নিঃশব্দ
তাসনিম মিসমা
জানালার শিক দু’হাতে শক্ত করে ধরে স্নেহা বিছানায় বসে আছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। দু চোখে ঘুম নেই তার। প্রায়শই এমন হয় তার সাথে। ঘুম আসেনা।বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে এক দু ফোঁটা তার মুখে এসে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি বারবার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেয়েটিকে অঢেল চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে আসার আহবান করছে।
কিন্তু স্নেহা তাতে বিন্দুমাত্র সায় জানাতে নারাজ। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখলো । অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো কিন্তু স্নেহা অতি মৃদু কন্ঠে বলল, ‘আমি ঠিক আছি মা। তুমি গিয়ে শুয়ে পরো। কাল আবার রবির স্কুল আছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।’ মা স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,‘কাল শুক্রবার । স্কুল নেই ওর...। তুই রাতে কিছুতো খেলি না। আমি খাওইয়ে দি..?’ ‘ নাহ, থাক আমার খিদে নেই। দেখলেতো বাহিরের দুনিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ’ই নেই...কবে কোন দিন যায় তাও জানি না। বড় বেমানান হয়ে গিয়েছি দুনিয়ার সাথে। তোমাকেও অনেক কষ্ট দিই আমি। আর সহ্য হয় না। অই দিন মরে গেলেই ভালো হতো; তাইনা, মা..?’ এই বলে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো যেন অনেক দিন পর পাহাড়ের বুক চিরে অঝোরে পানি বইতে লাগল। মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে মাও কাঁদতে শুরু করলো আর বলল, ‘কে বলেছে তুই বেমানান, আমাকে কষ্ট দিস, তুই আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে সুন্দর উপহার। তুই না হলে আমি আর তোর ভাই আজ বেঁচে থাকতাম না। দু’বছর আগে যদি তুই আর তোর বাবা নিজের জীবনের বাজি না রেখে বাস এক্সিডেন্টের সময় বাঁচাতি আমাদের তাহলে আজ হয়ত আমরা সবাই তোর বাবার মতোই অকালে মারা যেতাম। তোরা দুই ভাই-বোন আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। খবরদার আর কখনো এমন বাজে কথা বলবি না।’ এতোক্ষণে স্নেহার কান্না থেমে গিয়েছে । পনেরো ষোলো বছরের এই স্বল্প জীবনে যেন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কিছু দেখে ফেলেছে সে। যখনই সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হয় কিছুটা পিছুটান অনুভূত হয় তার। মন থেকে একটা আওয়াজ আসে যে, তার অনেক কাজ বাকি। এভাবে হাল ছাড়লে চলবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, যে মেয়ের একটা পাই নেই সে আর কতোটুকুই বা সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করতে পাড়বে। বাস এক্সিডেন্টের সময় প্রাণে বেঁচে গেলেও সে, মা-বাবা আর রবি আহত হয়েছিল। তার বাম পা প্রচুর আঘাত পেয়েছিল ফলে পরে তার পা টা কেঁটে ফেলতে হয়েছিল। তার সাথে প্রিয় বাবাকেও ডাক্তাররা বাঁচাতে পারেনি। সে দিনের কথা স্নেহার মনে পড়লেই সারা শরীর শিউরে উঠে। লাগে যেন দেহটা শক্ত হয়ে আসছে।আর সহ্য করা সম্ভব নয়। তবুও হার মানা চলবে না।বাবা তাকে কখনো হার মানতে শেখায়নি। যেখানে আশার বিন্দুমাত্র আভাস পাবে সে ছুঁটে যাবে; তাকে যেতেই হবে।
দু’বছর ধরে নিজেকে সে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। মার দিকে তাকিয়ে স্নেহা বলল,
‘আমাদের সাথেই কেন এমন হলো মা? আমাদেরতো কতো সুখী ছোট্ট পরিবার ছিল। কি অপরাধ ছিল আমাদের? কেনোই বা সৃষ্টিকর্তা এতো বড় শাস্তি দিলো? বলো না, মা?’ মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, ‘সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তিনি আমাদের সহনশীলতার পরীক্ষা নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আগামীতে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। হতাশ না হয়ে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এই বলে স্নেহার মা চোখ মুছতে মুছতে অন্য রুমে চলে গেল। স্নেহা জানে যে, কিছুই আর আগের মতো ঠিক হবেনা। সে তার বিছানার বালিশের নিচ থেকে ডায়রীটা বের করে লিখতে বসে পড়লো সারা দিনের সব কথা।ডায়রীটাই যেন এখন ওর সবচেয়ে আপন; যা স্নেহার প্রতিটা অনুভূতি,রাগ-দুঃখ নিঃশব্দে, নির্দ্বিধায় বিনা কোনো প্রতিবাদে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখে।