রিনভি

 



রিনভি
হাসনাত আসিফ কুশল


প্রায় চারটি দশক হতে চললো রিনভির সাংবাদিক জীবনের। চার দশক ধরেই সে কাঁধে একটা ব্যাগ আর পকেটে একটা কলম নিয়ে রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর কাদা ছোড়াছুড়ির সাক্ষ্য দিচ্ছে সে। সাংবাদিকতা বিষয়ক বইও লিখেছে অবশ্য। কিন্তু বই লিখে কি আর বিবিÑবাচ্চার দাবি মেটানো সম্ভব ? এখন সে ভাবছে এ পেশা ছেড়ে দেবে। অনেকবারই ভেবেছে। কিন্তু অন্য পেশায় গেলে অভিজ্ঞতার ঝুলি চায়। আর ব্যবসায়ে নামলে পুঁজি হারানোর ভয়। কাজেই এ পেশাতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও থেকে যেতে হয়। এবারও ভাবনা আসছে নানাবিধ। আবার ওগুলো উবে যাবে। আবার পুরনো কাজের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এখন আপাতত সে কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। সারা দিন দশ বারোটা ছোট ছোট অ্যাসাইনমেন্টের কাজ সহকর্মীদের ভেতর এন্তেজাম করে দিতে হয়। আবার গভীর রাতে বাসায় ফিরে বিবিÑবাচ্চার সঙ্গে কথাও হয় না। তারা তাদের ঘরে ঘুমিয়ে যায়। আর সে খেয়েদেয়ে তার ঘরে ল্যাপটপটা নিয়ে লেখালেখির কাজ করতে থাকে। কখনও পড়াশুনারও। রাত জেগে বসে থাকা তার পেশার অংশ হলেও সে এটাকে নেশার অংশ বানিয়ে নিয়েছে। এক সময় ভাবতো, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর আবর্তনের একটি অংশ যদি ঘুমেই কেটে যায় তাহলে জীবনকে সে কিভাবে উপভোগ করবে ? আগে কবিতা লিখতো। এখন লেখে না কাজের প্রেশারে। সাংবাদিকতা বিষয়ক কিছু বাংলা বই লেখে আর ইংরেজি বই বাংলায় অনুবাদ করে। বই বাজারে বের হয় প্রতি বছর। বইমেলায়ও যায় তার বই মাঝেমধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্যও তাকে যেতে হয়। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা সেগুলো ভালোই কেনে। উপকৃত হয় মনে হয়।

অফিস থেকে গভীর রাতে ফিরে ঘুমায় না রিনভি। রাত জেগে লেখালেখি করতে থাকে সে। ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলতে থাকে। কবিতায় শব্দেরা যেন দুশ্চিন্তার ভেতর থাকে। এখন মনে মনে ভাবছে, এ মাসের স্যালারি পেয়ে গেলে বাসার কিছু ফার্নিচার কেনা লাগবে। বিবি সেই কবে থেকে বলে আসছে, সোফাসেট কেনার জন্য। বাসায় পুরনো একসেট সোফা পড়ে আছে। নতুন একসেট কিনলেই ওগুলো সের দরে বিক্রি করে দেয়া হবে। ওগুলো ফেলে দিতে অবশ্য মায়া লাগছে রিনভির। সেই আশির দশকে যখন নীলক্ষেতের বাসায় ব্যাচেলর হিসেবে একা একা থাকতো, তখনকার কেনা সোফা ওগুলো। ওগুলোতেই কত আড্ডামুখর দিন পার হয়েছে। রিনভির মনে পড়ে, ওর খুব প্রিয় এক বন্ধু নীলাভের জন্মদিন ওর বাসায় হয়েছিলো। কেক কেটে কত মজা হলো। সুজন আবার স্টুডিও থেকে কোনো এক ফটোগ্রাফারকে জুটিয়ে নিয়ে এসেছিলো ছবি তুলবে বলে। এখনও সে ছবি অ্যালবামের পাতায় আছে। ওর কাছেই আছে। অবশ্য বিবির দখলে। আলমারিতে যতœ করে বিবি রেখে দিয়েছে। খেয়া, রাজন, বিউটি, দ্যুতি, সুজন, নীলাভÑসকলের কথা একযোগে মনে পড়ে গেল একরাতের ভেতর। ভাবছে চারটা দশক দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। এখন ওদের অনেকেই স্টাফ রিপোর্টার থেকে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের গ-ি পেরিয়ে সোজা এক্সিকিউটিভ এডিটর পর্যায়ে চলে গেছে। আর রিনভি এখনও সেই অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরেরই ঘানি টানছে। মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে পড়ে সে। মাঝেমধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হয় ওর ভেতর। প্রতি মাসে অশান্তি আর ভালো লাগে না তার। এ অশান্তির অধিকাংশই অর্থ সংক্রান্ত। এ পেশায় বেতন বড় কম। এখানে তাই ফ্রয়েডÑফুকোর দর্শন চর্চা করা অসম্ভব হলেও ভাবনার ভেতর ওগুলোকে লালন করতে থাকে রিনভি। ওয়ার্কশপ করেও অল্প কিছু পায় রিনভি। কয়েকটা পড়াশুনার বই কিনেই তা শেষ হয়ে যায়। বাচ্চাদেরও স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা কড়া নাড়ছে। টাকা দেবে কোথা থেকেÑএই দুশ্চিন্তায় তার ঘুম আসে না। রিনভি ভাবছে। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে টেবিলটা কেঁপে ওঠে। মনে হলো, জীবন ফিরে পেয়েছে সে। বড় অক্ষরে লেখা এডিটর। মেইল না গেলে ঠিক এই সময়টাকেই উনি বেছে নেন। রিনভির বড় বিরক্তি লাগে। ফোন ধরেই অবাক হয় ও। কারণ এডিটর আর আজকে মেইলের ব্যাপারে বলে নি। বরং শুরুতে অভিবাদন জানিয়ে ভূমিকা না করে তার প্রমোশনের খবর দিলেন। খবর শুনে খুশি হয় ও। কিন্তু কথার ভীড়ে স্যালারির বিষয়টা আর বলতে পারে না। রাতে অফিস থেকে আসার পথে ও দেখে এসেছে এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর এবং অফিসের কয়েকজন লোক মিলে সেমিনার রুমে আলোচনা করছে। চিফ রিপোর্টার জাহিদের সঙ্গে কিছুদিন আগে এডিটরের মনোমালিন্য হওয়ায় গতকাল সে ওই পদে ইস্তফা দিয়েছে। এখন ওই পদে তাকে রাখবে আর তার পদে আরেকজনকে নেয়া হবে। অবশ্যই অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বাজারে এই পদগুলোতে অভিজ্ঞতার মূল্য যেন চড়া। রিনভি ফোন রেখে দেয়। ওর এখন কি করা উচিৎ ? আনন্দ করবে, নাকি মাতম করবে ? ভাবে, নশ্বর এই পৃথিবীতে সে যেখানে অবিনশ্বর নয়, সেখানে এসব মেকি আনন্দ করার মানেটা কি ? 


হঠাৎ করে টেবিলের দিকে হুঁশ ফিরে আসে তার। ল্যাপটপটা কি কারণে যেন হ্যাং করেছে। প্রতিদিন এমন হচ্ছে। ভাবছে দোকানে নিয়ে যাবে। কিন্তু সময় নেই। সারা দিন খাটাখাটনি, নিশীথে স্বেচ্ছা নিঃসঙ্গ জীবন আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সমন্বয়হীনতা তাকে বাড়তি কাজের দিকে যেতেই দেয় না। বইমেলা আসতে অনেক দেরি। বইয়ের পা-ুলিপি তৈরি করতে হবে। এবার বইটা বের করতেই হবে। কাজের খুব প্রেশার। অফিসের কাজ সেরে আবার প্রকাশনীর কাজ। সামনে ঈদ সংখ্যায়ও তার একটি গল্প যাবে। অফিসের এডিটরই তাকে বারবার বলেছে। আবার নতুন পদ মানে নতুন দায়িত্ব। স্যালারি অবশ্য বাড়তে পারে। কিন্তু কতই বা বাড়বে ? এভাবে কি দিন চালানো যায় ?
এমন প্রবঞ্চনাপূর্ণ জীবন যেন ঘোর শত্রুও বেছে না নেয়। বারবার মনে হয় তার।
পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসলো হঠাৎ। মন্দিরেও ঘণ্টার সশব্দ বারতা। ভোরের আলো স্পর্শ করেছে দরজার ওপাশটা। বিবি বোধ হয় উঠেছে। বাচ্চাগুলোকে এবার ডাকবে। প্রতিদিনের রুটিন তার। রিনভির মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব মার্কসবাদী স্বপ্নে বিভোর দিনের কথা। তখন জীবন এত কঠিন হয় নি। মানুষ সামান্য যা কিছু পেত, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো। এখনÑমানুষগুলো এমন হলো কেন ?


স্তালিনের জীবন নিয়ে একটা বই হাতে রিনভি বারান্দায় বসে আছে। বিবি বাচ্চাদেরকে ভ্যানে উঠিয়ে দিলো। ভ্যান চালক স্কুলে নিয়ে যাবে ওদের।
স্তালিনের স্বৈরাচারী সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গ উঠলেই রিনভি বরং স্তালিনের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে। বন্ধুবান্ধবের সামনে হোক আর অফিসে হোক। সে স্তালিনের একজন অন্ধ ভক্ত। লেনিন, মার্কস এরা যেন তার পছন্দের লোক।
বাচ্চাদের ভ্যানে উঠিয়ে ফিরে আসে বিবি। তারপর সে বাসায় তুলসি গাছে পানি দেয়। তুলসি গাছটার বয়স সাত আট বছর। আর তাদের সংসারের বয়স বোধ হয় সতেরো। কিন্তু বাচ্চারা এখন কেবল ক্লাস টুÑথ্রিয়ের গ-ি পেরোতে পারে নি। এখন রিনভির সঙ্গে ওর বিবির কথা প্রায় হয়ই না। অফিসে যাওয়ার সময় বিবি শুধু ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। অবশ্য রিনভির ভাবতে লজ্জা লাগে এমন একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে যার সঙ্গে তার কোনো মিল নাই। রিনভির বিবি বাইরে সচরাচর বের হতে চায় না। বাজার করে নিয়ে আসে ও পাড়ার এক লোক। প্রতিমাসে ওর হাতখরচ বাবদ কিছু দিতে হয়। মাঝেমধ্যে ডাক্তারের কাছে বের হলে কালো বোরখা পরে বের হয় ওর বিবি। আর বোরখা পরায় প্রবল আপত্তি রিনভির। যে সারা জীবন ধরে স্তালিন, লেনিন ও মার্কসের আদর্শের রজ্জু ধরে এসেছে, তার বিবি কেন ওসব ‘মুখ ঢাকা সংস্কৃতির’ দিকে যাবে ?
বিবি কিন্তু ছেড়ে দেয় না। দু’য়েকটা কটু কথা বলে ফেললেও বিবির তীব্র প্রতিবাদের মুখে সে পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।


এই সময়টায় রিনভি সাধারণত বিবিকে ফোন করে না। বিবিও ফোন করতে চায় না। ভাবে হয়তো ব্যস্ত আছে। কিন্তু আজ কি মনে করে রিনভিই বিবিকে ফোন করেছে। প্রমোশনের খবরটা ওকে দেয়া হয়নি। বিবি শুনে প্রথমেই স্যালারির কথা জিজ্ঞাসা করলো। সে বললো, স্যালারি আগের চেয়ে দ্বিগুণ দেবে বলেছে এডিটর। তবে এসব লোকের কথা ও কাজের মিল খুব কমই থাকে। তাই নগদ হাতে না আসা পর্যন্ত রিনভি কিছু বলতে পারছে না।

সহকর্মীদের ফুলেল শুভেচ্ছা, বন্ধুদের অভিবাদন, মালিক পক্ষের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়াÑসব মিলিয়ে নতুন দায়িত্ব মানে কাজের প্রেশার বাড়া। এত কিছুর মধ্যেও রিনভি সুস্থ থাকবে এমন সংকল্প গ্রহণ করেছে। আর সুস্থ না থেকে উপায় কি আছে, অনেক দিন পর ওর একজন প্রিয় বান্ধবী শায়লা ফোন করেছে। বলেছেÑঅভিবাদন। অ্যাই, ইনবক্সে আয়। কথা বলি। কাজ ছিলো না বলে পাশের ট্যাবে ইনবক্সে গিয়েই দেখলো, শায়লা বলছেÑআজ নাকি ওরও প্রমোশন হয়েছে। ওর বোন নায়লাও আইন পরীক্ষায় পাস করেছে। শায়লা বড় একটি টেলিভিশনের মার্কেটিং অফিসার হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছিলো। এখন এক ধাপ উপরে প্রমোশন হয়েছে।


কোনো এক অজানা কারণে নতুন নিয়োগ পাওয়া অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর দীর্ঘ দিন ধরে অফিসে অনুপস্থিত। এডিটরের মাথা গরম হয়ে আছে। যাকে তাকে বকাঝকা করছে। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের অনুপস্থিতির কারণে রিনভিকেই অঘোষিতভাবে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ বার্তাকক্ষে শোরগোল শুনতে পেল রিনভি। কি হলো ? টিভির দিকে তাকিয়ে দেখেÑপল্টনে নাকি পুলিশের সাথে মোল্লাÑমুন্সিদের ধাওয়াÑপাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ নিহত হয়েছে নাকি তা কোনো টিভি চ্যানেল দেখাচ্ছে না। শুধু বায়তুল মোকাররমের সামনে একটা ওভারব্রিজ থেকে মোল্লাÑমুন্সিদের দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে রিনভি দূরদর্শী একটা কাজ করেছে। অফিসের পারভীনকে আগেভাগেই মতিঝিলে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাতে সে সবকিছু সময়মতো জানাতে পারে। পারভীনকে ফোন করে রিনভি। ফোন নট রিচেবল। এই জরুরি মুহূর্তে ফোন বন্ধ কেন ? ইনফরমেশন না থাকলে নিউজ হবে কি করে ? আর নিউজ না হলে পত্রিকা চলবে কি করে ? আধা ঘণ্টা পর আবার ফোন করে। তখন পারভীন কল ব্যাক করে। এটা রিনভির ক্ষেত্রে সব সময়ই ও করে থাকে। কল ব্যাক করার পর সে জানায়, তাকে কয়েক জন মোল্লাÑমুন্সি ধাওয়া করেছিলো কিছুক্ষণ আগে। সে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মক আহত হয়। তার আরেক বন্ধু সাংবাদিক সোহাগ তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। রিনভি জিজ্ঞাসা করে, কয়টার দিকে হামলা করে তারা ? পারভীন জানায়, ঘণ্টাদুয়েক আগে। রিনভি ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়িতে বাজে বিকেল চারটা। তারপর সমবেদনা জানিয়ে নি¤œতন সহকর্মীদের দুঃখের সঙ্গে বললো, পারভীনের ওপর হামলা হয়েছে। সবাই বিস্মিত! কেমন করে। এও মানুষ করতে পারে। পারভীনের নাকি একটাই দোষÑসে মাথায় কাপড় দেয়নি।


পত্রিকায় আট কলামের হেডলাইন গেলÑসংবাদকর্মীর পেছনে ধাওয়া। এটা অবশ্য রিনভিরই দেয়া। তবে এতে অবশ্য ওর ক্রেডিটের কিছু নেই। রিপোর্টটা যেহেতু মালেক নামে এক সহকর্মী করেছে, তাই তারই ক্রেডিট। আর তা ছাড়া মালেক এডিটরের খুব কাছের লোক। তাই ওর এমন সাহসী রিপোর্ট দেখে এডিটর ওর বেতন দ্বিগুণ করে দিলো। অথচ রিনভি ওর উপরের পদে কাজ করে। হেডলাইনও তার দেয়া। কিন্তু ক্রেডিট মালেকের।
রিনভি পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে পারে না। সে মনে মনে চায়, রাশিয়ার লেনিন, স্তালিনের যুগ আবার ফিরে আসুক। আফগানের সাউর বিপ্লব এদেশেও হোক। তবু পুঁজি তোষণ আর তোষামদী প্রক্রিয়া থেকে প্রলেতারিয়েতরা মুক্তি পাক। বন্ধ হোক শ্রেণিশোষণ।
 


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট