারিং করতে করতে হামাগুড়ি দিয়ে আমরা সামনে এগুচ্ছি। আমার বাম পাশে আমির হোসেন। হঠাৎ একটি বুলেট এসে আমির হোসেনের বুকের বামপাশে মিশে গেলো। সাথে সাথে তার শাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে গেলো। আমি তাকিয়ে দেখি আমির হোসেন আমার দিকে জলজ চোখে কি এক অমুগ বেদনায় তাকিয়ে আছে। আমিও ফায়ারিং থামিয়ে তার মাথা তুলে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি শুধু আমাকে একটি কথাই বললেন। ফায়ারিং।  
দু’পাশ থেকে আমরা আক্রমণ করছি। চারপার দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। আজো পাখির ডাকে ভোর হলো। কোনো অনিয়ম নেই। গাছের পাতারা ভোরের শীতল বাতাসে গা দুলিয়ে দুলতে থাকলো আপন মনে। মনে হলো এরাও জয়ের আনন্দে মাতম করছে। যুদ্ধ থেমে গেলো। আমরা বল্লা শত্রুমুক্ত করে ফেললাম। ছ’জন পাক আর্মি মারা যায়, দু’জন আহত আর বাকিরা সবাই পালায়। আমরা জয়বাংলা ধ্বনিতে চিৎকার করে উঠলাম।
এই যুদ্ধে আমরা দু’জন সহযোদ্ধাকে হারায়। আমির হোসেন ও রকেটকে। দিনের প্রথম আলোতে বাংলার সবুজ ঘাস বারুদে পোড়া লাল রক্তে রাঙিয়ে সহযোদ্ধাদের প্রাণহীন দেহ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলছি। যুদ্ধের এই কয়েক দিনে কত আপন হয়ে গিয়েছিলো তারা। আগে কারো সাথেই পরিচয় ছিলো না। আর আজ বুকের ভেতরটা ভাই হারানোর ব্যাথায় নিরব অশ্রুক্ষরণ করছে। যুদ্ধ ক্ষেত্র বলে চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না। শুধু প্রাণহীন দু’টি দেহ নিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলছি। কুয়াশা ভেজা সকালে আমরা বেতুয়া চলে আসি। এখানেই তাদের সমাহিত করে  আবার ক্যাম্পে চলে এলাম।   
দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সালে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতিতে ঢুকে পরি। তখন থেকেই মিটিং মিছিলে যুক্ত হই। এই মিটিং মিছিল আন্দোলনের কারণে পড়া-লেখার উপর প্রভাব পরে। সেজন্য বাবা-মার অনেক কথাও শুনতে হয়েছে। স্কুল জীবনেই যেহেতু ছাত্র রাজনীতি করেছি। কলেজে এসে থেমে থাকি কি করে। যেখানে পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণে, বৈশম্যের স্টীমরোলার চলছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশটির উপর। সেখানে চুপ করে বসে থাকি কি করে? দেশটাতো আমার। তাই দেশকে রক্ষার দায়িত্বও আমার। তাই প্রতিবাদ করতে হলে রাজনীতি বাধ্যতামুলক। একা কোন বৃহত্তর স্বার্থের আন্দোলন হয় না।
শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সোনার ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এলো মায়ের আঁচল থেকে, বেরিয়ে এলো প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে, বেরিয়ে এলো বাবা সন্তানের ভালোবাসা থেকে, বেরিয়ে এলো নারী দেশকে ভালোবেসে। তেমনি করে সেদিন আমিও ঘর থেকে বাবা মা ভাইবোনদের রেখে বেরিয়ে এসেছিলাম। বসে থাকতে পারি নাই। যদিও প্রথমে আমি আমার পরিবারে না জানিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর ফিরে এসে আবার পরিবারের অনুমোতি নিয়েই গিয়েছিলাম যুদ্ধে।
অনেক দিন হলো যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। মা বাবাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কমান্ডার লোকমান হোসেনকে বাড়ি যাওয়ার কথা বললাম। আমাদের কোম্পানীতে আমিই বয়সে তরুণ ছিলাম। লোকমান হোসেন আমার পিঠ চাপড়ে মুচকি হাসি হেসে বলো যাও। তবে সাবধানে যেও। আমি রাতে বাড়ি এলাম। আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিলো। তবে সেদিন গলা ছেড়ে কাঁদতে পারেনি মা। তার চেপে রাখা সেই কান্নার মধ্যে যে কষ্ট ছিলো তা আমাকে আরো সাহসী করে তুলেছিলো। মা তার আঁচল দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলেছিলো-“আমি তোমার এই স্বাধীন দেশ দেখেই যাবো।”
একবার আমরা চাপরি বাজারে আক্রমণে যাই। সেখানে যাওয়ার আগেই রাজাকাররা খবর পেয়ে যায়। তাই আমরা সেখানে সফল হতে পারি নাই। পরে যুদ্ধ শেষের দিকে সেখানে থাকা তিনজন রাজাকারকে আমরা বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মায়ের কাছে ফিরে আসি। আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমানও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসে।

আলোকিত এক অধ্যায়

আলোকিত এক অধ্যায়



আলোকিত এক অধ্যায়
সেলিম রেজা

এই দিনে ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে যুদ্ধে জয় লাভ করে বিজয় অর্জন করেছি। তাই তো ১৯৭১ইং এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক আলোকিত অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। বাঙালির চেতনাজুড়ে ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতা পরবর্তী বিজয় দিবসের গুরুত্ব অনন্য ও অসাধারণ।  দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ ও ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই বিজয়। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, মুক্তির দিবস। নতুন  স্বপ্ন, প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার দিন। যে মহান শহীদেরা সবার স্বাধীনতা-মুক্তির জন্য, নিশ্চিত-সুন্দর জীবনের জন্য যে সীমাহীন ত্যাগ -স্বীকার করে গেছেন, তাঁদের সম্মান করা পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের জন্য একান্ত  কর্তব্য।
আর এই ৪৬ তম বিজয় দিবসে প্রতিজ্ঞাবন্ধ হয়ে শপথ নিই জাতীয় স্বার্থে কোন বিভেদ, অনৈক্য, বিভাজনবিমুখ কর্মকান্ডে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন মান উন্নত হয় সেইলক্ষ্যে কাজ করা। হিংসা-বিদ্বেষ-অহঙ্কার ছুঁড়ে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব থেকে সরে এসে যেন আমরা একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াই। 



আমার দেখা ইতিহাস

আমি দেখেছি মায়ের বিষণœ মুখ রক্তাক্ত নদী
চোখের জলে ভেসে যাওয়া কিশোরী
সিঁদুর মুছে যাওয়া সূবর্ণার চেহারা
আগুন বারুদের আঘাতে যুবকের লাশ হয়ে ফেরা
সাতপুরুষের ভিটে মাটি উজাড় লেলিহান শিখায়
লুটেরার দল হিং¯্র থাবায় লুটে গোলাপকলি, শাপলা-শালুক
শালিক, দোয়েল, কোয়েল, কৃষ্ণচূড়া, কদম, বেলি, শিউলি
শান্তির ভিত নড়ে হারায় ঠিকানা
ক্ষুধার্ত পশুর নখরে ক্ষত-বিক্ষত শ্যামল ছায়া
ন্যুব্জ সময় বিধ্বস্ত ভূখ-ে লক্ষ লাশের সারি
রক্তের অৎ¯্র ঢেউয়ে ভাসমান ইতিহাস
হায়েনার বীভৎস অত্যাচারে শকুনের ঝাঁক
বদলায় প্রেক্ষাপট
গর্জে মিছিলের ধ্বনি প্রতিবাদী রক্ত শিরা-উপশিরায়
অবশেষে বিজয়; উনিশশত একাত্তর একটি ইতিহাস
একটি স্বপ্ন একটি দেশ
সবুজ জমিনে ঝরে পড়া রক্তজবা-বাংলাদেশ।


বুকের রক্তে লেখা বাংলাদেশ

তাজা রক্তের ¯্রােতে বহমান শত নদী, বধির সময়ে অধির মাটি ও মানুষ। রাজপথে মুক্তির মিছিল জয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনার দীপ্ত শপথে। শত কন্ঠে একটি সুর, একটি গান মুখরিত একটি দেশ। পিশাচদম্ভের অবসান, সাক্ষী কালের করোটি; দামামা বাজিয়ে আছড়ে পড়লো সংগ্রামের ঢেউ, জেগে উঠলো বাংলা- হলাম বিজয়। উড়লো পতাকা মুক্ত আকাশে নিল শ্বাস। বুকের রক্তে লেখা বাংলাদেশ রচিত ইতিহাস......

বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ

বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ



বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ
সাদিক আল আমিন

বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ। যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ কিছু সংস্কৃতিকথা, উচ্ছল মানবিকতা ও ব্রতপালন ফুটে ওঠে। যেই নয় মাস ব্যাপী ক্ষতবুক জখম নিয়ে বিজয় আমাদের বুকে স্থান পেয়েছে, তা নিয়েই দীর্ঘবছর ধরে বেঁচে আছে বাঙালী। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এক গুরুদায়িত্ব বহন করে এ বিষয়। সাহিত্যে এর প্রকাশ প্রকারান্তরে সম্পূর্ণই বলে মনে করি। কেননা একটি জাতির মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র্যতা ও অনন্য রুপময়তা কেবল নিজের ভাষাতেই বোধগম্য এবং ভাব প্রকাশে সমর্থ ভাষাতেই ফুটে ওঠে ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির রুপলাবণ্য ও ব্যঞ্জনা।
‘৭১ এর সুস্মৃতির সাথে একজন বাঙালী খুঁজে পায় বৈষম্যহীন এক জাতির খোঁজ। সে নিজেকে বাঙালী ভেবে গর্ববোধ করে। ১৬ই ডিসেম্বরের বৃহস্পতিবার যেন মনে করিয়ে দেয় গুরুতর প্রতিশোধ-পরায়ণতা-পরবর্তী এক সুখকর বিলাসী  সৌন্দর্যের; ফিরিয়ে দেয় জাগতিক সমূহ সুখের উৎস, যার মাঝেই নিহিত থাকে হাজার হাজার বিজয়, যার স্রষ্টা লক্ষ কোটি বাঙালী।


লালরঙা চোখ

উপচে পড়া রক্ত থেকে হারিয়ে গেছে চোখ
ব্যস্তদিনের স্বপ্নগাঁথা পাখির মতো উড়ে যাও লীন
নির্জীব দেহে এঁকে ফেলো পতাকার চেনা রঙ
লাল কিংবা সবুজ- পিঞ্জরবদ্ধ প্রভাতে স্নানীয়
পটভূমিকা তার সমুজ্জ্বল খেলা দেখায়...
বিচিত্র জাদুর তুলিতে এঁকেছো বিজয় তুমি
হে মহা মনোহর সৈনিক...

মঞ্চস্থপূর্ব সফল নাটকের অভিনেতা সেজে
সমূহ কাহিনীর বুকে লেপেছো বিজয়-আস্তরণ
‘৭১ এর আকাশে, পাখিদের মিছিলে উড়িয়েছো
রঙিন পতাকার হৃদয়, যেখানে একদিন রক্ত ছিল
লাল বৃত্তাকার; হে মহা মনোহর সৈনিক-
নয়মাস পর এক শকুন খুঁজে পায় তোমার
স্বপ্নিল, যুদ্ধক্লান্ত হারিয়ে যাওয়া সেই লাল-চোখ


মানচিত্র

আসন্ন মজলিশ চত্তরে উল্টোমুখী দুঃখের কারাগান
গাইতে থাকে ক্ষতবুক জখমিত এক নিরীহ বাঙাল
অপেশাদার যোদ্ধার ঘামে আঁকা আছে যাদের নাম
যারা কর্তব্যরত আছে এই দীর্ঘ সময় ধরে- তারা
সময় বুঝে বানিয়ে ফেলে এক দৃশ্যমান স্মৃতিনাম
‘মানচিত্র'; আছে সেই সময় থেকেই- প্রতিবাদী শরীরে