ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৮

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৮

তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৮

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০























শব্দমালা : সাফওয়ান আমিন

শব্দমালা : সাফওয়ান আমিন

 



এক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পেঁচাল


চায়ের কাপে সময় খেতে খেতে, কথা হচ্ছিল আমাদের। 

আলোচ্য: গতদিনের ট্রেন এক্সিডেন্টÑ  

কিভাবে ফিনকি দিয়ে রঙধনু’র একাংশ আকাশে চিত্রায়িত 

হয়েছিলো, সেই সব গপ্পো-সমৃদ্ধ আদ্যপান্ত!


চুরুটের শব্দে শব্দে একজন বলেছিলো, লোনলিনেস! লোনলিনেস!

সংসার-স্ট্রাগলে টিকতে পারে নাই-ওয়ার্থলেস ফেলো!


‘ইঞ্জিনের মরন শব্দে, এÑলোকটার মরা দেহি নাই, শুনিও নাই।

পরে শোনলাম, হইহই! রইরই! সব দৌড়াইতেছে-

(মাইনসের দুকখু দেইখতি, মানসের কত উৎসাহ!)’


ঘোন-রোদ ঝরছিলো সেই সময়টায়- আঁষ্টে-গন্ধ ভেসে

আসছিলো মাছ আড়ৎ থেকে- গুমরে ওঠার আনন্দ 

একটা ভিখারির চোখের জলে জমে উঠছিলো, বাকি সব 

ভদ্দরনোকেরা ‘হা’ করে তাকিয়ে; দেখছে, ডালিমের কোয়া থেকে

রসটুকু কি করে মাটিতে মিশে যায়...


স্ট্রাগল সংক্রান্ত জীবনপাঠ


জীবন হলো সলিড তেজপাতা-  মানবজনমের আগের পর্ব

পাতার পূর্ব অবস্থা (কচি লকলকে রক্তিম আমিষসমেত) ! 

আর মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসাই প্রথম মৃত্যু-

এই মরে যাবার আগ পর্যন্ত এক স্ট্রাগল; মরার পরে আরেক!  

মরার পরে মসলা বানিয়ে; এখানে ওখানে বসিয়ে, কষিয়ে নেয়-  

কোষানোর পরো নাকি আবার কষানো হয়...

রন্ধনে-রন্ধনে-রন্ধনে; তেজপাতা, আবার অর্থগত ব্যবহৃত তেজপাতাই হয়ে যায়!  


স্বপ্ন, ভেঙে যায়  


একটা জোনাকের সাধ হলো উড়ে উঠবে চাঁদে। দেখবে চাঁদের যত

আছে আভা আর বিভা। তারপর জোনাক এতো এতো স্বপ্ন সঙ্গে নিয়ে উড়লো আকাশেÑ

উড়তে উড়তে ভোর হলো। ফিঙে দেখে খেয়ে নিলো। 


একবার হাওড়ের এক কাঁকড়ার ইচ্ছে হলো যাবে সমুদ্দুর।

দিনে যেহেতু হিংস্র মানুষের তীব্র উপদ্রব। তাই চাইলো রাতে বেরবে।

এক বুক স্বপ্ন নিয়ে কাঁকড়া বেরলো রাতে, যাবে সুমুদ্দুরেÑ

হাওড় ছেড়ে হাতরে উঠলো বিলে, যেতে যেতে এলো চোখা-রাত;

মানুষের নেই উৎপাত! এরপর তাঁকে শিয়াল নিলো খেয়েÑ



সম্পর্কের দিন শেষে 


অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্কের দিন শেষে Ñ নীড়ের দিকে পাখিকে

উড়ে যেতে দেখেছি।

পাখির পেছনে খসে পড়লো একটা পালকÑ মূলত কারো মুখে ছুঁড়ে

মারা বিস্মৃতি!  

কেউ কেউ দেখলো আমার চোখে ভাসছে বিলীন আটলান্টিস! 



ঝরে যাওয়া পাখিদের কথা বা রোড এক্সিডেন্ট 


পাতা ঝরে যাওয়াই নিয়মÑ যেমন মানুষ ঝরে যায়।

নিয়মটা আমরা জানি, তবু শত বিরহে কাতর হই;

বিলাপের অন্তর্বাস ছুয়ে।


একবার ঝরে যেতে দেখেছিলাম একটা পাখিকেÑ

ডালে সাজানো বাসাসমেত! ছিল তাতে দু'টো ছানা

আর একটা ডিমও; ফুটে বাচ্চা বেরোবে এমন।


ফুটো ডিম তুলে ধরেছিলাম হাতেÑ যদি পারি বাঁচাতে!

খুঁজেÑখুঁজে শেষে সেই পাখি, দু'টো ছানা, ফুটো ডিম 

তুলে দিলাম এক অজ্ঞাতনামা খামেÑ খামটি উড়তে

দেখলাম বাতাসে।


পরে একদিন গল্পে গল্পে শুনেছিলাম, আমারই মত

কেউ ঝরতে দেখেছিলো আরেকটা পাখিকে, বাসাসমেত।

দুটো ছানা, ফুটো ডিমও ছিল তাতেÑ



জোনাক-যাপন


জোনাকের শোভা অন্ধকারেÑ রীতি মেনে, আলো ছড়িয়ে বিমুগ্ধ

করাই তাঁর সফলতা। ওতো আলোতে যাওয়া ভালো না, যতখানিতে

তাঁর আলোর গুরুত্ব ক্ষয়ে যায়!


দূরে চাঁদের কণার মত জ্বল জ্বল করে জ্বলা আলোগুলি, জোনাকেরÑ

এ আলো তাঁর নিজের জন্যে নয়। যেমনটা ফুল,

ফুলের ঘ্রাণ অন্যত্র ছড়িয়ে দেয়।


কেমন সুন্দর সে উড়ে ওঠে মৃদু মৃদুÑ দারুণ ব্যঞ্জনে! উড়তেই থাকে

সানন্দে, বাতাসের প্রতিটা আবেদনেÑ জোনাকের এই উড়ে ওঠা,

তার নিজের জন্যে কি? নাকি পাখিদের মতো মানুষকে অনুপ্রেরণা

দিতেÑ? যেমন করে উড়োজাহাজ ওড়ে


আর যদি বলি জীবনের কথা, সেও কি জোনাকের? যেমন 

মানুষের যাপিত জীবন নিজের জন্যে না-


ও বেলি ফুল গো


রাতের বেলিফুল গো তুমিÑ গড়িয়ে পরেছ বুকে

এমন ঘ্রাণে আসেনি সুনামিÑ মাতিনি তীব্র সুখে!

তমসাও এতো মধুর হয়? ছুঁয়েছে দূরের-বিধুর

স্পর্শে কেঁপেও নিধুবন ঠিক হয়নি এতো নিগূঢ়। 


পাপড়িগুলো সরস ঠোঁটের মত উড়ছে বাতাসে

সবই যে কেঁপে কেঁপে উঠে সুখ আগমনী ত্রাসে।

হেলে-দুলে প্রজাপতি উড়ে আসে..কামের-ঘ্রাণে

পুনঃপুনঃ মেতে ওঠে ত্রিজগৎ, নিধুবনের তানে!


প্রজাপতি পাখা ঝাপটায়Ñ ডাকে নানান সুরে;

ঘ্রাণ ছড়াইয়া ফুল গো তুমি আছো ক্যানে দূরে?

রাত্রি পোরায় ফুরাই আইলো, ফুরাবে কি সুবাস? 

তোমার ঘ্রাণের তীব্রতা আমি চাই যে বারোমাস।


আঁজলা ভোরে তুলে নেই গো সই তোমারি অবকাশ 

গ্রীষ্ম আর বর্ষার অপেক্ষায় ফেলি আজও দীর্ঘশ্বাস! 



আব্বার ইচ্ছেঅনিচ্ছে এর থেকে একটুও ব্যতিক্রম ছিলো নাÑ


ভালোবাসা বা সৌন্দর্য বিষয়ক


ধরো, মৃদুমন্দ বৃষ্টি নামার দিনে- কথা হচ্ছে মনে মনে, তোমার সনে।

এবং আরো কল্পনা করো, জানালার ওপাশে একটা বিল। তাতে পড়েছে জোসনা, করছে ঝিলমিল। রোগা বাতাস এসে লাগছে গায়। হারিকেন নিবুনিবু ভাবে জ্বলছে বিলের মাঝে একটা ডিঙি নৌকায়। এদিকে তুমি জানালায় বসে, তাকিয়ে আছ অপলক সেদিকেÑ আমাকে দেখা যায় না, অথচ আমি আছি সে ডিঙায়Ñ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি চাঁদ। আর নেমেছি নির্ণয়ে, কে সুন্দর?  তুমি নাকি চাঁদ!

এমন সূদুরে, দুজন দুপাশ থেকে ভাবছি দুজনকে মনে-মনে অনন্তকাল ধরেÑ এমন মুহুর্ত বারবার ফিরে আসছে দ্রুতলয়ে। দিন ধরো ক’ সেকেন্ডে শেষ। আবার ফিরে আসছে রাত; সুদীর্ঘ অথচ সুসংগত। হাজারটা বছর ধরে কেটে গেলো এভাবেÑ তুমি এপাশে আর আমি ওপাশে বিলে; ডিঙা, চাঁদরাত এবং তোমাকে নিয়ে অন্যরকম ফিলে!

ভালোবাসা বা সৌন্দর্য আমি এভাবেই গ্রহণ করি; দূর থেকে, মনে-মনে, খুব গোপনে অথচ আকণ্ঠমগ্নে-


ফুল ও শৈশব


আমি মরে গেলে সমাধিতে একটা ফুলের চারা রোপণ করে দিও।

আমার অস্থিজুড়ে ফুলের ঘ্রাণ সেঁটে যাওয়া চাই। মৃত্যুর পরেও যেন

সুঘ্রাণ নেওয়া যায়-


আমি মরে গেলে সমাধিতে আমার শৈশব-স্মৃতি, বিস্মৃতি পুঁতে দিও।

প্রিয় সব, বুকে পঁচে পঁচে গলে পড়–ক। আর সেই শৈশবি মন এসে নিত্যদিনই ঝরুকÑ


ফুলের চারা; ফুল আর শৈশবি ফোয়ারা; মিষ্টি ভুল: ছিটিয়ে দাও

মুঠি মুঠি বুকের উপরে। রেখো না অজুহাত।

ওমন কিছু ফুল ও শৈশবি-ভুল দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো অনায়াসে দীর্ঘ কয়েকটি আখিরাত!


হাল আমলে মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস, জাতিসত্তা ও জাতীয়তা নিয়ে বাঙালি মুসলমানের অবসেশন...

হাল আমলে মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস, জাতিসত্তা ও জাতীয়তা নিয়ে  বাঙালি মুসলমানের অবসেশন...

 



হাল আমলে মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস, জাতিসত্তা ও জাতীয়তা নিয়ে  বাঙালি মুসলমানের অবসেশন 

হাসনাত আসিফ কুশল 


অবসেশন কথাটি বস্তুত মানসিক পীড়াগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে বোঝায়। স্পেসিফিক অর্থে শুচিবায় বলা যেতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা দেখলে এই পীড়া খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার করার প্রবণতা থেকে এমন পীড়ার উদ্ভব হয়েছে। যেন আমাদের ভেতর থেকে আত্মিক প্রশান্তি তুলে নেয়া হয়েছে। 

পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে সুসম্পর্ক ছিলো তার মূলে আঘাত করেই পাকিস্তানের কায়দÑইÑআযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উদ্ভাবন করলেন ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’। জিন্নাহর ‘এক প্লেটে হিন্দু মুসলিম খায় না’ এমন তত্ত্ব মেনে নিতে পারেন নি ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ। বিশেষ করে প-িত জওহরলাল নেহেরু ও মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধী এ ব্যাপারে ভিন্নমত অবলম্বন করেছিলেন। প-িত জওহরলাল নেহেরু যুক্ত ভারত তথা অখ- ভারতের প্রস্তাব করলেও শেষ অবধি তৃপ্তির হাসি হাসলেন জিন্নাহ। দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে ভ্রান্ত, উদ্ভট ও ব্যর্থরাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। একদিকে চাঁদতারাখচিত সবুজসফেদ পতাকা উড়ছে, অপরদিকে স্বাধীনতার বাঁধভাঙা অপেক্ষা। এই অপেক্ষা মোটেই শান্তিময় ছিলো না। বরং দুই দেশের মানুষকে দেশত্যাগের অপরিসীম ও অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিলো আর অখ- ভারতবর্ষে তদানীন্তন হিন্দু ও মুসলমানের ভেতর সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা এবং পরবর্তীতে মুসলমানদের মধ্যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস সম্পর্কে এখানে তুলে ধরার প্রয়াস করছি। 

বঙ্গভঙ্গ ও তদানীন্তন ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা :

ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ এবং এর মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরম্পরা এখানে তুলে ধরার প্রয়াস করছি। তদানীন্তন ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়োজন অনুভব করেছি। তাই সেসব উল্লেখ করে এই প্রবন্ধটি লেখা শুরু করছি। কেননা ভারতের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ এবং দেশভাগ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা এ দুটো অনভিপ্রেত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। 


বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট :

পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমাগত বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার মূলে রয়েছে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস পাকিস্তান সৃষ্টির পরে শুরু হলেও এর শেকড়টি ছিলো ব্রিটিশ শাসনামলে। সুচতুর ব্রিটিশরা ঠিকই বুঝেছিলো যে এখানে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করতে গেলে বিভাজনের প্রয়োজন। কিন্তু জাতিতে বিভাজন ? সম্ভব নয়। কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে বিভাজন ? অসম্ভব। দেখা গেল ধর্মের নামে যদি এই উপমহাদেশের লোকজনকে উন্মাদ করে রাখা যায় তাতে ব্রিটিশরা দীর্ঘ দিন এই বিবাদ মীমাংসার নামে এখানে অবস্থান করতে পারবে। এদেশে ব্রাহ্মণÑকায়ঃস্থ’র মধ্যে ভেদাভেদ রয়েছে কিন্তু তা কখনো দাঙ্গাহাঙ্গামায় রূপ নেয় নি। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত তা এ পর্যন্ত আদর্শিক রূপ পেয়েছে। 

ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে এবং হযরত মুহাম্মাদকে (সাঃ) মুসলমানরা সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। আর হিন্দু ধর্মের ভিত্তি হলো তাদের তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। ভারতবর্ষের হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকে, সমগ্র বিশ্ব ত্রিমূর্তির পরিচালনাধীনÑব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। হিন্দু ধর্মের এই ত্রিমূর্তি ভাবনার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের ট্রিনিটি’র সাদৃশ্য লক্ষ্যনীয়। এছাড়া এই উপমহাদেশে পারস্যের জরুথুস্ত্রবাদ, নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ ও জৈন এবং শিখ ও ইহুদি ধর্মের ক্ষুদ্র প্রভাব রয়েছে। আর মুসলমানদের মধ্যে দল ও উপদলে ভেদাভেদ শুরু হয়েছিলো শিয়া ও সুন্নী দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে। শিয়া সম্প্রদায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র (সাঃ) পরে খিলাফতের হক্বদার হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। অতঃপর নবী নূরের নাকি মাটির তৈরি, নবী গায়েব জানতেন কী জানতেন না এসব বিষয়ে মুসলমানদের ভেতর বহু দল ও উপদল গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে এমন বিভক্তি অনভিপ্রেত এবং অনাকাক্সিক্ষত। কারণ মুসলমানরা পরস্পর ভাই। আর আমরা তো সকলেই আদমসন্তান। যিনি হিন্দু তিনিও তো আদমসন্তান। মুসলমানরা পরস্পর পরস্পরের বিপদেআপদে এগিয়ে আসেন; সহমর্মিতা জানান। কালক্রমে মুসলমানদের গ-ি বিস্তৃত হলে ভারতবর্ষ পর্যন্ত ইসলাম প্রবেশ করে। পরবর্তীতে পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ হয়ে ওঠে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল।১ 


বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ও তার প্রতিক্রিয়া :

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হন। এরপর এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী কতৃত্ব বিস্তার করে। বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের পর ব্রিটিশরা মহীশূরের টিপু সুলতানকে পরাজিত করে এবং সমগ্র দক্ষিণ ভারত করায়ত্ত করে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে তিন ভাগে বিভক্ত করে : বাংলা প্রেসিডেন্সি, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ও বম্বে (মুম্বাই) প্রেসিডেন্সি। কিন্তু বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিলো আয়তনে সুবিশাল। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম এবং ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে এই প্রেসিডেন্সি গঠিত হয়েছিলো। সেসময় এই প্রেসিডেন্সি ছিলো একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এই সুবিশাল বঙ্গাঞ্চলের দেখভাল করা একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো। বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ‘পশ্চিম বাংলায়’ যোগাযোগ ও জীবনব্যবস্থার কিছু উন্নয়ন হলেও কার্যত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ‘পূর্ববঙ্গ’, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা অবহেলিত রয়ে যায়। বিষয়টি অচিরে ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয় ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়। এ দুর্ভিক্ষের মূল কারণ অনুসন্ধানে তদানীন্তন ভারত বিষয়ক সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড হেনরি নর্থকোর্ট একটি কমিটি গঠন করেন ও বাংলা প্রেসিডেন্সির অভ্যন্তরীন প্রশাসনিক সমস্যা কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৮৬৭ সালে বাংলার ছোটলাট উইলিয়াম গ্রে বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করার জন্য সুপারিশ করলেও তদানীন্তন বড়লাট তথা ভাইসরয় লরেন্স এতে বাধা দান করেন। লরেন্স বরং আসাম এবং তার পাশ্ববর্তী জেলাসমূহের বিভাজনের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য লরেন্সের যুক্তি না মেনে বঙ্গবিভাজনের অনুকূলে চিন্তাভাবনা শুরু করে দেয়। এই কারণে ১৮৭২ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট বিবেচনায় এনে তদানীন্তন ছোটলাট ক্যাম্বল বঙ্গ বিভাজনের সুপারিশ করতে থাকে। তার সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৭৪ সালে আসামকে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ থেকে পৃথক করা হয়। এর ফলে আসামের বাংলা ভাষাভাষী তিনটি জেলাÑ শ্রীহট্ট (সিলেট), কাছাড় ও গোয়ালিয়র বাংলা থেকে পৃথক হয়ে যায়। এ তিনটি জেলার দায়িত্ব পড়ে চিফ কমিশনারের ওপর। ১৮৯৬ সালে আসামের তদানীন্তন চিফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব করেন। হেনরি কটন এতে বিরোধিতা করেন এবং নাকচ করে দেয়া হয়।১ 


বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে দেনদনবার :

১৯০১ সালে মধ্য প্রদেশের চিফ কমিশনার অ্যা-্রু ফ্রেজার উড়িয়া ভাষাভাষী অঞ্চলকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করে একটি পৃথক প্রেসিডেন্সির প্রস্তাব করেন। তিনি অবশ্য তদানীন্তন বড়লাট কার্জনের নিকট যুক্তি প্রদর্শন করেন, এক্ষেত্রে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করা হলে ব্রিটিশদের শাসনকার্যে সুবিধা হবে। কার্জন ফ্রেজারের কথামতো ১৯০২ সালে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সির’ সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজনের কথা জানান। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী হাবার্ট রিজলে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে আসামের চিফ কমিশনারের অধীনে করে দেয়ার সুপারিশ করেন। তবে এ সুপারিশের পর সরকারি ও বেসরকারি মহলে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।১ 


লর্ড কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফর :

১৯০৪ সালে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফরে আসেন এবং ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মুসলমান নেতৃবর্গকে নিয়ে সভা আহবান করেন। এ সভায় ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী করার এবং মুসলমানদের সুযোগসুবিধা দেয়া হবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন। লর্ড কার্জনের এই সফর বঙ্গভঙ্গ এবং ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কেননা একদিকে যেমন ব্রিটিশদের মধ্যে প্রশাসনিক দেনদরবার চলছিলো, তেমনই অন্যদিকে বঙ্গীয় অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় একত্রে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিলো। ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মুসলিম ক্রানিকল’ নামক পত্রিকার সম্পাদকীয় অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘জনগণÑসম্পর্কিত কোনও বিষয়ে দেশবাসী এতখানি ঐক্যবদ্ধ আগে কখনও হয়নি, যতটা প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হয়েছে।’ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ভ-ুল করে দেয়ার জন্য এবং বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে মুসলমানদের জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে কার্জন এই সফরে এসেছিলেন। তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবর্গ কার্জনের এমন প্রতিশ্রুতিতে মজে গেলেন। ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমোল্লা মানুষকে এ কথা বোঝাতে সমর্থ হন যে আদতে বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের’ সমতুল্য বলে অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে পূর্ববৎ আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। পূর্ববঙ্গেও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে। ফলে লর্ড কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফর বঙ্গীয় ভূমিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির যবনিকা ঘটিয়ে দিয়েছিলো। কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফরকে কেন্দ্র করে মুসলিম নেতৃবর্গের ব্রিটিশপ্রীতির বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের সেন্ট্র্যাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন বিক্ষুব্ধ হয়। কারণ নওয়াব স্যার সলিমোল্লা ছিলেন ব্রিটিশদের প্রতি অনুরক্ত। সুতরাং ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় সেন্ট্র্যাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের এক সভায় মৌলভী শামসুল হুদা ও মৌলভী সিরাজুল ইসলাম বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। শামসুল হুদা বলেন, ‘মুসলিম সংগঠনগুলির ততখানি জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করা উচিত যতটা হিন্দু সংগঠন গুলি করছে, কারণ এতে হিন্দুÑমুসলমান উভয়ের স্বার্থ জড়িত।’ সেন্ট্র্যাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি জাতির কোন অংশকে বাঙলা থেকে আলাদা করা উচিত হবে না, যদি প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোই বিভাজনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে সমগ্র বাঙলাকে মাদ্রাজ এবং বোম্বাইয়ের মতো নির্বাহী পরিষদ (ঊীবপঁঃরাব ঈড়ঁহপরষ) গঠন করে গভর্ণরের শাসনাধীনে আনা হোক।’ এ ছাড়া মুনতাসির মামুন সংকলিত ‘উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদÑসাময়িকপত্র’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে সেই সময় পূর্ববঙ্গ থেকে ঢাকা প্রকাশ ও বেঙ্গল টাইমস পত্রিকা বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তবে কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফরে মুসলিম নেতারা আনুগত্যের ছবক দিলেও মার্চ মাসে পূর্ববঙ্গের ঢাকার জগন্নাথ কলেজে হিন্দু ও মুসলমানের এক যৌথ সভায় ‘ভাইসরয়ের মিষ্টি কথাতে জেলার জনগণের মন ভোলেনি’ মর্মে প্রস্তাব পেশ করা হয়।২


বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে রাজনীতি এবং পরিপ্রেক্ষিত আন্দোলন :

১৯০৫ সালের ৯ জুন তদানীন্তন ভারত বিষয়ক সচিব ব্রডরিক বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন এবং ১০ জুলাই তা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়। ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে এবং ১৬ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করা হয়। 

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষি ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে থাকে। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবর্গ মুসলিমদের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ফলে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠন করে। ১৯০৭ সালে গঠিত হয় ‘বঙ্গীয় মুসলিম লীগ’। অপরদিকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবিস্তৃত সংঘাতময় পরিস্থিতির ভেতরে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী ও উদারপন্থী দুই পক্ষের উত্তেজনা শুরু হয়। ১৯০৫ সালে বেনারসে গোপালকৃষ্ণ গোখলে’র সভাপতিত্বে অধিবেশনে অনভিপ্রেত বিভক্তির হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় কংগ্রেস। ১৯০৬ সালেও কলকাতায় দাদাভাই নওরোজির সভাপতিত্বে বৈঠক হয় এবং দাদাভাই নওরোজির মধ্যস্থতায় বিভক্তি এড়ানো সম্ভব হয়। কিন্তু ১৯০৭ সালে সুরাটের অধিবেশনে কংগ্রেস দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চলতে থাকে স্বদেশী ও চরমপন্থী আন্দোলন। 


বঙ্গভঙ্গ রদ পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম বাংলার প্রতিক্রিয়া :

ব্রিটিশ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ১৯১০ সালের ৬ মে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার ছেলে পঞ্চম জর্জের অভিষেক ১৯১১ সালের ২২ জুন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর নভেম্বর ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ তার রাণী মেরিকে নিয়ে রাজকীয় শোভাযাত্রা সহকারে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন এবং দিল্লিতে ৭ ডিসেম্বর পৌঁছান। দিল্লিতে এসে রাজা পঞ্চম জর্জ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা পূর্বতন বাংলা এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম বিচ্ছিন্ন অখ- বাংলা প্রদেশ গঠিত হবে, বাংলা প্রদেশের শাসনভার ভারতের গভর্নরের হাতে ন্যস্ত করা হবে এবং কলকাতার পরিবর্তে ভারতের রাজধানী হবে দিল্লি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, দার্জিলিং ও ত্রিপুরা এবং আসাম নিয়ে ১৯০৫ সালে গঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ এবং পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের’ বিলুপ্তি ঘটে এবং আন্দোলনরত পশ্চিমবাংলার হিন্দু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম বণিক সম্প্রদায় এতে উল্লসিত হয়। অপরদিকে ঢাকায় নওয়াব স্যার সলিমোল্লা এবং বঙ্গভঙ্গের সমর্থকরা হতাশ হয়ে পড়েন। এর ফলে মুসলিম নেতৃবর্গ তদানীন্তন ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এর নিকট যথাবিহিত আবেদন করলে এর পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড হাডিঞ্জ পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। এ মর্মে মুসলিমরাও খুশী হয়। কারণ লর্ড ক্যানিং ১৮৫৭ সালে ‘দ্য অ্যাক্ট অব ইনকর্পোরেশন’ জারি করার মধ্য দিয়ে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বেতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাক্সক্ষা করতে থাকে। আর তাদের দীর্ঘ আকাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতিতে মুসলমান নতুন আশায় বুক বাঁধে। 


আইডেনটিটি ক্রাইসিসের মূল! 

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পেছনে ছিলো ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি ও বাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থ। বিশেষ করে মুসলিম লীগের রাজনীতিবিদদের পাকিস্তান সৃষ্টির আকাক্সক্ষার পেছনে সবচেয়ে যে বিষয়টি কাজ করেছে, তা হলো বহু জাতির ভারতবর্ষে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেলিয়ে দেয়া দীর্ঘদিনের মুসলিমবিদ্বেষ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা। ১৯০৭ সালে সুরাটের অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্তির পর থেকে নবসৃষ্ট এ সাম্প্রদায়িকতা নতুন রূপ ধারণ করে। এর আগে ১৯০৫ সালে বারানসী অধিবেশনে কংগ্রেস বিভাজিত হতে গিয়েও গোপালচন্দ্র গোখলে’র হস্তক্ষেপে অল্পের জন্য রক্ষা পায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৯০৬ সালের কলকাতা অধিবেশনেও এ উপক্রম হয়েছিলো। শুরু থেকেই কংগ্রেসের ভেতর এই বিভক্তি ভারতবর্ষকে নিয়ে যায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার দিকে। সুরাটে ভ-ুল হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে ব্রিটিশ শাসন নির্মূলের ব্যাপারে চরমপন্থা অবলম্বনকারীদের ভেতর বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন অগ্রগণ্য। বিশেষ করে অশ্বিনীকুমার দত্ত ১৮৮৫ সালে গঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে ‘তিন দিনের তামাশা’ মন্তব্য করে বসলেন। ওদিকে উদারপন্থা অবলম্বনকারীদের মধ্যে ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে, ফিরোজ শাহ মেহতা, বদরুদ্দিন তায়েবজি, শঙ্করণ নায়ার, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্র্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি অগ্রগণ্য। আবার মুসলিমরা ১৯০৬ সালের মধ্যেই ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠন করে ফেলেছে। ব্রিটিশরাও ১৯০৫ সালে শাসনের সুবিধার কথা বলে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেয়। ফলে বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গাপ্রদ অবস্থার সৃষ্টি হয়। সুচতুর ব্রিটিশ সরকার যায় ঘাবড়ে। ফলে ১৯১১ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এরপর নাটকীয়ভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে এবং বাংলায় হিন্দুÑমুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হতে থাকে। সুভাষচন্দ্র রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, সৈয়দ আমীর আলী, মহাত্মা গান্ধীসহ বহু রাজনীতিবিদ ব্রিটিশদের এ উপমহাদেশ থেকে তাড়ানোর সব রকম প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন। শেষমেশ লাহোর প্রস্তাব সামনে দেখিয়ে ১৯৪৭ সালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিÑজাতি’ অনুযায়ী পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বাধীন হয়। 


লাহোর প্রস্তাব :

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণ করেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনিই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তি হিসেবে সুপরিচিত। ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ লাহোরে সম্মেলনে দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হলো, হিন্দু ও মুসলিমদেরকে এক পরিচয়ে পরিচিত করার চেষ্টা স্বপ্নমাত্র। ‘হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শন ভিন্ন, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন। এই দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে হয় না, তারা একত্রে খায় না। তারা পৃথক সভ্যতার অংশ যে সভ্যতার মতাদর্শ ও ধ্যানধারণা ভিন্ন।’ 

লাহোরে দেয়া বক্তব্যেই তিনি তার উদ্ভাবিত ‘দ্বিÑজাতি তত্ত্বের’ ধারণা পরিষ্কার করে দেন। এরপর ২৩ মার্চ কৃষক প্রজা পার্টির শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব পাঠ করেন এবং বক্তৃতা দেন। এ সময় চৌধুরী খালিকুজ্জামান এ প্রস্তাব সমর্থন করে বক্তব্য দেন। এরপর ২৪ মার্চ সকলের আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাবটি পাস হয়। এরপর পরের বছরের জন্য কার্যকরী কমিটি নির্বাচন করে অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়। (পৃষ্ঠাÑ১৬, মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০) 

লাহোর প্রস্তাবের প্রাথমিক খসড়াটি তৈরি করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সিকান্দার হায়াত খান। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়াটি তৈরি করেন স্যার জাফরুল্লাহ খান। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ের ১৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, এ প্রস্তাব সাবজেক্ট কমিটির সভায় পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়। এতে কস্মিনকালেও ‘পাকিস্তান’ শব্দটির উল্লেখ ছিলো না। লাহোর সম্মেলনেই এ প্রস্তাবটি পাঠ করে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক আবেগতাড়িত হয়ে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘যদিও আমি বাংলায় একটি কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছি, বলতে দ্বিধা নেই আমি প্রথমে একজন মুসলমান, তারপর একজন বাঙালি। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোর মুসলমানদের ওপর যদি আঘাত করা হয়, আমি বাংলার হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ নেবো। ১৯০৬ সালে বাংলায় মুসলিম লীগের পতাকা ওড়ানো হয়েছিলো এবং মুসলিম লীগের এই মঞ্চ থেকে বাংলার নেতা হিসেবে আমি মুসলমানদের আবাসভূমির জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করছি।’ 

‘জিন্নাহর আদর্শই এখনও পাকিস্তানের মূলভিত্তি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘পাকিস্তানই প্রথম রাষ্ট্র যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতেÑএকই জাতিসত্তা ও ভাষার ভিত্তিতে নয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি ধর্মতান্ত্রিক (থিওক্র্যাটিক) রাষ্ট্রও নয়।’ ইসলামাবাদের কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক সিকান্দার কিরমানি জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত পাকিস্তান সৃষ্টির কারণ হিসেবে তারা দ্বিজাতি তত্ত্বকেই জানে। তারা মনে করে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো ব্যাপারেই মিল ছিলো না কেবল এক দেশে বসবাস ছাড়া। তারা আরও জেনেছে, ধর্ম, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি রক্ষার জন্যই পাকিস্তান সৃষ্টির প্রয়োজন ছিলো। তবে প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর সবচেয়ে বেশি মুসলিম ভারতে চলে যান। তারপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। 


আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা: 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সব থেকে গুরুতর আঘাত দেয়া হয় ভাষার প্রশ্নে। একেই মুসলিমদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র ভূমির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করা, তারপর আবার পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার হীনপ্রয়াস পূর্ব বাংলার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। আর তাই এদেশের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর এ চক্রান্তকে মেনে নিতে পারে নি। সেই কারণেই পূর্ব বাংলার কয়েকজন রাজনৈতিক সংগঠক কলকাতায় সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানে তাঁদের পরবর্তী কাজ কি হবে সেই বিষয়ে আলোচনা করেন। সেখানে শামিল ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহিদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমানসহ আরও অনেকে। এর আগে মুসলিম লীগের বাম ধারার কর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘গণআজাদি লীগ’। সে সংগঠনের সঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ সহ আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। কলকাতার আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে বেগবান করতে উপযুক্ত সংগঠনের প্রয়োজন। আর সেই উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে তারা কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, অলি আহাদ, নুরুদ্দিন আহমদ, আবদুল ওদুদসহ আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য এক সম্মেলন করার ব্যাপারে একমত হন। তখনও ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্টতা থাকায় মুসলিম ছাত্ররা এতে যোগ দিতে চাইতেন না। অবশেষে ১৯৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাসায় তসদ্দুক আহমদের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হলে পরের দিন পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে যুবলীগ প্রথমেই মুখ থুবড়ে পড়ে দলাদলির কারণে। সংগঠনের লক্ষ্য কি হবে তা নিয়ে দেখা দেয় মতভেদ। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ ৮৩ ও ৮৫ নং পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে বলেন: আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও যোগদান করেছে।...আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা...যাকে ইংরেজিতে বলে কমিউনাল হারমনি, তার জন্য চেষ্টা করা। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ এ শেখ মুজিবকে তখনও ‘মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য’ বলে উল্লেখ করেন। (পৃষ্ঠাÑ২৬) এসময় তিনি মুসলিম লীগ সদস্যদের একই সঙ্গে অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তাঁকে না জানিয়ে যুবলীগের সাবজেক্ট কমিটিতে ব্যাপক হারে কমিউনিস্টমনা লোকদের নেয়া হয়। সবটাই করা হয়েছিলো সদস্য বাড়ানোর তাগিদে। শেখ মুজিবুর রহমান এটা টের পেয়ে এক সভায় যুবলীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেন। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক দেশভাগের আগে থেকেই ছিলো। পূর্ব বাংলায় এমনও অনেকে ছিলেন যারা বাংলা ভাষা শিক্ষা করতে দ্বিধা করতেন। তারা উর্দুতেই কথা বলতেন। মহিউদ্দিন আহমদ এ ব্যাপারে তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ের ২৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:‘...জুন মাসের প্রথম দিকেই সংবাদপত্রে খবর বেরোয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। বেশ কয়েকজন বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতা করে প্রবন্ধ লেখেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, র্ফরুখ আহমদ, আবদুল হক, আবুল হাশিমসহ আরও অনেকে। উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তের বিরোধিতা করে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন আবদুল হক। ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামে তাঁর লেখাটি দৈনিক ইত্তেহাদ এর রবিবাসরীয় বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছিলো। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ৩০ জুন দৈনিক আজাদÑএ ছাপা হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন বারনী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলে জুলাইয়ের (১৯৪৭) শেষ দিকে তার বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ দৈনিক আজাদÑএ একটি প্রবন্ধ লেখেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো।’ 

এখানে মহিউদ্দিন আহমদ এ সিদ্ধান্তে এসেছেন দেশভাগের আগেই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোর দাবি তুলেছেন বুদ্ধিজীবীরাই। আবার আহমদ রফিকও তাঁর ‘ভাষা আন্দোলন’ বইয়ে মত দিয়েছেন, বাংলা ভাষার স্বপক্ষে প্রথম দাবি দেশভাগের আগে থেকেই উঠছিলো ও এ কাজে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরাই। তিনি দৈনিক আজাদÑএ প্রকাশিত আবদুল হকের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধের সূত্র দিয়ে তাঁর বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, ‘যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিই সবচেয়ে বেশি।’ এখানে তিনি একে ‘রীতিমতো সোজাসাপটা কথা’ বলেও অভিহিত করেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র নিয়ে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর এ সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম ভাষা বিষয়ে প্রস্তাবনা পেশ করেন। এ প্রস্তাবনায় যা লেখা হয় তা মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ের ২৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন: পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। বদরুদ্দিন উমরও তাঁর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইয়ের প্রথম খ-ের ১৪ ও ১৫ নং পৃষ্ঠায় এ কথা উল্লেখ করেছেন। বদরুদ্দিন উমর ১৬ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন: ‘পূর্ব বাংলার মুসলমানদের আড়ষ্টতার আরও দুটি কারণ ঘটেছিলো। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা, আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষার সম্পর্কিত মনে উর্দু ভাষার প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মোহ।’ এরপর তিনি আরও দেখিয়েছেন: ‘বাঙালী মুসলমানের সত্যিকার সভ্যতা বলতে যেন কোনো জিনিসই নাই, পরের মুখের ভাষা বা পরের শেখানো বুলিই যেন তার একমাত্র সম্পদ। স্বদেশে সে পরবাসী বিদেশীই যেন তার আপন।’ 

ঢাকার নবাববাড়ির প্রভাব খর্ব করার জন্য পূর্ব বাংলায় শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে একটি মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনের আহবান করে সদস্য সংগ্রহের জন্য প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁকে রসিদ বই দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদের রসিদ বই দেন নি বলেই উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ে ৪০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, ওই ক্যাম্পের সবাই ছিলো সোহরাওয়ার্দি-আবুল হাশিম গ্রুপের কর্মীদের সমর্থক। আর আকরাম-নাজিমুদ্দিন গ্রুপের সমর্থকরা তাদেরকে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। 

আর এই দলীয় রেষারেষির কারণে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে এক সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ে ৪৩ নং পৃষ্ঠায় মহিউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন, কয়েকজন দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি তুললেও দলের অধিকাংশই এর পক্ষে ছিলেন। তাই ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘(মাওলানা) আকরাম খাঁ, নুরুল আমিন, চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও লিয়াকত আলী পরিচালিত মুসলিম লীগ হলো সরকারি মুসলিম লীগ এবং তাঁদেরটা হবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ।’ অবশ্য ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। এর ফলে অমুসলিমরাও এ দলে যোগ দিতে সমর্থ হয়। তবে মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যদিও মাওলানা ভাসানী চাইছিলেন মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে, কিন্তু হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুক। কারণ তাঁর ভয় ছিলো, এটা বাদ হলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।’ 


ভাষা নিয়ে পূর্ববঙ্গে সমস্যার শুরু :

ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই পূর্ব বাংলায় এক শ্রেণির মুসলমান গড়ে উঠছিলো বাংলা ভাষার প্রতি ঘৃণা আর উর্দুপ্রীতি নিয়ে। তারা উর্দুতেই কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। অথচ জন্মসূত্রে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও তারা আইডেন্টিটি হিসেবে পাকিস্তান নামক অবাস্তব ভৌগোলিক কাঠামোকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই কারণেই পাকিস্তানের সাত ভাগ লোকের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ‘কায়দÑইÑআযম’ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বক্তৃতায় বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার ছাত্রসমাজ ও রাজনীতিবিদরা ক্ষুব্ধ হন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তনে এ ঘোষণা আবার দিলে সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা ‘নাÑনা’ ধ্বনিতে শোরগোল করতে থাকে। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) অন্যতম। এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মধ্যস্থতায় উপস্থিত ছাত্ররা শান্ত হয় এবং জিন্নাহর সঙ্গে ছাত্রদের একটি দল আলোচনার জন্য যান। তবে আজও সে আলোচনার ফল সম্পর্কে জানা যায়নি। 


জিন্নাহর মৃত্যু :

পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে জিন্নাহর মৃত্যু প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। কেননা জিন্নাহই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন বারনী ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর পাকিস্তানে এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে জিন্নাহ এ প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন। ফলে পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে জিন্নাহর নাম উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের আহ্বায়ক তথা কায়দÑইÑআযম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু ভাষা সমস্যার সমাধানের আগেই তিনি পরলোকগমন করেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশভাগের আগে থেকেই তাঁর শরীরে বাসা বেধেছিলো মরণব্যাধী। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ জাল প্যাটল বলেন, ‘এক্সÑরে প্লেটে তিনি দেখেছিলেন তাঁর ফুসফুসে ছোপ ছোপ দাগ।’ কিন্তু তিনি এ কথা সবার সামনে খোলাসা করেন নি। এ বিষয়ে পাকিস্তানের লেখক তিলক দেভেশর বলেন, ‘ডা. প্যাটেল খুব পেশাদার চিকিৎসক। সেজন্যই কারও কানেই পৌঁছয়নি জিন্নাহর অসুস্থতার বিষয়টা। তবে আমার ধারণা এ কথা লর্ড মাউন্টব্যাটেন জানতেন (এ বিষয়টি), সেজন্যই স্বাধীনতার তারিখ ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি থেকে মাস ছয়েক নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অতদিন দেরি করলে জিন্নাহ যদি বেঁচে না থাকেন! যতি গান্ধী, নেহেরু বা সরদার প্যাটেলদের কাছে জিন্নাহর অসুস্থতার খবর পৌঁছাতো, ওরাও নিজেদের নীতি বদলে ফেলে বিভাজনের জন্য আরও সময় চাইতেন।’ আর তাই তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মারা যান। ফলে পূর্ব বাংলার ভাষা সমস্যা আপাতত অমীমাংসিতই থেকে যায়। 


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

এ সময় ছাত্র ও যুব সমাজের ভেতর ভাষা প্রসঙ্গে বিক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এক ভাষণে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দুই। আহমদ রফিক ও আবদুল মতিনের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য’ বইয়ে খাজা নাজিমউদ্দিনের বক্তব্য লেখা হয়েছে এভাবে, ‘পাকিস্তানকে আমরা এছলামি রাষ্ট্ররূপে গঠন করিতে যাইতেছি। যে এলমে কোপ কুসংস্কার বা ভেদাভেদ নাই সে রাত্রে কেমন করিয়া প্রাদেশিকতার বীজ বপন করা চলিতে পারে ?’ এতে করে ছাত্রসমাজও তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনের জন্য। ফলে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে সকলে একত্রিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করে রাখার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষে ছিলেন শেখ মুজিব ও অন্যরা, অন্য পক্ষে ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতা। মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতা ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব এবং অন্যরা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করার পক্ষে ছিলেন এবং এ পক্ষের দাবিই গৃহীত হয়। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের পূর্বদিকে মিছিল করে আসতে থাকে ছাত্ররা। সহসা পুলিশের গুলিতে আবদুস সালাম, রফিকুল ইসলাম, সফিউর রহমান, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে শহিদ হন। পুলিশ কতৃক ছাত্র হত্যার এ খবর মুহূর্তেই সারা দেশে আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়লে সবাই এ ঘটনার নিন্দা জানাতে থাকে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে থাকে। তবে ভাষা আন্দোলনে ঢাকাবাসীর নিরপেক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে আহমদ রফিক তাঁর ‘ভাষা আন্দোলন’ বইয়ের ৫১ নং পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন: ‘সেদিন বিকেলের ঘটনা যেমন ছিলো অভাবিত, তেমনি মর্মস্পর্শী। কান্না আর বেদনার প্রকাশ সেদিন নুরুল আমিন সরকারের প্রতি ধিক্কার ছুঁড়ে দিয়েছিলো। ব্যারাক প্রাঙ্গণে ঢাকাই আমজনতার ঢল চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। পুরান ঢাকার নানা বয়সী মানুষ ঘুরে ঘুরে পুলিশি হত্যাকা-ের আলামত দেখে ক্ষোভে উত্তাল হয়েছে। প্রাঙ্গণে রক্তের ছাপ আর হোস্টেলের শেডগুলোতে গুলির চিহ্ন তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তা একটিমাত্র বাক্যে প্রকাশ পায়: গুলি কইরা ছাত্র মাইরা হালাইছে। হাসপাতালে তাদের ভীড়ে অন্য রোগীদের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই ঢাকাইয়া মানুষই আটচল্লিশে ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, কেউ কেউ ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। আর একুশের প্রস্তুতিপর্বে তারা এক ধরণের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছে। পুলিশের গুলি আর মৃত্যুর ঘটনাই তাদের সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিলো।’ পরবর্তীতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পূর্ব বাংলায় ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৯৫৪ সালে বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনা করা হয়, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। আর এই আদর্শের পথ ধরেই পরবর্তীতে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশ হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে এই বাংলাদেশ। 


বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস :

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শই একটি কথা বলে থাকেন বাঙালিরা আত্মবিস্মৃত জাতি। বঙ্গভঙ্গ রদের পর মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষবোসের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অন্যদিকে, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী জওহর ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। এই দুটি আন্দোলনের সময় ভারতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও তুরস্কের উসমানীয় খিলাফতের পরিসমাপ্তি এই আন্দোলনের যবনিকা হয়। অন্যদিকে গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা চৌরিচোরার পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করলে পুলিশের গুলিতে তিন জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী এ আন্দোলনের ইতি টানেন। এ সময় তাঁর যুক্তি ছিলো যে যেহেতু এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য অহিংস উপায়ে জাগরণ সৃষ্টি করা, কিন্তু পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠেছে, সেহেতু আন্দোলন বন্ধ করাটাই ভালো। তবে ১৯৪২ সালে গান্ধী সত্যাগ্রহীরূপে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলো এবং ভারতের উত্তরÑপশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠলো পাকিস্তান নামক ব্যর্থরাষ্ট্র। পাকিস্তানউত্তর পূর্ববাংলা এবং স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে। বিশেষ করে পাকিস্তানে শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কতৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবজ্ঞা এদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুললেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার পর এদেশের বেশিরভাগ মানুষ এই ক্রাইসিসে ভুগতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরে আসে এবং এদেশের মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা মারাত্মক আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকে। এর সুযোগই নিয়েছে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সামরিক সরকার সমর্থকরা। ইসলাম ধর্মকে রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বরং কুরআন ও সুন্নাহকে অবমাননা করেছে তারা। যেমন ‘বাঙালি মুসলিম নাকি মুসলিম বাঙালি’ এই নিয়ে বিতর্ক, কুতর্ক অনেক হয়েছে। আবার ‘বাঙালি নাকি বাংলাদেশি’ এই নিয়েও অর্থহীন বিবাদ হয়েছে। বর্তমানে একশ্রেণির তরুণ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখার ব্যাপারে তর্কবিতর্ক করছে। অথচ ইসলামের এমন বিপদসঙ্কুল দিনে আমাদের উচিৎ একত্রিত হওয়া। পারস্পরিক মতভেদকে ঝগড়াবিবাদে রূপ না দিয়ে বরং আমাদের রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) অনুসরণ করা উচিৎ। আমরা অধিকাংশই তা এড়িয়ে যাই বলে আমরা আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগি। 

তথ্যসূত্র

১. মুনতাসির মামুন, ‘উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদÑসাময়িকপত্র’ 

২. মুনতাসির মামুন, ‘১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া’ 

৩. ডঃ আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫Ñ১৯৭১ 

৪. এবনে গোলাম সামাদ, ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ 

৫. ডঃ অতুল সুর, ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ 

৬. অধ্যাপক ডঃ সিরাজুল ইসলাম, ‘বাংলার ইতিহাসঃ ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো’ 

৭. ডঃ মর্তুজা খালেদ, ‘বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ’ 

৮. কমল চৌধুরী সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বঙ্গভঙ্গ ও সমকালীন বঙ্গসমাজ’ 

৯. যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/শঁংযধষ.যধংহধঃধংরভ/ঢ়ড়ংঃং/১১০৮০৩১৪১২৯১১৫৬৭ 

১০. যঃঃঢ়ং://নষড়ম.সঁশঃড়-সড়হধ.পড়স/২০১৭/০১/১০/৪৯৯০৩/ 

১১. যঃঃঢ়ং://ৎড়ধৎ.সবফরধ/নধহমষধ/সধরহ/যরংঃড়ৎু/ঢ়ধৎঃরঃরড়হ-ড়ভ-নবহমধষ-ঃযব-নধপশমৎড়ঁহফ-ংঃড়ৎু/ 

১২. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪৪৬০৯৮৯১ 

১৩. যঃঃঢ়ং://ধৎঃং.নফহবংি২৪.পড়স/?ঢ়=৪৫৭৬ 

১৪. আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব (১৯৪৮Ñ১৯৭০), মহিউদ্দিন আহমদ 

১৫. ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, আহমদ রফিক ও আবদুল মতিন 

১৬. ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক 

১৭. পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীত, বদরুদ্দিন উমর 

১৮. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪৫৮৪৯৯৩৭ (যদি জিন্নাহর রোগের কথা জানা যেত, তাহলে কি ভারতÑভাগ আটকানো যেত?) 

১৯. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪০৯৭৫৮৭৭ (জিন্নাহর আদর্শই এখনও পাকিস্তানের ভিত্তি) 

২০. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪৮৭৩৪৮৮২ (আওয়ামী লীগের ৭১ বছরঃ যেভাবে জন্ম হয়েছে দলটির) 

লেখকঃ সাংবাদিক। 


শহর থেকে বহুদূর...

শহর থেকে বহুদূর...

 


শহর থেকে বহুদূর

মিসির হাছনাইন 


মেম্বার বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বহু বছরের পুরনো শিমুল গাছ। গ্রামের মানুষ চিনে তুলা গাছ নামে। বসন্তে ফুল হয়, রক্তের মতন লাল লাল ফুল রাস্তায় পড়ে থাকে, মানুষের পায়ের তলায় ফুলগুলো কত অসহায়। তবে কোন্ ফুলের তুলা বাতাসে উড়ে উড়ে মেঘের মতন পথিকের নাকেমুখে এসে পড়ে? সন্ধ্যার পর যে কেউ এই রাস্তায় হেঁটে গেলে গা ছমছম করবেই। গ্রামের সবাই জানে এই গাছে একটা বোবা ভূত থাকে। ভয়টা সবার মনে গেঁথে গেছে। 

বাজার থেকে উত্তরে যে রাস্তাটা সোজা দুই গ্রামের মাঝখান দিয়ে কচুয়ার বিল আর পরান্নাইর বাগান, আরো কিছুদূর আসতেই প্রথমে পড়ে চৌকিদার বাড়ি। বংশের আট-দশ পুরুষ এই গ্রামের চৌকিদারী দায়িত্বে নিজেদের পূর্বপুরুষদের সন্মান এখনও ধরে রেখেছেন। মাহে আলম চৌকিদারের বড় ছেলে শাহে আলম বর্তমান কুটিরিয়া গাঁয়ের চৌকিদার। গাঁয়ের চোর, বাটপার, জুয়ারি, নেশাখোর চৌকিদারের চোখে পড়লে তাঁর রেহাই নেই। নিরপেক্ষ বিচার করে গাঁয়ের মানুষের কাছে খুবই সন্মানী ব্যক্তি শাহে আলম। চৌকিদার বাড়ির পাশ দিয়ে অন্য একটি রাস্তা নীলিমাগঞ্জ বাজারের দিক চলে গেছে। পুব পাশে হাওলাদার বাড়ি। বলতে হয় লবাগাজী হাওলাদার এই গ্রামের জমিদার। তিন বউের সংসার। প্রত্যেক ঘরের ছেলে-মেয়ে বিয়ে-শাদি দিয়ে আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অনেক রাগী আর হিংসুটে স্বভাবের কারণে প্রথম বউ পাশের গ্রামের আলমাস মাস্টারের সাথে গভীর রাতে পালিয়ে যায়। যদিও এ নিয়ে হাওলাদার কোন বিচার সালিশ ডাকেনি। ছয় বছরের মেয়েকে রেখে গেছে এতেই সে খুশি। চার ছেলের কোন ছেলের ঘরের ভাত সে খায় না। ছোট বউ আর তার প্রথম ঘরের কন্যা বিলকিস সহ হাওলাদার একসাথে থাকে। লোকজন বলে, প্রচুর জায়গা জমির মালিক হাওলাদার মারা গেলেও তাঁর বংশের পাঁচ পুরুষ খেয়েও নাকি থেকে যাবে।

হাওলাদার বাড়ির পশ্চিমে হাজী বাড়ি। এই বাড়ির লোকজন কারও আগেও নাই কারও পিছেও নাই। বাড়ির উত্তরের ভিটায় মোতাহার হাজীর ঘর। দুই ছেলে তিন মেয়ে। পুবের ভিটায় নতুন ঘর উঠেছে সেখানে নয়া বউ নিয়ে বড় ছেলে আতাহার থাকে। বড় মেয়ে হাওলাদারের পুতের বউ, মেজো মেয়ে শাহে আলম চৌকিদারের শালা বউ। ছোট মেয়ের জন্যেও দুই তিন গ্রাম থেকে সমন্ধ আসে কিন্তু মোতাহার হাজী চান পাত্র হবে হুজুর মসজিদের মুয়াজ্জিন বা ইমাম। সবার ছোট মতিহার ঢাকায় পড়াশোনা করে। তাঁর গ্রাম ভালো লাগে না। 

সোজা রাস্তার একটু উত্তরে মেম্বার বাড়ি। চারচালা টিনের ঘর। মেম্বার হওয়ার দুই মাসের মাথায় দ্বিতীয় বউ ঘরে আনেন। প্রথম বউের কোন সন্তানাদি নাই। এই কারণে কি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছেন মেম্বার শেফালীর ভাবনার বিষয়। মেম্বার বাড়িতে এসেই সে দেখেছে প্রথম বউের পাগলামি, কে জানে এই ভালো এই খারাপ! তাঁর কথা কেউ বুঝতে পারে না। বোবা মানুষের মতন দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ই....... করে ওঠে কতক্ষণ পর পর। সবাই বলে তুলা গাছের বোবা ভূত। আর যখন ভালো থাকে, তখন মনে হয় তাঁর মতন লক্ষ্মী বউ দ্বিতীয়টা এই গ্রামে নাই। শেফালী মনে মনে খুশিই হয়। যদি এখন একখান সন্তান দিতে পারে তাহলে ঐ পাগলিরে সে এই বাড়ি থেকে বের করবে। সেদিন মেম্বার গেছে হাঁটে, সন্ধ্যার একটু পর, শেফালী হাঁসের বাচ্চা খুঁজতে খুঁজতে এই পুকুর ঐ পুকুর কোথাও খুঁজে পায় না, শেষে দেখে, তুলা গাছে হাঁসের বাচ্চা নিয়ে বসে আছে প্রথম পক্ষের বউ ছামিনা। হাঁট থেকে এসে এসব শুনে মেম্বার বলে উঠে, বলো কি! আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি, তুমি দেখেছো, তুলা গাছে বসে আছে ছামিনা! ওর ত দুই মাস হলো এই রকম আচরণ!! তারপর, মেম্বার বহু চেষ্টা করেছে হুজুরের পানি পড়া, ভূত তাড়ানোর দোয়া, তাবিজ-কবচ, গাছে পেরেকঠোকা, খনকারের কেরামতি, বাড়ি বান্ধানো ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু কিছুই কাজ করেনি। অবশেষে নিরাশ হয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছে সে। সোজা রাস্তা উত্তর দিকে গিয়ে ঘুরে গেছে পশ্চিমে তারপর বহুদূর গেলে একসময় পরবে উপজেলা শহর।

পুরো গ্রাম মূর্খ মানুষ দিয়ে ভরা। এদের নিয়ে গ্রামে বসবাস করা যায়! না, আমি আর গ্রামে আসবো না। এইরকম বহু কথা চিঠিতে লিখেছে মতিহার। ম্যাট্টিক পাশ করেই ঢাকায় কলেজে ভর্তি হয়ে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ টিউশনির ইনকাম দিয়েই বেশ ভালোই আছে। কলেজ পাশ শেষে একটা ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি নেয়, সাথে ডিগ্রিতে পড়াশোনাও চলছে। হাজীসাবরে বলে দিয়েছে পড়াশোনার পাশাপাশি সে চাকরি করবে, বিয়ে শাদিও ঢাকায় করবে, তাকে নিয়ে তাদের মাথা ঘামাতে নিষেধ করে দিয়েছে মতিহার। হাজীও সব মেনে নিছে, পড়াশোনা জানা ছেলে, বাবা, ‘তুই যা ভালো বুঝিস’। এখন আর দুনিয়ায় চিন্তা তাঁর মাথায় নাই, পরকালের সুখের চিন্তায় তাঁর ঘুম হয় না। বাকি জীবন একটা সেজদায় কাটিয়ে দিতে চান মোতাহার হাজী। 

হাওলাদার বাড়ির পুবে চির চেনা মেঘনা নদী। নদীর নৌকায় মাছ ধরে সংসার চালায় বেড়ীবাঁধের সরকারি জায়গায় ঘর করে থাকা শ'খানেক জেলে পরিবার। হাওলাদারের সেজো ছেলে রহিম গাজী নৌকার মহাজন। বছর ঘুরতে ঘুরতেই প্রচুর টাকার মালিক হয়ে যান। এক রাতে নদীর পাড়ে নৌকার খরচের হিসাব নিতে একাই গেছিলেন, পথে ডাকাতের হাতে পড়ে কোনোমতে নিজের জীবন বাঁচিয়ে ঘরে ফিরেছেন।

হাজী বাড়ির আতাহারের বউ ফুটফুটে এক রাজপুত্র জন্ম দিয়ে নিজে পরপারে চলে যান। আতাহার দরগায় সিন্নি আর পীরের দরবারে একটা গরু মানত করেছে। বাপ সে ঠিকই হয়েছে কিন্তু বউকে হারানোর দুঃখ সে ভুলবে কি করে! মনে আছে জমিলা বলেছিল, তাদের পুত্র সন্তান হবে। আরো কত কত স্মৃতি কত কথা মনে পড়ে.. গামছা দিয়ে বারবার মুছে নেয় চোখ। এই বুঝি বুকটা ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে প্রাণপাখি। বউকে কবরে শুইয়ে দিয়ে পুত্র সরফরাজকে বুকে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গরগর করে কি যেন বললেন! সবাই ভেবেছিল, শোক কেটে গেলে আবার বিয়ে করবে আতাহার।

মোতাহার হাজী অনেক আগ থেকেই চান গাঁয়ে একখান মসজিদ উঠুক। রাস্তার পাশে সে তাঁর পাঁচ বিঘা জমি দিতে রাজি। রহিম গাজীও নতুন জীবন পাওয়ার পর খুব করে চায় হ্যা, গাঁয়ে মসজিদ দরকার। সেদিনই সে মেম্বার, চৌকিদার, হাওলাদার কে ডেকে নিয়ে সবাই হাজী বাড়ির উঠানে বসে। বৈঠক শেষে ঠিক হয় মসজিদ উঠবে হাজী বাড়ির দক্ষিণ পাশে যাতে গাঁয়ের সবার জন্যে সুবিধা হয়। দুদিনে চারচালা টিনের মসজিদ ঘর দাঁড়িয়ে যায়। এখন দরকার মুয়াজ্জিন আর ইমাম। একজন হুজুর রাখলেই সে একসাথে দুই করতে পারবে। কিন্তু এইরকম বেতন করা হুজুর পাওয়া ত চারটি খানি কথা না, সময়ের ব্যাপার। মোতাহার হাজী বলেন, তাহলে এতদিনে আমিই দায়িত্ব পালন করবো, আর তোমরা যত তাড়াতাড়ি পারো আশেপাশের গ্রামে গঞ্জে খোঁজ নাও একজন কুরান হাদীস জানলেওলা অবিবাহিত মাওলানা হুজুরের, যাতে করে আমার মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে একখান ঘর করে দিয়ে আমাদের গাঁয়ে রেখে দিতে পারি। হাওলাদার এক গাল হেসে বলেন, ভালোই ত হইবো কিন্তু এমন হুজুর পাইলেই হয়। হাজী বাড়ির কাজের পোলা লাবু মিয়া হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আমগো গাঁয়ে নূরানী মাদ্রাসা আছে, ওখানে গেলে জুয়ান হুজুর পাইবেন আমগো পাতাবাহার বু’র লাই’। কথা কিন্তু খারাপ কয় নাই, কি কন আব্বা হুজুর?? বলে সেলিম গাজী। 



কুসুমপুর বাজারের উত্তরে সোনাগাজি গাঁও, পায়ে হেঁটে কিছুদূর গেলেই একটা বটগাছ, বহু দিনের পুরনো..মনে হবে, হাজার বছর আগের একজন মানুষের কথা জিজ্ঞেস করলে গরগর করে সব বলে দিতে পারে, ডানের পুকুর পাড় দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যায় বিলের পাশে ত্রিভুজ আকৃতির দোচালা টিনের ঘর মাঝখানে খোলা মাঠ বিকেলে ছাত্ররা খেলাধুলা করে। কেরামত আলী নূরানী হাফেজী মাদ্রাসা। কতগুলো ফুল ফুটে আছে, ঝরে পড়ে আছে কতগুলো ফুল, বিকেলের ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে মাদ্রাসার ভিতরে ঢুকে সোহেল গাজী সাথে শাহে আলম চৌকিদার, মোফাজ্জল মেম্বার, আতাহার।

ছোট ছোট কতগুলো ছেলে তাদের খেলা বন্ধ করে দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকে গেল, সবার পড়নে লুঙ্গি, গায়ে দাদা গেঞ্জি, মাথায় সাদা টুপি। তোমারা খেলো, খেলো, তোমাগো বড় হুজুরের ঘরটা কোনদিকে? বলে,সোহেল গাজী। ‘আন্নে আ’র লগে আইয়েন’ বলে, ছয় বছরের কালো ছেলেটা তাদের নিয়ে যায় হুজুরের ঘরে।

-আসসামুলাইকুম, হুজুর কেমন আছেন?

হাতে হাত মিলিয়ে সবাই বসে পড়লো।

-অলাইকুমআসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ। যাও ঐ ঘরে গিয়ে বলো, চা দিতে। ছেলেটি চলে গেল।

পুরো ঘটনা শুনে হুজুর একটু মুচকি হাসি দিলো পান খাওয়া মুখে। বলে, জুয়ান পাশ করা ছেলে আরো এক মাস পর দিতে পারুম। তো, এখন আমি আপনাগো একটা ক্লাসে নিয়ে যাবো এখানের সবাই পাশ করে বেরুবে কিছুদিন পর, প্রথমে যারে পছন্দ হবে শুধু তারে ডাকবেন, নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে আপনারা ফিরে যাবেন গাঁয়ে, ছেলের পিতাসহ আমি কুটিরিয়া গাঁয়ে যাবো, কথা দিলাম। কি সুন্দর গুনগুন করে সবাই মুখস্থ করছে আল্লাহর পবিত্র কুরআন শরীফ। ক্লাসে ঢুকলে সবাই সালাম দেয়, তারপর সবাইকে দাঁড়াতে বললেন বড় হুজুর। চৌকিদার একজনকে দেখে আতাহার, সোহেল গাজীকে কানে কানে কি জানি বললো মেম্বারও তাতে রাজি হয়ে গেল। ছেলেটার বয়স আঠারো কি উনিশ, মুখে কেমন জানি লজ্জা, চোখে একটু ভয়। উঁচা লাম্বাই ভালোই মানাবে আমগো পাতাবাহারের সাথে, মনে মনে ভাবলো আতাহার। 

-কি নাম তোমার? জিজ্ঞেস করলো আতাহার।

-মোহাম্মদ রফিকউল্লাহ। 

-তোমগো গেরাম কোনটা? বাপের নাম কি ? বলে, মোফাজ্জল মেম্বার। 

- মনিরামপুর গাঁও, বাবা ইসমাইলউল্লাহ খনকার।

-ওওও শুনছি, ইসমাইল খনকারের পোলা তুমি, আচ্ছা, আচ্ছা। বললেন, সোহেল গাজী। 

তোমরা সবাই বসো, যাও রফিকউল্লাহ, গিয়ে বসো, মনোযোগ দিয়ে পড়ো.. বড় হুজুর এই বলে ক্লাস থেকে সবাইকে নিয়ে বের হলেন, সবাই আবার গুনগুন করে পড়তে লাগলো সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। হুজুর আমরা তাহলে গেলাম আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি, এই বলে সোহেল গাজী হাত মিলালো, একে একে সবাই হাত মিলিয়ে কথা বলতে বলতে কুসুমপুর বাজার থেকে মিষ্টি খেয়ে রওনা দিলো তখন রাত দশটা বাজবে হয়তো, কারো কাছে ঘড়ি নাই। মসজিদ নিয়ে নানান কথাবার্তা বলতে বলতে তাঁরা একসময় চলে আসেন গাঁয়ে।

মতিহার বিয়ে করেছে। একইসাথে ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করতো মেয়েটা। ঢাকায় বড় বাসা নিয়ে থাকে, চাকরির বেতনও পায় ভালো। কিছুটাকা সাথে শাড়ি লুঙ্গিসহ একখানা বড় চিঠি লিখে পাঠায় মতিহার। মোতাহার হাজী মনে মনে খুশি হয়। যা হোক ছেলে মেয়েগুলো সুখে থাক এটাই আমার চাওয়া, ওদের সুখ দেখতে দেখতে যেন আমি মরতে পারি এই প্রার্থনা সবসময় করি আল্লাহর কাছে। মোতাহার হাজী চিঠি লিখবে, এই জীবনে দুইখান চিঠি লিখেছে সে, আজ আনন্দে লিখবে, সুখ লিখবে চিঠিতে।

প্রিয় মতিহার,

সুখে আছো, শুনে খুব ভালো লাগলো। তোমরা ভালো থাকো এটাই ত আমি চাই। তোমাদের মা, যে বছর হজ্জ করে দেশে আসলাম সে বছর মারা গেছে, মনে আছে? মায়ের জন্যে দোয়া করো। কতটা কষ্ট করে তোমাদেরকে আমি লালন করেছি, আমি অচল হয়ে গেলে ফেলে দিও না, অবহেলা করবে? আমি চাই না, সবসময় চাই আল্লাহ যেন সবগুলো গুনাহ ক্ষমা করে অচল হওয়ার আগে পৃথিবীতে কম কষ্ট দিয়ে মৃত্যু দেন। তোমাদের দাদীজানকে ত তোমরা দেখেছো, কি কষ্ট পৃথিবীতে পেয়ে আমার গুনাগার মা মরলো, আমিই তাকে শেষপর্যন্ত লালন করেছি। ও হ্যা, পাতাবাহারের বিয়ে দিচ্ছি তুমি চাইলে আসতে পারো গাঁয়ে..তোমার ভাই আতাহার বিয়ে করে নি, আমিও জোর করি নি, আর করবোও না, তোমাদের বসয় হয়েছে, তোমরা এখন ভালোমন্দ দুই বুঝো। সরফরাজ আমাকে দাদাই ডাকে, আতাহারের ছেলে। আমার খুব ভালো লাগে, আমি ওর সাথে খেলি। ভালো থাকো। গাঁয়ে আসলে খবর দিও।

ইতি

তোমার বাবা


মোতাহার হাজী থ্রি ক্লাস পর্যন্ত পুরান গাঁয়ের পাঠশালাতে পড়েছে, লিখতে শিখেছে। 

মোফাজ্জল মেম্বারের বউ ছামিনা বোবা হয়ে আছে। আজ রাতে মনে হয় ভর করেছে বোবা ভূত, তাঁর ঘর থেকে ই,ই.. আওয়াজ আসছে। টর্চ লাইট নিয়ে মেম্বার তাঁর ঘরে গেলো। আলো পড়তেই ছামিনা তাকায় মেম্বারের চোখে, কি ভয়ানক লাল চোখ! মনে হয়, এই বুঝি বের হয়ে যাবে লাল চোখ। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ই,ই,ই... করে কি জানি বলে। মেম্বার বলে উঠে, শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে, সকালে শুনবো। ঐ ঘরে শেফালী শুয়ে আছে ঘুমের ভান ধরে, মনে মনে বলে, ‘ইশ্শিরে..! বোবার লগে পিরিত দেখলে ঘুম ভাঙ্গে আমার’। ঘরে ঢুকে হারিকেনের বাতি একটু বাড়িয়ে দিয়ে মেম্বার বললে, ঘুমাই গেছো শেফু?? হ, শেফু ঘুমাইছে, এখন তুই ঘুমা, গায়ে হাত দিবি না, সোজা হয়ে শুবি, নাক ডাকবি না কইলাম.. এগুলো বলতে ইচ্ছে করতেছে শেফালীর আর রাগে তাঁর তামাম শরীর জ্বলতেছে। হারিকেনের আলো একটু কমাতে গিয়ে বন্ধ করে দিলেন মোফাজ্জল। তারপর কি জানি বলে শুয়ে পড়লেন।

খুব সকালে দরজা নাড়ায় ছামিনা। শেফালী ওঠে দরজা খুলে দেয়। শেফালী মনে মনে দেখতে পারে না ঠিক কিন্তু যখন ছামিনা ভালো থাকে ছামিনার ব্যবহারে সে তাঁর সাথে খারাপ কিছু করতে পারে না। আর ছামিনাও সবকিছু ভুলে যায়। তাঁরে খুব আদর করে। খুশি খুশি মুখ নিয়ে শেফালীরে বলে, দেখ, দেখ বইন, আমি মা হমু, অবশেষে আল্লাহ আমার দিক মুখ তুলে চাইছে। কথা গুলো কেমন জানি একটা বিকট আওয়াজের মতন শেফালীর কানে বাজতেছে। এ কি শুনলো সে। কিরে বইন তুই খুশি হস নাই?? সোনার মতন সুন্দর মুখখান এমন বেজার কেন? কি হইছে, শরীর খারাপ?? যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো। উনি ঘুম থেকে উঠলে বইলো আমার ঘরে একটু আসতে। ততক্ষণে মেম্বার সজাগ হয়ে গেছে, খবর শুনে মুখ না ধুয়েই খুশিতে নাচতে নাচতে বাজারে  মিষ্টি কিনতে চলে যান এই ভোর বেলাতে। শেফালী শুয়ে আছে। ছামিনা চলে গেল তাঁর ঘরে। মেম্বার খুশি হলেও তাঁর চিন্তার শেষ নাই।

বাজারে করিম গাজী আলু আর তিল নিয়ে যান। বিক্রি করেন, হাওলাদারের জন্যে ঔষধ আর ঘরের জন্যে কেরসিন কিনে রওনা দেন। পথে দেখা হয় লাবু মিয়ার সাথে। করিম ভাই আসসামুলাইকুম, কেমন আছেন? ভালো আছি, তুই কেমন আছস? ভালো আছি, আপনাগো দোয়া বরকতে। ভাই, মনিহার বু কেমন আছে, মনিহার বু আর সোহেল ভাইরে খবর দিছে হাজী চাচা, কইছে, বাজারে আপনার লগে দেখা হলে বলতে। আচ্ছা লাবু মিয়া, আমি খবর পৌঁছে দিবো। কি আনছিলা বাজারে? ভাই, আলু আনছিলাম। কথা বলতে বলতে পরাইন্নার বাগানের রাস্তায় ঢুকে দুইজন। কি জানি একটা পাখি ডেকে উঠলো, রাতের ঘরকুনো ব্যাঙ রাস্তায় ডাকছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আকাশে চাঁদ নাই, তারাদের আলোয় এসব রাস্তায় গাঁয়ের মানুষ চোখ বন্ধ করে হাঁটতে পারে।

করিম গাজী বাসায় আসে। বউরে ডাকে, ভাত খাবে, শুধু ডাল দেখে মেজাজ গরম করে জাল নিয়ে মাছ ধরতে গেলে.. বউ বলে, এতো রাতে যাওনের দরকার নাই, হাঁসের ডিম আছে ভাজি দি। কে শুনে কার কথা! আব্বার ঔষধ আনছি বিলকিস কে ডেকে দিয়া দিও, আমি আসতেছি.. এই বলে ঝাকি জাল নিয়ে মেঘনা নদীতে যায় মাছ মারতে। এর আগেও বহুবার মাছ ধরেছে সে, রাতের বেলায় মাছ ধরা খুবই সাহসের ব্যাপার। রাতে ভালো মাছ পাওয়া যায়। মাছেরা রাতের বেলায় চোখ বন্ধ রাখে?? আমি জানি না। নদীতে এখন ভাটা পড়েছে। পানি দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে যাচ্ছে, কি ¯্রােত..! কূল থেকে জোয়ারের পানি নেমে গেছে কিন্তু কচুরিপানা সহ আরো অনেক মরা গাছের ডালপালা, লতাপাতা, বোতল, ভাঙা হাড়ির টুকরা, প্লাস্টিক, পলিথিন ইত্যাদি পড়ে আছে, আবার জোয়ার আসলে ভেসে ভেসে চলে যাবে কোথাও। করিম গাজী হঠাৎ দেখে একটা মানুষ! হ্যা মানুষই ত, মরা নাকি!! প্রথমে ভয় পেলেও পরে ঠিকই কাঁধে করে তাকে বাড়িত নিয়ে আসে, তখনই ভরা পেটের পানি মুখ দিয়ে পড়ে ভিজে গেছে, করিম গাজীর পিঠ। সে বুঝতে পারে ভাসতে ভাসতে চলে আইছে, ভাটার টানে উঁচুতে আটকে গেছে, আর যাইতে পারে নাই, মনে হয় বাঁইচা আছে। উঠানে আগুন জ্বালিয়ে মানুষটারে নতুন জামা কাপড় পড়িয়ে বসিয়ে দেয় করিম গাজী। এতক্ষণে বাড়ির সবাই উঠানের লোকটাকে দেখে নিয়েছে..। হাওলাদার বলে উঠেন, উনারে সোহেল গাজী’র সামনের ঘরে রাখো, জ্ঞান ফিরলেও কোন কথাবার্তা বলার দরকার নাই, ঘুমাইতে দাও, ভোরে সবকিছু জানতে পারবা সকলে, এখন চিল্লাপাল্লা না কইরা সবাই ঘুমাতে যাও।

গাঁয়ের নাম মালতীমালা, উত্তরে দিনাজপুর জেলায় বাড়ি। লঞ্চে করে বরিশাল যাওয়ার পথে ডাকাতের হাতে লঞ্চ ডাকাতি হলে সবাইকে মেরে নেংটা করে নদীতে পেলে দিয়ে লঞ্চ নিয়ে যান। উনার নাম শ্যামল কান্তি দে। দিনাজপুর অঞ্চলের একজন বড় ব্যবসায়ী লোক। ব্যবসার কাজে বরিশাল আসলে ডাকাতের হাত থেকে কোন মতে জীবন নিয়ে লাফিয়ে পড়েন, তারপর ভাসতে ভাসতে কখন যে জ্ঞান হারালেন সে জানতেই পারেন নি। তাঁর দ্বিতীয় জীবন পাওয়া তে লোকটা খুবই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলো। বিনয়ী হয়ে তারপর বললো, আমি সারাজীবন আপনাদের মনে রাখবো, কিছু মনে না করলে আমি সামান্য উপহার আপনাদের পাঠাবো, যদি আপনারা তা গ্রহণ করেন, আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো আপনাদের চরণে। আর করিম গাজীকে সে নিয়ে যেতে চায় তাঁর সাথে করে। মনে মনে করিম গাজীও চায় দিনাজপুরের চারপাশ দেখে আসতে আর মানুষটাকে তার পরিবারের কাছে ঠিক মতন পৌঁছে দিতে।

মেম্বার অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিন্ধান্ত নেয় তুলা গাছটা সে কেটে ফেলবে। তাঁর বড় বউ পোয়াতি, আর শেফালীর মনের খবর তাঁর জানা। বাজার থেকে মিষ্টি কেনার পথে গাছটা বিক্রি করে দিয়েছে, বিকেলে এসে গাছ কেটে নিয়ে যাবে। মেম্বার অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে।

রাস্তায় দেখা হয় বড় হুজুর আর ইসমাইল খনকারের সাথে। কুশল বিনিময় করে তিনজনে যায় হাজী বাড়ি।

মোতাহার হাজীর সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে, চা বিস্কুট খেয়ে রওনা দেয় ইসমাইল খনকার সাথে বড় হুজুর। 

কার্তিক মাসের ১৫ তারিখ বিয়ে হয়। মসজিদের পাশে নতুন ঘরে নয়া সংসার রফিকউল্লাহ হুজুরের।

কয়দিন যাবৎ ছামিনা আর পাগলামি করছে না। তবে কি গাছ কাঁটার সাথে সাথে বোবা ভূত উড়াল দিছে? শেফালী বাপের বাড়িতে গেছে। অঘ্রাণ মাসে ছামিনা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। তার দুইদিন পর লবাগাজী হাওলাদার মারা যায়।

অনেক বছর পর মতিহার গ্রামে এসেছে সঙ্গে তাঁর বউ আর দুই ছেলে মেয়ে। মোতাহার হাজী অসুখে পরেছে, মনে হয় না, এই যাত্রায় আর সেরে উঠবেন। মতিহারের ছেলে মেয়ে এর আগে কখনও গ্রাম দেখে নি। বড় মেয়ে নিপুণ স্কুল পাশ দিয়ে কলেজে উঠেছে, তাঁর কাছে গ্রামখানি স্বর্গের মতন লাগছে। স্বর্গের কথা সে বহুবার শুনেছে, বইতে পড়েছে কিন্তু কখনও দেখেনি, এই যাত্রায় সে ঠিক করেছে স্বর্গেই থেকে যাবে, বাবা মার সাথে সে আর শহরে ফিরবে না।

পরশু রাতে ভোরের আজানের আগে মোতাহার হাজী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আকাশে চলে গেলেন। একে একে সবাইকে যেতে হবে। কেমন সহজ ভাবে চলে গেলেন মোতাহার হাজী, ছেলে মতিহার হয়তো পকেটে রাখা চিঠিটা আরেকবার পড়েছে, তাঁর পাষাণ হৃদয় চোখে জল এনেছিল কিনা আমি জানি না! কত বছর বয়সে মারা গেলেন হাজীসাব? গ্রামের মানুষ জীবনের হিসাব রাখে না। তার সপ্তাহ খানেক পর মতিহার ঢাকায় যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। 

এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে যায় নিপুন এই প্রথম বুঝতে পারলো। সে মনকে শক্ত করে বাবাকে গিয়ে বলে, আমি গ্রামে থাকবো, শহর আমার ভাল্লাগে না, বাবা, প্লিজ, তুমি না করো না। মতিহার রেগে গিয়ে বলে, না, গ্রামে থাকতে হবে না, কি আছে গ্রামে! চারপাশে মানুষ থাকে নাকি! গরু, ছাগল দিয়ে ভর্তি মূর্খের দল সব, না, তোমাকে এখানে থাকতে হবে না, তাড়াতাড়ি রেডি হও। সে ও বলে দিছে সে শহরে যাবে না, মানে যাবে না, আর যদি যেতে হয় তাঁর লাশ যাবে। মেয়ের এমন বাড়াবাড়িতে মতিহার জিদ করে স্ত্রী আর পুত্র কে নিয়ে ঢাকায় চলে গেল।

নিপুণ ঠিক করেছে এখানকার কলেজে ভর্তি হবে। বাকি জীবন সে গ্রামেই কাটাবে। তাঁর কাকু আতাহার একজন কৃষক, কখনও স্কুলে গেছে কিনা সে জানে না। কিন্তু কত সুন্দর ব্যবহার, কত সহজ সরল জীবন যাপন। একমাত্র ছেলে সরফরাজ জেলা শহরের কলেজে অর্নাসে পড়াশোনা করছে। নিপুণ তাঁর জীবন সঙ্গী ঠিক করে নিয়েছে, যদি সরফরাজ ভাই রাজি থাকে। 

দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে জেলা শহর থেকে সেও গ্রামে আসে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই সে তাঁর বাবাকে সবকিছুতে সাহায্য করেছে। প্রথম দেখায় সে ধরেই নিয়েছে নিপুণ শহরের মেয়ে তাঁর মতন গাঁয়ের ছেলের সাথে সে কি আর কথা বলবে!

কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কি হলো..! আজ তাদের বিয়ে..। সে কথাও লিখে রাখি। উপজেলা শহরের হাজী মোতাহার মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল সরফরাজ বিন আতাহার এখন কৃষিকাজ অনেকটাই ভুলে গেছে।


আতাহার রয়ে গেল গাঁয়ে। শত চেষ্টা করেও তাকে উপজেলা শহরে নিয়ে যেতে পারলো না সরফরাজ বিন আতাহার। মার মার করে গাঙ ভাঙ্গছে, আতাহারও ভাঙ্গছে..


পদাবলি

পদাবলি

 



তোমায় পড়ে মনে বাবা তোমায় পড়ে মনে

জাকির হোসেন কামাল


বাবা তুমি খুঁজতে যাকে অফিস থেকে ফিরেই,

দিনে রাতে ছিল তোমার স্বপন যাকে ঘিরেই,

তার কথা কি এখন তুমি ভাবো?

তার কথা কি তোমার এখন একটু  মনে পড়ে,

তাকে ছাড়া দিব্যি তুমি থাকো কেমন করে?


একদিনও না দেখলে যাকে পাগল হয়ে যেতে,

যার জন্যে থাকতে তুমি সুখের দোলায় মেতে,

তার কথা কি এখন তুমি ভাবো?

তার কথা কি এখন তোমার মনে পড়ে বাবা,

এখন তোমার বুকের ভেতর আর জ্বলেনা লাভা?


জানো বাবা, মেঘরা যখন আকাশ কালো করে,

একলা আমার তোমায় তখন ভীষণ মনে পড়ে।

এমন দিনে খুব শোনাতে দৈত্য দানোর কথা,

তোমার মুখে পড়তো ঝরে অপার সরলতা।

এখন ভয়ে কাঁপি আমি মেঘেরও গর্জনে,

তোমায় পড়ে মনে বাবা তোমায় পড়ে মনে।


একটা শাড়ি প্রথম তুমি কিনে দিয়েছিলে,

পড়িয়ে দিলে সেই শাড়িটা মা ও তুমি মিলে।

জানো বাবা, সেই শাড়িটা যায় না পড়া মোটেই,

স্মৃতির বিষাদ লেগে থাকে আমার বুকে ঠোঁটেই।

তোমায় ছাড়া এই পৃথিবীর সবই লাগে ফাঁকা,

কেবল মনে হচ্ছে আমার, বৃথাই বেঁচে থাকা।


জানো বাবা, ঝিঁ ঝিঁর ডাকে  সন্ধ্যা যখন নামে,

তোমার স্মৃতি কড়া নাড়ে আমার বুকের খামে।

মনে পড়ে গুজে দিতে খোঁপায় গোলাপ দু’টি,

কেমন করে ভুলবো তোমার আদর ও খুনসুটি।

এসব ভেবে ইচ্ছে করে ঘর ছেড়ে যাই বনে,

তোমায় পড়ে মনে বাবা তোমায় পড়ে মনে।


ছেঁড়া ভালোবাসা

মাহতাব উদ্দিন 


গহীন আঁধারে ঢেকে গেছে স্বপ্নের ধরণী

শান্ত পিলসুজে মিটমিট করে জ্বলে জ্ঞানের লণ্ঠন 

ঘোর ঠেলে আলোকচ্ছটার ব্যর্থ আগোয়ান 

মানব-পশুর হিংস্র ঝড়ে পরিশেষে নিভে যায়। 

দানবীয় ঝড়- জলোচ্ছ্বাসে উবে যায় হাড্ডিসার মনুষ্যত্ব

সব হারিয়ে ভাগ্যেরা হালে দুর্গত অঞ্চলের বাসিন্দা 

মুমূর্ষু প্রাণ বাঁচাতে দুর্লভ ত্রাণের খুঁজে কায়ক্লেশে মানবতা

চরণে শিকল-পরা রোদ পঙ্কিল দুঃখকে শুকাতে আসে না।

বাঘের কবল থেকে বেঁচে গিয়ে অসহায় হরিণীরা-

নামধারী কুলীনের পাশবিক অভিলাষে বন্দি

উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে সহসা পতিত যেন 

ছেঁড়া ভালোবাসা শুধু  হাতছানি দেয় অবলারে।



ক্ষরণ

মজনু মিয়া 


তুমি কি জান, কতটা ক্ষত হলে হৃদয়ে রক্ত ঝরে?

সবুজ পাতা ঝরে পড়ে যায়, দুঃখ বেদনায়?

আকাশের তারা জ্বলসে যায় এক পলকের মধ্যে? 

থরথর করে কাঁপতে থাকে, পায়ের তলার মাটি

দাঁড়াবার শক্তি হারা হয় দেহ?

মন হয় নিরানন্দ, চুপচাপ বসে বসে কান্না হয় সঙ্গী? 

দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে, আর থামতেই চায় না?

এসো কাছে দেখো, হৃদয়ে কান পেতে শোনো, 

কেমন ক্ষরণ হচ্ছে সেখানে! 

পুরোটাই তোমার কারণে, তুমি আমার থেকে যেই

হারালে, তারপর থেকে আর ক্ষরণ বন্ধ হয় নাই!



ফিরে যেতে চাই

জাহিদ আজিম


এই শহরটা জুড়ে শুধু’ই পোড়া মাটির ঘ্রাণ

কঠিন চিত্তে কোথায়ও এক রতি নেই প্রাণ।

রঙে ছাওয়া দেখতে ভীষণ, সবই যেন মেকি

কাগজ-ফুলের বাগানটাতেই মধুর স্বপ্ন আঁকি।

বড্ড নেশায় শূন্যে ওড়াই সুখের আতসবাজি

ঝাপসা চোখে তবুও নীল জোনাকিই খুঁজি।

প্রাচীর ঘেরা জীবন এখন সুখ শিকলে বাঁধা 

ক্ষণে ক্ষণেই মনটায় ভাসে দুর্বোধ্য সব ধাঁধা।

কোন পথেতে আবার যাব সবুজ শ্যামল গায়

প্রাণ ভরপুর প্রকৃতি হেথা রয়েছে অপেক্ষায়।

অকৃত্রিম রুপ, স্নিগ্ধ মায়া আপন করে পাবো

সব জড়িয়ে বুকে আবার মাটির মানুষ হবো।


এর নাম ভালোবাসা

মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ


গভীর রাত কেউ জেগে নেই-

ডাহুক কালিম বন্দিখাঁচায় পায়চারী করছে। 

জেগে আছি আমি..


সুচিন্তিত বন্দনা, শ্বাস প্রশ্বাসে

ঘনঘন উঠানামা করে।

নাভিশ্বাস ওঠে শিরা উপশিরায়।


এর নাম ভালোবাসা। রাত জেগে তাঁর

একান্ত প্রিয়ভাজন হওয়া যায়।

পৌঁছা যায় কাছাকাছি।



এবং তুমি

রাসেদুল হাসান রাসেল


কোথায় এখন-

আষাঢ়ের কদম,

কৃষ্ণচূড়ার ফুল,

স্বর্ণলতার মালা আর

শ্রাবণের জলে মাতামাতি,

সন্ধ্যাকালের কুপিবাতির নিভু নিভু আলো।

কোথায় আছো তুমি?

তোমার লাল, নীল আর সরষে হলুদ মাখা স্বপ্ন।

খুনসুটির প্রণয়,

এবং তুমি।



শোকের হাসি

রাশেদ বিন শফিক


দিনলিপির পৃষ্ঠায় সুখস্মৃতি নেই

বেদনার সমবেত মজলিশ!

কষ্টের নদীতে সাঁতারকাটা নিত্যকার রুটিন।


আমার আর গোপনীয় কিছু নেই

বেদনার বৈঠকে সব আলোচ্য বিষয়,

আমাকে নিয়ে নগ্ন সংলাপ সর্বত্র!

এ আমি যেন খেলবার পুতুল।


ধর্ষকের স্রষ্টারাই আমাকে ধর্ষিতা ডাকে,

ধর্ষকের শাস্তির আওয়াজ কণ্ঠ তুলে।

আমার আর কান্না আসে না একটুও,

বরঞ্চ  অট্টহাসিতে মেতে উঠি!

জানি না সুখে না পরম শোকে।


অশরীরী

অশরীরী

 



অশরীরী

আহাদ আদনান


খড়িয়া বাজার সোমবারের হাটে মধু পাগলা বিষের বেসাতি করে। ‘ইন্দুর, তেউলাপোকা কোন ছাড়, আড়াই মণি জব্বর পালোয়ান হইবে সাবাড়’। এই বিজ্ঞাপন শুনে ছেলে ছোকরার দল জড়ো হতে থাকে। বিষ বিক্রি হয় সামান্যই। গত বকরি ঈদের দুই সোমবার পরে যেমন ক্রেতা ছিল মাত্র একজন। হাট জমার আগেই দুপ্তারার সালেক মিয়ার ছোট মেয়ে সালেনূর সালোয়ারের খুট থেকে অতিসন্তর্পণে দশ টাকার একটা নোট বের করে বলেছিল, ‘কাকু, এক পোটলা বিষ দেও। ইন্দুর মরবতো’?

লালমাটিয়ার ছোট ফ্ল্যাটটায় দুইটা মাত্র থাকার ঘর। সালেনূর অবশ্য থাকে রান্নাঘরে। তিনবেলা খাওয়া আর মাসে তিনহাজার টাকা। এই চুক্তিতে এসেছে সে। ‘মামা, কাম কিছুই নাই। সাহেব ডেভেলপার আর ম্যাডাম পার্লারের ব্যবসা করে। দুই পোলা থাকে দার্জিলিং, মানে ইন্ডিয়া। একটা পড়ে কলেজে, আরেকটা স্কুলে। তোমার মাইয়া দুইটা বাসন মাজব, ঝাড় দিব, রান্না করব, টিভি ছাইড়া সিরিয়াল দেখব আর পেট ভইরা খাইয়া চেগাইয়া ঘুম দিব। তুমি কইলে কাইলই দিয়া আহি’। বাবা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ডেভেলপার কি জিনিস মত্তিন’? সেই ডেভেলপারের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে শুয়ে কামিজের ভেতর থেকে সালেনূর বিষের প্যাকেটটা নেড়েচেড়ে দেখে।

দুই ঘণ্টা পর। সালেনূর ঘামছে দরদর করে। গরমে ওড়নাটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এই বাসায় অবশ্য ওড়নাটা না থাকলে ম্যাডাম ভয়ঙ্কর রাগ করে। স্যার রাগ করে ওড়না থাকলে। এক টান দিয়ে কাপড়ের বস্তুটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে তারপর তার কথা শুরু হয়। এখন অবশ্য ওড়নাটা না পরলেও চলে। জীবিত কেও কি ফ্ল্যাটে আছে? আজ বৃহস্পতিবার রাত। এই রাতে সাহেবের বন্ধুদের পার্টি বসে। লাল-নীল জলের ফোয়ারা বসে। ম্যাডামই গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দেয় মদিরা। আজ সাথে ছিল মুরগি ভাজা। সালেনূর অনেক যতœ করে ভেজেছে এসব। রুটিন তার মুখস্ত। অতিথিরা যাবে দেড়টার দিকে। স্বামী স্ত্রী ড্রয়িং রুমে থাকবে আরও মিনিক কুড়ি। একজন আরেকজনকে অশ্রাব্য গালাগালি করবে। হাতে থাকবে মদের গ্লাস। সালেনূর হয়ত এসে গ্লাস ভরে দেবে। একসময় অচেতন পড়ে থাকবে দম্পতি। ফ্রিজ থেকে একটা মদের বোতলে আজ আগেই বিষ মিশিয়ে রেখেছে সালেনূর। আলাদা একটা বোতল। অর্ধচেতন অবস্থায় স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ কি ধরা পড়ে? সালেনূর তাই ভাবে, বেঁচে নেই কেও আর। নাকি সে স্বপ্ন দেখছে? দুটো মানুষ হত্যা করে ফেলেছে একা সে, বিষয়টা খুব বিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না।

খুব অস্থির লাগছে। দরজা খুললেই নিশ্চিত হওয়া যায় কিন্তু ভয় করছে খুব। ছোটবেলায় একবার বিষ খাওয়া মানুষ দেখেছিল সালেনূর। মুখভরতি ফেনা, মল-মূত্রে একাকার আর ঘামে ভেজা শরীর। দেখে ছোটরা বমি করে দিয়েছিল। বড়রাও অনেকে। সালেনূর ছোটই ছিল, কিন্তু সে তাকিয়েছিল নির্বিকার। দেশের আইনে এখনও সে ছোট, মানে শিশু। তবে ষোল বছরের মেয়ে শিশুটাকে সাহেব নিংড়ে দিত যুবতীর মতোই। আর ম্যাডাম যে কত চড়, ঘুষি আর লাথি মেরেছে, তাও মনে রেখেছে এই শিশু। তবে এর জন্য অবশ্য খুন করেনি তাকে। সাহেবের কুকর্ম কি তিনি কিছুই জানতেন না? বাধা তিনি দিয়েছেন কোনদিন? নাকি তারও কোন দুর্বলতা ছিল? সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, আর কলা গাছও ডুবে যেতে পারে। 

দাঁড়িয়ে দরজা খুলবে এমন সময় নিজে থেকে খুলে যায় ওটা। ম্যাডাম দাঁড়িয়ে হাসছেন। মুখ-ভরতি ফেনা, ঘামে ভেজা শরীর, অবিন্যস্ত চুল আর একটা সুতোও নেই শরীরে। ‘সালুনি, ও সালুনি, কি বিষ দিয়েছিলি মাগি? বিষটা এত টক আর ইঁদুর ইঁদুর গন্ধ। মদটা পেটে যেতেই সব গুলিয়ে উঠেছিল। এই এতোগুলো বমি করে দিয়েছি ড্রয়িং রুমে। আয় দেখে যা, বাম দিকের বড় সোফাটার হাতল ঘেঁষে এখনও লেগে আছে বমি। বমিতে কি আছে জানিস, হারামজাদি? মদ, মুরগি ভাজা, বাদাম, চিপস, সবজি ভাজা, ভাত, বীর্য, সব মেখে আছে। তোর হাতে সব পরিস্কার করব, না না চাটাবো। আয় মাগি, বমি চাটবি আয়। এই এসোতো, চুল ধরে টেনে নিয়ে যাও বজ্জাতিটাকে’। 

সাহেবকে দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকে সালেনূর। নগ্ন দেহ শুধু নয়, এক রাতেই যেন আঙুলের নখগুলো হয়ে গেছে কুকুরের মত। চোখ দুটো জ্বলছে যেন ভূতের সিনেমার কোন দৈত্য। সালেনূরের ঘাড় বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, হাত-পা খিচুনি’র মত তড়পাচ্ছে। সাহেব এসে ধপ করে হাত বসিয়ে দিল কামিজের বাঁ দিকটায়। বাম স্তনে ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে সালেনূর। অথচ কোন বাধা দিতে পারছেনা সে। হাত, পা, এমনকি মুখ, যে মুখ দিয়ে এক খাবলা থুথু মেরেছিল সাহেবের মুখে, যেদিন প্রথমবার ধর্ষিত হয় সে, তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। টেনে টেনে সব জামা ছিঁড়ে নিল সাহেব, কিংবা সাহেবের ভূত। অনেক ভূতের গল্প শুনেছে সালেনূর। ছায়া ভূত, কঙ্কাল ভূত, ধোঁয়া ভূত। মানুষরূপী ভূত হয় নাকি? নাকি ওরা ভূত নয়? বিষের প্রভাবে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাওয়া জলজ্যান্ত মানুষ। মানুষ কি ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর হতে পারে? একটা সময় সালেনূর অনুভব করে তার দৃষ্টি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা পেশাব উরু বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। স্তনে, ঠোঁটে, যোনিতে প্রচ- আঘাতের ব্যথা কমে আসছে। তার কি ঘুম পাচ্ছে? নাকি জ্ঞান হারাচ্ছে সে?



শুক্রবার সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে গৃহকর্ত্রীর। ফজর নয়, জুমার আজানে। দরজা খুলতেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার। রাতে পান করা মদের ‘হ্যাং-ওভার’ কেটে যায় এক মুহূর্তেই। ড্রয়িং রুম অগোছালো পড়ে আছে। এদিক সেদিক ময়লা। টেবিলে উচ্ছিষ্ট সরানো হয়নি। রাগে গজগজ করতে করতে রান্না ঘরে ঢুকেই আঁতকে ওঠেন ভদ্রমহিলা। চিৎকার করে স্বামীকে ডাকতে গিয়ে দেখেন ভয়ে গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছেনা। দৌড়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঘুমন্ত স্বামীর চুল ধরে টানতে থাকেন ম্যাডাম। 

‘ওঠ, কুত্তার বাচ্চা ওঠ। লুইচ্চচা কি করেছিস রাতে’? সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগে ঠাস করে চড় মেরে বসেন স্ত্রীর গালে। 

‘তোর জ্বালায় ঘুমুতেও পারব না? তোর বাপ মরছে, না মা মরছে’?

‘বাপ মরলেতো ভালোই হত। তুই কি করেছিস রাতে’?

‘কি করেছি মানে, তোমার সাথেই তো মাল গিললাম। এখন আবার কি হল’?

‘তুই সালুনি’র ঘরে যাস নি? মাগিটার সাথে আবার শুয়েছিলি তুই? তোকে তো ডিভোর্স আমি করবোই, এখন মার্ডারের মামলাও সামলা কুত্তার বাচ্চা’।

‘মার্ডার? কীসের মার্ডার? কে মরেছে’?

‘রান্না ঘরে গিয়ে দেখে আয়। তোর মা মরে পড়ে আছে মেঝেতে। খুন করতে গেলি কেন হারামজাদা’?

সাহেব দৌড়ে যায় সেই ঘরে। চিৎকার করে ডাকে স্ত্রীকে।

‘আমি কাল আসিনি এই ঘরে। কিছু করিনি ওর সাথে। তুই ওকে খুন করেছিস। এখন কি হবে’?

‘আমি খুন করব কেন? আর জামাকে খুলেছে, আমি? ঠোঁটে, বুকে, নিচে কে রক্তাক্ত করেছে, আমি? ইউ ব্লাডি পারভার্ট। আমি এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি পুলিশকে’।

‘তুমি বিশ্বাস কর, আমি আগে তিনবার ওকে ধর্ষণ করেছি, বাট নট অ্যাট লাস্ট নাইট। একটু মাথা ঠা-া কর। কাল রুমে এসেছিল নাসির, রুম্মান আর জিকো। ওদের মধ্যে কেও’?

‘ওদের বিদেয় করেই আমরা শুতে গিয়েছি। তোমার আর মিথ্যে বলতে হবেনা। পোস্ট-মর্টেম করলেই বোঝা যাবে ভ্যাজাইনাতে কার স্পার্ম। আচ্ছা দেখতো, এটা কীসের প্যাকেট’।

‘হীরা মার্কা কীটনাশক। ইঁদুর, তেলাপোকা’র যম। বিষ? বিষের প্যাকেট? এটা খেয়ে আত্মহত্যা করেছে’?

‘আত্মহত্যা কেও ন্যাংটো হয়ে করে? নিজেই সারা শরীরে খামছে খামছে? অবশ্য, একটা ব্যাপার...’

চোখের পাতা নড়ছে না কারও।

‘ও’র মা যখন দিতে এসেছিল ওকে একটা কথা বলেছিল’।

‘কি, কি বলেছিল’?

‘মেয়েটার খিঁচুনি, মানে মৃগী রোগ আছে। হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিল ছোটবেলায়, কয়েকবার। নিয়মিত ওষুধও নাকি খেত। ও’র মা বলেছিল, আমরা যেন মারধোর না করি। মানসিক চাপ, উত্তেজনায় নাকি আবার হতে পারে এমন। তাহলে কি কাল আবার খিঁচুনি হয়েছিল’?

‘হ্যা’।

‘তাই হবে। কিন্তু তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কিভাবে’?

সাহেব নির্বিকার ড্রয়িং রুমে চলে আসেন। সিগারেটের কাঠিতে একটা বড় টান দিয়ে ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেন চারপাশ।

‘পোস্ট-মর্টেম হবে বোঝাই যাচ্ছে। স্পার্ম কিন্তু পাওয়া যাবেনা। এর আগেই তো খিঁচুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল’।

‘মানে, রাতে তুমি গিয়েছিলে রেইপ করতে’।

‘আমি তো আর জানতাম না এই মৃগী রোগের কথা। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি হাতে গ্লভস পরে জামা পরিয়ে দাও। খিঁচুনি হয়ে নিজের শরীর নিজে খামচেছে। এমন আগেও হয়েছে। গ্রাম থেকে টাকা দিলেই পড়শি সাক্ষী পাওয়া যাবে। পুলিশ, মিডিয়া আমার হাতে আছে। আত্মহত্যার মামলায় তেমন কিছুই হবেনা আমাদের, আই প্রমিজ’। 

ধর্ষক স্বামী’র জন্য ঘৃণার চেয়ে প্রত্যুৎপন্নমতি স্বামী’র জন্য গর্ব ঠিকরে বেরোয় ম্যাডামের চোখ থেকে।  


মাতুয়াইল, ঢাকা।