গল্প : ভবঘুরে কবি






ভবঘুরে কবি
মোহাম্মদ অংকন

বিকাল গড়াতেই একদিন এক যুবককে চলনবিলের ধারে বসতে দেখা যায়। বিষয়টি অনেকেই খেয়াল করে। আবার অনেকে প্রয়োজন মনে করে না। তার ঝাকরা চুলের কারণে পেছন থেকে অবয়ব নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। উপর হয়ে বসে থেকে কি যেন লিখছে- এটা বেশ বোঝা যায়। কৌতুহলী হয়ে বিশ উর্ধ্বটপি সেই যুবকটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। উঁকি দিয়ে সে দেখে সবেমাত্র একটি কবিতার শিরোনাম লিখেছে- ‘তোমার টানে আগমন’। টপির অনুমান করতে দেরি হয় না যে তিনি একজন কবি। টপি কাশি দিতেই যুবক কবিটি পেছন ফিরে তাঁকিয়ে উঠে পড়ে। টপির মুখ থেকে বের হয়, ‘ভয় পাবেন না মহাশয়। আমি আপনার কাছেই এসেছি।’
‘জি¦, বলুন। কি উপকার করতে পারি?’
‘আমি তো উপকার পেতে আসি নাই। এসেছি কৌতুহল দূর করতে।’
‘জি¦, বলুন। কি জানতে চান?’
‘আমি  যদি ভুল না করি তাহলে নিশ্চিত যে আপনি কবিতা লিখেন। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, আপনাকে এ অঞ্চলে আগে কখনও দেখি নাই। যদি..’
‘হ্যাঁ, আমি আমার পরিচয় বলব। আমি পথেপ্রান্তরে কবিতা লেখার অনুসঙ্গ খুঁজে ফিরি। বলা চলে আমি একজন ভবঘুরে কবি। যেখানে রাত সেখানেই কাত! চলনবিলের কথা আমি একটি বইয়ে পড়েছিলাম। আর তারপর থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম, একদিন এখানে আসব। আমি এসেছি..’
‘বাহ! আপনি এতদূর থেকে চলনবিলে এসেছেন! আপনার দম আছে। তো একটু পড় রাত নামবে। কোথায় রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন?’
‘সে কথা বলতে নেই। ওই যে বললাম, যেখানে রাত সেখানে কাত।’
কবির এমন উত্তর শুনে বিরক্তির আভাস নিয়ে টপি সেখান থেকে চলে যায়। ‘আমার কৌতুহল মিটেছে। এবার আসি। যত্তসব কবি এসেছে দেশে!’

টপি চলে যায়। বিকালের সূর্য ডুবে গিয়ে সন্ধ্যা নামে। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমতে থাকে। কিন্তু ভবঘুরে কবিটি সেখানে বসেই থাকে। তার কবিতা লেখা শেষও করে। ওদিকে টপির ঘর থেকে বিলের ধারের রাস্তাটি পরিষ্কার দেখা যায়। যদিও টপি সেই কবির কথাটি ভুলে যায়। রাতে জানালার কপাট আটকাতে গিয়ে যুবকটিকে চোখে পড়ে যায়। বিরক্তির আভাস নিয়ে উচ্চশব্দ করে বলে, ‘হায় রে কবি।’ জোড়ে শব্দ করে জানালার কপাট বন্ধ করে দেয়। কপাটের শব্দ কবির কানে গিয়ে লাগে।

টপির বাবা একজন বাউল শিল্পী। গ্রামে গ্রামে গান করেন। ফিরতে প্রায়ই রাত হয়। তবে সেদিন দশটার আগেই দলবল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করেন। বাড়ির কাছে বিলের ধারে আসতেই সবাই রীতিমত চমকে ওঠে। রাতের মৃদু আলোতে দেখতে পায়, লাশের মত একটি দেহ পড়ে আছে। পাশে একটি ডায়েরি, একটি ব্যাগ ও রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার বই। একটু পড়েই তার নাকের আওয়াজ শোনা যায়। বাউল শিল্পী তার সাগরেদ ভল্টুকে বলে, ‘ডেকে তুলতো ছেলেটাকে।’
ভল্টু হাত থেকে ঢোলটি রেখে ঘুমন্ত কবিকে হালকা ধাক্কা দেয়। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে উঠে সে দাঁড়িয়ে পড়তেই বাউল প্রশ্ন ছোড়ে।
‘তুমি কে, বাবা। এখানে রাত্রি কাটাচ্ছ?’
কবি তার বৃতান্ত বলতেই বাউলের মনটা নরম হয়ে যায়। ‘কি, বলব তোমাকে, আমরাও একই পথের যাত্রী। পার্থক্য শুধু তুমি লেখ আর আমরা গাই। যদি কিছু মনে না একটি কথা বলি?’
‘জি¦, গুরু জ¦ী বলুন।’
‘তুমি এভাবে এখানে রাত্রিযাপন করলে এলাকার লোকজন ভালভাবে নিবে না। এছাড়া চোর ডাকাত ভেবে মারপিট করতে পারে। আমি বলি কি আমার সাথে চল। আজকের রাতটা না হয় ভল্টুদের সাথে কাটালে।’
এমন সুন্দর প্রস্তাবে কবি রাজি হয়ে যায়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাউল দলের সাথে রওনা করে। তবে সে জানত না সে কোনো বাড়ি যাচ্ছে।

টপি ও তার মা রোজ অপেক্ষা করে। কখন তার বাবা গান করে ফিরবে।
‘মা টপি, তোমরা কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
ঘর থেকে দ্রুত বের হতে হতে টপি জানান দেয়, ‘না বাবা, ঘুমাই নাই।’
তার বাবার সাথে কবিকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে, ‘বাবা কবিকে তুমি কোথায় পেলে?’
‘কি রে মা, তুই কি তাকে চিনিস?’
‘না বাবা, চিনি না। বিকালে বিলের ধারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই পরিচয়টা জেনেছি। তবে তিনি যে এখনও এখান থেকে চলে যান নাই সেটা আমার জানা ছিল না।’
‘ও আচ্ছা, রাত অনেক হয়েছে। সে আজ ভল্টুদের সাথে থাকবে। সকাল হলে কোথাও চলে যাবে। দে মা, আমাদেরকে এখন খেতে দে।’

সে সময় চলনবিলে বেশ চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। তাই লকলকে লাউ দিয়ে টপির মা চিংড়ি মাছ রান্না করে। কবিকে সঙ্গে করে বাউল খেতে বসে।
‘টপি মা, কবি আমাদের অতিথি। তাকে আগে খেতে দে।’
সে রাতে কবি এভাবেই সম্মান খাতির পেতে থাকে। ‘আপনারা আমাকে এভাবে আপ্পায়ন করবেন, আমার জানা ছিল না।’
কিন্তু টপি বরাবরই বিরক্তির আভাস প্রকাশ করে। মনে মনে বলে, ‘এ বয়সে কবি হয়েছে! তাও আবার ভবঘুরে কবি। ভাব দেখলে বাঁচি না।’
টপির বিরক্তির আভাস বুঝতে কবির আর দেরি হয় না। তখন সে ভাবে, ‘না, মেয়েটিকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। এমন করে তাকাচ্ছে যেন সে আমার শত্রু।’
কবি টপির রুঢ় আচরণে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ‘না, আমার এখানে থাকাটা ভাল হবে না। আমি পথের মানুষ, পথেই চলে যাব।’

রাত তখন ১টা হবে। যে কথা, সেই কাজ। কবি তার ব্যাগপত্র নিয়ে ভল্টুদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। ওরা ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন থাকায় বুঝতে পারে না।

কবি মধ্যরাতে রাস্তা বেয়ে বেয়ে যেতে থাকে। পথে তার সাথে গ্রামের মদখোর কফিলের দেখা হয়। কফিল কি দেখতে কি দেখে কবিকে চোর বানিয়ে মারতে থাকে। গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে, ‘চোর ধরেছি, চোর।’ কয়েকটা কিলঘুষি দিতেই সে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কফিলের চিৎকারের আওয়াজে আশেপাশের লোকজন ঘুম ত্যাগ করে হাজির হতে থাকে। টপি, তার বাবা-মা ও ভল্টুরাও ছুটে আসে। তাদের কবিকে চিনতে দেরী হয় না। বাউল বলে, ‘ওরে একে তোরা মারিস না। এ তো চোর না। যার কাছে রবীন্দ্রনাথের বই থাকতে পারে, সে কখনও চোর হতে পারে না। সে একজন কবি। কবিরা কখনও চোর হতে পারে না। তোরা এখান থেকে চলে যা।’
বাউলের কথা শুনে সবাই চলে যায়। কবিকে ধরাধরি করে টপিরা বাড়িতে নিয়ে আসে। কিলঘুষিতে কয়েকটা ক্ষত হয়। রক্ত ঝরে। টপি তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। কিন্তু ওর মনটা কেন যেন খাঁখাঁ করে। ভাবতে থাকে, ‘সে কেন আমাদের বাড়ি থেকে পালাতে গেল?’
‘আচ্ছা, একটা কথা বলবেন, আপনি কেন পালাতে গেলেন?’
‘কবি হাসতে হাসতে বলে উঠল,
কবিতার নিঃশ^াস যেখানে বন্দি হয়
সেখানে আমার একটি মুহুর্ত নয়।’
বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী টপি কবির এই সরল আহাজারী বুঝতে বাঁকি থাকে না। টপি বলতে থাকে, ‘আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন। আসলে আপনাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা আমার ঠিক হয় নাই। যারা সৃষ্টিশীল কর্ম নিয়ে কাজ করেন, হয়তো আমাদের মতো সাধারণদের কাছে অবজ্ঞার পাত্রই হয়।’

অনুতপ্ত টপিকে কবি শান্ত¡নার বাণি শুনিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়। তারপর সে রাত্রটি কেঁটে যায়। আরেকটি দিন চলে আসে। দিনের আলোয় সব অতীত মুছে যায়। কবি আবার ঘুরতে ঘুরতে কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। বিকালে টপি জানালা খুলে বিলের ধারে কবিকে খোঁজে। কিন্তু পায় না বলে তার মনে একটা বিষন্নতা বিরাজ করে। অতঃপর আস্তে করে জানালার কপাট আটকিয়ে বুকের নিচে বালিশ ফেলে কি কি যেন ভাবতে থাকে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট