পথের বাগড়া
শাদমান শাহিদ
কারওয়ান বাজারের সবকটা বস্তিকে একে একে পেছনে ফেলে ট্রেনের গতি তখন প্রায় পূর্ণমাত্রা। যাত্রীদের বিরস কোলাহল আর গিজগিজে ভিড়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি চোখটাকে বাইরে সারিবদ্ধ বস্তিদর্শন থেকে সরিয়ে তারই পাশে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা বিচিত্র কাঠামোয় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন দালানগুলোর দিকে ফিরিয়ে নেন। সেখানে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন কোম্পানির রুচিবোধ শৈল্পিক দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, নগরায়নে এমন নান্দনিক সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা দশ-বারো বছর আগেও ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের মাথায় আসে নাই। অথচ এখন...
ঢাকা শহরের দ্রুত উন্নয়নের বিষয়টা নিয়ে এভাবে ভাবতেই বুক ফুলিয়ে একটা তৃপ্তিকর শ্বাস বেরিয়ে যায়। ‘যাক, শেষ পর্যন্ত এই শহরে আমারও একটা ঠিকানা হলো। ধন্যবাদ সরকারকে। সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ফ্ল্যাট-বাসা বরাদ্দ না দিতো, অজপাড়া গাঁর একজন স্কুলশিক্ষকের পক্ষে এই শহরে ফ্ল্যাট-বাসা, কল্পনা করা যায়!’ ভাবতে গিয়ে টের পান আরও একটা তৃপ্তিকর ঢেউ বুকের ভেতর ইতি-উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন দৃষ্টিটাকে বাইর থেকে ধরে এনে ফাইলবদ্ধ কাগজগুলোয় ছেড়ে দেন। শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের সনদ। ওটাতে তাকালেই সব সময় মোটা কালিতে লেখা নিজের নামটা আগে নজরে আসে। গর্বিত নাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল হাসান। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা নামও মনের ভেতর উঁকি মেরে যায়। গ্রুপ কমান্ডার জসিম উদ্দিন। তিনিই তাকে যুদ্ধে নিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনি যখন মহকুমা সদর দখলে নিয়ে আশ-পাশের গ্রামগুলোয় আগুন জ্বালাতে শুরু করে দিলো, তখনই এক অন্ধকার রাতে ঘরে এসে বলেছিলেন, আবুল, লও নাম লেখাইয়া ইন্ডিয়া যাই। ট্রেনিং ছাড়া বন্দুক ধরন যাইবো না।
তারপর কত ঘটনা। কত স্মৃতি। সবই আজ বিস্মৃতির অতলে...
বছর তিনেক হয় জসিম ভাই মারা গেলেন, মতের ভিন্নতার কারণে রাষ্ট্রীয় সম্মান তো দূরের কথা রাষ্ট্রের কোনো কাক-পক্ষীও তাঁর জানাযায় এলো না। দল-মতের বিরুদ্ধে যাওয়া যেনো এমনই জঘন্য অপরাধ। পাপ। সহযোদ্ধা আবদুল আজিজ তো এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতিটাই আদায় করতে পারছে না। কতো করে বলা হয়, পার্টিতে যোগ দাও। স্বীকৃতিও পাবা, সাথে সাথে আরো নানান সুযোগ-সুবিধার রাস্তাও খুলবো। শুনে না। বলে, যেইডা আমার অধিকার, হেইডা অতো সিস্টেম কইরা পাইতে অইবো ক্যান? দেশ কি কারো বাপের জমিদারি? যা কইবে তা-ই হুনতে অইবে?
মুর্খলোক। দেশের কোনো কিছুই যে স্বাভাবিক চলছে না, এটা তাকে কে যাবে বোঝাতে? মনে মনে কথাগুলো উচ্চারণ করে আবার ফাইলটা খুলেন। এতো দৌড়াদৌড়ির ভেতর কোথাও কোনো কাগজ মিসিং হয়নি তো? ঈষৎ উদ্বিগ্নের সাথে কাগজগুলোয় চোখ বোলাতে থাকেন।
ঠিক এ-সময় ট্রেনের গতি অনেকটা নরম হয়ে আসে। বাইরে তাকিয়ে দেখেন ট্রেন বিমান বন্দর স্টেশনের প্লাটফর্মে উঠে গেছে। তারপরই চিরাচরিত দৃশ্য। ট্রেনটা থামতে না থামতে যুদ্ধাক্রান্ত দেশের শরণার্থীদের মতো আপাদমস্তক গিলে নেয়। কি বাইরে কি ভেতরে। পা ফেলারও জো থাকে না। বিরক্তিটা চরমে পৌঁছার আগেই দেখেন একঝাঁক তরুণ-তরুণী ফাইল-পত্র বগলদাবা করে অসম্ভব ভিড় ঠেলে তাঁর সিট বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত সরকারি কোনো অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। তাদের সবার কণ্ঠেই বিষাদের বুদ্ বুদ্। ‘কবে যে কৌটা প্রথা শেষ হবে আর আমাদের মতো সাধারণ ঘরের সন্তানরা চান্স পাবো! আল্লাই জানে। কেউ একজন বললো, কামাল ভাই চার-চারবার ভাইবাতে যেয়ে ফিরে এলো; অথচ মনির ভাই তার চেয়ে অনেক দুর্বল স্টুডেন্ট হয়েও শুধু কৌটার কারণে প্রথম চান্সেই চাকরি পেয়ে গেলেন। আহ! আফসোস। তারা যদি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেন, তখন কোন যোগ্যতায় কার্যালয় চালাবেন?’
তাই তো! কোন যোগ্যতায় ওসব ল্যাঙ-মারা লোক পদের প্রতি সুবিচার করে কর্মপরিচালনা করবে? ওদের মুখ থেকে প্রশ্নটা এক প্রকার কেড়ে নিয়ে আপন মনে ভাবতে লাগলেন। তখনই মনে পড়ে ছোট বোন জাহানারার ছেলে মারুফের কথা। এসএসসি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত সবকটা পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এসেছে ছেলেটা। অথচ তার মতো মেধাবী ছেলের চাকরি হলো না। তিন তিনবার বিসিএস-ভাইবায় পর্যন্ত ফেইস করলো। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, কাউকে ধরতে হবে না। ওর নিজের যোগ্যতায় পেয়ে যাবে।
শেষে দেখা গেলো আশায় গুড়েবালি। পরে তিনিও কয়েক জায়গায় ওর হয়ে কথা বলেছিলেন, কাজ হয়নি। এখন সে পাগল প্রায়। কোথায় যায়, কী করে, কোনো কিছুরই ঠিক-ঠিকানা নেই। অথচ নিজের মেয়ে শাকিলার জন্যে কোথাও ধরনা দিতে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কৌটায় প্রথম চান্সেই চাকরি পেয়ে গেলো। এ নিয়ে আরো কী যেন ভাবতে যাবেন,
এমন সময় আরেকজন তরুণ বলে উঠলো, আফসোস, বিদেশে না যেয়ে কেনো যে লেখাপড়া করতে গেলাম! ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করে। নরসিংদীর আগে আর কোথাও থামবে না। সেজন্যে গতিটা নিশ্চয়ই আগের মতো পূর্ণমাত্রায় গিয়ে উঠবে। তখন জানলার বাতাসে ফইলের কাগজ-পত্রগুলো এলোমেলো হয়ে যাবার জোর সম্ভাবনা। সে আশঙ্কায় তাড়াহুড়ো ফাইলটা গুটিয়ে নিতে নিতে টের পান কার যেনো এক দলা গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়লো।
সাথে সাথে মাথা তোলে দেখেন কাঁধ ঘেষে দাঁড়ানো ছেলেটা জানলা দিয়ে লক্ষ্যহীন বাইরে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে কী যেনো বলছে, কোলাহলের কারণে বোঝা যাচ্ছে না। তবে পাশের ছেলেটা নিশ্চয়ই কিছু একটা বুঝেছে।
টের পাচ্ছেন, ছেলেদের কথাগুলো কোথায় যেনো নড়ে-চড়ে উঠছে। একে একে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। সবার চোখে-মুখেই সেঁটে রয়েছে এক ধরনের বঞ্চনার প্রচ্ছদ। মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেন, কোনো লাবণ্য নেই। একজন তরুণকে মোহাবিষ্ট করে রাখার মতো কোনো লক্ষণই তাদের চোখে-মুখে নেই। যতোই দেখছেন ততোই শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠছে। সে-সাথে হাত-পাও অবাধ্য স্প্রিং-এর মতো কাঁপতে লাগলো। কী হচ্ছে এসব? কোথায় যাচ্ছি? ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন বটে; কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। কেবলই মনে হতে লাগলো, কোথায় যাচ্ছি আমরা! এজন্যই কি একদিন রাইফেল কাঁধে হারিয়ে গিয়েছিলাম ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের পরতে পরতে? সব সম্ভাবনা এভাবে দীর্ঘশ্বাসে তলিয়ে যাওয়ার জন্যেই কি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম দানবের মুখে?
আর ভাবতে পারছেন না। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এমনিতেই ডায়াবেটিসের রোগী, তার ওপর সারাদিনের ধকল। তিনদিন ধরে ঢাকায়। ফাইল-পত্র তৈরি, এ-অফিস থেকে ও-অফিসে কখনো রিক্সায়, কখনো হেঁটে বারবার ছুটে যাওয়া, কীসের খাওয়া কীসের কী? তিনদিন ধরে ঠিক মতো ঘুমোতেও পারেননি। তারপরও স্ত্রী রোকেয়ার মামাতো ভাই শিকদার সাহেব ছিলো বলে রক্ষা। তা না হলে হোটেলে থাকতে হতো। ঢাকা শহরের হোটেলে থাকা-খাওয়ায় কত যেতো, ভাবা যায়!
চোখ বুজে কপালের বামপাশ টিপতে থাকেন।
ঠিক এসময় গা ঘেঁষে দাঁড়ায় টিকেট চেকার।
তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন, উঠতি বয়সের যুবক। বুকের বাঁপাশে মুক্তিযুদ্ধের মনোগ্রাম অঙ্কিত ব্যাজ থাকা সত্ত্বেও পাশের ভদ্রলোকের কাছে টিকেট আছে কিনা জানতে চায়। পূর্ব অভিজ্ঞতায় তিনিও জেনে ফেলেছেন, এমনটিই হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ট্রেনে যাতায়াত ফ্রি হলেও টিকেটের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত হয়নি। যে-কারণে এ-ধরনের বিড়ম্বনা কিছুতেই পাছ ছাড়ছে না। টিকেট চেকার একটা না একটা কথা শোনাবেই। সে অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি কখনো এ-ভুলটি করেন না। শত কষ্ট হলেও টিকেট সংগ্রহ করেন। আজকেও করেছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে বাত ধরে এসেছিলো, তারপরও টিকেট ছাড়া ট্রেনে উঠার নাম করেননি।
পাশের ভদ্রলোক মনে হয় টিকেট করেনি। তাই কণ্ঠে যদ্দূর সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে বললেন, আমি এফ এফ। ‘এফ এফ’ শব্দটা শুনেই টিকেট চেকার এমনভাবে তাকালো, যেনো তিনি বিরক্তিকর কিছু একটা উচ্চারণ করে ফেললেন। সে-সাথে তিনি ছেলেদের দিকেও তাকালেন। ভাবলেন, ওরা নিশ্চয়ই টিকেট চেকারের উদ্দেশ্যে কোনো প্রতিকার দেখাবে। কিন্তু না, ওরা টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।
তখন ভাবলেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়, এ-বিষয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দেবেন। পরক্ষণেই মনে হলো, এটা স্কুল নয়। আর ওরাও তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থী নয়। তাছাড়া ওরা একটা স্বাধীন দেশের সন্তান হয়ে একটা নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর খাবি খেয়ে মরছে। এই অন্ধকার ভেদ করে কখন তাদের জীবনে ভোরের সূর্য উঁকি দেবে, তারও কোনো সম্ভাবনা আপাতত চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে কোন ভরসায় নীতিবাক্য আউড়াতে যাবেন?
এ আশঙ্কায় আর দাঁড়াতে সাহস করলেন না। বসে বসেই ভাবতে লাগলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা মিসিং হয়ে গেছে। কিন্তু মিসিংটা কোথা থেকে শুরু হলো? প্রশ্ন মাথায় রেখে যখন অনুসন্ধান চালাতে যাবেন, এমন সময় কে যেনো ডেকে উঠলো, কী ভাবছো?
কে আপনি?
তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? আমি আবুল হাসান। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল হাসান। যে কোনোদিন কারো কাছে ছোট হয়নি। বহরমপুরে যার জনপ্রিয়তায় চেয়ারম্যান সাহেব পর্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়; তুমি এখনো চিনতে পারলে না আমাকে?
চিনবো না কেনো? হা চিনেছি। তুমি বহরমপুর হাই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শত্রুর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে। বিশ্বাস না হয়, এই দেখো তোমার পরিচয়। মনে মনে উচ্চারণ করেই হাতের ফাইলটা জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলেন। ট্রেন তখন টঙ্গী-পোবাইল-আড়িখোলা পেরিয়ে শীতলক্ষার ব্রীজের উপর দিয়ে সোজা ছুটে যাচ্ছে নরসিংদীমুখী। বিষয়টা যারা খেয়াল করলো, তারা দেখলো ফাইলটা পানিতে পড়ে ঢেউয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সার্ফিং করতে করতে চোখের অন্তরালে চলে যাচ্ছে।
তরুণ-তরুণীরাও অবাক। বললো, আঙ্কেল, এইটা কী ফেললেন?
মুখে এখন দেবতার হাসি। ছেলেদের উদ্দেশ্যে ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগলেন, ওটা তেমন কিছু নয় বাবারা। অনাবশ্যক কিছু কাগজ ছিলো, ফেলে দিলাম। যেতে হবে অনেক দূর, শুধু শুধু পথের বাগড়া বাড়িয়ে লাভ কি।